যদিও সুর্যর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল, কিন্তু ছেচল্লিশ সালের মাঝামাঝি সে হঠাৎ মুক্তি পেয়ে গেল। বাংলার অ্যাসেমব্লিতে ‘জেল ডেলিভারির’র জন্য হট্টগোল চলছিল অনেক দিন ধরেই। বেয়াল্লিশের আন্দোলনের পর বাংলার জেলগুলিতে রাজবন্দিদের সংখ্যা সাড়ে তিন হাজার। সোহরাওয়ার্দি মুখ্যমন্ত্রী হবার পর অনেককেই ছেড়ে দিলেন–চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের মামলার অনেক বন্দিও এই সময় ছাড়া পান।
সূর্য বাড়িতে কোনও খবর পাঠায়নি, তার ধারণা ছিল সে একা বাড়ি ফিরে সবাইকে চমকে দেবে। তবু কী করে রটে যায়। সংবাদপত্রেও এই প্রসঙ্গের উল্লেখ ছিল। সূর্য যে ট্রেনে ফিরল, সেই ট্রেনেই আরও পঁচিশ-তিরিশ জন রয়েছেন। হাওড়া স্টেশনে বিপুল ভিড়, বহু লোক ফুলের মালা নিয়ে দাঁড়িয়ে। ট্রেন প্ল্যাটফর্মে থামতেই মুহুর্মুহু ‘বন্দে মাতরম’ ও ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ ধ্বনি উঠল–দৌড়োদৌড়ি, হুড়োহুড়ি পড়ে গেল চারদিকে। অনেক মা তাঁদের সন্তানকে বহু বছর বাদে দেখলেন, অনেক পিতা তাদের সন্তানদের ইহজীবনে আর দেখার আশা পরিত্যাগ করেছিলেন। অতিরিক্ত আবেগ ও আনন্দের সঙ্গে তাই চোখের জল মেশে।
সূর্যকে নিয়ে যাবার জন্য ছোটখাটো একটি দল এসেছে। বড়বাবু, চিররঞ্জন, হিমানী, সান্ত্বনা, বাদল এবং বাদলের তিন-চার জন বন্ধু। বাদলের জ্যাঠামশাইয়ের বাড়ি থেকে কেউ আসেনি। শ্রীলেখা কলকাতায় থাকলে বোধহয় যেমন করেই হোক আসত।
ট্রেনের দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল সূর্য। সে এখন বাইশ বছরের যুবক, মাথা-ভরতি ঝাকড়া ঝাকড়া চুল, দাড়ি-গোঁফ একবারও কামায়নি পর্যন্ত, লম্বায় সে বড়বাবুকেও ছাড়িয়ে গেছে। তার কাঁধে ঝোলানো একটা কাপড়ের ব্যাগ, হাতে একটা নতুন সুটকেস। ধুতি আর একটা টুইলের শার্ট পরে আছে।
গাড়ি থামতেই চিররঞ্জন এগিয়ে গিয়ে সূর্যকে জড়িয়ে ধরলেন। সূর্যর মুখে বিষণ্ণতা বা ক্লান্তির ছাপ নেই। তাকে বেশ উৎফুল্লই দেখাচ্ছে। সে নেমে এসে প্রথমে বাদলের মাকে বলল, কী মেজোমামিমা, কেমন আছেন? কী রে বাদল, সান্ত্বনা
হিমানী পা দুটোকে এমনভাবে জোড়া করে আছেন যে দেখলেই বোঝা যায় তিনি প্রণামের জন্য প্রতীক্ষা করছেন। কিন্তু প্রণাম করার কথা সূর্যর মনেই পড়ল না। সে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার শরীর ভালো আছে তো?
বড়বাবু স্মিতমুখে ঘাড় নাড়লেন।
বিষ্ণু আর রেণুকে সূর্য চিনতেই পারেনি। রেণুর হাতে একটা সাদা ফুলের মালা। সে লাজুক ভাবে এগিয়ে এসে মালাটা সূর্যকে পরিয়ে দিতে গেল। সূর্য প্রথমে দেখতে পায়নি, চমকে গিয়ে বলল, এ কী এ কী!
সূর্যর গলা পর্যন্ত রেণুর হাত পৌঁছোবে কেন? সে লাজুক মুখে হাত উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। চিররঞ্জন বললেন, দাও, দাও, মালাটা পরিয়ে দাও
কয়েক জন প্রায় জোর করেই সূর্যর মুখটা নিচু করে দিল, রেণু মালাটা পরিয়ে দিতেই বাদলের বন্ধু ভাস্কর চেঁচিয়ে উঠল, ইনকিলাব–
বহু অচেনা লোক স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে চেঁচিয়ে উঠল–জিন্দাবাদ।
সেই রকম ভাবেই চলল, বন্দে মাতরম, ভারত মাতা কি জয়!
সূর্যকে ঘিরে রীতিমতন একটি ভিড়। অস্বস্তি ও লজ্জায় সূর্য মুখ তুলতে পারছে না, মালাটা খুলে নিয়ে সান্ত্বনার হাতে দিয়েছে। নানা জনের নানা প্রশ্ন। চিররঞ্জন বলল, আরে বাড়িতে চল, ছেলেটাকে আগে একটু বিশ্রাম নিতে দে–।
রণক্ষেত্র থেকে বীর সৈনিকের প্রত্যাবর্তনের মতন একটা দৃশ্য।
বড়বাবু ভাবছেন, মেদিনীপুরের স্টেশনে কয়েক বছর আগেকার সেই দৃশ্যের সঙ্গে আজকে হাওড়া স্টেশনের এই দৃশ্যের কত তফাত। সূর্য আজ সুস্থ সবল শরীরে ফিরে এসেছে। সেদিন তিনি ভেবেছিলেন, সূর্যর সঙ্গে আর দেখাই হবে না। তিনি সূর্যর পিঠে হাত রেখে বললেন, আসবার পথে কোনও কষ্ট হয়নি তো?
সূর্য বলল, না। শোওয়ার জায়গা পেয়েছিলাম।
স্টেশনের বাইরেও কিছু লোক ওদের ঘিরে থাকে। সূর্য আজ অনেকেরই দ্রষ্টব্য। কেউ কেউ এমনি ভিড় দেখে হঠাৎ তার মধ্যে ঢুকে পড়ে জিজ্ঞেস করে, দাদা কী হয়েছে! কী করেছে? ইনি কে?
বাদল সগর্বে উত্তর দেয়, আমার দাদা। একজন বিপ্লবী।
বড়বাবু দুখানা ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করলেন। হইহল্লা করতে করতে আসা হল বিবেকানন্দ রোডের বাড়িতে। অনেক পাড়াপ্রতিবেশী উঁকিঝুঁকি দিতে এল।
এবং বিকেলের মধ্যেই সকলের সব কৌতূহলের নিবৃত্তি হয়ে গেল। তারপর থেকে সূর্য এই শহরের যে-কোনও একজন সাধারণ মানুষের মতন।
জমিয়ে গল্প বলার দক্ষতাও নেই সূর্যর। তার পলাতক জীবন ও কারাবাস সম্পর্কে ছেলের দল অসংখ্য প্রশ্ন করে-সূর্য মাত্র দু’-একটা বাক্যে তার উত্তর সেরে দেয়। সকলেই তাকে ভাবছে এক রোমাঞ্চকর ঘটনার নায়ক, অথচ নায়কটির আত্মগরিমা প্রচারের কোনও আগ্রহ নেই। সূর্যর সুটকেস খোলার পর তার থেকে যখন দুটো কাঁচা পাতিলেবু বেরোল–তখন সবাই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, এ-দুটো এনেছ কেন? সূর্য শুধু উত্তর দিল, জেলখানার স্মৃতি। তারপর লেবু দুটো নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ শুকতে লাগল।
দুপুরবেলা বড়বাবুর বাড়িতেই সকলের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা। চিররঞ্জন-হিমানী অনেক দিন বাদে এ বাড়িতে এলেন। এত বড় বাড়িটা কঁকা পড়ে আছে। বড়বাবু এক বার চিররঞ্জনকে বললেন, চিরু, তোমরা এসে আবার এ বাড়িতে থাকো। ছেলেটার একটু যত্নআত্যি করার দরকার, তোমরা যদি একটু দেখাশুনো না করো–
চিররঞ্জন বললেন, দাদাকে বলে দেখি–
সূর্যর ঘরখানা বড়বাবু পরিষ্কার করিয়ে রেখেছেন। সূর্যর জিনিসপত্র সব আগেকার জায়গায় ঠিকঠাক সাজানো রয়েছে। শুধু আলনায় তার যে পুরনো শার্টগুলো ঝুলছে– সেগুলো এখন আর তার গায়ে লাগবে না।
সূর্য ঘরে প্রথম পা দিয়ে থমকে দাঁড়াল। হঠাৎ তার মনে হল টেবিলটার পাশে শ্রীলেখা দাঁড়িয়ে আছে–নীল শাড়ি পরা, হাতে একটা চিরুনি। সূর্য শ্রীলেখার চিঠির উত্তর দেয়নি–সেই কথা মনে পড়ল। মুখ ফিরিয়ে বাদলকে জিজ্ঞেস করল, শ্রীলেখা কেমন আছে রে?
