একত্রিংশ পরিচ্ছেদ
ডাক্তার (গিরিশের প্রতি) — আর সব কর — but do not worship him as God (ঈশ্বর বলে পূজা করো না।) এমন ভাল লোকটার মাথা খাচ্ছ?
গিরিশ — কি করি মহাশয়? যিনি এ সংসার-সমুদ্র ও সন্দেহ সাগর থেকে পার করলেন, তাঁকে আর কি করব বলুন। তাঁর গু কি গু বোধ হয়?
ডাক্তার — গুর জন্য হচ্ছে না। আমারও ঘৃণা নাই! একটা দোকানীর ছেলে এসেছিল, তা বাহ্যে করে ফেললে! সকলে নাকে কাপড় দিলে! আমি তার কাছে আধঘণ্টা বসে! নাকে কাপড় দিই নাই। আর মেথর যতক্ষণ মাথায় করে নিয়ে যায়, ততক্ষণ আমার নাকে কাপড় দেবার জো নাই। আমি জানি সেও যা, আমিও তা, কেন তাকে ঘৃণা করব? আমি কি এঁর পায়ের ধুলা নিতে পারি না? — এই দেখ নিচ্ছি। (শ্রীরামকৃষ্ণের পদধূলি গ্রহণ।)
গিরিশ — Angels (দেবগণ) এই মুহূর্তে ধন্য ধন্য করছেন।
ডাক্তার — তা পায়ের ধুলা লওয়া কি আশ্চর্য! আমি যে সকলেরই নিতে পারি! — এই দাও! এই দাও! (সকলের পায়ের ধুলা গ্রহণ।)
নরেন্দ্র (ডাক্তারের প্রতি) — এঁকে আমরা ঈশ্বরের মতো মনে করি। কিরকম জানেন? যেমন ভেজিটেবল্ ক্রিয়েসন্ (উদ্ভিদ) ও অ্যানিম্যাল ক্রিয়েসন্ (জীবজন্তুগণ)। এদের মাঝামাঝি এমন একটি পয়েন্ট্ স্থান আছে, যেখানে এটা উদ্ভিদ কি প্রাণী, স্থির করা ভারী কঠিন। সেইরূপ Man-world (নরলোক) ও God-world (দেবলোক) এই দুয়ের মধ্যে একটি স্থান আছে, যেখানে বলা কঠিন, এ ব্যক্তি মানুষ, না ঈশ্বর।
ডাক্তার — ওহে, ঈশ্বরের কথায় উপমা চলে না।
নরেনদ্র — আমি God (ঈশ্বর) বলছি না, God like man (ঈশ্বর তুল্য ব্যক্তি) বলছি।
ডাক্তার — ও-সব নিজের নিজের ভাব চাপতে হয়। প্রকাশ করা ভাল নয়। আমার ভাব কেউ বুঝলে না। My best friends (যারা আমার পরম বন্ধু) আমায় কঠোর নির্দয় মনে করে। এই তোমরা হয়তো আমায় জুতো মেরে তাড়াবে!
শ্রীরামকৃষ্ণ (ডাক্তারের প্রতি) — সেকি! — এরা তোমায় কত ভালবাসে! তুমি আসবে বলে বাসকসজ্জা করে জেগে থাকে।
গিরিশ — Every one has the greatest respect for you. (সকলেই আপনাকে যৎপরোনাস্তি শ্রদ্ধা করে।)
ডাক্তার — আমার ছেলে — আমার স্ত্রী পর্যন্ত — আমায় মনে করে hard-hearted (স্নেহমমতা শূন্য), — কেননা, আমার দোষ এই যে, আমি ভাব কারু কাছে প্রকাশ করি না।
গিরিশ — তবে মহাশয়! আপনার মনের কবাট খোলা তো ভাল — at least out of pity for your friends (বন্ধুদের প্রতি অন্ততঃ কৃপা করে) — এই মনে করে যে, তারা আপনাকে বুঝতে পারছে না।
ডাক্তার — বলব কি হে! তোমাদের চেয়েও আমার feelings worked-up হয় (অর্থাৎ আমার ভাব হয়)। (নরেনেদ্রর প্রতি) I shed tears in solitude (আমি একলা একলা বসে কাঁদি।)
[মহাপুরুষ ও জীবের পাপ গ্রহণ — অবতারাদি ও নরেনদ্র ]
ডাক্তার (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি) — ভাল, তুমি ভাব হলে লোকের গায়ে পা দাও, সেটা ভাল নয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ — আমি কি জানতে পারি গা, কারু গায়ে পা দিচ্ছি কিনা!
ডাক্তার — ওটা ভাল নয় — এটুকু তো বোধ হয়?
শ্রীরামকৃষ্ণ — আমার ভাবাবস্থায় আমার কি হয় তা তোমায় কি বলব? সে অবস্থার পর এমন ভাবি, বুঝি রোগ হচ্ছে ওই জন্য! ঈশ্বরের ভাবে আমার উন্মাদ হয়। উন্মাদে এরূপ হয়, কি করব?
ডাক্তার — ইনি মেনেছেন। He expresses regret for what he does; কাজটা sinful (অন্যায়) এটি বোধ আছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (নরেন্দ্রের প্রতি) — তুই তো খুব শঠ (বুদ্ধিমান), তুই বল না; একে বুঝিয়ে দে না।
গিরিশ (ডাক্তারের প্রতি) — মহাশয়! আপনি ভুল বুঝেছেন। উনি সে জন্য দুঃখিত হননি। এঁর দেহ শুদ্ধ — অপাপবিদ্ধ। ইনি জীবের মঙ্গলের জন্য তাদের স্পর্শ করেন। তাদের পাপ গ্রহণ করে এঁর রোগ হবার খুব সম্ভাবনা, তাই কখনও কখনও ভাবেন। আপনার যখন কলিক (শূলবেদনা) হয়েছিল তখন আপনার কি রিগ্রেট (দুঃখ) হয় নাই, কেন রাত জেগে এত পড়তুম? তা বলে রাত জেগে পড়াটা কি অন্যায় কাজ? রোগের জন্য রিগ্রেট (দুঃখ-কষ্ট) হতে পারে। তা বলে জীবের মঙ্গলসাধনের স্পর্শ করাকে অন্যায় কাজ মনে করবেন না।
ডাক্তার (অপ্রতিভ হইয়া, গিরিশের প্রতি) — (তোমার কাছে হেরে গেলুম, দাও পায়ের ধুলা দাও। (গিরিশের পদধূলি গ্রহণ)। (নরেন্দ্রের প্রতি) — আর কিছু নয় হে, his intellectual power (গিরিশের বুদ্ধিমত্তা) মানতে হবে।
নরেন্দ্র (ডাক্তারের প্রতি) — আর-এককথা দেখুন। একটা Scientific discovery (জড় বিজ্ঞানের সত্য বাহির) করবার জন্য আপনি life devote (জীবন উৎসর্গ) করতে পারেন — শরীর, অসুখ ইত্যাদি কিছুই মানেন না। আর ঈশ্বরকে জানা grandest of all sciences (শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান)-এর জন্য ইনি health risk (শরীর নষ্ট হয় হউক, এরূপ মনের ভাব) করবেন না?
ডাক্তার — যত religious reformer (ধর্মাচার্য) হয়েছে, Jesus (যীশু), চৈতন্য, বুদ্ধ, মহম্মদ শেষে সব অহংকারে পরিপূর্ণ — বলে, ‘আমি যা বললুম, তাই ঠিক!’ এ কি কথা!
গিরিশ (ডাক্তারের প্রতি) — মহাশয়, সে দোষ আপনারও হচ্ছে! আপনি একলা তাদের সকলের অহংকার আছে, এ দোষ ধরাতে ঠিক সেই দোষ আপনারও হচ্ছে।
ডাক্তার নীরব হইলেন।
নরেন্দ্র (ডাক্তারের প্রতি) — We offer to him Worship bordering on Divine Worship (এঁকে আমরা পূজা করি — সে পূজা ঈশ্বরের পূজার প্রায় কাছাকাছি) —
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ আনন্দে বালকের ন্যায় হাসিতেছেন।