তিপ্পান্ন
মাধবীলতার অপারেশন হয়ে গেল। ডাক্তার দত্তগুপ্তের ইতস্তত ভাবটা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ছিল। শরীরে যার রক্ত নেই তাকে অপারেশন করায় বড় ঝুঁকি। কিন্তু এ ছাড়া অন্য উপায় নেই। দ্বিতীয়ত মাধবীলতার শরীরে যে গ্রুপের রক্ত চলাচল করে সেই গ্রুপের রক্ত হাসপাতালে পাওয়া যাচ্ছিল না। একে অস্বস্তি ছিল তার ওপর স্বাভাবিক শ্রেণীর রক্ত না হওয়ায় অন্যরকম ইঙ্গিত দিচ্ছিল। ডাক্তারদেরও মনে বোধহয় সংস্কার খুব বেশী কাজ করে। শরীরে রক্ত না থাকাটা অস্বাভাবিক ব্যাপার নয় কিন্তু সেই পেশেন্টের রক্তের শ্রেণী অসাধারণ হবে কেন?
পরমহংস, সৌদামিনী যখন শহরের সমস্ত রক্তসংরক্ষণ কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছেন তখন অর্কর সঙ্গে মুশকিল-আসান লোকটার দেখা হয়ে গেল। পাকা দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে এক ভদ্রলোককে সান্ত্বনা দিচ্ছিল সে, ‘অল্পবয়সী স্ত্রী চলে গেছে বলে শোক করছেন। কেউ গেলে তো কষ্ট হবেই। কিন্তু ভেবে দেখুন উনি আপনার পঞ্চাশ পঞ্চান্ন বছরে চলে গেলেন! তখন তো আরও খারাপ হত। তাই না? একটা সিগারেট দিন।’
ভদ্রলোকের অসাড় হাত থেকে প্যাকেটটা নিয়ে মুখ তুলতেই লোকটা অর্ককে দেখতে পেল। অর্কর খেয়াল হল লোকটা বলেছিল এই হাসপাতালের যা কিছু মুশকিল ও আসান করে দিতে পারে, একমাত্র মৃতকে জীবিত করা ছাড়া। মায়ের জন্যে যে রক্ত দরকার সেটাও কি ও সংগ্রহ করে দিতে পারবে? যেখানে বড় ডাক্তারের প্রভাব কোন কাজে লাগছে না সেখানে এ কি করবে?
লোকটি সিগারেট ধরিয়ে এগিয়ে এল, ‘কেমন আছে তোমার মা?’
‘ভাল নয়। অপারেশন হবে।’
‘কোন মুশকিল আছে?’
অর্ক মাথা নাড়ল, ‘হ্যাঁ, মায়ের জন্য রক্ত দরকার। কিন্তু মায়ের গ্রুপের রক্ত পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ সময় বেশি নেই।’
‘পাওয়া যাচ্ছে না বলে কোন কথা নেই। সবই পাওয়া যায়। কেসটা কি আমাকে নিতে হবে?’ লোকটা সিগারেটে জোরে জোরে টান দিতে লাগল।
‘আপনি পারবেন?’ অবিশ্বাসী চোখে তাকাল অর্ক।
‘বলেছি তো শুধু প্রাণ ফিরিয়ে দিতে পারি না।’ লোকটা হাসল, ‘তবে যত রেয়ার গ্রুপ হবে তত দাম বাড়বে। এটা ভাই বাজারের নিয়ম।’
‘আপনি আমার সঙ্গে একবার পরমহংস কাকুর কাছে চলুন।’
‘কেন?’
‘আমার কাছে বেশী টাকা নেই।’
‘কোথায় থাকা হয়?’
‘তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুর লেন।’
‘তাই? সেখানে তো জোর গোলমাল চলছে। মাস্তানদের প্যাঁদাচ্ছে।’
‘মাস্তানরাও মারছে।’ অর্ক জামার বোতাম খুলে ব্যাণ্ডেজ দেখাল।
‘আরে বাব্বা! তুমিই নাকি?’
‘আমিই নাকি মানে?’
‘শুনলাম কয়লার চেলা একটা ছেলেকে ছুরি মেরেছিল বলে পাবলিক তাদের শুইয়ে দিয়েছে। তোমাকে ছুরি মেরেছিল?’ লোকটার চোখে বিস্ময়।
‘হ্যাঁ, তবে বেশি লাগেনি। হাসপাতাল থেকেও তাই বলল।’
লোকটা যেন খুব বিমর্ষ হয়ে গেল। তারপর এক ঝটকা দিয়ে দ্বিধাটা কাটিয়ে উঠল। বিড় বিড় করে কিছু একটা হিসেব করে নিয়ে বলল, ‘ওপারের জন্যে খানিকটা মাল জমা করে নিই। তোমার কাছে আর নাফা করব না। কি গ্রুপের ব্লাড লাগবে বল?’
যে জিনিস সমস্ত শহর ঘুরেও পাওয়া যাচ্ছিল না সেটা পেতে মাত্র ঘণ্টাখানেক সময় লাগল। মুশকিল-আসানের সন্ধানে বেশ কিছু মানুষ আছে। তাদের এক একজনের রক্তের শ্রেণী আলাদা। হাসপাতালের যে রেট তার থেকে বেশি এদের দিতে হয়। একমাত্র মুশকিল-আসান খবর দিলেই এরা আসে রক্ত দিতে। ব্যাঙ্কে জমা পড়লে সেটা যাতে নির্দিষ্ট পেশেন্ট পায় সেই ব্যবস্থা মুশকিল-আসান করে দেয়। কিন্তু তার বদলে পেশেন্টকে সমপরিমাণ রক্ত দিতে হয়। এসব ব্যাপার করতে একটুও সময় লাগল না।
বিলু এবং কোয়া অর্কর সঙ্গে হাসপাতালে এসেছিল। পাড়ার মধ্যে দিয়ে ওদের বের করে আনার ঝুঁকি ছিল। যে পথে ওরা তিন নম্বরে ঢুকেছিল সেই পথ এর মধ্যে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অর্ক যখন বড় রাস্তা দিয়ে ওদের সঙ্গে নিয়ে এসে ট্রাম ধরল তখন অনেকের চোখে বিস্ময় ছিল। কিন্তু শুধু অর্কর জন্যে কেউ মুখে কিছু বলেনি। বিকল্প রক্ত দেওয়ার যখন প্রয়োজন হল তখন বিলু এবং কোয়া এগিয়ে এল। অর্ক ভেবেছিল ওদের নিষেধ করবে। কিন্তু ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে পারল না। যেন খুব পবিত্র কাজ করছে এরকম মুখের ভাব ছিল ওদের মুখে।
অপারেশন শেষ করতে দশটা বেজে গেল। পরমহংস এবং সৌদামিনী তখনও বসে। স্কুলের টিচাররা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে ফিরে গেছেন। নীপা মিত্র বলেছেন ভোরে আবার আসবেন। বলেছেন, ‘আমি দক্ষিণেশ্বরে মানত করেছি, কোনও ভয় নেই, ঠিক ভাল হয়ে যাবে।’
অর্কর দমবন্ধ হয়ে আসছিল। এই হাসপাতালে জীবন আর মৃত্যু এত কাছাকাছি বাস করে যে কোন আশা খুব জোর দিয়ে করা যায় না। তার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছিল অথচ কপালে ঘাম জমছিল। এবং হঠাৎই অর্কর মনে হল মা আর বাঁচবে না। এই হাসপাতাল থেকে মা আর ফিরে যাবে না। কথাটা ভাবা মাত্র ওর শরীরে প্রবল কাঁপুনি এল। অর্ক চেষ্টা করেও নিজেকে সুস্থির রাখতে পারছিল না।
বিলু আর কোয়া তার পাশে বসে ছিল। কাঁধে হাতের স্পর্শ পাওয়ায় অর্ক মুখ তুলতেই দেখল বিলুকে, ‘কি হয়েছে?’
অর্ক মাথা নাড়ল, ‘কিছু না।’
আর কি আশ্চর্য, কিছু না বলামাত্র তার শরীরটা স্থির হয়ে গেল। কিছু না ভাবলে কোন কিছুই গুরুত্বপূর্ণ হয় না। যে কোন সমস্যাকেই কিছু না বলে ধার কমিয়ে দেওয়া যায়।
দশটা নাগাদ খবরটা পাওয়া গেল। অপারেশন হয়ে গেছে। মাধবীলতার অবস্থা বাহাত্তর ঘণ্টা না কাটলে বলা যাবে না। এখন সে অচেতন। ডক্টর দত্তগুপ্ত সৌদামিনীকে বললেন, ‘প্রচণ্ড সহ্য শক্তি মহিলার। ওঁর যা কেস তাতে বেঁচে ফেরার চান্স থার্টি পার্সেন্ট। কিন্তু, আশা করছি এ যাত্রায় বেঁচে যাবেন। আপনাদের তো এখন কিছু করার নেই। থেকে আর কি করবেন।’
সৌদামিনী অর্কর দিকে এক পলক দেখে নিয়ে বললেন, ‘একবার দেখে আসতে পারি ওকে?’
‘মাথা খারাপ। এখন উনি ইনটেনসিভ কেয়ারে আছেন। প্রার্থনা করুন, ওঁর জন্যে প্রার্থনা করুন। আর কিছু বলার নেই।’
পরমহংস সৌদামিনীকে একটা ট্যাক্সিতে পৌঁছে দেবে ঠিক হল। রাত এগারটা নাগাদ অর্ক বেরিয়ে এল হাসপাতাল থেকে। কোয়া এবং বিলু তার সঙ্গ ছাড়েনি। আলোয় লেখা গেটের নিচে দাঁড়িয়ে অর্ক আবার হাসপাতালটার দিকে তাকাল। ওরই একটা ঘরে মা অজ্ঞান হয়ে শুয়ে রয়েছে। এই মুহূর্তে পৃথিবীর কোন সমস্যা কারো অস্তিত্ব ওঁর অনুভবে নেই। এমন দুশ্চিন্তামুক্ত অবস্থায় মা বোধহয় অনেককাল থাকেনি।
কোয়া বলল, ‘গুরু, খাবে না?’
অর্ক মাথা নাড়ল, ‘নাঃ। আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।’
বিলু বলল, ‘তুই মাইরি হেভি গিলে খেয়ে গেছ। ডাক্তার তো বলল কোন ভয় নেই। দরকার হলে আবার রক্ত দেব আমরা।’
অর্ক ওর মুখের দিকে তাকাল, ‘শুধু রক্ত দিয়ে কি কাউকে বাঁচানো যায়?’
‘তাহলে? মানে আমরা তো আর কিছুই করতে পারি না।’
‘ঠিক। আমাদের কিছুই করার নেই। চল।’
বিলু কোয়ার দিকে তাকাল। তারপর নিচু গলায় বলল, ‘আমরা যাব না।’
‘কেন?’
‘আমাদের আজকে পাড়ায় থাকা ঠিক হবে না। তুমি গিয়ে কথাবার্তা বল, তারপর।’
অর্ক বিলুর ইতস্তত করার কারণ বুঝতে পারল না। সে মাথা নেড়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোরা আর কোথায় যাবি?’
কোয়া বলল, ‘দেখি কোন শ্মশানে গিয়ে শুয়ে পড়ব।’
‘শ্মশানে?’
‘হ্যাঁ। ফাস্টকেলাস জায়গা। কেউ কোন পাত্তা নেবে না। আমরা কাল সকালে হাসপাতালে আসব।’
অর্ক আর কথা বাড়াল না! একটা ট্রাম গুমটিতে ঢুকবে বলে আসছিল। সেটায় সে চড়ে বসল। ওঠার সময় আঘাতটার কথা খেয়াল ছিল না অর্কর, সামান্য চাড় লাগতেই টনটন করে উঠল সেটা। অর্ক চোখ বন্ধ করল। তার মনে হচ্ছিল নিশ্চয়ই ক্ষতের মুখ থেকে রক্ত বেরিয়েছে।
গলির মুখে তিনচারজন লোক দাঁড়িয়ে। তাদের হাতে লাঠি। অর্ক সন্দিগ্ধ চোখে সেদিকে তাকাতেই লোকগুলো হেসে ফেলল, ‘আরে আমরা! আজ থেকে নাইট গার্ড পার্টি কাজ শুরু করেছে। ওই যে পুলিস ভ্যানও দাঁড়িয়ে আছে।’
অর্ক এবার দেখতে পেল। গলির উল্টোদিকের অন্ধকারে একটা ভ্যান রয়েছে। কয়েকজন পুলিস তার পাশে অলস ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে!
তিন নম্বরের সামনে এসে অর্ক দেখল সমস্ত দোকানপাট বন্ধ। শুধু নির্মল ড্রাইভার শিবমন্দিরের রকে বসে বিড়ি খাচ্ছিল। ওকে দেখেই উঠে এল নির্মল, ‘মা কেমন আছে?’
‘অপারেশন হয়েছে। এখনও জ্ঞান ফেরেনি।’
‘তাহলে ভাল হয়ে যাবে। সাধারণত অপারেশন টেবিলেই যা হবার হয়। শুনলাম ওরা নাকি তোমাকে ঝেড়েছে?’
‘এমন কিছু নয়।’
‘এবার শালাদের পাড়া থেকে হঠাতে হবে। পুরো পাবলিক জেগে গেছে। চল, ওরা সবাই অপেক্ষা করছে।’
‘কারা?’
‘সুবল, সতীশ, নিরঞ্জন।’
তৃতীয় নামটা শুনে অবাক হলেও ভাল লাগল অর্কর। নিরঞ্জন কংগ্রেস করে। তবে নুকু ঘোষের মত পুরনো কংগ্রেসী নয়। নিরঞ্জন এবং সতীশদা একই সঙ্গে বসেছে এটাই অভিনব ব্যাপার। যদিও নিরঞ্জনদের অস্তিত্ব এ পাড়ায় নেই বললেই চলে তবে গত নির্বাচনে ওরাই তো বেশী ভোট পেয়েছে।
নির্মলের সঙ্গে অর্ক হেঁটে এল কপোরেশন স্কুল বাড়িতে। সেখানেই শান্তি কমিটির অফিস হয়েছে। ওকে দেখা মাত্র সুবল জিজ্ঞাসা করল, ‘মা কেমন আছেন?’
অর্ককে একই জবাব দিতে হল। ঘরে তখন ছয়সাতজন মানুষ। এত রাত্রেও এই এলাকার কয়েকজন বিশেষ ভদ্রলোককে দেখে অবাক হল অর্ক। এঁরা সাধারণত সাতে পাঁচে থাকেন না। নিজের নিজের স্বার্থ নিয়ে গা বাঁচিয়ে চলেন। অনেকক্ষণ ধরে অর্ককে ওরা সমস্ত ঘটনা বিশদভাবে জানাল। এলাকার তরুণদের সংগঠিত করার দায়িত্ব অর্কর ওপর। কোনরকম রাজনৈতিক মতামত ছাড়াই সবাই এলাকার শান্তি বজায় রাখার জন্যে কাজ করবে। এই জন্যে এলাকার সম্মানীয় মানুষদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সুবল এবং অর্ক তার যুগ্ম সম্পাদক। সুবল বলল, ‘আমরা আমাদের এলাকা থেকে যে কোন রকমের সমাজবিরোধীদের সরিয়ে দিতে চাই। এ ব্যাপারে আমরা কোন নরমনীতি গ্রহণ করব না। সাধারণ মানুষ একবার যার দ্বারা অত্যাচারিত হয়েছে তাকেই পুলিসের হাতে তুলে দিতে হবে। অবশ্য আমরা সক্রিয় হবার পর এই সব সমাজবিরোধীরা পাড়া ছেড়ে পালিয়েছে। এদের আর পাড়ার ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হবে না যতক্ষণ তারা আইনের কাছে মাথা না নোয়াচ্ছে। আমরা একটা লিস্ট করেছি। তুমি দেখতে পারো।’
অর্ক লিস্টটা হাতে নিল। এই মুহূর্তে তার নিজের বয়স অভিজ্ঞতার কথা একটুও খেয়ালে আসছে না। নিজেকে যেন আচমকা খুব দায়িত্ববান বলে মনে হচ্ছে। এই মানুষগুলো তাকে যে গুরুত্ব দিচ্ছে সে যেন তার মর্যাদা রাখতে পূর্ণ সক্ষম। লিস্টে চোখ বোলাতে বোলাতে সে কোয়ার নাম দেখতে পেল। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, এলাকায় ছুরি দেখিয়ে চাঁদা তোলা, অকারণে মানুষকে হুমকি দেওয়া, মদ্যপান করে এলাকার শান্তিভঙ্গ করে অশ্লীল শব্দ বলা ইত্যাদি ইত্যাদি। যেসব দোকানদার কোয়ার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের নামও পাশে রয়েছে। মোট সমাজবিরোধীর সংখ্যা একশ ছত্রিশ জন। এবং এই লিস্টে বিলুর নাম নেই।
অর্ক এক মুহূর্ত চিন্তা করে সতীশদার দিকে তাকাল, ‘আমরা যদি সত্যি এই তালিকাটাকে গুরুত্ব দিতে চাই তাহলে আর একটা নাম লেখা উচিত।’
‘কার নাম?’ সুবল জিজ্ঞাসা করল।
‘বিলু।’
সতীশ চোখ বন্ধ করে ভাবল, ‘বিলু, বিলু তো তোমার বন্ধু।’
‘হ্যাঁ, আমি জানতাম না ও কয়লার হয়ে কাজ করছে। গতকাল যে হামলা হয় তার জন্যে বিলু কিছুটা দায়ী। কয়লার ধারণা ও বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল।’
‘তুমি এসব জানলে কি করে?’
‘বিলুরা দুপুরে আমার কাছে এসেছিল।’
সঙ্গে সঙ্গে ঘরে বসা একজন বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, সে কথা আমরা শুনেছি। আপনি ওদের পাড়া থেকে বের করে নিয়ে গেছেন। এটা অত্যন্ত অন্যায় ব্যাপার। যারা সমাজবিরোধী বলে পরিচিত তাদেরই যদি আমরা আশ্রয় দিই তাহলে এই ধরনের আন্দোলনের কোন যৌক্তিকতা থাকে না।’
অর্ক মাথা নাড়ল। ‘তখন আমি ঠিক কি করা উচিত ভেবে উঠতে পারছিলাম না। তাছাড়া আমি মনে করি বিলু সাধারণ মানুষের ক্ষতি করতে পারে না। সংসার চালাবার জন্যে লোভে পড়ে ও স্মাগলিং-এর ব্যবসায় ঢুকেছিল।’
সতীশদা বললেন, ‘তাহলে ওর নাম লিস্টে তুললে কেন?’
‘কারণ ও কয়লার সঙ্গে কাজ করেছে। তবে থানা থেকে ঘুরে এলে ওর বিরুদ্ধে যেন শান্তিকমিটি কোন অ্যাকশন না নেয়।’
সুবল বলল, ‘না, আমার মনে হয় কারো বিরুদ্ধে আমরা জেদ ধরে থাকব না। এই কারো বলতে আমি সেইসব মাস্তানদের বোঝাচ্ছি যারা খুবই সাধারণ স্তরের। তবে এদের একবার থানা থেকে ঘুরে আসা উচিত। কিন্তু কয়লা এবং তার প্রধান সঙ্গীদের আমরা কিছুতেই ছেড়ে কথা বলব না।’
মোটামুটি সিদ্ধান্ত সেইরকম হল। আজ সন্ধ্যায় শান্তি কমিটির নেতৃত্বে এই এলাকার চোলাই মদের আড্ডাগুলো তুলে দেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপার যে কটি আড্ডা ছিল তার সবগুলোই পরিচালনা করত ঘরের মেয়েরা। পরিবারের ছেলেরা কোন রোজগার করে না, মেয়েরা মদ বোতলে করে বিক্রি করে। সন্ধ্যের পর তাদের ঘরের সামনেই আসর বসে যায়। এই মেয়েগুলো শরীরের ব্যাপারে যথেষ্ট আত্মমর্যাদাসম্পন্ন। এদের পরিবারের ছেলেদের বলা হয়েছে আবার মদ বিক্রি করলে পাড়া ছেড়ে চলে যেতে হবে।
সুবল বলল, ‘মুশকিল হল পুলিসকে নিয়ে। কয়লার লোকদের উৎখাতের পর পুলিস সম্পর্কে আমরা নানান অভিযোগ পাচ্ছি। আজ সারাদিন ধরে এলাকার নিপীড়িত মানুষেরা এসে সেসব আমাদের দিয়ে গেছেন। এই এলাকা যে দুটো থানার মধ্যে পড়ে তার অফিসার এবং লালবাজারের একজন বড় অফিসারের প্রশ্রয় ছাড়া এই সমাজবিরোধী কাজকর্ম চলতে পারত না। আজকে অবশ্য পুলিস বলছে তারা আমাদের সাহায্য করবে। কিন্তু একই পুলিস ওদের সাহায্য করে আমাদের পাশে দাঁড়াবে এটা বিশ্বাস করা শক্ত। কারণ ওরা তো আমাদের কাছ থেকে কোন টাকা পাচ্ছে না। নিজেদের নির্ভরযোগ্য রোজগার বন্ধ হয়ে যাক সেটা ওদের কিছুতেই কাম্য হতে পারে না।’
নিরঞ্জন এতক্ষণ চুপচাপ বসে ছিল। এবার বলল, ‘কথাটা ঠিক কিন্তু বিশ্বাস করা ছাড়া আমাদের আর কি উপায় আছে। যেমন আজ দুটো থানায় বলা হয়েছে সমাজবিরোধীরা আশেপাশের পাড়ায় আশ্রয় নিয়েছে। পুলিস যদি তল্লাশি করে তাদের খুঁজে পাবে। কিন্তু থানা দুটো থেকে কোন অ্যাকশন নেওয়া হয়নি।’
আর একজন বলল, ‘শুনেছি শ্যামবাজারের মোড়ের কাছে ওরা অপেক্ষা করেছে। এই এলাকার লোকজন দেখলেই মারবে।’
সতীশদা বলল, ‘দেখুন, ভয় পেলে ওরা পেয়ে বসবে। কিন্তু আমরা যদি এক থাকি, ওদের কেয়ার না করি, পাড়ায় ঢুকতে না দিই তাহলে উল্টে ওরাই ভয় পাবে। কিন্তু আমার কাছে খবর আছে কয়লাকে কংগ্রেসকর্মী হিসেবে দাবি করে কংগ্রেসের নেতারা থানায় গিয়েছিলেন।’
সঙ্গে সঙ্গে নিরঞ্জন বলল, ‘বাজে কথা। নুকু ঘোষ সেই লাইনে চেষ্টা করেছিলেন। সমাজবিরোধীদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই এমন রাজনৈতিক পার্টি অন্তত ভারতবর্ষে নেই। কয়লা নিজের স্বার্থে আমাদের হয়ে যদি একসময় কাজ করে থাকে তাহলে সেই কাজটায় কোন অন্যায় ছিল না। কিন্তু তাই বলে আমরা এখন কয়লাকে পলিটিক্যাল শেল্টার কিছুতেই দিতে পারি না।’
সতীশদা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনাদের নেতা থানায় যাননি?’
‘যদি গিয়ে থাকেন অন্যায় করেছেন। তিনি নিজের দায়িত্বে গিয়েছেন দল তাঁকে পাঠায়নি। আমরা এটাকে সমর্থন করছি না। এই যে আমি শান্তি কমিটিতে আছি সেটাই তার প্রমাণ নয় কি?’ নিরঞ্জন স্পষ্ট গলায় বলল।
সতীশদা বললেন, ‘এই কথাটা মনে রাখতে হবে। আমরা কোনরকম রাজনৈতিক মতামত ছাড়াই শান্তিকমিটি তৈরি করেছি। আমাদের কার্যকলাপে যেন সেই ধারা বজায় থাকে। আমরা যদি এলাকার মঙ্গল চাই তাহলে এই ঐক্য বজায় রাখতেই হবে।’
সুবল বলল, ‘কিন্তু আমাদের পরবর্তী কার্যকলাপ ঠিক করতে হবে। আমার মনে হয় পুলিস কমিশনারকে অনুরোধ করা উচিত যাতে তিনি এখানে আসেন। এখানে আমরা যতটা না ক্ষতিগ্রস্ত কয়লার এলাকায় মানুষকে তার থেকে অনেক বেশি মূল্য দিতে হয়েছে। শুধু ঈশ্বরপুকুর নয় এই পুরো এলাকা জুড়ে শান্তি কমিটি কাজ করবে।
অর্ক আলোচনা শুনছিল। এর অনেকটা সে টুকরো টুকরো ভাবে আগে শুনেছে। একটা লোক কিভাবে শক্তি প্রয়োগ করে একটা অঞ্চলকে ক্রীতদাস করে রেখেছিল এবং তার ইচ্ছায় সব কিছু নিয়ন্ত্রিত হত তা শুনলে মাথা ঠাণ্ডা রাখা যায় না।
রাত বাড়ছিল। অর্ক উঠে পড়ল। তার কাঁধের ব্যথা শুরু হয়েছে। মুখে তেতো স্বাদ। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে এখন। সুবল বলল, ‘আমরা এখনই তোমাকে সক্রিয় হতে বলছি না। তোমার মা সুস্থ হয়ে উঠুন।’
অর্ক মাথা নাড়ল তারপর নির্মলের সঙ্গে বেরিয়ে এল। নির্মল বলল, ‘শালাকে সেদিনই খতম করা যেত যদি ওই পুলিস অফিসারটা না বাঁচাত।’
অর্ক নিচু গলায় বলল, ‘কিন্তু কথা হল আমরা এতদিন কি করছিলাম! আমাদের দাদারা এত অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করছিল কেন?’
‘মাল্লু। মাল্লুর লোভে সব শালা চুপ করে ছিল। এখন পাবলিক খেপেছে বলে সব্বাইকে বেরিয়ে আসতে হয়েছে। কিন্তু কয়লা যখন ছাড়া পাবে তখন কি হবে তাই ভাবছি। শালা তো বদলা নেবেই। আর উত্তেজনা কমে গেলে পাবলিক ভেড়ুয়া হয়ে যায়। তদ্দিনে শান্তিকমিটি থাকলে হয়।’ নির্মল চিন্তিত হল।
‘আগেই খারাপটা ভাবছেন কেন? কয়লাকে আমরা এই এলাকায় ঢুকতে দেব না। মানুষ যদি আবার ভুল করে তাহলে তাদেরই ঠকতে হবে।’
রাস্তা ফাঁকা। মাঝে মাঝে শান্তিকমিটির সদস্যদের লাঠির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। হঠাৎ অর্ক সচকিত হল। জড়ানো গলায় চিৎকার ভেসে আসছে সামনে থেকে। ওরা তখন তিন নম্বরের সামনে এসে পড়েছিল। সেই মাতালটি আসছে। টলতে টলতে কোনরকমে শরীরটা নিয়ে চলে আসছে তিন নম্বরে। অর্ক দেখল ওর বউ ঠিক একই ভঙ্গীতে বস্তির গলিতে দাঁড়িয়ে আছে স্বামীর অপেক্ষায়।
এরকম একটা দিনেও লোকটা মদ খেয়ে ফিরতে পারল? অর্ক অবাক হয়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল বেধড়ক পিটিয়ে লোকটাকে জ্ঞানে ফিরিয়ে আনার দরকার। কিন্তু তার আগেই ঘটনাটা ঘটে গেল। লোকটির বউ অর্ককে দেখে ছুটে এল। দুহাত জড়ো করে বলল, ‘তোমার পায়ে পড়ি ওকে কিছু বলো না। আমরা আজ সারাদিন খাইনি। আর পাচ্ছি না।’
বলতে বলতে বউটা কেঁদে ফেলল। অর্ক নির্মলের দিকে তাকাল। এবং ঝপ করে ওর সমস্ত উত্তেজনা থিতিয়ে গিয়ে অদ্ভুত ক্লান্তি ফিরে এল। নির্মলের কাছ থেকে ইশারায় বিদায় নিয়ে অর্ক গলিতে ঢুকে পড়ল।
আর একটা রাত অভুক্ত কাটল অর্কর। অভুক্ত এবং নির্ঘুম।
ওর কানে একটা কথাই বারংবার বাজছিল, আমরা আজ সারাদিন খাইনি। ঘুম আসছিল না তার। একটা কথা হঠাৎ তার মাথার মধ্যে চলকে উঠল। কয়লাদের পাড়া থেকে মেরে তাড়ানো হয়েছে শান্তির জন্যে। শুধু শান্তিতে কি হবে যদি মানুষ অভুক্ত থাকে?
এই যে বউটা আর তার বাচ্চাগুলো না খেয়ে আছে তার জন্যে দায়ী কে? ওই মাতালটা? তাহলে মাতালটাও সমাজবিরোধী। আবার মাতালটির যে যুক্তি তাতে আর একজনকে সমাজবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। বাইরের সমাজবিরোধীদের চোখে পড়ে, ভেতরের সমাজবিরোধীরা তো আরও মারাত্মক, কিন্তু তাদের কথা কেউ ভাবে না কেন?