নীলগঞ্জ হাই স্কুলে হেডমাস্টার মনসুর সাহেব মাথা নিচু করে তাঁর শোবার ঘরের খাটে বসে আছেন। তার সামনেই ঘোমটা দিয়ে বসে আছেন তার স্ত্রী আসিয়া। বিস্ময়কর ঘটনা ঘটেছে আসিয়া এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। তাঁর মাথায় কোনো সমস্যা নেই।
মধ্যদুপুর। প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি শুরু হয়েছে কাল রাত থেকে। এত প্রবল বর্ষণ নীলগঞ্জে এর আগে কখনো হয়েছে বলে মনসুর সাহেব মনে করতে পারছেন না। তিনি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, আসিয়া, তুমি যদি অনুমতি দাও। তাহলে আমি একটা কাজ করতে চাই।
আসিয়া ক্ষীণ গলায় বললেন, কী কাজ?
মনসুর সাহেব বললেন, ঘোমটা সরাও। কথাগুলি আমি তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলতে চাই।
আসিয়া ঘোমটা সরালেন। মনসুর সাহেব বললেন, আমার অতি প্ৰিয়জন ইরতাজউদ্দিন কাসেমপুরী সবসময় বলতেন, যে স্বামী স্ত্রীর মনে কষ্ট দিয়ে কোনো কাজ করবে। আল্লাহপাক তাকে কখনো ক্ষমা করবেন না। যে কাজটা আমি করতে যাচ্ছি, তার জন্যে তোমার অনুমতি চাই।
আসিয়া আবারো বললেন, কী কাজ?
মনসুর সাহেব বললেন, ইরতাজউদ্দিন কাসেমপুরীকে মিলিটারিরা গতকাল সন্ধ্যায় নদীর পাড়ে গুলি করে মেরেছে। তারা এ অঞ্চলে কারফিউ দিয়ে রেখেছে। মৃতদেহ পড়ে আছে নদীর পাড়ে। ভয়ে কেউ সেখানে যাচ্ছে না। আমি উনার ডেডবডি নিয়ে আসতে চাই। নিয়মমতো কবর দিতে চাই।
আসিয়া বললেন, আপনি একা এই কাজ পারবেন?
কেন পারব না? পারতে হবে।
আপনি যদি বলেন, তাহলে আমি যাব আপনার সঙ্গে।
মনসুর সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, তুমি যেতে চাও?
জি যেতে চাই। মিলিটারি। যদি আপনাকে গুলি করে মারে, তাহলে আপনার সঙ্গে আমিও মরতে চাই। আমি একা বেঁচে থেকে কী করব?
নীলগঞ্জের মানুষ বিস্ময়ের সঙ্গে দেখল, হেডমাস্টার সাহেবের সঙ্গে ঘোমটা পর একজন মহিলা প্ৰবল বর্ষণের মধ্যে মাওলানা ইরতাজউদিনের বিশাল শরীর টেনে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। তাদের খুবই কষ্ট হচ্ছে। অনেকেই দৃশ্যটা দেখছে, কেউ এগিয়ে আসছে না।
হঠাৎ একজনকে ভিজতে ভিজতে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। সে আসিয়া বেগমের কাছে এসে উর্দুতে বলল, মাতাজি আপনি সরুন, আমি ধরছি।
মনসুর সাহেব বললেন, আপনার নাম?
আগন্তুক বলল, আমি বেলুচ রেজিমেন্টের একজন সেপাই। আমার নাম আসলাম খাঁ।*
————-
*ইরতাজউদ্দিন কাশেমপুরীর নামাযে জানাজা হয় দেশ স্বাধীন হবার পর। ঐদিন তার কবর হলেও জানাজা হয় নি। জানাজার জন্যে মাওলানা খুঁজে পাওয়া যায় নি।