তৃতীয় পরিচ্ছেদ
শ্রীরামকৃষ্ণ ও গৃহস্থের মঙ্গলকামনা — রজোগুণের চিহ্ন
এ পর্যন্ত গৃহস্বামী ঠাকুরের মিষ্ট মুখ করাইবার কোনও চেষ্টা করেন নাই। ঠাকুর স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া গৃহস্বামীকে বলিতেছেন —
“কিছু খেতে হয়। যদুর মাকে তাই সেদিন বললুম — ‘ওগো কিছু (খেতে) দাও’! তা না হলে পাছে গৃহস্থের অমঙ্গল হয়!”
গৃহস্বামী কিছু মিষ্টান্ন আনাইয়া দিলেন। ঠাকুর খাইতেছেন। নন্দ বসু ও অন্যান্য সকলে ঠাকুরের দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া আছেন। দেখিতেছেন তিনি কি কি করেন।
ঠাকুর হাত ধুইবেন, চাদরের উপর রেকাবি করিয়া মিষ্টান্ন দেওয়া হইয়াছিল, সেখানে হাত ধোয়া হইবে না। হাত ধুইবার জন্য একজন ভৃত্য পিকদানি আনিয়া উপস্থিত হইল।
পিকদানি রজোগুণের চিহ্ন। ঠাকুর দেখিয়া বলিয়া উঠিলেন, “নিয়ে যাও, নিয়ে যাও।” গৃহস্বামী বলিতেছেন, “হাত ধুন।”
ঠাকুর অন্যমনস্ক। বলিলেন, “কি? — হাত ধোবো?
ঠাকুর দক্ষিণে বারান্দার দিকে উঠিয়া গেলেন। মণিকে আজ্ঞা করিলেন, “আমার হাতে জল দাও।” মণি ভৃঙ্গার হইতে জল ঢালিয়া দিলেন। ঠাকুর নিজের কাপড়ে হাত পুঁছিয়া আবার বসিবার স্থানে ফিরিয়া আসিলেন। ভদ্রলোকদের জন্য রেকাবি করিয়া পান আনা হইয়াছিল। সেই রেকাবির পান ঠাকুরের কাছে লইয়া যাওয়া হইল, তিনি সে পান গ্রহণ করিলেন না।
[ইষ্টদেবতাকে নিবেদন — জ্ঞানভক্তি ও শুদ্ধাভক্তি ]
নন্দ বসু (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি) — একটা কথা বলব?
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — কি?
নন্দ বসু — পান খেলেন না কেন? সব ঠিক হল, ওইটি অন্যায় হয়েছে!
শ্রীরামকৃষ্ণ — ঈষ্টকে দিয়ে খাই; — ওই একটা ভাব আছে।
নন্দ বসু — ও তো ইষ্টতেই পড়ত।
শ্রীরামকৃষ্ণ — জ্ঞানপথ একটা আছে; আর ভক্তিপথ একটা আছে। জ্ঞানীর মতে সব জিনিসই ব্রহ্মজ্ঞান করে লওয়া যায়! ভক্তিপথে একটু ভেদবুদ্ধি হয়।
নন্দ — ওটা দোষ হয়েছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — ও আমার একটা ভাব আছে। তুমি যা বলছ ও ঠিক বটে — ও-ও আছে।
ঠাকুর গৃহস্বামীকে মোসাহেব হইতে সাবধান করিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — আর একটা সাবধান! মোসাহেবরা স্বার্থের জন্য বেড়ায়। (প্রসন্নের পিতাকে) আপনার কি এখানে থাকা হয়?
প্রসন্নের পিতা — আজ্ঞে না, এই পাড়াতেই থাকা হয়। তামাক ইচ্ছা করুন।
নন্দ বসুর বাড়িটি খুব বড় তাই ঠাকুর বলিতেছেন — যদুর বাড়ি এত বড় নয়; তাই তাকে সেদিন বললাম।
নন্দ — হাঁ, তিনি জোড়াসাঁকোতে নূতন বাড়ি করেছেন।
ঠাকুর নন্দ বসুকে উৎসাহ দিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (নন্দ বসুর প্রতি) — তুমি সংসারে থেকে ঈশ্বরের প্রতি মন রেখেছ, এ কি কম কথা? যে সংসারত্যাগী সে তো ঈশ্বরকে ডাকবেই। তাতে বাহাদুরি কি? সংসারে থেকে যে ডাকে, সেই ধন্য! সে ব্যক্তি বিশ মন পাথর সরিয়ে তবে দেখে।
“একটা ভাব আশ্রয় করে তাঁকে ডাকতে হয়। হনুমানের জ্ঞানক্তি, নারদের শুদ্ধাভক্তি।
“রাম জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হনুমান! তুমি আমাকে কি ভাবে অর্চনা কর?’ হনুমান বললেন, ‘কখনও দেখি, তুমি পূর্ণ আমি অংশ; কখনও দেখি তুমি প্রভু আমি দাস; আর রাম যখন তত্ত্বজ্ঞান হয়, তখন দেখি, তুমিই আমি — আমিই তুমি।’ —
“রাম নারদকে বললেন, ‘তুমি বর লও।’ নারদ বললেন, ‘রাম! এই বর দাও, যেন তোমার পাদপদ্মে শুদ্ধাভক্তি হয়, আর যেন তোমার ভুবনমোহিনী মায়ায় মুগ্ধ না হই!”
এইবার ঠাকুর গাত্রোত্থান করিবেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (নন্দ বসুর প্রতি) — গীতার মত — অনেকে যাকে গণে মানে, তাতে ঈশ্বরের বিশেষ শক্তি অছে। তোমাতে ঈশ্বরের শক্তি আছে।
নন্দ বসু — শক্তি সকল মানুষেরই সমান।
শ্রীরামকৃষ্ণ (বিরক্ত হইয়া) — ওই এক তোমাদের কথা; — সকল লোকের শক্তি কি সমান হতে পারে? বিভুরূপে তিনি সর্বভূতে এক হয়ে আছেন বটে, কিন্তু শক্তিবিশেষ!
“বিদ্যাসাগরও ওই কথা বলছিল, — ‘তিনি কি কারুকে বেশি শক্তি কারুকে কম শক্তি দিয়েছেন?’ তখন আমি বললাম — যদি শক্তি ভিন্ন না হয়, তাহলে তোমাকে আমরা কেন দেখতে এসেছি? তোমার মাথায় কি দুটো শিং বেরিয়েছে?”
ঠাকুর গাত্রোত্থান করিলেন। ভক্তেরাও সঙ্গে সঙ্গে উঠিলেন। পশুপতি সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যুদগমন করিয়া দ্বারদেশে পৌঁছাইয়া দিলেন।