2 of 2

৫৪. স্কুল ছাড়ার আগে

স্কুল ছাড়ার আগে বিষ্ণু ছাড়া আমার আর যে দু’জন ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়, তাদের নাম ভাস্কর আর পঙ্কজ। এদের মধ্যে পঙ্কজ একটি কীর্তি করে সারা স্কুলে বিখ্যাত হয়েছিল। সরস্বতী পুজোর ভাসানের সময় নৌকো থেকে ধরাধরি করে প্রতিমা যখন গঙ্গায় ফেলে দেওয়া হয়েছিল, তখন ঝোঁক সামলাতে না পেরে পঙ্কজও জলে পড়ে যায়।

গঙ্গায় সে-দিন পূর্ণ জোয়ার, জল থইথই করছে। নৌকোয় মাস্টারমশাইরা কেউ ছিলেন না, শুধু আমরা কয়েক জন উঁচু ক্লাসের ছাত্ররা। পঙ্কজ জলে পড়ে যাওয়ায় আমরা শুধু হাসাহাসি ও চাচামেচি করেছি। ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝতে পারিনি। তারপর যা করেছি, সেটা আরও মূর্খের মতন। সেই ভরা গঙ্গায়, মাঝিদের কথায় কর্ণপাত না করে, আমরা আরও তিন জন জলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। প্রভাত নামের একটি বার বার ফেল করা ছেলে ছিল সাঁতারে চ্যাম্পিয়ান, সে-ই প্রথম জলে ঝাঁপিয়ে পড়ার ডাক দেয়–আমি বাঙালদেশের ছেলেসুতরাং আমারও পিছিয়ে পড়া উচিত নয় এবং আমার দেখাদেখি ভাস্কর।

আমাদের তিন জনের খুব বেশি বিপদ হয়নি–কাছাকাছি তিনটে নৌকোর মাঝি আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসে, কিন্তু পঙ্কজকে আমরা খুঁজে পাইনি। প্রায় আধ ঘণ্টা বাদে বাবুঘাটের কাছে জলপুলিশের একটি লঞ্চ পঙ্কজকে উদ্ধার করে। আশ্চর্যের ব্যাপার, সে তখনও বেঁচে ছিল।

সরস্বতী মূর্তির সঙ্গে সঙ্গে জলে ডুবে যাওয়া এবং পরে রোমহর্ষক ভাবে তার উদ্ধার পাওয়ায় পঙ্কজ এমনই বিখ্যাত হয়ে যায় যে পরে স্কুলের ছেলেরা তাকে ভিড় করে দেখতে আসত। এই উপলক্ষে খবরের কাগজে তার নামও ছাপা হয়েছিল। পঙ্কজ অবশ্য এই ব্যাপারে কখনও লজ্জা প্রকাশ করেনি। সে গম্ভীর ভাবে বলত, আমাকে তোলা হল কেন? সরস্বতী ঠাকুরের সঙ্গে সঙ্গে ডুবে মরলে আমি পরের জন্মে নিশ্চয়ই ঈশান স্কলার হতাম।

পঙ্কজ লেখাপড়ায় সাধারণ ছাত্র ছিল, কিন্তু ম্যাট্রিক পরীক্ষায় তার আশাতীত ভালো রেজাল্ট হওয়ায় অনেকেই বলেছিল, মা সরস্বতীর কৃপা। কিন্তু এই ঘটনা পঙ্কজের জীবনকে বিশেষ প্রভাবিত করতে পারেনি–উত্তরকালে পঙ্কজ ঘোরতর নাস্তিক হয়ে যায়।

