তৃতীয় পরিচ্ছেদ
পূর্বকথা — ঠাকুর মুক্তকণ্ঠ — ঠাকুর সিদ্ধপুরুষ না অবতার?
[ঈশ্বরের সঙ্গে কথা — মায়াদর্শন — ভক্ত আসিবার অগ্রে তাদের দর্শন — কেশব সেনকে ভাবাবেশে দর্শন — অখণ্ড সচ্চিদানন্দদর্শন ও নরেন্দ্র — ও কেদার — প্রথম উন্মাদে জ্যোতির্ময় দেহ — বাবার স্বপ্ন — ন্যাংটা ও তিনদিনে সমাধি — মথুরের ১৪ বৎসর সেবা ১৮৫৮-৭১ — কুঠির উপর ভক্তদের জন্য ব্যাকুলতা — অবিরত সমাধি। সবরকম সাধন। ]
ঠাকুর এই কথা বলিতে বলিতে নামিয়া আসিয়া মেঝেতে মহিমাচরণের নিকট বসিলেন। কাছে মাস্টার ও আরও দু-একটি ভক্ত। ঘরে রাখালও আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মহিমার প্রতি) — আপনাকে অনেকদিন বলবার ইচ্ছা ছিল পারি নাই — আজ বলতে ইচ্ছা হচ্ছে।
“আমার যা অবস্থা — আপনি বলেন, সাধন করলেই ওরকম হয়, তা নয়। এতে (আমাতে) কিছু বিশেষ আছে।”
মাস্টার, রাখাল প্রভৃতি ভক্তেরা অবাক্ হইয়া ঠাকুর কি বলিবেন উৎসুক হইয়া শুনিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — কথা কয়েছে! — শুধু দর্শন নয় — কথা কয়েছে। বটতলায় দেখলাম, গঙ্গার ভিতর থেকে উঠে এসে — তারপর কত হাসি! খেলার ছলে আঙ্গুল মটকান হল। তারপর কথা। — কথা কয়েছে!
“তিনদিন করে কেঁদেছি, আর বেদ পুরাণ তন্ত্র — এ-সব শাস্ত্রে কি আছে — (তিনি) সব দেখিয়ে দিয়েছেন।
“মহামায়ার মায়া যে কি, তা একদিন দেখালে। ঘরের ভিতর ছোট জ্যোতিঃ ক্রমে ক্রমে বাড়তে লাগল! আর জগৎকে ঢেকে ফেলতে লাগল!
“আবার দেখালে, — যেন মস্ত দীঘি, পানায় ঢাকা! হাওয়াতে পানা একটু সরে গেল, — অমনি জল দেখা গেল। কিন্তু দেখতে দেখতে চার দিককার পানা নাচতে নাচতে এসে, আবার ঢেকে ফেললে! দেখালে, ওই জল, যেন সচ্চিদানন্দ, আর পানা যেন মায়া। মায়ার দরুন সচ্চিদানন্দকে দেখা যায় না, — যদিও এক-একবার চকিতের ন্যায় দেখা যায়, তো আবার মায়াতে ঢেকে ফেলে।
“কিরূপ লোক (ভক্ত) এখানে আসবে, আসবার আগে দেখিয়ে দেয়। বটতলা থেকে বকুলতলা পর্যন্ত চৈতন্যদেবের সংকীর্তনের দল দেখালে। তাতে বলরামকে দেখলাম — না হলে মিছরি এ-সব দেবে কে! আর এঁকে দেখেছিলাম।”
[শ্রীরামকৃষ্ণ, কেশব সেন ও তাঁহার সমাজে হরিণাম ও মায়ের নাম প্রবেশ ]
“কেশব সেনের সঙ্গে দেখা হবার আগে, তাকে দেখলাম! সমাধি অবস্থায় দেখলাম, কেশব সেন আর তার দল। একঘর লোক আমার সামনে বসে রয়েছে! কেশবকে দেখাচ্ছে, যেন একটি ময়ূর তার পাখা বিস্তার করে বসে রয়েছে! পাখা অর্থাৎ দল বল। কেশবের মাথায় দেখলাম লালমণি। ওটি রজোগুণের চিহ্ন। কেশব শিষ্যদের বলছে — ‘ইনি কি বলছেন, তোমরা সব শোনো’। মাকে বললাম, মা এদের ইংরাজী মত, — এদের বলা কেন। তারপর মা বুঝিয়ে দিলে যে, কলিতে এরকম হবে। তখন এখান থেকে হরিণাম আর মায়ের নাম ওরা নিয়ে গেল। তাই মা কেশবের দল থেকে বিজয়কে নিলে। কিন্তু আদি সমাজে গেল না।
(নিজেকে দেখাইয়া) “এর (আমার) ভিতর একটা কিছু আছে। গোপাল সেন বলে একটি ছেলে আসত — অনেকদিন হল। এর ভিতর যিনি আছেন গোপালের বুকে পা দিলে। সে ভাবে বলতে লাগল, তোমার এখন দেরি আছে। আমি ঐহিকদের সঙ্গে থাকতে পারছি না, — তারপর ‘জাই’ বলে বাড়ি চলে গেল। তারপর শুনলাম দেহত্যাগ করেছে। সেই বোধ হয় নিত্যগোপাল।
“আশ্চর্য দর্শন সব হয়েছে। অখণ্ড সচ্চিদানন্দদর্শন। তার ভিতর দেখছি, মাঝে বেড়া দেওয়া দুই তাক। একধারে কেদার চুনি, আর আর অনেক সাকারবাদী ভক্ত। বেড়ার আর-একধারে টকটকে লাল সুরকির কাঁড়ির মতো জ্যোতিঃ। তারমধ্যে বসে নরেন্দ্র। — সমাধিস্থ!
“ধ্যানস্থ দেখে বললুম, ‘ও নরেনদ্র!’ একটু চোখ চাইলে — বুঝলুম ওই একরূপে সিমলেতে কায়েতের ছেলে হয়ে আছে। — তখন বললাম, ‘মা। ওকে মায়ায় বদ্ধ কর। — তা না হলে সমাধিস্থ হয়ে দেহত্যাগ করবে।’ — কেদার সাকারবাদী, উঁকি মেরে দেখে শিউরে উঠে পালাল।
“তাই ভাবি এর (নিজের) ভিতর মা স্বয়ং ভক্ত হয়ে লীলা করছেন। যখন প্রথম এই অবস্থা হল, তখন জ্যোতিঃতে দেহ জ্বল জ্বল করত। বুক লাল হয়ে যেত! তখন বললুম, ‘মা, বাইরে প্রকাশ হয়ো না, ঢুকে যাও!’ তাই এখন এই হীন দেহ।
“তা না হলে লোকে জ্বালাতন করত। লোকের ভিড় লেগে যেত — সেরূপ জ্যোতির্ময় দেহ থাকলে। এখন বাহিরে প্রকাশ নাই। এতে আগাছা পালায় — যারা শুদ্ধভক্ত তারাই কেবল থাকবে। এই ব্যারাম হয়েছে কেন? — এর মানে ওই। যাদের সকাম ভক্তি, তারা ব্যারাম অবস্থা দেখলে চলে যাবে।
“সাধ ছিল — মাকে বলেছিলাম, মা, ভক্তের রাজা হব!
“আবার মনে উঠল, ‘যে আন্তরিক ঈশ্বরকে ডাকবে তার এখানে আসতেই হবে! আসতেই হবে! দেখো, তাই হচ্ছে — সেই সম লোকই আসছে।
“এর ভিতরে কে আছেন, আমার বাপেরা জানত। বাপ গয়াতে স্বপ্নে দেখেছিলেন, — রঘুবীর বলছেন, ‘আমি তোমার ছেলে হব।’
“এর ভিতরে তিনিই আছেন। কামিনী-কাঞ্চনত্যাগ! একি আমার কর্ম। স্ত্রীসম্ভোগ স্বপনেও হলো না।
“ন্যাংটা বেদান্তের উপদেশ দিলে। তিনদিনেই সমাধি। মাধবীতলায় ওই সমাধি অবস্থা দেখে সে হতবুদ্ধি হয়ে বলছে, ‘আরে এ কেয়া রে!’ পরে সে বুঝতে পারলে — এর ভিতরে কে আছে। তখন আমায় বলে, ‘তুমি আমায় ছেড়ে দাও!’ ও-কথা শুনে আমার ভাবাবস্থা হয়ে গেল; — আমি সেই অবস্থায় বললাম, ‘বেদান্ত বোধ না হলে তোমার যাবার জো নাই।’
“তখন রাতদিন তার কাছে! কেবল বেদান্ত! বামনী বলত, ‘বাবা, বেদান্ত শুনো না! — ওতে ভক্তির হানি হবে।’
“মাকে যাই বললাম, ‘মা, এ-দেহ রক্ষা কেমন করে হবে, আর সাধুভক্ত লয়ে কেমন করে থাকব! — একটা বড় মানুষ জুটিয়ে দাও!’ তাই সেজোবাবু চৌদ্দ বৎসর ধরে সেবা করলে!
“এর ভিতর যিনি আছে, আগে থাকতে জানিয়ে দেয়, কোন্ থাকের ভক্ত আসবে। যাই দেখি গৌরাঙ্গরূপ সামনে এসেছেন, অমনি বুঝতে পারি গৌরভক্ত আসছে। যদি শাক্ত আসে, তাহলে শক্তিরূপ, — কালীরূপ — দর্শন হয়।
“কুঠির উপর থেকে আরতির সময় চেঁচাতাম, “ওরে, তোরা কে কোথায় আছিস আয়।’ দেখো, এখন সব ক্রমে ক্রমে এসে জুটেছে!
“এর ভিতর তিনি নিজে রয়েছেন — যেন নিজে থেকে এই সব ভক্ত লয়ে কাজ করছেন।
“এক-একজনের ভক্তের অবস্থা কি আশ্চর্য! ছোট নরেন — এর কুম্ভক আপনি হয়। আবার সমাধি! এক-একবার কখন কখন আড়াই ঘন্টা! কখনও বেশি! কি আশ্চর্য!
“সবরকম সাধন এখানে হয় গেছে — জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ, কর্মযোগ। হঠযোগ পর্যন্ত — আয়ু বাড়াবার জন্য! এর ভিতর একজন আছে। তা না হলে সমাধির পর ভক্তি-ভক্ত লয়ে কেমন করে আছি। কোয়ার সিং বলত, ‘সমাধির পর ফিরে আসা লোক দেখি নাই। — তুমিই নানক’।”
[পূর্বকথা — কেশব, প্রতাপ ও কুক্ সঙ্গে জাহাজে ১৮৮১ ]
“চারিদিকে ঐহিক লোক — চারদিকে কামিনী-কাঞ্চন — এতোর ভিতর থেকে এমন অবস্থা! — সমাধি, ভাব, লেগেই রয়েছে। তাই প্রতাপ (ব্রাহ্মসমাজের শ্রীপ্রতাপচন্দ্র মজুমদার) — কুক্ সাহেব যখন এসেছিল, জাহাজে আমার অবস্থা (সমাধি-অবস্থা) দেখে বললে, ‘বাবা! যেন ভূতে পেয়ে রয়েছে’।”
রাখাল, মাস্টার প্রভৃতি অবাক্ হইয়া ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের শ্রীমুখ হইতে এই সকল আশ্চর্য কথা শুনিতেছেন।
মহিমাচরণ কি ঠাকুরের ইঙ্গিত বুঝিলেন? এই সমস্ত কথা শুনিয়াও তিনি বলিতেছেন, “আজ্ঞা, আপনার প্রারব্ধবশতঃ এরূপ সব হয়েছে।” তাঁহার মনের ভাব, — ঠাকুর একটি সাধু বা ভক্ত। ঠাকুর তাঁহার কথায় সায় দিয়া বলিতেছেন, “হাঁ, প্রাক্তন! যেন বাবুর অনেক বাড়ি আছে — এখানে একটা বৈঠকখানা। ভক্ত তাঁর বৈঠকখানা।”