৫১-৫৫. আপিসে এলো মালু

৫১.

আপিসে এলো মালু।

প্রথমেই এগিয়ে এল করিম মিঞা। গাল ভরা তার হাসি। চোখ ভরা খুশি।

বলল, পেয়েছি।

কী পেয়েছ, শুধাল মালু।

ওই যে ডাক? স্যারও না। হুজুরও না, ভাই। কৃতিত্বের আনন্দে চকচকিয়ে যায় করিম মিঞার চোখ।

ভাই? বাহ্ চমৎকার তো, ছোট বড় আমরা সব ভাই, তাই না করিম মিঞা?

নতুন সম্বোধনটা খুব পছন্দ হয়ে যায় মালুর, সহকারী ইয়াসীনেরও। সেও হাসছে মিটি মিটি।

কিন্তু, এই তিন মাস করিম কী শুধু এ কথাটাই ভেবে চলেছে? চোখে শ্রদ্ধা ঝরিয়ে ওর দিকে তাকায় মালু।

কী ইয়াসীন সাহেব! ওপক্ষের খবর কী? করিমকে ছেড়ে এবার ইয়াসীনের দিকে মন দেয় মালু।

লজ্জায় রাঙিয়ে ওঠে ইয়াসীন। ফাইলের আড়ালে মুখ লুকিয়ে ছোট্ট করে বলল, পরীক্ষা তো শুরু হয়েছে।

শুরু হয়েছে? তবে আর ভাবনা কী?

ইয়াসীনের চেয়ে মালুরই যেন বেশি ফুর্তি। চেয়ার ছেড়ে উঠে আসে ও। ইয়াসীনের কাঁধে হাত রেখে বলে, মক্কার মিনার তা হলে দেখা যাচ্ছে? লাজুক হাসিতে রাঙিয়ে যায় ইয়াসীনের কালোপানা মুখখানি।

ভাই করিম। এসো এদিকে। লাগাও চা মিষ্টি। করিমের হাতে দুটো টাকা তুলে দিল মালু। বলল আবার : খবর টবর রাখ কিছু?

পরীক্ষা হচ্ছে তো!

খবর কী আর রাখেন করিম মিঞা! ইয়াসীনের ওপক্ষের খবরটা এ আপিসের অনেকেই তো রাখে। তিন বছর ধরে ওপক্ষের সাথে ঝুলে রয়েছে ইয়াসীন। কিন্তু ওপক্ষ বড় কড়া পক্ষ। বলে রেখেছে, ম্যাট্রিক পাস না করে একটা চাকরির ব্যবস্থা না করে বিয়ে টিয়ের কথা কানেই তুলবে না।

প্রতীক্ষার ধৈর্যে আপন অনুরাগকে লালন করে আসছে ইয়াসীন। বিগত তিনটি বছর প্রতিদিন নতুন নতুন কল্পনার রং ফেলে চলেছে প্রত্যাশিত সেই একটি দিনের স্বপ্নে। অবশেষে শুরু হয়েছে ম্যাট্রিক পাসের পরীক্ষাটা। করিম মিঞাও খুশি খুশি চোখের এক ঝলক হাসি ছড়ায়। তারপর বেরিয়ে যায় মিষ্টি কিনতে।

অনেকদিন পর আপিসে এসেছে মালু। দেখা সাক্ষাৎ, এ কামরা সে কামরা গল্প করেই কাটিয়ে দিল দিনটা। একেবারে শেষ ঘণ্টায় দু একটা ফাঁইলের উপর চোখ বুলিয়ে বাড়ি ফেরার জন্য উঠে দাঁড়াল ও, বেজে উঠল টেলিফোন।

রাবু বলছে : আমি যাচ্ছি তোর বাসায়, দরকারী কথা আছে তোর সাথে। শীগগির চলে আয়।

বাসায় এসে দেখল মালু, রাবু পৌঁছে গেছে, নতুন বাসার ঘরগুলো ঘুরে ঘুরে দেখছে। প্রশংসায় কলকলিয়ে তুলছে ওদের নীরব আঙ্গিনা। পাক ঘরে গিয়ে চেখে দেখছে নতুন বৌর রান্না।

মালুকে দেখে প্রশংসার তোড়টা যেন বেড়ে যায় রাবুর। বলে, ভারি লক্ষ্মী বৌ তোর সাত রাজার ভাগ্যি মালু, এমন বৌ পেয়েছিস, মাথায় তুলে রাখবি। বুঝলি? তারপর সোনাবরণ হাত দিয়ে রিহানার চিবুকটা তুলে ধরে আদর করে রাবু।

গল্প গুজবে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাতটাও কিছু দূর গড়িয়ে যায়। তবু দরকারী কথাটায় আসে না রাবু।

এক সময় উঠল রাবু, যাবার আগে রিহানার হাতটা ধরে বলল : কাল রাতে আমার বাসায় তোমাদের দু জনের দাওয়াত রইল। আগে আগেই এসে পড়ো। গল্প করা যাবে। কেমন?

ওকে রিকশায় তুলে দিতে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে এল মালু।

মালু, চাকরিটা আমি ছেড়ে দিলাম, রাস্তায় নেমে বলল রাবু।

 হঠাৎ? কী ব্যাপার?

ব্যাপার দেশে যাচ্ছি। কালই যাচ্ছি।

কালই? কেন? কী এক উদ্বেগ মালুর কণ্ঠে।

আব্বা ফিরে এসেছেন বাড়িতে। এই শেষ বয়সে একটু সেবা যত্ন কী তাঁর প্রাপ্য নয়?

কী তার প্রাপ্য আর কী নয়, সে আমি জানি না। কিন্তু, তুমি কী শুধু তাঁর সেবার জন্যই দেশে চলেছ?

জবাব না দিয়ে রিকশায় চড়ে বসল রাবু। বলল, ও কথা বাদ দে। যে জন্য তোর কাছে আসা, মেজো ভাইকে একটা খবর দিতে পারবি? দুপল কী যেন ভাবল রাবু, বলল আবার, না খবর নয়, একেবারে সঙ্গে করে নিয়ে আসবি আমার বাসায়।

কেন, মেজো ভাই বাসায় নেই?

তা হলে কী আর তোর কাছে ছুটে আসতে হত? বেঘোরে পড়ে কোথায় কখন যে মরে থাকবে লোকটা? আল্লাহ জানে।

মালু কী ভুল শুনল? না, ভুল দেখল? কেমন ভেঙে ভেঙে গেল রাবুর কম্পিত কণ্ঠ। চোখের কোণে দুটো মুক্তোর বিন্দু চিক চিক করে ঝরে পড়ল অকস্মাৎ।

কোনো কিছু শুধাবার আগেই মালু দেখল, রাবুকে নিয়ে বেশ কিছু দূর এগিয়ে গেছে রিকশাটা।

নতুন রাস্তার বিরল আলোর মিটি মিটি ছায়ায় মালুর চোখের সুমুখে ভেসে উঠল আর এক ছবি। কানে এসে বাজল অনেক কথা। কলকাতার দাঙ্গা থেমে গেছে। মেয়েদের কলেজের সেই আশ্রয় শিবিরটা গুটানোর কাজে ব্যস্ত রাবু আর জাহেদ। গেইটেই ওদের সাথে দেখা। কোনো কথা নয় এখুনি পাকড়াও কর ওকে, বলল জাহেদ।

নিশ্চয়। এখুনি। বলল রাবু।

মালুকে একরকম লুফে নিয়েই ট্রামে চড়ে বসল ওরা।

কয়েকদিন আগে বেশ বড় ধরনের একটা সাংস্কৃতিক জলসা বসেছিল পার্ক সার্কাস ময়দানে। সেখানে প্রচুর হাততালি পেয়েছে মালু। সেটাকে উপলক্ষ করে আজ ওকে খাওয়াবে জাহেদ এবং রাবু।

শুনলাম তোর গান। ভালো লাগল আর বুকটা কী এক গর্বে ভরে গেল। ট্রামে বসে বলল রাবু।

উত্তর না দিয়ে অপলক চোখে রাবুকেই দেখছে মালু। সেই দাঙ্গাবিরোধী মিছিলগুলোর শেষে রাবুর মুখে যে আনন্দিত দীপ্তি দেখেছিল মালু সে দীপ্তি যেন আরও উজ্জ্বল আরও প্রখর হয়েছে। এখন জাহেদের সাথে রাবুও বজবজ আর গার্ডেনরীচের বস্তি এলাকায় ঘুরে বেড়ায়, মিটিং করে, বক্তৃতা দেয়। জাহেদের সব কাজের সঙ্গী ও। বুঝি সেই কর্মের আনন্দটাই আশ্চর্য এক সৌন্দর্যের ছটা হয়ে লেপে রযেছে রাবুর মুখে। আর রাবু যেন ফিরে পেয়েছে সেই চৌদ্দ বছর বয়সের হারিয়ে যাওয়া হাসিটা বাব্বা। এ্যাদ্দিনে সেই পুরনো হাসিটা ফিরে এল মুখে, বলল মালু।

তুই এ সবের কী বুঝিসরে? কপট ধমকে ওকে থামিয়ে দেয় রাবু। চৌরঙ্গীর কোনো আধা বিলেতী আধা দেশীয় রেস্তোরাঁয় একটা টেবিলে মালুর সঙ্গীত সাফল্যের উৎসব বসাল ওরা।

ওরা ফিরে গেল অতীতে, বাকুলিয়ায়, তালতলিতে। ওরা স্মরণ করল সেকান্দর মাস্টারকে, লেকু-কসিরকে। ফেলু মিঞাকেও। ওরা চলে এল বর্তমানে। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎটাকেও চোখের সামনে যতটা সম্ভব স্পষ্ট করে তুলে ধরতে চাইল ওরা।

আর একদিন খেতে খেতে রাবুকে যে কথাটা বলেছিল আজ এক ফাঁকে জাহেদকেও সে কথাটাই বলল মালু। বলল, মেজো ভাই, এবার বিয়েটা করে ফেল।

দেশ জুড়ে স্বাধীনতার লড়াই। এ সময় বিয়ে? ক্ষেপেছিস তুই? জাহেদ উড়িয়ে দিতে চাইল মালুর আবদারটা।

হটবার পাত্র নয় মালু। মালু বলল, এটা কোনো যুক্তির কথা হল না, মেজো ভাই।

কেন?

তুমি কী বলতে চাও তোমার বন্ধু ওই অজিতদার চেয়ে বেশি কাজ কর তুমি? অজিতদার চেয়ে বেশি ত্যাগ তোমার? অজিতদা তো বিয়ে করেছে মালতিদিকে। তোমার চেয়ে স্বাধীনতার লড়াই কী কম করছেন তারা? একটা হাল্কা কথার উত্তরে এমন গুরুগম্ভীর কথা পাড়বে মালু, ভাবতে পারেনি জাহেদ। মুহূর্তের জন্য হকচকিয়ে গেল ও। তারপরই হেসে উঠল সশব্দে। হা আল্লা! কোথায় জাহেদ, কোথায় অজিতদা। কোথার মালতি দি আর কোথায় সৈয়দ রাবেয়া খাতুন। ছি। সত্যি বলছি মালু, তোমার মাথা খারাপ হয়েছে।

মাথা যে খারাপ হয়নি মালুর সেটা সবিস্তারে এবং সপ্রমাণে উপস্থিত করছিল মালু কিন্তু ততক্ষণে অন্য দিক থেকে এসে গেছে কঠিনতর প্রতিবাদ। রাবেয়া খাতুন কী কখনও মালতি দির সাথে তুলনা করেছিল নিজের? আহত, বুঝি বা অপমানিত কণ্ঠ রাবুর।

ওই দেখ আর একজন গাল ফুলিয়েছে। জোর করেই হাসল জাহেদ। বলল আবার, আরে আমি কী তুলনা করছিলাম? কথার পিঠে একটা কথা এসে পড়ল, এই তো।

মোটেই না। কথার পিঠে আসার মতো কথা এটা নয়।

পাশাপাশি যারা বাস করে, এক সাথে কাজ করে তাদের মাঝে শ্রেষ্ঠ এবং সাধারণ, উত্তম এবং অধমের তুলনা আসবে। না আসাটাই তো অস্বাভাবিক। মালতির সাথে তুলনাতে আপত্তি নয় রাবুর। রাবুর আপত্তি–যে তুলনা আমি কখনও করিনি, যেখানে আমার ক্ষুদ্রত্ব আর অকিঞ্চিৎকর অস্তিত্ব নিয়ে আমি নিজেই ব্ৰিত, জীবনটাকে কিছু মাত্র অর্থপূর্ণ করে তোলার জন্য আমার চেষ্টার অন্ত নেই সেখানে কেন তুমি বারবার খোঁচা দেবে? পানিতে টলটল করছে রাবুর চোখ জোড়া। এখুনি বুঝি কেঁদে ফেলবে রাবু।

দেখছিস মালু? মাথা শুধু তোরই খারাপ হয়নি, এই মহিলারও মাথা খারাপ হয়েছে। পরিহাসের স্বরে আবহাওয়াটাকে সহজ করতে চাইল জাহেদ। আমি পাগল, এ কথাই তো বলবে তুমি। কোনোদিন তো পারলে না আমাকে সম্মানের মর্যাদা দিতে। হিতোপদেশ, নীতি কথা, উপহাস, করুণা, ভালোবাসার নামে অনুকম্পা এ সবই তো পেয়ে আসছি ছোট বেলা থেকে। আর কেন মেজো ভাই… জাহেদ… আমি আর সহ্য করতে পারি না…কথার দমকে দমকে দ্রুততর রাবুর বুকের উঠানামা। মালুর মনে হয় বিশাল কোনো সমুদ্রের জলরাশি এখুনি আছড়ে পড়বে সে বুকের বাঁধ ভেঙে। কেমন করে, কোন কথা তুলে এই অপ্রীতিকর প্রসঙ্গটা চাপা দেবে ভেবে পায় না মালু।

থ মেরে গেছে জাহেদ। কোত্থেকে কোথায় এসে গেছে রাবু।

যেন মালুরই অনুচ্চারিত প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে এসে গেল একদল ছেলে মেয়ে, রাবু এবং জাহেদেরই বন্ধু। ওরা খেতে এসেছে। যে দম্পতিকে কেন্দ্র করে এত কথা সেই অজিত এবং মালতিও আছে দলের ভেতর। মালুদের টেবিলের পাশে এসেই বসল ওরা। তর্ক করতে করতেই ঢুকেছিল ওরা। টেবিলে এসে তর্কটা আরো তুমুল হল।

দেখে নিও নুরেমবার্গ ট্রায়ালে কিচ্ছু হবে না।

মানে? তুমি কী বলতে চাও লক্ষ কোটি নির্দোষ নর-নারীর রক্তে যাদের হাত রঞ্জিত সেই নাৎসী ঘাতকদের শাস্তি হবে না?

দু চারটে চাঁইকে লোক দেখানো শাস্তি দিলেও দিতে পারে কিন্তু বেশির ভাগই পার পেয়ে যাবে। দেখছ না ইংরেজ আর মার্কিনরা ইতিমধ্যেই জার্মানীর পশ্চিম অংশে ব্যবসা করতে লেগেছে, ওদের পিঠ চাপড়াতে শুরু করেছে?

অসম্ভব। মানুষের ইতিহাসে জঘন্যতম অপরাধে অপরাধী যে হিটলার তার পাপের দোসরগুলোকে সমুচিত শাস্তি দেবে না এমন বিচারক নেই পৃথিবীতে। পৃথিবী দেখেছে হিটলারের গ্যাস চ্যাম্বার অসউইজ, বুখেন ওয়ার্ল্ড, পাইকারী নরহত্যা, শিশু হত্যা। এ পাপ মানুষ কখনো ক্ষমা করবে না।

সিরাজ এ তো তোমারই মনের বাসনা। ব্রিটিশ সরকারের মনোভাবটা যে কী সে তো ভারতকে দিয়েই বুঝতে পারছ। যুদ্ধের সময় মানবতার বুলি খই ফুটিয়েছে চার্চিলের মুখে। আর এখন? সোজা বলে বসল, ভারতকে স্বাধীনতা দেয়া হবে না। ইয়াল্টা চুক্তির কালি এখনো শুকোয়নি, কিন্তু ইতিমধ্যেই সে চুক্তি ভঙ্গ করতে লেগেছে ওরা।

না ভাই, স্বাধীনতার কথা যদি বল তবে আমি বলব এটা আমাদেরই মোহ। গোল টেবিলে বসে স্বাধীনতা পাওয়া এ আমি বিশ্বাস করি না।

জাহেদও যোগ দিয়েছে ওদের তর্কে।

ইয়াল্টা থেকে পটসড্যাম, জাঞ্জিবার থেকে জিব্রাল্টার, জেনী লী থেকে রুশ বীরাঙ্গনা তানিয়া, মেদিনীপুরের মাতঙ্গিনী হাজরা–ওদের তর্কালাপের পরিধি বেড়েই চলে।

মালু আর রাবু নীরব শ্রোতা। এক সময় উঠে পড়ল ওরা। জাহেদের দিকে একবার তাকাল। ইশারায় বোঝাল জাহেদ-তোমরা যাও, আমি এখানেই আছি।

বড় অন্যায় করলাম। অহেতুক কষ্ট দিলাম জাহেদের মনে। রাস্তায় পড়ে বলল রাবু।

আমি তো অবাক হচ্ছিলাম। অমন আনন্দিত পরিবেশে সহসা নিরানন্দকে ডাকলে কেন তুমি? বুঝি উত্তরের প্রত্যাশায় রাবুর মুখের দিকে তাকাল মালু।

রাবুর চোখে থমথমে অন্ধকার। রাবুর মুখে অরুদ কোনো বেদনার কান্না। মার নিজেরই ভ্রম হয় মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে ট্রামে ওর পাশে বসেছিল আনন্দের ঔজ্জ্বল্যে দীপ্তিময়ী যে মেয়ে সে বুঝি অন্য কেউ।

রাবু আপা, তোমার অনেক দুঃখ, মেজো ভাইয়ের অনেক কষ্ট। আমার একটুও ভালো লাগে না।

শত দুঃখেও মানুষ হাসে। বুঝি তেমনি হাসল রাবু। বলল, আমাদের দুঃখে তোর বুঝি ঘুম হয় না?

সত্যি ঘুম হয় না আমার বিশ্বাস কর রাবু আপা।

আবারও হাসল রাবু। বলল, তুই এখনও সেই বার বছরের খোকাটিই রয়ে গেছিস। হারে এখনো কী কথায় কথায় কেঁদে বুক ভাসাস তুই? মালু বুঝল সহজ হয়ে আসছে রাবু। নীরবে রাবুর কথাগুলোই শুনে গেল ও।

আসল কথা কী, জানিস? আমাদের একান্ত ব্যক্তিগত আর ছোট ছোট দুঃখ কষ্টগুলোকে অযথা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বড় করে দেখি আমরা। আর সত্যিকার বড় বড় দুঃখ যা তোর আমার ব্যক্তিগত কষ্ট বা দুঃখ নয়, যা বিশাল মানব গোষ্ঠীরই দুঃখ সে সব হয় আমাদের স্পর্শ করে না, অথবা কিছুক্ষণের জন্য ব্যথিত হয়েও ভুলে যাই সহজে।

বুঝলাম না। বুঝবার আশায় রাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল মালু। আমার নিজের কথাটাই ধরা যাক। অল্প বয়সে, যখন আমার কোনো বুদ্ধি গজায়নি, বাবার পছন্দমতো বরের সাথে তিনি বিয়ে পড়িয়েছেন আমার। খুবই অন্যায়। কিন্তু এ রকম অন্যায় ঘটনা তো রোজই ঘটছে আমাদের দেশে। এর চেয়েও সহস্রগুণে কঠিন এবং নৃশংস পীড়নে ভুগছে আমাদের দেশের মেয়েরা। তাই না?

নিশ্চয়। একমত হয়ে ঘাড় নাড়ল মালু।

একটু আগে মুখে মুখে ঘুরছিল কয়েকটি নাম-মিউনিক, ডানকার্ক, লেনিনগ্রাড, প্যারি, বুশেনওয়াল্ড–এই এক একটি নামের পেছনে পৃথিবীর লক্ষ কোটি মানুষের কত ত্যাগ, কত যন্ত্রণা, কত দুঃখ। মানব জাতির এত বড় দুঃখের পাশাপাশি আমার এই ব্যক্তিগত দুঃখটা কী তুচ্ছ আর হাস্যকর নয়? গভীর আবেগে কম্পিত স্বর রাবুর। এক নিশ্বাসেই কথাগুলো বলেছিল রাবু। তারপর উদাস চোখে চেয়েছিল দূর পথের দিকে।

কলকাতায় রাবু এবং জাহেদের সাথে এটাই মালুর শেষ সাক্ষাৎ। এর কিছু দিন পর লন্ডন আর দিল্লী থেকে যুগপৎ এক ঘোষণা প্রচারিত হয়েছিল। সে ধাক্কায় ওরা সবাই চলে এসেছিল ঢাকায়।

ঢাকায় এসে ব্যক্তিগত প্রসঙ্গগুলো তোলেনি মালু। রাবুও না। বাড়ি ছেড়ে স্কুলের শিক্ষিকার চাকরি নিয়ে কেন আলাদা বাসা করেছে রাবু, সে প্রশ্নও শুধায়নি মালু। শুধায়নি শিক্ষিকার খুঁটিনাটি ব্যস্ততার জীবনে কোথায় ঠাঁই দিয়েছে মেজো ভাইকে?

কিন্তু, এ কী জীবন বেছে নিচ্ছে রাবু! প্রজাপতির মতো রঙিন পাখনা উড়িয়ে কতো মেয়েই তো এই নতুন রাজধানীতে এনে দিয়েছে বর্ণের শোভা! কই, ওরা তো, তোমার মতো নয়? ওদের হাসির চমকে বাতাস উত্তীর্ণ। ওদের চরণ ছোঁয়ায় মুখর শতাব্দীর ধূলো জমা এ শহরের পথ। এই শহরের নব ছন্দের গান ওদের কণ্ঠে। কই, ওরা তো তোমার মতো হাল্কা বাতাসের উড়ো পথটাকে দুঃখের কাঁটা ছড়িয়ে দুর্গম করে তোলেনি? দুর্নিবার ইচ্ছা জাগল মালুর, দৌড়ে গিয়ে প্রশ্নটা শুধিয়ে আসুক রাবুকে। দুকদম এগিয়ে আপন মনেই হেসে উঠল মালু। রিকশাটা হয়ত এতক্ষণে রাবুকে ওর বাসায় নামিয়ে দিয়ে ছুটছে অন্য কেরায়ার পেছনে।

৫২.

সকাল সকাল হাজিরা বইতে একটা সই মেরে বেরিয়ে পড়ল মালু।

জাহেদের কয়েকটা আড্ডার খবর জানত মালু। আর চিনত তার দু একজন বন্ধুকে। সে সব আড্ডায় গেল ও। সে সব বন্ধুদের কাছে খোঁজ নিল। তাদের মুখে শুনে আরও কত বাসায় পাত্তা লাগাল মালু। কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না জাহেদকে। কেউ বলল, এই তো সেদিন খেয়ে গেছে। কেউ বলল, গেছে চাটগাঁয়। কেউ বা বলল শ্রীহট্টে। নির্দিষ্ট সমাচার কারো কাছেই নেই।

পার্ক স্ট্রীটের বাড়িটা শান্তি নগরে কিছু জমি আর একটা দোতলা বাড়ির সাথে বদল করেছে সৈয়দরা। কোনো অর্থ হয় না সেখানে খোঁজ করার। তবু সেখানেও গেল মালু।

মালুর কপাল। সৈয়দ সাহেব আপিসে ছুটি নিয়ে বাড়িতেই অবস্থান করছেন, এটা জানার কথা নয় ওর। আর পড়বি তো পড়, সৈয়দ সাহেবের সামনেই পড়ে গেল মালু।

প্রশ্ন শুনে তেলে বেগুনে হলেন সৈয়দ সাহেব। ওই বদমাইশটার খোঁজ নিতে এসেছ বাড়িতে? বাড়িতে তো ভদ্রলোকেরা থাকে। সে কী ভদ্রলোক? সে তো ভেগাবন্ড, কুলি মজুর আর দুনিয়ার যত কমজাত কমবখত ছোট লোকদের সাথে সে। সেখানে খোঁজ নাও গিয়ে।

মালু মরিয়া। যেমন করে হোক জাহেদের খোঁজ তো ওকে পেতে হবে। ও শুধাল কিন্তু বাড়িতে কী মাঝে সাঝেও আসেন না তিনি? শেষ কখন এসেছিলেন?

বাড়ি আসবে? বাড়ি এলে ওর ঠ্যাং ভেঙে দেব না আমি? জান? ওই কমবখতটার জন্য আমার একটা প্রমোশন আটকে রয়েছে?

অধিক প্রশ্ন নিরর্থক। সিঁড়ি ধরে নেবেই যাচ্ছিল মালু। কিন্তু সিঁড়ির মাথায় ফুটফুটে একটি মেয়ে ওর ছোট্ট হাতের ইশারায় থামতে বলল মালুকে। কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলল, দাদী তোমাকে ডাকছে। সিঁড়ি ধরেই আবার উঠে আসছিল মালু। মেয়েটি বলল, উঁহু পেছন দিয়ে এসো। বাড়ির দক্ষিণ পাশে খিড়কি দরজা, পুরানো আমলের মতো। সেই দরজা দিয়ে মেয়েটা মালুকে নিয়ে গেল ভেতরে। মালু দেখল বারান্দায় বসে সৈয়দগিন্নী শাড়ির আঁচলে চোখ মুছছেন। পায়ে হাত দিয়ে সালাম করল মালু। মালুকে দেখেই অঝোর কান্নায় ভেঙে পড়লেন সৈয়দগিন্নী। কাঁদতে কাঁদতে সৈয়দগিন্নী যা বললেন তার সারার্থ–মাস দুই আগের কথা। হঠাৎ রাতের বেলায় এসেছিল জাহেদ। তিরিশটা টাকা চেয়ে নিয়েছিল। রুই মাছ দিয়ে প্রচুর ভাত খেয়েছিল, মনে হচ্ছিল অনেক দিন খায়নি। রাত বাড়তেই চলে গেছিল। তারপর কিছুলোক ওর খোঁজ খবর করে গেছে। সৈয়দগিন্নীর সন্দেহ সরকারের যে দফতরের অন্যতম মাথা সৈয়দ সাহেব স্বয়ং, লোকগুলো সেই স্বরাষ্ট্র বিভাগেরই। অর্থাৎ সাদা পোশাক পুলিশ। ছেলের কোনো খোঁজ পান না সৈয়দগিন্নী। ছেলেকে একবারটি দেখেছেন সেই দুমাস আগে। কেঁদে কেঁদে বুক ভাসিয়ে চলেছেন সৈয়দগিন্নী। মালু যেন অবশ্যই তাকে খুঁজে বের করে অন্তত কিছুক্ষণের জন্য পাঠিয়ে দেয় মায়ের কাছে।

এই প্রসঙ্গে সৈয়দ সাহেব সম্পর্কেও নিজের অভিমতটা তিনি খোলাখুলি ব্যক্ত করলেন। বললেন, বুড়োর ভীমরতি ধরেছে। উঠতে বসতে ছেলের মুণ্ডপাত করে চলেছেন। সকাল বিকাল মুখে শুধু এক কথা-প্রমোশন প্রমোশন। প্রমোশন প্রমোশন করেই বুড়ো পাগল হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই সৈয়দগিন্নীর।

সৈয়দগিন্নীকে সালাম করে বিদায় নিল মালু। বারান্দাটা পার হয়েই আবার মুখোমুখি পড়ল সৈয়দ সাহেবের। আপন মনেই আফসোস করে চলেছেন সৈয়দ সাহেব, ওই কমবখত্ কমজাতটার জন্যই তো! নইলে আমার দু বছরের জুনিয়ার সে উঠে যায় আমার উপরে?

বুঝি হঠাৎ চোখে পড়ে মালুকে। খেঁকিয়ে ওঠেন, এই ছোকরা! তুমি এখনো এ বাড়িতে? বের হও।

বেরিয়ে এল মালু। চলতে চলতে ভাবল মানুষের লোভের কী শেষ নেই? পাকিস্তানের বদৌলতে সৈয়দ সাহেব ধাই ধাই করে উপরে উঠছেন, আড়াই বছরে তিনটি পদোন্নতি পেয়েছেন। চতুর্থ পঞ্চম বা তার পরেও যদি উপরে উঠবার জায়গা থাকে সেখানে পৌঁছুবার সুযোগ তিনি হয়ত পাবেন একটু ধৈর্য ধরলেই। তবু কেন এত অতৃপ্তি, এত অধৈর্য সৈয়দ সাহেবের?

আরিফার ইঞ্জিনিয়র স্বামীর বাসাটা নীলক্ষেত। সেখানেও ঢুঁ মারল মালু। কিন্তু আরিফা বা তার স্বামী কাউকে পাওয়া গেল না। আরিফার ছেলেটা বলল, সিদ্ধেশ্বরীতে আমাদের নতুন বাড়ি উঠছে, আব্বা আম্মা দেখতে গেছেন।

মালুর মনে খটকা লাগল। এই নতুন বাড়িটা গত বছরই শেষ হয়েছিল এবং ভাড়াটে বসেছিল বলে শুনেছিল মালু। তাই শুধাল ও, এ বাড়িটা শেষ হয়েছিল গেল বছর?

ধ্যাৎ আপনি কিছু জানেন না। গেল বছর তো ধানমন্ডির বাড়ি উঠেছিল। এ বছর উঠছে সিদ্ধেশ্বরীতে, পাশাপাশি দুটো বাড়ি। মালুর অজ্ঞতায় ছেলেটার বুঝি কৃপা হল। কৃপা মিশিয়ে হাসল ও। বলল, জানেন? ঢাকা শহরে এই নিয়ে আমাদের চারটে বাড়ি হল। একটা আমার। একটা নন্তুর। বাকী দুটো দুবোনের। বিয়ের সময় যৌতুক হিসেবে লিখে দেওয়া হবে ওদের নামে। আব্বা বলেছেন, এরপর যত বাড়ি হবে সব আমার নামে। আমি বড় ছেলে কিনা, তাই।

একটা আস্ত বাড়ির মালিক সে, ভবিষ্যতে আরও অনেক বাড়ির মালিক হবে, এ খবরটা মালুকে জানাতে পেরে খুশি ছেলেটা। ডগমগিয়ে হাসছে ও। মালুও হাসল।

মালুর হাসিতে বুঝি উৎসাহ পেল ছেলেটা। বলে চলল, কিন্তু বাবাটা একেবারেই বোকা। তিনি তো ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেছেন। সে-ই ক-বে। জানেন না, আর্কিটেকচার একটা আলাদা বিদ্যা। তেজগাঁর বাড়িটা বাবা নিজেই ডিজাইন করেছেন। ছিঃ। কী যে চেহারা বাড়ির! আমিও বলেছি ও বাড়ি আমি ছোঁব না।

কিন্তু সিদ্ধেশ্বরীর বাড়ি?

এক্সেলেন্ট। হবে না কেন? চীফ আর্কিটেক্ট মি. গ্যারি…

আমি আসি। উঠে দাঁড়াল মালু। আরও অনেক বাড়িতে ঢুঁ মারতে হবে। ওকে।

না সে কী! লাঞ্চের সময় হল। আব্বা-আম্মা তো এখুনি এসে পড়বেন। আপনি একটা কোল্ড ড্রিঙ্ক খাবেন?

মালুর সম্মতির জন্য অপেক্ষা না করে এক দৌড়ে ভেতরে চলে গেল ছেলেটা। নিজেই তশতরির উপর চড়িয়ে নিয়ে এল এক গ্লাস লেমন স্কোয়াশ।

ছেলেটা ঠিকই বলেছে। মালুর হাতের গ্লাসটা শেষ হবার আগেই এসে পড়ল আরিফা আর ওর স্বামী।

মালুর প্রশ্নটা শুনে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল আরিফা। তারপর শুধাল, তুইও কী এসব করিস নাকি?

না।

খবরদার। এ সবের ধারে কাছেও যাবি না। জীবনটাই মাটি হয়ে যাবে।

মালু উপদেশ শুনতে আসেনি। এসেছে কাজে। কাজের কথাটাই আবার তুলল ও, আপনি কী জানেন কোথায় পাওয়া যাবে মেজো ভাইকে? দু-চার দশদিনের ভেতর এদিকে কী এসেছিল মেজো ভাই?

কী করে আসবে! যা ডরু তোর দুলা ভাই। কেবলই বলে, আমার চাকরি যাবে, সবাই উপোসে মরবে। শেষে আমিই বারণ করে দিয়েছি মেজো ভাইকে।

আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল আরিফা, থেমে গেল। স্যুট বদলিয়ে লুঙ্গি পরে স্বামীটি এসে বসেছে পাশে।

বাবুর্চি এসে খবর দিল খাবার দেয়া হয়েছে টেবিলে।

মালু উঠে দাঁড়াল।

আরিফা বসেই রইল। গালে হাত দিয়ে কী যেন ভাবছে ও। হঠাৎ শুধাল, রাবু কেমন আছে রে?

আশ্চর্য! আবাল্য এক সাথে যারা মানুষ হল তারা আজ পরস্পরের কোনো খোঁজ রাখে না।

জানি না, ইচ্ছে করেই মিথ্যা বলল মালু।

দেখা হলে মেজো ভাইকে বলিস এ সব যেন ছেড়ে দেয়। আমি জানতাম হিন্দুরাই স্বদেশি করে। মুসলমানরা কেন স্বদেশি করবে? মুসলমানদের এসব পোষায় না।

শেষ উপদেশটা দিয়ে আরিফা চলে গেল খাবার ঘরের দিকে। আরও অনেকগুলো বাড়ি এবং আপিসে হানা দিল মালু। সর্বত্র এক জবাব–জাহেদের খবর জানে না তারা। দু একজন, যাদের জাহেদের সাথে একসঙ্গে ঘুরতে দেখেছে। মালু, তারা জাহেদ নামের কাউকে চিনতেই অস্বীকার করল।

আশ্চর্য! একটা জ্যান্ত মানুষ এমন করে হারিয়ে যেতে পারে? তাও এই ছোট্ট শহরে? তবে কী বাইরে কোথাও আছে জাহেদ? কী করছে? কোথায় থাকছে?

হঠাৎ থানার কথা মনে পড়ল জাহেদের। পৃথিবীর যাবতীয় হারানো আর প্রাপ্তির খবর তাদের কাছে নাকি থাকে। সোজা পুলিশ সাহেবের কামরায় গিয়ে হাজির হল মালু।

মালুকে সাদরে অভ্যর্থনা জানালো পুলিশ সাহেব। মালুর নাম এবং গানের সাথে পরিচয় আছে তার।

সব শুনে কী এক রহস্য মিশিয়ে পুলিশ সাহেব হাসলেন, বললেন, আমরাও হন্যে হয়ে খুঁজছি জাহেদ সাহেবকে। কিন্তু তিনি আলেয়া–এই আছে তো এই নেই।

রহস্য অথবা হেঁয়ালি। মালু কিছুই বুঝল না। বোকার মতো চেয়ে রইল পুলিশ সাহেবের মুখের দিকে।

আচ্ছা আসুন একটা জরুরি কনফারেন্স রয়েছে আমার। আপনিও তো খুঁজেছেন তাঁকে, যদি কোনো খোঁজ পান তবে অনুগ্রহ করে জানাবেন আমাদের।

পুলিশ সাহেব চলে গেলেন কনফারেন্স কামরায়।

তবু হাল ছাড়ল না মালু। পত্রিকা অফিসগুলোতে যাতায়াত ছিল জাহেদের। সেখানে গেল মালু। কিন্তু সেখানেও এক জবাব। জাহেদের কোনো খবর জানে না তারা।

শুধু একটি আপিসে একটা লোক মালুকে টেনে নিয়ে গেল এক পাশে। কেমন ধমকের স্বরে বলল, আপনি কী ক্ষেপেছেন? এখানে খুঁজতে এসেছেন জাহেদ সাহেবকে? এই আপিসে তো গিস গিস করছে স্পাই। শীগগির চলে যান।

মালুকে এক রকম ঠেলে বের করে দিল লোকটা।

মালুর ইচ্ছে হল এই শহরের, এই দেশের সব কটি বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজবে ও। কোথায় যাবে জাহেদ? নিশ্চয় মরে যায়নি? মালুর বিয়ের দিন। আচমকা যেন পাতাল ফুঁড়ে উঠে এসেছিল জাহেদ। বগলে ছিল রিহানার জন্য একখানা শাড়ি আর মালুর জন্য গুটি কয় বই। আজাদী তো হল মেজো ভাই, এবার একটু বিশ্রাম নাও। এর ফাঁকে বলেছিল মালু।

বিশ্রাম কিরে? এখনই তো কাজের ধুম। মালুর কথায় কী এক মজা পেয়ে খুব করে হেসেছিল জাহেদ।

নতুন বৌ নিয়ে ব্যস্ত ছিল রাবু। বুঝি শুনে ফেলেছিল জাহেদের কথাটা। দূর থেকেই বলেছিল, কাকে কী বলছিস রে মালু? তোকে, আমাকে সবাইকে স্বর্গ রাজ্যে না নিয়ে তো ছাড়বে না মেজো ভাই। বিশ্রাম নেয়ার সময় কোথায় তার? রাবুর মুখে আনন্দিত কৌতুক, খুশির ছটা। কিন্তু ওর কথার মাঝে লুকানো থাকে না প্রচ্ছন্ন কোনো অভিমান, চাপা এক অনুযোগ। এই অভিমান, এই অনুযোগের যে কোনো প্রতিকার নেই রাবুর চেয়ে ভালো করে, এ কথাটা আর কে জানবে। তবু ওর অজ্ঞাতেই কতদিন এই অভিমান অনুযোগের আকারে ঝরে পড়েছে, মালু তার সাক্ষী। আজ চেপে ধরল মালু। এই তো মুশকিল তোমাকে নিয়ে রাবু আপা। নিটোল খুশির মাঝেও একটা স্ক্রু ঢুকিয়ে বসে থাকবে।

এই চুপ। নওসা কথা বলে না।

মালু চুপ করে গেছিল। কিন্তু ততক্ষণে চেঁচিয়ে উঠেছিল জাহেদ, ঠিক বলেছিস মালু। ঠিক বলেছিস। আর একটু বলতো?

তারপর জাহেদের সাথে আর দেখা হয়নি মালুর।

ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হল মালু। কোথাও জাহেদের কোনো খবর না পেয়ে হতাশ হল। দুপুরটা পার করে দিয়ে জোহরের শেষ সময় ফিরে এল বাসায়। অপেক্ষা করে করে বোধ হয় চোখের পাতায় ক্লান্তি নেমেছে রিহানার। ঘুমিয়ে পড়েছে ও।

রিহানা ওঠ। খাবে না? জামা ছাড়তে ছাড়তে ডাকল মালু।

ঘুম জড়ান কণ্ঠে চাকরটাকে ডাকল রিহানা। মালুকে উদ্দেশ্য করে বলল, যাও খেয়ে নাও গিয়ে।

তুমি খাবে না? অসুখ করেনি তো? উদ্বেগ ঝরল মালুর কণ্ঠে। হাত রেখে দেখল রিহানার কপালটা। না, কিছু হয়নি।

বিবি সাহেব খেয়ে নিয়েছেন আপনার খাবার দিয়েছি। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলে গেল চাকরটা।

আমি বাইরে খেয়ে এসেছি রে। তুই খেয়ে নে। ওকে জানান দিয়ে গুম হয়ে বসে রইল মালু। তারপর শুয়ে পড়ল রিহানার পাশে বিছানার খালি জায়গাটুকুতে।

এমন তো হয়নি কোনোদিন? না হয় ফিরতে একটু দেরি হয়েছে ওর! তাই বলে এমন নির্মম উদাসীনতায় ঘুমিয়ে থাকবে রিহানা? না খেয়েও অপেক্ষা করে থাকুক এমন কোনো অযৌক্তিক দাবী নেই মালুর। তবু খচ করে কাঁটার মতো কী যেন বিঁধে যায় মনের কোণায়।

টেবিল সাজিয়ে অপেক্ষা করত রিহানা। মালু এলেই দুজনে মিলে খেতে বসত। অভ্যস্ত হয়ে গেছিল মালু। অদ্ভুত এক মমতা লুকিয়ে থাকত ওই অপেক্ষাটুকুর মাঝে। আজ অপেক্ষা করে নেই রিহানা। ঘুরে ঘুরে ক্ষিধে পেয়েছিল মালুর। পেটটা চনচন করছিল। সেই খালি পেটটার মাঝে কী এক অসহ্য ভার জায়গা করে নিয়েছে এখন। কোথায় উবে গেছে ক্ষিধেটা। চোখ বুজে পড়ে রইল ও।

রিহানার সুরভিটা নাকে এসে লাগছে। আজ গন্ধরাজ জড়িয়ে নেই ওর চুলের গুচ্ছে। তবু গন্ধরাজের সুবাস মিশিয়ে ওর চুলে যে বিচিত্র সুরভি, তার আকর্ষণের এতটুকু কমতি নেই। যেন অজানতেই মালুর মুখটা ডুবে গেল রিহানার ছড়ানো চুলের অরণ্যে।

উঠে বসল মালু। ছোট খাট সুডোল দুটো হাত রিহানার, যেন মেলে রয়েছে। মধুর কোনো প্রত্যাশায়। আস্তে করে সে বাহুর কোমলতায় আপন মুখের স্পর্শ রাখল মালু।

আপন মনেই হেসে উঠল মালু। ঠুনকো একটা কারণে রিহানার উপর অমন মন ভার করার অর্থ হয় কিছু।

পাক ঘরে এসে চা করল মালু। জালের আলমিরা থেকে সকালের বানানো হালুয়া, কয়েকটি ফল আর বিস্কিট এনে সুন্দর করে সাজালো টেবিলটা। গ্লাসগুলো চাকরকে দিয়ে পরিষ্কার করে ধুইয়ে নিল। নিজ হাতে পানিটা মুছল, পরিপাটি করে সাজাল টেবিলটা। তারপর রিহানার কানের কাছে মুখটা এনে ডাকল রি, ঘুম ভাংলো? এসো, আমি চা করেছি তোমার জন্য।

কাত ফিরলো রিহানা।

ওর ঠোঁটে ঠোঁট জড়িয়ে আবার ডাকল মালু।

আহ্ মর। আদিখ্যেতা দেখে আর বাঁচিনে। উঠে বসল রিহানা। এক রকম হিড় হিড় করে ওকে টেনে এনে চায়ের টেবিলে বসিয়ে দিল মালু। এখনও ঘুম লেগে রয়েছে রিহানার চোখে। চোখের পাতাগুলো ডলে কচলে বুঝি ঘুমটাকে তাড়াল রিহানা। সোজা তাকাল মালুর দিকে। শুধাল, কী হয়েছে তোমার? ক্ষেপলে কেন?

না তো? ক্ষেপলাম কোথায়।

তুমি যদি ভাব খাবার সাজিয়ে হাতে পাখা নিয়ে, বউ তোমার অপেক্ষা করে থাকবে, তবে ভুল করছ।

আমি. ও রকম কিছু ভাবি না। রিহানার কথাটা শেষ হবার আগেই বলল মালু।

তোমার ইচ্ছে মতোই চলবে বউ, তেমন বউ বিয়ে করনি তুমি।

জানি।

চা-টা বিস্বাদ। বিস্কুটগুলো যেন লোহার ঢেলা, গলা দিয়ে গলতে চায় না কিছুতেই। নিঃশব্দে রিহানাকেই দেখছে মালু।

রিহানার মুখে বিরক্তি। রিহানার চোখে বিতৃষ্ণা।

তোমারই বা কী হল? অমন ক্ষেপেছ কেন? স্বাভাবিক স্বর মালুর।

উত্তর দিল না রিহানা। শুধু বিতৃষ্ণ দৃষ্টিতে একটি অবহেলা ছুঁড়ে মারল মালুর দিকে, টেনে নিল বিস্কুটের তসতরিটা। দাঁতের নিচে একটা বিস্কুট গুঁড়ো গুঁড়ো করে ঠেলে দিল গলার দিকে। এক নিশ্বাসে শেষ করল, পেয়ালার চা। তাকাল মালুর দিকে, যেন শুধাল, আরও কিছু বলার আছে তোমার?

এক রকম মরিয়া হয়েই বিস্বাদ চা-টা মুখের ভেতর ঢেলে নিল মালু, বলল তুমি তৈরি হও। আমি সে ফাঁকে গোসলটা সেরে নিই।

আমি যাচ্ছি না।

কেন?

ভালো লাগছে না। মাথা ধরেছে।

কিন্তু রাবু আপা যে নিজে এসে তোমায় দাওয়াত দিয়ে গেল।

দিলইবা।

না না রিহানা। দাওয়াতের কথা না হয় বাদ দাও। রাবু আপা চলে যাচ্ছে, তার সাথে একবার দেখা করব না আমরা? অনুনয়ের স্বর মালুর।

ভারি আমার বয়ে গেছে। অশ্রদ্ধায় ঠোঁট বাঁকায় রিহানা।

আসতে পারি? অনুমতির অপেক্ষা না করেই ঘরের ভিতর ঢুকে পড়ে আহসান।

বসুন। সৌজন্যের খাতিরে একটু ঝুঁকে পাশের চেয়ারখানি দেখিয়ে দেয় মালু।

আরে সাহেব, এক বাড়িতে থেকেও আপনার দেখা পাওয়া দায় হয়ে পড়েছে দেখছি। স্বরটাকে দরাজ করে অন্তরঙ্গ হবার চেষ্টা করে আহসান।

চা ঢেলে পেয়ালাটি এহসানের দিকে এগিয়ে দেয় রিহানা।

আচ্ছা, আপনারা গল্প করুন। উঠে এল মালু।

মালু স্নান সারল। জামা কাপড় পরল। বার দুই ডাকল রিহানাকে।

শুনেও বুঝি সাড়া দিল না রিহানা।

পর্দাটা ঈষৎ সরিয়ে দেখল মালু, গল্প করছে ওরা। বৃথাই রিহানার দৃষ্টিটা আকর্ষণ করার চেষ্টা করলো ও।

সন্ধ্যা হয়ে আসছে।

মালু রাস্তায় পড়ল।

ঘোরাঘুরিটাই সার হল তোর। কী আর করবি! আমার যেমন কপাল! ব্যর্থ অন্বেষণের খবরটা শুনে বলল রাবু।

সবই গোছানো সারা। শুধু সুটকেসটা বাকী।

খাটের উপর তাক করে রাখা শাড়ি ব্লাউজ তোয়ালে, নিত্যকার দরকারি জিনিস। একটা একটা করে এগিয়ে দেয় মালু।

দেখা হলে বলিস মেজো ভাইকে, ওর চোখের আলো আমার পথের সম্বল। ভরা সুটকেসের ডালাটা চাপতে চাপতে বলল রাবু।

কিছু বলে না মালু। নীরবে চেয়ে থাকে রাবুর ব্যস্ত হাতগুলোর দিকে। অনেকক্ষণ পর বলল মালু : রাবু আপা, তোমার কথাই ঠিক। মেজো ভাইদের জন্য কিছু লোককে সারা জীবন শুধু দুঃখই পেয়ে যেতে হয়।

শুধু দুঃখটাই দেখছিস? এর পেছনে যে লুকিয়ে আছে আনন্দ আর গৌরবের ফল্গুধারা, সেটা দেখছিস না? ক্লিক করে সুটকেসের তালাটা টিপে দিল রাবু।

রাবু আপা। আমার বিয়ের সময় মেজো ভাইয়ের সাথে দেখা হয়েছিল তোমার। সেই কী শেষ দেখা?

না। তারপর সে-ই দেখা করেছিল একদিন দশ মিনিটের জন্য। কথা হয়নি।

এর মাঝে কোনো চিঠিপত্র পাওনি মেজো ভাইয়ের?

দুটো চিঠি পেয়েছি তিন ছত্রের। ভালো থেকো, আমি ভালো। ব্যাস।

চাবির গোছাটা হাত ব্যাগে পুরে নিল রাবু। তারপর বইয়ের ট্রাঙ্কটার উপর সুটকেস রেখে তার উপর বসল রাবু।

আচ্ছা, রাবু আপা! তুমি কী শুধু দরবেশ চাচার সেবার উদ্দেশেই দেশে চললে? হঠাৎ শুধাল মালু।

তা, কেন, মানুষের মাঝে মেজো ভাইয়ের কাজ। সে কাজটা যদি আমারও হয়, আপত্তি আছে তোর?

একটুও না। রাবুর বলার ঢংটা দেখে ফিক করে হেসে দিল মালু

তালতলির মেয়েদের স্কুলটা বন্ধ হয়ে গেছে। সেই স্কুলটাকে আবার আমি চালু করব, আমাদের বাইর বাড়ির খালি দালানটায়।

আগের কথাটাকে বুঝি আরো খোলসা করে বলল রাবু।

মালুকে বিব্ৰত করল না রাবু। জিজ্ঞেস করল না, কেন আসেনি রিহানা।

হয়ত আঁচ করতে পেরেছে ও।

নিমন্ত্রণের খাবারগুলো ঢাকা রয়েছে টেবিলে।

সেদিকে তাকিয়ে বলল মালু, একটুও খেতে ইচ্ছে করছে না রাবু আপা।

 খাবি না? তাহলে উঠিয়ে নিক খাবারগুলো? আমারও ক্ষিধে নেই। ঝি এসে উঠিয়ে নিল খাবারগুলো।

৫৩.

গার্ডের হুইসেলটা বেজে উঠল। সবুজ নিশানটা ঘন ঘন আন্দোলিত হল।

রাবু আপা। ক্ষমা করে দিও মেজো ভাইকে। ওর হয়ে আমিই মাফ চেয়ে নিলাম তোমার কাছে। কেমন ধরে এল মালুর গলাটা।

ছিঃ! ও কথা বলিসনে মালু। মানদণ্ডের মতো দাঁড়িয়ে আছে মেজো ভাই, তোর সামনে আমার সামনে সবার সামনে। সে তো বিশুদ্ধতার প্রতীক।

কেঁপে গেল ট্রেনের ইস্পাত দেহটা।

যেন চমকে চাইল মালু। বিজলীর শিখারা বুঝি চাক বেঁধেছে রাবুর চোখের তারায়। চিকচিক জোনাকির মতো জ্বলে উঠছে ওর চোখজোড়া।

কী এক জ্যোতির্ময়ীর ভাষায় কথা বলে যায় সে চোখ।

দীর্ঘদেহী অজগরের মতো ধীর মন্থর গতিতে এঁকে বেঁকে বেরিয়ে গেল ট্রেনটা।

দিনের মতো ফুটফুটে আলো চারিদিকে। অথচ কী এক তমিস্রার গহ্বরে যেন তলিয়ে যাচ্ছে মালু। কানে এসে বাজছে দ্রুত বিলীয়মান প্রতিধ্বনি, রেলের ইস্পাত পিঠে পিঠে ছড়িয়ে পড়া কী এক আর্তনাদ। মাথার উপরে তারা ভরা আকাশের অনন্ত বিস্তৃতির মাঝে কী যেন খুঁজল মালু।

বড় গরম প্ল্যাটফরম। রাস্তায় এসে বুকের বোতামগুলো খুলে দিল মালু। ভালো লাগল মালুর। নিশ্বাসের সাথে টেনে টেনে হাওয়া খেল। ফুসফুসটাকে ধুয়ে নিল। আর একটু চাঙ্গা হবার জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে মাটির গেলাসে চা খেল।

বাসায় ফিরতে ফিরতে দেরি হয়ে গেল মালুর। মনে মনে লজ্জিত হল। গাড়ি ছেড়ে গেছে সেই দশটায় তারপর বারটা অবধি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছে, কোনো স্ত্রীর কাছেই এটা সন্তোষজনক কৈফিয়ত নয়। কিন্তু কৈফিয়ত তৈরির কষ্টটা করতে হল না ওকে, ঘরগুলো সব অন্ধকার। রিহানা নেই বাসায়।

কোনো সন্ধ্যায় তো একলা বাইরে যায়নি রিহানা? তা ছাড়া এত রাত অবধি কোথায়ই বা থাকবে ও।

উপরে সাহেবের সাথে বেরিয়েছেন বিবি সাহেব। মালুর প্রশ্নের জবাবে বলল ছেলেটা।

কখন রে?

আপনি বেরিয়ে যাবার কিছুক্ষণ পর। বলে, হাই তুলল ছেলেটা। কাঁচা ঘুমেই জেগে উঠেছে ও।

 যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে মালু, ছাইয়ের মতো ফ্যাকাশে হয়ে এসেছে ওর মুখ। কী এক অবসাদ এসে টেনে নিচ্ছে স্নায়ুর শক্তিটা। আর কত কী উঁকি দিয়ে যাচ্ছে মনের পর্দা সরিয়ে।

ছিঃ একি ভাবছে ও। নিজেকে শাসায় মালু।

দুটো মন ওর। শিল্পী মন, দরদী উদার। স্বামী মন, রক্ষণশীল, অধিকার কাতর। সব মনই বুঝি এমনি। এমনি দ্বিখণ্ডিত। আর দুয়ের মাঝে সংঘাত চলেছে অবিরাম।

কী বিশ্রী ইঞ্জিন, এই ভক্স ওয়াগন। সারা গায়ে ঝাঁকুনি তোলা বিকট শব্দ। হিটলার বুঝি মরে গিয়েও তার মাথাটা রেখে গেছে ওই ইঞ্জিনের ভেতর। ভক ভক করে হঠাৎ থেমে গেল ইঞ্জিনটা। তারপর টুক করে আলগা হল ঘরের ভেজান দরজাটা।

রিহানা এল। মালুকে দেখল কী দেখল না। বাথরুমে গিয়ে হাতে মুখে পানি ছিটিয়ে এল। দরজার ছিটকিনিটা এঁটে দিল। চুল ছাড়ল। রাতের প্রসাধন সারল। বসল খাটে। অকারণেই পা জোড়া ছুঁড়ে দিল সুমুখের দিকে। এক পাটি স্যান্ডেল বাথরুমের দরজায় ঠক করে শব্দ তুলে ছিটকে পড়ল অদূরে। তারপর শাড়ি আর ব্লাউজটা সিথানে রেখে শুয়ে পড়ল রিহানা।

শুয়েও চোখ বোজে না রিহানা। তেরছা চোখে চেয়ে থাকে মালুর দিকে। ড্রেসিং টেবিলটার পাশে মোড়ার উপর বসে আছে মালু। সেও যেন প্রাণপণে অস্বীকার করতে চাইছে রিহানার উপস্থিতিটা।

মালুর দৃষ্টিটা উদ্দেশ্যহীনভাবেই ঘুরে বেড়ায় এদিক ওদিক। ঘুরতে ঘুরতে আচমকা যেন ঠোক্কর খেল ওই তেরছা চোখের সাথে। তক্ষুণি সরে গেল অন্য দিকে।

শেষ শো সিনেমা দেখে এলাম। যেন দেয়ালকে উদ্দেশ্য করেই বলল রিহানা।

মাথা ধরার বাহানাটার প্রয়োজন ছিল কী?

আবার চুপচাপ।

এ এক অসহ্য নীরবতা। ঠাণ্ডা ছুরির মতো বসে যায় গায়ের মাংসে। ট্রেনে উঠে আফসোস করল রাবু আপা, যাবার আগে দেখা হল না তোমার সাথে।

আহ রাখতো তোমার রাবু আপার কথা, ছিলে যার চাকর তার বাড়িতে যাও দাওয়াত খেতে, লজ্জা করে না তোমার? আবার বউকেও সাথে নিয়ে যেতে চাও?

কী হল রিহানার? একী বলছে ও? ওর ঘৃণা ছিটানো মুখের দিকে নিরুত্তরে চেয়ে রইল মালু।

বাপ নেই। মা নেই, ঘর নেই, বাড়ি নেই। পরের বাড়িতে ফায়-ফরমাশ খেটে মানুষ। যাকে বিয়ে করেছ তার কাছে এই পরিচয়টা গোপন রেখেছিলে কেন, বলতে পার? রিহানার কণ্ঠ যেন বিষ ঢেলে চলেছে। চোখ ফিরিয়ে নিল মালু। ওই ঘৃণার মুখের দিকে চেয়ে থাকতে পারে না ও। সে-সব তো জানতে চাওনি তুমি! স্বরটাকে শান্ত আর সংযত রাখল মালু।

ও সেটাও আমার অপরাধ? চীট কোথাকার!

প্রচণ্ড এক ঝাঁকুনি খেয়ে গোটা ঘরটাই বুঝি কেঁপে গেল। সবই অস্পষ্ট সবই ঝাপসা মালুর চোখের সুমুখে। সংযমের সেই মহাশক্তিটার দিকে হাত বাড়াল মালু। সোজা হয়ে বসল।

কোত্থেকে, কী শুনেছে রিহানা। আর তারই ভিত্তিতে স্পষ্ট একটা অভিযোগ তৈরি করে নিয়েছে মালুর বিরুদ্ধে। বুঝি মোহ ভেঙেছে ওর। অনুতাপের জ্বালায় পুড়ছে ওর অন্তরটা। তাই মুক্তি খুঁজছে ও। সে কথাটা খোলসা করে কী বলতে পারে না ও? তা না করে এ কোন নর্দমার কাদা ঘাঁটছে রিহানা।

বাইরে মাঝ রাতটা গড়িয়ে গেছে। শিশিরের ভার নিয়ে চুপিসারে নেবে এসেছে শেষ রাত। ভেতরে অসহ্য গরম, গুমোট নীরবতা।

পাখার গতিটা বাড়িয়ে দিল মালু।

বাতিটা ওভাবে জ্বালিয়ে রাখলে আর এক জনের ঘুমের ব্যাঘাত হয়।

দেয়ালের দিকে মুখ করে বলল রিহানা।

উঠে এসে সুইচটা টিপে দিল মালু।

এক রাশ অন্ধকার দৌড়ে এসে ঢেকে দিল ওদের নগ্নতা। সেই ভালো। আলোর চোখের নিচে জিবের পর্দা ছিঁড়ে বেআব্রু হতে রুচিতে বাধছে মালুর। বিছানায় এসে বসল মালু। তারপর যে সন্দেহটা একমাত্র অন্ধকারেই উচ্চারণ করা যায় তাই ব্যক্ত করল : রিহানা ভালোবাসাটা তা হলে মোহই ছিল? সে মোহ ভেঙে গেছে তোমার? মুক্তি যদি চাও সে পথে তো অন্তরায় নাই কোনো?

আহ্, বকবকানি রেখে শুয়ে পড়তো! ঘুম পাচ্ছে আমার। ঝাঁঝ উড়িয়ে পাশ ফিরল রিহানা।

সঙ্গে সঙ্গেই বুঝি ঘুমিয়ে পড়ল রিহানা। নিশ্বাসের শব্দটা ভারি হয়ে আসছে ওর। একটু নাকও ডাকছে যেন।

পা তুলে খাটের মাথায় হেলান দিয়ে বসল মালু।

বাইরে শিশির ভারি বাতাসের দোল খেয়ে দুলছে পাম গাছের মাথাটা। পাম পাতার মায়া ছেড়ে টপ টপ শিশির ফোঁটা ঝরে পড়ছে মাটিতে, সে শব্দে ক্ষণে ক্ষণে যেন চমকে উঠছে মালু।

শেষ রাতের বিশীর্ণ চাঁদটা চুপি দিয়ে যায় জানালার ফাঁকে। এক চিলতে ম্লান জ্যোৎস্না নিথর অবশতায় শুয়ে রয়েছে রিহানার খোলা বুকে। প্রকৃতির মতোই। নিরাবরণ শুভ্রতায় উদ্ধত রিহানার উদলা বুক।

আশ্চর্য। হঠাৎ বিস্ফোরণের তোলপাড় তুলে এখন কেমন অঘোরে ঘুমুচ্ছে রিহানা। আর কী ঠাণ্ডা ওর গাটা। ওর দিকে আর একটু সরে এল মালু।

আর একটু নিবিড়তায়, আর একটু ঘন হয়ে স্পর্শ করা যায় না রিহানাকে? রক্তে আদিমতার স্বাদ তুলে, দেহে আত্মায় লীন হয়ে ঠিক আগের কোনো রাত্রির মতো, চমৎকার একটি অনুভূতিকে রাঙিয়ে তোলা যায় না?

না।

কঠিন একটি ধাক্কা খেয়েই যেন ফিরে এল মালুর হাতখানি। গানের রাজ্যে সুরের পাখায় ভর করে উড়ে এসেছিল যে মেয়ে রিহানা, বুঝি এক রাতেই সরে গেছে অনেক দূরে। সেখানে গান নেই। প্রেম নেই।

আর একবার, আর একবার ওকে স্পর্শ করতে চাইল মালু। চাইল বুকের উষ্ণ তাপে, দুবাহুর নির্মম পেষণে ওকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে। আশ্চর্য। মালু পারল না। মালুর হাত সরল না। আকর্ষণের বুঝি মৃত্যু হয়েছে। ম্লান জ্যোৎস্নাটা, রিহানার খোলা বুকের আশ্রয় ছেড়ে, আস্তে আস্তে চলে গেল ঘরের বাইরে। ফর্সা হয়ে উঠছে পূর্বের আকাশটা। দূরে কোথায় কিচির মিচির করে গেল ভোরের পাখি। হাত বাড়িয়ে তেপয় থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা তুলে নিল মালু। একটা সিগারেট ধরিয়ে সুমুখের ভাবনাগুলোকে যেন ছাই করে নিতে চাইল ও।

৫৪.

স্বচ্ছ নীলিমার নিচে আদিগন্ত সবুজের বিস্তার। চোখ জুড়ায়, মন ভোলায়। দোয়েল কোয়েলের কূজনে মায়া মুখর জীবন। এ দেশের গ্রাম বলতে এমন একটি ছবিই তো আমরা ভাসিয়ে তুলি চোখের সুমুখে। পুস্তকের পাতায় এখনও আঁকা রয়েছে এমনি এক বিকৃত চিত্র।

যাকে বলি পল্লী সুর, লোক গীতিকার মিষ্টি ডাক, সেখানেও এমনি শান্ত স্নিগ্ধ কল্পনা। সে সুর কখনো বিরাগী, কখনো ললিত মূৰ্ছনায় নিবিড় কখনো বা একতারার একঘেয়েমিতে মন্দ মধুর, মিষ্টি। সে সুর, সে ছন্দ থেকেই তো মালুর জন্ম। তারই প্রকাশ কণ্ঠে। তবু কী এক জিজ্ঞাসা অস্থির করে তুলেছে ওকে। বার বার মনে হয়েছে ওর, এ শুধু গলিত চর্বণ–আপনার শিল্পীদীনতাকে ঢেকে রাখবার এক করুণ প্রয়াস। এ যেন সেই ফেলু মিঞার মতো শুধু অতীতকে, লুপ্ত গৌরবকে সম্বল করে বাঁচার চেষ্টা। দুনিয়ার সুমুখে নিজেকে হাস্যাস্পদ করে তোলা।

ছোট বেলার বাকুলিয়া তালতলি। নৌকা করে গায়ের পর গা ঘুরে বেড়ান, গনি বয়াতির দল নিয়ে। তার পর বিচিত্র সেই মহানগরীর আজব জীবন তর তর করে বয়ে যাওয়া কোনো শান্ত ধারা নয়, এ এক বিচিত্র সংঘাত-ক্ষুব্ধ জীবন। এ জীবনটাই যেন আজ তার সমস্ত দাবি নিয়ে উঠে এসেছে মালুর সুমুখে। মালুর কণ্ঠে সে চায় প্রকাশ।

বুঝি তাই ললিত রাগিণীতে রুদ্র ভৈরবীর ঝংকার ঢালল মালু। মিষ্টি একতারায় তুলল ঝড়ের বোল। শীর্ণ স্রোতের মন্দ ছন্দে হেলে দুলে চলে না। এ সুর। এ যেন পাহাড়ী ঝর্না, অজস্র ধারার উদ্দাম বেগে দুকুল ভাসিয়ে তার তৃপ্তি।

আর কী আশ্চর্য! মালুর হাত গেছে খুলে। ছোট বেলায় মুখে মুখে ছড়া কেটেছে, গান বানিয়েছে মালু। কিন্তু সে ছড়া বা গানগুলোকেই লিখে ফেলা যায় কালির অক্ষরে, এ কথা ভাবেনি মালু। এমন কোনো ইচ্ছেও কোনো দিন জাগেনি ওর মনে। কিন্তু আজ যখন ঝড়ো হাওয়ার মাতম জেগেছে মনে তখন সব কিছু যেমন সুর হয়ে বাজতে চায় তেমনি কথা হয়ে ফুটতে চায়।

মালু গান লেখে কাটে। আবার লেখে। আবার কাটে।

মালু জানে না ওর মনের ঝড় ফুটে উঠবে কোন অক্ষরের অবয়বে। মালু জানে না ওর ভক্ত শ্রোতারা কেমন ভাবে গ্রহণ করবে ওর নতুন সুর। দ্বিধা সন্দেহ মালুর নিজের মনেও।

কিছুদিন আগে এক জলসায় ওর এই নতুন গান নতুন সুরে গেয়েছিল মালু। রিহানা তখন রিহানা ছিল না, ছিল কথা না-কওয়া নীরব দৃষ্টির মেয়ে। সেদিন রিহানার বিস্ফারিত চোখে মালু দেখেছিল অজানার আতঙ্ক। শ্রোতারা ছিল স্তব্ধ নির্বাক।

হয়ত ওরা বোঝেনি। হয়ত ভালোই লাগেনি ওদের। শুধু উদ্যোক্তাদের ভেতর একজন বলছিল পেছন থেকে, না এটা জমল না। বিরোধিতার পরোয়া করে না মালু, করবেও না। শুধু…শুধু ও যদি বুঝতো, স্পষ্ট করে বুঝতো, কোন্ তারে, কোন্ যন্ত্রে ও প্রকাশ করবে এই নতুন সুর। নেকাব চিকের আড়ালে রূপসীর হাতছানি, পূর্ণরূপ যে তার এখনো অনুঘটিত মালুর দৃষ্টির সুমুখে।

অবসর ছিনিয়ে নিয়ে গলা সাধতে বসে মালু। নিজের কথাটা ব্যক্ত হবে নিজেরই সুরে সেও যে এত বড় দুর্ঘটনা, তা কী জানত মালু? পরীক্ষা নিরীক্ষায় শ্রান্তি নেই ওর।

সুর তান লয়, সবই মিলল। কিন্তু কথায় রয়ে গেল কী এক জড়িমা, কী এক বেসুর। তারপর হয়ত কথার ব্যঞ্জনায় সুর গেল বদলে। উল্টিয়ে পাল্টিয়ে সবটাই আবার নতুন করে ধরতে হয় মালুকে। মনের কথাটাকে সাজাতে হয় নতুন কোনো ছন্দে। যে ছন্দে সুর তাল মিশ খেয়ে সৃষ্টি হয় ঐক্য, ঐক্যের ঝংকার। কথায় আর সুরে, অনুভূতি আর ধ্বনিতে এই সাম্য, এই ঐক্যই বুঝি সকল সঙ্গীতের উৎস।

মালু খোঁজে সংঘাত-ক্ষুব্ধ জীবনে সেই ঐক্যের সুরকে। নিঃশব্দে সুমুখে এসে বসে রিহানা। ওর মখমল চোখের নরম আলোতে কত আশ্বাস, কত ভরসা। গা। আর চুল থেকে ও ছড়িয়ে দেয় সেই গন্ধরাজ মিশেল সুরভি। সুরলোকে হারিয়ে গিয়েও যেন জেগে থাকে মালু শুধু ওই অনন্যা চোখের আলোটুকুর জন্য, সুধার মতো ওই সুরভিটুকুর জন্য। রিহানার উপস্থিতি আরাধনার সামান্য ফাঁকিটুকুও যেন ভরাট করে দেয়। সুরের অমিল আর অনৈক্যের মাঝে এনে দেয় সুন্দর এক ঐক্যের সংগতি। অবাক হয়ে মালু ভেবেছে কেমন করে এক হয়ে গেছে ওর গান আর ওর প্রেম।

আজ এল না রিহানা।

কয়েকদিন ধরেই গানের সময় কাছে এসে বসে না ও। গান বুঝি আর ভালো লাগে না ওর। বিরক্তি ধরে গেছে গানে।

তাই বলে শূন্য থাকে না সুরের পৃথিবীটা। চারিদিকে সুরের বৃত্ত রচনা করে তারই মাঝে ডুবে যায় মালু। যতক্ষণ ঘরে থাকে এমনি এক নিরাপত্তার ব্যুহ তৈরি করে আপনাকে রক্ষা করে চলে মালু।

কিন্তু রিহানা বুঝি ধরে ফেলেছে মালুর ফাঁকিটা। ছোট ছোট ঢিল ছুঁড়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয় ওর নাজুক ব্যুহের দুর্বল প্রতিরোধটা। প্রথম ঢিল : ধোপার হিসেবটা একটু মিলিয়ে দেখতো। ব্যাটা এন্তার ঠকিয়ে চলেছে। সাথে সাথে হিসেবের খাতাটাও মালুর দিকে ছুঁড়ে দেয় রিহানা। খাতাটা এক পাশে সরিয়ে রেখে বেহালার তারে ছড় টানে মালু। রিহানা চলে যায় পাক ঘরের দিকে। নাশতার তদারকটা সেরে এসে ছুঁড়ে দেয় দ্বিতীয় ঢিল : আর পারি না। কত দিন ধরে বলছি ভালো একটা বাবুর্চি দেখ, এই ছোকরাকে বিদায় দাও। না শোনে কথা। না করে কাম, আলসের হাঁড়ি।

বেহালাটা ফেলে হারমোনিয়ামটা টেনে নেয় মালু।

তৃতীয় ঢিল : এশিয়া ফানির্চার স্রেফ জুচ্চোরি করেছে। সদ্য কেনা চেয়ার, এখনি বেঁকে গেছে হাতল। ব্যাটাদের আজই একটা খবর দিও মনে করে। চুলটাকে পিঠের উপর ছড়িয়ে দিয়ে রিহানা চলে যায় স্নান করতে। আজ যেন যেতে না যেতেই সারা হয়ে যায় স্নানটা।

চতুর্থ ঢিল : এ মাসে বাজারের টাকা কম দিয়েছিলে, খেয়াল আছে? আজ টাকা লাগবে।

ইশারায় আলনায় ঝোলানো পাঞ্জাবীটা দেখিয়ে দিয়ে নিস্তার পেতে চায় মালু। কিন্তু, তারটা যে ছিঁড়ে গেল কেটে গেল তাল। সুর উঠবে কেমন করে?

টাকার কথায় আরো কথা মনে পড়ে গেল মালুর। ছেড়ে দিল হারমোনিয়ামের হাওয়াটা। রিডের ওপর তুলে দিল ঢাকনাটা। তারপর শুধাল : আচ্ছা, রাবু আপার টাকাগুলো কী তোমার কাছে রেখেছিলাম?

সে তো খরচ হয়ে গেছে। তুমিই তো খরচ করলে।

আমি খরচ করেছি? চকিতে যেন অবিশ্বাস দৌড়ে গেল মালুর চোখে।

নিশ্চয় আমি চুরি করিনি? অথবা গোপনে পাচার করিনি বাপের বাড়ি? গানের গলা না থাক বাপের আমার টাকার অভাব নেই।

আহা, তাই কী বললাম আমি! মনে পড়ছিল না কী না…

তাই, বৌর উপর একটু সন্দেহ হল মাত্র। বেশি কিছু না! জিবটা যেন বিদ্রূপে নেচে যায় রিহানার।

যেন স্থূল কথার ভোঁতা দা। সামান্য একটু তীক্ষ্ণতাও নেই। সেই ভোঁতা দার নির্দয় আঘাতে সুমুখের মানুষটাকে বুঝি কেটে ছিঁড়ে একেবারে নস্যাৎ করে দিতে চায় রিহানা।

ভাবনায় পড়ে যায় মালু।

দুটিও নয়, চারটিও নয়। পাঁচশো টাকা!

টাকাগুলো রাবুর। বিয়ের পর সেই খরচার মওসুম। টাকাগুলো মালুর হাতে দিয়ে বলেছিল রাবু : আমার পাশ বইটা জমা পড়ে আছে ব্যাংকে। এত টাকা সঙ্গে রাখতে চাই না। তোর কাছেই রাখ। দরকার পড়লে খরচ করিস।

এত কথার প্রয়োজন ছিল না। ওকে সাহায্য করতে চায় রাবু; নিঃশব্দ কৃতজ্ঞতায় গ্রহণ করেছিল মালু। ফিরিয়ে দেবার কথাটা এতদিনে মনে হয়নি মালুর। কিন্তু দেশে গেরামে কত বিপদ আপদ! দরকারের সময় কোথায় হাত পাতবে রাবু!

মালুর মনে পড়ল, বিয়ের দুদিন পরেই খরচা টরচা গিয়েও যে হাজার দুই টাকা ছিল হাতে, সেটা দিয়ে রিহানার নামে একটা সেভিংস একাউন্ট খুলেছিল।

রিহানা, তোমার সেভিংস একাউন্টে কত টাকা আছে? নরম করেই শুধাল মালু।

সেভিংস একাউন্ট যেন শব্দ দুটো জীবনে এই প্রথম শুনছে রিহানা। তারপর হঠাৎ মনে পড়ে গেছে তেমনি এক ঢংয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল : ও, হ্যাঁ। গোটা পনের মানে একাউন্টটা খোলা রাখার মতো টাকা রয়েছে বোধ হয়।

তা হলে? রাবু আপার টাকাটা শুধবো কোত্থেকে? কী এক অসহায়তায় যেন নিজেকেই শুধাল মালু।

তা হলে আমি একটা চাকরি নিই? নতুবা বাপের বাড়ি থেকে চেয়ে আনি? মালুর গালে ঠাস করে যেন দুটো চড় বসিয়ে দিল রিহানা।

ওহ্ রিহানা। তুমি অসহ্য, কেন বারবার তোমার বাপের খোটা দিচ্ছ। টাকা আছে তার অঢেল, সে আমি জানি। আর আবগারী কর্তারা কেমন করে টাকা বানায় সেও তো কারো অজানা নয়?

ও আমি অসহ্য? প্রথম উক্তিটাকেই তুলে নেয় রিহানা। কী এক হিংস্রতার তলোয়ার হয়ে চেয়ে থাকে মালুর দিকে।

মখমলের মতো নরম যে চোখ, যে চোখ ছড়িয়ে দিত স্নিগ্ধ আলোর দ্যুতি, এমন ভয়ংকর আর বীভৎস হতে পারে সে চোখের দৃষ্টিটা?

কোথাও যেন একটু আশ্রয় চাইল মালু। হাত বাড়াল আপন অন্তরের স্থৈর্য আর আত্মসংবরণের সেই শক্তিটির দিকে। নির্বাক হল। নিঃশব্দে বেরিয়ে এল সদর রাস্তায়।

ইয়াসীন, কিছু টাকা ধার দিতে পার? এ্যাসিস্ট্যান্টের কাছে অবলীলায়, হাত পাতল মালু।

মালেক সাহেবকে বরাবর টাকা ধার দিতেই দেখেছে ইয়াসীন, চাইতে দেখেনি। তাই বিস্ময়ের সুঁচ হয়ে যেন বাতাসের সাথেই গেঁথে রইল ও। তারপর গলা নামিয়ে শুধাল, কত লাগবে। এই ধর, পাঁচ শো।

পাঁ-চ শো?

এক আধ শো কম হলেও চলে যাবে। আশার আলো দেখে চাহিদাটা একটু নাবিয়ে নিল মালু।

তিন শো দিতে পারব। এখুনি চাই?

না। কাল পেলেও অসুবিধে হবে না।

ঠিক মাথার উপরকার এই সায়েবটির কাছে থেকে প্রশ্রয় আর স্নেহ পেতেই অভ্যস্ত ইয়াসীন। কিন্তু সেও যে দিতে পারে, খুশি করতে পারে সেই মানুষটিকে যে কখনো হাত পাতে না কারু কাছে, এটা বুঝি ইয়াসীনের জীবনে একটা অভাবনীয় আনন্দ অভিজ্ঞতা। খুশি হয়ে ওঠে ইয়াসীন। কিন্তু, তুমি যে দিচ্ছ, সামনে তো তোমার খরচার সময়। হঠাৎ শুধাল মালু।

আরো ভালো হল। জমা রইল আপনার কাছে। ঠিক প্রয়োজনের সময়টিতে চেয়ে নেব?

আর একজনও এমনি ধরনের কথা বলেই সাহায্য করেছিল মালুকে। কিন্তু প্রয়োজনের সময় তার কখনো আসবে না, কখনো ফেরত চাইবে না ও। এটা ভালো করেই জানে মালু।

তাই বলে মালুর কর্তব্যে বিচ্যুতি ঘটবে কেন।

সকাল থেকে যে ভারটা চেপেছিল বুকের উপর, ইয়াসীন যেন সে ভারটা নামিয়ে অনেক হাল্কা করে দিল মালুকে। তারিখ ঠিক করলাম। বলেই যেন টেবিলটার সাথে মিশে গেল ইয়াসীন।

তাই নাকি? কবে? চেয়ার ছেড়ে ওর দিকে এগিয়ে এল মালু। পয়লা আশ্বিন। টেবিল থেকে মুখ না তুলেই বলল ইয়াসীন। আশ্বিনের সোনা ঝরা লগ্ন? বাহ্, চমৎকার দিন তো? উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে মালু।

কিন্তু? ইতস্তত ইয়াসীন।

কিন্তু কী, ইয়াসীন?

ঘর যে এখনো পেলাম না। বৌকে তো আর মেসে রাখা যায় না।

সত্যি তো, বৌ কী আর মেসে থাকতে পারে? অনেক দিন পর গলা ছেড়ে হাসল মালু। হাসি থামিয়ে যেন কৈফিয়ত চেয়ে বসল, বাসা পাচ্ছ না, এ্যাদ্দিন বলনি কেন।

এ আর বলবার মতো কথা কি; পকেটে টাকা নিয়ে ঢাকায় যত অলিগলি চষে বেড়াচ্ছি। কিন্তু ঘর কোথায়; ঘর থাকলে তো লোকে ভাড়া দেবে; ঘর না পাওয়ার পক্ষেই যেন একটা যুক্তি খাড়া করতে চাইছে ইয়াসীন।

টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা চাবি বের করল মালু। চাবিটা পকেটে ছেড়ে দিয়ে বলল, হয়েছে ওঠ এবার।

রিক্সায় চড়ে বসল ওরা।

ওর একটা চাকরিও হয়ে গেছে। মিউনিসিপ্যাল স্কুলে। শিক্ষিকা। বলল ইয়াসীন।

তবে তো সোনায় সোহাগা। পরীক্ষার ফল না বেরুতেই চাকরি; ইয়াসীনের পিঠে একটা খুশির থাপ্পড় বসিয়ে দিল মালু।

ফল বেরুতে এখনো হপ্তা দুই দেরি। তবে প্রাইভেটলি জেনে নিয়েছি আমি। ও পাস করেছে। সেকেন্ড ডিভিশনে।

এ্যাঁ, তুমি কী রকম লোক হে। এতগুলো ভালো খবর পেটের ভেতর লুকিয়ে রেখেছ? এখন বুঝছি কেমন করে পয়লা আশ্বিন এত জলদি এসে গেল। সত্যি যেন অন্যায় হয়েছে তেমনি করে মুখ নাবিয়ে হাসে ইয়াসীন।

বাসাটা পেয়ে মহা খুশি ইয়াসীন। এটা ওর কল্পনার অতীত ছিল। দোতলার খোলামেলা ঘর। বিজলী বাতি, কলের পানি, পাক ঘর। তার উপর রীতিমতো সস্তা ভাড়া। আজকের এই স্বার্থপর ঢাকায় কে কার জন্য এতটা করে। ঝেড়ে মুছে সাফ করে রাখ, বলল মালু। চাবিটা গুঁজে দিল ইয়াসীনের হাতে। আপনি বাসাটা রেখে দিয়েছিলেন কেন? সিঁড়ি দিয়ে নাবতে নাবতে শুধাল ইয়াসীন।

যদি কখনো কাজে লাগে। এই তো কেমন চমৎকার কাজে লেগে গেল? মালু হাসল।

ইয়াসীনও হাসল। ওর কাছে বাসাটা না চাইতে পাওয়া আকাশের চাঁদ।

জান ইয়াসীন? তোমাদের এই প্রতীক্ষাটি ভারী সুন্দর। আমার খুব ভালো লাগে তোমাদের কথা ভাবতে। হঠাৎ গলাটাকে কী এক আবেগে কোমল করে বলল মালু।

প্রসঙ্গটা এলেই লজ্জায় রাঙিয়ে ওঠে ইয়াসীন। মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে দোকানের সাইনবোর্ডগুলোর উপর মন দিল ও। সত্যি বুঝি ভালো লাগে মালুর। নির্বাচিতাকে, স্বপ্নের রাণীকে সচ্ছলতার প্রশস্ত অঙ্গনে বরণ করে নেবে বলে মাসের পর মাস টাকা জমিয়ে চলেছে ইয়াসীন–সেই কবে থেকে। আর যে স্বয়ম্ভর মালা হাতে দিন গুনে চলেছে, সেও আসতে চায় না নিরাবরণ শূন্য হাতে। বন্ধনের সাথে সাথে। আশ্বাসও দিতে চায়। দিতে চায় অর্ধেক রাজত্ব। তাই পরম সহিষ্ণুতায় তৈরি করেছে নিজেকে, নিজের আয়ের পথটা নিশ্চিত করেছে। শুধু সুধাটুকু বুঝি নিতে চায় না, সে মেয়ে। যা ভার, যা দায় তাও ভাগ করে নেবে আধাআধি। বিঘ্নমুক্ত হোক, সার্থক হোক ওদের আশ্বিনের লগ্ন। মনে মনে কামনা করল মালু।

আজ তুমি আমার সাথে খাবে।

একটা রেস্টুরেন্টের সামনে রিকশা থেকে নেবে পড়ল ওরা।

পদে পদে আজ অপ্রস্তুত ইয়াসীন। ওর ঠিক মাথার উপরের কর্তাটি, ফাইলের ভেতর আর গানের চিন্তায় যে ডুবে থাকে অষ্টপ্রহর, সে মানুষটি আজ কেমন গা ছেড়ে দিয়েছে।

দুপুরটা আর এই অপরাহ্নটা আজ এত ভালো লাগছে কেন মালুর? যা পাওয়া গেল না নিজের জীবনে সেটাই স্নেহাস্পদ কারো জীবনে সার্থক হতে দেখলে এমনি ভালো লাগে বুঝি। অথবা এ-এক ধরনের ঈর্ষা, যে ঈর্ষাটাকে ভালো লাগায় রূপান্তরিত করেছে মালু।

খেতে খেতেই মনে পড়ল মালুর, খাবার সাজিয়ে রিহানা আর অপেক্ষা করেনা ওর জন্য।

অকারণেই ইয়াসীনকে নিয়ে এ রাস্তা সে রাস্তা এ দোকান সে দোকান ঘুরে বেড়াল মালু। ঘর-সংসারের কত উপদেশ দিল, যেন সংসার করে করে বুড়ো হয়ে গেছে ও। তারপর বিকেল নাগাদ ফিরে এল বাসায়। পরিপাটি করে সাজছে রিহানা। চোখটা চট করে ফিরিয়ে নিতে পারে না মালু। ইচ্ছে হয় চেয়ে থাকুক।

খাবে না বেরুবার আগেই বলে গেলে পার। চাকরটাকে আর কষ্ট করে রাঁধতে হয় না। ওকে দেখেই ঝাঁঝিয়ে উঠল রিহানা। নিরুত্তরে পাখাটার নিচে এসে বসল মালু। একটু ঠাণ্ডা হল। মুখ হাত ধুয়ে এল। তারপর পোশাকটা বদলে বেরিয়ে গেল ছাত্রীদের গান শেখাতে। গেইটটার কাছে এসে পেছনে শুনতে পেল রিহানার গলা–আমার ফিরতে দেরি হলে তুমি খেয়ে নিও।

গান শিখিয়ে রোজ রাতে যে সময়টিতে ফেরে মালু ঠিক সে সময়ই ফিরলো ও। রিহানা তখনো ফেরেনি। উপরে নিচে গোটা বাড়িটা অন্ধকার। ঘরে পা রেখেই মাথাটা ঝিম করে ধরে গেল মালুর। ওর মনে হল কী এক ষড়যন্ত্রের কূটজালে এ বাড়ির সমস্ত বায়ু সরে গেছে অন্য কোনো পৃথিবীতে। এখানে বায়ুহীন নিঃসীম শূন্যতা। এখানে নিশ্বাস নেয়া যায় না। ভীত পশুর মতো ত্রস্ত পায়ে বাইরে ছুটে এল মালু।

পল্টন তখন খোলা মাঠ। তখনো দেয়ালের অবরোধ ওঠেনি, উদ্যত হয়নি বেপারি হাতের আক্রমণ। লাট ভবনের কোণা থেকে সেই ফকিরাপুল, ফকিরাপুল থেকে পল্টনের সেই পরিত্যক্ত চাঁদমারি–উদলা মাঠ সবুজ মখমল গায়ে জড়িয়ে নিঝুম পড়ে থাকত।

এ কোণ থেকে সে কোণ গোটা মাঠটায় চক্কোর দিয়ে বেড়াল মালু। ঘাসের নরম পিঠে পিঠ দিয়ে ধুলোয় বেড়ালের মতো গড়াগড়ি খেল। জামা খুলে বাতাস মাখল গায়ে। তারপর বুঝি বন্ধু রাতের ঠাণ্ডা পরশে স্নিগ্ধ হল। ঘরের পথ ধরল।

বাতি জ্বলছে দোতলার ঢাকা বারান্দায়। বাতির নিচে মানুষ। মেয়ে আর পুরুষ, কয়েক জোড়া মিহি কথার কাঁচ ভাঙছে ওরা। ছোট ঘোট হাসির লহর তুলছে। ওদের হাসি, ওদের কণ্ঠ, গুনগুনিয়ে উঠছে অর্গানের নীচু খাদের মিঠে সুরের মতো।

কখনো বা মধ্য রাতের স্তব্ধতা চোখে মেখে থমকে থাকছে ওরা। হাই তুলছে আলস্যের। তন্দ্রালু চোখের ঠিকানাহীন দৃষ্টি ঘুরে ঘুরে হঠাৎ হয়ত লক্ষ করছে পাম গাছটির মাথায় এক ঝাঁপি নিকষ আঁধার।

ঠিক এমন সময় এক ঝলক বাতাস এসে সুড়সুড়ি তুলে ভেঙে দেয় ওদের ঝিমুনিটা। পাকা রাঁধুনির মতো যে উস্কিয়ে দিল নিভু নিভু কথা উনুনের আধ পোড়া কাঠের চেলাটা। অড্রি হ্যাপবার্ণের ছবিটা দেখে এলাম কলকাতায়। চমৎকার অভিনয়। শুনেছি, দুটো একাডেমি এওয়ার্ড পেয়েছে

বাবা, ঢাকায় বসে থাকলে পাঁচ বছরেও নো হোপ। আমি ভাবছি কালই একটা ট্রিপ দেব কলকাতায়। ছবিটাও দেখা হবে দুচারটি কেনাকাটাও সেরে আসব।

হু যাকে বলে রথ দেখা কলা বেচা।

তা, যা বলেছিস। আমার তো ভাই প্রতি মাসেই একবার কলকাতায় না গেলে চলে না। মানুষ থাকে ঢাকায়? না আছে সোসাইটি, না পাওয়া যায় দুটো শখের জিনিস।

ঠিক বলেছিস। একটা ম্যাক্স ফ্যাক্টর লিপস্টিক তামাম ঢাকা শহরে খুঁজেও পেলাম না। আমি তো ওনাকে বলে বলে হয়রান হয়ে গেলাম–চল বদলি হয়ে করাচী। এ ছাই শহর আর ভালো লাগে না। এমনি করে টুন টুন টুন টুন বোল ঝরে ওদের কথায়। গড়িয়ে চলে ডিনার শেষের বিশ্রম্ভালাপ। বিষয়টা মুখ্য নয়। বস্তুটাও না। একটু বা রোমন্থন। পেটের ভেতর গুরু আহার্যগুলোকে নরম করা।

উগ্র আলো ছড়ানো দোতলার নিচে একতলার অন্ধকারটা কেমন ছমছমে। গা ভার ভার ভয় জাগানো। হাত রাখতেই দু ফাঁক হয়ে গেল ভেজানো কপাট। সারাদিন ইয়াসীনের আনন্দে শরিক হয়ে জোর করে যে শূন্যতাটাকে সরিয়ে রেখেছিল দূরে দূরে, এই অন্ধকারে সোয়ার হয়ে দুঃসহ সেই শূন্যতাটাই যেন গ্রাস করে নিল মালুকে। হাতড়ে হাতড়ে দু একটা ঠোক্কর খেয়ে বিছানাটা খুঁজে পেল মালু। লম্বা হল।

অন্ধকারেই বুঝি জেগেছিল চাকরটা। মালুকে ঢুকতে দেখে উঠে আসে। জ্বালিয়ে দেয় বাতিটা। শুধায়, ভাত দেব সায়েব?

বিবি সায়েব খাবে না?

উনি তো উপরে খেয়েছেন।

আমি খাব না। তুই ঘুমা গিয়ে। বাতিটা নিবিয়ে দে।

দোতলার জোড়া জোড়া মানুষগুলোর কথাই ভাবছে মালু। কিন্তু ওরা সবাই কী জোড়া? রিহানার জুটি কে? নামটা মনে মনেও বুঝি উচ্চারণ করতে পারল না মালু।

তারপর প্রায়ই যেমন হয়, মাঝ রাতের ঢলে পড়া প্রহরে ঢুলু ঢুলু ঘুম নামবে ওদের চোখে। ছোট হয়ে আসবে ওদের চোখের তারা। ডিনার শেষের চুটকি আলাপনটা কিছুতেই আর জমবে না। উড়তে চাইবে না ঠুনকো কথার টুনটুনিরা।

শিথিল পা, বোজা বোজা চোখে নেবে আসবে রিহানা। এক তাল ঠাণ্ডা গোশতের মতো দলা পাকিয়ে পড়ে থাকবে বিছানার এক পাশে।

কিন্ত কোথায় চলেছে রিহানা? এতে কী সত্যিই আনন্দ পাচ্ছে ও? রিহানা কী চেয়েছিল? কী চায়?

বার বার ঠেলে দিলেও প্রশ্নগুলো ছেঁকে ধরে মালুকে।

৫৫.

ও শালার হয়ে গেছে।

হয়ে গেছে কিরে! বল ডুবে গেছে। যেমন তেমন ডোবা নয়। একেবারে মধুর চাকে হাবুডুবু গানটান সব ঝেড়ে পালিয়েছে।

শুনছি নাকি কোনো বড়লোকের মেয়েকে ভাগিয়ে…

শালা বেইমান। নেমকহারাম। ফষ্টিনষ্টি করবি তো অন্য জায়গায় কর। তা না ভদ্রলোক বিশ্বাস করে তোকে বাড়িতে ঢুকতে দিলেন। আর তারই মেয়েকে নিয়ে ইলোপ?

মানে গান গাইতে গাইতে একেবারে সপ্ত আকাশে উধাও?

সাধে অমন টসটসে হয়েছে চেহারাখানা। দেখ না একবার, কেমন বাহারের সুরত? এক্কেবারে দুলা মিঞা আর কী!

ছিঃ ছিঃ এ কী কেলেঙ্কারী! শালা একটা আস্ত বদমাস।

ভোঁতা বিদ্রূপ। আড়ালে আবডালে নয়। ওর চোখের সুমুখেই।

অট্টহাসি ছড়ায়। ভেংচি কাটে। মালু দেখে এবং শোনে, উপহাসের জিহ্বা গুলো কেমন লিক লিক করে যায়। এককালে হয়ত এরাই ছিল ওর অন্ধ স্তাবক।

ব্যাটা কিন্তু রোজগার করছে মেলা।

তা আর করবে না; যাকে বলে আদার বনে খাটাস বাঘ। পাকিস্তানের অর্থ ওদের মনপোলি, মানে নো কম্পিটিশন। কিন্তু এখন আর সেটি হচ্ছে না সায়েব।

কেন বলুন তো?

মশায় ঢাকার রাস্তায় এখন গায়কের ছড়াছড়ি। মেয়েকে গান শেখাবেন? দিন না একটা বিজ্ঞাপন, দেখবেন গণ্ডায় গণ্ডায় গায়ক আপনার দরজায় হাজির। এ বলে আমারে দেখ, ও বলে আমারে দেখ।

থামুন তো মশায়, গানটা একটু শুনতে দিন। পেছনের সারির কোনো রস পিপাসুর ধৈর্যে বুঝি আর কুলায় না।

ব্যাটা উজবুক নাকি রে? হো হো হাসির রব উঠে। কার সাধ্য প্রতিবাদ জানায়।  

মশায় ওকি গান? ভাটিয়ালিতে বেহাগ রাগ! সুট কোট পরে গলায় চাদর ঝোলান।

যত সব কালোয়াতি

উপায় কী? পুঁজি তো মোটে দেড়খানা বাউল, আড়াইখানা মারফতি, তিনখানা ভাটিয়ালি। সেই মান্ধাতার আমলে শিখে রেখেছে। ওতে কী আর এখন কল্কে মিলে? তাই খিচুড়ি পাকানো শুরু হয়েছে।

লে বাবা, থাম এবার। তার চেয়ে ধরনা একটা বোম্বাই কা গানা। উত্যক্ত করতে চায় ওরা মালুকে। থামিয়ে দিতে চায় ওর গান। ওর এই বিচিত্র পরীক্ষায় ওদের বিদ্রোহ। প্রতিবাদ।

বিদ্রূপের আঙ্গুলগুলো নেচে নেচে যায় মালুর চোখের সুমুখ দিয়ে। কতক্ষণ ও দেখে পারবে! কতক্ষণ উপেক্ষা করবে! বুঝি এ ফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যায় ওর সাহস ভরা বুকটা।

উঠতে গিয়েও ভেঙে যায় মীড়। স্বর যায় ফেটে। সুর যায় কেটে। গলা যায় শুকিয়ে। যা গাইতে চায় তাও আর গাওয়া হয় না।

কী সব ছাইপাশ গাও বল তো? আমার যে মুখ দেখানো দায়। তিক্ততার হুল ফোটায় রিহানা।

গান কী আর বোঝ তুমি রিহানা? যে হৃদয় দিয়ে বুঝতে সে তো হারিয়ে ফেলেছ।

ইস কথায় আবার ছিরি দেখ! গা জ্বলে যায়।

জ্বালা কী আমারই কম রিহানা? ঘরে বাইরে উপহাস, মনের ভেতর অশান্তির জ্বালা, তুমি কী দেখছ না?

তার আর কী করা যাবে।

কিছুই কী করা যায় না রিহানা? তুমি কী দিতে পার না এক ফোঁটা সান্ত্বনা, একটু মমতার পরশ? পার না পাখির ডানার মতো তোমার ছোট্ট দুখানি বাহুর শান্ত আশ্রয়ে আমার সব জ্বালা জুড়িয়ে দিতে?

ন্যাকামি রাখতো। ও সব ভালো লাগে না আমার। তোমার ফাংশান-টাংশানে ও আর যাচ্ছি না আমি। বিশ্রী সব রিমার্ক। তুমি সইতে পার। আমার চামড়া অত মোটা নয়। বিতৃষ্ণা বিরক্তি আর তাচ্ছিল্য রিহানার কণ্ঠে।

ও এই বুঝি তুমি? আমার গানের টানে, সুরের আরাধনায় যে উঠে এসেছিল পাতলা ফুঁড়ে। যাকে মনে করতাম আমার পরম পুরস্কার? এত স্থূল, এত নির্মম তুমি?

হ্যা তাই তাই, হল তো? কর্কশ গলায় কয়েক দলা বিষ উগরে দিয়ে বেরিয়ে যায় রিহানা।

যেমন বলেছে রিহানা কাজেও তার ব্যতিক্রম হয় না। গানের জলসাগুলোতে মালুর সাথে ওকে আর দেখা যায় না। কিন্তু মালুকে যেতেই হয়! ওটা ওর যশ। এখন বুঝি অপযশ। তার চেয়েও বড় কথা, ওটা তার রোজগার। তাই ও যায়। বিদ্রূপের কণ্ঠ ছাপিয়ে সুর তোলে। অদৃশ্য কোনো নিয়তির বিরুদ্ধে আকাশের দিকে চেয়ে বুঝি ছুঁড়ে মারে হাতের মুঠো। না বুঝুক, না শুনুক ওরা। তবু মালু গেয়েই যাবে, ওদের শুনতেই হবে বুঝতেই হবে।

কিন্তু ছাত্রীদের বাড়িতে কী সে জিদ খাটে?

মাস্টার সায়েব, মেয়েটিকে খান কয় রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখিয়ে দিন, ওটা বেশ চালু হয়েছে আজকাল।

কী বললেন? রবীন্দ্র-সঙ্গীত? আমাকে দিয়ে হবে না। অন্য মাস্টার দেখুন।

তা…আপনি বলছেন যখন তাই হবে।

এক ঝাঁকের পাখি ওরা। লিলির গার্ডিয়ান কম মাইনের রবীন্দ্রসঙ্গীতের নতুন মাস্টার রাখে। রীনার বাবাও। হয়ত ওদেরই দেখাদেখি অপেক্ষাকৃত নিম্ন আয়ের গার্ডিয়ান রুক্কুর বাবা আর লীনার চাচা, ওরা দুজনে মিলেই নতুন মাস্টার বহাল করে। দু মেয়ে এক সাথেই গান শিখবে।

কিন্তু তর্ক তোলেন অধ্যাপক হোসেন, রেখার বড় ভাই। রীনা লীনা রুক্কু আর লিলির গার্ডিয়ানদের মতো বুঝি এক কথায় মালুকে জবাব দিতে পারেন না তিনি।

বলেন : এমন সুন্দর আপনার গলা। এত আপনার সুনাম। কেন শিখে নেন না রবীন্দ্র-সঙ্গীতটা? সেই সাথে কিছু চলতি আধুনিক?

ভাল লাগে না।

আকাশ থেকে পড়েন সাহিত্যের অধ্যাপক। এমন কথা কখনো শোনেননি তিনি। সকল বাঙালি মধ্যবিত্তের মতোই রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি অনুরাগ তাঁর গভীর।

কেন, মানে যুক্তি? কেমন তীক্ষ্ণ শোনাল অধ্যাপকের স্বরটা।

যুক্তি যে আমার কী, সেটা তো তলিয়ে দেখিনি কখনো? মনের ভেতর থেকে সাড়া পাইনি। তাই ওটা শিখিনি।

বলেন কী? ভাবে-ব্যঞ্জনায়-রূপে এমন নিটোলতা, এমন মধুর আনন্দের স্বাদ অন্য কোন্ সুরে আছে বলুন তো? হৃদয়ের রস, প্রকৃতির লাবণ্য আর ফুলের কোমলতা মিশিয়ে যে সুরের সৃষ্টি, সেই রবীন্দ্রসঙ্গীত সাড়া জাগায় না আপনার মনে? আপনার মতো নামজাদা গুণীর মুখে কথাটা শুনে বড় অবাক লাগছে। ছিঃ মালেক।

রবীন্দ্র-সুরের বিপুল অবদানকে তো আমি অস্বীকার করছি না হোসেন সাহেব। আমার মনের প্রক্রিয়াটাই শুধু জানালাম আপনাকে। কেবলই মনে হয় কী এক কান্না এসে কেড়ে নিয়ে যায় মধুর আনন্দটি। যেন এক বেদনা বিলাস দুঃখের গায়েও একটু মাধুরিমা, একটু মহত্তের প্রলেপ লাগিয়ে কী এক অবশ তৃপ্তিতে নিজের ভেতর নিজেকে গুটিয়ে আনি। বুকটা যেন ভরে যায় অক্ষম কোনো ব্যথায়। সে ব্যথার রাজ্যে ডুবে গিয়ে এক ধরনের তৃপ্তিও পাই। এখানেই বিদ্রোহ করে আমার মনটা।

বিদ্রোহটা কেন বলুন তো? উনুখ এক আগ্রহে সামনের দিকে ঝুঁকে আসেন অধ্যাপক হোসেন।

দুঃখ আমার অবাল্য সাথী। সে দুঃখ ক্ষুধার, বঞ্চনার, অপমানের, অকারণ আঘাতের। কদর্য তার রূপ, হিংস্র তার ভাষা। কিন্তু সঙ্গীতের রাজ্যে তাকে প্রকাশের ভাষা বা সুর এখনো খুঁজে পাইনি আমি।

এতো আপনার নিজের কথা বলছেন। ক্ষুণ্ন স্বর অধ্যাপক হোসেনের।

আমি খুঁজছি। তাই মনের ভেতরে সুখের কান্নার মতো পুষে রাখতে চাই না দুঃখটাকে।জ্বালিয়ে রাখতে চাই অগ্নিশিখার মতো। রবীন্দ্রসুরের কান্নার সুখ আমার অসহ্য। আমি…

একটু থামুন। হাত উঁচিয়ে ওকে থামাবার ইশারা জানিয়ে কী এক উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়েন অধ্যাপক হোসেন। তার পর বসে ঠোঁটের উপর একটা আঙ্গুল রেখে যেন অনুধাবন করলেন মালুর কথাগুলো। অবশেষে বললেন : যাকে আপনি বলছেন কান্নার সুখ, ব্যথার রাজ্যে ডুবে যাওয়ার তৃপ্তি, এ কথাগুলোকেই কী একটু ঘুরিয়ে বলা যায় না? বলা যায় না, দুঃখদীর্ণ জীবনে যে সত্যের আরাধনা তারই নাম সৌন্দর্য, আর এই সৌন্দর্যই রবীন্দ্র-সুর? এ ভাবে বললেই কী সত্য কথাটা বলা হয় না?

কিন্তু, এ সৌন্দর্য যে আচ্ছন্ন করে চেতনাকে। আচ্ছন্ন হৃদয় চেতনায় চিন চিন করে বাজে ব্যথার রাগিণী। কী এক অতৃপ্তি কী এক শূন্যতাবোধ ঘিরে ধরে, বিষণ্ণতার অবসাদে চোখ বুজি। কিন্তু আমি তো চাই সেই রূপকথার সোনার কাঠি যার মন্ত্র ছোঁয়ায় প্রাণ জাগে। সেই সঞ্জীবনী সুর…উঁহু দাঁড়ান। হাত তুলে মালুকে আবার থামিয়ে দেন অধ্যাপক হোসেন। ওই যে বললেন চিন চিন করে বাজে। ব্যথার রাগিণী সেই সূক্ষ্ম বেদনাটুকু যে অনেক কিছুর প্রকাশ, মালেক সাহেব। সার্থক শিল্পকর্ম, সার্থক সুর সর্বত্রই তো এ বেদনার ধারা। রবীন্দ্র গীতিকায় এ বেদনাই তো তার উৎকৃষ্টতম আবেদন।

বুঝি দম নেবার জন্য একটু থামলেন হোসেন সাহেব। দম নিয়ে বলে চললেন : আচ্ছা বলুন তো, সৌন্দর্য কী নিরবচ্ছিন্ন আনন্দ? না, আমি তা মনে করি না। যে বেদনার গর্ভ থেকে তার সৃষ্টি সে বেদনাটা সব সৌন্দর্যের মাঝেই তো মিশে থাকে। তাই ওই বেদনাকে বাদ দিয়ে সৌন্দর্যের অনুভব বা উপলব্ধি শাঁসটাকে বাদ দিয়ে শুধু খোসা নিয়ে তৃপ্ত থাকার মতো। রবীন্দ্র-সুরের এ বেদনার আবেদন অনুপম সৃষ্টি সুন্দরের আবেদন…

মালুর মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ থেমে গেলেন অধ্যাপক। মনে হল তাঁর মালু যেন শুনছে না।

তাই তো রবীন্দ্র গীতির বৃত্তটা ফিনফিনে বাবু সাহেবদের গোছালো ড্রয়িং রুম ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারল না, পারবেও না। যেন আপন মনেই বলল মালু।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন অধ্যাপক সাহেব। সময় হয়ে গেছে কলেজের। তত্ত্বের তর্ক আপাতত স্থগিত রেখে কাজের কথায় এলেন : আসল কথাটা কী জানেন? হাল জামানায় বানের পানির মতো অফিসার কুলে ছেয়ে গেছে দেশটা। এই ছোকরা অফিসারগুলো সঙ্গীত না বুঝুক, গাইতে না জানুক, কিন্তু দুটি রবীন্দ্র সঙ্গীত জানে না এমন বৌ রোচে না ওদের। তাই ভাবছিলাম রেখাকে…

নিশ্চয় নিশ্চয়। আপনাদের পাড়াতেই তো গীতিকা নামের একটা নতুন গানের স্কুল খুলেছে দেখলাম। রেখার যেমন সুরবোধ দুমাসেই ও রপ্ত করে নেবে। অধ্যাপকের কথাটা আঁচ করে নিয়ে বলল মালু। উদারতার একটি প্রশস্ত হাসি ছড়িয়ে বেরিয়ে এল ও। কিন্তু রাস্তায় পড়তে না পড়তেই হপ করে নেবে এল এক উদ্বেগের ছায়া।

উদারতার হাসিটি উবে গেল ওর।

এদেশে আধুনিকতার জোয়ার এসেছে।

চুলের ফ্যাশনে, ঠোঁটের রংয়ে, শাড়ির নক্সা আঁকা আঁচলে, মুখের বোলে, চলার ঢংয়ে, সর্বত্র আধুনিকতার প্রতিযোগিতা। গানের ক্ষেত্রটা বাদ যাবে সেই প্রতিযোগিতার আওতা থেকে, এমন কিছু ভেবে রেখেছিল নাকি মালু? দশটা আধুনিকের মাঝে একটি ভাটিয়ালি, একটি সারি, জারি, ক্লাসিকাল একটিও না। এই তো চলছে। অস্তিত্বের কঠিন সংগ্রামে এটুকু স্বীকৃতিও কী থাকবে না?

একটার পর একটা ট্যুশনি যাচ্ছে। এর অর্থ আয়ের ঘাটতি। রিহানার গঞ্জনা। মালুর হার রিহানার সুমুখে।

তার চেয়েও বড় কথা মালুর সঙ্গীতের ব্যর্থতা। ওর সাধনার মৃত্যু। একদা মালু বয়াতি, আজ বড় জোর রেডিও গায়ক। এর বেশি কিছু নয়। সঙ্গীতের স্রষ্টা নয়, শিল্পীর সৃজনে, কর্মে আর ধর্মে পথিকৃৎ নয়। আগাগোড়া ভাবতে গিয়ে কেমন যেন খেই হারায় মালু। কিছুদিন আগেও কত শ্রদ্ধা সম্মান এসে লুটিয়ে পড়েছে ওর পায়ে। একটানা প্রশস্তি শুনে শুনে নিজেই কানে আঙ্গুল দিত মালু। সেই মালুকেই আজ চতুর্দিক থেকে বর্জনের হিড়িক পড়ে গেছে।

বর্জন? শব্দটার মাঝে যেন অনেক অর্থ। ওর প্রায় ছাত্রছাত্রী আর শ্রোতা, ওর সাধনার সাথে যারা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে, তারা, এমন কী রিহানা, সবাই আজ বর্জন করে চলেছে ওকে।

মালু ভেবে পায় না, সত্যি কী অবাক হবে ও? মুষড়ে পড়ার মতোই বা কী কারণ থাকতে পারে। কেননা চারিদিকেই তো আজ বর্জনের পালা। অতীতকে, ঐতিহ্যকে, কথামালায় শেখা সত্যবোধ, নীতিবোধকে, মহৎকে, ভালোকে, সুরুচিকে-ঝেড়ে মূল বর্জন করার উৎকট প্রতিযোগিতা আজ এই শহরে। সেখানে বর্জিত মালুর সুর, কেননা, নতুন সুরের অভিনবত্বের মাঝেও প্রাচীনের গন্ধ, ঐতিহ্যের ছোঁয়া। এ আর তেমন কথা কী!

তাই হোক। উপেক্ষিত অনাদৃত হয়েই থাকুক মালু। আবার যখন আসবে গ্রহণের পালা তখন আপনার ঐশ্বর্য ভাণ্ডার নিয়ে ওদের সুমুখেই এসে দাঁড়াবে মালু। তদ্দিন? তদ্দিন আপনা পথে একলাই চলবে, সেখানেই ওর জিত।

কিন্তু রিহানা? সে যে মালুর সবচেয়ে বড় পরাজয়। এ পরাজয়ের সত্যটাকে এখনো স্বীকার করতে চায় না মন। বুকের হাড়গুলোও যেন কী এক কান্নায় গুমরে ওঠে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *