2 of 2

৫১. জানুয়ারি মাসের এক অপরাহ্নে

জানুয়ারি মাসের এক অপরাহ্নে কলকাতায় ঘনঘন তোপধ্বনি শোনা যেতে লাগল। ফোর্ট উইলিয়াম কেল্লা থেকে কামান দাগা হয়, তার গুপুস গুপুস শব্দ শোনা যায় অনেক দূর পর্যন্ত। একবার, দুবার, তিনবার….লোকেরা গুনতে থাকে। সিপাহি বিদ্রোহের পর বেয়াল্লিশ বছর কেটে গেছে, তারপর এদিকে আর যুদ্ধ-বিগ্রহ, গুলি-গোলা চলেনি! মাঝে মাঝে রুশ আক্রমণের হুজুগ শোনা যায় বটে, তাও হিমালয় পেরিয়ে বাংলা দেশে পৌঁছনোর সম্ভাবনা প্রায় অলীক বলা যায়। এখন চতুর্দিকে শান্তি। 

সময় জানাবার জন্য দিনের বেলা তোপ পড়ে। দুপুর বারোটায় তোপ শোনার জন্য অনেকে কান খাড়া করে থাকে, ওই তোপধ্বনি হলেই খিদে পায়। ইংরেজ সরকারের কেষ্টবিষ্টু কেউ এলে তাদের সম্মানেও কামান দাগা হয়, দেশীয় রাজ্যের রাজারা এলেও সেই প্রথা আছে। কিন্তু আজ যে থামতেই চাইছে না। আঠাশ, ঊনত্রিশ, তিরিশ, একতিরিশ। একসঙ্গে এত তোপধ্বনি তত সহসা শোনা যায় না। কার সম্মানে এত, স্বয়ং মহারানি ভিক্টোরিয়া এলেন নাকি? চল্লিশ বছরেরও বেশি তিনি ভারতের রাজেন্দ্রাণী, কখনও তাঁর ভারতীয় প্রজাদের দেখতে আসেননি, তিনি তো আর অকস্মাৎ না জানিয়ে-শুনিয়ে আসবেন না, কয়েকমাস ধরে প্রস্তুতি চলবে। তবে কে এলেন? 

গঙ্গার ধারে বাবুঘাট-কয়লাঘাট লোকে লোকারণ্য। না, বিলেত থেকে কোনও জাহাজ আজ এই বন্দরে ভেড়েনি। হাওড়ার রেলওয়ে স্টেশন থেকে মহাসমারোহে আসছেন একটি দম্পতি। ধবল রঙের চারটি ঘোড়ায় টানা স্বর্ণখচিত গাড়িতে বসে আছেন তাঁরা দুজন, সামনে পেছনে সুদৃশ্য পোশাক পড়া দেহরক্ষীর দল, পথের দুপাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে সৈন্যবাহিনী, তাদেরই ফাঁক দিয়ে সাধারণ মানুষেরা একঝলক দেখে নিয়ে চক্ষু সার্থক করতে চাইছে। সমস্ত বাড়ির বারান্দা ও ছাদেও দাঁড়িয়ে আছে অজস্র মানুষ, সহর্ষে হাত নাড়ছে তারা। সত্যিই, চক্ষু সার্থক করার মতনই ব্যাপার বটে। এমন রূপবান, এমন সুশ্রী দম্পতি যেন কলকাতার মানুষ আগে দেখেনি। সুঠাম শরীর ও সুন্দর মুখশ্রীসম্পন্ন পুরুষদেরই দেহরক্ষী হিসেবে নির্বাচন করা হয়, কিন্তু তাদের সবার চেয়ে সুঠাম ও সুন্দর এই ঘোড়াগাড়িতে উপবিষ্ট পুরুষটি। দীর্ঘকায়, নবনীবর্ণ, তীক্ষ্ণ নাসা, টানা টানা চোখের মণি দুটির রং সমুদ্রের মতন নীল। তিনি বসে আছেন মেরুদণ্ড সোজা করে, ওষ্ঠাধরে সামান্য হাসির চিহ্ন থাকলেও মুখমণ্ডলে স্পষ্ট অহংকারের ছাপ! পাশের রমণীটিও অসামান্য রূপসী, তাঁর মুখখানি যেন পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় মাখা, তাঁর দু’চক্ষে অবশ্য অহংকারের বদলে বিস্ময়ই বেশি। 

জর্জ এবং মেরি। ভারতে মহারানির সবোচ্চ প্রতিনিধি, ভাইসরয় লর্ড জর্জ ন্যাথনিয়েল কার্জন এবং তাঁর পত্নী ভাইসরিন মেরি কার্জন। কলকাতার মানুষ এর আগে আরও অনেক বড়লাট ও বড়লাট পত্নী দেখেছে, কিন্তু এত সুন্দর ও যৌবনবন্ত কোনও দম্পতি আগে দেখেনি। এই তো, বিদায়ি ভাইসরয় লর্ড এলগিন, বেঁটেখাটো, কোলকুঁজো, মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি, সাদামাটা চেহারা। তাঁর স্ত্রীটিও এমন কিছু আহামরি নয়। লর্ড কার্জনের মতন এত তরুণ ভাইসরয়ও আগে আসেননি, এঁর বয়েস এখনও চল্লিশ পূর্ণ হয়নি।

শোভাযাত্রাটি বড়লাট ভবনের সিংহদ্বারের কাছে এসে থামল। এখান থেকে ভেতরের বিশাল সিঁড়ি পর্যন্ত লাল কার্পেট পাতা। ঘোড়ার গাড়ি থেকে নামবার সময় লর্ড কার্জন মৃদু স্বরে তাঁর পত্নীকে বললেন, মেরি, এই প্রাসাদটি বাইরে থেকে দেখে নাও ভাল করে, এর বিষয়ে একটা মজার কথা তোমাকে পরে বলব! 

এরপর আনুষ্ঠানিকতার আড়ম্বর চলল কিছুক্ষণ ধরে। প্রশস্ত সিঁড়িটির একেবারে তলার ধাপে দাঁড়িয়ে আছেন বাংলার লেফটেনান্ট গভর্নর বা ছোটলাট, সিড়ির দুধারে রয়েছেন বিশিষ্ট ইংরেজ রাজপুরুষেরা, সৈন্য ও নৌবাহিনীর সেনাপতিরা, ধমর্যাজক ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ীরা। অশ্বেতাঙ্গ ভারতীয় শুধু কয়েকজন দেশীয় রাজ্যের রাজা, কাশ্মীরের মহারাজ। গোয়ালিয়র, পাতিয়ালা ইত্যাদি রাজ্যের রাজা। নিজেদের বিশিষ্টতা বোঝাবার জন্য তাঁরা পরে আছেন হিরে-জহরত খচিত পোশাক। তাদের দু হাতের আঙুলের আংটি ও গলার হারের বহুমূল্য মণি-মাণিক্য দেখে লেডি কার্জনের চক্ষু বিস্ফারিত হতে হতে সীমা ছাড়িয়ে গেল।

সিঁড়ির একেবারে উপরিভাগে দাঁড়িয়ে আছেন বিদায়ি ভাইসরয়, লর্ড এলগিন। লেফটেনান্ট গভর্নর লর্ড ও লেডি কার্জনকে সঙ্গে নিয়ে ওপরে উঠে এসে প্রথা অনুযায়ী লর্ড এলগিনের সঙ্গে এঁদের আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচয় করিয়ে দিলেন। লর্ড এলগিন অভ্যর্থনার জন্য হাত বাড়াতেই বেজে উঠল কাড়া-নাকাড়া, ভেঁপু ও জগঝম্প।

বেশ কিছুক্ষণ পর নিজেদের জন্য নির্দিষ্ট ঘরে এসে, পোশাক বদলাবার জন্য লোকচক্ষুর আড়াল হতেই লর্ড কার্জন বিছানায় শুয়ে পড়লেন। বোম্বাই থেকে দীর্ঘ ট্রেন যাত্রায় এবং বারংবার সরকারি আনুষ্ঠানিকতায় তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন, শরীরে বিষম ব্যথা। এমন সুগঠিত শরীর, যৌবন প্রাচুর্যে ভরপুর হলেও লর্ড কার্জন প্রায় সর্বক্ষণ একটা ব্যথায় কষ্ট পান। অল্প বয়েসে একবার ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে তিনি শিরদাঁড়ায় প্রচণ্ড চোট পেয়েছিলেন, আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবেন না, এমনই অবস্থা হয়েছিল। চিকিৎসকদের পরামর্শে এখন জাগ্রত অবস্থায় সর্বক্ষণ একটা লোহার খাঁচা তাঁর পোশাকের নীচে পরে থাকতে হয়। সেটা পরে থাকা বেশ কষ্টকর, মাঝে মাঝেই তীব্র যন্ত্রণা শুরু হয়, তিনি মুখ বুজে সহ্য করেন, কারুকে কিছু বুঝতে দেন না। ব্যাপারটা অতিশয় গোপন, নিজের স্ত্রী ছাড়া আর মাত্র দু’চারজন জানে। লোকজনের সমক্ষে এই ব্যথা শুরু হলে তিনি কঠিন মুখ করে থাকেন, অন্য কেউ কথা বললে হাসেন না। হুঁ-হাঁ ছাড়া কিছু বলেন না। সেইজন্যই অনেকে মনে করে, এই লোকটি অতি রূঢ় এবং দাম্ভিক। এতদিনেও কেউ যে তাঁর পোশাকের নীচে ঢেকে রাখা দুর্বলতার কথা জানতে পারেনি, তার কারণ এরকম অবস্থা নিয়েও লর্ড কার্জন অসাধারণ পরিশ্রম করার ক্ষমতা দেখিয়েছেন বারবার। তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা চেয়ার টেবিলে বসে লিখতে থাকেন, অশ্বারোহণে বা পায়ে হেঁটে ঘুরতে দ্বিধা বোধ করেন না, দারুণ বিপদসঙ্কুল স্থানে তিনি অনেকবার গেছেন অকুতোভয়ে। তিনি অশ্বপৃষ্ঠে মরুভূমি পার হয়েছেন, ঘুরেছেন পাহাড়ে-জঙ্গলে। 

মেরি জিজ্ঞেস করলেন, জর্জ, তুমি এই লাটভবনটি সম্পর্কে কী বলবে বলছিলে? 

লর্ড কার্জন বললেন, এই প্রাসাদটি প্রথম দর্শনে তোমার কিছু মনে হল না? মনে হয় নি যে, এটা ঠিক আমাদের কেড়লস্টন হল বাড়িটার মতন? 

মেরি বললেন, হ্যাঁ, ঠিক তো। দেখেই আমার মনে হয়েছিল আমাদের ওই বাড়ির সঙ্গে অনেকটা মিল আছে।।

লর্ড কার্জন হাসলেন। গভীর পরিতৃপ্তির হাসি।

সাদৃশ্যটি অবশ্যই বিস্ময়কর। মেরি কার্জন এই প্রথম ভারতে এলেন, কিন্তু লর্ড কার্জন অনেক দিন আগে ভারত ভ্রমণ করে গেছেন, কলকাতাতেও এসেছিলেন, এই সরকারি প্রাসাদটির অভ্যন্তরে এসেও ঘুরে দেখেছেন। 

খুব অল্প সংখ্যক মানুষের জীবনেই তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা হুবহু মিলে যায়। বারো বছর আগে জর্জ ন্যাথনিয়েল কার্জন যখন কলকাতায় এসেছিলেন, তখন উঠেছিলেন একটি হোটেলে। কলকাতা শহরটি তাঁর পছন্দ হয়েছিল, মনে হয়েছিল ইওরোপের কোনও শহরের মতনই, পরিচ্ছন্ন ও আকর্ষণীয়। যদিও কার্জনের মতন অধিকাংশ ভ্রমণার্থীই লাল দিঘি সন্নিহিত অঞ্চল, ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রিট, বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট, এসপ্ল্যানেড ও পার্ক স্ট্রিট মিলিয়ে যে সাহেবপাড়া সেইটুকু ঘুরেই চলে যায়, এদেশের মানুষদের পল্লীগুলি কিছুই দেখে না। কার্জন তৎকালীন ভাইসরয়ের সঙ্গে সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎকার করতে গিয়ে লাটভবনটির সঙ্গে তাঁদের পারিবারিক প্রাসাদটির আকৃতি ও গঠনগত মিল দেখে চমকে উঠেছিলেন। কলকাতার এই প্রাসাদটির নির্মাণ শেষ হয় ১৮০৩ সালে, ইংল্যান্ডের ডার্বিশায়ারের কেড়লস্টন গ্রামে কার্জনদের প্রাসাদটি আরও পুরনো। ইস্ট ইণ্ডিয়া কম্পানির যে স্থপতি কলকাতার এই অট্টালিকাটির নকশা বানিয়েছিল, সে নিশ্চয়ই কোনও সময়ে কোস্টনের বিখ্যাত বাড়িটি দেখে মুগ্ধ হয়েছিল। 

সেই প্রথমবার কলকাতার এই রাজপ্রাসাদটি দেখে বেরিয়ে আসার সময় দেউড়ির কাছে থমকে দাঁড়িয়ে কার্জন মনে মনে বলেছিলেন, একদিন কেলস্টন ছেড়ে আমি এই বাড়িটাতে এসে থাকব, আমি ভারতের ভাইসরয় হব! 

এই আকাঙ্ক্ষা এতই অবাস্তব যে একে আকাশকুসুম রচনার পর্যায়ে ফেলা চলে। সেই সময় কার্জন ছিলেন আঠাশ বৎসরের এক যুবক, এবং একবার হেরে যাওয়ার পর সদ্য পালামেন্টের টোরি দলের নিবাচিত এক অকিঞ্চিৎকর সদস্য, রাজনীতি ক্ষেত্রে প্রায় অচেনা। সেখান থেকে ভাইসরয়ের। পদ বহু দূরের পথ। মাত্র বারো বছরের মধ্যেই তবু যে কার্জনের সেই স্বপ্ন সফল হল তা যেন নিতান্তই নিয়তির খেয়ালে। 

কার্জনের জীবনে নিয়তি বা ভাগ্যচক্রের ভূমিকা অনেকখানি। তা বোঝাতে গেলে অনেকখানি পিছিয়ে শুরু করতে হয়। এক প্রাচীন, অভিজাত পরিবারে কার্জনের জন্ম, বংশ লতিকাটিতে আটশো বছর অতীতে যাওয়া যায়, সেই উইলিয়াম দা কংকারারের সময়ে। কিন্তু কার্জনের পিতা কিংবা পিতামহ কেউই পরিবার-প্রধান ও জমিদারির উত্তরাধিকারী ছিলেন না। ইংল্যান্ডের আইনে শুধু জ্যেষ্ঠ পুরুষ সন্তানই সমস্ত সম্পত্তি ও বংশমর্যাদার অধিকারী হয়, অন্যান্য সন্তানেরা কিঞ্চিৎ মাসোহারা পায়, জীবিকার জন্য তাদের অন্য পেশার সন্ধান করতে হয়। কার্জনের বাবা ছিলেন দ্বিতীয় সন্তান, ঠাকুরদা ছিলেন সপ্তম সন্তান! 

নিয়তির খেলাটি শুরু হয় ঠাকুরদার বাবার আমলে। প্রপিতামহ সেই দ্বিতীয় ব্যারন ছিলেন। বাউণ্ডুলে স্বভাবের এবং জুয়াড়ি। বিবাহের পর তাঁর একটি সন্তান জন্মেছিল কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই তাঁর পত্নী বিয়োগ হয়। ভারপর তিনি প্রচণ্ডভাবে জুয়া খেলায় প্রবৃত্ত হলেন, এবং হারতে হারতে এমন অবস্থায় পৌঁছলেন যে পাওনাদাররা তাঁকে প্রায় ছিড়ে খাবার জোগাড় করেছিল। একদিন শিশু পুত্রটিকে ফেলে, জমিদারি ছেড়ে তিনি সবার অলক্ষ্যে চম্পট দিলেন। ভাগ্যান্বেষণে তিনি ঘুরতে লাগলেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে, এক সময় একটি অল্পবয়েসী বেলজিয়ান মেয়ের প্রেমে পড়লেন। ইওরোপে তখন নৈতিকতাবোধ অতি শ্লথ, লাম্পট্য ব্যভিচার সামাজিক স্বীকৃতি পেয়েছে, কোনও কুমারী মেয়ে সন্তানের জন্ম দিলে কেউ তা নিয়ে মাথা ঘামায় না। দ্বিতীয় ব্যারন মহাশয় তাঁর সেই প্রেমিকার গর্ভে ছ’টি সন্তান উৎপন্ন করলেন। তারপর তাঁর কী খেয়াল হল, তিনি এই প্রেমিকাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিতে চাইলেন, হামবুর্গ শহরের কাছে এক গিজায় এঁদের বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হল। এর পরেও এই দম্পতির আরও চারটি সন্তান হয়, সপ্তম সন্তানটিই লর্ড কার্জনের ঠাকুরদা। তাঁর পক্ষে জমিদারির উত্তরাধিকারী হবার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনাই থাকার কথা নয়। 

দ্বিতীয় ব্যারন চক্ষু বুজলে এই দশটি সন্তানকে বাদ দিয়ে তাঁর প্রথম পক্ষের পুত্রটিই স্বকিছু পাবার ন্যায্য অধিকারী। তিনিই হলেন তৃতীয় ব্যারন। এই তৃতীয় ব্যারন বিবাহ করেননি এবং তিনি অকালে প্রয়াত হলেন। স্বাভাবিকভাবে পরবর্তী উত্তরাধিকারী তাঁর পরের ভাই। তখনই ডাক পড়ল দ্বিতীয়পক্ষের সপ্তম সন্তানের। এ পক্ষের দশটি ভাই বোনের যদিও একই পিতার ঔরসে ও একই মাতার গর্ভে জন্ম, কিন্তু প্রথম ছ’জন কুমারী মাতার সন্তান, তাই আইনের চক্ষে তারা অবৈধ। অভাবনীয়ভাবে সপ্তম সন্তানটি হয়ে গেলেন সব সম্পদের অধিকারী এবং তৃতীয় ব্যারন।

এই তৃতীয় ব্যারনের পুত্র সংখ্যা মাত্র দুটি। জর্জ এবং অ্যালফ্রেড। ছোট ভাই অ্যালফ্রেড ধরেই নিলেন তিনি সম্পত্তি পাবেন না, কোনও সুপরিচিত, ধনী বংশের কন্যাকে বিবাহ করার সামর্থ্যও তাঁর নেই। অভিজাত পরিবারের প্রথা এই যে মেয়ের বাবা বেশ কিছু টাকা যৌতুক দিয়ে মেয়েকে স্বামীর ঘরে পাঠাবে, আর স্বামীকেও দেখাতে হবে যে স্ত্রী বিধবা হলে তাকে মোটা টাকার মাসোহারা দেবার ব্যবস্থা আছে। অ্যালফ্রেড তা দেখাবেন কী করে? তাই গিজায় যোগ দিয়ে ধর্মযাজক হলেন। 

যথাসময়ে বড় ভাই জর্জ হলেন চতুর্থ ব্যারন। ইনি বিবাহ করলেন না, তার বদলে রক্ষিতা-গমন বা লাম্পট্যকে প্রশ্রয় দিলেন না, বরং হয়ে গেলেন ব্যর্থ প্রেমিক। এঁর এই ব্যর্থ প্রেমিকের ভূমিকা নিয়ে একটি কৌতুককাহিনী প্রচলিত ছিল। কেলস্টনের এই জমিদার মহাশয় প্রায়ই চুপিচুপি চলে যেতেন লন্ডনে এবং ঘুরে বেড়াতেন হাইড পার্কের আশেপাশে। উঁচু ঘরের নারী-পুরুষরা বিকেলবেলা একবার পার্কে বেড়াতে আসবেনই, এটা একটা সামাজিক কেতা। হাইড পার্কের এক অংশে ধনী ও বিলাসী পরিবারের নারী পুরুষদের নিত্য আনাগোনা। মেয়েরা তাদের শ্রেষ্ঠ পোশাকে, দারুণ প্রসাধনে সেজেগুজে রঙিন ছাতা নিয়ে ঘোরে, কথায় কথায় হাসির ফোয়ারা ছড়ায়। কুমারীরা অবিবাহিত যুবকদের দিকে নয়নবাণ হানে। যুবকেরা ভ্রমরবৃত্তি অবলম্বন করে বিভিন্ন ওষ্ঠের মধু পান করে। 

এদের থেকে একটু দূরে কোনও গাছের আড়ালে অশ্বপৃষ্ঠে অপেক্ষা করেন জর্জ ন্যাথনিয়েল স্কারসডেল। তিনি যৌবনবয়েসী হলেও এখানে সমাগত রূপসীদের সঙ্গে মেলামেশা, এমনকী কথা বলতেও যান না। তিনি প্রচ্ছন্ন অবস্থায় একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন শুধু একজনই রমণীর দিকে। এই রমণীর তিনি প্রণয়প্রার্থী ছিলেন, কিন্তু সে বরমাল্য দিয়েছে অন্য এক জনের কঠে। সেই ব্যর্থতার জ্বালী জর্জ ন্যাথনিয়েল ভুলতে পারছেন না, বারবার সেই পূর্ব প্রেমিকাকেই দেখতে আসেন, এখনও তাঁর কৃপা পাবার আশা ত্যাগ করেননি। কেড়লস্টনের চতুর্থ ব্যারন সামান্য কোনও বঞ্চিত কবির মতন দীর্ঘশ্বাস ফেলেন দূর থেকে। 

এই কৌতুককাহিনীর শেষ পরিণতি অবশ্য খুবই করুণ। অনেক দিনই মনে হত, সেই প্রেমিকাটি যেন জর্জ ন্যাথনিয়েলকে দেখেও দেখতে পেত না। হঠাৎ একদিন যেন জর্জের মনে হল, তাঁর হৃদয়েশ্বরী একবার অপাঙ্গে তাকিয়ে ফিক করে হেসেছে এবং ঘোড়ার গাড়িতে ওঠার সময় তাঁর উদ্দেশে হাতছানি দিয়েছে। তা দেখে এমনই অভিভূত হয়ে গেলেন তিনি যে প্রত্যুত্তর দেবার কথাও মনে পড়ল না। যখন খেয়াল হল, তখন গাড়িটি অনেক দূর এগিয়ে গেছে। তৎক্ষণাৎ অন্ধের মতন ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন সেদিকে। একটা গাছের ডালে তাঁর মাথায় প্রচণ্ড আঘাত লাগল, সঙ্গে সঙ্গে পতন ও মৃত্যু। 

অকস্মাৎ গ্রহের ফেরে ধমর্যাজক অ্যালফ্রেড হয়ে গেলেন কেড়লস্টনের প্রাসাদ-জমিদারির মালিক এবং পেয়ে গেলেন লর্ড খেতাব। 

এইসব নাটকীয় ঘটনাবলি ঘটে গেছে কার্জনের জন্মের আগে। তিনি তাঁর পিতার প্রথম সন্তান। বড় ভাইয়ের স্মৃতিতে অ্যালফ্রেড তাঁর এই পুত্রটির নাম রেখেছেন জর্জ। অল্প বয়েস থেকেই এই বালকটি জানে, সে এই পারিবারিক সম্পত্তির ভবিষ্যৎ-অধিকারী। অভিজাত সমাজের উপযুক্ত করে ভোলার জন্য অন্যান্য ভাইবোনের তুলনায় কার্জনের জন্য বিশেষ শিক্ষার ব্যবস্থা হল। পিতা কিছুটা স্বভাবকৃপণ হলেও এই ছেলের নানারকম দাবি ও আবদার প্রায় সবই মেনে নেন। অতি সুদর্শন ও তেজি বালকটিকে সকলেই পছন্দ করে।

অত্যন্ত ব্যয়সাধ্য বিদ্যালয়ে পাঠানো হয় কার্জনকে। প্রথমে হ্যাম্পশায়ারের উইক্সেনফোর্ড স্কুলে, তারপর প্রখ্যাত ইটন-এ। এই ইটনের ছাত্ররাই প্রাপ্ত বয়েসে ইংলন্ডের রাজনীতি ও সমাজজীবনে শীর্ষ স্থান দখল করে, সমসাময়িককালে অন্তত চারজন প্রধানমন্ত্রী এই স্কুলের ছাত্র। ইটন স্কুলের চত্বর সুবিস্তৃত হলেও প্রাচীর বেষ্টিত, ছাত্ররা এই দেয়ালঘেরা জীবনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে, বাইরের জগতের বিশেষ কিছুই তাদের জানতে দেওয়া হয় না। লেখাপড়া ছাড়াও তাদের শেখানো হয় শিষ্টাচার, আভিজাত্যের গরিমা, স্বাজাত্যবোধ এবং কিছু কিছু কুসংস্কার, যেমন সারা পৃথিবীতে ইংরেজরাই শ্রেষ্ঠ জাতি। নানান কুটকৌশলে এবং অস্ত্রের জোরে বিভিন্ন দেশ জয় করে যে সাম্রাজ্য বানানো হয়েছে, সেটা নিছক পররাজ্যলোলুপতা নয়, সেটা ইংরেজ জাতির পবিত্র অধিকার। অশ্বেতাঙ্গ জাতিগুলি শিক্ষাদীক্ষাহীন, দুর্নীতিগ্রস্ত, শারীরিকভাবে দুর্বল, বর্বর সামাজিক প্রথা মেনে চলে, ধর্মের পথে কদাচারে মেতে থাকে, নিজেদের দেশ পরিচালনার ক্ষমতা নেই, সেই জন্যই তো এদের সুশৃঙ্খলভাবে শাসনের ভার বর্তেছে ইংরেজদের ওপর। এটা একটা মহান দায়িত্ব। এই দায়িত্ব, এই সাম্রাজ্য রক্ষার জন্য প্রাণ দেওয়াও যে-কোনও ইংরেজের পক্ষে গৌরবের ব্যাপার।

ইংরেজরা ইওরোপীয় জাতি হলেও, যেহেতু দ্বীপবাসী, তাই অন্যান্য ইওরোপীয় রাজ্যগুলি থেকে অনেকটা স্বাতন্ত্র রক্ষা করে। অন্য কোনও ইউরোপীয় রাজ্যের সঙ্গে তাদের সদ্ভাব নেই। বিশ্বজয়ের শক্তি পরীক্ষায় ইংরেজদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল ফরাসিরা, ওয়াটার যুদ্ধে নেপোলিয়নকে সম্পূর্ণভাবে পর্যুদস্ত করার পর সেই ফরাসিদেরও মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে। ভারতে ফরাসিদের সাম্রাজ্য বিস্তারের আশা প্রায় অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়েছে বলা যায়, এখন সেখানে তারা কোণঠাসা। ইউরোপীয় শক্তির মধ্যে এখন একমাত্র রাশিয়া সম্পর্কেই খানিকটা উদ্বেগের কারণ আছে, কিন্তু রাশিয়াও এখন দূর প্রাচ্যে জাপানকে নিয়ে বিব্রত। জাপানিরা এশীয় জাতি হলেও তারাও দ্বীপবাসা, বাকি এশীয়দের সঙ্গে তাদের চরিত্রগত তফাত আছে। এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলির মানুষরা অসম্মবদ্ধ, কাপুরুষ, মাথা তুলে দাঁড়াতে জানে না, কিন্তু আত্মাভিমানী জাপানিরা রাশিয়ার মতন এক প্রবল প্রতিপক্ষের সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে উদ্যত হয়েছে।

সমগ্র পথিবীর এক পঞ্চমাংশ এখন ইংরেজদের অধীনে। এই জাতির ইতিহাসে এমন সুসময় আগে কখনও আসেনি। শুধু অস্ত্রের জোরই নয়, ব্যবসায় বাণিজ্যেও তাদের আধিপত্য অবিসংবাদিত। তারা আবিষ্কার করেছে স্টিম ইঞ্জিন, দ্রুত যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য রেললাইন বসাচ্ছে চতুর্দিকে, সেতু নির্মাণের কৃতিত্বে অনেক দুর্গম হয়েছে সুগম। মহারানি ভিক্টোরিয়ার মাথার মুকুটে উজ্জ্বলতম রত্নটির নাম ভারতবর্ষ।

ইটন থেকে কার্জন চলে আসে অক্সফোর্ডের বেলিওল কলেজে। ছাত্র হিসেবে মেধাবী কিন্তু কিছুটা উজ্জ্বল ও দুর্দান্ত প্রকৃতির, পোশাক-পরিচ্ছদ, শৌখিন মুখমণ্ডলে আভিজাত্যের গরিমা, সে যে সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করবে, তা খুবই স্বাভাবিক। বিতর্ক সভায় সে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে। ছাত্র রাজনীতিতে রক্ষণশীল দলের পাণ্ডা হয়ে ওঠে। ইংলন্ডে তখন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন গ্ল্যাডস্টোন, কার্জন ডিজরেইলির সমর্থক। তখন থেকেই কার্জনের একটা ধারণা গড়ে উঠেছে যে একমাত্র অভিজাত শ্রেণীই দেশ ও সাম্রাজ্যের শাসনভার পাওয়ার উপযুক্ত। শ্ৰেণী স্বাতন্ত্রে সে ঘোর বিশ্বাসী। লন্ডনের জাঁকজমকের তুলনায় ইংল্যান্ডের গ্রামগুলি অনেক নিষ্প্রভ, অশিক্ষা ও দারিদ্র্য রয়েছে যথেষ্ট। কার্জনের ধারণা, চাষা-ভুষো, শ্রমিক শ্রেণীর লোকেরা যে যার জায়গাতেই থাকবে, সেটাই তাদের নিয়তি। আর অভিজাত শ্রেণীর লোকেরা শিক্ষা-সংস্কৃতিতে, বুদ্ধিতে শ্রেষ্ঠ, স্বাভাবিকভাবেই দেশশাসনের দায়িত্ব তারই নিয়ে থাকবে।

কলেজ ছাড়ার পর প্রথমবার পালামেন্টের নির্বাচনে কার্জন হেরেছিলেন কারণ সাধারণ মানুষ সম্পর্কে তাঁর কোনও জ্ঞানই ছিল না। কেড়লস্টন হলের ভাবী উত্তরাধিকারী হিসেবে তিনি ভেবেছিলেন যে তাঁর মতন একজন পুরুষ সভাস্থলে গিয়ে দাঁড়ালেই প্রজারা আভূমি নত হবে। কিন্তু দিনকাল বদলে যাচ্ছে! ডিজরেইলি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন নানা কারণে রক্ষণশীল দল অনেকখানি জনপ্রিয়তা হারিয়েছিল। এর মধ্যে ভোটারের সংখ্যাও অনেক বেড়েছে, তাদের মধ্যে অনেকেই কার্জনদের প্রজা নয়। বক্তৃতামঞ্চে উঠে কার্জন দেখলেন, সামনে যত রাজ্যের কুলি আর কারখানার মজুর বসে আছে, তাদের কালিঝুলি মাখা চেহারা, তাদের মুখে কোনও শ্রদ্ধার ভাব নেই। অক্সফোর্ডের এই নামকরা ছাত্রটির উচ্চাঙ্গের বাগ্মিতার তারা মূল্যই দিল না। 

সাতাশ বছর বয়েসে, দ্বিতীয়বার নির্বাচনে দাঁড়িয়ে ল্যাঙ্কাশায়ার থেকে জয়ী হলেন কার্জন। ইংলন্ডের ভোটদাতাদের স্বভাবই এই, তারা এক জনকে বেশি দিন ক্ষমতায় রাখে না। উদারনৈতিক গ্লাডস্টোনের পতনের পর এখানে এখন রক্ষণশীল হাওয়া বইছে, তাতেই কার্জন পার হয়ে গেলেন, এবং দলনেতা লর্ড সসবেরির সহকারী ব্যক্তিগত সচিব হিসেবে কাজ চালাতে লাগলেন।

কার্জন তাঁর শরীরের প্রতিটি রক্তবিন্দুতে সাম্রাজ্যবাদী। ধর্মচিন্তা কিংবা নারীকে জয় করার আকাঙ্ক্ষার চেয়েও সাম্রাজ্য সুরক্ষার দায়িত্ব অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সে দায়িত্ব এই তরুণ পালামেন্টারিয়ানকে কেউ দেয়নি, তিনি নিজেই সেটা নিয়ে বসে আছেন। সাম্রাজ্য শাসনের ব্যাপারে কোনওরকম নমনীয়তা প্রদর্শন তাঁর মনঃপূত নয়। সাম্রাজ্যের প্রকৃত অবস্থা দেখার জন্য তিনি নিজের উদ্যোগে বেরিয়ে পড়লেন ভ্রমণে। ভারতে এসে ঘুরতে ঘুরতে তাঁর মনে হল, এই বিশাল জনবহুল দেশটির যা-কিছু উন্নতি ঘটছে তা ব্রিটিশদেরই উদ্যোগে। কলকাতা তো এশিয়ার বুকে বসিয়ে দেওয়া একটা ইওরোপীয় শহর। এই দূরদেশের যেখানেই নিজ জাতির কোনও কীর্তিস্তম্ভ দেখেন, তাতেই তাঁর মন ভরে যায়। একমাত্র আগ্রার তাজমহল দেখে তিনি থমকে গিয়েছিলেন, তাজমহলের সৌন্দর্য যেন অপার্থিব। ইংলন্ড বা ইওরোপের কোনও কীর্তির সঙ্গে এর তুলনাই চলে না। তাজমহল সম্পর্কে কার্জন আগেই অনেক কিছু শুনেছিলেন, তাঁর মনে হয়েছিল, সেটি বড় জোর স্পেনের আলহামব্রা প্রাসাদের মতন হবে। কিন্তু স্বচক্ষে দেখার পর তিনি স্বীকার করতে বাধ্য হলেন, নাঃ, এ যে অতুলনীয়, অবর্ণনীয়! কিন্তু ইংরেজদের সাহায্য ছাড়াই ভারতীয়রা এমন একটা বিস্ময়কর শিল্প গড়তে সক্ষম হয়েছিল এটা কার্জনের ঠিক মানতে ইচ্ছে করে না, স্মৃতি সৌধটিতে কিছুক্ষণ ঘুরতে ঘুরতে তিনি একটি ইংরেজ সংযোগ আবিষ্কার করলেন। তাজমহল সংলগ্ন উদ্যানটির সংরক্ষক একজন শ্বেতাঙ্গ, কার্জন আলাপ করে জানলেন যে সে ইয়র্কশায়ারের লোক, তার নাম স্মিথ, সে কুড়ি বছর ধরে উদ্যানটি দেখাশুনা করছে। কার্জন উল্লসিত হয়ে উঠলেন, বাগানটিতে তাজমহলের সৌন্দর্য অনেক বেশি খুলেছে, একজন ইংরেজের হস্তক্ষেপের জন্যই তো তাজমহল এত দর্শনীয়। 

শুধু ভারত নয়, দুর্গম আফগানিস্তান, বোখারা, কোরিয়া, কম্বোডিয়া, আন্নাম, হংকং, মধ্য এশিয়া, পারস্য, আমেরিকা, কানাডা ইত্যাদি দেশে কার্জন পাড়ি দিয়েছেন একাধিকবার। অনেক বিপদের ঝুঁকি নিয়েছেন, উপেক্ষা করেছেন শারীরিক কষ্ট। আতিথ্য পেয়েছেন এক একটা দেশের রাজা বা সুলতান বা প্রধানমন্ত্রীর আলয়ে। কার্জনের তেমন কিছু পদমর্যাদা না থাকলেও তাঁর কন্দর্পকান্তি ও রাজকীয় হাবভাব দেখে সবাই মুগ্ধ। কথিত আছে, কোরিয়ার এক মন্ত্রী তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, মহাশয়, আপনি কি ইংলন্ডের রানির পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত? কার্জন তৎক্ষণাৎ উত্তর দিয়েছিলেন, না। তবে আমি এখনও বিয়ে করিনি! 

মধ্য প্রাচ্যে ব্রিটিশ প্রভাব বিস্তারের সম্ভাবনা এবং রাশিয়ার আগ্রাসী শক্তি কতখানি তা পর্যবেক্ষণ করে কার্জন একাধিক বই লিখেছেন। রাশিয়া ইন সেন্ট্রাল এশিয়া, ‘প্রবলেমস অফ দা ফার ইস্ট’, ‘পারশিয়া অ্যান্ড দা পারশিয়ান কোয়েশ্চেন’, এর মধ্যে শেষোক্ত বইটির পৃষ্ঠা সংখ্যা তেরো শো! 

এই সব ভ্রমণ অভিযান ও কেতাব রচনার সুফলও তিনি পেয়েছেন যথা সময়ে। স্ত্রীভাগ্যেও তিনি বিশেষ সৌভাগ্যবান। অল্প বয়েস থেকেই কার্জনের প্রতি অনেক মহিলা ও পুরুষ আকৃষ্ট হয়েছে। ইটন স্কুলে পড়ার সময় একজন শিক্ষকের সঙ্গে তার অতি ঘনিষ্ঠতা নিয়ে অনেক গুজব ছড়িয়েছিল। প্রখ্যাত লেখক এবং শেষ জীবনে ভাগ্যবিড়ম্বিত ও এক কলঙ্কজনক অভিযোগে অভিযুক্ত অস্কার ওয়াইল্ডও তরুণ কার্জনকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। বড় ঘরের মহিলারা কার্জনকে দেখে প্রায় মুছা যেত। অনেক রূপসী রমণীর সঙ্গেই কার্জনের বন্ধুত্ব হয়েছিল। কিন্তু যারা উচ্চাকাঙ্ক্ষী, যারা জীবন সম্পর্কে পরিকল্পনা ছকে রাখে, তারা হুট করে আবেগের মাথায় বিয়ে করে না, প্রেমকেও প্রাধান্য দেয় না। কার্জনের পারিবারিক বংশগৌরব যতখানি, তত অর্থসম্পদ নেই। এই সব অভিজাতরা স্ত্রীভাগ্যে ধন কথাটায় খুব বিশ্বাসী। 

কার্জনের স্ত্রী মেরি আমেরিকান। এই ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে আমেরিকায় ধনীর সংখ্যা প্রচুর। সেই সব ধনীদের সন্তানেরা যদৃচ্ছ অর্থ ব্যয় করে বিলাসী জীবনযাপন করতে পারে, কিন্তু যতই অর্থ থাকুক, দু-এক পুরুষে বংশগৌরব পাওয়া যায় না। আমেরিকার ধনী দুহিতারা ইওরোপে এসে কোনও পড়ন্ত বনেদি বংশের যুবককে বিবাহ করে লেডি কিংবা কাউন্টেস হবার জন্য খুবই লালায়িত। লন্ডনে এক পার্টিতে মেরির সঙ্গে কার্জনের প্রথম দেখা, তারপর বছর পাঁচেক ধরে ইওরোপে ও আমেরিকায় কয়েকবার সাক্ষাৎকার ও চিঠিপত্র বিনিময়ের পর কার্জন মনস্থির করলেন এবং অনেক ইংরেজ কুমারীর বুক শেলবিদ্ধ করে কার্জন এই আমেরিকান যুবতীটিকেই পত্নী হিসেবে নির্বাচন করলেন। 

মেরির পিতা আমেরিকার এক ক্রোড়পতি ব্যবসায়ী। মেরিও চমকপ্রদ রকমের রূপসী। একেবারে যেন রাজযোটক, স্বামী ও স্ত্রী দুজনে— যা চেয়েছিলেন, ঠিক তাই পেলেন। মেরি তার পিতার কাছ থেকে প্রায় দেড় লক্ষ পাউন্ড যৌতুক পেল; শ্বশুর তাঁর জামাতার জন্যও পাঁচ শো পাউন্ড মাসোহারার ব্যবস্থা করে দিলেন আজীবন। তিনি চান, লন্ডনের উচ্চ সমাজে মেলামেশা করার জন্য কন্যা জামাতাকে যেন কখনও কার্পণ্য না করতে হয়।

কার্জন ততদিনে বৈদেশিক দফতরে আন্ডার সেক্রেটারির পদে উন্নীত হয়েছেন মাত্র। সুতরাং ভারতের ভাইসরয় পদ থেকে লর্ড এলগিনের অবসর নেবার সংবাদ যখন প্রচারিত হল, তখন সেই পদের জন্য দাবিদার অনেক, এবং তাঁরা সবাই কার্জনের চেয়ে উচ্চপদস্থ। এমনকী মহারানির এক নাতিও এই পদের প্রার্থী। ইংলন্ডের রাজা-রানি ও প্রধানমন্ত্রীর পরেই ভারতের ভাইসরয়ের পদটি গুরুত্বপূর্ণ। বয়েস এবং পদমর্যাদার দিক থেকে কার্জনের দাবি নগণ্য হলেও অন্য এক দিক থেকে কার্জন নিজেকে যোগ্য করে তুলেছিলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী সাবেরিকে চিঠি লিখে আবেদন জানালেন, আমি দশ বছর ধরে ভারতের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছি, চারবার সে দেশে গিয়ে ঘুরে ঘুরে স্বচক্ষে দেখেছি, প্রতিবেশী রাজ্যগুলির শাসকদের সঙ্গেও আমার ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা হয়েছে, ভারত শাসনের জন্য এইসব কি খুব প্রয়োজনীয় নয়? 

বিবাহের পর কার্জন এত বড় বড় সব পার্টি দিয়েছেন যে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা সবাই তাঁকে চেনে, স্বয়ং প্রিন্স অব ওয়েলসের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ পেয়ে মহারানি ভিকটোরিয়াও একবার এই দম্পতিকে দেখতে চাইলেন। ভাইসরয়ের পত্নীকেও নানা রকম আদব-কায়দা পালন করতে হয়, এই আমেরিকার মেয়েটি তা পারবে তো? মেরির সঙ্গে কথাবার্তা বলে মহারানি সন্তোষ প্রকাশ করলেন। মেয়েটি সুন্দরী তো বটেই, বুদ্ধিও আছে। অন্যান্য প্রার্থীদের স্তম্ভিত করে ঘোষিত হল কার্জনের নাম।

ভারত সাম্রাজ্যে ভাইসরয় সম্রাজ্ঞীর প্রতিনিধি। কিন্তু লন্ডন থেকে কলকাতা প্রায় সাত হাজার। মাইল দূরে। এখানে ভাইসরয়ই যেন সম্রাট। কার্জন এক সময় নিজের কাছে শপথ করেছিলেন, কলকাতার-এই লাটভবনে আমি অধিষ্ঠান করব। নিয়তির দুজ্ঞেয় খেলায় সে শপথ পূর্ণ হয়েছে। আজ কার্জন একজন পরিতৃপ্ত মানুষ। আসমুদ্র হিমাচলের রাজকর্মচারীরা টের পাবে কদিনের মধ্যেই। যে কে এসেছে ভাইসরয় হয়ে। সাম্রাজ্য শাসনে তিনি কারুকেই এক মুহূর্তের জন্যও শিথিল হতে দেবেন না। 

সকালবেলা পাশাপাশি দুটি ঘোড়ায় চেপে সস্ত্রীক কার্জন চলে আসেন ময়দানে। লন্ডনের হাইড পার্কের মতনই এক বিশাল প্রান্তর সবুজ, অল্প অল্প কুয়াশা মাখা, দূরের গাছপালাগুলিকে অরণ্যের মতন মনে হয়। এই দম্পতির সঙ্গে থাকে শুধু কয়েকজন পার্শ্বচর। এ সময়ে কোনও স্থানীয় মানুষদের ময়দানে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না।

খানিকক্ষণ ঘোড়া ছুটিয়ে এঁরা শীত কাটিয়ে নেন, তারপর গঙ্গার ধারে এসে নদীর শোভা দেখেন। মেরিকে একটা একটা করে দ্রষ্টব্য স্থান চিনিয়ে দেন তাঁর স্বামী। নদীটি বড় সুন্দর। স্টিমার যাওয়া-আসা করছে অনবরত, ছোট ছোট দিশি নৌকোগুলি ঢেউয়ের সঙ্গে দোল খায়। অস্পষ্টভাবে শোনা যায় সেইসব নৌকোয় মাঝিদের গান।

একদিন বেশ খানিকটা দূরে চলে যাওয়া হল। খিদিরপুর ছাড়লেই আর জনবসতি নেই, বেশ জমাট জঙ্গল। এখানে নানারকম জন্তু-জানোয়ার আছে, শিয়াল প্রচুর। শিকার করা যায় না? দেহরক্ষীরা জানাল, অবশ্যই যায়, অনেক প্রধান প্রধান রাজপুরুষ এখানে শিকার করে গেছেন, বিশেষত শিয়াল-শিকার ইংরেজদের প্রিয় ব্যসন। তবে লর্ড এলগিন শিকার পছন্দ করতেন না। কার্জন বললেন, তা হলে শীঘ্রই এখানে একদিন শিকারে আসতে হবে।

এক জায়গায় গোটা দশ বারোজন লোক গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, মাঝখানে একজন লোক হাত নেড়ে নেড়ে কী যেন বলছে। সাহেব সম্প্রদায়কে দেখেই বক্তাটি থেমে গেল, অন্যান্যরা জড়ামড়ি করে ভিতু চোখে চেয়ে রইল। 

মেরি কৌতূহলী চোখে তাদের দেখলেন। এই শীতের মধ্যেই কেউ কেউ পরে আছে শুধু ধুতি, একদিকের খুঁট গায়ে জড়ানো, কেউ কেউ বুকে জড়িয়ে রেখেছে একটা গামছা। এরকম বিচিত্র শীতের পোশাক মেরি আগে কখনও দেখেননি। তিনি স্বামীকে জিজ্ঞেস করলেন, এই লোকগুলি কী জাত? 

কার্জন বললেন, প্রিয়তমে, আমরা এখন বেঙ্গলে আছি, এই লোকগুলিকে বলে বাঙালি। 

তারপর ঈষৎ নাসিকা কুঁচকে আবার বললেন, পুরুষগুলোকে দেখো, পুরুষোচিত কোনও ভাবই নেই। ওদের দিকে তাকাতেই বিশ্রী লাগে। এই বাঙালিরা আর কিছু পারে না। শুধু সর্বক্ষণ বকবক করে। চলো, ফেরা যাক। 

দুটি তেজোবান অশ্ব ধুলো উড়িয়ে চলে গেল ময়দানের দিকে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *