2 of 2

৫৩. সকালবেলা ঘণ্টাখানেকের জন্য

সকালবেলা ঘণ্টাখানেকের জন্য ঘরের বাইরে আসা যায়। প্রাতঃকৃত্যের জন্য গোসলখানার বাইরে লাইন দিয়ে দাঁড়ায় আন্ডার ট্রায়াল বাবুরা। নানা রকম রস রসিকতা গুঞ্জরিত হয়। জেলের জীবন অনেকটা সহ্য হয়ে গেছে।

কয়েক জনকে দেখা যায় চাতালে দাঁড়িয়ে ব্যায়াম করতে। প্রিয়লালবাবু একটি স্কুলের ড্রিলমাস্টার ছিলেন, তিনি এখানেও মাস্টারি ভঙ্গিতে অন্যদের সঠির ব্যায়ামের নির্দেশ দেন।

অবশ্য সোস্যালিস্ট দলের ছেলেরা তখন আলাদা দাঁড়িয়ে থাকে। জাতিভেদের মতনই জেলখানার মধ্যে পার্টিভেদ খুব প্রবল। এক পার্টির লোক অন্য পার্টির কারওর সঙ্গে বেশি মেলামেশা করলে সেই নিয়ে রীতিমতন কানাকানি শুরু হয়ে যায়। যেমন, প্রৌঢ় ধনঞ্জয়বাবুর সঙ্গে ইন্দ্রজিতের অন্তরঙ্গতা অনেকেই রীতিমতন খারাপ চোখে দেখছে। ধনঞ্জয়বাবু একটি দিনও ইন্দ্রজিৎকে না দেখে থাকতে পারেন না। ইন্দ্রজিৎ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে গেলে তিনিও অসুখের ছুতো করে কিংবা ইচ্ছে করে অসুখ বাধিয়ে হাসপাতালে গিয়ে তবে ছাড়লেন।

তবে দু’জন মানুষকে সবাই খাতির করে। বৃদ্ধ শর্মাজি ভোর হতে-না-হতেই ভজন গান শুরু করে দেন। তাঁর গলা ভারী সুন্দর। একটার পর একটা গান গেয়ে চলেন তিনি, ওয়ার্ডার, মেটরাও চুপ করে শোনে। দূরের ব্যারাক থেকে অনুরোধ আসে, শর্মাজি, আর একখানা, আর একখানা! শর্মাজির কোনও ক্লান্তি নেই।

শর্মাজি মুঙ্গের জেলার লোক। বাংলাও খুব ভালো জানেন। বেদ স্তোত্র থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথের বহু গান তার জানা–এমন সংগীতপাগল লোক কেন রাজনীতিতে সক্রিয় ভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন কে জানে। প্রায় প্রত্যেক দিন ভোরবেলাই তিনি শুরু করতেন এই গানটি দিয়ে:

…যুগ যুগান্তর তব তপোবন পর কতহি ধরম বাখন।
বিমান কম্পই উঠত নিতি গম্ভীর ঝঙ্কার তান।।
যমুনাকিতটপর কৈসন মনোহর শ্যামকী বশী বয়ান।
যোহি দরস কিয়া যমুনাকি পানিয়া চঞ্চল চলত উজানা।।
অব ওহি ভারত পর-পদ লাঞ্ছিত বিহীন যশ বীর্ষ মান।
সোহি দরশ কিয়া দিন হুঁ রাতিয়া ঝরত মেরা নয়ান।।


এই গানটা বহু বার শুনতে শুনতে অনেকেরই মুখস্ত হয়ে গেছে। রাজবন্দিদের মধ্যে যারা দেশকে মাতৃকা রূপে ধ্যান করে না, তাদেরও অনেককে গুণ গুণ করতে শোনা যায় এই গান। গানটা কার লেখা জিজ্ঞেস করলে শর্মাজি হাত উলটে বলেন, জানি না। তাতেই অনেকের ধারণা হয়, ওটি ওঁরই রচনা।

রবীন্দ্রনাথের গানের মধ্যে তার প্রিয় গান:

‘একবার তোরা মা বলিয়া ডাক,
জগত জনের শ্রবণ জুড়াক
হিমাদ্রি পাষাণ কেঁদে গলে যাক
মুখ তুলে আজি চাহ রে।’

আর একজন মানুষ অতুলপ্রসাদ রায়। কোনও দিন কেউ তার মুখে একটাও অভিযোগের কথা শোনেনি। কোনও দিন কারোকে উপদেশ কিংবা ভর্ৎসনা করেন না। দীর্ঘদেহী পুরুষ, মাথার চুল কাঁচাপাকা। তিনি নিজের রসে নিজে মজে আছেন সব সময়। তার চেহারা ও ব্যক্তিত্বে একটা সর্বাত্মক সতোর পরিচয় স্পষ্ট। সতোর প্রতি মানুষের এখনও বাধ্যতামূলক শ্রদ্ধা আছে–তাই অতুলপ্রসাদের কাছে সকলেই একটু অবনত হয়ে যায়।

রাজনৈতিক কর্মী মাত্রেই শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি নয়, বিশেষত জেলখানায় এলে তাদের অনেক ক্ষুদ্রতা, লোভ ও স্বার্থপরতা প্রকট হয়ে পড়ে। প্রাণ তুচ্ছ করে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল যে লোক, কারাগারে এসে সে সামান্য খাবারদাবার প্রভৃতি নিয়ে এমন রেষারেষি করে যে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। অনেকের যৌন অতৃপ্তিও এখানে এসে হঠাৎ প্রকাশ পেয়ে যায়। অতুলপ্রসাদ এখানে আছেন বলেই তার তুলনায় বেশ কয়েক জনকে মানুষ হিসেবে অতি তুচ্ছ মনে হয়।

অতুলপ্রসাদ রায় জেলের বাইরে রীতিমতন বড় দরের নেতা ছিলেন, বি পি সি সি’র সদস্য ছিলেন অনেক দিন। কিন্তু জেলে এসে যেন রাজনীতি একেবারেই ভুলে গেছেন। এখানে কয়েকটি দলের নিয়মিত স্টাডি সার্কল বসে, অতুলপ্রসাদ তাতে যোগ দেন না। কেউ এসে ডাকলেও উদাসীন ভাবে হেসে বলেন, বুড়ো হয়ে গেছি, আমাদের দিন শেষ হয়ে গেছে–এখন নতুন নতুন ছেলেরা কাজের ভার নেবে।

প্রত্যেক দিন ভোরবেলা দেখা যায়, তিনি চাতালের এক প্রান্তে যে কয়েকটি ছোট ছোট গাছ রয়েছে, সেগুলোতে জল দিচ্ছেন, গোড়া নিড়িয়ে দিচ্ছেন। সেগুলো ফুল গাছও না, দামি কোনও গাছও না-নেহাতই আগাছা–তবু সেগুলির প্রতিই তার অসীম ভালোবাসা।

জেলখানার নিয়মকানুনের কড়াকড়ি এখন অনেকটা শিথিল হয়ে এসেছে। দেশে আর কোনও আন্দোলন নেই। অনেক দিন নতুন বন্দি আসে না। জেলখানার মধ্যে বন্দিদের গতিবিধি এখন আর তেমন নিয়ন্ত্রিত নয়। ছোট ছোট সেলের বদলে ব্যারাকের মতন বড় ঘরে একসঙ্গে অনেকে মিলে থাকে–নিঃসঙ্গতার শাস্তিটুকু অন্তত পেতে হয় না। লোহার সানকি হাতে নিয়ে আর দাঁড়াতে হয় না খাবারের লাইনে, সরকার এখন মাথা পিছু টাকা বরাদ্দ করে দিয়েছেবন্দিরা নিজেরাই ছোট ছোট দল করে নিয়ে নিজেদের খাবার রান্না করে খায়। কবে কী রান্না হবে, কিংবা কে কত ভালো রাঁধে–সেই আলোচনায় অনেকটা সময় কাটে। এক দল আরেক দলকে নেমন্তন্ন করে খাওয়ায়। আবার মাছের টুকরো কে ছোট পেয়েছে, কে বড় নিয়েছে–এই নিয়ে ঝগড়া লাগার ঘটনাও বিরল নয়।

বিকেলে কিছুক্ষণ খেলাধুলোর সুযোগ মিলেছে, অনুমতি পাওয়া গেছে বাইরে থেকে বই আনানোর। একটি দেওয়াল পত্রিকাও একদিন আত্মপ্রকাশ করল।

সূর্য এবং আরও সাত জনের বিচার শেষ হয়ে গেছে–এখন ওরা দণ্ডাজ্ঞার প্রতীক্ষায়। ডেঞ্জারাস ক্রিমিন্যাল হিসেবে ওদের সেলেই রাখা হয়েছে। তাতে অবশ্য ওদের তেমন অভিযোগ নেই। এ-জেলের সুপারিনটেনডেন্ট প্রকৃতই সজ্জন–প্রায়ই এসে ওদের সুযোগ সুবিধের ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে যান। মাঝে মাঝে তিনি ঠাট্টা করে বলেন, কী মশাই, আপনারা পালা করে এক এক জন অসুখ বাধাতে পারেন না? তা হলে বেশি করে দুধ মাখন আর ডিম খাওয়াতে পারতাম।

খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা মোটামুটি ভালোই। সূর্যর স্বাস্থ্য ফিরে গেছে। তবে, দাড়ি কামায় না বলে তার মুখখানা অন্য রকম দেখায়।

মাসের পর মাস জেলের জীবন নিস্তরঙ্গ। শান্তিপ্রসাদ নামে একটি ছেলের হঠাৎ পাগল হয়ে যাওয়া ছাড়া বিশেষ কোনও ঘটনা ঘটেনি।

শান্তিপ্রসাদের মা মারা যাওয়ার খবর আসার পর থেকেই সে খুব মনমরা হয়ে পড়েছিল। সবাই তাকে নানা কথায় ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে, অতুলপ্রসাদ তাকে গীতা পড়ে শুনিয়েছেন। তবু শান্তিপ্রসাদ একদিন বাথরুমে যাবার সময় সূর্যকে ফিসফিস করে বলেছিল, রেডি থাকবেন, আমাদের জেল ভেঙে বাইরে নিয়ে যাবার সব ব্যবস্থা ঠিকঠাক হয়ে গেছে।

কথাটা শুনেই সূর্যর খটকা লেগেছিল। বাইরে তাদের কোনও দল নেই, কারওর সঙ্গে যোগাযোগও হয়নি কারা হঠাৎ তাদের জেল ভেঙে বার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে?

কিন্তু শান্তিপ্রসাদ দিনের-পর-দিন সেই অবাস্তব স্বপ্ন নিয়ে মেতে রইল। ক্রমশ ঘোলাটে হয়ে এল তার চোখের দৃষ্টি। একদিন রাত্তিরবেলা সে লোহার গরাদে প্রচণ্ড জোরে মাথা ঠুকতে ঠুকতে চিৎকার করতে লাগল, এসে গেছে! এসে গেছে!

ওয়ার্ডবয় আর সেন্ট্রিরা ছুটে এল। অন্যান্য সেলের বন্দিরা উদগ্রীব হয়ে রইল খবর জানবার জন্য। শান্তিপ্রসাদের চিৎকারের বিরাম নেই। তার কপাল থেকে দরদর করে। রক্ত পড়ছে। জেলার সাহেব এলেন একটু বাদেই। দরজা খুলে তার চিৎকার থামাবার জন্য তাকে মারধরও করা হল–কিন্তু শান্তিপ্রসাদ তখন সবাইকে কামড়ে দিতে আসছে। তারপর ডাক্তার এসে জোর করে মরফিন ইঞ্জেকশন দিয়ে অজ্ঞান করে দিলেন ওকে। একদিন বাদে শান্তিপ্রসাদকে সরিয়ে নেওয়া হল এই জেল থেকে–কোথায় গেল কেউ জানে না।

সূর্য কিছু দিন ছিল ব্যারাকে অন্যদের সঙ্গে। তখনও সে বিশেষ সুখে থাকেনি। সে কোন দলের ছেলে, কী তার রাজনৈতিক বিশ্বাস–তা কেউ জানে না। তার সঙ্গে কথা বলেও কিছু বার করা যায় না। অন্য বন্দিদের মধ্যে সূর্যর পূর্ব-পরিচিত শুধু শংকরবাবু। তিনি এখন অন্য মতে বিশ্বাসী। সূর্যকে তিনি আগেও বিশেষ পছন্দ করতেন না এখানেও তাকে বেশি পাত্তা দিলেন না।

তবু, পূর্ব-পরিচিত বলেই সূর্য প্রথম প্রথম শংকরবাবুর কাছাকাছি থাকতে চেয়েছিল। হাজারিবাগে যে-গুপ্ত দলটির সঙ্গে সূর্য একদিন পাকেচক্রে জড়িয়ে পড়েছিল, সেই দলের লোকজন ছাড়া সূর্যর আর কোনও বন্ধু নেই, আর কারোকে সে চেনে না। শংকরবাবুর সঙ্গে সে হরকুমার, ব্রজগোপাল কিংবা যোগানন্দ সম্পর্কে কথা বলতে চায়। শংকরবাবু তাকে পাত্তা দেন না। বিদ্রূপ করে বলেন, আমি তখনই বলেছিলাম না, শুধু গুন্ডামি আর ডাকাতি করে দেশ স্বাধীন করা যায় না! সূর্য আহত হয়ে সরে আসে।

অন্য অনেকে গায়ে পড়ে তার সঙ্গে আলাপ করতে এসেছে। বিশেষত তার সুন্দর চেহারা দেখে কেউ কেউ আকৃষ্ট হয়, কেউ কেউ আবার ওই চেহারার জন্যই তার সঙ্গে একটু বিদ্রুপের সুরে কথা বলে। সূর্য তাদের উত্তর দেয় কঠিন অবজ্ঞায়। একদিন কী এক অজ্ঞাত কারণে একজন নেতৃস্থানীয় দাদার সঙ্গে সুর্যর মারামারি শুরু হয়ে গেল। দু’একটা কথার পরই সূর্য কষিয়ে দিল তার মুখে এক ঘুষি। তাঁর মুখ থেকে রক্ত পড়তে লাগল। এই ঘটনায় সবাই ছি ছি করতে লাগল সূর্যকে। রাজনৈতিক বন্দিদের এ রকম মারামারি বড়ই কেলেঙ্কারির কথাসাধারণ চোর-ডাকাত কয়েদিরা যে একথা শুনে হাসবে। সবাই একঘরে করল সূর্যকে।

তারপরই সূর্যকে আবার সেলে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। সেই অবস্থাতেই কেটে গেল টানা দেড় বছর। একাকিত্বে সূর্যর কোনও কষ্ট নেই। সে আশা করে আছে, তাকে আন্দামানে পাঠানো হবে। মৃত্যুদণ্ডের কথা সে চিন্তা করে না। মৃত্যুর আবার কোনও মানে। হয় নাকি? সে কিছুতেই মরবে না। তা ছাড়া, কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে, বেয়াল্লিশের আন্দোলনে ধৃত কারোকেই সরকার এখনও ফঁসি দেয়নি। যাদের মেরে ফেলার আগেই মেরে ফেলেছে। হাজারিবাগ জেলে কয়েক জন বন্দির রহস্যজনক মৃত্যুর কথা শোনা গেছে। এখনও ঢালাও ভাবে দেওয়া হচ্ছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। সূর্য আন্দামানেই যেতে চায়–এখানকার কারাজীবন তার পছন্দ হয়নি–দেখাই যাক না আন্দামানটা কী রকম। সুপারিনটেনডেন্টকে সে এই মর্মে অনেক বার অনুরোধ জানিয়েছে।

সূর্য অবশ্য জানত না, আন্দামানে বন্দি পাঠানো অনেক দিন বন্ধ হয়ে গেছে। কিছু দিনের জন্য সুভাষ বোস আন্দামান স্বাধীন করে সেখানে জাতীয় পতাকাও উড়িয়ে দিয়েছিলেন।

ধরা পড়ার পর প্রথম প্রথম সূর্যকে অনেক অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিল। তার মুখ দিয়ে কথা বার করার জন্য কোনও বীভৎস পন্থাই তারা বাকি রাখেনি। সে-সব দিনগুলো এখন দুঃস্বপ্নের মতন মনে হয়। সেই অত্যাচারের সময় সূর্যর জেদ আরও বেড়ে গিয়েছিল। সে ভাবত, আবার সে জেল থেকে বেরিয়ে লড়াইতে নেমে পড়বে। কত দিন জেলে আটকে রাখবে তাকে–পালাবার পথ একটা বেরোবেই।

এখন সে বুঝে গেছে, আগামী দশ-পনেরো বছরের মধ্যে অন্তত তার বেরোবার। কোনও সম্ভাবনাই নেই। আন্দামান গেলেই বা কী হবে! আন্দামান থেকে কি কেউ কোনও দিন পালাতে পেরেছে? তাকে একলা একলাই কাটাতে হবে অনেকগুলি বছর। সে আর লড়াইয়ের কথা ভাবে না।

সূর্যর সেলে একটা জানলা আছে। এটা একটা অতিরিক্ত সৌভাগ্যের ব্যাপার, কারণ অধিকাংশ সেলই অন্ধকূপের মতন। জানলাটা এত উঁচুতে যে সূর্য লাফিয়েও সেটা ছুঁতে পারে না। অনেক বার চেষ্টা করে দেখেছে–এর ফলে তার হাইজাম্পে দক্ষতা বাড়লেও জানলা পর্যন্ত পৌঁছোতে পারেনি। জানলাটার বাইরে আকাশ দেখা যায় না। একটু দূরেই একটা উঁচু দেওয়ালের চৌকো অংশ শুধু চোখে পড়ে। ঘরের বিভিন্ন জায়গায় শুয়ে থাকলে সেই চৌকো অংশটা ছোট কিংবা বড় হয়। দেওয়ালটাতে শ্যাওলা ধরাবর্ষার সময় আর রোদ্দুরে শ্যাওলার রং পালটায়।

জানলাটা থাকার একটা সুবিধে, বাইরের শব্দ বেশি আসে। বাইরের নানা রকম কথা সে শুনতে পায়, এমনকী জেলারের কোয়ার্টারের বাচ্চাদের কিংবা মেয়েদের গলার আওয়াজ কখনও কখনও ভেসে আসে। একদিন একটা শালিক এসে জানলার শিকে বসে সূর্যর দিকে খুব মনোযোগ সহকারে তাকিয়েছিল। সূর্য তার সঙ্গে ভাব জমাবার চেষ্টা করল, রুটির টুকরো ছুঁড়ে দিল–তবু উড়ে গেল শালিকটা, সাত দিনের মধ্যে আর এল না। তারপর আবার পর পর দুদিন এসে আবার কয়েক দিন একটানা ডুব। অদ্ভুত খেয়ালি পাখি।

সকালবেলা শর্মাজির গান শুনে সূর্যর ঘুম ভাঙে। কয়েকটা গান সে এতবার শুনেছে যে গানগুলোর সময় সেও ঠোঁট নাড়তে পারে। যদিও এত দূর থেকে শোনার জন্য সবক’টা শব্দ সে ঠিক জানে না। মুখটুখ ধুয়ে জলখাবার খেয়ে সে বই নিয়ে পড়তে বসে। এখন সে ইচ্ছে মতন বই পায়। তার মধ্যে একটি অধ্যবসায়ী ছাত্র সুপ্ত ছিল বই পড়তে সে ক্লান্ত বোধ করে না। পড়তে পড়তে সে জানলার দিকে তাকায় বার বার, শালিকটার প্রতীক্ষা করে। লক্ষ্মীছাড়া শালিকটা যে রোজ আসে না–আবার যে-কোনও সময়েই আসতে পারে, এইটাই ওর একমাত্র আকর্ষণ।

বাবার কাছ থেকে প্রায়ই চিঠি আসে। বাবার চিঠিগুলো সংক্ষিপ্ত এবং শুধু নানা রকম খবরে ভরা। ছেলের কাছে লেখা চিঠিতে বড়বাবু আবেগের আতিশয্য দেখাতে চান না। এবং নিজের বিষয়েও কিছুই লেখেন না। তাঁর চিঠির অনেক খবরই জেল কর্তৃপক্ষ কালো কালি দিয়ে কেটে দেয়। বাদলও মাঝে মাঝে চিঠি লেখে। মাস দু’-এক আগে বড়বাবুর সঙ্গে ও একবার দেখাও করতে এসেছিল এখানে। বাদল বেশ বড় হয়ে গেছে।

একদিন সূর্য একটা চিঠি পেয়েছিল, সে চিঠিতে কোনও সম্বোধন নেই। শেষে নাম সই নেই। তবু সূর্যর বুঝতে অসুবিধে হয়নি, চিঠিটা কার লেখা। এ রকম চিঠি তাকে ইহ সংসারে শুধু একজনই লিখতে পারে। চিঠিটাতে লেখা ছিল:

‘জেলখানার ভেতরটা কী রকম দেখতে হয় আমি জানি না। কিন্তু সব সময় আমি তোমার পাশাপাশি আছি। তুমি টের পাও না? আমি তোমাকে দেখতে পাই। আমি সব সময় তোমাকে খুব কাছে পাই। যদি জিজ্ঞেস করো কেন এবং কী ভাবে, বলতে পারব না। সবার মধ্যে বসে থেকেও মনে হচ্ছিল, কোনও এক জায়গায় ওই মানুষটি একান্তই আমার। আমার মতন করে একে আর কেউ জানে না। এই অনুভূতিটা সত্যি হতে পারে, মিথ্যাও হতে পারে, কিন্তু এমন ভাবনা আমাকে গভীর তৃপ্তি দেয়, বেঁচে থাকতে সাহায্য করে।

তুমি আমায় স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছ।’

চিঠিখানা সূর্য অন্তত একশো বার পড়ে ফেলল একদিনে। শ্রীলেখার মুখখানা তার মনে পড়ছে, আর সে চিঠিখানা মেলে ধরছে চোখের কাছে।

দু’দিন এ রকম চলার পর সে ভাবল, এ রকম করলে সে পাগল হয়ে যেতে পারে। এত বেশি আবেগ তার এই অবস্থায় অস্বাস্থ্যকর। তখন সে চিঠিখানা ছিঁড়ে কুটি কুটি করে ছড়িয়ে দিল ঘরের মধ্যে। তারপর এক একটা টুকরো তুলে নিয়ে বাকি অংশটা মুখস্ত বলে যেতে লাগল। কিন্তু শ্রীলেখাকে কোনও উত্তর লিখল না।

সূর্য শুয়ে শুয়ে বুখারিনের লেখা ‘হিস্টরিক্যাল মেটেরিয়ালিজম’ বইখানা পড়ছিল– এই সময় অতুলপ্রসাদ তার সেলের সামনে এসে দাঁড়ালেন। তার হাতে একটা ছোট্ট সাদা ফুল।

তিনি একদৃষ্টিতে সূর্যকে দেখতে লাগলেন। দরজার দিকে পা রেখে সূর্য উপুড় হয়ে শুয়ে আছে, অতুলপ্রসাদের উপস্থিতি লক্ষ করেনি। লোহার শিকের বাইরে থেকে এই যুবকটিকে দেখতে দেখতে অতুলপ্রসাদ এক ধরনের মায়া অনুভব করলেন। তার মনে হল, বহু বইতে তিনি এই রকম দৃশ্যের বর্ণনা পড়েছেন কিন্তু সেই সব দৃশ্যের সঙ্গে বাস্তব চিত্রটি একেবারেই মেলে না। কারাগারে বন্দি তেজস্বী যুবকের সঙ্গে শৃঙ্খলাবদ্ধ সিংহের তুলনা দিয়েছেন অনেক লেখক–। কিন্তু এই দৃশ্যের মধ্যে কোনও মহৎ ট্র্যাজেডি নেই, আছে দারুণ অপচয়। এই সুকুমারকান্তি যুবকটির জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় এই চার দেওয়ালের মধ্যে নষ্ট হয়ে যাবে। অতুলপ্রসাদ অকৃতদার, পুত্রস্নেহের কোনও অভিজ্ঞতা তার নেই–কিন্তু সূর্যকে দেখে বার বার তাঁর নিজের যৌবনের কথা মনে পড়তে লাগল।

তিনি মৃদু গলায় বললেন, সূর্যকুমার, কেমন আছ?

সূর্য তাড়াতাড়ি উঠে বসল। বই মুড়ে রেখে এগিয়ে এসে বলল, আমি ভালো আছি, আপনি হঠাৎ এ-দিকে যে!

অতুলপ্রসাদ বললেন, আমাকে তো সব দিকেই যেতে দেয়। কেউ কিছু নিষেধ করে না। তোমার সঙ্গে দেখা করতে এলাম।

আপনি—

আমি কাল ছাড়া পেয়ে যাচ্ছি!

সূর্য একটুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, খুব ভালো লাগল শুনে। আপনাকে শুধু শুধু আটকে রেখেছিল।

অতুলপ্রসাদ বললেন, না হে, ঠিক তার উলটো। আমাকেই বরং অনেক দিন আটকে রাখার কথা ছিল। এখনও আমাদের কেসই উঠল না ভালো করে, হঠাৎ যে ছেড়ে দেবে কে ভাবতে পেরেছিল!

অতুলপ্রসাদকে মোটেই উৎফুল্ল দেখা গেল না। কিংবা আর একজন বন্দির কাছে। নিজের মুক্তির কথা জানাতে তার সহজাত ভদ্রতায় আটকাচ্ছিল। শুকনো হেসে বললেন, সরকার আর আমাদের বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াতে চায় না। সরকারের চোখে তো আমরা ডেঞ্জারাস ক্রিমিন্যাল নই। আমরা তো অকর্মার ঢেঁকি।

অতুলপ্রসাদের মুখে কেউ কোনও দিন আপশোস বা অভিযোগের কথা শোনেনি– শুধু আজই মুক্তি পাওয়ার ব্যাপারে তাকে একটু ক্ষুব্ধ মনে হল।

সূর্য জিজ্ঞেস করল, শুধু আপনি একা?

না। আমাদের ও-দিককার সতেরো জনের রিলিফ অর্ডার এসেছে।

শর্মাজি?

হ্যাঁ, শর্মাজিও ছাড়া পাচ্ছেন। শুনে তোমার মনখারাপ লাগছে, না?

না, না–

আমার কথা বাদ দাও। আমি তো কারওর কোনও উপকারে লাগতাম না–কিন্তু শর্মাজি তোমাদের গান শোনাতেন–সকালবেলা ওই চারণ কবির গান আর তোমরা শুনতে পাবে না।

তা বলে উনি কি আমাদের গান শোনাবার জন্য সারাজন্ম জেলে কাটাবেন?

তুমিই কি সারা জীবন জেলে কাটাবে ঠিক করেছ নাকি?

আমি কিছু ঠিক করিনি।

শুনছি তো আলিপুর সেন্ট্রাল জেল থেকে একটা দলকে এখানে পাঠাবে। তাদের মধ্যে কেউ গায়ক থাকতে পারে। তবে শর্মাজির জায়গা কেউ নিতে পারবে না। অসাধারণ মানুষ!

সূর্য অনুভব করল, অতুলদা তাকে কিছু একটা বলতে চান। শুধু বিদায় নেবার হলে–এতক্ষণে তো তা হয়ে গেছে।

অতুলপ্রসাদ নীরবে দাঁড়িয়ে আছেন সূর্যর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে। অস্বস্তি কাটাবার জন্য সূর্য একটু হালকা ভাবে বলল, আপনি ছাড়া পাচ্ছেন। কিন্তু আপনাকে খুশি মনে হচ্ছে না কেন?

ছাড়া পেয়ে কী করব?

বাঃ, আপনার কি জেলখানাই ভালো লাগে!

জেলখানায় আমার জীবনের অনেকগুলো বছর কেটেছে। সেই দেশবন্ধুর আমল থেকে। এখন আর ভালো লাগা খারাপ লাগার প্রশ্ন নেই। তবে তোমাদের মতন তো আর কম বয়স নেই–আমাদের বয়সি লোকেরা জীবনের সবকিছুই ভেবেচিন্তে ছক বেঁধে করতে চায়। মনে মনে ঠিক করেই রেখেছিলাম, আরও অন্তত দু-তিন বছর এখানে থাকতে হবে–সেই অনুযায়ী সাজিয়ে নিয়েছিলাম জীবন–হঠাৎ সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেল।

জেলখানার এই একঘেয়ে জীবনে আবার সাজাবার কী আছে, সূর্য তা ভেবে পায় না। তবু এই প্রৌঢ়ের সঙ্গে কিছু একটা কথা বলার জন্যই সে বলে, আপনার বাড়ির লোকেরা আপনাকে পেয়ে খুশি হবে।

ত্রি-সংসারে আমার কেউ নেই রে ভাই!

আপনার পার্টি?

প্রকৃতি শূন্যতা সহ্য করে না। আমার পার্টির লোকেরা কি আমার জন্য বসে আছে? উপেনদা জেল থেকে বেরিয়ে নিজের পার্টিতে ভোটে হেরে গিয়েছিলেন।

তা হলে আপনি বেরিয়ে আবার একটা কিছু করে জেলে ফিরে আসুন।

অতুলপ্রসাদ হাসলেন। তারপর বললেন, যাই হোক, কালই চলে যাচ্ছি, তোমার সঙ্গে আর দেখা হবে না। যদি কিছু অপরাধ করে থাকি, ক্ষমা কোরো আমাকে।

অতুলপ্রসাদ সত্যি হাত জোড় করলেন। সূর্য একেবারে অভিভূত হয়ে পড়ল। এই নিঃশত্রু প্রৌঢ়ের পক্ষে তার কাছে কোনও অপরাধ করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। তবু এই বিনয়ের সৌম্যতা, এই প্রাচীন আদর্শবোধ–যা তার চরিত্রের একেবারে বিপরীত, তাকে হঠাৎ খুব নাড়া দেয়।

সূর্য গরাদের বাইরে হাত বাড়িয়ে অতুলপ্রসাদের বাহু চেপে ধরে বলে, দাদা, এ কী বলছেন! আমিই হয়তো কখনও রাগের মাথায় কিছু বলে ফেলেছি–

না, না, তুমি কিছু বলেনি—

আমি ছাড়া পেলে আপনার সঙ্গে নিশ্চয়ই দেখা করব—

যদি তত দিন আমি বেঁচে থাকি! শোনো, বাইরে গিয়ে তোমার কোনও খবর কাউকে পৌঁছে দিতে হবে?

সূর্য একটুক্ষণ ভেবে বলল, না। সে রকম কিছু নেই।

তোমার বাড়ি কোথায়?

কলকাতায়।

তোমার বাড়িতে গিয়ে আমি বলে দেব এখন তোমার স্বাস্থ্যটাস্থ্য ভালো আছে। ঠিকানা কী।

বাড়িতে আমার বাবা ছাড়া আর কেউ নেই। তিনিও কখন বাড়িতে থাকেন তার ঠিক নেই। আমি তো চিঠি লিখে তাঁকে খবর দিচ্ছিই। আপনি কষ্ট করে যাবেন কেন?

না।

তোমার আর কোনও প্রিয়জন নেই? কোনও বন্ধুবান্ধব? না।

আশ্চর্য! ভারী আশ্চর্য। তোমার বয়সে এ রকমটি ভাবা যায় না। তোমার কোনও কাজই কি আমি বাইরে গিয়ে করে দিতে পারব না?

সে রকম তো কিছু মনে পড়ছে না।

তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারো তোমার কোনও চিঠি যদি কোনও জায়গায়। পৌঁছে দিতে হয়–

আমি আপনাকে অবিশ্বাস করব কেন? আপনিই বিশ্বাস করুন, আমার আর কোনও দল নেই। কারওর সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই।

তা হলে, সূর্য, তুমি আমার একটা উপকার করবে?

বলুন।

অতুলপ্রসাদ হাতের সাদা ফুলটা সূর্যর হাতে দিয়ে বললেন, এটার গন্ধ শুঁকে দেখো! এটা কী ফুল বলতে পারো?

সূর্য একটু বিস্মিত ভাবে ফুলটা নিল, নাকের কাছে নিয়ে শ্বাস টানল। মৃদু মৃদু মিষ্টি গন্ধ। কিন্তু সূর্য তার কৈশোর থেকেই যে ধরনের জীবন কাটিয়েছে, তাতে তার ফুল চেনার অবকাশ হয়নি।

সে বলল, বেশ সুন্দর গন্ধ। কী ফুল?

অতুলপ্রসাদ গর্বের সঙ্গে বললেন, লেবু ফুল। বিশ্বাস করতে পারো, সত্যি সত্যি একটা লেবু ফুল।

কোথায় পেলেন?

আমি তৈরি করেছি।

কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে শিশুর মতন সরল হাস্যে তার মুখখানা উদ্ভাসিত হয়ে গেল। একটি লেবু ফুলের বার্তা তাঁর কাছে মুক্তির চেয়েও অনেক বড়।

তিনি বললেন, সবাই ভেবেছিল আগাছা, আমিও তাই ভেবেছিলাম–জমাদার কত দিন সাফ করতে চেয়েছে–আমি তবু দিইনি, তবু তো একটুখানি সবুজ। তারপর একদিন টের পেলাম, সেই আগাছার জঙ্গলে একটা লেবু গাছও রয়েছে। টের পাবার পর কাউকে বলিনি। যদি সত্যি না হয়! আজ প্রথম ফুল ফুটেছে, এবার কেউ অবিশ্বাস করতে পারবে? কত যত্নে গাছটাকে তৈরি করেছি–দিনের পর দিন–এক একটা লেবু গাছ বন্ধ্যা হয়, ফুল ফোটে না, ফল হয় না–যদি সে রকম কিছু হয়–এই ভয়ও ছিল। আজই ফুল ফুটল, আর কাল আমাকে চলে যেতে হবে! একি পরিহাস নয়!

ফুলটা আপনি সঙ্গে নিয়ে যান। একটা স্মৃতি।

আমি এ-স্মৃতি নিয়ে কী করব! আমি আশা করেছিলাম, গাছটা একদিন বড় হবে, ফল ফলবে–আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখব। আমার গ্যাসট্রিক আছে, আমি লেবু খাই না– অন্যরাই খেত–কিন্তু আমি দেখে যেতে পারলাম না। তুমি আমার অবর্তমানে এই গাছটার ভার নেবে? এটাকে বাঁচিয়ে রাখবে?

আমি? কিন্তু আমি তো গাছের বিষয়ে কিছু জানি না।

অতুলপ্রসাদ মহা উৎসাহের সঙ্গে বললেন, তার জন্য কোনও চিন্তা নেই। কাল সকালটাতে তো সময় আছে–সেই সময় আমি তোমাকে সব বুঝিয়ে দেব। আসল কথা হচ্ছে ভালোবাসা। তুমি যদি কোনও কাজকে ভালোবাসতে শেখো–তবে তার সম্পর্কে তোমার কিছুই জানতে বাকি থাকবে না। এমনকী গাছও ভালোবাসা বোঝে।

আপনি এত লোক থাকতে আমার ওপরই এ-ভার দিয়ে যাচ্ছেন কেন?

যেন সম্পত্তির উত্তরাধিকার দিয়ে যাচ্ছেন এই সুরে তিনি বললেন, সকলকে তো বিশ্বাস করা যায় না। একটু অযত্ন করলেই ধাঙড়-জমাদাররা উপড়ে ফেলে দেবে। তোমার সঙ্গে আমার যেন কোথায় একটা মিল খুঁজে পাই। তোমাকে আমার বরাবরই বড় ভালো লাগে। এমন ঠান্ডা স্বভাব, মুখের মধ্যে একটা লক্ষ্মীশ্ৰী আছে–তুমি ঠিক পারবে। তা ছাড়া তোমারই বয়স সবচেয়ে কম–

সূর্য স্নেহ-ভালোবাসার প্রতিদান দিতে জানে না। যে-ই তাকে স্নেহ-ভালোবাসা দেখাতে আসবে–তাকেই নিষ্ঠুর প্রতিআঘাত দেবার একটা অদ্ভুত প্রবণতা আছে তার। মধ্যে। এখানেও সে নিজেকে সামলাতে পারল না।

নিষ্ঠুরের মতন বলল, আমার বয়স কমতার মানে আমি সবচেয়ে বেশি দিন জেলে থাকব–বেশি দিন আপনার গাছটা দেখাশুনো করতে পারব–সেই জন্যই আমাকে বেছে নিয়েছেন, তাই না?

তারপর সূর্য হঠাৎ খুব উত্তেজিত হয়ে দরজা ধরে ধাক্কা দিতে দিতে বলল, আমি থাকতে চাই না, আমি এখানে থাকতে চাই না। আমি বাইরে যেতে চাই। চুলোয় যাক আপনার লেবু গাছ!

অতুলপ্রসাদ বিস্ফারিত চোখে তাকালেন। প্রথমটা কোনও কথাই বলতে পারলেন না। তারপর দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে আস্তে আস্তে বললেন, না, আমি সে কথা ভাবিনি। সে কথা ভাবিনি। আমি ভেবেছিলাম, তুমি একটা কিছু নিয়ে ভুলে থাকতে পারবে। তোমার শুকনো দিনগুলো একটা কিছুর প্রতীক্ষায় কাটবে। আমি মনে প্রাণে চাই তুমি তাড়াতাড়ি ছাড়া পাও। যদি আমার বদলে তোমাকে—

অতুলপ্রসাদের চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল পড়তে লাগল। গরাদের ফাঁক দিয়ে তিনি সূর্যর হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *