একান্ন
কাঁধ টনটন করছে, ছুরিটা যদিও বেশী ঢোকেনি কিন্তু রক্ত বেরিয়েছে অনেকটা। ইনজেকশন এবং ওষুধের দৌলতে তাকে আর হাসপাতালে যেতে হবে না ধরে নিয়েছে অর্ক। তখন রক্ত দেখে ডাক্তারবাবু হাসপাতালের কথা বললেও অর্কর মনে হয়েছে ক্ষতটা তেমন মারাত্মক নয়। যদিও ব্যথা আছে, জায়গাটা আড়ষ্ট হয়ে আছে কিন্তু নিজের অসুবিধে তো বোঝা যায়।
আজ ঈশ্বরপুকুর উত্তাল। কয়েক’শ মানুষ পুলিসের ভ্যান ঘেরাও করে রেখেছিল। সমাজবিরোধীদের এলাকা থেকে দূর করতেই হবে। পুলিসকে কথা দিতে হবে যাতে তারা সমাজবিরোধীদের মদত না দেয়। ছোট অফিসারদের কথায় কাজ হয়নি, লালবাজার থেকে বড় অফিসাররা এসে সেইরকম প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাওয়ার পর ওই অধমৃত ছেলেটিকে ওদের হাতে তুলে দেওয়া হল। এর মধ্যে একটা শান্তি কমিটি ঠিক হয়ে গেছে। যারাই সমাজবিরোধীদের বিরুদ্ধে তারাই শান্তি কমিটির সদস্য। এলাকার শিক্ষিত বিশিষ্ট ভদ্রজন যাঁরা এতকাল গোলমাল হলেই জানলা বন্ধ করে দিতেন তাঁরাও নেমে এসেছেন পথে।
পুলিস চলে যাওয়ার পর একটা বিরাট দল নিয়ে গেল অর্ককে থানায়। ডায়েরি করতে হবে। প্রকাশ্যে হত্যার ষড়যন্ত্র। আজকে থানার চেহারা অন্যরকম। এত মানুষকে দেখে অফিসারদের সেই গা-ছাড়া ঔদাসীন্য নেই। অভিযোগে লেখা হল, সম্প্রতি ঈশ্বরপুকুর এলাকায় সমাজবিরোধীদের কাজকর্ম বেড়ে গিয়েছিল। কয়লা ওই এলাকায় সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল এক শ্রেণীর পুলিসের সাহায্যে। গতরাত্রে কয়লা দলবল নিয়ে ঈশ্বরপুকুরে হামলা করে। তার প্রতিবাদ করায় কয়লার অনুচররা অর্ককে ছুরি মেরেছে। এই আঘাত প্রাণহানি ঘটাতে পারত।
থানার অফিসার একটু ইতস্তুত করেছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল অভিযোগ লিপিবদ্ধ করতে কোন আপত্তি নেই, শুধু পুলিসের কথা উল্লেখ না করলেই হয়। কিন্তু সুবলরা কিছুতেই অন্য কথা বলতে না চাওয়ায় ওইভাবেই ডায়েরি করা হল।
অর্কর শরীর ভাল লাগছিল না। কাঁধের ব্যথা এবং ক্লান্তি তার খিদেটাকেও চাপা দিয়েছিল। এবং আশ্চর্য, একটি ছুরির আঘাত তাকে রাতারাতি নায়ক তৈরি করে ফেলেছে যেটা তার পছন্দ হচ্ছে না। সে একটু বিশ্রাম চাইছিল। থানা থেকে বেরিয়ে অর্ক সোজা ঈশ্বরপুকুরে চলে এল।
কিন্তু ব্যাপারটা ওখানেই থেমে থাকল না। ঈশ্বরপুকুরের মানুষের সঙ্গে বেলগাছিয়ার সাধারণ মানুষ মিলিত হয়ে গেল। তারপর সেই ক্ষুব্ধ মিছিল গিয়ে আছড়ে পড়ল পাশের পল্লীতে। কয়লার দোতলা বাড়িটি মুহূর্তেই লুণ্ঠিত হয়ে গেল। এতদিনের আক্রোশ মিটিয়ে নেওয়ার সুযোগ পেয়ে জনতা পাগল হয়ে গেল। কয়লার স্ত্রী এবং বাবা মাকে করুণা করে বলা হল অবিলম্বে পাড়া ছেড়ে যেতে। তারপর জনতা খুঁজতে লাগল কয়লার চামচেদের। যারা এতকাল ওয়াগন লুঠ করার সঙ্গী ছিল, যারা তোলা তুলত কয়লার হয়ে, ছুরি এবং বোমার ভয়ে যাদের বিরুদ্ধে কেউ টুঁ শব্দ করার সাহস করত না এখন তাদের খুঁজে বের করার জন্যে সবাই মরিয়া হয়ে গেল। ঘন্টা দেড়েকের মধ্যে ঈশ্বরপুকুর এবং তার আশে পাশের এলাকা থেকে সমাজবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত মানুষগুলো হয় পালিয়ে গেল দত্তবাগান কিংবা শ্যামবাজার এলাকায়।
অর্ক এসব জানতো না। ঘন্টা দেড়েক নিঃঝুম পড়ে থেকে মনে হল মাথাটা পরিষ্কার হয়েছে। ঘরটা এখন নোংরা, অগোছালো। অর্ক চারপাশে তাকাল। একটুও ইচ্ছে করছে না উঠে পরিষ্কার করতে। আর তখনই খিদেটা ফিরে এল। এখন দুপুর শেষ হতে চলেছে। ঘরে কোন খাবার আছে বলে মনে পড়ছে না। মুখে একটা বিশ্রী তেতো স্বাদ।
অসহায় চোখে অর্ক তাকাচ্ছিল কিন্তু যেন কিছুই তার চোখে পড়ছিল না। কোথা থেকে কি হয়ে গেল। আজ যদি মায়ের অপারেশন হয় তাহলে তার অনেক কাজ বেড়ে যাবে। কিন্তু ঘাড় যেমন টনটন করছে সে যে কিছু করতে পারবে এমন মনে হয় না। তাছাড়া এই ব্যাণ্ডেজ নিয়ে মায়ের সামনে যাওয়াও যাবে না। যতই শাটের নিচে চাপা থাক মা ঠিক বুঝতে পারবে। যে রক্ত শরীর থেকে বেরিয়ে গেল সেটা মায়ের জন্যে রাখতে পারল না সে। অর্কর শরীরে কাঁপুনি এল। নিজেকে ছিন্নভিন্ন নিঃস্ব মনে হচ্ছে।
রান্নার বাসন যেখানে চাপা দেওয়া থাকে সেখানে উঠে এল অর্ক। ওগুলো এখনও নোংরা, ধোয়া হয়নি সময়মত। কৌটোগুলো খুলতে খুলতে অর্কর মুখে হাসি ফুটল। নিমকিগুলো একটু কালচে হয়ে গেছে। কবে কখন মা করে রেখেছিল জলখাবারের জন্যে। একটু গন্ধ হয়ে গেছে, ঠাণ্ডা তেলের চিমসে গন্ধ, কিন্তু অর্ক তৃপ্তির সঙ্গে খেতে গিয়ে আবিষ্কার করল এতে খিদেটা বেড়ে যাচ্ছে। ঘরে চাল আছে, স্টোভে তেলও আছে। এক হাতে বালতিটা ঝুলিয়ে বেরিয়ে আসতেই সে অনুপমাকে দেখতে পেল। ওদের ঘরের দরজায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে। ওকে দেখতে পেয়ে অনুপমা জিজ্ঞাসা করল, ‘কেমন আছ?’
অর্ক বলল, ‘ঠিক আছি।’
‘বালতি নিয়ে কি করবে?’
‘জল আনবো।’
‘দাও, আমাকে দাও। আমি এনে দিচ্ছি।’
‘কেন? আমিই পারব।’
‘থাক। আর একটু হলেই তো প্রাণ যেত। দেখি বালতিটা।’ প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে চলে গেল অনুপমা। অর্ক আকাশের দিকে তাকাল। তামাটে আকাশে দুটো চিল পাক খাচ্ছে। রোদের তেজ নরম হতে চলেছে। কটা বাজল কে জানে। নিমকি খাওয়ার পর মুখটা আরও বিশ্রী লাগছে। যে কাঁধে ছুরি লেগেছিল সেদিকটা সামান্য নাড়াতে চেষ্টা করল। না তেমন লাগছে না। লাগলে ভাল হত। একটা কষ্ট অনেকসময় আর একটা কষ্টকে ঢেকে দেয়। ব্যথাটা বাড়লে খিদেটা থাকতো না। অনুপমা জল নিয়ে ফিরে এসে জিজ্ঞাসা করল, ‘কি হবে জল নিয়ে?’
‘কিছু না। এমনি।’
‘খেয়েছ?’
অর্ক মাথা নাড়ল এমনভাবে যাতে দুইই বোঝায়। তারপর জলটা নিয়ে ঘরে ঢুকতে অনুপমা ফিরে গেল। স্টোভ জ্বেলে ভাত চাপিয়ে দিল অর্ক। ঘরে আর কিছুই নেই, সামান্য আলুও চোখে পড়ল না। স্টোভের শব্দ একধরনের তৃপ্তি এনে দিল মুহূর্তেই। কিছু একটা হচ্ছে এই ঘরে এই রকম বোধ এল ওই শব্দ থেকে।
আজ স্নান করা যাবে না। অথচ স্নান জরুরী ছিল। বিশ্রী গন্ধ বের হচ্ছে শরীর থেকে। কাঁধের ব্যাণ্ডেজে জল লাগলে ক্ষতি হবে। কিন্তু ওটাকে বাঁচিয়ে যদি কিছু করা যায়। অর্ক জামা কাপড় ছাড়ল। তারপর কোনরকমে কলতলা থেকে পরিষ্কার হয়ে এল। হাতে পায়ে এবং মাথায় সামান্য জল দিলে যে পবিত্র আরাম হয় তা যেন এমন করে কোনদিন টের পায় নি অর্ক।
পরিষ্কার জামাকাপড় পরে সে চেয়ারটায় বসল। এবং তখনই তার মনে হল আবার, পৃথিবীতে সে একা। এখন থেকে যা করবার তা তাকে একা একা করতে হবে। মা যাই বলুক পড়াশুনা করে সে কোনকালে চাকরি পাবে না। অথচ মাকে দেওয়া কথা রাখতে তাকে পরীক্ষা দিতে হবে। কিন্তু এভাবে যদি একটার পর একটা ঘটনায় সে জড়িয়ে পড়ে তাহলে পড়াশুনা করবে কখন। অপারেশনের পর তো মা অনেক দিন অসুস্থ হয়ে থাকবে। তখন তাদের চলবে কি করে। সে এই কদিনে অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। আচমকা কেউ যেন তাকে টেনে বড় করে দিয়ে গেল। অতএব এখন থেকে তাকেই দায়িত্ব নিতে হবে যে। কিভাবে দায়িত্ব নেওয়া যায় তা সে জানে না। কিন্তু নিতে হবে এটা তো পরিষ্কার।
ঘরের বাতাস এখন পাল্টে গিয়েছে। চমৎকার ভেতো গন্ধ বের হচ্ছে সসপ্যান থেকে। ঢাকনাটা নড়ছে। ঠিক তখনই একটা চাপা গলায় নিজের নাম শুনতে পেল সে, ‘অক্ক!’
গলাটা চিনতে অসুবিধে হল না। সে ‘আয়’ বলতেই দরজা ঠেলে কোয়া যেন ছিটকে ঢুকে পড়ল। তার পেছনে বিলু। ঘরে ঢুকেই ওরা দরজা বন্ধ করে দিল।
অর্ক ওঠার সুযোগ পেল না, তার আগে কোয়া প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর পায়ের ওপর, ‘গুরু আমাকে বাঁচাও। আমি সারা জিন্দেগী তোমার গোলাম হয়ে থাকব। গুরু, আমি কোন দোষ করিনি।’
অর্ক পা সরাবার চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। সে অস্বস্তিতে চিৎকার করল, ‘কি হচ্ছে, পা ছাড়।’
‘না গুরু, তুমি কথা দাও, ওরা আমাদের পেলে মেরে ফেলবে।’ ককিয়ে উঠল কোয়া। অর্ক দেখল ওর মুখে মৃত্যুভয় স্পষ্ট। কিন্তু বিলু কোন কথা বলছে না। ঠোঁট কামড়ে দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
‘কারা মারবে?’
‘পাড়ার লোক আমাদের খুঁজছে আবার কয়লার পার্টিও পেলে শেষ করে দেবে।’
‘পাড়ার লোক তোদের খুঁজছে কেন?’
‘আমাদের সমাজবিরোধীদের লিস্টে ঢুকিয়ে দিয়েছে। গুরু, তুমি বাঁচাও।’
‘পা ছাড়।’
কোয়া এবার সরে বসল। ওকে খুব ভীতু প্রাণীর মত মনে হচ্ছিল। অর্ক ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কাল থেকে কোথায় ছিলি?’
‘গঙ্গার ধারে। আজকে সেখানে কয়লার ছেলেরা শেল্টার নিয়েছে তাই পালাতে হল। আমি মাইরি কসম খাচ্ছি, আর কখনও মাস্তানি করব না। আমি এই পাড়ায় ভদ্দলোকের মত থাকব। তুমি ওদের বলে দাও নাম কেটে দিতে।’
কোয়া আবার ককিয়ে উঠল।
প্রথমে অর্ক ব্যাপারটা বুঝতে পারছিল না। কয়লাকে ভয় পাওয়ার কারণ থাকতে পারে কিন্তু পাড়ার লোকদের কোয়া এত ভয় পাচ্ছে কেন? পাড়ার লোকদের অভিযোগ কোয়ার বিরুদ্ধে। তাকে ছুরি মারার জন্যে কয়লার ছেলেরা দায়ী। কোয়া তো কখনই কয়লার চেলা হিসেবে পরিচিত নয়। কিন্তু কোয়া যা বলল তাতে চমৎকৃত হল অর্ক। প্রথমে আক্রোশটা ছিল কয়লা এবং তার ছেলেদের ওপর। তাদের সবাইকে পাড়া ছাড়া করার পর ওরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে পাড়ায় যারা মাস্তানি করত তাদেরও তাড়ানো হবে। যদি যেতে না চায় তাহলে গণধোলাই-এর ব্যবস্থা। সেই লিস্টে কোয়ার নাম আছে।
অর্ক চুপচাপ শুনল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, ‘কাল রাত্রে একজন পুলিস অফিসার তোকে খুঁজছিল কেন?’
‘আমাকে খুঁজছিল? কে? দত্ত সাহেব?’
‘নাম জানি না। মোক্ষবুড়িকে মারার পর তোর নাম উঠল কেন?’
‘আমি জানি না গুরু। তুমি বিশ্বাস করো, একজন দত্তসাহেব আমার কাছে হিস্যা চেয়েছিল। সে শালার আমার ওপর খার আছে। কিন্তু আমি কোন বড় গোলমাল করিনি। তুমি তো আমাকে জানো, আমি তো খুরকি কিলার মত কাউকে জবাই করিনি। বল, করেছি?’
অর্ক কি করবে বুঝতে পারছিল না। সে অন্যমনস্ক গলায় বলল, ‘কিন্তু আমার কথা ওরা শুনতে চাইবে কেন?’
কোয়া যেন আঁতকে উঠল, ‘কি যে বল গুরু! তোমার কথা শুনবে না? তুমিই তো সব। তোমাকে ওরা সেক্রেটারি করেছে।’
‘সেক্রেটারি? কিসের?’
‘শান্তিকমিটির। মাইরি গুরু, কি করে সবাই এক কাট্টা হয়ে গেল কে জানে!’
‘শান্তি কমিটি?’ অর্ক হোঁচট খেল। এর মধ্যে কখন শান্তি কমিটি গঠিত হল আর তাকে সম্পাদক করা হল তা সে নিজেই জানে না। নিশ্চয়ই সুবল নেতৃত্ব নিচ্ছে। সতীশদা কখনই সামনে আসবে না এরকম কথা একবার হয়েছিল। সতীশদা নেতৃত্বে থাকলেই আন্দোলনে রাজনীতির ছায়া পড়বে। এলাকার মানুষ কোন পার্টি! ফেস্টুন ছাড়াই ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। এইটে সচরাচর হয় না। আজ অবধি কোন কারণে এরকম হয়েছে কি না অর্ক জানে না। জ্ঞান হবার পর থেকে তো কখনই দ্যাখেনি কংগ্রেস এবং সি পি এমের সমর্থকরা একসঙ্গে কাজ করছে। সেটা যখন হয়েছে তখন এলাকার পক্ষে মঙ্গলজনক বলতেই হবে। কিন্তু রাজনীতি নেই বলে সতীশদাদের বাদ দিয়েও হতে পারে না।
এই সময় সসপ্যানের ঢাকনাটা খানিকটা সরে গেল আর সোঁ করে বাষ্প ছিটকে উঠল। অর্ক এগিয়ে গিয়ে সেটাকে স্টোভ থেকে নামিয়ে দেখল জল প্রায় মরে এসেছে। এখন ফ্যান গালা প্রায় অসম্ভব। ওর মনে হল, এতে ভালই হয়েছে। শুধু ভাত খাওয়ার চেয়ে এই গলা ভাত তবু সহজে পেটে পাঠানো যেতে পারে। ঢাকনাটা নামিয়ে স্টোভ নিবিয়ে অর্ক মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোরা খেয়েছিস?’
কোয়া মাথা নাড়ল, ‘না গুরু, তুমি খাও।’
‘খেয়েছিস কিনা বল। ভাত বেশী আছে।’
‘তাহলে একটু দাও। কাল রাত থেকে কিছু খাইনি।’
‘কিন্তু শুধু ভাত, তরকারি টরকারি নেই।’
কোয়া হাসল, ‘গরম ভাত পাচ্ছি তাই বাপের ভাগ্যি আবার তরকারি।’
অর্ক থালার দিকে হাত বাড়াতেই বিলু বলল, ‘আমি খাব না।’
ঘরে ঢোকার পর বিলু এই প্রথম কথা বলল। অর্কও এতক্ষণ ইচ্ছে করেই বিলুর দিকে তাকাচ্ছিল না। সেই থেকে দরজায় হেলান দিয়ে রয়েছে।
অর্ক স্বাভাবিক গলায় বলতে চাইল, ‘কেন?’
‘আমার খিদে নেই।’
‘মিথ্যে কথা গুরু, ও সকাল থেকে আমার সঙ্গে ঘুরছে।’ কোয়া বলে উঠল।
অর্ক দেখল সসপ্যান থেকে বেশ ধোঁয়া উঠছে। এই অবস্থায় খাওয়া সম্ভব নয়। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘তোর সঙ্গে কয়লার কি সম্পর্ক?’
বিলুর চোখ ছোট হল, ‘সম্পর্ক আছে তা কে বলল?’
‘কয়লার ছেলেরা, কয়লা বলে গেছে।’
‘এমন কিছু না, চিনতাম।’
‘কোনদিন আমাকে বলিসনি তো।’
‘বলার প্রয়োজন মনে করিনি।’
‘আজ আমার কাছে এসেছিস কেন?’
‘আমি আসতে চাইনি, কোয়া জোর করে নিয়ে এসেছে।’
অর্ক ঠোঁট কামড়ালো, ‘তুই পাড়ায় ফিরতে চাস না?’
‘চাইলেই পাড়ার লোক আমাকে ফিরতে দেবে?’
‘কেন দেবে না?’
‘আমার সঙ্গে কয়লার সম্পর্ক ছিল।’
বিলু এত স্পষ্ট এবং সরাসরি কথা বলছে যে অর্ক অবাক হচ্ছিল। এই সময় যে কেউ কয়লার সঙ্গে সম্পর্ক অস্বীকার করবে কিন্তু বিলু সেটা করছে না। গতকাল বিকেলে শ্যামবাজারের পাঁচমাথার মোড়ে বিলুর হাবভাব এবং পালিয়ে যাওয়াটা এখন চোখের ওপর ভাসছে। বিলু কিছু অন্যায় করছিল সেটা তো তখনই মনে পড়েছিল।
অর্ক জিজ্ঞাসা করল, ‘কিন্তু তুই তো কয়লার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিস।’
ওটাকে বিশ্বাসঘাতকতা বলে না। আমি মন থেকে সায় দিতে পারিনি।’
‘কি সেটা?’
‘আমি বলতে পারব না। শোন, আমি কয়লার টানা মাল যারা কিনতো তাদের কাছে যেতাম ঠিক কত টাকা দিয়েছে সেটা জানবার জন্যে। তাতে যে বিক্রি করছে সে কয়লাকে ঢপ দিতে পারত না। এ ছাড়া কয়লার কিছু জিনিস আমি পাচার করেছি অন্য জায়গায়।’ বিলু একই রকম ভঙ্গীতে বলল।
অর্কর মনে পড়ল কাল রাত্রে বিলু সম্পর্কে ওদের অভিব্যক্তির কথা। সে বলল, ‘কয়লা তোকে পেলে ছিঁড়ে খাবে।’
‘আমি ভয় পাই না। জীবনে তো একবারই মরব।’
‘কিন্তু তুই এইসব জঘন্য কাজ করেছিস তোর লজ্জা করে না?’
‘লজ্জা? দ্যাখো গুরু, ওসব লজ্জা ফজ্জার কথা আমার কাছে বলো না। আমার বাড়িতে পাঁচটা খাওয়ার লোক। বাবা অসুস্থ, একটাও রোজগারের মানুষ নেই। সবাই আমার মুখ চেয়ে বসে আছে। আমার যা বিদ্যে কোন শালা আমাকে চাকরি দিতে পারে না। আমাকে ওদের বাঁচাতেই হবে। যে কোন নম্বরী কাজ করতে আমি তাই রাজি ছিলাম।’
‘তাহলে বিশ্বাসঘাতকতা করলি কেন?’
‘না আমি বিশ্বাসঘাতকতা করিনি। একটা মেয়েকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম শুধু।’
‘মেয়েকে বাঁচাতে চেয়েছিলি? কাকে?’
‘বলতে পারব না।’
‘বাঁচাবার কি দরকার ছিল?’
‘হয়তো ছিল না। আমি বাঁচালেও অন্য কেউ মারবে। তবু পারলাম না। তাই কয়লার খুব খার আমার ওপর। পালিয়ে গঙ্গার ধারে গিয়েছিলাম। ওখানে কোয়ার সঙ্গে দেখা হল। কোয়া বলল তোমার কাছে আসতে। আমি আসতে চাইনি, কিন্তু ও জোর করল। বলল এখানে এলে একটা ফয়সালা হবে।’
অর্ক বুঝতে পারছিল না কি ফয়সালা সে করতে পারে। বিলুকে সমাজবিরোধী হিসেবে এলাকায় কেউ জানে না। বিলু কোয়া কিলা খুরকির মত পাড়ায় কখনও মাস্তানি করেনি। তাছাড়া কয়লা কাল রাত্রে বিলুর বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে গিয়েছে। সেইটেই অবশ্য কাল হতে পারে। হয়তো এর মধ্যে কেউ কয়লার সঙ্গে বিলুর সম্পর্ক আবিষ্কার করে ফেলেছে। কিন্তু তা ছাড়া সে নিজে কি করে বিলুকে বাঁচাবে। কয়লাকে যে সাহায্য করেছে সে তো পরিষ্কার সমাজবিরোধী। না বিলুকে সাহায্য করার প্রশ্নই ওঠে না। অর্ক মুখে এসব কিছুই বলল না। তিনটে থালায় থকথকে ভাত ঢেলে বলল, ‘খেয়ে নে। এখানে নুন আছে।’
কোয়া যেন কথাটার জন্যেই অপেক্ষা করছিল। চট করে নিজেরটা তুলে বিলুর দিকে তৃতীয়টা এগিয়ে দিল। বিলু কিছুটা ইতস্তত করে থালাটা নিল। ভাত খুবই কম। তিনজনের পক্ষে অতিরিক্ত কম। কিন্তু খেতে গিয়ে অর্ক বুঝল নিমকি তার উপকার করেছে। এতক্ষণে খিদে বোধটুকুই মেরে ফেলেছে। অথচ গরম ভাতের যে মায়াময় গন্ধ সেটা চমৎকার লাগলো। এমন করে শুধু নুন দিয়ে চটচটে ভাত সে আগে কখনও খায়নি।
কোয়া বলল, ‘একটা ভাজা থাকলে দারুণ জমত।’
‘নিমকি আছে, খাবি?’
‘নিমকি? তাই দাও।’
অর্ক অবশিষ্ট নিমকিটা বের করে দিতেই কোয়া সেটাকে বেগুন ভাজার মত ভাতের সঙ্গে চটকে খেয়ে নিল। অর্ক দুজনের দিকে তাকাল। বিলুরও যে প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে সেটা বোঝা যাচ্ছে। এই বিলুকে কোয়া পছন্দ করত না। কোয়াকেও বিলু ঈর্ষা করত। অথচ দুজনে এখন পাশাপাশি ভাত খাচ্ছে, একই বিপদে পড়ে পালিয়ে এসেছে একসঙ্গে। এটা আগে ভাবা যেত না।
খাওয়াদাওয়া হয়ে গেলে অর্ক বিলুকে বলল, ‘আমি তোকে কোন সাহায্য করতে পারব না বিলু। তোর সঙ্গে কয়লার সম্পর্ক ছিল, তুই থানায় যা।’
‘থানায়?’ বিলু হাসল, ‘এখনও পুলিস আমার সম্পর্কে জানে না। যেচে গলা বাড়িয়ে দেওয়ার পার্টি আমি নই।’
‘তাহলে তোর যা ইচ্ছে তুই কর।’
বিলু পকেটে হাত দিল। তারপর পাঁচটা একশ টাকার নোট বের করে অর্কর সামনে ধরল, ‘এগুলো আমার মাকে দিয়ে দিতে পারবে?’
‘তুই নিজেই দে না।’
‘আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়।’
‘এখানে এলি কি করে তোরা?’
‘পেছনের বস্তি দিয়ে।’ টাকাগুলো হাতে নিয়ে বিলু একটু ভাবল। তারপর দরজার দিকে এগোতে অর্ক তাকে ডাকল, ‘বিলু।’
বিলু মুখ ফেরাতেই অর্ক ইতস্তত করে বলল, ‘আমি যদি পাড়ার লোকদের বলে রাজি করাই তাহলে তুই ওসব দু নম্বরী কাজ ছেড়ে দিবি?’
বিলু হাসল, ‘বলতে পারছি না। সত্যি কথা বলছি গুরু, আমাকে বাঁচতে হবে। আজ যারা তোমাদের সঙ্গে মাথা বাঁচাবার জন্যে আছে তাদের অনেকেই কাল আবার লাইনে ফিরে যাবে। মিথ্যে কথা বলে কি লাভ?’
‘ঠিক আছে। কিন্তু সবাই যে একটা ভাল কাজের জন্যে একসঙ্গে হয়েছে এটা কম কথা নয়। তুই কয়লার সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখবি না, এলাকার মানুষের ক্ষতি হোক এমন কাজ করবি না, এই কথা দিতে হবে।’
‘আমি এখনও কোন মানুষের ক্ষতি করিনি। আর কয়লা তো পেলে আমাকে ছিঁড়ে খাবে, সম্পর্ক রাখার কোন কথাই ওঠে না।’ বিলু মাথা নাড়ল।
এইসময় বাইরে অনেক লোকের গলা পাওয়া গেল। অর্ক দেখল কোয়ার মুখ শুকিয়ে গেছে, বিলুও খুব ভয় পেয়েছে। কেউ একজন ডাকল, ‘অর্ক।’
অর্ক চাপা গলায় বলল, ‘তোরা খাটে উঠে বস।’ তারপর বিলুর পাশ দিয়ে এগিয়ে দরজা খুলতেই দেখল সুবল এবং আরও কয়েকজন বিশিষ্ট ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছে। সুবল জিজ্ঞাসা করল, ‘কেমন আছ?’
অর্ক বলল, ‘ভালই, মনে হচ্ছে আর কিছু হবে না।’
‘তবু একবার হাসপাতালে গিয়ে দেখানো উচিত ছিল।’
‘আমি তো বিকেলে হাসপাতালে যাবই, তখন নাহয় দেখাবো।’
‘হ্যাঁ, শুনলাম তোমার মা অসুস্থ। অপারেশন হবে?’
‘হ্যাঁ।
‘তুমি আজ সন্ধ্যেবেলায় আসতে পারবে?’
‘কেন?’
‘আমরা একটা শান্তি কমিটি তৈরি করেছি। তোমাকে এবং আমাকে যুগ্ম সম্পাদক করা হয়েছে।
তুমি অল্পবয়সীদের দেখবে আমি বয়স্কদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখব। এলাকার সমস্ত মানুষ আজ এগিয়ে এসেছে। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস পুলিসের একটা অংশ এখনও সমাজবিরোধীদের সাহায্য করছে। আমরা সমাজবিরোধীদের একটা লিস্ট করছি। ঠিক কি কি করতে চাই সে ব্যাপারে আজ আলোচনা হবে।’ সুবল জানালো।
অর্ক বলল, ‘ঠিক আছে, যদি হাসপাতালে আমি না আটকে যাই তবে চলে আসব।’
ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন বলল, ‘কিন্তু একা একা পাড়ার বাইরে যাওয়া ঠিক হবে না। ওরা বদলা নিতে পারে।’
অর্ক হাসল, ‘কিন্তু আমাকে তো যেতেই হবে।’
সুবল বলল, ‘তা হলে আমরা কয়েকজন তোমার সঙ্গে যাব।’
অর্ক মাথা নাড়ল, ‘সেটা একবার হতে পারে কিন্তু রোজ তো সম্ভব নয়। তাছাড়া ওরা বদলা নিতে পারে এই ভয়ে পাড়ায় সবাই কদিন বসে থাকতে পারবে? এতে তো ওদেরও জোর বেড়ে যাবে। ওরা ভয় পেয়েছে কিন্তু আমরা ভয় পাব কেন?’
আরও কিছুক্ষণ কথার পর সুবলরা যখন ফিরে যাচ্ছে তখন অর্ক বলল, ‘আর একটা কথা। একসময় যারা পাড়ায় মাস্তানি করেছে কিংবা কোন অন্যায় কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল তাদের সম্পর্কে কঠোর হওয়ার আগে চিন্তা করা দরকার তারা কতটা খারাপ, আর ভাল হতে পারে কিনা!’
‘মানে?’ সুবল অবাক হল।
‘কেউ কেউ তো পাল্টেও যেতে পারে।’
‘সে দায়িত্ব কে নেবে?’
‘আমি যাদের নাম বলব তাদের দায়িত্ব আমার।’
সুবল একটু ভাবল, ‘ঠিক আছে, সন্ধ্যেবেলায় এসো, লিস্ট ফাইন্যাল করার সময় আমরা আলোচনা করব। তবে কোন ঝুঁকি নেওয়া উচিত হবে না।’
ওরা চলে যাওয়ার পর ঘরে ঢুকতেই দেখল কোয়া একটা ছুরি টেবিলের ওপর রেখে দিল। বিলু জিজ্ঞাসা করল, ‘মাসীমার কি হয়েছে?’
‘আলসার। তোরা এখানে থাকতে পারিস ইচ্ছে করলে। আমাকে এখনই হাসপাতালে যেতে হবে। বলা যায় না আজ বিকেলেই হয়তো অপারেশন হবে।’
বিলু বলল, ‘চলো আমরাও যাচ্ছি তোমার সঙ্গে।’
‘তোরা যাবি মানে?’
‘এখানে পাথরের মত বসে না থেকে ওখানে গেলে কোন কাজে লাগতে পারি। শালা, আমরা অবশ্য কোন কাজেই আসব না। মা ঠিকই বলতো, দুনিয়ার আবর্জনা। কিন্তু শরীরে এখনও রক্ত আছে। সেইটে তো দিতে পারি। শুনেছি অপারেশনে রক্ত লাগে। কিন্তু, মাসীমার শরীরে আমাদের রক্ত গেলে কাজ হবে?’ বিলু অর্কর মুখের দিকে তাকাল।