৫০. হাইড অ্যান্ড সিক

অধ্যায় ৫০

জায়ান তার সবচেয়ে প্রিয় খেলাটা খেলছে মামণির সঙ্গে–হাইড অ্যান্ড সিক।

এই খেলাটা প্রতিদিনই খেলে। তার মা সম্ভবত বিরক্ত হয়ে গেছে এতে। কাজের মহিলা সুফিয়াখালার সঙ্গে খেলতে একটুও ভালো লাগে না তার। খালার কোনো আগ্রহই নেই, তার যতো আগ্রহ দিনভর টিভিতে হিন্দি সিরিয়াল দেখায়।

আজকে আম্মু আসার পর ফ্রেশ হবার আগেই বায়না ধরেছিল খেলবে বলে, কিন্তু তার মা বিরক্ত হয়ে বলেছে, খুব ক্লান্ত লাগছে, এখন না। তাছাড়া জায়ান সবার আগে নাস্তা করবে, তারপর না-হয় খেলা। মায়ের সব কথা মেনে নিয়ে এক গ্লাস দুধ আর কর্নফ্লেক্স অনিচ্ছা সত্ত্বেও খেয়ে নিয়েছে, এখন খেলা শুরু করার জন্য অস্থির হয়ে অপেক্ষা করছে সে।

কিন্তু আজ তার মায়ের কী যেন হয়েছে। বাসায় ফিরেই কেমন মন খারাপ করে আছে।

“মামণি?” জোরে ডাক দিলো জায়ান। তার আর সহ্য হচ্ছে না। “জলদি আসো! হারি।”

“আসছি, বাবা,” বেডরুম থেকে জবাব দিলো মা।

যথারীতি সুফিয়াখালা ভলিউম একেবারে কমিয়ে, টিভির সামনে বসে কী সব দেখছে। সারা দিন এসব দেখেও তার মন ভরে না।

সোফায় বসে ছটফট করছে জায়ান। “মামণি?”

“উফ,” তার মায়ের কণ্ঠটা ভেসে এলো। একটু পর উদয় হলো বেডরুম থেকে। “এত অধৈর্য কেন, তুমি? একটু বিশ্রাম নিতে দাও না।”

“সারা দিন তো বাসায়ই ছিলে…অফিসও করোনি।”

দশ বছরের ছেলের কাছ থেকে এমন কথা শুনে অবাকই হলো জায়ানের মা। “আজকাল বেশি পাকনামো করো, বড়দের মতো কথা বলো। কিছু বলি না তো, তাই…”

“কিছু বলি না তো, তাই!” জায়ান অনুকরণ করলো মাকে।

হেসে ফেলল নওরিন খান। ইদানিং এমনটা বেশি করে। ছেলের এই অনুকরণপ্রীতি অবশ্য সুফিয়াখালা বহু কষ্টে সহ্য করে যায়।

“বুঝেছি, এখন আসো…খেলি,” ছেলেকে বলল নওরিন খান।

খুশিতে লাফ দিয়ে সোফা থেকে নেমে পড়লো জায়ান। “তুমি এখানে বসে চোখ বন্ধ করে বসে থাকো…অ্যান্ড কাউন্ট টেন…ওকে?”

“ওকে,” তার মা সোফায় বসে চোখ বন্ধ করে ফেলল।

“নো চিটিং!”

চোখ বন্ধ করেই হেসে ফেলল মা, সেই হাসি যদিও মলিন।

“ওকে, শুরু করো,” জায়ান বলল।

“ওয়ান…টু…থ্রি…”

মা গুণে যাচ্ছে আর জায়ান দেখছে কোথায় লুকালে মা তাকে সহজে খুঁজে পাবে না। আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে চলে গেল মায়ের পেছনে, সোফার আড়ালে। যাবার আগে সুফিয়াখালাকে চোখ রাঙানি দিলো, সে যেন মাকে বলে না দেয়। যদিও কাজের মহিলার কোনো মনোযোগ নেই এসবে।

“নাইন…টেন…” জায়ানের মা চোখ খুলে তাকালো। “ওকে, আমি এখন খুঁজবো। কোথায়…কোথায় আমার স্পাইডারম্যান?…আমার ক্যাপ্টেন আমেরিকা?” ইদানিং স্পাইডারম্যানের পাশাপাশি জায়ানের প্রিয় কমিক্স চরিত্রের জায়গা করে নিয়েছে এটাও।

অমনি কলিংবেলটা বেজে উঠলে অবাক হলো নওরিন খান। সুফিয়াখালাও ফিরে তাকালো দরজার দিকে। এই ফ্ল্যাটে সচরাচর কেউ বেল বাজায় না-দারোয়ান ছাড়া।

কাজের মহিলা বিরক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়ালেও জায়ানের মা এসে হাত তুলে তাকে বিরত করলো। “আমি দেখছি।”

দরজার পিপহোল দিয়ে তাকালো সে। তিনজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। একজন বেশ লম্বা, অন্যজনের মাথায় ক্যাপ। সবার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। গোঁফওয়ালা একজন। তারা সবাই ভেস্ট পরে আছে। ভেস্টের বুকে বাঁ দিকে ইংরেজিতে ছোট্ট করে যে লেখাটা আছে সেটা দেখে ভড়কে গেল।

ডিবি? আমার বাড়িতে?! নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো জায়ানের মা। আবারো বেজে উঠল কলিংবেলটা। “কে?” ভীরু গলায় জানতে চাইলো।

“দরজা খুলুন। আমরা ডিবি থেকে আসছি,” বাজখাই একটা কণ্ঠ বলল দরজার ওপাশ থেকে। “আপনার সাথে কথা আছে।”

পিপহোল দিয়ে দেখলো, গোঁফওয়ালা লোকটিই বলছে। “আ-আমার সাথে কু-কী কথা?” সামান্য তোতলালো জায়ানের মা। কিছুই বুঝতে পারছে না।

“আপনি নওরিন খান না?”

“হ্যাঁ।”

“দরজা খোলেন…সব বলতাছি।”

কিছু বুঝে উঠতে না পারলেও জায়ানের মা দরজা খুলে দিলো।

তিনজন ডিবি পোশাকধারী লোক ঢুকে পড়লো অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরে।

“কী ব্যাপারে কথা বলতে এসেছেন, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি?”

এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে গোঁফওয়ালা লোকটি ফ্ল্যাটের ভেতরটা ভালো করে দেখে নিলো। কাজের মহিলা সুফিয়া ভয়ে দাঁড়িয়ে আছে সোফার পাশে।

“আর কে আছে?”

“এই তো, আমরাই…আর কেউ না,” বলল নওরিন খান।

মাথা নেড়ে সায় দিলো গোঁফওয়ালা। তার বাকি দুই সঙ্গি কিছু বলছে না।

“একটু আগে আপনার এক্স-হাজব্যান্ড উজ্জ্বলের সঙ্গে ঝগড়াঝাটি হইছিল…তখন যে লোকটা তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছে, সে কোন্ ফ্ল্যাটে থাকে?”

হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো নওরিন খান। এমন কী ঘটেছে যার জন্য ডিবি চলে আসবে এখানে।

“ঐ লোক অনেক বড় ক্রিমিনাল, তারে আমরা অনেক দিন ধইরা খুঁজতাছি।”

জায়ানের মা সন্দেহগ্রস্ত চোখে চেয়ে রইলো লোকগুলোর দিকে।

“কোন্ ফ্ল্যাটে থাকে সে?”

ভড়কে গেল সে। “ফ্‌-ফাইভ বি’তে থাকেন।”

“আপনে আসেন আমাদের সঙ্গে, গোঁফওয়ালা হুকুমের সুরে বলল।

“আমি?!” বিস্ময়ে বলে উঠল নওরিন খান। “আমি কেন যাবো, আজব!”

“আপনে ঐ লোকরে ডাইক্যা দিবেন।”

“আমাকে এসবের মধ্যে টানছেন কেন!” অসহায় কণ্ঠে বলল জায়ানের মা।

“আপনি ঐ লোরে ভালা কইরা চিনেন, আপনেরে দেখলে সুরুত কইরা গেট খুইল্যা দিবো,” গোঁফওয়ালা বাঁকা হাসি দিয়ে বলল। “ঝামেলা কম হইবো।”

মাথা দোলালো নওরিন খান। “আমি উনাকে ওভাবে চিনি না, পাশের ফ্ল্যাটে থাকেন, কখনও কথাও হয়নি।”

“এতো কথা কইতাছেন ক্যান? আসেন!” ধমকের সুরে বলল গোঁফওয়ালা।

“আমি যাবো না, আপনারা যান। আমাকে এসবের মধ্যে জড়াবেন না, প্লিজ।”

লম্বা করে লোকটি কোনো কথা না বলে পিস্তল বের করে জায়ানের মায়ের দিকে তাক কারলো। “এতো কথা কইতাছোস ক্যান, বেটি? আয় আমৃগো লগে!”

কাজের মহিলা ভয়ে মুখে হাত চাপা দিলো। নওরিন খান রীতিমতো কাঁপছে এমন মারমুখি আচরণে, তুই-তোকারি শুনে, আর অবশ্যই পিস্তলটা দেখে।

“মামণি!” সোফার পেছন থেকে দাঁড়িয়ে বলল জায়ান।

সঙ্গে সঙ্গে দু-জন লোক তাকালো বাচ্চাটার দিকে। জায়ানের মা পুরোপুরি ভড়কে গেল এবার।

“আসেন,” আস্তে করে বলল গোঁফওয়ালা। নইলে..” কথাটা বলেই জায়ানের দিকে তাকালো ইঙ্গিতপূর্ণভাবে।

ইঙ্গিতটা বুঝে গেল নওরিন খান, ভয়ে ঢোক গিলে মাথা নেড়ে সায় দিলো। “সুফিয়া, তুমি বেডরুমে চলে যাও জায়ানকে নিয়ে,” বলল সে।

কাজের মহিলা সেটাই করলো, ভীত জায়ানকে নিয়ে বেডরুমে ঢুকে পড়লো।

“তুই এগোরে ঘর থেইক্যা বাইর হইতে দিবি না,” ক্যাপওয়ালার উদ্দেশ্যে বলল পুরু গোঁফের লোকটি।

মাথা নেড়ে সায় দিলো ক্যাপওয়ালা।

এরপরই নওরিন খানকে নিয়ে ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে গেল ডিবি’র দু জন।

ফ্ল্যাটের বাইরে এসে জায়ানের মাকে ৫ বি’র দরজার কাছে এগিয়ে যেতে ইশারা করলো গোঁফওয়ালা।

ডিবি’র দু-জন দরজার দু-পাশে দাঁড়িয়ে পড়লো। এখন তাদের দু জনের হাতেই পিস্তল। অদুটো দেখে জায়ানের মা আরো বেশি ভড়কে গেল।

“আপনার কোনো ভয় নাই,” গোঁফওয়ালা বলল নিচু কণ্ঠে। “জানতে চাইলে জাস্ট বলবেন, কথা আছে…জরুরি কথা…ওকে?”

জায়ানের মা ফ্যাল ফ্যাল চোখে চেয়ে রইলো। সত্যি বলতে ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে।

“আরে বেল বাজান,” লম্বু অধৈর্য হয়ে বলল চাপা কণ্ঠে।

গভীর করে শ্বাস নিয়ে কলিংবেলের সুইচ টিপে দিলো জায়ানের মা। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরও কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া গেল না। গোঁফওয়ালা ইশারা করলে দ্বিতীয়বার কলিংবেল বাজানোর জন্য। কথামতো তা-ই করলো কিন্তু এবারও কোনো সাড়া পাওয়া গেল না।

ভুরু কুঁচকে গেল গোঁফওয়ালার।

অধ্যায় ৫১

একটু আগে বেডরুমের অ্যাটাল্ড বাথরুমের দিকে যাবার সময় ফোনে ইনকামিং মেসেজ আসার শব্দটা শুনতে পেয়েছিল। এক বার ভেবেছিল, বাথরুম থেকে ফিরে এসে মেসেজটা ওপেন করবে কিন্তু কী মনে করে যেন ফোনটা হাতে তুলে নিয়েছিল। অবাক হয়েই দেখে, জায়ান আবারো মেসেজ পাঠিয়েছে। কিন্তু মেসেজের নোটিফিকেশনে প্রথম লাইনটা স্ক্রিনে দেখে অবাক হয় সে :

ডু নট ওপেন ইউর ডোর…

সঙ্গে সঙ্গে মেসেজটা ওপেন করে।

ডু নট ওপেন ইউর ডোর। দে উইল কিল

মেসেজটা অসমাপ্ত হলেও বাতাটা বুঝতে সমস্যা হয়নি। দশ বছরের বাচ্চা মেসেজ লিখে শেষ করার আগেই তড়িঘড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। জায়ান কি তার সঙ্গে প্র্যাঙ্ক করছে? যদিও পরিচয়ের পর থেকে এখন পর্যন্ত এমন কিছু করেনি।

তাহলে এমন মেসেজ দিলো কেন?

তার ধারনা জায়ান আসলে তার দরজার সামনে আছে। হয়তো মেসেজের মানেটা উল্টো করে ধরে নিতে হবে তাকে। বেশি খুশি হয়ে জায়ান এমন মজা করেছে। একটু আগে সে মেসেজ করে জানিয়েছিল, মা তাকে তার সঙ্গে মিশতে বাধা দেবে না। মায়ের কাছ থেকে সদ্য অনুমতি পেয়েই সেটার সদ্ব্যবহার করছে নিশ্চয়ই। ক্যাপ্টেন আমেরিকা-স্পাইডারম্যান সেজে কিংবা ভয়ঙ্কর কোনো মাস্ক পরে চলে এসেছে হয়তো।

কিন্তু পিপহোল দিয়ে দেখে, দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে জায়ানের মা!

খুবই অবাক হয়েছিল। একটু আগেই মেসেজ করে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিল মহিলা, এখন নিশ্চয়ই তার ফ্ল্যাটে এসে আবারো কৃতজ্ঞতা জানাতে চাইছে না। আর যদি সেটাই হয়, জায়ান কেন এমন মেসেজ পাঠাবে? তা-ও আবার অসমাপ্ত!

পিপহোল দিয়ে ভালো করে মহিলাকে দেখে নেয়-কেমন আড়ষ্ট হয়ে আছে, চোখেমুখে চাপা আতঙ্ক, মোটেও স্বাভাবিক লাগছে না। ঘন ঘন পলক ফেলছে, চোখের মণিদুটো ডানে-বাঁয়ে দুলছে-অস্থিরতা আর ভয়ের লক্ষণ!

ডানদিকে তাকায় জায়ানের মা, কেউ তাকে কিছু বলে দিচ্ছিল যেন, তারপরই কলিংবেলটা বাজায়। মহিলার চোখেমুখের ভীতিটা আরো বেড়ে যায় তখন।

দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা তার। আন্ডারওয়ার্ল্ডের জীবনে সেই শুরু থেকেই বিপদের গন্ধ সবার আগে পেতো, আর এটাই তাকে অসংখ্য বার বাঁচিয়ে দিয়েছে। গভীর করে শ্বাস নিয়ে নেয়। বুঝতে পারে, মহিলার দু-দিকে কমপক্ষে দু-জন মানুষ আছে। একটু আগে ব্যালকনি থেকে দেখেছে একটা কালো রঙের মাইক্রোবাস এসে থেমেছে এই ভবনের নিচে। ভেবেছিল, ঈদের ছুটিশেষে কোনো পরিবার ফিরে এসেছে।

সম্ভবত ঐ গাড়িতে করে যারা এসেছে, তারাই দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।

কারা এরা? কয়জন এসেছে?

চার-পাঁচজনের কম হবে না, তবে নিশ্চিত হবার উপায় নেই। যদিও বুঝতে পারছে না, ওরা কেন এসেছে। শুধু এটা বুঝতে পারছে, এখান থেকে বেরোতে হবে। কিন্তু এই ছয়তলার উপরে, টপফ্লোরের এই ফ্ল্যাট থেকে। মেইন দরজা ছাড়া কীভাবে বের হবে?

কলিংবেলটা এখনও বেজে চলছে, যেন তাকে তাড়া দিচ্ছে কিছু একটা করতে!

লম্বা করে শ্বাস নিয়ে মাথা খাটাতে লাগলো সে। তাকে খুব দ্রুতই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

ওদিকে কলিংবেলটা বেজেই চলছে!

অধ্যায় ৫২

তৃতীয় বারের মতো কলিংবেল বাজাতে ইশারা করলো গোঁফওয়ালা।

জায়ানের মা তা-ই করলো কিন্তু এবারও সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না ভেতর থেকে। অস্ত্রধারী দু-জন অবাকই হলো, নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিয়ম করে নিলো তারা।

“ঐ লোক কি বাইরে গেছেনি?” ফিসফিসিয়ে জানতে চাইলো লম্বা করে লোকটি।

মাথা দোলালো জায়ানের মা, আস্তে করে বলল, “জানি না। নিজের ফ্ল্যাটে ছিল, এই লোক যদি বের হয়েও থাকে তার পক্ষে দেখার কথা নয়।

ধন্দে পড়ে গেল অস্ত্রধারী দুজন। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে তাদেরকে। এমন নয় যে, কলিংবেলটা নষ্ট-তিনবারই ফ্ল্যাটের ভেতরে বেল বাজার শব্দ শুনতে পেয়েছে তারা।

জায়ানের মাকে এবার দরজায় টোকা দেবার ইশারা করলো লম্বু। মহিলা কম্পিত হাতে দরজায় টোকা দিলো। নিজের অস্থির হৃদস্পন্দন টের পাচ্ছে। এমন বিপদের মধ্যে পড়বে, বুঝতে পারেনি। আজকের দিনটাই তার জন্য অপয়া। কোনো কিছুই ঠিকভাবে হচ্ছে না, সব খারাপ ঘটনাগুলো ঘটছে। মামুনুরের সাথে মনোমালিন্যটা হয়ে গেছে একটু আগে, আর সবচাইতে খারাপ ব্যাপারটা ঘটে গেছে এই ভবনের নিচে। ঘুণাক্ষরেও যেটা ভাবেনি, সেটাই হয়েছে উজ্জ্বল জেনে গেছে তারা এখানে থাকে!

কতো সতর্কই না ছিল। এই বদমাশটার হাত থেকে নিজেকে, জায়ানকে দূরে রাখার জন্য কয়েক মাস আগে খিলক্ষেতের এই নতুন আবাসিক এলাকায় উঠেছে, তারপরও বদমাশটা ঠিকই খুঁজে বের করে ফেলল! আর এখন যে দুই অস্ত্রধারী ডিবি সেজে এসেছে এই ফ্ল্যাটের ভদ্রলোককে ধরতে, সেটার আসল কারণ বুঝতে একটুও সমস্যা হচ্ছে না তার। ডিবি হলে বলতো, রাহিদ হাসান। কিন্তু যে ডাক নামটি কাছের মানুষজন ছাড়া আর কেউ ডাকে না, সেই নাম বলেছে এই লোকগুলো।

এরা উজ্জ্বলেরই লোক, মনে মনে বলল সে। ব্ল্যাক রঞ্জুর লোক! ভয়ে তার রক্ত হিম হয়ে গেল। পাশের ফ্ল্যাটের ভদ্রলোক কী এমন করেছে যে যার জন্যে এভাবে অস্ত্রধারী এসে হানা দেবে? লোকটাকে এরা মেরে ফেলবে নাকি? বুঝতে পারছে না। তবে আজকাল পত্রিকায় প্রায়শই দেখে, ব্ল্যাক রঞ্জুর সন্ত্রাসি বাহিনি প্রচুর খুনখারাবি করছে। তার পরিচিতজনেরাও বলেছে, রঞ্জুর মতো নির্দয় খুনি এ দেশে এর আগে কখনও আসেনি।

হঠাৎ ডান বাহুতে একটা পুঁতো খেয়ে সম্বিত ফিরে পেলো জায়ানের মা। চমকে তাকালো। পুরু গোঁফের লোকটা কটমট চোখে চেয়ে আছে, ভুরু কপালে তুলে ইশারায় জানতে চাইলো, এতোক্ষণ কী ভাবছিল।

নিজেকে সামলে নিলো নওরিন খান। লোকটা আবারো ইশারা করছে কলিংবেল বাজানোর জন্য, অগত্যা তাই করলো।

আগের মতোই কোনো সাড়াশব্দ নেই।

আরেকটু অপেক্ষা করে জায়ানের মাকে দরজার সামনে থেকে সরিয়ে দিলো লম্বু, তার পর দরজার নব ধরে ঘোরালো-দরজাটা ভেতর থেকে লক করা। মুচকি হাসলো সে। দরজা খোলার প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে, একটা মাস্টার কি আর ক্রু-ড্রাইভারের মতো জিনিস আছে তার সঙ্গে। পিস্তলটা কোমরে গুঁজে মাস্টার কি বের করে ডোর নবের লকে ঢোকালো, কয়েক বার এদিক ওদিক ঘুরিয়ে লকটা খুলে ফেলল সে।

“খুইল্যা গেছে, ভাই।” লম্বুটা বলল ফিসফিসিয়ে।

হাসি দেখা গেল গোঁফওয়ালার মুখে, জায়ানের মাকে নিজের ঘরে ফিরে যাবার জন্য ইশারা করলো সে। ভীত হরিণের মতো কম্পিত পায়ে নিজের ফ্ল্যাটে চলে গেল নওরিন খান। জায়ানদের ফ্ল্যাটের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অপর সঙ্গিকে ইশারা করলো, ওদেরকে যেন সামলে রাখে, চোখে চোখে রাখে। বুড়ো আঙুল তুলে দেখালো ক্যাপওয়ালা।

“ওইটার হাতে মেশিন থাকলে তুই শুট করবি,” বলল গোঁফওয়ালা। মাথা নেড়ে সায় দিলো লঘু।

“মেশিন না থাকলে আমি শুট করুম।” গভীর করে দম নিয়ে নিলো সে।

রঞ্জু তাদেরকে এমনটাই করতে বলেছে। মাত্র এক-দেড় ঘণ্টার মতো সময় পেয়েছে তারা, এর মধ্যেই সব প্রস্তুতি নিতে হয়েছে। একটি আবাসিক এলাকায় ঢুকে এমন কাজ করা চাট্টিখানি কথা নয়। ভাগ্য ভালো ঈদের ছুটি চলছে, নইলে এভাবে কাজটা করতে রাজি হতো না। তারা তো সেনাবাহিনি নয় যে পল্টনে বসে অপেক্ষা করবে কখন ডাক আসে। কাজ না থাকলে তারা নিজেদের মতোই থাকে। কারোর আবার ছোটোখাটো ব্যবসাপাতিও আছে। তবে রঞ্জুর হয়ে কাজ করার সুবিধা অনেক বেশি। বিশেষ করে এখন যারা কাজ করে তাদেরকে টাকা-পয়সা নিয়ে ভাবতে হয় না, রঙুর হাত খুলে গেছে, দশ টাকার জায়গায় একশ টাকা দিতে দুবার চিন্তা করে না।

যদিও রঞ্জু গ্রুপে এখন বেশিরভাগ কাজ করে বিভিন্ন এলাকার কিশোর গ্যাংগুলো। আর এইসব পিচ্চিপাচ্চাদেরকে খুব সস্তায় ভাড়া করার কাজটিও করে সে নিজেই। পিচ্চিগুলো একেকটা পাক্কা বদমাশ। হাফপ্যান্ট পরা বয়সে এরা খুনখারাবি করে, মাগিবাজি করে। নেশাপানি তো এদের কাছে ডালভাত। ওদের কেউ ধরা পড়লে সমস্যা হয় না, কারণ পিচ্চিগুলো জানেই না কার হয়ে কাজ করছে। তবে চাইলেও আজকে ঐসব পিচ্চি-পাচ্চাদের পাওয়া যেতো না। ঈদের ছুটিতে কে কোথায় গিয়ে মওজ-মাস্তি করছে কে জানে। অনেকে গ্রামের বাড়িতেও চলে গেছে।

মাঝেমধ্যে পুরনোদেরও ডাক পড়ে নির্ভরযোগ্য এবং বিশেষ কিছু কাজের জন্য। এই কাজটা সেরকমই কিছু। পিচ্চিদের পাওয়া গেলেও তাদের দিয়ে কাজটা হয়তো করাতো না রঞ্জু।

ফ্ল্যাটে ঢোকার আগে গভীর করে দম নিয়ে নিলো গোঁফওয়ালা। তার দিকে উদগ্রীব হয়ে চেয়ে আছে লম্বু। তারা তিনজনের ছোট্ট একটি দল, তাতে সদ্য যোগ দিয়েছে এই ছেলে। ওর বুকের পাটা গ্রাম্য ডাকাতদের মতো, মানুষ খুন করা কোনো ব্যাপারই না। এমন পৈশাচিক লোক গ্রামেগঞ্জে পড়ে থেকে অপচয় হচ্ছিল, তাই তাকে ঢাকায় নিয়ে এসেছে সদ্ব্যবহার করার জন্য।

তারা এখন দরজার দু-পাশে দেয়াল ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে। ভালো করে কান পাতলো-ফ্ল্যাটের ভেতরে জনমানুষের কোনো সাড়াশব্দ নেই, তবে ভেতরে বাতি জ্বলছে। আঙুল তুলে গোঁফওয়ালা তার সঙ্গিকে ভেতরে ঢোকার জন্য ইশারা করলো, সে থাকবে তার ব্যাকআপে।

চোয়াল শক্ত হয়ে গেল লম্বুর। এক হাতে পিস্তল নিয়ে দরজাটা ঠেলেই ঢুকে পড়লো ফ্ল্যাটের ভেতরে, তার পেছনে গোঁফওয়ালা।

ড্রইংরুমে কেউ নেই।

সতর্ক দৃষ্টিতে ফ্ল্যাটের চারপাশটা দেখে নিলো তারা। প্রায় ফাঁকা ড্রইংরুমে এমন কিছু নেই যেখানে একজন মানুষ লুকিয়ে থাকতে পারে। ডান দিকে দেয়াল আর একটা বাথরুম, সামনে ড্রইংরুমের বিশাল বড় জানালাটা, বাঁ-দিকে দুটো বন্ধ দরজা। বুঝতে পারলো, এ দুটো রুমের যে কোনো একটাতে আছে তাদের টার্গেট।

আঙুল তুলে দরজা দুটোর দিকে ইশারা করলো গোঁফওয়ালা। সতর্কতার সঙ্গে পর পর দুটো বন্ধ দরজার নব ঘুরিয়ে দেখলো লম্বা করে লোকটিভেতর থেকে লক করা আছে দুটোরই। অবাক হলো সে। গোঁফওয়ালার সাথে দৃষ্টি বিনিময়ে হলো তার। কোন ঘরে লুকিয়ে আছে ঐ লোক, বুঝতে পারছে না। কোনটার লক খুলবে, ইশারায় জানতে চাইলো।

ভয়ে ইঁদুরের মতো যে লোক গর্তে ঢুকেছে তার জন্য গোঁফওয়ালা একটুও সময় নষ্ট করতে চাইলো না। দুটো দরজার মধ্যে ডান দিকেরটা ইঙ্গিত করলো সে। “লাথি মার!”

লম্বুর খুব পছন্দ হলো এটা। একটু পিছিয়ে গিয়ে সজোরে লাথি মারলো বন্ধ দরজাটায়, খ্যাচ করে শব্দ হলো কিন্তু লা পুরোপুরি খুলল না। সময় নষ্ট না করে আরেকটা লাথি মারতেই দরজাটা খুলে গেল।

খোলা দরজার বাইরে থেকে পিস্তল তাক করে ভেতরে দেখতে পেলো, এই ঘরটায় কোনো বিছানা নেই। একটা ট্রিডমিল আর ব্যয়াম করার কিছু সরঞ্জাম আছে কেবল। ফ্লোরে বিছানো আছে নিল রঙের একটি ইয়োগা ম্যাট।

তারা বুঝে গেল, টার্গেট দ্বিতীয় রুমে আছে। লম্বু সেই ঘরের দরজায় জোরে একটা লাথি মারলো কিন্তু কিছুই হলো। আরেকটা মারার পর বুঝতে পারলো লকটা খুলে গেলেও দরজার উপরের দিকে ছিটকিনি লাগানো আছে।

সঙ্গে সঙ্গে সর্তক হয়ে গেল। তারা এখন পুরোপুরি নিশ্চিত, শিকার এই ঘরেই লুকিয়ে আছে!

গোঁফওয়ালা মাথা নেড়ে সায় দিলো, পিস্তলটা এখনও সামনের দিকে তা করে রেখেছে। তার সঙ্গি পর পর আরো দুটো লাথি মারতেই ছিটকিনি ভেঙে দরজাটা খুলে গেল।

পিস্তল দুটো সামনের দিকে চোখ বরাবর তা করে সতর্ক পদক্ষেপে ঘরে ঢুকে পড়লো লম্বু, দরজার চৌকাঠের সামনে দাঁড়িয়ে রইলো গোঁফওয়ালা।

ঘরটা অন্ধকার, কেউ নেই সেখানে!

ব্যালকনির দরজাটার দিকে এগিয়ে গেল লম্বু, বাঁ-হাতে নবটা ধরে ঘোরালোল করা। শতভাগ নিশ্চিত হয়ে গেল, টার্গেট এই ব্যালকনিতেই আছে। পিস্তলটা বাঁ-হাতে নিয়ে, ডান হাতে পকেট থেকে মাস্টার কি-টা বের করে নবে ঢোকালো সে, খুব সহজেই খুলে গেল লকটা। পিস্তল উঁচিয়ে ধরে দরজাটা খুলে ফেলল।

অবিশ্বাসের সাথেই তারা দেখতে পেলো, ব্যালকনিতেও কেউ নেই!

নিচের দিকে তাকালো লম্বু, যদিও জানে, এখান থেকে কারো পক্ষেই নিচে নামা সম্ভব নয়। কিছু বুঝতে না পেরে গোঁফওয়ালার দিকে তাকালো।

“খানকির পোলায় গেল কই!” অবিশ্বাসে বলে উঠল গোঁফওয়ালা।

কী মনে করে যেন একটু নিচু হয়ে বিছানার নিচটাও চেক করে দেখলো সে। ওখানেও কেউ নেই। পিসি সরকারের মতো ভোঁজবাজি দেখিয়ে বাস্টার্ড উধাও হয়ে গেছে ফ্ল্যাট থেকে! উঠে দাঁড়াতেই কিছু একটা টের পেয়ে চমকে ঘুরে তাকালো। থুপ করে একটা শব্দ হতেই চিৎকার দিয়ে ছিটকে মেঝেতে পড়ে গেল গোঁফওয়ালা।

ক্ষিপ্রতার সাথেই গুলি চালাতে উদ্যত হলো লম্বু, কিন্তু তার পিস্তল থেকে গুলি বের হবার আগেই ভোঁতা আরেকটি শব্দ টলিয়ে দিলো তাকে। গলার কাছে, কণ্ঠা হাড়ের দিকে গুলিটা লেগেছে, সেই অবস্থায়ই পর পর দুটো গুলি চালালো, প্রকম্পিত হলো ছোট্ট ঘরটা।

কিন্তু গুলি দুটোর কোনোটাই নিশানা খুঁজে পেলো না। বাঁ-দিকের দেয়ালে একটা, অন্যটা সিলিং-ফ্যানের কাছে বিদ্ধ হলো।

এই দুটো গুলির শব্দের আড়ালে চাপা পড়ে গেল আরেকটি ভোঁতা শব্দ।

হুড়মুড়িয়ে পাশের বিছানার উপরে পড়ে গেল লম্বু। তারপরও অস্ত্রটা হাত থেকে ছেড়ে দিলো না, তবে সেটা দিয়ে গুলি করার শক্তিও নেই তার। বিছানায় চিৎ হয়ে পড়ে থেকেই দেখতে পেলো, লম্বা নলের পিস্তল হাতে একজন দাঁড়িয়ে আছে বেডরুমের দরজার সামনে। লোকটা আস্তে করে এগিয়ে এলো তার দিকে!

বাস্টার্ড

তীব্র যন্ত্রণার মধ্যেও তার মনে একটা প্রশ্নের উদয় হলো, ভেল্কিবাজির মতো ফ্ল্যাট থেকে কী করে বের হলো এই লোক? কী করেই বা ঢুকলো। এখানে?

অধ্যায় ৫৩

একটু আগে নিজের ফ্ল্যাটে কোণঠাসা হয়ে পড়ার পর কয়েক মুহূর্ত তার মাথাটা কাজ করেনি। তারপর চট করেই একটা সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিল।

সে জানে না ঠিক কতোজন এসেছে তার ফ্ল্যাটে হামলা চালাতে। ওদিকে তার কাছে সাইলেন্সারসহ পিস্তল থাকলেও তাতে গুলি ছিল মাত্র পাঁচটা। কক্সবাজারে অমূল্যবাবু চার রাউন্ড গুলি করার পর আর লোড করা হয়নি। এই অল্প রাউন্ড দিয়ে ওদের সঙ্গে কোনোভাবেই পারা যাবে না। তাছাড়া এ রকম অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরে কয়েকজন অস্ত্রধারীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধ করার মতো বোকাও নয় সে। এসব হিরোইজম সিনেমাতেই মানায়, বাস্তবে না। তাছাড়া সে জানতো, জায়ানের মাকে অস্ত্রধারী দু-জন ঢাল বানিয়ে রেখেছে, ফলে অন্য পথ অবলম্বন করেছিল।

দৌড়ে গিয়ে ক্লোজিট থেকে পিস্তল আর টুল বক্স থেকে একটা স্কু ড্রাইভার পকেটে নিয়ে নেয়। ফ্ল্যাটের মেইন-সুইচটা বন্ধ করার সময়ই শুনতে পায় দরজার লক খোলার চেষ্টা করছে লোকগুলো বাইরে থেকে তার রুমটার ডোরনব লক করে দরজা বন্ধ করে দেয়, এর পর বেডরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে লক করে দেয়ার পাশাপাশি ছিটকিনি লাগিয়ে ব্যালকনিতে

চলে যায় সে। এখানকার সবগুলো ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে কাঁচের স্লাইডিং ডোর না দিয়ে পিভিসি ডোর দেয়া হয়েছে। সেটাও বাইরে থেকে লক্ করে দেয়। দরজাগুলো লক্ করার একটাই উদ্দেশ্যসময়ক্ষেপণ করানো। যারা তার ফ্ল্যাটে ঢুকবে, প্রতিটি ঘর তল্লাশি করবে, দরজাগুলো খুলে দেখবে এটা করতে কিছুটা সময় লেগে যাবে ওদের।

এটুকু সময় তার ভীষণ দরকার।

নিচের দিকে তাকিয়ে দেখে, কালো রঙের মাইক্রোবাসটা মেইনগেটের সামনে নেই, সম্ভবত গাড়িটা ভেতরে ঢুকিয়ে রেখেছে।

তার এই রুমের দক্ষিণ দিককার ব্যালকনিতে গ্রিল নেই। পাশের ফ্ল্যাটটায় ফার্নিশিংয়ের কাজ চলছিল, ঈদের ছুটিতে সেটা বন্ধ আছে। ঐ ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতেও গ্রিল নেই। নতুন এই আবাসিক এলাকা বেশি দিন হয়নি চালু হয়েছে, দোতলা আর তিনতলা ছাড়া বাকি ফ্ল্যাটগুলোর ব্যালকনিতে গ্রিল লাগানোর দরকার মনে করেনি বাসিন্দারা। দুয়েকবার চুরি হলে কিংবা পাশের ফ্ল্যাটে উচ্চতাভীতি নেই এমন সাহসি রোমিওর আবির্ভাব ঘটলে জুলিয়েটদের বাবা-মায়েরা নিজেদেরকে গ্রিলের খাঁচায় পুরে ফেলতে সময় নেবে না।

তার ফ্ল্যাটের মেইন দরজাটা ভেঙে ফেলার শব্দ কানে যেতেই গভীর করে নিশ্বাস নিয়ে নেয় সে। উচ্চতাভীতি তার নেই, তারপরও ছয়তলার উপরে এক ব্যালকনি থেকে আরেক ব্যালকনিতে যাওয়াটা বেশ ভীতিকর আর ঝুঁকিপূর্ণ।

তার ব্যালকনি আর পাশের ফ্ল্যাটের ব্যালকনির দূরত্ব কমপক্ষে দশ বারো ফুট হবে। এই দূরত্ব লাফিয়ে কিংবা অন্য কোনোভাবে ডিঙানো সম্ভব না। কিন্তু এ দুটো ব্যালকনির মাঝখানের জায়গাটায় অসংখ্য ভার্টিক্যাল স্প্যানের গ্রিল দেয়া আছে-ভবনের সম্মুখ দিক থেকে ভেতরের দুটো ফ্ল্যাটের মধ্যে যে প্যাসেজটা চলে গেছে লিফট আর সিঁড়ির দিকে, সেখানে আলো বাতাস ঢোকার জন্য এই ব্যবস্থা। আর্কিটেক্ট হয়তো ভবনের সৌন্দর্য আর আলো-বাতাসের কথা ছাড়া অন্য কিছু ভাবেনি-কিন্তু এটাই তাকে ভীষণ সাহায্য করে এই বিপদে।

ব্যালকনির রেলিং ডিঙিয়ে গ্রিলটা ধরে ফেলে সে, পা রাখে দুটো গ্রিলের মাঝখানের জায়গায়, সতর্কভাবে একটু একটু করে সরে যায় ডানদিকে।

দ্বিতীয় বেডরুমের দরজায় আঘাত হানার শব্দটা কানে গেলেও তাড়াহুড়ো করেনি, কারণ একটু ওদিক হলেই পড়ে যাবে নিচে নির্ঘাত মৃত্যু। সে জানতো, বেডরুমের ছিটকিনিটার কারনে আরেকটু সময় পাবে, ব্যালকনির দরজা খুলতেও লাগবে কিছুটা সময়। তাই নার্ভ ঠিক রেখে আস্তে আস্তে সরে যায় ডানদিকে, পাশের ফ্ল্যাটের ব্যালকনিটার নাগাল পেতেই সেটার রেলিং টপকে উঠে পড়ে। এই ব্যালকনিটাতেও পিভিসি দরজা আছে, সেই দরজাটা ভেতর থেকে যে লক্ করা থাকবে ধরেই নিয়েছিল, সেজন্যে টুলবক্স থেকে একটা স্কু-ড্রাইভারও নিয়ে নিয়েছিল সে।

দু-মাস আগে এখানে ওঠার পাঁচ-ছয়দিনের মাথায় বেখেয়ালে একটা ভুল করে বসেছিল, বাইরে থেকে ফিরে এসে বুঝতে পারে ভেতরে চাবি রেখে রুমের দরজা লক করে বেরিয়ে গেছে। ফ্ল্যাটের মেইন দরজাটা সেগুনকাঠের তৈরি-যেমন ভারি তেমনি মজবুত। ধাক্কাধাক্কি করে ওটা খোলা অসম্ভ। এক তালাচাবিওয়ালাকে ডেকে এনে সমস্যাটার সমাধান করেছিল দারোয়ান। দুশো টাকা পারিশ্রমিক নিয়ে লোকটা যা করলো, তা দেখে অবাক হয়ে যায়। দরজার নবটার গোলাকার বেইজ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কিছুটা খুলে, সেই খোলা অংশের লকের মেকানিজমের নির্দিষ্ট একটি অংশে ভ্রু ড্রাইভার দিয়ে জোরে আঘাত করতেই লকটা খুলে যায়। নতুন শেখা বিদ্যাটা পরের মাসেই কাজে লেগেছিল। দ্বিতীয় বারের মতো রুমে চাবি রেখে বাইরে চলে যাবার পর আর কাউকে ডাকেনি, দারোয়ানের কাছ থেকে ভ্রু-ড্রাইভার নিয়ে লকটা খুলে ফেলেছিল।

আজকে দ্বিতীয় বারের মতো কাজটা করেছে।

কয়েক দিন ধরে বন্ধ ছিল বলে ফাঁকা ফ্ল্যাটটায় গুমোট গন্ধ টের পায়, সন্তর্পণে এগিয়ে যায় টাইলসবিহীন ফ্ল্যাটের মেইন দরজার দিকে। আস্তে করে দরজাটার পিপহোলে চোখ রেখে দেখতে পায়, তার ফ্ল্যাটের দরজা বেশ খানিকটা খোলা, কাছেপিঠে জায়ানের মা নেই, তাই দেরি না করে কোমর থেকে সাইলেন্সর পিস্তলটা বের করে নেয়।

এমন সময় তার বেডরুমের দরজা ভাঙার শব্দটা কানে যায়। ডোরনবটা আস্তে করে খুলে ফেলে, শিকারি পশুর মতো সতর্ক পায়ে ঢুকে পড়ে নিজের ফ্ল্যাটে। আক্রমণকারিরা ব্যস্ত ছিল দরজা ভাঙতে, তারা ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি মেইন দরজা দিয়ে কেউ ঢুকে আক্রমণ করতে পারে তাদের উপরে।

ড্রইংরুমে ঢুকতেই দেখতে পায়, অস্ত্রধারী দুজন তার বেডরুমে ঢুকে পড়েছে দরজা ভেঙে, ফাঁকা ঘরটায় কিছু না পেয়ে হতভম্ব হয়ে পড়েছিল তারা। ততক্ষণে সে নিশব্দে চলে এসেছে তার ঘরের দরজার কাছে।

পিস্তল হাতে গোঁফওয়ালা খাটের নিচটা দেখছে, আর লম্বা মতোন অস্ত্রধারী অন্য দিকে তাকিয়ে আছে।

এটাই ছিল মোক্ষম সুযোগ। প্রথম শটটা নিতে যাবে, তখনই গোঁফওয়ালা সম্ভবত কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছিল। কিন্তু লোকটা কিছু করার আগেই গুলি চালায় সে।

সঙ্গে সঙ্গে বিছানার কাছে লম্বা করে যে অস্ত্রধারী ছিল তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। কিন্তু সে যেটা চায়নি, তা-ই হয়ে যায়-গুলিবিদ্ধ হবার সাথে সাথে এলোপাথারি দুটো গুলি ছুঁড়ে বসে লম্বু। নিচু হয়ে বসে পড়ে সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা গুলি করে সে।

তার পিস্তলের মৃদু শব্দটা চাপা পড়ে যায় অস্ত্রধারীর আর্তনাদের কারণে।

অধ্যায় ৫৪

সে জানে, অন্ত্রধারীর ছোঁড়া দুটো গুলির শব্দ সোয়ান লেক সিটিতে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে।

মেঝেতে পড়ে থাকা লোকটার কাছে এসে ভালো করে দেখলো, অন্ধকারে দেখতে একটু সমস্যা হলেও বুঝতে পারলো গুলিটা লেগেছে বুকে। খুব কাছে থেকে গুলিগুলো করেছে বলে নিশানা ব্যর্থ হয়নি। লোকটার শরীর মৃদু কেঁপে উঠে নিস্তেজ হয়ে গেল।

বিছানার উপরে যে লোকটা পড়ে আছে, সে এখনও মরেনি। সমস্ত শরীর কাঁপছে আর গোঙাচ্ছে। একটা গুলি লেগেছে গলার কাছে, অন্যটা বুকে। এখনও হাতে ধরে রেখেছে পিস্তলটা। ওটা নিতে গিয়ে টের পেলো শক্ত করে অস্ত্রটা ধরে রেখেছে মরণাপন্ন লোকটি। অবাক হলো না, অনেক সময় প্রচণ্ড শকে এ রকমটা হয়ে থাকে। অস্ত্রটা প্রায় জোর করেই ছিনিয়ে নিলো সে। ঝুঁকে লোকটাকে ভালো করে দেখলো। রক্তে ভেসে গেছে বিছানাটা। সাইলেন্সার পিস্তলটা ঠেকালো মৃত্যুপথযাত্রির মাথায়।

“কে পাঠিয়েছে তোমাদেরকে?” শান্ত কণ্ঠে জানতে চাইলো।

গুলিবিদ্ধ লোকটি অবিশ্বাসে তাকালো, জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে আর ঘোৎ ঘোৎ শব্দ করছে এখন।

“কে পাঠিয়েছে?” আবারো জিজ্ঞেস করলো।

“র-রঞ্জু…” বহু কষ্টে শুধু এটুকুই বলতে পারলো সে।

অবিশ্বাসে মাথা দুলিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “রঞ্জু মরে গেছে।”

আরো ঘন ঘন নিশ্বাস নিতে শুরু করলো মরণাপন্ন লোকটি।

“আমি যে এখানে আছি, কিভাবে জানলে?”

প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে জোরে জোরে হিক্কা তুলে স্তিমিত হয়ে পড়লো গুলিবিদ্ধ সন্ত্রাসি।

মেঝেতে পড়ে থাকা প্রথমজনের পিস্তলটা নিতে গিয়ে বেশ অবাক হলো সে। আবছা আলোতেও পিস্তলটার গায়ে বড় করে লেখা নামটা দেখতে পেলো : বিওয়াইআরএনএ!

বায়েরনা? বারনা?

নিশ্চিত হতে পারলো না। এ জীবনে অনেক পিস্তল-রিভলবার ব্যবহার করেছে, কিন্তু এমন জিনিস কখনও দেখেনি। অন্যান্য অটোমেটিক পিস্তলের চেয়ে একটু বেশি মোটাসোটা। পকেটে ঢুকিয়ে নিলো অস্ত্রটা।

দ্রুত ভাবতে লাগলো সে : তার ফ্ল্যাটে দুটো লাশ। ডিবির পোশাক পরে আছে কিন্তু তারা আসলে রঞ্জুর লোক! এ নিয়ে অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে তার মাথায়। এরা কিভাবে জানলো তার কথা? তারপরই মনে পড়লো, একটু আগে নিচের ঘটনাটার কথা। আপাতত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে এখনকার পরিস্থিতি নিয়ে ভাবলো-দু দুটো লাশ কি এই অল্প সময়ের মধ্যে সরাতে পারবে? কোথায় সরাবে? কিভাবে সরাবে?

সে নিশ্চিত, সোয়ান লেক সিটির সচেতন বাসিন্দাদের মধ্যে কমপক্ষে একজন আছে যে পুলিশকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে এরইমধ্যে। জায়গাটা যতো ভেতরেই হোক না কেন, খিলক্ষেত থানা থেকে কতো আর দূরে? বড়জোর দশ-পনেরো মিনিটের পথ।

এমন সময় মনে পড়ে গেল, গাড়িতে করে এসেছে এরা, নিশ্চয়ই আরো লোকজন আছে। ব্যালকনিতে গিয়ে নিচের দিকে তাকালো-কাউকে দেখতে পেলো না। একাধিক লোক থাকলেও সে অবাক হবে না। যে মাইক্রোবাসে করে এসেছে, ওটাতে কমপক্ষে আট-নয়জনের জায়গা হবার কথা। সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক হয়ে উঠল। আর কয়জন থাকতে পারে? দু-জন? তিনজন?

এদিকে তার পিস্তলের ম্যাগাজিনে গুলি আছে মাত্র দুটি। বিছানায় পড়ে থাকা সন্ত্রাসির হাত থেকে যে অস্ত্রটা কেড়ে নিয়েছে, সেটার সাইলেন্সর না থাকলেও তার কাজে লাগবে।

দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে গেল, নিজের ফ্ল্যাটের দরজাটা বন্ধ করে লিফটের দিকে যে-ই না পা বাড়াবে, দেখতে পেলো জায়ানদের ফ্ল্যাটের দরজা দিয়ে বের হয়ে আসছে এক লোক!

তার হাতেও পিস্তল!

একটা সঙ্কীর্ণ প্যাসাজের মধ্যে মাত্র কয়েক গজ দূরত্বে একজন অস্ত্রধারীর মুখোমুখি সে! পিস্তল হাতে তাকে দেখেই চমকে গেল সন্ত্রাসি, তারপরই মরিয়া হয়ে গুলি চালাতে উদ্যত হলো।

কিন্তু প্রথম গুলিটা সে-ই করতে পারলো, যদিও প্রায় সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্রধারীও গুলি চালিয়েছে। সঙ্কীর্ণ প্যাসেজটা কেঁপে উঠল সেই গুলির শব্দে। অল্পের জন্যে তাকে ঘায়েল করতে পারেনি সেটা, গুলিটা একেবারে কাছ দিয়ে চলে গেছে।

পাল্টা গুলি করার আগেই দেখতে পেলো, অস্ত্রধারী জায়ানদের খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে পড়লো আবার।

সে নিশ্চিত, তার সাইলেন্সর পিস্তলে মাত্র একটা গুলি আছে এখন, তারপরও সময়ক্ষেপন না করে দৌড়ে চলে গেল জায়ানদের দরজার কাছে। দেরি হলে বিরাট সমস্যা হয়ে যাবে।

অস্ত্রধারী অবশ্য দরজাটা বন্ধ করার চেষ্টাও করেনি, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ড্রইংরুমটা পেরিয়ে যাবার চেষ্টা করলো, আর তখনই দরজার কাছে এসে গুলি চালালো সে।

মাত্র একটা।

মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো অস্ত্রধারী।

লোকটার বাঁ-কানের ঠিক উপরে গুলিটা লেগেছে।

তারপরই যেটা দেখতে পেলো, সেটা মোটেও আশা করেনি।

অধ্যায় ৫৫

জায়ানদের ফ্ল্যাটের ড্রইংরুমে গুলিবিদ্ধ এক সন্ত্রাসির লাশ পড়ে আছে, তার সামনে অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছে বাবলু।

ছোট্ট জায়ান বেডরুমের দরজার ফাঁক দিয়ে চেয়ে আছে তার দিকে। সেই চোখে অবিশ্বাস আর ভয়। এই মাত্র তার চোখের সামনে খুন করেছে লোকটাকে। ছেলেটার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে তার মা, মুখে হাতচাপা দিয়ে রেখেছে সে। কাজের মহিলা থর থর করে কাঁপছে তার পাশে দাঁড়িয়ে।

নওরিন খান স্তম্ভিত জায়ানকে বেডরুমের ভেতরে নিয়ে যেতে বলল কাজের মহিলাকে।

“আপনার এক্স…সে কে? কি করে?” জায়ানকে পাশের ঘরে নিয়ে যাবার পর জানতে চাইলো বাবলু।

পুরোপুরি বিপর্যস্ত দেখাচ্ছে নওরিন খানকে। চোখেমুখে ভয় জেঁকে বসেছে। “আ-আমার আগেই বলা উচিত ছিল,” কম্পিত কণ্ঠে বলল। “ভুলটা আমারই হয়েছে। জানতাম, ও কিছু একটা করবে। কিন্তু এরকম কিছু করবে, এতো তাড়াতাড়ি করবে, বুঝিনি।” গভীর করে শ্বাস নিয়ে আবার বলল জায়ানের মা, “ও ব্ল্যাক রঞ্জুর খুবই ক্লোজ।”

খুব বেশি বিস্মিত হলো না সে। একজন সন্ত্রাসি এরইমধ্যে তাকে বলেছে, রঞ্জু পাঠিয়েছে তাদেরকে। কিন্তু ঐ লোক তাকে কিভাবে চিনলো? একটু আগে নিচে যা ঘটেছে তার জন্য রেগেমেগে এ কাজ করেছে?

না। এতো সামান্য ঘটনায় এরকম কিছু করবে না।

আবারো মনোযোগ দিলো বর্তমান পরিস্থিতির দিকে। নিজের ফ্ল্যাটে দুটো লাশ, এখানে একটা। বুঝতে পারছে না, কী করবে। তার ঠাণ্ডা আর ধীরস্থির মাথাটাও রীতিমতো এলোমেলো হয়ে পড়েছে আবার। পুলিশ আসার আগে লাশগুলো সরানো অসম্ভব।

নওরিন খানের দিকে তাকালো। মহিলা পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে, চোখেমুখে তীব্র আতঙ্ক। অজানা আশঙ্কায় কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে মুখটা।

“পুলিশ এলে আমাকে হেনস্তা করবে,” কাঁদো কাঁদো হয়ে জায়ানের মা বলল। “সঙ্গে সাংবাদিকও আসবে…টিভিতে দেখাবে, বিরাট বড় কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে! এখন কী করবো আমি!”

বাবলুও জানে কথাটা সত্যি। তার চোখের সামনে দৃশ্যপটটা ভেসে উঠল : ত্রিশ-বত্রিশটা টিভি চ্যানেল, পত্রিকা, নিউজ পোর্টাল-সবখানে জায়ানের মায়ের ছবি ঘুরে বেড়াবে, সেই সঙ্গে ছোট্ট জায়ানও রেহাই পাবে না।

নওরিন খানের সাবেক স্বামী, জায়ানের বাবা কুখ্যাত সন্ত্রাসি ব্লাকরঞ্জুর ঘনিষ্ঠ লোক। মহিলার সমস্যাটা বুঝতে পারলো। তারচেয়েও বড় আশঙ্কা, রঞ্জুর লোকজন আবার হানা দিতে পারে এখানে।

নওরিন খান করুণ মুখে তাকালো। তার চোখেমুখে আতঙ্ক। সামান্য ঘটনায় যারা খুন করতে লোক পাঠায়, তারা তিন-তিনজন লোকের হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নিতে কতোটা মরিয়া হয়ে উঠবে, ধারনাও করতে পারছে না। পুলিশ আর সাংবাদিকেরাও হয়রানি করবে, কিন্তু আসল ভয়টা রঞ্জুর দিক থেকেই। সব কিছু ছাপিয়ে অন্য একটা ভাবনাও অবশ করে ফেলছে তাকে : জায়ান জেনে যাবে তার বাবা বেঁচে আছে। আর সে কুখ্যাত রঞ্জু গ্রুপের লোক!

“আপনাদের এখানে থাকা ঠিক হবে না।”

এমন কথা শুনে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো নওরিন খান।

“ঢাকায় আপনার আত্মীয়-স্বজন আছে না?”

মাথা দোলালো জায়ানের মা। তার বড়বোন আর মা থাকে কানাডায়। বাকি যারা আছে তাদের সঙ্গে খুব একটা সম্পর্ক নেই। থাকলেও সে যেতো না, কারণ তাদের সবাইকেই উজ্জ্বল চেনে। আত্মীয়স্বজনদেরকে এমন বিপদে ফেলতে পারে না সে। রঞ্জুর লোকজন যে রকম নৃশংস, আশ্রয়দাতাকে খুন করতেও দ্বিধা করবে না। সোয়ান লেক সিটির মতো জায়গায় আসার পরও তাকে ঠিকই খুঁজে বের করেছে ঐ বদমাশটা।

“এমন কোনো বন্ধুবান্ধব আছে, যার কথা আপনার এক্স জানে না?” চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল বাবলু।

মাথা নিচু করে ফেলল নওরিন খান। মামনুরের কথা মাথায় এলেও তার কাছে এ রকম সাহায্য চাইতে এখন কুণ্ঠা বোধ করছে, সেই সাথে ভয়ও। উজ্জ্বল হয়তো মামুনুরের বাড়িও চিনে ফেলবে।

আর কিছু না বলে পকেট থেকে ফোন বের করে একটা নাম্বারে ডায়াল করলো বাবলু। ভালো করেই জানে, তার কাছ থেকে ফোন পেয়ে অমূল্যবাবু। ভীষণ অবাক হবে।

“কী হয়েছে?” এই প্রথম ফোনে বাবু আগে কথা বলল। কণ্ঠটা শান্ত শোনা গেলেও তাতে প্রচ্ছন্ন উদ্বিগ্নতার ছাপ আছে।

“একটু আগে আমার ফ্ল্যাটে কিছু লোক এসেছিল।”

“কারা?” এবার স্পষ্টতই উদ্বিগ্ন শোনালো কণ্ঠটা।

“রঞ্জুর লোক।”

ভারি দীর্ঘশ্বাসের আওয়াজটা শোনা গেল ও প্রান্ত থেকে। “তুমি যে ওখানে থাকো, কিভাবে জানলো ওরা?”

“লম্বা গল্প, পরে বলবো। এখন লাশগুলো সরাতে হবে।”

“কতোগুলো?”

“তিনটা।”

ও প্রান্তে থাকা অমূল্যবাবু যে অবাক হয়েছে সেটা বোঝা গেল।

“দুটো আমার ঘরে, অন্যটা পাশের ফ্ল্যাটে।”

“পাশের ফ্ল্যাটে?”

“গুলি খেয়ে ওই ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়েছিল।”

“গোলাগুলির শব্দ হয়েছে?” গম্ভীর কণ্ঠে জানতে চাইলো অমূল্যবাবু।

“হুম।”

“আমার এখানে চলে আসো,” জোর দিয়ে বলল। “দেরি কোরো না, পুলিশ এসে পড়বে।”

“কিন্তু এখানে এতোগুলো লাশ, আমার ফিঙ্গারপ্রিন্ট-”

“ক্লিন করার মতো সময় নেই,” কথার মাঝখানে বাঁধা দিয়ে বলল। “ওসব পরে দেখা যাবে, তুমি চলে আসো।”

কল শেষে ফোনটা পকেটে রেখে দিলো সে। নওরিন খানকে কিছু বলতে যাবে, অমনি ফোনের ভাইব্রেশনের শব্দ শুনে চমকে তাকালো। মেঝেতে পড়ে থাকা সন্ত্রাসির কাছ থেকে আসছে ওটা। নিহতের প্যান্টের পকেট থেকে ফোনটা বের করে দেখলো, ডিসপ্লেতে কলার আইডির জায়গায় লেখা : মামু।

কলটা রিসিভ করলো না সে। তার ধারনা নিচে যে আছে সে কল দিয়েছে। এখান থেকে বের হবার আগে এই লোককে মোকাবেলা করতে হবে।

“আমি না আসা পর্যন্ত ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করে রাখবেন,” নওরিন খানকে বলল সে। মেঝেতে পড়ে থাকা সন্ত্রাসির সানক্যাপটা তুলে নিয়ে পরে নিলো। এই ভবনের নিচে সিসিক্যাম আছে, সেগুলো রঞ্জুর লোকজন নষ্ট করেছে কি না সে জানে না। কিন্তু সোয়ান লেক সিটির অন্য ভবনের সিসিক্যামগুলো নিশ্চয়ই সচল আছে।

লিফটে করে না গিয়ে সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নিচে নেমে গেল। সময়টা নিয়ে ভীষণ চিন্তিত, যে কোনো সময় পুলিশ এসে পড়তে পারে, আর সেটা হলে বিরাট বড় সমস্যায় পড়ে যাবে।

পার্কিং এরিয়ায় পৌঁছাতেই বিস্ময়ের সঙ্গে দেখতে পেলো, এক লোক ফোন হাতে লিফটের দিকে এগিয়ে আসছে, চোখেমুখে অজানা আশঙ্কা।

এই লোকটাকে সে ভালো করেই চেনে।

তায়েব।

চোখাচোখি হতেই থমকে দাঁড়ালো তায়েব। দুচোখ বিস্ফারিত হলো তার। সম্বিত ফিরে পেয়েই উল্টো দিকে ঘুরে পড়িমরি করে দৌড় দিলো।

দুই মাস আগে ক্সবাজারে এই লোকটাকে বলতে গেলে জীবন ভিক্ষাই দিয়েছিল। একজন মহিলাকে বিধবা করতে চায়নি, চায়নি তিন-তিনজন সন্তানকে অনাথ করতে। কিন্তু অপরাধ জগতে যে ক্ষমার কোনো স্থান নেই, আরেক বার বুঝতে পারলো।

তায়েবের পিছু নিলো না, গুলিও করলো না। কারণ সন্ত্রাসিদের কাছ থেকে নেয়া পিস্তলে সাইলেন্সার নেই।

যে কোনো সময় পুলিশ চলে আসবে এখানে। যতো দ্রুত সম্ভব চলে যেতে হবে। কালো রঙের যে মাইক্রোবাসটায় করে রঞ্জুর লোকগুলো এসেছিল সেটা ফেলেই চলে গেছে তায়েব। মেইনগেটের ভেতরে সামনের দিকে মুখ করে গাড়িটা রাখা আছে, যেন অপারেশন শেষে সোজা বের হয়ে যেতে পারে। গাড়ির কাছে কাছে গিয়ে সিকিউরিটি বক্সের দিকে তাকালো, কাউকে দেখতে পেলো না। দারোয়ান সম্ভবত প্রাণের ভয়ে পালিয়েছে। গাড়ির ড্রাইভিং ডোরের কাঁচ নামানো, ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখলো, ইগনিশনে চাবি ঝুলছে। মাইক্রোবাসের মাঝখানের সিটের উপরে কম্পিউটারের সিপিউটা দেখে বুঝে গেল, এখানকার সিসিক্যামগুলোর ফুটেজ নিয়ে নিয়েছে ওরা। এই গাড়িটাই ব্যবহার করবে বলে ঠিক করলো। লিফটে করে উপরে চলে গেল আবার।

“আমি…দরজা খুলুন,” জায়ানদের ফ্ল্যাটে টোকা মেরে বলল।

দরজা খুলে দিলো জায়ানের মা।

“ওদের আরেকজন লোক ছিল নিচে,” বলল সে। “পালিয়ে গেছে।”

ভয়ার্ত চোখে তাকালো নওরিন খান।

“আবারো বলছি, আপনাদের এখানে থাকাটা ঠিক হবে না।”

কী বলবে বুঝতে পারলো না নওরিন খান।

“পুলিশ আসবে, সাংবাদিকও আসবে…এই সময়টা অ্যাভয়েড করতে হবে আপনাদেরকে।”

নওরিন খানও এ নিয়ে ভীষণ চিন্তিত। পরিস্থিতিটা সে-ও বুঝতে পারছে, কিন্তু কী করবে সেটাই মাথায় ঢুকছে আছে। “কোথায় যাবো আমরা?” অসহায়ের মতো বলল।

একটু ভেবে নিলো সে। “আমার এক কাকার বাড়িতে থাকতে পারেন কয়েকটা দিন।”

নওরিন খান হ্যাঁ-না কিছুই বলতে পারলো না। তার হয়ে সিদ্ধান্তটা দিয়ে দিলো বাবলু।

“টাকা-পয়সা আর দরকারি কাগজপত্র একটা ব্যাগে নিয়ে নিন, আমি আসছি…জলদি করবেন।”

কথাটা বলেই দৌড়ে নিজের ফ্ল্যাটে চলে গেল, ঝটপট একটা জুতো পরে নিয়ে ল্যাপটপটাসহ কিছু কাগজপত্র ডাফেল ব্যাগে ভরতেই তার ফোনটা বেজে উঠল।

“কোথায়?” অনেক বেশি উদ্বিগ্ন শোনালো অমূল্যবাবুর কণ্ঠটা।

“বের হবো এখন।”

“পুলিশ দশ-পনেরো মিনিট আগেই রওনা দিয়েছে, যেকোনো সময় চলে আসবে…ওখান থেকে বের হও!” অস্থির শোনালো কণ্ঠটা।

বাবু এটা কিভাবে জানলো, প্রশ্নটা মাথায় উদয় হলেও সেটা নিয়ে ভাবার সময় নেই এখন।

“ইয়ে মানে…” কথাটা বলতে দ্বিধা বোধ করলো।

“কিছু বলবে?” তাড়া দিলো অমূল্যবাবু।

“পাশের ফ্ল্যাটের এক মা আর তার বাচ্চা ছেলে…ওদেরকে শেল্টার দিতে হবে কিছু দিন।”

ফোনের ওপাশে কয়েক মুহূর্তের জন্য নিরবতা নেমে এলো। “ঐ মেয়ে আর তার বাচ্চাটা?”

কয়েক মুহূর্ত লাগলেও বুঝতে পারলো সে। অমূল্যবাবু মনে করছে, মেঘলা আর তার মেয়ের কথা বলছে। “ওরা না…এরা আমার পাশের ফ্ল্যাটে থাকে।”

“ওদের কী সমস্যা?”

আবারো গভীর করে নিশ্বাস নিয়ে নিলো বাবলু। “লম্বা গল্প।”

অমূল্যবাবু বেশ জোরে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “মনে হচ্ছে অনেক লম্বা গল্প শুনতে হবে। ঠিক আছে, এক্ষুণি চলে আসো।”

ফোনটা পকেটে রেখে আবারো চলে এলো জায়ানদের ফ্ল্যাটে।

“চলুন, পুলিশ এসে পড়বে!” তাড়া দিয়ে বলল সে।

নওরিন খানের বোধবুদ্ধি যেন লোপ পেয়ে গেছে, সম্মোহিতের মতো কাজের মহিলা আর জায়ানকে নিয়ে বের হয়ে এলো ফ্ল্যাট থেকে।

ইচ্ছে করেই জায়ানদের ফ্ল্যাটের দরজাটা লক করলো না বাবলু। লিফট দিয়ে নিচে নেমে অনেকটা দৌড়ে মাইক্রোবাসটার স্লাইডিং ডোর খুলে দিলো। জায়ানদের ভেতরে ঢুকে পড়ার জন্য ইশারা করে ড্রাইভিং সিটে বসে গভীর করে শ্বাস নিলো সে। স্লাইডিং ডোরটা বন্ধ করার শব্দ কানে যেতেই শুনতে পেলো সোয়ান লেক সিটির মেইনগেটটা খুলে যাচ্ছে। গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে গেট থেকে একটু বের হতেই দেখতে পেলো, পুলিশের গাড়িটা ঢুকে পড়েছে ভেতরে!

অধ্যায় ৫৬

জায়ান তার মাকে জাপটে ধরে চোখ বন্ধ করে রেখেছে।

ছেলেকে শক্ত করে ধরে আছে নওরিন খান। তার মুখ থমথমে। বাচ্চা ছেলেটা প্রচণ্ড ভয়ে কাঠ হয়ে আছে। এমন শক পেয়েছে যে, এখনও ধাতস্থ হতে পারছে না।

রিয়ার-মিরর দিয়ে পেছনের সিটে তাকালো বাবলু। এমনিতেও তাকে সান্ত্বনা দিতে পারতো না সে, এসব তার ধাতে নেই। তার চেয়ে বড় কথা, ওকে দেখেছে গুলি করে মানুষ মারতে। দুজনের মধ্যে যে হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিল, সেটার মাঝে যেন শক্তপোক্ত দেয়াল উঠে গেছে এক নিমেষে। জায়ান তাকে ভয় পাচ্ছে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। গুলিটা না করে উপায় ছিল না।

আরেকটু দেরি হলেই ধরা পড়ে যেতো। অমূল্যবাবু যদি ফোন করে না জানাতো, বের হবার আগেই পুলিশ চলে আসততা তাদের বিল্ডিংয়ের সামনে। তবে তার নার্ভ শক্ত বলে, উপস্থিত বুদ্ধির জোরে এ যাত্রায় বেঁচে গেছে। গাড়িটা নিয়ে বের হতেই যখন দেখতে পেলো, পুলিশের পিকআপ ভ্যানটা মেইনগেট দিয়ে ঢুকে পড়েছে, তখন তাড়াহুড়ো করে এক্সেলেটেরে পা দাবায়নি। মাথার ক্যাপটা আরো নিচু করে পেছনে থাকা জায়ানের মায়ের উদ্দেশ্যে বলেছিল, তারা সবাই যেন মাথা নিচু করে রাখে।

পুলিশের গাড়িটা মেইনগেট দিয়ে ঢুকে পড়তেই এক্সেলেটরে পা দাবায়, লেক-সাইড রাস্তা দিয়ে ছুটে যেতে শুরু করে। রিয়ার-মিররে দেখে নেয়, পুলিশ তাদের পিছু নিয়েছে। ওদিকে মেইনগেটটা বন্ধ করতে উদ্যত হয়েছে দারোয়ান। এক হাতে স্টিয়ারিং ধরে অন্যহাতে সন্ত্রাসিদের পিস্তল দিয়ে পর পর দুই রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছুঁড়লে গেটটা না লাগিয়েই দারোয়ান প্রাণ ভয়ে দৌড়ে পালায়। পুলিশের গাড়িটাও তাদের পিছু নেয়নি। এই সুযোগে দ্রুত গতিতে মেইনগেট দিয়ে কোনো রকম বাধা ছাড়াই বের হয়ে যেতে পেরেছিল গাড়ি নিয়ে।

পুলিশের গাড়িটা যেহেতু ঢুকেছে, ধরে নেয় রঞ্জুর আর কোনো লোক বাইরে নেই। তারপরও সতর্ক দৃষ্টি রাখে আধাকাঁচা-পাকা রাস্তাটা পার হবার সময়। ফাঁকা গুলি করার পরই পুলিশের গাড়িটা থেমে গিয়েছিল, হয়তো ওয়াকিটকিতে তারা জানিয়ে দিয়েছে রাস্তার টহল পুলিশকে, তাই প্রচণ্ড গতিতে ছুটতে শুরু করে।

এখন ঢাকা-ময়মনসিংহ হাইওয়েতে উঠে আসার পর অনেকটাই নিশ্চিন্ত হয়ে গেল, পুলিশের কোনো টহল দল এখনও তাদের পিছু নেয়নি।

এয়ারপোর্টটা পার হয়েই হাইওয়ে থেকে উত্তরার ৫ নাম্বার সেক্টরে ঢুকে পড়লো। আবাসিক এলাকার ভেতর দিয়ে গেলে বেশি নিরাপদ। গাড়ির গতি স্বাভাবিক করার পর বাবুকে একটা ফোন দিলো সে।

“কোথায় তুমি?” কলটা রিসিভ করেই উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইলো অমূল্যবাবু।

“রাস্তায়…একটু পরই চলে আসবো।”

“কোনো সমস্যা হয়েছিল?”

একটু ইতস্তত করলো বাবলু। “না।” কলটা কেটে দেয়া হলে ফোন রেখে দিলো সে।

“আমরা কোথায় যাচ্ছি?” পেছনের সিট থেকে জানতে চাইলো জায়ানের মা।

রিয়ার-মিরর দিয়ে পেছনে তাকালো। “এখানেই…আমার এক কাকার বাড়িতে।”

নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো মহিলা। “সুফিয়াকে এসবে না জাড়ানোই ভালো। আমি ওকে কিছু টাকা দিয়ে দেই, ও ওর বোনের কাছে চলে যাক।”

গাড়ি চালাতে চালাতেই মাথা নেড়ে সায় দিলো বাবলু।

“আমি আপনেগো লগেই যামু, আপা…” মহিলা অনুনয় করে বলল। “এই বিপদে আপনেরে, বাবুরে ফালাইয়া আমি কুনোহানেও যামু না।”

“সুফিয়া, তুমি বুঝতে পারছে না, আমাদের সঙ্গে এখন তোমার থাকার দরকার নেই,” জায়ানের মা বোঝানোর চেষ্টা করলো। “তুমি তোমার বোনের বাড়িতে চলে যাও…নইলে গ্রামে। এখানে সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে গেলে আমি তোমাকে ফোন দেবো।”

“না, আপা…আমি যামু না।”

বাবলু রিয়ার মিরর দিয়ে দেখলো। কাজের মহিলা আন্তরিকভাবেই চাইছে এটা, শুধু বলার জন্য বলছে না। কিন্তু জায়ানের মা রাজি হলো না, বোঝানোর চেষ্টা করলো।

“তুমি দেখেছো না, কী হয়ে গেল!” মহিলার কাঁধে হাত রাখলো নওরিন। “আমরা কয়েকটা দিন অন্য কোথাও থাকবো…” তারপর চাপাস্বরে বলল বাকি কথাটুকু।

সামনের সিট থেকে সে সব কথা বাবলু শুনতে পেলো না।

অবশেষে সুফিয়াকে বোঝাতে সক্ষম হলো জায়ানের মা। “ও এখানেই নেমে যাক।”

গাড়িটা রাস্তার এক পাশে থামালো সে। কাজের মহিলাকে কিছু টাকা দিয়ে জড়িয়ে ধরলো নওরিন খান। “ভালো থেকো, সুফিয়া…কিছু দিন পর তোমাকে ফোন দেবো। আমাদের জন্য দোয়া কোরো।”

সুফিয়ার চোখে অশ্রু। জায়ানকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেলো। “আল্লা আপনাগোরে ভালা রাখবো। আমি খাস দিলে দোয়া করুম, আপা। জায়ারে দেইখ্যা রাইখেন।”

মহিলা গাড়ি থেকে নেমে গেলে জায়ানের মা-ও চোখ মুছলো।

রিয়ার মিরর থেকে চোখ সরিয়ে গাড়িটা আবার চালাতে শুরু করলো বাবলু। বাকি পথটুকু কেউ কোনো কথা বলল না।

উত্তরার এগারো নাম্বার সেক্টরের একটি দোতলা বাড়ির সামনে গাড়িটা থামতেই দু-বার হর্ন বাজালো, একটু পর ষোলো-সতেরো বছরের এক ছেলে মেইনগেটটা খুলে দিলো ভেতর থেকে। গাড়ি নিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো সে।

পুরনো ধাঁচের বাড়ি, সামনে বেশ কিছুটা ফাঁকা জায়গা। গাড়ি রাখার গ্যারেজটা বাড়ির ভেতরের দিকে হলেও মাইক্রোবাসটা ওখানে নিয়ে গেল না বাবলু।

“আদাব, দাদা,” গাড়ি থেকে নামতেই ছেলেটা বলল।

কক্সবাজার থেকে ঢাকায় আসার পর প্রায় সপ্তাখানেক এই বাড়িতে থেকেছে বাবলু, তখনই নন্দ নামের ছেলেটার সঙ্গে তার পরিচয় হয়ছিল।

“কাকা সামনের ঘরেই আছেন।”

জায়ান আর তার মাকে নিয়ে বাবলু চলে গেল বাড়ির ভেতরে।

ড্রইংরুমে ঢুকেই দেখতে পেলো, অমূল্যবাবু সাদা পাজামা আর একটা হালকা নিল রঙের ফতুয়া পরে সোফায় বসে আছে।

বাবলু তাকে নমস্কার দিলো না-তাদের সম্পর্কের মধ্যে এসব সৌজন্যতা নেই।

“ওর নাম জায়ান,” বাচ্চাটাকে দেখিয়ে বলল বাবলু। “উনি জায়ানের মা।”

অমুল্যবাবু স্থিরদষ্টিতে তাকালো জায়ান আর তার মায়ের দিকে। মহিলা নিশব্দে সালাম দিলে মাথা নেড়ে জবাব দিলো। “নন্দ, উনাদেরকে উপরতলায় নিয়ে যাও।”

বাবলু ইশারা করলে জায়ানের মা তার ছেলেকে নিয়ে চুপচাপ নন্দর সঙ্গে চলে গেল পাশের ঘরে।

“রঞ্জুর লোকজন কিভাবে জানতে পারলো তুমি ওখানে থাকো?” শান্তকণ্ঠে জানতে চাইলো বাবু।

পাশের একটা সোফায় বসে পড়লো বাবলু। “ঐ বাচ্চাটার মা পাশের ফ্ল্যাটে থাকে…মহিলার এক্স হাজব্যান্ড রঞ্জুর ঘনিষ্ঠ লোক।”

অমূল্যবাবুর ভুরু সামান্য উঠে গেল।

“ঐ লোক আজকে সোয়ান লেকে এসেছিল, মহিলাকে কী নিয়ে যেন হুমকি ধামকি দিচ্ছিল, তখনই আমাকে দেখে ফেলে।”

“তাকে দেখে তুমি চেনোনি?”

“না। ওই লোক আমাকে কিভাবে চিনলো সেটাও বুঝতে পারছি না।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল অমূল্যবাবু। “তাহলে রঞ্জু বেঁচে আছে।”

বাবলু চুপ মেরে রইলো। যদিও কথাটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে কিন্তু যে ঘটনা ঘটে গেছে, তাতে করে মনে হচ্ছে, এই অসম্ভব ঘটনাটিই হয়তো সত্যি।

“কয়জন এসেছিল?”

“চারজন।” এরপর ঘটনাটা সংক্ষেপে বলে গেল সে।

“বাচ্চাটাই তাহলে বাঁচিয়ে দিয়েছে তোমাকে,” সব শুনে বলল। অমূল্যবাবু।

“হুম,” সায় দিলো বাবলু। “আমার ফ্ল্যাটে দুটো ডেডবডি আছে…ওদের ফ্ল্যাটে আরেকটা।”

গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়লো বাবু। তার চোখেমুখে উদ্বিগ্নতার ছাপ নেই।

এখনও এই মানুষটার ক্ষমতা সম্পর্কে পুরোপুরি ধারনা নেই বাবলুর। তবে এটুকু জানে, ক্ষমতার কেন্দ্রে যারা থাকে, তাদের সঙ্গে অমূল্যবাবুর ওঠাবসা।

“ওদেরকে পুলিশ-সাংবাদিক খুব ঝামেলায় ফেলে দিতো…” বলল সে। “রঞ্জুর দলও খুঁজতো…কয়টা দিন ওখানে না থাকাই ভালো।”

“এরপর কি আত্মীয়-স্বজনের বাসায় চলে যাবে?”

“মহিলার এক্স ওসব জায়গা চেনে, ওখানে গিয়ে হানা দেবে, ওদের ক্ষতি করার চেষ্টা করবে।”

“তাহলে অন্য কোথাও রাখার ব্যবস্থা করতে হবে কয়েকটা দিন।”

“হুম।”

“পুলিশ ওদের খুঁজবে তো।”

“পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হবার পর পুলিশের কাছে গিয়ে সব খুলে বলবে..যা ঘটেছে সব।”

সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো অমূল্যবাবু।

“ওরা কেউ আমার নাম জানে না।”

একটু অবাকই হলো, তবে দ্রুতই অভিব্যক্তি পাল্টে ফেলল বাবু। “আমি দেখছি ওদের ব্যাপারটা। তুমি কয়েক দিনের জন্য আমার পরিচিত এক লোকের কাছে গিয়ে থাকো…আমি ব্যবস্থা করছি।” একটু থেমে আবার বলল, “যতোবার ব্যক্তিগত আবেগের বশে কাজ করেছো, তোমার জন্য সেটা বিপজ্জনক হয়েছে…ভুলে যেয়ো না।”

মলিন হাসি দিলো বাবলু। সে-ও জানে কথাটা সত্যি, তবে জায়ানদের ব্যাপারটা আলাদা। ছেলেটার প্রতি তার মায়া-মমতা আছে, তারচেয়ে বেশি আছে দায়িত্ববোধ। এমন সঙ্কটের মূহুর্তে ওদেরকে ফ্ল্যাটে রেখে আসা সম্ভব ছিল না, একদল নেকড়ের মুখে ঠেলে দেয়ার শামিল হতো সেটা। ওদের স্বাভাবিক জীবনটা তছনছ করে দিতে নির্দয়ভাবে। এসব থেকে বাঁচতে হলে ওখান থেকে সরে পড়া ছাড়া আর কোনো পথ ছিল না।

“নন্দ?” ডাকলো অমূল্যবাবু।

ছেলেটা ঘরে ঢুকলো।

“উনাদের জন্য খাবার নিয়ে আয়,” বলেই বাবলুর দিকে তাকালো। “তুমি ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিও।”

মাথা নেড়ে সায় দিয়ে পাশের ঘরে চলে গেল বাবলু।

একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো অমূল্যবাবুর ভেতর থেকে। বাবলু তাকে ঘটনাটা জানানোর পরই খিলক্ষেত থানায় ফোন দিয়েছিল-তার অ্যাপার্টমেন্টে কে বা কারা গোলাগুলি করেছে। থানার ওসি তখন জানায়, এরই মধ্যে ফোর্স চলে গেছে ওখানে। কততক্ষণ লাগতে পারে পৌঁছাতে-এমন প্রশ্নের জবাবে ওসি বলেছিল, দশ মিনিটেরও কম লাগবে। সঙ্গে সঙ্গে বাবলুকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিল সেটা। এখন বুঝতে পারছে, অল্পের জন্য পুলিশের হাত থেকে বেঁচে গেছে।

অধ্যায় ৫৭

দোতলার একটি ঘরের বিছানায় বসে আছে নওরিন খান, পাশে একটা সিঙ্গেল সোফায় চুপচাপ বসে আছে জায়ান। চঞ্চল ছেলেটা একেবারেই নিশুপ হয়ে গেছে। এমন কি ট্যাবও খেলছে না।

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো নওরিনের ভেতর থেকে। মামুনুরকে ফোন দিয়ে ঘটনাটা জানানো উচিত, ফ্ল্যাটটা ও-ই ভাড়া করে দিয়েছে।

ডিভোর্সের পর থেকে তাকে সব ধরণের সাহায্য সহযোগিতা করেছে সে। যখন উজ্জ্বলকে ডিভোর্স দেবার সিদ্ধান্ত নিলো, তখন তার পরিবারের কেউই রাজি হয়নি, এমন কি এটা জানার পরও, লোকটা কুখ্যাত সন্ত্রাসির ঘনিষ্ঠ লোক। নওরিনের বাবা নেই, আছে কেবল মা আর এক বড়বোন। ধূর্ত বদমাশটা তাদেরকে ম্যানেজ করে ফেলে এই বলে যে, এক সময় একই এলাকায় থাকার সুবাদে ব্ল্যাক রঞ্জুর সঙ্গে তার পরিচয় থাকলেও পরে যখন সন্ত্রাসি হয়ে ওঠে তখন তার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখেনি।

কিন্তু সে জানতো, ব্ল্যাক রঞ্জুর সঙ্গে তার স্বামীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। দুয়েক বার আড়াল থেকে উজ্জ্বলের সঙ্গে রঞ্জুর কিংবা তার দলের লোকজনের ফোনালাপ শুনেছে সে। বুঝতে পেরেছে, তার স্বামী কেবল ঐ সন্ত্রাসির ঘনিষ্ঠই না, বরং তার জঘন্য কাজকারবারেও সঙ্গি। সেই সাথে নেশাগ্রস্ত এবং জুয়ায় আসক্ত।

জায়ানের বয়স যখন এক বছর, তখন তার এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবি তাকে জানিয়েছিল, উজ্জ্বল প্রায়শই পান্থপথের একটি ফ্ল্যাটে যাতায়াত করে, ওখানে মেয়েমানুষ নিয়ে আসে। ঐ ভবনের অন্য একটি ফ্ল্যাট তার সেই বান্ধবি ভাড়া নিয়েছিল তখন। এটা শোনার পর সিদ্ধান্ত নেয়, আর না। ডিভোর্স দেবে উজ্জ্বলকে, তবে তার আগে নিজেকে স্বাবলম্বী করতে হবে। ঠিক তখনই তাদের এক বন্ধুর বিয়ের দাওয়াতে গিয়ে মামুনুরের সঙ্গে দীর্ঘদিন পর দেখা হয় তার। একই সঙ্গে পড়তো তারা, ভালোই সখ্যতা ছিল, মামুনুরও তাকে খুব পছন্দও করতো। যদিও ভালোবাসার কথা মুখ ফুটে বলতে পারেনি কখনও। অনার্স শেষ করার পরই উজ্জ্বলের সঙ্গে যখন তার বিয়ে হয়ে যায় মামুনুর তখনও বেকার। তার বাবা-মায়ের কাছে পাত্র হিসেবে উজ্জ্বল ছিল সব দিক থেকে সেরা-বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবি ছেলে, ভালো একটা ব্যাঙ্কে চাকরি করে, পরিবার বলতে মা আর এক বড়ভাই, সেই ভাই বিয়ে করে আলাদা থাকে–একেবারেই নির্ঝঞ্ঝাট একটি পরিবার।

বাবা-মায়ের হিসেব কতোই না সহজ ছিল। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। কিন্তু মানুষ চেনা এতো সহজ না!

ডিভোর্স দেবার সিদ্ধান্তের কথা জানার পরই উজ্জ্বল তার গলা চেপে ধরেছিল, হুমকি দিয়ে বলেছিল, এসব কথা দ্বিতীয় বার মুখে আনলে তাকে মাটিতে পুঁতে ফেলবে। শুধু তা-ই না, তাদের পুরো পরিবারকে শেষ করে দেবে সে! প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেছিল নওরিন। কথাটা তার মা আর বোনকে বলার পর তারা আরো বেশি ভড়কে যায়। উল্টো তাকে বুঝ দিতে থাকে, সংসার করতে হলে অনেক কিছুই মানিয়ে নিতে হয় মেয়েদেরকে। একটা বাচ্চা হয়ে গেছে, ডিভোর্সের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলা উচিত তার।

কিন্তু সে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেনি। বছরখানেক পরই শোনা যেতে থাকে, ব্ল্যাক রঞ্জু না কি মারা গেছে। এসব খবর যখন ভেসে বেড়াচ্ছে তখন সে দেখতে পায়, উজ্জ্বলের মধ্যে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। আগের মতো আর ঠাঁটবাট নেই, কেমন চিন্তিত। এরপরই একদিন একটি ফোনালাপ শুনে ফেলে সে। রঞ্জু গ্রুপের কারো সাথে কথা বলছিল, সেই কথাবার্তা থেকে নওরিন বুঝে যায়, ঐ সন্ত্রাসি আসলেই বেঁচে নেই, তার দলটাও ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়েছে।

মামুনুরের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানায়, সে ডিভোর্স দেবে তার স্বামীকে, একটা চাকরিরও দরকার। ডিভোর্সের কথা শুনে উজ্জ্বল আবারো রেগে গেছিল, ক্ষিপ্ত হয়ে হুমকি ধামকি দিতে শুরু করে, কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে তার গায়ে হাত তোলে। তখনই সে পাল্টা হুমকি দিয়ে বলে, পুলিশকে জানিয়ে দেবে ব্ল্যাক রঞ্জুর সাথে তার কী সম্পর্ক। এ কথা শুনে চুপসে যায় উজ্জ্বল। এরপরই জায়ানকে নিয়ে এক কাপড়ে বাড়ি ছাড়ে নওরিন, কিন্তু মায়ের কাছে গিয়ে ওঠে না। ভালো করেই জানতো, উজ্জ্বল সেখানে গিয়ে ঝামেলা করবে। কয়েকটা দিন এক বান্ধবির বাড়িতে থেকে একটা বাসা ভাড়া নিয়ে নেয়, মা আর বোনের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে জানায়, উজ্জ্বলকে সে ডিভোর্স দিয়ে দিচ্ছে কয়েক দিনের মধ্যে।

সেই থেকে নওরিনের একলা চলা শুরু। সেই চলার সঙ্গি হিসেবে পেয়েছে মামুনুরকে। সব ধরণের সাহায্য করে গেছে তাকে। বকে বলে নিজের অফিসে তার জন্য ভালো একটা চাকরিও জুটিয়ে দিয়েছে।

কিন্তু কয়েক মাস ধরে পত্রপত্রিকায় ব্ল্যাক রঞ্জুর কথা শোনা যাচ্ছে, ঐ সন্ত্রাসি মরেনি, ঢাকায় ফিরে এসেছে আবার। এটা জানার পর বেশ ভীত হয়ে পড়েছিল সে। মামুনুরকে সেটা জানানোর পরই খিলক্ষেতের সোয়ান লেক সিটির ফ্ল্যাটটা ভাড়া করে দেয় তাকে। সিঙ্গেল মাদারকে ভাড়া দিতে চাইবে না বলে তার স্বামী সেজে ফ্ল্যাটটা ভাড়া করে দিয়েছিল।

মামুনের সঙ্গে তার স্ত্রীর সেপারেশন চলছে দীর্ঘদিন ধরে, তবে এখনও ডিভোর্স হয়নি। ডিভোর্সের পর তারা বিয়ে করবে বলে ঠিক করেছে। ছেলেকে নিয়ে একা থাকতে থাকতে নওরিনও হাঁপিয়ে উঠেছে। তো গতকাল রাতে ফোন করে জানায়, আজ একটু দেখা করতে চায়, জরুরি কথা আছে। বিকেলের দিকে সোয়ান লেক সিটিতে গাড়ি নিয়ে আসে, তাকে নিয়ে যায় এক রেস্টুরেন্টে, সেখানেই কথা হয় তাদের। মামুনুর জানায়, মা-বাবাকে সে বলেছিল, ডিভোর্সের পর নওরিনকে বিয়ে করতে চায়, কিন্তু দশ বছরের একটা ছেলে আছে শুনে তার মা-বাবা রাজি হয়নি। মামুনুরের মুখ থেকে এ কথা শুনে হতভম্ব হয়ে যায় নওরিন। তাকে কেন এসব কথা বলছে? তার মা-বাবাকে রাজি করানোর দায়িত্ব তার। এসব তাকে শোনানোর মানে কী? কিছুক্ষণের মধ্যেই বিষয়টা বাকবিতণ্ডায় গড়ায়। মামুনুরের এমন আচরণে মুষড়ে পড়েছিল সে। গাড়িতে করে তাকে সোয়ান লেকে পৌঁছে দেবার সময় সারাটা পথ বলতে গেলে আর কোনো কথা হয়নি তাদের মধ্যে। গুমোট অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল তাদের মধ্যে।

গাড়িতে করে তাদের বিল্ডিংয়ের সামনে নামিয়ে দিলে দারোয়ান দেখবে, মুখরোচক গল্প ছড়াবে সোসাইটিতে, তাই সাত নাম্বার ভবনের সামনে না নেমে, একটু আগেই নেমে পড়েছিল, বাকি পথটুকু হেঁটে যাবার সময়েই উজ্জ্বল এসে হাজির হয়।

সে যে সোয়ান লেক সিটিতে থাকে, এটা উজ্জ্বল কিভাবে জেনে গেল, এখনও বুঝতে পারছে না। তার বড় বোন স্বামী-সন্তান নিয়ে কানাডায় চলে গেছে, কয়েক মাস আগে তার মাকেও নিয়ে গেছে সেখানে। ঢাকায় যে ক জন আত্মীয়স্বজন আর বন্ধুবান্ধব আছে তাদের মধ্যে হাতেগোণা দুয়েকজন জানে তার এখানকার কথা, কিন্তু ঘুণাক্ষরেও তারা উজ্জ্বলকে সেটা বলবে না। তার পরও জেনে গেল!

বদমাশটা আজকে তাকে কী জঘন্য কথা-ই না বলেছে।

“নতুন নাগর ধরছো দেখি!” মামুনুরের গাড়িটা চলে যেতেই কোত্থেকে যেন উদয় হয়েছিল সে।

নওরিন হতভম্ব হয়ে গেছিল তাকে দেখে।

“গাড়িওয়ালা মাল!” কুৎসিতভাবে বলেছিল। “ভালো ভালো।”

নিজেকে ধাতস্থ করে নওরিন অবশেষে জানতে চায়, “তুমি কিভাবে জানলে আমি এখানে থাকি?”

এ কথা শুনে বিচ্ছিরি হাসি দিয়েছিল উজ্জ্বল। “আমি চাইলে দুনিয়ার যেখানে গিয়া-ই লুকাও, বাইর করতে পারুম।”

তিক্ততায় ভরে উঠেছিল তার মুখ। “কী জন্যে এখানে এসেছো?”

“জায়ারে অনেক দিন দেখি না,” গাল চুলকে বলেছিল।

এ কথা শুনে হাসি পেয়েছিল তার। “এতোদিন পর সন্তানের খোঁজ নিতে এসেছো? হুট করে দরদ উথলে উঠল কেন?”

“দরদ আমার সব সময়ই আছিল,” সাফাই গেয়ে বলেছিল উজ্জ্বল। “তুমি ওরে আমার কাছ থিকা দূরে রাখছো, চোরের মতো পলাইয়া থাকো।”

“তুমি জায়ানকে দেখতে এখানে আসোনি। সত্যি করে বলো, কী জন্যে এসেছো?”

নওরিনের এমন সোজাসাপ্টা কথা শুনে আর ভণিতা করেনি উজ্জ্বল। “তোমার নামে একটা অ্যাকাউন্ট করছিলাম না?…ঐটার কাগজপত্র তুলতে হইবো।”

প্রথমে বুঝতে পারেনি সে, তারপরই মনে পড়ে যায়, বিয়ের পর পর তার নামে একটা অ্যাকাউন্ট করে দিয়েছিল উজ্জ্বল। কিন্তু ওটার কথা কখনও জিজ্ঞেসও করেনি, খোঁজও নেয়নি।

“তোমার নিজের ব্যাঙ্কেই তো অ্যাকাউন্টটা, তুমি নিজেই তুলে নাও, আমার কাছে কেন এসেছো?”

উজ্জ্বল অধৈর্য হয়ে ওঠে। “চেক বইটা শ্যাষ হইয়া গেছে, নতুন বই তুলতে হইবো। ওইটা তুলতে অ্যাকাউন্টের মালিকরে লাগে।”

নওরিন দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল।

“খালি একটু ব্যাঙ্কে যাইবা, চেক বইটা তুলবা, আর কিছু করা লাগবো না।” তারপর আস্তে করে বলে, “তোমারে কিছু দিমুনে।”

নওরিনের বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছিল। “তুমি কী করে ভাবলে টাকার জন্য আমি এটা করবো? তোমার ঐ টাকায় আমি থুতু দেই।”

“ভালায় ভালায় কামটা কইরা দে,” দাঁত কিটমিট করে বলেছিল উজ্জ্বল। “মিজাজ খারাপ করিস না আমার। এইটা নিয়া তেরিবেরি চোদাইলে ভালা হইবো না তোর?”

“কি করবি তুই আমার?” রেগেমেগে জানতে চেয়েছিল নওরিন।

“করবার তো পারি অনেক কিছু, বাঁকাহাসি দিয়ে বলেছিল উজ্জ্বল। “আমারে চিনোস না তুই?”

আবারো হাসি পেয়েছিল তার। “চিনবো না কেন! চিনেছি বলেই তো লাথি মেরে চলে এসেছি তোর সংসার থেকে।”

“চুপ, মাগি!” রেগেমেগে গালি দেয় উজ্জ্বল। “রঞ্জু আবার ফিরা আইছে! আমি যদি চাই, তোরে তুইল্যা নিতেও পারুম। ঢাকা শহরে কুনোখানে গিয়া থাকবার পারবি না!”

এমন গালি অবশ্য নতুন ছিল না নওরিনের জন্য। রেগেমেগে চড়থাপ্পর দেয়া, গলা টিপে ধরা উজ্জ্বলের ভয়ঙ্কর বদঅভ্যেস।

“তোর ঐ নয়া নাগরের পুটকি দিয়া বুলেট হান্দাইয়া দিমু আমি।”

আর শোনা সম্ভব হয়নি তার পক্ষে, চলে যেতে উদ্যত হতেই তার হাতটা খপ করে ধরে ফেলে।

“যাস কই!”

“ছাড় আমাকে!” দাঁতে দাঁত চেপে বলেছিল নওরিন। “তোর কোনো কথা আমি শুনতে চাই না!”

“তুই শুনবি না তোর বাপে শুনবো!”

নওরিন তার হাতটা ছাড়ানোর জন্য জোরাজুরি করতে শুরু করে তখন।

“আমার কথা না শুনলে-”

অমনি পাশের ফ্ল্যাটের সেই লোকটা পেছন থেকে এসে উজ্জ্বলের কলার চেপে ধরে।

কতো খারাপ ধারনা-ই না করতো লোকটা সম্পর্কে। জায়ানের সাথে তার মেলামেশাটাকে ভালো চোখে দেখেনি। একা একটা বাচ্চাছেলে, সুফিয়ার কাছে রেখে সারাটা দিন অফিসে থাকে, এ রকম অচেনা একজন লোকের সাথে মিশুক, সে চায়নি। বাচ্চারা প্রায়শই বিকৃত মানসিকতার পুরুষ মানুষের শিকার হয়। ঈদের দু-দিন আগে অফিস থেকে ফিরে যখন জানতে পারে, পাশের ফ্ল্যাটের লোকটার সঙ্গে আছে জায়ান, বুক কেঁপে উঠেছিল তার। ছেলেকে তো বারণ করেছেই, ঐ লোকটাকেও সাফ বলে দিয়েছে, সে যেন জায়ানের সাথে আর না মেশে।

আশ্চর্য হলেও সত্যি, লোকটা একটুও রাগ করেনি। চুপচাপ শুনে গেছে তার কথা। জায়ান ছাড়া এখানকার কারো সাথেই মানুষটা কথা বলে না। বলতে গেলে তার সম্পর্কে কেউ কিছু জানে না। এমন কি নামটাও না।

কিন্তু ব্ল্যাক রঞ্জুর সন্ত্রাসিরাও এই লোকের ফ্ল্যাটে ঢুকে তাকে মারতে পারেনি, উল্টো তাদেরকে মেরে ফেলেছে! রঞ্জুর লোকগুলো বলেছিল, মানুষটা না কি বিরাট বড় এক খুনি। ওদের মতো সন্ত্রাসিদের কথা বিশ্বাস করা যায় না। কিন্তু এটাও ঠিক, এই লোক সাধারণ কেউ না। তবে কেনজানি তার কাছে লোকটাকে খারাপ বলেও মনে হয়নি। তার ধারনা, রঞ্জু গ্রুপের। সঙ্গে এই লোকের পুরনো কোনো শত্রুতা আছে।

ঘরের দরজায় টোকা পড়তেই সম্বিত ফিরে পেলো নওরিন খান। জায়ানকে রেখে ঘরের বাইরে চলে এলো সে। দেখতে পেলো লোকটা দাঁড়িয়ে আছে।

“ওই লোকের নাম কি?”

তার পেছনে দরজাটা লাগিয়ে দিলো নওরিন খান, সে চায় না এসব কথা জায়ান শুনুক। একটু এগিয়ে গিয়ে সামনের খোলা বারান্দায় চলে এলো তারা। “রাহিদ হাসান, তবে উজ্জ্বল নামে চেনে সবাই।”

“আপনি আগে থেকেই জানতেন ওই লোক রঞ্জুর ঘনিষ্ঠ?”

“অনেক দেরিতে জেনেছি এসব,” গভীর করে নিশ্বাস নিলো। “আরো বাজে অভ্যাস আছে ওর।”

“অ্যাডিক্টেড?”

“হুম। কয়েক বছর আগে যখন শুনলাম, ব্ল্যাক রঞ্জু মারা গেছে তখন ওকে ডিভোর্স দিয়ে দেই। এখন আবার শুনছি রঞ্জু মরেনি, ফিরে এসেছে। উজ্জ্বলও আজকে এটা বলল।”

ভুরু কুঁচকে গেল তার।

“ও আমাকে আবারো খুঁজে বের করবে। ও অনেক খারাপ…এতো সহজে ছেড়ে দেবে না আমাকে।”

“আমার এই কাকা…উনি অনেক ভালো মানুষ, আপনাদের থাকার ব্যবস্থা করবে, এরপর কী করতে হবে না করতে হবে, সব বলে দেবেন। উনার উপরে ভরসা রাখতে পারেন।”

নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো নওরিন খান। “কিন্তু আমি যে এভাবে পালিয়ে এলাম, পুলিশ তো ভাববে…”

“পুলিশকে পরে সব বলবেন…যা যা ঘটেছে সব।” নওরিন খান অবাক হলো কথাটা শুনে।

“আপনার এক্স, ব্ল্যাক রঞ্জু…সবার কথা বলবেন। আমার কথাও বলবেন। বানিয়ে টানিয়ে বলার দরকার নেই।”

পুরোপুরি হতবিহ্বল দেখাচ্ছে নওরিন খানকে। ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে রইলো সে।

“বলবেন, আপনি আমাকে চেনেন না, আমার নামও জানেন না।” একটু থেমে আবার বলল, “কথাটা মিথ্যেও নয়। আমার নাম আপনি জানেন?”

মাথা দোলালো নওরিন।

“পুলিশ আপনার ব্যাপারটা বুঝবে। তখন আর মিডিয়াও ঝামেলা করবে। বাসি খবর নিয়ে ওদের আগ্রহ থাকে না।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো নওরিন। ক-দিন পর পুলিশকে গিয়ে সব খুলে বললে, সেটা আর মিডিয়াতে ফলাও করে প্রচার করা হবে না।

“আমার এই কাকার কথাও বলবেন পুলিশকে।”

আবারো অবাক হলো জায়ানের মা।

“বলবেন, আপনার দুরসম্পর্কের কাকা হয়।”

আলতো করে মাথা নেড়ে সায় দিলো জায়ানের মা।

“আমি একটু পর চলে যাবো এখান থেকে..আপনাদের সঙ্গে আর না-ও দেখা হতে পারে।”

মুখ তুলে তাকালো নওরিন। কিন্তু কী বলবে কথা খুঁজে পেলো না।

বাবলু একবার ভাবলো, জায়ানের সঙ্গে দেখা করবে কি না। কিন্তু সঙ্কোচে পেয়ে বসলো তাকে। ছেলেটা তার হাতে পিস্তল দেখেছে, দেখেছে অবলীলায় মানুষ খুন করতে, তাই মুখোমুখি হতে চাইলো না, আস্তে করে চলে গেল।

কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকার পর নওরিন খান তার ফোনটা বের করলো। কিন্তু মামুনুরকে ফোন করতে যেয়ে টের পাচ্ছে, এক ধরণের অস্বস্তি জেঁকে বসেছে তার মধ্যে।

অধ্যায় ৫৮

রাতের খাবার খেয়ে চলে যাবার আগে অমূল্য বাবুর সাথে বসেছে বাবলু।

“রঞ্জু গ্রুপের কেউ যেন নাগাল না পায় এমন জায়গায় রাখতে হবে ওদেরকে,” বলল সে।

“তোমাকেও সেভাবেই রেখেছিলাম, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল বাবু। “কিন্তু দুনিয়াটা আসলেই ছোটো, এ দেশটা আরো বেশি ছোটো।”

কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বাবলু বলল, “পুলিশ আপনাকে ফোন দিতে পারে।”

কিন্তু বাবুকে দেখে চিন্তিত মনে হলো না এ নিয়ে। আমার ছেলে থাকতো ওখানে…পাশের ফ্ল্যাটের মহিলাকে রঞ্জু গ্রুপের একজনের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল বলে…” কথাটা আর শেষ করলো না।

বুঝতে পারলো বাবলু।

“এটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। আমি দেখছি ব্যাপারটা।”

বাবলু জানে, এই লোকের নার্ভ লোহার মতোই শক্ত। তার মুখের অভিব্যক্তি বেশিরভাগ সময়ই পাথরে খোদাই করা মূর্তির মতো থাকে, খুব কমই তাতে দুশ্চিন্তার ছাপ দেখা যায়। তার কাছে জায়ানরা নিরাপদেই থাকবে। “আমি তাহলে চলে যাই,” উঠে দাঁড়ালো সে।

“ওখানে কয়েকটা দিন একটু সাবধানে থাকবে, পাসপোর্টটা হয়ে গেলে দয়া করে কিছুদিন বাইরে থেকে ঘুরে আসবে।”

বাবলু কিছু বলল না।

“তোমার সাথে যে অন্ত্র আছে সেটা হোটেল ম্যানেজার জানে, একটা ট্যাক্সি নিয়ে সোজা আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিংয়ে চলে যাবে, ওখানেই ম্যানেজার দেখা করবে তোমার সঙ্গে। বাকিটা সে-ই দেখবে।”

“আমার ল্যাপটপ আর কিছু জরুরি কাগজপত্র আছে, ওগুলো আপনার কাছে থাকুক।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো বাবু। “নন্দর কাছে দিয়ে দিও।”

চুপচাপ ঘর থেকে বের হয়ে গেল বাবলু। মাইক্রেবাস থেকে ডাফেল ব্যাগটা বের করে সন্ত্রাসিদের দুটো পিস্তল নিজের কাছে রেখে ব্যাগটা নন্দকে দিয়ে দিলো সে। “কাকাকে এটা দিয়ে দিও।”

ব্যাগটা হাতে নিয়ে ছেলেটা মেইন গেট খুলে দিলো, কালো রঙের মাইক্রোবাসটা নিয়ে বের হয়ে গেল সে। ঠিক করলো, এই গাড়িটা নির্জন কোথাও পরিত্যাগ করবে।

রঞ্জুর লোকজনের দুটো পিস্তল আছে সঙ্গে, তার নিজের পিস্তলে এখন কোনো গুলি নেই। যে কয়টা ছিল, আজকে শেষ করে ফেলেছে। তাই নিজের পিস্তলটা ডাফেল ব্যাগে ল্যাপটপসহ বাকি জিনিসপত্রের সঙ্গে দিয়ে দিয়েছে।

সে এখন নিশ্চিত, তাকে হত্যা করতে নয়, তুলে নেবার জন্য লোকগুলো এসেছিল! ওদের একজন বার্না না বায়ার্না নামের অদ্ভুত একটি পিস্তল নিয়ে এসেছিল। রাতের খাবার খাওয়ার আগে গুগল করে জেনে নিয়েছে সে, ওটা একটা ট্রাঙ্কুলাইজার গান! ম্যাগাজিনটা খুলে চেক করে দেখেছে, ছোট্ট মার্বেল আকৃতির রাউন্ড আছে তাতে।

তার মানে, রঞ্জু সত্যি সত্যিই বেঁচে আছে!

কিন্তু ওভাবে পুড়িয়ে মারার পরও কিভাবে বেঁচে থাকে একজন মানুষ?! তার মাথায় ঢুকছে না।

রাতের এ সময় উত্তরার পথঘাট বলতে গেলে অনেকটাই ফাঁকা হয়ে পড়েছে, খুব কম যানবাহনই চোখে পড়ছে এখন। পথে পুলিশের চেক পয়েন্ট থাকবে, এ মুহূর্তে আইনশৃঙ্খলা বাহিনির সাথে গোলাগুলি করার কোনো ইচ্ছে তার নেই। গাড়িটা এখান থেকে বের হয়ে রাস্তার পাশে রেখে চলে যাবে।

কিন্তু অমূল্যবাবুর বাড়ি থেকে একটু এগোতেই দেখতে পেলো, পুলিশের একটা গাড়ি ধেয়ে আসছে। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির হেডলাইট-ইনসাইড লাইট বন্ধ করে পথের পাশে পার্ক করলো সে।

তাকে অতিক্রম করে চলে গেল পুলিশের গাড়িটা। পেছন ফিরে তাকালো, অমূল্যবাবুর বাড়ির দিকে যাচ্ছে। অপেক্ষা করলো সে। বাবুর বাড়ির কাছে গিয়েই থামলো পুলিশের গাড়িটা কিন্তু গাড়ি থেকে দু-জন পুলিশ নামলেও তারা কিছুই করলো না, দাঁড়িয়ে রইলো বাড়ির সামনে।

পুলিশের টহল দল কেন এ সময় বাবুর বাড়িতে আসবে? ফ্ল্যাটের মালিকানার সন্ধান করে ফেলেছে? যদি তা-ই হয়, পুলিশ বাড়িতে না ঢুকে বাইরে অপেক্ষা করছে কেন?

দ্রুত মাথা খাটাতে লাগলো। অন্ধকার জগতে দীর্ঘদিন ধরে বিচরণ করছে, এতোদিন ধরে যে বেঁচে আছে তার কারণ এই না, সে খুব সতর্ক থাকে। সতর্কতা অবশ্যই জরুরি কিন্তু টিকে থাকার জন্য সেটাই একমাত্র বিষয় না, দীর্ঘদিন ধরে বেঁচেবর্তে থাকতে আরো অনেক কিছু লাগে। বিপদের গন্ধ আগেভাগে টের না পেলে বেশি দিন টিকে থাকা যায় না।

সঙ্গে সঙ্গে একটা ভাবনা উঁকি দিলো তার মাথায় : হোমিসাইড ডিপার্টমেন্ট না তো? তিন-তিনটি খুন হয়েছে সোয়ান লেক সিটিতে, হোমিসাইডই তদন্ত করার কথা। আর ট্র্যাক করার কাজটা তারাই সবচেয়ে ভালোভাবে করতে পারে।

জেফরি বেগ!

পকেট থেকে ফোনটা বের করে নিলো, ভালো করেই জানে, সব কিছুর মূলে আছে এই জিনিসটা। তবে তারটা নয়-এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত। তার ফোনে মাত্র তিনটা নাম্বার সেভ করা আছে-কাজের মহিলার নাম্বারটা বন্ধ, চালু আছে বাকি দুটো নাম্বার, সেই দুটো নাম্বারের মধ্যে একটা নাম্বারে কল দিলো।

“কী হয়েছে?” সামান্য উদ্বেগ শোনা গেল অমূল্যবাবুর কণ্ঠে।

“আপনার বাড়ির সামনে পুলিশ এসেছে।”

“তুমি কোথায়?”

“কাছেই আছি…আমার ধারনা, ওরা ফোন ট্র্যাক করছে।”

“কার ফোন?”

“সম্ভবত জায়ানের মায়েরটা।”

ওপাশে নিরবতা নেমে এলো কিছুক্ষণের জন্য।

“পুলিশ এতো দ্রুত ট্র্যাক করেছে বলে মনে হয় না…হোমিসাইড ডিপার্টমেন্ট এটা করেছে।”

“বুঝেছি,” গম্ভীর কণ্ঠে বলল অমূল্যবাবু। “তুমি ওখানে চলে যাও, আমার সঙ্গে আর যোগাযোগ কোরো না…আমিই করবো।”

অধ্যায় ৫৯

বর্তমান সময়

জেফরি বেগের বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে, কার বাড়িতে চলে এসেছে, আর কাকেই বা দেখছে চোখের সামনে।

আজকে রাতে এ নিয়ে দু দু-বার বিস্মিত হলো। প্রথমবার সিসিটিভিতে রাহিদ হাসানকে দেখে, দ্বিতীয় বার উত্তরার এই বাড়িতে অমূল্যবাবুকে আবিষ্কার করে। তবে মানতেই হয়, প্রথম বারের চেয়ে এটা অনেক বেশি চমকে যাবার মতো ঘটনা।

এ হচ্ছে বাবলুর মেন্টর-কিংবা হ্যান্ডলার।

তাহলে সোয়ান লেক সিটির সাত নাম্বার ভবনের রহস্যময় লোকটি বাস্টার্ড!

রাহিদ হাসানের সাবেক স্ত্রীকে যে বাবলুই এই বাড়িতে নিয়ে এসেছে, সে ব্যাপারে তার মনে কোনো সন্দেহ নেই। তবে বিস্ময়টা হজম করে নিতে একটু সময় লাগলো। অবাক হয়েই দেখতে পেলো, তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা শক্ত নার্ভের লোকটি তাকে দেখে একটুও ভড়কে যায়নি। যেন লোকটা জানতো, সে এখানে আসবে!

প্রতাপশালী একজন মানুষ এই অমূল্যবাবু। নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করে বার বার বাবলুকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। ক্ষমতার শীর্ষে যারা আছে তাদের সঙ্গে সখ্যতা রয়েছে এই লোকের।

“অনেক দিন পর দেখা হলো,” বাড়ির ভেতরে ঢুকে বলল জেফরি বেগ। তাকে অনুসরণ করলো জামান আর উত্তরা থানার এক এসআই। “আমাকে দেখে নিশ্চয়ই অবাক হয়েছেন?”

অমূল্যবাবুর মুখ নির্বিকার, যেন পাথরে খোদাই করা। প্রশ্নের জবাব না দিয়ে জানতে চাইলো, “আপনি এখানে কেন এসেছেন?”

জামানও অবাক হয়েছে তবে কিছু বলছে না, উত্তরা থানার এসআইকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ।

“ঐ অ্যাপার্টমেন্টটাও তাহলে আপনারই,” কথাটা প্রশ্নের মতো শোনালো না।

গভীর করে নিশ্বাস নিয়ে নিলো বাবু। এটা অস্বীকার করার মতো বিষয় নয়। “আমার বাড়িতে কেন এসেছেন সেটা বলুন। আমি খুব তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ি, এখন আমার ঘুমের সময় হয়ে গেছে।”

এবার গভীর করে শ্বাস নিলো জেফরি বেগ। “এসেছিলাম তো এক মহিলা আর তার বাচ্চাছেলের খোঁজে, সেই সাথে রহস্যময় একজনের সন্ধানে…এখন বুঝতে পারছি, ওটা বাবলু।”

“আপনি কি সোয়ান লেকে আমার অ্যাপার্টমেন্টে যে থাকে তার কথা জানতে চাইছেন?”

মুচকি হেসে মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি বেগ।

“ওখানে থাকে পার্থিব রায় চৌধুরী, নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল অমূল্যবাবু।

চোয়াল শক্ত হয়ে গেল হোমিসাইড ইনভেস্টিগেটরের। “আপনি কার কথা বলছেন?”

“আমার ছেলের কথা বলছি।”

“আপনার ছেলে?!” তীর্যকভাবে বলল জেফরি বেগ।

একদম শান্ত আর প্রসন্নমুখে চেয়ে রইলো অমূল্যবাবু।

“আপনি নিজেকে কী ভাবেন? দিনকে রাত আর রাতকে দিন বানিয়ে দিতে পারেন?” মাথা দোলালো জেফরি বেগ। “আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নেবেন না, ঠিক আছে?”

“আপনাকেও আমি একই কথা বলতে পারি।”

ভুরু কুঁচকে চেয়ে রইলো হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর। “আপনি সব অস্বীকার করতে চাইছেন? বাবলু…তৌফিক আহমেদ বাবলু, যাকে আন্ডারওয়ার্ল্ডে বাস্টার্ড নাম চেনে, সে ওখানে থাকতো না?”

“বললাম তো, আমার ফ্ল্যাটে যে থাকতো সে আমার ছেলে। ডকুমেন্ট দেখতে চাইলে দেখাতে পারি। আর আপনার বাকি প্রশ্নের জবাব দিতে আমি বাধ্য নই।”

লোকটার দিকে সরাসরি তাকালো জেফরি। “আপনি বোধহয় ভুলে গেছেন, আমি আইনশৃঙ্খলা বাহিনির লোক, আমার প্রশ্নের জবাব দিতে আপনি বাধ্য।”

“আপনার যে প্রশ্নের জবাব আমি জানি সেটা দিয়েছি,” আরো বেশি শীতল কণ্ঠে বলল বাবু। “যে প্রশ্নের জবাব আমার জানা নেই, সেটা কী করে দেববা?”

এই লোক ঠাণ্ডা মাথায় এমন কথা বলছে, যে জেফরির পক্ষে হজম করা সম্ভব হচ্ছে না। বাস্টার্ডকে দিয়ে লেখক জায়েদ রেহমানকে হত্যা করিয়েছিল এই অমূল্যবাবু, অথচ কিছুদিন পর এক ডাকাত আদালতে স্বীকার করে। বসলো, ডাকাতি করার সময় না কি লেখককে সে হত্যা করেছে। জেফরি তখনই বুঝতে পেরেছিল, সবই এই লোকের কারসাজি।

“আমার এখানে কি শুধু এটাই জানতে এসেছেন?” অমূল্যবাবু জিজ্ঞেস করলো এবার। “তাহলে যা বলার বলে দিয়েছি, এবার আপনারা যেতে পারেন।”

নিজের রাগ দমন করলা জেফরি। “একটু আগে এক মহিলা আর ছোটো বাচ্চাকে নিয়ে বাবলু এখানে এসেছে, আমি ওদের খোঁজে এসেছি।”

“এ রকম কেউ এখানে আসেনি।”

অমূল্যবাবুর শক্ত নার্ভ আর সব কিছুর অস্বীকৃতি জেফরিকে একই সাথে হতাশ আর ক্ষুব্ধ করে তুলল, ভুরু কুঁচকে চেয়ে রইলো সে লোকটার দিকে। “মহিলার ফোনের জিপিএস ট্র্যাক করে দেখেছি।” নিজের ক্রোধকে প্রশমিত করলো জেফরি বেগ। “আমরা শতভাগ নিশ্চিত, নওরিন খান আর তার ছেলে এখানে আছে।”

“মনে হচ্ছে নিজের চোখকে না, জিপিএসকে বেশি বিশ্বাস করেন আপনি। কিন্তু দেখতেই তো পাচ্ছেন, ওরা এখানে নেই।”

রাগ দমন করে বলল জেফরি বেগ, “আমি আপনার বাড়িটা সার্চ করবো।”

“সার্চ ওয়ারেন্ট আছে আপনার কাছে?”

অমূল্যবাবুর খুব কাছে চলে এলো জেফরি। “সব সময় ওটা নিয়ে কেউ ঘুরে বেড়ায় না। আমরা ওদেরকে ট্র্যাক করতে করতে এখানে চলে এসেছি…ওয়ারেন্টের কোনো দরকার নেই।”

ঠিক তখনই বাড়ির ভেতর থেকে নন্দকে আসতে দেখলো অমূল্যবাবু। “আমারা দুজনেই আর্লি রাইজার, এখন আমার ঘুমানোর সময়,” বলেই নন্দকে কাছে ডাকলো। “আপনার চলে গেলে ও দরজা বন্ধ করে দিয়ে ঘুমাবে।” এ কথা বলেই চলে যেতে উদ্যত হলো সে।

“দাঁড়ান!” চেঁচিয়ে বলল জেফরি। “এই বাড়িটা আমি তল্লাশি করবো, এক্ষুণি!”

“সার্চ ওয়ারেন্ট ছাড়াই?”

“হ্যাঁ।” নিজের রাগ দমন করতে বেগ পেলো জেফরি। “আপনার দুর্বলতা আপনি প্রকাশ করে ফেলেছেন, ভয়ে বাড়িটা সার্চ করতে দিচ্ছেন না।”

স্মিত হাসি দিলো বাবু। “আমাদের কার দুর্বলতা নেই, বলুন? সবারই আছে, ওটা নিয়েই আমাদের বাঁচতে হয়।”

এসব দার্শনিক আলাপে আগ্রহ নেই জেফরির। স্থিরচোখে চেয়ে রইলো লোকটার দিকে। এ জীবনে অনেক লোকের মুখোমুখি হয়েছে সে কিন্তু এমন শক্ত নার্ভের লোকের দেখা পায়নি। এর সাথে কিভাবে কী করতে হবে, কথা বলতে হবে, বুঝে উঠতে পারছে না। তবে, বার বার তার দ্ৰতা আর আইনের প্রতি আনুগত্যকে দুর্বলতা ভেবে অপরাধীরা ফায়দা তোলার চেষ্টা করে-ঠিক এখন যেমনটা করছে এই লোক।

জামান চোখ কটমট করে তাকিয়ে আছে বাবুর দিকে।

কয়েক মুহূর্ত ভেবে হঠাৎ করেই বাবু বলে উঠল, “ঠিক আছে, সার্চ করুন তাহলে।”

ভুরু কুঁচকে চেয়ে রইলো হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর। এমনটা সে মোটেও আশা করেনি।

“কিছু পেলে আমাকে ডাকবেন, নইলে চলে যাবেন,” কথাটা বলেই অমূল্যবাবু আস্তে করে বাড়ির ভেতরে চলে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *