এ বছর এত বৃষ্টি যে শীতকালেও রেহাই নেই। বর্ষার বৃষ্টি মানুষের গা-সহা, কিন্তু শীতের বৃষ্টি ভিজতে অনেকেই ভয় পায়। রাস্তাঘাট একেবারে ফাঁকা।
একটা রিকশা দাঁড় করিয়ে রেখেছে তপন, বস্তির মধ্যে এসে কৌশিককে বললো, চট করে তৈরি হয়ে নে, এক্ষুনি যেতে হবে!
কৌশিক খাঁটিয়ায় শুয়ে আছে, জ্বরটা তার ছাড়ছে না কিছুতেই। সে উদাসীন ভাবে বললো, আবার কোথায় যেতে হবে, আর পারছি না!
তপন বললো, এই জায়গাটা হট হয়ে গেছে। এখানে আর থাকা যাবে না। যে-কোনো সময় এই বস্তি রেইড হবে। তোর জন্য না, জুট মিলের দু’তিনজন ওয়াকার একজন ওয়ার্কস ম্যানেজারকে খুন করে অ্যাবসকন্ড করে আছে, পুলিশ একবার এই বস্তিতে ঢুকলে তাকে ঠিক চিনে ফেলবে। ওঠ, উঠে পড়, দেরি করা যাবে না।
কৌশিক বললো, কোথায় যাবো, ঠিক করেছিস?
তপনের মুখ-চোখ স্বাভাবিক নয়; ভয়, উত্তেজনা, আশঙ্কা অনেক কিছু মিশে আছে। তবু সে ফ্যাকাসে ভাবে হাসবার চেষ্টা করে বললো, পমপমের কাছে!
কথাটা কৌশিকের বিশ্বাস হলো না। পমপম সম্পর্কে তার মনে একটা গম্ভীর হতাশা জন্মে গেছে, তার মনে হয় পমপমের সঙ্গে আর কোনোদিন দেখা হবে না। পমপম তাকে ছেড়ে যাবে কিংবা পার্টির সঙ্গে সম্পর্ক অস্বীকার করবে, তা হতে পারে না, পমপম সে ধাতুতে গড়া নয়। কিন্তু তপনের কথা শুনে বোঝা যায় না, পমপম আর বেঁচে আছে কিনা। কৌশিকের ধারণা, পমপমকে হয় আবার পুলিশ ধরেছে, তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে মফস্বলের কোনো জেলে, অথবা পমপম আর পৃথিবীতে নেই। না হলে পমপম যে-কোনো উপায়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেই!
কৌশিক ক্লান্ত ভাবে বললো, কোথায় পমপম? তপন মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে বললো, কালই তার খবর পেয়েছি, সে আছে উল্টোডাঙ্গার একটা বাড়িতে।
–সত্যি কথা বলছিস?
–আমি তোকে বাজে কথা বলবো?
একটা লুঙ্গির মধ্যে টুকিটাকি জিনিসগুলো নিয়ে বোঁচকা বেঁধে ফেললো তপন। অনেক বই রয়েছে, সেগুলো আর নেওয়া যাবে না। খাঁটিয়া ছেড়ে উঠে গায়ে একটা জামা গলিয়ে নিতে গেল কৌশিক। তপন তাকে বললো, তোর ঐ নোংরা পাজামাটা খুলে ফাল, প্যান্ট পরেন। রাস্তা দিয়ে একটু ভদ্র সেজে যেতে হবে।
মাত্র দিন পঁচিশেক থাকা হয়েছে এখানে, তবু যেন ঘরটার ওপর একটা মায়া পড়ে গেছে, কৌশিক চারদিক চোখ বুলিয়ে দেখলো। এখানে আর ফেরা হবে না। দেওয়ালের গায়ে ঠেস দিয়ে রাখা আছে ক্রাচ দুটো। সে দিকে তাকিয়ে কৌশিক জিজ্ঞেস করলো, এগুলো কী করবো? আমার এখন একটা ক্রাচেই চলে যায়। এমনকি ক্রাচ ছাড়াও মোটামুটি হাঁটতে পারি।
তপন বললো, তাহলে ক্রাচ না নিলেই ভালো হয়। পুলিশের রিপোর্টে আছে, তোর পা। ভাঙা!
ঘর থেকে বেরিয়ে দু’জনে একটুখানি বৃষ্টি ভিজে এসে রিকশায় উঠলো। তপন। রিকশাওয়ালাকে বললো, সামনের পদাটা টাঙিয়ে দাও!
সন্ধে হয়েছে একটু আগে। বৃষ্টির জন্য ওদের সুবিধেই হয়েছে, কারুর নজর পড়বে না রিক্সার দিকে।
কৌশিক জিজ্ঞেস করলো, পমপমের খবর কে তোকে দিল?
তপন বললো, দিয়েছে একজন। তুই চিনবি না।
–উল্টোডাঙ্গায় কার বাড়িতে আছে? আমাদের চেনা কে আছে উল্টোডাঙ্গায়?
–পমপম আছে একজন দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে!
–কী ব্যাপার বলতো, তপন, তুই ফামবল করছিস কেন? তুই আমাকে মিথ্যে কথা বলছিস না তো?
–আরে না, মিথ্যে কথা কেন বলবো!
–অন্যবার আমরা শেষ রাত্তিরে ডেরা ছেড়ে যাই। আজ তুই আমাকে এই সন্ধেবেলা বার করে আনলি যে!
–বললাম না, এই বস্তিতে আর থাকা যাবে না। যে-কোনো সময়…
–বস্তি রেইড হবে, সে খবর তোকে কে দিল? তুই আগে থেকে জানলি কী করে?
–বলছে, একজন, খুব রিলায়েবল সোর্স!
–হুঁ, সাধারণত এই ধরনের রিলায়েবল সোর্সগুলো পুলিশের ইনফর্মার হয়। আমাকে ধরিয়ে দিলে তুই হাজার দশের টাকা পেতে পারিস, তপন!
–তুই আমাকে এই কথা বললি?
–আমার আর দুনিয়ায় কারুকে বিশ্বাস হয় না।
–কৌশিক, তোর পায়ে ধরি, আজ আবার আমার সাথে ঝগড়া লাগাস না। এই তোর গা ছুঁয়ে বলছি, যদি এক বাপের ব্যাটা হয়ে থাকি, যদি মায়ের দুধ খেয়ে থাকি, তা হলে কোনোদিন তোর সাথে ট্রেচারি করবো না। আমি নিজে মরে যাবো, সেও ভি আচ্ছা…
–এসব লম্বা লম্বা কথা আমি শুনতে চাই না। পমপমের খবর তোকে কে দিয়েছে, সে কথা বল ঠিক করে।
–নিশীথদা বলেছে।
–নিশীথা মানে? কে নিশীথদা? কোনোদিন তো এই নাম শুনিনি। আমাদের দলে এই নামে কে আছে?
