দুপুরবেলা মমতাদের খাওয়া-দাওয়া শেষ হবার একটু পরেই এসে হাজির হলো পরেশ। তার হাতে একখানা এল পি রেকর্ড আর এক বাক্স মিষ্টি। এ রকম সে প্রায়ই অসময়ে আসে, কিছু না কিছু উপহারও সঙ্গে আনে। চাকরি করে না পরেশ, সে তার দাদার সঙ্গে ট্রান্সপোর্টের ব্যবসা শুরু করেছে, তাই তাকে দশটা-পাঁচটায় আবদ্ধ থাকতে হয় না কোথাও। সে এখন এ বাড়ির জামাই, তার তো এ বাড়িতে যখন তখন আসার অধিকার আছেই।
দরজা খুলে দিয়েছে টুনটুনি, তবু সে গলা তুলে জিজ্ঞেস করলো, কাকিমা কোথায়? কাকিমাকে ডাকো!
মমতা নিজের ঘরে ঢুকে পড়েছিলেন, তাঁকে আবার বেরিয়ে আসতেই হলো। পরেশ যখন। যে-জিনিসই আনুক তা সে শুধু টুনটুনিকে দিতে চায় না, সাড়ম্বরে বাড়ির সবাইকে জানিয়ে মমতার হাতে তুলে দেয়। নিজের বউকে চুপি-চুপি শুধু উপহার না দিয়ে সে যে বাড়ির গুরুজনদের হাতে সবকিছু দেয় এটা হয়তো তাদের পারিবারিক রীতি, কিন্তু এর মধ্যে খানিকটা দেখানেপনাও আছে।
পরেশ বললো, কাকিমা, আপনার জন্য এই ফিরোজা বেগমের নজরুলগীতির রেকর্ডটা এনেছি, আপনি গান শুনতে ভালোবাসেন। আর এই সন্দেশ আমাদের পাড়ার ভীম নাগের, স্পেশাল অর্ডার দিয়ে তৈরি।
মমতা যথারীতি কিন্তু কিন্তু ভাবে বললেন, আবার কেন এতসব এনেছো!
এর আগে পরেশ একটা রেকর্ড প্লেয়ারও এনে দিয়েছিল এইভাবে। সেটা টুনটুনির ঘরেই থাকে। রেকর্ডটাও টুনটুনিই বাজাবে, তবু মমতাকে হাত পেতে নিতে হয়, যেন এসব শুধু তাঁরই জন্য আনা হয়েছে।
মমতা খুবই অস্বস্তি বোধ করেন। মানুষের কাছ থেকে কিছু পেলে, প্রতিদানেও কিছু দিতে হয়। এমনি এমনি কারুর কাছ থেকে কোনো জিনিস নিতে অভ্যস্ত নন মমতা। তা ছাড়া পরেশ এ বাড়ির নতুন জামাই, কেই তো কিছু দেওয়া উচিত।
সঞ্চয় বলতে আর কিছুই নেই মমতার। প্রতাপকে মাঝে মাঝেই অফিসের পেশকার-দারোয়ানদের কাছ থেকে ধার করতে হয়। বিমানবিহারীর কাছে বেশ মোটা টাকার ধার আছে, তা আজও শোধ করা হয়নি। তবু সংসারের টাকা ভেঙে মমতা এই কয়েক মাসে পরেশের জন্য শার্ট, স্যুটের কাপড় কিনে দিয়েছেন। পিকলু বাবলুর অন্নপ্রাশনের সময় পাওয়া অনেকগুলো ছোট ছোট সোনার আংটি ছিল, অন্যান্য কিছু গয়না অভাবের সময় বিক্রি করতে হলেও মমতা তাঁর ছেলেদের এই আংটিগুলো এতকাল রেখে দিয়েছিলেন। অত ছোট আংটি তো আর কোনো কাজে লাগবে না, এবারে সেগুলো ভেঙে টুনটুনির জন্য কানের একজোড়া দুল আর পরেশের জন্য একটা আংটি গড়িয়ে দিয়েছিলেন। মমতার একটা নাকছাবির হীরেও বসিয়ে দিয়েছিলেন পরেশের সেই আংটিতে। ওদের বিয়ে উপলক্ষে একটা কিছু তো দেওয়া দরকার, আর দিতে গেলে ভালো জিনিসই দিতে হয়। হালকা ফিনফিনে গয়না মমতা কিছুতেই কারুকে দিতে পারেন না।
শুধু পিকলুকে তার ঠাকুদার দেওয়া একটা আংটি রেখে দিলেন মমতা। পিকলুর জিনিসপত্র সব চলে গেলে যেন পিকলুও চিরকালের মতন হারিয়ে যাবে।
এই যে আজ একটা লং প্লেয়িং রেকর্ড আনলো পরেশ, মমতার হাতে প্রথম তুলে দিল, এ জন্য পরেশকে আবার কিছু দিতে হবে। যতক্ষণ না দিচ্ছেন, মমতা শান্তি পাবেন না।
বিয়ে হয়েছে বলেই টুনটুনিকে আলাদা একটা নিজস্ব ঘর দিতে হয়েছে। পরেশ মাঝে মাঝে রাত্তিরটাও থেকে যায়। মুন্নিকে এখন শুতে হয় সুপ্রীতির সঙ্গে, ও বেচারার পড়াশুনোর খুব ক্ষতি হয় তাতে। সে ঘরটা একেবারে সরু, এক ফালি, আগে ভাঁড়ার ঘর ছিল। উপায় কী, আর
তা কোনো জায়গাও নেই। যতবার বাড়ি বদলানো হচ্ছে, ততবার জায়গা কমে যাচ্ছে, ঘরগুলোও ছোট ছোট হয় আজকাল, একটুও অতিরিক্ত জায়গা কেউ রাখে না। কালিঘাটের বাড়ি থেকে এই পরেশই জোর করে তাড়িয়ে দিয়েছিল মমতাদের, সে কথা যেন তার মনেই নেই, দিব্যি অম্লান বদনে হেসে হেসে কথা বলে।
বাড়িতে জামাই এলে কিছু খেতে দিতে হয়। মমতা সেই চিন্তা করতে লাগলেন।
রেকর্ড প্লেয়ারে ফিরোজা বেগমের রেকর্ডখানা চাপিয়ে পরেশ বললো, কাকিমা, আপনিও আসুন, শুনবেন আসুন! এই টুনটুনি, কাকিমাকে বসতে দাও!
গান শুনতে ভালোবাসেন মমতা, কিন্তু তিনি শুধু ভেবে যাচ্ছেন, পরেশকে কী খেতে দেবেন? বাড়িতে সে রকম কিছু নেই। দোকান থেকে কিছু কিনে আনতে হলেও কে যাবে? মুন্নি কলেজে গেছে। টুনটুনিকে তার বরের সামনে থেকে উঠিয়ে দোকানে পাঠানো যায় না। একটা ঠিকে ঝি শুধু সকালে আর বিকেলে এসে বাসন মেজে দিয়ে যায়, আর কোনো কাজের লোক রাখা হয়নি। অসময়ে কোনো অতিথি এসে পড়লে এই মুশকিল হয়।
বাড়িতে কয়েকখানা লুচি ভেজে, বেগুন ভাজা করে দেওয়া যায়। ময়দা থাকলেও ঘি নেই। ঘি খাওয়া তে উঠেই গেছে। প্রতাপ গরম ভাতের সঙ্গে ঘি পছন্দ করতেন, এখন ভালো ঘি’র অসম্ভব দাম বলে প্রতাপ ঘি কেনা বন্ধ করে দিয়েছেন। দালদা’র লুচি কি নতুন জামাইকে দেওয়া যায়! মমতা কিছুতেই তা পারবেন না। লুচির সঙ্গে দু’একটা মিষ্টিও দেওয়া উচিত। পরেশ যে মিষ্টি এনেছে, সেই মিষ্টিই তাকে খাওয়ানোটা মোটেই ভালো দেখায় না।
ধুত, মাথার মধ্যে এইসব চিন্তা ঘুরলে কি গান শোনা যায়? মমতা বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে।
দোকান থেকে একটু ঘি আর মিষ্টি আনা দরকার। মমতা কোনোদিন একা একা মুদির দোকানে, মিষ্টির দোকানে যাননি। দুপুরবেলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে-মমতার হঠাৎ কান্না এসে গেল। এবং এই কান্নার সঙ্গে সঙ্গে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে মনে পড়ে গেল বাবলুর কথা। ছেলেটা অনেকদিন চিঠি দেয় না। প্রায় দেড় মাস অ্যামেরিকা থেকে কোনো চিঠি আসেনি। তবু বাবলুর ওপর রাগ হয় না তাঁর। মমতার মনে হয়, বাবলুকে এদেশ থেকে নির্বাসন দেওয়া হয়েছে, তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেই জন্য সে অভিমান করে আছে।
আঁচল দিয়ে চোখ মুছলেন মমতা।
টুনটুনির ঘরের দরজাটা খোলা ছিল, এখন সেটা আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গেল। ওদের কোনো চক্ষুলজ্জা নেই। ভেতরে এখনো জোরে জোরে গান বাজছে, আর কোনো শব্দ শোনা যাবে না।
তবু নতুন জামাইকে কিছু খাবার না দেওয়াটা খুবই অভদ্রতা। মমতা আটপৌরে শাড়িটাই একটু ঠিক করে পরে নিয়ে, পায়ে চটি গলিয়ে বেরিয়ে পড়লেন রাস্তায়। আগে করেননি কখনো, তাও করতে হবে। জীবনের আরও কী বাকি আছে কে জানে!
মাত্র চারটি রসগোল্লা কিনলেন বলে মিষ্টি দোকানের লোকটি তাঁকে গ্রাহ্যই করলো না। বোধ হয় ভেবেছে, কোনো বাড়ির ঝি। শাড়িটা পাল্টে আসা উচিত ছিল বোধ হয়। কিংবা এক সঙ্গে দশ-পনেরো টাকার জিনিস কিনলে হয়তো লোকটি মমতার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতো।
মমতা এক শো গ্রাম ঘি কিনবেন ভেবেছিলেন, তাঁর কাছে বেশি টাকাও নেই, কিন্তু পাড়ার মুদির দোকানটি বন্ধ। একটা স্টেশনারি দোকান খোলা আছে, সেখানে টিনের ঘি পাওয়া যায়, আড়াই শো গ্রামের কম নেই। দোকানের মধ্যে দাঁড়িয়েই মমতা ছোট্ট ব্যাগটা খুলে পয়সার হিসেব করে দেখলেন, আড়াই শো গ্রামের টিন কেনা যাবে না।
এই দোকানের কাউন্টারের একটি ফর্সা, অল্প বয়েসী ছেলে বললো, আপনি নিয়ে যান না, মাসিমা। পরে দাম দেবেন।
মমতা আড়ষ্টভাবে বললেন, পরে?
ছেলেটি ঘিয়ের টিনটা একটা কাগজের ঠোঙায় ভরতে ভরতে বললো, পরে এক সময়। পাঠিয়ে দেবেন। আমি চিনি আপনাকে। মুন্নিদির মা তো? মুন্নিদি এই দোকান থেকে প্রায়ই পাঁউরুটি নিয়ে যায়।
মমতা বিরাট একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। দোকানে কোনো জিনিস কিনতে ঢুকেও পয়সার অভাবে না কিনে ফিরে যাবার অভিজ্ঞতা তাঁর আগে কখনো হয়নি। হয়তো এটা এমন কিছুই ব্যাপার নয়। অনেকেরই এরকম হয়, দোকানদাররা কিছু মনে করে না। তবু মমতা। লজ্জায়, ক্ষোভে যেন মরমে মরে যাচ্ছিলেন, তাঁর চোখে আবার জল এসে যাবার উপক্রম। এই ছেলেটি যে তাঁকে কতখানি গ্লানি থেকে বাঁচালো, তা ও নিজেই বোধ হয় জানে না।
মমতা কৃতজ্ঞভাবে হেসে বললেন, সন্ধেবেলাতেই আমার মেয়ে এসে দাম দিয়ে যাবে।
ফিরে এসে মমতাকে রান্নাঘরে আবার কেরোসিন স্টোভ জ্বালতে হলো। তারপর তিনি ময়দা মাখতে বসলেন।
টনটনির ঘরের দরজা বন্ধ। বিরাট জোরে গান বাজছে। পরেশ দুপুরবেলা এলে ঐ ঘর থেকে টুনটুনিকে আর বেরুতেই দেয় না। আর আড়াই মাস বাদে টুনটুনির বাচ্চা হবে।
ময়দা মাখা হয়ে যাবার পর লেচি করে সবে বেলতে শুরু করেছেন মমতা, এই সময় সুপ্রীতি এলেন রান্নাঘরে। এই সময় সুপ্রীতি ঘুমিয়ে থাকেন, কিন্তু পাশের ঘরে এত জোরে গান বাজলে কার সাধ্য ঘুমোয়!
রোগা হতে হতে একেবারে শালিক পাখির মতন চেহারা হয়েছে সুপ্রীতির। সেই সঙ্গে বেড়েছে শুচিবাই। ঘরে তিন-চারটি ঠাকুর দেবতার পট টাঙিয়ে পুজো-আচ্চা করেন। একমাত্র মুন্নি ছাড়া আর কারুর সঙ্গে তাঁর বিশেষ কথাবাতাই হয় না আজকাল।
মমতার ঠিক সামনে বসে পড়ে সুপ্রীতি বললেন, আজ আবার দুপুরবেলা পরেশ এসেছে।
এটা ঠিক প্রশ্ন নয়, বেশ স্পষ্ট অপছন্দের উক্তি মমতা কিছু বললেন না।
সুপ্রীতি আবার বললেন, যখন তখন এরকমভাবে আসে, এত জোরে জোরে গান বাজায়, মাঝে মাঝে ওর বন্ধুদের আনে, এরপর খোকন না একদিন হঠাৎ মাথা গরম করে বসে!
এটা মমতারও মনের কথা। প্রতাপের মেজাজের জন্য সবসময় মমতাকে কাঁটা হয়ে থাকতে হয়। টুনটুনির সঙ্গে পরেশের বিয়েটা এখনও প্রতাপ মেনে নিতে পারেননি। কোনদিন যে প্রতাপ পরেশকে হঠাৎ দাবড়ানি দিয়ে বসবেন, তার ঠিক নেই।
মমতা তবু মৃদু গলায় বললেন, পরেশ এখন বাড়ির জামাই, সে তো আসবেই।
সুপ্রীতি বললেন, বাড়ির জামাই, তাকে নেমন্তন্ন না করলে আসবে কেন? আমাদের সময়। জামাইরা এমন নির্লজ্জ ছিল না।
মমতা বললেন, এখন দিনকাল অন্য রকম, অত নিয়মটিয়ম কেউ মানে না। ওদের অল্প বয়েস!
–বিয়ে করে পরেশ ওর বউকে এখানে কতদিন ফেলে রাখবে? টুনটুনিকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতে পারে না?
–আপনি ভুলে গেছেন দিদি, পরেশের বাবা মারা গেছে, এখনও কালাশৌচ চলছে, এক বছরের মধ্যে বিয়ে করা চলে না। সেই জন্যই তো গোপনে রেজিষ্ট্রি বিয়ে করেছে, বাড়িতে কিছু জানায়নি।
–টুনটুনিরও তো এখন কালাশৌচ, তার মধ্যে এইসব কাণ্ড, ছি ছি ছি ছি, ভাবলেও গা-টা ঘিন ঘিন করে। বাড়িতে জানায়নি তো আমরা কী করবো? আমরা কি ওকে ঘরজামাই হতে বলেছি? ওদের তো শুনি অনেক পয়সা আছে, অন্য জায়গায় বাড়ি ভাড়া করে পরেশ তার বউকে রাখতে পারে না?
মমতা চোখ তুলে সুপ্রীতির দিকে তাকালেন। এই প্রশ্নের উত্তর মমতা দেবেন কী করে? তিনি কি পরেশকে এ কথা জিজ্ঞেস করতে পারেন?
সুপ্রীতি আবার বললেন, এই দুপুরবেলা, তোমার একটু বিশ্রাম নেই, তুমি ওদের জন্য লুচি ভাজতে বসলে। টুনটুনিটা কি, সে নিজে এসব করতে পারে না?
মমতা বললেন, তাতে কী হয়েছে? ওদের নতুন বিয়ে…আমি দু’খানা লুচি ভেজে দেবো, তাতে আর কতক্ষণ সময় লাগবে। আপনি শুয়ে পড়ুন গিয়ে দিদি!
সুপ্রীতি বললেন, মমো, আমি জানলা দিয়ে দেখলাম, তুমি বাইরে বেরুলে। তুমি বুঝি ওদের জন্য কিছু কিনতে টিনতে গিয়েছিলে?
–বাড়িতে কিছু ছিল না, লুচি ভাজার জন্য একটু ঘি…
–মমো, তুমি নিজে গেলে ঐ সব আনতে? টুনটুনিকে বলতে পারলে না? তুমি ঐ সব কিনে ফিরে আসছিলে, তোমাকে দেখে আমার বুকটা ভেঙে যাচ্ছিল! আমাদের বাড়ির কত আদরের বউ ছিলে তুমি, খোকন আমাদের একটা মাত্র ভাই, তার ঘাড়ের ওপর আমরা সবাই চেপে বসেছি। আমি এতদিন অসুখে ভুগলাম, সব ধকল তোমাকেই তো সহ্য করতে হলো!
–আহা একটু দোকানে গেছি, তাতে কী হয়েছে? আজকাল এ রকম অনেকেই যায়!
–তুমি মজুমদার বাড়ির বউ! টুনটুনি ভেবেছি কি, মামাবাড়িতে বসে যা খুশি করবে? ওর বাপটা একটা অপদার্থ, অমানুষ! মেয়েটার কথা একবার ভাবলোও না?
সদর দরজায় বেল বেজে উঠলো। কথা থামিয়ে সুপ্রীতি আর মমতা দু’জনেই উৎকর্ণ হলেন। এখন আবার কে আসবে? মুন্নির কলেজ থেকে ফেরার সময় হয়নি, ঠিকে ঝি পাঁচটার আগে আসে না। প্রতাপ হঠাৎ আদালত থেকে ফিরে এলেই মুশকিল।
মমতার হাতে ময়দা মাখা, সুপ্রীতি বললেন, আমি দেখছি।
সুপ্রীতি দরজার কাছে পৌঁছোবার আগেই টুনটুনি আর পরেশ বেরিয়ে এসেছে। পরেশই দরজা খুলে দিল। তারই বয়েসী আর দুটি যুবক এসেছে। যেন এটা পরেশেরই নিজের বাড়ি,
এই ভঙ্গিতে পরেশ বললো, আয়, আয়, এত দেরি করলি!
সুপ্রীতি রান্নাঘরে ফিরে এসে মুখ চোখ গোঁজ করে বললেন, পরেশের দু’জন বন্ধু এসেছে। এ সব কী শুরু হলো, মমো? এটা কি একটা আড্ডাখানা?
মমতা নীরবে হাঁটুতে থুতনি চেপে রইলেন।
সুপ্রীতি বললেন, আমি টুনটুনিকে ডেকে বলছি, এ বাড়িতে এসব উপদ্রব চলবে না। প্রতাপ এসে দেখলে দাপাদাপি করবে! প্রতাপেরও শরীর ভালো না।
মমতা বললো, থাক, আজকের দিনটা থাক।
সুপ্রীতি বললেন, পরেশ এ বাড়িতে বন্ধুদের ডেকে আড্ডা বসাবে, আর তুমি তাদের সবাইকে লুচি ভেজে খাওয়াবে? এত আস্কারা দিও না। তুমি মুখে কিছু বলতে না পারো, আমি পরেশকে ডেকে বলছি, তোমার বউকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাও।
মমতা আবার বললেন, আজ থাক। টুনটুনির বাচ্চা হবে, এই অবস্থায় ও অন্য কোথাও গিয়ে একাও তো থাকতে পারবে না।
–কেন পারবে না? আজকাল কত অল্প বয়েসী ছেলেমেয়ে বিয়ে করে আলাদা বাসা ভাড়া করে থাকে। তাদের ছেলেপুলে হয় না?
পরেশের বন্ধুদের জন্য আরও খানিকটা ময়দা মাখতে লাগলেন মমতা, সুপ্রীতি গজগজ করতে করতে বঁটি নিয়ে বেগুন কেটে দিলেন।
মমতার ভয়টা অন্য জায়গায়। টুনটুনি একটা ভুল করে ফেলেছে, সেই জন্যই পরেশের সঙ্গে তার বিয়েটা বাধ্য হয়ে মেনে নিতে হয়েছে তাঁদের। কিন্তু পরেশের মতিগতি ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। নিজের বাড়িতে সে এই বিয়ের কথা জানায়নি। পরেশ যদি হঠাৎ এ বাড়িতে আসা বন্ধ করে দেয়, টুনটুনিকে আর না নেয়? তাহলে কি টুনটুনি আর তার গর্ভের সন্তানের বোঝা সারা জীবন প্রতাপকেই টানতে হবে? অথবা পরেশের নামে তখন মামলা-মকদ্দমা করতে হবে, সে একটা বিশ্রী ব্যাপার। সেই জন্যই তো মমতা কোনো রকমে একটা বছর সহ্য করে যেতে চান। একটা বছর পর অন্তত পরেশ যদি ভালোয় ভালোয় টুনটুনিকে নিয়ে যায়
এই সময় টুনটুনি রান্নাঘরে আসতেই মমতা সুপ্রীতির দিকে একটা স্থির দৃষ্টি দিয়ে অনুনয় করলেন, যেন তিনি ঐ প্রসঙ্গটা না তোলেন।
টুনটুনি বললো, ও মা, তোমরা এইসব লুচিটুচি করতে গেছ কেন? ওর বন্ধুরা কাটলেট এনেছে। এই একগাদা!
মমতা ক্লিষ্টভাবে বললেন, না, না, ওরা খাবার আনবে কেন? তুই বারণ করে দিস।
সুপ্রীতি রাগ গোপন করে চলে গেলেন নিজের ঘরে।
পরেশ তার বন্ধুদের নিয়ে বেরিয়ে গেল, সাড়ে পাঁচটায়, টুনটুনিকেও সঙ্গে নিয়ে গেল কোনো সিনেমা দেখাবে বলে। একটু পরেই প্রতাপের বাড়ি ফেরার কথা। পরেশ পারতপক্ষে প্রতাপের মুখোমুখি পড়তে চায় না। মমতা জানেন, সিনেমা দেখে ফেরার সময় পরেশ টুনটুনিকে বাড়ির দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে যাবে, তখন আর ওপরে আসবে না।
প্রতাপ অবশ্য ফিরলেন আরও দেড় ঘণ্টা বাদে। চোখ-মুখে ক্লান্তির ছাপ। আদালত থেকে একবার বাড়ি এসে আর বেরুতে ইচ্ছে করে না প্রতাপের, অন্য কোনো কাজ থাকলে একবারে। সেরে আসেন। বিমানবিহারী কিংবা মামুন সাহেবের কাছে যান প্রায়ই। আজ অবশ্য অন্য একটা জায়গায় যেতে হয়েছিল।
জামা-প্যান্ট ছাড়তে ছাড়তে প্রতাপ বললেন, আজ কী হলো জানো? কোর্ট থেকে সোজা বাড়ি ফিরবো ভেবে শিয়ালদা স্টেশনে এসেছি, হঠাৎ নেপুকাকার সঙ্গে দেখা। নেপুকাকা কে জানো তো? মালখানগরে আমাদের বাড়ির পুব দিকে, বড় পুকুরটার ধারে নেপুকাকাদের বাড়ি ছিল, তোমার বোধ হয় মনে নেই। আমিও প্রথমে চিনতে পারিনি, অনেক বছর দেখিনি, বেশ বুড়ো হয়ে গেছেন নেপুকাকা। বেশ লম্বা চওড়া মানুষ ছিলেন, এক সময় হাতের গুলি ফুলিয়ে আমাদের বলতেন, টিপে দ্যাখ, দাবাতে পারবি? একেবারে লোহা! দুগা পুজোর সময় পাঁঠা বলি দিতেন নেপুকাকা। আগে একজন কামারকে ডাকা হতো। একবার নেপুকাকা বললেন, কামার লাগবে কিসে, আমিই বলি দিতে পারি। খাঁড়া নিয়ে এক কোপে কাটা চাই, তাও আবার অষ্টমীর দিন জোড়া পাঁঠা, খালি গায়ে, কপালে সিঁদুর লাগিয়ে, খাঁড়া হাতে নেপুকাকাকে দেখাত ঠিক কাঁপালিকের মতন…
মমতার এ গল্প শোনার মন নেই। আজ বিকেল থেকে তিনি শুধু ভাবছেন ছেলের কথা। কেন যেন তাঁর মনে অযৌক্তিক একটা ধারণা তৈরি হয়ে গেছে যে, বাবলু এবার শিগগিরই ফিরে। আসবে। সেই যে শিলিগুড়িতে চাকরি নিয়ে গিয়েছিল, তারপর আর বাবলু বাড়ি ফেরেনি, মমতার সঙ্গে দেখা হয়নি, তিন বছরের বেশি হয়ে গেল। বাবলুরও কি মন কেমন করে না?
আর একটা কথাও মমতার মনে হচ্ছে। বাবলু যদি হঠাৎ এসে পড়ে, তাহলে সে থাকবে কোথায়? বাড়ি বদল করার সময় বাবলুর জন্য একটা আলাদা ঘর রাখার কথা চিন্তাই করা হয়নি। বাবলুকে কি চিরকালের জন্য নিবাসন দেওয়া হয়েছে? এ বাড়িতে সুপ্রীতির ঘর আছে, টুনটুনিকেও ঘর দিতে হয়েছে, শুধু বাবলু ও মুন্নির কোনো নিজস্ব ঘর নেই।
প্রতাপ বললেন, আমি চিনতে না পারলেও নেপুকাকা ঠিক চিনেছেন আমাকে। নেপুকাকার বয়েস খুব বেশি না, পঁয়ষট্টি ছেষট্টি হবে, কিন্তু কুঁজো হয়ে গেছেন এরই মধ্যে। নেপুকাকা আমার হাত ধরে টানাটানি করতে লাগলেন, উনি এখন থাকেন যাদবপুরে, সেখানে আমাকে জোর করে নিয়ে যাবেনই যাবেন। আমি আর শেষপর্যন্ত না বলতে পারলাম না।
মমতা জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এখন যাদবপুর ঘুরে এলে?
প্রতাপ বললেন, না গিয়ে পারলাম না যে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য মনটা খারাপ হয়ে গেল। এইসব পুরোনো মানুষজনের সঙ্গে আর দেখা না হওয়াই ভালো। যাদবপুরের অনেকখানি ভেতরে একটা জবরদখল কলোনিতে নেপুকাকা বাড়ি করেছেন। নেপুকাকার চার-চারটি মেয়ে, তারপর এক ছেলে। ছেলেটাই সবচেয়ে ছোট। দেশ ছেড়ে এসে নেপুকাকা এদিকে চাকরি বাকরি যোগাড় করতে পারেননি, কী করে এতদিন চালিয়েছেন কে জানে, তার মধ্যেও আবার মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন।
মমতা জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এখন কিছু খাবে? নাকি চানটান করে একেবারে রাত্তিরের খাওয়া খেয়ে নেবে?
প্রতাপ বললেন, নেপুকাকার ওখানে দুটো সিঙ্গাড়া খেয়েছি, খিদে নেই। তারপর শোনো, নেপুকাকার বউকে আমরা নতুন কাকিমা বলতাম, খুব সুন্দরী ছিলেন, এখন অবশ্য ওঁকে দেখে তা বোঝার উপায় নেই। নেপুকাকার বড় মেয়ের নাম সরস্বতী, সে আমাদের কানুর সমান। বয়েসী, সেই সরস্বতী এরই মধ্যে বিধবা হয়ে তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে নেপুকাকার, ওখানেই থাকে।
মমতা বললেন, আমি আসছি রান্নাঘর থেকে।
প্রতাপ বললেন, আর একটু দাঁড়াও, বাকিটা শুনে যাও। তোমাকে কেন এই সব বলছি জানো? একটা ব্যাপার দেখে মন খারাপ হয়ে গেল। নেপুকাকার সঙ্গে যখন কলোনির মধ্যে সেই বাড়িটাতে হাজির হলাম, তখন দেখি নতুন কাকিমা বেড়ার ধারে দাঁড়িয়ে পাশের বাড়ির এক মহিলার সঙ্গে ঝগড়া করছেন। কী খারাপ ভাষা যে বলছেন, তা তুমি কল্পনা করতে পারবে না। সেই আমাদের সুন্দরী নতুন কাকিমা, যার দিকে আমরা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম, তার এই দশা! নেপুকাকাও ঝগড়া থামাবার বদলে পাশের বাড়ির মহিলার দিকে তেড়ে গেলেন। আমার মনে হলো, এ কিসের মধ্যে এসে পড়লাম রে বাবা? এদিকে নেপুকাকা আমাকে ছাড়বেন না। যাই হোক, ঘণ্টাখানেক বসতেই হলো। টিনের চাল দিয়ে মোটামুটি দুখানা ঘরের একটা বাড়ি বানিয়েছেন। তার মধ্যে একগাদা লোক। নেপুকাকার ছোট ছেলেটি, বিয়ে করেছে, সে-ই সংসার চালায় এখন, সামান্য কী একটা চাকরি করে। সরস্বতীর বড় ছেলেটির বয়েস তেইশ, সে বেকার। আমাকে যে জোর করে ধরে নিয়ে গেলেন নেপুকাকা, তার আসল উদ্দেশ্য ঐ সরস্বতীর ছেলেটার জন্য একটা চাকরি যোগাড় করে দেওয়া। ওদের ধারণা, আমি একজন হাকিম, আমার অনেক ক্ষমতা। চাকরি দেবার কোনো ক্ষমতাই যে আমার নেই, তা ওদের বোঝাই কী করে। নেপুকাকা আর সরস্বতী প্রায় আমার পা ধরে আর কি!
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামান্য অন্যমনস্কভাবে প্রতাপ বললেন, সবচেয়ে আশ্চর্য কী লাগলো যেন, ওঁদের মনগুলো পর্যন্ত ছোট হয়ে গেছে। পুকুর ধারে মস্ত বড় বাড়ি ছিল নেপুকাকাদের, নেপুকাকা এক এক সময় ঐ অত বড় পুকুরের এক ধার থেকে বাজখাঁই গলায় ডাকতেন। আমাদের, আমরা এপার থেকে শুনতে পেতাম। সেই নেপুকাকা এখন ঘ্যানঘেনে সুরে কথা বলেন। এখন ঐ ছোট ছোট ঘুপচি ঘরের মধ্যে থাকে, তাই জগৎটাও ওদের কাছে ভীষণ ছোট, সব কথাই স্বার্থ দিয়ে জড়ানো। দেবে, দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করা যায়, কিন্তু মনটাও যদি ছোট হয়ে যায়, তাহলে আর মনুষ্যত্বও থাকে না। আত্মসম্মানজ্ঞানটা নষ্ট হয়ে গেলে মানুষের সবকিছুই চলে যায়।
মমতা ঝাঁঝালো স্বরে বললেন, আমাদেরও মন ছোট হয়ে গেছে। আমরাও তো ছোট ছোট ঘুপচি ঘরে থাকি! রিফিউজি কলোনি না হলেও …
প্রতাপ অবাক হয়ে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। তাঁর একটু অভিমান হলো। মমতা কি জানেন না যে, এই বাড়ি ভাড়াই তাঁর সাধ্যের অতিরিক্ত? তবু নেপুকাকাদের সঙ্গে তাঁর তুলনা চলে না।
মমতা বললেন, বাবলু যদি ফিরে আসে, তখন সে কোথায় থাকবে, তা কখনো ভেবে দেখেছো?
প্রতাপ বললেন, বাবলু? সে আসবে…চিঠি লিখেছে নাকি?
মমতা বললেন, তুমি কি চাও, তমার ছেলে আর না ফিরুক?
প্রতাপ বললেন, কী পাগলের মতন কথা বলছো? বাবলুর এখনও ফেরার সময় হয়েছে। নাকি? পি এইচ ডি কমপ্লিট না করে ফেরার তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তা ছাড়া, পলিটিক্যাল সিচুয়েশান খানিকটা ইমপ্রুভ না করলে–বিমান বলেছে, সামনের ইলেকশানে যারাই পাওয়ারে আসুক, বন্দীমুক্তি আর পুরোনো কেস উইথ ড্র করার ব্যাপারে তাদের কিছু প্রতিশ্রুতি দিতেই হবে।
–টুনটুনিকে যে তুমি একেবারে পছন্দ করো না, সেটা কি খুব বড় মনের পরিচয়?
–টুনটুনি যা কাণ্ড করেছে, সে জন্য তাকে চাবকানো উচিত ছিল, তবু তো আমি সব সহ্য করেছি।
–তবু টুনটুনি তোমার নিজের বোনের মেয়ে। সে যদি একটা ভুল করেই থাকে, তবু কি তাকে একেবারে ফেলে দেওয়া যায়? তুমি টুনটুনি আর পরেশকে এ বাড়ি থেকে তাড়িয়ে। দেবার কথা বলো নি?
প্রতাপ অভিযোগ শোনা একেবারে পছন্দ করেন না। তাঁর ব্যবহারের কোনো দোষ দেখালে তিনি উত্তর দেবার বদলে রেগে যান। তিনি গম্ভীরভাবে বললেন, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোজগার করছি, সংসার চালাতে প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে, আর ঐ মেয়ে এ বাড়িতে থেকে বেলেল্লা করবে? নিজের বোনের মেয়ে হলেও এসব সহ্য করবো না!
মমতা বললেন, আমারও মন ছোট হয়ে গেছে। ঠাকুরঝিকে তুমি বরানগরের বাড়ি থেকে আদর করে নিজের বাড়িতে ডেকে আনলে, তোমার নিজের দিদি, কিন্তু সত্যি কথা বলছি, এক এক সময় আমার মনে হয়, আমি কি সারা জীবন ধরে ঠাকুরঝির সেবা করে যাবো? ওর যখন অত বড় অসুখ হলো, তখন আমি এমনও ভেবেছি যে…
প্রতাপ ধমক দিয়ে বললেন, মমো! চুপ করো।
মমতা তবু বললেন, ঘুপচি ঘুপচি ঘরে থেকে আমাদেরও মন ছোট হয়ে গেছে। তোমার নেপুকাকার আর দোষ কী! নিজের দিদিকে তুমিও কি আজকাল সেই আগের মতন খাতির করো? দিনের পর দিন একটা কথাও তো বলো না ওঁর সঙ্গে।
প্রতাপ বললেন, তুমি খালি আমার দোষই দেখো!
মমতা বললেন, আমি নিজের দোষও অস্বীকার করছি না। সব সময় শুধু টাকার চিন্তা, এ আমার আর ভালো লাগে না! বাবলুটা কত কষ্ট করে ওখানে থাকে, তার মধ্যেই সে একবার তো টাকা পাঠিয়েছিল। তুমি তা ফেরত দিলে।
প্রতাপ বললেন, সে কষ্ট করে থাকে বলেই তার টাকা ফেরত দিয়েছি। টাকা রোজগার করতে গিয়ে তার পড়াশুনো নষ্ট করার দরকার নেই!
আর কথা না বাড়িয়ে প্রতাপ দপদপিয়ে চলে গেলেন স্নান করতে। মমতা টাকার খোঁচা দিলে প্রতাপের সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয়।
এক একদিন হঠাৎ একটা দারুণ অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে যায়।
স্নান সেরে ফিরে এসেই প্রতাপ আদালতের নথিপত্র খুলে গুম হয়ে বসে রইলেন। মমতার সঙ্গে একটা কথা বললেন না। মমতাও অনবরত চোখের জল মুছছেন। এই পরিবারে আজ আর গুমোট কাটার সম্ভাবনা ছিল না।
কিন্তু সিনেমা দেখে ফেরার সময় টুনটুনি নিচের চিঠির বাক্স থেকে একটা চিঠি নিয়ে এলো। মুন্নি কলেজ থেকে ফেরার সময় রোজ বাক্সটা দেখে আসে, এই চিঠি তার পরে এসেছে।
বিদেশের চিঠি দেখেই মমতার বুকটা ধক করে উঠলো। আজ সারা দিন বাবলুর কথা মনে পড়েছে, ডান চোখের পাতা কেঁপেছে কয়েকবার, ঠিক বাবলুর চিঠি এসেছে সেই জন্য। বাবলু। কি ফিরে আসছে!
টুনটুনির কাছ থেকে চিঠিটা নিয়ে স্ট্যাম্প দেখে মুন্নি বললো, এটা অ্যামেরিকার চিঠি নয় মা, বিলেতের।
লম্বা থামে বেশ মোটাসোটা চিঠি, যদিও ওপরে প্রতাপের নাম আছে, তবু মুন্নি বাবাকে দেখাবার আগেই ছিঁড়ে ফেললো। এক খামের মধ্যে তুতুল প্রত্যেকের নামে আলাদা আলাদা চিঠি দেয়। খাম খোলার পর মুন্নি নিজের চিঠিটা নিতে গিয়ে সবিস্ময়ে বললো, এর মধ্যে একটা চেক।
সুপ্রীতি জপে বসেছেন একটু আগে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে উঠতে পারবেন না। তবু মুন্নি তাঁকে চিঠি আসার কথাটা শুনিয়ে বাবার ঘরে চলে এলো।
প্রতাপ চেকটা নিয়ে বললেন, তুতুল টাকা পাঠিয়েছে, দু শো পাউন্ড, এ যে অনেক টাকা!
মুন্নি বললো, মা, তোমার খুব ফ্রিজের শখ, এবার একটা ফ্রিজ কিনে ফেললো।
মমতা স্বামীর দিকে জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে বললেন, আমার মাথার দিব্যি রইলো, তুমি এ টাকা কিছুতেই ফেরত পাঠাতে পারবে না। তোমার যত অহঙ্কারের ফল ভোগ করতে হয়। আমাদের।
প্রতাপ গম্ভীরভাবে বললেন, এবারে তুতুল বুদ্ধি করে চেকটা তোমার নামে পাঠিয়েছে। তুতুলের আগের টাকা আমি ফেরত দিইনি, সে মুসলমান বিয়ে করেছে বলে দিদি সে টাকা নিতে চায়নি। এবার এ টাকা ফেরত দেবার অধিকার শুধু তোমার।
মমতা হাত বাড়িয়ে চেকটা নিয়ে ভালো করে দেখলেন। চেক নয়, ব্যাঙ্ক ড্রাফট, সেটা সত্যিই মমতার নামে, এবং সত্যিই দু শো পাউন্ড!
মমতা তাকালেন টুনটুনির দিকে। এমন একটা সুখবর ওর হাত দিয়ে এসেছে। টুনটুনির। জন্য হঠাৎ বেশ স্নেহবোধ করলেন মমতা। আহা, পোয়াতী মেয়েটাকে রোজ এখন একটু দুধ খাওয়ানো দরকার।