1 of 2

৫০. লা-ছিরিঙ আর জয়িতা

লা-ছিরিঙ আর জয়িতা কথা বলতে বলতে আসছিল। গত সপ্তাহে যারা এই গ্রাম থেকে সুখিয়াপোকরিতে গিয়েছিল তারা ভাল ব্যবসা করছে। ওখানে একজন পাইকার তাদের কাছ থেকে নিয়মিত এলাচ কিনবে। মুরগি এবং বেতের ঝুড়ি যদি বয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় অন্তত কালিয়াপোকরি পর্যন্ত তাহলে লাভ বেশি থাকবে। খচ্চরওয়ালারা যা যা জিনিস গ্রামে আনত তা অনেক সস্তায় ওরা কিনে এনেছে নিচু থেকে। এভাবে চললে আগামী বরফে প্রত্যেকের শরীরে গরমজামা একটা না একটা থাকবেই। আনন্দ চাইছে এ বছরের মধ্যে অন্তত তিনটে গরু কিনে আনতে নিচে থেকে। গরুর যা দাম তা শেষপর্যন্ত ব্যবস্থা করা যাবে কিনা কে জানে! যদি জিনিসপত্র বিক্রির টাকা উদ্ধৃত্ত না থাকে তাহলে আনন্দই ব্যবস্থা করবে। সুদীপের টাকা এখনও রয়ে গেছে অনেকটা। আনন্দ চাইছে এখানে একটা বেশ বড় ডেয়ারি করতে। পোলট্রি এবং ডেয়ারি যদি চালু করা যায় তাহলে সামনের বছর থেকে দুধ ডিম ও মুরগি চালান দিলে অর্থনৈতিক কাঠামো মজবুত হবে। তবে এখন সুদীপের টাকা ঋণ হিসেবে নেওয়া হবে। লাভ হবার পর শোধ করার দায় থাকবে। পাশের গ্রামের সঙ্গে তাপল্যাঙের এখন প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা। যেহেতু ওরা আনন্দ কিংবা জয়িতার সাহায্য সরাসরি নিচ্ছে না তাই এখনও পিছিয়ে। কিন্তু তাপল্যাঙ যা করছে ওরা সেই পথে এগোচ্ছে। লা-ছিরিঙের বিশ্বাস গরু কিনলে ওদের ওপর টেক্কা দেওয়া যাবে। এ বছর ওরা যাই রোজগার করুক গরু কেনার মত সামর্থ্য হবে না।

ওরা যখন আস্তানার কাছাকাছি তখন সুদীপকে দেখতে পেল জয়িতা। খানিকটা দূর থেকে দেখা বলেই জয়িতাব মনে হল সুদীপ খুব রোগা হয়ে গিয়েছে। ইদানীং খুব খিটখিটে এবং সন্দেহপরায়ণ হয়েছে সুদীপ। বারংবার সে বোঝাবার চেষ্টা করছে, অনেক হয়েছে এবার ফেরা যাক। কিন্তু ফিরলে কি হবে তা নিয়ে মোটেই ভাবছে না। হঠাৎ লা-ছিরিঙ জিজ্ঞাসা করল, তোমরা কি তাপল্যাঙ ছেড়ে চলে যাবে?

জয়িতা হাসল, হঠাৎ একথা তোমার মনে হচ্ছে কেন?

লা-ছিরিঙ জবাব দিল, গ্রামের সবাই বলাবলি করছে। সবাই ভয় পাচ্ছে যে তোমরা চলে যাবে।

ভয় পাচ্ছে? ভয় কেন? জয়িতা অবাক হল।

তোমরা আসার আগে আমাদের অবস্থা কি ছিল তা তো দেখেছ। তোমরা এলে বলেই এখন গ্রামের মানুষ কোনরকমে কিছু খেতে পাচ্ছে। আমরা সবাই বুঝতে পারছি এভাবে চললে আগামী তিন-চার বছরে আর কোন অভাব থাকবে না। আমরা কখনও ভাবতে পারিনি যে সবাই এক হয়ে লড়তে পারব। তোমরা চলে গেলে এসব ভেঙে যাবে। আমাদের বুদ্ধি দেওয়ার কে থাকবে? অত্যঙ্গ সরল গলায় বলল লা-ছিড়িঙ।

জয়িতা বলল, আমরা না হয় এখানে আছি কিন্তু পাশের গ্রামের মানুষরা কি করে পারছে?

লা-ছিরিঙ হাত নাড়ল, ওরা তো তোমরা যা করতে বলছ আমাদের তাই নকল করছে। এই গ্রামের ব্যাপার দেখার পরেই তো রোলেন ওদের বোঝাল। চোখের সামনে কারও ভাল না দেখলে ওরা এসব মানত না। শোনা কথাতে কে বিশ্বাস করে?

জয়িতা বলল, এটা ঠিক নয়। আমরা চলে গেলে যদি সব ভেঙে যায় তাহলে আমাদের সব পরিশ্রম অর্থহীন। তোমাদের উচিত নিজেরাই যাতে আরও এগিয়ে যেতে পার তা ভাবা।

হঠাৎ লা-ছিরিঙ প্রসঙ্গ পালটাল, তোমাদের ওই বন্ধু আগে পালাতে চায়, না? সুদীপকে দেখাল সে। সুদীপ হাঁটছিল কাহুনের মন্দিরের দিকে।

একথা কে বলল তোমাকে?

