৫১
নিমকহারাম শব্দটাই বারবার মুখে উঠে আসতে চাইছে। এই লোককেই না বীণাপাণি মরণের। হাত থেকে উদ্ধার করে এনেছিল? তার পাঠানো টাকাতেই না আজও প্রতিপালন হয় ওর বাপ-মা? তার পয়সাতেই না ও দিনের পর দিন ঠ্যাঙের ওপর ঠ্যাং তুলে বসে বসে খায়? মুখের একটা কথায় রাত না পোয়াতেই বিয়ে করা বউকে ছেড়ে চলে গেল! গেল তো যাক! বীণাপাণিও জীবনে আর ওর মুখ দেখবে না।
সকালে ঘুম ভেঙে বিছানাটা খালি দেখেই বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল তার। নিমাই রোজই খুব ভোরে উঠে পড়ে। বাইরে-টাইরে খুটখাট কাজ করে। তাই ঘর খালি দেখে চমকানোর কিছু ছিল না। কিন্তু কখনও কখনও মনটা যেন কু গেয়ে ওঠে। বীণাপাণি কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারল না। বাপের বাড়ি বলে কথা, জামাই চলে গেছে জানলে একটা সোরগোল উঠবে হয়তো। একটু খুঁজে দেখল, নিমাই তার সামান্য জামা আর ধুতি নিয়ে যায়নি। পরনে যা ছিল, তাই নিয়েই গেছে। পয়সাকড়িও ছোঁয়নি। তবে সে যে বিদেয় হয়েছে তাতে সন্দেহ ছিল না বীণাপাণির। সে টের পাচ্ছিল। ঘরে একটা খাঁ-খাঁ ভাবই জানান দিচ্ছে সে কথা।
আজ বীণা কাঁদল না। তার জ্বলুনি হচ্ছিল বুকে। নিমকহারাম! নিমকহারাম! মুখচোখ স্বাভাবিক রেখে সে বেরোলো। পুকুরঘাট গেল। ফিরে এসে বাসি কাপড় ছাড়ল। তারপর রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে বসে বলল, মাথাটা ধরে আছে। একটু চা দাও তো মা।
নয়নতারা জামাইয়ের জন্য হালুয়া আর রুটি তৈরি করছিল। বলল, দিই। জামাইকে ডাক তো, রুটি ক’টা গরম গরম খেয়ে নিক।
বীণা ভ্রূ কুঁচকে একটু ভাবল। তাহলে মাও টের পায়নি! অবশ্য পাবেই বা কী করে? নিমাই কি কাউকে বলে গেছে? তেজ করে বোধ হয় রাত থাকতেই রওনা দিয়েছে। বে-আকেলে তোক, দরজা ভেজিয়ে রেখে গেছে। চোর-টোর আসতে পারত।
চোরের চিন্তাতেই হঠাৎ চমকে ওঠে বীণাপাণি। আসতে পারত কেন? এসেছিল কিনা তাই বা কে জানে! ডলার-পাউন্ডের প্যাকেটটা ছিল বালিশের তলায়। আছে তো?।
প্রায় পাখির মত উড়ে ঘরে এল বীণা। বালিশ উল্টে দেখল। প্যাকেট আছে। বুকটা হঠাৎ এত ধকধক করছিল যে বলার নয়।
আবার রান্নাঘরে এসে বসতেই নয়নতারা বলল, অমন হুড়ুম করে কোথায় গিয়েছিলি?
একটা জিনিস দেখে এলাম। হ্যাঁ মা, এখানে চোর-ছ্যাঁচড়ের উপদ্রব কেমন গো?
আছে মা, ভালই আছে। তবে আমাদের বাড়িতে আছেটাই বা কি? নেবেই বা কি? কিন্তু জামাই কোথায় গেল?
সকাল থেকে জামাই-জামাই করছো কেন? তাকে আমি একটা কাজে পাঠিয়েছি।
নয়নতারা অবাক হয়ে বলে, কোথায় পাঠালি আবার! আমি যে জলখাবার করে বসে আছি।
খাওয়ার লোক আছে মা। সে একটু বনগাঁয়ে গেছে।
বনগাঁ! বলে হাঁ করে থাকে নয়নতারা, হঠাৎ গেল কেন?
বললাম তো কাজ আছে।
তা কখন ফিরবে?
ফিরবে না।
দেখ কাণ্ড! কই, কালও তো কিছু বলিসনি!
বললাম তো, হঠাৎ একটা জরুরি দরকার পড়ে গেল।
জামাই নেই শুনে নয়নতারা ভারি হতাশ হয়েছে। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি সকাল থেকে রান্নাবান্নার জোগাড় করছি। নিমাই কচুর শাক খেতে ভালবাসে বলে এই ডাঁই কচুর শাক কেটে এনেছি। কী হবে এখন?
বীণা মুখ গোমড়া করে বলে, বলেছি তো, কিছুই ফেলা যাবে না। কচুর শাক ভারি তো একটা জিনিস!
সকালটা এভাবে পাশ কাটানো গেল। একটু বেলায় বারান্দায় যখন বাবাকে গম্ভীর আর দুঃখী মুখে বসে থাকতে দেখল, বীণা তখন কাছে গিয়ে ডাকল, বাবা!
বিষ্ণুপদ মেয়ের দিকে চোখ ফিরিয়ে একটু দেখল, তারপর বলল, আয়, বোস এসে এখানে। কিছু বলবি?
তুমি সারাক্ষণ একদৃষ্টে ওই ঘরখানার দিকে চেয়ে কী দেখ বাবা?
বিষ্ণুপদ ম্লান একটু হেসে বলে, ঘরখানা আর শেষ করতে পারল না রামজীবন। একটু করে হয়, আবার থেমে থাকে। তাই দেখি চেয়ে চেয়ে।
কাছটিতে এসে মাটির ওপরেই বসে পড়ল বীণা। বলল, তাই বা দেখার কী?
বিষ্ণুপদ মৃদু স্বরে বলল, ওটার মধ্যে মানুষের একটা লড়াই আছে যে। মানুষ কত চেষ্টা করে, সব কি হইয়ে তুলতে পারে? খানিকটা হয়, খানিকটা হয় না। চেয়ে চেয়ে দেখি। আমার আর কী। দেখার আছে বল!
বীণাও ঘরখানার দিকে চেয়ে ছিল। অনেকটা উঠেছে। ছাদ ঢালাই বাকি। ভারার বাঁশ এখনও বাঁধা আছে, তাতে শ্যাওলা ধরেছে, পচেও গেছে অনেকটা। বীণা জানে, মেজদা যদি মদ-টদ না খেত, তাহলে হয়তো হয়েও যেত ঘরখানা। এই ঘরখানা নিয়ে মেজদা আর সেজদায় তুমুল ঝগড়া বেঁধেছে, তার খবরও বীণা পেয়েছে মায়ের কাছে।
বীণা হঠাৎ বলল, এ বাড়িতে কি আমার ভাগ আছে বাবা?
বিষ্ণুপদ আনমনা ছিল। জবাবটা দিল একটু দেরিতে, আছে।
ভাগ হলে আমি কতটা জমি পাবো?
পাবি খানিকটা। কেন রে, থাকবি এখানে এসে?
থাকি না থাকি, একখানা ঘর তুলে রাখতে পারলে হয়।
কেন, বনগাঁ তোর ভাল লাগে না?
তাও লাগে।
আর পালপাড়া? সেখানে কেমন লাগে?
বীণা একটু মাথা নিচু করে থাকে। তারপর বলে, সেখানে অভাব ছাড়া আর কিছু নেই বাবা। সংসারটা যেন এক পেট খিদে নিয়ে বসে আছে।
বিষ্ণুপদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, মরে গেলে আর খিদেও থাকে না, তেষ্টাও থাকে না।
বীণা অবাক হয়ে বলে, হঠাৎ মরার কথা কেন বাবা?
বিষ্ণুপদ একটু যেন অপ্রস্তুত হল। বলল, বলছি কি, খিদেটা হল বেঁচে থাকার লক্ষণ। খিদে পায় মানে বেঁচে আছে।
তুমি মাঝে মাঝে বড় অদ্ভুত কথা বলো বাবা। ভয় করে।
ওরে না, ভয় পাওয়ার মতো কথা নয়। মাঝে মাঝে বেবাক ভুল হয়ে যায়। বেঁচে আছি, না মরে গেছি। মাঝরাতে স্বপ্ন-টপ্ন দেখলে ওরকম হয়। তখন খিদে পেলে বা বাহে পেচ্ছাপের বেগ হলে বুঝতে পারি—না, বেঁচেই আছি। তাই বলছিলাম।
বীণা ফিকে একটু হাসল, তোমার মাথায় সব উদ্ভট চিন্তা।
বিষ্ণুপদ নির্বিকারভাবে বলে, ওই ঘরখানার কাছে আমি কত কিছু শিখি!
ঘরের কাছে শেখো! সে কী গো বাবা! ঘরের কাছে আবার শিখবে কি? তোমার মাথাটাই গেছে।
তাও গেছে। মাথাটা চিরকালই গবেট। এ মাথা দিয়ে কিছু করতে পারলাম না মা।
দুঃখ পেলে বাবা? ওভাবে বলিনি।
ওরে না। দুঃখ-টুঃখ আজকাল আর তেমন হয় না। ওসব পার হয়ে এসেছি। এখন শুধু চারদিকটা চেয়ে চেয়ে দেখি। আগে যা সব দেখেও দেখতে পেতাম না, এখন তা পাই। সময় দিব্যি কেটে যায়।
বীণাপাণির ঘোর সন্দেহ হতে থাকে, তার বাবার মাথায় একটু ছিট দেখা দিয়েছে। বরাবরই একটু যেন ছিল, এখন বেড়েছে।
আমার কথা তোমার মনে হয় বাবা?
বিষ্ণুপদ ঘরখানার দিকে চেয়ে ছিল। বলল, হয়। সকলের কথাই মনে হয়। মনে-হওয়া নিয়েই তো আছি। এখন তোর কথা আরও বেশী মনে হয়।
কেন বাবা?
বিষ্ণুপদ চোখ না ফিরিয়েই বলে, নিমাইকে ধরে রাখতে পারলি না! মা!
বীণা একটু চমকে উঠল, ধরে রাখব মানে! তাকে তো একটা কাজে পাঠিয়েছি।
বিষ্ণুপদ নিরুত্তেজ গলায় বলে, তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। অন্ধকারেই বেরিয়ে যাচ্ছিল, ডেকে বসিয়ে কথা কইলাম। তারপর টর্চ ধরে এগিয়ে দিলাম বটতলা অবধি। বড় দাগা পেয়েছে।
বীণা কিছুক্ষণ স্তব্ধ থেকে বলল, কি কথা হল?
সব কি মনে আছে! নানা কথাই হচ্ছিল।
এড়িয়ে যেও না বাবা। কী বলে গেল তোমাকে?
বিষ্ণুপদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, নিমাই কাঁদছিল।
বীণা পুরুষের কান্না সহ্য করতে পারে না। কান্নার কথায় তার রাগ হল। ঝাঁঝের গলায় বলল, ভ্যাত-কাঁদুনে পুরুষ দু চোখে দেখতে পারি না। কী বলে গেল তোমাকে? ডেকে তুলেছিল নাকি ঘুম থেকে?
না। আমার মাঝে মাঝে বায়ু চড়ে যায়। তখন বারান্দায় এসে বসে থাকি। হঠাৎ শুনলাম তোদের ঘরে দরজা খোলার শব্দ। তারপরই নিমাইয়ের কান্নার শব্দটা পাই। ডেকে বসালাম।
আমার নামে অনেক কুচ্ছো গেয়ে গেছে, না?
বিষ্ণুপদ যেন শঙ্কিত চোখে একবার মেয়ের দিকে তাকিয়ে নিল। তারপর ফের চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল, তোমার বিয়েটা যে ভাল হয়নি মা, তার জন্য আমিই দায়ী। তুমি যদি আজ আমাকে খুব বকাবকি করো, গালাগাল দাও, তাতে যদি তোমার বুকটা ঠাণ্ডা হয়, তো তাই করো মা।
ও কথা কেন বলছো বাবা! তোমাকে বকব কেন! আমারও কি কপালের লিখন বলে কিছু নেই?
কপালের কথা আজকাল আমার তেমন বিশ্বাস হয় না। কর্মফলে হয়। মানুষ মোটাবুদ্ধির হলে বড় ভয়ের কথা। সে যে কত অকাজ করে ফেলতে পারে! আমার মতো আহাম্মক নেই।
কথা ঘুরিয়ে ফেলছে কিন্তু বাবা। বলতে চাইছো না।
নিমাই তোর নামে বানিয়ে কিছু বলেনি। সে তেমন লোক নয়। সেও হয়তো আহাম্মক, কিন্তু পাজি নয়।
পাজি নানা রকমের হয়। তোমার জামাই আমার জন্য কী করেছে বলো তো! অন্য মেয়ে হলে কবে ছেড়ে চলে যেত। আমিই যে পেলে-পুষে রেখেছিলাম ওকে! শুধু ওকেই বা কেন, ওর। বাপ-মা কার পয়সায় খেয়ে-পরে আছে বলো! তার এই প্রতিদান?
বিষ্ণুপদ একটু ভেবে নিয়ে বলল, তুই কি যাত্রাদলে অনেক টাকা মাইনে পাস?
না বাবা। কিন্তু কষ্ট করে হলেও তো পাঠাই!
তোকে কত করে মাইনে দেয়?
তার কি কিছু ঠিক আছে! পালা যখন চলে তখন কিছু বেশী দেয়, যখন পালা থাকে না, তখন তিনশো-চারশো, যখন যেমন হয়। তবে কাকা লোকে ভীষণ ভাল। যাত্রা তার প্রাণ। আর আমাকেও খুব দেখে। তাই বেঁচে বর্তে আছি।
তুই কি এখন পালা ছাড়াও অন্য কাজ করে দিস?
দিই বাবা। কাকার টাকাপয়সার জিম্মা আর হিসেব রাখি। এ কাজটা তোমার জামাইয়ের করার কথা ছিল। সে পাপের টাকা বলে কাজটা নেয়নি। আমি নিয়েছি। কলিযুগে বেঁচে থাকা ছাড়া আর কোন ধর্ম আছে বলল! ধর্ম ধুয়ে কি জল খাবো?
বিষ্ণুপদ মাথা নেড়ে বলে, ঠিকই কথা।
ধর্ম ধরে বসে থাকলে কোথায় তলিয়ে যেতাম তার ঠিক নেই। তোমার জামাই কথাটা বুঝতে চায় না। কেবল কোনটায় ধর্ম হল, কোনটায় অধর্ম হল, তাই বিচার করে মরছে। অথচ ফুটো পয়সার মুরোদ নেই।
তাই কি কাল ওকে বকেছিলি?
না বাবা। সব তুমি জানো না। তোমার জামাই তোমাকে কী বলেছে কে জানে! তবে তার জবানিতে শুনেছো, এবার আমারটাও শোননা। আমার কাছে কিছু বিদেশি টাকা আছে। চুরিও করিনি, জোছুরিও করিনি। একজন গচ্ছিত রেখেছিল। সে খুন হয়ে যায়। তার কোনও ওয়ারিশ নেই। এখন বলো টাকাটা আমি কাকে ফেরত দেবো? যারা টাকাটা চায় তাদের কারোই ওটা হকের টাকা নয়। তাহলে কি আমার অধর্ম হল নাকি? টাকার গায়ে কি কারও নাম লেখা আছে?
তা বটে।
তুমি আমার কথাটা বুঝতে পারছো বাবা?
পারছি। টাকা কি অনেক?
তা, খারাপ হবে না। ডলারের দাম ওঠে পড়ে। রোজ একরকম থাকে না।
কাঁচা ঘরে থাকিস, তোর চোর-বাটপাড়ের ভয় নেই?
নেই আবার! খুব আছে! সেইজন্যই তো তোমার কাছে গচ্ছিত রাখতে চেয়েছিলাম। রাখবে বাবা?
রাখলে তোর সুবিধে হবে?
হবে বাবা। বনগাঁয়েই তো বেশী ভয়। সেখানে ওই টাকা নিয়ে ধুন্ধুমার হচ্ছে। একটা পাজি লোক জেনেও গেছে। সেটা তোমার জামাইয়ের দোষেই। যদি বলে দেয় তো আমার ওপর হামলা হতে পারে।
বিষ্ণুপদ একটু হাসল।
হাসছো কেন বাবা?
টাকাটা কত হতে পারে তাই ভাবছি।
হিসেব করিনি। তবে আমাদের কাছে অনেক।
আরও খুন হয়েছে নাকি?
হয়েছে। কিন্তু কোনওটাই তো আমার দোষে হয়নি। আমি তো টাকাটা চুরি করিনি। তোমার জামাই তোমাকে উল্টো বোঝয়নি তো!
না। এরকমই যেন বলছিল।
তাহলে বাবা? টাকাটা রাখবে তোমার কাছে?
গচ্ছিত থাকলেই কি হয়? টাকা রক্ষা করার সাধ্যি কি আছে?
তার মানে?
টাকা রক্ষা করা এক মস্ত দায়। আমার বয়স চলে গেছে, মাথা কাজ করে না, চারদিকে সব লোভী চোখ। আমার কাছে কি রাখতে আছে? মোটাবুদ্ধির কাজ হবে না!
তাহলে কী হবে বাবা?
মাথা ঠাণ্ডা করে খানিক ভাব। টাকার সঙ্গে অনেক বিপদ-আপদ লেগে থাকে। ওগুলোই টাকার ময়লা।
আমার যে বনগাঁয়ে ওই টাকা নিয়ে যেতে ভরসা হয় না।
বনগাঁ থেকে তাহলে বাস উঠিয়ে দে। পালপাড়ায় গিয়ে থাক।
তুমি যে কী বলো না, তার ঠিক নেই। বনগাঁ ছাড়লে মাসকাবারি মাইনে কে দেবে শুনি?
সেটাই তো কঠিন প্রশ্ন।
কয়েকটা দিন বাবা। তারপর বিপদ কাটলে এসে নিয়ে যাবো।
কাটবে?
কাটবে বাবা। ক’দিন পর আর লোকে ও টাকার খোঁজও করবে না।
এই হুট করে বাপের বাড়ি এলি, এতে লোকের সন্দেহ হবে না?
অত কে ভাবছে বলে?
তুই কবে যাবি?
দিন সাতেকের কথা কাকাকে বলে এসেছিলাম। দু-চারদিন বেশী থাকলে দোষ হবে না।
তাহলে একটা দিন টাকার কথাটা ভুলে যা। ভাল করে খা, ঘুমো। আর কষে ভাবতে থাক।
আমার মাথায় অত ভাবনা আসে না। কী ভাববো?
টাকার কথাই ভাব। টাকাটা দিয়ে কী হবে, কী করতে চাস, এসবই ভাবতে থাক। টাকাটা পেয়ে তোর লাভ হল, না লোকসান হল, তাও ভাব।
লোকসান কেন হবে বাবা?
লোকসান নানারকম আছে। ভেবে দেখ।
তোমার জামাই কোথায় গেছে, কিছু বলে গেছে?
স্পষ্ট করে নয়। তবে মনে হয় বাপ-মায়ের কাছেই যাবে প্রথমে। ওদিকে খুব টান।
সেটাই হয়েছে আমার আর এক জ্বালা।
বিষ্ণুপদ ভ্রূ কুঁচকে বলে, তোর শ্বশুর শাশুড়ি কি ভাল নয়?
ভাল হবে না কেন? ভালই। তবে তারা সব কাঙাল ধরনের লোক। সবসময়ে হাতজোড় করে আছে যেন।
সেটা তোর ভাল লাগে না?
কেন লাগবে? একটু লোভীও।
পয়সা না থাকলে মানুষ কি আর মানুষ থাকে? কিরকম ধারা হয়ে যায় যেন। এখন যা, পুরনো খেলুড়ি আর বন্ধুদের সঙ্গে বেশ করে কয়েকটা দিন গল্প-টল্প কর। অত ভাবিস না।
তোমার জামাই যে নতুন চিন্তায় ফেলে গেল।
জামাই তোকে বিপদে ফেলবে না ইচ্ছে করে। সে তেমন লোক নয় বোধ হয়।
তার আহাম্মকিকেই যে ভয় পাই।
বিষ্ণুপদ একটু হাসল। বলল, আহাম্মক ছাড়া আর কী? খুব আহাম্মক। এ যুগে অচল।
বাপের বাড়ি সাতটা দিনই কাটাল বীণা। তবে খুব আনন্দে নয়। নিমাইয়ের কোনও খবর নেই। বনগাঁয়ে কী হচ্ছে কে জানে। ঘরে পাশের বাড়ির একটা ছেলের রাতে এসে শোওয়ার কথা সে শুচ্ছে তো! নানা চিন্তা।
বনগাঁ যাওয়ার দুদিন আগে রাঙা ফিরে এল।
মেজদা মেজবৌদি কথাই বলে না বীণার সঙ্গে। আলাদা ঘরে তারা নিজেদের মতো থাকে। এসে একবার গিয়ে প্রণাম করে এসেছিল তাদের। দায়সারা একটু কুশল প্রশ্ন করেছিল। দেখে খনি হয়েছে বলে মনেও হল না। কেমন আলগা ভাব।
সেই তুলনায় সেজো রাঙা কিছু মিশুকে। বীণাকে দেখে জড়িয়ে ধরে বলল, ইস! কত দিন। আসেনি!
বেশ গল্প হল রাঙার সঙ্গে। তার চেয়েও বেশী ভাল লাগল দুটো ভাইপোকে। তারা পিসির সঙ্গে সারাদিন লেগে থাকে। গোপাল কথা কইতে পারে না, কিন্তু তারও বুকে কথা আছে নিশ্চয়ই। সে চোখ দিয়ে সেই কথা বলে। তাই গোপালের চোখদুটো অমন মায়াবী বোধ হয়।
ও সেজবউদি, তোমার তো দু-দুটো আছে, গোপালকে দাও না আমায়। আমি পুষ্যি নেবো।
নাও না ঠাকুরঝি, নিলে তো বাঁচি। ওটার জন্য ভেবে ভেবেই তো আমার বুকের দোষ হওয়ার জোগাড়।
তুমি মুখে বলছে, সত্যিই কি আর দেবে?
রাঙা হেসে বলে, যার সম্পত্তি তাকে একবার জিজ্ঞেস করে নাও। ওর বাপকে।
সেজদা! সেজদা আপত্তি করবে না।
তাহলে তো ভালই। কিন্তু পুষ্যির কথা বলছো কেন গো? তোমার কি হতে নেই?
লজ্জা পেয়ে বীণা বলে, কই আর হল?
সে তুমি যাত্রা-থিয়েটার করে বলে হওয়াচ্ছো না। বাচ্চা হলে ফিগার নষ্ট হওয়ার ভয় থাকে, তাই না বলো!
না গো, বাচ্চার ঝক্কি আছে। দেখবে কে?
লোক রাখবে। পয়সার তো আর অভাব নেই!
না নেই! তোমাকে বলেছে। আমি কি সিনেমায় পার্ট করি যে, পয়সা থাকবে?
শুনি যে!
কী শোনো?
তোমার নাকি অনেক পয়সা!
ছাই শুনেছো। দাও না গো এটাকে। খুব আদর করে রাখব, দেখো।
নিমাইবাবুর অনুমতি নিয়েছো?
নিমাইবাবুর অনুমতি! কেন বলো তো! এতে তার অনুমতির আবার কী দরকার?
পুরুষ মানুষরা ভাই, অন্যের ছেলেপুলে ঘরে ঢোকানো পছন্দ করে না।
তোমার সব অদ্ভুত ভাবনা! সে লোক খারাপ নয়। বাচ্চা-কাচ্চা ভালও বাসে।
দেখো বাপু।
সে দেখব। আগে বলে দেবে কিনা।
রাঙা ফাঁপরে পড়ে বলে, দিতে আপত্তি নেই। কিন্তু তুমি সামলাতে পারলে হয়! বোবা বটে, কিন্তু ভীষণ দুষ্ট।
হোক গে। একটাকে ঠিক সামলে রাখব।
খুব বুঝে চলতে হবে কিন্তু। খিদে পেলে রেগে যায়।
তুমি এবার ফাঁড়া কাটছো।
না গো। বোবা ছেলের মনের কথা না বুঝলে বিপদ। এখানে সবাই মিলে দেখে রাখি। ওখানে তুমি আর নিমাইবাবু।
তা বটে।
তাই বলছিলাম, নিতে চাচ্ছো নাও, কিন্তু কঠিন হবে। আরও একটা কথা আছে। ও সবচেয়ে বেশী ভালবাসে কাকে জানো? পটলকে। সারাদিন পটল ওকে বুকেবুকে করে আগলে রাখে। দাদা ছাড়া গোপাল অচল।
তাহলে আমাকে দুটোই দাও।
রাঙা খুব হাসল, তাহলে তো আমি হালকা হই। এর পর পটলের বাপ বা ঠাকুমা দাদু সবাইকেই। নিয়ে যাওয়ার বায়না করবে না তো! সে ভাই পেরে উঠব না।
গোপালকে ঘুরে ঘুরে দেখে বীণা। একা ঘরে তাকে আদর করে, আর ভাবে, আহা! আমার এরকম একটা হল না?
সাত দিন পেরোনোর পর বীণাকে বনগাঁয়ে যেতেই হল। শেষ অবধি গোপালকে নেওয়া হল না। দোনোমোনো করে টাকাটাও সঙ্গেই রাখল! গচ্ছিত রেখে যেতে ভরসা হল না।
বনগাঁয়ে ফিরল সন্ধেবেলা। ঘর খুলল। হ্যারিকেন জ্বালল। চারপাশ ঘুরে ঘুরে দেখল। সবই এক আছে। তবু ফাঁকা। বড় ফাঁকা। নিমাই নেই।
রাতে আর রান্না করল না বীণা। কয়েকখান রুটি আর আলুর ঘ্যাঁট রাস্তায় খাওয়ার জন্য করে দিয়েছিল মা। সেটা খাওয়া হয়েছিল না। রাতে সেই ঠাণ্ডা রুটি তরকারি খেয়ে শুয়ে রইল।
শ্যামল তার ফেরার কথা জানত না। রাতে শুতে এসে বলল, ওঃ তুমি এসে গেছ? ভালই হয়েছে। কাকা তোমার খোঁজ করতে এসেছিল কাল।
ওঃ, কিছু দরকার আছে?
তা বলেনি। তবে মুখটা খুব গম্ভীর দেখছিলাম।
বীণা একটু ভয় পেয়ে গেল কি? মুখে কিছু বলল না। কিন্তু গভীর রাতে সে একটা নতুন গর্ত খুঁড়ে একটা মেটে হাঁড়ির মধ্যে সরা চাপা দিয়ে প্যাকেটটা রাখল। গর্ত ভরাট করে লেপে পুঁছে দিল। তারপর দুশ্চিন্তার পাথর বুকে নিয়ে শুয়ে রইল।