2 of 2

৫৩. কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার ভূমিকা

কবিকেও কখনও কখনও কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার ভূমিকা নিতে হয়। একাকী লেখার টেবিলে তিনি মুক্ত বিহঙ্গ, সেই টেবিল ছেড়ে উঠে এলেই তিনি টের পান যে আসলে তিনি সংসারে আবদ্ধ জীব। অনেক সময় সেই কল্পনাবিহারী মন বাস্তবের মাটিতে এসে আছড়ে পড়ে, ক্ষত-বিক্ষত হয়। কর্তব্য, দায়-দায়িত্বের বোঝা নিতে কবি পরাভুখ হন না, সবাইকে দেখিয়ে দিতে চান যে আমিও এসব পারি, তবু অকস্মাৎ কখনও কখনও সেই বোঝা কাঁধ থেকে পিছলে পড়ে যায়, কিংবা উত্তরে যাবার কথা, কবি চলে যান দক্ষিণে।

মাধুরীলতা বেশ ডাগরটি হয়েছে। রূপে-গুণে এক অদ্বিতীয়া কিশোরী। চোদ্দো বছর পার করে পনেরোয় পা দিয়েছে, এখনও তার বিয়ের ব্যাপারে পিতার হুঁশ নেই। এরপর যে সে অরক্ষণীয়া হয়ে যাবে! স্বামী কল্পনাবিলাসী বলে স্ত্রীকে বেশি বেশি বাস্তববাদী হতে হয়, স্ত্রীকেই ধরতে হয় সংসারের হাল। কবিপত্নী প্রায়ই কন্যার পাত্র খোঁজার জন্য তাড়া দেন স্বামীকে। রবীন্দ্রনাথ বিশেষ গা করেন না। জোড়াসাঁকোর বাড়িতে প্রতি বছরই দু’তিনটি বিয়ে হয়, ঘটক-ঘটকিরা নিয়মিত যাতায়াত করে, তারা নানা রকম সম্বন্ধ নিয়ে আসে। আর বেশি দেরি করলে মেয়ে অরক্ষণীয়া হয়ে যাবে বলে তারা মৃণালিনীর কান ভারী করে। মৃণালিনীও সরলা ও ইন্দিরার অবস্থা দেখেছেন, নিজের কন্যাকে সেই অবস্থায় নিয়ে যেতে চান না। মেয়ের বয়স বেশি হয়ে গেলে তার জন্য আর সুপাত্র পাওয়া যায় না সহজে। ইন্দিরার বিয়ে হয়েছে বটে শেষ পর্যন্ত, কিন্তু তা নিয়ে কম ঝামেলা হয়নি। সরলার তো এখনও বিয়ের নামগন্ধ নেই, সে ধিঙ্গি হয়ে ঘুরে বেড়ায়, একাধিক পুরুষ তার কাছাকাছি ঠুকচুক করে, ঠাকুরবাড়ির ধারা সে একেবারেই মানে না।

কিন্তু ঘটকের মারফত পাত্র নির্বাচন রবীন্দ্রনাথের পছন্দ হয় না। দফায় দফায় বিভিন্ন পাত্র-পক্ষ এসে মেয়ে দেখে যাবে, তাদের খাতির যত্ন করতে হবে, তারা কোনও অসমীচীন প্রশ্ন করলেও মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই, এবং সহ্য করতে হবে প্রত্যাখ্যান। মাধুরীলতা তার বড় আদরের, কত যত্ন করে তাকে শিখিয়েছেন বাংলা, ইংরিজি, সংস্কৃত। অতি চমৎকার তার লেখার হাত। চর্চা করে গেলে সে কালে একজন বড় লেখিকা হতে পারে। এমন কন্যারত্নকে কি যার তার হাতে দেওয়া যায়!

নিজেই যে উদ্যোগী হয়ে পাত্র খুঁজবেন, সে সময়ও নেই রবীন্দ্রনাথের। এখন তার খ্যাতি অনেক ছড়িয়েছে, বিভিন্ন সভা সমিতিতে প্রায়ই তার ডাক পড়ে, ভাষণ দিতে হয়, গানও গাইতে হয়, লেখালেখির চাপও বেড়ে গেছে, লিখতেও হচ্ছে প্রচুর। ভারতী পত্রিকার দাবি তো মেটাতে হচ্ছেই, এর ওপর আবার নব পর্যায় বঙ্গদর্শন পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব প্রায় জোর করেই চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে তাঁর ওপর। রবীন্দ্রনাথ এ দায়িত্ব নিতে চাননি, কেননা পাঠক ও সমালোচক পদে পদে তার সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের তুলনা করবে, সম্পাদক বঙ্কিমের কৃতিত্ব এখনও পর্যন্ত তুলনাহীন। দায়িত্ব যখন নিতেই হয়েছে, তখন পত্রিকার মান যাতে ক্ষুণ্ণ না হয়, তাই রবীন্দ্রনাথ নিজের রচনা দিয়েই প্রায় ভরিয়ে দিচ্ছেন, প্রতিটি সংখ্যা। প্রত্যেক সংখ্যায় থাকে তার রচিত গান ও কবিতা, প্রবন্ধ, ধারাবাহিক উপন্যাস, সমসাময়িক পর্যালোচনা। লিখতে তার ক্লান্তি নেই। ‘ভারতী’ পত্রিকায় লিখছেন ধারাবাহিক ‘চিরকুমার সভা’ ও ‘নষ্টনীড়’, ‘বঙ্গদর্শন’-এ শুরু করলেন ‘চোখের বালি’ উপন্যাস। এক সঙ্গে তিনটি ধারাবাহিক লেখার কথা এর।

এই সবের ওপর জমিদারির কাজ দেখাশুনোর দায়িত্ব তো আছেই।

একদিন প্রিয়নাথ সেন কথায় কথায় বললেন, বন্ধু, তোমার বড় কন্যাটির বিবাহের কথা কিছু ভাবছ নাকি? শুনলাম, বিহারীলাল চক্রবর্তীর ছেলে শরতের বিয়ের উদ্যোগ চলছে। ছেলেটি বেশ উপযুক্ত। ওরা আমার প্রতিবেশী তো, আমি অনেক দিন যাবৎ ওদের চিনি।

যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন। বিহারীলাল নতুন বউঠানের প্রিয় কবি ছিলেন, রবীন্দ্রনাথও এক সময় ওঁর লেখা পছন্দ করতেন। দুই কবির পরিবারের মধ্যে কটুম্বিতার চেয়ে আদর্শ আর কী হতে পারে! ছেলেটিও বেশ যোগ্য, উচ্চ শিক্ষিত, মুঙ্গের শহরে ওকালতি শুরু করেছে। কলকাতা ছেড়ে মুঙ্গেরের মতন দূর শহরে যাওয়ার যৌক্তিকতা আছে। বর্তমানে বাঙালির মধ্যে উকিল ব্যারিস্টারের সংখ্যা অনেক। কলকাতায় সবাই মিলে প্রতিযোগিতার মধ্যে না পড়ে খোঁজ খবর নেয় যে, ভারতের কোন কোন শহরে এখনও তেমন আইনজ্ঞ নেই। কলকাতার উকিলরা সেখানে গিয়ে বিনা প্রতিযোগিতায় আঁকিয়ে বসে। এইভাবে ভারতের প্রায় সব শহরেই বাঙালি ছেলেরা ওকালতি-ডাক্তারি-শিক্ষকতার পদগুলিতে ছড়িয়ে পড়েছে। শরৎ যখন মুঙ্গেরে গেছে, তখন অবিলম্বেই পশার জমিয়ে ফেলবে নিঃসন্দেহে।

ছেলেটিকে দেখারও প্রয়োজন বোধ করলেন না রবীন্দ্রনাথ, তক্ষুনি সম্মতি জানিয়ে দিলেন।

কিন্তু লাখ কথা না হলে বিয়ে হয় না।

রবীন্দ্রনাথ অত্যুৎসাহে মৃণালিনীকে খবরটা জানাতেই তিনি কিছুক্ষণ ভ্রূ কুঞ্চিত করে রইলেন। তারপর বললেন, তুমি দেখলে না শুনলে না, ছেলেটি কানা না খোঁড়া জানলে না, আগেই কথা দিয়ে এলে।

রবীন্দ্রনাথ বললেন, বিহারীলাল চক্রবর্তীর ছেলে। সে কখনও কানা খোঁড়া হতে পারে?

সঙ্গে সঙ্গে নিজেই হেসে ফেলে আবার বললেন, না না, তা নয়। প্রিয়নাথ আমাদের বিশেষ শুভার্থী বন্ধু, সে কখনও জেনেশুনে বেলার সঙ্গে কানা খোঁড়া ছেলের সম্বন্ধ দিতে পারে? তার ওপর আমি খুব ভরসা করি। জানো, বিহারীলাল খুব সরল, সাদাসিধে মানুষ ছিলেন, তাকে আমার খুব পছন্দ।

মৃণালিনী বললেন, আমি কি শুধু শ্বশুরকে পছন্দ করে মেয়ের বিয়ে দেব নাকি? তুমি আগে ছেলেকে একবার দেখার ব্যবস্থা করো।

রবীন্দ্রনাথ বললেন, পাত্র-পক্ষের বাড়িতে গিয়ে তো দেখার রীতি নেই। তা ছাড়া শরৎ থাকে মুঙ্গেরে। ঠিক আছে, প্রিয়নাথকে বলে তার একখানা ফটোগ্রাফ জোগাড় করা যায় কি না দেখছি আমি।

মৃণালিনী বললেন, তুমি কত জায়গায় যাও। একবার মুঙ্গেরে গিয়েও তোত তাকে দেখে আসতে পারো। পাত্র-পক্ষের বাড়ির অবস্থা, অনেকগুলি অবিবাহিতা ননদ আর বিধবা জা আছে কিনা, এসবও খোঁজখবর নিতে হয়।

বিহারীলাল চক্রবর্তী বেশ কয়েক বছর আগে গত হয়েছেন। বাড়ির অবস্থা সাধারণ। কন্যার পিতা হয়েও রবীন্দ্রনাথ গলায় চাঁদর ঝুলিয়ে পাত্রপক্ষের দ্বারস্থ হতে দ্বিধান্বিত হলেন, প্রিয়নাথ সেনের বাড়িতে উভয়পক্ষের কথা শুরু হল। পাত্রের এক ভাই ঋষিবর অতি সুপুরুষ, একে দেখেই বোঝা যায়, শরৎও মাধুরীলতার অনুপযুক্ত হবে না।

প্রথমেই পাত্র-পক্ষ কুড়ি হাজার টাকা পণ চেয়ে বসল। রবীন্দ্রনাথ খুব দমে গেলেন। অত টাকা তিনি পাবেন কোথায়? ব্যবসা করতে গিয়ে অনেক টাকা ঋণ হয়ে গেছে, সদ্য নিজের জন্য একটা বাড়ি বানিয়েছেন, হাত একেবারে শূন্য। বিয়ের আনুষঙ্গিক খরচ নিয়ে চিন্তা নেই। পিতা দেবেন্দ্রনাথই এখনও সমস্ত নাতি-নাতনিদের বিবাহের ব্যয় বহন করেন, মৃণালিনীর গহনা থেকে যৌতুকও দেওয়া যাবে যথেষ্ট, কিন্তু পণের ক্যাশ টাকা জোগাড় করা যে অসম্ভব।

তবু, এমন সুপাত্রকে কিছুতেই হাতছাড়া করা চলে না। বিহারীলাল চক্রবর্তীর ছেলেকে নিজের জামাতা হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ইতিমধ্যে ধরেই নিয়েছেন। নতুন বউঠান বেঁচে থাকলে, এই বিয়ের সম্বন্ধতে তিনি নিশ্চয়ই খুব উৎসাহিত হতেন। মৃণালিনী বিহারীলালের নামের মর্ম কিছুই বোঝেন না, তিনি বুঝতেন। ‘নষ্টনীড়’ লিখতে লিখতে ইদানীং নতুন বউঠানের কথা আবার খুব মনে পড়ছে। এমনকী চোখের বালি লেখার সময়েও।

বিয়েতে পণ দেওয়া যে গরু-ছাগল কেনা বেচার সমান, এই কুপ্রথা সমাজ থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করবার কথা রবীন্দ্রনাথ নিজেও অনেকবার ভেবেছেন, দেবেন্দ্রনাথ এই প্রথার ঘোর বিরোধী, এসব ভুলে গেলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি বিহারীলালের ছেলেকে জামাতা হিসেবে পাওয়ার জন্য পণ দিতেও রাজি। শুরু হল গো-হাটার দরাদরি। কুড়ি হাজার থেকে নামতে নামতে দশ হাজারে পৌঁছে পাত্রপক্ষ অনড় হয়ে রইল। শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ তাতেই সম্মতি জানালেন, তখন পাত্র-পক্ষ আবার কৌশলে মুঙ্গের থেকে শরতের যাওয়া-আসা ও বরযাত্রীদের রাহা খরচ বাবদ আরও দুহাজার বাড়িয়ে নিল। মোট বারো হাজার।

রবীন্দ্রনাথ বললেন, বিয়ের তারিখ ঠিক করবার ভার আপনাদের ওপর। তবে আমাদের একটি পারিবারিক প্রথা আছে। বিবাহের কয়েকদিন আগে পাত্রকে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নিতে হবে।

প্রিয়নাথ বললেন, সে কথা আমি ওঁদের আগেই জানিয়েছি। শরৎ ব্রাহ্ম হতে রাজি আছে।

ঋষিবর বলল, ঠিক আছে, দাদাকে কয়েকদিন আগেই আসার জন্য তার করব। যেদিন দীক্ষা হবে, সেদিনই আপনারা পণের টাকাটা দিয়ে দেবেন। ওই টাকাটা আমাদের আগেই চাই।

রবীন্দ্রনাথ আড়ষ্টভাবে বললেন, আগেই দিতে হবে? ঋষিবর বললেন, হ্যাঁ। মা সেই কথাই বলে দিয়েছেন। তিনদিন আগে বা পরে দেওয়া তো একই কথা।

রবীন্দ্রনাথ বললেন, তা ঠিক। সেই ব্যবস্থাই হবে।

পণের ওই বারো হাজার টাকা দেবার সংস্থান রবীন্দ্রনাথের নেই। কিন্তু তিনি জানেন, প্রতিটি বিবাহের পর কন্যা-জামাতা যখন দেবেন্দ্রনাথকে প্রণাম জানাতে যায়, তিনি তাদের বেশ কয়েকটি গিনি দিয়ে আশীর্বাদ করেন। সেই গিনিগুলির মূল্য বারো হাজারের কম হবে না।

পিতাকে সব জানাবার জন্য রবীন্দ্রনাথ গেলেন ওপর মহলে। ধ্যানভঙ্গ করে দেবেন্দ্রনাথ সব শুনলেন, পাত্রের পারিবারিক অবস্থা, কটি ভাই বোন, কতদিন ধরে ওকালতি শুরু করেছে সব জেনে নিলেন খুঁটিনাটি প্রশ্ন করে, তারপর বললেন, বেশ তো, খাজাঞ্চিকে বলে দাও সব বন্দোবস্ত করতে, আতিথেয়তার যেন ত্রুটি না থাকে।

রবীন্দ্রনাথ বললেন, খাজাঞ্চিমশাইকে আশীর্বাদী গিনিগুলি সংগ্রহ করে দিতে বলব? ওরা আগে চেয়েছেন।

নিষ্পলকভাবে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলেন দেবেন্দ্রনাথ। তারপর অতিশয় ধীরভাবে বললেন, ওই যৌতুক তো আমার আশীর্বাদস্বরূপ। আগে দিতে হবে কেন? ওরা কি আমায় বিশ্বাস করেন না? বিবাহের পূর্বেই যৌতুক চাইবার কী কারণ, তা তো বুঝতে পারলাম না।

রবীন্দ্রনাথের মাথায় যেন বজ্রপাত হল। ছি ছি ছি, এ কী করেছেন তিনি? এ যে তার পিতার প্রতি চরম অপমান। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতন মানুষের বদান্যতায় অবিশ্বাস। রবীন্দ্রনাথ কী করে এ প্রস্তাবে রাজি হয়েছিলেন, কোন মুঢ়তা তাকে পেয়ে বসেছিল।

নিঃশব্দে কিছুক্ষণ বসে থাকার পর তিনি বেরিয়ে গেলেন মুখ নিচু করে।

পুরো একটা দিন তিনি বাড়িতে বসে রইলেন চুপচাপ। এই সঙ্কটের কথা তিনি স্ত্রীকেও বলতে পারেন না। এমন অসম্মানজনক শর্ত শুনে মৃণালিনীও দারুণ চটে উঠবেন নিশ্চিত। শর্ত বদলের কথাই বা তিনি এখন বলেন কোন মুখে, প্রিয়নাথকে সাক্ষী রেখে তিনি নিজেই যে রাজি হয়ে এসেছেন।

কাজের ছুতো দেখিয়ে রবীন্দ্রনাথ চলে গেলেন শিলাইদহে। যাবার আগে প্রিয়নাথকে ইঙ্গিত দিয়ে গেলেন, অন্য কোনওভাবে এই সঙ্কট নিরসন করা যায় কি না তার উপায় খুঁজতে। সে সম্ভাবনা খুবই কম। পাত্রপক্ষেরও মানে লেগেছে। ভাবী শশুর রবীন্দ্রনাথ নিজেই কথা দিয়ে কথার খেলাপ করছেন, এ কী রকম ব্যাপার? ঠাকুর বাড়ির পারিবারিক প্রথা আছে, তাদেরও বুঝি কিছু প্রথা থাকতে পারে না, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি ছাড়া আর কি কোথাও পাত্রী পাওয়া যাবে না? শরতের মতন পাত্রের জন্য শত শত মেয়ের বাপ ছুটে আসবে!

শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ এবারে একা। মন ভাল নেই। কন্যার বিবাহের জন্য উতলা হয়ে টাকা-পয়সা নিয়ে দরাদরি। আগে দেওয়া, পরে দেওয়া এইসব চিন্তা করলেই মনে কেমন যেন গ্লানির ভাব আসে। এই সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলতে হবে, না হলে কিছু লেখা যাবে না। লেখাটাই তো তার আসল কাজ।

জ্যোৎস্নাময় রাত্রে বোটের ছাদে দাঁড়িয়ে চেয়ে থাকেন আকাশের দিকে। নদীর ছলোচ্ছল শব্দ বাজতে থাকে সঙ্গীতের মতন। রবীন্দ্রনাথের মনে হয়, কে আমি, কী আমার পরিচয়? কারুর চোখে আমি ধনীর নন্দন, সংসারী, পাঁচটি পুত্রকন্যার জনক। কেউ ভাবে, আমি এক বিশিষ্ট জমিদার। কারুর কাছে আমি সম্পাদক, লেখক, গায়ককবি। একই মানুষের অনেক পরিচয় থাকতে পারে, কিন্তু যখন আমি সম্পূর্ণ একা, তখন আমি শুধুই কবি। একজন কবির প্রকৃত পরিচয় কি কোনও মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব?

হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মতন মনে এসে যায় কয়েকটা কবিতার লাইন :

বাহির হইতে দেখো না এমন করে
আমায় দেখো না বাহিরে।
আমায় পাবে না আমার দুখে ও সুখে,
আমার বেদনা খুঁজো না আমার বুকে,
আমায় দেখিতে পাবে না আমার মুখে,
কবিরে খুঁজিছ যেথায় সেথা সে নাহি রে…

নীচে নেমে এসে লণ্ঠনের আলোয় ঝরঝর করে অনেকগুলি পঙক্তি লিখে ফেলার পর একটু থামেন। কবিতা-পাঠককে ধাঁধার মধ্যে ফেলা রাখা কি ঠিক হবে? কবির একটা নিভৃত পরিচয় আছে, সে কথা কিছুটা আভাসে বলে দেওয়াও যায়।

যে আমি স্বপন-মূরতি গোপনচারী,
যে আমি আমারে বুঝিতে বুঝতে নারি,
আপন গানের কাছেতে আপনি হারি,
সেই আমি কবি, কে পারে আমারে ধরিতে…

পরদিন সকালেই আবার চিন্তার ভার মাথায় চেপে বসে। কন্যার বিয়ের ব্যাপারটা উপেক্ষা করা যায় না। বিহারীলালের ছেলের সঙ্গে মাধুরীলতার সম্বন্ধের কথাটা অনেকটা জানাজানি হয়ে গেছে, এখন এটা কাচিয়ে গেলে লোকে হাসবে।

অনেক ভেবেচিন্তে তিনি মুঙ্গেরে শরকুমারকেই একটা চিঠি পাঠালেন সব ব্যাপারটা খোলাখুলি লিখে। সে শিক্ষিত, আধুনিকমনস্ক যুবক, সে নিশ্চিত পণপ্রথা সমর্থন করবে না।

কয়েকদিনের মধ্যেই শরতের কাছ থেকে ঝটিতি উত্তর এসে গেল। আগাগোড়া শ্রদ্ধা ও বিনয়পূর্ণ বচনে লেখা। সে জানিয়েছে যে, সে পণপ্রথা সমর্থন করে না, তার নিজের দিক থেকে টাকাপয়সার কোনও দাবি নেই। ঠাকুর পরিবারের কন্যাকে স্ত্রী রূপে পেলে সে গর্বিত বোধ করবে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতন একজন বিশিষ্ট ব্যক্তির সান্নিধ্য পাবার জন্য সে আগ্রহী। কিন্তু সে তার জননী ও ভাইদের বিরুদ্ধ মতে গিয়ে কোনও কাজ করতে পারবে না। পরিবারের লোকদের মনঃক্ষুণ্ণ করে বিবাহ করতে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। সুতরাং এ ব্যাপারে তার মা-ভাইদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

চিঠিখানি পড়ে রবীন্দ্রনাথ অখুশি হলেন না। তার নিজেরও পুত্রসন্তান আছে। তাঁর পুত্র যদি বাবা-মায়ের মতামত অগ্রাহ্য করে বউয়ের পরিবারের সব কথা মেনে চলে, তাতে কি তিনি খুশি হবেন? এ ছেলেটির নিজের গুরুজনের প্রতি শ্রদ্ধা আছে, এটাও তো একটা ভাল গুণ।

তা হলে বুঝি এই সম্বন্ধ ভেঙে দেওয়া ছাড়া আর গতি নেই। ওরাও পণের টাকা আগে না পেলে ছাড়বে না, দেবেন্দ্রনাথও বিয়ের আগেই আশীর্বাদী যৌতুক দিতে কিছুতেই রাজি হবেন না।

হঠাৎ একটি সমাধানের সূত্র এল প্রিয়নাথ সেনের কাছ থেকে। রবীন্দ্রনাথের হাতে টাকা নেই। যদি কোনও বন্ধু দীক্ষার দিনে ওই টাকাটা দিয়ে দেয়, তা হলেই তো হল। পরে বিয়ে টিয়ে চুকে গেলে যৌতুকের টাকা থেকে সেই বন্ধুকে শোধ করে দেওয়া যেতে পারে। প্রিয়নাথ নিজেই সেই দশ-বারো হাজার টাকা জোগাড় করে ফেলতে রাজি আছেন।

এ প্রস্তাবে খুবই উৎফুল্ল বোধ করলেন রবীন্দ্রনাথ। এই হল খাঁটি বন্ধুর মতন কাজ। প্রিয়নাথের প্রতি কৃতজ্ঞতায় তার মন ভরে গেল। প্রিয়নাথের যেমন সাহিত্যবোধ আছে, সংসার সম্পর্কেও সেই রকম অভিজ্ঞ। প্রিয়নাথের অনেক কবিতার সমালোচনা যেমন রবীন্দ্রনাথ মেনে নেন, তেমনি মাধুরীলতার বিয়ের ব্যাপারটাতেও তার ওপরেই পুরোপুরি নির্ভর করতে হবে। নদীর বাঁধের ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রবীন্দ্রনাথ ভাবলেন, এক্ষুনি কলকাতায় ফেরা দরকার।

কলকাতায় প্রিয়নাথ আরও ভাল খবর দিলেন। দীক্ষার দিনে নগদ টাকাটা হাতে হাতে তুলে না দিলেও চলবে। সব ব্যাপারটা তিনি কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্যকে খুলে বলেছিলেন। কৃষ্ণকমল দেবেন্দ্রনাথের বিশেষ পরিচিত এবং বিহারীলালেরও বন্ধু ছিলেন, ও পরিবারের সবাই তাঁর কথা মানে। তিনি বলেছেন, দেবেন্দ্রনাথের বদলে অন্য কারুর টাকা দিয়ে দেওয়াটা ভাল দেখায় না। এ সংবাদ কোনওক্রমে দেবেন্দ্রনাথের কানে পৌঁছলে তিনি দুঃখ পাবেন। তার মতন মানী লোকের নাতনির বিয়ের টাকা দেবে অন্য লোক! শরত্র টাকা চেয়েছে, সেটা পেলেই তো হল! কৃষ্ণকমল নিজে এই টাকার জন্য জামিন থাকবেন।

বাঃ, তা হলে তো সব সমস্যা মিটেই গেল। এবার শুভকাজের দিন ঠিক করে ফেললেই হয়। প্রিয়নাথ বললেন, মাঝখানে অবশ্য একটা অনুষ্ঠান বাকি আছে। পাত্রপক্ষের তরফ থেকে তো মেয়েকে এখনও দেখাই হল না। ছেলের মা-মাসিরা একবার পাত্রীকে দেখতে চান। পাকা-দেখা নামে একটা ব্যাপার থাকে। হিন্দু বাড়ি শাশুড়িরা কখনও জামাই বাড়ি যান না। মেয়েকে একবার নিয়ে আসতে হবে শরৎদের বাড়িতে। প্রিয়নাথ বললেন, বন্ধু, তুমি তোমার গাড়িতে করে মাধুরীলতাকে নিয়ে আসবে, বেশিক্ষণের ব্যাপার নয়, ঘণ্টা খানেক লাগবে, মেয়েকে তো পছন্দ হবেই জানা কথা, ওঁরা ধান-দুর্বো দিয়ে মেয়েকে আশীর্বাদ করবেন।

কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার ভূমিকায় আর একবার প্রচণ্ড ভুল করলেন কবি। অগ্র পশ্চাৎ বিবেচনা না করে তিনি এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেন।

কবিপত্নী এই কথা শোনা মাত্র যেন খণ্ডপ্রলয় শুরু হয়ে গেল! ঠাকুরবাড়ির মেয়েকে নিয়ে যাওয়া হবে পাত্রের বাড়িতে! মেয়ে কি জলে পড়ে গেছে নাকি যে রাজি হতে হবে এমন অপমানজনক শর্তে! এই পরিবারের অনেক মেয়েকে বিয়ের পরেও শ্বশুরবাড়িতে পাঠানো হত না, আর মাধুরীলতাকে পাঠাতে হবে বিয়ের আগে?

মৃণালিনী দুঃখ-বেদনা ক্ৰেধে অধীর হয়ে স্বামীর কাছে এসে আঙুল নেড়ে নেড়ে বলতে লাগলেন, কেন তুমি ওদের এমন প্রস্তাবে রাজি হলে? কেন, কেন? এতে তোমাদেরই বংশের যে কত অসম্মান, তা তুমি ভেবে দেখলে না? চিরটাকাল বরপক্ষের লোক আসে কন্যাপক্ষের বাড়িতে। মেয়েকে আগ বাড়িয়ে পাঠাতে হবে, এমন কথা তুমি জগতে শুনেছ? অতি গরিব ঘরের মেয়ের বাপও নিজের বাড়িতেই যথাসাধ্য ব্যবস্থা করে, আর তুমি নির্লজ্জের মতন মেয়েকে নিয়ে ড্যাং ড্যাং করে ও বাড়ি যাবে? এতে তোমার নিজের সম্মান, তোমাদের বংশের সম্মান যে ধুলোয় লুটোবে, তা একবারও ভেবে দেখলে না? ওই পাত্ৰ ছাড়া কি আমাদের মেয়ের আর বিয়ে হবে না! ওদের সব উদভুট্টি আবদার আমাদের মেনে নিতে হবে?

রবীন্দ্রনাথ লজ্জায়, আত্মগ্লানিতে, অপরাধবোধে যেন দারুভূত হয়ে গেলেন। সত্যিই তো, বাঙালি সমাজে অনুঢ়া কন্যাকে ভাবী স্বামীর গৃহে কখনও নিয়ে যাওয়া হয় না। বাবামশাই শুনতে পেলে আবার অপমান বোধ করবেন। এটাও তার মনে পড়েনি! পাত্রপক্ষের কাছে বারবার নত হতে গিয়ে তিনিই সব গোলমাল পাকিয়ে ফেললেন। তার স্ত্রী বিরূপ, মাধুরীলতাও সব জানতে পারলে মনে আঘাত পাবে।

মৃণালিনী ভেঙে পড়া গলায় আবার জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কেন মেনে নিলে? কেন রাজি হলে?

রবীন্দ্রনাথ অস্ফুট গলায় বললেন, তার কারণ আমি একটা নিতান্ত গধভ। তুমি আমাকে যা খনি গঞ্জনা দিতে পারো। তোমার কথাই ঠিক, আমি নিবোধের মতন কাজ করেছি।

কিন্তু পাত্রপক্ষের সামনে রবীন্দ্রনাথ নিজে কথা দিয়ে এসেছেন, এখন প্রত্যাহার করবেন কী করে? সেও তো আর এক অপমানজনক ব্যাপার।

একটু পরে সব রাগ গিয়ে পড়ল প্রিয়নাথ সেনের ওপর। সে-ই তো ভুল পরামর্শ দিয়েছে, এই কি বন্ধুর কাজ? রবীন্দ্রনাথ না হয় সংসার সম্পর্কে অনভিজ্ঞ, সব দিক বিবেচনা করে দেখতে পারেন না, এই প্রথম মেয়ের বিয়ে দিচ্ছেন, কিন্তু প্রিয়নাথ সেন তো যথেষ্ট অভিজ্ঞ ব্যক্তি, এর আগে নিজের দুটি মেয়ের বিয়ে দিয়ে শ্বশুর হয়েছেন, তিনি কী করে এরকম আচার গহিত প্রস্তাব মেনে নিতে বললেন পাত্রপক্ষের সামনে? রবীন্দ্রনাথ ভুল করলেও তার কি সেই ভুল ধরিয়ে দেওয়া উচিত ছিল না? বিয়ের আগেই দু’পক্ষের মধ্যে একটা তিক্ততার সৃষ্টি হতে চলেছে। প্রিয়নাথকে একখানা কড়া চিঠি লিখলেন, রবীন্দ্রনাথ, তারপর সব কিছু অসমাপ্ত রেখে চলে গেলেন দার্জিলিং।

ত্রিপুরার রাজা রাধাকিশোর মাণিক্য এখন দার্জিলিং-এ অবস্থান করছেন। তিনি রবীন্দ্রনাথকে আগেই আমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছিলেন, তবু রবীন্দ্রনাথের পক্ষে এ যেন কলকাতা ছেড়ে পলায়ন।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে রাধাকিশোরের উৎসাহ যেন তার পিতার চেয়েও বেশি। তার পিতা অবশ্য নিজে গান ও কবিতা রচনা করতে পারতেন, রাধাকিশোরের সে ক্ষমতা নেই, তবু কাব্য উপভোগ করার সময় তিনি বিভোর হয়ে যান।

রাধাকিশোর দার্জিলিং-এর মোলায়েম ঠাণ্ডায় বিশ্রাম নিতে এসেছেন, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গও তার বিশেষ কাম্য। কিন্তু এবারে যেন কবিতা পাঠ ও গানের সময় বারবার অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছেন কবি। যত আদরেরই হোক, মেয়েকে চিরকাল নিজের কাছে রাখা যায় না, আবার মেয়ের বিয়ে যদি উপযুক্ত পরিবারে না দেওয়া যায়, তা হলে সারাজীবন অশান্তিতে দগ্ধ হতে হবে। শরৎ পাত্র হিসেবে অবশ্যই সুযোগ্য, কিন্তু সে তার মা-ভাইদের মতের বিরুদ্ধে কোনও কিছুই করবে না। সুতরাং ওই পরিবারের সঙ্গে প্রথম থেকেই সম্পর্ক ঘুলিয়ে ভোলা একেবারেই অনুচিত। এতদূর এগিয়ে আবার অন্য পাত্র খোঁজার চেষ্টাও যুক্তিযুক্ত নয়।

মহারাজকে ঘুণাক্ষরেও এই সংকটের কথা জানাতে চান না রবীন্দ্রনাথ। টাকা পয়সার ব্যাপারে মহারাজ অতি উদার, দানে তিনি মুক্তহস্ত। রবীন্দ্রনাথের কন্যার বিয়েতে পণের টাকা নিয়ে কিছু অসুবিধের সৃষ্টি হয়েছে শুনতে পেলেই তিনি সব টাকা দিয়ে দেবেন, আরও অতিরিক্ত কিছু দিয়ে তিনি পাত্রপক্ষকে অভিভূত করে ফেলবেন। দ্বারকানাথ ঠাকুরের বংশের এক কন্যার বিয়ে হবে অন্যের টাকায়? এ যেন কিছুতেই না হয়। চামড়ার ব্যবসা করতে গিয়ে চল্লিশ হাজার টাকা ধার না হয়ে গেলে কবিকে এত ভাবনাচিন্তা করতেই হত না।

কাব্য বা সঙ্গীত নয়, অন্য একটি ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ জড়তা ভেঙে অতি উৎসাহী হয়ে উঠলেন। রাধাকিশোর তার পিতার মতন কাজ চালানো গোছের ইংরিজিও জানেন না। শশিভূষণ মাস্টার বিদায় নেবার পর রাজ পরিবারে ইংরিজি শিক্ষার চল প্রায় উঠেই গেছে। শুধু ত্রিপুরায় কেন, অন্যান্য অনেক দেশীয় রাজ পরিবারের ছেলেরা লেখাপড়া না শিখে ভোগবিলাসে মেতে থাকে অল্প বয়েস থেকেই। ইংরেজ পলিটিক্যাল এজেন্টদের এতে খুব অসুবিধে হয়, রাজা বা রাজপুত্রদের সঙ্গে সরাসরি কোনও কথাই বলা যায় না। সেইজন্যই ইংরেজ সরকার আজমিরে লর্ড মেয়োর নামে। একটি কলেজ স্থাপন করেছে, এবং সমস্ত রাজকুমারদের সেখানে ইংরিজি শিক্ষা গ্রহণে বাধ্য করা হচ্ছে।

রাধাকিশোর তার পুত্রকে অত দুরে পাঠাতে চান না। এই ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের পরামর্শ চাওয়া। হতেই তিনি বললেন, কক্ষনও পাঠাবেন না।

মেয়ো কলেজ শুধু দূর বলেই না, সেখানে ইংরিজি শিক্ষার নামে বিলিতি আদবকায়দা শিখিয়ে রাজকুমারদের নিজস্ব দেশীয় সংস্কৃতি থেকে বিচ্যুত করা হবে। তারা হবে ইংরেজের ধামাধরা এক ধরনের ট্যাস ফিরিঙ্গি, এটাই সরকারের মতলব। ভারতীয় রাজকুমারদের কাছে ভারতীয় ঐতিহ্যই সবচেয়ে বড় হওয়া উচিত, তাদের জানা উচিত প্রাচীন রাজধর্ম।

কিছুদিন ধরেই রবীন্দ্রনাথের মন বিলিতি শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ হতে হতে ক্রমশ পিছোচ্ছে, পিছোতে পিছোতে প্রাচীন ভারতের আশ্ৰমিক শিক্ষার দিকে ঝুঁকেছে, এমনকী বর্ণাশ্রম এবং ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্বেও বিশ্বাসী হয়েছেন। বলেন্দ্ৰনাথ শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম বিদ্যালয় খোলার পরিকল্পনা করেছিল, তার অকালমৃত্যুতে সেটা চাপা পড়ে যায়, রবীন্দ্রনাথ আবার সেই পরিকল্পনাটি লালন করছেন মনে মনে।

রবীন্দ্রনাথ রাজাকে বললেন, ইংরিজি শেখাতে হবে তা ঠিক কথা। ইংরেজদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় জয়ী হতে গেলেও ওই ভাষা শিক্ষা অনিবার্য। তার জন্য মেয়ে কলেজে যেতে হবে কেন? ওরা যে চরিত্রটাই বদলে দেবে। বিলিতি হাব-ভাব শিখিয়ে মর্কট বানাবে। নিজের রাজ্যেই সাহেব মাস্টার নিযুক্ত করে রাজকুমারদের ইংরিজি শেখানো যায়, সেই সঙ্গে স্বদেশের আদর্শও তাদের শিক্ষা দিতে হবে।

কিন্তু সেরকম সাহেব মাস্টার পাওয়া যাবে কোথায়?

রবীন্দ্রনাথের লরেন্সের কথা মনে পড়ল। এই ভবঘুরে ইংরেজটিকে তিনি নিজের পুত্রকন্যার শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন। নির্বাচনে ভুল হয়নি, মানুষটি পড়ায় ভাল, নিজের ভাষা ছাড়াও অনেক কিছু জানে, বহু ব্যাপারে উৎসাহী ও গুণী। কিন্তু একাকী চাঁদ যেমন সমস্ত অন্ধকারকে হত্যা করে, সেইরকমই লরেন্সের একটি দোষ তার সব গুণরাশি ঢেকে দিয়েছে। সে মদ্যপায়ী এবং তার মদের নেশা দিনদিনই বাড়ছে। নিজের কাছে না থাকলে সে রবীন্দ্রনাথের কাছে এসে মদের বোতলের জন্য জ্বালাতন করে। মানুষটির ওপর রাগও হয়, আবার ভাল না বেসেও পারা যায় না।

মাধুরীলতার বিয়ের কথাবার্তা চলছে জেনে লরেন্স খুব ক্ষুব্ধ। এত অল্পবয়েসী মেয়েকে বিয়ে দেবার প্রস্তাব সে মেনে নিতে পারছে না। মাধুরীলতা মেধাবিনী, সে তো আরও লেখাপড়া শিখতে পারত। মাধুরীলতার প্রতি লরেন্সের খুব টান। ওদের দুজনের মধ্যে যে সম্পর্ক, রবীন্দ্রনাথ জানেন, তা নির্মল ও নিদোষ, কিন্তু অন্য লোকে অন্যরকম ধারণাও করতে পারে। এ দেশের অধিকাংশ মানুষই তো নারী-পুরুষের মধ্যে শুধু খাদ্য-খাদকের সম্পর্ক ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারে না। মাধুরীলতা একটু বড় হবার পর তার সঙ্গে লরেন্সের ঘনিষ্ঠতা ভাল চোখে দেখেন না মৃণালিনী। তিনি মেয়েকে দূরে সরিয়ে দিতে চান। মাধুরীলতার বিয়ের প্রস্তাব শুনে লরেন্স বারবার এসে রবীন্দ্রনাথের কাছে প্রতিবাদ জানায়, মৃণালিনী তাতেও বিরক্ত। মুঙ্গেরে গিয়ে স্বামীর ঘর করা মেয়ের পক্ষে সেই হিসেবে ভালই।

মুশকিল হচ্ছে এই, লরেন্সকে বিতাড়িত করার কোনও উপায় নেই। তাকে বকুনি দিলেও সে হাসে। কখনও দু’চারদিনের জন্য অন্য কোথাও চলে যায়, আবার ফিরে আসে। মদ ছাড়া তার আর অন্য কোনও বিলাসিতার দাবি নেই। তাকে ত্রিপুরার রাজকুমারদের শিক্ষক হিসেবে পাঠিয়ে দিতে পারলে ভালই হত, কিন্তু জেনেশুনে কোনও শুভার্থীকে কি একটি মাতাল গছিয়ে দেওয়া যায়?

রবীন্দ্রনাথ বললেন, আমার বন্ধু জগদীশ বসু বিলেতে আছেন। তাঁকে লিখতে পারি, যাতে তিনি দেখেশুনে একজন নিরপেক্ষ, প্রকৃত বিদ্বান ইংরেজকে এদেশে পাঠাতে পারেন। কিংবা কুচবিহারের রাজা… হ্যাঁ, তিনিও তাঁর সন্তানদের জন্য ইংরেজ শিক্ষক রেখেছেন, তিনি সন্ধান দিতে পারবেন।

কুচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ এখন দার্জিলিং-এ আছেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে একদিন পথে দেখাও হয়েছে। নৃপেন্দ্রনারায়ণের সঙ্গে রাধাকিশোরের পরিচয় নেই, যদিও তাঁরা দুই প্রতিবেশী রাজ্যের রাজা। যুদ্ধের সময় ছাড়া রাজায় রাজায় কদাচিৎ মোলাকাত হয়। রাজারাজড়ারা সাধারণ মানুষের মতন হুট করে একে অন্যের কাছে যেতে পারেন না, অনেক রকম বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠানের ভড়ং ছাড়া তাঁদের চলে না। এই দুজনের সাক্ষাৎকারের জন্য কারুর মধ্যস্থতার প্রয়োজন।

তাতে কোনও অসুবিধা নেই। কুচবিহারের রাজপরিবারের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের এখন কুটুম্বিতার সম্পর্ক। স্বর্ণকুমারী দেবীর পুত্র জ্যোৎস্নানাথ বিয়ে করেছে এই রাজ পরিবারের এক কন্যাকে। নববিধান ও আদি ব্রাহ্ম সমাজ, এই দুই সম্প্রদায়ের সঙ্গেই কুচবিহার রাজবাড়ির সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে।

কুচবিহারের রাজা ও রাজপুত্ররা শিক্ষিত তো বটেই, জীবনযাত্রায় অনেকটা পাশ্চাত্য ভাবাপন্ন। তবে কলকাতা, দার্জিলিং বা লন্ডনে তাঁদের মহিলারা প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করলেও, কুচবিহার রাজ্যে তাঁরা পদানশীন, সেখানে বংশানুক্রমিক রীতিনীতি মেনে চলেন। রাধাকিশোর ত্রিপুরা ও বাংলার বাইরে কোথাও যাননি, নৃপেন্দ্রনারায়ণের কাছে ইওরোপ পর্যন্ত জলভাত। রাধাকিশোর অন্তর্মুখী, মৃদুভাষী এবং কিছুটা ঘরকুনো, নৃপেন্দ্রনারায়ণ বহির্মুখী, খেলাধুলা ও শিকারে দক্ষ। কেশব সেনের কন্যা, মহারানি সুনীতি দেবীর অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ একাধিক গল্প বানিয়ে শুনিয়েছেন। এখনও দেখা হলেই তিনি রবীন্দ্রনাথের কাছে ভূতের গল্প শোনবার বায়না করেন।

নৃপেন্দ্রনারায়ণের সঙ্গে দেখা করতে এসে রবীন্দ্রনাথ কথায় কথায় দেশীয় রাজাদের মধ্যে একতাবন্ধনের বিষয়টি তুললেন। এখন তো আর প্রতিবেশী রাজ্যগুলির পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহের প্রশ্ন নেই, মাঝখানে ইংরেজ চোখ রাঙিয়ে আছে, এখন বরং দেশীয় রাজারা যদি পরস্পরকে সাহায্য করেন, তা হলে তাঁদেরই শক্তি বৃদ্ধি পাবে।

নৃপেন্দ্রনারায়ণ এসব ব্যাপার নিয়ে কখনও মাথা ঘামাননি, সুনীতি দেবী রবীন্দ্রনাথের প্রস্তাব শুনে বললেন, ঠিকই ভো। ত্রিপুরা রাজ্যটি এত কাছে, অথচ ওদের সম্পর্কে আমরা কত কম জানি। রবিবাবু, শুনি তো ওখানকার রাজার সঙ্গে আপনার খুব সৌহার্দ্য, আপনি ত্রিপুরায় গেছেন?

রবীন্দ্রনাথ বললেন, শীঘ্রই যাবার ইচ্ছে আছে। সুনীতি দেবী জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কুচবিহারে আসবেন না?

রবীন্দ্রনাথ হেসে বললেন, ডাকলেই ছুটে যাব। রাজসভার আহ্বান পেলে কোন কবি উপেক্ষা করতে পারে?

একটু পরে তিনি আবার বললেন, বেয়ান, আপনার স্বামী ব্যস্ত মানুষ, সাহেব-সুবোদের সঙ্গে সবসময় ঘোরা ফেরা করতে হয়। দুই রাজার সম্মিলন হওয়া বিশেষ দরকার। আপনিই তার উদ্যোগ নিন না।

সুনীতি দেবী বললেন, অবশ্যই। তা হলে একটা শুভদিন ঠিক করা যাক।

সেই শুভদিন পর্যন্ত অবশ্য রবীন্দ্রনাথ অপেক্ষা করতে পারলেন না। দার্জিলিং থেকেই প্রিয়নাথ সেনের সঙ্গে চিঠি চালাচালি চলছিল, প্রিয়নাথ এক চিঠিতে জানালেন যে, মেয়ে দেখার ব্যাপারে যে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছিল, তা কেটে গেছে। এবার পাত্র স্বয়ং হস্তক্ষেপ করেছে, প্রিয়নাথের অনুরোধে সে জানিয়েছে যে পাত্র-পক্ষই ঠাকুরবাড়িতে যাবে, সেখানে পাকাঁদেখার অনুষ্ঠান হবে। এবার রবীন্দ্রনাথের দ্রুত ফেরা দরকার।

বিবাহ-বাসর হল বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালিয়ে। ইংরেজি শতাব্দী শেষ হতেই সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে এই এক নতুন আলো, বিদ্যুৎ। শুধু আলো নয়, এই বিদ্যুৎকে কাজে লাগাবার অসীম সম্ভাবনা। অনেকে বিস্ময়ে বলাবলি করছে, এই নতুন শতাব্দী হবে বিদ্যুতের যুগ।

ঠাকুর বাড়িতে আর কোনও উৎসবে এমন আলোর ঝলমলানি দেখা যায়নি। এই উৎসবের রাতে কন্যার পিতাই যেন সবচেয়ে তৃপ্ত মানুষ। শেষ পর্যন্ত শেষরক্ষা হয়েছে, সব কিছুই সম্পন্ন হল সুষ্ঠু ভাবে। ঋজু স্বভাব, বিনয়ী অথচ দৃঢ়চরিত্র জামাইটিকেও তাঁর খুব পছন্দ হল।

এরপর মাস দেড়েক যেতে না যেতেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর দ্বিতীয়া কন্যা রেণুকার বিয়ে দেবার জন্য উঠেপড়ে লাগলেন। ঠাকুরবাড়িতে ছেলেমেয়ের সংখ্যা কম নয়, হঠাৎ যেন তাদের বিয়ের একটা ধুম। পড়ে গেছে। এই বছরেই হুড়োহুড়ি করে এত বিবাহের কারণ কী?

প্রকৃত কারণটি স্বার্থগত, তা অবশ্য কেউই স্বীকার করবে না প্রকাশ্যে। কিংবা চিন্তাটি হয়তো অনেকেরই অবচেতনে সুপ্ত। এখন পর্যন্ত এ পরিবারের সকলেরই বিবাহের খরচ দেন দেবেন্দ্রনাথ তাঁর নিজস্ব তহবিল থেকে। অশীতিপর দেবেন্দ্রনাথ মাঝে মাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়েন, তিনি হঠাৎ কবে চলে যাবেন তার ঠিক নেই। তিনি চক্ষু বুজলেই ভাইদের মধ্যে সম্পত্তি ভাগাভাগি হয়ে যাবে, তখন সব খরচই প্রত্যেকের নিজস্ব। দেবেন্দ্রনাথ বেঁচে থাকতে থাকতে ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিতে পারলে বেশ কয়েক হাজার টাকা বাঁচানো যায়।

প্রেমতোষ বসু এক প্রেসের মালিক, রবীন্দ্রনাথের বই যত্ন করে ছাপেন। তিনি একদিন বললেন, তাঁর এক বন্ধুর ভাইপো ডাক্তার, সে আবার হোমিওপ্যাথি পড়বার জন্য বিলাত যেতে চায়। সেখানে যাবার সঙ্গতি নেই, তাই কোনও উচ্চ পরিবারে বিয়ে করার জন্য উৎসুক। রবীন্দ্রনাথ তৎক্ষণাৎ সত্যেন্দ্র ভট্টাচার্য নামে সেই ছেলেটিকে দেখতে চাইলেন, কথাবার্তা শুনে পছন্দ হয়ে গেল, ছেলেটিকে বিলেত পাঠাবার ও সেখানে পড়াশুনো চালাবার খরচ জোগানোর শর্তে রাজি হয়ে সম্বন্ধ স্থির করে ফেললেন। টাকা তো যাবে পিতার তহবিল থেকে। মাত্র তিন দিন পরেই তারিখ।

মাধুরীলতার বিবাহ হয়েছিল ১লা আষাঢ়, রেণুকার বিবাহ হল ২১ শে শ্রাবণ। রেণুকার বয়েস মাত্র সাড়ে দশ। যে-কবি এক সময় বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে লেখালেখি করেছিলেন, এখন প্রয়োজনের তাগিদে তা বিস্মৃত হলেন। কবি নয়, কন্যার পিতা হিসেবে তাঁর এবারের ব্যবস্থা নিখুঁত ও সার্থক।

কবিকে তার মূল্যও দিতে হল। পরের দু’তিন মাস তাঁর মাথায় একটাও কবিতা এল না, কণ্ঠে এল না নতুন গান। শুধু গদ্য!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *