৫৪. সকালে একবার চোখ মেলেছিল অর্ক

 চুয়ান্ন

সকালে একবার চোখ মেলেছিল অর্ক। ছায়া ছায়া অন্ধকার সামনে। একটা আলোর ফুলকি যেন দ্রুত এগিয়ে এসে মিলিয়ে গেল আচমকা। তারপর আর খেয়াল নেই। মাঝরাতে কখন যে তার জ্বর এসেছে জানে না।

কিন্তু সারা রাত ধরে সে মাধবীলতাকে দেখে গেছে। মাধবীলতা তার সেবা করছে। মাথা ধুইয়ে দিচ্ছে, হাত বোলাচ্ছে কপালে। মাকে সব সময় কাছাকাছি পেয়ে একধরনের আরাম ওকে পেয়ে বসেছিল। ভোরে চেতনাটা স্বচ্ছ হতে হতে আবার যখন হারিয়ে গেল তখন চমৎকার এক জগতে চলে এল সে। সেখানে কোন ছায়াজড়ানো অন্ধকার নেই, কোনও আলোর ফুলকি নেই। নিরুপদ্রব একটা ঢিলে শান্তি।

দরজায় ধাক্কা বাড়তে লাগল। সেই সঙ্গে চিৎকার, নাম ধরে ডাকা। অর্ক চোখ খুলল। যেন লেপ সরিয়েই সূর্যর মুখ দেখা। মাথার ভেতরে ঢং করে কিছু একটা বাজল। কনুই-এ ভর দিয়ে সে উঠে বসতেই প্রথম টের পেল, তার জ্বর হয়েছে। এবং রাত্রে যে জ্বরটা বেশ ছিল সেটাও বোঝা যাচ্ছে। হাতের তেলো, আঙ্গুল কেমন অসাড়, মাথার ভেতরটা ভীষণ ভারী। শূন্য ঘরে একটা চাপা আলো ছেটানো। আর কেউ নেই। এবং তখনই তার খেয়াল হল মা হাসপাতালে এবং সেখানে তার সকালেই যাওয়ার কথা ছিল। বাইরে তখনও শব্দ হচ্ছে, তার নাম ধরে ডাকছে অনেকে। অর্ক চোখ বন্ধ করে জিজ্ঞাসা করল, ‘কে?’

‘কি হয়েছে তোমার? দরজা খুলছ না কেন?’

অর্ক পরমহংসকাকুর গলা চিনতে পারল। পরমহংসকাকু এখানে কেন? মুহূর্তেই মাথার ভেতরটা ফাঁকা হয়ে গেল। সে লাফিয়ে উঠতে গিয়ে দেখল শরীর টলে যাচ্ছে, কোন রকমে খাটটা ধরে নিজেকে সামলালো। পরমহংস এখন আবার ডাকছে, ‘কি হয়েছে অর্ক, অর্ক?’

অনেক কষ্টে নিজেকে সামলালো সে। তারপর কোন রকমে দরজার কাছে পৌঁছে খিল নামিয়ে দিতেই মনে হল চোখ পুড়ে যাবে, বাইরে কড়া রোদ।

অন্তত আট নয়জন বাইরে দাঁড়িয়ে। পরমহংস ঘরে ঢুকে ওর দিকে তাকাল, ‘কি হয়েছে তোমার? জ্বর?’ কপালে হাত দিয়ে পরমহংস গম্ভীর হয়ে গেল, ‘হুঁ, বেশ জ্বর আছে দেখছি। এসো, শুয়ে পড়ো, দাঁড়িয়ে থেকো না।’

অর্ক মাথা নাড়ল, ‘আমার তেমন কিছু হয়নি।’

‘সে তো দেখতেই পাচ্ছি। শোবে এসো।’

নিতান্ত অনিচ্ছায় অর্ক খাটে ফিরে এল। ওর ইচ্ছে করছিল স্বাভাবিক ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে কথা বলতে। কিন্তু সেটা যে সম্ভব হচ্ছিল না। পরমহংস জিজ্ঞাসা করল, ‘কি করে জ্বরটা বাধালে?’

অর্ক ফ্যাকাশে হাসল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, ‘হাসপাতালে গিয়েছিলেন?’

পরমহংস মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। তারপরেই ঘুরে দাঁড়িয়ে, ‘আপনাদের একজন কেউ ডাক্তার ডেকে আনতে পারবেন?’

অর্ক তাকিয়ে দেখল ন্যাড়া দরজায়। এখন চোখ সয়ে নিয়েছে অনেকটা। মাথাটাও সামান্য হালকা লাগছে। সে বলল, ডাক্তার ডাকার দরকার নেই। একটু বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।’

‘কিন্তু তোমার এটা হল কি করে? একটু আগে শুনলাম কারা নাকি তোমাকে ছুরি মেরেছে?’

হ্যাঁ

‘মায়ের যখন এই অবস্থা তখন তুমি ঝামেলার মধ্যে যাও কেন?’ পরমহংস বিরক্ত হল, ‘ওই উণ্ডের জন্যে জ্বর আসেনি তো?’

অর্ক কাঁধে হাত দিল। না, তেমন ব্যথা লাগছে না। গতকাল হাসপাতালেও বলেছিল ছুরিটা বেশী দূর ঢোকেনি। এখন একটা চিনচিনে অনুভূতি ছাড়া কিছু নেই।

অর্ক বলল, ‘না, তার জন্যে কিছু হয়নি।’

পরমহংস বলল, ‘ঠিক আছে, তোমার কি কি অসুবিধে হচ্ছে বল আমি ডাক্তারের কাছে গিয়ে বলছি। তোমার তাড়াতাড়ি সেরে ওঠা দরকার এখন।’

‘কেন?’ অর্কর খেয়াল হল পরমহংস তার প্রশ্ন তখন এড়িয়ে গিয়েছে। মা কেমন আছে বলেনি।

‘বাঃ, তোমার মা অসুস্থ আর তুমি পড়ে থাকলে চলবে?’

‘মা কেমন আছে?’ পরমহংসর চোখের দিকে তাকাল অর্ক।

‘এ সময় কেমন থাকে নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারো। কি কি অসুবিধে বোধ করছ বল, আমি ডাক্তারখানায় যাচ্ছি।’

‘আমার জন্যে ব্যস্ত হবেন না। আমি ঠিক আছি।’

‘অদ্ভুত ব্যাপার! কাল রাত্রে কিছু খেয়েছিলে?’

‘না।’

‘চমৎকার। ঠিক আছে, তুমি বিশ্রাম নাও। আজকে তোমাকে হাসপাতালে যেতে হবে না। তেমন দরকার হলে আমি খবর দেব। আমি তোমার ওষুধ আর খাবার এনে দিচ্ছি। দয়া করে সেগুলো খেয়ো।’

‘পরমহংসকাকু, মা কেমন আছে সত্যি করে বলুন!’

‘বললাম তো, এখনও কিছু বলতে পারল না। এই সব সেন্টিমেন্টাল আদর্শবতী মেয়েরা চিরকাল পৃথিবীতে সাফার করে যাবে। ঠিক আছে, ওদিকটা আমি দেখছি। তুমি এখন শুয়ে পড়।’

খানিক বাদে পরমহংস কয়েকটা জ্বরের ট্যাবলেট আর খানিকটা খাবার কিনে দিয়ে বলে গেল বিকেলে আবার আসবে। অর্ক যেন একটুও না ভাবে এ সব ব্যাপার নিয়ে।

দরজা থেকে ভিড়টা সরে গেলেও ন্যাড়া ছিল পাশে। খাটে শুয়ে ন্যাড়ার দিকে তাকাল অর্ক। ছেলেটা খুব দ্রুত পাল্টে যাচ্ছিল। কয়েক মাসের মধ্যেই নিজেকে মাস্তান করে নেবার জন্যে প্রাণপণে চেষ্টা চালাচ্ছিল। কিন্তু এখন ওকে একটু অন্যরকম দেখাচ্ছে। একটু নিষ্প্রভ, ভেঙ্গে পড়া ভাব।

অর্ক জিজ্ঞাসা করল, ‘কি খবর?’

‘পাড়াটা মাইরি পাল্টি খেয়ে গেছে।’

‘মানে?’

‘কেউ আর রোয়াব নিচ্ছে না।’

‘তোর অসুবিধে হচ্ছে?’

‘দূর, নিজেকে কেমন ধূর মনে হচ্ছে। অক্কদা, তুমি আমার একটা উপকার করে দেবে?’

‘কি উপকার?’

‘আমাকে শান্তি কমিটির ভলেন্টার করে দাও।’

‘কেন?’

‘তাহলে কাজ করতে পারি।’

‘ওদের গিয়ে বল।’

‘ওরা আমাকে নেবে না। বলছে বাচ্চাদের দরকার নেই। শালা, আমি কি বাচ্চা? তুমিই বল?’

অর্ক চোখ বন্ধ করল, ‘আমি ভাল হই তারপরে দেখব।’

ন্যাড়া একটু ইতস্তত করে বলল, ‘বিড়ি খাবে?’

অর্ক ঘাড় নাড়ল।

ন্যাড়া আবার বলল, ‘কোয়াদা হাওয়া হয়ে গিয়ে আমাকে ডুবিয়ে দিল।’

‘কেন?’

‘কোয়াদাই তো পয়সা দিত আমাকে।’

অর্ক আর কিছু বলল না। ন্যাড়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার শরীর খারাপ লাগছে?’

‘কেন?’

‘খাবারগুলো খাবে?’

‘দেখি।’

‘না খেলে আমাকে ডেকো।’ বলে ন্যাড়া বেরিয়ে গেল।

অর্ক চুপচাপ পড়ে রইল। ওর হঠাৎ মনে হল, ভারতবর্ষে তিন শ্রেণীর মানুষ ভালভাবে বেঁচে থাকে। এক, যাদের প্রচুর টাকা আছে, যা ইচ্ছে প্রয়োজনে কিনে নিতে পারে। দুই, যারা শিক্ষিত এবং শিক্ষাটাকে বুদ্ধিমানের মত ব্যবহার করে সমাজে ঠাঁই করে নিতে পেরেছে। তিন, কয়লার মত মাস্তানরা, যারা যে-কোন জায়গায় যেতে পারে, যাদের অনেকের প্রয়োজন হয়।

আজকের ন্যাড়ারা যাদের বিদ্যা নেই, অর্থ নেই তারা এই তৃতীয় পথটাকে বেছে নিতে চাইছে বেঁচে থাকার রাস্তাটা খুঁজে পাওয়ার জন্য। তাই একজন কয়লা চলে গেলে দশজন কয়লা তার জায়গা নেবে। মহাভারত না রামায়ণ কোথায় যেন গল্প আছে, একটা রাক্ষসের মাথা কাটামাত্র দশটা মাথা গজিয়ে উঠত। সেই রকম সমাজবিরোধীদের দূর করা সম্ভব নয়। এরা থেকেই যাবে। হঠাৎ তার মনে হল, যদি প্রথম দলটাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া যেত তাহলে বোধ হয় তৃতীয় দলটা আর জন্মাত না। কারণ, প্রথম দলের টাকার ওপর তৃতীয় দল এত রোয়াবি দেখিয়ে বেড়ায়।

ঘুম ভাঙ্গতেই অর্কর মনে পড়ল তার জ্বর হয়েছিল। এখন ভরদুপুর। সকালে ন্যাড়া চলে যাওয়ার পর কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল সে জানে না। এখন প্রচণ্ড খিদে এবং অবসাদ, শরীরের উত্তাপ সাধারণ। এই সময় দরজায় শব্দ হতেই ও চোখ খুলল। পাল্লা একটু একটু করে উন্মুক্ত হয়েই বন্ধ হল। দরজায় দাঁড়িয়ে ঝুমকি। ঝুমকির মুখ চোখ এবং দাঁড়াবার ভঙ্গীতে এমন একটা চোর চোর ভাব যে অর্ক বিছানায় উঠে বসল।

‘তোমার জ্বর হয়েছে?’ ঝুমকির গলা কাঁপছে।

‘ও কিছু না। কি ব্যাপার?’

‘তোমাকে দেখতে এলাম।’

‘কেন?’

‘বাঃ, কারো অসুখ করলে দেখতে আসব না?’ ঝুমকি আবার বন্ধ দরজার দিকে তাকাল। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে এল টেবিলটার দিকে, ‘এ কী, এই সব খাবার পড়ে আছে কেন? খাওনি?’

অর্ক মুখ ফিরিয়ে খাবারগুলো দেখতেই ওর খিদেটা প্রবলতর হল। কিন্তু তার আগে মুখ ধোওয়া দরকার। কাল দুপুরে বালতিতে জল আনা হয়েছিল। সেটার জন্যে অর্ক বিছানা থেকে নামতে যেতেই ঝুমকি হাঁ হাঁ করে ছুটে এল, ‘ওমা, জ্বর গায়ে নামছ কেন?’

‘জ্বর নেই এখন, মুখ ধোব।’

‘দেখি কপালটা। হুম্‌, জ্বর নেই কিন্তু ছ্যাঁক ছ্যাঁক করছে। তোমাকে নামতে হবে না আমি জল এনে দিচ্ছি। ওই বালতিতে জল আছে, না?’

অর্ক হাত নাড়ল, ‘আমি নিজেই নিতে পারব।’

কয়েক পা হাঁটতে গিয়ে মাথার ভেতরটা যেন টলমলে হয়ে গেল। বালতি থেকে এক মগ জল নিয়ে দরজা খুলে বাইরে গিয়ে মুখ ধুচ্ছিল অর্ক। ওপাশ থেকে অনুপমা জিজ্ঞাসা করল, ‘কেমন আছ?’

অর্ক ঘাড় নেড়ে ভাল বলল। তারপর ঘরে ফিরে আসতেই ঝুমকি ইশারা করতে লাগল দরজাটা বন্ধ করে দিতে। অর্ক অবাক হয়ে নীরবেই প্রশ্ন করল, ‘কেন?’ কিন্তু ঝুমকি বারংবার বলায় তার হাত পাল্লা দুটো টেনে দিল।

এবার হাসি ফুটল ঝুমকির মুখে, ‘আমি তো খারাপ মেয়ে, আমি যদি তোমার ঘরে আসি তাহলে লোকে বদনাম করবে তোমার।’

অর্কর মনে পড়ল সেদিন এই রকম কথা বলেছিল সে ঝুমকিকে, আজ ও এটা ফিরিয়ে দিল। তবে কথাটা এরকম হয়েও ঠিক এ রকম ছিল না।

‘তাহলে এলে কেন?’

‘না এসে পারলাম না।’

‘কেন?’

‘তোমার অসুখ হয়েছে শুনলাম, তাই।’

‘এসেছ যখন তখন এত চোরের মত এলে কেন?’

‘লোকে আমাকে নিয়ে খারাপ ভাবতে ভালবাসে। তুমি তো এখন হিরো, কয়লার লোক ছুরি মেরেছে, সমাজবিরোধী তাড়াচ্ছো, আমি এলে তোমার বদনাম হবে।’

‘তুমি খারাপ মেয়ে হলে তোমাকেও তো তাড়াতে হয়।’

‘তার মানে?’

‘সমাজবিরোধী মানে শুধু গুণ্ডা বদমাস মাস্তান নয় সমাজের যারা ক্ষতি করে তারা সবাই। তুমি যদি খারাপ মেয়ে হও তাহলে তুমি নিশ্চয়ই সমাজের ক্ষতি করছ।’

ঝুমকি কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল। তারপর বলল, ‘যারা খারাপ মেয়েদের সঙ্গে খারাপ কাজ করতে যায়, তারা?’

অর্ক মাথা নাড়ল, ‘তারাও।’

‘যারা ঘুষ নেয়?’

ঘুষ? সঙ্গে সঙ্গে অর্কর চোখের সামনে সেদিনের সেই পুলিসটার চেহারা ভেসে উঠল। লোকটা তো প্রকাশ্যেই হাত বাড়িয়ে ঘুষ নেয়। যারা ঘুষ নেয় তারা যদি সমাজবিরোধী হয় তাহলে সেই পুলিসও সমাজবিরোধী। যে পুলিস অফিসার কয়লাকে আড়াল করতে চেয়েছিল সে-ও সমাজবিরোধী। এ পাড়ার মিত্তিরবাবু সরকারি অফিসে কেরানির কাজ করে নাকি বেশ ঘুষ নেন। তিনিও সমাজবিরোধীদের লিস্টে উঠে যাবেন। অর্কর মাথাটা অপরিষ্কার হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সে মুখে বলল, হ্যাঁ।

‘কিন্তু আমি তো আর ক্যাবারে নাচতে যাই না। এক মাসের ওপর তৃষ্ণাদির ফ্ল্যাটে যাই নি। তবু আমি খারাপ মেয়ে হব?’

‘এ সব বন্ধ করলে কেন?’

‘অনেক পরে বুঝলাম আমার দ্বারা ক্যাবারে হবে না।’

‘কেন?’

‘সে তোমাকে বোঝাতে পারব না।’

‘বাড়িতেই থাক?’

‘না।’

‘তাহলে?’

‘ম্যাসেজ করি।’

‘ম্যাসেজ?’

‘হ্যাঁ। বড়লোকের বউদের। মাসে চারদিন গেলে একশ টাকা পাওয়া যায়। এইটে অবশ্য তৃষ্ণাদি শিখিয়ে দিয়েছে। আর এই লাইনে কাজ খুব।’

অর্ক খাবারের প্যাকেটটা হাতে নিল, ‘তুমি খাবে?’

‘না।’

‘আমার খিদে পেয়েছে, খাচ্ছি।’

‘নিশ্চয়ই।’ ঝুমকি দরজার দিকে তাকাল, ‘এবার আমি যাই।’

অর্ক হাসল, ‘এলেই বা কেন আর যাচ্ছই বা কেন?’

‘থাকতে তো বলছ না।’ ঝুমকি মাথা নাড়ল, ‘আমাকে এখন গড়িয়ায় যেতে হবে।’

‘গড়িয়া? সে তো অনেক দূর।’

‘হুঁ। সেখানে একটা বউকে ম্যাসেজ করতে হবে।’

‘এসব কাজ কি ভালো?’

‘ভালো? কারও শরীর টিপতে কি ভাল লাগে? কিন্তু বাড়িতে অভাব হাঁ করে বসে আছে। এখন আমি না যেতে চাইলে মা জোর করে পাঠায়। আচ্ছা, আমার শরীরটা কি খুব খারাপ?’

‘মানে?’ অর্ক হতভম্ব হয়ে ঝুমকিকে দেখল। বেশ স্বাস্থ্যবতী মেয়ে।

‘এই শরীর দেখেও তো কেউ বলতে পারত, এসো মন্ত্র পড়ে বিয়ে করি তোমাকে। ফুর্তি লোটা ছাড়া আমাকে দেখে কেউ কিছু ভাবতে পারে না কেন?’

‘তোমার বিয়ে করার খুব ইচ্ছে, না?’

‘আমার মত মেয়ের বাঁচার তো কোন আশা নেই, ওই ইচ্ছেটুকু সম্বল।’

কথাগুলো বলতে বলতে যেন সচেতন হল ঝুমকি। অর্কর মুখের দিকে ভাল করে তাকিয়ে বলল, ‘তোমার কথাবার্তা আজকাল অন্যরকম হয়ে গেছে।’

‘কি রকম?’

‘কেমন বয়স্ক ভদ্রলোকের মতন। বস্তির রকের ছোঁড়াদের মত কথা আর বলো না। এত জলদি কিভাবে পাল্টালে গো?’

গো শব্দটা শুনে অর্কর কেমন অস্বস্তি হল। ঝুমকির শব্দটায় যেন কিলবিলে কিছু মেশানো ছিল। সে বলল, ‘তুমি এবার যাও, আমি ঘুমুবো।’

‘ঘুম পাড়িয়ে দেব?’ চোখের কোণে হাসল ঝুমকি।

‘এসব ইয়ার্কি আর ভাল লাগে না।’

‘কি কি ইয়ার্কি ভাল লাগে?

‘কি আজে বাজে বকছ। আমাকে এখন একটু একা থাকতে দাও।’

ঝুমকি মাথা নাড়ল। তারপর দরজার দিকে যেতে যেতে ঘুরে দাঁড়াল, ‘তুমি তো ভদ্রলোকের ছেলে, ভগবানের অভিশাপে এই বস্তিতে আছ। তোমার সঙ্গে আমার কোন মিল নেই। কিন্তু তুমি আমার উপকার করেছ, তাই দেখতে আসি।’

অর্ক কোন উত্তর দিল না। ঝুমকির গলা যেন বদলে গেছে আচমকা। ঝুমকি এবার খুব নিচু স্বরে বলল, ‘তুমি আমার একটা কথা রাখবে?’

‘কি কথা?’

‘বল রাখবে!’

‘আশ্চর্য। কথাটা না শুনলে রাখব কিনা বলতে পারি?’

‘কোন কোন সময় অত না ভাবলেও তো চলে।’

‘বেশ বল, কি কথা।’

‘আমি তোমাকে আর কখনও বিরক্ত করব না। আমি জানি এভাবে এলে তোমার খুব অস্বস্তি হয়। বেশ, কথা দিচ্ছি, আমি আর আসব না।’

অর্ক বলল, ‘কিন্তু আমাকে কি কথা রাখতে হবে?’

ঝুমকি হঠাৎ চোখ বন্ধ করল। অর্কর মনে হল ওর শরীরটা কেঁপে উঠল যেন। তারপর সেই অবস্থায় মাথা নেড়ে বলল, ‘না, কোন কথা রাখতে হবে না।’

ঝুমকির নীরবে চলে যাওয়া অর্ককে খুব একটা নাড়ালো না। শুধু মনে হল, মেয়েটা অদ্ভুত। ওর খেয়াল হল, ঝুমকি ঘরে এসে একবারও মায়ের খবর নেয়নি। মাধবীলতা কেমন আছে এই প্রশ্নটা যেখানে খুব সামান্য চেনা মানুষ দেখা হলে করছে সেখানে ঝুমকি এ ব্যাপারে কোন কথাই জিজ্ঞাসা করল না। ও যেন সব সময় নিজেকে নিয়েই থাকে। ঝুমকির মুখ চোখ মনে করে অর্কর মনে কেমন একটা অনুভব জন্ম নিল এই মুহূর্তে। আজকে মেয়েটা হাবেভাবে বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছে সে ওকে ভালবাসে। বিলু যাকে বলে মহব্বত।

যাচ্চলে! মেয়েটা আর জায়গা পেল না। ও বোধহয় জানে না তার ঠিকঠাক বয়স কত। ঝুমকি নিঃসন্দেহে তার চেয়ে বয়সে বড়। আর এটা ভাবতেই ওর মনে ঊর্মিমালার মুখ ভেসে উঠল। ঊর্মিমালা যদি ঝুমকির মত ব্যবহার করত! অসম্ভব। ঊর্মিমালারা চিরকাল অন্য ছেলের সঙ্গে মাথা উঁচু করে হেঁটে যাবে।

উর্মিমালাকে সে চাইতে পারে না। কি আছে তার! বিদ্যে নেই, অর্থ নেই এবং জন্মটাই তো প্রহেলিকায় জড়ানো। অর্ক, তোমার বাবার নাম কি? কে তোমার বাবা? কার কাছে তুমি ঋণবদ্ধ? কার উত্তরাধিকারিত্ব নিয়ে তুমি পৃথিবীতে এসেছ? এই জন্মে তুমি তোমার পূর্বপুরুষের কাছে কি পেয়েছ? কি নিয়ে এগোবে?

কেউ তোমাকে কিছু দেয়নি। এই পৃথিবীতে তুমি না এলে কারো কোন ক্ষতি হতো না। বিন্দুমাত্র না। ঊর্মিমালারা তাই তোমাদের কাছ থেকে ক্রমশ দূরে সরে সরে যাবে। আর ওরা যত দূরে যাবে তত মিস ডি হতে চাওয়া বয়স্কা মেয়েরা এগিয়ে আসবে।

অর্ক চিৎকার করে উঠল, ‘দূর শালা। কাউকে কেয়ার করি না আমি। কারো কাছে কিছু চাই না।’ যেন সামনে অনেক সুখহীন মানুষ দাঁড়িয়ে।

তারপর পড়ন্ত দুপুরে বেরিয়ে পড়ল সে রাস্তায়। ওর শরীরের তাপ তখন কমে এলেও কেমন একটা জ্বলুনিতে ছটফট করছিল সে।

একটা ঘোরের মধ্যে ঈশ্বরপুকুর লেন দিয়ে বেরিয়ে এল অর্ক। ঠিক মোড়ের মাথায় আসতেই ও চমকে উঠল। একটা লোক ক্রাচ বগলে নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। বাবা! বুকের মধ্যে ধক করে উঠতেই ও হেসে ফেলল। কে বাবা? কার বাবা? আমার কোন বাবা নেই।

লোকটা অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়েই খেপে গেল, ‘এই যে ভাই, হাসছ কেন? খোঁড়া বলে খুব হাসা হচ্ছে?’

অর্ক মাথা নাড়ল, তারপর জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনার ছেলের নাম কি?’

‘ছেলে?’ লোকটা হতভম্ব, ‘আমি বিয়েই করিনি তো ছেলে আসবে কোত্থেকে!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *