সপ্তদশ পরিচ্ছেদ
বিজয়াদি ভক্তসঙ্গে প্রেমানন্দে
কিয়ৎক্ষণ পরে শ্রীযুক্ত বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী পরমহংসদেবকে দর্শন করিতে আসিলেন। সঙ্গে কয়েকটি ব্রাহ্মভক্ত। বিজয়কৃষ্ণ ঢাকায় অনেক দিবস ছিলেন। আপাততঃ পশ্চিমে অনেক তীর্থ ভ্রমণের পর সবে কলিকাতায় পৌঁছিয়াছেন। আসিয়া ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন। অনেকে উপস্থিত ছিলেন, — নরেন্দ্র, মহিমা চক্রবর্তী, নবগোপাল, ভূপতি, লাটু, মাস্টার, ছোট নরেন্দ্র ইত্যাদি অনেকগুলো ভক্ত।
মহিমা চক্রবর্তী (বিজয়ের প্রতি) — মহাশয়, তীর্থ করে এলেন, অনেক দেশ দেখে এলেন, এখন কি দেখলেন বলুন।
বিজয় — কি বলব! দেখছি, যেখানে এখন বসে আছি, এইখানেই সব। কেবল মিছে ঘোরা! কোন কোন জায়গায় এঁরই এক আনা কি দুই আনা, কোথাও চারি আনা, এই পর্যন্ত। এইখানেই পূর্ণ ষোল আনা দেখছি!
মহিমা চক্রবর্তী — ঠিক বলছেন, আবার ইনিই ঘোরান, ইনিই বসান!
শ্রীরামকৃষ্ণ (নরেন্দ্রের প্রতি) — দেখ, বিজয়ের অবস্থা কি হয়েছে। লক্ষণ সব বদলে গেছে, যেন সব আউটে গেছে। আমি পরমহংসের ঘাড় ও কপাল দেখে চিনতে পারি। বলতে পারি, পরমহংস কি না।
মহিমা চক্রবর্তী — মহাশয়! আপনার আহার কমে গেছে?
বিজয় — হাঁ, বোধ হয় গিয়েছে। (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি) — আপনার পীড়ার কথা শুনে দেখতে এলাম। আবার ঢাকা থেকে —
শ্রীরামকৃষ্ণ — কি?
বিজয় কোন উত্তর দিলেন না। খানিকক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন।
বিজয় — ধরা না দিলে ধরা শক্ত। এইখানেই ষোল আনা।
শ্রীরামকৃষ্ণ — কেদার[1] বললে, অন্য জায়গায় খেতে পাই না — এখানে এসে পেট ভরা পেলুম!
মহিমা চক্রবর্তী — পেট ভরা কি? উপচে পড়ছে!
বিজয় (হাতজোড় করিয়া শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি) — বুঝেছি আপনি কে! আর বলতে হবে না!
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভাবস্থ) — যদি তা হয়ে থাকে, তো তাই।
বিজয় — বুঝেছি।
এই বলিয়া শ্রীরামকৃষ্ণের পাদমূলে পতিত হইলেন ও নিজের বক্ষে তাঁহার চরণ ধারণ করিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ তখন ঈশ্বরাবেশে বাহ্যশূন্য চিত্রার্পিতের ন্যায় বসিয়া আছেন।
এই প্রেমাবেশ, এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখিয়া উপস্থিত ভক্তেরা কেহ কাঁদিতেছেন, কেহ স্তব করিতেছেন। যাঁহার যে মনের ভাব তিনি সেই ভাবে একদৃষ্টে শ্রীরামকৃষ্ণের দিকে চাহিয়া রহিলেন! কেহ তাঁহাকে পরমভক্ত, কেহ সাধু, কেহ বা সাক্ষাৎ দেহধারী ঈশ্বরাবতার দেখিতেছেন, যাঁহার যেমন ভাব।
মহিমাচরণ সাশ্রুনয়নে গাহিলেন — দেখ দেখ প্রেমমূর্তি — ও মাঝে মাঝে যেন ব্রহ্মদর্শন করিতেছেন, এই ভাবে বলিতেছেন —
“তুরীয়ং সচ্চিদানন্দম্ দ্বৈতাদ্বৈতবিবর্জিতম্।”
নবগোপাল কাঁদিতেছেন। আর একটি ভক্ত ভূপতি গাহিলেন:
জয় জয় পরব্রহ্ম অপার তুমি অগম্য
পারাৎপর তুমি সারাৎসার।
সত্যের আলোক তুমি প্রেমের আকর ভূমি,
মঙ্গলের তুমি মূলাধার।
নানা রসযুত ভব, গভীর রচনা তব,
উচ্ছ্বসিত শোভায় শোভায়,
মহাকবি আদিকবি, ছন্দে উঠে শশী রবি,
ছন্দে পুনঃ অস্তাচলে যায়।
তারকা কনক কুচি, জলদ অক্ষর রুচি,
গীত লেখা নীলাম্বর পাতে।
ছয় ঋতু সম্বৎসরে, মহিমা কীর্তন করে,
সুখপূর্ণ চরাচর সাথে।
কুসুমে তোমার কান্তি, সলিলে তোমার শান্তি,
বজ্ররবে রুদ্র তুমি ভীম;
তব ভাব গূঢ় অতি, কি জানিবে মূঢ়মতি,
ধ্যায় যুগযুগান্ত অসীম।
আনন্দে সবে আনন্দে, তোমার চরণ বন্দে,
কোটি চন্দ্র কোটি সূর্য তারা!
তোমারি এ রচনারি, ভাব লয়ে নরনারী,
হাহাকারে নেত্রে বহে ধারা।
মিলি সুর, নর, ঋভু, প্রণমে তোমায় বিভু
তুমি সর্ব মঙ্গল-আলয়;
দেও জ্ঞান, দেও প্রেম, দেও ভক্তি, দেও ক্ষেম,
দেও দেও ওপদে আশ্রয়।
ভূপতি আবার গাহিতেছেন:
[ঝিঁঝিট — (খয়রা) কীর্তন ]
চিদানন্দ সিন্ধুনীরে প্রেমানন্দের লহরী।
মহাভাব রসলীলা কি মাধুরী মরি মরি
বিবিধ বিলাস রসপ্রসঙ্গ, কত অভিনব ভাবতরঙ্গ,
ডুবিছে উঠিছে করিছে রঙ্গ, নবীন নবীন রূপ ধরি,
(হরি হরি বলে)
মহাযোগে সমুদয় একাকার হইল,
দেশ-কাল ব্যবধান ভেদাভেদ ঘুচিল,
(আশা পুরিল রে, আমার সকল সাধ মিটে গেল!)
এখন আনন্দে মাতিয়া দুবাহু তুলিয়া, বলরে মন হরি হরি।
[ঝাঁপতাল ]
টুটল ভরম ভীতি ধরম করম নীতি
দূর ভেল জাতি কুল মান;
কাঁহা হাম, কাঁহা হরি, প্রাণমন চুরি করি,
বঁধূয়া করিলা পয়ান;
(আমি কেনই বা এলাম গো, প্রেমসিন্ধুতটে),
ভাবেতে হল ভোর, অবহিঁ হৃদয় মোর
নাহি যাত আপনা পসান,
প্রেমদার কহে হাসি, শুন সাধু জগবাসী,
এয়সাহি নূতন বিধান।
(কিছু ভয় নাই! ভয় নাই!)
অনেকক্ষণ পরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ প্রকৃতিস্থ হইলেন।
[ব্রহ্মজ্ঞান ও ‘আশ্চর্য গণিত’ — অবতারের প্রয়োজন ]
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — কি একটা হয় আবেশে; এখন লজ্জা হচ্ছে। যেন ভূতে পায়, আমি আর আমি থাকি না।
“এ-অবস্থার পর গণনা হয় না। গণতে গেলে ১-৭-৮ এইরকম গণনা হয়।”
নরেন্দ্র — সব এক কিনা!
শ্রীরামকৃষ্ণ — না, এক দুয়ের পার![2]
মহিমাচরণ — আজ্ঞা হাঁ, দ্বৈতাদ্বৈতবিবর্জিতম্।
শ্রীরামকৃষ্ণ — হিসাব পচে যায়! পাণ্ডিত্যের দ্বারা তাঁকে পাওয়া যায় না। তিনি শাস্ত্র, — বেদ, পুরাণ, তন্ত্রের — পার। হাতে একখানা বই যদি দেখি, জ্ঞানী হলেও তাঁকে রাজর্ষি বলে কই। ব্রহ্মর্ষির কোন চিহ্ন থাকে না। শাস্ত্রের কি ব্যবহার জানো? একজন চিঠি লিখেছিল, পাঁচ সের সন্দেশ ও একখানা কাপড় পাঠাইবে। যে চিঠি পেলে সে চিঠি পড়ে, পাঁচ সের সন্দেশ ও একখানা কাপড়, এই কথা মনে রেখে চিঠিখানা ফেলে দিলে! আর চিঠির কি দরকার?
বিজয় — সন্দেশ পাঠানো হয়েছে, বোঝা গেছে!
শ্রীরামকৃষ্ণ — মানুষদেহ ধারণ করে ঈশ্বর অবতীর্ণ হন। তিনি সর্বস্থানে সর্বভূতে আছেন বটে, কিন্তু অবতার না হলে জীবের আকাঙ্খা পুরে না, প্রয়োজন মেটে না। কিরকম জানো? গরুর যেখানটা ছোঁবে, গরুকে ছোঁয়াই হয় বটে। শিঙটা ছুঁলেও গাইটাকে ছোঁয়া হল, কিন্তু গাইটার বাঁট থেকেই দুধ হয়। (সকলের হাস্য)
মহিমা — দুধ যদি দরকার হয়, গাইটার শিঙে মুখ দিলে কি হবে? বাঁটে মুখ দিতে হবে। (সকলের হাস্য)
বিজয় — কিন্তু বাছুর প্রথম প্রথম এদিক-ওদিক ঢুঁ মারে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (হাসিতে হাসিতে) — আবার কেউ হয়তো বাছুরকে ওইরকম করতে দেখে বাঁটটা ধরিয়ে দেয়। (সকলের হাস্য)
১ শ্রীযুক্ত কেদারনাথ চাটুজ্যে অনেকদিন ঢাকায় ছিলেন। ঈশ্বরের কথা পড়লেই তাঁহার চক্ষু আর্দ্র হইত। একজন পরমভক্ত। বাটী হালিসহর।
২ এক দুয়ের পার — The Absolute as distinguished from the Relative.