–নিশীথ মজুমদার, মানিকতলা পাড়ার।
–নিশীথ মজুমদার, মানে কংগ্রেসী? তার সঙ্গে আমাদের কী সম্পর্ক?
–তুই ছোটবেলায় মানিকতলায় থাকতি, নিশীথদা তোকে চেনেন, পমপমকে চেনেন। তোদের স্নেহ করেন। সব মানুষকে কি পাটির লেবেল দিয়েই শুধু বিচার করতে হয়।
–আলবৎ তাই বিচার করতে হবে। যারা শ্রেণী সংগ্রামে বিশ্বাস করে না, তারা সবাই আমার শত্রু।
–প্রথম থেকেই সবাইকে শত্রু বলে ধরে নিয়ে এই তো ফল হলো, আমরা এগোতেই পারলাম না। যাক, ঐসব কথা এখন থাক। নিশীথদা আমাদের হেলপ করছেন ব্যক্তিগত ভাবে । তুই আর পমপম দু’জনেই ছোটবেলা অতুল্য ঘোষের বাড়িতে দিলীপ-মেনির সঙ্গে খেলা করতে যেতিস, নিশীথদা সেই কথা বললেন। বললেন, ওরা তো আমার ছোট ভাই-বোনের মতন।
–আমি নিশীথদার কোনো সাহায্য চাই না। আমি তোরও কোনো সাহায্য চাই না। এক্ষুনি আমি রিকশা থেকে নামবো! আই ক্যান টেক কেয়ার অফ মাইসেলফ!
–পাগলামি করিস না, কৌশিক, তোর পায়ে ধরি। পমপমের সঙ্গে আগে তোর দেখা করা দরকার কি না বল! পমপমকে দেখার পর তোর যা ইচ্ছা করিস!
দুর্বল শরীরেও কৌশিক রাগে ফুসতে লাগলো, তপন জোর করে চেপে ধরে রইলো তার দু’হাত।
নৈহাটি স্টেশনেও আজ ভিড় কম। আজ কিসের যেন একটা সরকারি ছুটির দিন, অফিস ফেরত বাবুরা আজ অনুপস্থিত। এমনি হাঁটতে পারলেও সিঁড়ি দিয়ে উঠতে-নামতে কষ্ট হয়। কৌশিকের। তবু তপন তাকে ধরলো না।
একটা লোকাল ট্রেন থেমেই আছে প্লাটফর্মে। একটি কামরার সামনে দাঁড়িয়ে স্বল্প আলোয় একজন লোক কাগজ পড়ছে। তপন একবার তাকে চকিতে দেখে নিয়ে সেই কামরাতেই উঠলো। সেই লোকটি ট্রেন ছাড়ার আগের মুহূর্তে কাগজটা ভাঁজ করে লাফিয়ে উঠে পড়লো এবং দরজার কাছে একটা সাটে বসে চেয়ে রইলো বাইরের দিকে।
যে-কটি স্টেশনে ট্রেন থামলো, প্রত্যেকবার লোকটি নেমে দাঁড়ালো প্ল্যাটফর্মে।
তপন কৌশিককে কথা বলতে নিষেধ করেছে। কিন্তু কৌশিকেরও সন্দেহ হলো লোকটির হাব ভাব দেখে। তপন সেই লোকটির দিকে প্রায় এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। কৌশিক একবার তপনকে কনুইয়ের খোঁচা মেরে জানতে চাইলো লোকটি সম্পর্কে। তপন মাথা নাড়লো দু’দিকে।
উল্টোডাঙ্গা স্টেশনে প্ল্যাটফর্ম থেকে সিঁড়ি দিয়ে অনেকটা নামতে হয়। কৌশিক রেলিং ধরে আস্তে আস্তে নামতে নামতে বারবার পেছন ফিরে তাকালো, সেই লোকটিকে দেখতে পেল না।
এখানেও বৃষ্টি পড়ছে, রিকশাও নেই। ওরা মুশকিলে পড়ে গেল।
তপন বললো, মিনিট পাঁচেক হাঁটতে হবে। পারবি?
কৌশিক বললো, পারবো। একটু সময় লাগবে। তুই আমার হাত ধরিস না, সামনে সামনে চল।
এই ঠাণ্ডার মধ্যেও তপনের মুখে ঘাম চকচক করছে। নিঃশ্বাস পড়ছে ঘনঘন। খানিকটা এগোবার পর সে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো, ট্রেনের সেই কাগজ-পড়া লোকটি খানিকটা দূরত্ব রেখে আসছে এদিকেই।
তপন একটা গলির মধ্যে বেঁকলো। গলির শেষ বাড়িটা একেবারে নতুন, দোতলা। একতলার ঘরগুলো অন্ধকার। দোতলার একটি ঘরে আলো জ্বলছে, কিন্তু সব কটা জানালায় ভারী পর্দা টানা। গলির দু’পাশে আরও নতুন নতুন বাড়ি উঠছে, এখনো লোকজন বিশেষ আসেনি মনে হয়। খুব নির্জন।
গলিটার মাঝখানে এসে তপন হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, কৌশিক, আমি একটা রিস্ক নিয়েছি, নিতে বাধ্য হয়েছি। তেকে আগে থেকে বলিনি, তুই শেষ মুহূর্তে যদি বেঁকে বসিস, মানে, তোকে একটা মিথ্যে কথা বলেছি।
সঙ্গে সঙ্গে কৌশিকের মুখখানা বিকৃত হয়ে গেল। সে একটা ফাঁদে পড়া হিংস্র প্রাণীর মতন একবার সামনের বাড়িটা, একবার গলিটার মুখের দিকে দেখলো, গলির মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। ট্রেনের সেই লোকটি।
কৌশিক বললো, শালা স্পাই! তোর দশ হাজার টাকার লোভ হয়েছে—
তপন কৌশিকের হাত চেপে ধরে বললো, শোন শোন, আগে কথাটা শোন—
কৌশিক হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করতে করতে বললো, তুই এক বাপের সন্তান, না বেজন্মা? খানকীর বাচ্চা! আমাকে ধরিয়ে দিবি? তুই বাঁচতে পারবি না, তোকে খতম করবোই! তুই পমপমের নাম করে টেনে এনে।
তপন বললো, কৌশিক, কৌশিক, শোন, এখানে পমপম নেই, কিন্তু…
কৌশিক বললো, পমপম নেই! আমাকেও মারবি ভেবেছিস! তোর মতন একটা নিমকহারামকে কুচি কুচি করে কাটবো।
নিজেকে ছাড়াতে না পেরে কৌশিক তপনের হাত কামড়ে ধরলো। তপন তবু মুঠি আলগা না করে বললো, এখানে তোর মা আছেন। একবার তোকে দেখা করতেই হবে।
কৌশিক মুখ তুলে বিমূঢ়ভাবে বললো, মা? শুয়োরের বাচ্চা, তুই এবার আমার মায়ের নাম বলে ভরকি দিচ্ছিস!
তপন বললো, মাসিমা সত্যিই এখানে আছেন। তুই মাসিমার সঙ্গে দেখা করবি না বলেছিলি, কিন্তু মাসিমা কেঁদে কেঁদে পাগলের মতন হয়ে গেছেন!
–আবার বাজে কথা?
–না, বাজে কথা নয়। নিশীথদা তোর মাকে এখানে নিয়ে এসেছেন।
–তোকে বলেছি না, মায়ের সঙ্গে, আমার বাড়ির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই।
-–কেন, মাসিমা কী দোষ করেছেন! মাসিমা বলেছেন, তোকে শুধু একবার দেখতে চান। উনি নিজের চোখে দেখলে বিশ্বাস করবেন যে তুই বেঁচে আছিস!
–আর, তোর মতন একটা ইডিয়েটকে নিয়ে…তুই আমার মাকেও বিপদে ফেলতে চাস? সেইজন্যই তো বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক রাখি না। পুলিশ আমার মাকে নিয়ে টানাটানি করবে। মারবে। অত্যাচার করবে! ও শুয়োরের বাচ্চারা সব পারে।
–এখানে কেউ টের পাবে না। গলির মোড়ের ঐ লোকটাকে ভয় নেই, ও আমাদের সাহায্য করতে এসেছে।
-–ও কে?
–বলছি তো, সাহায্য করতে এসেছে। কৌশিক, প্লীজ, বেশি সময় নেই। একবার চল, মাসিমার সামনে রাগারাগি করিস না! মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই চলে যেতে হবে।
–না, আমি মায়ের সামনে যাবো না!
–এ কী রকম কথা, আমি বুঝতে পারছি না। তুই পমপমের সঙ্গে দেখা করতে চাস, আর নিজের মাকে দেখবি না একবার? এ আবার কিসের বিপ্লব?
–মাকে কী বলবো আমি? আমি কি মার কাছে ফিরে যেতে পারবো?
–কিছু বলতে হবে না। মাসিমা শুধু তোকে একবার দেখবেন!
বিমূঢ় কৌশিককে প্রায় টানতে টানতে নিয়ে এলো তপন।
সদর দরজা খোলা, দোতলায় সিঁড়ির মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন নিশীথ মজুমদার। পাজামা আর খদ্দরের পাঞ্জাবি পরা, তার ওপর একটা মুগার চাঁদর জড়ানো। মধ্যবয়েসী, বেশ সবল পুরুষ। তাঁর মুখের চাপা উদ্বেগের চিহ্ন মুছে ফেলে তিনি তপনকে জিজ্ঞেস করলেন, সব ঠিক আছে?
তপন বললো, হ্যাঁ, এ পর্যন্ত কোনো গণ্ডগোল হয় নি। নিশীথ মজুমদার কৌশিকের দাড়ি সমেত থুতনিটা ছুঁয়ে বললেন, এই সেই কৌশিক? চিনতে পারে কার সাধ্য। তোকে আমি ছ’সাত বছরের বাচ্চা দেখেছি, মনে আছে?
কৌশিক কোনো উত্তর দিল না।
নিশীথ মজুমদার বললেন, খুব হীরো হয়েছিস, জেলের পাঁচিল থেকে লাফ দিয়েছিলি! ওরে, ব্রিটিশ আমলে আমরাও একবার জেল ভেঙেছিলুম। পমপমের বাবা অশোকদা, উনিও তখন কংগ্রেস করতেন, অশোকদা ছিলেন আমাদের সঙ্গে।
তারপর তিনি কৌশিকের কাঁধে সস্নেহ হাত রেখে বললেন, চল, বৌদি বড় কান্নাকাটি করছেন।
আলো-জ্বলা রটির দরজা ঠেলে খুলে ফেলে নিশীথ মজুমদার বললেন, বৌদি এই নিন, আপনার ছেলে। এবার বিশ্বাস হলো তো!
একটা বেতের চেয়ারে বসে ছিলেন অলকা, ছুটে এসে কৌশিকের মাথাটা দুহাতে জড়িয়ে ধরে কুশু, কুশু বলে হু-হুঁ করে কাঁদতে লাগলেন।
কৌশিকের চোখ জ্বালা করছে কিন্তু কান্না আসছে না। তার কান্না শুকিয়ে গেছে। সে আস্তে আস্তে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, মা, ভালো আছো তো? পিন্টু, সোমারা ভালো আছে?
অলকা আবার শুধু বললেন, কুশু!
কৌশিক শান্তভাবে বললো, মা, শুধু কাঁদলে তো চলবে না। বেশি সময় নেই।
অলকা চোখ মুছতে লাগলেন, কিন্তু তিনি হেঁচকি থামাতে পারছেন না। একটুক্ষণ কৌশিকের সারা গায়ে হাত বুলিয়ে, কোনোরকমে নিজেকে সামলে বললেন, আমি নিশীথকে ধরেছিলুম, কোনোরকমে একবার দেখা করিয়ে দেবার জন্য “হ্যাঁরে, এভাবে কতদিন চলবে তুই কোথায় থাকিস এখন?
–কোনো ঠিক নেই, মা।
–তুই আমাদের হুগলির বাড়িতে গিয়ে থাক। ওখানে কেউ টের পাবে না।
–পুলিশ ঠিক তাড়া করে যাবে। মামাদের ওখানে থাকলে মামারাই বিপদে পড়বে।
–হলে তুই বিলেতে চলে যা। বাবলু গেছে, আরও অনেকেই তো গেছে শুনেছি।
–আগে যারা চলে গেছে, তারা গেছে। এখন যাওয়া যাবে না। তুমি ও জন্য কিছু ভেবো না। আমি ঠিক থাকবো।
নিশীথ মজুমদার ইচ্ছে করেই এসময় ঘরে থাকেন নি। তপনকে নিয়ে তিনি গল্প করছেন বারান্দায় দাঁড়িয়ে। এই বারান্দা থেকে গলির মোড় পর্যন্ত দেখা যায়। একটু পরে তপন চঞ্চল হয়ে উঠে বললো, আর দেরি করা বোধহয় ঠিক হবে না!
নিশীথ মজুমদার সেই ঘরের দরজায় টক টক শব্দ করে বললেন, বৌদি, এবার ওকে ছেড়ে দিতে হবে।
কৌশিক বললো, মা, এবার যাই! তোমরা ভালো থেকো!
অলকা বললেন, আর একটু দাঁড়া!
আসলে দাঁড়াতেই অসুবিধে হচ্ছে কৌশিকের, পায়ে ব্যথা করছে, শরীরটা অসম্ভব দুর্বল লাগছে হঠাৎ। কিন্তু অলকা দাঁড়িয়ে আছেন বলে সে বসতেও পারেনি এতক্ষণ। মায়ের সামনে। কোনোরকম অসুস্থতা সে দেখাতে চায় না।
অলকা হ্যান্ডব্যাগ খুলে একড়া একশো টাকার নোট বার করে বললেন, এগুলো তোর কাছে রাখ।
নোট গুলোর দিকে তাকিয়ে কয়েক মুহূর্ত দ্বিধা করলো কৌশিক। তারপর দু’খানা একশো টাকার নোট তুলে নিলো।
অলকা বললেন, এই সবগুলোই রাখ তোর কাছে। তোর জন্য এনেছি, কুশু!
কৌশিক বললো, না, এতেই হবে।
অলকা তবু দু’তিনবার জোর করতে থাকলে কৌশিক দৃঢ়ভাবে বললো, মা, আমরা যে কাজ করতে নেমেছি, তাতে লোভ করতে নেই। বেশি টাকাও সঙ্গে রাখতে নেই। বলছি তো, এতেই চলে যাবে এখন। মা, যাই?
চোখের জল মুছে অলকা ব্যাগ থেকে দু’খানা ইনল্যান্ড চিঠি বার করে বললেন, এই দ্যাখ, পমপম আমাকে লিখেছে। তুই ওকেও কোনো খবর দিস না?
চিঠি দু’খানা প্রায় ছোঁ মেরে নিয়ে নিল কৌশিক। দ্রুত চোখ বোলালো। দুটো চিঠিই বেশ সংক্ষিপ্ত। বহরমপুরের এক নার্সিং হোমের ঠিকানা। পমপম অসুস্থ হয়ে সেখানে আছে, কৌশিকের সন্ধান হারিয়ে ফেলেছে বলে অলকার কাছ থেকে কৌশিকের ঠিকানা জানতে চায়। চিঠির হাতের লেখা পমপমের নয়, কিন্তু তলার সইটা আঁকাবাঁকা হলেও পমপমেরই।
চিঠি দু’খানা পকেটে ভরে নিয়ে কৌশিক এই প্রথম নিজে থেকে জড়িয়ে ধরলো মাকে। এতক্ষণে তার চোখে জল এসেছে, সে বাষ্পজড়ানো গলায় বললো, আমার জন্য চিন্তা করো না, মা, আমি ঠিক থাকবো। শরীরের যত্ন নিও!
ঘর থেকে বেরিয়ে এসেই কৌশিক বললো, আমি এক্ষুনি বহরমপুর যাবো!
নিশীথ মজুমদার বললেন, চলো, আমি তোমাদের গলির মোড় পর্যন্ত পৌঁছে দিচ্ছি। বৌদির জন্য ভাবিস না, কুশু, বৌদিকে পুলিশ ডিসটার্ব করবে না। তোর বাবা এক সময় আমাদের কত সাহায্য করেছেন!
গলির মোড়ে এখন একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। ট্রেনের সেই লোকটি আড়ালে কোথাও ছিল, এখন এগিয়ে এসে ট্যাক্সির দরজা খুলে দিয়ে তপনকে বললো, হাওড়া স্টেশানে কিংবা শিয়ালদায় যাইস না। নৈহাটিতেও যাইস না।
সে নিজে উঠলো না, ট্যাক্সির গায়ে দু’বার চাপড় মারতেই ড্রাইভার ছেড়ে দিল। কৌশিকের শরীর অস্থির অস্থির করছে। তার অসুস্থ শরীরে এতখানি আবেগ সহ্য হয়নি। এই রকম সময়ে গোটা কতক অ্যাসপ্রো-জাতীয় ট্যাবলেট খেলে তার উপকার হয়। তপনের কাছ থেকে পোঁটলাটা নিয়ে খুলে সে ট্যাবলেট বার করলো, কিন্তু একটু জল না হলে খাবে কী
সে ঝুঁকে ট্যাক্সি ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলো, আপনার কাছে জলের বোতল আছে?
তপন বললো, নিশীথদার ওখানে জলের কথা বললি না? নিশীথদা কিছু খাবারের ব্যবস্থা করবেন বলেছিলেন, আমি বারণ করলাম।
ড্রাইভারটি বললো, রাস্তার ধারে কোনো টিউবওয়েল দেখলে থামাবো? আমার কাছে তো ডিসটিল্ড ওয়াটার আছে, ব্যাটারিতে দেবার জন্য।
কৌশিক বললো, ঐ ডিসটিলড ওয়াটারই দিন, একটু খানি, এক ঢোঁক।
ওষুধ খাবার পর মাথাটা হেলিয়ে দিয়ে কৌশিক বললো, ঐ যে লোকটা, ট্রেনে আমাদের ফলো করছিল, শেষে ট্যাক্সিতে উঠিয়ে দিল, ও কে রে? নিশীথদার লোক!
তপন আড়ষ্টগলায় বললো, তোকে আগে ওঁর কথা জানাইনি, তুই রেগে যেতিস। আমাদের অনেক সাহায্য করেছে।
–কোন পার্টির লোক, সেটা বল আগে।
–কোনো পার্টির না, উনি পুলিশ। স্পেশাল ব্রাঞ্চের লোক, আমার চেনা।
–তুই বুঝি আজকাল পুলিশের সঙ্গেও মাখামাখি শুরু করেছিস?
–কৌশিক, তোকে আগে একদিন বলেছিলাম। তোর মনে নেই। ওনার বাড়ি ইস্টবেঙ্গলে, আমাদেরই সরাইল গ্রামে। কথায় কথায় আমাদের সাথে একটা আত্মীয়তাও বেরিয়ে গেল। তাই উনি আমাকে ছোট ভাইয়ের মতন সাহায্য করছেন। নিজের ডিপার্টমেন্টের কারুকে না। জানিয়ে, রিস্ক নিয়ে। অন্য পুলিশ আমাদের ফলো করছে কি না, সেটা উনিই ভালো বুঝতে পারবেন। এনার জন্যই কোনো বিপদ হয় নি।
কৌশিক ক্লান্ত ভাবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। চোখ বুজে রইলো খানিকক্ষণ।
তারপর আস্তে আস্তে বললো, একটা সিগারেট দিবি? ধরিয়ে দে, আমার বড়ড শরীরটা খারাপ লাগছে। ট্যাক্সি নিয়ে কতদূর যাবো? ও, এই নে, মা দিয়েছে।
একশো টাকার নোট দুটো সে বাড়িয়ে দিল তপনের দিকে।
তপন বললো, আমি নিয়ে কী করবো। তোর কাছে রাখ।
হাত বাড়িয়ে তপনের কাঁধ ছুঁয়ে কৌশিক বললো, তুই আমার ওপর রাগ করেছিস? আমি তোকে খুব খারাপ খারাপ গালাগাল দিয়েছি। আগে কোনোদিন আমি এসব গালাগাল উচ্চারণও করতুম না। মাথাটা কী যে হয়ে যায় মাঝে মাঝে।
তপন শুকনো ভাবে বললো, গালাগালটা কিছু না। রাগের মাথায় লোকে খারাপ কথা বলতে পারে। কিন্তু আসল ব্যাপার হলো, আমাদের মধ্যে অবিশ্বাস এসে যাচ্ছে। তুই আমাকে যখন তখন সন্দেহ করিস। যদি আমরা নিজেরাই নিজেদের বিশ্বাস করতে না পারি, তা হলে
আর কী বাকি রইলো।
–আমি ক্ষমা চাইছি, তপন।
–ক্ষমা চাইবার কিছু নেই। তুই তাহলে মনে করি যে আমি তাকে সত্যিই ধরিয়ে দিতে পারি?
–মানুষ যা একেবারেই বিশ্বাস করে না, সে রকম কথাও এক এক সময় মুখ দিয়ে বলে ফেলে। দিনের পর দিন একা থাকলে বোধহয় এরকম হয়। আমি আর একা থাকতে পারছি না! কবে আবার কাজ শুরু করবো?
–আজ রাতে তোকে কোথায় রাখবো, সেইটাই ভাবছি।
–আমি আজ রাত্তিরেই বহরমপুর যাবো। যে কোনো উপায়ে।
–ভবেনদা হাওড়া আর শিয়ালদায় যেতে বারণ করলো। নিশ্চয়ই কিছু বিপদ আছে। তাহলে বহরমপুর যাওয়া যাবে কী করে? সন্ধের পর কি অতদূর বাস যায়?
-–শিয়ালদার বদলে দমদম থেকে ট্রেনে উঠবো। রাত্তিরটা ট্রেনেই কেটে যাবে। কাল সকালে–
–বহরমপুর ডেঞ্জারাস জায়গা এখন। আমি বরং ভাবছিলাম, বসিরহাট কিংবা বনগাঁয় জয় বাংলার বারে গেলে কেমন হয়? কোনো রিফিউজি ক্যাম্পে ঢুকে গেলে পুলিশ সন্দেহ করবে না।
–আমাকে বহরমপুরে যেতেই হবে! তুই পমপমের খবর সত্যিই জানতিস না? পমপম নিজের হাতে চিঠি পর্যন্ত লিখতে পারে না।
বহরমপুরে নেমে সরাসরি নার্সিং হোমে না গিয়ে তপন বাস স্ট্যান্ডের কাছে খুব শস্তার এক হোটেলে একখানা ঘর ভাড়া নিল। কৌশিক সারাদিন শুয়ে রইলো সেখানে। ট্রেনে ছারপোকার কামড়ে তার সারা শরীর ফুলে গেছে প্রায়। পেটে আবার যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। বুলেটটা যেন মাঝেমাঝে পেটের মধ্যে নড়াচড়া করে, সে টের পায়।
নার্সিং হোমটা একবার ঘুরে দেখে এলো তপন। সেখানে পমপম সেনগুপ্ত নামে কোনো পেসেন্ট নেই, অবশ্য পমপম অন্য নাম নিতেই পারে। এত জায়গা থাকতে পমপম বহরমপুরের এক নার্সিং হোমে কেন আসবে, তা বোঝা যাচ্ছে না।
রাত সাড়ে আটটার পর পেটের ব্যথাটা একটু কমলে কৌশিক ছোট ছেলের মন বায়না ধরলো, সে নিজে একবার নার্সিং হোমে গিয়ে দেখে আসবে। পমপম নিশ্চয়ই সেখানে আছে। এই সময় যে বাইবের কোনো লোককে নার্সিং হোমে ঢুকতেই দেওয়া হয় না, সে কথা সে। কিছুতেই শুনবে না।
তখন কৌশিকের একটা কথা মনে পড়লো। এক সময় এই বহরমপুরের জেলেই তাকে থাকতে হয়েছিল কয়েক মাস। সেই সময় অলি একবার দেখতে এসেছিল তাকে। তখন নকশালদের সঙ্গে কেউ কোনোরকম সম্পর্কের কথা স্বীকার করতে চায় না, তবু অলি এসেছিল, সাহস করে। সে এনেছিল পমপমের খবর, অতীনের খবর। পরে পমপমের কাছে কৌশিক শুনেছিল যে বহরমপুরে অলির এক মামা থাকেন, তিনি ডাক্তার, তিনি নকশালদের কিছু কিছু সাহায্য করেন। কী যেন অলির সেই ডাক্তার মামার নাম? শক্তি না শান্তি? শক্তি মজুমদার? শান্তি মজুমদার, এই দুটোর একটা হবেই!
এবারে তপনকে বেরুতেই হলো কৌশিককে নিয়ে। বহরমপুর শহরটা এক বছর আগেও যতটা ভয়ের জায়গা ছিল, এখন আর ততটা নেই। সীমান্ত বেশি দূরে নয়, এখানেও জয় বাংলার প্রচুর লোক গিসগিস করছে। এখানে ট্রেনিং ক্যাম্প হয়েছে দুটো, রাস্তা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা যখন তখন দল বেঁধে যাতায়াত করে। পুলিশী ব্যবস্থা কিছুটা শিথিল।
নার্সিং হোমটা কাছেই, গেটের বাইরেই প্রধান ডাক্তারের নাম লেখা, শান্তিময় মজুমদার।
কৌশিকের যেন চোখ জ্বলে উঠলো। প্রবল মনঃসংযোগে সে স্মৃতি থেকে এই নামটা উদ্ধার করেছে। পমপম একবারই মাত্র নামটা উল্লেখ করেছিল, এখন বোঝা যাচ্ছে অলির সঙ্গে চেনাশুনোর সূত্রেই পমপম এখানে এসেছে।
কৌশিক বললো, দিস ইজ ইট! পমপম এখানে থাকতে বাধ্য। শোন, তপন, ডাক্তারটি যদি এখন আমাদের সঙ্গে দেখা করতে না চায়, তাহলে একদিনের জন্য আমি এখানে ভর্তি হয়ে যাবো। বলবি, আমি গুরুতর অসুস্থ। তোর কাছে তো এখনো শ দেড়েক টাকা আছে?
ভেতরের কাউন্টারে একটি লোক ঘাড় নীচু করে কী যেন লিখে চলেছে। কৌশিক তার সামনে গিয়ে বললো, দেখুন ডক্টর মজুমদারের সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই।
লোকটি মুখ না তুলেই বললো, এখন তো দেখা হবে না। কাল সকালে ন’টার পর আসবেন।
কৌশিক বললো, আমার পেটে সাঙ্ঘাতিক ব্যথা হচ্ছে, নিশ্বাস ফেলতে পারছি না। কোনো ডাক্তার অ্যাটেন্ড না করলে মরে যাবো। আমাকে ভর্তি করে নিন।
লোকটি বললো, একটাও তো বেড় খালি নেই ভাই। হাসপাতালে চলে যান!
কৌশিক সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বড় করে দম নিল। কোমরের কাছে হাত বুলোলো একবার। এখন সে তার রিভলভারটার অভাব খুব বোধ করছে। এই লোকটার কপালে রিভলভারের নলটা ঠেকালেই কাজ হয়ে যেত। অস্ত্র নেই, গায়ের জোর নেই, এমনকি গলার জোরও এমন কমে গেছে যে কৌশিক ওকে ধমকেও ভয় দেখাতে পারবে না।
সে একবার তপনের দিকে তাকালো। এইসব ব্যাপারে তপন খুব সুবিধে করতে পারে না। তার চেহারা বা কথা শুনলে কেউ সমীহ করে না।
কৌশিক খুবই বিনীত ভাবে বললো, দয়া করে একবার মুখ তুলে আমার কথাটা শুনবেন? আমরা কলকাতা থেকে এসেছি। ভবানীপুরের বিমানবিহারী চৌধুরীর মেয়ে অলি চৌধুরী আমাদের পাঠিয়েছেন। তিনি ডক্টর মজুমদারের ভাগ্নী হন। ডক্টর মজুমদার নাম শুনলেই চিনতে পারবেন। আপনি অনুগ্রহ করে তাঁকে একবার খবর দিন যে অলির কাছ থেকে কৌশিক রায় নামে একজন এসেছে। বিশেষ দরকার। বুঝতেই পারছেন, খুব দরকার না থাকলে এই সময় ডিসটার্ব করতুম না।
লোকটি এবার কাউন্টার ছেড়ে বেরিয়ে এসে পাশের একটা ছোট্ট ঘর দেখিয়ে বললো, এখানে বসুন। আপনাদের ভাগ্য ভালো, ডাক্তারবাবুর আর ঠিক পাঁচ মিনিট বাদে ডি এম-এর বাংলোয় তাস খেলতে যাবার কথা।
একটু বাদে সেই ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন অলির ছোট মামা। সাদা প্যান্টশার্টের ওপর একটা শাদা পুলওভার পরা। তিনি দু’জনের ওপর চোখ বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনাদের মধ্যে কৌশিক রায় কে?
কৌশিক আগেই উঠে দাঁড়িয়েছে। খানিকটা নাভাস ভাবে বললো, আমি!
ঠোঁটে বিদ্রূপ ও কৌতুক মেশানো একটা হাসির ঝিলিক দিয়ে শান্তিময় বললেন, এতদিনে বাবু কৌশিক রায়ের আসবার সময় হলো? আমরা দু’মাস ধরে আপনার প্রতীক্ষায় বসে আছি। প্রায় শবরীর প্রতীক্ষার মতন।
কৌশিক ঠিক বুঝতে না পেরে বললো, আমার জন্য?
শান্তিময় বললেন, ইয়েস! পুলিশ আপনার জন্য এখানে ফাঁদ পেতে রেখেছে। আপনি এলেই খপ করে ধরবে। দরজার দিকে তাকাচ্ছেন কী, এখান থেকে পালানো সহজ?
কৌশিক শান্তিময়ের চোখে চোখ রেখে বললো, আমাদের যারা ধরিয়ে দেয়, তাদের। কিছুতেই আমরা ক্ষমা করি না। আমাদের কেউ না কেউ এসে ঠিক প্রতিশোধ নিয়ে যাবে।
ডাক্তার অনুচ্চ শব্দে হাসলেন। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন, হুঁ, এখনও খানিকটা তেজ অবশিষ্ট আছে দেখছি! অত উত্তেজিত হবার কিছু নেই, আমার এই নার্সিং হোমের প্রেমিসেসের মধ্যে আজ অবধি আমি পুলিশ ঢুকতে দিই নি। একটা কথা জিজ্ঞেস করি, অলি চলে গেছে অ্যামেরিকায়। সে তোমাদের এখানে পাঠালো কী করে?
কৌশিক বললো, অলি পাঠায় নি। অলির নামটা নিতে হলো, না হলে আপনার সঙ্গে দেখা করতে দিচ্ছিল না। আপনাকে বেশিক্ষণ আটকাবো না। আমি শুধু একটাই কথা জানতে চাই। পমপম সেনগুপ্ত, অলির খুব বন্ধু। সে কি এখানে আছে?
শান্তিময় বললেন, পমপমের আর এক বন্ধু কৌশিক রায় কেন পমপমকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে, সেটা জানতে পারি কী?
সাঙ্ঘাতিক বিমর্ষভাবে কৌশিক বললো, কী হয়েছে পমপমের!
–এসো আমার সঙ্গে!
পুরোনো আমলের বাড়ি, ওপরে ওঠার সিঁড়িটা বিরাট লম্বা। সেই সিঁড়ির মুখে এসে কৌশিক একটু থমকে গেল।
তপন মৃদু গলায় বললো, তুই আমার কাঁধে ভর দে। আমি ধরে ধরে তুলছি।
শান্তিময় মুখ ফিরিয়ে কৌশিককে ভালো করে দেখলেন। তারপর তপনকে বললেন, তুমি ভাই বাঁ দিকটা ধরো, আমি এই দিক ধরছি। সেই ভাবে উঠতে পারবে, স্ট্রেচার আনবো?
কৌশিক বললো, এই ঠিক আছে। আমার সিঁড়ি ভাঙতে একটু কষ্ট হয়।
শান্তিময় বললেন, একটু? তোমার গায়ে বেশ জ্বর, মুখের চামড়া দেখলেই বোঝা যায় দারুণ অ্যানিমিয়া, তোমার শরীরের আর আছে কী? তোমার সম্পর্কে আমরা অনেক কিছু জানি, তোমার দু’পা ভেঙেছিল, কাঁধে আর পেটে গুলি ঢুকেছে।
তপন বললো, পেটের মধ্যে এখনো গুলিটা রয়েছে।
শান্তিময় বললেন, পেটের মধ্যে গুলি নিয়েও অনেকে বহুদিন বেঁচে থাকতে পারে, কিন্তু এই অ্যানিমিয়াটা খুব ভয়ের। পমপম যে এখানে আছে, সে খবর বুঝি তোমরা আগে পাওনি?
কৌশিক বললো, মাত্র আজই পেয়েছি। এর আগে আমার বন্ধু তপন ওকে তন্নতন্ন করে খুঁজেছে। কোনো ট্রেস পায় নি।
শান্তিময় বললেন, পমপমের বাবা ওকে কলকাতার একটা নার্সিং হোমে ভর্তি করাতে চেয়েছিলেন কিন্তু পমপম বাবার পয়সায় চিকিৎসা করাবে না বলে বাবার সঙ্গে ঝগড়া করে দুম করে চলে এসেছিল এখানে। তাও এসেছিল নিতান্তই মনের জোরে, তখন ওর একা একা চলাফেরা করার ক্ষমতাই ছিল না। আসবার সময় তোমাদের নামে বাড়িতে একটা চিঠি লিখে রেখে এসেছিল, তোমরা সেটা পাওনি?
তপন বললো, আমি তিন-চারবার পমপমদের বাড়িতে গেছি, ওর বাবার সঙ্গেও দেখা করেছি, চিঠি তো দেওয়া হয়ইনি, কোনো খবরও দেননি পমপম সম্পর্কে।
–উনি জানেন যে পমপম এখানে আছে। উনি দু’বার এসে দেখেও গেছেন। এদিকে মুশকিল হয়েছে কি, তোমাদের সঙ্গে যোগাযোগ হারিয়ে পমপম অসম্ভব ডিপ্রেশনে ভুগছে। তার ধারণা হয়েছে, আমি ফ্র্যাংকলি বলছি,, কৌশিক রায় সম্ভবত বেঁচে নেই, আর তার বন্ধু তপন সব সম্পর্ক ত্যাগ করেছে! এই ডিপ্রেশানের ফল কী জানো? কৌশিক রায় বেঁচে নেই, এই কথা চিন্তা করতে করতে পমপমের নিজের বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই চলে গেছে। যে পেসেন্ট নিজে বাঁচতে চায় না। তাকে ডাক্তাররা কতদিন বাঁচিয়ে রাখতে পারে?
তপন আর শান্তিময় প্রায় বহন করেই কৌশিককে নিয়ে এলেন তিন তলায়। তারপর দু’জনেই হাঁপাতে লাগলেন।
সিঁড়ির মুখের কোলাপসিবল গেট টেনে বন্ধ করে দিয়ে শান্তিময় বললেন, ওপর তলাটায় আমরা নিজেরা থাকি। আর পমপম থাকে। আরও একটা গেস্ট রুম আছে, সেখানে আজ তোমরা দু’জনে থাকবে।
পমপম একটা লোহার খাটে শুয়ে আছে। গভীর ভাবে ঘুমন্ত। তার চেহারাটা শুকিয়ে এত ছোট হয়ে গেছে যে তাকে চেনাই যায় না। তার শিয়রের কাছে এসে দাঁড়ালো ওরা তিনজন। শান্তিময় পমপমের কপালটা ছুঁয়ে বললেন, হেভি সিডেটিভ দিয়ে ওকে ঘুম পাড়াতে হয়। নইলে পেটের ব্যথায় চিৎকার করতে থাকে। অনেক চেষ্টা করেও ঐ ব্যথাটা কমানো যাচ্ছে না। আমার ধারণা, ওটা সাইকোসোমাটিক। তবে, লালবাজারে যে পুলিশ অফিসারটি পমপমের শরীরের প্রাইভেট পার্টসেও টচার করেছে, আমারই এক এক সময় ইচ্ছে করে, তাকে গুলি করে মেরে আসি। তোমরা এত কনস্টেবল মারো, তাকে কিছু করতে পারলে না?
কৌশিক চোয়াল শক্ত করে বললো, তাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না!
সেখান থেকে জানলার কাছে সরে গিয়ে শান্তিময় বললেন, কৌশিক রায়, এ কী ধরনের বিপ্লব তোমাদের? যুদ্ধে যারা আহত হবে, তাদের জন্য একটা চিকিৎসক স্কোয়াড তৈরি করার কথা আগে ভাবো নি? পুলিশের তাড়া খেয়ে যারা আত্মগোপন করবে, তারা যে কোথায় শেলটার নেবে, খবর কী করে যোগাড় হবে, সে সম্পর্কে প্ল্যান নেওয়া উচিত ছিল না? লোকের কাছ থেকে বন্দুক কাড়ছো, বুলেট কোথা থেকে পাবে, তা ভেবেছো?
হঠাৎ থেমে গিয়ে শান্তিময় বললেন, যাক, তোমরা আমার কাছে এসে পড়েছে বলেই আমি তোমাদের ওপর উপদেশ ঝাড়তে চাই না। আমার এই এক দোষ হয়েছে ইদানীং। বেশি বকবক করা। তবু একটা কথা বলবোই। কৌশিক, তপন, তোমাদের বাঁচতে হবে। বেঁচে না থাকলে কিসের বিপ্লব, কিসের দেশোদ্ধার, কিসের গরিবের উন্নতি। অকারণে প্রাণ দিলে এর কোনোটাই হয় না। হ্যাঁ, মানছি, বড় একটা কাজের জন্য, মহৎ একটা উদ্দেশ্যর জন্য মানুষ অনেক সময় প্রাণ দিতে দ্বিধা করে না, কিন্তু তাতে সেই মহৎ উদ্দেশ্যটা যাতে একটুখানি সফল হয়, কিংবা অন্যরা প্রেরণা পায়, সেটাও তো দেখতে হবে? শুধু শুধু ব্যর্থ মৃত্যু, এত চমৎকার সব প্রাণ, এগুলো নষ্ট হতে দেখলে আমি সহ্য করতে পারি না। বাঁচতে হবে, বাঁচাতে হবে, বেঁচে থেকে উদ্দেশ্য সফল করতে হবে। এই যে তোমাদের নেতা মানিক ভটচাজ, তাকে দেখতে গিয়েছিলুম, কী সামান্য ভাবে, মিনিংলেস ভাবে তার মৃত্যু হলো বলো তো!
কৌশিক বললো, আপনি মানিকদাকে দেখেছেন?
–দেখেছি বলতে পারো, আবার দেখিনিও বটে। একটা ডেড বডি দেখা মানে সেই লোকটিকে তো দেখা নয়। আমাকে ডেকে নিয়ে গেল এত দেরি করে, ততক্ষণে সব শেষ। পরে অলির কাছে, পমপমের কাছে শুনেছি তোমাদের নেতা ঐ মানিকবাবুর কথা, এমন একটা মহৎ মানুষ প্রাণ দিলেন সামান্য পাটি রাইভালরির জন্য? এতে দেশের কী উপকারটা হলো শুনি, বাঁচতে না শিখলে, জীবনটাকে ভালোবাসতে না শিখলে কি পৃথিবীটাকে ভালোবাসা–
কৌশিক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো, এই মানিকদাকে রক্ষা করার জন্য অতীন একজনকে মারতে বাধ্য হয়েছিল। তারপর খুনের অপবাদ নিয়ে দেশান্তরী হয়েছে। তার পরেও পাটির ছেলেরা মানিকদাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলো না!
একটু পরে ঘরে আর একজন মহিলা ঢুকলেন। শান্তিময় পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, এই মামার স্ত্রী রীতা। অলির খুব ফেভারিট মামামা। আর রীতা, এই শ্ৰীমান হচ্ছে সেই ফেমাস কৌশিক রায়, যার নাম আমরা রোজ জপ করছি।
রীতা রাগ রাগ মুখ করে বললেন, আপনারা এতদিন পর এলেন? ভয় পেয়ে পালিয়ে ছিলেন? পমপম আপনার জন্য কী কষ্ট পেয়েছে তা শুধু আমরাই জানি।
কৌশিক কাতর ভাবে হাসলো। তারা যে কী অবস্থায় এই দু’মাস কাটিয়েছে, সে কাহিনী এদের শুনিয়ে লাভ নেই।
তারপর দু’দিন কেটে গেল সেখানে। তপন চলে যেতে চাইলেও শান্তিময় তাকেও ছাড়লেন না। তপনের যে ইতিমধ্যে টি বি হয়ে বসে আছে, তা সে নিজেই জানতো না। কৌশিকের জন্য সে নিজের দিকে মনোযোগ দেবার সময়ই পায়নি।
তৃতীয় দিনে শান্তিময় একটা অদ্ভুত প্রস্তাব দিলেন। তিনি এই নার্সিং হোমের মধ্যেই কৌশিক আর পমপমের বিয়ে দিতে চান।
তিনি পমপমের বিছানার পাশে কৌশিককে দাঁড় করিয়ে বললেন, দেখো, তোমরা দুটি আহত, দুঃখী মানুষ। তোমরা আর কতদিন বাঁচবে সে গ্যারান্টি আমি দিতে পারি না। তবু, তোমরা যদি মনের দিক থেকে পরস্পরের খুব কাছাকাছি থাকো, আপাতত বিপ্লব-টিপ্লব ভুলে শুধু দু’জনে দু’জনের ওপর নির্ভর করো, তাহলে তোমাদের শরীর-স্বাস্থ্যের উন্নতি হলেও হতে পারে। এই আমার ধারণা, যদি কোনোদিন পুরো সুস্থ হয়ে ওঠো, তাহলে আবার আদর্শ নিয়ে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়বে না হয়। আপাতত আমি এখানেই আর একটা খাট এনে দিচ্ছি, তোমরা রাত্তিরেও পাশাপাশি থাকবে।
রীতা আর তপন দু’জনেই খুব উৎসাহের সঙ্গে সমর্থন করলো এ প্রস্তাব।
পমপম হ্যাঁ কিংবা না কিছুই বললো না, চুপ করে চেয়ে রইলো। কৌশিক ক্ষীণ আপত্তি জানিয়ে বললো, এক ঘরে পাশাপাশি খাটে থাকতে পারি, আমার সেটাই ইচ্ছে, কিন্তু তার জন্য কি বিয়ে করার দরকার আছে?
শান্তিময় বললেন, আমি বিয়ের শাস্ত্রীয় কিংবা মরাল দিকটার কথা বলছি না। দুটি সুস্থ যুবক-যুবতী স্বেচ্ছায় লিভিং টুগেদার করলেও আমার বলার কিছু নেই। কিন্তু তোমরা যেহেতু অসুস্থ, দুর্বল, সেইজন্যই এই সামাজিক বন্ধনটায় তোমাদের ক্ষেত্রে টোটকার কাজ করতে পারে। কেন, বিয়েতে তোমার আপত্তিই বা কিসের?
পরদিনই শান্তিময় ডেকে আনলেন একজন ম্যারেজ রেজিস্ট্রার। তাঁর খাতায় এক মাস আগের ডেট দিয়ে নোটিস বসানো হলো। তারপর তিনি পমপম আর কৌশিকের আইনসিদ্ধ বিয়ের পুরোহিত হয়ে বসলেন দুটি লোহার খাটের মাঝখানের চেয়ারে।
পমপম নীচে নামতে পারে না, তার নিম্নাঙ্গে ক্যাথিটার লাগানো, রীতা একখানা নতুন শাড়ি পরিয়ে তাকে বসিয়ে দিয়েছেন। পেটের ব্যথা যাতে না বাড়ে, সেই জন্য পমপমকে সারাদিন সলিড ফুড কিছু না দিয়ে শুধু গ্লুকোজ খাওয়ানো হয়েছে। পমপমের আজ জ্ঞান আছে পুরোপুরি, সে এমনকি একবার রসিকতা করে বললো, কৌশিকের দাড়িটা কামিয়ে দিলে না? এমন ঝোঁপ-জঙ্গলের মতন দাড়িওয়ালা বর আমি আগে দেখিনি!
কৌশিকও বললো, আহা, ক্যাথিটার লাগানো নববধূই বা পৃথিবীতে কে আগে দেখেছে?
এ বিয়েতে কোনো মন্ত্র নেই। আইনের শুকনো কথাগুলো উচ্চারণ করার পর রেজিস্ট্রার মহোদয় নিজস্ব একটি বাক্য উচ্চারণ করলেন, আপনাদের বিবাহ দীর্ঘস্থায়ী ও শান্তিপূর্ণ হোক।
তপন বেরিয়ে গিয়ে কোথা থেকে যোগাড় করে এনেছে এক রাশ নানা ধরনের ফুল। সেইগুলো সে ছড়িয়ে দিল কৌশিক আর পমপমের লোহার খাটে।
বিয়ে হলো, আর ফুলশয্যা হবে না?