2 of 2

৫৫. মেজর জিয়া

মেজর জিয়া যখন দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন
হানাদার খান সেনারা তখন তার পরিবার পরিজনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল

॥ মনজুর আহমদ প্রদত্ত ॥

বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের বীর নায়ক মেজর (বর্তমানে কর্নেল) জিয়া যখন হানাদার পাক-বাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্ৰ প্ৰতিরোধ গড়ে তুলে তাদেরকে নাজেহাল করে তুলছিলেন, তখন তার প্রতি আক্রোশ মেটাবার ঘূণ্য পন্থী হিসেবে খান সেনারা নৃশংসভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তার আত্মীয়া স্বজন পরিবার-পরিজনদেব ওপর।

তাদের এই প্ৰতিহিংসার লালসা থেকে রেহাই পান নি কর্নেল জিয়ার ভায়রা শিল্পোন্নয়ন সংস্থার সিনিয়র কো-অর্ডিনেশন অফিসার জনাব মোজাম্মেল হক।

চট্টগ্রাম শহর শক্ৰ কবলিত হবার পর বেগম খালেদা জিয়া যখন বোরখার আবরণে আত্মগোপন করে চট্টগ্রাম থেকে স্টিমারে পালিয়ে নারায়ণগঞ্জে এসে পৌঁছেন, তখন জনাব মোজাম্মেল হকই তাকে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। সেদিন ছিল ১৬ই মে। ঢাকা শহরে কারফিউ। নারায়ণগঞ্জেও সন্ধ্যা থেকে কারফিউ জারি করা হয়েছিল। এরই মধ্যে তিনি তার গাড়িতে রেডক্রস ছাপ এঁকে ছুটে গিয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জ টার্মিনালে।

বেগম জিয়াকে নিয়ে আসার দিন দশেক পর ২৬শে মে শিল্পোন্নয়ন সংস্থায় হক নাম সংবলিত যত অফিসার আছেন সবাইকে ডেকে পাক সেনারা কর্নেল জিয়ার সঙ্গে কারোর কোনো আত্মীয়তা আছে কিনা জানতে চায়। জনাব মোজাম্মেল হক বুঝতে পারলেন বিপদ ঘনিয়ে আসছে। তিনি সেখানে কর্নেল জিয়ার সাথে তাঁর আত্মীয়তার কথা গোপন করে অসুস্থতার অজুহাতে বাসায় ফিরে আসেন এবং অবিলম্বে বেগম জিয়াকে তার বাসা থেকে সরাবার ব্যবস্থা করতে থাকেন।

কিন্তু উপযুক্ত কোনো স্থান না পেয়ে শেষপর্যন্ত ২৮শে মে তিনি তাকে ধানমণ্ডিতে তার এক মামার বাসায় কয়েক দিনের জন্য রেখে আসেন এবং সেখান থেকে ৩রা জুন তাকে আবার জিওলজিক্যাল সার্ভের এসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর জনাব মুজিবুর রহমানের বাসা এবং এরও কদিন পরে জিওলজিক্যাল সার্ভের ডেপুটি ডিরেক্টর জনাব এস কে আব্দুল্লাহর বাসায় স্থানান্তরিত করা হয়।

এরই মধ্যে ১৩ই জুন তারিখে পাক বাহিনীর লোকেরা এসে হানা দেয় জনাব মোজাম্মেল হকের বাড়িতে। জনৈক কর্নেল খান এই হানাদার দলের নেতৃত্ব করছিল। কর্নেল খান বেগম জিয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং জানায় যে, এই বাড়িতে তারা বেগম জিয়াকে দেখেছে। জনাব হকের কাছ থেকে কোনো সদুত্তর না পেয়ে তার দশ বছরের ছেলে ডনকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ডন কর্নেল খানকে পরিষ্কারভাবে জানায় যে, গত তিন বছরে সে তার খালাকে দেখে নি।

সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হলে খান সেনারা তার বাড়ি তল্লাশী করে। কিন্তু বেগম জিয়াকে সেখানে না পেয়ে হতোদ্যম হয়ে ফিরে যায়। যাবার আগে জানিয়ে যায়, সত্যি কথা না বললে আপনাকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হবে।

এরপরই জনাব হক বুঝতে পারেন সর্বক্ষণ তাকে অনুসরণ করা হচ্ছে। যেখানেই যান। সেখানেই তার পেছনে লেগে থাকে। ফেউ। এই অবস্থায় তিনি মায়ের অসুখের নাম করে ছুটি নেন। অফিস থেকে এবং সপরিবারে ঢাকা ছেড়ে যাবার ব্যবস্থা করতে *यकिक।

ব্যবস্থা অনুযায়ী ১লা জুলাই গাড়ি গ্যারেজে রেখে পেছন দরজা দিয়ে বেরিয়ে তারা দুটি অটোরিকশায় গিয়ে ওঠেন। উদ্দেশ্য ছিল ধানমণ্ডিতে বেগম জিয়ার মামার বাসায় গিয়ে আপাতত ওঠা। কিন্তু সায়েন্স ল্যাবরেটরি পর্যন্ত আসতেই একটি অটোরিকশা তাদের বিকল হয়ে যায়। এই অবস্থায় তারা কাছেই গ্ৰীনরোডে এক বন্ধুর বাসায় গিয়ে ওঠেন। কিন্তু এখানে তাদের জন্যে অপেক্ষা করছিল এক বিরাট বিস্ময়। জনাব হক এখানে গিয়ে উঠতেই তাঁর এই বিশিষ্ট বন্ধুর স্ত্রী তাঁকে জানান যে, কর্নেল জিয়ার লেখা চিঠি তাদের হাতে এসেছে। চিঠিটা জনাব হককেই লেখা এবং এটি তার কাছে পাঠাবার জন্যে কয়েকদিন ধরেই তাকে খোঁজ করা হচ্ছে।

তার কাছে লেখা কর্নেল জিয়ার চিঠি এ বাড়িতে কেমন করে এলো তা বুঝতে না পেরে তিনি যারপরনাই বিস্মিত হন এবং চিঠিটা দেখতে চান। তাঁর বন্ধুর ছেলে চিঠিটা বের করে দেখায়। এটি সত্যই কর্নেল জিয়ার লেখা কিনা বেগম জিয়াকে দিয়ে তা পরীক্ষা করিয়ে নেবার জন্যে তিনি তাঁর বন্ধুর ছেলের হাতে দিয়েই এটি জিওলজিক্যাল সার্ভের জনাব মুজিবর রহমানের কাছে পাঠান।

এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায় জনাব হক তাঁর এই বন্ধুর বাসায় রাতের মতো আশ্রয় চান। তাদেরকে আরো নিরাপদ স্থানে রাখার আশ্বাস দিয়ে রাতে তাদেরকে পাঠানো হয় সূত্রপুরের একটি ছোট্ট বাড়িতে। তাঁর বন্ধুর ছেলেই তাদেরকে গাড়িতে করে এই বাড়িতে নিয়ে আসে। এখানে ছোট্ট একটি ঘরে তারা আশ্রয় করে নেন।

কিন্তু পরদিনই তারা দেখতে পেলেন পাক-বাহিনীর লোকেরা বাড়িটি ঘিরে ফেলেছে। জনা দশেক সশস্ত্র জওয়ান বাড়িটার সামনে দাড়িয়ে। এই দলের প্রধান ছিল ক্যাপ্টেন সাজ্জাদ আর ক্যাপ্টেন আরিফ। তারা ভেতরে ঢুকে কর্নেল জিয়া ও বেগম জিয়া সম্পর্কে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। জনাব হক ও তার স্ত্রী জিয়ার্থ সাথে তাদের সম্পর্কের কথা অস্বীকার করে যান। কিন্তু ক্যাপ্টেন সাজ্জাদ জনাব ও বেগম হকের সাথে তোলা বেগম জিয়ার একটি গ্রুপ ছবি বের করে দেখালে তারা জিয়ার সাথে সম্পর্কের কথা স্বীকার করেন। তবে তারা জানান কর্নেল ও বেগম জিয়া কোথায় আছেন তা তারা জানেন না।

এই পর্যায়ে বিকেল পাঁচটার দিকে জনাব হক ও তার স্ত্রীকে সামরিক বাহিনীর একটি গাড়িতে তুলে মালিবাগের মোড়ে আনা হয় এবং এখানে মৌচাক মার্কেটের সামনে তাদেরকে সন্ধ্যে পর্যন্ত গাড়িতে বসিয়ে রাখা হয়। এখানেই তাদেরকে জানান হয় যে বেগম জিয়াকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এরপর তাদেরকে দ্বিতীয় রাজধানী এলাকা ঘুরিয়ে আবার সুত্রাপুরের বাসায় এনে ছেড়ে দেয়া হয়। এখান থেকে রাতে তারা গ্রীনরোডে জনাব হকের বন্ধুর বাসায় আসেন এবং সেখান থেকে ফিরে আসেন খিলগাঁয়ে তার নিজের বাসায়।

উল্লেখযোগ্য যে এই দিনই জনাব এস কে আব্দুল্লাহর সিদ্ধেশ্বরীর বাসা থেকে বেগম জিয়া ও জনাব আব্দুল্লাহকে এবং একই সাথে জনাব মুজিবর রহমানকেও পাক-বাহিনী গ্রেফতার করে। এবং ৫ই জুলাই তারিখে জনাব মোজাম্মেল হক অফিসে কাজে যোগ দিলে সেই অফিস থেকেই ক্যাপ্টেন সাজাদ তাকে গ্রেফতার করে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়।

ক্যান্টনমেন্টে তাঁকে এফ আই ইউ (ফিল্ড ইনভেস্টিগেশন ইউনিট) অফিসে রাত দশটা পর্যন্ত বসিয়ে রাখা হয় এবং দশটায় তাকে স্কুল রোডের সেলে নিয়ে যাওয়া হয়।

সেলে প্রবেশের আগে তাঁর ঘড়ি, আংটি খুলে নেয়া হয় এবং মানিব্যাগটিও নিয়ে নেয়া হয়। সারাদিন অভুক্ত থাকা সত্ত্বেও তাকে কিছুই খেতে দেয়া হয় নি।

পরদিন সকালে তাকে এক কাপ মাত্র ঠাণ্ডা। চা খাইয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ক্যাপ্টেন সাজাদের অফিসে। সাজ্জাদ তাঁর কাছে তাঁর পরিকল্পনার কথা জানতে চায়। তিনি তাঁর কোনো পরিকল্পনার কথা অস্বীকার করেন। ক্যাপ্টেন সাজাদ। এতে তাকে মিথ্যাবাদী বলে অভিহিত করে এবং শাস্তি হিসেবে তাকে বৈদ্যুতিক শক দেবার হুমকি দেখায়। কিন্তু এরপরও কোনো কথা আদায় করতে না পেরে ক্যাপ্টেন সাজ্জাদ তাঁকে হাজার ওয়াটের উজ্জ্বল আলোর নিচে শুইয়ে রাখার হুকুম দেয়।

হুকুম মতো রাতে তাকে তাঁর সেলে চিৎ করে শুইয়ে মাত্র হাত দেড়েক ওপরে ঝুলিয়ে দেয় পাঁচশ পাওয়ারের দুটি অত্যুজ্জ্বল বান্ধ। প্ৰায় চারঘণ্টা অসহ্য যন্ত্রণা তাকে ভোগ করতে হয়।

পরদিন আবার তাকে ক্যাপ্টেন সাজাদের কাছে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সাজাদ। আবার তার পরিকল্পনার কথা জানতে চায়। জানতে চায় শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে তার কী কী কথা হয়েছে, তিনি ভারতে চলে যাবার পরিকল্পনা বকরেছিলেন। কিনা। জনাব হক এসব কিছুই অস্বীকার করলে ক্যাপ্টেন সাজাদ তার ঘাড়ে প্ৰচণ্ড আঘাত হানে। এরপর তার সেলে চব্বিশ ঘণ্টা হাজার ওয়াটের বাতি জ্বলিয়ে রাখার হুকুম দেয়।

বেলা একটায় তাকে সেলে এনেই বাতি জ্বালিয়ে দেয়া হয়। ঘণ্টা কয়েক পরেই তিনি অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার করতে থাকেন। চিৎকার করে তিনি একটি কথাই বলতে থাকেন–আমাকে একবারেই মেরে ফেল। এভাবে তিলে তিলে মেরো না।

তিনি যখন অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার করছিলেন, তখন তাঁর দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল একজন পাঠান হাবিলদার। তার এই করুণ আর্তি বোধ হয় হাবিলদারটি সইতে পারে নি। তারও হৃদয় বোধহয় বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছিল মানুষের ওপর মানুষের এই নিষ্ঠুর জুলুম দেখে। আর তাই বোধহয় সে সেন্ট্রিকে ডেকে হুকুম দিয়েছিল বাতি নিভিয়ে দিতে। বলেছিল, কোনো জীপ আসার শব্দ পেলেই যেন বাতি জ্বালিয়ে দেয়, আবার জীপটি চলে যাবার সাথে সাথেই যেন বাতি নিভিয়ে দেয়া হয়।

এরপর ক্যাপ্টেন সাজাদ তাকে আরো কয়েকদিন জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং নতুন ধরনের নির্যাতন চালায়। তার কাছ থেকে সারাদিন ধরে একটির পর একটি বিবৃতি লিখিয়ে নেয়া হয় এবং তার সামনেই সেগুলি ছিঁড়ে ফেলে আবার তাকে সেগুলি লিখতে বলা হয়। এবং যথারীতি আবার তা ছিঁড়ে ফেলে আবার সেই একই বিবৃতি তাকে লিখতে বলা হয়। এবং আবার তা ছিঁড়ে ফেলা হয়। এই অবস্থায় ক্লান্তি ও অবসন্নতায় তিনি লেখার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেন। এদিকে হাজার ওয়াটের উজ্জ্বল আলোর নিচে থাকার ফলে তিনি দৃষ্টিশক্তিও প্রায় হারিয়ে ফেলেন। দিন ও রাতের মধ্যে কোনো পার্থক্যই বুঝতে পারতেন না।

২৬শে জুলাই বিকেলে তাকে ইন্টার স্টেটসস্ক্রিনীং কমিটির (আই এস এস সি) ছাউনিতে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে একটি ছোট্ট কামরায় তাবা মোট ১১০ জন আটক ছিলেন। বিকেল পাঁচটার দিকে তাঁকে বের করে রান্নাঘরের বড় বড় পানির ড্রাম ভরার কাজ দেয়া হয়। এই কাজে আরো একজনকে তার সাথে লাগানো হয়। তিনি হচ্ছেন, জিওলজিক্যাল সার্ভের জনাব এস কে আব্দুল্লাহ। তাঁরা দুজনে প্ৰায় পেয়া মাইল দূরের ট্যাপ থেকে বড় বড় বালতিতে করে পানি টেনে তিনটি বড় ড্রাম ভরে দেন। রাতে লাইন করে দাঁড় করিয়ে তাঁদেরকে একজন একজন করে খাবার দেয়া হয়। এতদিন পরে এই প্ৰথম তিনি খেতে পান। গরম ভাত ও গরম ডাল।

পরদিন সকালে তার এবং তৃণরো অনেকের মাথার চুল সম্পূর্ণ কামিয়ে দেয়া হয়।

এখানে বিভিন্ন কামরায় তাকে কয়েকদিন আটকে রাখার পর ৬ই আগস্ট নিয়ে যাওয়া হয়। ফিন্ড ইনভেস্টিগেশন সেন্টারে (এফ আই সি)। মেজর ফারুকী ছিল এই কেন্দ্রের প্রধান এবং এখানে সকলের ওপর নির্যাতন করার দায়িত্বে নিযুক্ত ছিল সুবেদার মেজর নিয়াজী। ফারুকী এখানে তাকে আবার জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং তাকে বিবৃতি দিতে বলে। কিন্তু বিবৃতি লেখানোর নাম করে সেই পুরনো নির্যাতন আবার শুরু হয়। একটানা তিনদিন ধরে তিনি একই বিবৃতি একের পর এক লিখে গেছেন এবং তাঁর সামনে তা ছিঁড়ে ফেলে আবার এই একই বিবৃতি তাঁকে লিখতে বলা হয়েছে।

৯ই আগষ্ট তাঁকে দ্বিতীয় রাজধানীতে স্থানান্তরিত করা হয় এবং এখানে বিভিন্ন কক্ষে তাঁকে প্ৰায় দেড়মাস আটক রাখার পর ২১শে সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। সেখান থেকে ৩০শে অক্টোবর তিনি মুক্তি পান।

ইতিমধ্যে রাজাকাররা তিন দফা তাঁর বাড়িতে হামলা চালিয়ে সর্বস্ব লুটপাট করে নিয়ে যায়। সর্বশেষ গত ১৩ই ডিসেম্বর তারা তার গাড়িটিও নিয়ে যায়।

————–

সূত্র : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ
দলিলপত্র : ৮ম খণ্ড (পৃষ্ঠা : ৪৭৬)
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, তথ্য মন্ত্রণালয়

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *