পঞ্চাশ
সারাটা রাত হাসপাতালের বারান্দায় কেটেছে এবং কি আশ্চর্য, ভোরের দিকে বসেই বসেই ঘুমিয়ে পড়েছিল অর্ক। হঠাৎ সংবিৎ ফিরতেই সে উঠে দাঁড়াল। কাল রাত্তিরে অনেক চেষ্টা করেও সে মায়ের কাছে পৌঁছতে পারেনি। কড়া নিয়মকানুনগুলোকে সে মানতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু তিন নম্বরের ঘরে বসে যা হয়নি এখানে এসে তা হয়েছিল। মনের ছটফটানিটা কমেছিল। এই বিশাল বাড়ির একটা ঘরের বিছানায় মাধবীলতা শুয়ে আছে আর সে তারই কাছাকাছি বারান্দায়—এটাই যেন অনেকটা আরামের মনে হয়েছিল। মা এখন হাতের মধ্যেই, এই বোধ তাকে নিশ্চিত করেছিল। একটা মানুষের জন্যে আর একটা মানুষের বুকের মধ্যে এই যে একধরনের আঁচড়কাটা শুরু হয় এবং তার একটা মানানসই সান্ত্বনায় না আসা অবধি যে উপশম হয় না তাকে কি বলে? অর্ক যেন এসবই বুঝতে পারছে। এইভাবে সে ভাবতে পারত না আগে, বড্ড তাড়াতাড়ি সে অন্য মানুষের চেয়ে বড় হয়ে যাচ্ছে। আর কি আশ্চর্য, নিজেকে বড় ভাবতে ভাল লাগছে তার।
ভাঁড়ের চা হাতে নিয়ে সে হাসপাতালটাকে দেখছিল। চারধারে কেমন ঢিলে ঢিলে ভাব। অথচ এর মধ্যেই কিছু মানুষ আউটডোরের সামনে জড় হয়েছে। সেই লোকটা কোথায়? যে সব মুশকিল আসান করে দেয় এই হাসপাতালে! অর্ক তাকে দেখতে পেল না।
শরীর থেকে বিচ্ছিরি গন্ধ বের হচ্ছে। জামাকাপড় বেশ ময়লা। আজকাল ঠিকঠাক কাচাকুচি হয় না। নিজের দিকে তাকিয়ে শরীর গুলিয়ে উঠল। এত ময়লা পোশাকে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে? অর্ক বসার জায়গা পাচ্ছিল না। এখন স্বচ্ছন্দে বারান্দায় বসতে পারল। অনেক লোক এখানে বসে আছে এবং তাদের পোশাক ও চেহারা দেখলে বোঝা যায় যে কোনরকম মানসিক খুঁতখুঁতুনি নেই। যে-কোন পরিবেশেই এরা হাঁটু গেড়ে বসে ভবিতব্যের জন্যে অপেক্ষা করতে পারে।
সকালবেলায় হাসপাতালের ভেতরটা অন্যরকম দেখায়। টাটকা ওষুধের গন্ধ এবং একটা অগোছালো ঘরোয়া ভাব বেশ টের পাওয়া যায় ভেতরে ঢুকলে। এমনকি রুগীদের চেহারাও স্বাভাবিক দেখায়। অর্ক মাধবীলতার কাছে যাওয়ার অনুমতি যখন পেল তখন রুগীদের ছিমছাম করে দেওয়া হয়েছে। মায়ের বিছানার সামনে গিয়ে অর্কর হৃৎপিণ্ড যেন লাফিয়ে উঠল। মাধবীলতা বালিশে পিঠ দিয়ে আধো-শোওয়া হয়ে আছে। ওকে দেখামাত্রই মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে পড়ল মুখে। অর্ক মুগ্ধ চোখে মায়ের দিকে তাকিয়েছিল। মুখের চামড়া সাদা, সমস্ত দেহে ক্লান্তি এঁটে বসেছে অথচ মুখখানায় একটু হাসি প্রতিমার মত সৌন্দর্য এনেছে। ছেলে দাঁড়িয়ে আছে দেখে মাধবীলতা চোখ ছোট করল, ‘কি হল, আয়!’
অর্ক পায়ে শক্তি পাচ্ছিল না। মাকে দেখা মাত্র তার সব দুশ্চিন্তা যেন মুহূর্তেই উধাও হয়ে গিয়েছে কিন্তু অদ্ভুত একটা অবসাদ তাকে গ্রাস করল। তার মা যদি এত ভাল তাহলে সে বাস্টার্ড হয় কি করে? কেন তার কোন মূল্যবোধ থাকবে না? সঙ্গে সঙ্গে ভেতর থেকে কেউ প্রতিবাদ করল, কে বলেছে তা নেই? না থাকলে মাকে দেখামাত্র বুকের ভেতরটা এমন টনটন করবে কেন? এমন আনন্দিত হবে কেন? হঠাৎ সে আবিষ্কার করল কেউ বাস্টার্ড হয়ে জন্মায় না, জন্মাবার পর তার আচরণ তাকে বাস্টার্ড করে তোলে।
মাধবীলতার বিস্ময় বাড়ছিল। সে আবার ডাকল, ‘কি রে?’
এবার অর্ক কাছে এল। এবং কাছে আসবার সময় সে আবেগের শিকার হল। তার গলার স্বর কেঁপে উঠল, ‘কেমন আছ?’
‘আমি ভাল আছি। দ্যাখ না আমার কোন ব্যথা নেই। সকাল থেকে নার্সকে দু’বার বললাম আমায় ছেড়ে দিতে কিন্তু শুনতেই চাইছে না। কি জ্বালা!’ মাধবীলতা হাসল এবং তারপরেই গম্ভীর হল, ‘কিন্তু তোর কি হয়েছে?’
অর্ক অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘আমার আবার কি হবে?’
‘আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছিস এর মধ্যে? ছি ছি।’ মাধবীলতা ঠোঁট কামড়াল।
অর্ক হতভম্ব হয়ে নিজের দিকে তাকাল। মাকে দেখতে এসে যে আক্রান্ত হতে হবে তা কল্পনা করেনি সে। লজ্জিত ভঙ্গীতে অর্ক বলল, ‘জামাপ্যান্টের কথা বলছ? ময়লা হয়ে গেছে, না?’
‘ময়লা? ওগুলো কোন ভদ্রলোক গায়ে দিতে পারে? কাল সারা দিন স্নান করিসনি? চুল আঁচড়াসনি? ইস, কি চেহারা হয়েছে তোর?’ মাধবীলতা ছেলের কাঁধে হাত দিল। বিছানার পাশের টুলটায় ততক্ষণে বসেছে অর্ক।
‘ছেড়ে দাও তো আমার কথা!’ অর্ক মাথা নাড়ল।
‘কেন, ছাড়ব কেন? দুদিন আমি না থাকলে যদি তোমার এই অবস্থা হয় তাহলে লোকে বলবে কি? মায়ের আদরে ছেলে এতকাল খোকা হয়ে ছিল!’
‘বেশ ছিলাম তো ছিলাম।’
‘কাল কোথায় খেয়েছিলি?’
অর্ক এবার হেসে ফেলল, ‘আমি কি এখনও ছেলেমানুষ আছি যে এসব প্রশ্ন করছ? ঠিক আছে, বিকেলে যখন আসব তখন দেখবে কি ফিটফাট।’
মাধবীলতা ছেলের গালে হাত রাখল। অর্কর মুখে এখন লাল-কালোয় মেশানো লোম যা আর কিছুদিনের মধ্যেই দাড়ির চেহারা নেবে। যদিও এখন তা খুবই নরম এবং সুন্দর দেখায় তবু আঙ্গুলের ডগা মাধবীলতাকে মনে করিয়ে দিল ছেলে বড় হয়েছে।
মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, ‘কাল রাত্রে ঘুমিয়েছিলি?’
‘বা রে, ঘুমাবো না কেন?’
‘আমাকে এখান থেকে কবে ছাড়বে খোঁজ নে তো! আর ভাল লাগছে না। শরীরে যখন কোন অসুবিধে নেই তখন এখানে খামোকা পড়ে থাকব কেন? আর কিইবা এমন হয়েছিল যে সাততাড়াতাড়ি আমাকে হাসপাতালে নিয়ে এলি?’
‘তুমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে।’
‘ও কিছু নয়, অম্বল টম্বল থেকে এসব হয়।’
‘তোমাকে এরা কিছু বলেনি?’
‘না তো।’
অর্ক অস্বস্তিতে পড়ল। মাকে সব কথা খুলে বলা ঠিক হবে কিনা কে জানে। অসুস্থ মানুষকে নাকি অসুখের বিবরণ জানাতে নেই। মাধবীলতা ছেলের হাত ধরল, ‘কি হয়েছে আমার? কি বলেছে এরা?’
‘তুমি এতকাল খুব অনিয়ম করেছ, খাওয়া দাওয়া করোনি। তোমার পেটে বেশ বড় ঘা হয়েছে। আজকালের মধ্যে অপারেশন করবে। অপারেশন না করলে তুমি বাঁচবে না। কিন্তু তোমার শরীরে রক্ত এত কম যে—।’ অর্ক চুপ করে গেল।
মাধবীলতা অর্কর হাতটা মুঠোয় ধরেছিল। এবার সেটাকে ছেড়ে হাসল, ‘তুই ওরকম মুখ করে কথা বলছিস কেন? আমি কি মরে গেছি?’
অর্ক বলল, ‘তুমি সত্যিই অদ্ভুত। আমাদের খাইয়েছ আর নিজে খাওনি? শরীরের রক্ত কমে গেছে সেকথা তুমি জানতে না?’
মাধবীলতা চোখ বন্ধ করল, ‘বাংলাদেশের কটা মেয়ের শরীরে ঠিকঠাক রক্ত আছে!’ তারপর চোখ খুলে বলল, ‘যাক এসব কথা। কিন্তু তুই একা এসব ঝামেলা সামলাবি কি করে? তার চেয়ে হোমিওপ্যাথি করালে ভাল হত।’
শক্ত মুখে অর্ক বলল, ‘কি করলে ভাল হত তা তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। আর আমি একা হব কেন? তোমার স্কুলের টিচার্সরা এসেছিলেন, পরমহংসকাকু আছে। দেখো কোন অসুবিধে হবে না।’
‘টিচার্সরা এসেছিল? কে কে?’
অর্ক বিশদ ব্যাখ্যা করল। সৌদামিনীর পরিচিত ডাক্তার অতএব কোন ভয় নেই। টাকা পয়সা যা লাগে তা ওঁরাই দেবেন। মাধবীলতার এসব নিয়ে মোটেই মাথা ঘামাতে হবে না। মাধবীলতা ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি যখন এখানে পড়ে থাকব তখন তোর চলবে কি করে? তুই কার কাছে থাকবি? কি খাবি?’
‘আমি আমার কাছেই থাকব। আর কোলকাতায় সব খাবার পাওয়া যায়।’
মাধবীলতা ঠোঁট দাঁতে চাপল, ‘আমার সুটকেসটা খুলে দেখবি বাঁ দিকের কোনায় কিছু টাকা আছে। দুশো টাকার মত। ওটা নিয়ে সাবধানে খরচ করবি। বাড়িতে স্টোভে ফুটিয়ে নিতে যদি পারিস তাহলে সবচেয়ে ভাল হয়। হোটেলের রান্না তোর সহ্য হবে না। আর খুব সাবধানে থাকবি। পাড়ার কোন ঝামেলার মধ্যে যাবি না।’
‘আচ্ছা।’ অর্ক মাথা নাড়ল।
‘আর হ্যাঁ, পড়াশুনা কর। এখন তো কোন ঝামেলা রইল না। সকাল বিকেল আমাকে দেখতে আসা ছাড়া অফুরন্ত সময় পাচ্ছিস। মন দিয়ে পড়াশুনা কর যাতে আমি সবাইকে বলতে পারি স্কুলে না গিয়েও আমার ছেলে ভালভাবে পাশ করেছে। আমি তোর পরীক্ষা দেবার সব ব্যবস্থা করে এসেছি।’
‘তুমি বলছ যখন তখন আমি পড়ব, পরীক্ষা দেব।’
‘তুই নিজের ভেতর থেকে কোন তাগিদ পাস না, না?’
‘না মা। টাকা রোজগার করার জন্যে যদি পড়াশুনা করতে হয় তাহলে সেটা না করেও উপার্জন করা যায়। হ্যাঁ, বড় চাকরি পাওয়া যায় না একথা ঠিক কিন্তু চাকরি যারা করে তারা আর কত রোজগার করে?
‘চাকরি ছাড়া আর কি করে উপার্জন করবি? ব্যবসা করে? তার জন্যে টাকার দরকার। এছাড়া আছে গুণ্ডামি আর ডাকাতি? নিশ্চয়ই শেষদুটো করবি বলছিস না?’
‘কি করব আমি জানি না। তবে তুমি নিশ্চিন্ত হও এবার আমি পরীক্ষা দেব। আমি এমন কাজ করব না যাতে তুমি দুঃখ পাও।’
‘সত্যি?’ মাধবীলতা উদ্ভাসিত হল।
‘হ্যাঁ। কিন্তু মা, তুমি তাড়াতাড়ি সেরে ওঠো। তোমাকে ছাড়া আমার একটুও ভাল লাগে না। আমার কোন বন্ধু নেই, কোন আত্মীয় নেই—।’ অর্কর জিভ আড়ষ্ট হয়ে গেল। মাধবীলতার দুচোখের কোলে টলটলে জল, চোখের পাতা বন্ধ হতেই গাল ভিজিয়ে গড়িয়ে পড়ল নিচে।
আর তখনই গম্ভীর গলা শুনতে পেল অর্ক, ‘কি ব্যাপার কান্নাকাটি কেন?’
মুখ ফিরিয়ে সে পরমহংসকে দেখল, দেখে টুল ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। পরমহংসর উপস্থিতি মাধবীলতাকেও সচেতন করেছিল। কারণ সে চট করে চোখের জল মুছে ফেলে হাসবার চেষ্টা করল, ‘কেমন আছো?’
পরমহংস হাঁ হয়ে গেল, ‘যাঃ বাবা। হাসপাতালের বিছানায় নিজে শুয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করছ কেমন আছি? চমৎকার। তা ম্যাডাম, এই রোগটা তো পাকামি না করলে হয় না। খুব স্যাক্রিফাইস করেছ না? এখন বোঝ ঠ্যালা। সব রিপোর্ট এসে গিয়েছে?’ শেষ প্রশ্নটা অর্কর উদ্দেশে।
অর্কর গলা ধরেছিল, ‘আমি জানি না।’
তার দিকে তাকিয়ে পরমহংস জিজ্ঞাসা করল, ‘ডাক্তার খোঁজ নিতে আসেনি?’
এবার মাধবীলতা জবাব দিল, ‘সব দেখাশোনা হয়েছে। নার্স বলেছে তোমাদের অফিসে খোঁজ খবর নিতে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম কিন্তু ভাঙ্গতে চাইল না।’
পরমহংস চিন্তিত হল, ‘সকালে ডাক্তার বসে নাকি! তুমি বসো অর্ক, আমি দেখে আসি।’
মাধবীলতা বলল, ‘ঠিক আছে, ওসব পরে হবে। তোমরা এমন করছ যেন আমি মরতে বসেছি। আমি তো এখন ভাল আছি। কোন অসুবিধে নেই। খোকা, তুই কিন্তু ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করবি আমাকে আজ ছেড়ে দেবে কিনা। এখানে আর মোটেই ভাল লাগছে না।’
ঠিক এইসময় ওরা সৌদামিনীকে দেখতে পেল। অর্ক একটু অবাক হল, সকালবেলায় সৌদামিনীর আসার কথা ছিল না। তাঁর ভারী শরীর নিয়ে তিনি দ্রুত পায়ে কাছে হেঁটে এসে বললেন, ‘বাঃ, বেশ তো উঠে বসেছ। তা তলে তলে এরকম একটা রোগ বাধিয়ে বসে আছ টের পাওনি?’
‘কি রোগ?’ মাধবীলতা হাসবার চেষ্টা করল। ওকে এখন সঙ্কুচিত দেখাচ্ছিল।
‘ন্যাকা, জানো না কি রোগ? শোন, আজ সকালে ডাক্তারের সঙ্গে কথা হল। অপারেশন ছাড়া কোন উপায় নেই। এসব ব্যাপার নিয়ে একটুও চিন্তা করো না, সুধীরের হাত খুব ভাল।’ কথা বলতে বলতে ঝোলা থেকে একটা ছোট তোয়ালে চিরুনি পাউডারের কৌটো আর সাবান বের করলেন সৌদামিনী। ওগুলোকে পাশের ছোট আলমারিতে রেখে বললেন, ‘শুধু আমাদের ভরসায় থাকলে তো চলবে না, স্বামীকে খবর দিয়েছ?’
অর্ক চট করে মায়ের মুখ দেখল। চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে মাধবীলতার। তারপরেই ঠোঁটের কোণে ভাঁজ পড়ল তার, একটু যেন হাসল, ‘আমার তাহলে অপারেশন হচ্ছেই।’
‘হ্যাঁ হচ্ছে। এইটে মাথার নিচে রাখবে। না, মাথার নিচে থাকলে তো চলবে না। আমি আবার লালসুতো আনতে ভুলে গেলাম। আচ্ছা এখন জামার মধ্যে রাখো তো। ধরো, মাথায় ছুঁইয়ে নাও।’ ছোট্ট বেলপাতায় মোড়া একটা ফুল সন্তর্পণে এগিয়ে দিলেন সৌদামিনী মাধবীলতার হাতে।
মাধবীলতা সেটাকে ধরে বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘এটা কি?’
‘ইয়ার্কি মেরো না। বাঙালির মেয়ে হয়ে চিনতে পারছ না, না? খুব জাগ্রত কালী, সঙ্গে থাকলে কোন অমঙ্গল হবে না। সুধীরের হাত যদিও ভাল তবু সাবধানের মার নেই। অপারেশনের সময় ওটাকে সঙ্গে রাখবে। আমি চলি।’
মাধবীলতা যেন সাপ দেখছে। সৌদামিনীর চরিত্র এবং চেহারা যেন হঠাৎ বদলে গেছে তার কাছে। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘এসব আপনি বিশ্বাস করেন?’
‘যা বলছি তাই করো। আমি কি করি না করি তাতে তোমার কি দরকার? হ্যাঁ, আপনার নাম কি যেন?’
‘পরমহংস।’
‘এরকম নাম কারো হয় নাকি? পরমহংস, মানে—।’
‘বক। চুপচাপ একপায়ে জলার ধারে দাঁড়িয়ে থাকে।’ হাসল পরমহংস।
‘উস্। রসবোধ আছে দেখছি। আপনি আসুন আমার সঙ্গে। অফিসে গিয়ে খোঁজখবর নিই। রক্ত লাগবে বলল সুধীর। আসুন।’
সৌদামিনী হাঁটা শুরু করতেই পরমহংস মাধবীলতার দিকে তাকিয়ে হাসল, ‘তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে ওঠো। আমরা আছি, কোন চিন্তা নেই। আর হ্যাঁ, কাল রাত্রে আমি অনিমেষকে টেলিগ্রাম করে দিয়েছি।’
ওরা চলে গেলে অর্ক চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল। শেষ কথাটা শোনার পর মায়ের মুখের চেহারা হঠাৎ পাল্টে গেল। রক্তশূন্য, সাদা কাগজের মত দেখাচ্ছে এখন। কেমন নিথর হয়ে শুয়ে রয়েছে। দুটো চোখ বন্ধ। এমন কি সে যে পাশে দাঁড়িয়ে আছে সেটাও খেয়ালে নেই। অর্ক টুলটা টেনে নিয়ে বসল। তারপর খুব নিচু গলায় ডাকল, ‘মা!’
মাধবীলতা চোখ খুলল না, ‘খোকা, আমি যদি আর ফিরে না যাই তোর খুব কষ্ট হবে, না? কি করি বল তো?’
অর্কর সারা শরীরে কাঁপুনি এল। সে কোন কথা বলতে পারল না।
কিছুক্ষণ আবার চুপচাপ। শেষপর্যন্ত মাধবীলতাই বলল, ‘না, আমি মরব না। মেয়েরা এত সহজে মরে না। মরলে তো সব ফুরিয়ে গেল। তুই ভাবিস না খোকা।’
এইসময় দুজন নার্সকে নিয়ে একজন হাউস সার্জেন এগিয়ে আসতেই অর্ক উঠে দাঁড়াল। হাউস সার্জেন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি খবর, কেমন আছেন? আরে, আবার কান্নাকাটি কেন? ব্যথা লাগছে?’
মাধবীলতা নীরবে মাথা নাড়ল কিন্তু চোখের জল মোছার চেষ্টা করল না।
অর্ক দেখল একজন নার্স তাকে ইশারা করছে চলে যাওয়ার জন্যে। মায়ের কাছ থেকে উঠে যেতে তার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে করছিল না। এইসময় মাধবীলতা বলল, ‘খোকা, একটা কাজ করতে পারবি?’
‘বল!’ অর্ক ঠোঁট টিপল।
‘একটা টেলিগ্রাম করে দে এখনই, ব্যস্ত হয়ে আসার দরকার নেই, আমি ভাল আছি।’
মাধবীলতার গলার স্বরে ডাক্তারও চমকে তাকালেন। অর্কর খুব ইচ্ছে করছিল মাকে জড়িয়ে ধরতে। ওর মনে হচ্ছিল এই শেষবার মাকে সে সুস্থ মানুষের মত দেখতে পাচ্ছে। আজ যদি অপারেশন হয় এবং—। ও আর কিছু ভাবতে পারছিল না। কিন্তু কি আশ্চর্য, ও বেশ সহজেই মায়ের কাছ থেকে একটু একটু করে দূরে সরে এল। লম্বা বারান্দা দিয়ে আচ্ছন্নের মত হাঁটতে লাগল অর্ক। প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গে মাধবীলতার সঙ্গে দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে তার।
যা করবার সব পরমহংসই করল। সৌদামিনী হুকুম দিয়ে স্কুলে চলে গিয়েছিলেন। বারোটা নাগাদ হাসপাতালের বাইরে দাঁড়িয়ে পরমহংস জিজ্ঞাসা করল, ‘কোথায় যাবে?’
‘স্নান করব।’ অর্ক জবাব দিল, ‘আমার কিছুই ভাল লাগছে না।’
পরমহংস ওর কাঁধে হাত দিল। তারপর খুব সান্ত্বনা দেবার গলায় বলল, ‘মন শক্ত করো। তোমার মা ভাল হয়ে যাবে।’
অর্ক কোন কথা বলল না। পরমহংস রাস্তাটা দেখল, ‘সকাল থেকেই তো এখানে বসে আছ, খাওয়া দাওয়া করেছ?’
‘আমার খেতে ভাল লাগছে না।’
‘কি পাগলামি করছ! তুমি আমার ওখানে চল। স্নান করে খেয়ে বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে একসঙ্গে ফিরব।’ পরমহংস প্রায় হুকুমের গলায় বলল।
অর্ক মাথা নাড়ল, ‘না, এই জামাপ্যান্ট খুব ময়লা হয়ে গিয়েছে। আপনি চিন্তা করবেন না। আমি বাড়িতে যাচ্ছি।’
পরমহংস ওর দিকে তাকাল। সত্যি খুব নোংরা দেখাচ্ছে অর্কর পোশাক। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘খাবে কোথায়?’
অর্ক হেসে ফেলল, ‘আমি দোকানে খেয়ে নেব। চলি।’ তারপর ব্রিজের দিকে হাঁটতে লাগল। কয়েক পা গিয়ে অর্কর কথাটা মনে পড়তেই ঘুরে দাঁড়াল। সে দেখল পরমহংস তখনও সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে তার যাওয়া দেখছে। সে চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি কি সত্যি কাল টেলিগ্রাম করেছিলেন?’
‘টেলিগ্রাম, ও হ্যাঁ। কাল রাত্রে করেছি। মনে হয় আজ সকালেই পেয়ে গেছে। কেন?’
‘মা বলেছেন আর একটা টেলিগ্রাম পাঠিয়ে ওঁকে আসতে নিষেধ করতে।’
পরমহংস খুব অবাক হয়ে গেল, ‘সে কি! কেন? এইসময় তো অনিমেষের আসা উচিত।’
‘আমি জানি না।’ কথাটা বলে অর্ক আর অপেক্ষা করল না। হন হন করে ব্রিজের ওপর দিয়ে হাঁটতে লাগল। ওর মনে হচ্ছিল একটা দায়িত্ব মাথার ওপর থেকে নেমে গেল। মায়ের অনুরোধ রাখতে তাকে টেলিগ্রাম করতেই হত।
মা ভাল আছে এই মিথ্যে কথাটা সে লিখতে পারত না। অতএব যে প্রথম টেলিগ্রামটা পাঠিয়েছিল তার ওপর দায়িত্বটা দিয়ে সে হালকা হয়ে গেল।
বেলগাছিয়ার মুখটায় আসতেই অর্কর জিভে একটা তেতো স্বাদ উঠে এল। পিত্তি পড়ে গেলে এমনটা হয় নাকি? ঠিক তখনই তিনটে ছেলে রাস্তার উল্টোদিক থেকে পায়ে পায়ে তার সামনে এসে দাঁড়াল। তিনজনের চেহারা এবং মুখভঙ্গী দেখে অর্কর বুঝতে বাকি রইল না এরা কোন জাতের। কিন্তু অর্ক বিস্মিত হচ্ছিল এই ভেবে যে তার ওপর এদের রাগ কেন?
‘তোর নাম কি বে? অক্ক?’
অর্ক সতর্ক চোখে দেখল একজনের হাত গেঞ্জির মধ্যে ঢোকানো। সেখানে যে-কোন যন্তর থাকতে পারে। সে বুঝতে পারছিল রাস্তার দুধার থেকে লোকজন সরে যাচ্ছে নিঃশব্দে। এই তিনটেই যে পেশাদারী খুনী তা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। কি করা যায় ভেবে পাচ্ছিল না অর্ক। তবে এদের সঙ্গে লড়াই করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। সে নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘কেন অর্ককে কি দরকার?’
ছেলেটার মুখ বেঁকে গেল, ‘কিমা বানাবো। শালা কয়লাদার—।’ এইটুকু বলেই সামনে নিল ছেলেটা। তারপর মুখে বিকট চিৎকার করে ছুটে এল অর্কর দিকে। অর্ক শুধু ওর নড়াচড়ার আরম্ভটুকু দেখতে পেয়েই দৌড় শুরু করেছিল। ওদের তিনজনের ফাঁক দিয়ে যে অর্ক দৌড়াবে এটা বোধহয় মাথায় আসেনি কারণ তিনটে ছেলেই একটু থিতিয়ে গিয়ে ওর পিছু নিল। তিনজনেই উৎকট শব্দ করছে ছোটার সময়। যেন একটা মুরগির পিছু নিয়েছে তিনটে খ্যাঁকশেয়াল এরকম ভঙ্গী তিনজনের। অর্ক ঈশ্বরপুকুরের মুখে চলে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। মৃত্যুভয় মানুষের গতি বাড়িয়ে দেয়। অর্ক মরিয়া হয়ে ছুটছিল বলে ব্যবধান বাড়ছিল। এইসময় ছেলেটা অদ্ভুত কায়দায় শূন্যে হাত ঘোরালো ছুটতে ছুটতে। আর তীব্রগতিতে রোদ চলকে যেটা ভেসে গেল সামনে সেটা বিদ্ধ হল অর্কর বাঁ কনুইয়ের সামান্য ওপরে। সঙ্গে সঙ্গে অর্ক স্থির হয়ে গেল। প্রচণ্ড ব্যথা এবং সেইসঙ্গে বেরিয়ে আসা রক্ত তার চিন্তাশক্তিকে অবশ করে দিলেও সে আবার দৌড় শুরু করল ওই অবস্থায়।
রক্ত বোধহয় মানুষের চেতনাকে খুব জলদি জাগিয়ে দেয়। একটা ছেলেকে তিনজনে মিলে ধাওয়া করে ছুরি মেরেছে এই দৃশ্য চোখের ওপর দেখে কিছু মানুষ চিৎকার করে উঠল। সেই চিৎকার অনুসরণকারীদের পায়ের জোর কমাল। অর্ক তখন ঈশ্বরপুকুরে পৌঁছে গেছে। গলির মুখে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটা ছেলে অর্ককে ওই অবস্থায় দেখতে পেয়ে সামনে এসে দাঁড়াতেই ওরা থেমে গেল। একজন চিৎকার করে উঠল, ‘যা শালা, খুব বেঁচে গেলি। কয়লাদার গায়ে হাত? সাবধান করে দিচ্ছি, তিনদিনে ঈশ্বরপুকুর জ্বালিয়ে শ্মশান করে দেব।’
কথাটা শেষ হওয়ামাত্রই একটা অন্যরকম প্রতিক্রিয়া হল। বিস্মিত এবং স্থবির জনতা যেন হঠাৎই জেগে উঠে তেড়ে গেল ছেলে তিনটের দিকে। তিনজন এরকমটা হবে আশা করেনি। ওরা পালাবার চেষ্টা করল। দুজন ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে সীমানা ছাড়ালেও একজন শেষপর্যন্ত ধরা পড়ল।
এর মধ্যে ঈশ্বরপুকুরে খবরটা ছড়িয়ে পড়েছে। অর্ককে কয়লার লোক ছুরি মেরেছে শুধু এই খবরটাই তিন নম্বরের মানুষগুলোকে উত্তেজিত করল। ধরাপড়া ছেলেটিকে প্রায় আধমরা করে তিন নম্বরের সামনে ফেলে রাখা হয়েছে। তাকে ঘিরে উৎসুক মানুষের ভিড়। চারধারে উত্তেজিত আলোচনা।
ছুরিটা অর্কর বাঁ হাতের মাংসে বিদ্ধ হয়েছিল। হাড়ে লাগেনি। ঈশ্বরপুকুরের ডাক্তারবাবু সেটাকে বের করে বললেন, ‘হাসপাতালে নিয়ে গেলে ভাল হত। আমি ব্যাণ্ডেজ করে দিচ্ছি আপাতত। কিন্তু হাসপাতালে দেখিয়ে নেওয়া দরকার।’
কিন্তু ঈশ্বরপুকুরে উত্তেজনা বেড়ে চলল। কেউ কেউ চাইছে অর্ধমৃত ছেলেটিকে শেষ করে দিতে। সতীশদা আর সুবল জনতাকে সামলে রাখার চেষ্টা করছে। অর্কর খুব দুর্বল লাগছিল। তার হাত খুব ব্যথা করছে, পেটে কেমন যেন অস্বস্তি। কিন্তু তার একটুও রাগ হচ্ছিল না। সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে বেরিয়ে এসে কেমন যেন ফাঁকা লাগছিল।
সুবল জিজ্ঞাসা করল, ‘কি করা যায় বলুন তো!’
অর্ক বলল, ‘আমরা প্রতিবাদ করব।’
‘কিভাবে?’
‘আমাদের এলাকা থেকে সমস্ত সমাজবিরোধীদের বের করে দিয়ে।’
‘কিন্তু তা কি সম্ভব? এপাড়া থেকে বেরিয়ে পাশের পাড়ায় তারা আশ্রয় নেবে।’
‘পাশের পাড়ার মানুষ যদি তাদের বের করে দেয় তাহলে তারা কোথায় যাবে? সতীশদা, আপনি শুধু বলুন কোনরকম দলবাজি ছাড়া আমরা এই কাজটা করতে পারি কিনা।’ অর্ক সতীশদাকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করল।
সতীশ একমুহূর্ত ভাবল। তারপর মাথা নাড়ল, ‘ঠিক আছে। তবে মনে রাখা দরকার সি পি এম যেমন নয়, কংগ্রেস বা অন্য কোন দলের আন্দোলন নয়, এ এলাকার শান্তিপূর্ণ মানুষের আন্দোলন। এতে আমি অন্যায় কিছু দেখছি না।’
সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার উঠল, ‘সমাজবিরোধীর কালো হাত ভেঙ্গে দোও। কয়লা গুণ্ডা নিপাত যাক।’
অর্ক বলল, ‘কিন্তু সতীশদা, এভাবে হবে না। আপনারা একটা শান্তিকমিটি তৈরি করুন এলাকার সমস্ত মানুষকে নিয়ে। শান্তিকমিটি যা বলবে আমরা তাই শুনব।’
এই সময় খবর এল দুটো পুলিসের ভ্যান ঈশ্বরপুকুরের মুখে এগিয়ে এসেছে।