দরজাটা সামান্য ফাঁক করে তপন দেখলো, খাঁটিয়ার ওপর কাত হয়ে ঘুমিয়ে আছে। কৌশিক। তিন চারদিন দাড়ি কামায়নি, খালি গা বলে আজ বোঝা যাচ্ছে যে সে কত রোগা হয়ে গেছে, পাঁজরাগুলো সব গোনা যায়। সারা ঘরে বইপত্র এলোমেলোভাবে ছড়ানো, কিছু বই মাঝখান থেকে ছেঁড়া। দেয়ালের পাশে একটা এঁটো থালায় আধখানা রুটি আর খানিকটা শুকিয়ে যাওয়া আলুর দমের ঝোল। খাঁটিয়ার মাথার দিকে দাঁড় করানো দুটি ক্রাচ, তার ওপরে। একটা দলা পাকানো লুঙ্গি।
তপন একবার দ্বিধা করলো কৌশিককে ডাকবে কি না। ঘুমটাই কৌশিকের সমস্যা, রাতের পর রাত ঘুমোতে পারে না সে। আজ সে বিকেলবেলাতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু তপনের হাতে বেশি সময় নেই। ভেতরে ঢুকে সে নিঃশব্দে দরজাটা বন্ধ করে দিল। তার হাতের দু’খানা বই আর একটা নতুন জামার প্যাকেট নামিয়ে রাখলো এক পাশে। এ ঘরে একটি মাত্র জানলা, সেটা একবার খুলেই বন্ধ করে দিল তপন, ওখান থেকে সবসময় পেচ্ছাপের গন্ধ আসে, তাই কৌশিক জানলাটা বন্ধ রাখে।
গন্ধটা কাটাবার জন্য তপন একটা সিগারেট ধরালো। ঐ খাঁটিয়াটা ছাড়া ঘরে আর কোনো বসবার জায়গা নেই। তপন দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। একটাই চিন্তা তার মাথায় ঘুরছে। এইভাবে কৌশিককে আর কতদিন রাখা যাবে। কৌশিককে ব্যাঙ্গালোরে পাঠানো যায়নি, ঘাটশিলাতেই সে প্রায় মরতে বসেছিল, জামসেদপুর থেকে একজন ডাক্তারকে গোপনে নিয়ে আসা হয়েছিল, তিনিও ওর পেটের গুলিটা বার করতে পারেননি। কয়েকদিনের মধ্যেই ঘাটশিলার হাইড আউটের কথা পুলিশ জেনে যায়, প্রায় শেষ মুহূর্তে কৌশিককে সরানো গিয়েছিল সেখান থেকে। তারপর থেকে অন্তত পাঁচ জায়গায় রাখা হয়েছে কৌশিককে। তবু সে মরলো না। তার কাঁধের গুলির ক্ষতটা সেরে গেছে, পা দুটোও অনেকটা ভালো হয়ে এসেছে, কিন্তু পেটের মধ্যে গুলিটা রয়ে গেছে। পটে লিভারের মধ্যে একটা বুলেট গেঁথে থাকলেও মানুষ বাঁচে? কৌশিকের তুলনায় অনেক অম আহত হয়েছিল সুবীর, কিন্তু সে পট করে মরে গেল। সুবীরের মৃত্যুর খবর তার মা-বাবা জানতে পারেন প্রায় একমাস বাদে।
এর মধ্যে অবস্থা অনেক বদলে গেছে। দলের কর্মীদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। যারা জেলের বাইরে আছে,তারা যে কে কোথায় আন্ডার গ্রাউন্ডে চলে গেছে তার কোনো ঠিক নেই, তাদের খোঁজ করাও বিপজ্জনক। যারা ওপরের মহলের সিমপ্যাথাইজার ছিল, তারাও এখন আর সম্পর্ক রাখতে চায় না। আগে কলকাতার নামকরা কিছু লোক টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করতেন, তাঁরা সাহায্য বন্ধ করেছেন, দেখাও করতে চান না। তপন সে রকম একজন ব্যক্তির বাড়িতে তিনবার গিয়েছিল, তিনি তৃতীয়বারে চাকরের হাত দিয়ে দশটা টাকা পাঠিয়ে দিয়ে বলেছেন, তপন যেন আর কোনোদিন না আসে।
জেল ভেঙে পালাবার সময় কৌশিকরা চিন্তাও করেনি যে এরপর পুলিশ যখন হন্যে হয়ে খুঁজবে, তখন আত্মগোপন করা হবে কোথায়। আগে থেকে কোনো পরিকল্পনা ছিল না। অবশ্য কৌশিকরা জেল থেকে পালিয়েছে মরীয়া হয়ে, নইলে জেলের মধ্যেই তাদের মেরে ফেলতো। সে রকম অনেককে মেরেছে।
অনেক কিছুই আগে থেকে চিন্তা করা হয়নি!
তপন সবচেয়ে মুস্কিলে পড়েছে টাকা পয়সার ব্যাপার নিয়ে। মাসের পর মাস কৌশিককে কোনো গোপন আস্তানায় লুকিয়ে রাখতে গেলে তার তো একটা খরচও আছে, সেটা কে দেবে? পাশে দাঁড়াবার মতন আর কেউ নেই। বাড়ি ফেরারও উপায় নেই কৌশিকের, তার বাড়ির ওপর পুলিশের নজর আছে। এবারে ধরা পড়লে কোশিককে আর জেলে রাখবে না, পুলিশ তাকে শেষ রাতে কোনো ফাঁকা মাঠে নিয়ে গিয়ে গুলি করে খতম করবে। কৌশিকের সঙ্গে যেক’জন জেল থেকে পালিয়েছিল, তাদের মধ্যে তিনজন আবার ধরা পড়েছে, কিন্তু তারা কোথায় আছে তার কোনো খবর নেই। একজন মারা গেছে, আর বাকিরা ছড়িয়ে পড়েছে দূর দুর জায়গায়। কৌশিকেরই শুধু কোথাও যাবার জায়গা নেই। সে এখনো ক্রাচ ছাড়া হাঁটতে পারে না, পুলিশের সামনে পড়ে গেলে আত্মরক্ষাও করতে পারবে না।
তপনের বিপদ অনেকটা কেটে গেছে, সে ফিরে গেছে দমদমের কলোনিতে। পাড়ার মধ্যে কেউ তার রাজনৈতিক পরিচয় কখনো জানতে পারেনি, তবু অতিরিক্ত সাবধানতার জন্য সে ইদানীং কংগ্রেসী ছেলেদের সঙ্গে একটু একটু ভাব জমাচ্ছে। এর আগেই তার একটা ইনসিওরেন্সের এজেন্সি নেওয়া ছিল, সেই কাজই সে শুরু করেছে আবার, সেই সঙ্গে ন্যাশনাল সেভিংস সার্টিফিকেটও বিক্রি করে। কোন মাসে কত রোজগার হবে তার কিছু ঠিক নেই, জ্যাঠামশাইয়ের সংসারে তাকে খরচ দিতে হয়, তারপর আর হাতে প্রায় কিছুই থাকে না।
তবু কৌশিককে সে ছাড়বে কী করে? অসুস্থ, অসহায় কৌশিককে ছেড়ে সে কি শুধু নিজের নিরাপত্তার জন্য ব্যস্ত হতে পারে? কৌশিকের মতন সম্পূর্ণ স্বার্থশূন্য, মহৎ চরিত্রের ছেলেকে বিপদের মধ্যে ফেলে রেখে কি পালিয়ে যাওয়া যায়? পাটির অন্যান্য বন্ধুরা যে যোগাযোগ রাখতে পারছে না, সেটাও তাদের দোষ নয়, তারা নিজেদের প্রাণ বাঁচাতেই ব্যতিব্যস্ত, কয়েকজন অবশ্য বড়লোক বাপ-মায়ের আশ্রয়ে ফিরে গেছে। তপনের ওপর কখনো পুলিশের নজর তেমনভাবে পড়েনি, সে কলকাতার বড় ঘরের ছেলে নয়, বিখ্যাত ছাত্রও নয়, কোনো বড় রকমের অ্যাকশান বা খুনোখুনির নায়কও সে নয়। তবে, সে যে মানিক ভট্টাচার্যের গ্রুপে ছিল, তা পুলিশ জানে, জলপাইগুড়ির সেই মার্ডারটার সঙ্গে তার যোগসূত্র টানা যেতে পারে, কিন্তু তারপর এত মার্ডার হয়েছে যে সেটার কথা পুলিশও বোধহয় ভুলে গেছে। আই বির একজন অফিসার কিছুদিন তার পেছনে লেগেছিল, কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, কথায় কথায় বেরিয়ে গেল যে সেই গোয়েন্দা অফিসারটির বাড়ি ছিল পূর্ববঙ্গের সরাইলে, তপনের সব পরিচয় জেনে সে বেশ নরম হয়ে গেল। তপনকে কংগ্রেসী ছেলেদের দলে ভিড়ে যেতে সে-ই পরামর্শ দিয়েছে। অবশ্য পুলিশের চোখে কৌশিক এমনই দামি আসামী যে কৌশিকের সঙ্গে তুপনও যদি ধরা পড়ে, তাহলে ঐ আই বি অফিসারটিও তপনকে বাঁচাতে পারবে না।
নৈহাটির কাছাকাছি একটা জুটমিলের কুলি বস্তির মধ্যে এই ঘরখানা ভাড়া নেওয়া হয়েছে দিন দশেক আগে। এই বস্তির লোকেরা অধিকাংশই বিহারী মুসলমান, জুট মিলটায় সম্প্রতি লক আউট হয়েছে বলে তারা এতই উত্তেজিত হয়ে আছে যে কৌশিককে নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। কাছাকাছি একটা ভাতের হোটেল থেকে একটা বাচ্চা ছেলে কৌশিককে খাবার দিয়ে যায়। তা হলেও এই ব্যবস্থা মোটেই সম্পূর্ণ নিরাপদ নয়, কৌশিককে আবার সরাতে হবে।
তপনের কাছে এখন টাকার চিন্তাটাই প্রধান। কিন্তু সে কথা কৌশিকের সামনে ঘুণাক্ষরে উচ্চারণ করা যায় না। পেটের মধ্যে একটা বুলেট ঢুকে বসে আছে, তপনের ধারণা, কৌশিককে বাঁচাতে গেলে তার আরও ভালো করে চিকিৎসা করানো দরকার। কিন্তু কে করাবে?
কৌশিকের বাবা নেই, কিন্তু মা বেঁচে আছে, নিউ আলিপুরে ওদের নিজস্ব বাড়ি। সেই বাড়ির ছেলে নৈহাটির এক চটকলের বস্তিতে শুয়ে আছে। এই রকম ভাবে ক্লাস ক্যারেকটার পরিবর্তনের একটা মহিমা আছে। কিন্তু এরপর কী সেটাই তপন বুঝতে পারে না। কৌশিকের মতন একটা ছেলে যদি নষ্ট হয়ে যায়, পুলিশের গুলিতে খরচ হয়ে যায়, তাহলে সেটা যে একটা বিরাট ক্ষতি।
দু’দিন আসতে পারে নি তপন, আজও কে সন্ধের ট্রেন ধরে ফিরতে হবে। কলোনির মধ্যে বেশি রাত করে ফিরলে লোকে সন্দেহ করে, তাছাড়া দমদমে প্রায়ই একটু রাত করে বোমাবাজি শুরু হয়। তপন আস্তে আস্তে ডাকলো, কৌশিক, এই কৌশিক!
কয়েকবারের ডাকেও উঠলো না বলে তপন কৌশিকের গায়ে হাত দিল। সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠলো সে। কপালটা বেশ গরম, আজ আবার কৌশিকের জ্বর এসেছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল তপনের।
কৌশিক চোখ মেলেই জিজ্ঞেস করলো, পমপম? পমপম কোথায়?
তপন নিঃশব্দে মাথা নাড়লো। মাস দু’ এক ধরে পমপমের সঙ্গেও যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গেছে। তাতেই আরও বেশি মুস্কিলে পড়েছে তপন। এর আগে পর্যন্ত কৌশিক অনেকটা পমপমের দায়িত্বেই ছিল। যদিও টাকা পয়সার টানাটানি শুরু হয়ে গেছে তার আগে থেকেই। বাবার কাছ থেকে টাকা পয়সা নেয় না পমপম, তারও উৎসগুলো শুকিয়ে আসছিল। তবু পমপম কলকাতার উঁচু সমাজের অনেককে চেনে, খুব বিপদে পড়লে কারুর কাছে ধার চাইতে পারে। রেফিউজি কলোনির ছেলে তপনকে কে ধার দেবে?
কৌশিককে যখন দুর্গাপুরে রাখা হয়েছিল, তখন ব্যবস্থাটা ভালোই ছিল। কিন্তু যিনি আশ্রয় দিয়েছিলেন, তিনি হঠাৎ নোটিস দিলেন যে তাঁর স্ত্রী বাপের বাড়ি থেকে ফিরে আসছে, বাড়িতে আর জায়গা হবে না। হাতে মাত্র চারদিন সময়। বাঁকুড়ায় পমপমের এক অল্প চেনা লোকের বাড়িতে পরবর্তী আশ্রয় খুঁজতে যাওয়ার কথা, হঠাৎ হাওড়া স্টেশনে এসে পমপম অজ্ঞান হয়ে গেল।
কী বিপদেই সেদিন পড়েছিল তপন! তার সব সময় পুলিশের ভয়। ভিড় জমে গেলেই পুলিশ আসতে পারে। কৌশিক জেল পালাবার পর পুলিশ আবার পমপমকে অ্যারেস্ট করতে চেয়েছিল। পমপমের বাবা এম এল এ হলেও পুলিশ এখন তোয়াক্কা করছে না। ওয়েস্ট বেঙ্গলে প্রেসিডেন্টস রুল জারি করার পর পুলিশ একেবারে বেপরোয়া। তাছাড়া মাঝখানে একটা কাণ্ড হয়ে গিয়েছিল, কোথাকার একদল নকশাল ছেলে পমপমদের মানিকতলার বাড়িতে একদিন বোমা চার্জ করে বসলো। পমপমের বাবার ওপর তারা আটেমপট নিয়েছিল। কোন। দল যে কোথা থেকে কী অ্যাকশন চালাচ্ছে, তা বোঝার উপায় নেই। এই অবস্থায় অশোক সেনগুপ্ত তাঁর বাড়িতে মেয়েকে রাখেন কী করে? তাঁকেও তো তাঁর পাটির কাছে মুখব। করতে হবে। পমপম সেই জন্য তার কলজ আমলের বন্ধু বান্ধবীদের বাড়িতে থাকছিল। তপনের সঙ্গে দেখা করতে হাওড়া স্টেশনে।
লালবাজারে সেই অত্যাচারের জের পমপমের শরীরে অনেকখানিই রয়ে গেছে। যখন-তখন তার শাড়ী নষ্ট হয়ে যায়। অসহ্য পেট ব্যথা হয়, সেই ব্যথাতেই সে মাঝে মাঝে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। হাওড়া স্টেশন থেকে অজ্ঞান অবস্থায় পমপমকে কোনোক্রমে ধরাধরি করে একটা ট্যাক্সিতে তুলেছিল তপন। কিন্তু কোথায় নিয়ে যাবে? কোনো হাসপাতালে নিলে যদি পুলিশ কেস হয়, তাহলে পমপমই পরে তপনকে ক্ষমা করবে না। আর কোথায় যাওয়া যায়? পমপম তো একটা মেয়ে, তাকে যেখানে সেখানে রাখা যায় না, দমদমের কলোনিতেও হঠাৎ এই অবস্থায় নিয়ে যাওয়া যায় না। দিশেহারা হয়ে গিয়ে সে পমপমকে মানিকতলার বাড়িতেই নিয়ে গেল।
ভাগ্যক্রমে অশোক সেনগুপ্ত তখন বাড়িতে ছিলেন। সেদিন পমপমের বাবার মতন একজন পোড় খাওয়া পলিটিশিয়ানের চোখেও জল দেখেছিল তপন। পমপমের নিঃস্পন্দ শরীর ও বিবর্ণ মুখ দেখে তিনি প্রথম ভেবেছিলেন, পমপমকে মৃত অবস্থায় আনা হয়েছে। তিনি খুকি, খুকি বলে হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরেছিলেন মেয়েকে। খানিকবাদে সজল মুখ ফিরিয়ে তিনি তপনকে বলেছিলেন, তোমরা আর কিছুদিন খোঁজ করতে এসো না। মেয়েটাকে বাঁচতে দেবে তো? এই শরীর নিয়ে ঘোরাঘুরি করলে ও কি বাঁচবে।
তবু দু’দিন বাদে তপন গিয়েছিল পমপমের খবর নিতে। অনেক চেষ্টায় পমপমের বাবার সঙ্গে দেখা হলো, তিনি রীতিমতন ধমক দিয়ে তপনকে বললেন, আমার বাড়িতে কি তোমরা তোমাদের আখড়া করবে ভেবেছো নাকি? পমপম এখানে নেই। তার চিকিৎসা চলছে, এখন তার সঙ্গে দেখা হবে না!
কৌশিককে এসব কথা বোঝানো যাবে কী করে? অসুস্থ শরীর ও একাকীত্বের জন্য সে অবুঝ হয়ে গেছে। পমপমের যদি হাঁটা চলার ক্ষমতা থাকলে, তাহলে কোনো বাধাই সে মানতো না, ঠিকই দেখা করতে কৌশিকের সঙ্গে। কৌশিকের ধারণা, পমপম ফের পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে, আর তপন সে কথা গোপন করে যাচ্ছে।
উঠে বসে কৌশিক বললো, পমপম কোথায় তুই বলবি না?
তপন বললো, এখনও খবর পাইনি। চেষ্টা করছি। ওর বাবার সঙ্গে কিছুতেই দেখা হচ্ছে না। তা ছাড়া ওপাড়ার সি পি এমের ছেলেরা আমাকে চেনে।
তপনকে একটা ধাক্কা দিয়ে কৌশিক বললো, তোকে বলেছি না, পমপমের খবর না নিয়ে তুই। আমার কাছে আর আসবি না!
শুধু অবুঝ নয়, খিটখিটেও হয়ে গেছে কৌশিক। দেখা হলেই প্রথমে সে তপনের সঙ্গে ঝগড়া করে। যেন তপনই তার সমস্ত দুভোগের জনা দায়ী।
তপন তবু নরম ভাবে বললো, চেষ্টা করছি, দু’একদিনের মধ্যেই কিছু খবর পেয়ে যাবো। তবে এটুকু বলতে পারি, সে জেলে নেই।
কৌশিক চোখ রাঙিয়ে বললো, তুই বুঝি সব কটা জেল ঘুরে দেখেছিস? ওগুলো কী বই এনেছিস? কী বই দেখি!
বই দু’ খানা উল্টে পাল্টে দেখে কৌশিক ছুঁড়ে ফেলে দিল। মুখখানা কুঁচকে বললো, এই সব বাজে গল্পের বই, যত রাজ্যের ট্র্যাশ, তোকে কে আনতে বলেছে? তুই কি কোনো ভালো বই কখনো চোখে দেখিসনি?
একা একা থাকে, ঘুম হয় না, তাই কৌশিকের বই পড়ার অসম্ভব ক্ষুধা। কিন্তু তপন এত বই জোগাবে কেমন করে? নতুন বই কেনার সামর্থ্য তার নেই। লোকের কাছ থেকে চেয়েচিন্তে আনতে হয়। সে এখন যাদের মধ্যে ঘোরাফেরা করে, তারা কেউ উচ্চাঙ্গের বই পড়ে না। পুরোনো খবরের কাগজ যারা বাড়ি থেকে কেনে তাদের একজনকে ধরেছে তপন। অনেক লোক কিছু কিছু ছেঁড়া খোঁড়া বইও খবরের কাগজের সঙ্গে ওজন দরে বিক্রি করে দেয়। তপন সেইসব বই চারআনা আটআনা দিয়ে কিনে আনে। ইংরিজি, বাংলা দু’রকমই থাকে, কিন্তু বিশেষ বাছাবাছি করার সুযোগ নেই। তাছাড়া তপন নিজেও কৌশিকের মতন অত লেখাপড়া জানে না।
তপন অবশ্য জানে, যতই রাগারাগি করুক, কৌশিক এই বইও পড়বে ঠিক। হয়তো পড়তে পড়তে বিরক্ত হয়ে ছিড়বে এক সময়, তবু এমনই নেশা যে চোখের সামনে কিছু ছাপা অক্ষর চাই-ই তার।
অন্য প্যাকেটটা হাতে নিয়ে কৌশিক জিজ্ঞেস করলো, এটা কী? জামা? কার জন্য?
কৌশিকের একটি মাত্র জামা, তাও ছিঁড়ে ঝুলিঝুলি হয়ে গেছে। স্টাডি সার্কেলের গোড়ার দিকে অন্য সব সদস্যের মধ্যে কৌশিককেই সবচেয়ে শৌখিন জামা-প্যান্ট পরতে দেখেছিল তপন সচ্ছল বাড়ির ছেলে, আদরে-যত্নে মানুষ। তপন নিজে কাটা-ছেঁড়া জামা গায় দিতে পারে, কিন্তু কৌশিককে ময়লা, ছেঁড়া পরতে দেখলে তার কষ্ট হয়। বর্ধমানে থাকার সময় তপন বেশ কয়েকবার স্টেশনের কুলি আর ঝাঁকামুটের ছদ্মবেশ ধরেছিল, কিন্তু কৌশিককে ঐ সব। ছদ্মবেশে একেবারেই মানাতো না।
ক’দিন ধরে একটু একটু ঠাণ্ডা পড়েছে। সামনে শীত আসছে। পেটের মধ্যে বুলেট থাকার জন্যই হোক বা যে-কারণেই হোক কৌশিক মাঝে মাঝে খকখক করে কাশে। সেই জন্য চৌরঙ্গির ফুটপাথ থেকে দরাদরি করে আঠারো টাকা দিয়ে কৌশিকের জন্য একটা মোটা কাপড়ের জামা কিনে এনেছে।
পকেট থেকে দু’প্যাকেট চারমিনার সিগারেট বার করলো তপন। আগে কৌশিক সিগারেট খেত না, এখন সিগারেট ছাড়া তার চলে না।
প্যাকেট দুটো বাড়িয়ে দিয়ে তপন জিজ্ঞেস করলো, আর কিছু লাগবে? ওঃ হো, দাড়ি কামাবার ব্লেড আনতে আজও ভুলে গেছি।
কৌশিক আবার ধমক দিয়ে বললো, তুই জামাটা কেন এনেছিস, সে কথা বল! তপন শুকনো গলায় বললো, আমি ভাবছি, এই ভাবে আর কতদিন চলবে?
–আমার পায়ে আর একটু জোর এলেই আমি বেরিয়ে পড়বো।
–বেরিয়ে কোথায় যাবি? আমি ভাবছিলাম জানিস, কৌশিক? তোর শরীর এখনও এত দুর্বল, একটু দুধ কিংবা ডিমসেদ্ধ না খেলে সারবে কী করে? কিন্তু এসব কেনার পয়সা কোথায় পাওয়া যাবে? সেই জন্যই বলছিলাম।
–কী পাগলের মতন কথা বলছিস! আমি দুধ-ডিম খাবো? কেন, আমি কি কচি খোকা নাকি? এই বস্তিতে কে দুধ খায়, ডিম খায়?
–ওদের কথা আলাদা। ওরা কেউ তোর মতন অসুস্থ নয়। আমার কথাটা শেষ করতে দে। আমি একবার তোর মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করবো?
-–মা? কেন, তুই আমার মাকেও জেল খাটাতে চাস বুঝি?
–খুব সাবধানে, তোর মামাবাড়িতে গিয়ে টেলিফোন করে…তোর মা তোর কোনো খবর জানেন না, তাঁকে একবার সব জানানো দরকার, তাছাড়া তোর মামারা যদি কিছু ব্যবস্থা করতে পারেন।
–আমার কোনো মা নেই। আমার এখন মা নেই, ভাই-বোন নেই, মামা-টামা কেউ নেই! শোন তপন, একবার আমি বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি, এরপর আবার বাচ্চা ছেলের মতন ভয় পেয়ে মায়ের আঁচলের তলায় ফিরে যাবো?
–আমি প্র্যাকটিক্যাল কথা বলছি।
–হ্যাং ইয়োর প্র্যাকটিক্যাল কথা! তোকে দিয়ে কোনো কাজের কাজ হয় না। এতদিনে। পমপমের একটা খবর আনতে পারলি না।
–আমি বলছি, তোর মা আর মামারা যদি ব্যবস্থা করতে পারেন, তাহলে অতীনের মতন তোরও বিলেতে চলে যাওয়া উচিত। সেখানে চিকিৎসা করাতে পারবি। পেট থেকে গুলিটা বার করতে হবে না?
–ঐ বুলেট আমি হজম করে ফেলেছি! গোলা খা ডালা! শুনিস নি সে কথা! আমি বিলেত, আমেরিকা কোনোদিন যাবো না। সোভিয়েত রাশিয়াতেও চিকিৎসা করাতে যাবো না। যদি কোনোদিন সুযোগ পাই তো চীনে যাবো। কিংবা আলবেনিয়ায়।
–তোর প্রাণের বন্ধু অতীন যদি যেতে পারে।
–অতীন গেছে বেশ করেছে! অতীনের ব্যাপার তুই কি বুঝবি রে ইডিয়েট?
–পরশুদিন দেওঘরে অসীম চ্যাটার্জি ধরা পড়ে গেছে। কয়েক মুহূর্ত থেমে রইলো কৌশিক, কিন্তু অবাক হলো না। গম্ভীর গলায় বললো, জানি। কালকে হোটেলের ছোকরাটাকে দিয়ে একটা খবরের কাগজ আনিয়েছিলুম। কালই বেরিয়েছে খবরটা। ওরা পুলিশকে রেজিস্ট করেছিল কি না জানিস?
–তা জানি না। কৌশিক, আমাদের দলের মানিকদা মারা গেছেন। গুরুদাস, সুদেব, শশী ওরা কেউ বেঁচে নেই। আগস্ট মাসের গোড়ার দিকে কমরেড সরোজ দত্তকে পুলিশ গুলি করে মেরেছে। এরপর আর কী হবে?
–আর কী হবে মানে? আমরা তো বেঁচে আছি। কমরেড চারু মজুমদার আছেন। ভারতবর্ষের পুলিশের সাধ্য নেইই তাঁকে ছোঁয়। আমাদের ছেলেরা শেষরক্তের ফোঁটা দিয়ে তাঁকে আড়াল করে রাখবে। অনেকে তো মরবেই। চেয়ারম্যান বলেছেন, এইসব ধাক্কা খাওয়ারও প্রয়োজন আছে।
–আমি কিন্তু সামনে কোনো পথ দেখতে পাচ্ছি না। হঠাৎ উঠে এসে তপনের কাঁধটা খামচে ধরে কৌশিক রক্তচক্ষে জিজ্ঞেস করলো, তুই তখন আমাকে দুধ-ডিম খাওয়ার কথা বললি কেন রে, ছোটলোক?
–আমি… আমি ছোটলোক? তুই আমাকে ছোটলোক বললি।
ছোটলোক মানে ছোট জাত বা নীচু জাত বলিনি, মনের দিক দিয়ে ছোট। আলবাৎ তুই ছোট লোক! তুই আমাকে দুধ-ডিম খাওয়াবি, তুই আমাকে দয়া করতে চাস?
–আমি মোটেই সে কথা বলিনি!
–ড্যাম ইট। আমি জানতে চাই, কে তোকে পয়সা সাপ্লাই করে? তুই আমার নাম করে হ্যাংলার মতন লোকের কাছে চাঁদা তুলছিস!
–এসব বাজে কথা।
–আমি বাজে কথা বলছি? দ্যাখ তপন, তুই ভাবিস না, আমি তোর দয়ার ওপর বেঁচে আছি। আই ক্যান টেক কেয়ার অফ মাইসেলফ! তোকে আর আসতে হবে না!
–কৌশিক ছেলেমানুষী করিস না। অত চাচাচ্ছিস কেন, তোর জ্বর হয়েছে দেখলাম।
–এসব ন্যাকামি আমার ভালো লাগে না! জ্বর সবারই হয়। আমার জন্য জামা আনতে কে বলেছে? কে কিনে দিয়েছে বল আগে? দুধ আর ডিমের লোভ দেখানো! তারপরেই ও মারা গেছে, সে মারা গেছে, এইসব বলার মানে কী? অন্যরা মারা যাচ্ছে, আমি দুধ আর ডিম খাবো?
–আমি সেইভাবে বলিনি।
–আই হেইট ইউ! বুর্জোয়া আর শোধনবাদীদের মতন বিদেশে চিকিৎসা করাতে যাবো আমি? গেট আউট! আমি আর কোনোদিন তোর মুখ দেখতে চাই না।
পাগলের মতন হয়ে গিয়ে তপনকে ধাক্কা দিয়ে বার করার চেষ্টা করতে লাগলো কৌশিক। তপন দুতিনবার বলার চেষ্টা করলো, এই কী হচ্ছে, কী করছিস, কিন্তু কৌশিক যেন হিংস্র হয়ে উঠেছে। এক সময় ধৈর্য হারিয়ে তপন বলে ফেললো, ধুর শালা!
ক্রাচ ছাড়া হাঁটতে পারে না কৌশিক, তবু সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দরজা পর্যন্ত এসে বললো, তুই আর কোনোদিন এখানে আসবি না, এলেও আর আমাকে দেখতে পাবি না। আই স্পিট অন ইয়োর চ্যারিটি! বেরিয়ে যা।
কৌশিক ঠেলাঠেলি করতে লাগলো এমনভাবে যে তপনকে একসময় বাধা দিতেই হলো। এই ঘরখানা সে নিজের অতি কষ্টের উপার্জনের পয়সায় ভাড়া করেছে কৌশিকের জন্য, আর এখান থেকে কৌশিক তাকে গলাধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দেবে? সে অন্যের পয়সায় কৌশিকের জন্য জামা কিনেছে? একথা শুনলে তার রাগ হবে না? একটু বেশি জোর করেই নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে গেল তপন, পায়ে জোর নেই বলে টাল সামলাতে না পেরে মেঝেতে পড়ে গেল কৌশিক।
তপন আর পেছন ফিরে তাকালো না, হনহন করে চলে গেল গলি দিয়ে। এখান থেকে স্টেশন প্রায় পঁচিশ মিনিটের পথ। তপন আপনমনে বিড় বিড় করতে লাগলো, আমি আর কত ধৈর্য ধরবো। আমি যথেষ্ট করেছি, কেউ আমাকে দায়িত্ব দেয় নি। আর সবাই তো কেটে পড়েছে। স্টাডি সার্কেলে যারা বড় বড় কথা বলতো, তারা দিব্যি বড় বড় চাকরি বাগিয়ে বসেছে, দেখা হলে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। আমি রিফিউজি বাড়ির ছেলে, আমি কখনো। বিপ্লব-টিপ্লবের কথা বলেছি? কৌশিকরাই হল আমাকে ভিড়িয়েছিল। আমি যথাসাধ্য করেছি ওদের জন্য। ওরা কেউ বড় চাকরি করে, কেউ বিলেত যাবে, আমি যেখানে পড়ে আছি সেখানেই থাকবো। আমি মাসের পর মাস কী করে কৌশিকের খরচ চালাবো, আমার নিজেরই চলে না। পকেটে মাত্র সাতটা টাকা রয়েছে, কাল কী জুটবে তার ঠিক নেই।
পাঁচ মিনিট হেঁটে তপন থামলো। রাগে-অভিমানে তার চোখে জল এসে গেছে। কৌশিক তাকে ছোটলোক বললো? কৌশিক ভাবে যে সে কৌশিকের নাম করে অন্যদের কাছ থেকে টাকা আনছে? পমপম অসুস্থ হবার পর কেউ তাক একটা পয়সাও দেয়নি। আজ থেকে কৌশিকের সঙ্গে সম্পর্ক শেষ। সে নিজেরটা নিজে বুঝে নিতে যদি পারে তবে ভালোই তো! তপন আর এসব ঝাটের মধ্যে নিজেকে জড়াবে না।
রাস্তার আলোর নীচে তপন চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো।
এই মুহূর্তে তপন ছাড়া আর একজনও জানে না যে কৌশিক কোথায় আছে। কৌশিকের এখনও একা চলা ফেরা করার সাধ্য নেই। আর কেউ তাকে এখানে সাহায্য করতে আসবে না!
কৌশিক আজ রাত্তিরে খাবে কী? তপন জানে, কৌশিকের কাছে একটা দাড়ি কামাবার শস্তা। ব্লেড কেনারও পয়সা নেই। তপন ভেবেছিল, তার সাত টাকার মধ্যে ছটা টাকা কৌশিককে দিয়ে আসবে। সামনের হোটেলটায় বারো আনায় ভাত বা রুটি আর ডাল আর একটু তরকারি, অন্তত ছ’টা টাকা ওকে দিয়ে আসা উচিত। দরজাটা খুলে ছুঁড়ে দিয়ে আসবে।
তপন ফিরে এসে গলির মোড়টার দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলো। ছেঁড়া জামাটা গায়ে দিয়ে, একখানা মাত্র ক্রাচ ডান বগলে দিয়ে গলির মোড়টায় দাঁড়িয়ে আছে কৌশিক। এখনো ভালো করে সন্ধে হয়নি। এর মধ্যে বেরিয়ে এসেছে, একা একা কোথায় যাবার চেষ্টা করছে ও? এ যে প্রায় আত্মহত্যা! শ্রমিক বিক্ষোভ হচ্ছে বলে এ রাস্তায় যখন তখন পুলিশ আসে। স্টেশনের কাছে বসে থাকে একদল অন্য পার্টির ছেলে। এদের মধ্যে কেউ যদি কৌশিককে। চিনতে পারে, তাহলেই শেষ। এখন চতুর্দিকে শুরু হয়েছে বদলা নেবার পালা।
দৃঢ় আদর্শবাদী, দুর্দান্ত সাহসী কৌশিক রায়কে কী অসহায় দেখাচ্ছে এখন। রোগা হাড় জিরজিরে চেহারা, চোখ দুটো কোটরে ঢুকে গেছে, বগলে একটা ক্ৰাচ, সে কোথাও যেতে পারবে না তার কোনো যাবার জায়গা নেই।
বুকটা টনটন করে উঠলো তপনের, সে কান্না সামলাতে পারছে না। সে তো জানে, কৌশিকের মত খাঁটি মানুষ কত দুর্লভ! একটা রুমালও নেই ছাই, সে জামার হাত দিয়ে চোখ মুছলো। তারপর কাছে এসে শুধু বললো, কৌশিক।
অদ্ভুত বিস্ময়ের সঙ্গে কৌশিক একটুক্ষণ তাকিয়ে রইলো তপনের দিকে। তারপর দুবোধ্য কোনো ভাষার মতন আস্তে আস্তে বললো, তপন, তুই আমাকে ফেলে চলে যাচ্ছিলি? তুই আমার কাছে আর আসতে চাস না?
তপন বললো, পাগল নাকি, কোথায় চলে যাবো? এই এমনি একটু বেরিয়েছিলাম। চল, ঘরে চল।