অধ্যায় ৫০
হোমিসাইডের মহাপরিচালক ফারুক আহমেদ কখনও এতো রাত পর্যন্ত অফিস করে নি। তবে আজকের দিনটা অন্য সব দিনের মতো নয়। বিরাট সাফল্য বয়ে এনেছে তার ডিপার্টমেন্ট। আজ সকালেই যে খুনটা হয়েছে তার রহস্য উদঘাটন করে ফেলেছে সেহপ্রতীম জেফরি বেগ। তবে ঘটনা আরো বড়-এই খুনের আসল রহস্য ছিলো কিডন্যাপিং। এক ধনী পরিবারের একমাত্র সন্তানকে কিডন্যাপ করেছিলো কতিপয় দুষ্কৃতিকারী। এটা করতে গিয়েই ড্রাইভার লোকটাকে হত্যা করা হয়।
জেফরি শুধু দ্রুততার সাথে এসব রহস্য উন্মোচনই করে নি, ঐ বাচ্চাটাকেও অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করেছে। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে অন্য আরেকটি ঘটনা। ভয়ঙ্কর এক পেশাদার খুনিকে গ্রেফতার করেছে সে। কিডন্যাপিং দলের প্রায় সবাই গোলাগুলিতে নিহত হলেও এই খুনিকে জীবিতই ধরা সম্ভব হয়েছে। অনেক দিন ধরেই তাকে ধরার চেষ্টা করেছে তারা, সফল হয় নি। প্রচণ্ড ধূর্ত আর দক্ষ এই খুনি সব সময়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে।
গত বছর ব্ল্যাকরঞ্জুর হাতে মারাত্মক আহত হবার পর তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিলো কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কৃপায় জেল থেকে জামিন নিয়ে ছাড়া পেয়ে যায়। ব্যাপারটা জেফরি বেগ কোনোভাবেই মেনে নিতে পারে নি। এমন কি চাকরি ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্তও নিয়ে নিয়েছিলো সে। অনেক কষ্টে ফারুক আহমেদ তাকে ম্যানেজ করেছিলো সেবার।
আজ আবার সেই খুনি গ্রেফতার হয়েছে আর সেটা দ্বিতীয়বারের মতো করতে পেরেছে স্বয়ং জেফরি বেগ। আগের সেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও এখন নেই, তার জায়গায় নতুন একজন এসেছে। আশা করা যাচ্ছে, এবার আর অতীতের মতো কিছু হবে না। পেশাদার খুনিকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা যাবে।
এতো কিছু ঘটে গেছে মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে। আজ সকালে ড্রাইভার হত্যার ঘটনাটি বৃফ করেছিলো জেফরি। ব্যস, এটুকুই। তাকে আর কিছু জানানো হয় নি। সম্ভবত জেফরি নিজেও আশা করে নি ঘটনা এতো দ্রুত এগোবে। ব্যাপারটা ফারুক আহমেদ বোঝে। এসব যদি না-ই বুঝলো তাহলে কোন যোগ্যতায় এতোবড় একটি ডিপার্টমেন্টের প্রধান হয়েছে?
কিন্তু জেফরির অন্য একটি কর্মকাণ্ডে সে কিছুটা নাখোশ। এতো বড় সাফল্য অথচ মিডিয়া কিছুই জানে না! জানে না মানে জানানো হয় নি। আর এ কাজটা বরাবরের মতো করেছে জেফরি। মিডিয়ার ব্যাপারে ছেলেটার অ্যালার্জি আছে, এটা ফারুক সাহেব জানে। তবে আজকের ঘটনায় এটা মেনে নিতে তার কষ্ট হচ্ছে। এতো বড় একটি সাফল্য অথচ মিডিয়াতে তার স্থান নেই! ফ্ল্যাটের গ্রিল কেটে যারা ডাকাতি করে তাদেরকে গ্রেফতার করা হলেও সবগুলো চ্যানেল-পত্রপত্রিকায় ফলাও করে প্রচার করা হয়।
আরে বাবা, এই যুগে প্রচারণার দরকার রয়েছে। নিজেদের ভালো কাজের প্রচারণা করাতে অন্যায়ের কী আছে? তারা তো কোনো প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে না।
এমনিতেই পুলিশের হাজারটা বদনাম। চারিদিকে শুধু সমালোচনা আর সমালোচনা। ব্যর্থ, অযোগ্য, দুর্নীতিপরায়ন এসব অভিযোগে বিপর্যস্ত। যেনো এই বাহিনীটা ক্রিমিনালে ভরে গেছে। এখানে কোনো ভালো কাজই হয় না।
ফারুক সাহেব জানে তার চিফ ইনভেস্টিগেটরের কাছে এর যৌক্তিক ব্যাখ্যা রয়েছে। তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে এসব প্রচারণা আর পাবলিক রিলেশান্স নিয়ে সে ভাবে না, ভাবারও কথা নয় কিন্তু হোমিসাইডের ডিজি হিসেবে তাকে এরকম অনেক বিষয়েই নজর রাখতে হয়।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর আধুনিকায়নের উপরে একটি সেমিনারে অংশ নেবার জন্য ফারুক আহমেদ আজ বিকেলে অফিস থেকে চলে গেছিলো। সেমিনারটা শেষ করে এক নিকট আত্মীয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দেয় সস্ত্রীক। সেখানে থাকার সময়ই জেফরি তাকে ফোন করে সংক্ষেপে ঘটনাটি জানায়। গ্রেফতারকৃত ঐ খুনিকে এখন ইন্টেরোগেশন করা হচ্ছে। আজ রাতে কাজটা না করে কাল সকালেও করা যেতো কিন্তু আইনগত বাধ্যবাধকতা আছে-চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে আসামীকে আদালতে হাজির করতে হবে-যদিও পুলিশ বিভাগে এটা প্রায়শই মানা হয় না।
জেফরির কাছ থেকে সব শুনে ফারুক আহমেদ একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। স্ত্রীকে বাসায় ড্রপ করে দ্রুত পাঞ্জাবি পায়জামা বদলে প্যান্ট-শার্ট পরে চলে আসে হোমিসাইডে।
জেফরিকে রুমে ঢুকতে দেখে চওড়া একটা হাসি দিলো হোমিসাইডের মহাপরিচালক।
নিঃশব্দে সালাম ঠুকলো জেফরি বেগ।
“কগ্রাচুলেশন্স, মাই বয়,” হাত বাড়িয়ে দিলো ফারুক আহমেদ।
“থ্যাঙ্কস, স্যার,” বসের হাতটা ধরে বললো সে।
“বসো।”।
“আপনি এতো রাতে চলে এলেন?” বললো জেফরি।
“আরে কী যে বলো,” ফারুক সাহেবের হাসিটা আরো চওড়া হলো। “এতো বড় একটা সাকসেসফুল নাইট…আমি কী করে ঘরে বসে থাকতে পারি!”
যদিও জেফরির কাছে মনে হচ্ছে তার বস্ এ কারণে এই অসময়ে অফিসে আসে নি। তার অন্য কোনো এজেন্ডা আছে।
“কিছু স্বীকার করেছে?” হাসিহাসি মুখে জানতে চাইলো মহাপরিচালক।
করছে, স্যার,” ছোট্ট করে বললো জেফরি।
“করতেই হবে, না করে উপায় আছে।”
“স্যার কি আমাকে কিছু বলবেন?” জেফরি চাচ্ছে দ্রুত ইন্টেরোগেশন রুমে ফিরে যেতে। বাবলু নিজে থেকেই তার জীবনের সব ঘটনা বলে যাচ্ছে। জেফরিও আগ্রহী হয়ে উঠেছে তার জীবনের গল্প শুনে। এখন সে গল্পের শেষ পর্যায়ে আছে।
“ইয়ে মানে,” একটু ইতস্তত করলো ফারুক আহমেদ। “এতো বড় একটা ঘটনা, মিডিয়াতে কভারেজ পেলো না…ব্যাপারটা কি ঠিক হলো?”
আচ্ছা! মনে মনে বললো জেফরি, তবে মুখে বললো, “মিডিয়াকে জানানোর কি দরকার, বুঝতে পারছি না।”
“দরকার আছে, মাই বয়,” হেসে বললো মহাপরিচালক। “আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপর জনসাধারণের আস্থা তৈরি করার জন্য হলেও এটা করা দরকার। আমাদের সাফল্যগুলো ঠিকমতো প্রজেক্ট করা উচিত।” জেফরি কিছু বলছে না দেখে আবার বলতে লাগলো, “ব্যর্থতাগুলো তো চেপে রাখলেও মিডিয়া খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বের করে, ফলাও করে প্রচার করে…”
বসের দিকে চেয়ে রইলো সে। “তাহলে আপনি এখন কি করতে চাচ্ছেন?” সব শোনার পর শান্তকণ্ঠে জানতে চাইলো সে।
“তেমন কিছু না, জাস্ট মিডিয়াকে জানিয়ে দেয়া…মানে পুরো ঘটনাটা ওদের কাছে বৃফ করা আর কি।”
জেফরির মন সায় দিচ্ছে না। সে চাচ্ছে না বাবলুকে সাংবাদিকদের সামনে হাজির করতে। কাল সকালে পুলিশের কাছে সোপর্দ করে দেবার পর ওরা যা করার করবে।
“কাল সকালে পুলিশের কাছে ওকে হ্যান্ডওভার করে দেবো,” বললো সে। “তখন ওরাই না হয় মিডিয়াকে ডেকে
“আহ” তার কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে উঠলো মহাপরিচালক। “কী যে বলো তুমি। সব কৃতিত্ব ওরা নিয়ে নেবে। সবাই মনে করবে পুলিশই এটা করেছে।”
“তাতে সমস্যা কি, আমরা করি কিংবা ওরা, ফলাফল তো একই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি মানুষের আস্থা তৈরি হবে!”
জেফরির শ্লেষটা ধরতে পারলো ফারুক সাহেব। নিজের যুক্তিতে নিজেই ফেঁসে গেছে। একটু কাচুমাচু খেলো সে।
“আমরা যেহেতু কাজটা করেছি, আমাদেরই উচিত এটা জানানো,” আস্তে করে বললো অবশেষে।
জেফরি কিছু বললো না।
“তুমি হয়তো আমাকে একটু স্বার্থপর ভাবতে পারো, মনে করতে পারো আমি প্রচারনা পছন্দ করি, আসলে ব্যাপারটা সেরকম নয়।”
মহাপরিচালকের মলিন অভিব্যক্তি দেখে জেফরি বললো, “না, স্যার, আমি এরকম কিছু মনে করি না।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো ফারুক আহমেদ, “দ্যাখো, একজন অ্যাডমিনেস্ট্রেটর হিসেবে আমাকে অনেক কিছুই মাথায় রাখতে হয়। সবদিক বিবেচনায় নিতে হয়।”
“জি, স্যার,” সায় দিয়ে বললো সে।
“উপরমহলে জবাবদিহি করা থেকে শুরু করে ডিপার্টমেন্টের ইমেজের ব্যাপারটাও মাথায় রাখতে হয়।”
এবার নিঃশব্দে মাথা নেড়ে সায় দিলো চিফ ইনভেস্টিগেটর।
“ইদানিং আইন-শৃঙ্খলা বিষয়ক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটি তো সোচ্চার কণ্ঠে বলে আসছে তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে হোমিসাইডের মতো ডিপার্টমেন্ট নাকি ব্যয়বহুল শ্বেতহস্তী ছাড়া আর কিছু নয়। এর বাজেট কমানো উচিত। অন্যান্য সংস্থাগুলোর তুলনায় এটা অনেক বেশি সুযোগ সুবিধা পায়। তাদের এসব সমালোচনার জবাব দিতে হলে সাফল্যগুলোকে যথাযথভাবে তুলে ধরা খুব জরুরি।”
জেফরি এসব বোঝে কিন্তু তার মন সায় দেয় না। “ঠিক আছে, স্যার,” বললো সে। “কাল সকালে ওকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করার আগে একটা প্রেসবৃফিং করে জানিয়ে দিয়েন।”
ফারুক আহমেদ স্থিরচোখে চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। বুঝতে পারছে তার এই ইনভেস্টিগেটর রাগ করলো কিনা।
“কিন্তু বাবলুকে সাংবাদিকদের সামনে হাজির করা যাবে না।”
“বাবলু?” ফারুক আহমেদ ভুরু কুচকে বললো।
“মানে বাস্টার্ড,” অগত্যা জেফরিকে শব্দটা উচ্চারণ করতেই হলো।
“ও।” আর কিছু না বলে জেফরির দিকে চেয়ে রইলো মহাপরিচালক।
বেশিরভাগ গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে পত্রপত্রিকা আর টিভি সাংবাদিকদের সামনে অপরাধী হিসেবে বুকে কাগজ সেঁটে দিয়ে হাজির করা হয়। সেই কাগজে হয়তো লেখা থাকে ফেন্সিডিল ব্যবসায়ি, মাদক ব্যবসায়ি, খুনি, সন্ত্রাসী, অস্ত্র বিক্রেতা ইত্যাদি। এ দেশের পুলিশ বিভাগে এটা একটা রেওয়াজে পরিণত হয়ে গেছে কিন্তু পুরো ব্যাপারটাই আইনের দৃষ্টিতে অবৈধ এবং গর্হিত কাজ। কাউকে আদালত কর্তৃক অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত করার আগে এভাবে জনসম্মুখে চিত্রিত করার অধিকার কারোর নেই। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা হিসেবে পুলিশের জন্য এটা আরো বড় অপরাধ।
“শুধু ঘটনার বর্ণনা আর মেয়েটার উদ্ধারের কথা জানানো হবে,” মহাপরিচালককে চুপ থাকতে দেখে বললো জেফরি।
“চারটা খুনের ব্যাপারে কি বলবো?” গম্ভীর কণ্ঠে জানতে চাইলো ফারুক আহমেদ।
এটা একটা সমস্যা। জেফরি জানে চারজন কিডন্যাপারই খুন হয়েছে বাবলুর হাতে। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠবে, যে লোক কিডন্যাপারদের হত্যা করেছে তার ভূমিকাটা কি? সে কি কিডন্যাপারদের কেউ ছিলো? তাই যদি হবে তাহলে সে ওখানে কি করতে গেছিলো?
“আমাদের সাথে এনকাউন্টারে মারা গেছে,” আস্তে করে বললো জেফরি বেগ। কথাটা বলতে নিজের কাছেই সংকোচ হলো, কারণ এটা সত্যি নয়।
“এনকাউন্টারে?” অনেকটা আপন মনে বললো ফারুক সাহেব। জেফরি যখন ফোনে তাকে জানিয়েছিলো তখন অবশ্য বাবলুর কথাই বলেছিলো। তবে এ নিয়ে আর তর্ক করলো না ভদ্রলোক।
“তাহলে কাল সকালে প্রেস বৃফিং করি?” নিশ্চিত হতে চাইলো মহাপরিচালক।
“জি, স্যার।”
ফারুক আহমেদের মুখটা খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। “গ্রেট। সেটাই ভালো হবে।”
“আপনি বাড়িতে চলে যান, চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো জেফরি বেগ। “অনেক রাত হয়ে গেছে।”
ফারুক আহমেদও উঠে দাঁড়ালো। “হ্যাঁ। খুব টায়ার্ড লাগছে। তুমিও বেশি দেরি কোরো না। ইউ নিড সাম গুড রেস্ট।”
“জি, স্যার।”
মহাপরিচালকের রুম থেকে তারা দুজন একসাথে বেরিয়ে এলো। যাবার আগে জেফরির পিঠে চাপড় মেরে ফারুক আহমেদ বললো, “গ্রেট জব, মাই বয়…ওয়ান্স এগেইন!”
হোমিসাইডের মহাপরিচালককে বিদায় দিয়ে ইন্টেরোগেশন রুমের দিকে পা বাড়ালো জেফরি। কয়েক পা এগোতেই টের পেলো তার মোবাইলফোনটা ভাইব্রেট করছে। পকেট থেকে ফোনটা বের করার আগেই বুঝে গেলো কলটা কার।
করিডোর ধরে হাঁটতে হাঁটতেই রেবার সাথে কথা বলে চললো সে।
রাতের অভিযানটা নিয়ে এতো ব্যস্ত ছিলো যে মেয়েটাকে ফোন করা হয় নি। তার উচিত ছিলো অনেক আগেই ফোন করে জানিয়ে দেয়া, অপহৃত বাচ্চামেয়েটাকে উদ্ধার করতে পেরেছে তারা। যাইহোক, সে কথা বলতে বলতে যখন করিডোরের ডান দিকে মোড় নিলো তখনই একটা কিছু তার চোখে পড়লো। কয়েক পা পিছিয়ে ডান দিকের দেয়ালের দিকে তাকালো সে। ওখানে একটা ফায়ার ইস্টিংগুইশারের বক্স আছে। সেটার কাঁচ ভাঙা!
ইস্টিংগুইশার আর একটা কুড়াল থাকার কথা। দুটোই নেই!
ভাঙা কাঁচের গুঁড়ো পড়ে আছে মেঝেতে। এটা শুধুমাত্র আগুন লাগলে ব্যবহার করার কথা। কেউ একজন কুড়ালটা দিয়ে বক্সের কাঁচ ভেঙে ইস্টিংগুইশারটা নিয়ে নিয়েছে, সেইসাথে কুড়ালটাও!
জেফরির ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে রেবাকে ফোন রাখতে বললো সে। মোবাইলফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে কোমর থেকে পিস্তল বের করে ছুটে গেলো ইন্টেরোগেশন রুমের দিকে।
রুমের কাছে আসতেই অজানা এক আশংকা জেঁকে বসলো তার মধ্যে। দরজার নীচে আধ ইঞ্চির মতো যে ফাঁকটা আছে সেটা দিয়ে কোনো আলো দেখা যাচ্ছে না!
সর্বনাশ!
অধ্যায় ৫১
জেফরি বেগ ইন্টেরোগেশন রুম থেকে বের হবার পরই জামানের সাথে ছোট্ট একটা খেলায় মেতে ওঠে বাবলু। খুব সহজেই তাকে ক্ষেপিয়ে তুলতে পেরেছিলো সে। কজটা করতে খুব বেশি বেগ পেতে হয় নি।
বাবলু জানতো তার হাতে প্রচণ্ড মার খাবার পর থেকে ক্ষেপে আছে সে। ছেলেটাকে রুমে একা পেয়ে সেটাকেই কাজে লাগায়।
“আমি আরেক কাপ চা খাবো,” নির্বিকার ভঙ্গিতে বলেছিলো বাবলু।
কথাটা শুনে রাগে কাঁপতে শুরু করে জামান। দাঁতে দাঁত পিষে বলে, “এটা ইন্টেরোগেশন রুম। কোনো হোটেল না।”
“একটু আগে কিন্তু চা পেয়েছিলাম…আর আপনিই সেটা নিয়ে এসেছিলেন।”
জামানের মাথায় খুন চেপে যায়। কিন্তু নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে সে। দাঁতে দাঁত পিষে বলে, “আমার স্যার নিতান্তই একজন ভদ্রলোক বলে তোকে”।
কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বাবলু তখন বলে, “তার মানে বলতে চাচ্ছেন আপনি ভদ্রলোক নন?”
রেগেমেগে টেবিলে চাপড় মেরে বলে জামান, “শাটআপ! শাট ইওর রাডি মাউথ আপ!”
“ওরে বাবা!” ভয় পাবার অভিনয় করে সে। “মি: বেগের সামনে এতোক্ষণ যেভাবে বসেছিলেন আমি তো ভেবেছিলাম আপনি একটা মেনি বেড়াল। এখন দেখছি বেড়ালটা বাঘের মতোই গর্জন করতে পারে!”
কথাটা শুনে জামান চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। “ইউ ব্লাডি সোয়াইন!”
“আহ…” আক্ষেপের মতো করে বলে সে। “এটা কোনো গালি হলো! লোকজন এরচেয়েও খারাপ নামে আমাকে ডাকে!”
জামান নিজের রাগ আর দমন করতে পারে না। রাগে কাঁপতে শুরু করে এবার। তখনও বাম কানের উপর আঘাতটা টনটন করছিলো।
মাথা দুলিয়ে চুকচুক শব্দ করে বাবলু। “একদম মানাচ্ছে না! মেনি বেড়াল হিসেবেই তোকে বেশি মানায়!”
“ইউ বাস্টার্ড!” গর্জে ওঠে জামান। এই খুনির কতো বড় সাহস, তার সাথে তুই-তোকারি করছে! হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে চেয়ার ছেড়ে তেড়ে আসে বাবলুর দিকে। খপ করে তার গলাটা শক্ত করে ধরে ফেলে। “শুয়োরেরবাচ্চা! তোর এতো বড় সাহস! তুই-তোকারি করিস!”
জামানের ইচ্ছে করছিলো গুলি করে মেরে ফেলে হারামজাদাটাকে। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে গলা টিপে ধরে তার। কিন্তু চেয়ারে বসা বন্দী একটুও ঘাবড়ে যায় না, বরং নিঃশব্দে তাচ্ছিল্যভরে হাসতে থাকে খুনি।
“তোকে আমি-” কথাটা আর শেষ করতে পারে না জামান। বরফের মতো জমে যায়। টের পায় অদ্ভুত এক শীতলতা। তার চোখেমুখে আতঙ্ক ফুটে ওঠে মুহূর্তে।
“খুব লাগছে, ফ্যাসফ্যাসে কণ্ঠে বলে উঠে বাবলু। “গলাটা ছেড়ে দে!”
আস্তে করে হাতটা গুটিয়ে নেয় হোমিসাইডের সহকারি ইনভেস্টিগেটর। এছাড়া আর কিছু করা সম্ভব ছিলো না তার পক্ষে।
খুনির হাতে তখন তার নিজের পিস্তলটা!
শোল্ডারহোলস্টার থেকে নিয়ে নিয়েছে সেটা। এখন ঠেকিয়ে রেখেছে জামানের ডান বগলের নীচে, ফুসফুস লক্ষ্য করে।
জামান কিছুই বুঝতে পারে না। ভেবে পায় না, তার শোল্ডার হোলস্টার থেকে কিভাবে পিস্তলটা নিতে পারলো এই খুনি!
জবাবটা পেয়ে যায় সঙ্গে সঙ্গে।
খুনির দু’হাতই খোলা! অসম্ভব! এটা কিভাবে হলো?
জামানের বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছিলো। সে নিজে তার দু’হাতে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে দিয়েছে। চা-সিগারেট খাওয়ার সময় কেবল ডান হাতের কাফ খুলে দেয়া হয় জেফরি বেগের নির্দেশে কিন্তু একটু আগে আবারো তার হাত দুটো পেছন মোড়া করে কাফ লাগিয়ে দিয়েছিলো সে।
কোনোভাবেই সে বুঝতে পারলো না এটা কি করে সম্ভব হলো।
বাঁকা হাসি হেসে পিস্তলটা জামানের বুকে ঠেকিয়ে রেখেই উঠে দাঁড়ায়। বাবলু। অন্য হাতে ছেলেটার চুলের মুঠি ধরে তার মাথাটা টেবিলের উপর চেপে ধরে। “একটা শব্দ বের হবে তো তুই শেষ!” ভীতিকর কণ্ঠে বলে সে।
আতঙ্কের সাথেই জামান লক্ষ্য করে তার চোখের সামনেই পড়ে আছে বাস্টার্ড নামের খুনির ফাইল। সেই ফাইলের উপরের দিকে ডান কোণে তার একটা ছবি জেম ক্লিপ দিয়ে আটকানো ছিলো। ছবিটা এখনও আছে। কিন্তু জেম ক্লিপটা নেই!
মুহূর্তেই জামান বুঝে যায় এই ভয়ঙ্কর খুনি জেম ক্লিপটা তাদের অলক্ষ্যে হাতিয়ে নিয়েছে আর সেটাই ব্যবহার করেছে হ্যান্ডকাফ খোলার কাজে।
“এপর থেকে তোদের অফিস স্টেশনারির লিস্ট থেকে জেম ক্লিপটা বাদ দিয়ে রাখবি।”
এ কথার জবাবে জামান কিছু বলতে পারে নি।
“উল্টাপাল্টা কিছু করবি না। বুঝলি?” বলে ওঠে বাবলু।
জেফরির সহকারীর হতভম্ব ভাব তখনও কাটে নি। তার দু’চোখে সুতীব্র ভীতি জেঁকে বসে। এই খুনি কি করতে পারে সে সম্পর্কে তার ভালো ধারণা রয়েছে। এরকম স্মার্ট আর ভয়ঙ্কর খুনি তাকে নিয়ে এখন কি করবে ভাবতেই শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল একটি প্রবাহ বয়ে যায়। এভাবে ভড়কে গেলে চলবে না, নিজেকে সুধায় সে। সাহস সঞ্চয় করে নেয় দ্রুত।
“এখান থেকে বের হতে পারবে না, কোনোরকমে বলে জামান। “পুরো বিল্ডিংয়ে।”
“চপ!” তাকে থামিয়ে দেয় বাবল। মাথাটা আরো শক্ত করে টেবিলের উপর চেপে ধরে। “এটা নিয়ে তোকে মাথা ঘামাতে হবে না।” বলেই গেটের দিকে তাকায়। “আমি যদি এখান থেকে বের হতে না পারি তাহলে তোদের অনেক লোক খুন হবে আজ।” তারপর কানের কাছে মুখ এনে আরো ভীতিকরভাবে বলে, “সবার আগে থাকবে তোর ঐ বস্!”
ঢোক গেলে জামান।
দ্রুত ভাবতে থাকে বাবলু।
চায়ের কাপটা রাখতে গিয়ে জেফরি বেগ আর জামানের অলক্ষ্যে জেম ক্লিপটা হাতিয়ে নিয়েছিলো সে। তারপর গল্প বলার ফাঁকে ফাঁকে ক্লিপটার প্যান্ট খুলে কিছুটা সোজা করে নেয়। একটু আগে জামান যখন তার হাত দুটো পেছন মোড়া করে আবারো হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে দেয় বাড়তি একটা সুবিধা পেয়ে যায় বাবলু।
ডান হাতে থাকা ক্লিপটার সোজা অংশ দিয়ে হ্যান্ডকাফের লক খুলে ফেলে অনায়াসে। এরকম একটা জিনিস দিয়ে সব ধরণের লক খুলতে পারে সে। এটা তার কাছে ছেলেখেলার মতোই সহজ। আন্ডারওয়ার্ল্ডের তালা-মতিনের কাছে সেজন্যে চিরকৃতজ্ঞ সে।
জেফরি বেগ রুম থেকে বের হবার আগেই হ্যান্ডকাফটা খুলে ফেলতে পেরেছিলো। আর জামানকে ক্ষেপিয়ে তোলাটা ছিলো খুব সহজ। তার হাতে বেদম মার খেয়ে তেতে ছিলো ছেলেটা।
যেভাবে পরিকল্পনা করেছিলো জামান ছেলেটা ঠিক সেভাবেই প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। একেবারে পাপেটের মতো। ছেলেটার দিকে তাকালো। মৃত্যুভয়ে চোখ দুটো যেনো কোটর থেকে বের হয়ে আসতে চাইছে।
মুচকি হাসলো সে।
হোমিসাইডের হেডকোয়ার্টারে তাকে যখন আনা হয় তখন তার অবস্থা ছিলো আধো-অচেতন। তারপরও দু’চোখ অল্প একটু খুলে রেখে সব কিছু দেখেছে। অবশ্য এর আগে ব্ল্যাকরঞ্জুর হাতে মারাত্মক আহত হয়ে যখন গ্রেফতার হয়েছিলো তখন তাকে এখানে নিয়ে আসা হয়। যথারীতি জেফরি বেগ তাকে ইন্টেরোগেট করে। সেবার কোথায় কি দেখেছিলো সবই তার মনে আছে। ইনভেস্টিগেটরকে গল্প বলার সময় তার মস্তিষ্কের একটা অংশ এসব নিয়ে ভেবে যাচ্ছিলো।
নিজের পরিকল্পনা দ্রুত সাজিয়ে নিয়ে জামানের কপালে পিস্তলের নলটা ঠেকায় বাবলু। সেফটি ক্যাচটা আনলক করার শব্দ শুনে বিস্ফারিত চোখে চেয়ে থাকে জেফরির সহকারী।
এই খুনি তাকে খুন করবে এখন!
*
ইন্টেরোগেশন রুমের অন্ধকারের মধ্যে জেফরি দেখতে পেলো বাবলুর আবছায়া অবয়বটি। উপুড় হয়ে বসে আছে সে। কিন্তু ঘরে আর কেউ নেই! খোলা দরজা দিয়ে বাইরের যেটুকু আলো এসে পড়েছে তা দিয়ে এরচেয়ে বেশি দেখা সম্ভব হলো না।
জামান কোথায়!
সিলিং থেকে যে স্পটলাইটটা জ্বলতো সেটা বন্ধ। দরজার পাশে সুইচবোর্ড হাতরিয়ে বাতি জ্বালিয়ে দিলো সে।
যে দৃশ্য দেখতে পেলো সেটার জন্য মোটেও প্রস্তত ছিলো না। হকচকিয়ে গেলো সে।
বাবলু যে চেয়ারে বসে ছিলো সেখানে এখন জামান।
তার এক হাতে হ্যান্ডকাফ লাগানো, চেয়ারের হাতলের সাথে আটকানো!
জামানের নিথর দেহটা দেখে আতঙ্কিত হয়ে উঠলো। টেবিলের উপর শরীরের অর্ধেকটা পড়ে আছে।
দৌড়ে ছুটে গেলো ইন্টেরোগেশন টেবিলের কাছে। “জামান!” ছেলেটার মাথা তুলে বললো জেফরি। “জামান! কথা বলো?” সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলো তার সহকারী বেঁচে আছে। তবে অচেতন।
জেফরি ভেবে পেলো না কী করে এমন হলো। একজন বন্দী কিভাবে এখান থেকে চলে যেতে পারলো। রাগে ক্ষোভে সারা শরীর কাঁপতে শুরু করলো তার। বাবলুকে ধরার জন্য এক্ষুণি ছুটে যাওয়া উচিত কিন্তু সহকারীকে এভাবে ফেলে রেখে যেতে পারছে না। ছেলেটার আঘাত কতোটা তীব্র বুঝতে পারছে না সে। খেয়াল করলো জামানের শোল্ডার হোলস্টারে পিস্তলটা নেই!
মাই গড! বাবলুর মতো একজনের হাতে পিস্তল থাকলে কী হতে পারে সেটা জেফরির চেয়ে ভালো আর কে জানে।
সহকারীর দু’গালে আলতো করে চড় মারলো সে। “জামান! জামান!”
এবার ছেলেটা দু’চোখ খুলে দেখার চেষ্টা করলো।
“তুমি ঠিক আছে তো?”
মাথা নেড়ে সায় দেবার চেষ্টা করলো ছেলেটা। “আমি ঠিক আছি…ঐ শূয়োরেরবাচ্চা-”
সঙ্গে সঙ্গে পুরো ঘরটা নিকষ কালো অন্ধকারে ঢেকে গেলো।
লোডশেডিং?
জেফরি একটু অপেক্ষা করলো। কিন্তু এটা তো সম্ভব নয়। তাদের এখানে জেনারেটর আছে। সেটা মুহূর্তেই চালু হয়ে যায়। তাহলে?
পাওয়ার রুম!
বাবলু পাওয়ার রুমে গেছে! নীচতলায় ইন্টেরোগেশন রুমের খুব কাছেই এই ভবনের পেছন দিকে সেটা অবস্থিত। ওখান থেকে মেইনগেটটা বেশ দূরে।
এখনও সময় আছে! বাবলু যাতে মেইনগেটের দিকে যেতে না পারে সেটা করতে হবে সবার আগে।
জেফরি আর দেরি করলো না, জামানকে ওভাবে রেখেই ইন্টেরোগেশন রুম থেকে এক দৌড়ে বের হয়ে গেলো।
ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে দৌড়াতে দৌড়াতে চিৎকার করে বললো সে, “মেইনগেট বন্ধ করো! মেইনগেট বন্ধ করো!”
এই ভবনে রাত্রিকালীন ডিউটিতে কিছু র্যাট সদস্য থাকে কিন্তু সমস্যা হলো তারা সবাই থাকে পাঁচতলার উপর রিজার্ভ কোয়ার্টারে। ওদেরকে এনগেজ করাতে গেলে বাবলু ফসকে যাবে। সবার আগে দরকার মেইনগেটটা সিকিউর করা। গেটে একজন সশস্ত্র প্রহরি থাকলেও তাকে অ্যালার্ট করতে হবে। আর সেটাই করা দরকার সবার আগে।
মেইনগেটের দিকে ছুটে যেতে যেতেই পিস্তলের সেফটি লকটা খুলে ফেললো সে।
.
হোমিসাইডের মেইনগেটের বাইরে কনস্টেবল কুতুব উদ্দিন এততক্ষণ দাঁড়িয়েই ছিলো, পা ব্যথা করছে বলে কিছুক্ষণ আগে ছোট্ট টুলটায় একটু বসেছে মাত্র আর তখনই চারপাশের সবকিছু অন্ধকারে ডুবে যায়। অবাক হয় সে।
না, লোডশেডিং হয়েছে বলে নয়। তাদের অফিসে তত জেনারেটর আছে। বিদ্যুৎ চলে গেলে সঙ্গে সঙ্গে সেটা চালু হয়ে যায়। আজ সেটা হলো না বলে অজানা আশংকায় তার বুকটা কেঁপে ওঠে। একটু পরই ভেতর থেকে এক চিৎকার ভেসে আসে : “মেইনগেট বন্ধ করো! কাউকে বের হতে দেবে না!”
আরে বাবা, মেইনগেট তো বন্ধই আছে, মনে মনে বলে ওঠে কুতুব। এই তো, মাত্র কয়েক মিনিট আগে ডিজি স্যার চলে যাবার পরই সে তালাটা লাগিয়ে রেখেছে। রাতের বেলায় কি মেইনগেট কখনও খোলা থাকে?
নাইন শুটার শটগানটা টুলের পাশে ঠেক দিয়ে রেখেছিলো কুতুব উদ্দিন, সেটা হাতে তুলে নিতেই অন্ধকার প্রকম্পিত করে পর পর দুটো গুলির শব্দ হলো!
গেট থেকে সরে গিয়ে দেয়ালের সাথে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে। তার বুক ধরফর করে উঠেছে। গুলিটা করা হয়েছে ভেতর থেকে। যে করেছে তার পায়ের আওয়াজ পাচ্ছে সে। গেটের দিকেই এগিয়ে আসছে! হাতের অস্ত্রটা শক্ত করে ধরলো।
লা ইলাহা..ইল্লা আন্তা…সুবহানাকা…আর বলতে পারলো না। দোয়া ইউনুসের বাকিটুকু ভুলে গেছে।
অধ্যায় ৫২
এক হাতে ফায়ার ইস্টিংগুইশার আর অন্য হাতে কুড়ালটা নিয়ে পাওয়ার রুম থেকে বেরিয়ে সংঙ্কীর্ণ সিঁড়িটার ল্যান্ডিংয়ে চলে এলো বাবলু। চারপাশ অন্ধকারে ঢেকে আছে কিন্তু তাতে কোন সমস্যা হলো না। পাওয়ার রুমে ঢোকার আগেই এই সিঁড়িটার অবস্থান দেখে নিয়েছিলো।
পিস্তলের বাট দিয়ে জামানের মাথার পেছনে প্রচণ্ড আঘাত করলে জ্ঞান হারায় সে। তারপর ইন্টেরোগেশন রুম থেকে বের হয়েই দেয়ালে বসানো ফায়ারবক্সটার কাছে চলে যায়। এই ভবনের অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা বেশ ভালো। আজকে যখন তাকে এখানে নিয়ে আসা হয় তখনই এটা তার চোখে পড়েছিলো।
পাশে রাখা কুড়ালটা দিয়ে বক্সের কাঁচ ভেঙে ফায়ার ইস্টিংগুইশারটা নিয়ে নিতে কোনো সমস্যাই হয় নি।
তার কোমরে এখন নাইন এমএম-এর অটোম্যাটিক একটি পিস্তল। জামানের কাছ থেকে নিয়েছে এটা। আপাতত অস্ত্রটা ব্যবহার করার কোনো ইচ্ছে তার নেই। হাতের কুড়ালটাই বেশি কাজে দেবে।
ইন্টেরোগেশন রুমের খুব কাছেই পাওয়ার রুমটা। এখানে আসতে কোনো বাধাই পেরোতে হয় নি। সে বুঝতে পারছে, রাত্রিকালীন ডিউটিতে খুব বেশি লোক এখানে থাকে না। এ পর্যন্ত কোনো মানুষের চিহ্নও দেখে নি।
সিঁড়িতে ওঠার পরই শুনতে পায় কেউ একজন চিৎকার করে মেইনগেটটা বন্ধ করতে বলেছে। তার ধারণা, কণ্ঠটা সম্ভবত জেফরি বেগের। মেইনগেট বন্ধ করার কথা শুনে তার মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে।
চিৎকারটা মিহঁয়ে যেতে না যেতেই পর পর দুটো গুলির শব্দ। এই গুলির শব্দটা তাকে চমকে দিয়েছে। গোলাগুলি করার মতো পরিস্থিতি তো হয় নি এখনও! তাহলে গুলি হলো কেন?
এই ভবনের ভেতরে কোথায় কি আছে সে সম্পর্কে খুব একটা ধারণা নেই তার। অন্ধকারে এটা তার জন্যে গোলকধাঁধা ছাড়া কিছু না। তবে এই গোলকধাঁধা থেকে বের হবার সহজ একটা পথ পেয়ে গেছে সে।
সঙ্কীর্ণ সিঁড়িটার কয়েকটি ধাপ উঠে একটু থামলো। কান পেতে শোনার চেষ্টা করলো সে। দূর থেকে কিছু মানুষের দৌড়াদৌড়ি আর কথাবার্তা শুনতে পেলো। সবগুলোই আসছে উপরতলা থেকে। পায়ের আওয়াজ শুনে বুঝতে পারলো চার-পাঁচ জনের কম হবে না।
আবারো নিঃশব্দে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করলো। বোঝার চেষ্টা করছে গুলি হবার কারণ কী হতে পারে। খুব দ্রুতই জবাব পেয়ে গেলো বাবলু : পুরো বিল্ডিংয়ের সবাইকে এক মুহূর্তে সতর্ক করে দেবার জন্যই এটা করা হয়েছে। কাজটা অবশ্যই মি: বেগের। এ ব্যাপারে তার কোনো সন্দেহ নেই।
এই ভবনের সবাই এখন সতর্ক হয়ে গেছে। মেইনগেটটা এতোক্ষণে সিকিউর করে ফেলেছে তারা। নিশ্চয় বিকল্প আলো জ্বালানোর ব্যবস্থাও করা হবে, তারপরই শুরু হবে তল্লাশী।
বাবলু এসব নিয়ে ভাবছে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই এই ভবন থেকে সে বেরিয়ে যেতে পারবে। এখন শুধু দরকার মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজ করা। তড়িঘড়ি করে কিছু করতে গেলে বিপত্তি বেধে যেতে পারে, এটা সে কোনোভাবেই চায় না।
.
শারীরিকভাবে সে পুরোপুরি ফিট নয়, তবে মানসিকভাবে বেশ চাঙ্গা। যে কৌশলটা খাটাতে চেয়েছিলো সেটা দারুণভাবেই করতে পেরেছে। তার আত্মবিশ্বাস এখন তুঙ্গে। কেউ তাকে থামাতে পারবে না।
অন্ধকারের মধ্যেই একা একা মেইনগেটের কাছে চলে এলো জেফরি। সে জানে এটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। বাবলু হয়তো ঘাপটি মেরে আছে কোথাও। খাঁচায় বন্দী শিকারী প্রাণী ছাড়া পেয়ে গেলে যেমন বিপজ্জনক হয়ে ওঠে তার অবস্থাও এখন সেরকম। কোনো কিছু পরোয়া করবে না।
তার হাতের পিস্তলটা দুহাতে ধরে সামনের দিকে তাক করে রেখেছে। মেইনগেটের কাছে একটু আলো দেখতে পেলো। বাইরে থেকে এসেছে। সেই আলোতে বুঝতে পারলো গেটটা বন্ধ কিন্তু সশস্ত্র কনস্টেবলের কোনো দেখা নেই! কোথায় গেলো সে?
এক হাতে গেটটা ধরে খোলার চেষ্ট করলো। বুঝতে পারলো গেটে তালা লাগানো আছে। সঙ্গে সঙ্গে সচেতন হয়ে উঠলো জেফরি বেগ। গেটের দিকে পিঠ দিয়ে ভেতরের দিকে তাক করলো অস্ত্রটা। বাবলু বের হতে পারে নি। এখনও ভবনের ভেতরেই আছে!
“কুতুব?” আস্তে করে বললো সে। এখনও গেটের দিকে পিঠ দিয়ে সজাগ দৃষ্টি রেখেছে। “কুতুব?”
“কে?” গেটের বাইরে থেকে ফিসফিসে গলায় বললো কনস্টেবল।
“তুমি কোথায়?”
এবার গেটের সামনে চলে এলো কুতুব। তার হাতে নাইন শুটার শটগান।
জেফরি চট করে ঘুরে তাকে কিছু বলার আগেই ফ্ল্যাশলাইটের আলো এসে পড়লো তার উপর। গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা কুতুব এবার চিনতে পারলো কে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
“স্যার?”
জেফরি তাকে কিছু না বলে পেছন ফিরে জোরে জোরে বললো, “আমি জেফরি বেগ! গেটটা সিকিউরড! সবাই সাবধান! ওর কাছে অস্ত্র আছে।”
পাঁচজন র্যাট সদস্য ছুটে এলো তার দিকে। তাদের মধ্যে দুজনের হাতে ফ্ল্যাশলাইট।
হোমিসাইডের হেডকোয়ার্টারে এ মুহূর্তে সব মিলিয়ে এগারো জন কর্মকর্তা আর কর্মচারি রয়েছে। এদের মধ্যে দু’জন কনস্টেবল লেভেলের। একজন মেইনগেটে থাকে, অন্যজন সিসি ক্যামেরা মনিটর করে। বাকি দু’জন ড্রাইভার। এদেরকে বাদ দিলে থাকে জেফরি জামান আর পাঁচজন র্যাট সদস্য। তারা সবাই সশস্ত্র। কিন্তু জেফরি আশ্বস্ত হতে পারছে না। বাবলুর মতো একজন পেশাদার খুনি কি করতে পারে সেটা ভালো করেই জানে। ছয়-সাতজন অস্ত্রধারীকেও অনায়াসে ঘায়েল করতে পারে সে।
এরইমধ্যে পাওয়ার অফ করে দিয়েছে পেশাদার খুনি। অন্ধকারে, গোলকধাঁধাতুল্য এই ভবনে তাকে খুঁজে বের কারটা সহজ কাজ হবে না। জেফরি অবশ্য আশংকা করছে অন্য কিছু। কোনোভাবেই সে চাইছে না তাদের কেউ হতাহত হউক।
“স্যার?” তার সামনে এসে একজন র্যাট বললো।
জেফরি চিনতে পারতো সৈকতকে। ছেলেটার পরনে স্যান্ডো গেঞ্জি আর গৃ-কোয়ার্টার। এক হাতে অস্ত্র আর অন্য হাতে একটি ফ্ল্যাশলাইট।
তাকে দেখে মনে হচ্ছে কিছুটা ভড়কে গেছে। পাঁচতলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নেমে আসায় রীতিমতো হাপাচ্ছে সে। তার পেছন পেছন চলে এলো বাকিরা। তাদের অবস্থাও একই রকম। একেবারেই অপ্রস্তুত। এরা স্ট্যান্ডবাই থাকে ইমার্জেন্সি ডিউটির জন্য কিন্তু নিজেদের হেডকোয়ার্টারের ভেতরে এরকম কোনো পরিস্থিতির জন্য তাদের প্রস্ততি থাকার কথা নয়।
“ও পালিয়েছে!” বললো জেফরি। বাস্টার্ড কিংবা বাবলু, কোনো নামই উচ্চারণ করলো না। “জামানের পিস্তলটা ওর কাছে…এখনও বের হতে পারে নি…ভেতরেই আছে।”
“পাওয়ার অফ করলো কে?” সৈকত জানতে চাইলো। ও-ই?”
“হুম।”
“তাহলে তো নীচের তলায়ই আছে!”
“আমারও তাই মনে হচ্ছে,” বললো জেফরি। উপর তলায় যাবার সিঁড়িটা তাদের থেকে খুব বেশি দূরে নয়। একটু আগেই এটা দিয়ে র্যাটরা নেমে এসেছে। তার মানে বাবলু এখনও নীচের তলায় আছে।
“শামীম, সিঁড়িটা সিকিউর করো!” দেরি না করে আদেশের সুরে বললো সৈকত। আজ রাতে র্যাটদের যে দলটি ডিউটিতে আছে সে তাদের নেতা।
লম্বামতো এক তরুণ এক হাতে ফ্ল্যাশলাইট আর অন্য হাতে অস্ত্র নিয়ে দৌড়ে সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ের কাছে চলে গেলো।
জেফরি এবার গেটের দিকে ফিরলল। “কুতুব, কাউকে বের হতে দেবে না। আমি না বলা পর্যন্ত এই গেটটা খুলবে না। সাবধান। আসামীর কাছে পিস্তল আছে।”
“জি, স্যার, ঢোক গিলে বললো কুতুব।
“লেটস মুভ, র্যাটদের দিকে ফিরে বললো জেফরি।
“স্যার?” সৈকত বললো। “সবার আগে পাওয়ার রেস্টোরেশন করা দরকার?”
জেফরির মন বলছে পাওয়ার রেস্টোরেশন করা সম্ভব হবে না। সে নিশ্চিত, বাবলু কুড়াল ব্যবহার করে সার্কিটের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। দ্রুত সেটা রেস্টোরেশন করা যাবে না। “চলো, দেখি ওখানকার অবস্থা কি।”
চারজন র্যাটকে নিয়ে পাওয়ার রুমের দিকে চলে গেলো জেফরি বেগ।
অধ্যায় ৫৩
এতোদিন কুতুব জানতো নাইট ডিউটিটা খুব আরামের। কোনো ঝঞ্ঝাট পোহাতে হয় না। শুধু ঘুম নামক বস্তুটাকে কজায় রাখলেই হলো। তারপর বসে বসে এটা সেটা ভেবে সময় পার করো। কোনো কাজ নেই কাম নেই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে-বসে থেকে সারা রাত পার করা আর কি।
দিনের বেলা হলে এই স্যার ওই স্যারকে আসতে যেতে দেখলেই সালাম দিতে হয়, সারাক্ষণ তটস্থ থাকতে হয় কখন কে এলো আর গেলো। একটুও ফাঁকি মারার সুযোগ থাকে না। এমনকি টুলে বসে ঝিমুতে দেখলেও চাকরি নট হয়ে যাবার ঝুঁকি থাকে। সেদিক থেকে দেখলে রাতের শিফটে কাজ করার মধ্যে অনেক আরাম। সাধারণত মাঝেসাঝে দুএকজন বড়কর্তা রাতের বেলায় অফিসে থাকে, আর বেশিরভাগ সময়ই লোকজনের যাওয়া আসা একদম হয় না বললেই চলে। তবে আজকের পরিস্থিতি একটু আলাদা। বিরাট এক খুনিকে ধরে আনা হয়েছে এখানে। কুতুব ভেবেছিলো ঐ ব্যাটাকে সারারাত ধরে প্যাদানি দেয়া হবে। কিছুক্ষণ আগপর্যন্ত হয়তো তা-ই হচ্ছিলো কিন্তু এখন আর সেটা মনে হচ্ছে না।
সে বুঝে উঠতে পারছে না ভেতরে আসলে কি হয়েছে। এতোগুলো মানুষের চোখে ধুলো দিয়ে একজন বন্দী কিভাবে পালালো? মেইনগেট দিয়ে তো কেউ বের হতে পারে নি। তার হাতে নাকি আবার অস্ত্র আছে! ঘটনা কোন দিকে যায় কে জানে।
একটু ধাতস্থ হতেই দোয়া ইউনুসের বাকিটুকু মনে পড়ে গেলো তার। ময়মুরুব্বিরা বলে, এই সুরা পড়লে বিপদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। ইউনুস নবী নাকি বিরাট একটা মাছের পেটে ঢুকে যাবার পর এই সুরাটা পড়ে রক্ষা পেয়েছিলেন।
তিনবার সুরাটা পড়ে বুকে ফুঁ দিতে যাবে কুতুব সঙ্গে সঙ্গে কান ফাটানো প্রচণ্ড বিস্ফোরণে কেঁপে উঠলো হোমিসাইডের হেডকোয়ার্টার। লাফ দিয়ে শুয়ে পড়লো সে। আরেকটু হলে মাগো-বাবাগো বলে চিৎকারটা দিয়েই দিয়েছিলো কিন্তু আতঙ্কের কারণে গলা দিয়ে শব্দ বের হয় নি।
.
পাওয়ার রুমে ঢুকেই জেফরি বেগ বুঝতে পারে তার আশংকাই ঠিক। বাবলু শুধু পাওয়ার সার্কিটটাই ধ্বংস করে নি, ব্যাকআপ জেনারেটরটাও কুপিয়ে নষ্ট করে রেখেছে।
হাতে ফ্ল্যাশলাইট থাকা সৈকত আরেকটু খতিয়ে দেখার চেষ্টা করেছিলো কোনোভাবে মেরামত করা যায় কিনা, কিন্তু জেফরি তাকে বারণ করে। দ্রুত রুম থেকে বের হয়ে যাবার তাগাদা দেয়। বাবলু নিশ্চয় আশেপাশে কোথাও ওৎ পেতে আছে।
পাওয়ার রুম থেকে বের হবার পর পরই প্রচণ্ড জোরে বিস্ফোরণটা হয়। ক্ষণিকের জন্য হকচকিয়ে যায় তারা সবাই।
“স্যার! ওদিক থেকে এসেছে আওয়াজটা,” ভবনের পেছন দিকে ফ্ল্যাশলাইটের আলো ফেলে ইঙ্গিত করলো সৈকত।
জেফরি ধারণাও তাই। সর্বনাশ! বাবলু কি করে ওখানে গেলো? এই ভবনের ভেতর দিয়ে ওখানে যাওয়া যায় না। বিস্ফোরণটাই বা কী করে করলো?
জেফরি কিছু বলছে না দেখে তাড়া দিলো সৈকত, “স্যার?”
হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর তার দিকে তাকালো। এখনও নিজের চিন্তা থেকে পুরোপুরি বের হতে পারে নি।
“মনে হয় ওখানে আছে,” বললে ছেলেটা।
জেফরি নিশ্চিত, বাবলু ভবনের পেছনে নেই। এটা তাদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্য করা হয়েছে। তার মনে পড়ে গেলো জায়েদ রেহমানের হত্যাকাণ্ডের তদন্তের সময় যখন প্রথম এই খুনির নাগাল পেয়েছিলো তখন সে গ্যাসের চুলা ব্যবহার করে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পুরনো একটি বাড়ি থেকে কিভাবে পালিয়ে গেছিলো।
ফায়ারবক্স…কুড়াল…ইস্টিংগুইশার…বিস্ফোরণ!
“না,” জোর দিয়ে বললো সে। মাথার ভেতরে ঘুরতে থাকা প্রশ্নগুলোর জবাব যেনো চট করেই পেয়ে গেলো। “ওখানে না। উপরে গেছে!”
সৈকত যারপরনাই বিস্মিত। “উপরে!” এটা কী করে সম্ভব?
অধ্যায় ৫৪
যে ভবনের ভেতরে ইস্টিংগুইশার আছে সেখানে ফায়ারস্কেপ সিঁড়ি থাকবেই, বাবলুর এই ধারণাটা সত্যি প্রমাণ হয়েছে।
সাধারণত ফায়ারস্কেপ সিঁড়ি ব্যবহার করা হয় আগুন কিংবা অন্য কোনো কারণে ভবন থেকে দ্রুত আর নিরাপদে বেরিয়ে আসার জন্যে, তবে একটু আগে বাবলু সেটা ব্যবহার করেছে উপরে ওঠার কাজে। তার ধারণা জেফরি বেগ যতো স্মার্টই হোক না কেন ফায়ারস্কেপ সিঁড়িটার কথা প্রথমে তার মাথায় আসবে না। যখন আসবে তখন বাবলু চলে যাবে নাগালের বাইরে।
ছাদে উঠে ভবনের পেছন দিকে ফায়ার ইস্টিংগুইশারটা ফেলে দেয় সে। উপর থেকে পড়ে ধাতব সিলিন্ডারটি বোমার মতোই বিস্ফোরিত হয়। বাবলু নিশ্চিত, এতে করে সবাইকে আরেকটু বিভ্রান্ত করা গেছে।
পাঁচতলার ছাদের চারপাশটা তাকিয়ে দেখলো। যে জিনিসটা খুঁজছিলো সেটা দেখতে পেলো ছাদের এককোণে।
ওয়্যারলেস কমিউনিকেশন্সের ছোট্ট একটি টাওয়ার।
এই ভবনের তিন দিকে অসংখ্য অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং। শুধু উত্তর দিকটা খোলা। এটা হোমিসাইডের হেডকোয়ার্টারের সম্মুখ ভাগ আর প্রবেশপথ। বাকি তিন দিকে একেবারে গা ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে কতোগুলো সুউচ্চ ভবন।
টাওয়ারটা উত্তর-পশ্চিম কোণে অবস্থিত। ছাদের চারদিক চার ফুট উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। বাবলু দ্রুত পূর্ব আর পশ্চিম দিকের দেয়ালের কাছে গিয়ে নীচে কি আছে দেখে নিলো।
পূর্ব দিকে একটা দশ তলা অ্যাপার্টমেন্ট। দুটো ভবনের মাঝখানে সাত-আট ফুটের মতো খালি জায়গা। এর দক্ষিণ দিকটা অন্য একটা ভবনের সীমানা প্রাচীর দিয়ে বন্ধ করা আর উত্তর দিকটা চলে গেছে হোমিসাইডের প্রবেশ পথের পাশ দিয়ে মেইনরোডের দিকে।
পশ্চিম দিকেও একটা বিল্ডিং আছে তবে সেটা অপেক্ষাকৃত পুরনো। হোমিসাইডের হেডকোয়ার্টারের মতো ওটাও পাঁচতলার, তবে একটু বেশি উঁচু। দুই ভবনের মাঝখানে খুবই সংকীর্ণ একটি গলির মতো জায়গা, সেটা দক্ষিণ দিকে চলে গেছে একটা ঝোঁপঝাড়ের দিকে। উত্তর দিকটা যথারীতি মেইনরোডে গিয়ে শেষ হয়েছে।
এবার টওয়ার থেকে যে মোটা ক্যাবলটা ভবনের নীচে চলে গেছে সেটা দেখতে পেলো। কুড়ালটা প্রাচীরের উপর রেখে ক্যাবলটা ধরে সজোরে টান দিলো সে। দু’তিনবার টান দিতেই সেটা ছিঁড়ে গেলো। ক্যাবলের অন্য মাথাটা টাওয়ারের সাথে সংযোগ দেয়া। একটু টেনে দেখলো বাবলু। না। বেশ শক্ত করে লাগানো আছে। তবে সে নিশ্চিত হতে পারলো না, এটা একজন মানুষের ওজন সহ্য করতে পারবে কিনা।
ক্যাবলটা ছেড়ে দিয়ে কুড়ালটা তুলে নিলো। নীচের দিকে তাকিয়ে দেখলো বাম পাশে কিছু টিনের ছাদওয়ালা ঘর। বাবলু বুঝতে পারলো ওগুলো কি।
গাড়ি রাখার গ্যারাজ।
কুড়ালটা এবার ফেলে দিলো সেই ঘরগুলোর ছাদের উপর।
.
ফায়ারস্কেপ সিঁড়ি দিয়ে সতর্ক পদক্ষেপে উঠে যাচ্ছে জেফরি বেগ, সৈকত আর বাকি দুই র্যাট সদস্য। তারা সবাই সতর্ক। সবার সামনে আছে সৈকত। আজরাতের শুরুর দিকে আন্ডারকন্ট্রাকশন ভবনে অভিযানের সময় সে-ই বাবলুকে ঘায়েল করতে পেরেছিলো। তার গুলিগুলো বাবলুর প্রাণ কেড়ে নিতে পারে নি বুলেটপ্রুফ জ্যাকেটের কারণে।
তারা যখন তিন তলার ল্যান্ডিংয়ে তখনই কিছু একটা পড়ার শব্দ শুনতে পায়। সঙ্গে সঙ্গে থেমে যায় জেফরিসহ সবাই। একটু দূর থেকে আসার কারণে তারা বুঝতে পারলো না শব্দটা কিসের।
“টিনের ছাদের উপর কিছু পড়ার শব্দ বলে মনে হচ্ছে,” পেছন ফিরে জেফরিকে বললো সৈকত।
টিনের ছাদ? কয়েক মুহূর্ত লাগলো জেফরির বুঝতে। “মাই গড! নীচের গাড়ি রাখার গ্যারাজ!”
“লাফ দিয়েছে!?” সৈকতের বিশ্বাস করতেও কষ্ট হলো।
“তোমরা ছাদে যাও, আমি নীচে যাচ্ছি।”
কথাটা বলেই জেফরি বেগ আর সময়ক্ষেপন করলো না। ফায়ারস্কেপের সঙ্কীর্ণ সিঁড়িটা দিয়ে একাই নেমে গেলো। সৈকত কিছু বলারও সুযোগ পেলো না।
সৈকতের নেতৃত্বে তিনজন র্যাট দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে গেলো।
ছাদে আসার পর সৈকতসহ চারজন র্যাট পজিশন নিয়ে নিলো চারদিকে। তাদের সবার অস্ত্র সামনের দিকে তাক করা।
চারপাশের বাড়িঘর থেকে আসা আলোতে স্পষ্ট দেখতে পেলো ছাদটা ফাঁকা।
সবার আগে সৈকতের নজর পড়লো টাওয়ারের সাথে সংযুক্ত ক্যাবলটা। ছাদের সীমানা প্রাচীরের উপর দিয়ে চলে গেছে নীচে। কাছে এসে নীচের দিকে তাকালো সে। ক্যাবলটা ঝুলছে। ঠিক তার নীচেই গাড়ি রাখার গ্যারাজগুলো।
ফ্ল্যাশলাইট হাতে এক র্যাট সদস্য এসে টিনের ছাদের উপর আলো ফেললো। কুড়ালটা পড়ে থাকতে দেখা গেলো ওখানে।
কিন্তু বাবলুর কোনো চিহ্ন নেই।
দেরি করে ফেলেছে তারা! বদমাশটা সটকে পড়েছে। তাদের সবাইকে বোকা বানিয়ে হাত ফসকে পালিয়ে গেছে পেশাদার খুনি।
সৈকত খেয়াল করলো জেফরি বেগ ততোক্ষণে নীচের গ্যারাজে সামনে চলে এসেছে। সে উপরের দিকে তাকাতেই সৈকত চিৎকার করে বললো,
“স্যার! নেই। ভেগেছে!”
নীচের অন্ধকারেও জেফরির আবছায়া মূর্তিটা দেখে সে বুঝতে পারছে চরম হতাশ আর ক্ষুব্ধ হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর। পিস্তল হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
“টাওয়ারের ক্যাবলটা দড়ি হিসেবে ব্যবহার করেছে!” আবারও চিৎকার করে বললো সৈকত।
.
জেফরি বেগ যেনো বিশ্বাস করতে পারছে না। উপরের দিকে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ।
টাওয়ারের ক্যাবল বেয়ে বাবলু নীচে নেমে গেছে?
অবিশাস্য!
একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেলো তার। হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টটা তখন সদ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জনবল হাতেগোনা। পুরোপুরি কাজ শুরু করে নি। তখন একরাতে ছিঁচকে এক চোর টাওয়ারের ক্যাবল বেয়ে ভবনে ওঠার চেষ্টা করেছিলো, ক্যাবলটা তার শরীরের ভার সইতে পারে নি। ওটা ছিঁড়ে গিয়ে চোর বেচারা নীচে পড়ে মারাত্মক আহত হয়েছিলো।
“স্যার, কুড়ালটা গ্যারাজের ছাদে পড়ে আছে,” জেফরিকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পাঁচতলার উপর থেকে সৈকত চেঁচিয়ে বললো।
কুড়ালটা গ্যারাজের টিনের ছাদে পড়ে আছে!
ওহ্!
সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পেরে সৈকতের উদ্দেশ্যে চিৎকার দিয়ে বললো জেফরি বেগ, “ছাদের চারপাশটা ভালো করে দেখো…ও ক্যাবল বেয়ে নামে নি! আমি নিশ্চিত! কুড়ালটা টিনের ছাদে ফেলে ধোকা দিয়েছে!”
দ্রুত ভাবতে লাগলো জেফরি তাদের ভবনের কোনদিকে কি আছে। ডানে-বামে বার কয়েক তাকালো সে।
অধ্যায় ৫৫
একটা জানালার শেডে দাঁড়িয়ে আছে বাবলু। হোমিসাইডের ছাদ থেকে র্যাটদের কথাবার্তা আর নীচ থেকে জেফরি বেগের সব কথা স্পষ্ট শুনতে পেরেছে সে।
এ মুহূর্তে ভবনের পশ্চিম দিকের ভবনের তিনতলার জানালার শেডের উপরে আছে।
টাওয়ারের ক্যাবল দিয়ে যে বেয়ে বেয়ে নামা যেতো না তা নয় কিন্তু তাতে ঝুঁকি ছিলো। ক্যাবলটা তার শরীরের ওজন সহ্য করে টিকে থাকবে কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলো না। তাছাড়া ওরকম পিচ্ছিল ক্যাবল বেয়ে পাঁচতলা থেকে নীচে নামাও খুব কঠিন হতো। দুর্ঘটনা ঘটে যাবার বেশ সম্ভাবনা ছিলো।
ছাদের চারপাশটা দেখার সময়ই বাবলু তার পরিকল্পনা একটু বদলে নেয়।
পশ্চিম দিকের এই ভবনটাও হোমিসাইডের মতো পাঁচতলার কিন্তু অপেক্ষাকৃত পুরনো বলে এর উচ্চতা একটু বেশি। ফলে দুটো ভবনের কার্নিশ আর জানালার শেডগুলো একই লেভেলে অবস্থিত নয়। আনুমানিক দুই-আড়াই ফুটের মতো ব্যবধান হবে। অন্যদিকে ভবন দুটোর মাঝে দূরত্ব বড়জোর ছয় ফুটের মতো হলেও কার্নিশ আর জানালার শেডগুলো দেড় ফুটের মতো প্রশ্বস্ত বলে এই দূরত্ব কমে তিন-সাড়ে তিন ফুটের বেশি হবে না।
তার মানে খুব সহজেই একটা থেকে আরেকটায় টপকে যাওয়া সম্ভব।
সুতরাং দেরি না করে কুড়ালটা নীচের গ্যারাজের ছাদের উপরে ফেলে দিয়েই সে পশ্চিম দিক দিয়ে নীচে নামতে শুরু করে।
অন্ধকারাচ্ছন্ন বলে একটু সাবধানে আর ধীরে ধীরে নামছিলো, তাই দুটো তলা পর্যন্ত নামার পরই টের পায় ছাদের উপর কয়েকজন লোক এসে পড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে পাশের ভবনের একটি জানালার শেডের উপর স্থির হয়ে যায়, যাতে করে লাফানোর ফলে কোনো আওয়াজ না হয়।
এখন বুঝতে পারছে জেফরি বেগ তার কারসাজিটা ধরে ফেলেছে। ছাদের লোকগুলোকে চারপাশটা ভালো করে দেখার কথা বলেছে ইনভেস্টিগেটর। বাবলু আবার নীচে নামতে শুরু করলো। এবার দ্রুত গতিতে।
দোতলার কার্নিশে ল্যান্ড করতেই তার উপর ফ্ল্যাশলাইটের আলো এসে পড়লো। হোমিসাইডের ভবনের উপর থেকে তার দিকে আলোটা ফেলা হয়েছে।
শিট! বাবলুর মুখ দিয়ে অস্ফুট শব্দটা বের হয়ে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে একটা জোড়ালো কণ্ঠ শুনতে পেলো সে :
“এদিক দিয়ে নামছে! এদিক দিয়ে!…”
তারপরই হৈহট্টগোল বেধে গেলো যেনো।
.
হোমিসাইডের প্রবেশপথের সামনে যে কংক্রিটের বিশাল লনটা আছে সেখানে দাঁড়িয়ে পাঁচতলার উপর থেকে সৈকতদের হৈহল্লা শুনতে পেলো জেফরি বেগ।
বাবলু তাদেরকে ধোঁকা দিয়ে ভবনের পশ্চিম দিক দিয়ে নেমে যাচ্ছে!
খুব বেশি কিছু না ভেবেই এক দৌড়ে মেইনরোডে এসে পড়লো সে। তাদের অফিস ভবনের চারপাশের অলিগলি তার চেনার কথা নয়। আসা যাওয়ার পথে, ভবনের জানালা দিয়ে যতোটুকু দেখা যায় ততোটুকুই চেনে। পশ্চিম দিকে আরেকটা পাঁচতলা ভবনের পেছনে কোনো রাস্তা আছে কিনা সে জানে না। কিন্তু এটুকু বুঝতে পারছে, বাবলু যখন ওখান দিয়ে নীচে নেমে যাচ্ছে নিশ্চয় কোনো পথ রয়েছে।
দুটো ভবনের মাঝখানে পাঁচ-ছয় ফুটের মতো সঙ্কীর্ণ যে জায়গাটা আছে সেটা আসলে সুয়ারেজ ড্রেন। উপরে বড় বড় কংক্রিটের স্ল্যাব ফেলে ড্রেনটা ঢেকে দেয়া হয়েছে। অন্ধকারাচ্ছন্ন হলেও জেফরি দেখতে পেলো তার উপর অসংখ্য ময়লা আবর্জনা পড়ে আছে। দুটো ভবনের জানালা দিয়ে দিনের পর দিন উচ্ছিষ্ট ফেলে জায়গাটাকে নর্দমা বানিয়ে ফেলা হয়েছে।
কোনো কিছু না ভেবেই জঘন্য সব ময়লা আবর্জনা উপেক্ষা করে জেফরি বেগ ঢুকে পড়লো সেখানে।
বড়জোর দশ ফুটের মতো ভেতরে ঢুকতেই ধপ করে একটা শব্দ শুনতে পেলো সে। বুঝতে পারলো বাবলু লাফ দিয়ে নীচে নেমে পড়েছে। কিন্তু সঙ্কীর্ণ গলিটার ভেতরে কোনো ছায়ামূর্তি চোখে পড়লো না। পিস্তলটা সামনের দিকে তাক করে আবার ছুটে গেলো সে।
এমন সময় হোমিসাইডের ভবনের উপর থেকে ফ্ল্যাশলাইটের আলো ফেলা হলো গলিতে। জেফরি এখন গলির মাঝপথে। এদিক ওদিক প্রক্ষেপিত ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় দেখতে পেলো একটা ছায়ামূর্তি; দৌড়ে ডান দিকে মোড় নিয়ে নিলো।
তার পিছু নিলো জেফরি বেগ। বাবলু এখন নাগালের মধ্যে। দৌড়ের গতি বাড়িয়ে দিলো সে। যে করেই হোক ওকে ধরতে হবে। এক বন্য জেদ চেপে বসেছে তার মধ্যে। কয়েক মুহূর্ত পর সেও ডান দিকে মোড় নিয়ে নিলো।
আশেপাশের ভবনের জানালা দিয়ে মৃদু আলো আসার কারণে এখানটা একটু আলোকিত। জেফরি বেগ সেই আলোতে দেখলো আরেকটা সরু গলি, যথারীতি নোংরা, চলে গেছে সোজা পশ্চিম দিকে। এখানে ময়লার স্তূপ আরো বেশি। দুপাশে যতোগুলো বিল্ডিং আছে সবগুলোর পেছন দিক এটা। গলিটা শেষ হয়েছে ছয়-সাত ফিট উঁচু দেয়ালের কাছে গিয়ে। বাবলু সেই দেয়ালটা টপকাতে যাচ্ছে।
জেফরি বেগ দ্বিধাগ্রস্ত না হয়েই সঙ্গে সঙ্গে গুলি চালালো। সরু জায়গাটা প্রকম্পিত হলো গুলির শব্দে।
কিন্তু বাবলু থামলো না। অনায়াসে দেয়াল টপকে চলে গেলো। গুলিটা যে তার লাগে নি সেটা জেফরি বেগ জানে। সত্যি বলতে, বাবলুকে লক্ষ্য করে গুলিটা করে নি সে।
অসহায়ের মতো নোংরা গলিতে দাঁড়িয়ে রইলো হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর। তার মনের একটা অংশ বলছে দৌড়ে গিয়ে দেয়ালটা টপকাতে, অন্য অংশটা বলছে কোনো লাভ হবে না। বাবলু এখন ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে। এই অংশটারই জয় হলো। পিস্তলটা কোমরে গুঁজে ফিরে গেলো সে।
পরাজিতের মতো মাথা নীচু করে গলি থেকে বের হয়ে এলো জেফরি বেগ।
সৈকত আর অন্য এক র্যাট অস্ত্র হাতে ছুটে এলো তার কাছে।
“স্যার!” সৈকত বললো তাকে।
আস্তে করে মুখ তুলে তাকালো সে। কিছু বললো না।
সোডিয়াম লাইটের উৎকট হলুদাভ আলোতে জেফরির মুখটা খুব বেশি ফ্যাকাশে দেখালো।
অধ্যায় ৫৬
মাঝরাতে সুনসান ঢাকা শহরে ধীরে ধীরে হাটছে বাবলু।
হোমিসাইড থেকে পালিয়ে আসাটা সহজ কাজ ছিলো না। বেশ সময় নিয়ে, ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেছে কখন সুযোগ আসে। জেফরি বেগের কাছে নিজের জীবনের উপাখ্যান বলার কোনো ইচ্ছে তার ছিলো না। সে যদি কিছু না বলতো ঐ ইনভেস্টিগেটর তার মুখ থেকে একটা শব্দও বের করতে পারতো না। কিন্তু সে বলেছে, কারণ তার দরকার ছিলো একটা সুযোগের। আর সেটা আসামাত্রই ব্যবহার করেছে।
এর আগে ব্ল্যাক রঞ্জুর হাতে মারাত্মক আহত হবার পর যখন গ্রেফতার হলো তখন হাসপাতাল থেকে সোজা হোমিসাইডের ইন্টেরোগেশন রুমে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। অমূল্য বাবু অনেক চেষ্টা করেও এটা আটকাতে পারে নি জেফরি বেগের দৃঢ়তার কারণে। অবশ্য জিজ্ঞাসাবাদে সে কিছুই বলে নি। জেফরি বেগও তাকে চাপাচাপি করে নি। ওদের কাছে নাকি মিথ্যে ধরার যন্ত্র আছে! সেটা ব্যবহার করেও খুব একটা ফায়দা হয় নি ভদ্রলোকের।
তবে আজকের রাতের শুরুতে যখন জেফরি বেগের দলবলের কাছে ধরা পড়ে গেলো তখন ভেবেছিলো সারা জীবনের জন্য বুঝি ফেঁসে গেলো। এমনকি অমূল্য বাবুও তাকে এবার উদ্ধার করতে পারবে না। কারণ রাজনসহ তার গ্রুপের চারজনকে খুন করেছে সে। আর এসবের অকাট্য প্রমাণ আছে ঐ জেফরি বেগের কাছে, আগের কেসগুলোর কথা না হয় বাদই দিলো।
আন্ডারকন্ট্রাকশন ভবন থেকে অচেতন অবস্থায় তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে আসা হয় হাসপাতালে। বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরে থাকার কারণে বেঁচে গেলেও বেশ আহত ছিলো। তবে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে সরাসরি তাকে নিয়ে আসা হয় হোমিসাইডের ইন্টেরোগেশন রুমে।
নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন একদম নিশ্চিত হয়ে গেলো তখনই গাঢ় অন্ধকারে ছোট্ট আর মিটমিটে একটি আলোর রেখা দেখতে পেলো সে।
মামুলি একটা জেম ক্লিপ।
তারপর দ্রুত মাথাটা কাজ করতে শুরু করে। জেফরি বেগকে তার নিজের জীবনের গল্পগুলো বলার সময় তার মাথায় একটা জিনিসই কাজ করছিলো : যেভাবেই হোক তাকে মুক্ত হতে হবে। ওখান থেকে পালাতে হবে।
বরাবরের মতোই মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজ করে সফল হয়েছে। এখন সে মুক্ত। বেইলি রোড থেকে একটু দূরে ইস্কাটনের এক নির্জন রাস্তা দিয়ে হাটছে। সে ভেবেছিলো জেফরি বেগ গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়বে, তাকে হন্যে খুঁজবে কিন্তু সেটা হয় নি। তার ব্যাপারে হয়তো হাল ছেড়ে দিয়েছে ভদ্রলোক।
স্মার্ট! মনে মনে বললো সে। বুদ্ধিমানের মতোই কাজ করেছে!
এখন রাত কটা বাজে সে জানে না। সম্ভবত মাঝরাত। রাস্তায় কিছু টহল পুলিশের গাড়ি নিশ্চয় ঘুরে বেড়াচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত একটাও তার চোখে পড়ে নি।
এটা নিশ্চিত, জেফরি বেগ তাকে খুঁজতে বের না হলেও সবগুলো থানার টহল পুলিশকে তার ব্যাপারে জানিয়ে দিয়েছে। সুতরাং, কোনো টহল পুলিশের চোখে পড়া যাবে না। এতো রাতে একজন যুবক নির্জন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে-এটা খুব সহজেই পুলিশের চোখে সন্দেহের উদ্রেক করবে।
মিন্টো রোডে ঢোকার আগে হাতের ডান পাশে রমনা পার্কে ঢুকে পড়লো সে।
এ সময় পার্কে কিছু আজেবাজে লোকজনের উপস্থিতি থাকে, আর থাকে নগরবধূরা। তারা তাকে এই রাতদুপুরে আরেকজন খদ্দের ছাড়া অন্যকিছু ভাববে না।
পার্কের অনেকটা ভেতরে ঢুকে যাবার পরও কোনো পাহারাদারের দেখা পেলো না। চারপাশটা ভুতুরে আর মায়াবি লাগলো তার কাছে। গাছগাছালির ফাঁকে ফাঁকে নিয়ন লাইটের আলো অনেকটা পূর্ণিমা রাতের আবহ তৈরি করেছে। বাবলু সেই বানোয়াট পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় হেঁটে গেলো ধীরস্থিরভাবে।
একটা বিশাল গাছের নীচে কংক্রিটের বেঞ্চ খালি দেখতে পেয়ে বসে পড়লো সে।
এরপর কী করবে সেসব ভাবার জন্য তার দরকার একটু বিশ্রাম।
ভোরের আলো ফোঁটার আগেই পার্ক থেকে চলে যেতে হবে কিন্তু কোথায় যাবে সেটা ভাবতে লাগলো এখন।
অনেক ভেবে অবশেষে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো। ওখানে যাওয়াটা তার জন্য জরুরি। ভালো করেই জানে এতো সকালে তাকে দেখলে ভীষণ চমকে যাবে বাড়ির বাসিন্দা।
অধ্যায় ৫৭
রাতে বাড়ি ফেরার পর না খেয়েই বিছানায় শুয়ে পড়লো জেফরি। কিন্তু দু’চোখের পাতা এক হলো না মুহূর্তের জন্যেও। ভোরের দিকে ক্লান্তিতে একটু ঝিমুনি এলেও প্রচণ্ড মাথা ব্যথার কারণে অতীষ্ঠ হয়ে উঠলো সে। ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করে সোফায় বসে রইলো এমনি এমনি।
এ জীবনে এরকম খারাপ কখনও লাগে নি। এমনকি ফাদারের মৃত্যুতেও এতোটা মুষড়ে পড়ে নি। কেমন জানি ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তার। মনে হচ্ছে এতোদিনের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, অভিজ্ঞতা, সুনাম সব কিছুর উপর বিরাট চপেটাঘাত করা হয়েছে। তার হাতের মুঠোয় থাকা বাবলু এভাবে পালিয়ে যেতে পারলো!
একটা গ্লানি চেপে বসেছে তার বুকে।
সান্ত্বনা পাবার জন্য তার মনের একটা অংশ বার বার প্রবোধ দিচ্ছে, জামান ছেলেটার বোকামিতে এটা হয়েছে। কিন্তু জেফরি ভালো করেই জানে, সব দায় জামানের উপর চাপিয়ে দেয়া যাবে না। তার নিজেরও দায়-দায়িত্ব আছে। বাবলুর হাতে অস্ত্রটা তুলে দিয়েছে সে নিজে।
সামান্য একটা জেম ক্লিপ!
আক্ষেপে আরো একবার পুড়লো। সোফার হাতলে বার কয়েক ঘুষি মারলো সে।
বাবলুর যে ফাইলটা তারা তৈরি করেছিলো সেটার কোনো হার্ড কপি ছিলো না। ইন্টেরোগেশন শুরুর আগে কম্পিউটার থেকে প্রিন্টআউট বের করে নেয় দ্রুত। লুজ-শিটগুলো হাতের কাছে থাকা জেম ক্লিপ দিয়েই আটকে নেয় সে। তখন কি ভেবেছিলো এই সামান্য জেম ক্লিপটাই বাবলু তার মুক্তির চাবি হিসেবে ব্যবহার করবে!
ছেলেটা যে স্মার্ট আর ইনোভেটিভ এটা জেফরির চেয়ে ভালো আর কে জানতো। অনুপ্রবেশ করার কায়দা, বেরিয়ে পড়ার কৌশল, খুনের দক্ষতা, প্রতিপক্ষকে বিভ্রান্ত করা আর খুনে মানসিকতা, সবই রয়েছে তার। কিন্তু তাই বলে সামান্য একটা জেম ক্লিপ!…
যে-রাতটা অপ্রত্যাশিত সফলতা নিয়ে এসেছিলো সে-রাতটাই শেষ হলো চরম ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে।
কী বিচিত্র এ জীবন!
বাবলুকে ধরার জন্য যখন হন্যে হয়ে ছিলো তখন তার টিকিটাও পায় নি। কিন্তু যখন তাকে ধরার কোনো ইচ্ছে তার ছিলো না তখনই কিনা ধরা পড়ে গেলো সে-তাও অন্যরকম একটি ঘটনায়-একদম অপ্রত্যাশিতভাবে।
রাত বেশি হয়ে যাওয়াতে বাবলুর পালানোর ঘটনাটি হোমিসাইডের মহাপরিচালককে জানায় নি। আগামীকাল সকালে ফারুক আহমেদ যখন ফুরফুরে মেজাজে অফিসে আসবে প্রেসবৃফিং করার জন্য তখন তাকে কী বলবে? নাকি সকালে অফিসে আসার আগেই বাসায় ফোন করে পুরো ঘটনাটি জানিয়ে দেবে?
আহ্, বেচারা হয়তো তখন চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে পত্রিকা পড়তে থাকবে।
জেফরি বেগের মনটা খারাপ হয়ে গেলো। মাঝরাতে মানসিকভাবে বিধস্ত হয়ে বাসায় ফিরে আসার পর রেবাকে ফোন করতে ইচ্ছে করছিলো কিন্তু করতে পারে নি। অতো রাতে ফোন করাটা ঠিক হতো না। অনেক কষ্টে রেবার সাথে কথা বলার ইচ্ছেটাকে দমন করেছে সে। মেয়েটার সাথে কথা বললে হয়তো মনটা একটু হালকা হতো।
সোফায় বসে থেকেই ফজরের আজানটা তার কানে গেলো। একটু ঘুম ঘুম ভাব এলেও বিছানায় যেতে ইচ্ছে করলো না। দু’চোখ বন্ধ করে বসে রইলো চুপচাপ।
ঘুমিয়ে পড়ার আগে নিজেকে বাবলুর জায়গায় বসিয়ে জেফরি বেগ কেবল একটা কথাই ভাবতে লাগলো। ওভাবে পালিয়ে যাবার পর সে কি করবে-কোথায় যাবে?
*
দরজার আঘাতগুলো যেনো হাতুড়ি পেটার মতো শোনাচ্ছে। বুক ধরফড় করে বিছানায় উঠে বসলো জেফরি বেগ। চারপাশ আধো-আলো অন্ধকার। কেমন একটা ঘোর ঘোর লাগছে তার কাছে। দরজার আঘাতটা বিরতিহীনভাবে চলছেই।
বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো সে। টের পেলো সম্পূর্ণ নগ্ন! তার শরীরে একরত্তি কাপড়ও নেই। ঘাবড়ে গেলো। ঘরে কেউ না থাকলেও লজ্জায় কুকড়ে গেলো সে। আশ্চর্য! জামাকাপড় খুললো কখন?
চারপাশে তাকালো। গায়ের পোশাকগুলো নেই। এভাবে নগ্ন হয়ে দরজা খুলবে কিভাবে?
এদিকে দরজার আঘাতগুলো যেনো ক্রমশ বেড়েই চলছে।
“কে?” নিজের কাছেই মনে হলো তার কণ্ঠ দিয়ে তেমন আওয়াজ বের হচ্ছে না। আবারো বললো, তবে এবার চিৎকার দিয়ে। “কে!”
দরজার ওপাশ থেকে কোনো জবাব এলো না, বরং আঘাতের তীব্রতা আরো বেড়ে গেলো। দরজাটা যেনো ভেঙেই যাবে।
জেফরি বেগ একচুলও নড়তে পারলো না। এভাবে নগ্ন হয়ে কী করে সে দরজা খুলে দেবে?
বিকট শব্দ করে দরজাটা ভেঙে গেলো নাকি খুলে গেলো সেটা বুঝতে পারার আগেই দেখতে পেলো তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে বাবলু!
আহত, বিধ্বস্ত কিন্তু তার চোখ দিয়ে যেনো আগুন বের হচ্ছে।
জেফরি কিছু বলার আগেই তার ডান হাতটা উঠে এলো।
একটা পিস্তল!
একটুও নড়তে পারলো না। আলপিনের মতো গেঁথে আছে সে।
বাবলুর ঠোঁটে এবার তাচ্ছিল্যের হাসি। তারপরই চারপাশ আলোড়ন তুলে গুলির শব্দ হলো। জেফরি বেগ টের পেলো তার শরীরটা শূন্যে উঠে গেছে। ছিটকে চলে যাচ্ছে দ্রুত বেগে!
লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিলো। বাইরে প্রচণ্ড শব্দ তুলে বজ্রপাত হচ্ছে এখন। বাতাসের ধাক্কায় জানালার পর্দাগুলো উড়ছে। রাত শেষ হলেও অন্ধকার কাটে নি।
কয়েক মুহূর্ত লাগলো ব্যাপারটা বুঝতে।
একটা দুঃস্বপ্ন!
অধ্যায় ৫৮
খুব সম্ভবত দুই যুগেরও বেশি সময় পর অমূল্য বাবু এতোটা চমকে উঠেছিলো।
অস্থিরতা, ঘাবড়ে যাওয়া, কোনো কিছুতে বিস্মিত হওয়া কিংবা চমকে ওঠার মতো তোক সে নয়। বহুকাল আগেই ঐ পর্ব চুকিয়ে ফেলেছে। তার যৌবনের সমাপ্তির সাথে সাথে ওসবেরও তিরোধান ঘটেছে অনেক কাল আগে কিন্তু আজকের দিনটা শুরু হলল চমকে যাওয়ার মধ্য দিয়ে।
খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যেস তার। এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল পান করে কিছুটা জল হাতের তালুতে নিয়ে মাথার উষ্ণীষের উপর চেপে রাখে। তারপর স্নান করে ধ্যানে বসে সে। সকালে দশটার আগে মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হয় না। সেই ভোর থেকে দীর্ঘ সময়টা মৌত করে কাটিয়ে দেয়। এ কাজ করতে তার কোনো সমস্যাই হয় না। অন্য সবার মতো সংসারি হলে, ঘরে স্ত্রী-সন্তান থাকলে এটা করা সম্ভব হতো কিনা কে জানে। সে থাকে সম্পূর্ণ একা। এমনকি বাড়িতে কাজের লোকও রাখে না। নিজের রান্না নিজেই করে। স্বল্পাহারি আর সাত্ত্বিক একজন মানুষ। একেবারে ধরাবাধা তার খাবারে মেনু। আর সেটা নিজের হাতেই রান্না করে। জামা-কাপড় ধোয়া আর ইস্ত্রির কাজটা অবশ্য লন্ড্রির উপরেই ছেড়ে দিয়েছে আর ঘর মোছা, পরিস্কার করার কাজটা করে নিট অ্যান্ড ক্লিন নামের একটি প্রতিষ্ঠানের দু’জন চুক্তিভুক্ত পরিচ্ছন্নতাকর্মী।
তার এই নিয়মনিষ্ঠ সকালটায় আজ বিঘ্ন ঘটেছে।
খুব ভোর থেকেই আবহাওয়া খারাপ। থেমে থেমে বজ্রপাত হচ্ছে, সেইসাথে বৃষ্টি। ঝড়ো বাতাসে জানালার পর্দাগুলো অস্থির হয়ে উঠেছে।
সবগুলো জানালা বন্ধ করে ঠাণ্ডা জল পান করে সে, তারপর হাতের তালুতে কিছুটা জল নিয়ে মাথার উপর যখন চাপতে যাবে তখনই দরজায় টোকা মারার শব্দ হয়। তার এখানে কোনো কলিংবেল নেই। তাকে বাড়িতে ডাকার জন্য খুব বেশি লোক আসেও না।
তখনও চমকে ওঠে নি সে। ভেবেছিলো পত্রিকার হকার বুঝি কোনো কারণে তার সাথে দেখা করতে চাইছে। এই হকার লোকটি বিপদে পড়লে তার কাছ থেকে সাহায্য পেয়ে থাকে। বেচারার এক মেয়ে লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত। সেই মেয়ের চিকিৎসার প্রায় সমস্ত খরচ বহন করে সে।
আস্তে করে উঠে দরজা খুলতেই চমকে ওঠে অমূল্য বাবু। এমনকি তার নিঃশ্বাসও কয়েক মুহূর্তের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকে সে।
তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে বাবলু!
আহত আর বিধ্বস্ত কিন্তু মনোবল অটুট। সেটা তার দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গি দেখলেই বোঝা যায়।
এই ছেলেটা কখনও তাকে আদাব কিংবা সালাম দেয় না। কোনো সন্তান নিজের বাপকে দেখলে যেমন করে বাবলুও তার সাথে ঠিক একই আচরণ করে থাকে।
কোনো কথা না বলে মাথা নীচু করে ঘরে ঢুকে পড়ে সে। যেনো বাপকে না বলে বাড়ির বাইরে ছিলো সারারাত, এখন ঘরে ফিরে এসেছে অপরাধী এক সন্তান!
কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে বাবলু। অমূল্য বাবুই প্রথম মৌনতা ভাঙে।
“মেয়েটাকে তো পুলিশ উদ্ধার করেছে, তাহলে তুমি কি করতে গেছিলে?”
বাবুর এ কথা শুনে অবাক হয় সে, কিন্তু পরক্ষণেই বুঝতে পারে এই লোকের পক্ষে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।
এরপর অমূল্য বাবুর কাছে পুরো ঘটনাটা খুলে বলে।
সব শোনার পর একটা মৃদু দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বাবুর বুকের ভেতর থেকে। “তুমি একটু পরই রিসোর্টে চলে যাবে। এক মাসের মধ্যে ওখান থেকে আর বের হবে না,” অবশেষে আদেশ করে অমূল্য বাবু। “আমি তোমার জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করছি।”
এ কথা বলে ঘর থেকে চলে যায় ভদ্রলোক। দশ মিনিট পরই একটা গাড়ি চলে আসে তাকে নিয়ে যাবার জন্য। কোনো কথা না বলে চুপচাপ চলে যায় সে।
বাবু এখন নিজের ঘরে একা। ভাবছে মানুষের জীবনে আবেগ সব সময়ই বিরাট প্রভাব ফেলে। সে তো কোনো যন্ত্র নয়। তার মধ্যে যুক্তির পাশাপাশি আবেগও থাকবে।
সঙ্গে সঙ্গে সুধরে নিলো। নিকট ভবিষ্যতে যন্ত্রও আবেগ বুঝতে পারবে। যুক্তি আর আবেগের মধ্যে সত্যিকার অর্থে কোনো পাথর্ক নেই! এ হলো যুক্তির ভিন্ন একটি নিয়ম। অঙ্কের যেমন অনেক নিয়ম থাকে-যোগ, বিয়োগ, ভাগ, গুন।
বাবলু যা করেছে তার জন্যে তাকে দোষ দিলো না। এরকম বয়সে সে নিজেও কি এমন আবেগে ভেসে যেতো না?
ছেলেটার এসব কর্মকাণ্ডের কথা শুনে মনে হচ্ছে এটাই যেনো তার নিয়তি। সে সব সময় খুন করবে, তবে ভিন্নভাবে, ভিন্ন ভিন্ন কারণে।
যে ছেলে শৈশব থেকে খুন করতে শিখে গেছে তাকে কেউ স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারবে না। তার কাছে যেকোনো সমস্যার সহজ সমাধান হত্যা-খুন। সে নিজেও চেষ্টা করেছিলো তাকে ফেরাতে, পারে নি। তখনই বুঝতে পেরেছিলো, নিয়তিকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
মনে মনে হেসে ফেললো বাবু। এসব কথা শুনে কেউ হয়তো তাকে অদৃষ্টবাদীদের দলে ফেলে দিতে পারে, ভাবতে পারে নির্দিষ্ট করে রাখা নিয়তিতে বিশ্বাস করে সে। কিন্তু সত্যি হলো এরকম কিছুতে তার বিশ্বাস নেই। সে বিশ্বাস করে একেকটা মানুষের জন্য অনেকগুলো নিয়তি বরাদ্দ থাকে। সেখান থেকে বেছে নেয়ার স্বাধীনতা রয়েছে প্রত্যেক মানুষের। সৃষ্টিকর্তা এটুকু স্বাধীনতা অন্তত দিয়েছে, নইলে মানবসন্তানের কৃতকর্মের বিচার তিনি কিভাবে করবেন?
বাবলুও তার নিয়তি বেছে নিয়েছে। এখানে অমূল্য বাবুর কিছু করার নেই। যার যার নিয়তি তাকেই বেছে নিতে হয়। কেউ সজ্ঞানে বেছে নেয়, কেউ না বুঝেই তাতে নিপতিত হয়।
যারা না বুঝে নিয়তি বেছে নেয়, নিতে বাধ্য হয়, তাদেরকে সাহায্য করা উচিত। একজন শুভাকাঙ্খি হিসেবে সে শুধু ছেলেটাকে বিপদে-আপদে সাহায্য করতে পারে, তার পাশে দাঁড়াতে পারে। এর বেশি না।
অধ্যায় ৫৯
ভোর থেকেই বৃষ্টি। থেমে থেমে বজ্রপাত। এখন রীতিমতো মুষলধারে পড়ছে। মনে হচ্ছে সারাদিনই বৃষ্টি হবে আজ। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই প্লাবিত হয়ে গেছে ঢাকা শহরের বেশিরভাগ পথঘাট। লোকজন বাসের জন্য অপেক্ষা করছে। রিক্সার যাত্রিরা জুবুথুবু হয়ে বৃষ্টির ছ’টা থেকে নিজেদের রক্ষা করার কোনো চেষ্টাই বাদ রাখে নি। আকাশের দিকে তাকালে মনে হচ্ছে সব মেঘ যেনো জড়ো হয়েছে এ শহরের উপর।
কানফাটা শব্দ তুলে একটা বজ্রপাত হলে মেঘলার মনে হলো সেটা বুঝি ট্যাক্সির ছাদেই পড়েছে। বুকে ফুঁ দিলো সে। বেশ ভয় পেয়ে গেছিলো। গাড়ির ঘোলাটে কাঁচ বিরামহীনভাবে পরিস্কার করে যাচ্ছে ওয়াইপার দুটো।
নিজের গাড়ি থাকতেও আজ একটা ইয়েলো ক্যাবে চড়েছে মেঘলা। এর কারণ তার গাড়ির ড্রাইভার খুন হয়ে গেছে। দিহানের অপহরণ আর উদ্ধার হওয়ার পর এখনও নতুন কাউকে এ কাজে নিয়োগ দেয়া হয় নি।
আজ সকালে দিহানকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দিলে মেয়েকে নিয়ে সোজা চলে যায় গুলশানে বাপের বাড়িতে। সবুজ বিশ্বাসঘাতকতা করার পর বাড়ির কাজের লোকদের উপর ভরসা করতে পারছে না তার স্বামী। আজ বাকিদেরকেও বিদায় দিয়ে দেবে। সুতরাং, কয়েকটা দিন শ্বশুর বাড়িতেই থাকুক তারা।
এহসান আরো একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। তারা সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাবে কয়েকদিনের মধ্যেই। ওখানে এহসানের দুই বোন আর অনেক আত্মীয়স্বজন রয়েছে। প্রথমে তাকে আর দিহানকে রেখে চলে আসবে, তারপর ব্যবসা-বাণিজ্য গুছিয়ে নিয়ে সেও স্থায়ী হবে ওখানে। মেঘলা কখনও চায় নি বিদেশে গিয়ে থাকবে কিন্তু এখন নিজের সন্তানের জন্যে সবই মেনে নিতে হচ্ছে তাকে। স্বামীর এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বলার মতো কিছু নেই। তাই চুপচাপ মেনে নিয়েছে। এহসান এখন সেসবের ব্যবস্থা করতেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
এখন এই বাজে আবহাওয়ায় সে বের হয়েছে তার এক বান্ধবীর বাসায় যাবে বলে-তার মা-বাবা এটাই জানে। কিন্তু তার আসল গন্তব্য অন্য কোথাও।
তাদের জীবনের উপর যে কালো ছায়া নেমে এসেছিলো সেটা দ্রুতই কেটে গেছে। মনে হচ্ছে তাদের জীবনটা আবারো সুন্দর আর স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। কিন্তু মেয়েকে জীবিত ফিরে পাবার পরও মেঘলার মনে একটা খচখচানি রয়ে যায়। বাবলুর কি হয়েছে তার কিছুই সে জানতো না। ছেলেটার সাথে কোনো রকম যোগাযোগ করা যায় নি। গতরাতে ওর ফোনে কল করার পর সেটা ধরেছিলো অন্য কেউ। মেঘলা সঙ্গে সঙ্গে লাইন। কেটে দেয়। এরপর থেকে নানান দুশ্চিন্তায় কেটে গেছে সারাটা রাত। দু’চোখের পাতা এক করতে পারে নি। সে জানে আর মাত্র দু’তিনদিনের মধ্যেই দেশ ছাড়বে তারা। বাবলুর সাথে কি তাহলে আর কোনোদিন দেখা হবে না?
একটু আগে তার সব উদ্বেগ উৎকণ্ঠা চলে গেছে। মনে হচ্ছে বুকের ভেতর থেকে সরে গেছে বিরাট একটি বোঝ।
বাবলুর সাথে কোনোভাবে যোগাযোগ করতে না পেরে সে ঐ রিসোর্টে ফোন করেছিলো আবার। ম্যানেজার ভদ্রলোক ফোন ধরলে তাকে চিনতে পারে। গতকাল এই লোকই বাবলুকে ডেকে দিয়েছিলো। বাবলুর কথা জিজ্ঞেস করতেই ভদ্রলোক জানায় সকাল ন’টা সাড়ে নটার দিকে নাকি সে ফিরে এসেছে।
কথাটা শুনে মেঘলার যে কেমন ভালো লাগার অনুভূতি হচ্ছিলো বলে বোঝাতে পারবে না। খুশিতে চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ে গেছিলো। ভাগ্য ভালো এটা তার মেয়ে কিংবা মা কেউই দেখে নি। দেখলে একগাদা মিথ্যে বলতে হতো।
ম্যানেজার লোকটি খুব ভালো। মেঘলাকে নিজে থেকেই বলে, তওফিক সাহেবকে ডেকে দেবে কিনা কিন্তু ভদ্রলোককে অবাক করে দিয়ে মেঘলা জানায়, দরকার নেই। তওফিক সাহেবকে যেনো তিনি কিছু না বলেন। ওর ফোনটা আবারো বন্ধ পাচ্ছে বলে তার কাছে ফোন করে একটু খোঁজখবর নিলো। জরুরি দরকার হলে আবার ফোন করবে। এ কথার পর ম্যানেজার আর কিছু জিজ্ঞেস করে নি।
মেঘলার ধারণা বাবলু তার সাথে ইচ্ছে করে যোগাযোগ করছে না। দিহানকে উদ্ধার করার পর সে নিজে থেকেই আবার দূরে সরে গেছে। অনেকদিন আগে তো সে এটাই করেছিলো। কোনোরকম যোগাযোগ করার চেষ্টা করে নি। সে জানে, এটা তার জন্যে মোটেও সহজ কাজ ছিলো না। ছেলেটাও খুব ভালোবাসে ওকে। তার ভালোবাসার তীব্রতা কতো সে প্রমাণ গতকালই দিয়েছে-তার দিহানকে জীবিত উদ্ধার করেছে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে।
পুলিশ যতোই বলুক তারা উদ্ধার করেছে কিন্তু মেঘলা জানে কাজটা আসলে করেছে বাবলু। পুলিশকে তারা অপহরণের ব্যাপারে কিছুই জানায় নি, ওরা কিভাবে তার মেয়েকে উদ্ধার করবে? তাদের কাজেরছেলে সবুজ যে এ ঘটনার সাথে জড়িত সেটাও বাবলু আবিষ্কার করে। সবুজকে ওর হাতে তুলে দেবার পরই বাবলু দৃঢ়ভাবে তাকে বলেছিলো, চিন্তা না করতে। তার মেয়ে তার কাছে ফিরে আসবে।
পুলিশ এসে বললো তারা উদ্ধার করেছে আর সে বিশ্বাস করবে? কক্ষনোই না! তার ধারণা এর পেছনে অন্য কিছু আছে, আর সেটা বলতে পারবে বাবলু।
এরপরই হুট করে তার মাথায় এই চিন্তাটা আসে-বাবলুর সাথে দেখা করতে হবে তাকে। এ জীবনে আর হয়তো দেখা নাও হতে পারে। দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে ইয়েলো-ক্যাব কোম্পানিতে ফোন করে সে।
হাতঘড়িতে সময় দেখলো মেঘলা। গাড়িতে ওঠার পর প্রায় এক ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। আবহাওয়া খারাপ বলে পথে তেমন একটা যানবাহন নেই। তার ধারণা আর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যাবে ওখানে। ভাবলো, বাবলু তাকে দেখে কতোটা অবাক হবে। তাকে না বলে এভাবে রিসোর্ট চলে আসাতে মোটেও রাগ করবে না। সে জানে, তার কোনো কাজেই বাবলু রাগ করে না। আগেও করতো না। কোনোদিন করবেও না।
বাবলুর মুখটা ভেসে উঠলো তার মনের পর্দায়। দেবদূতের মতো একটা ছেলে। বাচ্চাদের মতো হাসে। দেখলে মনেই হবে না এই ছেলে শৈশব থেকে কতো কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে গেছে। মেঘলার বিশ্বাস হয় এই বাবলু মানুষ খুন করে…
“আপা?” মাঝবয়সী ড্রাইভার ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে উঠলো।
সম্বিত ফিরে পেলো সে। ট্যাক্সিটা চলে এসেছে রিসোর্টের মেইনগেটে।
“ভিতরে যামু?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো মেঘলা।
ক্যাবটা ঢুকে পড়লো রিসোর্টের ভেতর। মেইনরোড থেকে অনেকটা পথ ইটে বিছানো রাস্তা। বৃষ্টির কারণে পিচ্ছিল হয়ে গেছে। এখন একছন্দে বৃষ্টি পড়ছে। বাতাসের ঝাঁপটা কমে এসেছে কিছুটা।
অফসিজন বলে রিসোর্টে লোকজন খুব একটা নেই আর বৃষ্টির কারণে কোনো গেস্টও দেখা যাচ্ছে না বাইরে। রিসেপশন আর অফিসরুমটার সামনে এসে ক্যাবের গতি কমে এলো। ক্যাব ড্রাইভার এই রিসোর্টে আরো অনেকবার এসেছে প্যাসেঞ্জার নিয়ে, সে জানে রিসেপশনের সামনে গাড়ি পার্ক করে রাখাই নিয়ম। কিন্তু মেঘলা ড্রাইভারকে তাড়া দিলো পার্কিং এলাকায় নয়, আরো ভেতরে চলে যেতে।
ক্যাবটা ধীরগতিতে সামনের দিকে এগিয়ে চললো আবার। কিছুক্ষণ পর একটা লজের সামনে এলে মেঘলা ড্রাইভারকে বললো গাড়িটা থামাতে। ক্যাবটা আপ-ডাউন হিসেবে ভাড়া নিয়েছে, এটাতে করেই ঢাকায় ফিরে যাবে কিছুক্ষণ পর। আবহাওয়া খারাপ বলে সঙ্গে করে ছাতা নিয়ে এসেছে মেঘলা। ছাতাটা নিয়ে গাড়ি থেকে নেমেই লজের দরজার কাছে ছুটে গেলো।
বাবলুর লজের দরজায় টোকা দিলো মেঘলা। কোনো সাড়া নেই। আবারো দিলো। ভেতর থেকে কেউ জবাব দিলো না।
নবটা ধরে বুঝতে পারলো লক করা আছে। “বাবলু! বাবলু!” এবার দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে বললো সে। তারপরও কোনো সাড়াশব্দ নেই।
ও এখানে নেই! মনে মনে বললো সে। তাহলে?
কিছু একটা টের পেয়ে পেছন ফিরে দেখলো রেইনকোট পরা এক লোক বৃষ্টির মধ্য দিয়ে হেলেদুলে ছুটে আসছে তার দিকে। মেঘলা নিশ্চিত, এটা বাবলু নয়। হতেই পারে না।