৫১. নবজাতকের সুতীব্র চিৎকার

ডুঙ, ডুঙ, ডুঙ। রাত থেকেই শব্দটা ছড়িয়ে পড়ছে পাহাড়ে পাহাড়ে। মন্দিরের সামনে রাখা বিশাল জায়টাকে ঘা পড়ছে সমান বিরতিতে। পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে শব্দটা গড়িয়ে যাচ্ছে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে অথবা বুনো গাছগাছালি আর পাথরের খাঁজে খাঁজে।

এখন ভরা বরফের সময়। ঝড়ঝাপটা পেরিয়ে শান্ত রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনগুলো অল্প সময়ের জন্যে আসে। এই রোদে তাপ নেই। দুপুর হল কিনা বোঝার আগেই হিমবাতাস নেমে আসে এভারেস্টের শরীর থেকে। এবারই প্রথম, বরফের প্রথম চোটটা বৃথা গিয়েছে। তাপল্যাঙ কিংবা পাশের গ্রামের কারও কোন ক্ষতি হয়নি। গ্রামবৃদ্ধরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন। যৌথগৃহগুলোতে মানুষ এখন নিবাপদে বসবাস করছে।

ডুঙ, ডুঙ, ডুঙ। শব্দটা বাজছে একনাগাড়ে। আনন্দ দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়াল। সুদীপের জন্যে কাল রাত্রে তার বেশ ঠাণ্ডা লেগে গেছে। বেলা হয়েছে বেশ কিন্তু বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করছিল না। এখনও জ্বর জ্বর ভাবটা ছেড়ে যায়নি। শরীরে বোদ পড়ায় ওর ভাল লাগল। ক্লান্ত চোখে ও চারপাশে তাকাল। এখন সাদায় সাদায় তাপল্যাঙ ঝকঝক করছে। অন্তত ফিটখানেক পুরু এর পায়ের তলায়। বাড়ির ছাদে গাছের পাতায়, চাষের ক্ষেতে, যেখানে চোখ রাখা যায় সেখানেই ষার রোভ জরুরী জায়গাগুলো থেকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে ওদের, ভোরেই আবার ফিরে আসছে। আনন্দ ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। বাজনাটা বেজেই চলেছে একটানা।

পাশাপাশি দুটো ঘর। দুটোই বন্ধ। জয়িতাকে ওরা নিয়ে গিয়েছে এক সপ্তাহ হল। অনেক যত্নে নতুন সুদকেরিঘর তৈরি হয়েছে ঠিক গ্রামের মাঝখানে। তিনজন মাইলিআমার সঙ্গে সে রয়েছে সেখানে। এক ফোঁটা শীতের বাতাস ঢুকছে না সুদকেরিঘরে। চব্বিশ ঘণ্টা আগুন জ্বালিয়ে রাখার ব্যবস্থা হয়েছে। আর মাইলিআমারা ঘণ্টায় ঘন্টায় বেরিয়ে এসে জানিয়ে যাচ্ছে দ্রিমিত কেমন আছে।

সুদীপের ঘরটাও বন্ধ। এবং সুদীপ নেই। কাল রাত্রেই কাণ্ডটা করল সে। মদ খেয়ে মেয়েটাকে সে বলেছিল চলে যেতে। মেয়েটাও নেশা করেছিল। ফলে চটজলদি দুজনের মধ্যে লেগে গেল। ব্যাপারটা যখন সহ্যের বাইরে চলে গেল তখনই আনন্দ ওদের দরজায় পৌঁছেছিল। ইদানীং প্রায়ই দুজনের মধ্যে লাগত। আনন্দ সেগুলোকে উপেক্ষা করার চেষ্টা করত।

আনন্দকে দেখে সুদীপ চিৎকার করেছিল, ওকে চলে যেতে বল আমার কাছ থেকে।

মেয়েটা ঝাঝিয়ে উঠেছিল, ও কি বলল তোমাকে?

আনন্দ শান্ত গলায় জবাব দিয়েছিল, ও তোমাকে চলে যেতে বলছে এখান থেকে।

বলবেই তো। বলবে না? পুরুষমানুষের ক্ষমতা না থাকলে গলার জোর বাড়ে। মেয়েটি চিৎকার করল।

সুদীপ মুখ ফেরাল, ক্ষমতা আছে কি নেই তার পরীক্ষা তোর কাছে দেব না!

দিতে পারলে তো! দিনের পর দিন আমার মত মেয়ে একটা পাথরের পাশে শুয়ে থাকলে সে-ও নড়ে-চড়ে বসত। আবার গলা ফুলিয়ে বলা হয় আমি ওকে ছুঁয়েও দেখিনি। যেন কত কৃতিত্ব! ঠুবি কি করে? তোর মন তো পড়ে আছে দ্রিমিতের জন্যে। মুখের সামনে থেকে খাবার হাওয়া হয়ে গিয়েছে বলে সাধু সাজছিস। মেয়েটা কথা শেষ করে উঠে দাঁড়াতেই টলে গেল।

আর সুদীপ, দূর শালা, নিকুচি করছে বলে ছিটকে বেরিয়ে এল ঘর থেকে।

আনন্দ বলল, এসব কি হচ্ছে সুদীপ!

সুদীপ কাঁধ ঝাঁকাল, জ্ঞান দিস না।

কিছুই দিচ্ছি না আমি। শুধু বলছি স্টপ ইট।

এটা ওকে বল। এমন একটা মেয়েমানুষ যে সেক্স ছাড়া কিছু বোঝে না। এবং ও আমার কাছে স্বীকার করেছে যে মা হবার কোন ক্ষমতা ওর নেই। শী ডিড দ্যাট নট অনলি উইদ হার হাজব্যান্ড! রোলেনরা ভুল করে ওকে নিয়ে যাচ্ছিল। সুদীপ হাঁপাচ্ছিল।

কিন্তু মেয়েটা তোকে বাঁচিয়েছে। তোর সেবা ও যেভাবে করেছে তা আমরা দেখেছি।

ইয়েস, আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু আর কত কৃতজ্ঞতা জানাব!

ও মা হতে পারলে তুই বিরক্ত হতিস না বলতে চাইছিস? আনন্দ প্রশ্নটা করতেই যেন ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল সুদীপ।

উদভ্রান্তের মত মুখ ফেরাল দূরের সুদকেরিঘরের দিকে। তারপর দুহাতে মাথা চেপে ধরে বলল, আই কান্ট স্ট্যান্ড ইট।

বুঝলাম। কিন্তু সব কিছুর একটা শোভন ভঙ্গি আছে, এইটে ভুলে যাস না।

দূর! আমি ওই মেয়েটার কথা বলছি না। জয়ী, জয়ীটা এরকম করবে–! সুদীপ কথা শেষ করল। কিন্তু আনন্দ সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাহলে কি একটু আগে মেয়েটা যে অভিযোগ করল তা সত্যি? সুদীপ হঠাৎ পাগলের মত চিৎকার করে উঠল, ইটস ইনটলারেন্স! ওকে যখন বুড়িগুলো আঁতুড়ঘরে নিয়ে গেল তখন ওর মুখ দেখেছিলি? হার হাইনেস হেঁটে গেলেন কি ভঙ্গিতে? আবার প্রত্যেকদিন মুরগির মাথার সুপ খাওয়াচ্ছে ওরা, ওতে নাকি বাচ্চার মঙ্গল হয়। রোজ চারটে মুরগি মারার সাচ্ছল্য এই গ্রাম এখন অর্জন করেছে? হোয়াই দিস ভি আই পি ট্রিটমেন্ট? কেন?

সুদীপ, তুই এইসব নজর করেছিস? এটা ঠিক না। গ্রামের লোকরা কেন জয়িতাকে কাছে টেনে নিয়েছে তা তোর অজানা নয়। ভুলে যা এসব। আনন্দর কথাটা শেষ হতেই দূরের সুদকেরিঘর থেকে এক বৃদ্ধার চিৎকার ভেসে এল। বাইরে বেরিয়ে বৃদ্ধাটি চিৎকার করে আবার কিছু বলে ভেতরে ফিরে গেল। সেই চিৎকারের প্রতিধ্বনি বাজল মুখে মুখে। এবং তারপরেই কানের নির্দেশে সেই মধ্যরাত্রে জয়টাকে ঘা পড়ল, ডুঙ, ডুঙ, ডুঙ।

সুদীপ চোখ বড় করে আতঙ্কিত মুখে প্রশ্ন করল, কি হল? আনন্দও বুঝতে পারেনি। সুদীপ আবার ঘরের মধ্যে একটা পা বাড়াল। মেয়েটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে টলছে। সুদীপ তাকে প্রশ্ন করতেই মেয়েটা কেঁদে ফেলল।

সুদীপ তাকে ধমক দিল, অ্যাই, কাঁদছিস কেন তুই?

আমার কোনদিন হবে না। ওটা নাকি খুব কষ্টের, আবার কি আরামের!

কোন্‌টা? ঠিক করে কথা বল।

ব্যথা হচ্ছে পেটে দ্রিমিতের। বাচ্চাটা বেরিয়ে আসবার জন্যে নড়াচড়া শুরু করেছে।

মেয়েটি কথা শেষ কমাত্র সুদীপ আফসোসে মাথা নাড়ল, মরে যাবে, নির্ঘাৎ মরে যাবে। ওই তো রোগা পটকা চেহারা। মেয়ে বলে মনেই হয় না। না খেয়ে খেয়ে শরীরে রক্ত নেই। জয়ী মরে গেলে।

এবার আনন্দ উত্তেজিত হল। এক হাতে সুদীপের কাঁধ চেপে ধরে চাপাগলায় বলল, চুপ কর!

তুই চুপ করতে বলছিস? ওই বুড়িগুলো ডেলিভারির কি জানে? যদি এটা সিজারিয়ান কেস হয়? একটা বাচ্চা জয়ীর শরীর থেকে বেরিয়ে আসবে, ভাবতে পারিস? শী উইল নট সারভাইব! অ্যান্ড আই কান্ট স্টে হেয়ার। ওর মরা মুখ আমি দেখতে পারব না। নো। এবং তখনই সুদীপ কাণ্ডটা করল। আচমকা আস্তানার বারান্দা থেকে নেমে সাদা বরফেব ওপর দিয়ে ছুটতে লাগল। ব্যাপারটা বুঝতে পারা মাত্র আনন্দ পা চালিয়েছিল। বরফে পা পিছলে যাওয়ায় ওকে সে শেষ পর্যন্ত ধরতে পেরেছিল, কোথায় যাচ্ছিস তুই?

কলকাতায়। ছেড়ে দে আমাকে।

কলকাতায়? বিস্ময়ে জমে গিয়েছিল আনন্দ।

হ্যাঁ। চোয়াল শক্ত করেছিল সুদীপ।

ও। কিন্তু এত রাত্রে কেন? ঠাণ্ডায় তো জমে যাবি!

জ্ঞান দিস না। ঠিক পারব।

ফিরে গিয়ে পুলিশের কাছে ধবা দেওয়ার জন্যে এসেছিলি?

যা করতে চেয়েছি তা তো হয়েই গেছে। এই পাহাড়ি লোকগুলো এখন যথেষ্ট আত্মনির্ভর। দে ক্যান লুক আফটার দেমসেলভ্‌স।

কিন্তু কলকাতায় ফিরলে তুই মরবি।

মরব। এখানে থেকে একটা মেয়ে ওইভাবে মরছে দেখার পর বেঁচে থাকব?

জয়িতা মরবে এটা ভাবছিস কেন?

এছাড়া কোন উপায় নেই। ওকে মরতেই হবে।

তোর নেশা হয়েছে।

হঠাৎ এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিল সুদীপ। তারপর পাতলা জ্যোৎস্না গায়ে মেখে বরফের ওপর বড় বড় পা ফেলে চলে গেল ওপরের দিকে। আনন্দ মাথা নাড়ল। তার কিছু করার নেই। সুদীপকে সে ধরে বেঁধে রাখতে পারে না। অনেকদিন ধরে সুদীপ পালাই পালাই করছিল। হয়তো নিজের কাছে একটা দায় ছিল বলে যেতে পারেনি। আজ জয়িতার ব্যাপারটাকে উপলক্ষ করে নিজেকেই সান্ত্বনা দিয়ে নিল। স্পষ্ট চোখে আনন্দ যেন দেখতে পেল সান্দাকফু পোঁছবার আগেই সুদীপ অসুস্থ হয়ে মারা পড়ছে। অথচ তার কিছুই করার নেই। নিজেকে ভীষণ নিঃস্ব মনে হচ্ছিল তার। সে এখন কি করবে? কলকাতা থেকে চার বন্ধু যে কারণে পালিয়ে এসেছিল তার একটা সার্থক রূপ এখানে দিতে পেরেছে। এবং এই গ্রামের অনুকরণ শুরু হয়েছে পাহাড়ে পাহাড়ে। অথচ তিনজন আজ তার পাশে নেই। কল্যাণ অবশ্যই শহীদ। জয়িতা? জয়িতাকে সে আজও বুঝতে পারল না। আর সুদীপ যে এভাবে পালিয়ে যাবে তাও তো কল্পনায় ছিল না। যুদ্ধক্ষেত্রে একা দাঁড়িয়ে আছে সে, কোন সৈন্য তার সঙ্গে নেই। না, কোন অবস্থায় সে আর ফিরে যেতে পারবে না। ফেরা মানেই আত্মহত্যা, যেটা তার রক্তে আছে।

এখন এই হালকা মিঠে রোদে দাঁড়িয়ে আনন্দর খুব ইচ্ছে করছিল জয়িতাকে দেখতে। কিন্তু আঁতুড়ঘর, যাকে এরা বলে সুদকেরিঘর তার চৌকাঠে পা রাখা পুরুষদের নিষেধ। মজার ব্যাপার হল জয়িতা এইসব ব্যাপারের সঙ্গে চমৎকার মানিয়ে নিয়েছে। গত দুমাস ধরে ওর সঙ্গে বেশি কথাই বলা যায়নি। সব সময় পাশাংকিত নরমিতরা ওকে সঙ্গ দিত। সেই চটপটে ঝকঝকে মেয়েটা ক্রমশ শ্লথ হয়ে গেল। শরীরের স্মৃীত অংশ নিশ্চয়ই ওকে কষ্ট দিত কিন্তু এবার সে-সব কথা তার জানার উপায় ছিল না। জয়িতা যেন এখন এই গ্রামের মানুষের এবং ও সেটা খুব আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছে। সুদীপের মত তীব্র নয়, কিন্তু আনন্দর মনে হল জয়িতা তাদের থেকে অনেক পা এগিয়ে গিয়েছে। ঈর্ষাটা বুকে দুলছে কিন্তু সেটা বাধ্য হয়ে আছে। গত রাত্রে সুদীপের চলে যাওয়াটা পর্দা তোলার কাজ করেছে। সুদীপ বলেছে জয়িতা মারা যাবে। সুদীপ নিজেও বাঁচতে পারে না ওই পাহাড় রাত্রে ডিঙোতে গেলে। তাহলে রইল সে একা। চারজনেব শেষজন। অথচ তাকে গ্রামের মানুষ ভালবাসে। কিন্তু এখনও নিজের বলে মনে করে না। এরা ভেবেই রেখেছে সময় হলেই সে এই গ্রাম ছেড়ে চলে যাবে। ফলে দূরত্ব ঘোচেনি।

 

ডুঙ, ডুঙ, ডুঙ। জয়ঢাকের শব্দ হচ্ছিল একা একা, একটানা। এখন সেই শব্দের সঙ্গে আরও শব্দ মিলল। পাহাড়ে পাহাড়ে যেন শব্দের পিচকারি ছুটছে। আনন্দ আবও কয়েক পা এগিয়ে গেল। তারপরেই দৃশ্যটা নজরে এল। পাশে গ্রামের একদল মানুষ ঢাকজাতীয় বাদ্য বাজাতে বাজাতে পাহাড় থেকে নামছে। ওপাশেও আর একটা দল মিছিল করে নামছে এই গ্রামের উদ্দেশ্যে। প্রত্যেকটা দলের সঙ্গে উৎসবের বাজনা বাজছে।

সুদকেরিঘরের সামনে যে বিশাল চাতালটা সেখানে কোন নরম বরফ নেই। গ্রামের মানুষের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে এর মধ্যেই। সুদকেরিঘরে ঢুকতে হলে দশটা সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে হয়। সেখানে গ্রামের মেয়েদের ব্যস্ততা দেখা যাচ্ছে। আনন্দকে দেখতে পেয়ে পালদেম এগিয়ে এল, কাল রাত্রেই ব্যথা শুরু হয়েছে কিন্তু বাচ্চাটা কখন বেরিয়ে আসবে মাইলিআমারা এখনও বলতে পারছে না। খুব কষ্ট পাচ্ছে দ্রিমিত। যে বাচ্চা মাকে বেশি কষ্ট দিনে পৃথিবীতে আসে সে চিরদিন সুখী করে রাখে।

আনন্দ পালদেমের দিকে তাকাল। লোকটা এমন ভঙ্গীতে কথা বলছে যেন ওর বাড়ীতেই সন্তান আসছে। পালদেম আবার বলল, আজ দেখছি গ্রামটা মানুষে মানুষে ভরে যাবে। যারা কখনও আমাদের এখানে আসতো না তারাও আসছে।

কেন? প্রশ্নটা আচমকা বেরিয়ে এল আনন্দর ঠোঁট থেকে।

বাঃ। সবাই কাহুনের ঢাকের শব্দ শুনতে পেয়েছে যে।

এই শব্দের মানে কি?

মানে হল আমাদের গ্রামে ভগবানের সন্তান আসছেন। এই শব্দ সমস্ত আবহাওয়াকে পবিত্র করুক। সমস্ত দানো দূরে থাক। যে যেখানে থেকে এই শব্দ শুনছে তারই ইচ্ছে হবে এখানে উপস্থিত হবার। পালদেম হাসল।

ওর পাশে দাঁড়ানো এক বৃদ্ধ বলল, তোমরা কেউ লক্ষ্য করেছ গত দশ চাঁদের মধ্যে পাহাড়ের দানোটা আর আমাদের কান্না শোনায়নি। হে হে বাবা, ওটাও ভয় পেয়েছে। বুড়ি মাইলিআমা বলছিল দ্রিমিতের শরীরে এমন সব চিহ্ন দেখেছে যা সে আগে দ্যাখেনি।

ভিড় জমছিল ওদের ঘিরে। একজন কৌতূহলী হল, কি চিহ্ন বাউ?

নাভি থেকে সোজা একটা নীল রেখা নিচে নেমে গেছে। একটুও আঁকাবাঁকা হয়নি।

সঙ্গে সঙ্গে অনেকগুলো গলায় বিস্ময়ধ্বনি উঠল। একজন বৃদ্ধ এগিয়ে এসে আনন্দর কাঁধ ধরল, সাথী, আমরা তোমাদের কাছে কৃতজ্ঞ। তোমরা তিনজন ছেলে ছিলে, কিন্তু তোমার মন সবচেয়ে ভাল। আমরা খেতে পেতাম না, কিভাবে বাঁচতে হয় জানতাম না। তোমরা নতুন জীবন দিলে। কিন্তু প্রায়ই মনে হত তোমরা চলে গেলে কি হবে? একদিন আমি মরে যাব, পালদেম লা-ছিরিঙরা থাকবে না পৃথিবীতে, তখন আমাদের রক্ত শরীরে নিয়ে যারা বাঁচবে তাদের কি হবে? আজ আর কোন চিন্তা নেই। আমাদের আর তোমাদের রক্ত শরীরে নিয়ে যে আসছে সে তো থেকে যাবে তার সন্তানদের মধ্যে। তাদের মধ্যে তোমরা থাকবে, আমরাও।

এই সময় কাহুন নেমে আসছিলেন মন্দির থেকে, পেছনে তার শিষ্যরা। সবার নজর গেল সেদিকে। অন্দর মাথার ভেতর ঝিমঝিম করছিল। না জেনে একি কথা বলল বৃদ্ধ! আমরা এখন এই একুশ শতাব্দীর শুরুতেও যখনই কিছু চিন্তা করি সেটা আবর্তিত হয় নিজেকে কেন্দ্র করে। হয়তো বিস্তৃত হয়ে তা সমাজ এবং শেষতক দেশে গিয়ে পৌঁছায়। পববর্তী প্রজন্মের কথা কেউ চিন্তা করি না। আগামীকালের নবজাতকের জন্যে পৃথিবীটাকে বাসযোগ্য করে যাওয়ার শপথ নিয়েছিলেন এক তরুণ কবি, কিন্তু তার আবেদন কারও কানে পৌঁছায়নি। অথচ এই পাহাড়ি গ্রামের সরল বৃদ্ধ অর্কপটে বলতে পারল আসল সত্যিটা। যতই বিপ্লব করি না কেন, পরবর্তী প্রজন্মের ভিত সুদৃঢ় না করতে পারলে সেসবই এক সময় অর্থহীন হয়ে দাঁড়াবে।

আনন্দ ধীরে ধীরে মন্দিরেব চাতালে গিয়ে দাঁড়াল। এত মানু এতদিন ছিল কোথায়? ছোট ছোট দলে পাহাড় ফুড়ে এরা নেমে আসছে তাপল্যাঙে। গ্রামে ঢুকে এরা অবাক হয়ে চার পাশে তাকাচ্ছে। হয়তো নিজেদের গ্রামের সঙ্গে তাপল্যাঙকে মিলিয়ে নিতে পারছে না। বাদ্যযন্ত্রের শব্দের সঙ্গে শব্দ মিশে আরও গম্ভীর আবহাওয়া তৈরি হয়ে গেছে। সবাই জড়ো হচ্ছে সুদকেরঘরের সামনে। ক্রমশ আনন্দ জয়িতাকে ঈর্ষা করতে শুরু করল। এই এত মানুষ এসেছে দ্রিমিতের বাচ্চা হবে জনে। দ্রিমিতের বাচ্চা মানে তাদের বাচ্চা। যে বড় হয়ে তাদের দেখাশোনা করবে। এত করে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েও ঠিক এই জায়গায় সে হেরে গেল জয়িতার কাছে। পুরুষ নতুন প্রজন্ম লালন করতে পারে, বীজ বপন করতে পারে, কিন্তু তাকে নির্মাণ করতে পারে না।

 

সেদিন এখানে, এই মন্দিরের চাতালে জয়িতা সেই সাহস দেখিয়েছিল। এমন কি সুদীপের মুখেও শব্দ ফোটেনি একটাও। সমস্ত গ্রাম জমায়েত হযেছিল এখানে নির্বাচিত সদস্যদের সঙ্গে কানও বসেছিলেন বিচারকের আসনে। জয়িতা খানিকটা তফাতে বসেছিল স্বাভাবিক ভঙ্গিতে। পালংদম কথা শুরু করেছিল প্রথমে, দ্রিমিতের পেটে বাচ্চা এসেছে। দ্রিমিত বলছে তার কখনও বিয়ে হযনি। ও নিজেকে এখন এই গ্রামের মানুষ বলে মনে কবে। তাই আমাদের ওপর একটা দায়িত্ব এসে গেছে। আমরা জানি এই গ্রামের কোন কুমারী মেয়ের পেটে বাচ্চা এলে সেই মায়ালুদের বিয়ে দিয়ে দিতে হয়। যদি যে দায়ী সে বিয়ে না করতে চায় তাহলে চরম শাস্তি দেওয়ার নিয়ম। দ্রিমিতের বেলায় আমরা জানি না তার প্রেমিক কে? সে এসেছে দুই বরফেরও আগে আমাদের গ্রামে। অতএব তার বাচ্চা এখানে আসার পরেই পেটে এসেছে। আমি দ্রিমিতকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম কিন্তু সে কোন জবাব দেয়নি।

গুঞ্জন উঠল। আনন্দ লক্ষ্য করল সবকটা দৃষ্টি বারংবার তার এবং সুদাপের ওপর পড়ছে। কাহুন উঠলেন, দ্রিমিত বলুক তার বাচ্চার বাবা কে? সে যেই হোক তাকে বিয়ে করতে হবে। যদি কোন বিবাহিত পুরুষ এই কাজ করে থাকে তাহলে তার নাম বলা হবে।

জয়িতা কোন উত্তর দিল না। যেন তব কানে কথা পোহাচ্ছিল না। ক-ইন এবার গম্ভীর গলায় ডাকলেন, দ্রিমিত!

জয়িতা মুখ ফেরাল। তারপর উঠে দাঁড়াল।

কাহুন বলেন, তোমার সঙ্গে ওই যে দুজন এখানে এসেছে তারা কি বাচ্চার বাউ।

জয়িতা আনন্দর দিকে তাকাল, তারপর সুদীপকে দেখল। জনতা রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে। জয়িতা হাসল। তারপর ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল, না। সঙ্গে সঙ্গে জনতা একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, কে, কে?

কাহুন জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার বন্ধুরা যদি না হয় তাহলে ওটা তো আকাশ থেকে তৈরি হতে পারে না। তুমি কি বলতে চাও এই গ্রামের কেউ?

জয়িতা বিড়বিড় করল, এই গ্রাম? তারপর মাথা নাড়ল, না।

উত্তেজনা এবার তুমুল হল। আনন্দর মনে হল জয়িতা অনাবশ্যক নাটক করছে। এই সময় পেছন থেকে এক বৃদ্ধের গলা ভেসে এল, আমি জানি, আমি দেখেছি।

জনতা অবাক হয়ে পেছনে তাকাল। কাহুন নির্দেশ দিলেন লোকটাকে সামনে আনার জন্যে। মানুষটিকে দেখে সবাই অবাক। ও এই গ্রামে থাকে না। কাহুন তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি বলছ দেখেছ, কি দেখেছ?

একদিন বরফের সময়, ওরা আদর করছিল, আমি সেখানে পৌঁছে গিয়েছিলাম। ওই যে যেখানে ঝরনাটা পাতালে ভেসে গেছে সেখানে। লোকটা হাত বাড়িয়ে দেখাল।

কাহুন বলল, তুমি দাঁড়াও। দ্রিমিত, নামটা আমরা তোমার মুখে শুনতে চাই।

জয়িতা এবার মাথা নাড়ল, কি বলব ভাবছিলাম। বললে তোমরা বিশ্বাস করবে কিনা বুঝতে পারছিলাম না। কারণ ভেবেছিলাম এখন কোন প্রমাণ নেই। কিন্তু এই মানুষটি যখন এগিয়ে এল তখন সত্যি কথা বলতে আমার কোন দ্বিধা নেই। ওর নাম রোলেন।

রোলেন? একসঙ্গে শব্দটা জনতার মুখ থেকে ছিটকে আকাশে উঠে গেল। তারপরেই সব চুপচাপ। যেন সমস্ত তাপল্যাঙ নির্বাক হয়ে গেল। কিন্তু তখনই সুদীপের চিৎকার শোনা গেল; আমি বিশ্বাস করি না। মিথ্যে কথা বলছে ও। তুই আমাদের বোকা বানাতে চাইছিস জয়িতা?

জয়িতা হাসল নিঃশব্দে। তারপর বলল, আমার নাম দ্রিমিত।

কাহুন গলা তুললেন, সাথী, তুমি আমাদের ভাষায় কথা বল। তুমি কি বলতে চাইছ? সুদীপ ভাষা পালটে ব্যক্ত করতেই জয়িতা মাথা নাড়ল, তোর বিশ্বাসের পরিধিটা বড্ড ছোট্ট।

সুদীপ বলল, রোলেন মরে গেছে। একটা মৃত মানুষের নামে দোষ চাপিয়ে তুই কাউকে আড়ালে রাখতে চাইছিস জয়িতা?

জয়িতা কাহুনের দিকে ফিরল, এইজন্যেই আমি নাম বলতে চাইনি। আমি জানতাম আর কেউ না করুক আমার শিক্ষিত বন্ধুরাই প্রথমে অবিশ্বাস করবে।

কাহুন মাথা নাড়লেন। তারপর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বৃদ্ধকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি দেখেছিলে? কার সঙ্গে ওকে দেখেছিলে?

বৃদ্ধ গালে হাত দিল, এ নিয়ে তোমরা এত বিচলিত হচ্ছ কেন? পুরুষ এবং নারীর মন আর শরীর যদি একসঙ্গে সাড়া দেয় সেটা তো আনন্দের কথা।

পালদেম চিৎকার করল, আঃ, তোমাকে যা জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে তাই বল।

বৃদ্ধ বলল, ওই তো বললাম। ওই যে ঝরনাটা যেখানে আড়ালে নেমে গেছে সেখানে ওরা ছিল বরফের সময়ে।

পালদেম বলল, কাহুন তোমাকে জিজ্ঞাসা করেছেন কি দেখেছ, কাকে দেখেছ?

বৃদ্ধ চোখ বন্ধ করে দৃশ্যটা যেন কল্পনা করে নিল, আমি যাচ্ছিলাম সাদা ফুল খুঁজতে। হাঁটতে হাঁটতে অনেক নিচে নেমে গেছি। এমন সময় শব্দ শুনলাম। ভয় হল হয়তো ভালু উঠে আসছে খাদ থেকে। পা টিপে টিপে এগোতেই দেখি দ্রিমিতকে চুমু খাচ্ছে রোলেন। তখন ওদের আশেপাশে কেউ নেই শুধু আকাশ আর বরফ ছাড়া।

পালদেম জিজ্ঞাসা করল, তারপর?

বৃদ্ধ বলল, তারপর ওরা অনেক গল্প করল। অনেক আদর। তারপর, হ্যাঁ, তোমরা শুনতে চাইছ তাই হবে ভেবেছিলাম, হল না! ওদুটোই পাগল, নইলে ওসব করার পর দ্রিমিত রোলেনকে কি বোঝায়। কিভাবে গ্রামের মানুষের উপকার করতে হবে?

পালদেম শুধাল, কিন্তু রোলেনই যে বাবা তার প্রমাণ কি?

বৃদ্ধ হাসল, রোলেন আমাকে বলেছে। আমি যখন পরে তাকে একা ধরে জিজ্ঞাসা করেছিলাম সে কি রকম পুরুষমানুষ, গ্রামের মেয়েদের মনে ধরল না আবার বিদেশী মেয়ে পেয়ে শুধু চুমু খাওয়ার বাইরে কিছু করতে পারে না তখন সে বলেছিল, বাউ, একটা মেয়ের সঙ্গে শোওয়া নিশ্চয়ই আরামের কিন্তু দ্রিমিতের সঙ্গে শোওয়ার পর দেখেছি সেটাই সব নয়।

এবার জনতার গুঞ্জন শুরু হল। জয়িতা সুদীপের দিকে তাকাল, সরি সুদীপ, আমি জানি না তুই কেন আঘাত পাচ্ছিস। কিন্তু আমি রোলেনকে ভালবেসেছিলাম। হি ওয়াজ এ রিয়েল ম্যান। আমি কোন অন্যায় করিনি। বরং আমি মনে করি এই পাহাড়ের সঙ্গে এতদিন আছি, এদের সঙ্গে মিশে যেতে যখন পারছি তখন এদের মধ্যে সবচেয়ে বুদ্ধিমান শক্তিশালী পুরুষটির সন্তান শরীরে নেওয়া আমার কর্তব্য ছিল।

স্পষ্টত দুটো ভাগ হয়ে গেল তাপল্যাঙের মানুষরা। একদল বলল, যদি কেউ রাজী হয় তার সঙ্গে ভ্রিমিতের বিয়ে দেওয়া। নবজাতক একটি পিতৃপরিচয় পাবে। দ্বিতীয় দল বলল, এসবের কোন দরকার নেই। রোলেন মারা গিয়েছে। রোলেনের সন্তান নিশ্চয়ই তার উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সম্পত্তির অধিকারী হবে। সেক্ষেত্রে নতুন করে বিয়ে নয়। সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্যে তখন সভা স্থগিত হয়েছিল। আনন্দ নির্বাক ছিল। এতদিন ধরে নিরন্তর পরিশ্রমে যে আদর্শ সমাজব্যবস্থা তারা তৈরি করতে চেয়েছিল সেটা মূলত ছিল অর্থনৈতিক উন্নয়নের কাঠামো অনুসরণ। কিন্তু দীর্ঘকালের অভ্যেসে তৈরি মানসিক গঠন এত সহজে পরিবর্তিত হয় না। হলে জয়িতাকে নিয়ে এত কাণ্ড ঘটত না। তাছাড়া ধর্ম এবং সামাজিক আইনকে সে স্পর্শ করতে চায়নি। সুদীপের মত কোন হঠকারী মন্তব্য করার চেয়ে সে ধৈর্য ধরতে চাইল। সমস্যার সমাধান কিভাবে হয় সেটা জানার পর বোঝা যাবে এতকাল ঘি ভস্মে ঢালা হয়েছে কিনা। সে লক্ষ্য করল, গ্রামের মেয়েরা কিন্তু জয়িতার সঙ্গ ত্যাগ করেনি। দুতিনজন সবসময় ওর সঙ্গে লেগেই আছে।

দুপুরে আর একটি ঘটনা ঘটল। সেই বৃদ্ধ গ্রামে ফিরে খবর দেওয়ার পর রোলেনের গ্রাম থেকে দশজন মানুষ এখানে উপস্থিত হল। তারা বলল যেহেতু দ্রিমিতের শরীরে রোলেনের সন্তান আসছে, যা এতদিন ওরা কানাঘুষায় শুনে এসেছিল, এখন সভার মাঝে ব্যক্ত হওয়ায় আর কোন ধন্দ নেই—তাই ওরা দ্রিমিতকে সসম্মানে গ্রহণ করতে চায়। তাদের গ্রামের মানুষদের জন্যে স্বপ্ন দেখতে চেয়েছিল বলে রোলেন নিহত হয়েছে কিন্তু সেই স্বপ্ন যখন আজ প্রত্যেকের চোখে তখন দ্রিমিতকে তাদের মধ্যে দরকার।

কথাটা শোনামাত্র তাপল্যাঙের সাধারণ মানুষ আপত্তি জানাল। অসম্ভব। দ্রিমিত তাদের। প্রতি দিনের শোওয়া বসা অভ্যেসে দ্রিমিত জড়িয়ে আছে। ওর পেটে বাচ্চা এসেছে বলেই রোলেনের গ্রামে গিয়ে থাকতে হবে? শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা কাহুন কিংবা নির্বাচিত প্রতিনিধিরাও সমাধান করতে পারছিলেন না। দুপক্ষই সিদ্ধান্ত নিল দ্রিমিত যা চাইবে তাই হবে।

গ্রামের অধিকাংশ যুবকযুবতী চিৎকার করল, দ্রিমিত এখানেই থাকবে। জয়িতা উঠল, তারপর খুব বিনীত গলায় বলল, আমার দাজু, ভাই, বহিনী, আমা এবং সাথীরা। আজ সাবাদিন তোমাদের খুব কষ্ট গেল। আমাকে নিয়ে তোমরা খুব অসুবিধেয় পড়লে। জনতা নিশ্ৰুপ হল। জয়িতা আবার শুরু করল, এই গ্রামে আসার আগে আমি একটা শহরে ছিলাম। সেখানে কেউ আমাকে বলেনি তোমাকে আমার প্রয়োজন। আমার বাবা মা নিশ্চয়ই আমাকে ভালবাসতেন কিন্তু আমি সেটা অনুভব করতে পারতাম না। অক্ষমতা আমারই। আমার বন্ধুরা আমাকে মেয়ে বলে ভাবত না। তাতে সূখী হতাম। এবং এসবের জন্যে কোন কষ্ট হত না। তোমাদের এখানে থেকে আমার মন পালটে গেল, শরীর বদলে গেল, নামও। তোমরা যদি আমায় ভাল না বাসতে তাহলে আমিও এভাবে বদলে যেতাম না। রোলেনকে আমি আমার লোকনে ভাবি। এই জন্যে আমি গর্বিত। আমাদের সাহায্য ছাড়াই রোলেন তাদের জীবন বদলাতে চেয়েছিল। তোমরা যারা ওর গ্রাম থেকে এসেছ তারা আমার শ্রদ্ধার পাত্র। কারণ তোমরা রোলেনের অসমাপ্ত কাজ হাতে তুলে নিয়েছ। তোমরা যা করেছ নিজেদের জোরেই করেছ। আর আমার কাছে পাহাড়ের যে কোন কষ্ট পাওয়া মানুষের চেহারাই একরকম। আমরা যখন বিপদে পড়েছিলাম তখন পালদেমরা আমাদের বাঁচিয়েছিল। পুলিশ যখন ধরতে এসেছিল তখন তোমরা আমাদের রক্ষা করেছ। এতদিন আমরা তোমাদের সাথী ছিলাম, এখন আত্মীয়। কারণ তোমাদের একজনের সন্তান আমার শরীরে। আমার কাছে দুটো গ্রামের মানুষের কোন প্রভেদ নেই। তোমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ রোলেনের সম্পত্তির ওপর আমার কোন লোভ নেই। তোমরা দুই গ্রামের মানুষ আশীর্বাদ কর যেন যে সন্তান আসছে সে যেন তোমাদের উত্তরাধিকারী হয়। এই তাপল্যাঙের মাটিতেই সে আসুক কারণ এখানেই আমরা আমাদের স্বপ্ন সার্থক করতে চেয়েছি।

 

আনন্দ মন্দিরের চাতালে দাঁড়িয়ে জনতার দিকে তাকাল। সুদকেরিঘবের সামনে কাহুন পৌঁছে গেছেন। তার হাতে জপের মালা। শিষ্যরা দুপাশে। সেদিন জয়িতার বক্তৃতা শুনে সে অবাক হয়ে গিয়েছিল। কলেজে কেউ কেউ ওকে টাস বলত। কিন্তু সেদিন আনন্দর মনে হয়েছিল সে জয়িতাকে চিনতে পারেনি। বক্তৃতা শেষ হওয়ামাত্র দুই গ্রামের মানুষ মিলিত স্বরে উল্লাস প্রকাশ করেছিল। নোঙামিত, ইনামিত, পাশংকিতরা ওকে সযত্নে নিয়ে গিয়েছিল সভা থেকে।

আনন্দ ধীরে ধীরে নেমে এল। যে বৃদ্ধ একটু আগে কথা বলেছিল সে হাসল। তারপর বলল, প্রার্থনা করো যেন ভগবান বাচ্চাটাকে সুস্থভাবে পৃথিবীতে আনেন।

আনন্দ বলল, প্রার্থনা?

বৃদ্ধ মাথা নাড়ল, হ্যাঁ। আমাদের মানুষ পৃথিবীতে আসছে, প্রার্থনা করবে না। তোমার ধর্মে কি প্রার্থনা করার রীতি নেই?

আনন্দ মাথা নাড়ল, আছে।

ডুঙ, ডুঙ, ডুঙ। জয়ঢাক থেমে থেমে বাজছিল। হঠাৎ সুদকেরিঘরের দরজা খুলে একজন মাইলি:আমা চিৎকার করে উঠল, আসল যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। বলেই ফিরে গেল ভেতরে। সঙ্গে সঙ্গে কান দুটো হাত উপরে তুলে অদ্ভুত স্বরে মন্ত্রপাঠ শুরু করলেন। আর সমস্ত পাহাড়ের মানুষ হাঁটুগেড়ে বসে পড়ল সুদকেরঘরের সামনে। প্রত্যেকের মাথা নিচু , ঠোঁট নড়ছে।

বিস্মিত হয়ে আনন্দ দৃশ্যটি দেখছিল। হাজার দুয়েক মানুষ বরফ উপেক্ষা করে হাঁটুগেড়ে কি প্রার্থনা করছে? সে মুখ ফেরাল। তুষারশৃঙ্গের ওপর সূর্যেব আলো মাখামাখি। পৃথিবী তার পবিত্রতম হাসি হাসছে! সমস্ত চরাচর যেন উন্মুক্ত হয়ে আছে আগামীকালের মানুষের জন্মে। একমাত্র হিমালয়ের বাতাস ছাড়া কেউ শব্দ তুলছে না। হাঁটুগেড়ে বসে থাকা প্রতীক্ষারত মানুষদের ছবির মত মনে হচ্ছিল। আনন্দ মুখ ফেবাল। সঙ্গে সঙ্গে সে চমকে উঠল। দুটো মূর্তি পাহাড় থেকে নেমে আসছে। একজন আর একজনকে অবলম্বন করেছে। কাছাকাছি আসতে সে সুদীপকে চিনতে পারল। সুদীপ বিধ্বস্ত, খোঁড়াচ্ছে। তার সঙ্গিনী তাকে সাহায্য না করলে হাঁটা অসম্ভব হত। আনন্দ নড়ল না। ওরা সামনে আসার পর সে দেখল সুদীপের শরীর এক রাত্রেই বীভৎস। চোখ তুলে সুদীপ তাকে দেখল। তারপর বলল, পারলাম না। ওর গলার স্বর ভাঙা। মেয়েটা ইঙ্গিত করতে সুদীপ আরও একটু এগোল। তারপর বরফের ওপর বসে পড়ল। আনন্দ চুপচাপ।

সমস্ত পৃথিবীকে নাড়িয়ে দিয়ে একটি কান্না বাজবে এই আকাঙ্ক্ষায় এখন মানুষেরা উদগ্রীব। একটি কান্না যা রক্ত এবং সংস্কৃতির ঋণ গ্রহণ কবে আগামীকালকে শক্তিশালী করবে। সুদকেবিধরে যে প্রচণ্ড ব্যস্ততা তা টের পাওয়া যাচ্ছে। প্রতিটি মানুষ উন্মুখ সেই শব্দটি শোনার জন্যে। আনন্দ বড় বড় পা ফেলে দূরত্ব ঘোচাল। তারপর শেষতম মানুষটির পাশে হাঁটুগেড়ে বসে মাথা নিচু কবে চোখ বন্ধ করল। সঙ্গে সঙ্গে তার শরীর, হৃদয় শান্ত হয়ে এল।

নবজাতকের সুতীব্র চিৎকার শোনা যাবে এখনই, যে কোন মুহূর্তে।

–সমাপ্ত–

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *