॥ ৫১ ॥
কুঞ্জবনে আর এসো না, বুঝলে?
কেন বলো তো!
এটা তোমার জায়গা ছিল। একা একা বসে ভাবতে। আমি ঠাট্টা করে নাম দিয়েছিলাম কুঞ্জবন। কৃষ্ণ থাকত, কিন্তু রাধা আসত না। আজকাল রাধা আসে, কৃষ্ণও থাকে। তুমি পালাও।
এসব কী হচ্ছে মনু? আমার যে হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে।
সেইজনই তো তোমাকে সাবধান করছি। পৃথিবীর অনেক ঘটনা সম্পর্কেই তো তুমি চোখ বুঝে থেকেছো এতকাল। এটাও চোখ বুজে এড়িয়ে যাও।
কিন্তু এ তো আমার পরিবারের কলঙ্ক মনু।
তা জানি। কিন্তু তোমার বা আমার কিছু করার নেই।
কেন নেই?
যদি বাধা দাও তবে, মরীয়া হয়ে একটা কিছু করে ফেলবে।
কী করতে পারে বলো তো!
আত্মহত্যা করতে পারে। পালিয়ে যেতে পারে।
তা বলে চুপ করে থাকতে হবে?
অন্য কেউ হলে আমি চুপ করে থাকতে বলতাম না। তুমি বলেই বলছি। তুমি শান্ত, ভাবুক মানুষ। এসব সামাল দেওয়া তোমার কাজ নয়।
তার মানে তুমি আমাকে অপদার্থ ভাবো।
যা ভাবি তাই ভাবি। এখন তো নতুন করে ভাবতে পারব না।
হেমকান্ত কিছুক্ষণ গম্ভীর বিষণ্ণ মুখে বসে থেকে বললেন, আমি সত্যিই অপদার্থ মনু।
তুমি কী তা তো এ জন্মে সবটা জানা যাবে না। তবে যাই হও, তুমি যেমনটি, ঠিক তেমনটিই থেকো।
তা না হয় থাকলাম, কিন্তু ওদের যে রোখা দরকার মনু। তুমি একটা কিছু করতে পারো না?
রঙ্গময়ী মাথা নেড়ে বলে, না গো। তুমিও পারো না, আমিও পারি না। আমাদের সেই জোর নেই।
কেন নেই?
বোঝো না? একটু তলিয়ে দেখ, বুঝতে পারবে।
হেমকান্ত যথাসাধ্য তলিয়ে দেখলেন, কিন্তু বুঝতে পারলেন না। বললেন, আমি বুঝতে পারছি না মনু
সোজা তো।
বুঝিয়ে দাও।
তোমার আর আমার সম্পর্ক নিয়েও লোকের সন্দেহ আছে।
হেমকান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, লোকের মন বড় নোংরা মনু।
সে তুমি যাই বলো, কথাটা তো সত্যি। তাই তুমি বা আমি কারো নৈতিক চরিত্র নিয়ে কথা বলতে পারি না। যদি বলি তবে ওরাও আমাদের বিরুদ্ধে আঙুল তুলে বলবে, তোমরা কি সাধু?
বলবে বলছো?
নিশ্চয়ই বলবে। বিশাখা একদিন বুঝি শচীনকে আলতো করে কী একটু বলেছিল চপলাকে নিয়ে। শচীন উন্টে বিশাখাকে চোটপাট করেছে। বলেছে, চৌধুরি বাড়ির অনেক কেচ্ছাকাহিনী আছে।
বিশাখা বলেছিল তাহলে?
একটু বলেছিল। কিন্তু বেচারাকে অপমান হতে হয়েছে।
ওরা কতদূর এগিয়েছে মনু?
আমি কি আড়ি পাতি নাকি যে জানবো?
তুমি জানো। বলছ না।
খুব বেশী জানি না। তবে হাবভাব দেখে মনে হয় শচীন আর চপলা দুজনেই একটু বেশী বেপরোয়া। কাউকে গ্রাহ্য করছে না। করবেও না।
কনককে একটা খবর পাঠাবো?
তুমি বোকা।
কেন?
কনকের কিছুই করার সাধ্য নেই। তাকে আমি চিনি। চপলা ওকে যেমন ভেড়া বানিয়েছে ও তেমন ভেড়াটি হয়েই থাকবে। তুমি যদি ওর বউয়ের নামে ওকে কিছু বলো ও বিশ্বাস করবে না। উল্টে বরং তোমার ওপর রেগে যাবে।
কিন্তু কলকাতা যাওয়ার আগে কনকের সঙ্গে নাকি বড় বউমার ঝগড়া হয়েছিল।
হয়েছিল। তাতে কি প্রমাণ হয় যে, কনক পুরুষসিংহ? আর চপলা ওর কৃতদাসী?
তা বলছি না। ঝগড়া হয়েছিল কেন জানো?
তোমার মেনীমুখো ছেলে বউ ছাড়া থাকতে পারে না। তাই বউকে টানাটানি করেছিল যাওয়ার জন্য! চপলা যেতে চায়নি বলে ঝগড়া। কিন্তু সেই ঝগড়ায় কার হার হয়েছে তা তো দেখছই!
বিষণ্ণ হেমকান্ত গম্ভীর মুখে বললেন, হুঁ।
সংসারটা হল কাঁথার উল্টো পিঠের মতো। সামনেটা বেশ নকশাদার, সাজানো গোছানো সিজিল মিছিল। কিন্তু উল্টোপিঠে যত সূতোর গিঁট, উল্টোপাল্টা ফোঁড়। তোমার তো তলার দিকটা দেখবার দরকার নেই। যা হচ্ছে তোক।
শচীনকে যদি বরখাস্ত করি?
রঙ্গময়ী একটু হেসে বলে, তাতে তোমারই ক্ষতি। সে তোমার বিষয়-সম্পত্তি যক্ষের মতো আগলাচ্ছে। তাকে তাড়াতে আবার পাঁচ ভূতে লুটে খাবে। তাছাড়া লাভও নেই। বরখাস্ত করলে ওদের রোখ আরো বাড়বে। বেহেড হয়ে এমন কাণ্ড করে বসবে যে, তুমি মুখ দেখাতে পারবে না।
খবরটা কতদূর রটেছে জানো?
রটেছে। ভালই রটেছে। এসব কি চাপা থাকে?
আমার ধারণা, তুমি ইচ্ছে করলে এর মীমাংসা করে দিতে পারো। তোমার তো অনেক বুদ্ধি।
আমার ওপর তোমার অনেক বিশ্বাস। কিন্তু বললামই তো আমি সরাসরি কিছু করতে পারি না। আমার মনেও তো পাপ।
হেমকান্ত সামান্য উষ্মার সঙ্গে বললেন, তোমার মনে পাপ থাকবে কেন মনু? তুমি এমন কী অন্যায় করেছো?
অন্যায় নয়? ও বাবা, কত কলঙ্ক আমার!
হেমকান্ত মাথা নেড়ে বললেন, আমাকে যা তা একটা কিছু বোঝালেই যে আমি বুঝব অত বোকা আমি নই মনু। আমি বিপত্নীক, তুমি এখনো কুমারী। যদি চাই তো আমরা বিয়ে করতে পারি। তাতে কোনো নৈতিক অপরাধ হয় না, বিশ্বাসঘাতকতা হয় না, পাপও হয় না। বরং অরক্ষণীয়া কন্যাকে উদ্ধার করার পুণ্যই হয়। আমাদের সঙ্গে ওদের তুলনা করছ কেন? চপলা ঘরের বউ, ছেলেমেয়ের মা, সে আর তুমি কি এক?
রঙ্গময়ী হেমকান্তর কথায় মাথা নীচু করে লাজুক ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে রইল। হঠাৎ মৃদু হেসে বলল, খুব বুদ্ধি হয়েছে আজকাল, না?
বিপাকে পড়েছি মনু, এখন আমার মাথার ঠিক নেই। একটা কিছু পরামর্শ দাও। আমার তো তুমি ছাড়া কেউ নেই, জানোই।
রঙ্গময়ী একটা বড় রকমের শ্বাস ফেলে বলে, সেটাই তো হয়েছে মুশকিল। তোমার আমি ছাড়া কেউ নেই। কিন্তু কপালগুণে আমি মেয়েমানুষ। তার ওপর আবার শিক্ষাদীক্ষা নেই। আমি তোমাকে কী পরামর্শ দেবো?
তুমি মেয়েমানুষ হয়ে না জন্মালে আমার যে কী গতি হত!
বলছ যখন ভেবে দেখব। তবে যেটুকু অভিজ্ঞতা হয়েছে তাতে বলতে পারি, এসব ক্ষেত্রে জোর করে কিছু করতে যাওয়া ঠিক নয়।
জোর করতে পারি এমন জোরই যে আমার নেই।
রঙ্গময়ীর। অসামান্য ধারাল মুখশ্রীতে লজ্জার লাবণ্য তেমন মানায় না। তবু লজ্জার রেশটুকু এখনো টলটল করছে মুখে। সলাজ দৃষ্টিক্ষেপ করে সে বলল, আজ কিছু একটা খুব জোরের কথা বলে ফেলেছে।
কী বলো তো!
ভেবে দেখ। এইমাত্রই তো বললে!
কোন কথাটা?
উঃ, তোমাকে নিয়ে আর পারি না। সব কথাই ধরিয়ে না দিলে হয় না।
বুঝেছি। হেমকান্তর ফর্সা রঙেও একটু লাল আভা মিশল।
ছাই বুঝেছো।
বুঝিনি?
বলো তো কী?
বিয়ের কথাটা তো?
যাক। বলে রঙ্গময়ী পিছু ফিরল। হাঁটতে হাঁটতে বলল, কুঞ্জবনে থেকো না। ওরা আসবে।
এটা আমার জায়গা মনু। আমি থাকব। ওরা অন্য জায়গায় যাক।
রঙ্গময়ী যেতে যেতেও দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, শোনো বোকা মানুষটার কথা। কুঞ্জবন তবু খোলামেলা জায়গা। এখানে দুজন’ আর যাই করুক তেমন ঘনিষ্ঠ হতে পারবে না। তুমি কুঞ্জবন না ছাড়লে ওরা ঘরে গিয়ে দোর দেবে।
হেমকান্ত রেগে গিয়ে বলেন, দিক। যা খুশি করুক।
বঙ্গময়ী মাথা নেড়ে বলে, ওটা কাজের কথা নয়। রাগের কথা। ঘর কিন্তু ভাল জায়গা নয়। যত কাণ্ড সব নির্জন ঘরেই তো হয়। যা বলছি শোনো। মাথা ঠাণ্ডা রাখো।
হেমকান্ত ঘরের ব্যাপারটা বুঝতে একটু সময় নিলেন। কিন্তু যেই বুঝলেন অমনি ছ্যাঁকা খাওয়ার মতো চমকে উঠলেন।
সন্ধেবেলা সেজবাতির আলোয় হেমকান্ত একখানা বাঁধানো খাতার প্রথম পাতায় লিখলেন; ইহা আমি কী বলিলাম! আমার মুখনিঃসৃত এই কথা যে আমাকে বিস্ময়ে আবিষ্ট করিতেছে, আনন্দে শিহরিত করিতেছে। তবে কি রবিবাবুর, সেই কবিতার মতো আমার অভ্যন্তবেও এক নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ ঘটিতেছে! বাঁধ ভাঙিয়া প্রলয়ংকর জলরাশি প্রমত্ত বেগে নামিয়া আসিবে? রবির কর কি কোনো উপায়ে গুহার সূচীভেদ্য অন্ধকার বিকীর্ণ কবিয়া আমার প্রাণে স্পর্শ রাখিয়াছে? আদি কবি বাল্মীকির মতো আমিও যে আজ স্বীয় মুখে উচ্চারিত একটি বাক্যকে সবিস্ময়ে পর্যালোচনা করিতেছি। কিমিদং? ইহা কী?
ইহা যাহাই হউক, এই বাক্যের মধ্যে নিহিত রহিয়াছে সত্য। যাহা সত্য তাহাই আজ সবেগে বাহির হইয়া গেল। আমি নিমিত্ত মাত্র। অবচেতন মনের কথা শুনিয়াছি। চেতনার এমনই একটি স্তর যাহা ঘুমন্ত ও স্বপ্নময়। এইসব জীবনসত্য সেখানেই আত্মগোপন করিয়া থাকে। উপলক্ষ পাইলে সবেগে বাহির হইয়া আসে।
যে মানবীকে উপলক্ষ করিয়া আজ এই সত্য প্রকটিত হইল তাহাকে আমি বাল্যকালাবধি জানি। বয়সে সে আমার অপেক্ষা প্রায় বিশ বৎসর ছোটো। তাহাকে শিশু অবস্থায় আমি এক আধবার ক্রোড়েও ধারণ করিয়া থাকিব। ঠিক স্মরণ নাই। তবে সেই শিশুকে আমি বড় হইতে দেখিয়াছি। আমার যখন বিবাহ হয় তখন সে নিতান্তই বালিকা। আমার বাসরঘরে সে তাহার পিসির সহিত রাত জাগিতে গিয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল। গাছ বাহিতে, সাঁতার দিতে পারিত চমৎকার। রুক্ষ চুলে তেল জুটিত কি জুটিত না। পূজার দানের সস্তা ও মোটা শাড়ি পরিয়া সে ঘুরঘুর করিত। মুখখানায় বুদ্ধির দীপ্তি ছিল।
তাহাকে প্রথম ভাল করিয়া লক্ষ্য করি কিশোরী বয়সে। আমরা স্বামী-স্ত্রী দোতলার ঘরে থাকিতাম। আমাদের জানালার পাশেই একটি কাঠচাঁপা গাছের পুষ্পিত শাখা ছিল। পুষ্পের সুগন্ধ ঘরেও পাওয়া যাইত।
একদিন ভোর রাত্রে জানালার বাহিরে কাঠচাঁপা গাছের নরম ডাল ভাঙ্গিয়া পড়িয়া শব্দ হইল, সেই সঙ্গে একটি শিহরিত মৃদু কাতরতার ধ্বনি। তাহা আর্তনাদ নহে। যেন একটা কোকিলের শ্বাসরোধ হইয়াছে। বা গলা ভাঙিয়াছে। উপমাটা বোধহয় ভাল হইল না। যাহাই হউক, আর্তনাদটি ঠিক আর্তনাদ নহে, কেহ যেন আর্তনাদ করিতে গিয়াও অমানুষিক প্রয়াসে সেটি রুদ্ধ করিল।
সেই শব্দ এমনই মৃদু যে আমার স্ত্রীর ঘুম ভাঙিল না। আমি উঠিয়া প্রথমে জানালা দিয়া দেখিলাম। তেমন কিছু দৃষ্টিগোচর হইল না। দ্রুত নীচে নামিয়া কাঠচাঁপা গাছের তলায় ঘাসের উপর অধশায়িত যাহাকে আবিষ্কার করিলাম সে সেই কিশোরী। কোমরে ও হাতে সাঙ্ঘাতিক চোট লাগিয়াছে। তবু সে কাতর কোনো শব্দ করিতেছে না। শুধু মুখটি বিকৃত করিতেছে অবরুদ্ধ যন্ত্রণায়।
তাহাকে ধরিয়া তুলিয়া প্রশ্ন করিলাম, গাছে উঠেছিলে কেন?
ফুল তুলতে।
কাঠচাঁপা গাছে কেউ ওঠে? ওর ডাল নরম হয় জানো না?
জানি।
তবে উঠেছিলে কেন?
তোমাদের দেখতে।
আমাদের দেখতে? আমাদের দেখার কী আছে?
তোমরা ওরকমভাবে শুয়ে থাকো কেন?
আমি স্তম্ভিত হইয়া বলিলাম, কীভাবে শুয়ে থাকি?
বিশ্রীভাবে।
আমার ইচ্ছা হইয়াছিল অসভ্য মেয়েটার গালে বিরাশি সিক্কা ওজনের একটি চড় কষাইয়া দিই। কিন্তু নিজেকে সংবরণ করাই আমার চিরকালের অভ্যাস।
বলিলাম, তোমার লজ্জা হয় না?
কেন হবে?
আমরা স্বামী-স্ত্রী যে ঘরে বাস করি সেখানে অসময়ে উঁকি দাও, এটা কেমন কথা?
বেশ করব উঁকি দেবো।
কেন উঁকি দেবে?
আমার ইচ্ছে।
বাঃ বেশ তো! আমার এর বেশী কথা মুখে আসিল না।
সে বলিল, বেশই তো! কী করবে, মারবে? মারো না।
মারাই উচিত।
বলছি তো মারো। মারো না!
আমি হঠাৎ হাসিয়া ফেলিয়া বলিলাম, মার খাওয়ার অত শখ কেন?
তুমি আমাকে মারলে আমি খুশি হই। মেরে ফেললে আরো খুশি।
এ কাজ আর কোরো না। বাড়ি যাও।
কিশোরী সপাটে আমার মুখের উপর বলিল, রোজ করব। রোজ আসব। রোজ দেখা
আমার বিস্ময়ের ঘোর আর কাটিতে চায় না। এই মেয়েটি কি উন্মাদ হইয়া গিয়াছে? সামান্য গরীব ঘরের মেয়ে, ইহার তো অত তেজ থাকিবার কথা নহে।
মনুষ্যচরিত্র আমি কোনোকালেই তেমন অনুধাবন করি নাই। আমার কাজে বেশীর ভাগ মানুষের অস্তিত্বই গৌণ। তাহারা কখন, কেন কিরূপ আচরণ করে তাহা লইয়া আমি বিশেষ মাথা ঘামাই না। কিন্তু এই কিশোরী আমাকে ভাবাইয়া তুলিল। আমি ইহার মধ্যে স্বাভাবিকতার অভাব লক্ষ করিতেছিলাম, কিন্তু কারণটি অনুমান করিবার সাধ্য ছিল না।
তবে তাহার বাবাকে আমি পরদিন জিজ্ঞাসা করিলাম, আপনার কন্যাটির মধ্যে কোনো অস্বাভাবিক মানসিকতা আছে কি?
আজ্ঞা না তো!
সে কি খুব তেজী স্বভাবের মেয়ে?
তাও নয়। বরং স্বভাব নম্রই। কেন বলুন তো?
আমি তাকে হঠাৎ লক্ষ্য করলাম। সে একটু অদ্ভুত আচরণ করছে। তার প্রতি একটু লক্ষ রাখবেন।
বিবাহযোগ্যা কন্যার দায়গ্রস্ত পিতা ভয় পাইয়া বলিলেন, আজ্ঞে নিশ্চয়ই রাখব। তবে আমি দুবেলা গায়ত্রী জপ করি, অখাদ্য কুখাদ্য খাই না, নিত্য পূজা-পাঠ আমার বৃত্তি। আমার বংশে কেউ পাগল হবে এটা অস্বাভাবিক ব্যাপার।
আমি একটু হাসিলাম। বলিলাম, তবু লক্ষ রাখবেন।
আচ্ছা। বলিয়া তিনি চলিয়া গেলেন।
কয়েকদিন পর আমার ভাই আসিয়া আমাকে এক অদ্ভুত ঘটনার কথা বলিল।
তাহা সবিস্তারে লিখিতে চাই না। এইসব পারিবারিক ঘটনার লিখিত বিবৃতি থাকা ভাল নয়।
তবে নলিনী যাহা বলিল তাহা আমাকে চমকাইয়া দিল।
আমি বলিলাম, এই মেয়েটির একটি স্বাভাবিক আচরণ আমিও লক্ষ করেছি।
কী রকম?
মেয়েটি সেদিন আমাদের শোওয়ার ঘরে উকি মারতে গিয়ে গাছ থেকে পড়ে যায়।
তারপর?
আমি তাকে শাসন করতে গিয়ে ফ্যাসাদে পড়ে যাই। সে উল্টে আমাকে শাসন করে দিল।
নলিনী সবিস্তারে কাহিনীটি আমার কাছে শুনিল। সে স্বদেশী করা মানুষ, প্রায় সাধু বৈরাগী। সংসারের কোনো মোহ তার নাই। কিন্তু তাই বলিয়া সে বাস্তব বোধ বর্জিত নয়। ধৈর্য ধরিয়া আমার অভিজ্ঞতার কথা শোনার পর সে বলিল, রোগটি আমি অনেক আগেই ধরেছিলাম।
কিসের রোগ?
দাদা, এ দেহের রোগ নয়। রোগটা মনের।
আমি সরল বিশ্বাসে বলিলাম, আমারও তাই বিশ্বাস। মেয়েটা পাগল।
নলিনী হাসিল। বলিল, পাগল বটে। তবে সে পাগলামি অন্যরকম।
কি রকম?
চিত্তদৌর্বল্যের পাগলামি।
সে আবার কি?
দাদা, এ মেয়েটিকে তুমি কখনো আঘাত কোরো না। এর মনে ব্যথা বা দাগা দিও না।
ওসব বলছিস কেন?
এ মেয়েটি তোমাকে তার জীবনের মধ্যে একটা অত্যন্ত বড় জায়গা দিয়েছে।
আমাকে! আমাকে!
নিজেকে তুমি যত তুচ্ছই ভাবো, কারো কারো কাছে তুমিই হয়তো দেবতার মতো মহান।