৫৪
আজ ছুটি হবে পৃথুর। কতদিন পরে বাড়ি যাবে ও। কোনও সাড় নেই। মন বড় অশান্ত হয়ে রয়েছে ক’দিন হল। বার বার ‘কু’ ডাক দিচ্ছে। নানা কথা মনের মধ্যে ঝড় তুলছে।
পাগল হয়ে যাবার আগে কি মনের অবস্থা এরকম হয়?
কে জানে?
দীর্ঘদিন আমি এমন প্রবাসী হয়ে আছি।
বড়ো দীর্ঘদিন, দীর্ঘবেলা।
জলের ভিতরে ক্রমে জমে-ওঠা শ্যাওলার সবুজ,
হাওয়া ভারী হয়ে আসে, স্রোত
থেমে যায়, ক্রমে
কুসুমের বুক থেকে ঝরে পড়ে নিহিত কুসুম।
দীর্ঘদিন বিজনে একেলা।
প্রণব মুখোপাধ্যায়।
বড় গাড়িতেই যেতে পারত। কিন্তু ভুচু বলেছে যে, সে জীপ নিয়ে আসবে। ভালই। কত্বদিন জীপে চড়ে না।
ব্রেকফাস্টের পরই ওরা এসে গেল। ভুচু, লাড্ডু আর দিগা।
দিগা হাসল।
দিগার হাসিটা আশ্চর্য। অন্য দশটা সাধারণ মানুষের হাসির সঙ্গে একেবারেই মিল নেই। ও যেন পৃথুর বুকের মধ্যেটা সহজেই দেখতে পায়। তার সব দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, দুঃখ, একাকিত্ব। কিন্তু দিগা সমবেদনা জানায় না কখনও। করুণা করে না। যেন, না-বলেই বলে, মানুষ হয়ে জন্মেছ বলেই তো দুঃখ। দুঃখবোধ যার নেই সে তো মানুষই নয়! দুঃখে, দুঃখিত হবে কেন। দুঃখ সাঁতরে যাওয়ার আরেক নামই তো জীবন!
ওরা একটা খারাপ খবর নিয়ে এল। সাবীর মিঞারও আসার কথা ছিল ওদের সঙ্গে। পাঁচদিন আগে রাতে তাঁর ম্যাসিভ একটা হার্ট-অ্যাটাক হয়ে গেছে। লেফট ভেন্ট্রাকুলার ফেইলিওর। চলেই যেতেন। দুদিন অক্সিজেনে ছিলেন। গিরিশদা, শামীম আর হুদা ওঁর বাড়িতেই আছেন। লাড্ডু আর ভুচু বলছিল যে, পৃথুর এই পা-হারানো ব্যাপারটা সাবীর সাহেবকে বড়ই ধাক্কা দিয়ে গেছে। কেবলই বলতেন, খুদাহ এ কী করলেন। এত ভরসা ছিল খুদাহর উপরে!
পৃথুর টুকটাক জিনিসপত্র সব গুছিয়ে দিচ্ছিল ভুচু। পাউডারের কৌটো, ওডিকোলোনের শিশি; ওষুধপত্র। সিস্টার জনসন-এর ডিউটি ছিল আজ সকালে। ওষুধ কখন কী খেতে হবে, সব ভাল করে বুঝিয়ে দিলেন তিনি।
অশ্বত্থগাছটার মাথায় রোদ ঝিলমিল করছে। ঘরে অত লোক থাকলেও সেই শালিকটা সাহস করে উড়ে এল ঘরে। সাহসী একলা শালিক। ওয়ান ফর সরো।
ক্রাচ-এ ভর দিয়ে দাঁড়ানো পৃথুর দিকে ভুচু ভাল করে চাইতেও পর্যন্ত পারছিল না। খারাপ লাগছিল ভীষণ। ভাবছিল, ঈশ্বর যাইই করেন তারই পেছনে যুক্তি নিশ্চয়ই থাকে। সেই যুক্তি, আমাদের খোলা ও অদূর-দৃষ্টি চোখে চেয়ে আমরা বুঝতে পারি না। পৃথুর শাস্তি পাওয়ার হয়তো দরকার ছিল। সমস্ত রকম অনুভূতির মধ্যে দিয়ে তাকে পার করাবার পেছনে কোনও গভীর উদ্দেশ্য হয়তো আছেই। তাঁকে বা তাঁর স্বরূপকে বোঝার ক্ষমতা নেই বলেই হয়তো মনে হয় ঈশ্বর নিষ্ঠুর।
পামেলা এসব কথা খুব সুন্দর করে বলতে পারত; বোঝাতে পারত। আর পামেলা!
ক্রাচ-এ ভর দিয়ে ঘর থেকে বেরুল পৃথু। ঘরের বাইরেটা তার একেবারেই অচেনা। করিডর, সিঁড়ি, লবি, সবই! যখন এসেছিল, তখন তো হুঁশ ছিল না। সার্জনরা দুজনেই এসেছিলেন সাতসকালে। হ্যান্ডশেক করে বললেন, টেক্ ইট ইন ইওর স্ট্রাইড মিঃ ঘোষ। দিস্ ইজ লাইফ।
থ্যাঙ্ক উ্য।
বলেছিল পৃথু।
ও জানে। এমন কিছুই কোনও মানুষের জীবনে ঘটতে পারে না, তা যতই দুঃখবহ বা যন্ত্রণার হোক না কেন; যা তার আগে অসংখ্য অন্য মানুষের জীবনে ঘটেনি। তার পা-ই তো প্রথম কাটা গেল না! তবে দুঃখটা কিসের? এইটে ভাবলেও খারাপ লাগে। জীবনের সব অভিজ্ঞতাই আগে অন্য কোনও না কোনও মানুষের হয়েছেই। আনন্দর এবং দুঃখের সব অভিজ্ঞতাই। কোনও বিশেষ আনন্দ বা দুঃখের অবকাশ নেই তাই এতে।
সিস্টার জনসনকে ধন্যবাদ দিয়েছিল পৃথু।
উনি বলেছিলেন, এ তো আমাদের কর্তব্য!
কর্তব্যকর্মই বা কজন করে ভাল করে?
পৃথু হেসে বলেছিল। বলেছিল, সিস্টার লাওয়ান্ডেকে বলে দেবেন। দেখা হল না যাবার সময়।
ক্ৰাচটা নিয়ে জীপের সামনের সীটে উঠে বসতে গিয়েই টাল সামলাতে না পেরে, পড়ে গেল পৃথু। একটা ক্রাচ অনেকটা দূরে ছিটকে গেল। ভুচু দৌড়ে এসে তুলতে গেল ওকে।
পৃথু বলল, একদম না। দাঁড়াও দূরে। আমি নিজেই উঠব। আর না পারলে; উঠব না। করুণা কোরো না তোমরা আমাকে। প্লীজ।
ওর গলার স্বরে এমন কিছু ছিল যে, ওদের কারওই সাহস হল না কাছে যাবার।
আবারও চেষ্টা করে আগে বাঁ পা-টা ঢুকিয়ে দিয়ে সীটে বসল কাৎ হয়ে প্রথমে। তার পর এক-ঝাঁকিতে কোমর নাড়িয়ে ঠিক হয়ে বসল। ক্রাচ দুটিকে দেড় পায়ের মধ্যে রেখে বাঁ কাঁধের উপর শুইয়ে রাখল।
ভুচু, পৃথুর গায়ের ধুলো ঝেড়ে দিল।
পৃথু তাকাল একবার ওর দিকে। মুখে কিছু বলল না।
পেছন থেকে দিগা বলল, সন্তত ধরণী ধরত সির রেণু। অর্থাৎ, ধরণী সর্বদাই তার মাথাতে ধুলো ধরে আছে।
কেন যে বলল, তা পৃথু বুঝল না।
জীপের সামনের সীটে বসে উইন্ডস্ক্রীনের মধ্যে দিয়ে যে-পৃথিবীকে দেখল ও অনেকই দিন পর, তাকে নতুন বলে মনে হল। আগের মতোই তো সুন্দরই দেখাচ্ছে তাকে। তফাৎ তো কিছুই নেই।
পান খাবে তো পৃথুদা?
ভুচু শুধোল।
এতদিন খাইনি। অভ্যেস চলে গেছে। ছেড়ে দিলেই তো হয়। আবার কেন?
মনে মনে বলল, অনেক কিছুর অভ্যাসই চলে গেছে। শুধু পানই তো আর নয়!
ছাড়লে ছেড়ো। আজ তো খাও একটা। বাজারের, ছোটুয়ার দোকান থেকে তোমার জন্যে স্পেশ্যাল করে সাজিয়ে এনেছিলাম কাল। রুমাল ভিজিয়ে, তাতে জড়িয়ে, উপরে শালপাতা মুড়িয়ে রেখেছি। এই নাও। আর এই নাও জর্দার কৌটো।
কটা বাজে?
পৃথু শুধোল।
দশটা প্রায়।
জীপ তো আর কার-এর মতো জোরে যাবে না! পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেল হয়ে যাবে। তাই না?
তা হবে। মান্দ্লাতে, টাইগার প্রজেক্টের অফিস ছাড়িয়ে, নদী পেরিয়েই সান্নাটা জায়গায় একটা নতুন ধাবা খুলেছে। কাল ট্রায়াল দিয়ে এসেছি। সেইখানেই গাছতলায় বসে রুটি, আণ্ডা-তড়কা আর তন্দুরী চিকেন খাব। তোমার জন্যে কাল আসবার সময় মোরগা পছন্দ পর্যন্ত করে এসেছি। সঙ্গে ভড্কা আছে। লেবুও নিয়ে নিয়েছি এখান থেকে। তোমাকে একটা জম্পেস ভোজ দিতে হবে না! কত্বদিন পর, প্রাণে বেঁচে; ঘরে ফিরছ!
লাড্ডু বলল, আমার বাড়িতেও একদিন কিম্তি খানা হবে। খ্যয়ের, যে নিজে হাতে পেয়ারভরে রান্না করে খাওয়াত, সেই সাবীর সাহেবই পট্কে গেলেন।
ভাল তো হয়ে উঠবেন! পট্কালে কী হয়!
পৃথু বলল।
সন্দেহ আছে। বুড়ো বোধ হয় আর সেই বুড়ো থাকবে না। আমাদের সময়টা, সকলেরই খুবই খারাপ যাচ্ছে পৃথুদা।
পামেলা কেমন আছে? বিয়েটা হচ্ছে কবে? বেশ কিছুদিন আগে জানিও কিন্তু।
বিয়ে?
বলেই থেমে গেল ভুচু।
তারপর বলল, পরে বলব। তোমাকে তো বলতেই হবে সব।
পেছন থেকে ফুট্ কাটল দিগা, জানি না জাই নারী গতি ভাই। নারীর গতিপ্রকৃতি জানা যায় না ভাই। তারপরই বলল, ‘করত্ মনোরথ জস্ জিআঁ জাকে’ মানে যার হৃদয় যেমন, সে সেই রকমই ইচ্ছে করে। হৃদয়ের উপর কি জারিজুরি খাটে?
দিগাকে পৃথু চিরদিন পছন্দই করে। তবু, এ মুহূর্তে ওর এই জোর করে তুলসীদাস শোনানো ওর মোটেই পছন্দ হলো না। বিরক্তির সঙ্গে পেছনে তাকাল একবার। সব কিছুই সময় আছে।
জীপ স্টার্ট করল ভুচু।
পৃথু পানের পিক ফেলল। অনেকদিন পর জর্দা মুখে দিল। মুখটা ভরে গেছে জলে। জর্দা খুব জল কাটায়। পিক ফেলল, মুখ বাড়িয়ে।
জীপটা এগিয়ে চলল। সব সময়ই এই লেফ্টহ্যান্ড ড্রাইভ জীপে ডান পা-টাই বাইরে বের করে জীপের ছোট্ট পাদানির উপর রেখে বসত পৃথু। ট্রাউজারের ফাঁক-ফোকর দিয়ে হাওয়া ঢুকত। পত পত করে নড়ত তলাটা। আর…
ভুচু বলল, কি দাদা? টিকিয়া-উড়ান চালাই?
না। না। ডান পায়ে ভর দিতে তো পারব না। যদি হুমড়ি খেয়ে পড়ি? রইয়ে-সইয়ে। ভুচু। রইয়ে-সইয়ে।
টিকিয়া-উড়ান না হলেও বেশ জোরেই চলতে লাগল জীপ। টিকেরিয়ার পথে। দেখতে দেখতে জবলপুর শহরের ভিড় পাতলা হয়ে এল। শহরের বাইরে এসে পড়ল ওরা। হাওয়ায় ভাপ লেগেছে। শুকনো পাতা উড়ছে। তবে লু বইবার দেরি আছে এখনও অনেকই!
দু’হাতে ক্রাচ্ দুটিকে জড়িয়ে ধরে বসে। সামনে পথের দিকে চেয়ে রইল ও মুখে কোনও কথা নেই।
দিগা পাঁড়ে ওর দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল; চিন্তা সাঁপিন্ কো নহি খায়া? চিন্তারূপী সাপ, কামড়ায় না কাকে?
জীপের পর্দা উড়ছিল পত্ পত্ করে, রডের উপর আছড়ে পড়ার আওয়াজ আসছিল ধ্বপ-ধ্বপ।
ভুচু? অনেকদিন আসেনি রুষারা।
ভুচুর চোখে এক গভীর বিষণ্ণতা নেমে এসেছিল। চাম্কেও উঠেছিল যেন ও একটু।
বলেছিল, অনেকদিন ওদিকে যেতে পারিনি পৃথুদা। ভালই নিশ্চয়ই।
পৃথু বুঝেছিল, এড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বোঝেনি, কেন? বাড়ি ছেড়ে রুষা কোথাও গেলেও যেতে পারে, কিন্তু মিলি টুসু যাবে কোথায়? পামেলারই বা কী হল?
ক্যা হো গ্যয়া? সব্বে একদম চুপচাপ?
লাড্ডু বলল। জীপের মধ্যের নিস্তব্ধতা ভেঙে।
দিগা বলল, এই পৃথিবীতে বড় বেশি অপ্রয়োজনীয় কথা হয়। চিরদিনই হয়ে এসেছে। যে যতক্ষণ পারে চুপ করে থাকাই তো ভাল। মুখ চুপ করলে তো আর মস্তিষ্ক চুপ করে থাকে না। আগুন জ্বালায় শরীরকে; আর চিন্তা জালায় মনকে।
হাওয়া লাগছিল চোখে মুখে। দাড়িটা বেশ বড় হয়ে গেছে। তবে ট্রিম করা হয়নি বলে পাগলের মতই দেখাচ্ছে। চুলও কাটেনি সাড়ে তিন মাস। মাথার চুল আর দাড়ি এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। দুটি ক্রাচ-এর উপর দুটি হাতের পাতা রেখে তার উপরে মুখখানি রেখে বসেছিল পৃথু। জীপ এখন একেবারে নির্জনে এসে গেছে। নর্মদা এখনও দেখা যাচ্ছে না। আরও ঘণ্টাখানেক পর থেকে মান্দ্লার পথের পাশে পাশে চলবে নর্মদা।
কী হল পৃথুদা। একেবারেই চুপচাপ যে! নাও, ড্যাশবোর্ডের ড্রয়ারটা খোলো। পান খাও আর দুটো। তুমি যেন কীরকম হয়ে গেলে। নাকি, ভডকাই বানিয়ে দেব জীপ থামিয়ে? তোমাকে নিয়ে আমরা বাড়ি ফিরছি কত আনন্দের দিন আজকে। আর তুমি নিজেই কেমন মুষড়ে রয়েছ।
ঠিক আছে। খাচ্ছি পান। অন্য কিছু এখন নয়। আসলে আমি এই রকমই ভুচু। আমার কলেজের ফ্রেঞ্চ-এর প্রফেসার বলতেন, লা গাঁর্সো দ্য ল্যুন। ছেলেটা চাঁদে চলে গেছে। আমি কখন যে কোথায় থাকি, নিজেই জানি না। সত্যিই জানি না।
পান মুখে দিয়ে জর্দা ফেলে, মুখ বাড়িয়ে পৃথু পিক ফেলল আবার। কবিতা, কবি, এই সবেই পেয়েছিল তাকে। কথা বলতে সত্যিই ইচ্ছে করছিল না। এরকম হয় মাঝে মাঝে। অনেক অনেকদিন পর। কতদিন লেখে না একটিও লাইন। তার লেখার টেবলেও কি ধুলো পড়ে আছে? কতদিন কতদিন লেখে না…
“কবিতা লেখার জন্য সময়ই পান না।
বুঝি না?
উত্তর না দিয়ে জনান্তিকে মুখ মুচকে হাসি
ফাঁকা ঘরে জানালার ওপাশে দূর
নীলাকাশ থেকে আসে।
প্রিয়তম হাওয়া
না-লেখা কবিতাগুলি আমার সর্বাঙ্গ
জড়িয়ে আদর করে, চলে যায়, ঘুরে ফিরে আসে
না হয়ে ওঠার চেয়ে, আধো-ফোটা, ওরা খুনসুটি
খুব ভালবাসে।”
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
বড়ই দুঃখের কথা এই মহৎ কবি আজকাল সত্যিই বেশি কবিতা লেখেন না। এবং তাই-ই বোধ হয় মণি চাকলাদারদের মতো কবিদেরই লম্ফ-ঝম্ফ বেড়ে যেতে থাকে দিন দিন।
এবার নর্মদা দেখা যাচ্ছে। ডানদিকে চলেছে সে। এ নর্মদাকে দেখে জবলপুরের ভেড়াঘাটের মাৰ্বল রক্-এর মধ্যে থেকে বেরুনো পাথরের স্বপ্নিল যাদুর মধ্যের সরু নদীটিই যে এর পিতৃপুরুষ, এ কথা বিশ্বাস করাই মুশকিল। টিকেরিয়ায় এসে পৌঁছল ওরা। বাবার কথা, ঠুঠা বাইগার কথা অনেকই পুরনো কথা মনে পড়ে গেল। অনেকদিন দেখেনি ঠুঠাকে। ভুচুদের কাছে শুনেছে যে, ঠুঠা জঙ্গলে গেছে। কবে ফিরবে, কে জানে?
মান্দলায় পৌঁছে টাইগার্ প্রজেক্টের অফিসের ঠিক সামনেই পারিহার সাহেবের সঙ্গে দেখা। জীপ চালিয়ে বাড়ি যাচ্ছিলেন লাঞ্চ-এর জন্যে। বললেন, পেঞ্চ ন্যাশানাল পার্ক-এর ডিরেকটর হয়েছেন এখন। এখানে এসেছিলেন লাওলেকার সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে। জীপ থেকে নেমেই জড়িয়ে ধরলেন তিনি পৃথুকে। বললেন, আপনি তো এখন হিরো। আমরা যে আপনাকে চিনি এ কথা বিশ্বাসই করতে চায় না লোকে।
পৃথু হাসল। লাজুক হাসি।
পারিহার সাহেব বললেন, চলুন। চলুন। আমার বাড়ি লাঞ্চ খাবেন।
পৃথু বলল, আমার সঙ্গে যে মস্ত দল। বিনা-নোটিসে এত লোক মিলে ভদ্রলোকের বাড়ি যাওয়া যায় না। পারিহার সাহেব দল দেখে বুঝলেন আর পীড়াপীড়ি করলেন না।
পারিহার সাহেব একবার পেঞ্চ ন্যাশানাল পার্কে যাবার নেমন্তন্ন জানালেন। সীওনী হয়ে যেতে হয়। সাতপুরা পাহাড়শ্রেণীর বুকের মধ্যে। ভারী সুন্দর জায়গা। লাল নীল নদী, সবুজ পাহাড়। পরীরা খেলা করে সেখানে। ঠুঠা বলত। এক সময় অনেক শিকার করেছে সেখানে পৃথুরা। বাবার আমলে।
বলল, যাব একবার সময় করে। নিশ্চয়ই যাব।
ধাবাটা নতুন হলেও, ভালই। সঙ্গে সঙ্গে চৌপাই বের করে দিল গাছতলায়। ছায়াও আছে। ঝিরঝির করে হাওয়া বইছে।
ভুচু নেমে তাড়াতাড়ি গুরুর জন্যে ভড্কা তৈরি করল। কাপালিকের চেলারা যেমন গাঁজা সাজে। তারপর নিজের জন্যেও সেজে নিল.। লাড্ডু আর দিগা তো নিরামিষাসী। লাড্ডু ঠিক নিরামিষাসী নয়। সবুজ-রঙা সিদ্ধির গুলির লাথি সে খেতে ভালবাসে। সে খায় জমিয়ে, বাদাম-পেস্তা দিয়ে শরবৎ বানিয়ে। তবে সন্ধের পর চান-টান করে শুদ্ধ হয়ে, ঈত্বর টিত্বর ইস্তেমাল করে তানপুরা বেঁধে নিয়ে।
পৃথু বলল, এবার একদিন তোমার গান শুনতে হবে লাড্ডু সারারাত ধরে। গিরিশদার বাড়ি এখন আর কাকেদের ঝামেলাও নেই। কত্বদিন শোনা হয়নি।
কাক না থাকলে কী হয়? পণ্ডিত তো আছে। সে কখন যে কী পণ্ডিতী করে বসে সে সেই-ই জানে।
ভুচু বলল।
কে পণ্ডিত?
পৃথু শুধোল।
আরে শেয়াল পণ্ডিত। সে তো এখনও বহাল তবিয়তেই আছে। ভাল খেয়ে দেয়ে ভুঁড়ো শেয়াল একেবারে জার্মান অ্যালসেসিয়ানের চেহারা ধরেছে। তার হরকৎই আলাদা। গলায় চকচকে বকলেস। পাঁঠার টেংরি ছাড়া খায় না।
গিরিশদার এখন নতুন পাগলামি কী?
ডায়াসকোরিয়ার চাষ করছেন টাঁড়ে। বম্বের এবং কলকাতার ওষুধ কোম্পানীর সঙ্গে রেগুলার চিঠিচাপাটি চলছে। এইখানেই ট্যাবলেট বানাবেন কনট্রাসেপটিভ-এর।
পাগল একেই বলে। এই বয়সে কেউ কনট্রাসেপটিভ নিয়ে মাথা ঘামায়? কোথায় অ্যাফ্রডিসিয়াক নিয়ে পড়বেন তা না। কবিতা লিখেই দাদার মাথাটা গেছে।
পৃথু বলল।
ডান পাটা টনটন করছিল। রক্ত দপদপ করছিল কাটা জায়গাটাতে। ক্রাচ পাশে রেখে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল পৃথু চৌপাইয়ে। হঠাৎই মনটা খারাপ হয়ে গেল। বড়ই খারাপ। মন থাকলেই এমন হয় মাঝে মাঝে।
ভুচু এসে ভডকার গ্লাস দিল হাতে। শুয়ে শুয়ে খাওয়া যায় না। কাৎ হয়ে আধশোয়া ভঙ্গিতে উঠে বসল।
ঠিক সেই সময়ই একটা জীপ এসে ওদের পাশে দাঁড়াল। প্রকাণ্ড বড় বড় কালো কুচকুচে গোঁফওয়ালা একজন লোক ড্রাইভারের পাশে। পেছনে দুজন লোক। পেছনের লোকদের বুকে গুলির বেল্ট আর হাতে চকচকে জার্মান রাইফেল। সামনের গুঁফো লোকটির বুকেও গুলির বেল্ট। কোমরে পিস্তল। এবং হাতে অটোম্যাটিক রাইফেল।
সে নামতেই, পেছনের লোক দুজন তার দু পাশে দাঁড়াল নেমে এসে। বডি গার্ড।
গুঁফো লোকটি বলল, পিরথুবাবু আপই না হ্যায়?
আধো শুয়েই পৃথু তাকাল তাদের দিকে।
পৃথুর মনে হল এ বোধ হয় মগনলালের লোক। শেষ করতে এসেছে ওকে। কিন্তু তাতে পৃথুর কোনওরকম উত্তেজনা বা ভয় হল না। বরং ভাবল, দিক শেষ করে। ফুরিয়ে যাক সবকিছু। ক্লান্তি জমেছে বড়ই।
ভুচু পৃথুর হয়ে উত্তর দিল। বলল, জী হাঁ। আপ কি শুভনাম?
বলেই, কোমরের দিকে হাত চালান করল।
পৃথুর কোমরেও ছিল। কিন্তু ওর ইচ্ছেও হল না হাত নামাবার।
ম্যায় ভিনোদ সিং। মগনলাল হামারা ইক্-নাম্বারী দুশমন থে।
পররনাম পিরথুবাবু। বলেই, চোখ দিয়ে বারণ করল ভুচুকে পিস্তলের দিকে হাত না বাড়াতে।
বলল, আপসে মিল্কর বড়া খুশী আয়া। মা আপকি ভালা করেঙ্গী।
ততক্ষণে ড্রাইভার একটি ঝুড়ি নিয়ে এসে রাখল পৃথুর চৌপাইর সামনে। তাতে দু’বোতল জনি-ওয়াকার রেড লেবেল স্কচ হুইস্কি, কিছু ফল এবং চারটে তাগড়া লাল মোরগা।
ভিনোদ সিং বলল, আপনি গ্রহণ করলে, খুশি হব।
পৃথু কিছু বলার আগেই ভিনোদ সিং স্যালুট করল পৃথুকে। তার রকমটা অনেকটা উগান্ডার ভ্যাডা ফিল্ডমার্শাল ইডি আমিন্ পি এইচ ডি ড্যাডার স্যালুটেরই মতো। হাসি পেল পৃথুর।
বলল, ইন্দার সিং লালসাহেব ভি হামারা দুশমন। মগর আপ্ নহী। কোঈ জরুরৎ পড়নেসে মুঝে জারা ইয়াদ কীজিয়েগা। হামারা মদত্ আপকি লিয়ে বরাব্বর রহেগা। সিরিফ্ পুকারকা জরুরৎ। আপকা লিয়ে মেরী জান কবুল্।
বলেই, স্যালুট্ করে আবার ফিরে গেল জীপে। ড্রাইভার জীপ স্টার্ট করে জোরে চালিয়ে চলে গেল, পৃথুরা যেদিকে যাবে; সেই দিকেই।
ভুচু বলল, খুদাহ্ যব দেতা ছপ্পর ফাড়কে দেতা। চলল, আজ রাতেই লাড্ডুর গানের সঙ্গে হুইস্কির সেবা হবে।
লাড্ডু বলল, আজ নয়।
পৃথুও বলল, আজ নয়। ঝুড়িটা ভুচু তুমিই নিয়ে যাবে। পরে হবে একদিন। সাবীর সাহেব সুস্থ হয়ে উঠুন। গিরিশদার বাড়িতেই।
খাওয়া-দাওয়ার পর ভুচু টিকিয়া-উড়ান্ চালাল গাড়ি। পৃথু ভাবছিল, ভিনোদ সিং নামটা যেন কোথায় শুনেছে! কোথায় শুনেছে, মনে করতে পারল না অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও। তারপর হঠাৎই মনে পড়ে গেল। বিজ্লী বলেছিল। ভিনোদ সিং-এর ভাইয়ের সঙ্গে বিজ্লীর ছোট বোনের বিয়ে হবে না কী যেন বলেছিল বিজ্লী।
দূর থেকে হাটচান্দ্রা দেখা যাচ্ছিল। কারখানার পাঁচিল। বয়লারের চিম্নি। ক্লাবের কম্পাউন্ডের মধ্যে স্কোয়াশের কোর্ট-এর উঁচু দেওয়াল। নিচ্ছিদ্র। ভারী ভাল লাগছিল ওর। একেই বোধ হয় সাহেবরা হোম-কামিং বলে।
বাড়ির সামনে যখন জীপটা এসে পৌঁছল বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল হঠাৎ পৃথুর। সন্ধে হয়ে যাবে একটু পরই কিন্তু বাড়িতে আলো জ্বালেনি কেউই। রুষার ও মিলি টুসুর বেডরুমের আলোও নেবানো। জানালা সব বন্ধ। ড্রইংরুমের জানালাও সব বন্ধ। শুধু বাইরের দিকের দুটি জানালা খোলা। গাড়িটা অবশ্য পোর্টিকোতে আছে।
দুখী জীপের আওয়াজ পেয়ে দৌড়ে এসে দরজা খুলল।
মেরীও দৌড়ে এসে পৃথুকে ক্রাচ্-এ ভর করে কষ্ট করে নামতে দেখেই, দু’হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠল।
দুখী, পৃথুকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল। হাত তুলে বারণ করল পৃথু।
পৃথু বলল, মেমসাব?
ওরা কোনওই উত্তর দিল না।
দুখী জীপ থেকে মাল নামিয়ে নিল।
টুসুবাবা? মিলি? পৃথুর গলাটা শুকিয়ে এল। তেষ্টা পেতে লাগল খুব। বুকের মধ্যে অব্যক্ত চাপা একটা কষ্ট। এমন কষ্ট কখনও পায়নি ও।
পৃথু আবারও বলল। টুসুবাবা?
তাতেও জবাব দিল না ওরা কেউ। মেরী বা দুখী।
পৃথু ঘুরে দাঁড়িয়ে এবার ভুচুর মুখে তাকাল।
দিগা আর লাড্ডু অন্যদিকে চেয়ে দাঁড়িয়েছিল।
ভুচু মুখ নামিয়ে নিল। মুখ নিচু করেই বলল, কাল সকালে আমি আসব পৃথুদা। এখন যাই। আমি জানতাম। তোমাকে বলিনি। কী লাভ?
তারপর বলল, আমি কি ফিরে আসব পৃথুদা রাতে? তারপর নিজেই বলল, না। আজ তুমি একা থাকো। একা থাকা দরকার।
দিগা বলল, রাতটা ভুচুবাবুর গ্যারাজে কাটিয়ে আমি কাল সকালেই ফিরে যাব ডেরায়। আসবেন পৃথুবাবু। মন খারাপ লাগলেই আমার কাছে চলে আসবেন। এখনও অনেক ভাললাগা আছে। রোদ, বৃষ্টি, জঙ্গল, চাঁদ। ভাললাগাটাকে শুধু সরিয়ে আনতে হবে। আর কিছু নয়।
ওরা চলে গেল, জীপ ঘুরিয়ে নিয়ে।
খাণ্ডেলওয়াল সাহেবের কালো কুচকুচে যুবতী আয়া সাদা ধবধবে জোয়ান অ্যালসেসিয়ান কুকুরটি এবং লালচে রঙের একটি কুকুরীকে নিয়ে ফিরে এল।
প্রকৃতির মধ্যেই মানুষের মুক্তি নিহিত আছে। হয়ত কুকুরদেরও।
আয়াটি থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে পা-হীন পৃথুকে দেখল একঝলক। তারপরই দৌড়ে চলে গেল ভিতরে। হয়ত স্ত্রী-পরিত্যক্তা, ল্যাংড়া পৃথু ঘোষের প্রত্যাবর্তনের রসালো খবরটা ভিতরে পৌঁছে দিতেই।
পৃথু, আস্তে আস্তে ভিতরে গেল। সিঁড়ি টপ্কে উঠতে খুবই কষ্ট হল ওর।
জানল, যে বাকি জীবনটা সিঁড়িকে ভয় করেই চলতে হবে ওর। সে সিঁড়ি, আরোহণেরই হোক; কি অবরোহণেরই হোক।
লছ্মার সিং কুক্ এসে সেলাম করে জিজ্ঞেস করল, কী খানা পকাব হুজৌর?
খনা?
খাবার যে পাকাতে হয় এবং তাও যে আগে থাকতে বলে দিতে হয় এসব পৃথুর জানা ছিল না। কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে চেয়ে থেকে বলল, কিছু খাব না।
মেরী বলল, আপনার শরীর এখনও সুস্থ হয়নি স্যার। কিছু না খেলে চলবে কী করে? স্যুপ আর মুরগির রোস্ট বানিয়ে দিতে বলছি।
পৃথু অবাক হয়ে চেয়ে রইল। স্যুপ্ কী দিয়ে বানায়? মুরগি কোথায় পাওয়া যায়? দাম কত? এসব কিছুই তো ও জানে না।
মেরী ওর মনের কথা বুঝতে পেরে বলল, মুরগি ফ্রিজেই আছে। অন্য তরিতরকারিও আছে। চাল ডাল মশলাপাতি। কয়েকদিনের মতো সবই আছে। মেমসাহেব সবই রেখে গেছেন বন্দোবস্ত করে।
ওঃ। তাই-ই।
বলল, পৃথু।
তারপর পা টেনে টেনে নিজের ঘরের দিকে যেতে লাগল।
মেরী বলল, গীজার চালানো আছে। পায়জামা পাঞ্জাবি বের করা আছে। বাথরম স্লীপারও। চান করে নিন স্যার। এতখানি পথ এলেন!
এমন সময় দুখী এসে একটি মোটা খাম দিল পৃথুর হাতে।
বলল, মেমসাব দিয়ে গেছেন। আপনাকে দিতে বলেছেন।
ওরা কবে চলে গেছে?
তা, প্রায় দশ দিন হল।
টুসু, টুসু যাওয়ার সময় কিছু বলেনি আমাকে? আমাকে বলার জন্যে? কিছু না?
না। কাঁদছিল শুধু।
কাঁদছিল? তা যেতে দিলে কেন তোমরা?
আমরা কী করব স্যার? আমরা কে?
প্রথমে নিজের ঘরে না গিয়ে ও বলল, সব ঘর খুলে দে দুখী। সব ঘরে আলো জ্বেলে দে। এ বাড়িতে থাকতে পারব না আমি।
বলে, ও চান করতে গেল রুষার খামটি ওর ঘরের লেখার টেবলে রেখে।
ক্রাচ দুটো বাথরুমের দরজার বাইরে রেখে গেল। ক্রাচ ছাড়া দাঁড়াতে পারছিল না। বাথটাবের কোণায় বসে কোনওরকমে চান করল।
বাথরুম বা বাথটাবও নোংরা হলে ওকে বলার আর কেউই নেই। রুষা আর চেঁচামেচি করবে না তা জানে বলেই ও আরও বেশি সাবধানে চান করল। যা ঘটেছে বলে এরা বলছে, তা কখনও সত্যি হতে পারে না। রুষা ওকে ভয় দেখাতে গেছে। বাকি জীবন যাতে পৃথু একজন ভদ্র, সভ্য, সামাজিক মানুষ হয়ে, রুষা যেমন চিরদিন চেয়েছিল, তেমন তার মনোমত হয়ে যাতে রুষার সঙ্গে থাকে; তারই ওয়ার্নিং এ। চলে যাবে! হুঁ:! ছেলেমেয়েকে নিয়ে তাকে ছেড়ে ইদুরকারের কাছে। চিরদিনের মতো চলে যাবে এ কখনও হতেই পারে না। অসম্ভব। এই অশিক্ষিত মেরী আর দুখী রুষাকে কতটুকু জানে?
পৃথু ফিরে এসেছে এই খবর পেয়েই এক্ষুনি ফিরে আসবে সদলবলে ওরা।
জানে, পৃথু জানে তা।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে পৃথু মেরীকে ডাকল আবার।
বলল, ওদের জন্যে কী রান্না করছ?
কাদের জন্যে স্যার?
আঃ। তোমার মেমসাহেব, মিলি, টুসু…
মেরী চুপ করে থাকল।
তোমরা কী পেয়েছটা কি? খবর দিয়েছ একটা মেমসাহেবকে? আমি যে এসেছি, তা তারা জানবে কী করে?
আপনি আজ আসবেন জানেন বলেই তো মেমসাব সকালে এসেছিলেন। এসেই তো আমাদের সব বলে-টলে গেলেন।
কার সঙ্গে এসেছিলেন?
ইদুরকার সাহেবের সঙ্গে।
বড় লজ্জা হল পৃথুর। ওদের সামনে, ওর ইচ্ছে হল মাটিতে মিশিয়ে দেয় নিজেকে। আন্ইউজুয়াল পৃথু, কবি, পণ্ডিত, প্রকৃতিবিশারদ, ভার্সেটাইল, ডাকু মগনলালকে খতম-করা, বিলেত-ফেরৎ এঞ্জিনীয়ার হাটচান্দ্রা শেল্যক কোম্পানীর ভারিক্কি অফিসার পৃথু ঘোষের হঠাৎই মনে হল যে, ও সম্পূর্ণই ভারশূন্য হয়ে গেছে। সুন্দর প্লাস্টিক ইমাল্শানে রাঙানো নরম সুরুচিপূর্ণ প্যাস্টেল-রঙা দেওয়ালে ও এতদিন সুদৃশ্য এক ওরিজিনাল মহামূল্য ছবির মতই শোভা পাচ্ছিল। রুষা ছিল, মিলি ও টুসু ছিল বলেই, সেও ছিল। সেই দেওয়ালটিই রাতারাতি অপসারিত হয়ে গেছে। সেই নিশ্চিহ্ন দেওয়ালেরই সঙ্গে সঙ্গে সেও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এও এক আবিষ্কার। বড় বুক-ভাঙ্গা আবিষ্কার।
রুষার ঘরে গিয়ে দাঁড়াল ক্রাচ-এ ভর করে। ডাবল-বেড় খাট, দেওয়ালে তাদের বিয়ের সময়কার ফোটো, আসবাবপত্র, বেডকভার, ডিম্বাকৃতি হালকা কমলা-রঙা কার্পেট খাটের পাশে, হাল্কা কমলা-রঙা বাথ্-ম্যাট্ সবই আছে। যেমন ছিল। ড্রেসিং টেবলের ওপর ওর ব্রাশ, চিরুনী, রোলার, লিপস্টিক, পাউডার, অয়েল অফ উলে, নেইলপালিশ, নেইলপালিশ রিমুভার সব কিছুই ঠিকঠাক, যেন এক্ষুনি ফিরে আসবে রুষা। যেখানে যে জিনিসটি থাকার কথা ঠিক সেখানেই তা আছে। মনে হল বিকেলে ঘর ডাস্টিংও করেছে দুখী। এমনকী রুষার গায়ের গন্ধটিও রয়ে গেছে সেই ঘরে। শুধু সেই-ই নেই।
মিলির ঘরেও তাই। সবই পড়ে আছে, ওর দরজার ভিতরের দিকে মাইকেল জ্যাকসন-এর পোস্টার ছিল একটা, সেটা ও সযত্নে তুলে নিয়ে গেছে।
টুসুর ঘরে গিয়ে দেখল সে তার ব্যাডমিন্টনের র্যাকেটটা নিয়ে যায়নি। ফেলে গেছে সালিম আলির পাখির বইখানি। ফেলে গেছে দেওয়াল-জোড়া ব্রুস-লীর পোস্টারখানি। বইটি ওর আগের জন্মদিনে পৃথুই উপহার দিয়েছিল। বড় প্রিয় বই ছিল সেটি টুসুর। বইটি দু হাতে ধরল পৃথু ক্রাচ্-এ ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে। মলাট ওল্টাল। লেখা আছে: মিষ্টি এবং দুষ্টু টুসুকে, জন্মদিনে; তার খারাপ বাবা। ২০/৬/৮৪
সে তো কখনও ভালত্বর দাবি করেনি কারও কাছেই। এমনকী, তার ছোট্ট ছেলের কাছেও নয়। তবু তারা ছিল। বাড়ি ভরে ছিল। তার নিজের ঘরের লেখার টেবলের নির্মোকে নিজেকে মুড়ে ওদের তুলনায় নিজেকে অনেক আলাদা ও অন্যরকম ভেবে, ওদের গলার স্বর, রুষার সংসার চালানোর বকাবকি, টুং-টাং বাবুর্চিখানার, প্যানট্রির ডাইনীং টেবলের নানা শব্দের মধ্যে সে একা ঘরে থেকেও তাদের নিশ্চিত সঙ্গ তো পেয়েছিল। জানত তো যে, হাতের কাছের বেল টিপলেই একটি জীবন্ত, প্রাণবন্ত, দুরন্ত ফেনিল সংসার সমুদ্রের ঢেউয়েরই মতো তার ঘরে ঢুকে পড়বে। রুষাও ঢুকে পড়বে, “শী, শী; লাইক আ ভিজিটিং সী, হুইচ নো ডোর কুড এভার রেষ্ট্রেন” ব্যবধান ঘুচে যাবে। রুষা এসে বলবে কী চাই তোমার? না থাকলে মিলি আসবে, বলবে কী হল আবার? টুসু এসে বলবে, কাল আমার জিওগ্রাফির টেস্ট তুমি এত ঝামেলা করো কেন?
ওরা কেউই না থাকলেও দুখী, মেরী অথবা লছ্মার সিংও এসে বলবে সাব? স্যার? হুজৌর!
চাইবার মতো কিছুই তেমন চাইত না কুঁড়ে পৃথু। কখনও ছেলেমেয়ে অথবা রুষাকে ডেকে বলত, জানালাটা বন্ধ করে দাও। কখনও বলত, ওই যে, নীলরঙা বইটা তিন নম্বর তাকে? সেটা নামিয়ে দাও। কখনও বলত এক কাপ চা। ব্যাসস এইটুকুই।
রুষার সংসারের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে না থেকেও ও দারুণ ভাবেই জড়িয়ে ছিল যে, আজ এতদিন পরে, তা বুঝল ও। বুঝল একজন স্বামীর, একজন বাবার; তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে ছাড়া কোনও অস্তিত্বই নেই। সে যতবড় তালেবর পুরুষই হোক না কেন?
বুঝল পৃথু, বুঝল সবই; ফিরল ঘরে, গুমোর ছেড়ে; কিন্তু বড়ই দেরি করে। ছেড়ে যাওয়া যায়, যে কোনও সময়েই, দম্ভ ভরে, কিন্তু সময়ের মধ্যে না ফিরলে ঘর আর ঘর থাকে না। সব পাওয়াই তখন মিথ্যে হয়ে যায়। বড় বাঘেরই মতো বোকা পুরুষের সব দম্ভ, গর্ব, উচ্চমন্যতা, কোনও চালাক ইঁদুর এসে সময় বুঝে তার ইতর ছোট ছোট দাঁতে কেটেকুটে রেখে যায়।
পৃথু এ কথাটাই এখনও বিশ্বাসই করে উঠতে পারছে না। বুনতে সময় লাগে জীবনভর; কাটতে লাগে এত সামান্য সময়।
যে-ঘর ছেড়ে পৃথু বেলোতই না, যে ঘরের দরজা একটু সময় খোলা থাকলেও নানারকম সাংসারিক মানডেন ক্রিয়াকর্মে তার সৃষ্টিশীলতার ব্যাঘাৎ হত ভেবে সে বিরক্ত হত; সেই দরজাই সে এখন হাট করে খুলে রাখল। তার সেই কবিতা লেখার ঘরে সে এক মুহূর্তও থাকতে পারল না। এই প্রথম, সর্বজ্ঞ পৃথু ঘোষ চমকে উঠে বুঝতে পারল যে, কবিতা আসে, বোধ হয় শুধুমাত্র সুপারফ্লুইটি থেকেই। শুন্যতাকে কবিতায় পর্যবসিত যাঁরা করতে পারেন, তেমন বড় মাপের কবি পৃথু ঘোষ অন্তত নয়। হয়তো, অনেক কবিই নন। জীবন পূর্ণ হলে, পূর্ণ থাকলে তবেই তার শব্দমঞ্জরী, গন্ধপুঞ্জ, ভালবাসার নারীর শরীরের সুগন্ধ, শিশুর দুরন্তপনা এইসব ছাপিয়ে উঠে এসে জন্ম নেয় কবিতা। এতদিন সৃজনশীলতার বাহাদুরী, সে তার একার বলেই মনে করে এসেছিল। আজ বড় বেদনামিশ্রিত বিস্ময়ের সঙ্গে জানল যে, কৃতিত্বের প্রায় সবটাই ছিল রুষা এবং মিলি টুসুরই। যা এতদিন তার প্রতিবন্ধক বলে জেনেছিল, আজ তাকেই জানল তার জোর বলে! যা ছিল বন্ধনের প্রতীক, তাই-ই প্রতিভাত হল মুক্তি হয়ে।
রুষার খামটা হাতে করে ও রুষারই ঘরে এল। খোলা পড়ে থাকল নিজের মহামূল্য ঘর, কাগজ কলম, বইপত্র, সব কিছুই। উদলা গায়ের পথের কাঙালীর মতো সে অনাদৃত অনাবৃত করে দিল নিজের মনের জমিয়ে রাখা সমস্ত পণ্ডিতমন্যতাকে, অহমিকাকে। রুষার খাটে বসে একটানে বেডকভার সরিয়ে ফেলে তার পরমাসুন্দরী স্ত্রীর বালিশ টেনে নিয়ে নিজের হেঁটে দেওয়া আমিত্বরই মত দেড়খানা পা নিয়ে জবুথবু হয়ে বসল বিছানাতে। খামটা ছিঁড়ল ভয়ে ভয়ে।
তিক্ততাকে বড় ভয় পায় পৃথু। বড় বেশি আঘাত না পেলে ও নিজে কখনও তিক্ত হয়ও না। অন্য কেউও তার প্রতি তিক্ত হোক, তাও সে চায় না।
একটা লম্বা হিসাব বেরুল প্রথমে।
বাঁদিকে জমা; ডানদিকে খরচ। তার অবর্তমানে অফিস থেকে যে টাকা সংসার খরচ হিসেবে পেয়েছিল রুষা তাইই জমা করেছে বাঁ দিকে। মাসে মাসে ডান দিকে সব খরচ। বাজার, দোকান, মুদিখানা। একজন চাকর ও বাবুর্চির মাইনে অফিস থেকেই দেয়। শুধু দুখীর মাইনেটা নিজেদের দিতে হত।
অবাক হয়ে দেখল পৃথু, যে খরচের হিসেবের মধ্যে রুষার ব্যক্তিগত কোনও খরচই নেই। না পারফ্যুম, না লিপস্টিক, না জামাকাপড় না অন্য কিছু। একটি চুলের কাঁটাও পর্যন্ত কেনেনি রুষা পৃথুর পয়সাতে। সে কি গত সাড়ে তিন মাসেই কেনেনি, না কোনওদিনই না?
মুখে অবশ্য বলত রুষা, আমার সব খরচ আমার। আমার আত্মসম্মান আছে। তোমার টাকা আমি নিই না।
বিশ্বাস করেনি সে কথা কোনওদিনও।
রুষা বলত, আজকাল শুনতেই হাজার হাজার টাকা। টাকা তো পয়সাই হয়ে গেছে। ছেলেমেয়েদের তো না খাইয়ে রাখতে পারি না। জিনিসপত্রর যা দাম হয়েছে তার উপর ওদের শখ স্বাচ্ছন্দ্যও দেখতে হয়। আফটার অল ওরা হল গিয়ে টুয়েন্টিওয়ান ইয়ারস গেস্ট। টাকা নিয়ে স্বর্গে যাবে ভাবে অশিক্ষিত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন লোকেরা। টাকা তো কাগজ বই নয়। বদলে কী পাওয়া যায়, টাকার দাম শুধু সেইটুকুই। ছেলেমেয়েদের জীবন কাকে কোথায় নিয়ে যাবে কে জানে। তারপর করার ইচ্ছে বা সামর্থ থাকলেও করার কোনও উপায়ই থাকবে না ওদের জন্যে।
রুষা বলত, আমার রোজগারের কত টাকা যে তোমার সংসারে ঢালতে হয় তা আমিই জানি। প্রতি মাসেই।
রুষার একটি কথাও বিশ্বাস করত না পৃথু। মেয়েরা টাকাপয়সা খুবই ভাল চেনে। সংসারের খরচ থেকে জমিয়ে গয়না না বানায়, এমন স্ত্রী বিরল।
বিশ্বাস করেনি রুষার একটি কথাও।
আজকে রুষা যবে যা বলেছিল, ছোট কথা, বড় কথা, অকিঞ্চিৎকর কথা, সব কথাকেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছিল ওর। বলতে ইচ্ছে করছিল ভুল করেছি। হিসেবের ফর্দর সঙ্গেই আছে ন’শ আঠাশ টাকা। মাস পোয়ানো অবধি কী কী খরচা তার থেকে করতে হবে, তার নির্দেশ। লিখেছে আমরা দশদিন কম খেলাম। এই টাকা শুধু দৈনিক বাজার খরচের সেভিং।
এবার চিঠিটা খুলল পৃথু।
বিয়ের পর থেকে কটি চিঠি লিখেছে রুষা ওকে সবশুদ্ধ তা চেষ্টা করেও মনে করতে পারল না। চিঠি, লেখার অভ্যেস রুষার একেবারেই ছিল না। কিন্তু হাতের লেখাটি ওর খুবই সুন্দর। বড় বড় গোটা গোটা অক্ষরে লেখে। প্রত্যেকটি অক্ষরের মধ্যে অনেকখানি করে ফাঁক। প্রত্যেকটি লাইনের মধ্যেও অনেকখানি ফাঁক। যাদের চিন্তার স্বচ্ছতা থাকে তাদেরই হাতের লেখা এরকম হয়। বাংলায় চিঠি ও লিখতেই পারে না। ইংরিজিতেই লিখেছে।
মাই ডার্লিং পৃথু, মাই ডিয়ার হাজব্যান্ড;
কী বলে যে আরম্ভ করব তাই-ই বুঝতে পারছি না।
এই চিঠি এর আগে দশবার লিখেছি, গত তিন রাতে, প্রায় না ঘুমিয়েই। তবুও যা বলতে চাই তা স্পষ্ট করে বলে উঠতে পারিনি। এই চিঠিটিও ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু তুমি তো কাল সন্ধে নাগাদ এসে পৌঁছবেই আর দেরি করলে হবে না।
প্রথমেই কটি কথা বলে নিতে চাই। তোমাকে আমি ভালবাসি। বিশ্বাস করো, আজও তোমাকে আমি ভালবাসি। ভবিষ্যতেও তুমি আমাকে ভালবাসতে দেবে আশা করব।
এখনও শেষ হয়নি কিছুই। তবে, হতে পারে। আমাকে আর একটু সময় দাও ভাববার। তোমার সঙ্গে থেকে তোমাকে ছাড়ার ভাবনা ভাবাটা ঠিক হত না। তাইই ওর অনেক পীড়াপীড়িতে চলে এসেছি এখানে।
সমাজকে তো তুমি কোনওদিনও মানোনি। তুমি তো বনের বাঘ। আমি মেনেছিলাম। মেনেছিলাম নিজেকে আমি একজনের স্ত্রী এবং তার ছেলেমেয়েদের মা বলে। সমাজে থাকলে, সমাজকে মানতে হয়ই। নইলে বনে গিয়েই থাকতে হয়। সে কথাটাই তোমাকে কখনও বোঝাতে পারিনি।
এখন আর কিছু লিখতে পারছি না। তবে লিখব। যদি তোমাকে বুঝিয়ে না বলি কেন একজন মানুষ হঠাৎ এই রকম বুক-ভাঙা আপাত অবিশ্বাস্য সিদ্ধান্ত নেয়, কী করে নেয় তা না বললে, তুমি চিরদিনই আমাকে ভুল বুঝে থাকবে।
তোমার ছেলেমেয়েরাও তোমার। আমরা দু’জনে মিলে অনেক কল্পনায় আর সুখে ওদের বানিয়েছিলাম। তুমি যে-কোনওদিনই এসে ওদের নিয়ে যেতে পার। কিন্তু ওরা যেতে চাইছে না তোমার কাছে। চাইবেই বা কেন? তুমি তো ওদের কেউই; কিছুমাত্রও ছিলে না। যে বাবারা সন্তান পালনের দায়িত্বের কিছুমাত্রও ভাগ নেয় তাদের উপর ছেলেমেয়েদের টান কিছু থাকেই। তুমি তো টাকা রোজগার করা ছাড়া চিরদিন তোমাকে নিয়েই থেকেছ। তোমার সিলী কবিতাচর্চা, তোমার হাস্যকর টপ্পা, উটওয়ালাদের গান; তোমার লাফাঙ্গা, বেওয়াকুফ বে-রহিস সব বন্ধুবান্ধব, তোমার অসহ্য জঙ্গল-প্রীতি! ছেলেমেয়েরা তো কোনওদিনও পায়নি তোমাকে। পায়নি এমনকি তাদের জন্মদিনেও। তারা আজ যে তোমাকে চাইবে, এটা আশা করাই অন্যায়।
পৃথু, আমাদের এই জীবনে প্রতিটি প্রাপ্তির গায়েই একটি করে দামের টিকিট লাগানো থাকে। বিনা দামে, ধুলোকণা পর্যন্ত পাওয়া যায় না এখানে। প্রেম, ভালবাসা, মান, সম্মান তো দূরের কথা। বিবাহিত জীবনকে তুমি বিনামূল্যেই পেতে চেয়েছিলে তাই-ই সে জীবন হাতের আঁজলা গলে গড়িয়ে গেল।
দোষ আমাকে দিও না। যার যার কৃতকর্মের ফল তাকে ভোগ করতেই হয়।
ও বাড়ির মালিক যদিও আমি, কিন্তু এর মালিকানা আমি দাবি করব না। আমার এখন অনেকই আছে। কিছুরই অভাব নেই আমার। কিন্তু বিশ্বাস করো, এ সবের কণামাত্রও চাইনি আমি। ও বাড়িতে তুমিই থাকো। আমার বিবাহিত স্বামীকে এ আমার দান। তার সঙ্গে অনেক স্মৃতিও।
তুমি প্রায়ই বলতে, কী তোমাকে দিইনি আমি? কী চাও তুমি আমার কাছ থেকে?
আমি বলতাম, চোখ লুকিয়ে; বলব কেন?
তখন আরও ছেলেমানুষ ছিলাম তো। আশা তখনও ছিল, এই জীবন নিয়েই অনেক। তাইই চোখ ছলছল করে বলতাম তা বলব কেন?
না-বলা কথা বুঝে নেবার মতো ধৈর্য তোমার ছিল না কোনওদিনও। তুমি তোমাকে নিয়ে আর তোমার আশ্চর্য ঘর-বিমুখ শখের বাউণ্ডুলে জীবন নিয়েই মেতে ছিলে। ঘর না থাকলে, আমরা না থাকলে তোমার অন্তত দুঃখ পাওয়ার মতো কিছুই দেখি না। বরং জানব, নির্ঝঞ্ঝাট হয়ে, খুশিই হবে। আর যদি দুঃখ পাও তবে জানব, তোমার বোহেমিয়ানিজম, তোমার বন-জঙ্গল প্রীতি; আসলে একটা ভান মাত্র ছিল, একটা পোজ মাত্র; একজন নিচুদরের এসকেপিসট-এর সস্তা বাহানা। তুমি আসলে যে কী, তা তুমি নিজেই জানবে একদিন।
উইমেনস্ লিব্ বলতে কী বোঝায় আমি জানি না। ওঁদের সব কথায় সায়ও দিই না আমি। আমার জীবন দিয়ে আমি এটুকু বুঝেছি যে, এদেশে তোমরা, মানে পুরুষেরা আমাদের হাজার হাজার বছর ধরে হয় কুলুঙ্গির দেবী বলে পুজো করেছ নয় কচি নধর পাঁঠার মতো তোমাদের কামের যূপকাষ্ঠেই বলি দিয়েছ। আমরা মেয়েরাও যে তোমাদেরই সমান, মানসিক, শারীরিক সব ব্যাপারেই আমাদের যে সমান ভূমিকা, সমান চাইবার, তা তোমাদের মতো তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত, উচ্চবিত্ত, সমাজের এলিট্ পুরুষরাই এখনও স্বীকার করে না। তোমরা যদি না করো, তাহলে তোমাদের চেয়ে যারা লেস্ ওয়েল-প্লেসড, লেস্ ওয়েল-অফফ্ তারা করবে কী করে। অসম্ভব।
আমার আজ মনে হয়, এও এক ধরনের লিবারেশন্। মুক্তি, আমাদের। মন তো অনেকই বড় ব্যাপার। ক’জন মানুষ আর মনের কথা বোঝে? তুমিই কি বোঝ? ন্যাকা ন্যাকা চিঠি লিখে প্রেম-প্রেম খেলা করো কুর্চির সঙ্গে। তুমি একটা ডিসঅনেসট, ক্যারাকটারলেস্ মেয়ের সঙ্গে কলেজের ছেলের মতো ডায়ালগসর্বস্ব ভালবাসায় মাতো।
আসলে সে টাকা পেলেই তোমার বিছানাতে এসে ওঠার জন্যে তৈরি হয়ে আছে। বিজ্লীও তার চেয়ে অনেকই ভাল। তাদের কোনও প্রিটেন্স নেই। কিন্তু কুর্চিরা নেকু নেকু মুখ করে বলে, কেন দেন? আহাঃ কী দরকার ছিল? ভাঁটু জানলে কিন্তু ভীষণই রাগ করবে!
এ সবই তোমার বাহানা। তুমি একদিন জানবে যে, কুর্চিরা, বিজ্লীদের চেয়ে অনেকই নিচুদরের প্রসটিট্যুট। খারাপ লোকেরা কী একটা কথা বলেন না? মিসটার সেনরা একদিন পার্টিতে আলোচনা করছিল। ওরা তাইই। হাফ-গেরস্থ। সন্দেহ হয় আমার হাটচান্দ্রা ক্লাবেও তেমন আছে কিছু। তোমার কুর্চিরই মতো। আরও ভাল শাড়ি, হিরের একজোড়া ইয়ারটপ্ একটি কোজী—হলিডে, অ্যান্ড দে আর গেম। শিওর গেম। ভাবলেও গা ঘিনঘিন করে।
পৃথু। তুমি আমাকে আর যাইই মনে করো, করতে পার, আমি কুর্চি নই, বিজ্লীও নই। আমি সৎ। ছিলাম অন্তত দীর্ঘদিন। এবং যখন অসৎ হলাম, তখনই বাঁধন ছিঁড়লাম। ঘোমটার তলায় খেমটা নাচের ট্রাডিশান আমার নয়।
আমার জীবনকে আমি খুব ভালবাসি। মিলি-টুসুও ভালবাসে তাদের জীবনকে। তুমি একটি মেন্টাল কেস ছিলে, এখন তো ফীজিকালী ডিসএবলডও বটে। আমাদের সকলের জীবনকে তোমার মরবিড, মনোটোনাস, নির্জন বর্ষার সমুদ্রপারের টার্ন-এর ভীষণ ভীষণ মন-খারাপ করে দেওয়া কান্নার শব্দের মতো বিষন্ন আপসোস আর হতাশার জীবন থেকে আনন্দে নিয়ে যাবার জন্যেই আমার এই সিদ্ধান্ত। সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয়ে ফেরা।
আমাকে ক্ষমা কোরো পৃথু। ওল থিংগস আপার্ট উ্য আর আ ভেরী ভেরী ভেরী নাইস্ গাই। ট্যু সফ্ট্ ইন লাইফ, ট্যু সফ্ট্ ইন বেড এন্ড ট্যু সফ্ট্ উইথ্ ইওরসেল্ফ অ্যাজ ওয়েল। ওল দীজ্ ওয়্যার ইওর ভার্চু। অ্যান্ড ইওর ভাইস, অ্যাজ ওয়েল। ইটস্আ পিটী দো।
ভাল থেকো। পরে ভাল করে চিঠি লিখব। তোমার সঙ্গে শেষবারের মতো দেখা করব একবার। মানে, ডেটিং। ক্যান্ডেলনাইট ডিনার খাওয়াবে কোথাও? এটা একটা হরিবল্ জায়গা। লেট আস পার্ট উইথ গ্রেস্, উইথ আ টিয়ারফুল স্মাইল!
বাড়ির চাবি রেখে গেলাম। সব আলমারির চাবি, স্টেট ব্যাঙ্কের লকারের চাবি, টাকাপয়সা যদিও কিছু নেই, কলকাতার প্রকাশনীর কামসূত্রের বাংলা বইটা আছে শুধু। ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গেছে বলে তুমি রেখে দিতে বলেছিলে সেখানে। কী কাণ্ড! যে দম্পতি সচিত্র কামসূত্রের বই ব্যাঙ্কের লকারে রাখে, তাদের ঘর যে ভাঙবেই এতে আর আশ্চর্য কী!
তুমি একটা অ্যাডোলেসেন্ট ছেলেমানুষ, কাণ্ডজ্ঞানহীন একটা ড্রীমার। একটা ডন-কীয়টে। তোমাকে পুজো করা যায়, তোমার নামে চৌপট্টিতে মনুমেন্ট বানানোও যায়, তুমি একটা রিয়্যাল ডার্লিং কিন্তু তোমাকে নিয়ে ঘর করা যায় না। আটার্লী ইমপসিব্ল অথবা আমি তেমন অসাধারণ নই; তাইই হয়ত পারলাম না।
ভাল থেকো। ভালবাসা নিও। উ্য নো, আই মীন এভরী ওয়ার্ড অফ ইট।
—তোমার রুষা
পুনশ্চ: ডিভোর্স-টিভোর্স নিয়ে এখন আলোচনা করা প্রিম্যাচিওর। তুমিও ওসব ফর্মালিটিতে বিশ্বাস করো না জানি। তাছাড়া, ফিরে যদি আসি আবার কখনও? এমন কি, শীগগিরই?
ইঁদুর যে পোষ মানবেই তা কে জানে? যদি এও কামড়ে দেয়? তবে ভরসা এইই যে, এ বাঘ নয় যে হালুম করে কামড়াবে। তবুও যদি ফ্রাইং-প্যান থেকে আভেনে পড়তে হচ্ছে দেখি, তখন দৌড়ে আসব তোমারই কাছে। তুমি ছাড়া, আফটার অল, কে আর আমার আছে বল?
চিঠিটা শেষ করে চুপ করে বসে রইল পৃথু। ও নিজেকেই পাগল বলে জানত কিন্তু এ যে উন্মাদ।
গভীর এক ভালোবাসায় রুষার প্রতি ও স্তব্ধ হয়ে বসে রইল রুষার খাটে। যে খাটে, রুষা বার বার বলেও তাকে শোওয়াতে পারেনি, পারেনি সেই ঘরেই কখনও। যে ভালবাসা তেমন করে কখনও প্রকাশ করার সময় হয়নি রুষার কাছে পৃথুর, অথচ, রোজই ভেবেছে যে, প্রকাশ করবে, অথচ করবে করতে দেরি হয়ে গেছে বড়।
সময় বড় সাংঘাতিক। সময়ে সময় না রাখলে, সময় পায়ে দলে চলে যায়।
পৃথু ভাবছিল, একদিন ওর রাইফেলটাকে নিয়ে সময়ের চেয়েও অনেক বেশি জোরে দৌড়ে এগিয়ে গিয়ে একটা বাঁকের আড়ালে হাঁটু গেড়ে বসে থাকবে অ্যামবুশ্ করবে বলে। সময় যখন হাঁপাতে হাঁপাতে এসে পৌঁছবে মোড়ে তখন দেবে ট্রিগারটা টেনে। মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবে সময় নির্জন বনবাসে। সেদিন থেকে সময়ের খবরদারী ও আর মানবে না।