মানুষ সবচেয়ে কম দেখে নিজেকে। প্রতিদিন দর্পণে নিজের মুখোমুখি দাঁড়ালেও মানুষ লক্ষ করে না নিজের পরিবর্তন। শুধু আকৃতি নয়, মানুষের প্রকৃতিও যে অনেক বদলে যায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, তা যেন মানুষ ইচ্ছে করেই বুঝতে চায় না। নিজের মনের গহনে ডুব দিতে অধিকাংশ মানুষই ভয় পায়। মানুষের জীবনে যৌবনই শ্রেষ্ঠ সময়, তবে যৌবনকালে মনে হয় বুঝি যৌবনই চিরস্থায়ী।
পাটনায় রাজপথ দিয়ে যেতে যেতে ভরত দেখতে পায় তার পূর্বপরিচিত গাছগুলি অনেক বড় হয়ে গেছে, গোলঘরের কাছে একটি মস্ত ডালপালা মেলা গুলমোর বৃক্ষ ছিল, সেটি আর নেই। আর একটা বাজ-পড়া মৃত গাছ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, সেটা যে কী গাছ ছিল ভরতের মনেই পড়ে না। কিছু কিছু সুদৃশ্য প্রাসাদের দেয়ালগুলি এখন মলিন। আবার কোথাও বস্তি-মহল্লা বিধ্বস্ত করে গড়ে উঠেছে নতুন অট্টালিকা। অনেক পরিচিত মানুষের মুখে পড়েছে বয়েসের ছাপ। একদিন বিষ্ণু সহায়কে দেখে সে দারুণ চমকিত হয়েছিল। লয়েডস ব্যাঙ্কের এই ক্যাশিয়ারটি ছিলেন এক হাসিখুশি, তৃপ্ত মানুষ। অনেকগুলি পুত্র কন্যার জনক, স্বাস্থ্যটি বেশ ভাল ছিল, পারিবারিক ধনসম্পদ প্রচুর, ব্যাঙ্কের ওই চাকরি ছিল তাঁর সামাজিক প্রতিপত্তির অঙ্গ। ওই বিষ্ণু সহায়জির বাড়িতে ভরত কতদিন ভূরিভোজন করে এসেছে। সেই মানুষটির এত পরিবর্তন! সমস্ত শরীর যেন একটা বৃহৎ বেলুনের মতন ফুলে গেছে, পেটটি একটি জালার মতন, নিজের নাভি নিজে ছুঁতে পারবেন কি না সন্দেহ। তিনি ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে আসছেন। দু’জন তোক ধরে ধরে নিয়ে আসছে, অপেক্ষমাণ টাঙ্গায় তাঁকে তুলে দিতে প্রায় ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে গেল, বিষ্ণু সহায় পা তুলতেই পারেন না, সহকারী দুজনের গলদঘর্ম অবস্থা, ঘোড়াটা পর্যন্ত চি হি হি হি করে ডেকে উঠল। এই অবস্থাতেও বিষ্ণু সহায় চাকরি করতে আসেন সেটা যেন আরও বিস্ময়কর।
পুণা শহরে জেল থেকে বেরিয়ে মস্তক মুণ্ডন করেছিল, এখন আবার চুল গজিয়ে গেছে, তবে পূর্বের মতন টেরি কাটে না, বাবরি রেখেছে। গোঁফটিও মোটা। নানান অভিজ্ঞতার পরতে পরতে তার মুখে সারল্য ও বিস্ময়বোধ চাপা পড়ে গেছে! শরীরে মেদ নেই, তাকে দেখলেই বলশালী পুরুষ বলে মনে হয়। কোনও মানুষকে সে সহজে বিশ্বাস করে না। সদ্য পরিচিতদের সঙ্গে ভরত কিছুটা দূরত্ব রক্ষা করে, পূর্বপরিচিতদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে আগ্রহী হয়নি।
তার জীবিকার সমস্যা খুব সহজেই মিটে গেছে। সে ইংরিজি জানে এবং ব্যাঙ্কের কাজকর্মে রীতিমত অভিজ্ঞ। তার পক্ষে একটা চাকরি জুটিয়ে নেওয়া শক্ত ছিল না, দু-একটি ব্যাঙ্কের নতুন নতুন শাখা এখানে খোলা হচ্ছে, কিন্তু ভরতের আর চাকরি করার মন নেই। সে সংসারী নয়, খুব বেশি অর্থেরও প্রয়োজন নেই তার, তা হলে প্রতিদিন দশটা-পাঁচটার দাসত্ব করতে যাবে কেন? পাটনায় অনেকগুলি চালের আড়ত, বহু লোক চালের ব্যবসায়ে যুক্ত। সারা দেশে এখন দুর্ভিক্ষের অবস্থা, সেই জন্যই চাল ব্যবসায়ীদের লাভের অন্ত নেই, ভরত একবার ভেবেছিল তার যাবতীয় মূলধন বিনিয়োগ করে এই ব্যবসায় নেমে পড়বে। দু-চারদিন চালের বাজারে ঘোরাঘুরি করে তার এই ইচ্ছেটাও মিলিয়ে গেল। দুর্ভিক্ষে না খেতে পেয়ে মানুষ মরছে, আর ব্যবসায়ীরা ধান-চাল গুদামজাত করে রেখে অনবরত দাম বাড়াচ্ছে। ভরতের অত লাভের স্পৃহা নেই, সে শত শত মানুষের শেষনিশ্বাস কেড়ে নিতে চায় না। বাল্যকালে সে দেখেছে, ত্রিপুরায় দুর্ভিক্ষ হলে রাজবাড়ি থেকে বিনামূল্যে শস্য বিতরণ করা হত, মন্দিরে মন্দিরে বহু মানুষের জন্য খিচুড়ি ভোগের ব্যবস্থা হত, এখানে সে রকম কোনও উদ্যোগ নেই। এ শহরের পথে পথে এখন অসংখ্য ভিখারি।
ব্যাঙ্কে কাজ করার সময় ভরত অনেক ব্যবসায়ীর সংস্পর্শে এসেছিল। সে দেখেছিল, ব্যবসায়ীরা। অনেক উপার্জন করে বটে, কিন্তু নিজেরা কিছু ভোগ করতে পারে না। কী করে আরও বেশি লাভ হবে, এটাই তাদের প্রধান চিন্তা। চাকুরিজীবীরা দশটা-পাঁচটায় শ্রম দেয়, আর ব্যবসায়ীরা সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত নিজের কাজেই বন্দি।
পাটনা শহরে নিত্য-নতুন স্কুল গজাচ্ছে। তার মধ্যে অনেকগুলি পুরোপুরি স্কুল নয়, সব বিষয় পড়ানো হয় না, শুধু কথ্য ইংরিজি শেখাবার ব্যবস্থা। সেখানকার ছাত্ররা সব বয়স্ক পুরুষ। চতুর্দিকে এখন ইংরিজি শেখার হুজুগ। যারা কখনও স্কুল-কলেজে পড়েনি কিংবা টোল-মাদ্রাসায় পাঠ নিয়ে শিক্ষিত হয়েও ইংরিজি শেখেনি, অথচ নানা রকম বৈষয়িক কর্মের সঙ্গে যুক্ত, তারা এখন দেখছে যে সাহেবদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার জন্য সব সময় কর্মচারী-নির্ভর হতে হলে সমুহ ক্ষতি। কর্মচারীরা সত্য-মিথ্যা কখন কী বুঝিয়ে দেয়, তার ঠিক নেই। কোনও সংস্থায় মালিক হিসেবে সাহেবদের সামনে দাঁড়িয়ে দু-চারটি ইংরিজি বাক্য বলতে পারলে মর্যাদা বাড়ে, সাহেবরা পিঠ চাপড়ে দেয়।
আধা–ফিরিঙ্গি, ট্যাঁস-ফিরিঙ্গিরা কলকাতা থেকে এসে পাটনার মতন শহরগুলিতে এই ধরনের কথ্য ইংরিজি শেখাবার স্কুল খুলে প্রচুর আয় করছে। অ্যান্ড্রজ সাহেবের স্কুলের এমনই রমরমা যে সেখানে ভর্তি হতে গেলে ছ মাস অপেক্ষা করতে হয়। কয়েকটা স্কুল ঘুরে দেখার পর ভরত নিজেই একটা স্কুল খুলে ফেলল। ছাব্বিশ টাকায় সে ভাড়া নিল একটি দোতলা বাড়ি, এক তলায় পড়াবার ব্যবস্থা, ওপরে তার বাসস্থান। বাইরের সাইনবোর্ডে সে নিজের নাম লিখল, ভরতকুমার সিংহ, বি-এ, প্রেসিডেন্সি কলেজ। একে তো সে সত্যি সত্যি বি-এ পাস, তায় প্রেসিডেন্সি কলেজের গন্ধ, অচিরেই আকৃষ্ট হল অনেক ছাত্র।
ছাত্রেরা প্রায় সকলেই ভরতের চেয়ে বয়েসে বড়। কেউ ব্যবসায়ী, কেউ মহাজন, কেউ জমিদার তনয়। বিচিত্র তাদের পোশাক। দু’জন টিকি ঝোলানো সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতও নিয়মিত আসেন। পাটনা শহরে গো হত্যার প্রশ্নে দু-একবার দাঙ্গা হয়েছে বটে, তবু হিন্দু-মুসলমানের বিভেদরেখা প্রকট নয়। সামাজিক স্তরে মেলামেশা আছে, বাংলার মতন এখানে ছুঁৎমার্গ নেই, হিন্দু-মুসলমান সহজ ভাবেই পাশাপাশি বসে। ভরতের ছাত্রদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি মুসলমান। ইংরিজি শিক্ষায় মুসলমানরাই বেশি পিছিয়ে আছে।
বয়স্ক ছাত্রদের পড়ানো মোটেই সহজ কাজ নয়। কিছুতেই জিভের আড় ভাঙতে চায় না, এ অক্ষরটিই উচ্চারণ করতে পারে না কিছুতে। ব্যাট, ক্যাট, র্যাট-এর উচ্চারণ হয় বলবে র্যায়ট্টা, ক্যায়ট্টা, ব্যায়ট্টা; অথবা বেট, কেট, রেট।
ভরত ধৈর্য হারায় না। সে মজা পায়। তার মনে পড়ে, শশিভূষণ মাস্টারমশাই তাকে কত যত্ন করে শিখিয়েছেন। অনেক দিন পর্যন্ত সে বাংলা ভাষা ভালই পড়তে-লিখতে জানত, ইংরিজির জ্ঞান এক অক্ষরও ছিল না। শশিভূষণই তার ইংরিজি শিক্ষার ভিত তৈরি করে দিয়েছেন।
কয়েক মাসের মধ্যেই ভরতের স্কুল বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠল। কিন্তু ভরত আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছে, ছাত্রসংখ্যা পঞ্চাশের বেশি হবে না। সকালবেলা শুধু নটা থেকে বারোটা পর্যন্ত দু দফায় ক্লাস, তারপর স্কুল বন্ধ, অপরাহু ও সন্ধ্যা সে নিজের জন্য রাখতে চায়। বেতন পাঁচ টাকা, পঞ্চাশ জন ছাত্রেই তার উপার্জন যথেষ্ট, আর বেশি তার চাই না। এতেও তার বেশ কিছু অর্থ জমে যেতে লাগল, কারণ ছাত্ররা শুধু বেতন দেয় না, শিক্ষককে কিছু না কিছু গুরুপ্রণামি বা উপঢৌকন দেবার প্রথা এখনও বজায় আছে। কেউ নিয়ে আসে এক কাঁদি কলা, কেউ এক হাঁড়ি প্যাঁড়া বা বরফি, কেউ এক বস্তা দাদখানি চাল, একজন প্রথম দিন এসে ভরতের পায়ের কাছে একটি আকবরি মোহর রেখে প্রণাম করেছিল। নাগরার জমিদার জগদেও বাহাদুর লোক মারফত বলে পাঠালেন যে ভরত যদি স্কুলের অন্যান্য ছাত্রদের বাদ দিয়ে শুধু তাঁর কনিষ্ঠ পুত্রকে পড়ায়, তা হলে তিনি মাসিক তিনশো টাকা দিতে রাজি আছেন। ভরত সবিনয়ে সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে, সেও তো এক প্রনের চাকরি।
ছাত্ররা সবাই বিবাহিত, কুড়ি-একুশ বছরের মধ্যে বিবাহ হয় না এমন যুবক এ রাজ্যে দুর্লভ। অনেকেরই দশ-বারো বছর বয়েসের মধ্যেই ও কাজটা সেরে ফেলা হয়। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে অনেকেরই পত্নীর সংখ্যা একাধিক, অর্থবল থাকলে এর পরেও থাকে রক্ষিতা। ভরতের স্ত্রীও নেই রক্ষিতাও নেই, নারীসঙ্গবিহীন জীবন সে কী করে কাটায় দিনের পর দিন, তার ছাত্রদের কাছে এ এক বিস্ময়। কেউ কেউ সরাসরি প্রশ্নও করে ফেলে, ভরত উত্তর না দিয়ে মৃদু মৃদু হাসে। প্রশ্নকারীদের মনোভাব এরকম যে, ভরত ইচ্ছা প্রকাশ করলে তারা তাদের কৃপাধন্য কোনও নারীকে এখনই শিক্ষক মহাশয়ের কাছে পৌঁছে দিতে পারে।
নীচের তলার জন্য চেয়ার বেঞ্চি কিনতে হয়েছে, ওপর তলায় একটি চৌকি ছাড়া কোনও আসবাব নেই। জল তোলা, রান্না করার জন্য ভরত একজন লোক রেখেছে। বিকেল-সন্ধ্যা-রাত্তিরে ভরতের কোনও কাজ নেই, কিন্তু এই সময়টা সে নিজের জন্য কী ভাবে ব্যয় করবে, তা এখনও ঠিক করে উঠতে পারেনি।
মাঝে মাঝে সে সুর্যাস্তের সময় গঙ্গার ধারে বসে থাকে। প্রবাহিত জলস্রোতের দিকে তাকিয়ে সে দেখতে চেষ্টা করে নিজের ভবিষ্যৎ। স্কুলের পরিকল্পনাটি সফল হয়েছে, তার গ্রাসাচ্ছাদনের কোনও অভাব হবে না, কিন্তু এই ভাবেই কি কেটে যাবে সারা জীবন? মৃত্যু তাকে তাড়া করেছে বারবার, অহেতুকভাবে সে ভাগ্যবিড়ম্বিত হয়েছে, আবার এ কথাও ঠিক, প্রত্যেকবারই সে আবার উঠে দাঁড়াতে পেরেছে। ঈশ্বর নামে যদি কেউ থেকেও থাকেন, তা হলে সেই ঈশ্বরের যেন জাতক্রোধ আছে ভরতের ওপর। কেন ভরতের স্বপ্নসৌধ তিনি চুরমার করে দেন প্রত্যেকবার? দুর্বলচিত্ত ভক্তরা বলবে, এ সবই হল ঈশ্বরের পরীক্ষা! কীসের পরীক্ষা? কোনও নিদোষ মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়াটা পরীক্ষা, না নিষ্ঠুর খেলা? মহিলামণিকে অকালে তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হল কেন? ভরত তার চিকিৎসার কোনও ত্রুটি রাখেনি, নিজে সে মন্দিরে-মন্দিরে হত্যে দিয়েছে, কোনও দেব-দেবীর কাছেই সে কাতর মিনতি জানাতে বাকি রাখেনি, তবু মহিলামণি বাঁচল না। না, এসব যাগ-যজ্ঞ, পূজা-অর্চনা, গুরুর কৃপা, এ সবই মিথ্যে। বহু তীর্থস্থানে, বহু দেবালয়ে ঘুরেছে ভরত, এই পার্থিব জীবনের ঊর্ধ্বে আর কোনও চিহ্ন সে দেখতে পায়নি। ঈশ্বর যদি তাকে নিয়ে পরীক্ষা করে থাকেন, ঈশ্বরকেও কম পরীক্ষা করেনি সে!
হঠাৎ যেন বড় বেশি নিঃসঙ্গতা পেয়ে বসেছে ভরতকে। অতি নিঃসঙ্গ মানুষরাই ধর্ম এবং ঈশ্বরকে আঁকড়ে ধরতে চায়। যুক্তি যখন সান্ত্বনা দিতে পারে না, অন্ধ বিশ্বাস তখন আশ্রয় দেয়। ভরত কিছুতেই যুক্তি বিসর্জন দিতে পারবে না। কলেজের বন্ধু ইরফানের কাছে সে ডারউইন সাহেবের তত্ত্বের কথা শুনেছিল, এখন ক্রমশ তার মনে হয় সেই তত্ত্বই বিশ্বসযোগ্য। এই বিশ্বের সব কিছুই পদার্থের বিবর্তন। ঈশ্বর মানুষকে সৃষ্টি করেননি, মানুষই ঈশ্বরকে সৃষ্টি করেছে। ডানাওয়ালা ঘোড়া, অগ্নিস্রাবী ড্রাগন, সমুস্র লঙ্ঘনকারী হনুমানের মতনই ঈশ্বর এক কাল্পনিক প্রাণী।
মানুষ মানুষের সঙ্গ চায়। পুরুষ চায় নারীকে, নারী চায় পুরুষকে। আসঙ্গলিপ্সা ভরতকে প্রায়ই উতলা করে। সে কি আবার বিয়ে করবে? ভূমিসূতার জন্য তার বুক এখনও মাঝে মাঝে টনটন করে। কিন্তু সে জানে ভূমিসূতাকে আর পাবার আশা নেই, সে হারিয়ে গেছে চিরতরে। ভূমিসূতার মতন মুখের আদল দেখেই সে মহিলামণির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল, কিন্তু অনেক ভালবাসা, অনেক যত্ন, অনেক ব্যাকুলতা দিয়েও সে মহিলামণিকে ধরে রাখতে পারল না। তার বিড়ম্বিত জীবনের সঙ্গে কোনও নারীকে জড়ালে তারাও সব দিক থেকে বঞ্চিত হয়, হারিয়ে যাওয়াই তাদের নিয়তি। সেই জন্যই ভরত আবার বিয়ে করতে ভয় পায়।
তা হলে কি বাকি জীবন তাকে রমণী সান্নিধ্য বঞ্চিত হয়ে কাটাতে হবে? নারীর কোমলতার স্পর্শ পেলে পুরুষের জীবন বড় রুক্ষ হয়ে যায়। এই পাটনা শহরের এক প্রান্তে বারবণিতাদের এক বিশাল পল্লী আছে। নানা রকম সাজগোজ করে, মুখে রং মেখে স্ত্রীলোকেরা সন্ধের পর সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে। ভরত এক একবার ভেবেছে, সেখানে গেলে কেমন হয়? জীবনের সঙ্গে না জড়িয়ে শুধু এক রাত্রির সঙ্গ! বারীন নামে এক চায়ের দোকানের ছোঁকরার সঙ্গে তার আলাপ হয়েছে, সে প্রায়ই নিজের প্রেমের গল্প করে। ভরতের মনে হয়, প্রেম নামে বস্তুটি সে আর কখনও অনুভব করবে না। দু-দুটি নারীকে সে তার সমস্ত প্রেম উজাড় করে দিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে। প্রেমহীন পুরুষের শরীরও নারীর শরীর চায়। কিন্তু পণ্যা নারী। ভরত এক সময়ে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হয়েছিল, এখন তার মন থেকে ধর্মটর্ম সব ঘুচে গেছে, সে আর কিছুতেই বিশ্বাসী নয়, ব্রাহ্মধর্মের ধরন-ধারণও তার কাছে হাস্যকর মনে হয়। কিন্তু ব্রাহ্মদের রুচিবোধ গভীর ছাপ এঁকে দিয়েছে তার মানসিকতায়। তাই সে কিছুতেই বারবণিতা পল্লীতে নিঃসঙ্গতা ঘোচাবার জন্য যেতে পারবে না।
একাকী থাকার জন্যই কি সে তবে যাবজ্জীবন দণ্ডিত? কালস্রোতের মতন নদীর স্রোতে সে দেখতে পায় না তার ভবিতব্যের ছবি।
এক একদিন সন্ধ্যার পর সে একটি চায়ের দোকানে গিয়ে বসে। দোকানটি কিছুটা অভিনব। পাটনায় খাবারের দোকান অনেক আছে, লাড্ড, প্যাঁড়া, জিলাবি, কচৌরি বেশ ভাল পাওয়া যায়। সে সব দোকানে গরম দুধ মেলে, রাবড়িও অতি সুস্বাদু। কিন্তু টেবিল-চেয়ার পাতা কলকাতার মতন চায়ের দোকান আগে ছিল না। সবে মাত্র একটি খুলেছে। বলাই বাহুল্য, দোকানটির পরিচালক এক বাঙালি যুবক। পাটনায় বাঙালির সংখ্যা কম নয়। উকিল, ডাক্তার, শিক্ষক ও কেরানি অধিকাংশই বাঙালি, শুধু তারাই নয়, বিহারিরাও এই দোকানে আসে।
ভরত বরাবরই চায়ের ভক্ত। ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেও সে ঠিক কলকাতার চায়ের মতন স্বাদ পায়নি। অনেকেই মনে করে, জল বিনা খাঁটি দুধের মধ্যে চায়ের পাতা সিদ্ধ করে মুঠো মুঠো চিনি দিলেই বুঝি ভাল চা হয়। অনেক দিন পর এই দোকানে হালকা সোনালি রঙের পাতলা চা পেয়ে সেই টানে ভরত প্রায়ই আসে। চা ছাড়া আলুর চপ, মোচার চপ ও পেঁয়াজিও পাওয়া যায়, সেগুলিও বড় সুস্বাদু।
দোকানটির আরও বৈশিষ্ট্য আছে। যে সুদর্শন তরুণটি চা ও অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য পরিবেশন করে, তাকে দেখলে ভদ্রঘরের ছেলে বলেই মনে হয়। এই দোকানের সব কিছুর মধ্যেই এক নারীর স্পর্শ টের পাওয়া যায়, অন্তরালবর্তিনী এক রমণীকেও ভরত দু-একবার দেখেছে। সেই প্রৌঢ়া রমণীটিকে দেখলেই বোঝা যায়, এককালে তিনি পরমা সুন্দরী ছিলেন। যুবকটি ওই রমণীকে রাঙামা সম্বোধন করে। কোনও ভদ্র বাঙালি পরিবারের মা ও ছেলে চায়ের দোকান চালিয়ে গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করেছে, এমনটি আর আগে দেখা যায়নি।
যুবকটির নাম বারীন। সে কথা বলতে ভালবাসে। ভরতের কৌতূহল থাকলেও সে ওদের সম্পর্কে কোনও ব্যক্তিগত প্রশ্ন করেনি। ভরতের সঙ্গে কিছুটা ঘনিষ্ঠতা হবার পর বারীন নিজেই তাদের পারিবারিক ইতিহাস জানিয়ে দেয়। শৈশবেই সে পিতৃহীন, এই প্রৌঢ়া তার গর্ভধারিণী নন, পালিকা মা। আত্মীয়দের চাপে এই রাঙামার সঙ্গে তার বসবাস করা নিষিদ্ধ ছিল। দাদামশাইয়ের বাড়িতে আশ্রিত ছিল বারীন, সেই দাদামশাইয়ের মৃত্যুর পর মামা-মামিরা আর তার ভার নিতে চাননি, বারীনকে তারা গলগ্রহ মনে করত। এই পৃথিবীতে বারীনকে একমাত্র ভালবাসেন এই রাঙামা, শেষ পর্যন্ত তাঁর কাছেই পালিয়ে চলে গিয়েছিল বারীন। কিন্তু লেখাপড়া বিশেষ শেখেনি, জীবিকার কোনও পথ নেই। কলকাতায় রাঙামার একটা বসতবাটি ছিল, কিন্তু শুধু বাড়ি থাকলেই তো আহার জোটে না। তাই সেই বাড়ি বিক্রির মূলধনে এই চায়ের দোকান খুলেছে। রাঙামার হাতের রান্না অপূর্ব, যে একবার খাবে, তাকে বারবার ছুটে আসতেই হবে।
সব শুনে ভরত জিজ্ঞেস করেছিল, আচ্ছা ভাই, তুমি কলকাতায় চায়ের দোকান না খুলে পাটনা এলে কেন? কলকাতায় তো আরও বেশি সাফল্যের সম্ভাবনা ছিল। কলকাতা অত বড় শহর, সেখানকার মানুষ চায়ের দোকানে যেতে অভ্যস্ত। আমাদের কলেজজীবনে দেখেছি, জ্ঞানবাবুর চায়ের দোকানে সর্বক্ষণ ভিড়।
বারীন বলল, তা ঠিক। কিন্তু কলকাতায় আমার রাঙামাকে নিয়ে এ ব্যবসা শুরু করার কোনও উপায় ছিল না। বাপ-ঠাকুরদার মানসম্মানের একটা ব্যাপার আছে না? আমার দাদামশাইকে এক ডাকে দেশের মানুষ চেনে। বাবা ছিলেন নাম করা ডাক্তার। বড় বড় দাদারা সবাই বিলাত ফেরত, বিদ্যাদিগগজ, উঁচু পদে চাকরি করেন, তাঁরা কেউ আমার খাওয়া-পরার ভার নিতে চান না। কিন্তু চায়ের দোকানের মতন ছোট কারবার শুরু করেছি শুনলেই তাঁরা সব রে-রে করে তেড়ে আসতেন। তাই তাঁদের চোখের আড়ালে অনেক দূরে চলে এসেছি। আমার কোনও লজ্জা নেই। ব্যবসায় আবার ছোট-বড় কী! বাঙালির ছেলেরা ব্যবসা করে না বলেই তো আজ এ জাতের এমন দুর্দশা!
ব্যবসার ব্যাপারে বারীনের যতই উৎসাহ থাক, কিন্তু তার এই দোকানটি যে বিশেষ লাভের মুখ দেখছে না, তা ভরত কিছু দিনের মধ্যেই বুঝে গেল। কারবার খুলে বসলেই হয় না, একটা ব্যবসায়িক মনোভাব থাকা চাই। কোনও খরিদ্দার যদি আলুর চপ খেয়ে বিগলিত হয়ে বলে, বাঃ, তোফা, তোফা, এমনটি আর খাইনি, অমনি বারীন বলে ওঠে, ভাল লেগেছে যখন, আরও দুটো খান। ভেতর থেকে সঙ্গে সঙ্গে আরও এক প্লেট ভর্তি চপ চলে আসে। খরিদ্দার হাত নেড়ে বলে, না, না, আর থাক, আমার জেবে আর পয়সা নেই, বারীন তাকে আশ্বস্ত করে বলে, তাতে কী হয়েছে, পয়সা না হয় কাল দেবেন! বঙ্গ রমণীরা অতিথি পরায়ণতার জন্য বিখ্যাত, রাঙামার কাছে সব খরিদ্দারই যেন অতিথি, নিজের হাতে রান্না করা খাবারের জন্য পয়সা নিতে হয় বলে তিনি যেন খুব কুণ্ঠিত, না নিতে পারলেই ভাল হয়। বারীনের মধ্যেও একটা ঔদার্য দেখানোর ভাব আছে, দু-চার টাকা যেন তার হাতের ময়লা। কোনও খদ্দেরের ধার বাকি পড়লে সে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বা হাত নেড়ে বলে, ঠিক আছে, ঠিক আছে, দিতে হবে না। সুযোগ বুঝে একদল ছোঁকরা সন্ধেবেলা এসে টেবিল জাঁকিয়ে বসে, ইচ্ছেমতন খায়, ঘণ্টার পর ঘণ্টা তর্ক-বিতর্ক ও হাসিমস্করা করে, বারীনকেও গল্পে জড়িয়ে নেয়, যাবার সময় দশ আনার খেয়ে দু আনা টেবিলে রেখে অম্লান বদনে চলে যায়।
বারীন ভরতের থেকে বয়সে অনেকটা ছোট। এই বয়েসেই সে প্রেমের ব্যাপারে খুব অভিজ্ঞ। অনেক রসালো গল্প জানে। তার এক অতি নিকট আত্মীয়া কিশোরীর প্রেমে সে একসময় হাবুডুবু খেয়েছে, কিন্তু তার সঙ্গে বিয়ে হওয়া অসম্ভব বলে সে আর বিয়েই করবে না ঠিক করেছে। সেই মেয়েটিকে সে এখনও লম্বা লম্বা চিঠি লেখে, তবে সে জন্য যে অন্য কোনও মেয়ের প্রতি আসক্ত হওয়া চলবে না, এমন কোনও কথা নেই। এখানেও এক হিন্দুস্থানি স্ত্রীলোকের ওপর তার নজর পড়েছে।
একদিন বারীন বলল, দাদাগো, বাড়ি বিক্রি করে ন’ হাজার টাকা পেয়েছিলাম, তা সবই প্রায় শেষ হয়ে এল। এ ব্যবসায়ে মার নেই, ক্রমশ নাম ছড়ালে আরও খদ্দের বাড়বে। তার জন্য দোকানটি আরও বাড়ানো দরকার, আরও সাজিয়ে গুজিয়ে সুন্দর করতে হবে, গোটা কয়েক লোক নিয়োগ করতে হবে। আরও টাকা চাই। তুমি দাদা কেন আমার পার্টনার হও না? কিছু টাকা ঢালো, লাভের বখরা সমান সমান!
ভরত চুপ করে থাকে। এর মধ্যে তার কিছু টাকাকড়ি জমেছে ঠিকই, কিন্তু ব্যবসায়ে জড়িয়ে পড়ার ইচ্ছে নেই। তা ছাড়া এমন লোকসানের কারবারে স্বেচ্ছায় মাথা গলাবার মতন মূর্খ সে নয়। বারীনের স্বভাব দেখেই সে বুঝেছে যে আরও কয়েক হাজার টাকা উড়িয়ে দিয়েও সে অনায়াসে বলতে পারে, এরকম তো হয়েই থাকে!
দু-চার দিন ভরতকে খুঁচিয়েও আশানুরূপ কোনও সাড়াশব্দ না পেয়ে বারীন বলল, ভাবছি। একবার বরোদায় চলে যাব। আমার সেজদা সেখানে খুব মান্যগণ্য লোক, মহারাজের সঙ্গেও দহরম-মহরম আছে। দাদাদের মধ্যে সেজদাই আমাকে একটু ভালবাসে, ওঁর কাছ থেকে যদি কিছু টাকা আদায় করা যায়।
বারীনের সেজদার নাম শুনে ভরত চমকে উঠল। বরোদার এই অরবিন্দ ঘোষের সঙ্গে ট্রেনে একবার তার আলাপ-পরিচয় হয়েছিল। ঢিলেঢালা, অন্যমনস্ক, লাজুক প্রকৃতির মানুষ, কিছুক্ষণ কথাবার্তা শুনেই বোঝা গিয়েছিল, বেশ বিদ্বান। বাংলা ভাল বলতে পারে না, কিন্তু বাংলা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা আছে। এতদিনে ভরত জানতে পারল যে সেই মানুষটিরই আপন ভাই এই বারীন ঘোষ। দুই ভাইয়ে এত অমিল?
ভরত বলল, তোমার দাদাকে আমি চিনি। আমাকে বরোদা যাবার জন্য পীড়াপীড়ি করেছিলেন। সেখানে গেলেই নাকি চাকরি পাওয়া যায়। আমাকে বাংলা শেখাবার জন্য ধরেছিলেন। আমি তখন মাস্টারি করার কথা ভাবিনি, এখন অবশ্য এখানে সেই মাস্টারিই করতে হচ্ছে।
বারীন সোৎসাহে বলল, চলো চলো, আমরা দুজনে একসঙ্গে যাই। বরোদায় অঢেল সুযোগ। সেখানেও তুমি স্পোকেন ইংলিশের ক্লাস খুলতে পারো। অন্যদের ইংলিশ শেখাবে, আর আমার সেজদাকে শেখাবে বাংলা।
ভরত বলল, এখন যে এখানে জড়িয়ে গেছি। হঠাৎ যাই কী করে?
বারীন তবু লেগে রইল। মাঝে মাঝেই ভরতকে বরোদায় যাওয়ার জন্য উত্ত্যক্ত করে।
পুরনো পরিচিতদের সঙ্গে ভরত যোগাযোগ করেনি বটে, তবে একদিন সে শহিদ কা মকবরার পাশের রাস্তাটি দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে একটি বাড়ির সামনে থমকে দাঁড়াল। লোহার বন্টু বসানো প্রকাণ্ড দরজাটি বন্ধ। এক অভিশপ্ত রাতে ভরত এই দরজার সামনে রক্তাক্ত অবস্থায় হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল। পিছনে তাড়া করে আসছিল নির্ঘাত মৃত্যু। শেষ পর্যন্ত কে তাকে বাঁচিয়ে দিল, ভগবান? প্রাণের ভয়ে ভরত ভগবানের শরণ নিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু হিন্দুর ভগবান কি এক মুসলমান দারোগা ছাড়া আর কোনও প্রতিনিধি পেলেন না? ভগবানও নয়, আল্লাও নয়, ভরতকে সে রাতে রক্ষা করেছিল একজন মানুষ। মানুষই মানুষকে বাঁচায়, মানুষই মানুষকে মারে। মানুষই হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিভেদের সৃষ্টি করে, আবার মানুষই এই বিভেদের রেখা মুছে ফেলতেও পারে।
কৃতজ্ঞতার ঋণ কখনও শোধ করা যায় না। তবু ভরত একবার মীর্জা খোদাবন্দ সাহেবের কুশল সংবাদ নেবার জন্য সেই দরজায় করাঘাত করল। বেশ কিছুক্ষণ পরে সশব্দে খুলল সেই দরজা, এক বৃদ্ধ দারোয়ান মুখ বার করে জিজ্ঞেস করল, কী চাই!
ভরত বিনীতভাবে বলল, এ বাড়ির মালিকের সঙ্গে আমি একবার দেখা করতে চাই। তিনি আমার নাম শুনলে চিনতে পারবেন না। তিনি একবার আমাকে এ বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন, এইটুকু শুনলে যদি তাঁর কিছু মনে পড়ে।
দারোয়ানটি আপন মনে বিড়বিড় করে উর্দুতে বলল, এ বাড়িতে তো হুদো হুদো নোক আশ্রয় পায় আর দু’বেলা গাণ্ডেপিণ্ডে গেলে, তাদের মধ্যে কার কথা মালিকের মনে থাকবে?
তবু সে ভিতরে গিয়ে একটু বাদেই ফিরে এল, এবং দরজার এক পাল্লা খানিক ফাঁক করে ভরতকে প্রবেশ করতে দিল।
ভরতের যতদূর মনে আছে, বাড়িটি দো মহলা বা তিন মহলা, ঘরের সংখ্যা প্রচুর, দুটো তিনটে উঠোন, অনেক মানুষজনের কণ্ঠস্বর শোনা যেত। আজ যেন বড় বেশি নিস্তব্ধ, অনেক ঘরে বাতি জ্বলেনি। কেমন যেন একটা থমথমে ভাব।
এক জায়গায় মখমল বিছানো চৌকিতে বসে দাবা খেলছে দুজন যুবক। তাদের মধ্যে একজন মুখ তুলে ভরতকে কয়েক পলক দেখে নিয়ে বলল, ইয়েস, হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ?
ভরতের বুকটা ধক করে উঠল। তা হলে কি মীর্জা সাহেব আর ইহলোকে নেই? তা হলে আর এখানে এসে কী লাভ হল!
ভরত সংক্ষেপে ঘটনাটি জানাল।
যুবকটি ভুরু তুলে সব শুনল, তার মুখে কোনও স্মৃতির রেখা ফুটল না। ভরতের সামনে সে বলল, তুমি হিন্দু? এ বাড়িতে এক সময় ছিলে? আশ্চর্য কিছু না। আমার পিতা বরাবর নিষ্ঠাবান মুসলমান। প্রতিদিন পাঁচ ওক্ত নামাজ পড়েছেন। পুলিশের বড় কর্তা ছিলেন, ডিউটির সময়েও নিষ্ঠার সঙ্গে রোজা রাখতেন, প্রতি বৎসর শবে বরাতের সময় আড়াই-তিন শো গরিব-আতুরকে খাদ্য বস্ত্র দান করেছেন নিজের হাতে। একমাত্র শরাব পান করা ছাড়া আর কোনও গুণাহ ছিল না। খাঁটি মুসলমান হয়েও অন্য ধর্মের প্রতি কোনও বিদ্বেষ পোষণ করেননি, আগ বাড়িয়ে অনেক হিন্দুকে সাহায্য করেছেন, এ জন্য তাঁকে মূল্যও দিতে হয়েছে। আমাদের মোল্লারা এক সময় রটিয়ে দিয়েছিল, মীর্জা খোদাবক্স কাফেরদের চাটে।
ভরতের জিজ্ঞাসু চক্ষু দেখে সে আবার বলল, আমার পিতা এখন জীবত। এক আততায়ীর আক্রমণে চিরকালের মতন পঙ্গু হয়ে গেছেন। একটা পা অ্যামপিউট করতে হয়েছে, অন্য পায়েও শক্তি নেই, বিছানা ছেড়ে নিজে উঠতেই পারেন না। আপনি দেখা করতে চান, যান, তিনি হয়তো খুশিই হবেন।
সে হাঁক দিয়ে বলল, আবদুল, এই মেহমানকে আব্বাজানের কাছে নিয়ে যা। এই বারমহলেই অন্য একটি ঘরে একটা মস্ত বড় পালকে সবাঙ্গ চাঁদর ঢাকা দিয়ে আধশোওয়া হয়ে আছেন মীর্জা খোদাবক্স। একটা ঝাড়লণ্ঠন জ্বলছে, কক্ষটি আলোকোজ্জ্বল, সেই আলোতে মীর্জা সাহেব একটি বই পড়ছেন, অন্য হাতে আলবোলার নল। পাশের ছোট টেবিলে মদের বোতল ও গেলাস। আগে মীর্জা সাহেবের দাড়ি ছিল না, ভয় জাগানো মস্ত গোঁফ ছিল, এখন মুখভর্তি চাপ দাড়ি, মাথায় সাদা রঙের ছোপ লেগেছে।
মীর্জা সাহেব প্রথমে চিনতে না পারলেও ভরতের মুখে দু-তিনটি বাক্য শুনেই ঘটনাটি স্মরণ করতে পারলেন। তিনি বললেন, ও সেই গো হত্যার বধেরা? সে তো এখনও মেটেনি। গো হত্যাও বন্ধ হয়নি, হিন্দুর দল আর মুসলমানদের দলও তাদের জেহাদ ছাড়েনি। মাঝখান থেকে সেবারের দাঙ্গায় পাঁচ-সাতজন নিরীহ লোকের প্রাণ গেল! গোরর নামে মানুষের প্রাণ যায়!
হঠাৎ তিনি হো-হো করে হেসে উঠলেন। তারপর বললেন, সেবার তোমার মাথায় চোট লেগেছিল না? সেই থেকে নিশ্চয়ই তোমার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে। নইলে তুমি আমার কাছে ফিরে আসবে কেন? আমি তোমার কোনও উপকার করিনি, কর্তব্য পালন করেছিলাম মাত্র। উপকারীকে দ্রুত ভুলে যাওয়াই তো এ দুনিয়ার নিয়ম!
ভরত লজ্জিতভাবে বলল, আমার অনেক আগেই আসা উচিত ছিল। কিন্তু সেবারে আমি ভয় পেয়ে কটক শহরে পালিয়ে গিয়েছিলাম। তারপর অনেক দেশ ঘুরে মীর্জা সাহেব বললেন, বেশ করেছ। কটক শান্ত জায়গা, দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয় না। পাটনায় এসেছ, সাবধানে থেকো। এখানে আবার যে-কোনও দিন দাঙ্গা বাধতে পারে। তোমার ব্যাঙ্ক বুঝি তোমায় আবার পাটনায় বদলি করেছে?
ভরত বলল, জি না। সে চাকরি আমি অনেক দিন আগে ছেড়ে দিয়েছি। এখন আমি স্পোকেন ইংলিশ শেখাবার স্কুল খুলেছি।
পাশ ফিরে তিনি ভরতের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, স্পোকেন ইংলিশ? তুমি ইংরেজি ভাল জানো? শেক্সপীয়ার পড়েছ?
ভরত বলল, যৎসামান্য।
মীর্জা সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁমলেট-এর শেষ লাইনটা বলতে পারো?
ভরতের মনে পড়ল না।
মীর্জা সাহেব তাঁর দু হাত বুকের ওপর আড়াআড়ি রেখে বললেন, অ্যান্ড দা রেস্ট ইজ সাইলেন্স! তারপর চুপ করে রইলেন বেশ কিছুক্ষণ।
ভরত অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। এবার কি তার বিদায় নেওয়া উচিত! মীর্জা সাহেব কড়িকাঠের দিকে চেয়ে আছেন। যাওয়ার আগে কিছু একটা বলা উচিত, সেই কথাটা ভরত খুঁজে পাচ্ছে না।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মীর্জা সাহেব বললেন, তুমি আমার কাছে কেন এসেছ ঠিক করে বলো। তো? কোনও কারণে পুলিশের সাহায্যের দরকার? আমি তো আর নেই, তবে এখনও কেউ কেউ আমার কথা মানে।
ভরত বলল, না, আমি সে রকম কোনও প্রয়োজনে আসিনি। শুধু আপনাকে একবার দেখতে ইচ্ছে হল।
মীর্জা সাহেব বললেন, এই তো দেখলে। দিন গুনছি। ব্যাটারা আমাকে একেবারে খতম করে দিল না কেন?
শরাবের গেলাসে একটা চুমুক দিয়ে বললেন, আমার আততায়ীরা ছিল মুসলমান। গুণ্ডা বদমাশ সব সম্প্রদায়ের মধ্যেই আছে। আমাকে যদি কোনও হিন্দু গুণ্ডা মারত, তা হলে ব্যাপারটা সাম্প্রদায়িক রং পেয়ে যেত। কিছু হিন্দুর ওপর বদলা নেওয়া হত, আমার পরিবারের লোকদের সমস্ত হিন্দুদের ওপরই জাতক্ৰোধ জন্মে যেত। একজন আধজনের দোষে সমগ্র জাতটাকে ঘৃণা করা চরম অশিক্ষার লক্ষণ। তুমি একটু শরাব পান করবে নাকি, তা হলে গেলাস আনতে বলি।
ভরত বলল, আজ্ঞে না, আমার অভ্যেস নেই। আমি বরং এবার যাই।
মীর্জা সাহেব বললেন, খোদা হাফেজ। যদি ইচ্ছে হয়, আবার এস। ভাল করে শেক্সপীয়ারের। একখানি গ্রন্থ পড়ে এলো তা নিয়ে কথা বলা যাবে।
বাইরে বেরিয়ে আসার পর ভরতের মনে পড়ল, সেলিনা নাম্নী পরিচারিকাটির কথা জিজ্ঞেস করা হল না। সে তাকে বড় মমতাভরে সেবা করেছিল। তাকে আর একবার দেখলে ভাল লাগত।
মীর্জা সাহেবের কাছে ভরত মাঝে মাঝে আসবে ঠিক করলেও আর যাওয়া হয়ে উঠল না। শেক্সপীয়ারের কথা বলে মীর্জা সাহেব ভয় পাইয়ে দিয়েছেন। তেমন ভাবে সে ওই ইংরেজ মহাকবির রচনা পড়েনি, আবার কি নতুন করে পড়াশুনো শুরু করতে হবে? মন যে বড় অস্থির হয়ে আছে। মানুষের সঙ্গ পাবার জন্য সে ব্যাকুল, মীর্জা সাহেবের মতন একজন অসুস্থ মানুষের কাছে গিয়ে বসলে কি সে অভাব মিটবে?
ক্লাসে পড়ানোর ব্যাপারটাতেও একঘেয়েমি এসে গেছে। বয়স্ক ছাত্রদের কারুরই প্রকৃত লেখাপড়া শেখার আগ্রহ নেই। তারা হিন্দি বা উর্দুতে কিছু কিছু বাক্য তৈরি করে আনে, শুধু সেগুলিরই ইংরেজি আগে ভাগে জেনে নিতে চায়। আই অ্যাম অ্যাট ইওর সার্ভিস, আই অ্যাম ইওর মোস্ট ওবিডিয়েন্ট সারভেন্ট স্যার, মাই হোল ফ্যামিলি ইজ অ্যাট ইওর মার্সি…এর বাইরে অন্য কোনও বিষয় বা বইপত্র নিয়ে কথা বলতে গেলে ছাত্ররা অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে, হঠাৎ বিদায় নিতে চায়।
তার স্কুলের সুনাম অবশ্য বেড়েই চলেছে। ছাত্রসংখ্যা বাড়াবার জন্য নানান মহল থেকে চাপ আসে। অনেক সময় কঠিন কথা বলে কোনও কোনও প্রভাবশালী ব্যক্তিকেও ফিরিয়ে দিতে হয়। তার একার পক্ষে আর বেশি পড়ানো সম্ভব নয়। আরও শিক্ষক নিয়োগ করে রীতিমতন একটা স্কুল চালাবারও ইচ্ছে নেই তার। এদিকে অ্যান্ড্রজ সাহেবের স্কুল থেকে প্রস্তাব এল, ভরত সেখানে যোগ দিলে অনেক বেশি টাকা পাবে, ভরত সে প্রস্তাবও উড়িয়ে দিল।
একদিন আর একজন পূর্বপরিচিত এসে হাজির হল ভরতের বয়স্ক পাঠশালায়। শিউপূজন সহায়, কংগ্রেসের নেতা এবং ইদানীং একজন বড় ব্যবসায়ী। গোহত্যা বন্ধ আন্দোলনের একজন জোরালো প্রবক্তা হিসেবে এ অঞ্চলের বহু মানুষ তাকে চেনে। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে কংগ্রেসের অধিবেশনে উকিল ব্যারিস্টারদেরই প্রাধান্য, তাঁরা ইংরেজি বক্তৃতার বান ছোটান। শিউপূজন ইংরেজি জানে না, সে বুঝেছে যে ইংরেজি না শিখলে সর্বভারতীয় নেতৃত্বে স্থান পাবার কোনও আশা নেই।
ভরতকে চিনতে পেরে শিউপূজন খুবই আহ্লাদিত। আবেগের বশে কোলাকুলি করে ফেলল। ভরত যে আর ছাত্র নিতে চায় না, সে কথা এর মুখের ওপর বলে কী করে? সে বলল, শিউপূজনজি আপনাকে শেখাবার মতন ইংরিজি আমি জানি না। বক্তৃতা দেবার মতন ইংরিজি শিখতে হলে আপনি সাহেবদের স্কুলে যান।
শিউপূজন বলল, সাহেবদের আমি ঘৃণা করি। দৈবাৎ সাহেবদের সঙ্গে গায়ের ছোঁয়া লেগে গেলে আমি গঙ্গায় স্নান না করে কিছু খাই না। আমি কি বেঞ্চিতে বসে অন্য ছাত্রদের সঙ্গে ইংরিজি শিখব? সিংহজি, তোমায় যখন পেয়েছি, আমি তোমার বাড়ি আসব, তুমি আমার বাড়িতে যাবে, আমরা সর্বক্ষণ ইংরেজিতে বাতচিত করব। এইভাবে তুমি আমায় শেখাবে। তুমি নাকি সূর্য প্রসাদের ছেলেকে শেখাতে রাজি হওনি, এখান থেকে হঠিয়ে দিয়েছ? ওরা কিন্তু খুব রগচটা লোক। অনেক ক্ষমতা।
ভরত বলল, একজন মাস্টার কাকে শেখাবে না শেখাবে, সে ব্যাপারে তার স্বাধীনতা থাকবে না? শিউপূজন বলল, ওসব কথা ছাড়ো! এখন থেকে তুমি প্রতি সন্ধেবেলা আমার বাড়ি খেতে যাবে। মাছ খাওয়াতে পারব না, খাঁটি ঘি আর মালাই পাবে। হ্যাঁ ভাল কথা, শিগগিরই কলকাতায় কংগ্রেসের অধিবেশন হচ্ছে, তুমি সেখানে যাচ্ছ তো? আমরা একসঙ্গে যাব।
ভরত বলল, না, আমি কলকাতা যাব না। শিউপূজন বলল, সে কী, কেন যাবে না? তুমি তো কংগ্রেস সম্পর্কে আগ্রহী ছিলে। কলকাতায় খুব বড় অধিবেশন হবে।
ভরত বলল, এখন আর আমার কংগ্রেস সম্পর্কে আগ্রহ নেই। শিউপজন অবাক হয়ে বলল, কংগ্রেসের প্রভাব ক্রমশ ছড়াচ্ছে, এখনই তো আরও বেশি মানুষের যোগ দেওয়া উচিত। তোমার কলকাতা যাবার ভাড়া আমি দিয়ে দেব। তোমাকে ডেলিগেট করে নেব আমি। শীতকালে সব স্কুল বন্ধ থাকে। একজন বাঙালি সঙ্গে থাকলে আমারও সুবিধে হবে।
ভরত বলল, আমি বাঙালি নই, আসামের মানুষ। শিউপূজন বলল, বাংলা ভাষাটা তো জানো। তোমার সঙ্গে কথা বলে বলে ইংরিজির সঙ্গে সঙ্গে বাংলাটাও ঝালিয়ে নেব।
শিউপূজন ছাড়ল না, সে প্রায়ই আসে, ভরতকে জোর করে নিজের বাড়িতে নিয়ে যায়। কলকাতায় যাবার পরিকল্পনা করে। ওদিকে বারীনও তাকে বরোদায় নিয়ে যাবার জন্য লেগে আছে। কলকাতা যাবার বিন্দুমাত্র অভিপ্রায় নেই ভরতের, শিউপূজনের হাত থেকে ছাড়া পাবার জন্য সে বরং বরোদা যেতে রাজি আছে।
একদিন মধ্য রাতে প্রবল শোরগোল শুনে ভরতের ঘুম ভেঙে গেল। কিছু লোকজন আগুন আগুন বলে চিৎকার করছে। এই শীতকালে শহরের এখানে সেখানে প্রায়ই আগুন লাগে। শীত কাটাবার জন্য অনেকে ঘরের মধ্যে কাঠের ধুনি জ্বালে, তারপর অসাবধানতায় সেই আগুন ছড়িয়ে যায়। আজ আবার কোথায় লাগল?
ভরত উঠে দেখতে গেল জানলা দিয়ে। দোতলায় সে একা থাকে। তার পরিচারকটি রাত্রে নিজের বাড়ি চলে যায়। ঘরের দরজা বন্ধ, তাই ভরত কিছুক্ষণের জন্য টেরই পেল না যে আগুন লেগেছে তারই বাড়িতে। দরজা খুলে যখন সে দেখতে গেল, তখন সিঁড়ির অনেকখানি আগুন উঠে এসেছে।
বাঁচার সহজাত প্রেরণায় সে ছুটে বেরুতে গেল সেই আগুন ভেদ করে। খানিকটা গিয়েও থমকে গেল সে। একেবারে খালি হাতে যাবে? কিছু টাকা পয়সা সে জমিয়েছে, কয়েকখানা গিনি ও মোহর সে রেখেছে একটি ছোট টিনের বাক্সে। সে বাক্সটা আবার এক কাঠের আলমারিতে তালা বন্ধ। অতি হুড়োহুড়িতে চাবি খুঁজে পাওয়া যায় না। চাবি পেলেও ঠিক খুলতে চায় না। শেষ পর্যন্ত বাক্সটা যখন সে বার করল, ততক্ষণে আগুন পৌঁছে গেছে ওপরের দরজা পর্যন্ত। কাঠের রেলিংটা দাউ দাউ করে জ্বলছে। এর মধ্য দিয়ে যাওয়া অসম্ভব। বাক্সটার লোভে ভরত জীবন বিপন্ন করে ফেলেছে।
অনেক বিপদ পার হয়ে এসেছে ভরত, বেঁচে থাকার জেদ সে কখনও ছাড়েনি। বাঁচতে তাকে হবেই। বাক্সটা বগলে নিয়ে সে দৌড়ে পাশের ছাদে গিয়ে পাঁচিল টপকে ঝাঁপ দিল অন্ধকারে। পায়ে দারুণ চোট লাগলেও সে মরল না, হ্যাঁচোর-প্যাঁচোর করে সরে গেল খানিকটা দূরে, কয়েকজন লোক এসে ধরাধরি করে তাকে নিয়ে গেল আরও নিরাপদ দূরত্বে।
সেখানে বসে বসে সে দেখতে লাগল অগ্নির লীলা। তার স্কুলের সব আসবাব সমেত বাড়িটা জ্বলছে। ওখানে তো কোনও আগুন ছিল না, কেউ কোনও দাহ্য পদার্থ বা তেল ছড়িয়ে দিয়ে আগুন লাগিয়েছে? এত তাড়াতাড়ি আগুনে সবটা গ্রাস করে নিল।
পায়ে অসহ্য যন্ত্রণা সত্ত্বেও ভরত হাসল। ভগবানের পরীক্ষা? আবার তাকে একটা পরীক্ষায় ফেলা হল? সারা জীবন যদি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়েও বাঁচতে হয়, তবু সে আর কোনও বিগ্রহের কাছে মাথা নোওয়াবে না।