1 of 2

৫০. হঠাৎ লণ্ডনের ব্যবসা গুটিয়ে

হঠাৎ লণ্ডনের ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে শুরু করলেন শাজাহান। তিনি কোনওদিন কারুর সঙ্গে পার্টনারশিপে বিজনেস করেন না, নিজের চেষ্টাতেই লণ্ডনে সুতিবস্ত্র, তোয়ালে এবং কার্পেট আমদানির ব্যবসা বেশ জমিয়ে তুলেছিলেন, একখানা নিজস্ব ওয়্যারহাউজ ভাড়া নিয়ে রেখেছেন। এমন ব্যবসা বন্ধ করে দেবার কোনো মানেই হয় না, তবু তিনি অস্থির হয়ে উঠলেন। কলকাতা ছেড়ে ঢাকাতে গিয়েও তিনি বেশি দিন মন বসাতে পারেননি। তিনি খুব কম মানুষের সঙ্গেই সহজভাবে মিশতে পারেন, কিন্তু কোনো এক জায়গায় বছরের পর বছর থাকলে পরিচিতের সংখ্যা বেড়েই যায়। তাদের সকলের সঙ্গেই নিখুঁত ভদ্র ব্যবহার করেন। তিনি, অথচ ভেতরে ভেতরে বিরক্তি বোধ থেকেই যায়।

এত দিনেও আর বিয়ে করলেন না শাজাহান। তাঁদের কলকাতার বাড়িতে অনেক ভাই-বোন, বাবা-মা এখনো বেঁচে আছেন, কিন্তু লণ্ডনে শাজাহান একা থাকেন। একটা সুন্দর, ছোট্ট বাড়ি কিনেছেন কেনসিংটনে। কলকাতাতেও জামাকাপড় ও কার্পেটের পারিবারিক ব্যবসা আছে তাঁদের, এই ব্যবসা তিনি ভালোই জানেন। কিন্তু অন্যান্য সার্থক ব্যবসায়ীদের মতন তিনি সারা দিনে আঠেরো ঘণ্টাই এই নিয়ে মাথা ঘামান না। প্রত্যেক কাজের জন্য তাঁর আলাদা সময় ভাগ করা আছে। ঘুম থেকে উঠে কিছুক্ষণ প্রাতঃভ্রমণ, একা একা টেমস নদীর ধার দিয়ে হেঁটে বেড়াতে তাঁর খুব ভালো লাগে, বৃষ্টির মধ্যেও তিনি ম্যাকিনটস চাপিয়ে ছাতা নিয়ে বেরোন, বাইরের কোনো রেস্তোরাঁয় ব্রেক ফাস্ট খেয়ে ফিরে এসে চিঠিপত্র লিখতে বসেন। পুরো দুপুরটা তিনি ব্যয় করেন ব্যবসার কাজে, সেন্ট্রাল লণ্ডনে একটি ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে ভাগাভাগি করে তাঁর একটা ছোট্ট অফিস আছে, তা ছাড়া ব্যাঙ্ক, ইনসিওরেন্স, ক্লিয়ারিং এজেন্টদের অফিসে ঘোরাঘুরিও করতে হয়। সন্ধের পর নিতান্ত জরুরি না হলে তিনি ব্যবসা সংক্রান্ত কোনো লোকের সঙ্গে দেখা করেন না, ঐ বিষয়ে আলোচনাও করতে চান না কারুর সঙ্গে। বাড়িতে একা একা গান বাজনা শোনেন এবং বই পড়েন। এই দুটোই তাঁর প্রিয় নেশা, তিনি মদ খান না, সিগারেট খান না, গত ছ-সাত বছর ধরে কোনো নারীর প্রতি আকর্ষণ বোধ করেন না।

এইভাবে বেশ চলছিল, হঠাৎ তাসের ঘরের মতন তিনি সব কিছু ভেঙে দিতে চাইলেন। লণ্ডন আর তাঁর ভালো লাগছে না। প্রথমেই তিনি বাড়িটা প্রায় জলের দামে বিক্রি করে দিলেন, তার পর উঠলেন সাউথহলের একটা শস্তা হোটেলে। তিন-চার দিন পরেই সেই হোটেল আবার বদলালেন। তাঁর মালপত্রের স্টক পুরোটাই মার্ক অ্যাণ্ড স্পেনসারকে দিয়ে দিলেন চড়া কমিশনে। আরও যেসব কনসাইনমেন্ট আসছে সেইসব এবং তাঁর কম্পানির নামের গুড় উইল বেচে দেবার জন্য কথাবার্তা চালাতে লাগলেন গুজরাতি এবং পাকিস্তানী সিন্ধ্রী ব্যবসায়ীদের সঙ্গে। যেন যে কোনো কারণেই হোক, এক্ষুনি তাঁর প্রচুর ক্যাশ টাকা দরকার।

শাজাহানের পরিচিতরা অনেকে বলতে লাগলো, তিনি এইসব পাগলামি করছেন শুধু ত্রিদিবকে এড়াবার জন্য। ত্রিদিব ইদানীং বড় উপদ্রব শুরু করেছিলেন। শাজাহানের মতন একজন সূক্ষ্ম স্বভাবের মানুষের বাড়িতে এমন মাতালের চিৎকার ও দাপাদাপি যেন কল্পনাই করা যায় না।

তুতুল আর আলমের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রে শাজাহান ইচ্ছেতেই হোক কিংবা অনিচ্ছেতেই হোক, পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে খানিকটা জড়িয়ে পড়েছেন দু-এক মাস ধরে। শাজাহান নিজেকে ভারতীয় কিংবা পাকিস্তানী কিছুই মনে করেন না। যদিও অধিকাংশ বাঙালিদের তুলনায় তাঁর গায়ের রং বেশ ফর্সা, ছিপছিপে শরীর, স্যাভিল রোর দোকান থেকে তৈরি করা খাঁটি বিলিতি পোশাক পরেন, তা হলেও ইংরেজরা যে কোনোদিন তাঁকে আপনজন মনে করে না তা তিনি জানেন। মনে মনে নিজেকে তিনি একজন বিশ্ব নাগরিক ভাবেন। শেক্সপীয়ার-টলস্টয়-গ্যেটের রচনা কিংবা বাখ-মোৎসার্ট-চাইকভস্কির সঙ্গীত যেমন কোনো বিশেষ দেশের সম্পত্তি নয়, তেমনি যারা মানব সভ্যতার শ্রেষ্ঠ শিল্পগুলি উপভোগ করে, তারা মানব সভ্যতারই অঙ্গ। রাষ্ট্রনায়করা অবশ্য এসবের তোয়াক্কা করেন না। তাঁরা ক্রমশই মানুষকে আরও সীমাবদ্ধ করে দিচ্ছেন।

পাকিস্তানকে দু খণ্ড করার আলোচনায় শাজাহান কখনো কোনো মতামত প্রকাশ করেননি। রাজনীতিতে তিনি মাথা গলাতে চান না, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে নৃশংস অত্যাচার, গণহত্যার খবর জেনে বিচলিত না হয়ে পারেন না। ঢাকায় তাঁর পরিচিতদের মধ্যে কেউ কেউ লণ্ডনে পালিয়ে এলে তিনি গোপনে তাঁদের টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করেছেন। এখন আমরা তাঁকে চেপে ধরেছে, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে অর্থ সংগ্রহ অভিযানে সাহায্য করার জন্য। শাজাহান নিজে কিছু টাকা দিয়ে দূরে থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আলমের দলবল তাঁকে ছাড়েনি।

এই ব্যাপারে তাঁর বাড়িতে প্রায়ই মিটিং হচ্ছিল, সেখানে প্রায় প্রত্যেক দিনই মত্ত অবস্থায় হাজির হচ্ছিলেন ত্রিদিব। ত্রিদিব এলে আর কোনো কাজের কথা হয় না, শাজাহান তাঁর মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিতেও পারেন না।

কিন্তু শুধুমাত্র এই কারণে কী কেউ বাড়ি বিক্রি করে দেয়, ব্যবসা তুলে দিতে চায়?

ত্রিদিবের সঙ্গে আবার নতুন করে বন্ধুত্ব ঝালিয়ে নিতে উৎসাহী নন শাজাহান। তাঁর জীবন থেকে দিল্লির সেই পরিচ্ছেদটা তিনি মুছে ফেলে দিতে চেয়েছিলেন, সুলেখার স্মৃতিও অনেকটা ফিকে হয়ে এসেছে। সুলেখার মুখখানা মনে পড়লে এখনও একটু একটু বুক ব্যথা করে, তবে সেই ব্যথার মধ্যে পরিতাপের জ্বালার চেয়ে মাধুর্যই বেশি। এর মধ্যে রাতুল এসে পড়ে পুরোনো রাগ, ক্ষোভ, শোকানল আবার জ্বালিয়ে দিল।

রাতুলের কথা শুনে শাজাহান প্রথমে খুবই উত্তেজিত হয়ে পড়লেও আস্তে আস্তে তা দমন করেছেন। শাজাহানের দৃঢ় বিশ্বাস, রাতুলের নির্লজ্জ ব্যবহারের জন্যই সুলেখা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে। শাজাহান নিজে তো কখনো ভদ্রতার সীমারেখা লঙঘন করেননি, সুলেখার সঙ্গে কখনো ঘনিষ্ঠতার দাবি জানাননি, ত্রিদিব ও সুলেখা দু’জনের সঙ্গেই ছিল তাঁর বন্ধুত্বের সম্পর্ক, ওঁদের সঙ্গ তিনি উপভোগ করতেন। এর মধ্যে রাতুলের কোনো স্থান ছিল না। তবু রাতুল এক সকালবেলা তাঁকে চড় মেরেছিল। তাঁকে বলেছিল পাকিস্তানের স্পাই। রাতুলের কলাকৌশলেই শাজাহান সিক্সটি ফাইভের ওয়ারের সময় ডিটেইনড় হয়েছিলেন। সে কি প্রচণ্ড অপমান! তাদের পরিবার তিন পুরুষের কংগ্রেস সমর্থক, কলকাতায় তাদের নিজস্ব বাড়ি, তবু তিনি শুধু মুসলমান বলেই স্পাইইং-এর অভিযোগ! মারোয়াড়ি, গুজরাতি, বাঙালি হিন্দুরা পাকিস্তানের সঙ্গে ব্যবসা করেনি?

তবু সেই তিক্ততা সারাজীবন পুষে রেখে লাভ কী? অতীতের কোনো বোঝা ঘাড়ে চেপে থাকলে ভবিষ্যতের দিকে ঠিক মতন পা ফেলে এগোনো যায় না। সেই জন্যই তিনি ত্রিদিবের প্রস্তাবে সায় দেননি, রাতুলকে ডেকে তাঁরা তিন জনে একসঙ্গে বসার কোনো অর্থ হয় না। রাতুলকে তিনি ক্ষমা করতে পারবেন না, আবার রাগারাগি ঝগড়াঝাঁটি করাও তাঁর স্বভাব নয়।

ত্রিদিবের জন্য নয়, রাতুলের জন্যই তিনি লণ্ডন ছেড়ে যাওয়া ঠিক করেছেন। একই শহরে তিনি আর রাতুল থাকতে পারবেন না, যদি রাতুলের সঙ্গে হঠাৎ কোথাও দেখা হয়ে যায়! আমস্টারডামে কিংবা ফ্রাংকফুর্টে আপাতত কিছু দিন থাকা যেতে পারে, ঐ দুই জায়গায় ব্যবসার সুযোগ বাড়ছে দিন দিন।

বাড়ি বিক্রি করে হোটেলে চলে যাওয়ার পর শাজাহান আর আলম-তুতুলের সঙ্গেও দেখা করতে যাননি, কারুকেই তিনি আর ঠিকানা জানাতে চান না। তিনি যে ব্যবসা বিক্রি করে দিচ্ছেন, সে কথাও ঘুণাক্ষরে জানতে দেননি কারুকে।

অক্সফোর্ড ধরে হাঁটতে হাঁটতে শাজাহান একবার কাঁধ ঝাঁকালেন। নিজের ব্যবহার তাঁর নিজেরই কাছে দুবোধ্য হয়ে উঠছে ক্রমশ। একটু আগে তিনি একটা বাড়ির সামনে প্রায় আধ ঘণ্টা চুপচাপ দাঁড়িয়েছিলেন। সেই বাড়িটাতে রাতুলের অফিস। শাজাহান রাতুলের সঙ্গে দেখা করতে চান না, তা হলে রাতুলের অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার কী মানে হয়? এরকম তাঁকে মোটেই মানায় না। নিজের ওপরে বেশ বিরক্ত হলেন তিনি।

পর দিন ক্লিয়ারিং এজেন্টদের সঙ্গে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট রাখার জন্য তাঁকে অক্সফোর্ড স্ট্রিটের কাছাকাছি আবার আসতেই হলো। কাজ শেষ হয়ে গেল সাড়ে তিনটের সময়। শাজাহান নিজে গাড়ি চালান না, তাই ট্যাক্সিতেই অধিকাংশ সময় যাতায়াত করেন। এখন ট্যাক্সি নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে খানিকদূর এসে একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকলেন চা খাওয়ার জন্য। বসলেন জানলার পাশে একটা টেবিলে, উল্টো দিকের কোণাকুণি বাড়িটা যে রাতুলের অফিস, তা যেন তিনি খেয়ালই করছেন না, তিনি যে-কোনো একটা রেস্তোরাঁয় এসেছেন। পকেট থেকে একটা বই বার করে মনোযোগ দিলেন সে দিকে।

সাড়ে চারটের সময় রাতুল বেরিয়ে এলেন অফিস থেকে, ব্লু ফ্লানেল সুট পরা, হাতে ব্রীফ কেস। শাজাহান সঙ্গে সঙ্গে দাম মিটিয়ে দিয়ে চলে এলেন রাস্তায়। বিপরীত পেভমেন্ট দিয়ে রাতুল হাঁটছে, সত্যি দেখলে মনে হয় তার একটুও বয়েস বাড়েনি, ব্যাকব্রাশ করা মাথার চুল কুচকুচে কালো, হাতের ব্যাগটা দোলাতে দোলাতে হালকা মেজাজে হাঁটছে সে। শাজাহান বারবার নিজেকে প্রশ্ন করেন, আমি ওর সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছি কেন? কেন? কেন?

হাইড পার্ক করে দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে, রাস্তা ঐশ করে গিয়ে রাতুল তার সঙ্গে কথা বলতে লাগলো। আগে থেকেই এখানে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল নিশ্চয়ই ওদের। ওখানে দুটি জনতার গোল বৃত্তের মধ্যে দাঁড়িয়ে হাত পা ছুঁড়ে বক্তৃতা দিচ্ছে দু’জন শৌখিন বক্তা, তাদের মধ্যে একজন আলমের বন্ধু হামিদ। গলা ফাটিয়ে সে পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের শ্রাদ্ধ করছে, মাঝে মাঝে চেঁচিয়ে শ্রোতাদের মধ্য থেকে প্রতিবাদ করছে কয়েকজন পাকিস্তানী, তীব্র গালি-গালাজ চলছে দু’পক্ষে, পাশেই দাঁড়িয়ে আছে তিনজন পুলিশ। এখানে সবরকম গালমন্দই চলতে পারে, কিন্তু হাতাহাতির উপক্রম হলেই পুলিশ বাধা দেবে।

এরকম ভিড়ের জায়গায় একটি মেয়ের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছে কেন রাতুল? উত্তরটা বুঝতে শাজাহানের অসুবিধে হলো না। মহিলাটি বিবাহিতা, হিন্দু বাড়ির বউ, সিঁথিতে সূক্ষ্ম সিঁদুরের রেখা। রাতুল যেভাবে মহিলাটির কোমর জড়িয়ে ধরে ঘনিষ্ঠ হয়ে আছে, নিজের স্ত্রীর সঙ্গে সাধারণত কেউ এরকম আদিখ্যেতা করে না। পরস্ত্রীদের সঙ্গে প্রেম করার ব্যাপারেই রাতুল স্পেশালাইজ করেছে।

মিনিট পাঁচেক পরেই রাতুল মহিলাটিকে নিয়ে পার্কের মধ্যে চলে গেল। একটি ঝোঁপের আড়ালে বসে দু-এক মিনিট খুনসুটি করার পর যখন ওরা প্রথম চুম্বনে আবদ্ধ হলো, সেই পর্যন্ত। দেখে শাজাহান মুখ ফেরালেন। তাঁর মন আত্মগ্লানিতে ভরে গেল। ছি ছি, এত নীচে তিনি নামলেন কী করে? লুকিয়ে লুকিয়ে তিনি অন্যের প্রেম করার দৃশ্য দেখছেন, তাঁর এত দূর অধঃপতন! রাতুল যা ইচ্ছে করুক।

বেশ কয়েক বছর ধরে নিঃসঙ্গতাকে ভালোবেসে ফেলেছিলেন শাজাহান, কিন্তু আজ কিছুতেই হোটেলের ফাঁকা ঘরে ফিরতে ইচ্ছে হলো না। খুব পছন্দের দু-চারজন ছাড়া শাজাহান কখনো অন্যদের বাড়ি যান না, আজ তিনি বিষমভাবে চাইলেন মানুষের সাহচর্য! অন্যদের সঙ্গে কথা বলে তিনি রাতুলকে ভুলতে চান। কিন্তু কোথায় যাবেন? হঠাৎ কারুর বাড়িতে গিয়ে হাজির হওয়া শাজাহানের পক্ষে কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। একটা পাবলিক বুথে গিয়ে তিনি ৪ ০৪

ফোন করলেন আলমকে।

আলম বাড়িতে নেই, ফোন ধরলো তুতুল। শাজাহান প্রথমে তার স্বাস্থ্যের খবর নিয়ে তারপর জিজ্ঞেস করলেন, আজ ইভনিং-এ তোমরা আমার সঙ্গে বাইরে ডিনার খাবে? আমি শিগগিরই অ্যামস্টারডাম চলে যাচ্ছি, বেশ কিছু দিন সেখানে থাকতে হবে, তোমাদের সঙ্গে আর দেখা হবে না।

তুতুল বললো, আজ সন্ধেবেলা আমাদের এখানেই যে আলমের কয়েকজন বন্ধুবান্ধব আসছে। আমি রান্না করছি। আপনিও চলে আসুন না। আসুন, আমাদের খুব ভালো লাগবে।

একটু থেমে তুতুল আবার হাসতে হাসতে বললো, ত্রিদিবমামার আসার কোনো কথা নেই। আর যদি হঠাৎ চলে আসেন, তাতেই বা কী, আরও তো অনেকে থাকবে। আমরা শিগগিরই কলকাতায় যাচ্ছি তো, তাই আজকের এই পার্টি। আপনি আসুন!

যে-পার্টিতে শাজাহানকে অন্তত তিন দিন আগে নেমন্তন্ন করা হয় না, সেখানে তিনি কখনো যোগ দিতে পারেন না। রবাহূত হয়ে কোনো পার্টিতে উপস্থিত হয়ে কেউ কেউ বেশ হৈ চৈ করে জমিয়ে দিতে পারে, সে যারা পারে, তারাই পারে, শাজাহানের চরিত্রে সেই উপাদান নেই। তিনি আরও দু-একজনকে ডিনারে নেমন্তন্ন করে ফেলেছেন বলে তুতুলের কাছে মাপ চেয়ে নিলেন।

এর পর শাজাহান ফোন করলেন আর একজনকে। ইনি পাকিস্তানী, বেশ সহৃদয় ও শিক্ষিত মানুষ। এর সঙ্গে কথা বলে শাজাহান আনন্দ পান। ফোন বেজে গেল, কেউ ধরলো না।

শাজাহান পকেট থেকে নোট বই বার করে আর একটি টেলিফোন নাম্বার খুঁজতে গিয়েও থেমে গেলেন। কেউ দেখছে না, তবু মানুষের সাহচর্য পাবার জন্য এই রকম হ্যাংলামিপানায় তিনি লজ্জিত বোধ করলেন। নাঃ, আর চেষ্টা করার দরকার নেই।

টিকিট কেটে তিনি ঢুকে পড়লেন একটি সিনেমা হলে। এখানে তো কত লোক রয়েছে। পর্দায় নারী-পুরুষেরা নড়ছে, কথা বলছে, তবু কিছুতেই শাজাহানের মন বসলো না। রাতুল একটি নারীকে চুম্বন করছে, এই দৃশ্যটি তিনি ভুলতে পারলেন না। তাঁর মনে হচ্ছে, ঐ নারীটি সুলেখা!

ফিল্মটি শেষ হবার অনেক আগেই বেরিয়ে এসে শাজাহান চলে এলেন সোহে স্কোয়ারে। আজ তিনি অন্যরকম একটি পরীক্ষা করে দেখবেন। এখানে একটি বার-এর নাম কনট্যাকট। নিজে আগে না এলেও শাজাহান এই ধরনের বারগুলির ব্যাপার স্যাপার জানেন। তিনি দোতলায় উঠে একটা ফাঁকা টেবিলে বসলেন। ভেতরটা আবছা অন্ধকার, কাউন্টারের দু’পাশে তিন-চারটি করে যুবতী দাঁড়িয়ে আছে, তাদের মুখে ও ঠোঁটে উগ্র রং।

শাজাহান একটি দীর্ঘকায়া যুবতীর দিকে কয়েকবার তাকাতেই মেয়েটি তাঁর টেবিলের দিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো, হ্যালো, লাভ, মে আই জয়েন ইউ?

শাজাহান মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। মেয়েটি তাঁর পাশের চেয়ারে বসলো উরুতে উরু ছুঁইয়ে। শস্তা পারফিউমের গন্ধে শাজাহানের নাক একটু কুঁচকে গেল, তবু তিনি হেসে বললেন, হোয়াট উইল ইউ হ্যাভ?

মেয়েটি বললো, আই ওয়াজ হ্যাঁভিং স্কাছ! দুটি প্রিমিয়াম স্কচের পেগ এসে গেল টেবিলে। তার মধ্যে মেয়েটির গেলাসের মদে আগে থেকেই সোডা মেশানো। শাজাহান খুব ভালো করেই জানেন যে ঐ মেয়েটিকে শুধু একটু রং করা সোড়া দেওয়া হয়েছে, ওর মধ্যে স্কচের নাম-গন্ধও নেই। খদ্দেরদের ঠকিয়ে মদের বিলের অঙ্ক বাড়ানোই ওদের কাজ।

মেয়েটি বললো, আই অ্যাম ক্রিস্টিন। হোয়াটস ইয়োর নেইম, ডারলিং?

শাজাহান আবার হাসলেন। ব্রিটিশ মন্ত্রী জন প্রোফিউমোর সঙ্গে বারবনিতা ক্রিস্টিন কীলারের সম্পর্ক ফাঁস হয়ে যাবার পর অনেক দিন ধরে কেচ্ছা জমেছিল। তা এখনো মিলিয়ে যায়নি।

শাজাহান বললেন, ইফ ইউ আর ক্রিস্টিন, দেন আই অ্যাম জেনারেল আইয়ুব খান।

মেয়েটিও এবার হেসে উঠলো খিলখিল করে। পাকিস্তানের আগের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সঙ্গেও যে ক্রিস্টিন কলারের একটা সম্পর্ক ছিল, তা এই মেয়েটি জানে।

শাজাহান নিজের গেলাসে ঠোঁটও ছোঁয়ালেন না, আধ ঘণ্টার মধ্যেই মেয়েটি তিন গেলাস। সাবাড় করে দিল। বিল মেটাবার ইঙ্গিত করে শাজাহান বললেন, চলো, আমরা বাইরে গিয়ে ডিনার খাই।

ক্রিস্টিন বললো, আমার অ্যাপার্টমেন্টে যাবে? বাইরে থেকে কিছু খাবার পিক আপ করে নিয়ে যেতে পারি। সেখানে তুমি রিল্যাক্স করতে পারবে।

শাজাহান বললো, সে তো খুব ভালো কথা। তাই চলো। ক্রিস্টিন গলা নামিয়ে বললো, তুমি আমাকে একশো পঁচিশ পাউণ্ড ধার দিতে পারবে? আমার বিশেষ দরকার আছে।

একেবারে দরাদরি না করলে যুবতীটি তাঁকে একেবারে সদ্য আগত গবেট ভাববে, তাই তিনি বললেন, আমি সেভেন্টি ফাইভ পর্যন্ত স্পেয়ার করতে পারি।

ক্রিস্টিন বললো, মেক ইঁট ওয়ান হান্ড্রেড!

শাজাহান ওয়ালেট বার করে নোটগুলো শুনে টেবিলের ওপর রাখলেন। মেয়েটি সেগুলো নিয়ে উঠে চলে গেল। নতুন লোক দেখলে এরা আগে টাকা নিয়ে নেয়, এখানেই জমা রাখে? এই হোটেলের মালিক একটা পারসেন্টেজ কেটে নেয়? শাজাহান এদের ব্যবসার ধরনটা বোঝার চেষ্টা করলেন।

ফিরে এসে ক্রিস্টিন বললো, চল!

বাইরে তিন-চারখানা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। এই ট্যাক্সি চালকদের সঙ্গেও এদের বিশেষ চুক্তি আছে। ইচ্ছে করে অনেকটা ঘুরিয়ে নিয়ে যাবে, মিটার বেশি বলবে। গাড়িতে ওঠার পর ক্রিস্টিন শাজাহানের একটা হাত জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করলো, তুমি কি প্যাকি না ইণ্ডিয়ান?

শাজাহান কৌতুক করে বললেন, কোনোটাই না। আমি ইজিপশিয়ান। ক্রিস্টিন চোখ বড় বড় করে বললো, ইজিপশিয়ান? দে আর গ্রেট লাভারস! ওমর শরীফ!

শাজাহান ভাবলেন, তিনি নিজেকে ইণ্ডিয়ান বললে, এই মেয়েটি কোন ভারতীয় প্রেমিকের নাম করে উচ্ছ্বসিত হতো? হলিউডের এককালের অভিনেতা সাবু ছাড়া আর কোনো ভারতীয় ফিল্মস্টারকে কি এরা চেনে?

কিন্তু শেষ পর্যন্ত জমলো না।

খানিকটা খাবারদাবার কিনে নিয়ে যাওয়া হলো ক্রিস্টিনের ফ্ল্যাটে। যুবতীটি বেশ সরল, নানা বিষয়ে কৌতূহল আছে। কিন্তু সে যখন প্রায় নগ্ন হয়ে শাজাহানকে ডাকলো, শাজাহান নিজের মধ্যে কোনো সাড়া পেলেন না। এর শরীর সম্পর্কে তাঁর একটুও আগ্রহ জাগছে না। ক্রিস্টিন একবার প্রায় জোর করে তাঁকে আলিঙ্গন করলে তিনি অস্ফুট স্বরে বললেন, কোল্ড মিট! ক্রিস্টিন তাঁকে চুম্বন করতে এলে তিনি মুখ সরিয়ে নিলেন।

মাত্র কিছুক্ষণের আলাপেই একটি নারীর সঙ্গে এতখানি ঘনিষ্ঠ হওয়া তাঁর পক্ষে অসম্ভব। অন্য অনেকে কী করে পারে? যে-ছবিটা তিনি মুছতে চেয়েছিলেন, সেই ছবিটাই চোখে ভেসে উঠছে বারবার, হাইড পার্কে রাতুল চুমু খাচ্ছে একটি বিবাহিতা বাঙালি মহিলাকে। সে কি কোনোদিন সুলেখাকেও…

ক্রিস্টিনের সঙ্গে শুধু গল্প করতে তাঁর মন লাগছিল না, কিন্তু শারীরিক আহ্বান প্রত্যাখ্যান করায় সে দারুণ চটে গেল, গালাগাল করতে শুরু করলো শাজাহানকে। আরও পঁচিশটি পাউণ্ড তার ড্রেসিং টেবলের ওপর রেখে শাজাহান বেরিয়ে এলেন।

তাঁর অসম্ভব কষ্ট হচ্ছে, বুকটা মুচড়ে মুচড়ে উঠছে। না, তিনি অস্কার ওয়াইল্ডের মতন সমকামী নন, সেটা তিনি ভালোই জানেন। শুধু করমর্দন ছাড়া তিনি পুরুষের স্পর্শ বাঁচিয়ে চলেন, কখনো বাধ্য হয়ে ব্যাটাছেলেদের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসতে হলে তিনি অস্বস্তি বোধ করেন। তাঁর আকর্ষণ নারীদের প্রতি, কোনো সুন্দরী রমণীর মুখের দিকে তাকিয়েও তিনি এক ধরনের আনন্দ পান, অথচ কারুর সঙ্গে অন্তরঙ্গতা হয় না, তিনি নিজেই পিছিয়ে যান, কোথায় যেন একটা বাধা এসে যায়। এইরকম ভাবেই বাকি জীবনটা কেটে যাবে?

ক্রিস্টিনের অ্যাপার্টমেন্টে কী রকম যেন একটা গন্ধ ছিল, তাতে শাজাহানের একটু একটু গা। ঘিনঘিন করছিল, সেই জন্য তিনি একটুও খাবার মুখে তোলেননি। আর কিছু খেতেও ইচ্ছে। করলো না, সোজা ফিরে এলেন হোটেলে। দ্রুত পোশাক ছেড়ে তিনি গরম জলে স্নান করলেন অনেকক্ষণ ধরে। বারবার আপনমনে বলতে লাগলেন, রাতুল আমাকে চড় মেরেছিল, তবু আমি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। আমি সুলেখাকে ভুলে যাবো। ত্রিদিবের সঙ্গে আর কোনোদিন দেখা হবে না!

গোসল করে এসে তিনি শেক্সপীয়ারের রচনাবলী খুলে বসলেন। শেক্সপীয়ার তাঁর সব কিছু ভুলিয়ে দিতে পারেন। কোনো বিশেষ লেখার কথা চিন্তা না করে তিনি বইটার যে কোনো একটা জায়গা খুললেন, ডান দিকের পাতার দ্বিতীয় কলামের ওপর থেকে পড়তে শুরু করলেন :

Of one that loved not wisely, but too well;
Of one not easily jealous, but being wrought,
Perplexed in the extreme; of one whose hand,
Like the base Indian, threw a pearl away,
Richer than all his tribe; of one whose subdu’d eyes
Albeit unused to the melting mood…

বাকিটা আর পড়ার দরকার হয় না, শাজাহানের মুখস্থ। ওথেলো নাটকের একেবারে শেষ অংশ। তাঁর নিজের মনের কথার সঙ্গে যেন একেবারে মিলে যাচ্ছে। নিজের গলায় হাত দিয়ে তিনি আস্তে আস্তে বললেন, I took by the throat the circumcised dog…।

না, ক্রোধ, হিংসা, ঈষার ঊর্ধ্বে উঠতে চান শাজাহান, এখন ওথেলো তাঁর ভালো লাগবে। না। তিনি আন্দাজে আবার পাতা ওল্টালেন। আবার তাঁর চোখে পড়লো এইরকমই লাইন :

My hate to Március. Where I find him, were it
At home, upon my brothers guard, even there
Against the hospitable Canon, would I
Wash my fierce in his heart…

শাজাহান চোখ বুজে ফেললেন। প্রতিহিংসায় কখনো শান্তি পাওয়া যায় না। ট্রাজেডির নায়কেরা কাব্যেই মহান হয়, কিন্তু জীবনে তারা শুধু কিছু অনর্থই সৃষ্টি করে যায়। শাজাহান আর কারুকে তো আঘাত দিতে চান না, তিনি নিজেই দূরে সরে যাবেন।

তার চোখ দিয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো।

শেক্সপীয়ার বন্ধ করে তিনি কয়েক মিনিট চিন্তা করলেন। তার পর টেনে নিলেন কোরআন শরীফ। ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের অনুবাদ করা কোরআন শরীফখানা তিনি সব সময় সঙ্গে রাখেন। শাজাহান ধর্মচচা বিশেষ করেন না কিন্তু ধর্মশাস্ত্র পাঠে আগ্রহ আছে। বাংলা ভাষায় তেমন অধিকার নেই শাজাহানের। তিনি ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াশুনো করেছেন এবং তাঁদের পরিবারে উর্দুতেই কথাবার্তা বলা হতো। বাংলা তিনি পড়তে জানেন, তবে সব কথার অর্থ বুঝতে অসুবিধে হয়।

তিনি পড়তে লাগলেন : যেমন একটি শস্যবীজ সাতটি শস্যমঞ্জুরী উৎপাদন করে, প্রত্যেক মঞ্জুরীতে শত শস্য উৎপন্ন হয়, পরমেশ্বরের পথে যাহারা স্বীয় সম্পত্তি ব্যয় করে তাহাদের অবস্থা তদ্রুপ, এবং যাহাকে ইচ্ছা হয় ঈশ্বর দ্বিগুণ প্রদান করেন, এবং ঈশ্বর দাতা ও জ্ঞাতা।…

দানের পরে ক্লেশ প্রদান করা অপেক্ষা কোমল কথা বলা ও ক্ষমা করা শ্রেয়ঃ, এবং ঈশ্বর নিরাকাঙক্ষ ও প্রশান্ত।

হে বিশ্বাসী লোকসকল, উপকার স্থাপন ও ক্লেশ দান করিয়া যে ব্যক্তি তোক প্রদর্শনের জন্য স্বীয় ধন দান করে, পরমেশ্বর ও পরকালে বিশ্বাস রাখে না, তাহার ন্যায় তোমাদিগের ধমর্থ দান তোমরা ব্যর্থ করিও না। সে মৃত্তিকাবৃত কঠিন প্রস্তরের ন্যায়…

পড়তে পড়তে একসময় ঘুমিয়ে পড়লেন শাজাহান। তার ওষ্ঠে লেগে রইলো যন্ত্রণার রেখা।

পর দিনও শাজাহানের মন শান্ত হলো না। সারা দিন কাজের মধ্যে ডুবে থেকেও তিনি বিকেলবেলা আবার এসে হাজির হলেন রাতুলের অফিসের সামনে। তাঁর নিয়তি তাকে যেন টেনে নিয়ে আসছে। রাতুলকে খানিকক্ষণ অনুসরণ করবার পর তিনি হঠাৎ থেমে গেলেন। নিজের গলা টিপে ধরার ইচ্ছে হলো তাঁর। রাতুলের মতন একজন সামান্য জীবের জন্য তিনি এরকম ভাবে সময় নষ্ট করছেন! উল্টো দিকে ফিরে হাঁটতে হাঁটতে এক সময় তিনি এসে পৌঁছোলেন ওয়াটার্ল ব্রীজে। ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে রইলেন এক ঘণ্টা। অন্তত তিনবার তাঁর নদীতে ঝাঁপ দেবার তীব্র ইচ্ছে জাগলো। তিনি রেলিং চেপে ধরে রইলেন, তিনি অনুভব করলেন, কোনো একটা রোগ তাঁর মনোবল জীর্ণ করে দিয়েছে। জীবনের সব কিছুই বিস্বাদ লাগছে। বেঁচে থাকার মর্মটাই হারিয়ে যাচ্ছে যেন।

ব্রিস্টলের একটা ফাণ্ড রেইজিং মিটিং-এ যোগ দিতে শাজাহান চলে এলেন জোর করে। শনিবার মিটিং, রবিবারটাও তিনি থেকে গেলেন একটা হোটেলে, বেশ কিছু ভারতীয় ও পাকিস্তানী বাঙালির সঙ্গে সময় কাটালেন অনেকক্ষণ, টাকাও মন্দ উঠলো না। এই দুদিন তিনি রাতুলকে অনেকটা ভুলে থাকতে পেরেছিলেন। এর পরের মিটিং গ্লাসগো-তে, সেখানে শাজাহান যাবেন ঠিক করেও যাওয়া হলো না। লণ্ডন থেকে তাঁর অফিস সেক্রেটারি ফোন করে জানালো যে তাঁর ব্যবসা কেনার জন্য একজন বিশেষ আগ্রহী, অবিলম্বে কথা বলতে চায়।

লণ্ডনে ফিরতেই শাজাহানের মনটা আবার বিষিয়ে গেল। এই শহরের রাস্তা দিয়ে রাতুল হেঁটে বেড়ায়, দিব্যি আনন্দে আছে সে। এই চিন্তাটা শাজাহান কিছুতেই সহ্য করতে পারছেন না। মাঝে মাঝে অস্ফুটভাবে তিনি বলতে লাগলেন, কে আমাকে শিখিয়ে দেবে, কী করে একজন শত্রুকেও নিঃশর্তে ক্ষমা করা যায়?

বিকেল থেকে রাত পৌনে এগারোটা পর্যন্ত শাজাহান রাতুলের পেছনে পেছনে ঘুরলেন। ঝানু গোয়েন্দার চেয়েও যেন তার দৃষ্টি প্রখর, ধৈর্য অনেক বেশি। একবারও তিনি রাতুলকে চোখের আড়ালে যেতে দেননি।

রাতুল আজও সেই মহিলাটির সঙ্গে দেখা করেছে বেলসাইজ পার্কের কাছে একটি রেস্তোরাঁয়। সেখানে একটুক্ষণ বসার পরেই তারা একটা থিয়েটার দেখতে গেল। ওদের আগেই টিকিট কাটা ছিল, শাজাহান টিকিট পেলেন না, তিনি বাইরে বাইরে ঘুরে সময় কাটালেন। থিয়েটার থেকে বেরিয়ে ওরা হাতে হাত ধরে কিছুক্ষণ বেড়ালো। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আইসক্রিম খেল। তারপর মহিলাটিকে একটি বাসে তুলে দিল রাতুল। ওরা কেউ কারুরর বাড়ি যায় না, নিশ্চয়ই কোনো বাধা আছে।

রাতুল টিউবে ওঠার পর শাজাহান সেই একই কম্পার্টমেন্টে উঠলেন। এই কামরায় মাত্র দশ বারোজন যাত্রী, শাজাহান এক কোণে গিয়ে বসলেও রাতুল তাঁকে দেখে ফেলতে পারে। তাতে কোনো ক্ষতি নেই, শাজাহান বুঝেছেন যে রাতুলের সঙ্গে কথা না বলে তিনি ফিরতে পারবেন। না। আজ তিনি সব সংযম হারিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু রাতুল অন্য কোনো দিকে মনই দিচ্ছে না, সে খানিকটা শরীর এলিয়ে বসে পায়ের ওপর পা তুলে নাচাচ্ছে।

প্রায় চল্লিশ মিনিট পরে, ট্রেন ভূগর্ভ ছেড়ে মাটির ওপরে ওঠার পর একটা স্টেশনে রাতুল নামতেই শাজাহানও সঙ্গে সঙ্গে নেমে পড়লেন। সম্ভবত টারমিনাসের কাছাকাছি এসে গেছে, আরও বেশ কিছু যাত্রী নামলো এখানে। রাতুল বেশ দ্রুত এগিয়ে গেল, স্টেশন থেকে বেরিয়ে ডানদিকে ঘুরে মিনিট পাঁচেক হেঁটে রাতুল ঢুকে পড়লো একটা পার্কিং লটে। সেখানে একটিমাত্র গাড়ি রয়েছে।

শাজাহান বুঝলেন যে রাতুলের নিজের গাড়ি থাকলেও লন্ডন শহরে নিয়ে যায় না। অক্সফোর্ড স্ট্রিটে গাড়ি পার্ক করা অসম্ভব ব্যাপার। সেই জন্যই রাতুল নিজের বাড়ি থেকে এই পর্যন্ত গাড়িতে আসে, তারপর গাড়িটা পার্কিং লটে রেখে ট্রেনে যাতায়াত করে। এবার রাতুল হুস করে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাবে, শাজাহান আর তাকে ধরতে পারবেন না। কাছাকাছি কোনো ট্যাক্সিও নেই।

রাতুল গাড়িতে উঠে স্টার্ট দেবার চেষ্টা করলো কয়েকবার, কিন্তু ইঞ্জিন থেকে একটা বেসুরো শব্দ বেরুলো। আজ সারাদিন খুব ঠাণ্ডা বাতাস বইছে, এখন আবার ইলশে গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। প্রথম দিকের শীতটাই বেশি কনকনে লাগে। গাড়ির ইঞ্জিনেরও ঠাণ্ডা লেগেছে বোধ হয়। রাতুল বেরিয়ে এসে গাড়ির বনেটটা খুলে উঁকি দিল।

নিয়তি শাজাহানকে এই পর্যন্ত টেনে এনেছে, নিয়তিই যেন এই সুযোগ করে দিল, আর দ্বিধা করার কোনো মানে হয় না। কাছে এগিয়ে গিয়ে শাজাহান বললেন, গুড ইভনিং। এনি প্রবলেম? মে আই হেল্প ইউ?

চমকে মাথাটা তুলে রাতুল বেশ কয়েক পলক তাকিয়ে রইলো শাজাহানের দিকে। ত্রিদিবের মতন শাজাহানের চেহারার বিশেষ পরিবর্তন হয়নি, তাঁকে চিনতে না পারার কোনো কারণ। নেই। আর কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে রাতুল বললো, কী ব্যাপার?।

শাজাহান বললেন, আপনাকে দেখলাম এই স্টেশনে নামতে। আপনার গাড়ি নিয়ে কোনো প্রবলেম হয়েছে?

রাতুল ভুরু কুঁচকে বললো, আপনি এদিকে এত রাত্রে? হ্যাঁরোতেই থাকেন নাকি?

শাজাহান আলগাভাবে বললেন, জী, কাছাকাছিই থাকি বলতে পারেন।

আপনার গাড়িতে খানিকটা লিফট নেবো? এতদিন পরে দেখা হলো, অনেক কথা আছে। আমি ভেতরে বসে অ্যাক্সিলারেটার চাপবো, তাতে সুবিধে হবে?

রাতুল গম্ভীরভাবে বললো, থ্যাঙ্কস! নো, ইটস গোয়িং টু বি অল রাইট।

শাজাহান রাতুলের কথা অগ্রাহ্য করে ড্রাইভারের সীটে বসে পড়লেন। এককালে তাঁর গাড়ি চালাবার যথেষ্ট অভ্যাস ছিল। কিন্তু তিনি কিছু করার আগেই ইঞ্জিনটা সুস্থ হয়ে উঠলো। বনেট চেপে দিয়ে রাতুল এদিকে আসতেই শাজাহান পাশের সীটে সরে গিয়ে বললেন, আসুন। আই অ্যাম লাকি!

রাতুল ড্রাইভারের সীটে বসে বেল্ট বাঁধতে বাঁধতে বললো, লিন, লেটস বী স্ট্রেট! পুরনো সম্পর্ক নিয়ে আমার কোনো হ্যাঁঙ-আপ নেই। পুরনো ব্যাপার-ট্যাপার আমি সব মুছে ফেলেছি। আমি আজ খুবই টায়ার্ড, সোজা বাড়ি যাবো, আপনাকে লিফট দিতে পারছি না।

শাজাহান বললেন : মুছে ফেলবো বললেই কি সব মোছা যায়? মানুষের মন তো আর স্লেট নয়! ত্রিদিবের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ হয়নি?

রাতুল কর্কশ গলায় বললো, সে আমাকে টেলিফোনে মাঝে মাঝে পেস্টার করছে। আমি তাকে পরিষ্কার বলে দিয়েছি, আমি তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে ইন্টারেস্টেড নই। কলকাতা আর দিল্লির চ্যাপটার ক্লোজড। নাউ ইফ ইউ প্লিজ গেট অফ…।

–পুরনো সব চ্যাপটার ক্লোজড। ত্রিদিবের জীবনটা আপনি নষ্ট করে দিয়েছেন। আমি নিজেও আজ পর্যন্ত সাফার করছি। আর আপনি শুধু সব কিছু ভুলে গিয়ে আবার প্রেম করবেন, চাকরিতে উন্নতি করবেন, আনন্দে থাকবেন? সিক্সটি ফাইভের ওয়ারের সময় আপনি যে আমাকে পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছিলেন, সেটাও ভুলে গেছেন?

–হু সেইড আই ডিড দ্যাট!

–প্রমাণ আছে, আমি ঠিকই জেনেছি। দিল্লিতে আপনি আমাকে চড় মেরেছিলেন, পাকিস্তানের স্পাই বলেছিলেন।

–ইউ স্টিল আর আ ডাটি স্পাই। আপনি আমার পেছন পেছন ফলো করে এই পর্যন্ত এসেছেন। এখন বুঝতে পারছি। কী চান আপনি?

সুলেখা তোমারই জন্য মরেছে। তুমি ওদের বাড়িতে নোংরামি করে ফেলেছিলে তাই পারফেক্ট জেন্টলম্যান ত্রিদিব সুলেখাকে মুক্তি দেবার কথা বলেছিল। তোমার জন্যই সে বলেছিল। সে কথা শুনে ঘেন্নায় সুলেখা গায়ে আগুন লাগিয়েছে। দোষ তোমার, পুরোপুরি তোমার, ত্রিদিবের নয়।

–স্কাউন্ট্রেলের মতন কথা বলো না, শাজাহান। আমি এসব কথা সহ্য করতে রাজি নই। শুনতেও চাই না। লীভ মি অ্যালোন!

–তোমাকে ক্ষমা চাইতে হবে, সব কিছুর জন্য ক্ষমা চাইতে হবে।

খুব সম্ভবত শাজাহানকে একটা চড় মারার জন্যই ঘুরে গিয়ে হাত তুলেছিল রাতুল, অতি কষ্টে নিজেকে সামলে নিল। তারপর ঝুঁকে অন্য দিকের দরজাটা খুলে দিয়ে সে শাজাহানকে একটা ধাক্কা দিয়ে বললো, নাউ, গেট আউট!

হয়তো এটার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন শাজাহান। কোটের পকেট থেকে ফস করে একটা রিভলভার বার করে রাতুলের নাকে ঠেকালেন, অন্য হাতে দরজাটা আবার বন্ধ করে দিয়ে বললেন, আমার কথা এখনো শেষ হয়নি। আর কখনো কোনো লোককে এভাবে ধাক্কা দিও না। আমি মুসলমান, আমরা কখনো বেইমানি ক্ষমা করি না। তুমি একবার আমার গায়ে হাত তুলে অপমান করেছিলে, আমি তার শোধ নিইনি। তবু তুমি দ্বিতীয়বার আমার গায়ে হাত তোলার সাহস করলে!

শাজাহানের হাতের অস্ত্রটাকে বেশি গুরুত্ব দিল না রাতুল। শাজাহানের মতন চরিত্রের মানুষের হাতে একটা রিভলভার খুবই বেমানান, প্রায় অবিশ্বাসই মনে হয়। আত্মবিশ্বাস, অহঙ্কার ও রাগে রাতুলের মুখখানা জ্বলজ্বল করছে। সে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, তুমি এতদিন পর আমাকে এই সব বাজে কথা শোনাতে এসেছো। তুমি জানো, সুলেখা আমাকে বিয়ে করতে। রাজি হয়েছিল? সে নিজের মুখে আমাকে বলেছে, কলকাতা ছাড়ার আগে।

বাট ইউ ওয়্যার দা ডগ ইন দা ম্যানজার! তুমি সব সময় ওদের বাড়িতে সেঁটে থাকতে। ত্রিদিব তোমার জন্যই সুলেখাকে সন্দেহ করে!

শাজাহান বললেন, তোমার মতন একটা মিথ্যেবাদী, ক্রুড, কোর্স, আনকাল্ডারড় মানুষকে সুলেখা…

রাতুল হাত দিয়ে রিভলভারটা ধরার চেষ্টা করতেই শাজাহান পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে দু’বার তাকে গুলি করলেন। গাড়ির সব কাচ বন্ধ, তাই বাইরে বিশেষ শব্দ গেল না।

বেশ কয়েক মুহূর্ত হুমড়ি খেয়ে পড়া নিস্পন্দ দেহটার দিকে তাকিয়ে থেকে শাজাহান ফিসফিস করে বললেন, গুড বাই, রাতুল। খোদা হাফেজ!

দরজা খুলে বেরিয়ে এসে তিনি চারদিকটা দেখে নিলেন একবার। পার্কিং লটে কোনো গার্ড নেই, কাছাকাছি কোনো বাড়িও নেই। বৃষ্টির জলে কিছুটা জায়গা কাদা কাদা হয়ে আছে, এখনও বৃষ্টি পড়েই চলেছে। শাজাহান ওভার কোটের কলারটা তুলে দিয়ে, দু’ পকেটে হাত ঢুকিয়ে আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগলেন রাস্তা দিয়ে। এই স্টেশন দিয়ে তিনি ট্রেনে উঠতে চান না।

একটুও অপরাধ বোধ নেই, বরং তাঁর মনটা যেন বেশ হালকা হয়ে গেছে। অনেকগুলো জীবন নষ্ট করেছে রাতুল, তার বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। কাল সকালের আগে রাতুলের মৃতদেহ কারুর চোখেও পড়বে না। সকালবেলায় যারা গাড়ি রাখতে আসবে, তারা সাধারণত অন্য গাড়ির দিকে চেয়েও দেখে না। সম্ভবত বিকেল হয়ে যাবে। একজন এশিয়ান খুন হলে তা নিয়ে ইংরেজ পুলিশ কি খুব বেশি মাথা ঘামায়?

বৃষ্টি ভিজলেও সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই শাজাহানের। তিনি হেঁটে চলেছেন মাইলের পর মাইল। পথে আর কোনো মানুষ নেই, এ পর্যন্ত কোনো পুলিশের গাড়িও তাঁর নজরে পড়েনি। একটা প্রশ্ন তিনি নিজেকে করছেন বার বার, ত্রিদিবের মুখ থেকে লন্ডনে রাতুলের উপস্থিতি জানবার পরই কি রাতুলকে খুন করার কথা তিনি ভেবেছিলেন? না হলে সেদিন থেকেই তিনি। রিভলভারটা সব সময় সঙ্গে রাখতে শুরু করেছিলেন কেন? এতদিন ধরে এতখানি ক্রোধ চাপা দেওয়া ছিল? অথচ রাতুলকে তিনি ক্ষমা করতেও চেয়েছিলেন। রাতুল ক্ষমা পাওয়ার যোগ্যতার কোনো প্রমাণ দিতে পারলো না।

পরদিন সকাল আটটায় শাজাহান সেন্ট্রাল লন্ডনে এসে একটা ইওরোপিয়ান কোচের টিকিট কেটে উঠে বসলেন। সেখান থেকে ডোভার। সুটকেসটা চেক ইন করিয়ে তিনি অপেক্ষা করতে লাগলেন লাউঞ্জে। একটু পরেই তাঁর জাহাজে ওঠার ডাক পড়বে। তিনি আর ধৈর্য ধরতে পারছেন না। একবার ইংলিশ চ্যানেল পার হতে পারলেই নিশ্চিন্ত।

লাউঞ্জটা হিপিতে ভর্তি। কয়েকজন ভারতীয়-পাকিস্তানীও রয়েছে। শাজাহান একটা সোফায় বসে ইমিগ্রেশান কন্ট্রোল গেটের দিকে চেয়ে আছেন। তাঁর হাতে বোর্ডিং কার্ড, আর কতক্ষণ, আর কতক্ষণ?

প্রথমে একটা বিরাট আকারের কুকুর, তারপর দু জন পুলিশ অফিসার ঢুকে এলো লাউঞ্জে। শাজাহানের বুকে দুম দুম শব্দ হচ্ছে। এর মধ্যেই ওরা টের পেয়ে গেল? একমাত্র ত্রিদিব ছাড়া আর তো কেউ রাতুলের সঙ্গে তাঁর কোনো যোগসূত্র আবিষ্কার করতে পারবে না। ত্রিদিব তাঁকে ধরিয়ে দেবেন?

পুলিশ দু জন এদিক ওদিক চেয়ে সোজা শাজাহানের দিকেই আসছে। শাজাহান একবার ভাবলেন উঠে টয়লেটে ঢুকে পড়বেন। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। আর কোনো উপায় নেই।

একজন পুলিশ শাজাহানের পাশে এসে বললো, এক্সকিউজ মি, আর ইউ মিঃ যোগিন্ডার সিং?

বোমা ফাটার মতন শব্দ করে শাজাহান বললেন, নো!

পুলিশটি হাত বাড়িয়ে বললো, মে আই সি ইয়োর পাসপোর্ট?

হঠাৎ কুকুরটি গর্জন করে একজনের দিকে তেড়ে গেল। সে দরজার দিকে পালাবার চেষ্টা করছিল। কুকুরটি তার গায়ে দু পা তুলে হিংস্রভাবে চ্যাঁচাচ্ছে। অফিসারটি তাড়াতাড়ি শাজাহানকে পাসপোর্টটা ফেরত দিয়েই ছুটে গেল সেদিকে। খুব সম্ভবত নারকোটিক্স স্মাগলিং-এর ব্যাপার।

এই সব গোলমালের মধ্যেই মাইক্রোফোনে শাজাহানের জাহাজের নাম ঘোষণা করা হলো। তিনি পাসপোর্ট হাতে নিয়ে এগিয়ে গেলেন। বুকের মধ্যে দুম দুম শব্দটা এখনো থামেনি, তার হাত-পা কাঁপছে।

তারপর জাহাজ যখন ভেসে পড়লো ইংলিশ চ্যানেলে, ডেকে দাঁড়িয়ে অনেকখানি সামুদ্রিক বাতাস বুকে টেনে নিয়ে শাজাহান মনে মনে বললেন, মুক্তি, মুক্তি! এখন থেকে তিনি অন্য মানুষ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *