৫২
রুষা বসবার ঘরে বসে ছিল। মিলি টুসুর স্কুল খুলে গেছে জানুয়ারির প্রথমেই। ফেব্রুয়ারিতেই শীত কমতে শুরু করেছিল এখন সরস্বতী পুজোর পর শীতের প্রকোপ বেশ কমে গেছে। তবে এইসব জঙ্গুলে এলাকাতে শীত থাকবে মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত। আমেজ, এপ্রিলেও।
ভিনোদ আজ লাঞ্চ খাবে বলেছে এসে। দুখীটা ভোলেভালা ছেলে। বেশি বোঝে না। কিন্তু মেরী তেমন নয়। কুক লছমার সিং লোকটাও নিজের মনেই থাকে। চালাক হচ্ছে মেরী আর অজাইব সিং। রুষা যে সাংঘাতিক কিছু ঘটাতে যাচ্ছে তা ওরা দুজনেই যেন আঁচ করতে পেরেছে। এই দুজনেরই পৃথুর প্রতি এক বিশেষ দুর্বলতা আছে, হয়তো এক বোকা লোকের প্রতি অন্য বোকা লোকের থাকেই। এবং আছে বলেই, মেরীকে কাল রাতে দু’দিনের জন্যে ছুটি দিয়ে দিয়েছে রুষা। ছুটিটা মেরী নিতে চেয়েছিল পরের সপ্তাহের শেষে। কিন্তু রুষা এ সপ্তাহেই ওকে প্রায় জোর করেই পাঠিয়েছে। অজাইব সিংকেও ছুটি দিয়েছে। বলেছে, গাড়ি নিয়েই ওর বাড়িতে যেতে। সেখানে খেয়ে ও ঘুমিয়ে যেন বিকেলে মিলি ও টুসুকে স্কুল থেকে তুলেই ফেরে একেবারে। বাজারে দু’একটি কাজও দিয়ে দিয়েছে সেই সঙ্গে, বাহানা হিসেবে।
অজাইব সিং সবই বুঝেছে। আগে আগে ও মজা পেত। গাড়ির ক্যাসেট প্লেয়ারে ওর ক্যাসেট চাপিয়ে কেস গড়বড়-সড়বড় হলেই ও ওর প্রিয় গান ‘ঝুমকা গীড়ারে, ব্যারিলিকা বাজারমে ঝুমকা গীড়ারে’ শুনত। কিন্তু আজকাল ওর মনটা খারাপ লাগে। বিশেষ করে, পৃথুর পা কাটা যাওয়ার পর। শুনছে, তার সাহাব নাকি চাকরি ছেড়ে দেবেন। তার উপর মেমসাহেবের এই বেলেল্লাপনা। আওরতদের সব সময়ই ডাণ্ডার উপরে রাখতে হয়। জরু আর গরু শক্ত হাতে না সামলালে, থাকে না। ঢাল পেলেই, আওরত জলেরই মতো গড়িয়ে যায়। কোন জাহান্নামে যাচ্ছে যে, তা যাচাই না করেই। শুধু গড়ানোতেই আনন্দ ওদের।
অজাইব সিংয়ের নিজের আওরতেরও এই রকম ভীমরতি ধরেছিল একবার। তখনও শেল্যাক কোম্পানির চাকরিটা পায়নি অজাইব সিং। কাজ করত হনুমান ট্রান্সপোর্টে। ট্রাক চালাত তখন। হেভি ভেহিকেলস-এর ড্রাইভিং লাইসেন্সও তার ছিল। লম্বা লম্বা ট্রিপ নিয়ে যেতে হত ইন্দোর, ভোপাল, উজ্জয়িন, হোশাঙ্গাবাদ ইত্যাদি ইত্যাদি জায়গাতে। লাগাতার ঘরে থাকত না সাত-আট দিন। কখনও কখনও-বা আরও বেশি। অজাইব সিংদের বস্তিতেই থাকত ওর বন্ধু, রামখিলাওন। প্রায় পাশের ঘর। শাদি-শুদা আদমি। তবুও লন্দ-ফন্দ শুরু করেছিল দোস্ত-এর আওরতের সঙ্গে। তলপেটের কাঁকড়া! কাকে যে কখন কামড়াবে কেউই জানে না। সে রাণ্ডিও ঢাল পেয়েই গড়াতে শুরু করল। সব আওরতের মধ্যেই এই গড়িয়ে যাওয়ার প্রবৃত্তি থাকেই। কম আর বেশি। একটা শাড়ি, একটা রুপোর মল, দু’খিলি পান, এমনকী একটু মিষ্টি কথাতেই তারা কী না কী যে দিয়ে বসে পরপুরুষকে, তার কোনও ঠিক-ঠিকানা নেই।
তবে অজাইব সিং তো আর পিরথু ঘোষষা নয়। একদিন বারান্দার খোঁটাতে গামছা দিয়ে কষে বেঁধে এমন ঠ্যাঙান ঠেঙিয়েছিল তার আওরতকে যে, সব হিরোইনগিরি তার শুধরে গেছিল। আওরত ঘরে থাকবে, মরদকে পেয়ার দেবে, গরম গরম রোটি সেঁকে খেতে দেবে, আওলাদ প্যায়দা করবে—এইই তার কাজ। সে ঘরের লক্ষ্মী। মরদ বাইরেটা সামলাবে, রোদে; জলে। আর আওরত ভিতরটা। তবে না?
তার মেমসাহেবের মতো পড়ে-লিখে আওরতদের নিয়েই মুশকিল। মরদদের সঙ্গে সমানে টক্কর দেবে। নিজের মরদ ছেড়ে অন্য মরদদের সঙ্গে শোবে আর নিজের মরদকে শোওয়াবে অন্যর আওরতের সঙ্গে। রহিসি আর রহিসি হালচাল দেখে সাচমুচ থেকেই গেছে একেবারে অজাইব সিং। শেষ পর্যন্ত তাকে কী যে দেখতে হবে সে সম্বন্ধে ও নিশ্চিন্ত হতে পারছে না আদৌ। এরই মধ্যে একদিন মেমসাহেব জিজ্ঞেস করেছিলেন, সে ইদুরকার সাহেবের কাছে চাকরি করবে কিনা। অজাইব সিং চমকে উঠে বলেছিল, কাহে মেমসাব?
নাঃ। এমনিই জিজ্ঞেস করছি।
মেমসাব বলেছিলেন।
নেহি মেমসাব।
কেন, না?
হামারা সাহাব কা মাফিক সাহাব মিলেগা কাঁহা?
কেন? এত বড়লোক ইদুরকার সাহেব! মার্ডিডিস গাড়ি চালাবে। বেশি মাইনে পাবে। থাকার কোয়ার্টার। কোয়ার্টারে পাখা-টাখা সব আছে।
নেহি মেমসাব। জাদা পইসা হোনেসেই আদমি খরাব হো যাতা হ্যায়।
আরও কী যেন বলতে গিয়েও থেমে গেছিল অজাইব সিং। ভেবে পায়নি, ঠিক কী করে বলবে সে রুষাকে যে; তার পান-চিবুনো, নস্যি-নেওয়া, পায়দল চলে-বেড়ানো পাগলা সাহাব তাকে বাড়ি করে দিয়েছে নিজের জমি বিক্রি করে, তার বোনের বিয়ে দিয়েছে নিজের বিলাইতি রাইফেল বিক্রি করে। পৃথু ঘোষের মতো মালিক সে কোথায় পাবে? চাকরি যদি নাও করে সে আর, তবু এই কৃতজ্ঞতাবোধ তো থাকবেই! ওরা তো আর পড়ে-লিখে-শেখা ভদ্রলোক নয়। কৃতজ্ঞতাবোধকে ওরা এখনও মনুষ্যত্বর বড় এক অঙ্গ বলেই জানে। আধুনিক তো হয়নি এখনও অজাইব সিংরা। হতে চায়ও না।
রুষা, কথাটা ওঠানোতেই; অজাইব সিংয়ের বুকের মধ্যে ধ্বক্ করে উঠেছিল।
তবে কি, রুষা ইদুরকার সাহেবের সঙ্গেই থাকবে? তার সাহেবকে এই অবস্থায় ফেলে রেখে? পারবে? আওরতদের মন নাকি খুব নরম হয়? কী করে পারবে? ছিঃ ছিঃ!
রুষা ঘড়ি দেখল একবার। এতক্ষণে ভিনোদের চলে আসার কথা ছিল।
পৃথু হাসপাতালে ভর্তি হবার পর না বলে-কয়ে কোথা থেকে যে সব আন-জান আজেবাজে লোক চলে আসে তার খাল-খরিয়াৎ শুধোতে! কিছু বাজে লোককে চিনতোও পৃথু! ডিসগাস্টিং।
বাইরে গাড়ির শব্দ হল। উঠে, দরজা খুলে দিল রুষা। ভিনোদ নিজেই গাড়ি চালিয়ে এসেছে। রুপোলি ফিয়াট। দু’ বছরের মধ্যে ভিনোদ হৈহৈ করে বড়লোক হয়ে গেছে। নিজের অধিকারেই। নিজের পিতা পিতামহর সম্পত্তি ও সম্পদের কথা ছেড়েই বলছে রুষা। জিওমেট্রিক্যাল প্রগ্রেশানে বড়লোক, চাকচিক্যময় হয়েছে ভিনোদ। এবং ঠিক ওইভাবেই হতশ্রী এবং অর্থহীন হয়ে গেছে পৃথু। এই ইনফ্লেশান! বাঁধা মাইনের চাকরি! এক পয়সাও উপরি রোজগার নেই। সহজেই উপায় করার উপায় থাকা সত্ত্বেও এক পয়সাও উপরি রোজগার করে না পৃথু। আ স্ট্রেঞ্জ পার্সন। আটার ইডিয়ট। যাকগে, যা হবার হয়ে গেছে। এভরিথিং হ্যাজ আ প্রাইস। অ্যান্ড স্ট্রেঞ্জনেস ইজ নো একসেপশান। ওয়েল মাই ডিয়ার পৃথু, য়্যু হ্যাভ টু পে দ্যা প্রাইস ফর ইওর ইডিওসিনক্রেসিস, ইওর সেলফিশ স্ট্রেঞ্জনেস।
মুশকিল হয়েছে টুসুটাকে নিয়ে। মিলি ইজ আ গেম। ও তো নতুন, সচ্ছল, এয়ারকন্ডিশানড জীবনের জন্যে উন্মুখই হয়ে আছে। টুসু স্ট্রেঞ্জ স্ট্যান্স নিয়েছে একটা। বোঝা যাচ্ছে না ঠিক ওকে। বাবার রক্তের স্ট্রেঞ্জনেসের অনেকটাই পেয়েছে ছেলেটা। বাবাকে ভালও বাসে খুব। অথচ ওর বাবা ওর জন্যে কিছুমাত্রও করেনি। অন্য সব ছেড়েই দিল, কোনওদিন একটু সময় পর্যন্ত দেয়নি নিজের ছেলেকে। এই রকম বাবার প্রতিও কী করে যে কোনও ফীলিংস গড়ে উঠল ছেলের দিক থেকে, তা ভাবাও যায় না।
ভিনোদ বলল, হাই।
হাই! বলল রুষা।
দরজাটা বন্ধ করেই বসবার ঘরেই রুষাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল ভিনোদ। নিংড়ে নিল রুষার কমলালেবুর কোয়ার মতো ঠোঁটের স্বাদু সিক্ততা।
রুষা ধমকে, আবেগরুদ্ধ গলায় বলল, এনাফ, এনাফ। এভরিথিং হ্যাজ আ টাইম, হ্যাজ আ প্লেস…
আরেকটা চকিত চুমু খেয়ে ও বলল, ইয়া! বাট য়্যু আর মাইন, ফর এভার। এভরিটাইম ইজ রুষা-টাইম।
ওরা বসবার ঘরেই বসল।
রুষা বলল, তোমার কথামতই তোমার প্রিয় পদ আজ রান্না হয়েছে।
কী?
ক্র্যাব, চাইনিজ স্টাইল আর ক্যাভিয়ার। অনেক কষ্টে মিঃ গাঙ্গুলীকে দিয়ে বম্বে থেকে আনিয়েছিলাম।
না আনালেও পারতে। ওই গাঙ্গুলী একটা গসিপ-মঙ্গার মেয়েছেলে!
আই ডোন্ট কেয়ার।
রুষা বলল, দু’দিকে দু’হাত তুলে। কেয়ার ফর আ ড্রিঙ্ক? হোয়াট? ভডকা?
নাঃ। আজকে বীয়ারই খাব। আছে ফ্রিজে? কাল রাতে মেহেরোত্রার বাড়ি পাটি ছিল। ওঃ। অনেকগুলো হুইস্কি খাওয়া হয়ে গেছে। জানো তো? কালকেই আমাদের সোয়াবিন একস্ট্রাকশান প্লান্টের ফাউন্ডেশান স্টোন লে করা হল।
তাইই…?
রুষা বলল, সোয়াবিন একস্ট্রাকশান প্লান্টের ভাবী মালকিনের মতো গলায়।
তারপর ডাকল, দুখী। ‘দু’ অক্ষরটার উপর জোর দিয়ে, লম্বা করে টেনে ‘খী’টা ছোট্ট করে বলল, নিচু পর্দায়।
দুখী এসে বলল, জী মেমসাব।
সাবকা লিয়ে বীয়ার লাও। ফ্রিজমে হ্যায়। ট্রেমে বীয়ার মাগ্ লে কর আও।
আর তুমি?
নাঃ। থাক।
হোয়াই? থাকবে কেন? তোমাকে একটা স্ক্রু-ড্রাইভার বানিয়ে দিই আমি?
ভিনোদ বলল।
রুষা হেসে অস্ফুটে বলল, আমার কি হয়েছে জানি না। আজকাল। ড্রিঙ্ক করলেই…
কী? ড্রিঙ্ক করলে কী…?
আই ফীল লাইক বীয়িং স্ক্রুড। নট টু স্পীক অফ আ স্ক্রু-ড্রাইভার!
বলেই, লজ্জায় লাল হওয়া মুখটি অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিল রুষা।
হাঃ হাঃ হাঃ। করে হেসে লাফিয়ে উঠল সোফা ছেড়ে ভিনোদ ইদুরকার। বলল, দ্যাটস লাইক মাই গ্যাল্। উ্য রিয়্যালী আর “মাই কাপ অফ টী” ডার্লিং। তাহলে তো খেতেই হবে তোমার। আমি বানিয়ে দিচ্ছি।
রুষার মুখ লজ্জায় এবং এক নিষিদ্ধ ভাললাগায় লাল হয়ে রইল।
মাঝে মাঝে কী করে যে এত নির্লজ্জ হয়ে ওঠে আজকাল, ও নিজেই ভেবে পায় না। কে জানে, তার শিক্ষা, তার আধুনিকতাই বোধহয় তাকে এই নির্লজ্জতা দিয়েছে। দিয়েছে, সব ভারতীয় আধুনিক মেয়েদেরই। অনেক হাজার বছর ঘোমটার আড়ালে থেকে, পুরুষের ভোগের সামগ্রী হয়ে, ইচ্ছের বাহক হয়ে হয়ে তাদের নিজেদেরও যে জীবনে কোনও ভূমিকা আছে, স্বাধীনতা আছে, স্বাধীন ভাবে মনের ভাব, সত্যি ভাব প্রকাশ করার উপায় আছে এসব তো ভুলেই গেছিল ওরা। ইঁট-চাপা ঘাসের মতো ফ্যাকাসে, ইচ্ছের রক্তশূন্যতায় ভুগেছিল ওরা। কিন্তু এখন এক নতুন যুগ এসেছে। এই যুগে রুষারাও ভিনোদদের মতে, পৃথুদেরই মতো নিজের নিজের জীবন, নিজের নিজের ভালো লাগা, নিজের নিজের ইচ্ছাকে নিয়ে খেয়ালখুশিমত বাঁচবে, কারও কাছে কোনও জবাবদিহি না করেই। যাকেই ভাল লাগে, তাকেই সব দেবে। খোঁটায়-বাঁধা গাভীর মতো সকাল-সন্ধেতে তাদের মালিক গোয়ালাদের মাপা-দুধের সরবরাহ বন্ধ করবে তারা। প্রত্যেকেরই জীবন তাদেরই। স্বাদু, মনোরম; পুরুষের আলিঙ্গনেরই মতো গাঢ় উষ্ণ হয়ে উঠবে, দিন থেকে দিনে।
ভিনোদ উঠে গিয়ে ফ্রিজ খুলে রুষার জন্যে স্ক্রু-ড্রাইভার বানিয়ে নিয়ে এল। ততক্ষণে দুখী ট্রেতে করে, ট্রের উপর লেস্-এর ছোট্ট কভার দিয়ে বীয়ার-মাগ আর বীয়ার নিয়ে এল। অন্য ট্রেতে ওয়েফার চিপস, কাজু আর সেঁকা পাঁপড়।
ভিনোদকে এই জন্যেই ভাল লাগে এত রুষার। ওর হাবভাব একেবারে সাহেবদের মতো। টেনীসনের ‘এনক-আর্ডন’ কবিতার নায়কদেরই মতো তার বিবাহিত স্বামী পৃথু আর ভিনোদ। দুজনে দুই মেরুর লোক। পৃথুদের কবিতা বা উপন্যাস পড়ে কিছুক্ষণের জন্যে এক উচ্চমার্গের ভাললাগাতে আপ্লুত হওয়া যায় মাত্র, কিন্তু তাদের নিয়ে ঘর করার বড়ই অসুবিধে। জীবনে, রক্ত মাংস, জীবনীশক্তির যত বড় ও ব্যাপক ভূমিকা সাহিত্যর বা কাব্যর ততখানি কখনওই নয়। পৃথুর মতো ন্যাদনেদে, আলসে, ঘর-বিমুখ মানুষ যদি অন্যর স্বামী হত, তবে তাকে দূর থেকে ভালবাসা যেত; এমনকী তার ফোটোও দেওয়ালে টানিয়ে মস্ত বড় কবি বলে হৃদয়ের সব নৈবেদ্য দেওয়া যেত কিন্তু হৃদয়ই তো মানুষের শরীরের একমাত্র যন্ত্র নয়! শরীর, শরীরকে চায়। নারী মাত্রই সিকিওরিটি, অর্থ, আরাম, বিলাস চায়। চিরন্তন নারী তাইই চেয়ে এসেছে। আগেকার দিনে তাই রাজা মহারাজাকে বিয়ে করেছে তারা, এখন ভিনোদের মতো ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্টকে করে। মহাকবি কালিদাস বা মিঞা তানসেন, বা বীটোভেন বা মোৎজার্টকে রাজদরবারে বা ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্টের ড্রইংরুমে নেমন্তন্ন করে পঞ্চাশ হাজার টাকা দামের শাল উপহার দিয়ে শিরোপা দেওয়া যায়, তাদের সবাইকেই বেডরুমে আনা যায় না। ঘর তো করাই যায় না ওইসব মুডি সেন্টিমেন্টাল, স্ট্রেঞ্জ লোকদের সঙ্গে। পৃথু, এই সরল সত্যটা কোনওদিনও বুঝল না। বুঝল না বলেই, তাকে আঘাত পেতে হবে। সুন্দরী নারী, এই সুন্দর পৃথিবীরই মতো বীরভোগ্যা। বাঘ-মারার বীরত্বটা কোনও বীরত্ব নয় এই যুগে, মহাকবি হওয়াও আজকাল মুর্খদেরই সাজে। জীবনে যারা নায়ক-নায়িকা তাদের নিয়ে পৃথুরা লিখবে, চিরদিন লিখে এসেছে। নিজেরা কোনওদিনও নিজেদের জীবনে নায়ক অথবা নায়িকা হতে পারবে না ওরা। দিস ইজ রিয়্যালিটি! ইয়া। দিস ইজ। পৃথু হ্যাজ টু ফেস ইট। রুষা কান্ট হেল্প ইট। নট এনী মোর!
বরফ লাগবে আর? তোমার?
ভিনোদ জিজ্ঞেস করল।
নো। থ্যাঙ্ক উ্য!
তোমার বেডরুমে নতুন পর্দা লেগে গেছে। নতুন পেলমেট। যেমন বলেছিলে, পুরনো বাথরুম ভেঙে ফেলে, বাথরুমটা পিংক করে দিয়েছি। পিংক বাথ-টাব, পিংক টাইলস, পিংক ওয়াশ-বেসিন, কমোড, বিদে: সবই পিংক। তোমার ন্যুডিটির পিংকের সঙ্গে বাথরুমের পিংক মিশে যাবে। বাথরুমের দরজায় একটা কী-হোল লাগিয়েছি। তুমি যখন চান করবে, তোমায় দেখব আমি কী-হোল দিয়ে। যেন, তোমায় পেতে চাই, কিন্তু পাবার কোনওই উপায় নেই। দারুণ হবে, না?
উ্য আর আ পারভার্ট!
রুষা বলল।
ওল মেন আর। কেউ সারফেস-এ, কেউ গভীরে। তাছাড়া পারভার্ট বলছ কেন? জীবনকে ভালবাসা, শরীরকে ভালবাসা নিত্য নতুন ভাবে একে অন্যকে পাওয়াকে যারা পারভার্সন বলে, তারা নিজেরাই পারভার্ট। হীপোক্রিট।
রুষা কথা ঘুরিয়ে বলল, টুসুকে নিয়েই মুশকিল। বুঝেছ। হী ইজ গেটিং ডিফিকাল্ট ডে বাই ডে।
কিছু মুশকিল নয়। আমার বাড়িতে সাতদিন থাকলেই সে তার জংলী, বাবাকে ভুলে যাবে। দেখো।
আঃ ভিনোদ। ডোন্ট বী ক্রুয়েল। ইটস ব্যাড টেস্ট। ওরকম বোলো না। ভুলে যেও না যে এখনও পৃথুকে আমি ভালবাসি। ওরকম করে বললে, আমার লাগে। প্লীজ…
মাই। মাই। এখনও ভালই যদি বাসো, তাহলে…
তুমি বুঝবে না ভিনোদ। সকলেই সব বোঝে না। পৃথু আমার জীবনে একটি অশ্বত্থগাছেরই মতো গজিয়ে গেছে। তাকে নির্মূল করি এমন সাধ্য তো আমার নেই। তাছাড়া, করার ইচ্ছেও হয়তো নেই। সেই গাছকে কেটে ফেললেও তার শিকড় থেকেই যাবে আমার গভীরে। আমার শরীরে; মনে। যতটুকু আমিকে তুমি পাও, ততটুকু নিয়েই তোমাকে সন্তুষ্ট থাকতে হবে।
আই ডোন্নো। দু’দিকে দু’হাত ছুঁড়ে দিয়ে ভিনোদ এবার বলল, য়্যু উইমেন আর আ স্ট্রেঞ্জ লট।
উই আর। ইট ওজ গডস প্ল্যান। নো ম্যান আন্ডার দ্যা সান ক্যান চেঞ্জ আস। উই আর হোয়াট উই আর। অ্যান্ড হোয়াট উই ওলওয়েজ শ্যাল বী।
বিয়ারের ফ্রথে চুমুক দিয়ে ভিনোদ বলল, আঃ। আই লাইক ফ্রথ। জীবনের সঙ্গে ফেনার দারুণ মিল আছে। তাই না? একদিন সমুদ্রের ফেনাতেই ভেসে ভেসে, প্রথম বীজ, প্রথম অ্যালগী এসে বাসা বেঁধেছিল মাটির বুকে। মাটিকে আঁকড়ে ধরে তাকে প্রাণিত করেছিল। ফেনাতেই ভেসে গিয়ে আমার বীজ প্রোথিত হবে তোমার নরম নিভৃত জরায়ুতে। “সীজার প্লাওড্ ক্লিওপেট্রা”। মেয়ে মানেই মাটি। আমার কিন্তু মেয়ে চাই।
যেন ইচ্ছেমতই হয় সব কিছু।
অস্ফুটে বলল, রুষা।
টুইনস হলে আরও ভাল। এক মেয়ে, এক ছেলে। আমার এত সম্পত্তি ভোগ করার জন্যে যথেষ্ট লোকের দরকার। তাছাড়া, ফ্যামিলি বড় হলে ইনকাম ট্যাক্স ও ওয়েলথ ট্যাক্সের প্ল্যানিংয়েরও সুবিধে হয়।
তুমি বড় বেশিদূর অবধি ভাব ভিনোদ।
তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল ওরা দুজন। জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে।
রুষা বলল, পৃথুকে একটা চিঠি লিখব ভাবছি, বাড়িতে কাউকে না দেখতে পেয়ে ও শকড না হয়। ওকে তো মেন্টালি প্রিপেয়ার্ড হয়ে আসতে দিতে চাই আমি। এত বড় ফিজিক্যাল শক-এর পর হঠাৎ এত বড় মেন্টাল শক। ওর হার্ট তো ইস্কিমিক্। এই ফাঁকা বাড়িতে ও বেচারা একা থাকবে!
অবশ্য, চাকর-বাকররা সকলেই থাকবে, যদি ও চাকরি না ছাড়ে। আর ওরাই ত ওকে দেখত। সত্যি কথা বলতে কী, আমি তো কখনই ওর জন্যে নিজে হাতে কিছু করিনি।
ও বাড়িটা তো পৃথু দাদারই?
ভিনোদ শুধোল।
না। বাড়িটা তো আমার।
কী করবে? এই বাড়িটা?
ভাবছি, পৃথুকেই দিয়ে দেব। চাকরি ছেড়ে দিলে ও বেচারি থাকবে কোথায়?
সিলী! যার সঙ্গে সম্পর্কই রাখবে না, তাকে বাড়ি দিতে যাবে কোন দুঃখে। কী সে করেছে তোমার সুখের জন্যে?
আঃ ভিনোদ! করেছে, করেছে। সে সব তুমি বুঝবে না। সব বোঝার চেষ্টাও কোরো না। কিছু কিছু বিষয় আছে, যা তোমার সমস্ত বুদ্ধি জড়ো করেও তুমি কখনও নাগাল পাবে না।
আমি ভাবছিলাম, তোমার কাছ থেকে এই বাড়িটা আমার নতুন কোম্পানী ভাড়া নিতে পারত। হাজার টাকা করে ভাড়া দিতাম তোমাকে। ভাড়ার পুরো টাকাটাই জমত তোমার নামে। কোম্পানীর ম্যানেজার থাকত এই বাড়িতে। ভেবে দেখো। ল্যাংড়া পিরথু ঘোষের কি অধিকার আছে এই বাড়ির উপর?
আঃ ভিনোদ। উ্য আর সারপাসিং উওর লিমিট। উ্য আর আ ভেরী গ্রস্ পার্সন্। একজন আন্ফরচুনেট মানুষের সম্বন্ধে কেউ এইভাবে কথা বলে?
ওক্কে! বেবী, ওক্কে! ফরগেট দিস টপিক্। আর একটা স্ক্রু-ড্রাইভার বানিয়ে আনছি তোমার জন্যে। দেন, আই উইল স্ক্রু উ্য, অ্যাজ উ্য ডেজায়ার।
নো!
হোয়াট, নো?
না বলেছি, না।
কি না? আর খাবে না?
আর কিছু না।
কেন?
না। আজকে না। আমি পারব না।
তুমিই না বললে…। তোমার বিবেক? মাই ফুট।
বলেছিলাম, কিন্তু আমার মন কুঁকড়ে গেছে…
হাঃ! হাঃ! করে হাসল ভিনোদ অনেকক্ষণ। বলল, মনের কী করণীয় আছে এতে? মনের তো আর শরীর নেই। মন একটা অ্যাবস্ট্রাকট্ ব্যাপার। শরীর না কুঁকড়ালেই হল!
ভিনোদ! তুমি শরীর শরীর করেই মরলে। মনই তো সব। মনই কুঁকড়ে গেলে, শরীরের বাকি আর কী থাকে? সে তো তখন ডেড-বডি।
আমার ডেড-বডি হলেও চলবে। ডেড-বডিকে আমি জ্যান্ত করে নেব। ওসব বায়নাক্কা রাখো তো! আরেকটা খাও। আমি বানিয়ে আনছি।
বলেই, উঠে চলে গেল ভিনোদ রুষার উত্তরের অপেক্ষা না করে।
রুষার বড়ই ভয় করতে লাগল। নিজের জন্যে, পৃথুর জন্যে; মিলি ও টুসুর জন্যে। ঠিক করছে কি ও? এই মানুষটার সঙ্গে থাকতে কি পারবে বাকি জীবন? যদি না পারে?
ভিনোদ আর এক বোতল বীয়ার এবং রুষার জন্যে আর একটি স্ক্রু-ড্রাইভার বানিয়ে এনে রুষার হাতে দিয়ে বলল, পৃথুদাদা যদি ডিভোর্স দিতে রাজি না হয়?
হবে।
রুষা বলল, মুখ নামিয়ে।
তুমি কী করে জানলে?
আমি পৃথুকে জানি।
আমার সন্দেহ আছে। দেখো, আমার কাছ থেকে থোক টাকা ঝেড়ে নেবে। নইলে, অ্যাডালটারীরর কেস ঠুকে দেবে।
আঃ। ভিনোদ।
এবার জোরে চিৎকার করে উঠল রুষা। দু’হাত দিয়ে দু’চোখ ঢেকে ফেলল। যেন, চোখ দিয়েই শোনে রুষা।
ওক্কে। বেবী, ওক্কে।
বলেই ছিপছিপে সুগন্ধি রুষাকে হঠাৎ পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে রুষার আর নিজের গ্লাস আর বীয়ার মাগ এক হাতে ধরে, চলল ভিনোদ শোবার ঘরের দিকে। দুখী পাছে দেখে ফেলে, তাই চিৎকারও করতে পারল না রুষা। না দেখলেও, এ বাড়ির সকলেই এখন জানে। হয়তো পুরো শহরই জানে। প্রেম করতে হলে কলঙ্কর ভয় করলে চলে না। এমন ন্যাকা মেয়ে রুষা অন্তত নয়।
কী হল, তা বোঝার আগেই বেডরুমের দরজা বন্ধ করে দিল ভিনোদ।
হেরে গেল। উচ্চশিক্ষিত, আধুনিক, রুচিসম্পন্না রুষা হেরে গেল একটা জানোয়ারের কাছে। তার শরীর, প্রাকৃত, প্রাগৈতিহাসিক নারী-শরীর অবহেলায় হারিয়ে দিল তার ঘষা-মাজা-গর্বভরা সুরুচিসম্পন্ন উচ্চমন্য মনকে।
রুষা চোখ বুজে ছিল। ভাবছিল, তাইই যদি হবে, যদি তাইই হয়, তাহলে এই শিক্ষা, এই রুচি, এই বাছাবাছির দরকারটা কী? শরীরের কাছে যদি হেরেই যাবে, তাহলে…
বড়ই ধাঁধায় পড়ল ও নিজেকে নিয়ে। তার মত উচ্চশিক্ষিতা, মার্জিতরুচি সুন্দরী মেয়েরা কি সবাই-ই অবচেতনে কোনও পুরুষ জানোয়ারের কাছে তাদের শরীরী সত্তার কাছে হেরে যাবে বলেই অপেক্ষমান থাকে? মেয়েরা কি কোনওদিনও লিবারেটেড হতে পারবে না? পুরুষের মধ্যের চিরন্তন শরীরী জানোয়ারটি কি চিরদিনই সুন্দরীদের এমন করে অবহেলায় হারিয়েই দেবে?
ছিঃ! ছিঃ! কী করবে রুষা? মহিলা সমিতির মণি মাসীমাকে তো এসব বলা যাবে না! চামেলী, মণিদীপা, অনুরাধা, তার সমবয়সী যারা, তাদেরও না। সত্যি যা, তা গোপনই থাকে, মিথ্যেটাই জোর পায় বক্তৃতায়, সভাসমিতিতে; পুরস্কারে। এমন কি, আজকাল সমালোচনায়, তিরস্কারেও। মুক্তি যদি নেইই তাহলে কি লাভ মিছিমিছি…। লাভ কি?…
পৃথু, ও পৃথু; আমাকে ক্ষমা কোরো পৃথু। আমি খুব খারাপ। খুবই খারাপ আমি। কিন্তু বিশ্বাস করো, খুব লজ্জা করছে বলতে আমার, আমি কিন্তু খুব সুখীও। শরীরের মধ্যে যে এত আনন্দ লুকিয়ে ছিল, এত বছর কখনও জানিনি আমি। যে মুক্তি আমি চাইছিলাম, সে মুক্তির মনের দরজা বন্ধ করে দিয়ে আমাকে আমার শরীরের মুক্তির দরজা হাট করে খুলে দিয়ে গেল এই জানোয়ারটা! এই লোকটাকে আমি ঘেন্না করি পৃথু। বিশ্বাস করো। ঘেন্না, ঘেন্না, ঘেন্না। আবার তীব্র ভাবে ভালও বাসি।
ভালবাসা কি মানসিক অবস্থা নয় তাহলে? ভালবাসা কি শুধুই শরীর? মানুষ কি এখনও জানোয়ারই আছে? ভালুক ভালুকিরই মতো?
ছিঃ ছিঃ।
পৃথু, ও পৃথু! আমাকে ক্ষমা কোরো তুমি।