৫৪. মা

৫৪
আজাদের মা থাকেন মালিবাগের একটা বেড়ার বাসায়৷ ১৬ ডিসেম্বরের সকাল থেকেই তিনি শুনতে পাচ্ছেন, দেশ স্বাধীন হয়ে যাচ্ছে, পাকিস্তানি আর্মি সারেন্ডার করতে যাচ্ছে, তাঁর বুকের ভেতরটা আশায় আনন্দে কেমন যে করে, তিনি মহুয়াকে বলেন, ‘দেশ স্বাধীন হলে জেলখানা থেকে সব মুক্তিফৌজ তো ছাড়া পাবে, কী বলিস তোরা!’ সকাল গড়িয়ে বিকাল হয়, তিনি একবার ঘরে যান, আবার বেরিয়ে আসেন, ডিসেম্বরের বিকালের হলদেটে আলো এসে পড়ে দাওয়ায় দাঁড়িয়ে থাকা আজাদের মায়ের মুখে৷ ডালু এসে বলে, ‘আম্মা, মুক্তিবাহিনী আর মিত্রবাহিনী ঢুইকা পড়ছে, আর চিন্তা নাই, দেশ স্বাধীন’, মা বলেন, ‘তাহলে চল, যাই, মগবাজারের বাসায় যাই, আজাদ যদি ছাড়া পেয়ে চলে আসে!’
‘এখন যাইবা৷ চারদিকে গোলাগুলির আওয়াজ, এর মাঝে ?’
‘হ্যাঁ৷’
‘কাইলকা যাই চলো৷’
‘না৷ আজকেই যাব৷’
ডালু জানে তার খালার জেদ, তার খালার তেজ, সে আর ‘না’ করে না৷ সাফিয়া বেগম একটা থলেতে করে মগবাজারে বাসায় যাওয়ার জন্যে জিনিসপত্র গোছগাছ করেন৷ রিকশা জোগাড় করে সাফিয়া বেগমকে নিয়ে ডালু রওনা হয় মগবাজারের বাসার দিকে৷ একটা দোকানের সামনে এসে সাফিয়া বেগম বলেন, ‘এই রিকশা, একটু দাঁড়ান না৷’
ডালু বলে, ‘কেন ?’
সাফিয়া বেগম তার হাতে ১০টা টাকা দিয়ে বলে, ‘দু সের ভালো চাল কেনো তো বাবা৷ আলু পেঁয়াজ মরিচ তেল সাথেই আছে৷’
ডালু কোনো কথা না বলে চাল কিনে আনে৷
ততক্ষণে সন্ধ্যা ঝুপ করে নেমে এসেছে এই ঢাকায়৷ শীতও পড়েছে প্রচণ্ড৷ চারদিকে জনতার কন্ঠে জয় বাংলা ধ্বনি৷ মাঝে মধ্যে গুলির শব্দে প্রকাশ পাচ্ছে জয়োল্লাস৷
মগবাজারের বাসায় আসতে আসতে অন্ধকার ঘন হয়ে নামে৷ বারান্দাটা অন্ধকার, অন্ধকারেই তালা খুলতে গিয়ে আজাদের মা বোঝেন তালার ওপরে ধুলার আস্তর পড়ে গেছে৷ তালা খুলে ভেতরে ঢুকে লাইটের সুইচ অন করলে বোঝা যায় বিদ্যুৎ নাই৷ ডালু দোকানে গিয়ে মোমবাতি কিনে আনে৷ দিয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে মোমবাতি জ্বালানো হয়৷ ঘরদোরেও ধুলার প্রলেপ পড়ে গেছে৷ মা ঘরদোর সাফসুতরো করে ফেলেন দ্রুত৷ ছেলে ফিরে এসে দেখুক ঘর অপরিষ্কার, এটা হতে দেওয়া যায় না৷ মোমবাতি হাতে নিয়ে মা রান্নাঘরে যান৷ হাঁড়ি-পাতিল এখানে যে কটা ছিল সেসব মাকড়সার জালে ছেয়ে গেছে৷ তিনি একটা হাঁড়ি পেড়ে নিয়ে লেগে পড়েন চাল ধুতে৷
ডালু জিজ্ঞেস করে, ‘আম্মা, কী করো ?’
‘একটু ভাত রাঁধি৷’
ডালু আর কথা বাড়ায় না৷ খালা তার কার জন্যে ভাত রাঁধছে, এ সে ভালো করেই জানে৷ সে চোখের জল গোপন করে৷ বাইরে তখনও হঠাৎ হঠাৎ চিৎকার ভেসে আসছে : জয় বাংলা৷
ভাতের চাল সেদ্ধ হচ্ছে৷ বলক উঠেছে৷ ভাতের মাড়ের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে রান্নাঘরের বাতাসে৷ মা অনেক যত্ন করে রাঁধছেন এই ভাতটুকু৷ ভাত হয়ে গেলে তিনি হাঁড়িটা মুছে আবার চুলার ওপরই রেখে দেন৷ কিছুক্ষণ গরম থাকবে৷ আজাদ কখন আসবে, বলা তো যায় না৷
চুলার আগুন এক সময় নিভে আসে৷ ডিসেম্বরের শীতের স্পর্শে ভাত ঠাণ্ডা হয়ে আসে হাঁড়িতেই৷ সারা রাত কেটে যায় আশায় আশায়৷ মোমবাতি ক্ষয় হতে হতে এক সময় শেষ হয়ে যায়, আলো যায় নিভে৷ মেঝেতে একটা পাটি আর পাটির ওপরে একটা চাদরে বিছিয়ে শুয়ে থাকেন সাফিয়া বেগম৷ দু চোখের পাতা তাঁর কখনও এক হয় না৷ মাঝে মধ্যে উঠে বসেন৷ রাত ভোর হয়, ফজরের আজান ভেসে আসে মগবাজারের মসজিদ থেকে৷ আজাদ ফেরে না৷
সকালবেলা রোদ উঠলে সাফিয়ার বোনের ছেলেমেয়েরাও চলে আসে এই বাসায়৷ চঞ্চল বলে, ‘আম্মা, মগবাজারের মোড়ে পাড়ার পোলাপান আজাদ ভাইয়ের নামে ব্যানার টাঙাইছে৷’
‘কেন ? চল তো দেখে আসি৷’
‘চলো৷’
চঞ্চলের সঙ্গে মা হাঁটতে থাকেন৷
মগবাজারের চৌরাস্তায় এসে দেখেন, পাড়ার ছেলেরা ব্যানার তুলেছে, ‘শহীদ আজাদ, অমর হোক’৷ তিনি বলেন, ‘এইসব কী তুলেছ, এইসব নামাও, আজাদ তো বেঁচে আছে, ও তো ফিরবে!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *