৫৩
কাকা ডেকে পাঠিয়েছিল বটে, কিন্তু ভয়ের কিছু ছিল না। বিকেলের দিকে ভয়ে আধমরা বীণাপাণি যখন গিয়ে তার সামনে দাঁড়াল তখন কাকা হেসে-টেসে বলল, ভাল খবর আছে বীণা। নতুন পালার তিনটে আগাম বায়না পেয়েছি। আদাজল খেয়ে লাগতেই হবে। বাপের বাড়ি গিয়ে অনেক সময় নষ্ট করে এলে।
বুক থেকে যেন ভারী পাথর গড়িয়ে নেমে গেল। শ্বাস সহজ হল। বীণা বলল, পালা নামবে! উঃ, কতদিন পর।
কাকা বিষন্ন মুখে বলে, হ্যাঁ, এবারটা অনেকদিন ফাঁক পড়ে গেল। কত ঝামেলা হচ্ছিল! এবার আর চিন্তা নেই।
নায়িকার পার্ট নয়, তবে খুব বড় পার্টই দেওয়া হল বীণাকে। হাতে হাতে সবাইকে জেরক্স করা কাগজ বিলি করছিল কাকা। বলল, আগে নিজের নিজের পার্ট মুখস্থ করো, তারপর রিহার্সাল। সাত দিন সময় দিচ্ছি। তার মধ্যে কণ্ঠস্থ হওয়া চাই।
রাত্রিবেলা লণ্ঠনের আলোয় পালাটা পড়ল বীণা, তার একাকী ঘরে বসে। পড়তে পড়তে চোখে জল এসে গেল। এক দুঃখী মেয়েকে নিয়ে সামাজিক নাটক। কাকার নিজের লেখা। এ পালা জমে যাবে খুব।
অনেক রাত অবধি জেগে পালাটা শেষ করে লণ্ঠন কমিয়ে যখন বিছানায় শুয়ে পড়ল বীণা তখন তার বুকটা ছ্যঁৎ করে উঠল। বড্ড ফাঁকা লাগল বিছানাটা। পাশে লোকটা ছিল এতদিন। এবার থেকে কি ফাঁকাই থাকবে জায়গাটা? সারা জীবন?
থাকলে থাকবে। বীণা প্রথম প্রথম ভয় পাবে, মন খারাপ হবে। তার পর ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে। একটা নিষ্কর্মা লোকের ঘর-সংসার করে সুন্দর জীবনটা নষ্ট করবে নাকি সে? তার জায়গা তো হাজারটা লোকের চোখের সামনে, মঞ্চের ওপর। নাটক ছাড়া বাঁচবে না সে। লোকটা থেকে বরং বাধা হচ্ছিল। নানা বায়নাক্কা। মূর্তিমান বিবেক। এই-ই ভাল হয়েছে।
সারাটা রাত খানিক ঘুমে, খানিক জাগরণে, আর ভয়-ভয় একটা ভাব নিয়ে কেটে গেল বীণার। পরদিন সকাল থেকে আর নাওয়া-খাওয়ার সময় রইল না। দিন-রাত মুখস্থ করতে লাগল পার্ট। প্রায় সব সিনেই ঘুরে ফিরে সে আছে। বলতে গেলে নায়িকার চেয়েও তার পার্ট বড়। গুরুতরও বটে। ধরতাইগুলো বুঝে নিতে আগুপিছু অন্য পার্টগুলোও প্রায় ঠোঁটস্থ করে ফেলতে লাগল। তার গলায় দু’খানা গান আছে। সুর পরে বসবে। গানগুলোও সে মুখস্থ করে নিজের সুরে গুনগুন করে নিতে লাগল। নিমাইয়ের কথা বিস্মরণ হতে সাত দিনও লাগল না।
শুধু নিমাই কেন, বাবা-মা, ভাই-বোন, ডলার-পাউন্ড কিছুই আর মনে পড়ে না। কাকা ইচ্ছে করেই তার পার্টের মেয়েটার নামও রেখেছে বীণাপাণি। খুব তেজী মেয়ে। সব সময়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে তার লড়াই। নায়িকাটা একটু ছিঁচ-কাঁদুনে, আদুরি-আদুরি, ন্যাকা ধরনের পার্ট। দু’ নম্বর মেয়েটা ঠিক তার উল্টো এবং সেই নায়িকাকে প্রায় ঠেকা দিয়ে পাতে দেওয়ার যোগ্য করে। তুলেছে।
বীণা নিজে তেজী ধরনের মেয়ে নয়। বরং ভিতু আর নরম ধরনের। কিন্তু নাটকের বীণাপানির পার্ট মুখস্থ করতে করতে তার যেন তেজ-বীর্য এসে যেতে লাগল।
সাত দিন পর যখন রিহার্সাল শুরু হল তখন তার পার্ট করা দেখে কাকা অবধি বলে ফেলল, নাঃ, বীণাটার হবে। খুব ওপরে উঠবে মেয়েটা। পালা প্রায় একাই জমিয়ে দিয়েছে।
এই প্রশংসাটুকুই বীণাপাণির মেডেল। আর সে কী চায়?
তাদের পালায় প্রম্পটারের বালাই থাকে না। নিতান্তই কেউ পার্ট ভুলে গেলে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য একটা লোক থাকে। সে বাজনদারদের মধ্যে বসে থাকে ঘাপটি মেরে। কাজেই মুখস্থ রাখাই সবচেয়ে ভাল।
দিন কুড়ির মধ্যেই রানাঘাটে প্রথম পালা হবে। তার পর আরও দু’-তিন জায়গায়। জমলে বায়না আসবে হু-হু করে। কলকাতার অপেরার খাঁই বেশি। বিশ্ববিজয়ের খাঁই কম, আন্তরিকতা বেশি।
একা ঘরে কেমন লাগছে বীণার? নিমাইকে ছাড়া কেমন হচ্ছে এই থাকাটা? এসব নিজেকেই জিজ্ঞেস করে সে। কিছু খারাপ তো লাগছে না তার! একা বলেও বোধ হয় না। দিনরাত নাটকের চরিত্ররাই তার আশেপাশে ঘুরে বেড়ায় যেন, কথাও কয়। একটুও একা লাগে না তার।
তবে কেউ কেউ নিমাইয়ের খোঁজ করে। একদিন কাকাও জিজ্ঞেস করে বসল, আচ্ছা, নিমাইকে তো দেখি না আজকাল! গেল কোথায়?
গেল কোথায় সে খোঁজ বীণাপাণিও রাখে না। তবে অনুমানের ওপর বলে, পালপাড়ায়। জমিজমা দেখতে গেছে।
একা আছে নাকি? ভয়টয় নেই তো ওখানে?
একা থাকতে ভয় কি?
কাকা জবাবটায় খুশি হল না। বলল, মেয়েদের ভয় থাকেই। নিমাই কবে ফিরবে?
বললাম তো চাষবাস দেখতে গেছে। ফিরতে দেরি হবে হয়তো।
কাকা একটু ভেবে বলে, চাও তো একটি মেয়েকে তোমার কাছে রাতে রাখতে পারো। পুটুকে তো জানো! ওর বর ওকে তাড়িয়ে দিয়েছে।
পুটুকে ভালই চেনে বীণা। মাথা নেড়ে বলল, কাউকে দরকার নেই। একা আমি বেশ আছি। সারা দিন পালাটা নিয়ে ভাবি, মুখস্থ করি, একা একা রিহার্সাল করি। অন্য লোক থাকলে বকবক করবে, গল্প হবে, আমার তাতে অসুবিধেই হবে বরং।
সঙ্গে সঙ্গে কাকা বলল, তা হলে থাক।
বীণা বলল, ভয়ের কিছু নেই। চারদিকে প্রতিবেশী রয়েছে। তারা তোক ভাল।
একা থাকার ভয়টা কাটিয়ে উঠছে বীণা। একা থাকতে সে এখন মজা পাচ্ছে। সময়মতো রান্নাবান্না করতে হবে, কাচাকুচি করতে হবে, কথা শুনে চলতে হবে, মতামতের দাম দিতে হবে এমন কোনও বাধ্যবাধকতা আর নেই। কেমন অবাধ স্বাধীনতা! যা খুশি তাই করতে পারে বীণা।
রানাঘাটে যাওয়ার দিনটা যত এগিয়ে এল ততই বুকের ঢিবঢিব বাড়তে লাগল তার। একা ঘরে অতগুলো ডলার আর পাউন্ড রেখে যাওয়া কি ঠিক হবে? রাতে কাউকে শুতে রাজি করানো যাবে ঠিকই, কিন্তু সারা দিন ঘরখানা ফাঁকা পড়ে থাকবে যে!
নতুন দুশ্চিন্তাটা যুক্ত হওয়ায় একা থাকার আনন্দটা অনেকটাই মাটি হয়ে গেল তার। লুকিয়ে রাখার মতো জায়গা তো আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। সঙ্গে নিলে হয়। তবে পালা করতে গেলে জিনিসপত্র বড় ঘাঁটা পড়ে যায়। এক সঙ্গে থাকা, কখন কার চোখে পড়ে যাবে। চুরিও যে যেতে পারে না তা তো নয়!
বীণা খুব ভাবতে লাগল। রানাঘাটে দুই রাতের পালা। দুটো রাত কোনওরকমে কাটিয়ে দিতে পারবে সে। কিন্তু তার পর? আরও নানা জায়গায় একের পর এক পালা নামবে। তখন কী হবে? এই জন্যই না আর একবার নিমাইকে হাতে পায়ে ধরে রেখে দিয়েছিল সে। যত অপদার্থই হোক, তবু তো পাহারাদার!
এখন কী করে বীণা?
যত তাড়াতাড়ি পারা যায় ডলারগুলো ভাঙানো দরকার। দেশি টাকা হলে ব্যাঙ্কে বা পোস্ট অফিসে রেখে দিতে পারবে। কেউ টেরও পাবে না। কিন্তু ভাঙানোতেই যে বারবার বাধা পড়ছে।
বীণা একবার ভাবল, পল্টুর কাছে যাবে। আবার ভাবল, থাকগে। পল্টু ছেলেটাকে তার মোটেই বিশ্বাস হয় না। বনগাঁয়ে ডলার ভাঙানোর বিপদ আছে। চাউর হয়ে যাবে।
রানাঘাটে যাওয়ার জন্য বাক্স গোছাতে গিয়ে সে ডলারের প্যাকেটটা একটা পুরনো ব্লাউজে জড়িয়ে বাক্সের তলায় রেখে ওপরে অন্য সব জিনিস চাপিয়ে নিল। যা হওয়ার হবে। প্যাকেটটা সঙ্গে না থাকলে সে মন দিয়ে পার্টও করতে পারবে না।
একখানা পুরনো বাস ভাড়া হল। তাইতে পিকনিক পার্টির মতো একদিন সকালে চেপে বসল সবাই। ভারি হাসাহাসি, কথা চালাচালি করতে করতে এক বুক উত্তেজনা নিয়ে তারা পৌছে গেল দুপুরের আগেই। যে ক্লাব তাদের বায়না করে এনেছে তারা বেশ বড়সড় আয়োজন করেছে। বিশাল প্যান্ডেল। শোনা গেল টিকিট ভালই বিক্রি হয়েছে। দুপুরে খাওয়াল চমৎকার। খাণ্ডা খাণ্ডা মাছের টুকরো পড়ল পাতে, বড় বড় চটিজুতোর সাইজের বেগুনী, ঘন মুগডালে মাছের মাথা, টমেটোর চাটনি আর দই। কাকার বারণ আছে, পালার দিনে বেশি খেতে নেই। তাতে আইঢাই হয়, পার্ট করে জুত হয় না। বীণা তাই সাবধানে খেল। অম্বলের ব্যামোটাও বড্ড ভোগাচ্ছে।
একটু রাতের দিকে যখন ভরাভর্তি আসরে নামল বীণা তখন মনে হল, এই তো তার জগৎ। এ ছাড়া সে আর কী চায়? প্রাণ ঢেলে অভিনয় করল সে। কত যে ক্ল্যাপ পেল তার ইয়ত্তা নেই। পালা জমেছে। লোকে নিচ্ছে।
পালার এক ফাঁকে কাকা বলে গেল, কালকেও এই আসরেই পালা বসবে বীণা। সুপারহিট। কাকার মুখে তৃপ্তির হাসি দেখে বীণার বুকখান জুড়িয়ে গেল। কাকা তার জন্য যা করেছে তা তার বাবাও করেনি, স্বামীও নয়। এ লোকটার জন্যই বেঁচে আছে বীণা। কৃতজ্ঞতায় তার চোখে জল আসতে চাইছিল।
যে হাজার খানেক লোক পালা দেখছিল তাদের মধ্যে রোগাভোগা ছোটখাটো নিমাইও ছিল। সঙ্গে নদেরচাঁদ। নিমাই মোটেই পালা দেখতে আসেনি। সে দেখতে এসেছিল বীণাপাণিকে। না, তেমন পরিবর্তন হয়নি। একই রকম আছে। তবে সাজগোজ করায় দেখাচ্ছিল ভারি সুন্দর। যেন এ তার বউ নয়, সিনেমার মেয়েছেলে। বেশ ভরা লাগছিল বুকখানা তার।
নদেরচাঁদ কনুইয়ের ঠেলা দিয়ে বলে, কথা বলবে পালার পর?
ও বাবা, না।
বিয়ে-করা বউ, কথা কইবে না কেন?
ওরে না না। কথাই নেই।
পার্ট কেমন লাগল?
ভালই বোধ হয়, আমি কি অত বুঝি?
কেমন ক্ল্যাপ পাচ্ছিল দেখলে?
দেখলাম।
তোমার বউ কিন্তু জাতে উঠে গেল। আরও নাম হবে।
হোক। ওর ভাল হোক। কত কষ্ট করেছে। ভগবান এবার ওকে সুখশান্তি দিলে বড় ভাল হয়।
একবার দেখা করে গেলে ভাল করতে নিমাইদা।
ওরে দেখা করাটা একতরফা হলে হয় না। দু’ তরফেরই গরজ চাই। ওর গরজ নেই যে।
গরজ তোমারও নেই বোধ হয়?
আমি কি একটা মনিষ্যি রে? আমার কত কি মনে হয়। গরজ আছে, তবে ভয় লাগে। দেখা করে কাজ নেই। বীণা পছন্দ করবে না।
নদে মাথা নেড়ে বলে, কাজটা ঠিক হল না নিমাইদা।
নিমাইয়ের চোখে জল আসছিল! বীণাপাণি বড় অবহেলা করল তাকে। বড় দাগা দিল। এত তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য কি পাওনা ছিল তার? কিছু বিলিতি টাকাই যেন দেওয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে গেল মাঝখানে।
পালা শেষ হওয়ার পর আর কাঁচরাপাড়া ফেরার বাস নেই। রাত গভীর। চেনাজানা মেলা লোকের বাড়ি আছে রানাঘাটে। থাকার অসুবিধে নেই। নদে বলল, চলো, সুখরঞ্জনের বাড়ি যাই। তাকে বলা আছে।
নিমাই আনমনে বলল, তুই যা।
আর তুমি?
আমি! আমি একটু কোথাও বসে থাকব। আর ঘণ্টাটাক পরেই তো বাস।
তোমার অত তাড়াহুড়োর কী আছে?
আছে। সকাল পাঁচটা ছ’টার মধ্যে গিয়ে দোকান না খুললে অতগুলো লেবার খাবে কোথায়? ঘুগনির মটরদানা ভেজানো রয়েছে, পাঁউরুটির সাপ্লায়ার আসবে, দুধওলা আসবে।
তোমার অ্যাসিস্ট্যান্ট ছোঁড়াটা তো আছে।
ওরে না, ওকে দিয়ে কি কাজ হয়? আমি না থাকলে কাজে গা লাগাবে না।
ভারি তো দোকান। দিলেই না হয় একদিন লোকসান।
লোকসান বলে নয়, পাঁচজন নির্ভর করে তো। ব্যবসা মানে কি শুধু পয়সা উপার্জন? একটু সেবাও তত দিই।
তোমাকে নিয়ে আর পারা যায় না।
যা না তুই সুখরঞ্জনের বাড়ি। আমি ঠিক চলে যাবোখন।
নদে মুখ ব্যাজার করে বলে, তা হয় নাকি? এক সঙ্গে এসেছি, একসঙ্গেই ফিরব। চলো তা হলে কোথাও বসে মশা তাড়াই।
বড় রাস্তায় বাস রুটের ধারে একটা দোকানের বারান্দা পেয়ে গেল তারা। ফাঁকা নয়, বারান্দাতেও জনাকয়েক শুয়ে আছে মুড়িসুড়ি দিয়ে। সন্তর্পণেই বসল তারা।
নদে বলল, বীণাপাণি আজ কিন্তু ফাটিয়ে দিয়েছে।
নিমাই বলল, হ্যাঁ।
অমন মিয়োনো গলায় বলছো কেন? তোমার ভাল লাগেনি?
লেগেছে। তবে বড় উগ্র পার্ট।
তার মানে?
যে পার্টটা করল সে মেয়েটা যেন হান্টারওয়ালি। কী তেজ বাবা! সব যেন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিতে চায়।
ওরকমই তো চাই।
কেন চাস?
ওরকম না হলে এত অন্যায়ের সঙ্গে লড়াই করা যায়?
তোর বউ যদি ওরকমটি হয় তবে তোর কেমন লাগবে?
কেন বলো তো! আমার তো ভালই লাগবে।
একটু ভেবে বলিস। কথায় কথায় ফোঁস করা কি ভাল?
নদে একটু হাসল। বলল, তোমার মতো মাটির মানুষ হলে অবশ্য ওরকম তেজী মেয়েকে সামাল দেওয়া মুশকিল।
নিমাই মাথা নেড়ে বলে, তেজ অন্য জিনিস। এ ঠিক তেজ নয়, এ হল ঝাঁঝ। ভেতর থেকে যেন সবসময়ে হল্কা বেরোচ্ছে।
একটু ভেবে নদে বলল, হ্যাঁ, নিমাইদা, তুমি কি সত্যিই বীণাপাণিকে ত্যাগ দেওয়ার কথা ভাবছো?
আমি ত্যাগ দেওয়ার কে? ত্যাগ যদি দিতে চায় তো সে দেবে। আমি ওরকম পাপ-কথা ভাবি না।
তোমার রকমসকম আমার তো সেরকমই ঠেকছে। কী হয়েছিল সেটাও বললানি আমাকে।
স্বামী-স্ত্রীর ভিতরকার কথা বলিই বা কী করে? একদিন যদি গুছিয়ে বলতে পারি তো বলব। তবে এটুকু মনে হয়, বীণাপাণি বিপদের মধ্যে বাস করছে।
তা বিপদে তাকে একা রেখে চলে এলে কেন?
সে তো ইচ্ছে করলেই বিপদ কাটাতে পারে। কিন্তু চাইল না। তাই নিয়েই ঝগড়া।
অন্য কোনও ছেলে-ছোকরা জুটেছে নাকি?
ওরে না। বীণার এখনও সে দোষটা নেই। বড় ভাল মেয়ে।
ভালও বলছে আবার এক সঙ্গে থাকছে না এটা কীরকম ব্যাপার হচ্ছে বলল তো?
সে অনেক কথা। তোকে তো আমি বলেইছি, দোষটা আমারই বোধ হয়। আমি দুর্বল মানুষ, তেজ-টেজ নেই, খেটে খাওয়ার ক্ষমতা নেই। বীণাপাণির হাত-তোলা হয়ে বসে খেতাম। পোষা প্রাণী যেমনটা হয়।
আর নিজেকে আসামী বানিয়ে ভালমানুষ সেজো না তো। তোমাকে আমি জন্ম ইস্তক চিনি। তা এখানে যা করছে সেটা তো বনগাঁয়েও করতে পারতে। ব্যবসাই যদি করবে তো বনগাঁয়ে করতে কে মাথার দিব্যি দিয়ে নিষেধ করেছিল?
রাগিস না ভাই। বীণাপাণি দোকান দিয়ে দেবে বলেছিল। সেই আশায় ছিলাম। কিন্তু সেটা আর হয়ে ওঠেনি।
হল না কেন?
তার বড় নজর। মনোহারি দোকান দেবে বলে ঠিক করেছিল। অনেক টাকার ধাক্কা।
শুধু এইটেই কারণ নাকি?
আরও আছে।
যাকগে, তোমাকে আর বলতে হবে না। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। চোখ দুটো একটু বুজে নেই। বাস এলে ডেকে দিও।
ঘুমো।
বসে বসেই নদে ঘুমিয়ে পড়ল। এমনকি নাকও ডাকতে লাগল ঘড়ঘড় করে। নিমাই চুপ করে বসে রইল। অন্ধকার ঠাণ্ডা রাত। একটু কুয়াশা হয়েছে। চারদিকটা ভারি নিঝুম। বসে বসে সে একটাই কথা ভাবতে লাগল। বীণাপাণি। আজকাল তার শয়নে, স্বপনে, জাগরণে কেবল বীণাপাণির কথা মনে হয়।
পাঁচজন বীণাপাণিকে বাহবা দিচ্ছে বলে তার একটুও হিংসে হয় না। বরং তার মনে হয়, বীণাপাণির মতো মেয়ের যোগ্যই সে নয়। সে অনেকটাই ছোটলোক। বীণাপাণি গরিব হলেও বড় ঘরের মেয়ে। তার সঙ্গে খাপ খায় না। বীণাপাণিকে বিয়ে করেই যেন অপরাধ হয়েছে তার। আজ যদি বীণা নিজের ভাগ্য নিজে গড়ে নেয় তা হলে নিমাইয়ের হিংসে হবে কেন? তবে সে বড় ভালবেসেছিল বীণাপাণিকে। অনেকটা ভালবাসা। সেইটে বড় মনে হয়। ফাঁকা লাগে, উদাস লাগে।
দুটো জ্বলন্ত চোখে অন্ধকার ফুটো করে পয়লা বাসটা এসে পড়ছিল। নদেকে ঠেলা দিয়ে উঠে পড়ল নিমাই, ওরে, এসে গেছে।
যখন ভোরবেলা এসে নিজের ঠেকটিতে পৌঁছলো নিমাই তখন তার অ্যাসিস্ট্যান্ট বিশে উনুনে আগুন দিয়েছে। কয়লার ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠছে মিষ্টি গন্ধ ছাড়তে ছাড়তে। ধোঁয়ার গন্ধ কারও মিষ্টি লাগে না, একমাত্র নিমাইয়েরই লাগে।
উনুন ধরতে না ধরতেই ঘুগনি বসিয়ে দিল নিমাই। পাঁউরুটি এসে গেল। তারপর কাজ আর কাজ। দম ফেলার ফুরসত নেই। আজকাল কুলিকামিনরা ছাড়াও বাইরের লোক আসছে তার ঘুগনি খেতে। দু-চারজন বাবু মানুষও বসে যাচ্ছে সকালে এক কি দু’ ভাঁড় চা সেঁটে নিতে। খদ্দেরে থই থই করছে।
একজন সেদিন বলছিল, নিমাইবাবু, দুপুরে আর একটু ভারী টিফিন হলে সুবিধে হয়। পাঁউরুটি ফেনানো জিনিস, ওতে সুবিধে হয় না। হাতরুটি চালু করে দিন, দেখবেন কেমন চলে।
কথাটা ভাবছে নিমাই। হাতকটি বেচলে লাভও বেশি হয়। কিন্তু খাটুনি বেশি। তবে ছাতুটা সে চালু করে দিয়েছে। পরিশ্রমও কম। কয়েকটা পেতলের কানা-উঁচু থালা কিনেছে। ছাতু, নুন, চাটনি, পেঁয়াজ আর লঙ্কা। পশ্চিমের মানুষেরা পেট ভরে খায়।
সারা দিন হাজারো কাজের মধ্যে বারবারই বীণাপাণি এসে হানা দিল আজ। কয়েকটা দিন চোখের আড়ালে থাকায় একটু ভুল পড়েছিল। কাল যাত্রায় তাকে দেখে আবার যেন একটা ছ্যাঁদা দিয়ে বেনো জলের মতো স্মৃতি ঢুকে পড়ছে।
দুপুরের পর একটু নিরালা হল নিমাই। নিবন্ত উনুনের পাশে বেঞ্চে বসে হাঁ করে ভাবতে লাগল। তার অনেক দোষ, অনেক খামতি। এত খামতি দিয়ে ভগবান যে কেন পাঠাল তাকে দুনিয়ায়! চারদিকে বড় বড় সব মানুষ। সে কেন একরত্তি? সে কেন এত ভিতু? এত দুর্বল?
সন্ধের পর সারা রাত গুদাম চৌকি দিতে হবে। গতকাল যাত্রায় যাবে বলে অন্য লোককে টাকা দিয়ে মোতায়েন করে যেতে হয়েছে। আজ ফের তার পালা। দুপুরে একটু ঘুমনো দরকার। তা ঘুমটা আজ আর এল না। সন্ধের পর মাথায় কানে একটা কম্ফর্টার জড়িয়ে হাতে খেঁটে লাঠি নিয়ে গুদামের বাইরে ছোট ছাউনিতে বসে রইল নিমাই। হাতে টর্চ। এ দিকে আজকাল খুব চুরি হচ্ছে। হওয়ারই কথা। বেকার বাড়ছে, রোজগার নেই মানুষের, করবেটা কী?
আজ বসে বসে অন্য চুরির কথা ভাবছিল নিমাই। বীণাকে চুরি করল কে? বিলিতি টাকা, নাটক, হাততালি? এই বীণাই তাকে না মরন্ত অবস্থা থেকে বুকে আগলে ফিরিয়ে এনেছিল! তখন ভালবাসত, এখন আর বাসে না নাকি? বীণার কি কখনও মনে পড়ে তার কথা?
ভাবতে ভাবতে রাত কেটে গেল। ঘুম এল না। মাথাটা বড্ড গরম। সকালবেলাতেই ঠাণ্ডা জলে চান করে কাজে লেগে পড়ল নিমাই।
একদিন নিরঞ্জনবাবু এসে তার ব্যবসা দেখলেন। বললেন, কেমন লাভ হচ্ছে?
নিমাই অপ্রস্তুত হয়েই বলে, আজ্ঞে হিসেব তো করি না।
তোমাকে নিয়ে বড় মুশকিল দেখছি। হিসেব ছাড়া ব্যবসা হয়? হিসেব করেই করতে হয় সব। কত যাচ্ছে কত আসছে কত পড়তা হল দেখবে না? একখানা খাতা করো।
যে আজ্ঞে।
নিমাই খাতা করল। তারপর হিসেব কষতে বসল। একখানা পুরনো প্লাস্টিকের ভেতর তার টাকা থাকে। সেখানা খুলে সব টাকা-পয়সা বের করে যখন গুনে-গেঁথে তুলল তখন তার মাথাটা ঘুরেই গেল একটু। কম করেও মাসে হাজার খানেক টাকা তার আয় হচ্ছে যে! সত্যি না স্বপ্ন? হাজার টাকা যে অনেক টাকা।
আরও তিন দিন বাদে নদে এল। সব শুনে-টুনে বলল, ফুঃ! হাজার টাকা আবার এ বাজারে একটা টাকা নাকি?
ওরে, আমার যে এ-ই ঢের।
তোমার ঢের নিয়ে তুমি থাকো। ভাল করে ঘুগনি খাওয়াও তো!
বড় একটা প্লেটে ঘুগনি ঢেলে যত্ন করে দিল নিমাই। বলল, ব্যবসাটা আরও বাড়াবো, বুঝলি?
বুঝলাম। তোমাকে দেখে আমার হিংসে হয়। অল্পেই বেশ খুশি হয়ে যাও।
অনেকে যে বেশিতেও খুশি হয় না। তেষ্টা আরও বেড়ে যায়। অল্পে খুশি হই—এটাই আমার ভগবানের আশীর্বাদ।
এই ব্যবসাই যদি করবে তা হলে একটা দোকান দাও নিমাইদা। আর চৌকিদারের চাকরিটাও ছাড়ো।
ওরে না। চৌকিদারের চাকরি আমার লক্ষ্মী। এই চাকরি করতে করতেই বিয়ে হয়েছিল।
নদে হেসে বলল, তা হলে তো চাকরিটা অপয়াই। বিয়েটা তোমার ভাঙার মুখে।
ও কথা বলিসনি। নিরঞ্জনবাবু বড় ভাল লোক।
শোনো, আমি বনগাঁ গিয়েছিলাম। বিশ্ববিজয় অপেরার এখন তুঙ্গে বৃহস্পতি। মেলা বায়না পাচ্ছে।
তা হোক। কাকা নাটকের জন্য প্রাণ দিতে পারে। ওর অপেরার ভাল হোক।
কিন্তু একটা খবর একটু খারাপ। বীণাপাণির সঙ্গে দেখা হয়েছিল।
নিমাইয়ের বুকটা একটু কেঁপে উঠল, তাই নাকি?
হ্যাঁ, সে তোমার নাম শুনলেই রেগে যাচ্ছে।
নিমাই মলিন একটু হাসল, নামটা তুললি কেন?
তোমার অবস্থা দেখে মায়া হচ্ছিল বলে। তা সে কোনও কথাই কানে তুলল না। বলল, ওর হয়ে দূতিয়ালি করতে হবে না। ওই নিমকহারামকে আমি ভুলে গেছি।
নিমাই ফ্যাকাসে মুখে হাসবার আর একটা চেষ্টা করে বলল, কথাটা তো মিথ্যেও নয়। তার নুন অনেক খেয়েছি।