সে-দিনটা ছিল বাইশে শ্রাবণ। বাদলরা সব বন্ধু মিলে ভাস্করদের পাড়ায় রবীন্দ্র স্মরণসভার আয়োজন করেছে। দুপুর থেকেই তারা ছটফট করছে সেখানে যাবার জন্য। এবং সূর্যকেও নিয়ে যেতে হবে। সূর্যকে কোনও কিছু না বলেই ওরা তাকে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি করে ফেলেছে। দেওয়ালে দেওয়ালে এর মধ্যেই পোস্টার লাগানো হয়ে গেছে, প্রধান অতিথি: নির্যাতিত রাজবন্দি সূর্যকুমার ভাদুড়ী।
সূর্য সেই অনুষ্ঠানের কথা শুনে আকাশ থেকে পড়ল। এক কথায় উড়িয়ে দিয়ে বলল, যা যাঃ, আমি ও-সব মিটিং ফিটিংয়ে যাই না।
তখন চলল ঝুলোঝালির পালা। সূর্যকে না নিয়ে যেতে পারলে বাদলের সম্মান থাকে না বন্ধুদের কাছে। সূর্য কিছুতেই যাবে না। চিররঞ্জনও বললেন, ছেলেটাকে তোরা একটু বিশ্রাম নিতে দে। আজই কেন বাইরে নিয়ে যেতে চাইছিস।
শেষ পর্যন্ত বাদল তার মাকে আর দিদিকে ধরল সূর্যকে রাজি করাবার জন্য। সূর্যর চরিত্র সম্পর্কে বাদল এইটুকু অন্তত বুঝেছে সে মেয়েদের মুখের ওপর কোনও কঠিন কথা সাধারণত বলে না। মেয়েদের সে সম্মান দেয়।
শেষ পর্যন্ত সূর্যকে যেতেই হল। পরিচিত রাস্তাগুলি দিয়ে সূর্য অনেক দিন পরে হাঁটছে। এই রাস্তা দিয়েই বাদল একদিন সূর্যকে বিষ্ণুদের বাড়িতে নিয়ে এসেছিল। হাতিবাগান বাজারের কাছে এসে সূর্য জিজ্ঞেস করল, বাদল, তোর মনে আছে? বাদলের মনে নেই। সে বলল, কী সূর্যদা?
এই যে, ঠিক এইখানে একদিন একটা মিছিল আসবার সময় পুলিশ তোকে আর আমাকে মেরেছিল?
বাদল বলল, ও হ্যাঁ, হ্যাঁ। একটা লালমুখো সার্জেন্ট!
কী রকম ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল?
এই কথা বলার সময় সূর্য হাসছে। তিক্ততা বা ক্রোধের চিহ্নমাত্র নেই। এটাও যেন একটা মধুর স্মৃতি।
সেই জায়গাটা দিয়ে এখন অনবরত লোকজন যাচ্ছে আসছে, কাছেই ফুটপাতে সামগ্রী বিছিয়ে বসে আছে একজন ফেরিওয়ালা। সেদিনের সেই দুটি অপমানিত বালকের মুখচ্ছবি এখন কোথাও নেই। জীবন থেমে থাকে না কোথাও।
ভাস্করদের বাড়ির কাছেই রাস্তার ওপর প্যান্ডেল বাঁধা হয়েছে। অনুষ্ঠান শুরু হবার কথা সাড়ে পাঁচটায়–কিন্তু উদ্বোধন সংগীত যিনি গাইবেন, তিনি এখনও এসে পৌঁছোননি বলে আরম্ভ করতে একটু দেরি হচ্ছে। সভাপতি এসে গেছেন এরই মধ্যে সভাপতি উদীয়মান কথা সাহিত্যিক তাপস সিংহ রায়। তিনি এখন ভাস্করদের বৈঠকখানায় বসে সিগারেট টানছেন।
সূর্যকে সেখানে এনে বসানো হল। বাদল অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল, তাপসদা, ইনি আমার দাদা, জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আজই এসেছেন।
তাপস সিংহ রায়ের হাতে একটা বই ধরা ছিল। তিনি শুকনো ভাবে বললেন, নমস্কার। তারপর আবার বইয়ের পাতায় মনোনিবেশ করলেন।
তাপস সিংহ রায়ের এই নিরুত্তাপ ব্যবহার দেখে বাদল একটু দমে গেল। সে আশা করেছিল, তার কীর্তিমান দাদার কথা শুনে যে-কেউ লাফিয়ে উঠবে, বিস্ফারিত চোখে বলবে, ও আপনিই সেই!
তাপস সিংহ রায়ের মতন লেখকরা তখনও বাদলের চোখে দেবতার সমান। যে-কোনও ম্যাগাজিন খুললেই যাঁর লেখা দেখতে পাওয়া যায়–তার মতন কীর্তিমান আর কে আছে। অবশ্য সূর্যও কম কিছু নয়।
বাদল আবার বলল, আমার দাদা সেই ফরটি টু থেকে জেলে ছিলেন। মহাত্মা গান্ধী পর্যন্ত ওঁদের ছাড়াবার জন্য চেষ্টা করেছিলেন।
তাপস সিংহ রায়ের মতন লোকেরা নিজেরাই অপরের দ্বারা অভিনন্দিত হতে চায়। কোনও জায়গাতেই নিজের থেকে অপরকে বেশি উল্লেখযোগ্য হিসেবে মনে করা পছন্দ করে না। তিনি একটু বিরক্ত ভাবেই বললেন, তোমাদের আরম্ভ হতে আর কত দেরি?
বাদল কোনওক্রমে একটা উত্তর দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পর তাপস সিংহ রায় সূর্যর দিকে নিজের সিগারেটের প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, চলবে?
সূর্য বলল, আমি খাই না।
তাপস সিংহ রায় আগের সিগারেট থেকেই নতুন একটা ধরালেন। একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, এইসব মিটিং কিছুতেই টাইমলি আরম্ভ করতে পারে না। আমাকে আবার আর এক জায়গায় যেতে হবে। আপনি নজরুলের কিছু খবর, জানেন?
সূর্য বলল, নজরুল ইসলামের কথা বলছেন? কী হয়েছে তার?
শুনছি তো শরীর অসুস্থ। কাল প্রেমেনদার বাড়িতে গিয়েছিলেন। প্রেমেনদা বললেন–
প্রেমেনদা কে?
তাপস সিংহ রায় একটু অবাক হয়ে বললেন, প্রেমেন্দ্র মিত্র। এই নাম কি দ্বিতীয় কারওর আছে?
সূর্যর মুখ দেখেই বোঝা গেল সে এই নামের সঙ্গে পরিচিত নয়। সে চুপ করে গেল।
তাপস সিংহ রায় কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করলেন, আপনি পাক পড়েননি? কিংবা পুতুল ও প্রতিমা?
সূর্য নম্র ভাবে বলল, আমি বাংলা বই বিশেষ পড়িনি।
তাপস সিংহ রায় হঠাৎ উৎকট ভাবে গম্ভীর হয়ে গিয়ে নিজের হাতের বইখানাতে আবার মনোনিবেশ করলেন। এই হামবাগটা প্রেমেন্দ্র মিত্রেরই লেখা যদি না পড়ে থাকে, তা হলে তাপস সিংহ রায়ের লেখাও নিশ্চয়ই পড়েনি। একে তা হলে এই সভায় এনেছে কেন? তাপস সিংহ রায় সেই জাতীয় লেখক যাঁরা মনে করেন যে-লোক তার লেখা পড়েনি–সে মানুষ হিসেবে গণ্য করার মতন কিছু নয়।
লোকটির ভাবভঙ্গি দেখে সূর্যর একটু মজা লাগল। তার কারাবাস বিষয়ে তার মনে কোনও ভুল ধারণা নেই কিন্তু সে কথা এই লোকটির মনে বিন্দুমাত্র রেখাপাত করল না–এটা একটু আশ্চর্য হবারই মতন। এই কথা শুনে সকলেই কিছু না কিছু প্রশ্ন করে।
তাপস সিংহ রায় সূর্যর চেয়ে বছর দশেকের বড়। রোগা পাতলা চেহারা, ঠোঁট দুটো কালচে, চোখের নীচেও ঘন কালো দাগ। একমাথা চুল, চুলগুলো মাঝে মাঝে কপালে এসে পড়ছে, উনি এক হাত দিয়ে সরাচ্ছেন। এটা প্রায় ওঁর মুদ্রাদোষের মতন। এ ছাড়া, একটু নার্ভাস ধরনের মানুষ শান্ত হয়ে বসে থাকতে পারেন না, অনবরত হাঁটু দোলাচ্ছেন, সিগারেটের প্যাকেটটা ক্ষণে ক্ষণে হারাচ্ছেন আর খুঁজে পাচ্ছেন এবং একটার পর একটা সিগারেট খেয়ে যাচ্ছেন। একবার যখন তিনি চোখ থেকে চশমা খুলে তাকালেন, তখন মনে হল, তিনি কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না।
সূর্য ঠিক মিশুকে প্রকৃতির নয়–তবু এই লোকটির সম্পর্কে তার আরও কিছু জানতে ইচ্ছে করছিল কিন্তু কী ভাবে কথা শুরু করবে, ভেবে পেল না।
একটু বাদেই সভা শুরু হল। সমুখে শান্তি পারাবার’ দিয়ে উদ্বোধন। এরপর গানের পর গান, আবৃত্তি, বক্তৃতা, একটি ছেলে আর মেয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে পুরো কর্ণ কুন্তী সংবাদ’ শোনাল। সূর্যর বেশ ভালোই লাগছে। সবকিছুই যেন তার কাছে নতুন। জেলে থাকতেও আন্ডার ট্রায়াল প্রিজনাররা মাঝে মাঝে গানবাজনার আসর বসিয়েছে–কিন্তু তার সঙ্গে এর কোনওই মিল নেই। অধিকাংশ কম বয়সি ছেলে-মেয়ে, তাদের ভয়, লজ্জা ও অহংকার মিশ্রিত মুখ। রেণু আবৃত্তি করল, নিঝরের স্বপ্নভঙ্গ পরিষ্কার উচ্চারণ, রিনরিনে কণ্ঠস্বর। বাদল শোনাল রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার প্যারোডি, ভগবান তুমি যুগে যুগে ভূত পাঠায়েছ বারে বারে’ ইত্যাদি। লোকেরা খুব হাসল।
সভাপতির জরুরি কাজ আছে বলে তিনি প্রধান অতিথির আগেই ভাষণ দিয়ে ফেললেন। খুব জোরালো বক্তৃতা দিলেন তিনি। তিনি বললেন, রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুদিনে এ-ধরনের অনুষ্ঠান করার কোনও সার্থকতা নেই, জন্মদিনটাই পালন করা উচিত। মৃত্যুদিনে শোকের ভাবগাম্ভীর্য মোটেই বজায় থাকে না–লোকে আনন্দ করে, ভালো লাগলে হাততালি দেয়। এবং রবীন্দ্রনাথকে ভালোভাবে শ্রদ্ধা জানাতে গেলে রবীন্দ্রোত্তর সাহিত্যকেও জানতে হবে–কেন না একই নদীর প্রবাহ ইত্যাদি। রবীন্দ্রোত্তর সাহিত্যকে যারা রবীন্দ্র-ধুত্তোর সাহিত্য বলে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করে তারা যে আসলে কত মূর্খ ইত্যাদি। এবং অত্যন্ত অপ্রাসঙ্গিক ভাবে তিনি শনিবারের চিঠি পত্রিকাটিকে গালাগালি করতে লাগলেন।
সভাপতির বক্তৃতার সময়েই সূর্য চুপি চুপি সরে পড়বার চেষ্টা করেছিল–কিন্তু বাদলের বন্ধুরা স্টেজের বাইরে সতর্ক পাহারায় রয়েছে। সূর্য এখানে আসবার আগে বাদলকে দিয়ে কড়ার করিয়ে নিয়েছিল যে, সে কোনও বক্তৃতা দিতে পারবে না। স্টেজেও বসবে না। কিন্তু এখন তার কোনও কথাই খাটছে না। তাকে জোর করে স্টেজে বসানো হয়েছে এবং নানা অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে তার গুণপনার বর্ণনা দিয়ে তার বক্তৃতার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। সূর্য কী করে পালাবে বুঝতে পারছে না।
একসময় তাকে মাইকের সামনে দাঁড়াতেই হল। সে অনুভব করল, তার পা কাঁপছে। সে হাজার হাজার জনতার সঙ্গে একসঙ্গে দৌড়েছে, পুলিশের সঙ্গে লড়াই করতেও ভয় পায়নি–অথচ এখানে এই শ’ দু’-এক নারী-পুরুষের সামনে দাঁড়িয়ে ভয়ে তার গলা শুকিয়ে আসছে।
সে হাত জোড় করে বলল, আমার বলার কোনও ক্ষমতা নেই। আমাকে ক্ষমা করুন।
শ্রোতারা চেঁচিয়ে বলল, যা হয় একটু কিছু বলুন।
সূর্য বলল, রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আমি বিশেষ কিছু জানি না।
একজন লোক উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আপনি জেলখানার অভিজ্ঞতার কথা বলুন। বাদলের বন্ধুরাও চিৎকার করে উঠল, হা, হা, জেলখানার অভিজ্ঞতা শুনতে চাই।
সূর্য মাইকের সামনে একটুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, আমার কিছু মনে পড়ছে না। আমার জেলখানার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলার মতনও কিছু নেই–হাজার হাজার লোক জেল খাটছে–এর মধ্যে নতুনত্ব কী আছে?
বলুন, তবু কিছু বলুন
সূর্য লোকজনের মুখের দিকে না তাকিয়ে দূরের দিকে চোখ রাখল। তারপর বলল, আমার শুধু মনে পড়ছে কয়েক জন মানুষের কথা। আমার গুরু যিনি ছিলেন–তার নাম হরকুমার ভট্টাচার্য তিনি বেশ কয়েক বছর পুলিশের নজর এড়িয়ে পালিয়ে পালিয়ে ছিলেন। শেষকালে তার টি. বি. হয়। বেলেঘাটায় বস্তির মধ্যে লুকিয়ে থেকে তিনি বিনা। চিকিৎসায় মারা যান। দেশের কাজের জন্য তিনি প্রাণ দিয়েছেন–কিন্তু তাঁর নামও এখন কেউ জানে না।…আর একজন, ব্রজগোপাল মিত্র-বেয়াল্লিশের আন্দোলনে তিনিই আমাদের টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন ঝাড়গ্রামের কাছে পুলিশ তাকে লাঠিপেটা করে। মারে, মুখের ওপর বুট জুতো দিয়ে…আরও একজন, তার কথাই আমার বেশি মনে পড়ছে–যোগানন্দদা, আমরা অনেক দিন একসঙ্গে ছিলাম–খড়্গপুরে যখন আমরা দু’ জনে একসঙ্গে পালাচ্ছিলাম, যোগানন্দদা আমার থেকে মাত্র তিন-চার হাত দূরে–
একটু থেমে ঢোক গিলে সূর্য আবার বলল, উনি রাস্তার ওপরেই গুলি খেয়ে পড়ে সঙ্গে সঙ্গে মারা যান। আমি ওঁকে কোনও সাহায্যও করতে পারিনি, এঁদের জন্য কি কোনও দিন কোনও সভাট হবে? জানি না, এঁদের নামও কেউ মনে রাখবে কিনা—