আমার বাড়ির গ্রামে আমার পইতে হবার পর থেকেই আমার বেশ দেবদ্বিজে ভক্তি হয়। আচার অনুষ্ঠানগুলো নিয়মিত মেনে চলতাম, কখনও গলা থেকে পইতে খুলে ফেলার কথা চিন্তাও করতে পারতাম না। কী করে এই সব সংস্কার আস্তে আস্তে দূর হল, তা ঠিক মনে নেই। তবে, আমার বন্ধুদের সংসর্গ নিশ্চিত খুব কাজ করেছিল। ছাত্রমহলে তখন নাস্তিকতার একটা ঢেউ উঠেছে। উনবিংশ শতাব্দীতে ইয়ং বেঙ্গল যে নাস্তিকতার জোয়ার এনেছিলেন, হিন্দু ধর্মকে সংস্কার মুক্ত করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলেন– সেই উদ্দীপনা এই শতাব্দীর প্রথম ভাগের পর স্তিমিত হয়ে যায়। রক্ষণশীলতা আবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।

রাজনৈতিক আন্দোলনে হিন্দু-মুসলমানকে একত্র করার আপ্রাণ চেষ্টা কিছুতেই সার্থক হয়নি। এ জন্য আমরা ব্রিটিশের ভেদ নীতিকে সর্বাংশে দায়ী করলেও উভয় সম্প্রদায়ের অবিশ্বাসী মনোভাবও কম দায়ী নয়। বক্তৃতা মঞ্চে কিংবা মিছিলে হিন্দু-মুসলমানকে পাশাপাশি আমরা ডাক দিলেও, সামাজিক জীবনে মেলামেশা ছিল না। নজরুল ইসলাম শ্যামাসংগীত গাইলে হিন্দুরা খুশি হয়, মুসলমানরা চটে যায়। এই খুশি ও অখুশি–দুটোই এক রকমের গোঁড়ামির ফল।

স্লোগান হিসেবে ‘বন্দেমাতরম’-মুসলমানরা গোড়া থেকেই মেনে নিতে চায়নি। এই আপত্তির কারণ কতটা সংস্কৃত ভাষার জন্য, কতটা দেশকে মাতৃরূপে কল্পনার জন্য, আর কতটা বঙ্কিমচন্দ্রের জন্য–তা আজও স্পষ্টরূপে নির্ধারিত হয়নি। কিন্তু যেহেতু এই স্লোগান স্বতঃস্ফুর্ত, তাই হিন্দুরা এটি ছাড়েনি। সশস্ত্র বিপ্লবীরা পরজন্মে বিশ্বাসী এবং গীতায় নিষ্কাম ধর্মকে অবলম্বন করেছিল বলে মুসলমানরা তাদের থেকেও দূরে থেকেছে।

এদিকে, বাংলায় মুসলিম লিগ শাসনের দাপটের ফলে হিন্দুরা ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়ে। মধ্যবিত্ত হিন্দুদের যেটা একমাত্র আরাধ্য বস্তু, সেই চাকরিও যখন তাদের হাতছাড়া হয়ে যায় তখন তারা ঘোরর মুসলমান বিদ্বেষী হয়ে পড়ে। আত্মরক্ষার তাগিদে রক্ষণশীলতা বেড়ে যায়। এবং এই অবস্থায়, বোমা বানানো বাঙালিদের মধ্যে আরও বিভেদের ফাটল সৃষ্টি করায় ইংরেজ সরকারের যেমন স্বার্থ ছিল, তেমনই অবাঙালি ব্যবসায়ীদেরও কম স্বার্থ ছিল না। ১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত ছিল এর প্রস্তুতি পর্ব।

মধ্যবিত্ত হিন্দু সমাজের প্রবীণরা ও অভিভাবকরা যখন বেশি বেশি রকমের ধর্ম-গোঁড়া হয়ে উঠলেন, তারই প্রতিক্রিয়াস্বরূপ ছাত্র সমাজের মধ্যে নাস্তিকতা এসেছিল। নতুন করে। অভিভাবকদের বিপরীত মত পোষণ করা আধুনিকতার একটি অঙ্গ। মুসলমান ছাত্রদের মধ্যে অবশ্য এই প্রতিক্রিয়া আসতে আরও কয়েক বছর সময় লেগেছিল–তাদের অপেক্ষা করতে হয়েছিল একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি হয়ে ওঠার জন্য। তার আগে পর্যন্ত, তাদের মধ্যে ছিল শুধু সর্বাত্মক ভাবে অধিকার আদায়ের প্রশ্ন একে একে সবাই গিয়ে ভিড়ে পড়ছিল মুসলিম লিগে।

তা ছাড়া, হিন্দু ছাত্রদের মধ্যে তখন মার্কসবাদ এক নতুন প্রেরণা এনেছে। স্ট্যালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েট রাশিয়ার সময় বিজয় এক যুগান্তকারী ঘটনা বলে মনে হচ্ছে। সমাজতন্ত্রের পীঠস্থান রক্ষা পেয়েছে, এবার বাকি পৃথিবী ওই সমাজতন্ত্রের আওতায় আসবে। কেন না, উপনিবেশবাদ বা সাম্রাজ্যবাদ লড়াই করে শুধু নিজের স্বার্থ রক্ষার জন্যসুতরাং তারা একদিন পরস্পর লড়াই করে মরবেই–সমাজতন্ত্রবাদ নিয়ে আসবে প্রত্যেক মানুষের জন্য সমান অধিকার। ছাত্রদের মধ্যে কমিউনিস্ট হবার দারুণ ফ্যাশান চালু হয়েছে। একটু ভালো ছাত্র বা চৌকোশ ছেলেরা যদি কমিউনিস্ট না হয়–অন্যরা তাদের বিদ্রূপ করে।

এবং নতুন কমিউনিস্টরা সব দিক থেকেই উগ্র হয়। রাজা রামমোহন যেমন ভাবে দুর্গ পূজার নেমন্তন্ন অস্বীকার করেছিলেন, ঠিক সেই একই কায়দায় ভাস্করের দাদা অরুণদা তার বাড়ির সিঁড়িতে বসে বাঁকা হাস্যে একদল ছেলেকে বলেছিলেন, সরস্বতী পুজোর চাঁদা? তোমরা কী ভাই মেয়েছেলে যে আমার কাছে পুতুল খেলার কথা বলতে এসেছ?

মাথার উসকুখুসকু চুলে তেল নেই, গেরুয়া পাঞ্জাবি ও পাজামা পরা অরুণদা ছিলেন। আমাদের কাছে দারুণ শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। এই রকম পোশাক-পরা নতুন দাদারা আমাদের কাছে মৃদু গলায় শোনাতেন অসম্ভব সব জ্ঞানের কথা।

বিষ্ণু, আমি, পঙ্কজ আর ভাস্কর–আমাদের এই ক’জনকে দাদারা বলতেন থ্রি মাস্কেটিয়ার্স। কেউ কেউ যখন বলত, চার জন আবার থ্রি মাস্কেটিয়ার্স হয় কী করে, তাদের দিকে আমরা অবজ্ঞার চোখে তাকাতাম। তারা বইটা পড়েনি। আমাদের মধ্যে কে দার্তাগনান সে সম্পর্কে তর্কের কোনও অবকাশই ছিল না–সে পদমর্যাদা প্রথম থেকেই ভাস্করকে দিতে হয়েছিল।

বন্ধুদের মধ্যে ভাস্কর যেমন অহংকারী, তেমনই দুর্মুখ। অতি অল্প বয়স থেকেই তার মধ্যে একটা ব্যক্তিত্ব জন্মে গিয়েছিল, যে জন্য তার চেয়ে বয়সে বড় লোকেরাও তার সঙ্গে সমীহ করে কথা বলত। ভাস্করের ছিপছিপে লম্বা চেহারা, মাথা-ভরতি কোঁকড়া কোঁকড়া চুল এবং চোখের মণি দুটো কটা। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে কোনও গণতন্ত্র ছিল না, ভাস্করের ইচ্ছে মতনই আমাদের চলতে হত। তবে, ভাস্কর মনে মনে সমীহ করত বিষ্ণুকে। বিষ্ণু কম কথা বললেও তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু করতে সাহস পেত না ভাস্কর। আমার আর পঙ্কজের ভূমিকা ছিল বকুনি খাওয়ার–আমরা কিছু বললেই ভাস্কর ধুৎ বলে অত্যন্ত অবজ্ঞার সঙ্গে তা উড়িয়ে দিত।

আমাদের বয়সি ছেলেরা তখন অনেকেই বিড়ি সিগারেট খেতে শিখেছে–ভাস্কর এক দিন মাত্র সিগারেট বিষয়ে উল্লেখ করায় বিষ্ণু এমন ভাবে ছিঃ বলেছিল যে আমরা সবাই একবাক্যে সিগারেটের নিন্দে করা শুরু করে দিলাম। কেউ আর লুকিয়ে চুরিয়ে একটান দেবার কথাও. ভাবিনি। ইস্কুলের বাথরুমের দেওয়ালে অসভ্য কথা এবং ছবি আমাদের সবারই চোখে পড়ত যদিও, কিন্তু কেউ সে-বিষয়ে আলোচনা করিনি। এটাও বিষ্ণুর প্রভাব। তবে, অন্য সব বিষয়ে আমরা ভাস্করের নির্দেশই মানতাম।

ভাস্করের প্রধান শখ ছিল পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়ানো। বিকেলবেলা আমরা জমায়েত হতাম হেদোর মোড়ে। সেখান থেকে শুরু হত পদযাত্রা। জোড়াসাঁকো, পোস্তা, ক্যানিং স্ট্রিট হয়ে আমরা চলে যেতাম হাওড়া ব্রিজের কাছে। তখনও নতুন হাওড়া ব্রিজের দুদিকে দুটো বিরাট ধাতব বেলুন ওড়ে। আমরা শুনেছিলাম, এই ব্রিজের কাছাকাছি শত্রু পক্ষের বিমান এলেই বেলুন দুটো ফেটে গিয়ে একটা ধুন্ধুমার কাণ্ড হবে। গঙ্গাতেও আমরা একটা নতুন জিনিস দেখিজলে ভাসে এরোপ্লেন। এই সি-প্লেনগুলি নাকি জল থেকেই উড়ে যেতে পারে। সেই প্লেনের ডানার ওপর শুয়ে খালি গায়ে রোদ পোহায় আমেরিকানরা, যাদের আমরা বলতাম লালমুখো।

সন্ধ্যা হয়ে এলেই পঙ্কজের বাড়ি ফেরার তাড়া থাকে। ভাস্কর তাকে ধমকে ঠান্ডা করে দেয়। ভাস্করের নির্দেশে আমরা ব্রিজ পেরিয়ে চলে যাই হাওড়া স্টেশনে। ভাস্কর প্ল্যাটফর্ম টিকিট কাটে, আমরা যে-কোনও একটা খালি ট্রেনের কামরায় উঠে বসে থাকি। আমরা কোথাও যাব না, তবু ট্রেনের কামরায় আমাদের দারুণ গল্প জমে। ব্যাপারটাতে আমরা একটা নিষিদ্ধ আনন্দ পাই। আমাদের চেনা কেউ দেখতে পেলে কী ভীষণ চমকে উঠবে, মনে করবে বুঝি আমরা বাড়ি থেকে পালাচ্ছি। সে রকম কারওর চোখে পড়ার জন্য আমরা জানলা দিয়ে মুখ বার করে থাকি পর্যন্ত।

যে-ট্রেন ছাড়তে অনেক দেরি আছে কিংবা সে-দিন ছাড়বেই না–সেই সব ট্রেনই আমরা পছন্দ করে বসি। তাতে আমরা ছাড়া আর কেউ থাকে না–আমরা বেঞ্চে বসে পা দোলাতে দোলাতে মনে করি, ট্রেন সত্যি বহু দূর চলে যাচ্ছে, আমরা চার বন্ধু কোনও নাম-না-জানা দেশের মধ্য দিয়ে চলেছি।

কোনও কোনও সন্ধ্যাবেলা আমরা যেতাম বেলেঘাটা, তিলজলা কিংবা খিদিরপুর। এই সব জায়গাই আমাদের কাছে নতুন–আমরা একটু একটু করে কলকাতা শহরটাকে আবিষ্কার করতাম। আমরা চারজনে একসঙ্গে থাকতাম বলেই রাস্তা হারিয়ে ফেলার জন্য ভয় ছিল না। রাস্তা হারাতাম, ঘুরে ঘুরে আবার খুঁজে পেতাম। এই শহরের শিরা উপশিরার মতন অসংখ্য গলিখুঁজি, কত নানান রকমের বাড়ি–সব মিলিয়ে এক আশ্চর্য জগৎ। পাথুরেঘাটার গলিতে ঢুকে পুরনো কালের কতগুলো বিরাট বিরাট বাড়ি দেখে আমরা হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। শ্বেত পাথরের সিঁড়ি, বিশাল স্তম্ভ, কোনও বাড়ির ছাদ আবার দুর্গের মতন। কোনও বাড়ির গেটের সামনে সিংহ মূর্তি। রাজেন মল্লিকের বাড়িতে এসে আমরা আবিষ্কার করেছিলাম আস্ত একটি চিড়িয়াখানা। কে. কে. হাজারির বাড়িতে দেখেছি শিকল দিয়ে বাঁধা সত্যিকারের জ্যান্ত বাঘ।

প্রতিদিন আমরা অন্তত ছ’সাত মাইল হাঁটতাম। ভাস্করের কড়া নির্দেশে আমাদের ক্লান্ত ভাব দেখাবার কোনও উপায় ছিল না। ফেরার পথটা একটু একঘেয়ে লাগত–খুব বেশি রাত না হলে আমরা ট্রামে-বাসে ফিরতাম না। আমরা কখনও কখনও ফুটবল বা ক্রিকেট খেলেছি বটে, কিন্তু হেঁটে বেড়ানোই ছিল আমাদের বেশির ভাগ দিনের প্রোগ্রাম। শেষ পর্যন্ত এটা আমাদের নেশার মতন হয়ে গিয়েছিল। কলেজে এসেও দু’-এক বছর এটা বজায় রেখেছিলাম।

এই ভাবে কলকাতা শহরটা আমাদের হাতের পাতার মতন চেনা হয়ে যায়। আমরা ক্ষুদ্র পারিবারিক গণ্ডি থেকে শুধু যে বেরিয়ে আসি, তাই-ই নয়, এই শহরটাকে খুব আপন মনে হয়। আমরা মনে মনে বেশ জোর করে বলতে পারি, এই শহরটা আমাদের।

আর একটা কথাও আমি আলাদা ভাবে বুঝতে পারি, গ্রামের মাঠে কিংবা নির্জন বাগানে বা নদীর ধারে একা একা ঘুরে বেড়িয়ে আমি যে আনন্দ পেয়েছি, শহরের অঢেল রাস্তায় ঘুরে বেড়াবার আনন্দ ও উত্তেজনা তার চেয়ে মোটেই কম নয়। একটা গলি পার হলে কোথায় পড়ব আমরা জানি না, আচমকা পেয়ে গেছি পার্ক কিংবা পুকুর। আলুপোস্তার কাছে একদিন পথ হারিয়ে ঘুরতে ঘুরতে এমন একটা জায়গায় পৌঁছোলাম, যেখানে সকলেই চিনেম্যান, বস্তির মধ্যে সরু সরু গলিতে গরিব চিনেরা থাকে– দোকানের সাইনবোর্ডও চিনে ভাষায়। কয়েক জন লোক আমাদের পেছনে ঘুরঘুর করে বিড়বিড় করে কী সব বলতে লাগল। একটু একটু গা ছমছম করছিল আমাদের, কিন্তু ভাস্কর তার স্বভাবসুলভ অহংকারের সঙ্গে বলল, চল, এখানে একটা হোটেলে ঢুকে চা খাই।

বিষ্ণু আর পঙ্কজ একসঙ্গে বলল, না। আমি চুপ করে রইলাম। আমার আপত্তি ছিল না।

ভাস্কর চার দিকে তাকিয়ে বলল, এই জায়গাটা চায়না টাউন, আমার কাকার কাছে শুনেছি।

একটা দোকানের সামনের সাইনবোর্ডে দুটো সাপের ছবি আঁকা, ভাস্কর বলল, চীনা, ভেতরে ঢুকে দেখি!

বিষ্ণু দৃঢ় ভাবে না বলায় সেদিন আর বেশি দূর এগোনো যায়নি। বিষ্ণু তার বাবা-মায়ের খুব আদরের ছেলে–তার গতিবিধি সম্পর্কে অনেক বিধিনিষেধ ছিল–তবু সে জোর করেই বিকেল বেলা আসত আমাদের সঙ্গে। তাকে নিরাপদে ফিরিয়ে দেবার ব্যাপারে আমরা একটা দায়িত্ব বোধ করতাম।

বেড়াবার সময় আমরা কখনও যে কোনও বিপদে পড়িনি তা নয়। কখনও কোনও পাড়ায় হঠাৎ গোলমাল শুরু হওয়ায় ও পুলিশের আবির্ভাবে আমরা অন্ধের মতন। ছুটেছি। কিন্তু এসব ছোটখাটো ব্যাপার ছাড়াও একবার বেশ একটা গুরুতর ব্যাপারই ঘটেছিল।

তখন কলকাতায় অনেক বাড়িই খালি পড়ে থাকত। ‘টু লেট’ ঝোলানো বাড়ি আকছার। তা ছাড়াও, দমদম, বরানগর, বেলগাছিয়ার দিকে অনেক বড় বড় জমিদারদের বাগানবাড়ি–যা যুদ্ধের সময় মিলিটারিরা নিয়ে নিয়েছিল–সেগুলো এখন জানলা দরজা ভাঙা অবস্থায় হা-হা করছে। সেই সব বাড়িতে ঢুকে এ-ঘর ও-ঘর দেখার ব্যাপারে আমার খুব কৌতূহল ছিল, আমার এই ইচ্ছেটা ভাস্করকে প্রকাশ করায় সে বেশ উৎসাহের সঙ্গে গ্রহণ করেছিল। সুতরাং ফাঁকা বাড়ি পরিদর্শন করাও ছিল আমাদের একটা কাজ। সেখানে আমাদের কেউ হঠাৎ দেখলে চোর বলেও ভাবতে পারত, কিন্তু আমাদের চুরি করার মতন কিছুই ছিল না। আমরা সেই বিশাল বিশাল বাড়ির এক একটা ঘরে এক একজন ঢুকে হাহো ইত্যাদি চিৎকার করতাম প্রতিধ্বনি শোনার আশায়।

একদিন কী কারণে স্কুলে হাফ হলিডে হয়ে গেছে, বাড়ি ফেরার বদলে ভাস্কর আমাদের নতুন জায়গায় বেড়াতে যাবার প্রস্তাব দিল। সেদিন বিষ্ণু ছিল না সঙ্গে, বিষ্ণু জ্বরের জন্য স্কুলে আসেনি। কিন্তু প্রভাত বলে আর একটি ছেলে আমাদের দলে জুটে গেল। প্রভাত একটু বখাটে ধরনের ছেলে হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষায় ‘ভারতী’ কথাটার মানে ‘সিনেমার ভারতী’ লিখেছিল বলে সে বাংলার স্যারের কাছে প্রচণ্ড মার খেয়েছিল। এ ছাড়াও সে একবার হেডমাস্টার মশাইকে পেছন থেকে হেডু হেডু বলায় খুব লাঞ্ছিত হয়েছিল। তবু প্রভাতকে দলে নেওয়া হল, কারণ সে খুব মজার মজার কথা বলে।

শ্যামবাজারের খালপাড়ের স্টেশন থেকে টিকিট কিনে আমরা চড়ে বসলাম ট্রেনে। প্রায় খেলনার গাড়ির মতন ছোট ট্রেন, লোকের বাড়ির গা ঘেঁষে যায়-চলন্ত ট্রেন থেকে নেমে পড়ে আবার দৌড়ে ওঠা যায় সহজেই। এই রকম ট্রেন পরে আমরা আবার দেখেছিলাম দার্জিলিংয়ের রাস্তায়।

শ্যামবাজার ছাড়িয়ে পশু হাসপাতালের পাশ দিয়ে, বেলগাছিয়া ভিলার গা ঘেঁষে ট্রেন চলল দুলতে দুলতে। এরপর থেকে আর সবকিছু আমাদের অচেনা। হাতিয়াড়া নামে কোন এক সুদূর রাজ্যে গিয়ে এই ট্রেনের যাত্রা শেষ হবে।

কিছুদূর যাবার পর আমাদের মনে হল আমরা একটা অপূর্ব সুন্দর জায়গায় এসে পৌঁছেছি। সবুজ মখমলের মতন ঘাসে-ভরতি মাঠ, তার ওপাশে বিস্তৃত জলাভূমি, মাঠের আর এক প্রান্তে একটা মস্ত প্রাসাদ। সেই প্রাসাদের দেওয়ালে নানা রকম রঙিন কাঁচ বসানো, বিরাট সিংহদরজার পাশে দু’জন পুতুল দারোয়ান। কিন্তু দূর থেকে দেখেই বোঝা যায় বাড়ি পরিত্যক্ত। এমন সুন্দর স্থান শুধু স্বপ্নে দেখা যায়।

এক পাল গোরু পার হচ্ছে বলে ট্রেনটা সেখানে থেমে আছে। আমরা ক’জন ঝুপঝুপ করে নেমে পড়লাম।

একটু আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে, ঘাস ভিজে। তার ওপর দিয়ে আমরা দৌড়োতে লাগলাম বাড়িটার দিকে। ধারে কাছে কোনও লোকজন নেই। এই জায়গাটা যেন আমাদের জন্যই অপেক্ষা করে ছিল। পঙ্কজ তো উৎসাহের আতিশয্যে সেই মাঠে ডিগবাজি খেয়ে জামা-প্যান্টে কাদা লাগিয়ে ফেলল।

বাড়িটার সিংহদরজা পেরিয়ে গেলে ভেতরে একটা ছোট বাগান। দেখলেই বোঝা যায়, এবাড়িও মিলিটারিদের দখলে ছিল–যে-সব মাছ-মাংসর টিন তারা ব্যবহার করত–সারা বাগানে সেই টিন ছড়িয়ে আছে। কয়েকটা তাল গাছের গুঁড়িও কাটা অবস্থায় এখানে সেখানে ছড়ানো। আমরা আগেই শুনেছিলাম, জাপানিদের ভয় দেখাবার জন্য তাল গাছের গুঁড়ি কামানের মতো সাজিয়ে রাখা হত যুদ্ধের সময়–আসল কামানের অভাব দেখা গিয়েছিল। সেই বস্তু চোখের সামনে দেখলে উত্তেজনা লাগে।

বাগানটাতে গাছপালা কিছুই প্রায় অবশিষ্ট নেই বলতে গেলে, তবে একটা আম গাছে। কচি কচি আম ফলে আছে। ধারে কাছে অনুমতি নেবার মতন কেউ নেই, আমরা হুড়োহুড়ি করে আম পাড়তে লাগলাম। নিজের হাতে পাড়া সেই কঁচা আমের এমন অপূর্ব স্বাদ–যেন জীবনে আমরা সে রকম আম কখনও খাইনি।

প্রভাত বলল, ইস, মাইরি, একটু যদি নুন পাওয়া যেত তা হলে একেবারে আলুর দম হয়ে যেত!

সেকথা শুনে আমরা একেবারে হেসে লুটোপুটি। বিষ্ণু সঙ্গে নেই বলে প্রভাতের মাইরি বলায় আমরা কেউ আপত্তি জানালাম না। প্রভাত সব কিছুকেই আলুর দম বলে। আমাদের ইতিহাসের নতুন স্যারকে খুব ভালো লাগত। প্রভাত বলেছিল, এই স্যারটা খুব ভালো। একেবারে আলুর দম!

বাড়িটার সদর দরজা ভাঙা। কেউ যেন কুড়ুল দিয়ে দরজাটা ভেঙে খান খান করেছে। জানলার ভাঙা কাঁচ এখনও ছড়িয়ে আছে।

আস্তে আস্তে ভেতরে ঢুকলাম। সুদৃশ্য ডিসটেম্পার করা এক একটি ঘর–কিন্তু সেই সব দেওয়ালে ধোঁয়ার দাগ। দেওয়ালের মাঝে মাঝে অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার চৌকো চৌকো দাগ দেখে মনে হয়, আগে সেসব জায়গায় ছবি ছিল। ছাদ থেকে ঝুলন্ত ঝাড়লণ্ঠনের সামান্য ভগ্নাংশই অবশিষ্ট আছে।

চওড়া কাঠের সিঁড়িতে আংটা লাগানো। দেখে বোঝা যায়, আগে সেই সিঁড়িতে কার্পেট পাতা থাকত–এখন তার চিহ্নমাত্র নেই। সেই সিঁড়ি দিয়ে আমরা আস্তে আস্তে ওপরে উঠলাম।

ওপরে চৌকো চৌকো রঙিন পাথর বসানো বিরাট বারান্দা। এক পাশে লোহার রেলিং দেওয়া বারান্দা, আর এক পাশে সারি সারি ঘর। এত বড় বড় ঘর আমি কখনও দেখিনি। এত বড় বাড়িতে এক জনও লোক নেই বলে গা ছম ছম করে।

একটা ঘরে ঢুকে দেখি অসংখ্য ছেঁড়া কাপড় ছড়ানো। এবং কাগজের টুকরো। কাপড়গুলো ছুঁতে আমাদের ঘেন্না হয় কিন্তু কাগজের টুকরো দু-একটা তুলে দেখি। হাতের লেখা, মনে হয় যেন চিঠি। কিন্তু টুকরোগুলো এতই ছোট যে কিছু বোঝা যায় না। এ রকম ভাবে কেন এগুলো ছিঁড়েছে, কে ছিঁড়েছে? মিলিটারিরা বাংলা চিঠি পেল কোথায়!

বিভিন্ন কাগজের টুকরো মিলিয়ে দেখার জন্য আমার একটা ঝোঁক চেপে যায়। অতি কষ্টে দুটি লাইন উদ্ধার করতে পারলুম। তোমার চোখে রাজ্যের ঘুম…আমার চোখে ঘুম। নেই।…তুমি ঘুমোও, আমি বরং তোমায় দেখি… এটুকু পড়েই আমার বুকের মধ্যে শিরশির করে–যদিও মনে হয়, এ বোধহয় চিঠি নয়, কোনও কবিতার লাইন।

হঠাৎ তাকিয়ে দেখি, ঘরে আর কেউ নেই, আমি একা। সেই ফাঁকা ঘরে রেণুর জন্য আমার মন কেমন করে ওঠে।

ভাস্কররা ঘুরতে ঘুরতে একটা ঘরে গিয়ে দেখে দু’জন গুন্ডা চেহারার লোক সেখানে কী যেন করছে। ওদের দেখেই তোক দুটো হুংকার দিয়ে ওঠে, কী চাই?

ভাস্কর সহজে দমবার পাত্র নয়। সে তেজের সঙ্গে বলে, আপনারা জিজ্ঞেস করার কে? এটা কি আপনাদের বাড়ি?

তখন তাদের একজন ভাস্করের ঘাড় চেপে ধরল, আর একজন একটা মস্ত ছোরা বার করল, যাকে লোকে বলে ড্যাগার।

রীতিমতন সংকটজনক অবস্থা। প্রভাত কাঁদো কাঁদো মুখে বলল, আমাদের ছেড়ে দিন। আর করব না, ছেড়ে দিন।

ওদের মধ্যে একজন ভাস্করের ওপর খুবই রেগে গেছে। সে বলল, ভাস্কর যদি নাকে খত দেয়, তা হলে ছাড়তে পারে। ছুরির বিরুদ্ধে আমাদের করার কিছু ছিল না। ভাস্করকে। নাকে খত দিতেই হল। ভাস্করের সেই অপমানিত মুখ কোনও দিন ভুলব না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *