৫১.
রাস্তা থেকে ফের সবাই অফিসে ফিরে এসেছিল। বিধানবাবু চলে গেছেন। আমন্ত্রিত বিশিষ্ট অতিথিরাও একে একে বিদায় নিয়েছেন।
নতুন ভারত-এর সব কর্মীকে অনুষ্ঠান উপলক্ষে সকাল থেকে হাজির থাকতে বলা হয়েছিল। মর্নিং শিফটে যাদের ডিউটি নেই, অনুষ্ঠানের শেষে তারাও কিন্তু চলে যায়নি। এমনকি জগদীশ গুহঠাকুরতার মেয়ে এবং স্ত্রীও থেকে গেছেন। তারা আছেন জগদীশের কামরায়। কিশোরী ছাত্রীর দঙ্গলটাও আছে। তারা নিউজ ডিপার্টমেন্টের এক ধারে কেউ বসে, কেউ বা দাঁড়িয়ে কল কল করে চলেছে। কথার ফাঁকে হিহি হাসি। সানাইওলা আর তার বাজনাদারেরা চলে তো যায়ইনি, বাজিয়েই যাচ্ছে। মাঝে মাঝে দম নেবার জন্য একটু থামে। তারপর আবার শুরু হয়ে যায়। এইভাবেই চলছে। সারাদিনই হয়তো চলবে।
এমপ্লয়ীরা যে যার ডিপার্টমেন্টে গিয়ে বসেছে। কালই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর কেউ যেন চলে না যায়। পত্রিকার তরফ থেকে কর্মীদের সকলের জন্য মধ্যাহ্ন ভোজের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার রেশ এখনও থেকে গেছে। বিধানচন্দ্র রায়, তাঁর ভাষণ, তার অপরিমাণ ব্যক্তিত্ব–এ-সব নিয়ে আলোচনা চলছে প্রতিটি ডিপার্টমেন্টে, প্রতি সেকশানে। বিনয়দের রিপোর্টিং সেকশানও বাদ নেই। অন্য দিন তারা নিজের নিজের নির্দিষ্ট টেবলে গিয়ে বসে। আজ বসেছে প্রসাদ লাহিড়িকে ঘিরে। নানা কথার ফাঁকে একসময় উদ্বাস্তুদের প্রসঙ্গ উঠল।
সুধেন্দু বলছিল, বিধানবাবু ইস্ট পাকিস্তানের রিফিউজিদের প্রবলেম সলভ করতে অনেস্টলি চেষ্টা করছেন। শুনি দিনে চোদ্দ পনেরো ঘন্টা কাজ করেন। কিন্তু দিনের পর দিন ওপার থেকে হাজার হাজার মানুষ চলে আসছে। এত বড় সমস্যার সুরাহা কী করে হবে, কে জানে।
মণিলাল বলল, পাঞ্জাবের মতো টোটাল এক্সচেঞ্জ অফ পপুলেশন যদি হতো, কাজ অনেক সহজ হয়ে যেত। ওয়েস্ট বেঙ্গল এতটুকু স্টেট। লাখ লাখ রিফিউজির যে রিহ্যাবিলিটেশন হবে, তার জন্য ল্যাণ্ড কোথায়?
সুধেন্দু ঝাঁঝের গলায় বলে, নেহরু গভর্নমেন্ট ওয়েস্ট পাকিস্তানের রিফিউজিদের জন্যে দশ হাতে ঢেলে দিচ্ছে। আর ইস্ট বেঙ্গলের রিফিউজিদের বেলায় একটু আধটু ভিক্ষে। আঙুলের ফাঁক দিয়ে পয়সাই গলতে চায় না।
বিনয় চুপচাপ ওদের কথা শুনে যাচ্ছিল। এদের মধ্যে সে সবচেয়ে জুনিয়র। আনকোরা। অনভিজ্ঞ। সিনিয়ররা যখন কোনও গভীর বিষয়ে কথা বলেন তখন যে কোনও মন্তব্য করতে নেই, এটুকু কাণ্ডজ্ঞান তার আছে। কদিন আগেই কোনও একটা কাগজে কার যেন লেখা পড়েছিল। নামটা এই মুহূর্তে ঠিক মনে পড়ছে না। লেখাটায় প্রচুর তথ্য দিয়ে দেখানো হয়েছে কী বিপুল পরিমাণ আর্থিক অনুদান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা শরণার্থীদের দেওয়া হয়েছে। তাদের নিজের পায়ে স্বয়ম্ভর হবার জন্য নেওয়া হয়েছে কী কী পদক্ষেপ। লেখাটা পুরোপুরি টুকে রেখেছে বিনয়। এদিকে পশ্চিমবঙ্গে রিফিউজিদের জন্য কী করা হয়েছে বা হচ্ছে, সেই প্রক্রিয়া কীভাবে এগুচ্ছে, সে সম্বন্ধে এখনও পরিষ্কার ধারণা নেই তার। ওয়েস্ট বেঙ্গল রিফিউজি অ্যাণ্ড রিহ্যাবিলিটেশনের দপ্তরে একবার গিয়েছিল সে। আরও বারকয়েক গিয়ে গিয়ে খোঁজখবর নিয়ে তুলনামূলক একটা প্রতিবেদন তাকে তৈরি করতেই হবে। ওধারে রমেনও তার মতোই নীরবে বসে ছিল। সে সবে ঢাকা থেকে এসেছে। এখানকার রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক হালচাল এবং উদ্বাস্তুদের সম্পর্কে সরকারি পলিসি পুরোপুরি না জেনে খুব সম্ভব মুখ খুলতে চায় না। হিসেবি লোক।
সুধেন্দুর স্বর ক্রমশ চড়ছিল, দেশের জন্যে সবচেয়ে বেশি স্যাক্রিফাইস করেছে বাঙালি। সবচেয়ে বেশি জেল খেটেছে, ফাঁসিতে প্রাণ দিয়েছে। তবেই না আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি।
প্রসাদ বললেন, অন্য প্রভিন্সের ফ্রিডম ফাইটাররাও কম নির্যাতন ভোগ করেনি। তারাও জেলে পচে মরেছে, গুলিতে ফাঁসিতে প্রাণ দিয়েছে।
সুধেন্দু বলল, বাঙালিদের মতো নয়। কিন্তু স্বাধীনতার পরও সবচেয়ে বেশি সর্বনাশ হয়েছে বাঙালির। লক্ষ লক্ষ মানুষ উৎখাত হয়ে এপারে চলে আসছে। দিল্লি থেকে শুকনো সহানুভূতি শোনা যায়। তারা বলে, স্বাধীনতার জন্য পূর্ব বাংলার উদ্বাস্তুদের অবদানের কথা, তাদের চরম কষ্ট ভোগের কথা, তাদের আত্মত্যাগের কথা দেশ কোনওদিন ভুলবে না। এইসব ভাল ভাল ফাঁকা বুলি কতকাল ধরে শুনে আসছি। কিন্তু এই লোকগুলোর জন্যে কাজের কাজ কী হয়েছে? কতটুকু হয়েছে? কোপটা যদি বেঙ্গলের ওপর না পড়ে পড়ত বোম্বে কি মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির ওপর, পড়ত যুক্তপ্রদেশ কি বিহারের ওপর, দেখতেন সারা ভারতবর্ষ তোলাপাড় হয়ে যেত।
সুধেন্দুর দিকে অবাক তাকিয়ে আছে বিনয়। বাঙালি উদ্বাস্তুদের প্রতি বৈষম্যের জন্য তার ভেতরে এতটা তীব্র ক্ষোভ যে জমা হয়ে আছে আর সেটা এই উদ্বোধন অনুষ্ঠানের দিনে এভাবে ফেটে পড়বে, ভাবা যায়নি।
আরও উগ্র, আরও উত্তপ্ত কিছু অভিযোগ উগরে দিত সুধেন্দু, এই সময় নিউজ এডিটর তারাপদ ভৌমিক এলেন। সঙ্গে জগদীশ গুহঠাকুরতার মেয়ে পারমিতা। তারাপদ কখনও সখনও রিপোর্টিং সেকশানে আসেন। কিন্তু নতুন ভারত-এর মালিক এবং সম্পাদকের মেয়ে আসবে, সেটা প্রায় অকল্পনীয়।
প্রথমটা সবাই হকচকিয়ে যায়। তারপর দ্রুত উঠে দাঁড়ায়।
তারাপদ বলেন, জগদীশবাবু পারমিতাকে নতুন ভারত-এর সব এমপ্লয়ীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্যে পাঠিয়েছেন। প্রথমে রিপোর্টিং সেকশনে নিয়ে এলাম। তারপর একে একে অন্যদের কাছে নিয়ে যাব।
পারমিতা হাতজোড় করে মৃদু গলায় বলে, নমস্কার। তার হাসি এবং কণ্ঠস্বর দুই-ই মিষ্টি।
রিপোর্টিংয়ের সবাই হাতজোড় করে। প্রসাদ বলেন, আপনি এসেছেন, আমরা খুব খুশি। এখনও কি পড়াশোনা করছেন?
পারমিতা বলে, না। লাস্ট ইয়ারে হিস্ট্রি নিয়ে এমএ পাস করেছি।
বিনয় একদৃষ্টে পারমিতাকে লক্ষ করছিল। মেয়েটি নম্র, বিনয়ী। মালিকের মেয়ে বলে লেশমাত্র অহমিকা নেই।
তারপদ বললেন, ভাল রেজাল্ট করেছে পারমিতা। ফার্স্ট ক্লাস সেকেণ্ড। একটা কলেজে লেকচারশিপও পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ওর ইচ্ছে সাংবাদিক হয়। জগদীশবাবু আপত্তি করেননি। পারমিতা কাল থেকে নতুন ভারত-এ জয়েন করছে। আমাদের সঙ্গে কাজ করবে।
বিনয় তাকিয়েই আছে। কলকাতায় বাঙালি মেয়েরা অনেকেই গার্লস স্কুল বা কলেজে পড়ায়। দেশভাগের পর নানা অফিসেও কেউ কেউ চাকরি বাকরি করছে। কিন্তু খবরের কাগজে সাংবাদিকতা করে, এমন মেয়ের কথা জানা নেই। নতুন ভারত-এও কোনও মহিলা রিক্রুট করা হয়নি। প্রেস থেকে এডিটোরিয়াল, এই কাগজ আগাপাশতলা পুরুষদেরই রাজ্য। তাদের পাশাপাশি বসে একা একটি মেয়ে কাজ করবে, ভাবতে অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল বিনয়ের। সেটা যে কী, ব্যাখ্যা করে বোঝাতে পারবে না সে।
পারমিতা বিনয়ী হলেও বেশ সপ্রতিভ। জড়তাহীন। বলল, আমি বেসিক থেকে শুরু করতে চাই। আপনারা আমাকে শিখিয়ে টিখিয়ে নেবেন।
তারাপদ তোয়াজের সুরে বললেন, তুমি হাইলি-এডুকেটেড, ইনটেলিজেন্ট মেয়ে। মাসখানেকের ভেতর সব শিখে যাবে। এরপর বিনয়দের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে পারমিতাকে নিয়ে ওধারে সাব-এডিটরদের টেবলগুলোর দিকে চলে গেলেন।
বিনয়রা ফের বসে পড়ে।
পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বাস্তুদের প্রতি বৈষম্য এবং উদাসীনতা নিয়ে যে উত্তপ্ত আলোচনার সূত্রপাত হয়েছিল, সুধেন্দু তার জের আর টানল না। পুরোপুরি আলাদা প্রসঙ্গে চলে গেল। মজার গলায় সে বলে, দিনকাল জোর কদমে পালটে যাচ্ছে। বাঙালি মেয়েরা পুরনো গৃহলক্ষ্মী-মার্কা ইমেজ নিয়ে আর সংসার টংসার আগলে ঘরে বসে থাকতে চায় না। পটাপট ডিফারেন্ট প্রফেশনে ঢুকে পড়ছে। বাংলা সাংবাদিকতাটা পুরুষদের হানড্রেড পারসেন্ট মনোপলি ছিল। সেখানে আজ এক রমণীর আবির্ভাব ঘটল। শিগগিরই দেখবে এ-লাইনে ঝাঁকে ঝাঁকে নারীবাহিনী চলে আসছে। ভুরু নাচিয়ে, গলার স্বর উঠিয়ে নামিয়ে এমন ভঙ্গিতে কথাগুলো সুধেন্দু বলল যাতে সবাই প্রাণ খুলে হেসে ওঠে।
মণিলাল তার সঙ্গে তাল দিল, যা বলেছ ভাই। হয়তো দেখা যাবে, দু-চার মাসের ভেতর কুমারী পারমিতা গুহঠাকুরতা অনেক সিনিয়রকে টপকে নতুন ভারত-এর কোনও ডিপার্টমেন্টের টপে গিয়ে বসেছে।
বিশুদ্ধ রগড়ই কিন্তু একটু বাড়াবাড়ি ধরনের। প্রসাদ চাপা গলায় ধমক দিলেন, অনেক হয়েছে, স্টপ ইট। তোমরা যা বললে, জগদীশবাবুর কানে যাওয়া বাঞ্ছনীয় নয়।
সুধেন্দু, মণিলাল-দুজনেই অপ্রস্তুত। সুধেন্দু কাঁচুমাচু মুখে বলে, এটা ফান। আমরা একটু মজা করছিলাম।
প্রসাদ বললেন, মজারও মাত্রা থাকা দরকার। কাকে নিয়ে রগড় করছ, কোথায় বসে করছ, সেটা মনে থাকা উচিত। আই ডোন্ট লাইক দিস কাইন্ড অফ ফ্রিভোলিটি।
সুধেন্দুরা আর কিছু বলে না। সকাল থেকে দিনটা একটা চমৎকার সুরে বাঁধা ছিল। হঠাৎ সেটায় সামান্য ছেদ পড়ল।
নতুন ভারত-এর কর্মীদের সংখ্যা সব মিলিয়ে আপাতত এক শ একাশি। তা ছাড়া বাইরের আরও কিছু লোকজন আছেন। যেমন সেই কিশোরীর দলটা। যেমন সানাইওলা, তার সঙ্গী বাজানা দারেরা, ইত্যাদি। খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে বিল্ডিংয়ের ছাদে। ছাদটা যদিও বেশ বড়, তবে তত বড় নয় যে একসঙ্গে এত লোককে বসিয়ে খাওয়ানো যায়। তাই দুটো ব্যাচে ভাগ করে নেওয়া হয়েছে।
সাড়ে বারোটায় খাওয়ার ডাক পড়েছিল। প্রথম ব্যাচে প্রেসের লোকন, কম্পোজিটর, সাইকেল পিওন, কিশোরীদের দলটা, সানাইওয়ালাদের গ্রুপ এবং অফিসের আরও দু-তিনটে ডিপার্টমেন্টের এমপ্লয়ীদের খাইয়ে দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় ব্যাচে বাকি সবাইকে যখন ডাকা হল তখন সোয়া একটা।
ছাদে এসে বিনয় অবাক। সকালে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জন্য যে চেয়ারগুলো অতিথিদের জন্য লাইন দিয়ে বসানো ছিল সেগুলো উধাও। মাইকও নেই। ডেকরেটরের লোকেরা কখন সে-সব সরিয়ে নিয়ে গেছে, নিউজ ডিপার্টমেন্টে বসে টের পাওয়া যায়নি। তবে মঞ্চটা এখনও আছে।
বিনয়ের ধারণা ছিল, লম্বা লম্বা টেবল পেতে চেয়ারে বসিয়ে খাওয়ানো হবে। তা নয়, মঞ্চের দিকটা বাদ দিয়ে বাকি তিন দিকের ছাদের দেওয়ালের গা ঘেঁষে চট ভাজ করে পেতে নিচে বসার ব্যবস্থা। মাঝখানেও রয়েছে চটের আসনের দুটো বো। আসনগুলোর সামনে সারি সারি কলাপাতা আর জল ভর্তি মাটির গেলাস। পাতের এক কোণে নুন, লেবুর টুকরো আর কাঁচা লঙ্কা।
মঞ্চের পাশে বিরাট বিরাট পেতলের হাঁড়ি, কাঠের বারকোশ আর ডেকচিতে স্তূপাকার খাদ্যবস্তু। যারা পরিবেশন করবে তারা ধুতির ওপর গামছা বেঁধে অপেক্ষা করছে। মঞ্চের ঠিক নিচে দাঁড়িয়ে ছিলেন জগদীশ, তার স্ত্রী এবং পারমিতা।
বিনয়রা উঠে আসতেই জগদীশ বয়স অনুযায়ী কারওকে তুমি কারওকে আপনি বলে সযত্নে। খেতে বসিয়ে দিয়ে পরিবেশনকারীদের খাবার দিতে বললেন।
নিখুঁত বাঙালি ভোজ। পদ অনেকগুলো। ধবধবে সরু চালের ধোঁওয়া-ওঠা গরম ভাত, খাঁটি গাওয়া ঘি, বোঁটাসুদ্ধ বেগুন ভাজার লম্বা ফালি, আলু-ফুলকপির ডালনা, মাছের মাথা দিয়ে মুগের ডাল, ততপসে মাছ ভাজা, সর্ষে-ইলিশ, বড় বড় পাবদা মাছের ঝাল, আমসত্ত্বের চাটনি, চিনিপাতা দই আর নলের গুড়ের কাঁচাগোল্লা, ক্ষীরের পানতুয়া।
বিনয় সকাল থেকে নতুন ভারত-এর অফিসে আছে। রান্নাবান্নার কোনও লক্ষণই চোখে পড়েনি। ভেবে পাচ্ছিল না, এত সব সুখাদ্য কোথায় তৈরি হল আর কীভাবেই বা ছাদে উঠে এল। তার পাশে বসে খাচ্ছিলেন প্রসাদ। তাকে জিজ্ঞেস করতেই জানা গেল, এ-বাড়িতে অনুষ্ঠান হবে, প্রচুর লোকজন আসবে। সেই ভিড় আর হট্টগোলের মধ্যে রান্নাবান্নার অসুবিধে। তাই পাশের বাড়িতে বামুন ঠাকুর দিয়ে রাধানো হয়েছে। নতুন ভারত-এর বিল্ডিংটার ভেতর দিয়ে যেমন ছাদে ওঠার সিঁড়ি আছে, তেমনি বাইরে থেকে পেছন দিকে একটা ঘোরানো লোহার সিঁড়িও রয়েছে। ভোজ্য বস্তুগুলো সেই পথেই ওপরে উঠে এসেছে।
জগদীশ গুহঠাকুরতা খুবই রাশভারী। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। কিন্তু এখন তাকে যেন চেনাই যায় না। তিনি আজ জয়েন্ট ফ্যামিলির সহৃদয় গৃহকর্তার ভূমিকায়। প্রতিটি এমপ্লয়ীর কাছে গিয়ে তদারক করছেন। হাঁকডাক করে পরিবেশনকারীদের ডাকিয়ে এনে কারও পাতে দিতে বলছেন ইলিশের পেটি, কারও পাতে পাবদা। তাঁর স্ত্রী আর মেয়েও ঘুরে ঘুরে দেখাশোনা করছে।
মুখ নিচু করে খাচ্ছিল বিনয়। ভাবছিল, এই গুহঠাকুরতায় পরিবারটি তো চমৎকার। তারা মালিক। কর্মচারীদের ভোজ দিয়েছেন। তারা খেয়ে কৃতার্থ হয়ে যাবে। এমনটাই তো নিয়ম। কিন্তু গুহঠাকুরতারা সপরিবারে প্রতিটি এমপ্লয়ীর কাছে গিয়ে তত্ত্বতালাশ নিচ্ছেন। এটা বিরল ঘটনা। বিনয়ের ভীষণ ভাল লাগছিল।
আপনি তো কিছুই খাচ্ছেন না
ভারী নরম কণ্ঠস্বর শুনে চমকে মুখ তোলে বিনয়। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে পারমিতা। এমন নয় যে আলাদা করে তার কাছে এসেছে। অন্য সবার মতো তারও খোঁজখবর নিচ্ছে সে।
বিনয় খুবই স্বল্পাহারী। এই সেদিন সে পাকিস্তান থেকে এসেছে। এখনও সুদুর নগণ্য এক শহরের লাজুক, জড়সড় যুবকটি তার ভেতরে থেকেই গেছে। একটি সপ্রতিভ, সুন্দরী তরুণী তার খাওয়া লক্ষ করছিল, ভাবতেই ভীষণ সংকোচ বোধ করে বিনয়। বিব্রতভাবে বলে, না না, ঠিক খাচ্ছি।
উঁহু–পাশ দিয়ে একটা পরিবেশনকারী যাচ্ছিল। তাকে থামিয়ে একরকম জোর করেই বিনয়ের পাতে দুটো কাঁচাগোল্লা দেওয়ালো পারমিতা।
ঘটনাটি এমন কিছুই নয়। খুবই তুচ্ছ। তবু বিনয়ের বুকের ভেতর হালকা শিহরনের মতো কী যেন খেলে যায়।
.
খাওয়াদাওয়া চুকিয়ে ফের নিউজ ডিপার্টমেন্টে। বিধানবাবু চলে যাবার পর সারা অফিস জুড়ে ছিল ঢিলেঢালা ভাব। সর্বত্র আড্ডার মেজাজ। কিন্তু কাল প্রথম কাগজ বাজারে বেরুবে। এখন চারদিকের চেহারা পালটে গেছে। কোথাও এতটুকু শৈথিল্য নেই। টান টান ব্যস্ততায় নিউজ ডিপার্টমেন্টে কাজ শুরু হয়ে গেছে।
বিনয় তার টেবলে বসে ছিল। তাকে যে অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হয়েছে তাতে চরকির মতো বাইরে বাইরে ঘুরতে হয়। কিন্তু শীতের এই পড়ন্ত বেলায় কোনও জবরদখল কলোনি বা ত্রাণশিবিরে যাবার প্রশ্নই নেই। কখন সেখানে পৌঁছবে আর কখনই বা বাড়ি ফিরবে? তাছাড়া, সাত-আটটা কলোনি আর রিলিফ ক্যাম্পের ওপর লেখা তৈরি করে প্রসাদের কাছে জমা দেওয়া আছে। পাকিস্তান থেকে আসার সময় যে-সব হাড় হিম-করা পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছিল কিংবা বিস্ময়কর যে মানুষগুলোর সঙ্গে দেখা হয়েছে, সেই সব বিবরণও কিছু কিছু লিখে দিয়েছে। শুধু তাই না, বম্বে এবং দিল্লির পুরানো কাগজ ঘাঁটাঘাঁটি করেও বেশ কটা লেখা লিখেছে।
বিনয় একবার ভাবল, লাইব্রেরিতে গিয়ে কলকাতার বাইরের কাগজগুলোর ফাইল নিয়ে বসে। কিন্তু কেমন যেন আলস্য লাগল। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর বেহালার একটা জবরদখল কলোনির নাম মনে পড়ে গেল মহাত্মা গান্ধী কলোনি। কদিন আগে সেখানে গিয়েছিল সে। বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে প্রচুর নোটও নিয়ে এসেছে। সেটা বরং লিখে ফেলা যায়।
টেবলের ড্রয়ার থেকে নিউজ প্রিন্টের প্যাড বার করে কলমের ক্যাপ খুলে ফেলল বিনয়।
তাড়াহুড়ো করে নয়, ধীরেসুস্থে সে যখন লেখাটা শেষ করল শীতের দিন ফুরিয়ে এসেছে। বাইরের রাস্তাটাস্তা এর মধ্যেই ঝাপসা হয়ে গেছে। কখন কুয়াশা পড়তে শুরু করেছিল, টের পাওয়া যায়নি।
নিউজ ডিপার্টমেন্টের সুবিশাল হল-ঘরটায় কিন্তু অজস্র আলো। চারদিকের জানালা-টানালা বন্ধ থাকায় কুয়াশা ঢুকতে পারেনি। তাই আলোর তেজটা এখানে অনেক বেশি।
বিনয় তার লেখাটা নিয়ে প্রসাদ লাহিড়ির টেবলে চলে এল। হাত বাড়িয়ে সেটা নিতে নিতে প্রসাদ জিজ্ঞেস করলেন, আজ কী নিয়ে লিখলে? কলোনি, না রিলিফ ক্যাম্প?
বিনয় বলল, বেহালার একটা জবরদখল কলোনি-
ঠিক আছে–লেখাটা টেবলের ড্রয়ারে রাখতে রাখতে প্রসাদ বলেন, সেই সকালে এসেছ। প্রচুর ধকল গেছে। লেখাও জমা দিলে। এখন বাড়ি যাও– এই হৃদয়বান মানুষটি প্রথম দিন থেকে অসীম মমতায় কাছে টেনে নিয়েছেন। নতুন চাকরি, কঠিন একটা অ্যাসাইনমেন্টও তাকে দেওয়া হয়েছে। যাতে শারীরিক ধকলে খুব কষ্ট না হয়, সেজন্য কাজ শেষ হলেই ছুটি দিয়ে দেন। বিনয় বলল, আপনারাও তো সেই সকালে এসেছেন। ফিরবেন মাঝরাত্তির পার করে আসলে কাল নতুন ভারত বাজারে বেরুবে। উত্তেজনায় সমস্ত অফিস ফুটছে। আরও কিছুক্ষণ বিনয়ের থাকার ইচ্ছা ছিল।
প্রসাদ বললেন, আরে বাবা, আমরা পুরোনো রিপোর্টাররা হলাম রাতজাগা প্রাণী। সন্ধেবেলায় মেসে ফিরলে বদহজম হবে। কিছুদিন যাক, হ্যাবিটটা পাকা হোক, তখন তুমিও আমাদের মতো হয়ে যাবে। এখন যাও
আর কিছু বলতে সাহস হল না। হঠাৎ সেই কথাটা মনে পড়ে গেল বিনয়ের। কদিন ধরেই বলব বলব করছিল। কিন্তু অধর ছুঁইমালীর কাছে ঝিনুকের খবর পেয়ে এমনই উতলা হয়ে চারদিকে ছোটাছুটি শুরু করে যে অন্য কিছুই খেয়াল ছিল না। সে বলল, প্রসাদদা, আমার একটা উপকার করতে হবে
প্রসাদ অবাক। জিজ্ঞেস করেন, কী উপকার?
আপনাদের মেসে আমার একটা সিটের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। আলাদা রুম হলে ভাল হয়। ছোট হলেও চলবে।
কিছুক্ষণ থ হয়ে থাকেন প্রসাদ। তারপর বলেন, তুমি তো তোমার দিদির কাছে থাকো!
হ্যাঁ।
কিছু মনে কোরো না। সেখানে কি কোনওরকম অসুবিধে হচ্ছে?
না না জোরে জোরে মাথা ঝাঁকায় বিনয়, একেবারেই না। দিদি, জামাইবাবু, জামাইবাবুর ঠাকুরদা, জেঠাইমা-সবাই আমাকে খুব পছন্দ করেন, ভীষণ ভালবাসেন। কী যত্ন যে করেন, ভাবা যায় না।
তা হলে?
দিদির শ্বশুরবাড়ি তো। সেখানে
ইঙ্গিতটা ধরে ফেলেন প্রসাদ, বুঝেছি। প্রশ্নটা আত্মসম্মানের–তাই না?
বিনয় বলে, বুঝতেই পারছেন, চিরকাল ওখানে থাকা ঠিক নয়।
একটু নীরবতা।
এবার প্রসাদ বলেন, ঠিক আছে, আমাদের মেসে অ্যারেঞ্জমেন্ট হয়ে যাবে। কবে আসতে চাও, দুদিন আগে আমাকে জানিয়ে দিও।
বিনয় চলে যাবার জন্য পা বাড়িয়েছে, প্রসাদ হঠাৎ বলে ওঠেন, অফিসে তোমার দিদির বাড়ির অ্যাড্রেস দেওয়া আছে?
চাকরির দরখাস্তে জাফর শা রোডের ঠিকানা লিখে দিয়েছিল আনন্দ। বিনয় বলল, আছে।
কাল থেকে রোজ সকালে অফিসের সাইকেল পিওন নতুন ভারত-এর কপি তোমাকে দেবে। কাল সকালে কাগজটা পেলেই খুলে দেখো, তোমার জন্যে একটা সারপ্রাইজ আছে।
বিস্ময়ের সুরে বিনয় জিজ্ঞেস করে, কী সারপ্রাইজ?
প্রসাদের মুখে রহস্যময় মৃদু হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে যায়, সেটা কালকেই দেখতে পাবে।
.
৫২.
কাল রাতে ভাল ঘুম হয়নি। মস্তিষ্কে চিন্তা অনবরত হুল ফোঁটালে কিংবা স্নায়ুতে উত্তেজনা থাকলে ঘুমোনো যায় না। খানিকটা সময় কেটেছে আধো তন্দ্রায়, বেশির ভাগটাই জেগে জেগে। এই শীতের রাতেও বার বার উঠে জল খেয়েছে বিনয়! কতবার যে বাথরুমে গেছে!
শান্তিনিবাস মেসে চলে যাবার সিদ্ধান্তটা অনেক আগেই নিয়েছিল সে। তার ব্যবস্থাও কাল হয়ে গেছে। প্রসাদ কথা দিয়েছেন, একটা আলাদা রুম তাকে জোগাড় করে দেবেন। সে যে সুধাদের কাছে থাকবে না সেটা এখনও ওদের জানানো হয়নি। খান মঞ্জিল-এ পুরোদমে কাজ চলছে। সারাই টারাই প্রায় শেষ। রংটং বাকি। সেটা হয়ে গেলে শুভদিন দেখে গৃহপ্রবেশ করা হবে। ওই বাড়ির দক্ষিণ-পূর্ব ভোলা একটা বড় ঘর তার জন্য ঠিক করে রেখেছে সুধারা। ওরা সেটা মনের মতো করে সাজিয়ে গুছিয়ে দেবে।
মেসের ব্যাপারটা আর ফেলে রাখা ঠিক হবে না। দুএক দিনের ভেতর এই নিয়ে সুধাদের সঙ্গে কথা বলবে বিনয়। সে জানে হিরণরা ভীষণ কষ্ট পাবে, কিছুতেই তাকে ছাড়তে চাইবে না। সুধা তো কেঁদেকেটে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ভাসিয়ে দেবে। তবু না জানালেই নয়। কাল রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে যতবার কথাগুলো ভেবেছে, নিজেরই ভীষণ খারাপ লেগেছে। নিদারুণ অস্বস্তি তাকে তোলপাড় করে দিচ্ছিল।
এ তো গেল একটা দিক। আর-এক দিকে রয়েছে সেই সারপ্রাইজের ব্যাপারটা। কাল সকালে প্রথম দিনের নতুন ভারত-এ তার জন্য কী ধরনের চমক অপেক্ষা করে আছে? প্রসাদ লাহিড়ির কথার তলকূল খুঁজে পাচ্ছিল না সে।
.
শীতের সকাল হয় ধীর চালে। অন্ধকার আর কুয়াশা কেটে দিনের আলো ফুটতে ফুটতে বেশ সময় লাগে।
ভোর হতে না হতেই আষ্টেপৃষ্ঠে চাদর জড়িয়ে, মাথা ঢেকে পশ্চিম দিকের ঝুল-বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল বিনয়। এখনও বাড়ির কেউ ওঠেনি।
অন্ধকার অবশ্য নেই। কুয়াশা আছে, তবে তেমন ঘন নয়। দূরে বড় রাস্তায় অল্প কিছু লোকজন আর গাড়িটাড়ি দেখা যাচ্ছে। দু-চারটে চায়ের আর খাবারের দোকান এর মধ্যেই খুলে গেছে। বাকি দোকানপাট খুলবে বেলা বাড়লে, শীতঋতুর রোদ উঠার পর যখন তপ্ত হতে শুরু করবে সেই সময়।
সুধারা দুখানা কাগজ রাখে। একটা ইংরেজি, একটা বাংলা। দ্য স্টেটসম্যান এবং যুগান্তর। ওদের কাগজওলা কারওকে না জানিয়ে বারোমাস কাগজ দুটো এই ঝুল-বারান্দায় ছুঁড়ে দিয়ে চলে যায়।
কোনও দিনই এত ভোরে বিনয় বা বাড়ির অন্য কেউ এখানে এসে দাঁড়ায় না। বিশেষ করে এই শীতকালে। এই সময়টা তারা থাকে লেপের ভেতর, দুই হাঁটু বুকে গুঁজে গুটিসুটি মেরে।
আজ যুগান্তর বা স্টেটসম্যান-এর জন্য আসেনি বিনয়। কখন নতুন ভারত আসবে সেই আশায় অপেক্ষা করে আছে সে। রুদ্ধশ্বাসে।
বেশিক্ষণ দাঁড়াতে হল না। পাতলা কুয়াশা ভেদ করে সুধাদের কাগজওলা সাইকেলে চেপে চলে এল। বাহনটি পুরোপুরি থামাল না, গতি কমিয়ে ওপর দিকে তাকালো। বিনয়কে দেখে একটু অবাক হল, এ-সময় কেউ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, হয়তো ভাবতে পারেনি। কোনও প্রশ্ন না করে সিটে বসেই অভ্যস্ত হতে পাটের সুতোয় বাঁধা দুটো কাগজ পটাপট ঝুল-বারান্দায় ছুঁড়ে দিয়ে সাইকেলের স্পিড বাড়িয়ে ডান পাশের বাড়িঘরের আড়ালে অদৃশ্য হল।
কাগজ দুটো পড়েই আছে। বাঁধন খুলে দেখার মতো গরজ এই মুহূর্তে নেই বিনয়ের। পরে দেখে নিলেই চলবে, ভাবখানা এইরকম। সে দূরের রাস্তায় চোখ রেখে তাকিয়েই থাকে।
মিনিট পনেরো কুড়ি বাদে আর-একটি কাগজওলা এসে হাজির। তার সাইকেলের সামনের হ্যাঁণ্ডেলে লাগানো সাদা রং-করা টিনের ফলকে লাল হরফে লেখা : নতুন ভারত।
কাল রাত থেকেই উত্তেজনার মধ্যে ছিল বিনয়। সেটা এখন শতগুণ হয়ে সমস্ত স্নায়ুমণ্ডলীতে চারিয়ে গেছে।
সাইকেল পিওনটা অবাঙালি। খুব সম্ভব বিহারি কিংবা ইউ পির লোক। মাঝবয়সী। এধারে ওধারে তাকাচ্ছিল। বিনয়ের তর সইছিল না। সে ঝুল-বারান্দার রেলিংয়ের ওপর দিয়ে ঝুঁকে কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, আপনি কি বিনয় কুমার বসুকে খুঁজছেন?
পিওনটা ওপর দিকে তাকিয়ে বলল, হাঁ, বাবুজি
আমিই বিনয় বসু।
নমস্তে-পিওনের মুখে মুশকিল আসান হাসি। খুব সম্ভব তাকে বেশি খোঁজাখুঁজি করতে হয়নি। যার জন্য আসা তাকে তাড়াতাড়িই পেয়ে গেছে। হিন্দি-বাংলা মিশিয়ে সে বলল, আপকা পেপার লিয়ে এসেছি। এই লিন বলে সুতো-বাঁধা কাগজ ছুঁড়ে দিল।
কলকাতার কাগজওলাদের টিপ অব্যর্থ। বিনয় আগেও লক্ষ করেছে, সাইকেল চালাতে চালাতেই একান্ত অবলীলায় তারা দোতলা, তেতলা, এমনকি চারতলা পাঁচতলাতেও কাগজ ছুঁড়তে ছুঁড়তে চলে যায়। কারও নিশানাই ফসকায় না। অবশ্য এসব নিয়ে এই মুহূর্তে কিছুই ভাবছিল না সে। নিচু হয়ে ঝুল-বারান্দার মেঝে থেকে নতুন ভারত-এর কপিটা তুলে নিল।
রাস্তা থেকে সাইকেল পিওনের গলা ভেসে আসে, অব চলতা হ্যায় বাবুজি। ফির কাল আসবে। নমস্তে সে চলে যায়।
পিওনটার কথা বুঝি বা শুনতেই পেল না বিনয়। সুতোর গিট খুলে কাগজটা বার করে ফেলে সে। নামকরা একজন আর্টিস্টকে দিয়ে কাগজের নামটা লিখিয়ে নিয়েছিলেন জগদীশ গুহঠাকুরতা। চোখে লেগে থাকার মতো ক্যালিগ্রাফি। সেটাই প্রথম পাতার মাথায় দেখা যাচ্ছে। আর সব ছাপাও চমৎকার। প্রথমত সাদা নিউজপ্রিন্ট, তাছাড়া নতুন লাইনো টাইপ, মেক-আপে যত্নের ছাপ। সব মিলিয়ে ঝকঝক করছে।
বিনয়ের চোখ পাতাটার ওপর ছোটাছুটি করছিল। ওপরের দিকে প্রথমেই কালকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের চার কলম জোড়া প্রতিবেদন। সেখানে বিধানচন্দ্র রায়ের বড় ছবি। তিনি ভাষণ দিচ্ছেন। এ-ছাড়া দেশি-বিদেশি নানা খবরের ছড়াছড়ি। কাশ্মিরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হামলা অব্যাহত। কয়েকটি দেশীয় রাজ্যের ভারতভূক্তিতে চাপা অসন্তোষ। রুশ-মার্কিন ঠাণ্ডা লড়াই, ইত্যাদি।
কিন্তু এইসব খবর তো আজকের অন্য কাগজগুলোতেও থাকবে। তাহলে প্রসাদের সারপ্রাইজটা কোথায়? অবশ্য নতুন ভারত আট পাতার কাগজ। চমকটা অন্য পৃষ্ঠাতেও থাকতে পারে।
বিনয় পাতা ওলটাতে যাবে, আচমকা নিচের দিকে নজর আটকে গেল। তিন কলম জুড়ে ইঞ্চি খানেক চওড়া রিভার্সে একটা লেখা সেখানে ছাপা হয়েছে। প্রথমে কালোর ওপর সাদা হরফে শিরোনাম : শরণার্থীদের ত্রাণশিবিরে এবং জবরদখল কলোনিতে। শিরোনামের তলায় চোদ্দ পয়েন্ট টাইপে লেখকের নাম : বিনয় কুমার বসু। তার নিচে ইটালিক হরফে কয়েক লাইনের ছোট্ট সম্পাদকীয় ভূমিকা।
[দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান হইতে প্রতিদিন শত শত শরণার্থী পশ্চিমবঙ্গে চলিয়া আসিতেছে। কবে ওই জনপ্রবাহ বন্ধ হইবে, কে জানে। ইতিমধ্যে উদ্বাস্তুদের সংখ্যা আনুমানিক বিশ লক্ষ ছাড়াইয়া গিয়াছে। সরকারি ত্রাণশিবিরে ইহাদের নগণ্য একটি অংশকে আশ্রয় দেওয়া সম্ভব হইয়াছে। বেশির ভাগই পড়িয়া আছে শিয়ালদা এবং অন্যান্য স্টেশনের প্লাটফর্মে কিংবা মহানগরীর ফুটপাথে, মুক্ত আকাশের নিচে। বাকি একটা অংশ সরকারি ত্রাণ ব্যবস্থার ওপর ভরসা না রাখিয়া নিতান্ত মরিয়া হইয়াই ফাঁকা পতিত বা জলা জায়গা কিংবা ঝোপজঙ্গল দখল করিয়া কলোনি বসাইয়া বাঁচিবার চেষ্টা করিতেছে। আমাদের প্রতিবেদক কলোনি এবং ত্রাণশিবিরগুলিতে ঘুরিয়া ঘুরিয়া ছিন্নমূল মানুষদের অবর্ণনীয় দুর্দশার তথ্য সংগ্রহ করিতেছেন। উপরের শিরোনামে প্রতিদিন একটি করিয়া শিবির বা কলোনির প্রতিবেদন প্রকাশ করা হইবে। আজকের বিষয় : গড়িয়ার নিকটস্থ সোনার বাংলা উদ্বাস্তু পল্লি। সম্পাদক : নতুন ভারত।]
বিনয় লক্ষ করল, ভূমিকার পর থেকেই তার লেখাটা শুরু হয়েছে। একটানা, ঠাসা লেখা। চোখের পক্ষে আরামদায়ক নয়। তাই সেটার মাঝখানে আটিস্টকে দিয়ে উদ্বাস্তুদের ধ্বস্ত, ভাঙাচোরা চেহারার স্কেচ আঁকিয়ে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে।
প্রথম পাতায় পুরো লেখাটা ধরানো যায়নি। শেষাংশ নিয়ে যাওয়া হয়েছে ছয়ের পাতায়। ঝড়ের গতিতে পাতা উলটে উলটে সেখানে পৌঁছে গেল বিনয়। আরও একটা সারপ্রাইজ তার জন্য অপেক্ষা করছিল। আগের লেখার শেষটুকু তো আছেই, তার অন্য একটা ফিচারও এখানে ছাপা হয়েছে। রিভার্সে শিরোনাম : দেশ ভাগ : নানা ঘটনা, নানা মানুষ। তবে এই লেখাটায় তার একটা ছদ্মনাম দেওয়া হয়েছে-দর্শক। এটার সঙ্গেও সংক্ষিপ্ত ভূমিকা রয়েছে। সেই ছেচল্লিশের দাঙ্গার সময় থেকে যে গণহত্যা, ধর্ষণ, আগুন লাগিয়ে গাঁয়ের পর গাঁ, শহরে মহল্লার পর মহল্লা ছারখার করা শুরু হয়েছিল, তার জের চলছেই। মাসের পর মাস কেটে যায়। হননক্রিয়া থামে না। ধর্ষণ থামে না। আগুন লাগানো বন্ধ হয় না। বিষবাষ্পে ভরে গেছে দশ দিগন্ত। এরই মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কোনও কোনও মানুষ প্রতিবেশীদের পাশে দাঁড়িয়েছে। দেশভাগ : নানা ঘটনা, নানা মানুষ-এ এইসব বিস্ময়কর মানুষ বা ঘটনার বর্ণনা থাকবে। সমস্ত উপমহাদেশ জুড়ে যে ঘোর অন্ধকার নেমে এসেছে, এগুলো তার মধ্যে টুকরো টুকরো আলোর বিন্দু। সম্পাদক জানিয়ে দিয়েছেন, এই ফিচারটা সপ্তাহে দুদিন বেরুবে। রবিবার আর বৃহস্পতিবার।
বিনয়ের আজকের লেখাটার বিষয়: মামুদপুর গ্রামের আফজল হোসেন। লোকটা নিজের প্রাণ তুচ্ছ করে এক কুয়াশাবিলীন রাত্তিরে রাজাকার আর মুসলিম লিগের ঘাতকবাহিনীর হাত থেকে তাকে আর ঝিনুককে আগলে আগলে নদী পার করে তারপাশা স্টিমারঘাটায় পৌঁছে দিয়েছিল।
চকিতে স্মৃতির গোপন কুঠুরি থেকে বেরিয়ে চোখের সামনে এসে দাঁড়ায় আফজল হোসেন। মধ্যবয়সী মানুষটি ধীর, স্থির, বিচক্ষণ। চরম বিপদের মুখেও বিচলিত হয় না। একদিন সকাল থেকে পরের দিন সকাল অবধি, মাত্র চব্বিশটা ঘন্টা তারা একসঙ্গে কাটিয়েছে। এইটুকু সময়ের প্রতিটি মুহূর্তে বিনয় অনুভব করেছে, মানুষটার বুকের ভেতরটা অপার মায়ায়, অফুরান করুণায় পরিপূর্ণ। সে নতুন করে তাদের জীবনদান করেছে। তাকে পাশে পাওয়া না গেলে কোনওভাবেই ইণ্ডিয়ায় আসা সম্ভব হতো না। হননকারীর দল তাদের শেষ করে দিত।
আফজল হোসেন বার বার বলে দিয়েছিল, কলকাতায় এসেই যেন বিনয় তাকে চিঠি লিখে পৌঁছনোর-সংবাদটা জানিয়ে দেয়। কিন্তু সে এমনই অকৃতজ্ঞ আর অমানুষ যে চিঠি লেখা হয়নি। নিজেকে হাজার বার ধিক্কার দেয় সে, নিজের গালে ঠাস ঠাস চড় কষাতে ইচ্ছা করে। মনে মনে বিনয় ভেবে নিল, নিত্য দাস তো প্রায়ই সুধাদের বাড়িতে আসে। সে চিঠিটা লিখে রাখবে। নিত্য এলেই তার হাতে সেটা দিয়ে অনুরোধ করবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যেন আফজলের কাছে পৌঁছে দেয়। ঠিকানাটাও পরিষ্কার মনে আছে। গ্রাম : মামুদপুর, বিক্রমপুর, জিলা ঢাকা, পূর্ব পাকিস্তান।
আফজল হোসেন যেমন চকিতে দেখা দিয়েছিল, চোখের সামনে থেকে তেমনি লহমায় মিলিয়ে গেল।
একবার, দুবার, তিনবার-বার বার নিজের লেখা দুটো পড়ল বিনয়। ছাপার অক্ষরে একি তারই লেখা? বিনয় কুমার বসু আর দর্শক, এই নাম দুটো কি তারই? না কি অন্য কেউ? সব যেন অবিশ্বাস্য, অলীক স্বপ্নের মতো।
প্রসাদ তাকে দিয়ে বেশ কটা প্রতিবেদন লিখিয়ে নিয়েছিলেন। কবে সেগুলো ছাপা হবে তার বিন্দুমাত্র আভাস দেননি।
বিনয় কল্পনাও করেনি, নতুন ভারত-এর প্রথম দিনের এডিশনে তার দুদুটো লেখা বেরিয়ে যাবে। সারপ্রাইজ, সত্যিই সারপ্রাইজ।
এমন একটা পরমাশ্চর্য দিন কি তার জীবনে কখনও এসেছিল? কলকাতায় আসার পর তো নয়ই। রাজদিয়ায় এলেও আসতে পারে। মনে পড়ল না।
হঠাৎ বিনয়ের মনে হল, তার দুই কাঁধে কেউ যেন দুটো ডানা জুড়ে দিয়েছে আর পৃথিবী থেকে, অনেক উঁচুতে কোনও অলৌকিক বায়ুস্তরে সে ভেসে বেড়াচ্ছে।
একসময় খেয়াল হল, কুয়াশা পুরোপুরি কেটে গেছে। শীতের ঠাণ্ডা, নিস্তেজ রোদ ঝরে পড়ছে মহানগরীর ওপর। কিচেনের দিক থেকে ঠুং ঠাং আওয়াজ আসছে। হিরণ, সুধা আর দ্বারিক দত্তর গলা শোনা যাচ্ছে। নতুন ভারত এবং নিজের দুটো লেখা নিয়ে বিনয় এমনই মগ্ন ছিল, কখন সবার ঘুম ভেঙেছে, টের পায়নি। গলার স্বর অনেক উঁচুতে তুলে প্রায় চিৎকার করতে করতে ভেতর দিকে ছুটল সে, ছোটদি, হিরণদা, দ্বারিক দাদু।
রোজই সকালে বাইরের ঘরে প্রভাতী চায়ের আসর বসে। সোজা সেখানে চলে এল বিনয়।
সুধা জিজ্ঞেস করল, কি রে, চেঁচাচ্ছিস কেন?
বিনয় বলে, এই দ্যাখ, আমাদের কাগজ বেরিয়ে গেছে। অফিসের পিওন কিছুক্ষণ আগে দিয়ে গেল।
নতুন ভারত যে আজই বাজারে ছাড়া হবে, এ-বাড়ির সবাই তা জানে। সুধারা অনন্ত আগ্রহে ঝাঁপিয়ে পড়ন, দেখি, দেখি
সুধা কাগজটা ছোঁওয়ার আগেই ছোঁ মেরে সেটা টেনে নিল হিরণ। সুধা আর দ্বারিক দত্ত তার দুপাশ থেকে ঝুঁকে দেখতে লাগলেন। তিনজনই টুকরো টুকরো মন্তব্য করতে থাকে।
ছাপা টাপা ভারী সুন্দর
বেশ দেখনদার কাগজ হয়েছে।
বেশির ভাগ পত্রিকায় বিড়া ধাবড়া সব ছবি বেরোয়। কে জওহরলাল, কে সুচেতা কৃপালনী, কে শ্যামাপ্রসাদ আর কে শেখ আবদুল্লা, বুঝবার জো নেই। সব কালিতে ল্যাবড়ানো। নতুন ভারত-এ সবাইকে আলাদা আলাদা চেনা যাচ্ছে।
কাগজের চেহারা দেখে সকলেরই পছন্দ হয়েছে। বিনয় একধারে দাঁড়িয়ে ছিল। লাজুক মুখে বলল, আজ আমার দুটো লেখা বেরিয়েছে–
সুধা প্রায় লাফিয়ে ওঠে, কোথায় রে, কোথায়?
হিরণ প্রচণ্ড উৎসাহে বলে, আগে বলবে তো
বিনয় লেখা দুটো দেখিয়ে দেয়। কে প্রথমে পড়বে, তাই নিয়ে সুধা আর হিরণের মধ্যে কাড়াকাড়ি শুরু হয়ে যায়। দ্বারিক দত্তর চিরকালই নাত-বউয়ের প্রতি পক্ষপাত। বললেন, সুধা জোরে জোরে পড়ুক। আমরা শুনি।
পড়া শেষ হলে শতমুখে প্রশংসা করলেন দ্বারিক দত্ত, এমন লেখাই এখন চাই। ইস্ট বেঙ্গলের রিফিউজিরা কী দুর্দশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে, দেশের লোকের চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো দরকার। বিনু, এইরকম লিখতে পারলে তুই খুব নাম করবি।
হিরণও দ্বারিক দত্তর সঙ্গে একমত। সুধা রীতিমতো উচ্ছ্বসিত।
খুব ভাল লাগছিল বিনয়ের। অন্যের মুখে সুখ্যাতি শুনলে কে না খুশি হয়। কিন্তু হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল, আজ সকালে সোদপুরে একটা নতুন জবরদখল কলোনিতে যাবার কথা। সে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এখনও তার মুখ ধোওয়া হয়নি, চান করা হয়নি। সুধাকে বলে, ছোটদি, আমি বাথরুমে যাচ্ছি। আটটায় বেরুব।
আজকাল সকাল হলেই চানটান সেরে বেরিয়ে পড়ে বিনয়। কলকাতার আশেপাশের কোও উদ্বাস্তু কলোনি বা ত্রাণশিবিরে চলে যায়। এক-এক দিন এক-এক জায়গায়। দুপুরে বাড়ি আসে না। ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে নটা দশটা। এত খাটুনি। দুপুরে হোটেলে কী ছাতমাথা খায়, সে-ই জানে। তাই ভোর ভোর উঠে উমাকে দিয়ে, কখনও বা নিজের হাতে ভাইয়ের জন্য প্রচুর জলখাবার তৈরি করে সুধা। ঠিকমতো না খেলে খাটবে কী করে? দুদিনেই স্বাস্থ্য ভেঙে পড়বে।
সুধা বলল, উমা লুচি ভাজছে। তুই চান করে নে।
বিনয় আর দাঁড়াল না। চানঘরের দিকে চলে গেল। চান সেরে নিজের শোবার ঘরে গিয়ে কাঠের আলমারি থেকে ইস্তিরি-করা জামাকাপড় বার করতে করতে একটা লম্বা ব্রাউন রঙের খামের ওপর নজর পড়ল তার।
ভবানীপুরের বাড়ি বিক্রি করে অবনীমোহনের ঋণশোধ হয়েও যা বেঁচেছিল তার একটা অংশ পেয়েছিল বিনয়। সে ঠিকই করে রেখেছে টাকাটা রামরতনের স্ত্রীকে ও তার মেয়েদের দিয়ে আসবে। একবারে নয়, ভাগে ভাগে। সেই মতো দিনকয়েক আগে হিরণকে দিয়ে ব্যাঙ্ক থেকে তিন হাজার তুলিয়ে নিয়েছিল। ব্রাউন খামে সেই টাকাটা আছে।
টাকাটা তোলার সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে আসা উচিত ছিল। কিন্তু উদ্বাস্তুদের ত্রাণশিবির আর জবরদখল কলোনিতে ছোটাছুটি, ঝিনুকের খোঁজ, নতুন ভারত প্রকাশের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, বিধানচন্দ্র রায়-সব মিলিয়ে এমন তুমুল ব্যস্ততার মধ্যে সকাল থেকে মাঝরাত অবধি কেটে গেছে যে এতটুকু সময় বার করা যায়নি। অথচ চারটি রমণী তার ওপর ভরসা করে আছে। টাকাটা না দিয়ে আসায় মারাত্মক অন্যায় হয়ে গেছে। প্রচণ্ড অপরাধবোধে নিজের কাছেই নিজে ছোট হয়ে যায় বিনয়। সে মনস্থির করে ফেলে, আজ আর সোদপুরের কলোনিতে যাবে না। সোজা শ্যামবাজারে গিয়ে রামরতনের স্ত্রীর হাতে টাকাটা দিয়ে আসবে।
বিনয়ের জীবনে আজকের দিনটা এক অলৌকিক উপহারের মতো। নতুন ভারত বাজারে বেরিয়েছে। সে তো জানাই ছিল। কিন্তু তার দুদুটো লেখা প্রথম দিনই ছাপা হয়েছে। এটা ভাবা যায়নি। কোনও আশ্চর্য জাদুকাঠির ছোঁয়ায় পৃথিবীর চেহারাটাই যেন বদলে গেছে।
ভালই হল, রামরতনের স্ত্রী এবং মেয়েদের সঙ্গে দেখা করার জন্য আজকের দিনটা বেছে নিয়েছে সে। টাকাটা হাতে পেলে ওদের চোখেমুখে কী ফুটে উঠবে? স্বস্তি, কৃতজ্ঞতা, না অন্য কিছু? যা-ই ফুটুক, চারটি রমণীকে দুঃসহ গ্লানি থেকে মুক্ত করতে পারলে ছাপার অক্ষরে নিজের লেখা দেখার চেয়ে আনন্দ কি এক তিলও কম হবে?
.
জলখাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়েছিল বিনয়। বেলা আর-একটু বেড়েছে, বোদ আর-একটু তপ্ত হয়েছে। কিন্তু এখনও ট্রাম বাসে অফিস টাইমের ভিড় শুরু হয়নি। কটা আর বাজে? বড় জোর সাড়ে আটটা।
ট্রামে জানালার ধারে বসে রামরতনের স্ত্রী আর মেয়েদের কথা ভাবছিল বিনয়। টাকা দিলেই চলবে না, ওদের জন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভদ্রপাড়ায় একটা বাসাও ঠিক করে দিতে হবে। অবশ্য মুকুন্দপুর কলোনিতে খানিকটা জমির ব্যবস্থা করে রেখেছে সে। যুগলদের ওখানে গেলে নিরাপদে থাকতে পারবে ওরা। এখন দেখা যাক, কোথায় থাকতে চায়-কলকাতাতেই, না মুকুন্দপুরে?
ধর্মতলায় ট্রাম পালটে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে মদন বড়াল লেনে বিমল গাঙ্গুলিদের ভাড়াটে বাড়ির সামনে চলে এল বিনয়। এক হিসেবে ভালই হয়েছে। এই সময়টা বিমল নিশ্চয়ই বাড়িতে নেই, অফিসে চলে গেছে। তার স্ত্রী দীপ্তি ধনুর্ভাঙা পণ করেছে, যতদিন রামরতনের স্ত্রী এবং মেয়েরা এ-বাসায় থাকবে, সে বাপের বাড়ি থেকে ফিরবে না। বিমল বা দীপ্তি বাড়িতে থাকলে তাদের সামনে রামরতনের স্ত্রীকে টাকাটা দিতে অসুবিধা হতো। তারা খুশি হয়ে এটা মেনে নিত না।
সদর দরজাটা হাট করে খোলা। ভিতরের মস্ত চাতালে গঙ্গাজল আর খাবার জলের কলের সামনে গিন্নিবান্নি জাতীয় মেয়েমানুষের ভিড়।
বিমল বাড়িতে নেই আন্দাজ করেও তাকেই ডাকতে লাগল বিনয়, বিমলবাবু, বিমলবাবু
কিন্তু বিনয়ের অঙ্কে গোলমাল হয়ে গেল। ছায়া মায়া বা বাসন্তী নয়, বিমল নিজেই সদর দরজায় এসে দাঁড়াল। তার দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠে বিনয়। শুকনো, শীর্ণ মুখ, চোখের কোলে কালি, গালে খাড়া খাড়া দাড়ি, উষ্কখুষ্ক চুল, চোখ দুটো রক্তের ডেলা। বোঝা যায়, সারারাত ঘুমোয়নি। রুদ্ধস্বরে বিনয় জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে?
ভাঙা গলায় বিমল বলল, সর্বনাশ হয়ে গেছে বিনয়বাবু।
এই কদিনে কী এমন অঘটন ঘটতে পারে, ভেবে পেল না বিনয়। বিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে থাকে সে। বিমল রাস্তায় বেরিয়ে আসে। বলে, চলুন, কোথাও গিয়ে বসি। তারপর সব শুনবেন।
এর আগে মাত্র দুবার বিমলকে দেখেছে বিনয়। একবার শিয়ালদা স্টেশনে, যখন সীমান্তের ওপার থেকে রামরতন গাঙ্গুলির মৃতদেহ এবং তাঁর অসহায় পরিবারটিকে নিয়ে এসেছিল। পরের বার দেখা এই ভাড়া বাড়িতে। পরিচয় খুবই সামান্য। তবু অনাত্মীয়, প্রায়-অচেনা বিনয়কে পারিবারিক বন্ধুই ভাবে বিমল।
বিনয় জানে, অভাব অশান্তি চারদিক থেকে ঠেসে ধরেছে বিমলকে। তবু সেদিন সে মদন বড়াল লেনে আসায় খুশি হয়েছিল বিমল। কথায় বার্তায় যথেষ্ট বিনয়ী। অমায়িক ব্যবহার। কিন্তু সেই বিমল আজ তাকে বাড়িতে ঢুকতে দিল না। বিনয় যতটা অপমানিত বোধ করল, অবাক হল তার শতগুণ। বিমলকে সে যতটুকু দেখেছে বা বুঝেছে তাতে এই ধরনের আচরণ খুবই অস্বাভাবিক। বিমলের ভাঙাচোরা, বিধ্বস্ত চেহারা দেখে শুধু এটাই মনে হচ্ছে, তার ওপর দিয়ে তুমুল ঝড় বয়ে গেছে। নিজের অজান্তেই তীব্র উৎকণ্ঠায় বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে উঠতে থাকে বিনয়ের।
মদন বড়াল লেনের ভিড়, কলরোল, রিকশা, ঠেলা, সাইকেল, সেকেলে দুচারটে মোটর, এ-সবের ভেতর দিয়ে ভেতর দিয়ে বিনয়কে নিয়ে একসময় বিমল ট্রাম রাস্তায় চলে এল। তারপর রাস্তা পেরিয়ে ওধারে গলিতে ঢুকে একটা মাঝারি পার্কে।
এই বেলা দশটায় পার্কটা মোটামুটি নির্জন। ভ্রমণকারীরা আসে সকালে আর বিকেলে। কটা অথর্ব বুড়ো, জীবন থেকে যারা প্রায় বাতিল, একধারে বসে রোদ থেকে শরীরে তাপ শুষে নিচ্ছে। এক পাল বেওয়ারিশ কুকুর কুণ্ডলী পাকিয়ে পড়ে আছে আর-এক কোণে। তিন চারটে কাক ওদের ঘিরে ডিঙি মেরে মেরে টহল দিয়ে চলেছে। বিমলরা একটা ফাঁকা বেঞ্চে গিয়ে বসল। এতটা পথ পাশাপাশি হেঁটে এসেছে, কিন্তু কেউ একটি কথাও বলেনি। বিনয় তার সঙ্গীকে লক্ষ করছিল। ভেতর থেকে সব ভেঙেচুরে, তছনছ করে কিছু একটা ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে আর ঠোঁট শক্ত করে টিপে রেখে সেটা ঠেকাতে চাইছে বিমল। গলার কাছের শিরাগুলো দড়ির মতো পাকিয়ে উঠেছে। চোখ যেন ফেটে পড়বে।
হতবুদ্ধি বিনয় তাকিয়েই থাকে।
শেষ অবধি আর যুঝতে পারল না বিমল। আচমকা শব্দ করে কেঁদে ওঠে সে। শেল বিধলে যেমন হয়, তেমনি অসহ্য কষ্টে, তীব্র যন্ত্রণায় তার মুখ দুমড়ে মুচড়ে বেঁকেচুরে যেতে লাগল। রক্তবর্ণ চোখ থেকে জল ঝরে পড়ছে অঝোরে।
বিহ্বল ভাবটা খানিক কাটিয়ে নিয়ে বিমলের কাঁধে একটা হাত রাখে বিনয়। আর্দ্র, নরম গলায় বলে, কাঁদবেন না বিমলবাবু, কাঁদবেন না। শান্ত হোন
কান্না থামে না। জোরে জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে অবুঝ বালকের মতো কেঁদেই চলে বিমল, কেঁদেই চলে। সে যে কী নিদারুণ আকুলতা। বিকৃত, জড়ানো গলায় বলতে থাকে, জেঠিমারা নেই।
ব্যাপারটা প্রথমে মাথায় ঢোকে না বিনয়ের। জটিল ধাঁধার মতো দুর্বোধ্য ঠেকে। ঝুঁকে জিজ্ঞেস করে, কী বলছেন?
কাল জেঠিমা বাসন্তীদিদি ছায়া মায়া, সবাই আমাদের বাসা থেকে চলে গেছে
অদ্ভুত একটা কাঁপুনি বিনয়ের মাথা থেকে পা পর্যন্ত আমূল ঝাঁকিয়ে দিয়ে যায়। হৃৎপিণ্ডের উত্থান পতন থমকে গেছে। ব্যাকুলভাবে সে জিজ্ঞেস করে, কোথায় গেছে?
জানি না, জানি না, জানি না বিমলের কান্না আরও উতরোল হয়ে ওঠে।
হঠাৎ চলে গেল কেন? কী হয়েছিল?
বিমল উত্তর দিল না। কাঁদছে ঠিকই, তবে এখন আর শব্দটা নেই। মুহ্যমানের মত সে বসে থাকে।
মনের এই অবস্থায়, যখন বিমল পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে, তাড়া দেওয়া ঠিক হবে না। পার্কে যখন টেনে নিয়ে এসেছে একসময় না একসময় সে বলবেই। বিনয় অপেক্ষা করতে থাকে।
অনেকক্ষণ পর কোঁচার খুঁট দিয়ে চোখের জল মুছে ধরা ধরা গলায় বিমল বলল, আমাদের ফ্যামিলি সম্বন্ধে আপনি কি কিছু শুনেছেন?
বিমল ঠিক কী বলতে চাইছে, ধরতে না পেরে বিনয় জিজ্ঞেস করে, কী শুনব?
বলতে মাথা কাটা যাচ্ছে, কিন্তু আপনাকে আমাদের আত্মীয়ের মতো মনে করি। জেঠামশাইয়ের ডেড বডি যেভাবে নিয়ে এসেছিলেন, জীবনে ভুলব না। তাই
বিমলকে থামিয়ে দিয়ে বিনয় বলে, ও-সব থাক। আপনার জেঠিমাদের কথা বলুন
বিমল বলল, জেঠিমারা আমাদের কাছে থাকুন, আমার স্ত্রী দীপ্তি একেবারেই চায় না। এই নিয়ে রোজ অশান্তি আর ঝগড়া। জেঠিমা কি এ-কথা আপনাকে জানিয়েছেন?
বিনয় ভীষণ বিব্রত বোধ করে। সেদিন যখন সে মদন বড়াল লেনে আসে, বিমল বাসায় ছিল না। রেশন তুলতে বাজার করতে বেরিয়ে গিয়েছিল। স্ত্রী দীপ্তি ছেলেমেয়ে নিয়ে তার আগে থেকেই বাপের বাড়িতে। সেই সুযোগটা কাজে লাগিয়েছিলেন রামরতনের স্ত্রী। কী অশেষ লাঞ্ছনা আর গ্লানির মধ্যে তাদের দিন কাটছে, সব বিশদভাবে বলেছিলেন বিনয়কে।
অন্য সময় হলে স্বীকার করত না বিনয়। যদিও অস্বস্তি হচ্ছিল, তবু মুখ নিচু করে বলল, হ্যাঁ, জানিয়েছেন।
বিমর্ষ সুরে বিমল বলল, আপনি নিশ্চয়ই শুনেছেন, আমার স্ত্রী ঝগড়া করে ওর বাপের বাড়ি গিয়েছিল। শাসিয়েছিল, যতদিন জেঠিমারা এ-বাসায় থাকবে, সে ফিরবে না। কিন্তু হঠাৎ কাল এসে হাজির। আমি তখন অফিসে। ছুটির পর ফিরে অন্য ভাড়াটেদের মুখে শুনলাম, দীপ্তি, নোংরা ভাষায় এমন অপমান করেছিল যে জেঠিমা মেয়েদের নিয়ে তক্ষুনি বেরিয়ে গেছেন।
বিনয়ের দমবন্ধ হয়ে আসছিল। ঢাকা জেলার এক নগণ্য গ্রাম জামতলির বাইরে কখনও কোথাও যাননি রামরতনের স্ত্রী এবং তার মেয়েরা। গেলেও আশেপাশের কোনও গাঁয়ে, কিংবা চল্লিশ পঞ্চাশ মাইলের ভেতর কোনও কুটুমবাড়িতে। দেশভাগ না হলে সীমান্তের এপারে তাদের কোনও দিনই আসা হতো না। এই বিপুল, অচেনা মহানগরে এক অসহায় বৃদ্ধা তার পূর্ণ যুবতী দুই মেয়ে এবং আধবয়সী এক বিধবা মেয়েকে নিয়ে কোথায় যেতে পারেন? রুদ্ধশ্বাসে বিনয় জিজ্ঞেস করে, ওঁদের খোঁজ করেছিলেন?
বিমল জানায়, তাদের বাড়ির অন্য ভাড়াটেদের নিয়ে উত্তর কলকাতার বড় রাস্তা, অগুনতি অলিগলি, পার্ক–নানা জায়গায় সারারাত খুঁজে বেড়িয়েছে। অনন্ত হতাশায় মাথা ঝাঁকাতে আঁকাতে ফের ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে, কোথাও পাওয়া গেল না। কী যে করব, ভেবে পাচ্ছি না।
কলকাতায় আপনাদের কোনও আত্মীয়স্বজন আছেন? তাঁদের কাছে যেতে পারেন কি?
না। মাথা নাড়ে বিমল। কান্নায় তার স্বর জড়িয়ে যেতে থাকে, আমার এক দূর সম্পর্কের পিসি থাকে জলপাইগুড়িতে।-এক কাকা, আমার বাবার মাসতুতো ভাই, থাকে আসানসোলে। জেঠিমাদের পক্ষে সেখানে যাওয়া অসম্ভব। এদিকের কিছুই তো চেনেন না।
চকিতে সেই দিনটার কথা মনে পড়ে গেল বিনয়ের। হেমন্তের এক কুয়াশাচ্ছন্ন রাতে প্রায় এইভাবেই ঝিনুক, চিরদুঃখী সেই মেয়েটা কোথায় যে হারিয়ে গিয়েছিল! আজ অবধি তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। যারা স্বেচ্ছায় নিখোঁজ হয়, তাদের হদিস কি কখনও পাওয়া যায়?
বিমল জানায়, কাল সমস্ত রাত তারা উত্তর কলকাতায় খোঁজাখুঁজি করেছে, আজ ঘুরে ঘুরে দেখবে মধ্য কলকাতায়। তারপর অফিসে ছুটি নিয়ে শহরের অন্য সব এলাকায়।
বিমলের সারা মুখ চোখের জলে মাখামাখি। সে ব্যগ্রভাবে জিজ্ঞেস করে, জেঠিমাদের ঠিক পেয়ে যাব, কী বলেন? প্রশ্নটা এমনভাবে করল যাতে মনে হয়, খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারে সে নিজেই যথেষ্ট সন্দিহান। বিনয় তাকে ভরসা দিক, এটাই হয়তো চাইছে।
বিনয় বলল, এত বড় সিটি। লক্ষ লক্ষ মানুষ। কদিন ছুটি নিয়ে আপনি খুঁজবেন?
নিমেষে হতাশার শেষ প্রান্তে পৌঁছে যায় বিমল, তাহলে কী করতে বলেন?
থানায় খবর দিন। পারলে পুলিশই পারবে। বলেই বিনয়ের খেয়াল হয়, ঝিনুক যেদিন নিখোঁজ। হয় সেই দিনই অবনীমোহন তাকে থানায় নিয়ে গিয়েছিলেন। ওসি দিবাকর পালিত মানুষটি যথেষ্ট সহৃদয়। তাঁদের চেষ্টায় লেশমাত্র ত্রুটি হয়নি। এখনও তাঁরা খুঁজে চলেছেন। কিন্তু পাওয়া কি গেছে ঝিনুককে?
থানার চিন্তাটা বিমলের মাথায় আগে আসেনি। একটু চুপ করে থেকে সে বলল, ওখানে গেলে কাজ হবে বলছেন?
জোর দিয়ে কিছু বলছি না। তবে থানায় জানিয়ে রাখা উচিত।
ঠিকই বলেছেন। আমার খেয়াল হয়নি। আপনার কি এখন একটু সময় হবে বিনয়বাবু?
কেন বলুন তো?
যদি দয়া করে আমার সঙ্গে থানায় যান। মানে- বলতে বলতে থেমে যায় বিমল।
বিমল নিরীহ, সাদাসিধে, ভালমানুষ। আচমকা মারাত্মক এক সংকটে একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়েছে। বিমলের দিকে তাকিয়ে মায়াই হয় বিনয়ের। অফিসে তার সেকেণ্ড শিফট চলছে। দুটোয় হাজিরা। এখন এগারোটাও বাজেনি। হাতে অঢেল সময়। বলল, ঠিক আছে, চলুন–।
পার্ক থেকে বেরিয়ে ফের বড় রাস্তায়। বিমল এই এলাকার থানাটা চেনে। সেদিকে হাঁটতে হাঁটতে সে বলতে থাকে, মা-বাবাকে সেই কোন ছেলেবেলায় হারিয়েছি। তারপর জেঠিমা আর জেঠামশাইই ছিলেন আমার সব। তারা না দেখলে হয় না খেয়ে মরে যেতাম নইলে উচ্ছন্নে যাবার রাস্তা খোলাই ছিল। দীপ্তিকে কত করে বুঝিয়েছি, জেঠিমা আমার কাছে মায়ের থেকেও বেশি। কিন্তু কোনও কথা কানে তোলেনি। দেশভাগ না হলে-কথাটা শেষ করতে পারে না সে। বুকের ভেতর থেকে উথলে আসা কান্নায় গলা বুজে যায়।
বিমলের জন্য ভীষণ কষ্ট হয় বিনয়ের। একদিকে চরম স্বার্থপর রণচণ্ডী স্ত্রী, আর-এক দিকে জেঠিমা আর জেঠতুতো বোনেদের প্রতি কর্তব্যপালন–দুইয়ের মাঝখানে পড়ে শান্ত, নির্বিরোধ মানুষটা একেবারে চুরমার হয়ে গেছে।
হঠাৎ অন্য একটা চিন্তা মাথায় ঢুকে যায় বিনয়ের। তার ধারণা, রামরতনের স্ত্রী এবং তার মেয়েদের সন্ধান পাওয়া যাবে না। তবু ধরা যাক, পাওয়া গেল। নিজের কাছে ফের যদি বিমল তাঁদের নিয়ে তোলে, এবার কি সংসারে সুখ শান্তির ঢেউ খেলতে থাকবে? রাতারাতি হৃদয়ের পরিবর্তন ঘটে যাবে দীপ্তির? কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে এবার জেঠশাশুড়ি আর তার মেয়েদের মাথায় করে রাখবে?
একসময় দুজনে থানায় পৌঁছে যায়।
কলকাতার অন্য সব থানার মতো এটারও অবিকল একই চেহারা। থমথমে, ভীতিকর। ব্রিটিশ আমলে তৈরি লাল রঙের ইমারত, চওড়া চওড়া দেওয়াল, চারদিকে উর্দি-পরা কনস্টেবলদের ছড়াছড়ি।
ওসির সঙ্গে দেখা করে বিনয়রা রামরতনের স্ত্রী এবং মেয়েদের ঘটনাটা জানালো। একজন রাইটার-জমাদারকে ডাকিয়ে পুরো কেসটা লিখিয়ে নিলেন ওসি। দিবাকর পালিতের মতোই ভরসা দিয়ে বললেন, পুলিশের তরফ থেকে চেষ্টার ত্রুটি হবে না। বিমল যেন মাঝে মাঝে এসে খোঁজ নিয়ে যায়। বৃদ্ধা এবং তার মেয়েদের খবর পাওয়া গেলে থানা থেকেও তার বাসায় যোগাযোগ করা হবে।
থানা থেকে যখন ওরা বেরুল, সূর্য খাড়া মাথার ওপর উঠে এসেছে। রোদের তেজ আরও একটু বেড়েছে। অনেকটা হেঁটে কর্ণওয়ালিশ স্ট্রিটে এসে পড়ে দুজনে।
বিমল বলল, বিনয়বাবু, আপনি আমার দুঃসময়ে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। বলেছিলেন, আপনার দিদির কাছে থাকেন। সেখানকার ঠিকানা জানি না। হঠাৎ দরকার হলে যে চলে যাব তার উপায় নেই। ঠিকানাটা যদি দেন।
বিনয় বলে, বেশিদিন দিদির বাড়িতে থাকছি না। একটা মেস ঠিক করেছি। যত তাড়াতাড়ি পারি সেখানে গিয়ে উঠব। কিছুদিন হল আমি একটা নতুন চাকরিতে ঢুকেছি। সেখানকার ঠিকানাটা রাখুন–কাঁধের ঝোলা থেকে প্যাড আর কলম বার করে নতুন ভারত-এর ঠিকানা লিখে দিল।
কাগজটা হাতে নিয়ে চোখ বুলোতে বুলোতে সামান্য উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে বিমল, আপনি খবরের কাগজে কাজ পেয়েছেন!
চাকরির কথাটা জেঠিমার কাছে শুনেছিলাম। আস্তে মাথা নাড়ে বিনয়। হ্যাঁ, মাসীমাকে বলেছি।
বিমল বলতে লাগল, নিউজপেপারের তো অনেক ক্ষমতা। দেখবেন সেদিক থেকে জেঠিমাদের ব্যাপারে যদি কিছু করা যায়–
দেখব।
একটু নীরবতা।
তারপর বিমল বলল, রিপোর্টারির কাজে আপনাকে তো নানা জায়গায় ঘুরতে হয়। একটু লক্ষ রাখবেন। যদি ছায়া-মায়াদের দেখতে পান, সোজা আমার বাসায় নিয়ে আসবেন।
এতদিন ছিল ঝিনুক। এবার অনুসন্ধানের তালিকায় আরও চার রমণীর নাম যোগ হল। বিনয় বলল, আসব।
মদন বড়াল লেনের মুখে এসে বিমল বিদায় নিয়ে গলির ভেতর ঢুকে পড়ে।
এই ভরদুপুরে শহর গমগম করছে। অফিস টাইমের মতো না হলেও বাস ট্রামে এখনও বেশ ভিড়। কোনও গাড়িতেই সিট ফাঁকা নেই। তবু দাঁড়াবার মতো জায়গা আছে। বিনয় কিন্তু বাস ট্রামে ওঠার আগ্রহ বোধ করল না। ফুটপাথ ধরে সোজা হাঁটতে লাগল।
আজ মদন বড়াল লেনে এসে রামরতনের স্ত্রী আর মেয়েদের খবরটা শুনে বিনয় এমনই হতচকিত হয়ে গিয়েছিল যে অন্য কোনও দিকে খেয়াল ছিল না। প্রবল ধাক্কাটা এখন খানিকটা সামলে নিয়েছে। সে। হাঁটতে হাঁটতে তার খেয়াল হল, পকেটে তিন হাজার টাকার সেই খামটা রয়েছে। সেই বিমলদের বাসায় এল। দুটো দিন আগে, এমনকি কাল সকালেও যদি আসত, এমন মারাত্মক একটা বিপর্যয় ঘটত না। চারটি মানুষের একটু ভদ্রভাবে, সসম্মানে বেঁচে থাকার দায় সে তো স্বেচ্ছায় নিজের হাতেই তুলে নিয়েছিল। আগেই মদন বড়াল লেনে আসাটা কত জরুরি যে ছিল! আসা হয়নি, সেটা তারই ত্রুটি। তারই অন্যায়। আত্মগ্লানি বিনয়কে পিষতে থাকে।
মনটা ভীষণ উতলা। লক্ষ্যহীনের মতো হেঁটেই চলল বিনয়। সকালবেলায় প্রচুর লুচি টুচি খাইয়ে দিয়েছিল সুধা। এতক্ষণে সেগুলো হজম হয়ে যাবার কথা। কিন্তু খিদেতেষ্টার বোধটাই যেন নেই। বিবেকানন্দ রোডের ক্রসিংয়ে এসে ডান দিকে ঘুরে তার অফিসে যাবার কথা। আনমনা হাঁটতে হাঁটতে কখন ক্রসিংটা পেরিয়ে কলেজ স্ট্রিটে চলে এসেছিল, খেয়াল ছিল না।
হাতঘড়িটা দেখে নিল বিনয়। সেকেণ্ড শিফট শুরু হতে এখনও দেরি আছে। অবশ্য তার হাজিরা নিয়ে কড়াকড়ি নেই। কিন্তু আজ যখন কলোনি বা ত্রাণশিবিরে যাওয়া হয়নি তখন দুটোর মধ্যেই অফিসে যাবে।
অনেকখানি হাঁটাহাঁটি হয়েছে। ক্লান্তি লাগছিল। রাস্তা পেরিয়ে ওধারে গিয়ে ট্রাম ধরল বিনয়। ওটা শ্যামবাজার রুটের।
.
অফিসে পৌঁছে দেখা গেল, গোটা তিনতলা বাড়িটা সরগরম। আজই নতুন ভারত প্রথম বাজারে বেরিয়েছে। সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে উঠতে টুকরো টুকরো কথা কানে আসছিল বিনয়ের। নানা ডিপার্টমেন্টের এমপ্লয়ীরা আজকের কাগজ নিয়ে কথা বলছে। সবাই বেশ খুশি। প্রথম দিনই নাকি নতুন ভারত সাধারণ পাঠকের নজরে পড়েছে।
উত্তেজনা সবচেয়ে বেশি নিউজ ডিপার্টমেন্টে। রীতিমতো হইচই চলছে।
সাব-এডিটর প্রুফ-রিডারদের টেবলের ফাঁক দিয়ে ফাঁক দিয়ে রিপোর্টিং সেকশানে যেতে হয়। অন্য দিনের মতো আজও যাচ্ছিল। হঠাৎ নজরে পড়ল সাব-এডিটররা উৎসুক চোখে তাকে লক্ষ করছে। সবার মধ্যে কেমন একটা সমীহ ভাব। তিন সপ্তাহ সে অফিসে যাচ্ছে, আসছে। পূর্ব পাকিস্তানের এক নগণ্য শহরের আকাট গেঁয়োমার্কা একটা যুবককে কেউ ধর্তব্যের মধ্যেই আনেনি। এক পলক তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিয়েছে তারা। চাউনিতে কেমন যেন অবজ্ঞার ভাব মেশানো থাকত। তাদের চোখমুখের চেহারা আজ পুরোপুরি পালটে গেছে।
সবাই মুখ-চেনা। অনেকের নামও জেনেছে বিনয়। ওরা কেউ কেউ হাত তুলে কিছু বলল, কেউ হেসে হেসে মাথা নাড়ল। কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না। বোকাটে একটু হেসে সে এগিয়ে গেল।
রিপোর্টিং সেকশানে প্রসাদ তার চেয়ারে বসে ছিলেন। টেবলের এধারে মণিলাল আর রমেন। সুধেন্দুকে দেখা যাচ্ছে না। খুব সম্ভব, এখনও অফিসে আসেনি।
প্রসাদ হাসিমুখে বললেন, আরে এস এস, বোসো। আজ এত তাড়াতাড়ি?
অন্য দিন কলোনি টলোনিতে ঘুরে অফিসে পৌঁছতে পৌঁছতে তিনটে চারটে বেজে যায়। মুখোমুখি বসতে বসতে বিনয় জানায়, আজ কোনও ত্রাণশিবির বা কলোনিতে যাওয়া হয়নি। তাই দুটোর ভেতরেই আসতে পেরেছে।
প্রসাদ জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের কাগজ সম্বন্ধে কোথাও কিছু শুনেছ?
না। জরুরি কাজে সকালবেলা বেরিয়ে গিয়েছিলাম। বাইরের কারও মতামত শুনিনি। তবে দিদি জামাইবাবু আর দিদির দাদাশ্বশুরের ভাল লেগেছে।
কাল সারপ্রাইজের কথা বলেছিলাম। কাগজ খুলে সেটা আশা করি, দেখেছ
লাজুক মুখে বিনয় বলল, দেখেছি।
প্রসাদ বললেন, তোমার একটা লেখায় ছদ্মনাম দিয়েছি-দর্শক। একই দিনে একই রিপোর্টারের নাম দুজায়গায় ছাপা হবে, সেটা দৃষ্টিকটু। তোমার লেখা পড়ে দিদিরা কী বললেন?
বাড়ির লোকেরা প্রশংসা তো করবেই। বাইরের রিডার কী বলল সেটাই আসল।
শোন, কাগজের রেসপন্স খুব ভাল। তোমার দুটো লেখাই পাঠকদের ভীষণ পছন্দ হয়েছে। এর মধ্যে কটা ফোনও এসেছে। তারা চাইছে কলম দুটো কোনওভাবেই যেন বন্ধ না হয়। রোজ মিনিমাম দুটো করে লেখা জমা দেবে।
প্রসাদ একটু চাপা ধরনের মানুষ। অন্তর্মুখী। আজ তাঁকে দস্তুরমতো উচ্ছ্বসিত দেখাচ্ছে।
সুধেন্দুও উদারভাবে বিনয়ের লেখার তারিফ করল। রমেন কিছু বলল না, ঠোঁট টিপে বসে রইল।
হঠাৎ কিছু মনে পড়ে যাওয়ায় ব্যস্ত হয়ে উঠলেন প্রসাদ, একদম ভুলে গিয়েছিলাম। পারমিতা তোমার খোঁজ করছিল।
বিনয় অবাক।–কোন পারমিতা?
আরে, নতুন ভারত-এর মালিক-কাম-এডিটরের মেয়ে। নামটা এর মধ্যে ভুলে গেছ!
বিনয়ের স্নায়ুমণ্ডলীতে মৃদু ঝংকারের মতো কিছু বয়ে গেল।
.
৫৩.
কাল ছিল নতুন ভারত পত্রিকার উদ্বোধনের অনুষ্ঠান। কালই প্রথম পারমিতাকে দেখেছিল বিনয়। মা-বাবার সঙ্গে বিধানচন্দ্র রায়কে নিয়ে এসে যখন সে পত্রিকা অফিসের সামনে গাড়ি থেকে নেমেছে, সুধেন্দু তাকে চিনিয়ে দিয়েছিল। যথেষ্ট সুন্দরী। পোশাক, চলাফেরা, তাকানোর ভঙ্গি–তার সমস্ত কিছু থেকে স্নিগ্ধ ব্যক্তিত্বের দ্যুতি যেন ছড়িয়ে পড়ছিল।
কাল আরও বারকয়েক পারমিতাকে দেখেছে বিনয়। দুপুরে খাওয়া দাওয়া মিটলে নিউজ-এডিটর তারপদ ভৌমিক তাকে সঙ্গে করে সারা অফিস ঘুরে ঘুরে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। রিপোর্টিং সেকশানেও এসেছিল সে। কথায়বার্তায় চমৎকার। খুবই ভদ্র। . এক শ একাশি জন কর্মচারীর মধ্যে বিনয় একজন নগণ্য রিপোর্টার। পারমিতার সঙ্গে ভদ্রতাসূচক সামান্য দু-একটি কথা, নমস্কার প্রতি-নমস্কারের বেশি কিছু হয়নি। এত মানুষের ভিড়ে তাকে মনে করে রাখার কারণ নেই। অথচ নতুন ভারত-এর কর্ণধার এবং সম্পাদক জগদীশ গুহঠাকুরতার মেয়ে কিনা তারই খোঁজ করছে!
বিনয় প্রসাদের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল। চমকটা কাটিয়ে উঠতে বেশ কিছুটা সময় লাগল। তারপর জিজ্ঞেস করল, পারমিতা দেবী আমার খোঁজ করছেন কেন?
প্রসাদ বললেন, আমাকে কিছু বলেনি।
বিনয় লক্ষ করল, চিফ রিপোর্টারের ঠোঁটের খাঁজে চিকন একটি হাসির রেখা ফুটে উঠেই চকিতে মিলিয়ে গেল। মনে হল, প্রসাদ ব্যাপারটা জানেন কিন্তু নিজে জানাবেন না।
বিনয় বুঝতে পারছিল, উৎকণ্ঠার কারণ নেই। তবু কেমন যেন অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছিল। জিজ্ঞেস করল, আমার সঙ্গে তো তেমন আলাপ হয়নি। জাস্ট একটু পরিচয়। তবু আমার কথা শেষ না করে সে থেমে যায়।
প্রসাদ উত্তর দিলেন না। একটু আগে ঠোঁটে অতি মিহি হাসি দেখা দিয়েছিল। এবার তার চোখে কৌতুক চিকচিক করছে।
বিনয় বলে, আমি কি ওঁর সঙ্গে দেখা করব? সে ঘাড় ফিরিয়ে নিউজ ডিপার্টমেন্টের দিকে তাকাতে থাকে। আগেই শুনেছিল, আজ থেকে পারমিতা সাব-এডিটরদের সঙ্গে বসে কাজ শিখবে। কিন্তু বিশাল হল-ঘরের কোথাও তাকে দেখা গেল না।
বিনয়ের ছটফটানিটা আঁচ করতে পারছিলেন প্রসাদ। হালকা গলায় বললেন, এত নার্ভাস হচ্ছ কেন? পারমিতা এখন নিউজ-এডিটরের ঘরে আছে। আমাকে বলে গেছে, পরে এসে তোমার সঙ্গে কথা বলবে।
একটু চুপচাপ।
তারপর প্রসাদ বললেন, এবার কাজের কথায় আসা যাক। আজ তো বললে কোনও রিফিউজি কলোনি কি রিলিফ ক্যাম্পে যেতে পারনি। কেন?
ভেতরে ভেতরে থমকে যায় বিনয়। ক্যাম্প ট্যাম্পে • যাওয়ার জন্য প্রসাদ কি অসন্তুষ্ট হয়েছেন? তাই কি ফের এই প্রসঙ্গ তুললেন? রামরতনের স্ত্রী এ মেয়েদের কথা একটু আগে জানানো সম্ভব হয়নি। এখনও বলা গেল না। অফিসের অ্যাসাইনমেন্ট ফেলে অনাত্মীয়, অল্প-চেনা, অসহায় চার রমণীর জন্য প্রাণ কেঁদে ওঠায় অফিসের কাজ ফেলে সকালে উঠে সে শ্যামবাজারে ছুটে গিয়েছিল, এ-সব শুনলে নিশ্চয়ই খুশি হবেন না প্রসাদ। বিনয় কাঁচুমাচু মুখে বলল, আপনাকে তো বলেছি, একটা পারিবারিক কাজ, মানে–
পারিবারিক সমস্যা-টমস্যা থাকতেই পারে– হাত তুলে বিনয়কে থামিয়ে দিতে দিতে প্রসাদ বললেন, কিন্তু এদিকটাও তো ভীষণ আর্জেন্ট। তোমার দুটো ফিচার ছাপা শুরু হয়েছে। প্রথম দিনই বহু রিডারের নজরে পড়ে গেছ। তার মানে তুমি বাঘের পিঠে চড়ে বসলে। আমার কথা কিছু বুঝলে?
সত্যিই বোঝেনি বিনয়। আস্তে মাথা নাড়ে সে।
ব্যাপারটা ভেরি সিম্পল। ওই লেখা এখন রেগুলার বেরুতে থাকবে। এডিটর আর নিউজ-এডিটরের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। মিনিমাম ছমাস তো বটেই, রিফিউজি প্রবলেম প্রতিদিন যেভাবে ভয়াবহ হয়ে উঠছে, তাতে ও দুটো এক দেড় বছরও চালাতে পারি। তুমি আমাকে যা দিয়েছ তাতে বড় জোর দিন সাত-আট চলবে। বলেছিলাম রোজ তোমাকে দুটো করে ফিচার দিতে হবে। সেটা আবার মনে করিয়ে দিলাম।
বিনয় চুপ করে থাকে।
প্রসাদ জিজ্ঞেস করলেন, আজ কী হবে? কলোনি টলোনিতে তো যাওয়া হয়নি
বিনয় জানালো, যে লেখাগুলো প্রসাদের কাছে জমা রয়েছে তা বাদেও আরও বারো চোদ্দটা কলোনি এবং ত্রাণশিবির সম্পর্কে তার প্রচুর নোট নেওয়া আছে। আজই অফিসে বসে সেগুলো থেকে দুটো লেখা তৈরি করে ফেলতে পারবে।
প্রসাদ খুশি হলেন। ভেরি গুড়- তারপর হঠাৎ কিছু খেয়াল হতে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি তখন বললে, সকালবেলা বাড়ি থেকে বেরিয়েছ। দুপুরে ভাতটাত খাওয়া হয়েছে?
লোকটার সব দিকে নজর। বিশেষ করে তার প্রতি কী যে বিপুল স্নেহ! পাকিস্তান থেকে চলে আসার পর একমাত্র ছোটদি ছাড়া তার খাওয়া দাওয়া সম্পর্কে এত খোঁজ টোজ অন্য কেউ নেয়নি। অভিভূত বিনয় আস্তে মাথা নাড়ে, না। পরে ক্যানটিন থেকে কিছু আনিয়ে খেয়ে নেব। আসলে রামরতনের স্ত্রী এবং তার তিন মেয়ের নিখোঁজ হয়ে যাবার খবরটা শোনার পর সে এমনই উতলা হয়ে ওঠে যে খিদে তেষ্টার বোধটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এখনও খাওয়ার তেমন ইচ্ছে নেই।
প্রসাদ বললেন, পরে টরে নয়। আমাদের ক্যানটিন এখনও পুরোপুরি চালু হয়নি। সুকিয়া স্ট্রিট চেনো?
চিনি। এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়।
ওখানে জগন্মাতা ভোজনালয় রয়েছে। ওড়িয়াদের নাম-করা হোটেল। রান্নাবান্না খুব ভাল। এক্ষুনি একটা রিকশা করে সেখান থেকে খেয়ে এস।
প্রসাদের কথা অমান্য করা যায় না। বিনয় উঠে পড়েছিল। হঠাৎ তারাপদ ভৌমিকের কামরা থেকে বেরিয়ে সোজা রিপোর্টিং সেকশানে চলে এল পারমিতা। হাসিমুখে বলল, কিছুক্ষণ আগে প্রসাদদার কাছে আপনার খোঁজ করে গিয়েছিলাম। তখনও আপনি আসেননি। দাঁড়িয়ে কেন? বসুন
অগত্যা বসতে হল বিনয়কে। পারমিতা চেয়ার টেনে কাছাকাছি বসে পড়েছে।
ঝিনুক আর ঝুমাকে বাদ দিলে অন্য কোনও মেয়ের সঙ্গে মেলামেশার অভ্যাস নেই বিনয়ের। বিশেষ করে সে যদি পারমিতার মতো কোনও তরুণী হয়। মাত্র তিন-চার ফিট দুরে বসে আছে। জগদীশ গুহঠাকুরতার মেয়ে। তার নিঃশ্বাসের লঘু শব্দ কানে আসছে। ক্রমশ আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছিল বিনয়। বুকের ভেতর ধকধকানি বেড়ে যাচ্ছে। মিনমিনে গলায় কোনওরকমে বলতে পারল, হা, প্রসাদদা আপনার কথা বলছিলেন। কিন্তু কেন তাকে পারমিতা খোঁজ করছে সেটা আর জিজ্ঞেস করে উঠতে পারল না।
পারমিতার মধ্যে বিন্দুমাত্র জড়তা নেই। আগাগোড়া সংকোচহীন। অনেকটা স্বচ্ছ ঝরনার মতো। তার চোখেমুখে, হাসিতে, কথাবার্তায় বা আচরণে এমন এক ধরনের উজ্জ্বলতা মাখানো যা চারপাশ ঝলমলে করে তোলে।
পারমিতা বলল, আমাদের কাগজে আপনার লেখা দুটো পড়েছি। ভীষণ ভাল লেগেছে। স্পেশালি দেশভাগ : নানা ঘটনা, নানা মানুষ –এই কলামে আফজল হোসেন নামে যে লোকটির কথা লিখেছেন সেটা কি সত্যি? বাস্তবে এমন কেউ কি আছে?
গুটিয়ে-থাকা ভাবটা কেটে যায় বিনয়ের। অদ্ভুত এক উদ্দীপনা তাকে যেন ধাক্কা মেরে জাগিয়ে তোলে। রীতিমতো জোর দিয়ে সে বলে, লোকটার নাম, ঠিকানা থেকে শুরু করে তার সম্বন্ধে যা যা বেরিয়েছে তার সবটাই সত্যি। একটা শব্দও বানানো নয়। খবরের কাগজে জায়গা কম। আমার লেখা অনেকটাই বাদ দিয়েছেন প্রসাদদা। পুরোটা ছাপা হলে বোঝা যেত মানুষটা কত বড় মাপের। একটু থেমে গম্ভীর গলায় বলতে লাগল, ওই মানুষটা রক্ষা না করলে আমাদের ইন্ডিয়ায় আসা হতো না। পথেই খুন হয়ে যেতাম।
বিনয়ের আবেগ খুব সম্ভব পারমিতার মধ্যেও চারিয়ে যাচ্ছিল। সে বলল, হি ইজ আ গ্রেট সোল। এই ধরনের মানুষ যে পাকিস্তানে আছে, জানতাম না।
বিনয় বলল, আরও অনেক আফজল হোসেন আছে। লক্ষ লক্ষ রিফিউজি ইন্ডিয়ায় চলে এসেছে। রোজ দলে দলে কত যে আসছে। তবু এখনও প্রায় টোয়েন্টি পারসেন্টের মতো হিন্দু ওখানে থেকে গেছে। আফজল হোসেনরা পাশে না দাঁড়ালে অসংখ্য মানুষ খুন হতো, একজন হিন্দুও ওখানে থাকতে পারত না। ইস্ট পাকিস্তান টোটালি হিন্দুশূন্য হয়ে যেত।
পারমিতা ধীরে ধীরে মাথা নাড়ে। একটু চুপ করে থেকে বলে, মা-বাবাও আপনার লেখার প্রশংসা করছিলেন।
বিনয় লক্ষ করল, দ্বিতীয়বার তার লেখা সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত হল পারমিতা। সে জানায়, এ-ব্যাপারে তার এতটুকু কৃতিত্ব নেই। আফজল হোসেন এমন এক মহান চরিত্র, যেমন তেমন করে লিখলেই পাঠক মুগ্ধ হবে। তার মনে হবে, অবিশ্বাস্য কোনও কল্প-কাহিনি পড়ছে।
পারমিতা বলল, এই ধরনের মানুষের কথা আরও বেশি করে লিখুন–
প্রসাদদাও তাই বলেছেন।
একটু চুপ করে থেকে পারমিতা বলল, আপনার লেখাটা পড়ে জানতে পারলাম, আপনাদের বাড়ি ছিল ঢাকার বিক্রমপুরে
হ্যাঁ।
আমাদের দেশও ইস্ট বেঙ্গলে। বরিশাল ডিস্ট্রিক্টে। গ্রামের নাম গাভা। আমার অ্যানসেস্টররা সেখানে থাকতেন। ফার্স্ট গ্রেট ওয়ারের পর নাইনটিন ফোরটিন কি ফিফটিনে বাবা আর মা কলকাতায় চলে এসেছিলেন। তারপর আর কখনও গাভায় যাননি। ওঁদের মুখে ইডিলিক ইস্ট বেঙ্গলের কথা অনেক শুনেছি। সেটা নাকি স্বপ্নের দেশ। .
বিনয় উত্তর দেয় না। আস্তে মাথা নাড়ে শুধু। পারমিতা থামেনি।–ইস্ট বেঙ্গলটা দেখে আসার খুব ইচ্ছে ছিল। কিন্তু এ-জীবনে সেখানে আর যাওয়া হবে না। মাঝে মাঝে এসে আপনার কাছে দেশের কথা শুনে যাব, কেমন?
বিনয় বলল, নিশ্চয়ই।
অনেকটা সময় আপনাদের নষ্ট করে দিলাম। এবার উঠি পারমিতা সোজা সাব-এডিটরদের টেবলগুলোর দিকে চলে গেল।
বিনয়ও উঠে দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ তার চোখ গিয়ে পড়ল রমেনের ওপর। হিংসেয় লোকটার মুখ কালীবর্ণ হয়ে গেছে। বিনয়ের লেখা পাঠকের ভাল লেগেছে। কাগজের মালিক জগদীশ গুহঠাকুরতা, তার স্ত্রী এবং চিফ রিপোর্টার তারিফ করেছেন। আর পারমিতা তো সামনে বসে প্রশংসার ঢল নামিয়ে দিয়েছে। এসব সহ্য করতে পারছিল না রমেন। এই গুণকীর্তন তারই প্রাপ্য ছিল। জোর করে অন্যায়ভাবে যেন সেটা ছিনিয়ে নিয়েছে বিনয়।
কয়েক পলক রমেনের দিকে তাকিয়ে থাকে বিনয়। দেখতে দেখতে সমস্ত অনুভূতি তিক্ততায় ভরে যায়। পরক্ষণে ভাবে, মন খারাপ করার মানে হয় না। পৃথিবীর সব মানুষই কি দেবদূত? আশেপাশে এদের নিয়েই তো থাকতে হবে। আগেও একদিন এমনটি ভেবেছিল সে। রমেনের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে প্রসাদকে খেয়ে আসি বলে হল-ঘরের দূর প্রান্তে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায় সে। ।
রিকশায় করে সুকিয়া স্ট্রিটের দিকে যেতে যেতে আজকের দিনটার কথাই বার বার মনে পড়ে যাচ্ছিল। সেই ভোর থেকে ঘটনার পর ঘটনা। সকালে খবরের কাগজে ছাপার হরফে নিজের নাম এবং দুদুটো লেখা দেখে মনে হচ্ছিল এক অলৌকিক স্বপ্নের চূড়ায় পৌঁছে গেছে। তারপর মদন বড়াল লেনে গিয়ে যখন শোনা গেল রামরতনের স্ত্রী মেয়েদের নিয়ে চলে গেছেন, কেউ যেন তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল অতল খাদে। আত্মগ্লানিতে নুয়ে পড়েছিল সে। পরে অফিসে এসে যখন জানা । গেল তার লেখার সুখ্যাতিতে ভরে গেছে দশ দিগন্ত, এমনকি পারমিতার মতো এক পরমাশ্চর্য তরুণী তার সামনে বসে মুগ্ধ হয়ে অঢেল প্রশংসা করছিল, বিনয়ের মনে হচ্ছিল, তার মতো সুখী মানুষ পৃথিবী নামে গ্রহটিতে আর একজনও নেই। কিন্তু তারই মধ্যে রমেনের মুখ দেখে মনে হয়েছে, লোকটা নিঃশব্দে তার গায়ে হুল ফুটিয়ে দিচ্ছে। একটা কথা না বলেও কীভাবে বিষ ঢালা যায়, রমেনকে না দেখলে সে জানতে পারত না।
একই দিনে কত রকমের ঘটনা, কত রকমের যে অনুভূতি।
.
কাগজ বেরুবার পর দিন দশেক কেটে গেল। এর মধ্যে বিনয়ের কলাম দুটো নিয়মিত ছাপ হচ্ছে। শরণার্থীদের ত্রাণশিবিরে এবং জবরদখল কলোনিতে রোজ প্রথম পাতায়, আর দেশভাগ: নানা ঘটনা, নানা মানুষ সপ্তাহে দুদিন–ভেতরে, ছয়ের পাতায়।
লেখা দুটো রীতিমতো সাড়া জাগিয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের ছিন্নমূল মানুষদের সমস্যা আর কোনও কাগজ এমন ব্যাপকভাবে তুলে ধরেনি। নতুন ভারত-এর প্রচার হু হু করে বেড়ে চলেছে। বিশেষ করে উদ্বাস্তুদের মধ্যে।
বিনয়ের লেখাগুলো পড়ে পাঠকরা, যাদের বেশির ভাগই শরণার্থী, প্রচুর চিঠি লিখছে। দিনে দশ পনেরোটা করে। তাদের অপরিসীম দুঃখ, অফুরান দুর্দশার চিত্রটি দেশের মানুষের সামনে ফুটিয়ে তোলার জন্য এই ধ্বস্ত, দিশেহারা মানুষগুলোর কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। খবরের কাগজে জায়গা কম, তবু সবিনয় নিবেদন নামে পাঠক-পাঠিকাদের চিঠিপত্রের যে বিভাগটি রয়েছে সেখানে প্রায় রোজই এইসব চিঠির দু-তিনটে করে ছাপা হয়।
আজকাল নাওয়া খাওয়ার সময় নেই বিনয়ের। এতদিন কলকাতার কাছাকাছি রিলিফ ক্যাম্প আর কলোনিগুলোতে যেত সে। এখন তিরিশ চল্লিশ মাইল দূরে দূরে চলে যাচ্ছে। কোথাও ট্রেনে, কোথাও বাসে। এমন অনেক দুর্গম এলাকায় কলোনি বসেছে সেখানে পৌঁছতে হলে ট্রেন বা বাস থেকে নেমে তিন-চার মাইল হাঁটতে হয়। সুধাদের বাড়ি থেকে ভোর হতে না হতেই বেরিয়ে কলোনি টলোনি ঘুরে অফিসে যেতে যেতে কোনও কোনওদিন সন্ধে হয়ে যায়। তারপর দুদুটো লেখা তৈরি করে প্রসাদের কাছে জমা দিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে মাঝরাত।
আশ্চর্য, এত যে ঘোরাঘুরি, প্রতিদিন দিগ্বিদিকে অবিরাম ছোটাছুটি, তবু একটুও ক্লান্তি বোধ করে না বিনয়। অজস্র পাঠকের সুখ্যাতি তাকে উদ্দীপনায় ভরে রাখে। বিনয়ের মনে হয়, খবরের কাগজের কাজটা নিছক একটা চাকরি নয়। অন্য অফিসে কাজ করলেও মাসের শেষে কিছু টাকা মেলে। এখানেও পাওয়া যাবে। কিন্তু এটা পুরোপুরি আলাদা ধরনের কাজ। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটা সামাজিক দয়। যে মানুষগুলোর লেশমাত্র অপরাধ ছিল না, দেশটা দুটুকরো করে আচমকা একদিন তাদের সাতপুরুষের ভিটেমাটি থেকে উপড়ে এনে ছুঁড়ে ফেলা হল চরম দুর্গতির মধ্যে। কলোনিতে, রিলিফ ক্যাম্পে, শিয়ালদা স্টেশনে, ত্রস্ত, বিহ্বল, ক্ষুধাকাতর পশুর মতো কোনওরকমে তারা টিকে আছে। ক্ষয়ে ক্ষয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাদের সম্বন্ধে কাগজে বিনয় যে লিখে চলেছে তা যেন বিরাট এক কর্তব্য পালন।
পূর্ব পাকিস্তান থেকেই শুধু নয়, পশ্চিম পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশ আর পাঞ্জাব থেকেও লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু সীমান্তের এপারে চলে এসেছে। তাদের ত্রাণ এবং পুনর্বাসনের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার কী ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে, খবরের কাগজ এবং সরকারি প্রেস নোট ঘেঁটে তার অনেক তথ্য টুকে রেখেছিল সে। আর পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বাস্তুদের জন্য কী করা হচ্ছে তা তো নিজের চোখেই দেখছে। পূর্ব এবং পশ্চিম, দেশের দুই প্রান্তের শরণার্থীদের পুনর্বাসন নিয়ে তুলনামূলক একটা প্রতিবেদন তৈরি করেছিল বিনয়। নিয়মিত দুটো ফিচারের সঙ্গে সেটাও ছাপা হয়েছে। সেই লেখাটা এইরকমঃ
দেশভাগের পর হইতে উদ্বাস্তু সমস্যা সারা ভারতবর্ষকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়াছে। প্রথমে পশ্চিম প্রান্তের, বিশেষ করিয়া খণ্ডিত পাঞ্জাবের পশ্চিম অঞ্চল হইতে যাহারা আসিয়াছে তাহাদের কথা বলা যাক। কেন্দ্রীয় সরকার দরাজভাবে ইহাদের জন্য খরচ করিতেছে।
পশ্চিম পাকিস্তানের হিন্দু এবং শিখ শরণার্থীদের জন্য ব্যাপক পুনর্বাসনের পরিকল্পনা করা হইয়াছে। তাহাদের জমিজমা দিয়া বসানো হইতেছে লুধিয়ানা, মোগা, সাহাবাদ, কার্নাল, পানিপথ, রোটক, ভিয়োয়ান্দি, গুরগাঁও ইত্যাদি স্থানে। বহু সংখ্যক পরিবারকে পাঠানো হইয়াছে বিহার, যুক্তরাজ্য, মহারাষ্ট্র, সেন্ট্রাল প্রভিন্স প্রভৃতি অঞ্চলে। কুরুক্ষেত্র হইতে ভিসাপুর, গোয়ালিয়র, রেওয়া, ইন্দোর–যেখানেই ফাঁকা জায়গা পাওয়া গিয়াছে সেখানেই সরকারি সহায়তায় গড়িয়া উঠিতেছে নূতন নূতন জনপদ।
শুধু আশ্রয়ের জন্য বাড়িঘর বানাইয়া দেওয়াই নয়, পশ্চিম পাকিস্তানের শরণার্থীদের ভবিষ্যৎ যাহাতে সুরক্ষিত হয়, নিজেদের পায়ে তাহারা যাহাতে দাঁড়াইতে পারে, সেজন্য বিপুল আয়োজন করা হইয়াছে। যেখানে যেখানে উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন হইয়াছে সেই সব অঞ্চলের কাছাকাছি বসানো হইয়াছে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট। হাতে-কলমে কাজ শিখিয়া এইসব কেন্দ্রগুলি হইতে বাহির হইলেই কলকারখানায় চাকরি বাঁধা। ইহা ছাড়া মেয়ে এবং ছেলেদের জন্য নানারকম বৃত্তিমূলক কাজ শেখানোর ব্যবস্থাও করা হইয়াছে। দিল্লি, রোটক, লুধিয়ানা, পানিপথ, কার্নাল ইত্যাদি স্থান এই ইণ্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং জাতীয় ইনস্টিটিউট এবং ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টারে ভরিয়া গিয়াছে।
নূতন নূতন বাজার তো বসানো হইয়াছেই, পূর্ব পাঞ্জাবের মুসলমানদের ফেলিয়া যাওয়া বাজারগুলিতে দীর্ঘমেয়াদি লিজে প্রায় বিনামূল্যে ওপার হইতে আসা শরণার্থীদের দেওয়া হইতেছে। ছোটখাটো হিন্দু এবং শিখ ব্যবসাদারদের দোকান করিয়া দেওয়ার ব্যবস্থা হইতেছে। অজস্র নূতন প্রাইমারি ও হাইস্কুল বসানো হইয়াছে। শরণার্থী শিক্ষকেরা সেগুলিতে চাকরি পাইতেছে। ওপারের উকিল, ইঞ্জিনিয়ার, ম্যাজিস্ট্রেট, ডাক্তার-কেহই বসিয়া নাই। সবার জন্য কাজের অবাধ সুযোগ।
ইহা ছাড়াও কেন্দ্রীয় ত্রাণ এবং পুনর্বাসন মন্ত্রক পশ্চিম পাঞ্জাবের উদ্বাস্তুদের জন্য সম্প্রতি তিন কোটি টাকা বরাদ্দ করিয়াছে।
পাঞ্জাবের শরণার্থীদের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের অদৃষ্ট খুবই খারাপ। সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে ত্রাণের কিছু ব্যবস্থা হইয়াছে ঠিকই। কলিকাতার আশেপাশে দু-একটি ইণ্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট এবং ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টারও বসানো হইয়াছে কিন্তু সুষ্ঠু, সুপরিকল্পিত পুনর্বাসনের ব্যবস্থা এখনও হয় নাই। কিছু উদ্বাস্তু মরিয়া হইয়া জবরদখল কলোনি বসাইয়াছে, কিন্তু বাকিরা?
ইতিমধ্যেই আনুমানিক কুড়ি লক্ষ মানুষ ওপার হইতে ইণ্ডিয়ায় চলিয়া আসিয়াছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার এখনও পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বাস্তুদের ব্যাপারে তেমন গুরুত্ব দেয় নাই। তাহাদের ধারণা, বাঙালি শরণার্থীরা আসার ফলে বিরাট কোনও সমস্যার উদ্ভব হয় নাই। আসাম এবং পশ্চিমবঙ্গের ফাঁকা জায়গাগুলিতে তাহাদের পুনর্বাসনের বন্দোবস্ত হইয়া যাইবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আসামের অবস্থা অগ্নিগর্ভ। সেখানকার মানুষ চায় না, বাঙালি উদ্বাস্তুতে ওই প্রদেশটি ভরিয়া যাক। বহু শরণার্থী যাহারা আসামে আসিয়াছিল, তাড়া খাইয়া দ্বিতীয়বার উদ্বাস্তু হইয়া পশ্চিমবঙ্গে চলিয়া আসিতেছে।
এই বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের ভবিষ্যৎ কী, আদৌ তাহাদের সম্মানজনক পুনর্বাসনের বন্দোবস্ত হইবে কি না, ভাবিলে আতঙ্কিত হইতে হয়। রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করা ছাড়া আপাতত অন্য কোনও উপায় নাই।..
এই লেখাটা বেরুবার পর নানা মহলে তীব্র আলোড়ন শুরু হয়ে যায়।
.
৫৪.
নতুন ভারত-এ বিনয়ের একমাস পূর্ণ হল। অফিসে এসে মাইনেও পেয়ে গেছে। আগেই ভেবে রেখেছিল, প্রথম মাসের মাইনে হাতে এলে শান্তিনিবাস-এ চলে যাবে। প্রসাদ তার জন্য একটা ঘরও ঠিক করে রেখেছেন।
আর দেরি নয়, আজই বাড়ি ফিরে মেসে যাবার কথাটা সুধাদের জানিয়ে দিতে হবে।
রোজ রাত্তিরে খাওয়াদাওয়ার পর্ব চুকলে বাইরের ঘরে বসে সুধা হিরণ আর বিনয় খানিকক্ষণ গল্প করে। সেই সকালবেলা বেরিয়ে বিনয় কোন কোন ত্রাণশিবির বা জবরদখল কলোনিতে গেছে, সেই সব জায়গায় কাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে, কী অবস্থায় তারা আছে, কিংবা কলোনি টলোনি ঘুরে নতুন ভারত অফিসে ফেরার পর কী কী ঘটেছে-খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সমস্ত জানতে না পারলে সুধা আর হিরণের পেটের ভাত হজম হয় না।
দ্বারিক দত্তরও অনন্ত কৌতূহল। পূর্ব পাকিস্তান থেকে যে ছিন্নমূল মানুষেরা সীমান্তের এপারে চলে এসে কী নিদারুণ পরিস্থিতিতে দিন কাটাচ্ছে সে সম্পর্কে তিনিও জানতে চান। কিন্তু যথেষ্ট বয়স হয়েছে। কবেই সত্তর পেরিয়েছেন। ইদানীং শরীর একদিন ভাল থাকে ত পরের দিন খারাপ। বেশির ভাগ দিনই সন্ধের পর দুখানা সুজির রুটি, এক বাটি দুধ আর দু-একটা মিষ্টি খেয়ে শুয়ে পড়েন।
যেদিন শরীর ভাল থাকে, রাত্তিরে বিনয়দের সঙ্গে গল্প করতে বসে যান দ্বারিক দত্ত। আজ নিজেকে বেশ সুস্থ মনে হচ্ছে। তাই গায়ে ঘন করে গরম শাল জড়িয়ে বাইরের ঘরের আসরে এসে বসেছেন।
আজ কিন্তু উদ্বাস্তুদের কথা উঠলই না। বিনয় সারাদিন কোথায় কোথায় ঘুরেছে, কেউ জানতে চাইল না।
হিরণ বলল, বিনু, রোজই তুমি সকালে উঠে কলোনি কি ক্যাম্পে চলে যাও। এই উইকে একটা দিন না গেলে হয় না?
বিনয় অবাক হল।-কেন বলুন তো?
খান মঞ্জিল সারানো হয়ে গেছে। এখন রং করা হচ্ছে। আশা করছি, খুব তাড়াতাড়িই সব কাজ শেষ হয়ে যাবে। ভীষণ ব্যস্ত থাকে বলে এর ভেতর তোমাকে দেখে আসার কথা বলিনি।
হিরণ বলতে লাগল, কিন্তু আমাদের সবার ইচ্ছে, তুমি একবার ওখানে যাও। এখন দেখলে বাড়িটা চিনতে পারবে না।
কাগজের অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে সারাদিন ছোটাছুটি, তারপর অফিসে গিয়ে ঘাড় গুঁজে দু দুটো লেখা তৈরি করে জমা দেওয়া। এটা একটা দিক। আর-এক দিকে রয়েছে পাঠকদের বিপুল প্রত্যাশা। সকাল থেকে রাত অবধি অদ্ভুত এক নেশার ঘোরে কেটে যায় বিনয়ের। তার মধ্যে খান মঞ্জিল-এর কথা একেবারেই খেয়াল ছিল না।
বিনয় অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। আজ অফিস থেকে বেরুবার সময় ঠিক করে রেখেছিল, খাওয়া দাওয়ার পর মেসে চলে যাবার কথাটা সুধাদের জানিয়ে দেবে। চিন্তাটা আবার মাথায় ফিরে এসেছে। কিন্তু তা নিয়ে কিছু বলার আগেই হিরণ খান মঞ্জিল-এর প্রসঙ্গ তুলল। উত্তর একটা না দিলেই নয়। বিনয় বলল, কী করে যাব? যা কাজের চাপ
সুধা জোর দিয়ে বলে, তোকে যেতেই হবে। কী বাড়ি কী হয়েছে, না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবি না। তোর ঘরটা নতুন খাট, আলমারি, ড্রেসিং টেবিল দিয়ে আমি নিজের হাতে সাজিয়ে দেব।
বুকের ভেতরটা থির থির কাঁপতে থাকে বিনয়ের। সে গিট খুলে চলে যেতে চাইছে, আর সুধারা চাইছে তাকে হাজার পাকে জড়িয়ে রাখতে। সে জবাব দিল না।
হিরণ বলল, বুঝলে বিনু, একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে
বিনয় মুখ ফিরিয়ে হিরণের দিকে তাকায়।-কী সমস্যা?
ও-বাড়ির নাম তো আর খান মঞ্জিল রাখা যাবে না। নতুন নামকরণ করতে হবে। আজ অফিস থেকে ফিরে এই নিয়ে সুধা আর দাদুর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। অনেকগুলো নাম আমরা ভেবেছি। কিন্তু ডিশিসান নিতে পারিনি। সবাই মিলে ঠিক করলাম, তুমি ফিরে এলে নামটা ফাইনাল করা হবে।
বিনয় কৌতূহল বোধ করে না। কিন্তু হিরণদের এত আগ্রহ যে কিছু না বলাটা অভদ্রতা। নিরুৎসুক সুরে সে জিজ্ঞেস করে, কী নাম ভেবেছেন?
হিরণ গড় গড় করে অনেকগুলো নাম আওড়ে যায়। দত্ত নিবাস, দত্ত ভিলা, আনন্দ নিকেতন, স্বপ্নের নীড়, আবাস, রাজদিয়া হাউস ইত্যাদি।
দ্বারিক দত্ত বললেন, রাজদিয়া হাউস নামটা আমিই বলেছিলাম। ইস্ট বেঙ্গলে তো আর কোনও দিন যাওয়া হবে না। রাজদিয়ার নামটা থাকলে যতদিন ওই বাড়ি আছে, দেশও এ বাড়ির বাসিন্দাদের সঙ্গে থাকবে।
এক পলক দ্বারিক দত্তকে দেখে তার মনোভাবটা আন্দাজ করে নিল বিনয়। পৃথিবীর যে ভূখণ্ড থেকে চিরকালের মতো চলে এসেছেন তার স্মৃতি বিলীন হয়ে যাক, বৃদ্ধ কোনওভাবেই তা চান না। কবছর বিয়ে হলেও সুধার ছেলেমেয়ে হয়নি। হবে নিশ্চয়ই। বাড়ির নামের সঙ্গে রাজদিয়াকে জড়িয়ে রাখার কারণ একটাই। উপ-মহাদেশের কোন প্রান্তে ছিল দত্তদের আদি নিবাস, কোন মৃত্তিকায় ছিল পূর্বপুরুষদের অস্তিত্বের মূল শিকড়, বংশধরেরা তা যেন কোনওদিন ভুলে না যায়। বাড়ির নামটা দেখলেই তাদের রাজদিয়ার কথা মনে পড়ে যাবে। ওদের কারও যদি কখনও ইচ্ছে হয়, শিকড়ের টানে বাপ-ঠাকুরদার জন্মভূমি দেখতে চলেও যেতে পারে।
নামকরণ নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ হইচই হল। সুধার পছন্দ আনন্দ নিকেতন, হিরণের স্বপ্নের নীড়। সবাই বিনয়ের মতামত জানতে চায়। কিন্তু যার আদৌ কোনও ঔৎসুক্য নেই, সে আর কী বলতে পারে? শুধু হুঁ হাঁ করে গেল। শেষপর্যন্ত অবশ্য ঠিক হল, দ্বারিক দত্তর সেন্টিমেন্টকে মর্যাদা দিয়ে বাড়ির নাম রাজদিয়া হাউসই রাখা হবে।
বাইরের ঘরের দেওয়াল-ঘড়িতে চোখ পড়তে চমকে ওঠে সুধা, ওরে বাবা, পৌনে বারোটা বেজে গেছে। এই, সবাই উঠে পড়। আর দেরি করে শুলে শরীর খারাপ হবে।
যে কুণ্ঠাটা ছিল সেটা এবার কাটিয়ে ওঠে বিনয়। মনস্থির করে ফেলেছে সে। সিদ্ধান্তটা যদিও কঠোর, তবু না জানালেই নয়।
বিনয় বলল, ছোটদি, তোরা আর-একটু বোস। আমার একটা কথা আছে
সবাই উঠে দাঁড়িয়েছিল। ধীরে ধীরে ফের বসে পড়ে।
সুধা জিজ্ঞেস করে, কী কথা রে?
আমি–আমি
তুই কী?
প্রথম বার বলতে গিয়েও আটকে গিয়েছিল। এবার চোখকান বুজে জানিয়ে দিল বিনয়, আমি একটা মেস ঠিক করেছি। দু-একদিনের ভেতর সেখানে চলে যেতে চাই
কথাগুলো যেন মাথায় ঢোকে না সুধার। ভাইয়ের দিকে হতবাক তাকিয়ে থাকে সে।
হিরণ কিন্তু ঠিকই ধরে ফেলেছে।-কী বললে, মেসে যাবে?
বিনয় আস্তে মাথা নাড়ে, হ্যাঁ।
এতক্ষণে ব্যাপারটা বোধগম্য হয় সুধার। আচমকা প্রবল ধাক্কায় জগৎসংসার তোলপাড় হয়ে যায় তার। বিনয়ের কাঁধ দুই হাতে আঁকড়ে ধরে চেঁচিয়ে ওঠে, মেসে যাবি? কেন? কেন? কেন?
হিরণও কম হকচকিয়ে যায়নি। বলল, এখানে কি তোমার কোনও অসুবিধে হচ্ছে?
কুণ্ঠিত বিনয় জোরে জোরে মাথা ঝাঁকায়। কী বলছেন হিরণদা! পাকিস্তান থেকে আসার পর আপনারা যদি কাছে টেনে না নিতেন, ঝিনুককে নিয়ে কী করতাম, কোথায় যেতাম, ভাবতেও ভয় হয়। আপনারা আমাকে কী যত্ন যে করছেন তা শুধু আমিই জানি। দাদু, দিদা আর মা ছাড়া অন্য কেউ
তার কথা শেষ হয় না। সুধা হঠাৎ কেঁদে কেটে মধ্যরাতের নৈঃশব্দ্যকে খান খান করে দেয়। তার ওপর যেন হিস্ট্রিরিয়া ভর করেছে। ভাইয়ের কাঁধটা ধরাই ছিল। উন্মাদের মতো তাকে ঝুঁকি দিতে দিতে বলে, তা হলে কেন যাবি? আমরা ছাড়া তোর কে আছে এই শহরে? মরে গেলেও তোকে আমি মেসে যেতে দেব না।
বিনয় সুধাকে শান্ত করতে চেষ্টা করে।আমার কথাটা শোন। কঁদিস না ছোটদি-কাঁদিস না তার গলা ভারী হয়ে আসে।
সুধা ভাইয়ের কোনও কথাই কানে তোলে না। অবুঝ বালিকার মতো সে বলে যায়, এক্সচেঞ্জ করে কত বড় বাড়ি পেয়েছি। ভেবেছি তোকে নিয়ে একসঙ্গে থাকব। কত কষ্ট পেয়েছিস। তোকে বুকের ভেতর থেকে কান্নার বলক বার বার উঠে আসতে থাকে। ফোঁপাতে ফোঁপাতে জড়ানো গলায় সে বলে যায়, আমাকে দুঃখ দিস না বিনু
সুধা যে তাকে কতখানি ভালবাসে, তার প্রতি ছোটদির যে অপার মায়া, বোধবুদ্ধি হবার পর থেকেই বিনয় জেনে এসেছে। তারা পিঠোপিঠি ভাইবোন। তেরো চোদ্দ বছর বয়স অবধি সারাক্ষণ মারপিট লেগেই থাকত। এই হয়তো মহাযুদ্ধ, পরক্ষণে সন্ধি। হাজার ধুন্ধুমারের মধ্যেও একটা মুহূর্তও একজনকে ছাড়া আর-এক জনের চলত না। তলায় তলায় পরস্পরের প্রতি কী যে গভীর টান!
সুধার কান্নাটা বিনয়ের মধ্যেও চারিয়ে যাচ্ছিল। একবার ভাবল, এত ভালবাসা তুচ্ছ করার ব্যাপার নয়। ওদের কাছেই থেকে যাবে। কাল অফিসে গিয়ে প্রসাদকে জানিয়ে দেবে, সে মেসে যাচ্ছে না। কিন্তু পরক্ষণে নিজেকে শক্ত করে নিল। বলল, তোরা তো রইলিই। যদি দেখি মেসে থাকা যাচ্ছে না, তোদের কাছে চলে আসব।
সুধা উত্তর দিল না। বিনয়ের কাঁধ থেকে হাত নামিয়ে নিয়ে দৌড়ে বাইরের ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
হিরণ এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। তার মুখে বিষাদ মাখানো। বিনয় তাকে বলে, হিরণদা, ছোটদিকে আপনি একটু বোঝান
হিরণ বলল, কী কারণে তুমি চলে যেতে চাইছ, বুঝতে পারছি না। আমাদের দিক থেকে কি কোনও ত্রুটি হয়েছে?
বিনয় বিব্রত হয়ে পড়ে। –না না, ত্রুটির কোনও প্রশ্নই নেই। একটু আগেই তো বলছিলাম, এখানে এসে যে আদর-যত্ন পেয়েছি, বাকি জীবনে আর কি কারও কাছে তা পাব?
তাহলে?
নতমুখে বিনয় জানায়, হিরণরা যতই আপনজন হোক, এটা তার দিদির শ্বশুর বাড়ি। পাকিস্তান থেকে চলে আসার পর সে এতটাই নিরুপায় হয়ে পড়েছিল যে সুধাদের আশ্রয় ছাড়া অন্য কোথাও যাবার জায়গা ছিল না। এখন সে চাকরি পেয়েছে, রোজগার করছে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়। এ ছাড়া মেসে যাবার অন্য কোনও উদ্দেশ্য নেই।
হিরণ এভাবে ঠিক চিন্তা করেনি। সুধার মতো অতটা প্রবল না হলেও এক ধরনের আবেগ তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। রাজদিয়ায় শেষ যখন বিনয়কে দেখে এসেছে তখন কত আর তার বয়স, নেহাতই এক কিশোর। তারপর কতগুলো বছর কেটে গেছে। দেশভাগের পর এপারে চলে এলেও হিরণের মনে হতো, বিনয় বুঝি সেই ছেলেবেলাতেই থেমে আছে। তার মা নেই, বাবা যাবতীয় সাংসারিক বন্ধন ছিঁড়ে চলে গেছেন গুরুর আশ্রমে, ঝিনুকের জন্য সুনীতিদের বাড়িতে হেমনলিনীর নিষ্ঠুর আচরণে সে ভেঙে পড়েছিল। সব মিলিয়ে হিরণের মনে হয়েছে, উদভ্রান্ত বিনয়কে গভীর মমতায় ঘিরে রাখা দরকার। এই পৃব্বিীতে কত যে সংকট, কত যে সমস্যা। বিনয়কে আগলে না রাখলে সে চুরমার হয়ে যাবে।
কিন্তু এই মুহূর্তে বিনয়ের কথাগুলো শুনতে শুনতে হঠাৎই তার সম্বন্ধে যেন সচেতন হয়ে উঠে হিরণ। বিনয় আর রাজদিয়ার সেই আদুরে, সরল কিশোরটি নেই। সে এখন এক পরিপূর্ণ যুবক। তার মধ্যে কখন যেন প্রখর আত্মসম্মানবোধ তৈরি হয়ে গেছে। সে কারও আশ্রয়ে থাকতে চায় না। স্বাধীনভাবে নিজের জীবন গড়ে তোলার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছে।
কী জবাব দেবে, ভেবে পেল না হিরণ।
দ্বারিক দত্ত নীরবে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এতক্ষণে মুখ খুললেন। হিরু, আমার একটা কথা বলার আছে।
হিরণ তার ঠাকুরদার দিকে তাকায়।
দ্বারিক দত্ত বলতে লাগলেন, বিনু যখন চাইছে, ওকে স্বাবলম্বী হতে দে। আমাদের নতুন বাড়ির দরজা তো খোলা রইলই। যখন ইচ্ছে চলে আসতে পারবে।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও হিরণ বলল, ঠিক আছে।
বিনয় আর হিরণদের শোবার ঘর দুটো পাশাপাশি নিজের ঘরে এসে শুয়ে শুয়ে অনেকক্ষণ সুধার ফোঁপানির আওয়াজ শুনতে পেল বিনয়। টের পেল, তার নিজেরও দুচোখ বাষ্পে ভরে গেছে।
.
দুদিন কেটে গেল।
আজ বিনয় শান্তিনিবাস-এ চলে যাবে। হিরণ তাকে পৌঁছে দিয়ে আসবে। তাই অফিসে ছুটি নিয়েছে। বিনয় আজ তার অ্যাসাইনমেন্ট অনুযায়ী কলোনি বা ত্রাণশিবিরে যাবে না। সেও ছুটি নিয়েছে।
মাঝখানের দুটো দিন সুধা ভাল করে খায়নি, ঘুমোয়নি। সেদিন রাতের মতো উতরোল কান্নাটা হয়তো নেই। তবে সারাক্ষণ যেন বিষাদপ্রতিমা। কাজের মেয়ে উমারও মন খারাপ। দ্বারিক দত্ত যদিও বলেছেন, বিনয় স্বাবলম্বী হোক, ভেতরে ভেতরে তিনিও কষ্ট পাচ্ছেন। জবুথবু, অথর্ব সরস্বতী, পৃথিবীর সমস্ত ব্যাপারে যিনি সম্পূর্ণ উদাসীন, নিজের রোগভোগ নিয়ে সর্বক্ষণ ব্যতিব্যস্ত, তিনিও ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়েছেন। বিনয়কে কাছে ডেকে তার দুটি হাত জড়িয়ে ধরে ধরা গলায় বলেছেন, যাস না বিনু। তুই চলে গেলে আমরা বড় কষ্ট পাব। বিনয় উত্তর দিতে পারেনি।
এই দুটো দিন মুহ্যমানের মতো কাটালেও সব দিকে সুধার নজর। পাকিস্তান থেকে আসার পর আনন্দ কটা ধুতি, শার্ট আর চাদর কিনে দিয়েছিল। যাকে রোজ বেরুতে হয়, ওই সামান্য পোশাকে কি চলে? তাই নিজে উমাকে সঙ্গে নিয়ে লেক মার্কেট থেকে নতুন কটা ধুতি, গরম কাপড়ের শার্ট, গেঞ্জি, চাদর, সোয়েটার কিনে নিয়ে এসেছে। শুধু তাই না, নতুন জায়গায় ভাই যাতে আরামে থাকতে পারে, তাই তোষক, বালিশ, বিছানার চাদর, লেপ এবং হোল্ড-অলও কিনেছে। তাছাড়া কিনেছে কটা কাপ প্লেট, কাঁচের গেলাস, বাথরুমের জন্য মগ, ঘরে পরার চটি, দাঁতের মাজন, জিভছোলা, ইত্যাদি।
দুপুরে খাওয়া দাওয়া চুকিয়ে বেরিয়ে পড়বে বিনয়। তাই সকালে উঠেই চাটা খেয়ে তার জিনিসপত্র গুছিয়ে ফেলল সুধা। জামাকাপড়, তোষক, বালিশ টালিশ-সমস্ত কিছু একটা সুটকেস আর হোল্ড-অলে ধরে গেল।
খাওয়া চুকতে ঢুকতে দুপুর পেরিয়ে গেল। এখন প্রায় দেড়টা।
হিরণ ট্যাক্সি ডেকে এনেছিল। শিখ ড্রাইভারকে সঙ্গে করে ওপরে এনে সে বিনয়ের মালপত্র নিচে পাঠিয়ে দিয়েছে।
এদিকে সুধা বিনয়কে ঠাকুর-ঘরে নিয়ে তেত্রিশ কোটি দেবদেবীকে প্রণাম করিয়েছে। তারপর সরস্বতী এবং দ্বারিক দত্তকে প্রণাম সেরে উমার মাথায় হাত বুলিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে লাগল । বিনয়। জাফর শা রোডের বাড়িটার আবহাওয়া দুটো দিন কেমন যেন নিস্তব্ধ হয়ে ছিল। সেটা আরও বিষাদময়, আরও থমথমে হয়ে গেল।
আগে আগে নামছিল হিরণ। তারপর বিনয়। পেছনে সুধা, উমা, দ্বারিক দত্ত। এমনকি সরস্বতীও ঘরে বসে থাকতে পারেননি। জরাজীর্ণ শরীর টানতে টানতে তিনিও সিঁড়ি ভাঙতে লাগলেন।
বাইরে এসে প্রথমে ট্যাক্সিতে উঠল হিরণ। বিনয় সুধার মুখের দিকে তাকাতে পারছিল না। অন্য দিকে চোখ রেখে বলল, চলি ছোটদি-
ঠিক ছিল, হিরণ তাকে শান্তিনিবাস-এ পৌঁছে দিয়ে আসবে কিন্তু সে ট্যাক্সিতে ওঠার আগেই আচমকা কী যেন হয়ে যায় সুধার। আমিও যাব– বলেই ট্যাক্সিতে উঠে পড়ে সে। আসলে ভাই কোথায় যাচ্ছে, কীভাবে থাকবে, সেখানে কতটা আরাম, কতটুকু স্বাচ্ছ প্য–নিজের চোখে না দেখা অবধি স্বস্তিবোধ করছিল না।
হতভম্বের মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর আস্তে আস্তে বিনয় উঠে সুধার পাশে বসে।
সুধার পরনে আধময়লা শাড়ি, ঘরোয়া ধরনে পরা। হিরণ হকচকিয়ে গিয়েছিল। বলল, এ কি, এ কি! যাবেই যখন, শাড়িটা পালটে এস।
সুধা বলল, দরকার নেই।
হিরণ জানে, সুধা ভীষণ জেদি। একবার যখন উঠে বসেছে, নামানো যাবে না। সে ড্রাইভারকে। বলল, চলিয়ে–।
ট্যাক্সি চলতে শুরু করে। বাইরে অজস্র মানুষ। বিপুল কলরোল। ধাবমান যানবাহনের বিরামহীন আওয়াজ। কিন্তু গাড়ির ভেতরটা আশ্চর্য রকমের নিঝুম। কেউ একটা কথাও বলছিল না।
রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে যায় বিনয়। রাজদিয়া থেকে আসার পর প্রথমে সুনীতিদের বাড়ি উঠেছিল সে। সেখান থেকে সুধাদের কাছে। তারপর প্রিয়নাথ মল্লিক রোডে তাদের সেই পুরানো বাড়ি হয়ে ফের জাফর শা রোডে। ক্রমাগত বাড়ি বদল। একের পর এক।
এবার শান্তিনিবাস। বিনয়ের মনে হল, জীবনের নতুন একটা পর্বে পা রাখতে চলেছে সে।
.
৫৫.
শীত ফুরিয়ে এসেছে। এই দুপুরবেলায় মহেশ হালদার লেনের মেস-বাড়ি অর্থাৎ শান্তিনিবাস-এ পৌঁছতে আধঘণ্টাও লাগল না।
ট্যাক্সি থামিয়ে প্রথমে নামল বিনয়। তারপর একে একে হিরণ এবং সুধা।
ওপর থেকে একটা গলা ভেসে এল, যাক, এসে গেছ। তোমার জন্যে ওয়েট করছিলাম।
বিনয় মুখ তুলে তাকায়। তেতলার রাস্তার দিকের টানা বারান্দায় রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছেন প্রসাদ। কাল অফিসে জানিয়ে দিয়েছিলেন, যতক্ষণ না সে শান্তিনিবাস-এ পৌঁছচ্ছে, তিনি মেসেই থাকবেন। নতুন জায়গা। মেসের প্রায় কারওকেই চেনে না বিনয়। তিনি না থাকলে ওর অসুবিধা হবে। বলেছিলেন, মেসে তার সব ব্যবস্থা করে দিয়ে আজ তিনি অফিসে যাবেন। কিন্তু প্রসাদ যে তেতলার বারান্দায় পথের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন, ভাবা যায়নি।
চোখাচোখি হতেই হাত তুলে প্রসাদ বললেন, দাঁড়াও, আমি আসছি।
একটু পরেই প্রসাদ নিচে নেমে এলেন। সঙ্গে সেই ছেলেটি। সুবল। আগে একবারই এখানে এসেছে বিনয়। সেদিন সুবলকে দেখে গিয়েছিল। ষোল সতেরো বছর বয়স। এই মেসেই কাজ করে।
বিনয়ের সঙ্গে হিরণ আর সুধাকে দেখে বেশ অবাক হলেন প্রসাদ।–এরা?
আমার ছোটদি আর ছোট জামাইবাবু প্রসাদের সঙ্গে হিরণদের পরিচয় করিয়ে দিল বিনয়।
ও, আচ্ছা আচ্ছা—
প্রসাদ বয়সে অনেক বড়। সুধা আর হিরণ তার পা ছুঁয়ে প্রণাম করে।
ওদিকে ট্যাক্সিওলা বিনয়ের হোল্ড-অল ব্যাগট্যাগ নামিয়ে ফেলেছিল। প্রসাদ সুবলকে বললেন, মালপত্র আমার ঘরের পাশের ঘরটায় নিয়ে যা
বলমাত্র জিনিসগুলো কাঁধে চাপিয়ে, হাতে ঝুলিয়ে চলে গেল সুবল।
হিরণ ট্যাক্সিভাড়া চুকিয়ে দিল। তারপর সবাইকে সঙ্গে করে শান্তিনিবাস-এ ঢুকলেন প্রসাদ। ভেতরে এসে একবার একতলার প্যাসেজের ডান পাশের ঘরটায় মুখ বাড়ালেন।
বিনয় লক্ষ করল, ঘরের মাঝখানে টেবলে একটা ঢাউস খাতার ওপর হুমড়ি খেয়ে সেই টাকমাথা, মাঝবয়সী, ভারী চেহারার লোকটা খুব মন দিয়ে কী সব লেখালেখি করছে। আগের দিনও তাকে। হুবহু একই ভঙ্গিমায় লিখতে দেখেছে সে।
প্রসাদ লোকটিকে বললেন, ম্যানেজারবাবু, আপনার নতুন বোর্ডার এসে গেছে। হিসেবপত্তর বন্ধ করে একটু ওপরে আসবেন?
লোকটা অর্থাৎ ম্যানেজারবাবু মাথা তোলে। নিকেলের গোল চশমার ওপর দিয়ে তাকিয়ে শশব্যস্তে বলে, হাতের কাজটা হয়ে এল। বাকিটুকু সেরেই যাচ্ছি প্রসাদকে সে যে যথেষ্ট সমীহ করে সেটা তার বলার ধরনে টের পাওয়া যায়।
প্রসাদ দাঁড়ালেন না। ম্যানেজারের সঙ্গে কথা শেষ করেই এগিয়ে চললেন।
আর-একটু ভেতর দিকে শ্যাওলা-ধরা মস্ত চাতালে বুকসমান উঁচু দুটো চৌবাচ্চা, গঙ্গাজল আর কর্পোরেশনের জলের কল, উঁই-করা এঁটো বাসনকোসন, ঝুলকালিমাখা রান্নাঘর, চারদিকের দেওয়াল থেকে জায়গায় জায়গায় পলেস্তারা খসার ফলে ঘায়ের মতো অজস্র দাগ-এ-সব দেখতে দেখতে মুষড়ে পড়ছিল সুধা।
পাশাপাশি চলতে চলতে তার ছোটদিটির দিকে নজর রাখছিল বিনয়। সুধার মুখচোখ দেখে টের পাচ্ছিল, এরকম একটা নোংরা, মলিন পরিবেশে ভাই থাকবে বলে তার মন ভীষণ খারাপ হয়ে গেছে।
প্রকাণ্ড মেস বাড়িটা এখন সুনসান। নিঃশব্দ। বোর্ডাররা যে যার কাজে বেরিয়ে গেছে। ওধারে রান্নাঘরের সামনের খোলা বারান্দায় মেসের কটা কাজের লোক তাস খেলছিল। ওরা ছাড়া আর কারওকে দেখা যাচ্ছে না।
চাতালটা ডান পাশে রেখে কয়েক পা এগুলেই ওপরে ওঠার সিঁড়ি। প্রসাদের সঙ্গে হিরণরা সিঁড়ি ভাঙতে লাগল।
তেতলায় নিজের ঘরের লাগোয়া যে ঘরটা প্রসাদ বিনয়ের জন্য ঠিক করে রেখেছিলেন, প্রথমে সবাইকে নিয়ে সেখানে গেলেন তিনি। দক্ষিণ দিকটা পুরোপুরি খোলা। রাস্তার ওধারে ঢ্যাঙা বাড়ি একটাও নেই। যা আছে তার বেশির ভাগই সেকেলে একতলা দালান। ক্কচিৎ দু-চারটে দোতলা। আর রয়েছে বেশ কিছু টিনের চালের চাপ-বাঁধা বস্তি। ফলে এত উঁচুতে বিনয়ের ঘরে আলো-হাওয়ার অভাব কখনও হবে না।
ঘরটা সবে চুনকাম করা হয়েছে। টাটকা চুনের ঝাঝালো গন্ধ নাকে আসছিল। আসবাব সামান্যই। একটা মান্ধাতার আমলের ন্যাড়া তক্তপোশ, একটা বেঁটে কাঠের আলমারি, দেওয়ালে ঝোলানো তাকওলা বড় একটা আয়না।
লটবহর মেঝেতে নামিয়ে রেখে একধারে অপেক্ষা করছিল সুবল।
প্রসাদ বললেন, অবিনাশ পাঁজা বলে এক ভদ্রলোক পঁয়ত্রিশ বছর এখানে ছিলেন। গেল সপ্তাহে রিটায়ার করে বর্ধমানে ওঁদের দেশের বাড়িতে চলে গেছেন। এখন থেকে এই ঘরটা বিনয়ের কথা বলছিলেন ঠিকই, তার চোখ কিন্তু ঘুরে ঘুরে সুধার দিকে চলে যাচ্ছিল। ওরা কেন বিনয়ের সঙ্গে শান্তিনিবাস-এ এসেছে আগেই সেটা মোটামুটি আঁচ করে নিয়েছিলেন। এবার বললেন, বয়েসে অনেক ছোট। তুমি করে বলছি কিন্তু
সুধা বলল, তাই তো বলবেন।
প্রসাদ জিজ্ঞেস করলেন, ভাইয়ের ঘর পছন্দ হয়েছে?
সুধা প্রশ্নটার জবাব না দিয়ে বলল, দেখুন, আমরা ইস্ট পাকিস্তানের সম্পত্তি এক্সচেঞ্জ করে টালিগঞ্জে বিরাট তেতলা বাড়ি পেয়েছি। সেখানে বিনুর জন্যে একটা বড় ঘর ঠিক করে রাখা আছে। কিন্তু ছেলে জেদ ধরে মেসে চলে এল– তার কণ্ঠস্বর থেকে দুঃখ, অভিমান, ক্ষোভ বেরিয়ে আসছিল। সরাসরি না বললেও মেসের ঘর যে পছন্দ নয়, সেটা বুঝিয়ে দিচ্ছিল সে।
বিনয়ের কাছে সবই শুনেছেন প্রসাদ। মৃদু হেসে বললেন, ভাইকে আগলে না রেখে একটু সাবালক হতে দাও না
পাশে দাঁড়িয়ে বিনয়ের মনে পড়ল, দ্বারিক দত্ত বিনয়ের স্বাবলম্বী হবার কথা বলেছিলেন। প্রসাদ বলছেন সাবালক হতে। একই ব্যাপার।
সুধা কী উত্তর দিতে যাচ্ছিল, তাকে থামিয়ে দিয়ে প্রসাদ বললেন, চল, আমার ঘরে গিয়ে বসা যাক- সুবলকে ডেকে পকেট থেকে টাকা বার করে দিতে দিতে বললেন, যা, চট করে গৌরাঙ্গ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকে নলেন গুড়ের সন্দেশ আর মিষ্টি দই নিয়ে আয়
তাদের আপ্যায়নের জন্যই যে সুবলকে পাঠানো হচ্ছে তা বুঝতে অসুবিধা হয় না সুধা আর হিরণের। তারা হইচই বাধিয়ে দেয়, না না, এখন কিছু আনাবেন না। আমাদের চান-খাওয়া হয়নি। বাড়িতে সব রান্না করা আছে। এখন খেলে ফিরে গিয়ে কী করে খাব?
প্রসাদ কোনও কথাই কানে তুললেন না। হাত নেড়ে সুবলকে পাঠিয়ে দিয়ে বললেন, তোমরা বিনয়ের বোন-ভগ্নীপতি। প্রথম দিন এসেছ। একটু কিছু মুখে না দিলে আমার ভীষণ খারাপ লাগবে। বাড়িতে গিয়ে দুটি ভাত না হয় কমই খাবে।
প্রসাদের আচরণে এবং কথাবার্তায় এমন একটা আন্তরিকতা মাখানো যে সুধারা আর আপত্তি করে না।
বিনয় বলল, ছোটদিরা খেয়ে আসেনি। আমাকে কিন্তু খাইয়ে এনেছে। এখন আর আমি কিছু খেতে পারব না।
প্রসাদ হেসে হেসে মজার গলায় বললেন, দিদি-জামাইবাবুকে সঙ্গ দেবার জন্যে দু-একটা সন্দেশ খেও। নইলে কি ভাল দেখায়? চল আমার ঘরে
সুধা ব্যস্তভাবে বলল, আমি বিনুর বিছানাটা পেতে, জামাকাপড়গুলো আলমারিতে গুছিয়ে দিয়ে যাচ্ছি।
সে হোল্ড-অল আর সুটকেস টুটকেসগুলোর দিকে পা বাড়িয়েছিল কিন্তু যাওয়া হল না। প্রসাদ খুব শান্ত গলায় বললেন, না, তোমাকে কিছু করতে হবে না। যা করার বিনয়ই করবে। এস
প্রসাদকে বেশ ভাল লাগছিল সুধার। অমায়িক। স্নেহপ্রবণ। মানুষকে নিমেষে আপন করে নেবার দুর্লভ ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু এই প্রথম টের পাওয়া গেল, প্রখর ব্যক্তিত্বের অধিকারীও। তিনি কিছু বললে অমান্য করা যায় না।
নিজের ঘরে এনে সবাইকে বসালেন প্রসাদ।
ভাইয়ের চিন্তাটা অবিরল মাথায় ঘুরছিল সুধার। সে বলল, এতদিন পাকিস্তানে দাদু দিদাদের কাছে থাকত বিনু। ইন্ডিয়ায় আসার পর আমার কাছে ছিল। ও কিছুই পারে না
প্রসাদ বললেন, এখন থেকে পারবে।
ভীষণ অন্যমনস্ক। খাওয়ার কথা মনে করিয়ে দিতে হয়।
আর মনে করাতে হবে না। তেমন খিদে পেলে ঠিক খেয়ে নেবে।
ভাইয়ের সম্পর্কে সুধার উদ্বেগটা আমলই দিচ্ছেন না প্রসাদ। তবু সুধা বিনু এটা পারে না, সেটা পারে নার লম্বা তালিকা আওড়ে যায়।
প্রসাদের বোধহয় মজাই লাগে। বলেন, ভাইকে তুলোর বাক্সে পুরে রেখেছিলে দেখছি। বাইরের আঁচ একেবারে গায়ে লাগতে দাওনি। তুমি যা যা বললে, এবার থেকে সেগুলো সব পারবে বিনয়। পুরুষ মানুষকে ভোলা বাতাসে ছেড়ে দিতে হয়। নইলে অপদার্থ হয়ে যায়।
প্রসাদের সূক্ষ্ম খোঁচাগুলো গায়ে মাখছিল না সুধা। সে বলে যায়, প্রসাদদা, বিনুর কাছে আপনার কথা অনেক শুনেছি। ও আপনাকে ভীষণ শ্রদ্ধা করে। ওকে একটু দেখবেন।
যেটুকু না দেখলে ও বিপদে পড়বে, ঠিক ততটুকুই দেখব। চিন্তা কোরো না।
সুবল মিষ্টি টিষ্টি নিয়ে এসেছিল।
একটা সন্দেশের কোনা ভেঙে মুখে পুরে অনিচ্ছাভরে চিবোতে চিবোতে সুধা বলল, এখানকার খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা কীরকম?
প্রসাদ এর মধ্যেই টের পেয়ে গেছেন, সুধা একটুতেই অস্থির হয়ে পড়ে, একটুতেই ব্যাকুল। বললেন, আমি কুড়ি বছর এই মেসে আছি। আমার থেকেও পুরনো বোর্ডার রয়েছে চার-পাঁচজন। এখানকার ডাল ভাত মাছের ঝোল খেয়ে দিব্যি বেঁচে আছি। আশা করি, বিনয়ও থাকবে।
খানিকক্ষণ চুপচাপ।
তারপর সুধা বলল, আমরা মাঝে মাঝে এসে বিনুকে দেখে যাব।
প্রসাদ বললেন, নিশ্চয়ই আসবে। যখন ইচ্ছে—
খুব শিগগিরই আমাদের নতুন বাড়ির গৃহপ্রবেশ হবে। দিন ঠিক হলে নেমতন্ন করে যাব। বিনুর সঙ্গে আপনি কিন্তু অবশ্যই যাবেন
যাব।
মেসের ম্যানেজার এসে ঢুকল। তাকে বসিয়ে বিনয়দের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন প্রসাদ। তার নাম মতিলাল চাকলাদার। তিন কুলে কেউ নেই। বহুকাল এখানে পড়ে আছে। এই মেসই তার ধ্যানজ্ঞান। তার জগৎসংসার।
বিনয়কে দেখিয়ে প্রসাদ বললেন, এই ছেলেটি আপনার নতুন বোর্ডার। এর কথা আগেই আমার কাছে শুনেছেন।
মতিলাল চাকলাদার ঘাড় হেলিয়ে দেয়, হা হা, অনেক বার।
জীবনে এই প্রথম বাড়ির বাইরে এসে থাকছে বিনয়। কাজের লোকেদের বলে দেবেন, যখন যা দরকার যেন ও পেয়ে যায়। আপনি নিজেও একটু লক্ষ রাখবেন, কোনওরকম অযত্ন না হয়।
মতিলালের আত্মাভিমানে খোঁচা লাগে। গলার স্বর সামান্য উঁচুতে তুলে সে বলে, প্রসাদবাবু, উনত্রিশ বছর শান্তিনিবাস-এ ম্যানেজারি করছি। একজন বোর্ডারও বলতে পারবে, এখানে তাদের অযত্ন হয়েছে? কারও অসুবিধে হচ্ছে কি না, ঘরে ঘরে গিয়ে আমি নিজে খোঁজখবর নিই–
ম্যানেজারের ক্ষোভটা উপশম করার জন্য প্রসাদ নরম গলায় বললেন, আপনি বোর্ডারদের সুখ সুবিধার জন্যে কী করেন তা এখানকার সবাই জানে। তবু কেন বললাম? বিনয়ের বোন-ভগ্নীপতি জেনে যাক, আসলে কার কাছে তাকে রেখে যাচ্ছে।
কথাগুলো বিশেষ করে সুধাকে শোনাবার জন্যেই যে বলা সেটা আন্দাজ করতে পারছিল বিনয়। চোখের কোণ দিয়ে একবার তার ছোটদিকে দেখে নিল। সুধা ভাইয়ের দেখাশোনার ভার দিতে চেয়েছিল প্রসাদকে। তিনি আবার সেটা ঠেলে দিতে চাইছেন মতিলালের দিকে। ফলে সে কতটা ভরসা পেল, বোঝা গেল না।
মতিলাল কাজের লোক। বলল, আমাকে আর কিছু বলবেন? যে হিসেবটা করছিলাম, এখনও মেলেনি। এখানে দরকার না থাকলে নিচে গিয়ে সেটা নিয়ে আবার বসব–
কথা তো হয়েই গেল। আপনি যেতে পারেন। প্রসাদ বলতে লাগলেন, আমারও অফিসে যাবার সময় হয়ে গেছে। আর দেরি করা যাবে না। এক্ষুনি বেরুতে হবে। বিনয় এবেলা খেয়ে এসেছে। বিকেলে ওকে চা পাঠিয়ে দেবেন।
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। একবার যখন শান্তিনিবাস-এর খাতায় নাম উঠেছে তখন বিনয়বাবুর সব চিন্তা আমার। ঘড়ির কাটার সঙ্গে মিলিয়ে সব পেয়ে যাবেন বলে মতিলাল ভারী শরীর টানতে টানতে চলে গেল।
সুধাদের দই-মিষ্টি খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। তারাও আর বসল না। বিনয় নিচের রাস্তা অবধি তাদের এগিয়ে দিয়ে ফিরে এল।
এর মধ্যে জামাকাপড় পালটে অফিসে যাবার জন্য তৈরি হয়ে নিয়েছেন প্রসাদ। বললেন, তুমি নিজের ঘরে গিয়ে মালপত্র গুছিয়ে নাও। সুবলকে বোলো সে তোমাকে হেল্প করবে।
আচ্ছা
দুজনে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল। প্রসাদ দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিয়ে বললেন, চল
বিনয় একটু অবাক হল। দরজায় তালা দিলেন না!
দরকার নেই। এই মেসের কাজের লোকেরা ভীষণ অনেস্ট। আমার টাকাকড়ি টেবলে পড়ে থাকে। কোনওদিন একটা পয়সাও এদিক ওদিক হয়নি। প্রসাদ বলতে লাগলেন, অফিস থেকে আমার ফিরতে ফিরতে রাত একটা দেড়টা হয়ে যাবে। তুমি অতক্ষণ জেগে বসে থেকো না। তোমার সময়মতো খেয়ে শুয়ে পোডো-
ভেতর দিকে টানা বারান্দা দিয়ে সিঁড়ির দিকে দুপা এগিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন প্রসাদ। বললেন, আরে, তোমাকে একটা কথা বলতেই ভুলে গিয়েছিলাম–
উৎসুক সুরে বিনয় জিজ্ঞেস করে, কী কথা?
হরিচরণ বসুর নাম শুনেছ?
বিনয় স্মৃতির ভেতর খানিকক্ষণ হাতড়ে বেড়ায়। তারপর একটু অবাক হয়েই বলে, না। তিনি কে?
প্রসাদ বললেন, একজন খুব বড় মাপের ফ্রিডম-ফাইটার। ব্রিটিশ আমলে প্রচুর নির্যাতন ভোগ করেছেন। জেল খেটেছেন পনেরো ষোল বছর। আমাদের এই মহেশ হালদার লেনেই থাকেন।
হঠাৎ এই অদ্ভুত সময়ে, অফিসে বেরুবার মুখে, একজন স্বাধীনতা-সংগ্রামীর প্রসঙ্গ কেন তুললেন প্রসাদ, বোঝা যাচ্ছে না। বিনয় তার দিকে তাকিয়েই থাকে।
প্রসাদ বলতে লাগলেন, ইনি নতুন ভারত-এ তোমার কলাম দুটো রেগুলারলি পড়ছেন। আমার কাছে খুব প্রশংসা করেছেন। আজ থেকে তুমি শান্তিনিবাস-এ থাকবে শুনে ভীষণ খুশি। তোমার সঙ্গে আলাপ করতে চান।
তার লেখা দেশের মুক্তিযুদ্ধের একজন সৈনিকের ভাল লেগেছে, শুনে ভেতরে ভেতরে উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে বিনয়। অবশ্য খানিকটা বিস্ময়ও বোধ করে। অত বড় একজন মানুষ আমার মতো সামান্য রিপোর্টারের সঙ্গে আলাপ করতে চাইছেন কেন?
পার্টিশান নিয়ে কী সব আলোচনা করবেন।
বিনয় উত্তর দিল না।
প্রসাদ বললেন, উনি মাঝে মাঝে আমাদের মেসে চলে আসেন। খানিকক্ষণ গল্প টল্প করে যান। আজও তোমার জন্যে চলে আসতে পারেন।
বিনয় ব্যস্ত হয়ে পড়ে।–উনি কষ্ট করে আসবেন কেন? ঠিকানাটা দিন। আমি নিজেই গিয়ে দেখা করব।
তোমার সংকোচের কারণ নেই। হরিচরণবাবু চমৎকার মানুষ। সবরকম অহমিকা থেকে মুক্ত। উনি যখন আসতে চেয়েছেন, আসুন না। পরে একদিন ওঁদের বাড়িতে গিয়ে দেখা করে এস–
প্রসাদ আর দাঁড়ালেন না। সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে নেমে গেলেন।
বিনয় নিজের ঘরে ঢুকে পড়ে। এখানেই এক কোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল সুবল। তাকে ডেকে নিয়ে দুজনে ধরাধরি করে প্রথমে বিছানা পেতে নিল। তারপর জামাকাপড় আলমারিতে গুছিয়ে রাখল। ঘরের দেওয়ালে বেশ কটা সিমেন্টর তাক। দাঁতের মাজন, জিভছোলা, দাড়ি কামাবার ব্লেড, সাবান, নারকেল তেলের টিন–টুকিটাকি নানা জিনিস সেগুলোতে ধরে গেল।
লেখাপড়ার জন্য এ-ঘরে টেবল চেয়ার নেই। বিনয় ঠিক করে ফেলে, আজই বিকেলের দিকে একবার বেরিয়ে কাছাকাছি কোনও আসবাবের দোকান থেকে কিনে আনবে। দামি কিছু নয়, কাজ চলে গেলেই হল।
সকাল থেকে তেমন কোনও পরিশ্রম হয়নি। কিন্তু সুধাদের বাড়ির নিরানন্দ আবহাওয়া, সবার বিষণ্ণ মুখ, ওদের ছেড়ে আসার জন্য নিজের ভেতরকার চাপা কষ্ট–সব মিলিয়ে ক্লান্তি বোধ করছিল বিনয়। সুবলকে বলল, এখন আর কিছু দরকার নেই। তুমি বিশ্রাম কর গে।
সুবল চলে যাবার পর শুয়ে পড়ে বিনয়। সঙ্গে সঙ্গে তার দুচোখ জুড়ে গভীর ঘুম নেমে আসে।