জানি। ওর ব্যবহার যেন কেমন কেমন। তাছাড়া ওই মেয়ের সঙ্গে বেশিদিন থাকলে ও মরে যাবে। এটা বুঝতে পেরেছে বলেই পালাতে চাইছে। মাথা নাড়ল লা-ছিরিঙ।

আজকাল অল্প হাঁটলেই বুকে হাঁপ ধরে। মাথা ঘোরে। কপালে ঘাম জমে। জয়িতা দাঁড়াল একটু। মেয়েটির সম্পর্কে যে ইঙ্গিত লা-ছিরিঙ দিল তাতে কথা বলার লোভ বাড়ে। সেই প্রসঙ্গে যেতে চাইল না সে। কিন্তু লা-ছিরিঙ যেন নিজের মনেই বলে চলল, ওকে ধরে নিয়ে যেতে চেয়েছিল রোলেনরা। কারণ ও নাকি মা হবার পক্ষে খুব উপযুক্ত। কারও সঙ্গে বিয়ে দিলে গণ্ডায় গণ্ডায় বাচ্চা তৈরি করতে পারবে। নিয়ে গেলে হাড়ে হাড়ে টের পেত। ও একটা উকুন। যা দেখে তা শুষে নেবে। সেটা বুঝতে পেরেছে বলে তোমাদের বন্ধুটা পালাতে চাইছে। আর এই পালাতে চাওয়ার মতলবটা টের পেয়ে গেছে মেয়েটা। সে-ই সারা গ্রামে গাবিয়ে বেড়াচ্ছে।

পালাতে চাইলেই পালাতে দেবে কেন তোমরা, ধরে রেখো।

না, তা কি করে সম্ভব! তোমরা তো কোন অন্যায় করোনি। অন্যায় না করলে কাউকে শাস্তি দেওয়া যায়? ওই মেয়েটার যদি বাচ্চা হত তাহলে ওকে পালাতে দিতাম না আমরা। কথাটা বলে কি ভাবল লা-ছিরিঙ আকাশের দিকে মুখ তুলে, তারপর মাথা নাড়ল, তাহলে হয়তো ও পালাতে চাইত না। আগুনে জল পড়লে তা আর গনগনে থাকে না।

গ্রামের সমস্ত সমস্থ পুরুষ এবং নারী আজ মন্দিরের চাতালে জড়ো হয়েছে। আনন্দ এবং কাহুন ওপরে বসে। কাহুনকে জোর করেই এনেছে আনন্দ। জনতার সঙ্গে যোগ দিয়ে জয়িতা দেখতে পেল সুদীপ খানিকটা দূরে একটা পাথরে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। ওর খুব ইচ্ছে করছিল সুদীপের সঙ্গে কথা বলতে। কিন্তু দূরত্বটা ডিঙোতে গেলে অনেক মানুষেকে সরাতে হয়। পালমে উঠে এল আনন্দর পাশে। এসে দুহাত তুলে দাঁড়াতে জনতার গুঞ্জন বন্ধ হল। পালদেম যেন নিজের কৃতিত্বে খুশী হল, তার মুখে হাসি ফুটল, জয়িতার মনে হল, সারল্য মানুষকে কত অল্পে তৃপ্ত করে!

আনন্দ উঠল, তাপল্যাঙের ভাই এবং বোনেরা। আজকের এই জমায়েতের একটা নির্দিষ্ট কারণ আছে। তার আগে আমি জানতে চাই এই গ্রামের সমস্ত মানুষ এখানে উপস্থিত আছে কিনা। কেউ না থাকলে তাকে ডেকে আনতে হবে।

খানিকটা সময় গলা তুলে এ ওর নাম করে ডাকাডাকির পর সমস্বরে জানান দেওয়া হল, আছে, আছে। আনন্দ মাথা নাড়ল। তারপর প্রায় বক্তৃতা দেবার ঢঙে বলল, তোমরা জানো এই গ্রামে কোন পালা এখন নেই। যিনি ছিলেন তিনি বরফের সময় মারা গিয়েছেন। কাহুন আছেন কিন্তু তিনি তো পালা নন। আসলে এখন আর আমাদের একজন পালার কোন দরকার নেই। কারণ একজন পালা যে সবসময় ঠিক কাজ করবেন তার কোন স্থিরতা নেই। পৃথিবীর যেসব দেশে সমস্ত মানুষের পরিশ্রম একসঙ্গে যোগ হয় তাদের দেশের জন্যে, যেখানে প্রতিটি মানুষ একটি পরিবারের সদস্য সেখানে কোন একজন পালা সবার মাথার ওপরে থাকে না। থাকা উচিত নয়। অথচ সব কাজ ভাল ভাবে দেখার জন্যে, সবাই যাতে ঠিকঠাক সুবিধে পায় তা খেয়াল রাখার ব্যবস্থা থাকা চাই। কেউ কোন অন্যায় করে অথবা কেউ বা কারা যদি এমন কাজ করে যা সমস্ত গ্রামের ক্ষতি ডেকে আনবে তার শাস্তির ব্যবস্থা করা দরকার। এই শাস্তি কারা দেবে? সবাই মিলে? না, কখনও নয়। এর জন্যে দরকার দশজন মানুষের একটা দল। যাদের ওপর সমস্ত গ্রামের দায়িত্ব থাকবে। আগে আমরা গ্রামের বাইরে যেতাম না। এখন যাচ্ছি। সেখানে যাতে ভাল ভাবে ব্যবসা করা যায় তার দায়িত্ব থাকবে এই দলের ওপর। কিসে গ্রামের মানুষের আরও ভাল করা যায় তা ওরা দেখবে। এই দলে কারা থাকবে তা ঠিক করবে তোমরা। আর সেই জন্যে এই জমায়েত। দল ঠিক হওয়ার পর তারাই বুঝে নেবে কে কোন্ দায়িত্ব নিতে চায়। তোমরা এবার নাম বল। যে নামগুলো বেশি মানুষ বলবে তারাই দলে থাকবে। আনন্দ কথা শেষ করামাত্র সব চুপচাপ হয়ে গেল। যেন বুঝে নিতে সময় লাগছে সবার।

কান মাথা নেড়ে মুখ ফেরালেন, আমি কি দলে থাকব?

আনন্দ বলল, নিশ্চয়ই থাকবেন, সবাই যদি দলে আপনাকে চায়।

কিছুক্ষণ কেটে গেল কিন্তু কেউ কোন কথা বলছে না। আনন্দর অস্বস্তি বাড়ছিল। কি ব্যাপার? ব্যবস্থাটা এদের মনঃপুত হচ্ছে না নাকি? এইসময় সে সুদীপকে এগিয়ে আসতে দেখল। ওপরে উঠে এসে সুদীপ বলল, অভ্যেস কখনও একদিনে তৈরি হয় না। উই শু্যড হেল্প দেম। সে চিৎকার করল, যারা এই দলে থাকতে চাও তারা ওপরে উঠে এস।

এবার নড়াচড়া শুরু হল। এ ওর দিকে তাকায়। কিন্তু উঠতে যেন সঙ্কোচ বোধ করছে সবাই। এইসময় সাওদের গুটি গুটি পায়ে ওপরে উঠে এল। তাকে দেখে লা-ছিরিঙ এগিয়ে গেল। এবং অমনি আরও পাঁচজন বিভিন্ন বয়সী মানুষ এগিয়ে এল। আনন্দ পালদেমকে ধরে নিয়ে গুনল, আটজন। সুদীপ হাঁকল, আরও দুজন চাই।

জনতার মধ্যে থেকে একজন চিৎকার করল, তোমরা দুজন তো আছ।

আনন্দ কিছু বলার আগেই সুদীপ জানাল, না, আমরা দলে থাকতে পারি না। আমরা বাইরের লোক। আমার নাম সুদীপ, ওর নাম আনন্দ, তোমাদের নামের সঙ্গেও মেলে না। এই গ্রামের মানুষের ভালমন্দ দেখাশোনা করবে গ্রামেরই মানুষ, বাইরের লোক নয়।

এইসময় কাহুন গিয়ে দাঁড়ালেন দলে। নজন হল। আর একজন চাই। হঠাৎ একটি মেয়ে বলল, দলে সব ছেলে থাকছে কেন? একজন মেয়ে চাই।

সুদীপ বলল, নিশ্চয়ই। মেয়েরা আগে আসছে না বলেই থাকছে না। দশ নম্বরের জন্যে তুমি এসো।

মেয়েটা মাথা নাড়ল, আমি কি কিছু জানি যে দলে যাব। দ্রিমিত কোথায়? দ্রিমিত যাবে। সঙ্গে সঙ্গে সম্মিলিত নারীকণ্ঠে ধ্বনিত হল, দ্রিমিত! দ্রিমিত! দ্রিমিত।

দুটি মধ্যবয়সিনী গিয়ে টানতে টানতে নিয়ে আসছিল জয়িতাকে। সুদীপ বাধা দিল, আরে ওকে আনছ কেন? ও তো আমাদের মতই বাইরের লোক!

যে মেয়েটা কথা বলছিল সে ফুঁসে উঠল, কে বলেছে বাইরের লোক? ওর নাম দ্রিমিত। দ্রিমিত আমাদের নাম। ওর পোশাক আমাদের পোশাক। তুমি নিজেকে এখনও বাইরের লোক ভাবতে পার কিন্তু দ্রিমিত তা ভাবে না। ওকে আমরা আমাদের লোক মনে করি।

কথাটার সমর্থন মিলল অনেক গলায়। সুদীপ কাঁধ নাচাল। ওরা ততক্ষণে জয়িতাকে ওপরে তুলে দিয়েছে। সুদীপ জয়িতার দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় বলল, চমৎকার! বলে নিচে নেমে পাথরে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল।

আনন্দ বলল, তাহলে এই দশজন আগামী বারোটা চাঁদ পর্যন্ত গ্রামের দায়িত্বে থাকবে। এই সময়ে যদি এরা ভাল কাজ করে তাহলে আবার দায়িত্ব পাবে। যদি কেউ খারাপ কিছু করে তাহলে গ্রামের সমস্ত মানুষ এক হয়ে তাকে দল থেকে সরিয়ে দেবে। তোমরা এ ব্যাপারে রাজী?

ঠিক কথা, ঠিক কথা। সবাই চেঁচিয়ে বলল।

আনন্দ এবার ঘোষণা করল, কে কোন্ দায়িত্ব নেবে তা এরা নিজেরা ঠিক করবে। এখন যে যার কাজে তোমরা যেতে পার।

জমায়েত যখন ভাঙব ভাঙব করছে উল্লসিত হয়ে তখন একজন, এক বৃদ্ধ, চিৎকার করল, সবাই বলছে তোমরা নাকি আমাদের ছেড়ে চলে যাবে, কথাটা ঠিক?

কথাটা আনন্দর কানেও এসেছিল। সে মাথা নাড়ল, আমি জানি না।

বৃদ্ধ বলল, আমরা খুব খারাপ ছিলাম। তোমরা চলে গেলে আবার খারাপ থাকব।

আনন্দ প্রতিবাদ করল, কেন খারাপ থাকবে? তোমরা তো শিখে নিয়েছ ভালভাবে থাকতে গেলে কি কি করতে হয়। তোমাদের এই শেখাটা অনেক সভ্যদেশের মানুষ শিখতে পারেনি।

বৃদ্ধর কানে যেন কথাগুলো ঢুকল না, আগে কেউ গ্রামের বাইরে যেতে সাহস করত না, এখন যাচ্ছে। সেখানে অনেক ডাইনি ওৎ পেতে বসে আছে। তারা এদের যাদু করবে। তোমরা না থাকলে এরা গ্রামের কোন নিয়মকানুন মানবে না। তাছাড়া–।

আনন্দ দেখল বৃদ্ধ উদাস হয়ে তাকাচ্ছে আকাশের দিকে। সে জিজ্ঞাসা করল, তাছাড়া?

আমাদের বাপ মা যারা স্বর্গে গিয়েছে তারা আমাদের কিছু শেখায়নি। আমরাও এদের কিছু শেখাতে পারিনি। এরা, যেসব বাচ্চা এখন জন্মাচ্ছে তাদের কিছু না শিখিয়ে বড় করছে। আসলে আমরা কিছুই জানি না, শেখাতে পারব কি করে। আমরা যখন মরে যাব, এরা যখন মরে যাবে তখন একই অবস্থা চলবে। তোমবা থেকে গেলে এ অবস্থা চলতে পারত না।

আনন্দ কিছু বলার আগে পালদেম বলল, তাহলে এরা কি করে আমাদের বাচ্চাদের শেখাবে?

বৃদ্ধ জবাব দিল, কেউ রক্তের টানে শেখে, কেউ দেখে শেখে। ওরা চলে গেলে যারা আসবে তারা কিছুই শিখবে না। এখনও এই গ্রামের তিনটে পরিবার আলাদা রয়ে গেছে।

আনন্দ উৎসাহিত করল, তোমরা মিছিমিছি দুশ্চিন্তা করছ। আমরা যাচ্ছি না এখনই। তবে পুলিশ যদি আমাদের ধরে নিয়ে যায় তাহলে অন্য কথা।

বৃদ্ধ চিৎকার করল, পুলিশদের আমরা ঢুকতে দেব না।

প্রতিধ্বনিত হল অনেক গলা পাহাড়ে পাহাড়ে, দেব না, দেব না।

জমায়েত যখন ভেঙেছে, মানুষজন যখন চলে যাচ্ছে তখন আনন্দ এগিয়ে গেল জয়িতার দিকে, কনগ্রাচুলেশন জয়িতা।

জয়িতা মাথা নাড়ল, উঁহু, জয়িতা নয়, দ্রিমিত।

ও হ্যাঁ, দ্রিমিত। আনন্দ মাথা নেড়ে নিজেকে সংশোধন করল। এইসময় সেই মেয়েটা এসে দাঁড়াল সুদীপের পাশে। ও যে এতক্ষণ জমায়েতে ছিল তা কেউ লক্ষ্য করে নি। আনন্দ তখন পালদেমদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে নেমে গেছে।

জয়িতা গ্রামের তিনটে মেয়ের সঙ্গে গল্প করছে, হঠাৎ সুদীপ এগিয়ে এল তার সামনে, জয়িতা, তোর সঙ্গে আমার কথা আছে, এদিকে আয়।

জয়িতা ওর গলার স্বর শুনে চমকে তাকাল! অতান্ত রাগী দেখাচ্ছে সুদীপের মুখ। সে হাসবার চেষ্টা করল। জয়িতা এখন মরে গেছে সুদীপ, আমি দ্রিমিত।

এইসব ন্যাকামি রাখ। আই ওয়ান্ট টু আস্ক ইউ এ স্ট্রেট কোয়েশ্চেন!

বলে ফেল?

তোর শরীরে বাচ্চা আছে?

সঙ্গে সঙ্গে জয়িতা পাথর হয়ে গেল। তার রক্ত চলাচল যেন এক মুহূর্তের জন্যে বন্ধ হল। তারপরেই কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। সুদীপের গলার স্বর আর এক পর্দা উঠল, উত্তর দে। সরাসরি বল হ্যাঁ কি না?

সুদীপ কথা বলছিল বাংলায়। জয়িতা দুর্বল গলায় জবাব দিল, কি শুনলে খুশী হবি সুদীপ?

আমার খুশী অখুশীর ওপর কিছু নির্ভর করছে না।

তাহলে জিজ্ঞাসা করছিস কেন?

প্রয়োজন আছে। তোকে আমরা বন্ধু বলে মনে করতাম। আই ট্রিটেড ইউ অ্যাজ এ পাশন , তুই একটা মেয়ে এটা আমার মাথায় কখনও আসেনি। এবং তুই, তুই সবসময় নিজেকে তাই মনে করতিস। কিন্তু এই মেয়েটা বলছে তুই প্রেগন্যান্ট। এর আগেও ও আমাকে বলেছিল যেদিন তুই বমি করেছিলি। আমি বিশ্বাস করিনি। কিন্তু আজ ও বলছে তোর মধ্যে নাকি চিহ্ন দেখতে পাচ্ছে। আমি উত্তরটা চাই।

আমি বুঝতে পারছি না সুদীপ, এতে তোর উদ্বিগ্ন হবার কি আছে?

হু ইস দ্যাট ম্যান? সুদীপের চোয়াল শক্ত হল।

তুই তো বন্ধুর মত প্রশ্নটা করছিস না সুদীপ। তোর মুখ এখন কি হিংস্র হয়ে উঠেছে, অতএব আমি তোর কোন প্রশ্নের উত্তর দেব না। জয়িতা খুব শান্ত গলায় শব্দগুলো উচ্চারণ করল।

সুদীপ মুখ ফেরাল নিচের দিকে। তারপর বিড় বিড় করল, আই নো হিম।

জয়িতা এবার হেসে উঠল, মিছিমিছি এ ব্যাপারে তুই উদ্বিগ্ন হচ্ছিস। এটা এখন সম্পূর্ণ মেয়েলি ব্যাপার, মেয়েদের কিছু নিজস্ব ব্যাপার থাকে যেখানে তারা একেবারে অবাঞ্ছিত।

হঠাৎ সুদীপ চিৎকার করে উঠল বিশ্রী ভঙ্গিতে, বাদ দে! আমার সব জানা হয়ে গেছে।

কি জেনেছিস তুই?

চিৎকারটা করেই সম্ভবত সুদীপ চেতনায় এসেছিল। এবং এখন তার মধ্যে হতাশা স্পষ্ট হল। দুহাতে মাথা চেপে ধরে সে বলল, তোকে আমি এতদিন অন্যচোখে দেখে এসেছিলাম। কলকাতায় তুই কি ছিলি ভেবে দ্যাখ। মেয়েলি যে কোন ব্যাপার তুই ঘেন্না করতিস।

ঘেন্না? জয়িতা ওর কাছে এগিয়ে এল, সুদীপ, তোকে আমাদের ঘেন্না করা উচিত নয়?

আমাকে? হোয়াই? চোখ বড় হয়ে উঠল সুদীপের।

এতদিন তুই কি করছিস? একটা মেয়ের হ্যাংলামির সুযোগ নিচ্ছিস। ওকে বিয়ে করার কথা চিন্তাও করছিস না। বরং কি করে এখান থেকে চলে যাওয়া যায় তার ফন্দি ভাবছিস। কলকাতায় থাকলে তুই এই কাজটা করতে পারতিস?

চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল সুদীপ। তারপর হাত নেড়ে মেয়েটিকে কাছে ডাকল। এখন নিতান্ত অনিচ্ছায় মেয়েটি সামনে এসে দাঁড়াল। সুদীপ তাকে জিজ্ঞাসা করল ওর ভাষায়, আমার বিরুদ্ধে তোর কোন নালিশ আছে?

সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটা মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।

সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, সেটা কি এখানে বল।

মেয়েটা এবার কেঁদে ফেলল দুহাতে মুখ ঢেকে। সুদীপ ওর কাঁধে হাত রাখল, ঠিক আছে, বল।

মেয়েটা এবার কোনমতে বলতে পারল, ও আমার সঙ্গে একদিনও শোয়নি। আমি অনেক চেষ্টা করেও পারিনি। বললেই বলে বন্ধুর সঙ্গে বন্ধু শোয় না। যদি কখনও আমাকে বিয়ে করে তবেই শোবে। আমাকে মেয়ে বলে যেন মনেই করে না ও। কথাগুলোর সঙ্গে কান্না জড়ানো ছিল। সবাই অবাক হয়ে মেয়েটিকে দেখছিল।

সুদীপ এবার জয়িতার দিকে তাকাল, পরে কথা হবে তোর সঙ্গে। বলে দৌড়ে নিচে নেমে গেল।

তার শরীর তরতর করে নিচে নামছিল। জয়িতা স্তব্ধ হয়ে ওর যাওয়া দেখছিল। এতক্ষণ যে নাটক এখানে চলছিল তার দর্শকরা ব্যাপারটা সম্পর্কে ধন্দে ছিল যেহেতু সংলাপ ছিল বাঙলা-ইংরেজিতে মেশানো। তবে ব্যাপারটা যে মারাত্মক পর্যায়ে গিয়েছে তাতে কারও সন্দেহ ছিল না। বিশেষ করে শেষ হল যখন মেয়েটির জবানবন্দীতে তখন তো বটেই। জয়িতা ওর আগে পাশের মেয়েদের দিকে তাকাল। সহজ সরল ঢলঢল মুখের মেয়েগুলোর নাম একই ধরনের রোমিত, ইনামিত, পাশাংকিত, পরমিত। এবার যে মেয়েটির নাম ইনামিত সে প্রশ্ন করল, কি হয়েছে? ও ওরকম রেগে গিয়েছিল কেন?

জয়িতা আবার বিন্দুতে মিলিয়ে আসা সুদীপকে দেখল। সুদীপ কোথায় যাচ্ছে? এইসময় কান্না থামিয়ে সুদীপের বান্ধবী চিৎকার করে উঠল, দ্রিমিতের পেটে বাচ্চা এসেছে!

সঙ্গে সঙ্গে উল্লাসের শব্দ ছিটকে উঠল মুখগুলো থেকে। মেয়েরা উৎসাহে জয়িতাকে জড়িয়ে ধবল। ওরা এমন করছে যেন খুব বড় প্রাপ্তির খবর পেয়ে গেছে। এবং এই প্রথম অন্যধরনের লজ্জায় আক্রান্ত হল জয়িতা। সেই চিৎকার শুনে কাহুন নেমে এলেন মন্দির থেকে। মেয়েরা ছুটে গেল তার কাছে, দ্রিমিতের পেটে বাচ্চা এসেছে।

লোকটির মুখ দেখে মন বোঝা দায়। কিন্তু কথাটা শোনামাত্র একটা হাত প্রসারিত হল তাঁর। যেন আশীর্বাদ করছেন কথাটা শোনামাত্র। পরমিত জয়িতাকে ইঙ্গিত করল বসার জন্যে। নিতান্ত অনিচ্ছায় হাঁটু গেড়ে বসল সে। মাথার ওপর অনর্গল অবোধ্য মন্ত্র বর্ষিত হতে লাগল। এরপর সবাই মিলে ওকে তুলে ধরতেই কাহুন জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি তো বিবাহিত নও, অতএব তোমার ভাবী স্বামী কে? বিয়ের আয়োজন করতে হবে।

নাম বলাটা কি খুব জরুরী?

নিশ্চয়ই। কুমারী মেয়ের পেটে বাচ্চা এলে তার একটা পরিচয়ের ব্যবস্থা করাই নিয়ম।

আমি যদি না বলি।

তাহলে তোমাকে এই গ্রাম ছেড়ে যেতে হবে। শুধু তোমার ক্ষেত্রে নয়, এই গ্রামের যে কেউ এমন করলে একই শাস্তি দেওয়া হবে। পুরুষ হলে তা আরও ভয়ানক হত।

সেই বিচার কি আপনিই করবেন কাহুন?

যতদিন তাপল্যাঙের মানুষ আমাকে কাহুন বলে স্বীকার করবে ততদিন অবশ্যই আমি করব। তবে আজ দশজনের দল তৈরি হয়েছে, তাদের কথাও শুনতে হবে। কিন্তু ধর্মের সঙ্গে তোমাদের বন্ধুত্বের কোন সম্পর্ক নেই। কাহুন নির্লিপ্ত গলায় জানালেন।

জয়িতা মাথা নাড়ল। বন্দুক—এরা কেউ জানে না সমস্ত গুলিগুলো এখন অকেজো, আর এই গ্রামের মানুষদের দিকে বন্দুকের নল তোলা মানে নিজের গলায় ঠেকানো। সে কলল, আমাকে একটু সময় দিন কাহুন।

 

ঢালু পাহাড় বেয়ে দৌড়াবার সময় শরীরের ভার যেন কমে যায়। কিন্তু বুকের ভেতর ঝড় বইছিল সুদীপের। অনেকটা নেমে আসার পর সে আনন্দকে দেখতে পেল। পালাদেম এবং সাওদেরের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ওরা জমি দেখছে। পরিকল্পনা হয়েছে ওপরের ঝরনা থেকে জল যাতে সরাসরি জমিতে আনা যায় তার ব্যবস্থা করতে হবে। সে ব্যাপারেই আলোচনা করছিল ওরা। সুদীপকে ওভাবে ছুটে আসতে দেখে অবাক হল সবাই। খানিকটা দূরে থমকে দাঁড়িয়ে দম নিতে নিতে সুদীপ ডাকল, আনন্দ, তোর সঙ্গে কথা আছে।

কি কথা? আনন্দ ওকে জরিপ করার চেষ্টা করল।

এদের সামনে বললে তোর হয়তো ভাল লাগবে না।

আনন্দ মুখ ঘুরিয়ে পালদেমকে বলল, ঠিক আছে, আমরা পরে এটা নিয়ে কথা বলব। মনে হচ্ছে সুদীপের কোন সমস্যা হয়েছে—! ঠিক আছে।

পালদেমরা চলে যাওয়ার পর আনন্দ এগিয়ে গেল, কি বলবি বল্।

মুখোমুখি কিছুক্ষণ তাকিয়ে সুদীপের মুখ বিকৃত হয়ে উঠল, ছিঃ!

খুব অবাক হল আনন্দ, কি ব্যাপার? তুই এভাবে আমাকে ছিঃ বলছিস কেন?

তুই, তুই এমন কাজ করলি আনন্দ, তুই মুখে বলতিস যদি তাহলে কি আমি আপত্তি করতাম?

আঃ! কি বলছিস স্পষ্ট করে বল্।

ন্যাকামি করিস না। তুই জানিস না কি করেছিস?

আনন্দর কপালে ভাঁজ পড়ল, ব্যাপারটা কি বল তো?

তোর সঙ্গে ওর শারীরিক সম্পর্ক আছে সেটা এতকাল চেপে রেখেছিলি কেন?

শারীরিক সম্পর্ক? কার সঙ্গে? ওঃ, তোর মেয়েটা এই কথা বলেছে বুঝি?

আবার বুলি করার চেষ্টা! জয়িতা প্রেগন্যান্ট তুই জানিস না?

জয়িতা? প্রায় চিৎকার করে উঠল আনন্দ।

আকাশ থেকে পড়লি মনে হচ্ছে।

কি যা-তা বলছিস তুই?

আনন্দ, আমি শেষবার আশা করছি তুই সত্যি কথা বলবি।

মিথ্যে কথা বলার কিছু দরকার আছে সুদীপ? আমি যদি করতাম তাহলে এই পাহাড়ে কেউ আমাকে বাধা দিতে আসত?

তাহলে স্বীকার করছিস না কেন?

কারণ আমি করিনি।

বিশ্বাস করি না!

চমৎকার! জয়িতার খবরটা তুই কোথায় পেলি?

আমাকে বেশ কিছুদিন আগে মেয়েটা বলেছিল। বমি করছিল তখন। বিশ্বাস হয়নি আমার। আজ প্রশ্ন করতে ও ইনডাইরেক্টলি স্বীকার করে নিয়েছে।

হায় ভগবান! আনন্দ চিৎকার করল এবার, ও স্বীকার করেছে?

হ্যাঁ। তোর আর লুকোবার পথ নেই। কিন্তু আনন্দ, ওকে তো আমরা সবাই বন্ধু বলেই জেনে এসেছিলাম এতদিন। একঘরে শুয়েছি কিন্তু কখনও মেয়ে বলে মনে করিনি। কল্যাণটা ওকে ভালবাসতো। আই নো দ্যাট। ওর সম্পর্কে দুর্বল ছিল। আমার মনেও যে দুর্বলতা আসেনি তা নয়। কিন্তু আমি সবসময় মনে করতাম ওকে বন্ধুর সম্মান দেব। ও মেয়ে নয়, একটা মানুষ। জীবনের সব প্রলোভন ছেড়ে আমরা যে কাজে পা বাড়িয়েছি তাতে আর যাই হোক একটি মেয়ের সঙ্গে হৃদয় বিনিময় প্রধান হয়ে ওঠে না। অথচ তুই তাই করেছিস। নাহলে তুই ওর শরীরের কথা ভেবে কলকাতার ওষুধের দোকান থেকে প্রটেকশান কিনতিস না। নাউ টেল মি, হোয়াটস দি ডিফারেন্স বিটুইন আস অ্যান্ড দ্যাট প্যারাডাইস পার্টি!

আনন্দ কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। ওর রোগা শরীরটা শত্ত। এলোমেলো দাড়ি এবং চুলভর্তি মাথাটা নিচের দিকে ফেরানো। তারপর ও চোখ তুলল, তোকে আমার খুন করতে ইচ্ছে করছে সুদীপ!

সুদীপ চমকে উঠল। এই গলায় আনন্দ কখনও তার সঙ্গে কথা বলেনি। কিছুক্ষণ কেউ কথা বলল না। সুদীপ আশঙ্কা করছিল আনন্দ তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। ওর চোখ দেখে সেই রকম মনে হচ্ছিল। কিন্তু আনন্দ কথা বলল, আমাকে যখন তোর সন্দেহ তখন আমিও বলতে পারি নিজে কাজটা করে তার দায়িত্ব আমার ওপর চাপিয়ে দিচ্ছিস!

আমি? আমি করেছি?

নিশ্চয়ই। চোরের মায়ের সবসময় বড় গলা হয়। আর তাই কদিন থেকে তুই চলে যাওয়ার কথা বলে যাচ্ছিস। তুই এমন কাজ করলি কেন সুদীপ?

প্রশ্নটা শোনামাত্র যেন উন্মত্ত হয়ে গেল সুদীপ। দুপাশে মাথা নেড়ে চিৎকার করে বলে উঠল, ইটস এ লাই, মিথ্যে কথা, আমি কিছুই জানি না। জানলে আমি তোকে এসে–।

বাক্যটা শেষ করতে পারল না সে। আনন্দ বলল, এটা তোর অভিনয় হতে পারে।

অভিনয়? সুদীপের চোখ বড় বড় হয়ে উঠল।

অবশ্যই। এতদিন ধরে ওই বিধবা মেয়েটার সঙ্গে থেকেও তোর লোভ মেটেনি। আমি বুঝতে পারছি না জয়িতা এই ভুল কি করে করল! একসময় মেয়েটা সম্পর্কে জেলাস ছিল। কিন্তু সব জেনেশুনে–। শোন সুদীপ, আমি কখনও তোর আর ওই মেয়েটার সম্পর্ক নিয়ে কিছু বলিনি। এটা অন্যায় কিন্তু আজ হোক কাল হোক তোকে বিয়ে করতে হবে ওকে। বলেই চুপ করেছিলাম। কিন্তু এই আমি সহ্য করব না।

সুদীপ হাসল অনেকক্ষণ পরে, আমার সম্পর্কে চমৎকার ধারণা তোদের।একটু আগে জয়িতা একই প্রশ্ন করেছিল। মেয়েটা আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে। আমি ওর কাছে কৃতজ্ঞ। বাট আই নেভার শ্লেপ্ট উইদ হার। কথাটা ও নিজের মুখে আজ সবাইকে বলেছে।

তুই? বিস্ময় ফুটে উঠল আনন্দর মুখে।

হ্যাঁ। সুদীপ জোরের সঙ্গে বলল।

আনন্দ মাথা নাড়ল, সব কেমন গোলমেলে হয়ে যাচ্ছে। তুই প্যারাডাইসের কথা বললি, চিরকাল যে ব্যাপারটাকে ঘৃণা করে এলাম নিজে তা কিভাবে করব? হ্যাঁ, যদি জয়িতাকে ভালেবেসে পেতে চাইতাম তাহলে সেটা জোরগলায় বলতাম।

সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, তুই ওকে ভালবাসিসনি?

হ্যাঁ, বেসেছিলাম। কিন্তু পেতে চাইনি।

আমিও তাই।

আমার মনে হয় একমাত্র কল্যাণ পেতে চেয়েছিল।

গলার স্বর দুজনের খাদে নেমে এসেছিল। হঠাৎ সুদীপ সজাগ হল, তাহলে কে?

তুই যে ভাবে ছুটে এলি, ওকি কারও নাম বলেছে?

না। কিন্তু তুই কিংবা আমি ছাড়া কে হতে পারে? আমরা তিনজনেই এক শিক্ষাব্যবস্থায় মানুষ হয়েছি। রুচি বল, মানসিকতা ব, আমরা এক। জয়িতার মত মেয়ে–।

ঠিকই। হয় তুই নয় আমি।

কিন্তু আমি নই। চিৎকার করল সুদীপ।

চিৎকার করার কিছু নেই। আমিও নই সুদীপ। স্টিল আইদার ইউ অর মি! এবং সেটা নির্ভর করবে জয়িতার সিদ্ধান্তের ওপর।

না। আমি মানি না। এটা হতে পারে না।

কেন মানবি না সুদীপ?

ও, ও যদি সত্যি কথা না বলে!

জয়িতা কখনও মিথ্যে কথা বলতে পারে না।

তুই এখনও ওকে বিশ্বাস করিস আনন্দ? মাটিতে বসে পড়ে অদ্ভুত চোখে তাকাল সুদীপ।

আমৃত্যু করব। তুই যে অস্বীকাব করছিস তাও আমি বিশ্বাস করছি সুদীপ। অবশ্য আমার কথা বিশ্বাস করা না করা তোর ওপর নির্ভব করছে।

দুই হাঁটুতে মাথা রাখল সুদীপ, স্যরি আনন্দ।

আনন্দ চারপাশে তাকাল। হালকা মিঠে বোদে এখন তাপল্যাঙ ভাসছে। ওপাশে নীল আকাশের নিচে চ্যামল্যাঙ, বরুণৎসে, নুপৎসে, লোৎসে, এভারেস্ট, মাকালু, ছোমল গর্বিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। এই তাপল্যাঙকে ওরা তিনবছর আগে দ্যাখেনি। কর্মযজ্ঞের সমস্ত চিহ্ন চারপাশে ছড়ানো। একটি প্রাণের পুরো চেহারা পালটে গেছে এর মধ্যে। মার্কস সাহেব চেয়েছিলেন মানুষের বেঁচে থাকবার রাস্তাটা পরিষ্কার হোক। পৃথিবীর সমস্ত নিপীড়িত মানুষ সেই পথে যাওয়ার স্বপ্ন দ্যাখে। ভারতবর্ষের কমুনিস্ট পার্টিরা তো সেই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে দেখল কাজ আর আদর্শের মধ্যে দুস্তব প্রভেদ। গণতন্ত্র এবং ভোটের বাক্সে এমন একটা যাদু আছে তো এরা তার মোহ আজও কাটিয়ে উঠতে পারল না। কলকাতা শহরে তারাও কি বোকামি শুরু করেছিল। এখানে এসে এই অরাজনৈতিক নিঃস্ব মানুষগুলোর সঙ্গে কাজ করতে করতে প্রতিটি মুহূর্তে আনন্দ সেটা অনুভব করেছে। ব্যক্তিহত্যা নয়, জীবন ফিরিয়ে দেওয়াতেই একজন কম্যুনিস্ট-এর বেঁচে থাকার স্বার্থকতা। আর সেই কাজ যখন তারা তিলে তিলে শুরু করে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তখন জয়িতা গর্ভবতী! এই খবরে এত বিচলিত হচ্ছে কেন? একটা ছোট্ট খবরে এত বড় বিশ্বাস ভেঙে যেতে পারে না। আনন্দ বলল, সুদীপ, জয়িতার সন্তানের পিতা কে এ নিয়ে দুশ্চিন্তা করে আমাদের কি লাভ? সুদীপ মুখ তুলল। আনন্দ বলল, এটা আমাদের সমস্যা নয়, তাই না?

না। কিন্তু ও কি বন্ধুত্বের সম্মান রাখল? আমার লাগছে, এখানেই।

আনন্দ হাসল, ও যে মেয়ে তাই আমরা ভাবতাম না। ও নিজে ও কি ভাবত! তাছাড়া তুই ভুলে ওই ভুলে যাচ্ছিস আমরা যেমন ছিলাম তেমনি আছি কিন্তু ও এখন আর জয়িতা নয়। ইদানিং ও আমাকে বারংবার মনে করিয়ে দেয় ওর নাম দ্রিমিত। ওঠ, আজকের কাজগুলো সেরে ফেলি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *