এ সবই যে যাদুগোপালের রসিকতা, তা ভরত বুঝল কৃষ্ণনগরে পৌঁছে। স্টেশনে ওদের জন্য একটি ঘোড়ার গাড়ি মজুত ছিল। যাদুগোপালের মামার বাড়ির অবস্থা মোটেই সাধারণ নয়, নদীর ধারে রীতিমতন এক প্রাসাদ, অনেকদিন সংস্কার হয়নি বটে, তবু যথেষ্ট সুদৃশ্য। মামা অনুপস্থিত হলেও দাস-দাসীর সংখ্যা অনেক, জমিজমার আয় বোঝা যায়।
ওরা পৌঁছে হাত-পা ধুয়ে বসতে না-বসতেই ওদের সামনে বড় বড় দুটি কাসার থালায় নানাপ্রকার ফল-মূল ও মিষ্ট দ্রষ্ট্য সাজিয়ে দেওয়া হল। সেই সঙ্গে এক গেলাস করে গরম দুধ।
ভরত যাদুগোপালের দিকে আড় চোখে তাকাতেই যাদুগোপাল বলল, কাল থেকে শুধু ছোলা আর গুড়! খাওয়াদাওয়া শেষ করার পর যাদুগোপাল বলল, চল, আমার দিদিমার সঙ্গে দেখা করে আসি। উনি উকিল গিন্নি, আমার দাদামশাই ছিলেন নামকরা উকিল, ওঁর সঙ্গে কথায় পারবি না।
বাড়িটি দোতলা, একতলাতেই বেশি ঘর এবং অনেকখানি ছড়ানো। কয়েকদিন দালান পার হয়ে ভেতরের দিকে একটা ঘরের দরজার কাছে ওরা দাঁড়াল। সন্ধে হয়ে এসেছে প্রায়, ঘরের মধ্যে দুটি দেয়ালগিরি জ্বলছে। একটা সিংহাসনের মতন বড়, মখমলের গদি আঁটা চেয়ারে বসে আছেন এক বৃদ্ধা, একটি পরিচারিকা মেঝেতে বসে তাঁর পা টিপে দিচ্ছে। বৃদ্ধটির রঙ হাতির দাঁতের মতন, মাথার চুল সব সাদা, পরনে পাড়হীন সাদা থান, চোখের দৃষ্টি স্থির। হঠাৎ দেখে মনে হয় এক শ্বেত পাথরের মূর্তি।
কেউ কিছু বলার আগেই বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করলেন, কে এল রে? কে?
যাদুগোপাল এক পা এগিয়ে গিয়ে বলল, আমি যাদু। নায়েবমশাই খবর দেননি যে আমি আজ আসব?
বৃদ্ধ পরিচারিকাটিকে বললেন, সরো, তুই এবার যা!
তারপর দু হাত বাড়িয়ে ডাকলেন, আয়, কোলে আয়!
ভরত এইবার বুঝতে পারল, বৃদ্ধা একেবারে অন্ধ। কিন্তু তাঁর কণ্ঠস্বরে তেজ আছে। কণ্ঠস্বর শুনলেই মনে হয়, তিনি সারা জীবন আদেশ দিতে অভ্যস্ত। শরীর এখনও জীর্ণ হয়নি, অত বয়েস বোধ হয় না।
যাদুগোপাল একটি বাচ্চা ছেলের মতন দৌড়ে গিয়ে দিদিমার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তিনি তাকে বেশ জোরে, চটাং চটাং করে থাপ্পড় মারতে মারতে বলতে লাগলেন, হারামজাদা ছেলে, এতদিন পর বুড়িকে মনে পড়ল? চত্তির, বোশেখ, জষ্ঠি এই তিন মাস কেটে গেল, তার মধ্যেও ছেলের দেখা নেই! কোন রাজকাজ্যে ব্যস্ত ছিলি, অ্যাঁ?
যাদুগোপাল দিদিমার গলা দু হাতে জড়িয়ে ধরে বলল, হয়েছে, হয়েছে, অনেক মেরেছ, এবার আদর করো!
নীপময়ী সঙ্গে সঙ্গে যাদুগোপালের মুখ চুমোয় ভরিয়ে দিতে লাগলেন। জানতে চাইলেন নানান খবরাখবর। একসময় বললেন, এবার অন্তত দিন দশ-বারো থাকিবি তো?
যাদুগোপাল বলল, যদি তার চেয়েও বেশিদিন থাকি? এক মাস? থাকতে দেবে তো?
নীপময়ী বললেন, হুকুম দিয়ে রাখব, আমি খালাস না-দিলে তোকে এখান থেকে কেউ যেতেই দেবে না। যাদুগোপাল বলল, শোনো বুড়ি, এসেছি। পড়াশুনো করতে। সামনেই পরীক্ষা। তোমার আদরের নাতিকে যে যখন তখন ডেকে পাঠাবে, তা চলবে না। সারাদিনে একবার শুধু তোমাকে দেখে যাব।
নীপময়ী বললেন, আর কত পরীক্ষা দিবি? দুটো পাশ দিয়েছিল তো, এবার বেশি পড়ে কী হবে? এবার এখানে এসে বোস, খাজাঞ্চিখানার কাজকম্মো বুঝে নে।
যাদুগোপাল বলল, ইস, আমি কলকাতা ছেড়ে আসতে গেছি আর কি! এবার পাশ করে বিলেত যাব। তুমি তোমার ছেলেকে এখানে ধরে রাখতে পারনি কেন?
এর কোনও উত্তর না দিয়ে নীপময়ী সামনের দিকে মুখ করে রইলেন কিছুক্ষণ, তারপর তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন, ওখানে কে দাঁড়িয়ে?
যাদুগোপাল বলল, দিম্মা, আমার এক বন্ধু সঙ্গে এসেছে। আমরা একসঙ্গে পড়াশুনো করব। ওর নাম ভরত।
ভরত এবার এগিয়ে গিয়ে নীপময়ীকে প্ৰণাম করতে গেল।
সম্পূর্ণ অন্ধ হলেও নীপময়ী যেন সব দেখতে পান। হাত তুলে দিয়ে বললেন, দাড়াও, তুমি কি বামুন? একটু আগে স্নান করেছি, এখন আর অন্য জাতে ছোঁয়াছুঁয়ি হলে শরীর কিটকিট করে।
ভরত থমকে গিয়ে বলল, না, আমি বামুন নই।
যাদুগোপাল চঞ্চল হয়ে বলল, দিম্মা, তুমি এখনও জাতপাত নিয়ে…তুমি আমার বন্ধুকে…
নীপময়ী নাতিকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, তুই চুপ কর। তোরা বেহ্মজ্ঞানী হয়েছিস, তোরা অজাত-কুজাতের হাতে রান্না খাবি, তা বলে আমি তোদের মানব কেন? আমার যা ভাল লাগে। তাই করব। হ্যাঁ, বাবা তুমি বামুন নও, তবে তুমি কোন জাতের ছেলে?
ভরত ইতস্তত করতে লাগল। প্রথম প্রথম সে কলকাতায় এসে বলত যে সে ক্ষত্রিয়। কিন্তু বাঙালিরা ক্ষত্রিয় ব্যাপারটা ঠিক বোঝে না। বলে, ও, কায়স্থ! বাঙালিদের মধ্যে ক্ষত্ৰিয় জাতি নেই। এখন ভরত নিজেকে আর ক্ষত্রিয়ও বলতে চায় না। যার পিতৃপরিচয় মুছে গেছে, তার আবার জাত কি?
ভরত বলল, আমার কোনও জাত নেই, আমি শুধু একজন মানুষ!
নীপময়ী ঠোঁট উল্টে বললেন, সে আবার কী গা? মায়ের পেটে জন্মেছ, আকাশ থেকে তো পড়নি, বাপ-মায়ের জাত ছিল না?
ভরত বলল, আমি অনাথ। অন্যের ঘরে পালিত হয়েছি। আমি আপনাকে ছোব না, দূর থেকে নমস্কার জানাচ্ছি!
যাদুগোপাল বলল, দিম্মা, এরপর থেকে আমিও আর তোমাকে প্ৰণাম করব না। আমারও তো জাত গেছে।
নীপময়ী বলল, তুই চুপ কর তো ছোড়া! এই যে, তোমার কী নাম বললে, ভরত? তোমার বাড়ি কোথায়?
ভরত বলল, অনেক দূরে, ত্রিপুরায়।
নীপময়ী বললেন, সে কোথায়, জানিনে বাপু। তুমি যে উঁচু গলায় বললে, তোমার কোনও জাত নেই, তুমি শুধু মানুষ, তা কি সত্যি? বাঁদর-টাঁদর নও কি না কী করে বুঝব?
যাদুগোপাল বলল, আঃ দিম্মা।
নীপময়ী আবার ধমক দিয়ে বললেন, চুপ কর, আমাকে বলতে দে! এই যে ভরত, এগিয়ে এসো। তোমার একটা হাত বাড়াও তো, লজ্জা করো না, আরও কাছে এসো।
নীপময়ী ভরতের ডান হাত খানি ধরে গন্ধ শুকলেন। তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে তিনি ভরতের মুখে, মাথায়, বুকে হাত বুলোতে লাগলেন। তাঁর প্রাচীন হাতটিতে যেন জমে আছে বহুদিনের স্নেহ। ভরতের শরীর শিরশির করতে লাগল।
এবার নীপময়ী ফিক করে হেসে ফেলে বললেন, হুঁ, বান্দর-হনুমান নয় দেখছি। শোনো বাপু, মানুষ বললেই কি মানুষ হওয়া যায়? সব বামুন-কায়েত কি মানুষ? কত অপদাৰ্থ গিসগিস করছে! তুমি মানুষের মতন মানুষ হও।
যাদুগোপাল বলল, দিম্মা, তা হলে তুমি ওকে ছুঁয়ে দিলে? আবার চান করতে হবে নাকি?
নাতির দিকে মুখ ফিরিয়ে ঝঙ্কার দিয়ে তিনি বললেন, ইস, খুব যে জাত মানিস না বলে গর্ব করিস! বিয়ে করার সময় তো সেই বামুনের মেয়ে! তাও আবার পিরিলির বামুন! একটা চাঁড়ালের মেয়ে বিয়ে করে আনতে পারতিস তো বুঝতুম তোর মুরোদ!
দুই বন্ধুর জন্য ঘর নির্দিষ্ট হয়েছে দোতলায়। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ভরত আবেগ জড়ানো কণ্ঠে বলল, যাদু, তোর দিদিমা এক অসাধারণ মহিলা। প্রথমে বললেন, আমাকে ছোঁবেন না, তারপর আমার মুখে হাত বুলিয়ে কত আদর করলেন। আমার চোখে জল এসে যাচ্ছিল।
যাদুগোপাল বলল, প্রথমে তোর সঙ্গে মজা করছিলেন। উনি আসলে জাত-টাত মানেন না বহুদিনই। আমার দিদিমা সত্যিই অসাধারণ। থাকতে থাকতে আরও দেখবি। এ দেশের নারী জাতির মধ্যে যে কত মহৎ, অসাধারণ হৃদয় রয়েছে, তা কজন জানে? আমার চার মাসি আর একটা মাত্র মামা। আমার সেই মামা বিদ্যাসাগর মশাইয়ের চ্যালা, বিধবা বিয়ে করেছেন। তা নিয়ে আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে কি শোরগোল, অনেকেই তাঁকে একঘরে করেছে। কিন্তু সবচেয়ে প্রথমে কে সেই বিয়ে মেনে নিয়েছিল জানিস? আমার এই দিদিমা! আমি জন্মের পর আট ন’ বছর এই দিদিমার কাছেই মানুষ। কী সুন্দর চোখ ছিল ওঁর। এই তো কবছর আগে হঠাৎ সাঙ্ঘাতিক বসন্ত রোগ হয়ে চোখ দুটোই নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু তাতেও একটুও যেন দমে যাননি! এই বাড়িঘর সব উনি সামলাচ্ছেন।
দোতলায় তিনখানি ঘর খালি পড়ে আছে। এবং প্রশস্ত ছাদে অনেক ফুলের টব। যাদুগোপালের প্রমাতামহ যখন এই প্রাসাদটি তৈরি করেছিলেন, তখন দেশে ইংরেজ কোম্পানির রাজত্ব বেশ ভালভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। অরাজকতা দূর হয়ে গেছে অনেকখানি, লোকে ধন-মান-জন রক্ষা সম্পর্কে নিশ্চিন্ত বোধ করছে। এই পরিবারের অধিপতি মনে করেছিলেন, ভবিষ্যতে একদিন এই গৃহ পুত্র-কন্যা-নাতি-নাতনিতে ভরে যাবে, তাই অনেক ঘর বানিয়েছিলেন। কিন্তু সে রকমটি হয়নি। ইংরেজি শিক্ষা চালু হওয়ার পর সচ্ছল পরিবারের সন্তানরাই প্রথম সেই সুযোগ গ্রহণ করে, সেই শিক্ষা তাদের শহরের দিকে টানে। উচ্চশিক্ষিতারা আর বাড়ি ফিরতে চায় না। গ্ৰাম্য জমিদার সেজে বসে থাকার চেয়ে শহরে উচ্চ সরকারি চাকুরে কিংবা উকিল-ব্যারিস্টার হওয়া অনেক সম্মানজনক। শিক্ষিত যুবকদের সঙ্গে কন্যার বিবাহ দিলে তারাও ইদানীং ঘর-জামাই হতে চায় না। নীপময়ীর এই সংসার সেইজন্য এখন শূন্য।
দোতলায় দাঁড়ালে নদী দেখা যায়। সন্ধে হয়ে গেছে, নদীর বুকে দেখা যায় বিন্দু বিন্দু আলো। দুই বন্ধু কিছুক্ষণ চুপ করে দাড়িয়ে রইল সেইদিকে চেয়ে।
একটু পরে যাদুগোপাল বলল, যদি আমি কবি হতাম, তা হলে এই দৃশ্যটি দেখলে মনের কথাটা এইভাবে বলতাম :
এই অপরূপ ছায়া ঘিরিতেছে কী যে মায়া
স্বৰ্গ হতে ভেসে আসে কুলুকুলু ধ্বনি
তবুও দেখি না কিছু তবুও শুনি না কিছু
মনে পড়ে তার মুখ
তার সেই নিবিড় চাহনি…
ভরত চমকে উঠে। জিজ্ঞেস করল, এটা কার লেখা?
যাদুগোপাল বলল, কার আবার, এই মাত্র বানালাম।
ভরত বলল, তবে যে বললি, যদি কবি হতাম। তুই তো কবিই রে, যাদু!
যাদুগোপাল বলল, দূর! দু লাইন পদ্য মেলালেই কি কেউ কবি হয় নাকি? অত সহজ নয়।
ভরত আপ্লুতভাবে বলল, আমার বড্ড ভাল লাগছে রে যাদু! কদিন ধরে আমার মনটা বড্ড ভার হয়েছিল, কিছুই ভালো লাগছিল না, এখানে এসে, এমন সুন্দর জায়গা, তোর দিদিমা আমার মুখে হাত বুলিয়ে দিলেন, আমায় কোনওদিন কেউ দেয়নি, কেউ আমার মাথায় হাত রাখেনি…
যাদুগোপাল ভরতের পিঠে এক চাপড় মেরে বলল, আ মালো যা, তুই কেঁদে ফেলবি নাকি? শোন, শোন ভরত, তোকে যে আমি এখানে নিয়ে এসেছি, তাতে আমার একটা বিশেষ স্বাৰ্থ আছে।
ভরতের চোখ সত্যি ছলছল করে এসেছিল, এবার সে বিস্মিতভাবে তাকাল।
যাদুগোপাল বলল, নিজের পড়াশুনো ছাড়াও আমি চাই তোকে পরীক্ষা করে দেখতে। তুই কতটা পড়া তৈরি করেছিস, সেটা আমার জানা দরকার। দ্বারিকা তো খসেই গেছে বুঝতে পারছিস, পরীক্ষা দেবেই না মনে হয়, দিলেও সুবিধে করতে পারবে না। দ্বারিকা আগে যেরকম ছাত্র ছিল, তাতে অনায়াসে ফাস্ট হতে পারত। আমাদের ক্লাসে অন্যদের মধ্যে আর আছে বিমলানন্দ আর রামকমল, আগাগোড়া ভাল রেজাল্ট করে এসেছে। কিন্তু রামকমল গাত মাসে হঠাৎ বিয়ে করে ফেলেছে শুনেছিস তো, শ্বশুর মৃত্যুশয্যায় ছিল, তাই দেরি করতে পারল না।
ভরত বলল, রামকমলের শ্বশুরবাড়ি বর্ধমান। রামকমল আমাকে একদিন বলছিল, পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগে, বউকে বর্ধমান থেকে আনা যাবে না, ওর বাবা এই কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন। যাদুগোপাল বলল, আরে দূর। রামকমল লুকিয়ে লুকিয়ে প্রায়ই শ্বশুরবাড়ি যায়। বর্ধমানে কিভাবে একদিনেই যাতায়াত করা যায়, সে পন্থা তো আমিই ওকে বাৎলে দিয়েছি। এখন পড়ার বইয়ের পাতায় ওর বউয়ের মুখ ভেসে ওঠে। রামকমল আউট! ওকে আর আমার ভয় নেই। বিমলানন্দর শুধু মুখস্থ বিদ্যে। মুখস্থ করতে পারে বটে এক একখানা গোটা বই, হিস্ট্রিতে স্ট্রং, ইংলিশেও ভাল, কিন্তু ফিলোসফি ইন্টারপ্রেট করতে পারে না, নিজস্ব চিন্তা নেই, ওর পেপার পড়ে দেখেছি, বিমলানন্দকে আমি সমকক্ষ মনে করি না। বাকি রইলি তুই। তুই তো গরিব! গরিবরা খুব জেদি হয়। জেদের বশে তুই যদি ফাট করে ফাস্ট হয়ে যাস, তা হলে আমি মহা মুশকিলে পড়ে যাব!
ভরত হাসতে হাসতে বলল, এতজনকে ডিঙিয়ে আমার ফাস্ট হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই। যদি বা অন্য কেউ হয়, তাতে তুই মহা মুশকিলে পড়বি কেন?
যাদুগোপাল মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, আমি যাব নিজের জোরে, সম্মানে। লন্ডন পোর্টে জাহাজ থেকে যেই নামব, অমনি সবাই আমার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলবে, এই যে এসেছে, কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের এ বছরের ফাস্ট ক্লাস ফাস্ট!
ভরত বলল, বিলেতের সব-কাগজে আগে থেকেই তোর ছবি ছাপা হয়ে যাবে আশা করি। হ্যাঁ রে, যাদু, তোর দিদিমা যে তোর বিয়ের কথা বললেন, তোরও বিয়ে নাকি শিগগির?
যাদুগোপাল বলল, হ্যাঁ, আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, কিন্তু আমি বিয়ে করছি না।
-তার মানে?
— পরীক্ষায় আগে রামকমলের মতন গাড়ল ছাড়া কেউ বিয়ে করে না। আমি অবশ্য পরীক্ষা শেষ হলেও বিয়ে করব না। আগে ব্যারিস্টারি পাশ করে এসে প্র্যাকটিস শুরু করব, তারপর।
— কোথা বিয়ে ঠিক হল?
— শুধু তোকেই জানাচ্ছি। আর কারুকে বলবি না বল! দেখ ভরত, আমাদের এই বয়েসে সকলেরই বিয়ে সম্পর্কে একটা স্বপ্ন থাকে। অনেকেরই মেলে না। কিন্তু আমি ঠিক যেমনটি চেয়েছিলাম, তেমন জায়গাতেই আমার বিয়ে হচ্ছে। পিরিলির বামুন কাদের বলে জানিস?
— কার মুখে যেন শুনেছিলাম, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি?
— জানিস দেখছি! এটা কি জানিস, ব্ৰাহ্মসমাজ আজ তিন টুকরো হয়ে গেছে। কিন্তু আমার বাবা কিংবা আমি কখনও আদি ব্ৰাহ্মসমাজ ছাড়িনি। আমার আচার্যদেব হলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। যতবার ওঁকে দেখেছি, মনে হয়েছে ঈশ্বরকোটির মানুষ। ওঁর কাছাকাছি থাকতে খুব ইচ্ছে করে। বাবার সঙ্গে জোড়াসাঁকোর বাড়ির নাটকে দেখতে গেছি। জ্যোতিবাবু, রবিবাবুমশাইদের সঙ্গে ওঁদের বাড়ির মেয়েরাও নাটকে অভিনয় করে, গান গায়। ও বাড়ির সব মেয়ে লেখাপড়া শেখে। অত বড় পরিবার, মেয়ের সংখ্যাও অনেক। তাই মনে মনে ভাবতাম, যদি ওই ঠাকুরবাড়ির কোনও মেয়েকে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে পাই…কী আশ্চর্যের কথা, ওই বাড়ি থেকেই বাবার কাছে প্রস্তাব এসেছে।
— এবার বুঝেছি! বিলেত ফেরত ব্যারিস্টার কিংবা আই সি এস না হলে ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের সঙ্গে বিয়ে হয় না। তাই তোর বিলেত যাওয়ার এত গরজ!
– সেরকম কোনও শর্ত নেই। ওরা এখনই বিয়ে দিতে রাজি। ঠাকুরবাড়ির ছেলেদের জন্য গরিবঘর থেকে সুন্দরী পাত্রী খুঁজে আনা হয়। আর মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার বেলায় অভিজাত কিংবা উচ্চশিক্ষিত পাত্ৰ চায়। আমার বাবার তেমন কিছু নেই বটে, কিন্তু আমার দাদু কিছু সম্পত্তি দিয়ে গেছেন আমার নামে লিখে, তা ওরা জানে। এরপর আমি গ্র্যাজুয়েট হলেই ওরা খুশি। কিন্তু আমার অন্যান্য ভায়রাভাইরা সবাই বড় বড় চাকুরে বা ব্যবসাদার কিংবা ব্যারিস্টার, আমাকেও তাদের সমান হতে হবে।
— মেয়েটিকে তুই দেখেছিস?
— স্বর্ণকুমারী দেবীর মেয়ের বিয়ের সময় অভিনয় করতে দেখেছি, দূর থেকে। তার একটা ছবিও আছে আমার কাছে।
— ব্যারিস্টারি পাশ করতে তো দুতিন বছর লাগবে। এতদিন তুই অপেক্ষা করবি আর ওর ধ্যান করবি?
— কবিতা লিখব। বিরহ থেকেই তো কবিতা জন্মায়। দেখা যাক, এই দুতিন বছরে আমার কবিত্ব শক্তি জাগে কি না।
— হবে, তোর হবে। ওই লাইন কটা বেড়ে লিখেছিস। ‘তবুও দেখি না কিছু, তবুও শুনি না কিছু, মনে পড়ে তার মুখ, তার সেই নিবিড় চাহনি…’, দেখ, আমার মুখস্থ হয়ে গেছে।
এরকম গল্পে গল্পে অনেক রাত হয়ে গেল। পরদিন ব্ৰাহ্মমুহূর্তেও জাগা হল না, ছোলা আর এখোগুড় খেয়েও দিন শুরু করতে হল না। এক ভৃত্য এসে প্রথমে বেলের পানার সরবত এনে ওদের ঘুম ভাঙাল, তারপর এল চা, একটু পরে থালাভর্তি ফুলকো লুচি, বেগুন ভাজা ও রসগোল্লা।
আঠারো ঘণ্টা একটানা অধ্যয়নের সঙ্কল্পও রাখা গেল না, বেলা এগারোটার পর বই মুড়ে রেখে যাদুগোপাল বলল, চল, একটু বেরিয়ে আসি। বেশি পড়ে কেউ রাজা হয় না।
একতলায় এসে ওরা দিদিমার সঙ্গে দেখা করতে গেল। আজও নীপময়ী সেই ঘরের মাঝখানে সিংহাসনের মতন চেয়ারটিতে বসে আছেন, সামনেই একটি জলচৌকিতে বসে মাথায় মন্ত টিকিওয়ালা একজন বামুন তাঁকে মহাভারত পাঠ করে শোনাচ্ছে।
যাদুগোপাল ও ভরত একটুক্ষণ দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে রইল। নীপময়ী যে খুব মন দিয়ে শুনছেন, তা বোঝা যায় তাঁর দু একটি মন্তব্যে। ব্ৰাহ্মণকে এক জায়গায় থামিয়ে দিয়ে তিনি বললেন, ভটচার্যিমশাই, আপনি মুদিতা কারা ভাৰ্যা বললেন?
ব্ৰাহ্মণ বললেন, “আপস্য মুদিতা ভাৰ্যা সহস্য পরম প্রিয়’, অর্থাৎ সহ নামে যে অগ্নি ছিলেন, তাঁর পরম প্রিয়তম ভাৰ্যার মুদিতা। এই দুজনের মিলনে এক মহাতেজা পুত্র জন্মেছিল। সমস্ত যজ্ঞে পূজিত সেই পুত্রের নাম গৃহপতি…
নীপময়ী বললেন, তাহলে গৃহপতি নামে অগ্নির সামনেই সব যজ্ঞ হয়। হ্যাঁ, বুঝলাম, দরজার কাছে কে দাঁড়িয়ে।
যাদুগোপাল বলল, দিম্মা, তুমি মহাভারত শোনো, আমরা একটু বাইরে যাচ্ছি।
নীপময়ী বললেন, তোর সেই ভরত নামের মানুষ বন্ধুটি কোথায়?
ভরত বলল, দিদিমা, আমিও এখানেই আছি। নীপময়ী বললেন, নদীতে বেড়াতে যাচ্ছ, সাতার জানো?
ভরত বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ, জানি।
নীপময়ী বললেন, যাদু, নবদ্বীপের ঘাটে নামিসনি যেন। ওখানে শাক্ত-বৈষ্ণবে লাঠালাঠি হচ্ছে শুনেছি। দুপুরের মধ্যে ফিরবি, তোদের জন্য খাসির মাংস রান্না হচ্ছে।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে নদীর দিকে গিয়ে যাদুগোপাল বলল, তোকে নৌকায় চড়াব, মাঝি লাগবে না। আমি নিজেই চালাতে পারি।
ভরত জিজ্ঞেস করল, আমরা যে নদীতে বেড়াতে যাব, তা কি তুই আগেই ঠিক করে রেখেছিলি? তোর দিদিমা জানলেন কী করে?
যাদুগোপাল বলল, ওইসব প্রশ্ন করিস না, অনেক কিছুরই উত্তর পাওয়া যায় না। নারীজাতির ষষ্ঠ ইন্দ্ৰিয় খুব প্রবল, ওরা অনেক কিছুই টের পেয়ে যায়। আমি একটি মেয়েকে চিনতাম, সে আপনমনে কথা বলত। তার জন্মের আগের অতীত, দূর ভবিষ্যতের কথা বলত। এমন ছিল তার কথা বলার ধরন, ঠিক যেন সে চোখের সামনে অনেক অদৃশ্য কিছু দেখতে পায়।
– তোর দিদিমা বুঝি লেখাপড়া জানেন?
— বেশ ভালই জানেন। অন্ধ হওয়ার আগে পর্যন্ত নিজেই মহাভারত পড়তেন। উনি বন্দুক চালাতে পারেন, তা জানিস? আজ থেকে চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগে আমার দিদিমা দাদামশাইয়ের সঙ্গে ঘোড়ায় চেপে শিকারে যেতেন। নিজে হরিণ মেরেছেন। লোকে বলে, ঠাকুরবাড়ির ছেলে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তাঁর স্ত্রী কাদম্বরীকে নিয়ে ঘোড়ায় চেপে ময়দানে হাওয়া খেতে গিয়েছিলেন। তাতেই হুলুস্থুল পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু সে মোটে একবার না। দুবার। সবাইকে চমকে দেওয়াই ছিল উদ্দেশ্য। আমার দিদিমা কত আগে ঘোড়ায় চড়ে বেরিয়েছেন। কলকাতার বড় বড় পরিবারের এই সব ঘটনা নিয়ে কত ধুমধাড়াক্কা হয়, এখানকার মতন ছোট জায়গার কত কী ঘটে, কেউ খবরও রাখে না।
– উনি ঘোড়ায় চাপতেন, সেজন্য ওঁর নিন্দে হয়নি?
– দু চারজন আড়ালে কিছু টিপ্পনি কেটে থাকতে পারে। কিন্তু সামনে বলার সাহস ছিল না। আমাদের কৃষ্ণনগরের মেয়েরা অত পর্দানশীল নয়। বিদ্যাসাগর মশাইয়েরও আগে এই কৃষ্ণনগরের মহারাজ বিধবা বিবাহের প্রস্তাব তুলেছিলেন তা জানিস?
— হ্যাঁ রে যাদু, নবদ্বীপে মহাপ্ৰভু শ্ৰীচৈতন্য জন্মেছিলেন না? গিরিশবাবুর নাটকে সেরকমই তো দেখিয়েছে। সেখানেও মারামারি হয়? তোর দিদিমা বললেন—
– শ্ৰীচৈতন্য অত করে মানুষে মানুষে ভালবাসার কথা বলে গেলেন, তাতে ফল হল কী? নবদ্বীপে বরাবরই শাক্তদের প্রাধান্য। ওই শাক্তদের উৎপাতেরই মহাপ্ৰভু নীলাচলে চলে গেছিলেন। এখনও নবদ্বীপের শাক্তরা সুযোগ পেলেই বোষ্টমদের ধরে ধরে পেটায়। আমরা অবশ্য ওদিককার ঘাটে নেমে দেখব কেমন মারামারি চলছে। আমাদের কে কী করবে?
ওদের বাড়ি থেকে নদী বেশ দূর। সে পর্যন্ত ওরা গল্প করতে করতে হেঁটেই চলে গেল। এখানকার ঘাটে যাদুগোপালের মামাবাড়ির একটা নিজস্ব নৌকো বাঁধা থাকে। মাঝিটি যাদুগোপালকে চেনে। যাদুগোপাল অবশ্য মাঝিটিকে সঙ্গে নিল না, সে নিজেই নৌকো চালাতে চায়।
আষাঢ় মাসের মেঘলা আকাশ, রোদ্দুরের তাপ নেই। এখনও পুরোপুরি বর্ষা নামেনি বলে নদী এখানে কিছুটা শীর্ণ। যাদুগোপাল বেশ ভালই বইঠা চালাতে জানে। ছোট একটা নৌকো নিয়ে সে নদী পার হচ্ছে কোণাকুনি। একসময় সে গান ধরল :
দিল দরিয়ার মাঝে দেখলাম আজব কারখানা
দেহের মাঝে বাড়ি আছে
সেই বাড়িতে চোর লেগেছে
ছয়জনাতে সিঁদ কাটিছে
চুরি করে একজনা…
ভরত জিজ্ঞেস করল, এটাও তুই বানালি নাকি?
যাদুগোপাল ভৎসনা করে বলল, তুই কিছুই জানিস না। এ লালন ফকিরের গান। চল, একদিন তোকে লালনের আখড়ায় নিয়ে যাব। হিন্দু-মুসলমান দু’জাতেরই অনেক ভক্ত আছে। ওঁর। লালন শুকনাে উপদেশ দেয় না, নতুন নতুন গান বেঁধে শোনায়। লিখতে পড়তে পারে না, মুখে মুখে গান বাঁধে, এলেম আছে মানুষটির।
ভরত অন্যমনস্ক হয়ে একটু কাত হয়ে জলে হাত রেখেছে। দু’পাশ দিয়ে অনবরত যাচ্ছে খেয়ার নৌকো। কলকাতার তুলনায় এখানকার গঙ্গার জল অনেক নির্মল, মুখ দেখা যায়। সেদিকে তাকিয়ে ভরত বলল, আমি কথা দিচ্ছি যাদু, পরীক্ষায় আমি কিছুতেই ফাস্ট হব না, তুই-ই হবি, তুই বিলেত যাবি।
যাদুগোপাল হেসে বলল, আমাকে দয়া করছিস নাকি? চৈতন্যদেবের জীবনীতে এইরকম কী একটা গল্প আছে না? ফরগেট ইট, ব্রাদার। তোর একটুখানি পড়াশুনো দেখেই বুঝে গেছি, আমাকে ছাড়াবার ক্ষমতা নেই। তবে সেকেন্ড হবার চেষ্টা কর। সেকেন্ড হলেও ভালো চাকরি পাবি।
নবদ্বীপের ঘাটে কোন্দল-কাজিয়ার কোনও চিহ্ন নেই। লোকজন আসছে যাচ্ছে, বুক-জলে দাঁড়িয়ে কেউ কেউ স্তব পাঠ করছে, দুরন্ত কিশোরেরা মেতে আছে হুটোপাটির খেলায়। মনে হয় যেন চৈতন্যদেবের আমল থেকে বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। এই যে কিশোররা দুরন্তপনা করছে, হয়তো ওদেরই একজনের নাম নিমাই। নৌকো বেঁধে ওরা নবদ্বীপ শহরটি খানিকটা ঘুরে এল। তেমন দর্শনীয় কিছুই নেই।
ফেরার পথে, নবদ্বীপের দিকেই গঙ্গার ধারে একটা বিশাল বটগাছের ধারে নৌকো থামাল যাদুগোপাল। গাছটির অনেকখানি শিকড় ও ঝুড়ি নেমে এসেছে জলে। খানিকটা উঁচুতে একটি খড়ের চালের বাড়ি, খুটাের সঙ্গে গরু বাঁধা, একজন দীর্ঘকায় ব্যক্তি রোদ্দুরে বসে তেল মাখছে। যাদুগোপাল হাঁক দিয়ে বলল, হরুজ্যাঠা, ভালো আছেন?
লোকটি চোখ সঙ্কুচিত করে দেখল, চিনতে পারল না, একটু এগিয়ে এসে বলল, কে? ওঃ হো, যাদু, কবে এলে? মা কেমন আছেন?
সাধারণ কিছু কুশল সংবাদ বিনিময়ের পর আবার নৌকো ছেড়ে দিল যাদুগোপাল। এখন তার ঠোঁটে বিরক্তির রেখা, দু’চোখে ঘৃণা। একটুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর সে বলল, খুনীদের শাস্তি হয়, অথচ এই সব মানুষদের শাস্তি হয় না।
ভরত বলল, সে কি? গলায় পৈতে দেখলাম, এই লোকটি খুনী নাকি?
যাদুগোপাল বলল, তার চেয়েও অধম। এই হরমোহন এককালে আমার মামার বাড়ির পুরুত ছিল। তোকে খানিক আগে একটি মেয়ের কথা বললাম না, যে মেয়েটির মাঝে মাঝে ঘোর হতো, অতীত কিংবা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নানান অদ্ভুত কথা বলত। সে এই হরমোহনের মেয়ে। বাবার সঙ্গে আমাদের বাড়িতে আসত প্রায়ই। সাত-আট বছর বয়েস থেকে ওকে দেখছি, ফুটফুটে সুন্দর চেহারা, মিষ্টি গলায় স্বর, মাঝে মাঝে কোনও ফুলগাছের দিকে কিংবা জলের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত। তারপর আপনমনে কথা বলত। অনেকে বলত, ওর মাথার একটু দোষ আছে। আসলে তা নয়, মেয়েটি ছিল অতিরিক্ত কল্পনা প্রবণ, মোটেই সাধারণ মেয়ের মতন নয়। উচিত ছিল ওকে একটু বেশি যত্ন করা, ওকে একটু লেখাপড়া শেখানো। আমার দিদিমা মেয়েটিকে খুব পছন্দ করতেন, চেয়েছিলেন নিজের কাছে রেখে ওকে মানুষ করবেন। হরমোহন রাজি হয়নি। পাগল মেয়ের তাড়াতাড়ি বিয়ে দেবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল। তোকে যেমন এবারে নিয়ে এসেছি, সেই রকম দ্বারিকাও- আমার সঙ্গে বেশ কয়েকবার এখানে বেড়াতে এসেছে। দ্বারিকা দেখেছিল মেয়েটিকে, দ্বারিকাও রোমান্টিক স্বভাবের তুই জানিস, মেয়েটির কথাবার্তা শুনে সে মুগ্ধ হয়েছিল। মেয়েটার বয়েস তখন এগারো, হরমোহন এক দোজবরের সঙ্গে ওর বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে, শুনে দ্বারিকা দুম করে বলে বসল, সে ওই মেয়েটিকে বিয়ে করতে চায়। সেই বিয়ে হলে মেয়েটা বেঁচে যেত, কিন্তু হরমোহন রাজি হল না।
ভরত বলল, দ্বারিকা এখানে এসে একটি মেয়েকে বিয়ে করতে চেয়েছিল? আমাকে কখনও এসব বলেনি। লোকটা রাজি হল না কেন?
যাদুগোপাল বলল, যে বুড়োর সঙ্গে বিয়ে ঠিক করেছিল, তার কাছে ওর কিছুটা জমি বন্ধক ছিল। মেয়ের থেকে জমির দাম বেশি। দ্বারিকা তখনও মামাদের সম্পত্তি পায় নি, বাবার সঙ্গে সম্পর্ক ভালো নয়, সাধারণ অবস্থা, কিন্তু তাতে কী, লেখাপড়া শিখে সে নিজের পায়ে দাঁড়াতই। হরমোহন খুঁত ধরল যে দ্বারিকারা ভঙ্গ কুলীন, ওদের সঙ্গে বিবাহ সম্পর্ক হয় না।
ভরত বলল, তোদের এখানে এত জাতপাতের ব্যাপার আমি এখনও বুঝিই না। ভঙ্গ কুলীন আবার কী?
যাদুগোপাল বলল, মেয়েটির নাম ছিল বাসন্তী। ওর বিয়ের কয়েক দিন আগে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, হ্যাঁরে বাসি, তুই তো অনেক কিছু বলতে পারিস। বল তো তোর এই বিয়ে কেমন হবে? তোর স্বামী কেমন মানুষ হবে? বাসন্তী একটা আরও বড় এক গঙ্গায়..। ঠিক মিলে গিয়েছিল ওর কথা। ওর বুড়ো বরটা দু’বছরের বেশি বাঁচেনি। দেখতে শুনতে ভালো কোনও মেয়ে যদি বালবিধবা হয়, তা হলে এই সব মফঃস্বলে, গ্রামে গঞ্জে তার কি দশা হয় তা তো তুই জানিস না। হয় তাকে কাশীতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, না হলে লোভী পুরুষরা তাকে নষ্ট করে। বাসন্তীকে নিয়ে প্রথমে পালাল এক সুপুরির ব্যবসায়ী, তারপর হাত বদল হতে হতে কয়েক বছর পর তার স্থান হল কলকাতার বেশ্যা পাড়ায়। এই গঙ্গা ছেড়ে আর এক বড় গঙ্গার ধারে কলকাতা শহরে।
ভরত বলল, বিয়ের সময় তুই বাধা দিতে পারিসনি?
যাদুগোপাল বলল, আমি বাধা দেব কী করে? মেয়ের বাপ যদি অন্যায় করে। তাকে বাধা দেবার মতন কোনও আইন আছে? আমার প্রায়ই ইচ্ছে করে, ওই হরমোহন ভট্টচাজকে মুখের ওপর শুনিয়ে দিই, তোমার মেয়ে এখন হাড়কাটার গলির বেশ্যা। তোমার জাত এখন রইল কোথায়? প্রত্যেকবার আসি, কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারি না!
একটু থেমে, যাদুগোপাল আবার বলল, হাড়কাটার সেই বাসন্তীর নাম এখন বসন্তমঞ্জরী!
ভরতের মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল। এতক্ষণ এই কাহিনীর মেয়েটির অবয়ব সে দেখতে পাচ্ছিল না, এবার তার চোখের সামনে ভেসে উঠল এক আলো জ্বালা ঘরে পালঙ্কের ওপর চোখ বুজে শুয়ে থাকা এক যুবতীর মুখ। সেই বসন্তমঞ্জরী, যার ডাক নাম বাসি।
ভরত বলল, যাদু, তুই জানিস কি, হাড়কাটার গলিতে, এখন দ্বারিকা.ওই বসন্তমঞ্জরীকে আলাদা করে রেখেছে।
যাদুগোপাল বলল, জানি। তুই একদিন দ্বারিকার সঙ্গে গিয়েছিলি, তাও শুনেছি। দ্বারিকা কিছুই বলতে বাকি রাখে না আমার কাছে। সেই দুজনের মিলন হল, মাঝখান থেকে মেয়েটাকে কিছু পোকায় খেয়ে গেল। দ্বারিকা কি আর ওকে সামাজিক ভাবে গ্রহণ করতে পারবে?
এরপর কিছুক্ষণ কেউ কোনও কথা বলল না। জলে বইঠা ফেলার ছপ ছপ শব্দ হতে লাগল। দু’জনের চিন্তার কোনও মিল নেই।
অন্য পারে পৌঁছে নৌকো বাঁধতে বাঁধতে যাদুগোপাল জিজ্ঞেস করল, ভরত, তুই তোর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কী ঠিক করেছিস?
ভরত শূন্য চোখে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল। তারপর আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে বলল, কিছু না!
এখানে এস প্রথম দিনটায় যে-রকম ভালোলাগায় আচ্ছন্ন হয়েছিল ভরত, তা হঠাৎ মুছে গেল। এখানে এসেও যে বসন্তমঞ্জরীর নাম উত্থাপিত হবে, তা তার সুদূর কল্পনাতেও ছিল না। বসন্তমঞ্জরী আর ভূমিসূতা একই। ভূমিসূতাকে সে কিছুতেই নষ্ট হতে দেবে না। এর মধ্যেই ভূমিসূতা যদি কোনও বিপদে পড়ে, ভরতের কাছে ডাক পাঠায়? সে স্বার্থপরের মতন কৃষ্ণনগরে বসে থেকে মামাবাড়ির আদর খাচ্ছে? ভরতের মুস্কিল এই, সে যে অন্য কারুর কাছে নিজের মনের কথা প্ৰকাশ করতে পারে না। দ্বারিকা কিংবা যাদুগোপাল কত অনায়াসে নিজেদের সব কথা বলে দেয়। ভরত এ পর্যন্ত ভূমিসূতার কথা কারুকে জানায় নি। এক একবার খুব ইচ্ছে করে, যাদুগোপালের কাছে সব কিছু খুলে বলে পরামর্শ নিতে। কিন্তু কিছুতেই তার মুখ ফোটে না।
সে রাত এবং পরদিন সকালেও দু’জনে কোমর বেঁধে পড়াশুনো করতে বসল বটে, কিন্তু ভরত টের পেল, তার কিছু সুবিধে হচ্ছে না। যাদুগোপালের পদ্ধতিটা তার নিজস্ব। সে প্রায় ঘণ্টা খানেক গভীর মন দিয়ে পড়ে, একটা কথাও উচ্চারণ করে না, তারপর কিছুক্ষণ চিত হয়ে চোখ বুজে থাকে, যেন অধীত পৃষ্ঠাগুলি সে মনে গেঁথে নিচ্ছে। খানিকবাদে একটু রঙ্গরসিকতা করে সে আবার বইয়ের পাতায় ডুব দেয়।
ভরত যে কিছুই পারছে না। তার মনে পড়ছে বারবার যাদুগোপালেরই কবিতার লাইন, ‘তবুও দেখি না কিছু, তবুও শুনি না কিছু, মনে তার মুখ, তার সেই নিবিড় চাহনি!
নাঃ, ভরতকে কলকাতায় ফিরে যেতে হবে।