বাহান্ন
জরুরী মিটিং ছিল রাত্রে।
জলপাইগুড়িতে হঠাৎ শীত জাঁকিয়ে পড়েছে। রোদ না ওঠার আগে বিছানা ছাড়ার কোন কথাই ওঠে না। এত বছর আবহাওয়ার সঙ্গে পরিচয় না থাকায় অনিমেষ আরও অলস হয়ে পড়েছিল। মাধবীলতারা যখন গেল তখন বাতাসে সবে ঠাণ্ডার আমেজ আর এই কয়দিনেই সেটা দাঁত নখ বের করে কামড়াতে আঁচড়াতে শুরু করেছে। অবশ্য এই বাড়িতে তাড়াহুড়ো করার কিছু নেই। সময় যেন আটকে আছে। কারো বাইরে কোন কাজ নেই, খাও এবং ঘুমোও। সকাল দশটার আগে এই বাড়ির উনুনে আগুন জ্বলে না। হেমলতা অবশ্য একটু তাড়াতাড়ি ওঠেন। কিন্তু খাট থেকে নামেন না। সেখানে বসেই ঘন্টাখানেক চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে গুরুনাম করেন। আর তারপরেই তাঁর কথা বন্ধ হয়ে যায়। শরীরে চার পাঁচটা কাপড় চাপিয়ে বাগানে ঘুরে ঘুরে ফুল তোলা হয়ে গেলে সেই যে ঠাকুর ঘরে ঢোকেন বেলা এগারটার আগে তাঁর সময় হয় না বের হবার।
ছোটমা ওঠেন দেরিতে। কিন্তু অনিমেষ মুখ ধুয়ে বারান্দার রোদে বসতে না বসতেই চা পেয়ে যায়। গরম চা আর এরারুট বিস্কুট। খানিক তফাতে আর একটা চেয়ারে বসে ছোটমা কথাবার্তা বলেন যেটুকু প্রয়োজন। বাড়ির মামলার ব্যাপারে উকিলের সঙ্গে দেখা করতে হবে কিনা, সেদিন বাজারে যাওয়ার প্রয়োজন আছে কিনা, কথাবার্তা এই চৌহদ্দিতে ঘোরাফেরা করে। কদিন হল অনিমেষ লোক লাগিয়ে বাড়ির ভেতরের জমি অনেকটা কুপিয়েছে। এতদিন আগাছা আর বড় ঘাসে জায়গাটার চেহারা ছিল বুনো, এখন কালো মাটি বেরিয়ে পড়ায় চোখে অন্যরকম দেখাচ্ছে। ছোটমা ওই কোপানো মাটিটা নিয়ে বেশ মেতে রয়েছেন। এর মধ্যে লোক দিয়ে কপির চারা পুঁতে দেওয়া হয়েছে ছড়িয়ে। নিয়ম করে দুবেলা জল দেওয়া চলছে। অনিমেষ লক্ষ্য করেছে কচি চারাগুলোর দিকে তাকিয়ে ছোটমার মুখে বেশ বাৎসল্যভাব ফুটে ওঠে।
আজ সকালে কপি নিয়ে কথা বলতে বলতে হঠাৎ ছোটমা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কিছু মনে করো না, একটা কথা জিজ্ঞাসা করব বলে কদিন থেকে ভাবছি।’
‘বল।’ অনিমেষ ঠাওর করতে পারছিল না।
‘তোমার বউ গিয়ে অবধি পৌঁছ-সংবাদও দিল না কেন?’
অনিমেষ অস্বস্তিতে পড়ল, ‘দিয়েছে হয়ত, যা ডাকের গোলমাল—।’
‘তাই বলে চিঠি আসবে না এ কেমন কথা। বেশ কয়েকদিন হয়ে গেল।’
‘এসে যাবে।’
ছোটমা আর কথা তোলেননি। কিন্তু কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে ছিল অনিমেষ। যত দিন যাচ্ছে একটা জেদ তার মধ্যে তিল তিল করে মাথা তুলছে। জেল ছেড়ে বের হবার পর কতগুলো বছরে সে কিভাবে বেঁচে ছিল? একটা কেন্নোর মত, মেরুদণ্ডহীন। যা কিছু গৌরব তা ছিনিয়ে নেবার জন্যে মাধবীলতা দিন রাত পরিশ্রম করে গিয়েছে। হয়তো অর্কর চোখে তার মা অনেক বিরাট, অনেক মহান। তাকে একটা খাঁচার মধ্যে আটকে রেখে মাধবীলতা হয়তো সুখী ছিল, আত্মপ্রসাদ লাভ করত কিন্তু সে দিন দিন ক্লীব থেকে ক্লীবতর হয়ে যাচ্ছিল। আজ যদি তার সঙ্গে সম্পর্ক না রাখতে চায় মাধবীলতা সে কেন হেদিয়ে মরবে। বরং এখানে এসে সে মানসিক দিক দিয়ে অনেক সুস্থ আছে। এখন মনে হয় অনেক কাজ করা যাবে। ঈশ্বরপুকুর লেনে থাকতে কাজ করতে চাওয়ার ইচ্ছেটাই লোপ পেয়ে গিয়েছিল।
অনিমেষ অবশ্য এখন অনেক সক্রিয়। সে ক্রাচ বগলে নিয়ে বাজারে যায়, উকিলের সঙ্গে দেখা করে, দরকার মত হেঁটে আসে চারপাশে। আর আছে জুলিয়েন। অনিমেষ এখনও নিজে সরাসরি জুলিয়েনের সঙ্গে কাজে নামেনি। কিন্তু আলোচনার সময় সে খবর পায়। ঠিকঠাক হাজির হয়, পরিকল্পনায় মতামত দেয়। দলের ছেলেরা যে তাকে গুরুত্ব দিচ্ছে এটা সে বুঝতে পারে, এবং বুঝে তার ভাল লাগে। নিজেকে আর খেলো বলে মনে হয় না। কিন্তু এসব সত্ত্বেও অনিমেষ একটি ব্যাপারে খুব অসহায় বোধ করে। মাধবীলতার ওপর নির্ভরতা তাকে টাকা পয়সার ব্যাপারে ভাবনা-চিন্তা থেকে বিরত রেখেছিল। এখন যত দিন যাচ্ছে সেটা প্রবল হচ্ছে। দুবেলা ডাল-ভাত খেয়ে শুয়ে থাকলে মহীতোষের রেখে যাওয়া টাকার সুদে হয়তো কোনরকমে চলে যায় কিন্তু এই বাড়ির কাছে নিজেকে মূল্যহীন বলে মনে হয়। কথাটা একদিন সে জুলিয়েনকে বলেছিল, ‘কি করা যায় বলুন তো! এভাবে বসে বসে খেতে ইচ্ছে করছে না।’
জুলিয়েন হেসেছিল, ‘তাহলে মাঠে নেমে পড়ুন। জীবনের আদ্দেকের বেশি তো খরচ হয়ে গেল, আমার তো আরো বেশি। কিছুই করা হল না। বাকি সময়টায় কিছু করতে হলে বাড়ি ছেড়ে চলে আসুন। গ্রামে কাজ শুরু করে দিন কিংবা চা বাগানে চলে আসুন।’
এই একটা ব্যাপারে সামান্য দ্বিধায় ছিল অনিমেষ। যে কারণে সে মাধবীলতার সঙ্গে কলকাতায় ফিরে যায়নি সেই কারণে চটজলদি এই বাড়ি ছেড়ে যায় কি করে? দুজন প্রায় অশক্ত মানুষ তার মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সে কিছুই করছে না তবু নাকি এরা স্বস্তিতে আছে। এখন দিন-রাতে হেমলতা হুটহাট করে বাড়ির ভেতরে মানুষ ঢুকতে দেখেন না। জলপাইগুড়ির সমস্ত চোর-ছ্যাঁচোড় বুঝি জেনে গেছে এই বাড়িতে অনিমেষ আছে। এক কথায়, এই বিশ্বাস এবং নির্ভরতাকে উড়িয়ে দিয়ে বেরিয়ে যেতে তার বিবেকে লাগছে। অবশ্য কাছাকাছি গ্রাম কিংবা চা-বাগানে জুলিয়েনের কথামতন গেলে সে জলপাইগুড়ির সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারে। চাই কি সপ্তাহে একদিন এখানে এসে থাকতে পারে যা কলকাতায় গেলে সম্ভব ছিল না। অনিমেষ সেই কথাটা ছোটমায়ের কাছে তুলল, ‘অনেকদিন তো হয়ে গেল এবার একটু নড়ে চড়ে বসি কি বল?’
ছোটমা কথাটা বুঝতে না পেরে চোখ ছোট করে তাকালেন। অনিমেষ বুঝিয়ে বলল, ‘চুপচাপ বসে আছি এতে তো আরও অকর্মণ্য হয়ে যাব।’
ছোটমা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কি কোন কাজের খোঁজ পেয়েছ?’
‘ঠিক চাকরি-বাকরি নয় তবে ওইরকম আর কি!’
‘কোথায়?’
‘এখনও ফাইন্যাল হয়নি। একজন আমাকে বলেছে গ্রামে কাজ করতে যেতে। আমিও ভাবছি এভাবে বাড়িতে বসে খাওয়ার কোন মানে হয় না। এই বাজারে একটা মানুষ চুপচাপ বসে থাকবে সেটাও ভাল দেখায় না।’
‘তোমার কি খুব অসুবিধে হচ্ছে?’
‘ঠিক তা নয়। আমি তোমাকে বোঝাতে পারছি না বোধহয়—!’
‘বুঝেছি।’
অনিমেষ দেখল ছোটমা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। তার চোখ গেটের দিকে। সেখানে একটা ল্যাজঝোলা পাখি চুপচাপ বসে রয়েছে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অনিমেষ বলল, ‘আমি প্রত্যেক সপ্তাহে একদিন বাড়িতে আসব।’
ছোটমা মুখ না ফিরিয়েই বললেন, ‘যা ভাল বোঝ তাই করো। কিন্তু তোমার শরীর এত ধকল সইতে পারবে তো?’
‘এখন তো আমি অনেক ভাল আছি। সিঁড়ি ভাঙ্গতে সামান্য অসুবিধে হয় আর উঁচু জায়গায় উঠতে পারি না। কিন্তু অনেকটা হাঁটতে পারি।’
‘ভাল।’
অনিমেষ বুঝতে পারছিল ছোটমা তার প্রস্তাবটাকে ঠিক মেনে নিতে পারছেন না আবার এমন ভান করছেন যে তাঁর কোন আপত্তি নেই! সে সামান্য হেসে বলল, ‘তোমার কোন অসুবিধে হবে না।’
ছোটমাও এবার হেসে ফেললেন। তারপর চলে যেতে যেতে ঘুরে দাঁড়ালেন, ‘দ্যাখো, আমি তোমাদের মত শিক্ষিত নই। কিন্তু একটা জিনিস বুঝেছি। জীবনের একটা সময় আসে যখন আর কিছুই চাইতে নেই। তখন সবই দিয়ে যাওয়ার সময়। আর, আর কেউ না জানুক আমার জীবনে এমন সময় কখনও আসেনি যখন আমি জোর গলায় চাইতে পেরেছি। এখন তো আর সে প্রশ্ন ওঠে না।’
ছোটমা চলে যাওয়ার পর অনিমেষ অনেকক্ষণ চুপচাপ বসেছিল। কথাটা সত্যি ভীষণ সত্যি। আর এই সত্যি কথাগুলো মেয়েরা সহজে বোঝে এবং বোঝায়। এটা সে বারে বারে দেখেছে। আর সেইসময় নিজেদের মধ্যে অনেক পার্থক্য সত্ত্বেও মেয়েরা এক হয়ে যায়। তার মনে হল, মাধবীলতা এখানে থাকলে ওই একই কথা বলত। ছেলেদের বোধহয় মনের বয়স বাড়ে না। সেই একই ভাবপ্রবণতার শিকার হয়ে তারা সারা জীবন বেঁচে থাকে। আর মেয়েরা যখন ছাড়ে তখন আমূল বদলে যায়।
দুদিন আগে মন্টু এসেছিল। চল্লিশ পেরিয়ে গেছে অথচ ও সেই একই রকম থেকে গেছে। হৈ চৈ চিৎকার। স্থূল সামান্য ব্যাপার নিয়ে রসিকতা এবং শরীর নাচিয়ে হাসা, স্কুলের সেই মনটাকে ও এখনও লালন করছে। এই বারান্দায় বসে ও যতক্ষণ গল্প করেছে তার অনেকটাই মেয়েদের নিয়ে। বাল্যকাল থেকে মন্টু যাদের সঙ্গে প্রেম করেছে তারা এখন কে কোথায় আছে তারই বিশদ বিবরণ দিয়ে অদ্ভুত সুখ পাচ্ছিল। সেইসব মেয়েরা তাদের যৌবন এবং সৌন্দর্য হারিয়ে এখন কি করুণ হয়ে গেছে তার বর্ণনা দিয়ে যেন তৃপ্তি পাচ্ছিল মন্টু। তারপর হঠাৎই জিজ্ঞাসা করল, ‘তোর ছেলেটা কিন্তু বুদ্ধিমান। প্রেম-ট্রেম করে?’
অনিমেষ হেসে ফেলেছিল, ‘কি জানি।’
‘নিশ্চয়ই করে। ওই বয়সে আমরা তিস্তার চরে মেয়েদের স্নান করা দেখতে যেতাম, তোর মনে নেই। তুই তো শালা উর্বশীর প্রেমে খাবি খাচ্ছিলি।’
‘কি আজেবাজে বকছিস?’
‘অবিরাম করকে তোর মনে নেই।’
‘অবিরাম নয় বিরাম, বিরাম কর।’
‘ওই একই হল। কলকাতায় ওদের সঙ্গে তোর দেখা হয় না?’
অনিমেষ ঘাড় নেড়েছিল, ‘দেখছিস তো হাঁটা চলা করতে অসুবিধে হয়।’
মন্টু বলল, ‘এখানে একবার নাকি এসেছিল। ছোট চুল, খুব সিগারেট খায়। তোর বউটা মাইরি খুব গম্ভীর। কি করে প্রেম করলি?’
হঠাৎ অনিমেষের মনে হল মন্টু গলে গেলে ভাল হয়। ঠিক এইরকম তরল কথাবার্তা তার সহ্য হচ্ছে না। চল্লিশ পেরিয়ে গেলেও মানুষের বয়স বাড়বে না? যা কিছু ভাবনা-চিন্তা আদি রসে আবদ্ধ থাকবে? কথা ঘোরাবার জন্যে সে জিজ্ঞাসা করল, ‘তুই রোজ শিলিগুড়ি যাস?’
‘হ্যাঁ। না গেলে পয়সা আসবে কোত্থেকে! ঘুষের পয়সায় বাড়িটার চেহারা পাল্টে দিয়েছি। একদিন গিয়ে দেখে আসিস।’
‘ঘুষের পয়সায় নিজের চেহারাটা পাল্টাতে পারিস না?’
‘মানে?’ মন্টু প্রথম অবাক হয়েছিল।
‘এই যেমন, তুই নিজের চেহারা মেরামত করে বাইশ বছরে নিয়ে গেলি, পারিস না?’
মন্টু হাসল, ‘তা তো হয়ই। ষাট বছর বয়সে লোকে ভিয়েনায় গিয়ে চামড়া পাল্টে আসে, জানিস না? আরে এসব করতে হলেও দু নম্বরী মাল চাই।’
অতএব মন্টু ভাল আছে। ওর সঙ্গে যারা পড়াশুনা করত তারাও যে যার মত আছে। শুধু অনিমেষ বেকার, অকর্মণ্য। মন্টু যেন ওর ব্যাপারে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ল। বলে গেল একটা কিছু ব্যবস্থা সে করার চেষ্টা করবে। অনিমেষের মনে হয় মন্টু আর আসবে না। যদি ও নেহাতই গবেট না হয় তাহলে বুঝতে পেরেছে যে অনিমেষ এখন আর তাকে পছন্দ করছে না। মন্টুর একটা কথা মনে পড়ছে অনিমেষের, ‘দ্যাখ, আমরা হলাম পাবলিক। আমরা রাজনীতির কিছুই বুঝি না। আমাদের অফিসে যে ইউনিয়ন জেতে আমি তাদেরই সাপোর্টার। গতবার কংগ্রেসী ছিলাম এবার সি পি এম। শালা, এ না করলে বাঁচা যাবে না।’
কথাটা বোধহয় ভারতবর্ষের মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে খুব লাগসই।
বিকেলে বেশ মেঘ করে এল। ঠাণ্ডাটাও জমেছে খুব। জলপাইগুড়িতে ইলেকট্রিক আলো প্রদীপের চেয়েও কমজোরী। তাও দুপুর থেকে নেই। সমস্ত বাড়িটার ওপরে একটা মরা ছায়া চেপে বসেছে অনেকক্ষণ। হেমলতা বিকেল তিনটেয় খেয়ে শুয়ে পড়েছেন। আজকাল তাঁর রাত অনেক বড়। অনিমেষ গেটের সামনে দাঁড়িয়েছিল। এইসময় পিয়ন এই পথে যায়। মাধবীলতা শেষপর্যন্ত চিঠি দিল না। কিন্তু তার মনে হত শেষপর্যন্ত একটা চিঠি না দিয়ে ও পারবে না। অর্ক যা জেনে গেছে তা ওর পক্ষে হয়তো খুবই কষ্টকর কিন্তু ছেলেটা তো পাল্টে যাচ্ছিল। অনেক কিছু সহজ চোখে দেখবার মত মন তৈরি হচ্ছিল। আকস্মিকতার আঘাত কমে গেলে ও কি নতুন করে ভাববে না? তাহলে ওর কাছ থেকেও একটা চিঠি পাবে অনিমেষ। এইসময়ে পিয়নের বদলে পরিতোষকে দেখতে পেল অনিমেষ। আরও বৃদ্ধ হয়েছেন পরিতোষ, লাঠিতে ভর রেখে কোনরকমে এগিয়ে আসছেন। অনিমেষকে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেমন আছ?’ অনিমেষ মাথা নেড়ে ভাল বলল। লোকটাকে বেশ কিছুদিন বাদে দেখছে সে। ওধারে আদালতে মামলা দায়ের করেছে এধারে মুখে হাসি ঠিক ফুটিয়ে রেখেছে।
পরিতোষ কাছে এসে বললেন, ‘বড় শীত পড়েছে হে, এত সহ্য হয় না।’
যেন রোজ দেখা হচ্ছে, খুব প্রীতির সম্পর্ক ভঙ্গীটা এইরকম। অনিমেষ বলল, ‘শীত যখন তখন বেরুলেন কেন?’
‘না বেরিয়ে পারলাম না হে। তুমি কি চিরকাল এখানেই থেকে যাবে ভেবেছ?’
‘দেখি।’
‘তোমার ছেলে-বউ চলে গেল বলেই কথাটা বললাম কিছু মনে করো না।’
অনিমেষ বৃদ্ধের মুখের দিকে তাকাল, ‘আপনি কেমন আছেন?’
‘ভাল নয় বাবা, মোটেই ভাল নয়। পথটা ছাড়ো, দিদির সঙ্গে দেখা করব।’
‘কেন আর জ্বালাতন করতে যাচ্ছেন। উনি ভাল নেই।’
‘ভাল নেই? সে কি? কি হয়েছে? ছাড়ো ছাড়ো পথ।’
অনিমেষ লক্ষ্য করল পরিতোষ ওর প্রথম মন্তব্যটাকে আমলই দিলেন না। যেন কিছুই বলেনি অনিমেষ এমন ভঙ্গীতে ভেতরে ঢুকে গেলেন। এরকম মানুষের একটাই সুবিধে কেউ বেশীক্ষণ ওদের সঙ্গে ঝগড়া করতে পারে না। পরিতোষ ভেতরে যাওয়ার পর অনিমেষ বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। চিঠি নিয়ে পিওন আজ এই পথে এলোই না। পরিতোষকে বাড়িতে রেখে সে বেরিয়ে যেতে পারছিল না। সে দেখল ছোটমা বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন, ‘অনিমেষ।’
‘বল।’
‘একবার ভেতরে গিয়ে দেখে এসো।’
‘কি হয়েছে?’
‘যাও না একবার।’
সিঁড়ি ভাঙ্গার ঝামেলা এড়িয়ে অনিমেষ ক্রাচ নিয়ে বাগানের ভেতর দিয়ে হাঁটতে লাগল। হেমলতার ঘরের পাশে একটা ছোট দরজা আছে সেইটে বিশেষ কায়দায় বাইরে থেকেও খোলা যায়। এই কয়দিনে অনিমেষ কায়দাটা জেনে গেছে। ওই পথে গেলে তাকে ওঠা নামা করতে হবে না। ভেতরে ঢুকে অনিমেষ অবাক হল। হেমলতা কাঁদছেন। গোঙানির মত তাঁর কান্নাটা একটানা বাজছে। শুধু হেমলতা নয় আর একটা গলায় কান্না বাজছে। ওটা যে পরিতোষের তা অনুমানে বুঝল অনিমেষ। কিন্তু দুজনে একসঙ্গে কেন কাঁদবেন সেটাই সে ধরতে পারছিল না। এতদিন যে ভাইকে দুচোখে দেখতে পারেননি হেমলতা এখন কেন তার সামনে কাঁদবেন? অনিমেষের মনে হল ধূর্ত পরিতোষ নিশ্চয়ই কৌশল করছে। হেমলতাকে ভেজাতে পারলে মামলা জেতা তার পক্ষে সুবিধে হয়ে যায়।
কি করা যায় বুঝতে পারছিল না অনিমেষ। শেষপর্যন্ত সে এগিয়ে গেল। দরজা খোলা, খাটের ওপর বাবু হয়ে বসে হেমলতা কেঁদে যাচ্ছেন, তার নিচে মোড়ায় বসে পরিতোষ, তার গলাতেও কান্না। ওকে দেখে হেমলতা চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘ওরে অনি, দ্যাখ পরি কি কাণ্ড করেছে। আমার তো কেউ নেই। বাবা গেলেন, মহী গেল, প্রিয় কোথায় জানি না। এই আমাকে সব সম্পত্তি লিখে দিচ্ছে পরি। এ নিয়ে আমি কি করব? ঘাটের মড়া আমি—।’ কান্নাটা বাড়তেই পরিতোষের গলা তার সঙ্গে যোগ হল। কিন্তু সেইসঙ্গে শব্দগুলো জড়ানো ছিল, ‘আমারও কেউ নেই। পৃথিবীতে পরের মেয়ে কখনও আপন হয় না। সে যখন আমায় ছেড়ে চলে গেল তখন আমি কেন আর ছোট হই। আমি মামলা তুলে নিলাম দিদি, আমার যদি কিছু প্রাপ্য হয় সেটা তুমিই নিয়ে নাও।’
হেমলতা পরিতোষের কাঁধে হাত রাখলেন, ‘না রে ভাই, আমি আর বন্ধন চাই না। এখন চোখ বন্ধ করলেই আমি বাবাকে দেখতে পাই। বাবা সবসময় আমার পাশে আছেন। ওই দ্যাখ, বাবা তোর পেছনে দাঁড়িয়ে হাসছেন। বাবা, দেখুন, পরির কত পরিবর্তন হয়েছে। ও আর মামলা করবে না বলছে। পরিকে আপনি ক্ষমা করুন বাবা, ও ওর ভুল বুঝতে পেরেছে।’
হেমলতার কথার ধরন এত আন্তরিক ছিল যে পরিতোষ চমকে উঠল। যেন সত্যিই সরিৎশেখরের অশরীরী আত্মা ঘরে ঘুরছে। চোখের জল মুছতে মুছতে পরিতোষ বেরিয়ে এল ঘর ছেড়ে। তার হাতে একটা কাগজ, ‘বাবা অনিমেষ, তোমার কাছে একটা ভিক্ষে আছে। আমার ছেলে-বউ সবাই আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। তুমি আমাকে একটু থাকার জায়গা দেবে? আমি মামলা তুলে নিলাম।’
পরিতোষের হাতের কাগজটা দুলছিল। অনিমেষ বলল, ‘আমার ওপর দুজন এই বাড়িতে আছেন। তাঁরা যদি অনুমতি দেন—।’
‘বউমা তো কখনই অনুমতি দেবে না। সে আমাকে দেখতে পারে না।’
‘তাহলে আমার কিছু বলার নেই।’
অনিমেষ আর দাঁড়াল না। ব্যাপারটা তার নিজের কাছেই খুব খারাপ লাগছিল। পরিতোষ যদি সত্যি পরিত্যক্ত হন তাহলে সহানুভূতি আসেই। মামলা তুলে নিলে একটা বিরাট ঝামেলা থেকে বাঁচা যায়। কিন্তু এই বাড়িতে থাকলে ওঁকে খাওয়াবার দায়িত্ব যে এসে যায়! সেটা কম কথা নয়। কিন্তু পরিতোষকে যে বিশ্বাস করা মুশকিল। আজ একা এখানে ঘাঁটি গেড়ে কাল যে স্ত্রীপুত্রদের ডেকে আনবেন না তার নিশ্চয়তা কি! অতএব এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবার ভার ছোটমার ওপর ছেড়ে দেওয়াই ভাল।
জলপাইগুড়িতে সন্ধ্যেটা বড্ড চটজলদি রাত হয়ে যায়। এবং শীতের রাত মানেই হু হু ধারালো দাঁত চকচক করে। রাত্রের খাওয়া শেষ করে অনিমেষ কিছুক্ষণ নিজের ঘরে বসেছিল। ছোটমা পরিতোষের প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। এই নিয়ে হেমলতার সঙ্গে তাঁর মতান্তর হয়েছিল। হেমলতা হঠাৎ আজ তাঁর ভাই-এর ওপর দুর্বল হয়ে পড়েছেন। কিন্তু ছোটমার যুক্তির বিরুদ্ধে কিছুই বলতে পারেননি। হেমলতার যে চিন্তাশক্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে সেটা স্পষ্ট বোঝা যায়। মৃত্যু যেন ওই মানুষটির চারপাশে বৃত্ত রচনা করে চুপচাপ অপেক্ষা করছে, আজকাল ওঁর দিকে তাকালেই এমন মনে হয়। ছোটমাও শেষপর্যন্ত ভেঙ্গে পড়েছিলেন, ‘আমি কার জন্যে এসব করছি। এ কি আমার সম্পত্তি? শুধু তোমার দাদু বাবার কথা ভেবে লোকের কাছে অপ্রিয় হচ্ছি। এখন থেকে যা সিদ্ধান্ত তা তোমাকেই নিতে হবে। আমার ওপর সবকিছু চাপিয়ে দেওয়া চলবে না। তুমিই এ বাড়ির উত্তরাধিকারী।’
ঘরে বসে অনিমেষ উত্তরাধিকার শব্দটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল, কিছু রেখে গেলে তবেই পরের পুরুষ সেটি পায়। উত্তরাধিকারসূত্রে অর্জিত সম্পত্তি, স্থাবর কিংবা অস্থাবর, রক্ষা করাই কর্তব্য। কিন্তু আগের পুরুষ যদি কিছুই না রেখে যায়? যদি একটা বিরাট শূন্য ছাড়া অতীতের কাছ থেকে কিছুই না পাওয়া যায় তবে? এই বাড়ি-ঘর হয়তো খুব সাধারণ জিনিস। কিন্তু সরিৎশেখরের চারিত্রিক দৃঢ়তা, একটা গোপন অনুচ্চার ভালবাসা, মহীতোষের নীরব আত্মোৎসর্গ যা তিনি তাঁর বাবার জন্যে অকাতরে করে গেছেন, ছেলের জন্যে প্রতিদান না চেয়ে নিঃশেষ হয়েছেন, সেগুলোর মূল্য এর পরের পুরুষরা জানবে না। কারণ অনিমেষরা এগুলোর কিছুই ওদের দিয়ে যেতে পারছে না। অতএব অর্ক কোন অর্থেই কারো উত্তরাধিকারী নয়। এই শব্দটাই তাই স্থবির হয়ে যাবে একসময়।
দরজা ভেজিয়ে অনিমেষ বেরিয়ে এল বাইরে। ঠিক দশটায় ওদের মিলিত হবার কথা। এখন চারপাশে গভীর অন্ধকার। ঘরের বাইরে আসতেই ঠাণ্ডাটা যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল। অনিমেষের ছেলেবেলার কথা মনে পড়ল। এরকম চুপচাপ দরজা ভেজিয়ে গিয়ে সে রাতের সিনেমা দেখেছে সরিৎশেখরকে ফাঁকি দিয়ে। আজ ছোটমাকে জানিয়ে যাওয়া হল না। কারণ এত রাতে যাওয়ার জায়গাটা সম্পর্কে ছোটমার কৌতূহল হবেই।
রাস্তা ফাঁকা। ঠাণ্ডা হাওয়ায় হাড়ে কাঁপুনি আসছিল। বাঁধ পেরিয়ে বালির চরে এসে দাঁড়াতেই ওর মনে হল এটাকে আর বালির চর বলা যায় না। রীতিমতন ঘনবসতি হয়ে গেছে।
মোট দশজন মানুষ আলোচনায় বসেছিল। অনিমেষ পৌঁছানোমাত্র আলোচনা শুরু হল। উত্তরবাংলার গ্রামের মানুষদের নিজস্ব সমস্যা আছে। সেইসব সমস্যা নিয়ে প্রথম কাজ শুরু করতে হবে। যে গ্রামগুলোকে নির্বাচন করা হয়েছে প্রাথমিক কাজ শুরু করার জন্যে সেই গ্রামগুলোয় দলের ছেলে আছে। অতএব তাদের সাহায্য নিয়ে কাজ করতে কোন অসুবিধে হবে না। মোটামুটিভাবে এই ব্যাপারে নির্বাচনের দায়িত্ব দেওয়া হল জুলিয়েনের ওপর। তারপরেই আর একটি প্রস্তাব উঠল। উত্তরবাংলার চা-বাগানগুলো আগেই করা যায়। এই চা-বাগানগুলোর অধিকাংশ মানুষ বাঙালি নয়। এই দেশের মাটিতে তাদের একশ বছর আগে রাঁচি-হাজারিবাগ থেকে ধরে আনা হয়েছিল। এরা নিজেদের পশ্চিমবঙ্গীয় মনে করে না। অথচ নিজেদের আদিগ্রামে ফিরে গেলে এদের জায়গা হবে না। কারণ এই মানুষগুলো সংখ্যায় এত বছরে কয়েকশ গুণ বেড়ে গেছে। তাছাড়া চা-শিল্প ছাড়া আর কোন কাজ এরা জানে না। এই মানুষগুলো নিজেদের নানা কারণে অবহেলিত ভাবে। এখনও এদের মধ্যে তেমনভাবে শিক্ষা সম্প্রসারিত হয়নি। অতএব এই কয়েক লক্ষ মানুষকে একত্রিত করার বড় সুযোগ আছে। গ্রামে কাজ শুরু না করে তাই চা বাগানেই আন্দোলন প্রথম ছড়ানো উচিত।
কথাটা যেন বেশ উত্তেজনা ছড়ালো। চা-বাগানগুলো যেহেতু জঙ্গুলে এলাকায় এবং প্রত্যেকের সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন তাই অনেক সুবিধে পাওয়া যাবে।
অনিমেষ প্রথম প্রশ্ন করল, ‘কিন্তু এটার অন্য দিক আছে। আমরা যা চাইছি তা না হয়ে যদি সাম্প্রদায়িক ব্যাপার হয়ে যায়? আমরা নিশ্চয়ই চাইবো না একটা মদেশিয়াল্যাণ্ড করার দাবি উঠুক।’
আলোচনা যখন জোর কদমে চলছে তখন দরজায় শব্দ হল। তারপরেই একজন সন্ত্রস্ত গলায় জানালো বাঁধের ওপর অস্ত্র হাতে কিছু লোক জড়ো হয়েছে। মনে হচ্ছে তাদের লক্ষ্য এদিকেই। সঙ্গে সঙ্গে সভা ভেঙ্গে দেওয়া হল। সভ্যদের বলা হল আত্মগোপন করতে। তাড়াহুড়ো করে সবাই কাঠের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসতেই চিৎকার শুনতে গেল। শখানেক মানুষ মশাল হাতে তিস্তার চর ঘিরে ছুটে আসছে। সদস্যরা যে যেদিকে পারল দৌড়ে গেল। জুলিয়েন অনিমেষকে বলল, ‘এরা কারা বলুন তো?’
অনিমেষ মাথা নাড়ল, ‘বুঝতে পারছি না।’
জুলিয়েন বলল, ‘পালান।’ তারপরে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। কিন্তু এই বালির চরে অনিমেষ জানে তার পক্ষে জোরে হাঁটাও সম্ভব নয়। চারপাশে চিৎকার চেঁচামেচি চলছে। সে কিছুটা হেঁটে একটা বালির ঢিবির পাশে ক্রাচদুটো নিয়ে চুপচাপ বসে পড়ল।
চোখের ওপরে একটা নারকীয় ঘটনা ঘটে গেল। আধঘণ্টার মধ্যে কয়েকটি মানুষ বেধড়ক মার খেয়ে বালির চরে চিরজীবনের মত লুটিয়ে পড়ল। উত্তেজিত মানুষগুলো যেন ডাকাত ধরার মত নৃশংস হল। অনিমেষ বুঝতে পারছিল এরা সাধারণ মানুষ, নেহাতই সাধারণ মানুষ। বালিতে বসে থাকায় অনিমেষ এদের নজর এড়িয়ে গেল।
ভোরবেলায় অনিমেষ ফিরে এল বাড়িতে। কয়েকজন ডাকাতকে পাবলিক তিস্তার চরে ধরে ফেলেছে, অন্ধকার থাকতে থাকতে শহরে খবর ছড়িয়ে গেল। গেট খুলে সে অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় এগোতেই দেখল ছোটমা দাঁড়িয়ে। ওকে দেখতে পেয়ে ছোটমা ছুটে এলেন, ‘তুমি কেমন আছ?’
‘ভাল।’
‘একটা টেলিগ্রাম এসেছে মাঝ রাত্রে।’
‘টেলিগ্রাম?’
‘হ্যাঁ। কি হয়েছে?’ অনিমেষ আর ভাবতে পারছিল না।