2 of 2

৫৪. জেড ফোর্স

তাঁর চোখ কালো চশমায় ঢাকা। গায়ে ধবধবে সাদা হাফ হাতা গেঞ্জি। বসেছেন ঋজু ভঙ্গিতে। বঁ হাতের কজিতে পরা ঘড়ির বেল্ট সামান্য বড় হয়ে যাওয়ায় হাত নাড়ানোর সময় ঘড়ি উঠানামা করছে। এতে তিনি সামান্য বিরক্ত, তবে বিরক্তি বোঝার উপায় নেই। যে চোখ মানবিক আবেগ প্ৰকাশ করে, সেই চোখ তিনি বেশিরভাগ সময় কালো চশমায় ঢেকে রাখতে ভালোবাসেন। মানুষটার চারপাশে এক ধরনের রহস্য আছে।

তাঁর নাম জিয়াউর রহমান। তিনি তাবুর বাইরে কাঠের ফোন্ডিং চেয়ারে বসে আছেন। চারপাশের দৃশ্য অতি মনোরম। যে দিকে চোখ যায় জঙ্গলময় উঁচু পাহাড়। কোনো জনবসতি নেই। জায়গাটা মেঘালয় রাজ্যের ছোট্ট শহর তুরা থেকেও মাইল দশেক দূরে। নাম তেলঢালা। মেজর জিয়া ঘন জঙ্গলের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে চোখ ফেরালেন আকাশের দিকে। আকাশে মেঘের আনাগোনা। এই মেঘে বৃষ্টি হয় না, তবে এই অঞ্চলের বৃষ্টির ঠিক নেই। যেকোনো মুহুর্তে ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি নামতে পারে।

প্রায় স্বর্গের কাছাকাছি এই অপূর্ব বনভূমিতে জড়ো হয়েছে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম, তৃতীয় এবং অষ্টম স্যাটালিয়ান। তাদের নিয়ে গঠন করা হয়েছে দুর্ধর্ষ এক পদাতিক ব্রিগেড, নাম জেড ফোর্স। জিয়াউর রহমানের নামের আদ্যক্ষর জেড দিয়ে এই ফোর্সের নামকরণ।

জেড ফোর্সের অধিনায়ক মেজর জিয়ার মন খানিকটা খারাপ। কারণ তিনি খবর পেয়েছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ জেনারেল ওসমানি তার বিষয়ে খানিকটা বিরক্তি প্ৰকাশ করেছেন। মেজর জিয়ার নির্দেশে প্রথম ইষ্ট বেঙ্গলের কামালপুর বর্ডার আউটপোস্ট আক্রমণ জেনারেল ওসমানীর মতে উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা। কামালপুর আক্রমণ করতে গিয়ে প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের ত্ৰিশজন নিহত হন, ছেষট্টিজন আহত। ডেল্টা কোম্পানির কমান্ডার ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন শহিদ হন। ব্রাভো কোম্পানির কমান্ডার ক্যাপ্টেন হাফিজউদ্দিন গুরুতর আহত হন। দুটো কোম্পানিই কমান্ডারবিহীন হয়ে পড়ে।

জেনারেল ওসমানীর মতে, যেহেতু আমাদের লোকবল অস্ত্ৰবল কম সেহেতু রক্তক্ষয়ী দুর্ধর্ষ পরিকল্পনায় যাওয়া ঠিক না।

মেজর জিয়ার মত হচ্ছে, আমি দেশের ভেতর যুদ্ধ করছি। কখন কী করব সেই সিদ্ধান্ত আমি নেব। কমান্ডার ইন চিফ–যিনি থাকেন বাংলাদেশ সরকারের দপ্তরে–তিনি পরিস্থিতি জানেন না।

মেজর জিয়া এস ফোর্সের অধিনায়ক মেজর কে এম শফিউল্লাহ এবং কে ফোর্সের অধিনায়ক মেজর খালেদ মোশাররফের সঙ্গে এক বৈঠকেও খোলাখুলি নিজের এই মত প্ৰকাশ করেন। তাঁর কথা হলো, গেরিলা ধরনের এই যুদ্ধে আমাদের সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়কের প্রয়োজন নেই। আমাদের দরকার কমান্ড কাউন্সিল। সবচে বড় কথা সেনাবাহিনী থেকে অবসরপ্রাপ্ত কেউ সেনাবাহিনীর প্রধান হতে পারেন না। মেজর জিয়ার এই মনোভাব জেনারেল ওসমানীর কানে পৌঁছেছিল। সঙ্গত কারণেই এই মন্তব্য তার ভালো লাগে নি।

 

তাঁবুর ভেতর কিছু সময় কাটিয়ে মেজর জিয়া আবার বের হয়ে আগের জায়গায় বসলেন। এবার তার হাতে দুলাইনের একটা ইংরেজিতে লেখা চিঠি। চিঠিটি তিনি লিখেছেন পাকিস্তানের মেজর জেনারেল জামশেদকে। এখন তিনি ঢাকায় ৩৬ ডিভিশনের প্রধান। মেজর জিয়া যখন পাঞ্জাব রেজিমেন্টে ছিলেন, তখন মেজর জেনারেল জামশেদ ছিলেন তার কমান্ডিং অফিসার।

চিঠিতে মেজর জিয়া লিখেছেন–

Dear General Jamshed,
My wife Khaleda is under your custody. If you do not treat her with respect, I would kill you someday.
Major Zia

এই চিঠি দেয়া হলো মেজর শাফায়েতকে। মেজর শাফায়েত চিঠিটি ঢাকায় পোষ্টবক্সের ডাকবাক্সে ফেলার ব্যবস্থা করলেন। মজার ব্যাপার হলো, এই চিঠি মেজর জেনারেল জামশেদের হাতে পৌঁছেছিল।*

————–

সূত্র : রক্তে ভেজা একাত্তুর
মেজর (অবঃ) হাফিজ উদ্দিন আহমদ, বীর বিক্রম

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *