বাতাসে স্পষ্ট একটা পরিবর্তনের গন্ধ পাওয়া যায়। পথ দিয়ে চলতে চলতে কেমন যেন হালকা হালকা লাগে। ছ-সাত বছর আগের দেখা কলকাতার সঙ্গে এখনকার এই কলকাতার যেন অনেক তফাত। বাইরের চেহারাটা তো কিছু কিছু বদলে গেছে বটেই, মানুষজনও যেন অন্যরকম।
।এই পরিবর্তনের কারণ কি এক শতাব্দীর অবসান, নতুন শতাব্দীর শুরু? সেই একত্রিশে ডিসেম্বর ভরত পাটনায় ছিল। কলকাতার সঙ্গে পাটনার তুলনা চলে না। সেখানে ইংরেজের সংখ্যা অনেক কম, তবু সেখানেও উৎসবের আড়ম্বর দেখে সকলের তাক লেগে গিয়েছিল। রাত্রি বারোটার পর বুঝি কোনও সাহেব-মেমই আর ঘরে ছিল না, পথে পথে নাচ-গান-হল্লা, অজস্র রঙিন বাজিতে উদ্ভাসিত হয়েছিল রাত্রির আকাশ, সেইসঙ্গে তোপধ্বনি। এ ছাড়াও অনেক রাস্তার মোড়ে মোড়ে জ্বলে উঠেছিল আগুন, ইংরেজরা ছুটে ছুটে বাড়ি থেকে পুরনো কাগজপত্র, পোশাক, ভাঙা আসবাব ইত্যাদি টেনে এনে ছুঁড়ে দিচ্ছিল সেই আগুনে। হিন্দুদের হেলি উৎসবে চাঁচর পোড়ানোর মতন, নতুন শতাব্দীর সূচনায় পুরনো শতাব্দীর অনেক অপ্রয়োজনীয় জিনিস ও আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছিল। প্রকাশ্যে ইংরেজদের এমন লাগামছাড়া, মাত্রাছাড়া ফুর্তি করতে আগে দেখা যায়নি। বিংশ শতাব্দীকে বরণ করার জন্য ইংরেজদের উৎসাহের অবধি ছিল না, এমন ভাব প্রকাশ পাচ্ছিল যেন এক শতাব্দী পার হয়ে অন্য শতাব্দীতে বিচরণ করা দারুণ সৌভাগ্যের ব্যাপার।
ইংরেজ-তোষক সরকারি কর্মচারী ও কিছু কিছু ব্যবসায়ীও এই উৎসবে মেতেছিল, সাধারণ ভারতীয়রা এই শতাব্দী-পরিবর্তনের ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামায়নি। অনেকে এখনও ইংরেজি মাস-তারিখের গণনাই জানে না। অধিকাংশ গ্রামের মানুষেরই অমাবস্যা-পূর্ণিমার হিসেবে জীবন চলে। ভরত তার বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে সাহেব-মেমদের সেই উদ্দীপনা দেখতে দেখতে ভেবেছিল, শতাব্দী তো মানুষেরই তৈরি একটা কাল নির্ণয়ের মাপকাঠি, তাতে তো প্রবহমান মহাকাশের গায়ে একটি আঁচড়ও লাগে না। এই অনাদি-অনন্তকালকে কি শতাব্দী দিয়ে মাপা যায়? মানুষের জীবন অতি ক্ষুদ্র। মানুষের ইতিহাসেরও তো এই সেদিন শুরু। বিশাল অন্ধকার প্রাগৈতিহাসিক কাল পেরিয়ে এসে মানুষ এই সবেমাত্র সভ্যতার আলো দেখতে পেয়েছে। তাই একশোটা বছর মনে হয় বড় একটা সীমানা।
পার্টনার চেয়ে কলকাতায় সেই উৎসবের ঘনঘটা কত বেশি হয়েছিল, তা ভরত জানে না। এই শহরের বহু মানুষও তো এখনও লেখাপড়া শেখে না। ইংরিজি এক দুই গুনতেও জানে না, তারা ইংরিজি শতাব্দী বদলে প্রভাবিত হবে কেন? কিন্তু পরিবর্তনটা যে একটা ঘটেছে, তা পথচলতি মানুষদের মুখ-চোখ দেখলেও টের পাওয়া যায়।
ভরত একা একাই এসব কথা ভাবে। আলোচনা করার মতন কোনও সঙ্গী-সাথি নেই। কংগ্রেসের অধিবেশন শেষ হয়ে যাবার পর রিপন কলেজের ক্যাম্প ছেড়ে এসে শিউপজন আর সে বউবাজারে ‘অজন্তা’ হোটেলে ঘর ভাড়া নিয়েছে। ব্যবসায়ের প্রয়োজনে শিউপূজনকে ভারতের রাজধানীতে আরও কিছুদিন থাকতে হবে, ভরতকেও সে ছাড়তে চায় না। ভরতেরও অবশ্য পাটনায় ফেরার কোনও তাড়া নেই। আর আদৌ সে পাটনায় ফিরবে কি না তাও সে ভেবে দেখছে।
কলকাতায় সে অনেক বছর আসতে চায়নি, কেমন যেন ভীতির ভাব ছিল। এখন সে বুঝতে পারছে, সেই ভয় অমূলক। কেউ যদি আত্মগোপন করে থাকতে চায়, তা হলে কলকাতার মতন বড় শহরই তার জন্য শ্রেষ্ঠ স্থান। এখানে কেউ কারুকে চেনে না, অহেতুক চিনতেও চায় না। রাস্তা দিয়ে মানুষ ছোটে, অন্য মানুষদের মুখের দিকে চেয়েও দেখে না একবার।
তা ছাড়া আত্মগোপন করারও তো কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। ভরত চুরি-ডাকাতি করে পলায়ন করেনি এ শহর থেকে। শুধু আছে চক্ষুলজ্জা। শশিভূষণ মাস্টারের মুখোমুখি আর দাঁড়াতে চায় না সে। পুরনো বন্ধুবান্ধবদের কথা মনে পড়ে, এখনও কারুর খোঁজ করেনি। কংগ্রেসের অধিবেশনে ভিড়ের মধ্যে তার দু-তিনজন কলেজের সহপাঠীকে দেখেছে, এদের সঙ্গে তেমন ঘনিষ্ঠতা ছিল না, মুখ চেনা ছিল, ভরত নিজে থেকে এগিয়ে গিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলেনি, তারাও চিনতে পারেনি। ভরতের চেহারায় নিশ্চয়ই কিছু পরিবর্তন ঘটে গেছে।
স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে কারুর সঙ্গে যোগাযোগ করার আগ্রহও বোধহয় করেনি ভরত, তবু বেশ কয়েকদিন এই শহরের পথে পথে সে ঘোরাঘুরি করল, কিন্তু একজনও কখনও বলল না, আরে ভরত না? এজন্য সে খানিকটা বেদনাও অনুভব করে। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে শ্যামবাজার পর্যন্ত সে একসময় চষে বেড়িয়েছে, অনেক দোকানদারও তার নাম ধরে ডাকত, হেসে কথা বলত, এখন একজনও চেনে না!
‘অজন্তা’ হোটেলের অদূরেই রাস্তার বিপরীত দিকে হাড়কাটার গলি। ওই গলির মুখ দিয়ে যাবার সময় ভরতের মনে পড়ে, এখানে এক বাড়িতে তার বন্ধু দ্বারিকার সঙ্গে সে এসেছিল বসন্তমঞ্জরীর কাছে। এখনও কি বসন্তমঞ্জরী ওখানে থাকে? এর মধ্যে একবার ওদের দুজনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল এলাহাবাদে, তখন ভরতের মাথার ঠিক ছিল না, সে কিছু না জানিয়েই ওদের আশ্রয় ছেড়ে চলে গিয়েছিল। দ্বারিকা খুব উপকারী বন্ধু!
কিন্তু ওই গলিতে প্রবেশ করে না ভরত। সে নিজের ভুল বুঝতে পারে। বসন্তমঞ্জরী এখন দ্বারিকার স্ত্রী, দ্বারিকা তাকে এই কুখ্যাত পল্লীতে রাখবে কেন? মানিকতলার কাছে দ্বারিকার একটি বাড়ি ছিল, একদিন তার সামনে দিয়ে যেতে গিয়েও ভরত দেখেছে যে সে বাড়িতে অন্য মানুষ থাকে, নীচের তলায় অনেক দোকানপাট বসেছে। অনেক কিছুই আর আগের মতন নেই। ভরত যেকলকাতা শহরটা দেখে গিয়েছিল, সেই স্মৃতির সঙ্গে অনেক জায়গারই মিল খুঁজে পায় না।
শুধু প্রেসিডেন্সি কলেজের গেটের ঠিক বাইরেই একটি মুচিকে দেখে ভরত বেশ কৌতুক বোধ করে। ছাত্র বয়েসেও ওই মুচিটিকে ওই একই জায়গায় বছরের পর বছর বসে থাকতে দেখেছে। লোকটির যেন লয়-ক্ষয় নেই, একই চেহারার, একই ময়লা ফতুয়া পরা, মুখ গুঁজে জুতো সেলাই করে চলেছে। দেখলে মনে হয়, মহাকালও ওকে পাশ কাটিয়ে যায়।
শিউগৃজন কিছু পরিচিত ব্যক্তিকে পেয়েছে বড়বাজারে, রোজই দুপুর থেকে সন্ধে পর্যন্ত সেখানে কাটায়। ব্যবসায়িক চুক্তি সম্পন্ন হয় কিছু কিছু ভরতের সাহায্যের আর তার প্রয়োজন হয় না। ভরত আপন খেয়ালে একাই ঘুরে বেড়ায়।
আজ সকালে অনেকেই ছুটেছে খিদিরপুরের দিকে। সেখানে একটি অত্যাশ্চর্য ব্যাপার সংঘটিত হবে। কয়েকদিন ধরেই লোকের মুখে মুখে কথাটা আলোচিত হচ্ছে, বেশ কিছু হ্যাঁন্ডবিলও বিলি হয়েছে। শিউলুজন বেরিয়ে যাবার পর ভরত একটা ছ্যাকড়া গাড়ি ভাড়া করে খিদিরপুরে উপস্থিত হল।
বন্দর এলাকার ঠিক বাইরেই একটি গোলাকার স্থান সাজানো হয়েছে অজস্র ফুল ও হরেক রকম বেলুন দিয়ে। লাল শালু দিয়ে ঘেরা একটি ছোটখাটো মঞ্চও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেখানে চেয়ারে বসে। আছে দ’জন ইংরেজ ও এক বাঙালিবাবু। মঞ্চের নীচে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি ব্যান্ড পার্টি। সামনে বিগ ড্রাম, মাঝখানে কে ড্রাম, পেছনে বিউগল। একটু পরেই শুরু হবে ট্রাম গাড়ির নতুন ভেলকি! হাজার কয়েক মানুষের ভিড় জমেছে সেখানে।
সাহেবরা বলে ট্র্যাম, দেশি লোকরা সেটাকেই ট্রাম বানিয়েছে। প্রথমে চালু হয়েছিল শিয়ালদা স্টেশন থেকে টাটকা তরিতরকারি-সবজি তাড়াতাড়ি সাহেব পাড়ায় পৌঁছে দেবার জন্য। এখন মানুষজনই, বেশি চাপে। কলকাতা শহরে অফিসকাছারি চালু হয়েছে প্রচুর, কিন্তু সেখানকার কর্মীদের যাতায়াতের জন্য যানবাহনের ব্যবস্থা ভাল নেই। ছ্যাকড়া গাড়িতে গাদাগাদি করে পাঁচ-ছ’জন ওঠে, জীর্ণশীর্ণ অধভুক্ত ঘোড়ারা সেই সব গাড়ি টানে, রাস্তার মাঝখানে যখন তখন এক একটা ঘোড়া চোখ উল্টে পড়ে যায়। ট্রামগাড়ির ঘোড়াগুলি অবশ্য রাজকীয় ধরনের, দিশি নয়, অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানি, বেগবান ও তেজস্বী, কিন্তু রাজা-রাজড়াদের মতনই মেজাজি ও খেয়ালি। তিন কামরার ট্রাম টানে ছটা ঘোড়া, আর দু কামরার ট্রামে চারটি ঘোড়া। কামরা টইটুম্বুর মানুষজন নিয়ে বেশ ঝমঝমিয়ে চলে বটে, তবে হঠাৎ কুকুর ঘেউ ঘেউ করলে থেমে যায়, কখনও রাস্তা জুড়ে বিশাল চেহারার ষাঁড় দাঁড়িয়ে থাকলে ঘোড়া আর কাছে এগোয় না, পথের ধারে ধারে জলপান পাত্র দেখলে ঘোড়ারা নিজেদের মর্জিমতন দাঁড়িয়ে পড়ে জল পান করার জন্য। এই সব কারণে অফিসে পৌঁছতে যে দেরি হয়ে যায়, তা তো বড় সাহেবরা বুঝবেন না। তাঁরা তো আসেন নিজস্ব ল্যান্ডো গাড়িতে, পাঁচ-দশ মিনিট লেট হলেই কেরানিদের বকুনি দেন। অনেকে সে জন্য গাড়ি-ঘোড়ার তোয়াক্কা না করে পাঁচ সাত মাইল দূর থেকেও পায়ে হেঁটেই অফিসে চলে আসে।
ঠিক এগারোটার সময় একটা চার ঘোড়ার ট্রাম এসে পৌঁছল মঞ্চের সামনে। আজ ঘোড়াগুলি, যেন বেশি বেশি সুসজ্জিত, পিঠের ওপর ঝালর দেওয়া মখমলের পোশাক, মাথায় রঙিন পালক। ঘোড়াগুলি খুব জোরে জোরে ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়ছে, সহিসরা ঘোড়াগুলোকে খুলে নিয়ে গেল।
মঞ্চে উপবিষ্ট একজন ইংরেজ উঠে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কী যেন বলল, ঠিক বোঝা গেল। তারপর বাঙালিবাবুটি তার তর্জমা করে দিল এই মর্মে : কলিকাতা শহরের অধিবাসীগণ, আপনাদের সেবার জন্য ট্রাম কোম্পানি সদা তৎপর। গত বৎসর হইতে প্রথম শ্রেণীতে চামড়ার। গদিযুক্ত সিট যুক্ত হইয়াছে। দ্বিতীয় শ্রেণীতে পাদানি ছিল না বলিয়া অনেকের অসুবিধা হইত, তাহাও দূর করা হইয়াছে। দুপুর দ্বাদশ ঘটিকা হইতে অপরাহ্ন তিন ঘটিকা পর্যন্ত টিকিটের দাম শস্তা করা হইয়াছে। বিলাত হইতে সদাশয় ট্রাম কোম্পানির বড় সাহেব মহোদয় আসিয়া এই শহরের ট্রাম পরিচালনার এক অভিনব পরিবর্তন সুচনা করিতেছেন। চমকপ্রদ, অভাবনীয় এই ব্যবস্থা। যাত্রীসাধারণ এখন হইতে যাতায়াতের নিখুঁত সময় রক্ষা করিতে পারিবেন। এই নতুন ব্যবস্থা আজই : আপনারা চাক্ষুষ করুন…
ব্যান্ড পার্টি এ বার বাজনা শুরু করে দিল। সুসজ্জিত ঘোড়াগুলিকে এনে ঘোরানো হতে লাগল মঞ্চের চার দিকে। সাকাসে যেমনটি দেখা যায়। ক্লাউনের মতন সেজেগুঁজে একজন ঘোড়াগুলির সঙ্গে লাফাচ্ছে। কয়েকবার পাক খাওয়াবার পর ঘোড়াগুলিকে নিয়ে যাওয়া হল ট্রামগাড়িটির কাছে, যেখানে তাদের জুতে দেবার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু ঘোড়াগুলিকে বাঁধবার বদলে সেই ক্লাউনটি নাচ শুরু করল। একটা ঘোড়া থেকে সে অন্য ঘোড়ায় লাফিয়ে চলে যায়। পাশ দিয়ে নামবার বদলে সে ল্যাজের দিক দিয়ে সরসর করে নামে। এই রকম কিছুক্ষণ কসরত দেখাবার পর সে একটা ছপটি নিয়ে ঘোড়াগুলিকে মারতে লাগল। ঘোড়াগুলোর খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা অবস্থা, এ রকম অকারণে তাদের মার খাওয়ার অভিজ্ঞতা নেই। তারা বিদেশ থেকে আমদানি করা, কোম্পানির পেয়ারের পোষ্য। প্রথম প্রথম মার খেয়েও তারা নড়তে চাইল না, এই মারটাও খেলার অঙ্গ কিনা তারা বুঝতে চাইছে। ক্লাউনটি এবার বেশ জোরে শপশপ করে কষাতে লাগল ছপটি। ঘোড়াগুলি ছত্রভঙ্গ হয়ে দূরে সরে যেতে লাগল।
অকস্মাৎ থেমে গেল ব্যান্ড বাজনা। নাচ থামাল ক্লাউনটি। একটুক্ষণের নীরবতা। মঞ্চের দ্বিতীয় ইংরেজটি এ বারে উঠে দাঁড়িয়ে একটা পিস্তল বার করে বলে উঠল, রেডি, স্টেডি, গো! দুম করে পিস্তল থেকে গুলি ছোঁড়ার শব্দ হল।
ও মা, আশ্চর্য না, আশ্চর্য, অত্যাশ্চর্য ব্যাপার, ঘোড়াবিহীন সেই দু কামরার ট্রামগাড়িটি দিব্যি চলতে লাগল গড়গড়িয়ে। ধোঁয়া উড়ল না, ধুলো উড়ল না, ঘ্যাসঘেসে শব্দও হল না। একটু আধটু গড়িয়ে যাওয়া নয়, অনেক দূর চলে গেল সেই ট্রামগাড়ি, প্রায় চোখের আড়ালে। মিনিট সাতেক বাদে আবার ফিরেও এল। সামনের জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে আছে চালকটি, আনন্দে সে টুপি খুলে নাড়ছে।
হাজার হাজার দর্শক চটাপট চটাপট শব্দে হাতচাপড়ি দিয়ে অভিনন্দন জানাল তাকে।
বিজ্ঞানের এই নবতম কীর্তি দেখে যত না বিস্মিত হল ভরত, তার চেয়েও সে বেশি বিস্মিত হল জনতার ব্যবহার দেখে। এই অলৌকিক কাণ্ডটি দেখে কেউ ভয়ে ছুটে পালাল না, কেউ ভক্তিতে সাষ্টাঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে প্রণামও জানাল না। এ দেশের মানুষ এত পরিণতমনস্ক হয়ে উঠল কবে? এই কি যুগ পরিবর্তনের হাওয়ার ফল? ভয়, কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাসে নিমজ্জিত হয়েছিল এ দেশের আপামর জনসাধারণ, বিংশ শতাব্দীতে পা দিয়ে তারা আধুনিক পৃথিবীর উপযুক্ত নাগরিক পদবাচ্য হল? বিজ্ঞানকে মেনে নিচ্ছে এত সহজভাবে!
চোখের সামনে দেখলেও ভরত নিজেই এখনও বিজ্ঞানের বিজয় অভিযানের সব রহস্য অনুধাবন করতে পারে না। এত হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ জেনে এসেছে যে আগুন ছাড়া আলো হয় না। এখন ঘরের মধ্যে আলো জ্বলে, তার জন্য একটি দেশলাইয়ের কাঠিও খরচ করতে হয় না। এবং সেই আলোতে হাত রাখলে হাত পুড়ে যায় না। এ সবই বিদ্যতের কেরামতি। আকাশের বিদ্যুৎ নয়, মানুষের তৈরি বিদ্যুৎ। আকাশের বিদ্যুৎ দু-এক মুহূর্তের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যায়, আর মানুষ বিদ্যুৎকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বন্দি করে রেখে দিতে পারে। আকাশের দেবতার চেয়েও মানুষের শক্তি বেশি। সেই বিদ্যুৎ দিয়েই আবার চালানো হচ্ছে এই ট্রাম গাড়ি। একটি প্রবন্ধে ভরত পড়েছে যে, এই বিদ্যুতের শক্তির যে কী অসীম সম্ভাবনা, তা সব এখনও জানা যায়নি। এই নতুন শতাব্দী হবে বিদ্যুতেরই শতাব্দী!
এবারে ট্রাম কোম্পানির বাঙালিবাবুটি ঘোষণা করল যে আজ এখন থেকেই এই ঘোড়াবিহীন বৈদ্যুতিক ট্রাম যাত্রীবহন শুরু করবে। খিদিরপুর থেকে যাবে চৌরঙ্গির রাস্তা পর্যন্ত। এই নতুন গাড়িতে অবশ্য ভাড়া কিছু বেশি লাগবে। আগে ভাড়া ছিল ছ পয়সা, এখন দু আনা দিতে হলেও সময় লাগবে অর্ধেক। হঠাৎ বর্ধিত ভাড়া দিয়ে সময় বাঁচাতে নিশ্চয়ই সকলেই রাজি হবেন।
দৌড়োদৌড়ি শুরু হতে ভরতও দ্বিধা করল না, সেও ছুটে গিয়ে প্রথম শ্রেণীতে উঠে বসল। এই ঐতিহাসিক দিনটির অভিজ্ঞতা সেও সঞ্চিত করতে চায়। জানলার ধারেই একটা আসন পেয়ে গেল।
ট্রাম গাড়িটিতে সদ্য সাদা রং করা হয়েছে। মাটিতে রেলগাড়ি চালাবার মতন লোহার লাইন পাতা হলেও ট্রামকে ঠিক ক্ষুদে ট্রেন বলা যায় না, দেখায় যেন ছোট ছোট স্টিমারের মতন। জলে ও স্থলে মানুষ গতির নতুন বাহন পেয়ে গেছে। এতকাল গাড়ি টানার জন্য গোরু-ঘোড়া-মোষ-উট-হাতি এই রকম কত পশুকে দিয়ে গাড়ি টানানো হয়েছে। এমনকী মানুষকেও পশুর পর্যায়ে নামিয়ে এনে জুড়ে দেওয়া হয়েছে গাড়ির সঙ্গে। কোনও জীবিত প্রাণী টানবে না, অথচ গাড়ি চলবে, এত কালের মানব সভ্যতায় কেউ তা কি কল্পনাও করতে পেরেছে? সেই কবে মানুষ আগুনের ব্যবহার শিখে সভ্য হতে শুরু করেছিল, এতকাল পর বাষ্প ও বিদ্যুতের শক্তি কাজে লাগিয়ে সেই সভ্যতা যেন একলাফে অনেকটা এগিয়ে গেল।
ট্রাম ছাড়ার আগে ভরত দূরে দাঁড়ানো ঘোড়াগুলোকে দেখছিল। অদ্ভুত, বিমুঢ় দৃষ্টিতে ওরা তাকিয়ে আছে। ওরা বুঝতেই পারছে না, ওদের গতিশক্তি ছাড়া কী করে গাড়িটা চলবে। ওরা জানে না, আজ থেকে ঘোড়াদের গৌরবের দিন শেষ হল। রেলগাড়ি আর ঘোড়ায় টানা গাড়ি এসে পালকিগুলিকে হটিয়ে দিয়েছিল। রেলে অনেক নিরাপদে ও কম খরচে চাপা যায়, তার বদলে পালকি চাপতে আর কে চায়? এবারে বিদ্যুতে টানা ট্রাম এসে ঘোড়াগুলোকে বিদায় করে দিল। এর ওপর আবার এসে গেছে মোটর কার বা অটোমোবিল। এবার কোনও মানুষ যাতায়াতের জন্য ঘোড়ার বদলে ওই গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাবে।
ময়দানের মধ্য দিয়ে ছুটে চলেছে ট্রাম। দু পাশে বড় বড় গাছ, ফাঁকে ফাঁকে পড়েছে ধপধপে শীতের রোদ। এক অপূর্ব অনুভূতি হল ভরতের। এই ট্রামগাড়ির যাত্রার সঙ্গে অন্য কোনও যানবাহনের তুলনাই চলে না। এত মসৃণ, এত আরামপ্রদ, যেন সে হাওয়ায় ভাসছে। রেলগাড়িতে যাবার সময় জানলা খুলে রাখলে কয়লার গুঁড়ি আর ধোঁয়া এসে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে, পোশাক নোংরা হয়ে যায়, ঘোড়ায় টানা ট্রামে ঝাঁকুনি ছিল খুব। জলযান স্টিমারে এমন শব্দ হয় যে কান ভোঁ ভোঁ করে, কিন্তু এই ট্রাম সকলের শ্রেষ্ঠ। আধুনিকতার জয়ধ্বজাবাহী এই ট্রাম যেন তাকে নিয়ে চলেছে অনাগত ভবিষ্যতের দিকে।
সন্ধেবেলা হোটেলে ফিরে এসে ভরত শিউপূজনকে তার এই অভিজ্ঞতার গল্প করতে গিয়ে তেমন কোনও আগ্রহের সৃষ্টি করতে পারল না। আজ সারাদিন বড়বাজার অঞ্চলে এই ভেলকিবাজি ট্রামের গল্প হয়েছে, শিউপূজন সেখানেই শুনেছে। বড়বাজারের বড় বড় ব্যবসায়ীরা কেউই তেমন মুগ্ধ নয়। শিউপূজন জোর দিয়ে বলল, তোমার ওই সব বিদ্যুৎ টি টিকবে না। বাবর মানুষ ঘোড়ার ওপর ভরসা করে এসেছে, ঘোড়াই আবার ফিরে আসবে। ওই কলে টানা ট্রামে মানুষ চাপবে কেন, ভাড়া বেশি না?
ভরত তর্কের মধ্যে গেল না। এই হচ্ছে কলকাতা শহর আর অন্য জায়গার মানুষের তফাত। নাগরিক স্বভাব, নাগরিক মনোবৃত্তি অন্য ব্যাপার, বাইরের লোকরা তা সহজে আয়ত্ত করতে পারে না। বড় শহরের অধিকাংশ নাগরিকরা অনেক নতুন জিনিসকে তবু সহজে মেনে নিতে পারে, বাইরের বেশিরভাগ মানুষই যে কোনও নতুন জিনিস দেখলেই সন্দেহ করে, পুরাতনকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়। অনেক গ্রামের লোক এখনও মনে করে কাঠের আঁচের বদলে কয়লার উনুনের রান্না খেলে পেটের রোগ হয়। এ দিকে শহরে কাঠের রান্না প্রায় উঠেই যাচ্ছে।
‘অজন্তা’ হোটেলের খাদ্যদ্রব্য অখাদ্য। কাছাকাছি অনেক আহারের স্থান আছে, ওরা দুজনেই প্রতি রাতে হোটেল থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কোনও খাবারের দোকান খুঁজে নেয়। শিউজন খায় ব্রিামিষ, ভরতেরও নিরামিষে আপত্তি নেই, তবে মাঝে মাঝে একটু মাছের জন্য মন কেমন করে। এখন শীতকাল, ইলিশের সময় নয়, কিন্তু এই সময়টায় কলকাতায় অতি উত্তম, টাটকা চিংড়িমাছ পাওয়া যায়। কলকাতার হোটেলগুলির চিংড়িমাছের মালাইকারি অতি বিখ্যাত, ভারতের আর কোথাও এমনটি পাওয়া যাবে না। কিন্তু শিউপূজনের ঘোর আপত্তিতে সেই দেবভোগ্য ভোজ্য আস্বাদন করার উপায় নেই। যে দোকানে চিংড়ি মৎস্য ভর্জিত হয়, সে দোকানের কাছাকাছি গেলেই শিউপূজন বিকট গন্ধ পায়। মানুষ কী বিচিত্র প্রাণী। একই বস্তুতে সম্পূর্ণ বিপরীত প্রতিক্রিয়া। কোনও বিশেষ খাদ্যের ঘ্রাণে একজন মানুষের আয়ুদে জিহ্বা সিক্ত হয়, আবার কোনও মানুষের ঘৃণায় বমি আসে।
খাওয়া-দাওয়ার পর হজম প্রক্রিয়ার সুবিধার জন্য খানিকক্ষণ পদব্রজে ভ্রমণের অভ্যেস আছে শিউপূজনের। বউবাজারের দিকটায় অনেক রাত্রি পর্যন্ত দোকানপাট খোলা থাকে, আলোয় ঝলমল করে। হাড়কাটার গলির কাছে অনেক গাড়ি এসে থামে, তার থেকে নেমে বাবুরা হাতে ফুলের মালা জড়িয়ে হেলতে দুলতে এক একটি বাড়ির মধ্যে ঢুকে যায়। অন্য দিকে, লালবাজার অঞ্চলে অন্ধকার-অন্ধকার ভাব। নামে লালবাজার হলেও সেখানে কোনও বাজার নেই। দিনের বেলা দেখা যায় সারি সারি দাঁতের ডাক্তারদের চেম্বার, সন্ধ্যার পর সেগুলি বন্ধ হয়ে যায়।
ওই অঞ্চলেই এক একটি বাড়িতে ওপর তলায় বাতি জ্বলে। সেখান থেকে ভেসে আসে গানের কলি কিংবা নূপুরের শিঞ্জন, হঠাৎ হঠাৎ হাসির ফোয়ারা। বেশ আমোদ-প্রমোদ চলছে বোঝা যায়। ওই সব শুনে মন চঞ্চল হয়ে ওঠে শিউপূজনের। কিন্তু চক্ষুলজ্জায় বেশ কয়েকদিন সে এই ব্যাপারে ভরতকে কিছু বলতে পারেনি।
মূল অধিবেশনের তিনদিন এবং তার আগে-পরে দু চারদিন, এই কটি দিনই কংগ্রেসের নেতারা কংগ্রেসি হয়ে থাকেন। এই কদিন তাঁরা দেশের নানা সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামান। সারা বছরের বাকি সমস্ত দিন তাঁদের নিজেদের পেশা বা ব্যবসায়ের কাজকর্মে ব্যস্ত থাকতে হয়। তা ছাড়া তাঁরা রক্ত মাংসের মানুষ, শরীর-মনের অন্যান্য দাবিও আছে। প্রবাসে গেলে অনেক বাসনা যেন লাগাম ছাড়া হয়ে যায়।
শিউপূজন একদিন বলেই ফেলল, ভরতভাইয়া, কী রোজ রোজ আমরা রাত্তির নটা বাজতে না বাজতেই হোটেলে গিয়ে শুয়ে পড়ি! পাটনা শহরেও তো আমরা এর অনেক পরে ঘুমোতে যাই, আর কলকাতা শহরে এসে…আমাদের ওদিকে একটা কথা চালু আছে, যদি ভোর দেখতে চাও তো মুঙ্গেরে যাও, দুপুর দেখতে এসে পাটনায়, গোধূলি দেখে মুগ্ধ হবে বেনারসে, আর রাতের রোশনাই দেখার জন্য চলে যাও কলকাতায়! তা এই কদিনে আমরা তো রাতের রোশনাই কিছুই দেখলাম না। তুমি এই শহরের মানুষ, তুমি আমাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাও! ভরত ফিকে হেসে বলল, শিউপূজনজি, আমি দিনের কলকাতা ভাল চিনি, রাতের শহরটা চিনি না। দিনের বেলা আপনি ব্যস্ত থাকেন।
শিউপূজন বলল, দিনের বেলা আর কী দেখার আছে! রাতের রোশনাইটাই আসল। এই যে বাড়িটা থেকে ঘুংঘুঁটের রিনিঝিনি শোনা যাচ্ছে, এখানে নিশ্চয়ই কোনও বাঈ নাচছে। এখানে আমরা · নাচ দেখতে যেতে পারি না? পয়সার জন্য কোনও পরোয়া করবেন না।
ভরত বলল, কিছু কিছু লোক তো বাড়ির মধ্যে ঢুকছে। আপনি যেতে পারবেন না কেন, চলে। যান!
শিউজন চক্ষু কপালে তুলে বলল, আমি একেলা যাব? আপনি যাবেন না? কেন, বাঈজির নাচ-গান শুনতে যাওয়া কি অন্যায়?
ভরত একটুক্ষণ চিন্তা করে, খানিকটা দ্বিধার সঙ্গে বলল, না, অন্যায় কেন হবে। অনেকেই তো যায়। তবে আমার কখনও যেতে ইচ্ছা করেনি, এখনও ইচ্ছা হয় না।
শিউপূজন বলল, আপনি আমার জন্য যাবেন, আমার সঙ্গে থাকবেন।
ভরত চুপ করে রইল। তার নিজের কোনও আকাঙক্ষা নেই, তবু শিউপূজনের আগ্রহে তার সঙ্গে বাঈজির ঘরে যাওয়া অনেকটা দালালির পর্যায়ে পড়ে না? শিউপূজন তার উপকার করেছে, সে জন্য রূঢ়ভাবে তাকে আঘাত করাও যায় না।
শিউপূজনের ব্যগ্র দৃষ্টি দেখে সে আবার বলল, এক কাজ করা যেতে পারে। আপনি তো বাঙালি থিয়েটার দেখেননি কখনও। কলকাতায় থিয়েটারের খুব সুনাম আছে। কাল সন্ধের সময় আমরা ভাল কোনও থিয়েটার দেখতে যাব।
ভরত এক সময় বন্ধুদের সঙ্গে দল বেঁধে থিয়েটার দেখতে যেত। উত্তর কলকাতার রঙ্গালয়গুলির সবকটিই সে চেনে। পরদিনই সে শিউপূজনকে নিয়ে গেল থিয়েটার পাড়ায়। এর মধ্যে দু-একদিন সে ট্রামের যাত্রীদের অল্প আলাপ আলোচনা শুনে বুঝেছে যে ‘নল-দময়ন্তী’ এবং ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ এই দুটি নাটকই এখন শহরে জমজমাট। ভরতের কৃষ্ণকান্তের উইল দেখার আগ্রহই বেশি, বঙ্কিমের এই উপন্যাসটি তার প্রিয়, কিন্তু সে ভাবল, ‘নল দময়ন্তী’র মতন পৌরাণিক কাহিনীই শিউপূজনের বেশি ভাল লাগবে।
আগে যেটি ছিল ‘বেঙ্গল থিয়েটার’, এখন সেটিই নাম পাল্টে হয়েছে ‘অরোরা থিয়েটার’। দেওয়ালে রঙের পলেস্তারা পড়েছে, সামনের গেট সাজানো হয়েছে বৈদ্যুতিক বাতি দিয়ে। নটচুড়ামণি অর্ধেন্দুশেখর যোগ দিয়েছেন এই থিয়েটারে।
আজ যে শিবরাত্রি তা ভরতের জানা ছিল না। শিবরাত্রির ব্রত যারা পালন করে, তারা সারাদিন সারারাত উপবাসে থাকে, তাদের জাগিয়ে রাখার জন্য সারারাত্ৰব্যাপী অভিনয় হয় অনেক রঙ্গালয়ে। আজ তাই ‘অরোরা থিয়েটার’ এ পরপর তিনটি পালা হবে, ‘নল-দময়ন্তী’, ‘আবু হোসেন’ এবং ‘জেনানা ওয়ার’। এক টিকিটে তিন নাটক, শিউপূজন মহা খুশি। নাটক দেখতে দেখতেও সে মোহিত হয়ে গেল, পাটনাতে এ রকম কিছু দেখার সৌভাগ্য হয় না। ‘নল-দময়ন্তী’-তে দময়ন্তীরই মুখ্য ভূমিকা, সেই ভূমিকায় অভিনয়ে তারাসুন্দরী একাই একশো। এ নাটকে কিন্তু অর্ধেন্দুশেখর মঞ্চে অবতরণ করলেন না, তাঁকে দেখার জন্য ভরত ছটফট করছে। তাঁকে দেখা গেল পরের নাটকে। অনেকক্ষণ প্রতীক্ষা করার পর অর্ধেন্দুশেখরকে দেখে যেমন পুলকিত হল ভরত, তেমন কিছুটা নিরাশও হল। এর মধ্যে এত বুড়ো হয়ে গেছেন তিনি। বয়েস তো খুব বেশি হবার কথা নয়, তবু যেন চেহারাটা ভেঙেচুরে গেছে। অভিনয়ের সময় অবশ্য সেই বুড়ো হাড়েই জাদু দেখালেন, নেচে-গেয়ে-লম্পঝম্প দিয়ে দেখালেন, এখনও সিরিওকমিক রোলে তাঁর জুড়ি নেই। যখন চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকেন, তখনই বোঝা যায়, তাঁর চোয়াল ঝুলে পড়েছে, ললাটে শ্রান্তির বলিরেখা!
তৃতীয় নাটিকাটি অবশ্য একেবারেই ভাঁড়ামি, রাতের শেষ প্রহরে দর্শকদের জাগিয়ে রাখার চেষ্টা!
সব নাটকেই নাচ-গান থাকবেই। পৌরাণিক বা ভক্তিমূলক বা দেশাত্মবোধক নাটক, যেখানে নায়িকার পক্ষে চটুল নাচ বা গান একেবারেই মানায় না, সেখানেও সখীদের দৃশ্য থাকে। কিংবা এক খল, লম্পটের চরিত্র আমদানি করা হয়, সে জোর করে মেয়েদের নাচায়, সে সব দৃশ্যে নর্তকীদের নিতম্বের আন্দোলন বেড়ে যায়, বক্ষের আঁচল খসে পড়ে বারবার। ভরতের মনে হল, বাঈজিদের বাড়িতে এই ধরনের নাচ দেখতে যেতে অনেক পয়সা লাগে, অনেক সাধারণ মানুষের পক্ষেই তা সম্ভব নয়, যদিও বাসনা বা লোভ থাকে। থিয়েটারের মালিকরা সেই জন্যই সব নাটকে এ রকম একটা দৃশ্য ঢুকিয়ে দেয়। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটে।
এখন প্রতিদিনই এক একটি নতুন নাটক। ওই অবোরা থিয়েটারই পরদিন ‘রিজিয়া’। বাইরে পোস্টারে রয়েছে এই নাটকে মুখ্য ভূমিকায় অর্ধেন্দুশেখর ও তারাসুন্দরী। শিউপূজন এমনই মজা পেয়েছে যে পরের দিনের টিকিট সে আগেই কেটে নেবার ব্যবস্থা করল।
রিজিয়াও বেশ জমজমাট নাটক, নামভুমিকায় দাপটের সঙ্গে অভিনয় করছেন তারাসুন্দরী, কিন্তু অর্ধেন্দুশেখর কোথায়? দৃশ্যের পর দৃশ্য চলে যাচ্ছে, অর্ধেন্দুশেখরের দেখা নেই। অন্যান্য পুরুষ চরিত্রে সব অচেনা অভিনেতা। আজ কি তা হলে অর্ধেন্দুবাবু অনুপস্থিত? হঠাৎ এক সময় মঞ্চে প্রবেশ করল একজন কুৎসিত দর্শন মানুষ, পোড়া কয়লার মতন রং, মুখে দগদগে ঘা, পোশাকের রংও কালো, মাথায় আবার একটা লাল ফেট্টি বাধা। হাতে একটা বাঁকা, লকলকে ছুরি। সে একজন ঘাতক, মাত্র পাঁচ-সাত মিনিটের দৃশ্যে তার অভিনয়। আর সে কী অভিনয়, সে একজন হিংস্র ঘাতক, কিন্তু চোখের দৃষ্টিতে চকিত ভয়, অতি সামান্য সংলাপ, তাও কেমন যেন স্খলিত, হাঁটার ভঙ্গি কাঠের পুতুলের মতন, শরীর হাঁটছে, মন নেই। তার প্রস্থানের পর দর্শকদের হাততালি আর থামতেই চায় না। এই বীভৎস আকৃতির মেকআপ দেখে অর্ধেন্দুশেখরকে চেনবার উপায় নেই। যিনি এক খ্যাতমান অভিনেতা, স্বয়ং এই নাটকের পরিচালক, তিনি ওই অকিঞ্চিকর অত ক্ষুদ্র ভূমিকা নিলেন? এবং দেখিয়ে দিলেন, ওইটুকু সময়েও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করা যায়।
ভরতের পাশের আসনের একজন তোক বলল, আরে মোসাই, অর্ধেন্দুবাবুর ওই অ্যাক্টোটুকু দেখার জন্যই এই থ্যাটারে এই নিয়ে পোঁয়োরো বার এলুম!
একদিন নাটক দেখে ফেরার পথে বৃষ্টি এল এবং দুজনকেই ভিজতে হল। অসময়ের বৃষ্টি, সঙ্গে নিয়ে আসে সর্দি-সান্নিপাতিক। শিউপূজনের কিছু হল না, ভরত জ্বরে পড়ে গেল।
অগত্যা হোটেলের ঘরে একা শুয়ে থাকতে বাধ্য হল ভরত। শিউপূজন এক কবিরাজকে ডেকে এনে দেখিয়েছে, কবিরাজ কয়েকটি বড়ি ও পাঁচন দিয়ে গেছে। ওষুধের অনুপান মধু, পানপাতা ও গোলমরিচও কিনে এনেছে, এর বেশি আর সে কী করবে, সারাক্ষণ তো ঘরে থাকতে পারে না। সে থাকতে চাইলেও ভরত আপত্তি করত।
একা থাকতে ভরতের খারাপ লাগবার কথা নয়। তীর্থযাত্রী হিসেবে সে অনেক দেশ ঘুরে বেরিয়েছে, বহু সরাইখানা-ধর্মশালায় সে তো একাই কত দিনরাত্রি অতিবাহিত করেছে। এমন হয়েছে, সারাদিন একটাও কথা বলেনি কারুর সঙ্গে। কিন্তু সে সব জায়গা ছিল অচেনা, সেখানে একা থাকাই স্বাভাবিক। এটা কলকাতা শহর, রাস্তাঘাট সব পরিচিত, তার নিঃসঙ্গতা এখানে বড় প্রকট হয়ে চেপে ধরে। একদিন পরেই ভরত বড় উতলা বোধ করতে লাগল।
শিউপূজন কিছুটা প্রমোদের স্বাদ পেয়েছে, শুধু থিয়েটার দেখে তার মন ভরে না। আরও দু-চারজন বন্ধু জুটিয়েছে, হোটেলে ফেরে বেশ গভীর রাতে।
তৃতীয় দিনে জ্বর কিছুটা কমে গেলেও শরীর বেশ দুর্বল, মুখ একেবারে বিস্বাদ, চিত হয়ে শুয়ে ভরত আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগল। এরপর তার জীবন কোন দিকে যাবে? কলকাতাতেই থাকবে, না ফিরবে পাটনায়? পাটনায় তার বাড়ির আগুন নিছক দুর্ঘটনা নয়, কেউ লাগিয়েছে বলেই শিউপূজনের দৃঢ় বিশ্বাস। ভরতের সঙ্গে কে এবং কেন শত্রুতা করবে, সে তো কারুর পাকা ধানে মই দেয়নি! তবু বারবার এই রকম হয়। পাটনার প্রতি তার বিতৃষ্ণা জমে গেছে। কলকাতা শহরই এখন নানারকম ঘটনার কেন্দ্র, থাকলে এখানেই থাকা উচিত। অন্য কোথায়ই বা সে যাবে।
হোটেলের পাশের কক্ষে এক স্ত্রীলোকের প্রগলভ কলহাস্য শোনা যাচ্ছে। শুনলেই বোঝা যায়, কোনও ভদ্র নারীর কণ্ঠস্বর নয়। বাজারের পাশে হোটেল, এখানে কেউ বউ-ঝি নিয়ে আসে না, হোটেলের বাসিন্দারা সবাই পুরুষ। সন্ধ্যার পরপরই এই এলাকার পথে পথে বাতিস্তম্ভগুলির নীচে বারাঙ্গনারা দাঁড়িয়ে থাকে। লোকে ওদের বলে পতিতা, কুলটা। আসলে সহায়-সম্বলহীন বালবিধবা কিংবা স্বামী-শ্বশুরকুল দ্বারা বিতাড়িত অসহায় বাঁজা নারী, নিছক বেঁচে থাকার তাগিদে পথে নেমেছে। সেই রকমই কোনও রমণীকে কেউ হোটেলের ঘরে তুলে এনেছে। ভরত একবার ভাবল, অনেককাল আগে তার বন্ধু দ্বারিকা বুঝিয়ে ছিল যে এরা সবাই অসহায় নারী, বসন্তমঞ্জরীকে দেখেই তো তা বোঝা যায়, কিন্তু অসহায়, দুঃখী হলে এমন তীক্ষ্ণ গলায় হাসে কেন? কথার ভঙ্গিতে কেন, লাস্য জড়ানো? তবে কি, সবই কৃত্রিম? হাসি না থাকলে, নকল ছলাকলার ভাব না দেখালে কেউ মূল্য দেবে না।
এক সময় ভারতের অসহ্য লাগল, জামা গলিয়ে নেমে এল রাজপথে। মাথাটা একটু টনটন করছে, না হাঁটলেই হল, ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করে সে যেখানে ইচ্ছে যেতে পারে। একটা গাড়িও দাঁড়িয়ে আছে কাছে, সেটার দিকে এগোতে এগোতে ভরত প্রথমে ভাবল, গঙ্গার ঘাটের দিকে গেলে হাওয়া খেয়ে এলে কেমন হয়? নতুন নতুন বড় বড় জাহাজ এসে বন্দরে ভিড়ছে, সাদা, কালো, খয়েরি, হলুদ কত রকমের মানুষ সেই সব জাহাজ থেকে নামে, সে সব দেখতেও তো ভাল লাগে।
গাড়িতে ওঠার ঠিক আগের মুহূর্তে ভরত মত বদল করে আবার ভাবল, বরং তার বদলে ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’-এর নাট্যরূপ দেখে আসা যাক। অমর দত্ত নামে এক তরুণ অভিনেতা নাকি এতে ফাটাফাটি অভিনয় করছে, ভরতরা ছাত্র বয়েসে এই অমর দত্তের নামও শোনননি। ভরতের নিয়তি যেন তাকে টেনে নিয়ে যেতে লাগল ক্লাসিক থিয়েটারের দিকে।
ক্লাসিকের দ্বার প্রান্তে নেমে ঘোড়ার গাড়ি থেকে যখন নামল ভরত তখন টিকিট প্রায় শেষ হয়ে গেছে। বারো টাকা দামের টিকিট দুটি একটি বাকি আছে মাত্র, গাড়ি ভাড়া মিটিয়ে সে কাউন্টারে এসে শেষ টিকিটটি পেয়ে গেল ভাগ্যক্রমে।
শো শুরু হতে আরও মিনিট সাতেক দেরি আছে, সবে মাত্র ফাস্ট বেল পড়েছে, অনেক লোক অপেক্ষা করছে বাইরে। থিয়েটারের দর্শকরা ভাল সাজগোজ করে আসে, এটাই প্রথা। শীতকালের পোশাকে অনেক রঙের বাহার থাকে। শৌখিন বাবুদের গায়ে কাশ্মীরি শাল, জামেয়ার এবং মলিদার যেন প্রদর্শনী চলছে, চতুর্দিক ভুরভুর করছে আতর এবং ফরাসি পারফিউমের গন্ধে। তুলনায় ভরতের বেশবাস মলিন, সে হঠাৎ উঠে এসেছে বিছানা ছেড়ে, মুখে তিনদিনের দাড়ি, এই কদিন স্নানও করেনি, কোটরে বসে গেছে চক্ষু। গায়ে একটা সাধারণ চাঁদর জড়ানো, তবু একটু শীত শীত করছে। আবার বুঝি জ্বর আসবে।
ভরত দাঁড়িয়ে আছে এক পাশে। হঠাৎ পেছন থেকে তার কাঁধে একজন চাপড় মারল। ফিরে দাঁড়িয়ে কিছুটা বিস্ময়ে ও বিরক্তিতে ভ্রূ কুঞ্চিত করল, তার দিকে চেয়ে মৃদু মৃদু হাসছে সম্পূর্ণ অচেনা একজন মানুষ। একজন হোমরা-চোমরা মৌলবি, শেরওয়ানি ও জরির চুমকি বসানো কোট পরা, মাথায় ঝালর লাগানো ফেজ, মুখের দাড়িতে লালচে রং মাখানো। নিশ্চয়ই ভরতকে অন্য কেউ ভেবে ভুল করেছে।
ভরত কিছু বলার আগেই সে বলল, কী রে ভরত, চিনতে পারছিস না?
ভরত সত্যিই পারছে না চিনতে। কলকাতা শহরে এই প্রথম হঠাৎ তাকে কেউ নাম ধরে সম্বোধন করল, অথচ বুঝতে না পারছে না সে কে! ভরত ভেবেছিল, এতদিন বাদে তাকে চেনাই শক্ত।
ভরত কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না দেখে সেই লোকটি আবার হেসে বলল, আমি একটু মুটিয়েছি, তা বলে কি চেনা যাবে না? আমি ইরফান রে, ইরফান!
ভরত এবার আনন্দময় বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠল, ইরফান, তুই?
দুই বন্ধু আলিঙ্গনাবদ্ধ হল।
প্রাথমিক বিস্ময় কেটে যাবার পর, কুশল প্রশ্নাদি সেরে ভরত জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার রে,
ইরফান, তুই যে খুব মুসলমান সেজেছিস? সেইজন্যই তোকে দেখে ধারণাও করতে পারিনি।
ইরফান বলল, সে কী ভায়া, মোছলমানের ছেলে মোছলমান হব না কি হি হব?
ভরত বলল, তা বলছি না। তুই ডারউইন সাহেবের খুব ভক্ত ছিলি। তোর সঙ্গে আমার যখন শেষ দেখা হয়, তুই আমাকে অনেকক্ষণ ধরে ডারউইন তত্ত্ব বুঝিয়েছিলি, আমার এখনও মনে আছে।
ইরফান উদারভাবে হেসে বলল, তাই বুঝি? ডারউইন তত্ত্ব, তা হবে!
ভরত বলল, তুই তখন তোর একটা সংশয়ের কথাও বলেছিলি। ডারউইন তত্ত্ব অভ্রান্ত, এবং সেটা মানলে ঈশ্বর-আল্লা বা মানুষের কোনও সৃষ্টিকর্তাকে মানা যায় না। তা হলে আর আমরা কেউ হিন্দু বা মুসলমান থাকি না।
ইরফান বলল, ছাত্র বয়েসে ও রকম এক একটা থিয়োরি নিয়ে মাথা গরম হয়। তুই এখনও ও সব মনে করে রেখেছিস? ডারউইন তত্ত্ব অভ্রান্ত কে বলেছে? যত্তসব গাঁজাখুরি। ওরে ভাইরে, ধর্ম
আঁকড়ে ধরলে কি সমাজে টেকা যায়, না উন্নতি করা যায়? তুই যদি ধর্ম না মানিস, তা হলে তুই কে? হিন্দুও না, মোছলমানও না, কুষ্ঠরোগীর মতন অস্পৃশ্য! আমি এখন দিনে পাঁচ ওয়ক্ত নামাজ পড়ি, এই শরীরে আল্লার করুণার স্পর্শ পাই! ভাল কথা, তুই কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছিলি? যাদুগোপালের কাছে একদিন তোর কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম, সেও কোনও সন্ধান জানে না।
ভরত বলল, একটা চাকরি পেয়ে চলে গিয়েছিলাম কটকে।
ইরফান বলল, এখনও সেখানে থাকিস? কলকাতায় কাজে এসেছিস?
ভরত বলল, না, কংগ্রেসের অধিবেশন দেখতে এসেছিলাম।
মুখের মধ্যে যেন হঠাৎ একটা গন্ধ-পোকা ঢুকে গেছে, এই ভাবে ওষ্ঠ বিকৃত করে ইরফান বলল, কংগ্রেস! তুই বুঝি কংগ্রেসি হয়েছিস শালা? আর মোছলমানরা যাতে কংগ্রেসে যোগ না দেয়, আমি সেটাই প্রচার করছি।
শেষ বেল বেজে উঠল, আর সময় নেই, এখনি নাটক শুরু হয়ে যাবে। দুজনের বসার আসনও এক জায়গায় নয়।
ভেতরের দিকে যেতে যেতে ইরফান বলল, তুই একদিন আয়, ভরত, তোর সঙ্গে অনেক কথা আছে। বড় ভাল লাগল তোকে দেখে। সৈয়দ আমির আলির যে বাড়িতে আমি একসময় আশ্রিত ছিলাম, তোর মনে আছে? সেই বাড়িটা আমি কিনে নিয়েছি। ওদের অবস্থা পড়ে গিয়েছিল, বেশ সস্তাতেই পাওয়া গেছে। মুর্শিদাবাদের পাট চুকিয়ে দিয়েছি, এখন এখানেই আমার আস্তানা।
তারপর ভরতের দিকে তাকিয়ে ইরফান নিঃশব্দে এমনভাবে হাসল, যে-হাসির মর্ম কলেজ জীবনে দরিদ্র, পরাশ্রয়ী ইরফানকে যারা দেখেছে, তারাই শুধু বুঝবে!
বারো টাকার সবচেয়ে দামি আসনে অন্যান্য দর্শকদের মাঝখানে ভরতকে বড়ই বেমানান লাগে। আর সকলেরই অঙ্গে ঐশ্বর্যের তকমা লাগানো, তারা আড়চোখে হংসদের মধ্যে বকের মতন ভরতকে দেখছে। ভরত ভ্রুক্ষেপ করল না।
ড্রপসিন ওঠার পর থেকেই বোঝা যায় ক্লাসিকের সঙ্গে অন্যান্য থিয়েটারের কত তফাত। মঞ্চসজ্জা, আলো পশ্চাৎপট সবই নতুন ধরনের। কনসার্ট বাজনাও শ্রবণ-সুখকর। লোকে মুখে মুখে কৃষ্ণকান্তের উইল বললেও এই নাটকের নাম ‘ভ্রমর’। নাট্যরূপ দিয়েছে স্বয়ং অমরেন্দ্রনাথ দত্ত, নায়ক গোবিন্দলালের চরিত্রেও সে নিজে। রোহিণীর ভূমিকায় নয়নমণি, ভ্রমর সেজেছে তিনকড়ি দাসী। এই সব নট-নটীই ভরতের অপরিচিত।
কিছুক্ষণ নাটক চলার পর প্রথম বিস্ময়ের আঘাতটা তেমন তীব্র ভাবে আসেনি। রোহিণীর অভিনয় দেখতে দেখতে তার একসময় মনে হল, মুখের আদলটা কেমন যেন চেনা চেনা। একটু পরে সে বুঝতে পারল, এ রকম মনে হবার কারণ কী। তার স্ত্রী মহিলামণির সঙ্গে এই রমণীর মুখের বেশ মিল আছে, বিশেষত এক পাশ ফিরলে মহিলামণিই মনে হয়।
অন্যমনস্ক হয়ে গেল ভরত, নাটক দেখার দিকে আর মন রইল না। মনে পড়তে লাগল তার পরলোকগতা স্ত্রীর কথা। বড় বাঁচার আকাঙ্ক্ষা ছিল মহিলামণির। জীবনটাকে সে বেশ সুন্দর সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখতে চেয়েছিল, প্রবল ঝড়ের ফুঙ্কারে সব উড়ে গেল! ভরতের সঙ্গে যদি নিজের ভাগ্যটা জড়িয়ে না নিত, তা হলে মহিলামণিকে হয়তো পৃথিবী থেকে অত তাড়াতাড়ি বিদায় নিতে হত না। ভরতের জীবনটাই যে অভিশপ্ত! একটি পুত্র সন্তান রেখে গেছে মহিলামণি, মামাদের বাড়িতে সে বর্ধিত হচ্ছে, সে কেমন আছে কে জানে! ভরত ইচ্ছে করেই তাকে দেখতে যেতে চায় না।
মঞ্চের রোহিণী একটা গান গেয়ে উঠতেই ভরতের বুকে কে যেন সজোরে একটা মুষ্ট্যাঘাত করল। এতক্ষণ কী ভুল ভাবছে সে! মহিলামণিকে সে চিতায় পুড়ে যেতে দেখেছে। রোহিণীবেশী এই রমণীর সঙ্গে মিল তো ভূমিসূতার। ভূমিসূতার মতন মুখের আদল দেখেই তো সে মহিলামণির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল।
ভূমিসূতা! এক অপমানিতা মানবী, দুঃখে-অভিমানে-ক্রোধে সে একদিন অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। এই কি সেই ভূমিসূতা? সে নাচ জানত, গান জানত। ভরতের মতনই সে ছিল ভাগ্যহীনা, রূপ-গুণ ছিল তার অভিশাপ। এই দুই ভাগ্যহীন-ভাগ্যহীনা এক সঙ্গে মিলতে চেয়েছিল, পৃথিবীর আর সব মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে বাধা দিয়েছে।
পাশের দর্শকটির দিকে ফিরে ভরত জিজ্ঞেস করল, মহাশয়, রোহিণীর পার্টে যে নেমেছে, ওর নাম কী?
করুণ দৃশ্য দেখে লোকটির চোখ ছলছল করছে, সে ধরা গলায় বলল, চুপ, চুপ। নয়নমণিকে চেনেন না, মোসাই নতুন বুঝি কলকেতায়? বাঙালদেশ থেকে আসছেন?
আশপাশ থেকে আরও কয়েকজন বলে উঠল, সাইলেন্ট, নয়নমণির গানটা শুনতে দিন।
নয়নমণি না ছাই, এ নির্ঘাত ভূমিসূতা। ভরতের ভুল হতেই পারে না। ওই কণ্ঠস্বর কি সে জীবনে ভুলতে পারে?
ভরত বসে আছে দোতলায়, তার ইচ্ছে হল উঠে গিয়ে রেলিং ধরে সে চিৎকার করে ডাকে, ভূমিসূতা, ভূমিসূতা! এই যে আমি এখানে।
কিন্তু এ রকম কিছু করলে লোকে তাকে পাগল বলবে, ঘাড় ধরে বার করে দেবে। সে অধীরভাবে নাটক শেষ হবার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।
সেই লাজুক, নতমুখী ভূমিসূতা এমন দাপটের সঙ্গে অভিনয় করে যাচ্ছে, এই রূপান্তর এক একসময় অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। আবার এক একবার মনে হয়, ভূমিসূতা যেন ভরতকে দেখতে পেয়েছে, ওপরের দিকে মুখ তুলে ভরতের দিকে তাকিয়েই পার্ট বলে যাচ্ছে।
মঞ্চে অনেক রকম কেরামতি দেখাল অমর দত্ত। মস্তবড় একটা ঘোড়ায় চড়ে এল একবার, দর্শকদের মাতালো, কাঁদালো। পুকুরে ডুবে আত্মহত্যা করতে গেল রোহিণী, সেখানে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে উদ্ধার করতে গেল গোবিন্দলাল, জল ছিটকে এসে স্টেজ ভিজিয়ে দিল। ভরত এ সব কিছুই দেখছে না। সে থরথর করে কাঁপছে। আবার ভূমিসূতাকে ফিরে পাবার সম্ভাবনাই যেন তার কাছে আশাতীত মনে হচ্ছে, সত্যি সত্যি ফিরে পেলে কী হবে?
নাটক শেষ হল, দর্শকরা হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানাল বেশ কয়েক মিনিট ধরে। ভিড় ঠেলে সহজে নীচে নামা যায় না। ধাক্কাধাক্কি করতে গেলে বিরক্ত হয়। ভরতকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গ্রিন রুমে পৌঁছতেই হবে। প্রথম চারিচক্ষু মিলনের পর তাকে কী বলবে ভূমিসূতা?
গ্রিন রুম পর্যন্ত যেতে হল না। আজ যেন বিশেষ তাড়া আছে নয়নমণির, ভাল করে মুখের রং না ধুয়েই সে বেরিয়ে পড়েছে, সারা শরীরে একটা কালোরঙের শাল জড়ানো, মুখখানিও অনেকটা ঢাকা। তবু অনেক দর্শক ছুটছে তার পিছুপিছু দু-তিনজন যুবক হাত ধরাধরি করে তাকে আড়াল করে আছে।
গেটের ঠিক সামনেই অপেক্ষমাণ একটি সুসজ্জিত জুড়িগাড়ি। ভরত সে দিকে ছুটে গেল। ভক্ত দর্শকরা নয়নমণিকে ভাল করে দেখবার জন্য রীতিমতন হুড়োহুড়ি শুরু করে দিয়েছে চ্যাঁচাচ্ছে, ভরত সেই ভিড় ভেদ করতে পারছে না, সে ভূমিসূতার নাম ধরে ডাকলেও তা শুনতে পাবার কথা নয়।
একটি অতি সুদর্শন যুবক নয়নমণির হাত ধরে তুলল সেই জুড়িগাড়িতে, তারপর নিজেও সে বসল তার মুখোমুখি। দেহরক্ষীরা ঠেলে ঠেলে সরিয়ে দিল সকলকে। নয়নমণি একবার ভরতকে দেখতে পেল কি পেল না বোঝা গেল না। চলতে শুরু করল গাড়ি।
ভরতকে কেউ যেন একটা থাপ্পড় কষিয়েছে। অপমানে বিবর্ণ তার মুখ। কী ভুল সে করতে যাচ্ছিল! এই নয়নমণি যদি সেই ভূমিসূতা হয়, তা হলে তার সামনে সে দাঁড়াবে কোন পরিচয়ে? ভূমিসূতাকে সে একদিন চরম অপমান করেছিল। সেই ভূমিসূতা আজ কত সার্থক, রূপ আরও খুলে গেছে, কত জনপ্রিয় সে! সেই তুলনায় ভরত সব দিক থেকে একজন ব্যর্থ মানুষ, জীবনের কাছে পরাজিত। ভূমিসূতার কাছে এখন তার ক্ষমা চাওয়ারও কোনও মূল্য নেই।
একটু পরে ফাঁকা হয়ে গেল রাস্তা। তবু কিছুক্ষণ সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল ভরত। রাত হয়েছে অনেক, কাছাকাছি একটাও ভাড়ার গাড়ি দেখা যাচ্ছে না। ঈষৎ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করল ভরত। শুনশান পথ, সে একাই হাঁটছে।