ত্রিপঞ্চাশ অধ্যায় – মণ্ডল-নিৰ্মাণাদি
ভগবান্ কহিলেন, তাহার পর ‘নমঃ’ এই মন্ত্রোচ্চারণপূর্বক অর্ঘ্যপাত্র রাখিবার নিমিত্ত পথ ও দ্বার-শূন্য একটী চতুষ্কোণ মণ্ডল নিৰ্মাণ করিয়া ‘ওঁ হ্রীং শ্রীং’ এই মন্ত্রদ্বারা স্বীয় আসন পূজা করিবে। ১
তৎপরে ‘ওঁ ঐঁ হ্ৰীঁ শ্ৰীঁ’ এই মন্ত্রদ্বারা অর্ঘ্য পাত্রটি পূৰ্বনির্মিত মণ্ডলে স্থাপিত করিয়া প্রথম সেই অর্ঘ্য পাত্রটি অর্চন করিবে। ২
পরে এই অপাত্রে ‘ঐ হ্রীঁ হ্রৌঁ’ এই মন্ত্র বলিয়া গন্ধ পুষ্প-জল নিক্ষেপ করিবে, তাহাতে আবার একটি মণ্ডল রচনা করিবে। ৩
এই অর্ঘ্যপাত্ৰ পূর্ববৎ একটী মণ্ডল রচনা করিয়া পাত্ৰটীকে ত্ৰিভাগ জলের দ্বারা পূরণ করিবে; তৎপরে ঐ অর্ঘ্যপাত্রস্থ জলে একটি পুষ্প নিক্ষেপ করিবে। ৪
তাহার পর ‘হ্রীং’ এই মন্ত্রদ্বারা স্বীয় আসন পূজা করিবে। ইহার পর সাধক, ‘ক্ষৌঁ’ এই মন্ত্রদ্বার আত্মাকে পূজা করিয়া গন্ধ পুষ্পদ্বারা আপনার শিরোদেশ অর্চনা করিবে। ৫-৬
অতঃপরঃ ‘ওঁ হ্রীং সঃ’ এই মন্ত্রদ্বারা হস্ততলস্থিত পুষ্পটীকে দক্ষিণ হস্তদ্বারা পূজা করিয়া আবার তাহা বাম হস্তের দ্বারা ঘ্রাণ লইয়া সেই পুষ্পটী পূর্ব মন্ত্র দ্বারা ঈশান কোণে নিক্ষেপ করিবে। ৭
দুই হস্তদ্বারা রক্তপুষ্প গ্রহণ করিয়া পাণিতল কচ্ছপাকৃতি করিবে, ইহার পর দহন ও প্লাবনাদি কৰ্ম্ম কর্তব্য। ৮
(কচ্ছপাকার হস্ত করিবার প্রণালী) বামহস্তের তর্জনীর সহিত দক্ষিণ হস্তের কনিষ্ঠের যোগ হইবে এবং দক্ষিণ হস্তের তর্জনীর সহিত বামাঙ্গুষ্ঠের যোগ হইবে। ৯
দক্ষিণহস্তের অঙ্গুষ্ঠ উন্নত থাকিবে, বামহস্তে মধ্যমাদি অঙ্গুলী দক্ষিণ হস্তের ক্রোড়ে (ক) যোগ করিবে এবং বামহস্তের তৃতীয় অঙ্গুলীর সহিত দক্ষিণ হস্তের মধ্যম ও অনামিকা নামক দুইটি অঙ্গুলীকে অধোমুখ করিয়া যোগ করিবে। তাহার পর দক্ষিণ হস্তের পৃষ্ঠটী কূৰ্ম্মপৃষ্ঠের ন্যায় করিবে। ১০-১২
পাণিতল এইরূপ কচ্ছপাকারে বদ্ধ হইলে সকল সিদ্ধি প্রদান করে; এবং নয়নদ্বয় মুদ্রিত করিয়া ঈশ্বরকে হৃদয়গত করিবে। ১৩
সাধক ধ্যানকালে শরীর, মস্তক ও গ্রীবাদেশ সমান রাখিয়া সুস্থিরচিত্তে দাহন প্লাবনান্তে দেবীর ধ্যানে নিযুক্ত হইবে। বায়ুতে অগ্নি, জলে বায়ু, হৃদয়ে জল, নিক্ষিপ্ত করিয়া তখন স্বয়ং হৃদয়কে নিশ্চল করিয়া উহা আকাশে নিক্ষেপ করিবে। “ওঁ হূঁ ফট্” এই মন্ত্রদ্বারা মস্তকের ব্রহ্মরন্ধ্র ভেদ করিয়া পরে শব্দের সহিত জীবকে আকাশে স্থাপন করিবে। ১৪-১৬
চন্দ্রবিন্দুর সহিত বায়ু, অগ্নি, যম, শত্রু ও বরুণের বীজের দ্বারা চিত্তশুদ্ধির নিমিত্ত যথাক্রমে শোষণ, পূরণ, অমৃতসিঞ্চন ইত্যাদি কর্ম সকল কর্তব্য। ১৭-১৮
তাহার পর দেবীবীজের দ্বারা সুবর্ণাকার ব্রহ্মাণ্ডকে ঐং হ্রীং শ্রীং এইমন্ত্র দ্বারা দ্বিধা বিভক্ত করিবে। ১৯
ঐ অণ্ডের উৰ্দ্ধভাগের দ্বারা আকাশ ও স্বর্গ মনের দ্বারা সৃষ্ট করিয়া অপর শেষ ভাগের দ্বারা পৃথিবী ও পাতাল সৃষ্টি করিতে হইবে। ২০
ইহাতে অন্যান্য বস্তু ও সপ্তদ্বীপা পৃথিবী চিন্তা করিবে। এই সপ্তদ্বীপ পৃথিবীতে আবার ইক্ষুসাগরের মধ্যস্থিত স্বর্ণদ্বীপ চিন্তা করিবে। ২১-২২
সেই স্বর্ণদ্বীপের মধ্যে আবার সৰ্ব্বদা মন্দাকিনীজলে ক্ষালিত রত্নমণ্ডপস্থিত সুন্দর রত্নপৰ্য্যঙ্ক বিরাজ করিতেছে। ২৩
এই রত্নপৰ্যঙ্কে একটি প্রফুল্ল কাঞ্চন পদ্ম সৰ্ব্বদা রহিয়াছে এবং ইহার স্বর্ণমালাকৃতি মৃণাল সপ্তপাতালগামী এবং পদ্মটী পৃথিবী হইতে ব্রহ্মলোক পর্যন্ত স্পর্শ করিতেছে। ২৪
ইহার কেশরের বর্ণ কাঞ্চন-বর্ণ-সদৃশ;–এইরূপ চিন্তা করিতে হইবে। এই কাঞ্চন-পদ্ম-স্থিত মহামায়াকে একাগ্রচিত্তে ধ্যান করিতে হইবে। ২৫
শোণ পুষ্পের ন্যায় রক্তবর্ণ কেশপাশ পৃষ্ঠে দোদুল্যমান; কর্ণদ্বয়ে রত্নখচিত চঞ্চল কাঞ্চনময় কুণ্ডল শোভা পাইতেছে। ২৬
মস্তকে রত্নখচিত হিরন্ময় কিরীট রহিয়াছে; তিনি শুক্ল-কৃষ্ণ-রক্তবর্ণ মিশ্রিত তিনটি নেত্ৰ-দ্বারা অতিশয় মনোজ্ঞা হইয়াছেন। ২৭
তাহার কপোলদ্বয় নবশশধর-সদৃশ; নয়ন চঞ্চল ও বিশাল; দন্তপংক্তি পরিপুষ্ট দাড়িমীবীজ-সদৃশ; ভ্রূযুগল পরম সুন্দর। ২৮
পরিধেয় বসনখানির বর্ণ বন্ধুকপুষ্পের ন্যায়; নাসিকা শিরীষপুষ্প সদৃশ। গ্রীবাদেশ শঙ্খ-সদৃশ, প্রভা সূৰ্য্য-কোটি-সদৃশ, তিনি চতুর্ভজা সুবসনা পীনোন্নত-পয়োধরা। ২৯-৩০
তাহার দক্ষিণ দিকের ঊৰ্ধ হস্তে খড়্গ, নিম্ন হস্তে সিদ্ধসূত্ৰক। বাম হস্তের দ্বারা অভয় বরপ্রদায়িনী। তাহার গম্ভীর নাভি ও মধ্যদেশ যথাক্রমে ক্ষীণ হইয়া আসিয়াছে। ৩১
তিনি মনোহরা অতিশয় নম্র-স্বভাব; তাহার ঊরুদ্বয় হস্তিশুণ্ড-সদৃশ, গুলফদ্বয় অতি নিম্ন, পাষ্ণিভাগ অতি সুন্দর; তিনি নিবিড় বদ্ধ পৰ্য্যঙ্কাসনে বসিয়া গাত্রদ্বারা একটি রত্নস্তম্ভ অবলম্বন করিয়া আছেন; “তুমি কি অভিলাষ কর?” এইরূপ বাক্য যেন সকলকে বার বার বলিতেছেন, সম্মুখস্থিত নিজ বাহন সিংহীকে দেখিতেছেন। ৩২-৩৩
তিনি মুক্তামালা স্বর্ণ ও রত্নহার এবং কঙ্কণাদি হস্তভূষণ ও অন্যান্য যাবতীয় অলঙ্কারের দ্বারা সমুজ্জ্বল, মুখখানি হাস্য যুক্ত, তিনি সূৰ্য্য-কোটি-সদৃশ সমুজ্জ্বল, সৰ্ব্ব-লক্ষণাক্রান্ত নবযৌবনসম্পন্ন সৰ্বাঙ্গসুন্দরী। অম্বিকার এইরূপ ধ্যান করিয়া ও “নমঃ ফট্” এই মন্ত্র দ্বারা কূৰ্ম্মমুদ্রিত হস্তস্থিত পুষ্পটী মস্তকে দিয়া দেবীর সহিত আপনাকে অভিন্ন চিন্তা করিবে। ৩৪-৩৬
অনন্তর, যথাক্রমে অঙ্গন্যাস ও করন্যাস করিবে। প্রধান-মূলে আকার প্রভৃতি দীর্ঘ স্বর ও বিন্দু যোজনা করিয়া তদন্তে “নমঃ” “স্বাহা” ইত্যাদি অঙ্গ মন্ত্র যথাযথ উচ্চারণ-পূর্বক অঙ্গ প্রণব দিয়া “ওঁ আং নমঃ” “ওঁ ঈং শিরসে স্বাহা” ইত্যাদি মন্ত্র দ্বারা, যথাক্রমে উক্ত ন্যাসদ্বয় কর্তব্য। এই সমস্ত মন্ত্র রক্ত বর্ণ এবং মনোহর। ৩৭-৩৮
পঞ্চ অঙ্গুলি ন্যাসের পরে অঙ্গুষ্ঠাদি কনিষ্ঠান্ত সমস্ত করতল ঘুরাইয়া করতলদ্বয়-যোগে অঙ্গুলিপ্রান্তভাগ দ্বারা “ফট” উচ্চারণপূর্বক ন্যাস করিবে। ৩৯
হৃদয়, মস্তক, শিখা, কবচ এবং নয়নয়ে পূর্বোক্ত ক্রমে অর্থাৎ ‘ওঁ আং হৃদয়ায় নমঃ’ ইত্যাদি মন্ত্র দ্বারা ন্যাস করিবে, পরে ঐরূপ করতলে ন্যাস করা কৰ্ত্তব্য। ৪০
অনন্তর, চক্ষু, পৃষ্ঠ, উদর, বাহু-যুগল, হস্ত, পদযুগল, জঙ্ঘাদ্বয় এবং জঘন দ্বয়ে যথাক্রমে মূলমন্ত্রের অন্তর্গত আটটি অক্ষর ওঙ্কার স্মরণ করত ন্যাস করিবে। ৪১
এইরূপে শরীরশুদ্ধি, ভূতাপসরণ ও মনোনিবেশ করিয়া মনুষ্যগণ, সতত পূজা করিতে অধিকারী হয়। নতুবা পূজা করিতে অধিকারী হইবে না। ৪২
ত্রিপঞ্চাশ অধ্যায় সমাপ্ত। ৫৩