আবিদ হোসেনের ঘরে আজ অতীন আর সোমেনের নেমন্তন্ন। আবিদের বাবা আর মা চট্টগ্রাম থেকে পালিয়ে, কলকাতায় কিছুদিন থেকে সদ্য এদেশে এসে পৌঁছেছেন। আবিদের দুশ্চিন্তা দূর হয়েছে। অবশ্য তার ছোট দুই ভাই যোগ দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধে, তাদের জন্য উদ্বেগ থেকে যাবেই।
আবিদের মা রান্না করে খাওয়াবেন, ওদের কাছে কলকাতার নতুন খবর শোনা যাবে, সুতরাং সন্ধ্যার নিমন্ত্রণটি বেশ আকর্ষণীয়ই মনে হয়েছিল অতীনের। কিন্তু একটা মুশকিল হলো এই যে আবিদ বাড়িওয়ালা সত্যদা এবং তাঁর স্ত্রী মার্থাকেও নেমন্তন্ন করে গুবলেট পাকিয়েছে। সত্যদা অত্যন্ত ফল, নিজের বাড়িতে ভাড়াটের কাছে বাংলা খাবার খেতেও তিনি আসবেন সুট ও বো পরে, তিনি ধোঁয়ার গন্ধ সহ্য করতে পারেন না বলে তাঁর সামনে সিগারেট টানা চলবে না। তিনি উপস্থিত থাকলে কেউ সোফায় পা মুড়ে বসতেও সাহস পায় না। মার্থা থাকার জন্য আর একটা ঝামেলা। মার্থা এমনিতে বেশ হাসিখুশি ভালো মহিলা, কিন্তু তার সামনে বাংলায় কথা বলা অভদ্রতা। কিন্তু বাকি সবাই বাঙালী, সকলেই মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী, কলকাতার গল্প শুনতে আগ্রহী, কিন্তু সে সব বলতে হবে ইংরিজিতে, এ কী অত্যাচার!
নিউ ইয়র্কে এবং কেমব্রিজেও বিভিন্ন বাঙালী বাড়ির সান্ধ্য আসরে অতীন লক্ষ করেছে, কেউ যদি মেম বউ নিয়ে আসে, তাহলে অন্যরা বিরক্ত হয়। রাস্তায়-ঘাটে, দোকানে, অফিসে বা কলেজে সর্বক্ষণই তো ইংরিজি বলতে বলতে ঠোঁট ব্যথা হয়ে যায়, উইক এন্ডের নেমন্তন্নগুলো তো বাংলায় প্রাণ খুলে আড্ডা দেবার জন্যই। যারা মেম বিয়ে করে, তারা কি এটা বোঝে না? কোনো একটা বাংলা রসিকতা ইংরিজিতে অনুবাদ করতে প্রাণ বেরিয়ে যায়। আসলে, যে মেম বিয়ে করেছে সেও আসে ভাত-মাছের ঝোল খাবার লোভে। নিজের বাড়িতে ঐ রান্না বিশেষ হয় না। কিন্তু অন্যের বাড়ির নেমন্তন্নে বউকে বাড়িতে ফেলে আসাও যায় না, সেটা সাঙ্ঘাতিক অভদ্রতা!
সোমেন তো আবিদকে বলেই ফেলেছিল যে, সত্যদা আর মাথাকে নেমন্তন্ন করার দরকার নেই! কিন্তু বাড়িওলাকে খাতির না করলে চলে না। আবিদের আরও বেশি খাতির করার কারণ, সত্যদা কোনো ভাড়াটের ঘরেই একজনের বেশি দু-জনকে থাকতে দিতে রাজি নন। ভাড়াটেরা তাদের গার্ল ফ্রেন্ডদের ঘরে নিয়ে আসতে পারে। কিন্তু তাদের নিয়ে রাত্রিবাস করা চলবে না। এই নিয়মরক্ষার ব্যাপারে সত্যদা এবং মাথা দু-জনেই খুব কঠোর। এখন আবিদের বাবা-মা ছেলের ঘরেই এসে উঠেছেন। এতেও সত্যদার আপত্তি। তিনি আবিদকে বলেছিলেন, বাবা-মাকে কোনো মোটেলে রাখো। এখানে অন্য সবাই ছাত্র, পড়াশুনো করে, আর তুমি বাবা-মাকে নিয়ে সংসার পেতে বসবে, তা তো ঠিক নয়! কিন্তু আবিদের বাবা-মা বিপদে পড়ে এখানে এসেছেন, তাঁদের কাছে ফরেন এক্সচেঞ্জ বিশেষ নেই, হোটেল-মোটেলে কতদিন থাকবেন? তা ছাড়া আবিদের মা ছেলেকে ছেড়ে অন্য কোথাও থাকতে একেবারেই রাজি নন।
আবিদ রীতিমতন কাকুতি-মিনতি করে সত্যদার কাছ থেকে সম্মতি আদায় করেছে।
আবিদের মা ইংরিজি জানেন না, এই যা রক্ষা। ইংরিজি না জানলেও ইংরিজিতে কথা বলতে হবে, এ রকম কোনো বাধ্যবাধকতা থাকতে পারে না, সেই সুযোগ নিয়ে সোমেন তাঁর সঙ্গে সাড়ম্বরে বাংলায় গল্প চালিয়ে যেতে লাগলো। সে প্রথমেই জিজ্ঞেস করলো, মাসিমা, কী কী রাধছেন, আগে থিকা কইয়া দ্যান তো! আলু-পটলের ডালনা? আপনেরা পটল লইয়া আসছেন শুনছি। কতদিন যে পটল খাই নাই। আর পাঁচফোঁড়ন দেওয়া ডাইল।
কথা বলতে বলতে সে একবার অতীনের দিকে চোখ টিপে বললো, এই সব কথা ইংরিজিতে অনুবাদ করতে গেলে প্রাণটি বেরিয়ে যেত ভাই!
সুতরাং অতীনকেই মার্থার সঙ্গে কথা বলার দায়িত্ব নিতে হলো।
মার্থা জিজ্ঞেস করলো, বাবলু, ইজ নট মিলি কামিংত?
স্ত্রী না হলেও স্টেডি গার্ল ফ্রেন্ডদের নেমন্তন্ন করার প্রথা আছে এদেশে। আবিদ হোসেন অবশ্য শর্মিলাকে বলেনি, একখানা ঘরের মধ্যে কতজনকে আর ডাকা যায়! তাছাড়া, জাস্টিস আবু সয়ীদ চৌধুরী এবং আরও দু’জনের আসার কথা আছে, এরা বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থা। বোঝাবার জন্য পৃথিবীর বহু দেশে ঘুরছেন, নিউ ইয়র্কে রাষ্ট্রপুঞ্জেও ভাষণ দিয়েছেন।
শর্মিলার অবশ্য আজ এমনিতেই অতীনের কাছে আসবার কথা আছে। সে এসে পড়লে পার্টিতে যোগ দেবে, কোনো অসুবিধে নেই।
অতীন বললো, শী ইজ সাপোজড টু কাম। শী সেইড শী উড বী আ বিট লেইট!
মার্থা বললো, বড় সুমিষ্ট স্বভাবের মেয়েটি। ওকে আমি খুব পছন্দ করি। আচ্ছা বাবলু, ঐ আবিডের মতন তুমিও কি ইস্ট পাকিস্ট্যানের, আই মিন, এখন যাকে ব্যাংলাডে বলা হচ্ছে, সেখানকার মানুষ?
অতীন একটু দ্বিধা করে বললো, না!
তার বাবার বাড়ি পূর্ববঙ্গে ছিল, বাবার জন্ম সেখানে, কিন্তু অতীন তো পূর্ববঙ্গে জন্মায় নি। সেখানকার কোনো স্মৃতিও তার নেই।
মার্থা জিজ্ঞেস করলো, তা হলে আবিদের দেশের সঙ্গে তোমার দেশের সম্পর্কটা ঠিক কী? ইস্ট জামানি-ওয়েস্ট জার্মানির মতন?
অতীন বললো, না, ঠিক তাও নয়। বলা শক্ত!
সত্যিই তো শক্ত! সম্পর্কটা আসলে কী? পশ্চিম জার্মানি এখনো মনে করে, দেশবিভাগটা আসলে অবাস্তব। পূর্ব জামানি আবার ফিরে আসবে, জার্মান জাতি এক হবে। পশ্চিম বাংলায় কি কেউ এ রকম মনে করে? না, দেশবিভাগটাই এখন কঠোর বাস্তব। পূর্ব জার্মানি কোনোদিনই আর ক্যাপিটালিস্ট জামানির সঙ্গে যোগ দেবে না। বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও পশ্চিম বাংলার সঙ্গে সম্পর্ক কী হবে? পাকিস্তানী আমলের সব বিধিনিষেধ উঠে যাবে?
অতীন খানিকটা ভাসা ভাসা ভাবে বললো, আমাদের দু’দিকের ল্যাঙ্গোয়েজ অ্যান্ড কালচারের অনেক মিল আছে, বিশেষত ল্যাঙ্গোয়েজের মিলটাই খুব বড় একটা টান, তাই না?
মার্থা মাথা নেড়ে বললো, না, আমি তা মনে করি না!
মার্থা অবশ্য তার বক্তব্য ব্যাখ্যা করলো না। সে প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে ফেললো। এইটাই মার্থার একটা বৈশিষ্ট্য, সে এক বিষয়ে বেশিক্ষণ কথা বলে না। সে হঠাৎ হেসে বললো, তুমি একটা লাল রঙের ফোর্ড গাড়ি কিনেছো? আমাদের কিছু বলোনি?
অতীন একটু শঙ্কিত হলো। হাসি মুখে বললেও এটা কি মাথার অভিযোগ?
মাত্র দিন সাতেক আগে গাড়িটা কিনেছে অতীন। সোমেনের বান্ধবী লিন্ডা ইসকনের সদস্যা হয়ে চলে গেছে লস এঞ্জেলিস, যাওয়ার আগে সে, তার গাড়িটা বিক্রি করে দিয়ে গেছে একেবারে জলের দামে। সোমেনের পীড়াপীড়িতেই অতীন সেটা কিনে নিয়েছে তিনশো ডলারে, সে পুরো টাকাটাও অতীনের কাছে ছিল না, সোমেন ধার দিয়েছে।
এ দেশে সবাই রাত্তিরবেলা বাড়ির সামনের রাস্তায় গাড়ি ফেলে রাখে। কিন্তু অতীন প্রথম তিন দিন অতি সাবধানতায় গাড়িটাকে ঢুকিয়ে রেখেছিল গেটের মধ্যে। সত্যদা একদিন আপত্তি করেছিলেন, ভোরবেলা তাঁর নিজের গাড়ি বার করতে অসুবিধে হয়।
অতীন বললো, গাড়িটা তো আমি এখন বাইরেই রাখছি!
তার বাহুতে একটা চাপড় মেড়ে মার্থা বললো, সে কথা বলছি না। গাড়ি বাইরে রাখবে না। কি বেডরুমে রাখবে। কিন্তু তোমার গাড়িতে একদিনও আমাকে চড়ালে না তো! একদিন তোমার গাড়িতে আমি শপিং করতে যাবো।
অতীন বললো, অবশ্যই, অবশ্যই!
মার্থার সঙ্গে কথা বলতে হলেও অতীন কান খাড়া করে অন্যদের কথা শুনছে। আবিদের বাবা এবং মা দু’জনেই খুব প্রশংসা করছেন কলকাতার। কলকাতার মানুষেরা খুব সজ্জন, কলকাতার ট্রামবাস ভালো, কলকাতায় নানা রকম খাবার পাওয়া যায়, কলকাতায় সিনেমায় নাইট শো দেখে সবাই হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফেরে। কোনো ভয় করে না।
অতীনের কেমন যেন সন্দেহ হতে লাগলো। কলকাতার গুণগান আজকাল শোনাই যায়ত না। তাছাড়া, সত্যিই তো কলকাতার ট্রামবাস মোটেই ভালো নয়, সব রকম খাবার দূরের কথা, মাঝে মাঝে চালই পাওয়া যায় না। তবু আবিদের বাবা-মা এত প্রশংসা করছেন, দেশত্যাগী হয়ে তাঁরা বাধ্য হয়ে কলকাতায় আশ্রয় নিয়েছিলেন বলে।
সত্যদা নিজের স্ত্রীকে অতীনের কাছে গছিয়ে দিয়ে এখন ওদের সঙ্গে দিব্যি বাংলায় গল্পে মেতে উঠেছেন। তাঁর মতন একজন সাহেব মানুষেরও যে কলকাতা সম্পর্কে এত আগ্রহ, তা আগে বোঝা যায়নি।
সত্যদা বললেন, ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি, বুঝলেন, এখনো মরা হাতি লাখ টাকা! ইন্ডিয়ার অন্য ইউনিভার্সিটির তুলনায় এখনো এদেশে ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির ডিগ্রির বেশি দাম দেয়।
অতীন জানে, একথাটাও সত্যি নয়। সত্যদা যখন এদেশে প্রথম আসেন, তখন হয়তো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সুনাম অক্ষুণ্ণ ছিল, এখন অতীন এখানকার বিশ্ববিদ্যালয় পরিবেশে কারুর কাছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুখ্যাতি শোনেনি। বরং তার ডিপার্টমেন্টের একজন। অধ্যাপক কিছুদিন বসু বিজ্ঞান মন্দিরে কাজ করতে গিয়েছিলেন, তিনি ফিরে এসে বলেছেন, তোমাদের কলকাতায় কেউ তো গবেষণা বা সিরিয়াস পড়াশুনোর কাজকর্ম করে না। সবাই পলিটিক্স করে। হায়, তারা যদি পলিটিক্সটাও ভালো বুঝতো!
আবিদের বাবা সাঈফ সাহেব বললেন, আরে মশায়, আমিও তো ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট। ফটিতে বি-এ পাস করছি। বেকবাগানের একটা বাড়িতে থাকতাম, সেই বাড়িখান এখনো একই রকম আছে। আমার ওয়াইফরে দেখাইতে নিয়া গ্যালাম একদিন।
আবিদের মা নাসিম বেগম বললেন, আমার সব থিকা ভালো লাগছে, কলকাতার দোকান বাজারে গ্যালেই জয় বাংলার মানুষ শোনোনেই সবাই কত খাতির করে, কোল্ড ড্রিংকস আইন্যা দেয়, দাম কমায়, কেমন আপন আপন ভাব। অথচ পাকিস্তানী আমলে ভাবতাম, ইন্ডিয়ার সকলেই বুঝি আমাগো শত্তুর!
অতীন অনেকক্ষণ চুপ করে আছে দেখে মাথা একটু গলা চড়িয়ে সকলের উদ্দেশে জিজ্ঞেস করলো, আমি একটা কথা জানতে চাই। এখন প্রায়ই খবরের কাগজে আর টেলিভিশনে ইস্ট পাকিস্ট্যানের নানান রকম খবর থাকে। এডোয়ার্ড কেনেডি গিয়ে দেখে এসেছে যে সত্যিই কয়েক মিলিয়ান রেফিউজি সেখান থেকে ইন্ডিয়া চলে এসেছে। এখন তোমরা কি মনে করো, ইন্ডিয়া যদি প্যাকিস্ট্যানের সঙ্গে যুদ্ধ লাগায়, সেটাই একমাত্র সলিউশান!
সাঈফ সাহেব এবং সোমেন একসঙ্গে বলে উঠলো, অফ কোর্স! যুদ্ধ ছাড়া এই বর্বরতাকে আর কিছুতেই দমন করা যাবে না।
আবিদ নিজে চার-পাঁচ মাস আগে পর্যন্ত ছিল প্রবল পাকিস্তানের সমর্থক, এখন তার মতামত সম্পূর্ণ উল্টে গেছে, সে জোর দিয়ে বললো, শুধু ইন্ডিয়া কেন, ওয়ার্ল্ডের সব পাওয়ারেরই উচিত পাকিস্তানকে একটা উচিত শিক্ষা দেওয়া। যাতে ওরা আর কোনদিনই আর্মি দিয়ে সিভিলিয়ানদের ওপর অত্যাচার করতে না পারে।
মার্থা খুব সরলভাবে বললো, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে এদেশে কত প্রতিবাদ আর মিছিল হয়। আমাদের ইয়াং জেনারেশন যুদ্ধ চায় না। শান্তি চায়। আর তোমরা তোমাদের দুই গরিব দেশে যুদ্ধ লাগাতে চাইছ? তোমরা ওয়ার মংগার?
এবার অতীন পর্যন্ত বলে উঠলো, তোমার এই তুলনাটা অত্যন্ত বোকার মতন হলো, মার্থা! ভিয়েতনামে যেটা চলছে, সেটা একটা ইমমরাল ওয়ার। তোমরা অ্যামেরিকানরা চোদ্দ-পনেরো হাজার মাইল উড়ে গিয়ে নর্থ ভিয়েতনামে বোমা ফেলছো, নাপাম গ্যাস দিয়ে তোক মারছো! আর ইস্ট পাকিস্তানে চলছে একটা বেঁচে থাকার লড়াই, প্রতিরোধ না করলে লোকরা মরতেই থাকবে!
মার্থা বললো, সব যুদ্ধই ইমমরাল। আমি কোনো যুদ্ধই সমর্থন করি না। আমি এখনো মনে করি, যুদ্ধের বদলে আলোচনার টেবিলেই এই সমস্যার সমাধান করা উচিত!
তারপর শুরু হয়ে গেল তর্ক!
নাসিম বেগম ইংরিজি না বুঝলেও এটা জানেন যে অ্যামেরিকান সরকার এখনও পাকিস্তানের সামরিক শাসকদেরই সমর্থক। তাঁর চোখে সব অ্যামেরিকানই এক। তিনি মার্থাকে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের মাসতুতো বোন ধরে নিয়ে এমনই চটে গেলেন তার ওপরে যে তাকে তিনি খাবার পরিবেশনই করতে রাজি হলেন না। তিনি বললেন, আবিদ, তুই ঐ ম্যামডারে প্লেট দে। আমি দিমু না!
আবিদের অন্য অতিথিরা শেষ পর্যন্ত এলো না, শর্মিলা ন’টার পর অতীনকে খুঁজতে এসে এখানে যোগ দিল।
নাসিম বেগম এতক্ষণ পর একটি বাংলা বলা মেয়েকে পেয়ে খুব আদর করতে লাগলেন। বাঙালী মহিলাদের স্বভাবই এই, অচেনা কারুকে পছন্দ হলে অমনি তার সঙ্গে চেনাশুনো কারুর মুখের মিল পেয়ে যায়। নাসিম বেগমও শর্মিলাকে দেখেই বললেন, যে তাকে নাকি দেখতে অবিকল তাঁর খালাতো বোনের মতন। সেই খালাতো বোনের কোনো সংবাদ নেই।
নাসিম বেগম শর্মিলার গায়ে হাত বুলিয়ে স্নেহের সঙ্গে বলতে লাগলেন, কইলকাতার মেয়েরা কী লক্ষ্মী। অফিসে কাজ করে, আবার বাসায় এসে রান্না করে স্বামীপুত্র কন্যাদের খাওয়ায়, যত্ন করে, বাড়িতে ঝি-চাকরও রাখে না। সব নিজেরা করে। তিনি এলগিন রোডে এক হিন্দু ভদ্রলোকের বাড়িতে দাওয়াত খেতে গিয়েছিলেন, সে বাড়ির পাঁচটি মেয়ে, প্রত্যেকেই এক একটি রত্ন, যেমন লেখাপড়ায় ভালো, তেমন কাজে কম্মে…
অতীন পাশে এসে বললো, এ কিন্তু কলকাতার মেয়ে নয়। জামসেদপুরের। বিহারী! কলকাতার মেয়ে হচ্ছে অলি। ইস, আজ যদি অলি এখানে উপস্থিত থাকতো, সে কত খুসী হলে!
এত কলকাতা নিয়ে আলোচনার জন্যই অলির কথা বার বার মনে পড়ছে অতীনের। অলি এখন কী করছে? মেরিল্যান্ডের মস্ত বড় একটা বাড়িতে অলি একা থাকে। এর আগে তো কোনোদিন সে এমন একা থাকে নি।
বিরিয়ানিও আছে, সাদা ভাতও আছে। ডালও আছে, বুরহানিও তৈরি করেছেন নাসিম বেগম। স্যামন মাছের ঝোল আর মুগির রোস্ট। তিন চার রকমের সবজির তরকারি। রান্না অতিশয় উৎকৃষ্ট। বাবা-মা আছেন বলেই আবিদ হোসেন মদ-টদ কিছু সার্ভ করেনি আগে। অতীন আর সোমেন সেটা জানতো বলেই নিজেরা আগে থেকে একটুখানি পান করে এসেছে। বেশি নেশা করে এলে খাবার খেতে ইচ্ছে করে না, অল্প নেশায় খিদে বাড়ে। তবু অতীন প্রায় কিছুই খেল না। অযৌক্তিকভাবে তার একটা কথাই বার বার মনে পড়ছে, অলি কেন এখানে নেই? অলির থাকা উচিত ছিল!
খাওয়া-দাওয়া শেষ হবার পরই সত্যদা আর মাথা বিদায় নিল। সত্যদা ঠিক দশটা বেজে পনেরো মিনিটে ঘুমোতে যান। পাক্কা সাহেব হলেও তিনি আজ একটু বিচলিত হয়েছিলেন। প্রায় সতেরো-আঠারো বছর তিনি দেশে যাননি, দেশের সঙ্গে তাঁর কোনো যোগাযোগই নেই। প্রায়, তবু আজ আবিদ হোসেনের বাবার মুখে বাঙাল ভাষা শুনে তাঁর মুখ দিয়েও কিছু কিছু বাঙাল ভাষা বেরিয়ে আসছিল। কুমিল্লার নানান লোকজনের খবরাখবর নিচ্ছিলেন তিনি। মাঝে মাঝে তাঁর মুখে একটা অদ্ভুত বিষাদের রেখা ফুটে উঠছিল। সতেরো বছর পরেও এ রকম থাকে!
ওঁরা দু’জন চলে যাবার পর সোমেন হাঁপ ছেড়ে বললো, যাক, বাঁচা গেল! উফ! এই মাথাটা এমন ইডিয়েট, ভিয়েতনাম যুদ্ধের সঙ্গে…।
শর্মিলা কাতরভাবে বললো, এই, ও রকম করে বলো না! মার্থা খুবই কাইন্ড হার্টেড মহিলা। কখনো কারুর নামে খারাপ কথা বলেন না।
সোমেন বললো, দেখো শর্মিলা, কাইন্ড হার্টেড মহিলারাও গ্রেট বোর হতে পারে। তুমি তো সবাইকেই ভালো দেখো। কিন্তু আমরা কি নিরিবিলিতেও একটু অ্যামেরিকানদের চুটিয়ে গালাগাল দিতে পারবো না? সেখানেও একজন আমেরিকান মহিলা বসে থাকলে তোমাকে আর একটা কথা বলি শোনো। কানে খাটো লোকেরা অনেক কথা শুনতে পায় না। কিন্তু তুমি তাদের শালা কালা বলো, অমনি ঠিক বুঝতে পারবে। সেই রকমই, যেসব ধলা মেয়েরা বাঙালীদের বিয়ে করেছে, তারা বাংলা বুঝতে পারে না। কিন্তু তুমি বাংলায় খুব সাঁটে সাহেবদের নিন্দে করে দেখো না, ওরা ঠিক ধরে ফেলবে! সেটা বোঝে!
শর্মিলা বললো, ওদের সামনে নিন্দে করার দরকারটাই বা কী?
সোমেন বললো, ওরা আমাদের দেশে আমাদের নিন্দে করে না? অবশ্য ওরা সেটা গোপন রাখার চেষ্টাও করে না, আমরা শালা ভিখিরির জাত—
আরও কিছুক্ষণ আড্ডা হলো, কিন্তু অতীন গুম হয়ে গেছে, সে শুধু দেখছে মেরিল্যান্ডের সেই বাড়িটা, একতলা পুরো অন্ধকার, আটিস্ট মহিলাটি বিদেশে গেছেন। পাশের দিকে দোতলার একটি ঘরে অলি একা। চোর-ডাকাত আসতে পারবে না। বার্গলার্স অ্যালার্ম দেওয়া আছে, তবু নিছক একাকিত্বেরই কি একটা কষ্ট নেই?
শর্মিলা প্রায়ই ফোন করে খবর নেয়। কিন্তু অলি নিজে থেকে একবারও ফোন করেনি অতীনকে।
এক সময় পাটি ভাঙলো। এখন অতীনের গাড়ি আছে, শর্মিলাকে তার বাড়ি পৌঁছে দেওয়া উচিত। রাত মাত্র সাড়ে দশটা। এখন একটা লং ড্রাইভেও যাওয়া যায়।
বাড়ির সামনের রাস্তাটা পেরিয়ে যাবার পর শর্মিলা বললো, বাবলু, আজ একবার লংফেলো ব্রীজে যাবে? সেই সেবারের ঘটনার পর ওদিকে আর আমরা কখনো যাইনি! অতীন শুকনো গলায় বললো, আজ থাক। আজ আমার ঘুম পাচ্ছে!
শর্মিলা ব্যস্ত হয়ে বললো, ওমা, তোমার ঘুম পাচ্ছে, তা হলে তুমি গাড়ি বার করলে কেন? আমি ট্যাক্সিতে চলে যেতে পারি।
অতীন কোনো উত্তর দিল না। সে খুব জোরে একটা মোড় ঘুরলো।
শর্মিলা বললো, বাবলু, তুমি আমাকে পৌঁছে দিয়ে গাড়ি চালিয়ে একলা ফিরবে, আমার একটা চিন্তা থাকবে।
অতীন বললো, তোমাকে কতবার বলেছি, মিলি, আমার অ্যাকসিডেন্টে মৃত্যু নেই? আই হ্যাভ আ চামড় লাইফ!
শর্মিলা বললো, অত গর্ব করা ভালো নয়। তারপর কিছুক্ষণ চুপচাপ। শর্মিলা কোনো কথা বললেও অতীন শুধু ই-হাঁ করে যায়। শর্মিলা তো অতীনের নাড়ি-নক্ষত্র জানে, সে বুঝলো, আজ অতীনের কিছু গোলমাল হয়েছে! সে পৌঁছোবার আগেই ওই পার্টিতে অতীন কারুর সঙ্গে ঝগড়া করেছে নাকি?
কিন্তু এখন সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা ঠিক নয়। দু’দিন পর অতীনের কাছ থেকে পুরো ব্যাপারটা জানা যাবে।
প্রসঙ্গ বদলাবার জন্য সে বললো, বাবলু, তুমি আমার শাড়িটা দেখে কিছু বললে না যে? আমি একটা নীল শাড়ি পরে এসেছিলুম। আবিদের মা আমাকে একটা শাড়ি দিলেন। প্রায় জোর করে সেটা পরে তাঁকে দেখাতে বললেন। খুব চমৎকার জামদানি!
শাড়ি বিষয়ে কোনো মন্তব্য না করে অতীন হঠাৎ হেঁড়ে গলায় গান জুড়ে দিল। তু লাল পাহাড়ীর দেশে যা। রাঙা মাটির দেশে যা! হেথায় তুরে মানাইছে না গ! ইক্কেবারে মানাইছে না গ!
শর্মিলা বললো, এটা আবার কী গান?
অতীন বললো, এটাই আমার এখন ন্যাশনাল সঙ! আমার কি কেমব্রিজে গাড়ি চালানোর কথা?
শর্মিলাকে পৌঁছে দেবার সময় তাকে একবারও চুমু খেল না অতীন। ফেরার সময়েও তার ঠোঁটে ঐ একই গান। আজ যে বার বার অলির কথা মনে পড়ছে, সে কথা শর্মিলাকে বলা যায় না। আবার শর্মিলাকে বলতে পারলো না বলেও তার কষ্ট হচ্ছে।
গাড়িখানা পার্ক করার পর অতীন সোমেনের দরজার সামনে একবার দাঁড়ালো। আলো নিবে গেছে, সোমেন এত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লো? তার এখনো আড্ডা মারতে ইচ্ছে করছে। আবিদের কাছে যাওয়ার কোনো মানেই হয় না!
ওপরে নিজের ঘরে এসে অতীন গেলাসে খানিকটা হুইস্কি ঢেলে একটা বই খুলে বসলো। তবু সে ঐ গানটাই গাইছে। হেথায় তুরে মানাইছে না গা! ইক্কেবারে মানাইছে না গ! 2 একটু পরেই সে দুমদাম করে সিঁড়ি ভেঙে নেমে এলো নীচে। এখন বসবার ঘরে টি ভি দেখার কেউ নেই। এই সময় নিরিবিলিতে ফোন করা যায়।
প্রায় এক মিনিট রিং হবার পর অলি ফোন ধরলো। এরই মধ্যে অতীনের অস্থিরতা তুঙ্গে পৌঁছে গেছে। সে কর্কশ গলায় বললো, এতক্ষণ কোথায় ছিলি? কী করছিলি?
অলি বললো, আমি নীচে কুকুরটাকে খাবার দিতে গিয়েছিলুম। তারপর লেটার বক্সে একটা চিঠি পেলুম।
–কার চিঠি?
উত্তর দিতে কি দু’এক মুহূর্ত দেরি হলো অলির? সে কি দ্বিধা করেছিল? কিংবা সে সঙ্গে সঙ্গেই বললো, শৌনকের। অনেক বড় চিঠি। আমি টেলিফোনের রিং শুনতে পাচ্ছিলুম, কিন্তু
অতীন ফেটে পড়ে বললো, হু ইজ দিস গড় ড্যাম শৌনক? অলি, আই ওয়ান্ট ফুল ডিটেইলস অ্যাবাউট দিস ক্যারেকটার! তুই যার-তার সঙ্গে মিশবি, আমি এটা মোটেই পছন্দ করি না!
অলি খুব মিষ্টি করে বললো, তোমার কী হয়েছে, বাবলুদা? এত রাগারাগি করছো কেন? শর্মিলা কেমন আছে?
–তুই কেমন আছিস, অলি?
–আমি ভালো আছি, বাবলুদা। চমৎকার আছি। শৌনকের চিঠিটা পড়া এখনো শেষ হয়নি। ও লিখেছে যে আমাদের চেনাশুনো বন্ধুরা সবাই ভালো আছে।
–প্লিজ, প্লিজ, অলি, শৌনক-টৌনকের কথা বাদ দে! আমি শুধু তোর কথা শুনতে চাই।
খুব মিষ্টি হেসে অলি বললো, কী ব্যাপার, বাবলুদা। আজ বুঝি শর্মিলার সঙ্গে তোমার ঝগড়া হয়েছে। তাই আমার কথা মনে পড়েছে? এটা তো ঠিক নয়? শর্মিলার সঙ্গে তোমার কী। হয়েছে, আমাকে বললো, আমি মিটিয়ে দিচ্ছি। আমি শর্মিলাকে ফোন করবো?
অতীন প্রায় হাহাকারের স্বরে বললো, অলি, অলি, ঐসব কিছু না। আমি শুধু জানতে চাইছি, তুই কেমন আছিস! আমি কি তোর জন্য কিছু
উত্তর না দিয়ে অলি কুলকুল করে হাসতে লাগলো। অতীন আবার বললো, অলি, তুই একলা একলা থাকিস, তোর কথা আমার প্রায়ই মনে।
তাকে বাধা দিয়ে অলি বললো, আমার একা থাকতে খুব ভালো লাগে, কেউ ডিসটার্ব করার নেই, মনে মনে আমি কলকাতায় ফিরে যাই…
রিসিভারটা রেখে দিয়ে অতীন সোজা চোখে প্রায় পাঁচ সাত মিনিট তাকিয়ে রইলো। দেওয়ালের দিকে। টেবিল থেকে হুইস্কির বোতলটা নিয়ে সে কাঁচাই চুমুক দিল খানিকটা।
বিছানায় ঢলে পড়ে যাবার সময় পর্যন্ত সে চাপা দুঃখের সঙ্গে বলতে লাগলো, অলি, অলি, অলি, অলি আমার কেউ না। শালা, শুয়োরের বাচ্চা শৌনক, তুই যদি কোনোদিন অলির মনে দুঃখ দিস…আমার মতন কিংবা আমি কেউ না… আমি তোদের বাধা হয়ে দাঁড়াবো না। আমি সরে যাবো…