অধ্যায় ৫০
ওই আসে ওই অতি ভৈরব হরষে
জলসিঞ্চিত ক্ষিতি সৌরভ রভসে…
বিকেলের পরই নতুন এই লাইব্রেরিটা ফাঁকা হয়ে যায়, আর তখনই সে চলে আসে এখানে। লোকজন থাকলে কখনও আসে না।
একজন নারী হিসেবে লক্ষ্য করে দেখেছে, তাকে দেখলেই লোকজন কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। অবশ্য এটা এ দেশের সবখানেই দেখা যায়-একটা মেয়েমানুষ আশেপাশে থাকবে, হেঁটে যাবে আর তার দিকে তাকাবে না, মনোযোগ আকর্ষিত হবে না কোনো পুরুষমানুষের?
এমনকি, মেয়েরাও মেয়েদের দিকে তাকায়, যদি সেই মেয়েটি চোখে পড়ার মতো হয়, কিংবা তার ব্যক্তিত্ব হয় প্রখর। ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের এই তাকানোর মধ্যে বেশ পার্থক্য আছে-ছেলেগুলো যেখানে চোখ দিয়ে খেয়ে ফেলতে চায়, মেয়েগুলো সেখানে অবধারিতভাবেই ঠোঁট বেঁকিয়ে, এমন একটি অভিব্যক্তি করে, যেনো নিজের ভেতরে বাম্পায়িত ঈর্ষা ঠেলেঠুলে উদগীরিত করতে চাইছে।
লালসা আর ঈর্ষা-মুগ্ধতার দেখা সে খুব কমই পেয়েছে।
অবশ্য এটাও ঠিক, এরকম প্রত্যন্ত এক গ্রামে তাকে দেখে হয়তো বেমানান লাগে লোকজনদের কাছে। তার বেশভূষা আর সৌন্দর্য তাদেরকে বাধ্য করে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতে। আর এই ব্যাপারটা যখন ঘটে তখন খুবই বিব্রতকর অনুভূতি হয়। মাঝে মাঝে কারো কৌতূহলি দৃষ্টি দেখে সে ঘাবড়েও যায়-তাকে চিনে ফেললো না তো?!
না। এখন পর্যন্ত এরকমটি হয়নি। তবে যেকোনো সময়ই যে হতে পারে সে-ব্যাপারে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। সতর্কতার অংশ হিসেবেই, এই প্রত্যন্ত গ্রামে যারা বেড়াতে আসে তাদের কাছ থেকে নিজেকে সযত্নে আড়ালে রাখে সে।
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে। যখনই কোনো জায়গার প্রতি তার মায়া জন্মে, সেটা ছেড়ে চলে যেতে হয় তাকে-এখন পর্যন্ত এরকমটিই হয়ে আসছে।
ঔষধি গাছ আর নানান ধরণের ফুলের বাগান করার বাতিক জন্মেছে এখানে আসার পর। তার ঘরের সামনে এক চিলতে জায়গাটা ভরিয়ে তুলেছে শুভ্র কালেনডুলা, লালাভ লাভেন্ডার, গোলাপী-বেগুনীর পাঁচ পাপড়ির ক্যালোট্রপিস, সাদা মুক্তোর দানার মতো পার্থেনিয়াম, সবুজ-লাল পাতার ক্যালাডিয়াম, লালচে-গোলাপীর ওলিয়েন্ডার, সাদা-লালের অশ্বগন্ধা, শুভ্র বেগুনীর স্বর্পগন্ধা, শুভ্র লিলি, সবুজ আইভি, মধুনাশিনী, গোলাপী জটামানসি আর শুভ্র-গোলাপীর নাগালিঙ্গ দিয়ে। ওদের পরিচর্যা করেই কাটিয়ে দেয় অখণ্ড অবসরের প্রায় সবটুকু। যত্নে বড় করা গাছগুলো, এখানকার প্রকৃতি আর এই লাইব্রেরিটার প্রতি তার মায়া জন্মে গেছে অল্প ক-দিনেই।
চারপাশে তাকালো সে। দিন দিন নতুন নতুন বইয়ের আগমণে সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে গ্রন্থাগারটি। এখানকার খুব কম মানুষজনই জানে, নতুন এই লাইব্রেরিটির পেছনে তার অবদানের কথা।
রবীন্দ্রনাথের স্মরণে দেয়া এই লাইব্রেরিটির দক্ষিণ দিকের এককোণের ফ্রেঞ্চ জানালার পাশে যে রিডিং টেবিলটা আছে, সেটা তার খুব প্রিয়। একান্তে, নির্জন লাইব্রেরিটি হয়ে ওঠে তার সময় কাটানোর জায়গা। ইচ্ছে। করলে এখান থেকে বই নিয়ে নিজের ঘরে গিয়েও পড়তে পারে, লাইব্রেরি থেকে খুব কাছেই সেটা, কিন্তু তার এখানে এসে বই পড়তেই বেশি ভালো। লাগে।
এ মুহূর্তেও তার কানে গোঁজা আছে হেডফোন, বাজছে আরেকটি প্রিয় একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত :
আমি নিশিদিন তোমায় ভালোবাসি,
তুমি অবসরমত বাসিয়ো।
নিশিদিন হেথায় বসে আছি,
তোমার যখন মনে পড়ে আসিয়ো…
কিছু একটা টের পেয়ে পাশ ফিরে তাকালো।
“নমস্কার দিদি,” লাইব্রেরিতে কর্মরত এক ছেলে এক কাপ গরম চা টেবিলের উপর রেখে চুপচাপ চলে গেলো।
ধূমায়িত চায়ের কাপটা তুলে নেবে, এমন সময় বন্ধ হয়ে গেলো গান। থমকে গেলো সে। পরক্ষনেই বেজে উঠলো ফোনের রিংটোন।
হাতেগোণা দুয়েকজন ছাড়া তাকে সচরাচর কেউ ফোন দেয় না। কিন্তু এখন যে তাকে ফোন দিয়েছে সে তার সবচাইতে কাছের একজন মানুষ। নিরাপত্তার কথা ভেবে তাকে খুব কমই ফোন করে সে। তারপরও যখন ফোন দেয়, দেখা যায় সেটা সুসংসবাদ দেবার জন্য নয়। এখনও সেরকমই কিছু আশঙ্কা করছে।
কলটা দ্রুত রিসিভ করলো। ওপাশে যে আছে তার উদ্বিগ্ন কণ্ঠটা শুনেই বুঝতে পারলো, সত্যি খারাপ কিছু ঘটে গেছে। তারপরও ধীরস্থিরভাবে শুনে গেলো কিছুক্ষণ। তার প্রশান্তিময় অভিব্যক্তি পাল্টে গেলো সবটা শোনার পর। নীচের ঠোঁটদুটো কামড়ে ধরলো। চা পানের রুচি উবে গেছে। দুচোখ বন্ধ করে ফেললো কয়েক মুহূর্তের জন্য। এরকম পরিস্থিতিতে কী করতে হবে, আর কতোটা সতর্ক থাকতে হবে ঠাণ্ডা মাথায় বলে দিয়ে ফোনালাপটি শেষ করলো সে।
অনেক সতর্ক আর সজাগ থাকলেও এরকম খবর শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। কলটা শেষ হতেই এক ধরণের বিষণ্ণতা জেঁকে বসলো। তার কারণে ঘনিষ্ঠ কোনো মানুষের উপর দুর্ভোগ নেমে আসুক এটা সে চায় না।
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে। জানালা দিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে তাকালো। গাছগাছালির ভীড়ে অনতি দূরে প্রবাহিত ভৈরব নদীটি এখান থেকে দেখা না গেলেও ভেসে আসা শীতল বাতাসে নদীর গন্ধটা ঠিকই অনুভব করা যায়।
জায়গাটা তার নামের মতোই সুন্দর!
.
অধ্যায় ৫১
সুশোভন মিত্রের ফ্ল্যাটটা লালবাজার পুলিশ হেডকোয়াটার্স থেকে খুব কাছেই, বেনটিঙ্ক স্ট্রিটে অবস্থিত।
গৃহকত্রীর অনুপস্থিতি ছফাকে এক ধরণের স্বস্তিই দিলো। তবে গৃহকর্তার বেলায়ও একই কথা খাটে! সুশোভনের ভাষায়, নিজেকে নাকি আপাতত ব্যাচেলর ভাবতে শুরু করে দিয়েছে। ডিনারের পরই সিগারেট নিয়ে বসলো সে, তারপর অর্ধেক খাওয়া হুইস্কির একটি বোতল। কিন্তু দুই পেগের পরই ছফা ক্ষান্ত দিলো। হালকা মাথাব্যথার কারণে রাত একটার পরই ঘুমোতে গেলো সে। হ্যাঁঙ্গওভারের জন্য ভালো ঘুমও হলো না, তারপরও খুব সকালেই বিছানা ছাড়লো। নিজের ঘর থেকে বের হয়েই দেখতে পেলো ড্রইংরুমে ইয়োগা ম্যাট বিছিয়ে ধ্যানে মগ্ন সুশোভন। কোনো এক দুর্বোধ্য যোগাসনে বসে আছে মূর্তির মতো।
ছফার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। হুইস্কির বোতল শেষ করেও সাত সকালে এমন ধ্যানমগ্ন ঋষিকে দেখবে আশা করেনি।
ছফা যে-ই না ধ্যানমগ্ন সুশোভনকে একা রেখে চলে যাবে ঠিক তখনই সে বলে উঠলো : “ফ্রেশ হয়েছে?”
“না। মাত্র উঠলাম।”
“ঘুম ভালো হয়েছে তো?” জানতে চাইলো কলকাতা পুলিশের সহকারী নগরপাল।
মাথা দোলালো ছফা।
“চাইলে আরেক দফা ঘুমিয়ে নিতে পারো। হ্যাঁঙ্গওভার খুব বাজে লাগে আমার কাছে।” ইয়োগা ম্যাট থেকে উঠে দাঁড়ালো। “আমি একটু পর অফিসে চলে যাবো। বাসু আছে…তোমার নাস্তা রেডি করে রাখবে ও। যেকোনো দরকারে ওকে বললেই হবে।”
“ঠিক আছে।”
“আমি অফিসে গিয়েই তোমাকে ঐ লিস্টটা পাঠিয়ে দেবো।”
“থ্যাঙ্কস।”
গত রাতে প্রথম কয়েক পেগ পেটে যেতেই সুশোভন কবি হয়ে উঠেছিলো, তারপর রাজনৈতিক ভাষ্যকার, ভারতবর্ষের রাজনীতি নিয়ে তিক্ত বক্তৃতা। শেষে চড়াও হয় হাল আমলের সঙ্গীত নামের অসঙ্গতির উপরে! সুরের নামে নাকি অসূরের বজ্জাতি চলছে! অটোটিউন নিয়ে কী সব বলেছে, ছফার মনেও নেই। এককালে সে ক্লাসিক গানের চর্চা করেছিলো, সে কথা জানিয়ে একটা ঠুমরির কয়েক লাইন গেয়েও শুনিয়েছে। খুব একটা মন্দ ছিলো না তার গান। চর্চা করলে আরো ভালো গাইতে পারবে সেন্দহ নেই।
ছফা একমনে শুনে গেছে তার কথা। বেশির ভাগ সময় মাথা নেড়ে, হু হা করে সায় দিয়ে গেছে। হুইস্কির বোতল যখন অর্ধেক খালি তখনও ছফার গ্লাস শেষ হয়নি। সুশোভন অবশ্য তাকে আরো বেশি পান করার জন্য বললেও জোর খাটায়নি।
এরপর নিজের ঘরে ফিরে এসে কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঘুমে তলিয়ে যায় আবার, সুশোভন কখন অফিসে চলে গেছে টেরই পায়নি ছফা।
যখন ঘুম ভাঙলো তখন বেলা প্রায় ১১টা বেজে গেছে। বিছানা থেকে জোর করে নিজেকে তুলতে হলো। ঘর থেকে বের হয়েই দেখতে পেলো ড্রইংরুমের ফ্যাক্স মেশিনে একটি লম্বা ফ্যাক্স চলে এসেছে। সুশোভন যে এতোটা করিৎকর্মা বুঝতে পারেনি। অফিসে গিয়ে প্রথমেই তার কাজটা করেছে। ফ্যাক্সের কাছে গিয়ে চোখ বুলালো সে। যেমনটা আশা করেছিলো, সুদীর্ঘ তালিকা। এটাতে মনোযোগ দেবার আগে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করবে বলে ঠিক করলো।
ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে দেখতে পেলো ডাইনিং টেবিলে নাস্তা দেয়া আছে। সুশোভনের হাউজকিপার ছেলেটার নাম সম্ভবত বাসুদেব।
দ্রুত ব্রেকফাস্ট করে নিলো সে, চোখ বুলালো এরপর ফ্যাক্সের কাগজে। এতোগুলো মানুষের মধ্যে থেকে মুশকান জুবেরির শিকার খুঁজে বের করা সহজ হবে না, তবে সে ভেবেছিলো, বয়স আর লিঙ্গ নির্দিষ্ট করে দেয়ার ফলে তালিকাটি অতত বড় হবে না হয়তো। এখন যে সুদীর্ঘ তালিকা দেখতে পাচ্ছে সেটা তাকে ভাবনায় ফেলে দিলো কিছুটা।
ডাইনিং টেবিলের উপর আজকের আনন্দবাজার আর আজকালসহ ইংরেজি দৈনিক স্টেটসম্যান রাখা থাকলেও তাতে চোখ বুলালো না। নাস্তার পর চমৎকার এক মগ কফি খেয়ে তালিকাটা নিয়ে চলে এলো গেস্টরুমে। রোল করা দীর্ঘ লম্বা কাগজের শুরু থেকে পড়তে শুরু করলো। ভালো করেই জানে, এ কাজ করতে যে জিনিসটার সবচেয়ে বেশি দরকার হবে সেটা হলো ধৈর্য। সেই সাথে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিও, যেনো নিখোঁজদের মধ্যে কোনো প্যাটার্ন তার চোখ এড়িয়ে না যায়।
সুশোভনের ছিমছাম নির্জন ফ্ল্যাটে বসে একের পর এক সিগারেট ধ্বংস করতে করতে নিখোঁজদের তালিকায় চোখ বুলিয়ে যেতে শুরু করলো নুরে ছফা। বিগত তিন বছরের সুদীর্ঘ তালিকা দেখে বুঝতে পারছে, সারাটা দিন এ কাজেই চলে যাবে।
.
অধ্যায় ৫২
আসলাম আবারো ফিরে এসেছে অরিয়েন্ট হাসপাতালের সামনে।
গতকাল পিএস তাকে ফোন করে মূল্যবান একটি তথ্য দিয়েছিলো-বুড়ো ডাক্তার নিজের হাসপাতালের একটি সুরক্ষিত ‘স্পেশাল কেবিন’-এ আছে। তবে ভদ্রলোক মোটেও অসুস্থ নয়।
আসলাম অবাক হয়নি একটুও। এরপরই সে হাসপাতালে চলে আসে, ডাক্তারকে নজরদারি করতে শুরু করে দেয়-কিন্তু সারা দিনেও উল্লেখযোগ্য কিছু চোখে পড়েনি। জানতেও পারেনি নতুন কিছু।
কিন্তু একটু আগে আশেক মাহমুদ আরেকটি তথ্য দিয়েছে তাকে : ডাক্তারের সব চাইতে বড় দুর্বলতার সন্ধান পাওয়া গেছে, আর সেটাকে কাজে লাগাতে পারলে, ঐ ধুরন্ধর লোকটাকে বাগে আনা যাবে খুব সহজে। পিএসের ক্ষমতা সম্পর্কে ভালোই অবগত আছে সে। অরিয়েন্ট হাসপাতালের ভেতরেও তার লোক আছে, সম্ভবত ঐ লোকই এরকম খবর দিয়েছে।
এখন কালো রঙের গাড়িটা নিয়ে হাসপাতাল থেকে একটু দূরে পার্ক করে বের হয়ে এলো সে। মেইনগেটের পরে যে বিশাল ওয়েটিং এরিয়া আর রিসেপশনটি আছে সেখানে এসে কিছু উদ্বিগ্ন মুখ দেখতে পেলো। হাসপাতালে এমন দৃশ্যই স্বাভাবিক-রোগীর নিকটাত্মীয়েরা বসে থাকে। রাজ্যের যতো দুশ্চিন্তা নিয়ে। কাঁচের বিশাল দরজাটার পাশেই অর্ধচন্দ্রাকৃতির রিসেপশন ডেস্ক, ওখানে বসে আছে এক তরুণ আর তরুণী। ছেলেটা মনোযোগ দিয়ে কী যেনো দেখছে, কিন্তু মেয়েটা কানে ফোন ঠেকিয়ে আলাপে ব্যস্ত। তার দিকে তাকালো মেয়েটা। গতকাল থেকে দেখছে তাকে, চেহারাটা চিনে ফেলেছে সম্ভবত। তাতে অবশ্য সমস্যা নেই। রোগীর আত্মীয়স্বজন তো ঘনঘন হাসপাতালে আসতেই পারে।
রিসেপশন এরিয়া থেকে সোজা লিফটের দিকে চলে গেলো সে। তার গন্তব্য আবারো পাঁচ তলায়-ওখানেই এক স্পেশাল কেবিনে আছে বুড়োটা।
প্রায় বিশ মিনিট ইনটেনসিভ কার্ডিয়াক কেয়ার ইউনিটের সামনে অপেক্ষা করার পর দেখতে পেলো, ওয়াশরুমের পাশে ছোট্ট একটি প্যাসেজ দিয়ে এক তরুণী আর অল্প বয়েসী এক ছেলে বেরিয়ে আসছে। পিএসের দেয়া তথ্যমতে ওখানেই আছে স্পেশাল কেবিনটা। তাহলে এই মেয়েটাই ডাক্তারের দুর্বলতা!
ওয়েটিং এরিয়া থেকে উঠে দাঁড়ালো আসলাম। তরুণী আর ছেলেটা লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে এখন। চুপচাপ তাদের পেছনে এসে দাঁড়ালো সে। লিফটের দরজা খুলে গেলে ঢুকে পড়লো ঐ দুজন, তাদের পেছন পেছন ঢুকে পড়লো আসলাম। তিন জন মানুষকে নিয়ে লিফটটা নামতে শুরু করলো এবার।
লিফটের ভেতরে কেউ কোনো কথা বলছে না। আসলাম ভালো করে তরুণীকে দেখে নিলো। চেহারাটা তার মুখস্ত করে রাখা দরকার। সঙ্গে থাকা তরুণকেও দেখে নিলো। একেবারেই সাদামাটা চেহারার। দেখে মনে হয়, মেয়েটার বাসায় কাজ করে। বড়লোকের বাড়িতে যে-রকম গরীব আর অভাবী আত্মীয়স্বজন আশ্রয়ে থাকে, ঠিক সেরকম।
গ্রাউন্ডফ্লোরে থামলে ওই দু-জন লিফট থেকে বের হয়ে গেলে আসলামও তাদের অনুসরণ করলো নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে। ওরা কেউই তাকে একবারের জন্যে লক্ষ্য করেনি। আসলাম মেয়েটার দিকে এক ঝলক
তাকিয়ে পারলো না। তাদেরকে পাশ কাটিয়ে কাঁচের দরজাটা খুলে বের। হয়ে এলো সে। ওদের আগে তাকে তার গাড়ির কাছে পৌঁছাতে হবে।
হাসপাতালের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা একটি গাড়িতে উঠে বসলো ঐ তরুণী আর ছেলেটা। গাড়িটা সম্ভবত উবার হবে। দূর থেকে দেখলো, ড্রাইভার মোবাইলফোন হাতে নিয়ে ট্রিপটা কনফার্ম করছে।
গুলশান থেকে উবারের গাড়িটা চলে যাচ্ছে ঢাকা শহরের আরেক অভিজাত এলাকা বনানীর দিকে। যেমনটা ভেবেছিলো, গাড়িটা এসে থামলো বনানীর তিন নাম্বার রোডে ডাক্তারের বাড়ির সামনেই।
তরুণী আর অল্পবয়েসী ছেলেটা গাড়ি থেকে নামতেই ভেতর থেকে গেটটা খুলে দিলো দারোয়ান, বাড়িতে ঢুকে পড়লো ওরা।
গাড়িতে বসে, একটু দূর থেকে সবটাই দেখলো আসলাম। তার ঠোঁটে ফুটে উঠলে হাসি।
পিএসের তথ্য একেবারেই ঠিক।
.
অধ্যায় ৫৩
এদিকে ঢাকা থেকে আধঘণ্টা পিছিয়ে থাকা কলকাতা মহানগরীর বেনটিঙ্ক স্ট্রিটে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে প্রায় উদ্দেশ্যবিহীনভাবেই হেঁটে যাচ্ছে নুরে ছফা। তার মাথায় একটা ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে অনেকক্ষণ থেকেই। চিন্তাভাবনা পরিস্কার করার জন্যই ঘর থেকে বের হয়েছে সে। প্রায় সারাটা দিনই সুশোভনের ফ্ল্যাটে ছিলো।
সন্ধ্যা নামার একটু আগে মাথাটা ভার হয়ে এলে সুশোভনের ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে পড়ে একটু হাটাহাটি করার জন্য। বিকেলের দিকে সহকারী নগরপাল ফোন দিয়ে জানিয়েছিলো তার ফিরতে একটু দেরি হবে আজ। কাজ শেষে শ্বশুড়বাড়িতে গিয়ে বৌকে দেখে আসবে। ছফার কাজের অগ্রগতি সম্পর্কেও জানতে চেয়েছিলো সে। তাকে জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত নিখোঁজদের সুদীর্ঘ তালিকা থেকে মাত্র দু-জনকে পেয়েছে যাদের ব্যাপারে আরো খোঁজ নেওয়া দরকার। সুশোভন তাকে বিস্তারিত তথ্য দেবার আশ্বাস দিয়েছে।
যাই হোক, নিখোঁজদের তালিকার বেশির ভাগ মানুষই নিম্নবর্গের। কিছু অপ্রকৃতিস্থ লোকজনও আছে। ছফা মনে করে না, মুশকান জুবেরি প্রতিবন্ধীদের উপর চড়াও হবে! মহিলার রুচিবোধ আছে। তার আগের কোনো শিকারই এমন ছিলো না। কিন্তু তারপরও কথা থাকে-অভাবে পড়লে বাঘ যেমন ঘাস খাওয়া শুরু করে, তেমনি মুশকানের পক্ষেও শিকারের ধরণ পাল্টানো সম্ভব। হয়তো ‘সফট টার্গেট’ বেছে নেবার সিদ্ধান্ত নিতে পারে মহিলা। তবে এটাও ঠিক, কলকাতা মহানগরীতে শিক্ষিত আর মার্জিত পুরুষ মানুষের অভাব হবার কথা নয়। বিগত তিন বছরের তালিকায় কিছু শিক্ষিত-মার্জিত পুরুষ মানুষও রয়েছে যারা মুশকান জুবেরি পালিয়ে যাবার পর নিখোঁজ হয়েছে, তবে তাদের মধ্যে কেবল দুজনই সব দিক থেকে শিকার হবার যোগ্যতা রাখে বলে মনে করছে ছফা।
নিখোঁজদের অনেকের বিরুদ্ধে ড্রাগ অ্যাডিকশনের অভিযোগ থাকায় ছফা তাদেরকে বাদ দিয়েছে। সে মনে করে না, নেশাগ্রস্ত কোনো মানুষকে মুশকান জুবেরি শিকার বানাবে। যে প্রত্যঙ্গটি ঐ মহিলার বিশেষভাবে দরকার, সেটা সুস্থ থাকা চাই।
তবে দু-জন সম্ভাব্য শিকারের মধ্যে একজনকে নিয়ে ছফা বেশি আগ্রহী-ভদ্রলোক একজন ডাক্তার! বয়স আটত্রিশের মতো হবে। মুশকানের শিকার হিসেবে সামান্য বেশি কিন্তু পদমর্যাদা আর শিক্ষার ব্যাপারটা হিসেবে নিলে তার দিকেই মনোযোগ চলে যায়। ঐ ডাক্তার নিখোঁজ হয়েছে। মুশকান জুবেরি পালিয়ে যাবার প্রায় এক বছর মাস পর। কলকাতায় গিয়ে আশ্রয় নেবার পর পরই মহিলা শিকারে নামবে, এমনটা আশা করে না ছফা। তবে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাবে না। মুশকান ঠিক কবে থেকে শিকার শুরু করেছে কে জানে!
তালিকাটা এখনও পুরোপুরি শেষ করতে পারেনি, ফ্ল্যাটে ফিরে গিয়ে বাকি নামগুলো দেখবে। আশা করছে, সুশোভন ফিরে আসার আগেই কাজটা শেষ করতে পারবে। এই দীর্ঘ তিন বছরে কমপক্ষে পাঁচ-ছয়জনকে শিকার বানানোর কথা ঐ মহিলার-এটা বিবেচনায় নিলে তালিকাটি এখন পর্যন্ত ছফার জন্য হতাশাজনকই। তবে, নতুন জায়গায় এসে মুশকান যদি নিজেকে সংযত রেখে থাকে, তাহলে এরকমটি হতেই পারে।
তালিকায় নিখোঁজদের শুধু নাম, বয়স, নিখোঁজ হবার দিনক্ষণ আর পেশার উল্লেখ আছে। তার দরকার সম্ভাব্য দু-জন শিকারের ব্যাপারে আরো বিস্তারিত তথ্য।
দ্বিতীয় সিগারেটটা শেষ করে নুরে ছফা পা বাড়ালো সুশোভনের ফ্ল্যাটের দিকে।
.
অধ্যায় ৫৪
রাত দশটার পর নিজের ফ্ল্যাটে ফিরলো সুশোভন, সঙ্গে করে একটা বোতলও এনেছে। ছফার বুঝতে বাকি রইলো না ওটা কি। আৎকে উঠলো সে। আবারো মদ্যপান! না। তার পক্ষে আজ আর এ জিনিস পান করা সম্ভব হবে না। সে ওকেশনাল ড্রিঙ্কার, বছরে টেনেটুনে তিন-চার বার খায়। তা-ও এক বসায় দুই পেগের বেশি না। কাল রাতে হাফ গ্লাস শেষ করতেই বেগ পেয়েছে, বুঝে গেছে তার শরীর এর চেয়ে বেশি অ্যালকোহল সহ্য করতে পারে না।
“আজকে আমি কিন্তু নেই,” ছফা আত্মসমর্পন করার ভঙ্গিতে বললো। “তোমাকে একাই ড্রিঙ্ক করতে হবে, দাদা।” সে বসে আছে সুশোভনের ড্রইংরুমে। ডিনারের পর টিভি দেখছিলো।
সুশোভন হেসে ফেললো। “তুমি না বড় ইয়ে…এতো কম খাও এ। জিনিস! লিও’তে কনিয়াক-এর মতো জিনিসও ছুঁয়ে দেখলে না।” ছফার পাশে এসে বসলো সে।
“ওসব খেলে আমার হ্যাঁঙ্গওভার হয়…কালকেও হয়েছিলো।”
“বেশি করে মেরে দিলে হ্যাঁঙ্গওভার হতো না,” বোতলটায় টোকা মেরে বললো, “লন্ডন থেকে এক বন্ধু গিফট করেছে…গ্লেনফিডিখ…কুড়ি বছরের পুরনো মাল! চেখে না দেখলে হয়?”
“একশ’ বছরের হলেও আমি নেই আজ,” ছফা হেসে বললো।
কাঁধ তুললো সুশোভন। “কী আর করা।” একটু থেমে আবার বললো সে, “তা বলো, সারাদিন খেটেখুটে কী পেলে?”
“এই লিস্ট থেকে মাত্র দু-জনকে পেয়েছি, যারা ঐ মহিলার সম্ভাব্য টার্গেট হতে পারে,” বললো ছফা।
“সেটা তো বিকেলেই বলেছো, এরপর আর কাউকে পাওনি?”
মাথা দোলালো সে। “তবে যে-দুজনকে পেয়েছি তাদের ডিটেইলস ইনফো লাগবে আমার।”
“ও তুমি পেয়ে যাবে। ওদের নিখোঁজ কেসগুলোর তদন্ত চলছে এখনও।”
“তাহলে তদন্তকারী অফিসারের কাছ থেকে হেল্প পাওয়া যাবে নিশ্চয়?”
“সেটার ব্যবস্থা করা যাবে, চিন্তা কোরো না।” একটু ভেবে আবার বললো সুশোভন, “তুমি বলেছিলে দুজনের মধ্যে একজন ডক্টর আছে?”
“হুম। কিন্তু কীসের ডাক্তার, কোথায় কাজ করতো সেসব কিছু ডিটেইল্স নেই তালিকায়।”
“ডেটাবেইজে অতো ডিটেইল্স থাকে না। যেগুলো দিয়েছি তার সবগুলোরই তদন্ত হচ্ছে, কেস প্রগ্রেস করলে আপডেট করা হয়।”
“আনসভ কেসগুলোর লিস্ট দিয়েছো বলে থ্যাঙ্কস। এটা আমার আগেই বলে দেয়া উচিত ছিলো তোমাকে।”
হেসে ফেললো সুশোভন মিত্র। “আরে ভুলে যাচ্ছো কেন, আমিও পুলিশ! ঘটে কিছু বুদ্ধি তো রাখিই, নাকি?”
“রাখো মানে…বেশিই রাখো।”
“হা-হা-হা,” করে প্রাণখোলা হাসি দিলো সহকারী নগরপাল।
“তবে তালিকা অনেক বড় দেখে আমি কিন্তু অবাক হয়েছি, দাদা।”
“কেন? কলকাতা মহানগরী কি কম বড় নাকি? কতো মানুষ থাকে জানো? দিন দিন এসবের সংখ্যা বাড়ছে।”
“আমাদের ওখানেও তাই।”
একটু চুপ থেকে বললো নগরপাল, “ডিনার করে ফেলেছে তো?”
“হুম। তুমি তো ফোনে বলেই দিয়েছিলে তোমার জন্য ওয়েট না করতে।”
“হ্যাঁ, আমি ওখান থেকেই খেয়ে এসেছি,” উঠে দাঁড়ালো সুশোভন। “তুমি বসো, আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।” বোতলসহ শোবার ঘরের দিকে যেতেই থমকে দাঁড়ালো সে।
“তোমার ঐ ডাক্তারের নামটা কি?”
“ডা. দয়াল প্রসাদ মল্লিক।”
“কি!” অবাক হলো নগরপাল। ভুরু কুঁচকে গেলো তার। “ডিপি মল্লিক??”
“চেনো তাকে?”
“আমি তো ভেবেছিলাম তার কেসটা এরইমধ্যে সল্ভ করে ফেলেছে পুলিশ।”
ছফা আরো কিছু জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে রইলো। “তোমার ঐ সাসপেক্ট…কী যেনো নাম?”
“মুশকান জুবেরি।”
“হুম। মহিলা তো দারুণ টার্গেট বেছে নিয়েছে, মাইরি,” প্রশংসার সুরে বললো।
“কী রকম?” উৎসুক হয়ে উঠলো সে।
“ডিপি মল্লিক একজন ফেমাস প্লাস্টিক অ্যান্ড কসমেটিক্স সার্জন, বুঝতে পেরেছো তো?”
কথাটার মধ্যে যে ইঙ্গিত আছে সেটা ধরতে পারলো ছফা।
.
অধ্যায় ৫৫
মুশকান জুবেরির সম্ভাব্য শিকার একজন প্লাস্টিক সার্জন?!
চিন্তাটা ছফার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে বিগত দশ-পনেরো মিনিট ধরে।
একজন সন্দেহভাজন পালিয়ে গেলো পাশের দেশে, তারপর দ্বারস্থ হলো এক প্লাস্টিক সার্জনের। কেন-এর জবাব পেতে কোনো কিছু ভাবার দরকার নেই। সুশোভনের মতো সে-ও জানে জবাব একটাই-মুশকান জুবেরি সম্ভবত তার চেহারাটা পাল্টে ফেলার চেষ্টা করেছে।
না, পাল্টে ফেলেছে! নিজেকে শুধরে দিলো মনে মনে।
“মহিলা দারুণ স্মার্ট,” বললো সুশোভন মিত্র। “এক ঢিলে দুটো পাখি মেরেছে।”
ছফাও জানে কথাটা সত্যি হবার সম্ভাবনাই বেশি।
“চেহারাটা পাল্টে ফেলে শিকারকে হত্যা করে তার অগানটারও একটা বন্দোবস্ত করেছে।”
মাথা নেড়ে সায় না দিলেও মনে মনে ঠিকই সায় দিলো ছফা। “এই কেসটা যে অফিসার দেখছে তার সাথে কথা বলা যাবে?”
“অবশ্যই যাবে,” জোর দিয়ে বললো সুশোভন। চাইলে এখনই কথা বলিয়ে দিতে পারি।”
“এখনই?” অবাক হলো সে।
“যদি তুমি চাও তো…রাত খুব একটা বেশি হয়নি কিন্তু।”
একটু ভেবে নিলো ছফা। তর সইছে না তার, তবে রাত দশটার পর কোনো অফিসারকে বিরক্ত করাটা ঠিক হবে না। ডিউটি শেষে নিশ্চয় বাড়িতে গিয়ে বৌ-বাচ্চার সাথে সময় কাটাচ্ছে। “এখন কল করলে বিরক্ত হবে না?”
“তা তো হবেই,” হাসিমুখে বললো সুশোভন। “কিন্তু আমার কাছ থেকে রাত দশটার পর ফোন পেলে মোটেও বিরক্ত হবে না, এ আমি দিব্যি দিয়ে বলতে পারি।”
হেসে ফেললো ছফা। “তাহলে কল দাও।”
“ওকে।” উঠে পাশের ঘরে গিয়ে মোবাইলফোনটা নিয়ে এলো। “আমি জানি কোন্ অফিসার এই কেসটা দেখছে,” এ কথা বলে একটা নাম্বারে ডায়াল করে ছফার পাশে এসে বসলো সে। কলটা রিসিভ হতেই কানে চেপে বললো : “হ্যা…দেবাঞ্জন, একটা ভীষণ দরকারে ফোন না দিয়ে পারলাম না…” ওপাশ থেকে কিছু শুনে গেলো নগরপাল। “তুমি তো ঐ। প্লাস্টিক সার্জন ডিপি মল্লিকের কেসটা দেখছো, তাই না?…কেসের আপগ্রেডটা জানতে চাইছি আমি,” একটু থেমে উৎসুক ছফার দিকে তাকালো সে, মুচকি হেসে চোখও টিপে দিলো। ওপাশের কথা শুনে গেলো কিছুক্ষণ। “কোনো কূলকিনারাই করা যায়নি, বলো কি!” ছফার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট ওল্টালো। “আচ্ছা…বুঝতে পেরেছি…হুম…সেটাই…ঠিক আছে…থ্যাঙ্কস…পরে দরকার হলে আবার কল দেবো তোমাকে।”
“কী বললো?” উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইলো ছফা।
“কানাগলিতে গিয়ে আটকে আছে কেসটা। কোনো কূলকিনারা করা যায়নি।”
“কাউকে সাসপেক্ট হিসেবেও চিহ্নিত করা যায়নি?”
“প্রাইমারিলি মি. মল্লিকের কিছু কলিগকে সাসপেক্ট মনে করলেও সেগুলোর কোনো ভিত্তি খুঁজে পায়নি। দেবাঞ্জন বলছে, ওর ধারণা ভদ্রলোক ইলিগ্যাল প্র্যাকটিস করতো…বুঝতেই পারছো কী রকম। এসবের সাথে তার নিখোঁজের সম্পর্ক থাকতে পারে।”
ছফাকে আশাহত দেখালো।
“ও বললো, কেসটা নাকি খুবই রহস্যময়। মি. মল্লিক একদিন বলা নেই কওয়া নেই, হুট করেই নিখোঁজ হয়ে গেছে। নিজের বাসা থেকে বের হয়েছিলো, কী কাজে সেটাও কাউকে বলেনি,” একটু থেমে আবার বললো সুশোভন, “এজন্যে সামান্য কুও বের করা যায়নি কেসটার।”
ছফার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো কথাটা শুনে।
“কী?” আগ্রহী হলো কলকাতা পুলিশের নগরপাল।
“মুশকান জুবেরি এর আগে যাদেরকে শিকার করেছে তাদের কেসগুলোও এমনই ছিলো, একদম কুলেস। পুলিশ সামান্য অগ্রগতিও করতে পারেনি বলে আমাকে কেসটা দেয়া হয়।”
“তুমি তো তাহলে বেশ ভালো কাজ দেখিয়েছে, সাসপেক্টকে চিহ্নিত করতে পেরেছিলে। নিখোঁজদের কী হয়েছিলো সেটাও বের করে ফেলেছিলে।”
“কিন্তু ঐ মহিলাকে…” কথাটা আর শেষ করলো না। নিজের ব্যর্থতার কথা বলতে সব সময় তার খারাপ লাগে।
“তুমি বসো, আমি আসছি,” শোবার ঘরে চলে গেলো সুশোভন।
ছফার মাথায় এখন অনেক কিছুই ঘুরপাক খাচ্ছে, উঁকি দিচ্ছে অনেক সম্ভাবনা। তাহলে কি কেএস খানের কথাটাই সত্যি? সে যে মুশকানকে রমনা থেকে ফেরার সময় দেখেছিলো, সবটাই ছিলো হেলুনিসেশন? কিংবা ডিশন!
এখন যা বুঝতে পারছে মুশকান জুবেরি ঢাকায় গিয়ে থাকলেও তাকে দেখে চিনতে পারতো না ছফা।
“তুমি বসে বসে মাথা ঘামাও,” বোতল আর গ্লাসসহ ঘরে ঢুকে বললো। সুশোভন মিত্র, “আমি একটু চেখে দেখি।”
“বৌদির অ্যাবসেন্সটার ভালোই ফায়দা নিচ্ছো।”
হেসে ফেললো নগরপাল। “আমার কি সেটা নেয়া উচিত হচ্ছে না?” তারপর চোখ টিপে দিলো। “বিয়ে থা করো, তখন বুঝতে পারবে। এখন
তো ঝাড়া হাত-পা, ব্যাচেলর মানুষ…আমাদের দুঃখ বুঝবে না তুমি।”
কিছু বললো না ছফা। তার মাথায় এখন অজস্র চিন্তা। একটু উদাস হলেও আড়চোখে দেখতে পাচ্ছে সুশোভন বেশ আয়েশ করে গ্লাসে হুইস্কি ঢালছে। লালচে তরলে ভর্তি গ্লাসটা নাকের সামনে নিয়ে ঘ্রাণ নিলো কয়েক মুহূর্ত, তারপর সন্তুষ্ট হয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো।
কয়েক বছর আগে ফ্রান্সের লিও’তে ইন্টারপোলের সদর দফতরে এক সেমিনারে অংশ নিতে গেলে ওখানে প্রথমবারের মতো সুশোভনের সাথে। এক রুমে থাকার অভিজ্ঞতা হয়েছিলো তার। যে ক-দিন তারা ছিলো, প্রতি রাতেই দামি দামি সব ফরাসি মদ নিয়ে আসতো কলকাতার এই নগরপাল। বেশ আয়েশ করে মদ্যপান করতো। এক্ষেত্রে সে আবার ফরাসিদের সমকক্ষই বলা চলে-কোন মদের জন্য কোন গ্লাস, কী তার প্রিপারেশন সবই তার নখদর্পনে। হুইস্কি পানের সময় গ্লাসটা নাকের সামনে নিয়ে চোখ বন্ধ করে ঠিক এভাবেই ঘ্রাণ নিতো তখন।
“কঠিন জিনিস, বুঝেছো?”
সুশোভনের কথায় লিও থেকে কলকাতায় ফিরে এলো ছফা।
“আস্তে আস্তে গলা দিয়ে নামতে দেবে…এ জিনিস সরবতের মতো খেতে হয় না। ছোট্ট একটা চুমুক দিলো এরপর। “আহ্!” আবারো চোখ বন্ধ করে ফেললো। “দুর্দান্ত জিনিস।”
“ডিপি মল্লিক যদি মুশকান জুবেরির শিকার হয়ে থাকে তাহলে ওর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ডি-অ্যাক্টিভ নয়তো ডিলিট করা থাকবে।”
“তাই নাকি?” গ্লাসের তরলে চুমুক দিতে গিয়ে থেমে গেলো নগরপাল।
“এর আগের প্রায় সব শিকারের সাথেই মহিলা এ কাজ করেছে, শুধু একটার বেলায় এটা করতে পারেনি, আর সেই ভিক্টিমের সূত্র ধরেই তাকে আমি খুঁজে বের করতে পেরেছিলাম।”
মাথা নেড়ে সায় দিয়ে গ্লাসে চুমুক দিলো সুশোভন মিত্র। “তাহলে ফেসবুক ঘেঁটে দেখো ডিপি মল্লিকের আইডিটার কী অবস্থা। আমার তো ওয়াইফাই আছে, সেলফোন থেকে লগ-ইন করো।”
পকেট থেকে মোবাইলফোনটা বের করলো ছফা। “পাসওয়ার্ডটা বলো?”
“শিভাস রিগ্যাল।”
“কি!”
হেসে ফেললো সুশোভন। “মজা করলাম। এবার আসলটা বলছি। এসএইচভিএন০২০৩১৯৭৮।”
“তোমার ডেট অব বার্থ নাকি?” পাসওয়ার্ডটা ইনপুট দিতে দিতে বললো ছফা।
মাথা নেড়ে সায় দিলো নগরপাল। “সহজ আর মনে থাকবে এমন পাসওয়ার্ডই আমি দেই। র্যান্ডম ডিজিট আমার মুখস্ত থাকে না। তবে ভেবো না, ফেসবুক, ইমেইল কিংবা ক্রেডিট কার্ডের বেলায়ও একই কাজ করি।”
মুচকি হাসলো ছফা। “তুমি অহোটা বোকা যে নও সেটা আমি জানি।”
হা-হা করে হেসে চোখ টিপে দিলো। “ওকে…তুমি কাজ করো, আমি একটু মদমত্ত হই।”
ছফা ফেসবুকে ঢুকে সার্চ করতে শুরু করে দিয়েছে এরইমধ্যে। “আমার ধারণা ভদ্রলোকের আইডিটা ডিঅ্যাক্টিভ….অথবা ডিলিটেড।”
সুশোভন গ্লাসে আরেকটা চুমুক দিলো। “তা হলে তো হয়েই গেলো, স্পষ্ট হয়ে যাবে, ওটা তোমার ঐ সেক্সি-গ্লামারাস মহিলারই কাজ।”
ছফা বুঝতে পারলো, সুশোভন এখন আস্তে আস্তে অশোভন হতে থাকবে।
“আচ্ছা, এখানকার মানুষজন ইংরেজিতে এভাবে মল্লিক লেখে কেন?”
ভুরু তুললো নগরপাল। “এম-ইউ-এল-এল-আই-সি-কে?”
“হুম।”
“কেন, তোমাদের ওখানে অন্যভাবে লেখে নাকি?”
“এম-ও-এল-এল-আই-কে লিখতে দেখেছি অনেককে।”
মাথা দোলালো সুশোভন। চোখ বন্ধ করে কী যেনো ভাবছে।
ছফা আর কথা না বাড়িয়ে নামটা টাইপ করে সার্চ দিলো। কিছুক্ষণ পরই ভেসে উঠলো রেজাল্ট। আৎকে উঠলো সে। “ওরে বাপরে! এতো দয়াল প্রসাদ মল্লিক আছে ভারতে।”
“কলকাতায় এ নাম কমই আছে কিন্তু সারা ভারতবর্ষ হিসেবে নিলে অনেক হবারই কথা।”
“তুমি কি ভদ্রলোককে কখনও দেখেছো?” ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থেকেই বললো ছফা।
“না। তবে পত্রিকায় ছবি দেখেছি।”
“তাহলে তো ছবি দেখলে চিনতে পারবে?”
“হুম।” গম্ভীর হয়ে জবাব দিলো নগরপাল। “এক কাজ করো, নামের আগে ‘ডক্টর’ লাগিয়ে সার্চ করো। ডক্টরদের মাইরি অদ্ভুত বাতিক থাকে, বুঝলে?” গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললো আবার, “নামের আগে ‘ডক্টর বসাতে না পারলে ওদের পোঁদের মধ্যে এক ধরণের চুলকোনি হয়। আমি কখনও ‘ডক্টর’ পদবী ছাড়া কোনো ডক্টরকে তার নাম লিখতে দেখিনি। এটা কিন্তু
তুমি অন্য প্রফেশনালদের বেলায় সব সময় দেখবে না।”
মুচকি হাসলো ছফা। পনেরো বছরের পুরনো দ্রব্যের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে, সামান্য মাতলামিতে ধরেছে সুশোভনকে।
নামের আগে সংক্ষেপে ‘ডক্টর’ যোগ করে সার্চ দিলো এবার।
ডা. দয়াল প্রসাদ মল্লিক
রেজাল্ট আসতেই চমকে উঠলো-এ নামে কোনো আইডিই নেই! নুরে ছফা হতাশ হয়ে তাকালো সুশোভনের দিকে।
“কি?” নগরপাল আবারো মদ ঢালতে উদ্যত হচ্ছিলো গ্লাসে। “এ নামে কোনো ফেসবুক আইডি নেই দেখছি!”
একটা সেঁকুর তুলে তার দিকে তাকালো সুশোভন মিত্র। আইডি না পেয়ে ছফার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে কেন বুঝতে পারছে না সে।
.
অধ্যায় ৫৬
প্লাস্টিক সার্জন ডিপি মল্লিকের আইডিটা খুঁজে না পেয়ে মনে মনে ছফা এখন একটাই কামনা করছে-এই সার্জনের নিখোঁজের পেছনে যেনো মুশকান জুবেরিই জড়িত থাকে।
“একটু চেখে দেখবে নাকি? টেনশনে এ জিনিস ভালো কাজে দেবে।”
মাথা দুলিয়ে না করে দিলো ছফা। সে এখন ভাবছে, ডিপি মল্লিকের ব্যাপারে কিভাবে তথ্য জোগাড় করা যায়।
“একা একা মদ খাওয়া কী রকম, জানো?” সহকারী নগরপাল বললো হতাশার সুরে। “হস্তমৈথুনের মতো। মজাটা তুমি পাবে কিন্তু আসলটার মতো না!”
“কীসের সাথে যে কী বলো না!” ফোনের ডিসপ্লের দিকে তাকিয়েই বললো ছফা। তার হাসিই পাচ্ছে।
“সত্যি বলছি, মাইরি,” সুশোভন ঝুঁকে এলো একটু। “এ জিনিস খেতে হয় কয়েক জনে মিলে, তাহলে জমে ভালো। বুঝতে পেরেছো?”
মাতালের সাথে তাল মেলানোর জন্যই মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা।
“তিনজন হলে তো কথাই নেই,” জোরে ঢেঁকুর তুলে বললো এবার। “অসাম! একেবারে থ্রি-সামের ফিলিংসটা পাবে।”
আক্ষেপে মাথা দোলালো নুরে ছফা। “দাদা, সাবধান! তুমি অন্যদিকে চলে যাচ্ছো।”
“কথা কিন্তু সত্যি বলেছি। আর চার-পাঁচ জন হলে কি হয় জানো তো? গ্যাং ব্যাং!”
ফোনের পর্দা থেকে চোখ সরিয়ে নগরপালের দিকে তাকালো। মাতালের সাথে তাল দেবার দরকার নেই আর। একা একা যতোক্ষণ পারে বকবক করুক। আবারো সে মনোযোগ দিলো ফোনের স্ক্রিনের দিকে।
“তোমার ঐ গ্লামারাস সাসপেক্ট কিন্তু কঠিন মাল,” সুশোভন বলে যেতে লাগলো। “নিজের চেহারাটাই পাল্টে ফেলেছে। এখন যদি সে কোনোভাবে এখানকার পাসপোর্ট বাগিয়ে নিতে পারে তাহলেই হয়েছে, একেবারে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে।”
ছফাও এরকম আশঙ্কা করছে এখন।
“না না, ভুল বললাম, মাতাল কণ্ঠে বললো সহকারী নগরপাল। “ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে না!”
কৌতূহলি হয়ে সুশোভনের দিকে তাকালো ছফা।
“আই উড রাদার সে…মহিলা আরো কাছে চলে আসবে। কিন্তু কোন্ শালা তাকে চিনবে, উম?” এবার কণ্ঠটা গম্ভীর করে বললো, “কিপ ইওর ফ্রেন্ডস ক্লোজ…ইওর এনিমিজ ক্লোজার!”
ছফা কিছু বললো না, চেয়ে রইলো নগরপালের দিকে।
“ঐ ডেঞ্জারাস লেডি তোমার খুব কাছে আসার প্ল্যান করেছে, বুঝতে পেরেছো! তোমাকেও তার শিকার বানানোর প্ল্যান-ট্রান করছে বোধহয়।”
ছফা মাথা দোলালো মাতালের কথা শুনে।
“হতাশ মনে হচ্ছে?” ঢুলু ঢুলু চোখে জানতে চাইলো। “এতো সহজে হতাশ না হয়ে ডিপি মল্লিকের কোনো পেইজ আছে কিনা খুঁজে দেখো,” মদে চুমুক দিয়ে বললো সুশোভন। “অ্যাকাউন্ট ডিলিট করা, ডি-অ্যাক্টিভ করা সহজ, পেইজের বেলায় কাজটা কিন্তু অতো সহজ না।”
নড়েচড়ে উঠলো ছফা।
“ফেমাস প্লাস্টিক অ্যান্ড কসমেটিক্স সার্জন…তার তো পেইজ থাকবেই।” একটা সেঁকুর তুলে আবার বললো, “বিশেষ করে তার ক্লিনিক কিংবা হসপিটালের নামেও থাকার কথা।”
মাথা নেড়ে সায় দিয়ে দ্রুত ফেসবুকে পেইজটার সার্চ করতে শুরু করে দিলো সে। পাঁচ মিনিট পরই খুঁজে পেলো, ডিপি মল্লিকের আসলেই একটা পেইজ আছে! সেটাতে ক্লিক করলো ছফা।
হাসি হাসি মুখের, সাদা অ্যাপ্রোন পরা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ডা. দয়াল প্রসাদ মল্লিকের প্রোফাইল পিকটা ভেসে উঠলো। সুন্দর করে ছাটা গোঁফ, ছোটো করে ছাটা পরিপাটি চুল, হালকা নাদুসনুদুস শরীর, বড় বড় চোখ।
ছফা জানে প্লাস্টিক আর কসমেটিক্স সার্জনের মধ্যে পার্থক্য আছে। তবে লোভনীয় পেশা হিসেবে প্লাস্টিক সার্জনেরা কসমেটিক্স সার্জারির দিকেই ঝুঁকে পড়ে বেশি। ডিপি মল্লিকও তাই করেছে সম্ভবত।
নিখোঁজ হবার আগে এই সার্জন কাজ করতো চেঞ্জমেকার নামের একটি ক্লিনিকে।
“কিছু পেলে?” সুশোভন অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর জানতে চাইলো।
“পেইজটা দেখছি,” ফোনের পর্দা থেকে চোখ না সরিয়েই বললো সে।
“ঐ সার্জন কিন্তু সেলিব্রেটিদের সাথে ইয়ে করে বেড়াতো। আমার এক কলিগ বলেছিলো, এখন মনে পড়েছে। ঐ যে, এক অ্যাক্ট্রেস আছে না?…আরে ঐ যে…” সুশোভনের বেয়াড়া স্মৃতি এখন সাড়া দিচ্ছে না ঠিকমতো। “ঐ মেয়েটার সাথে একটা কেলেঙ্কারির খবর বেরিয়েছিলো।”
“কি রকম কেলেংকারি?”
“আরে আজকাল যা শুরু হয়েছে…ওরকম,” একটু থেমে আবার বললো, “ঐ যে মিটু মুভমেন্ট চলছে না? ওটাতে ওর নাম এসছিলো। এক অ্যাক্ট্রেস অ্যাকুইজ করেছিলো ওকে।”
ছফা অবশ্য এ মুহূর্তে কেলেঙ্কারি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। তার সমস্ত মনোযোগ ফোনের ছোট্ট পর্দায়। প্রায় সব পোস্টই আগ্রহী কসমেটিক্স সার্জারির ক্লায়েন্টদের। কোনটা করতে কত টাকা লাগতে পারে, কতো দিন লাগবে, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কিনা, এইসব জানতে অনেকেই আগ্রহী। ডা. মল্লিকও সব প্রশ্নের জবাব দিয়েছে। তবে ছফার ধারনা এসব জবাব ভদ্রলোক নিজে দেয়নি। এরকম পেইজগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অন্য কেউ চালায়, এখানেও সম্ভবত তাই হয়েছে। ডাক্তারের মতো ব্যস্ত কেউ দিনরাত বসে বসে প্রশ্নের জবাব দেবার কথা না।
বেশির ভাগ পোস্টই ছবিসহ। সেইসব ছবি স্ক্রল করতে করতে একটা ছবিতে এসে থমকে গেলো ছফা। ভুরু কুঁচকে তাকালো সে।
“মাই গড!” অস্ফুটস্বরে বলে উঠলো।
.
অধ্যায় ৫৭
ডা. ডিপি মল্লিকের পেইজে তার অসংখ্য সাফল্য আর কর্মকাণ্ডের ছবি রয়েছে। সেসব ছবির সংখ্যা কয়েক শ’ হবে। বিদেশের কোন্ মেডিকেল থেকে কী কোর্স করেছে, কোথায় কোন্ সম্মাননা পেয়েছে, তার চেঞ্জ মেকার ক্লিনিক কী কী সুবিধা দিয়ে থাকে, কতো অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়, এ পর্যন্ত কতোজন ক্লায়েন্টকে সেবা দিয়েছে, সে-সবের ছবিসহ ফিরিস্তি দেয়া আছে। তবে তার সেলিব্রেটি ক্লায়েন্টের মধ্যে খুব কমই নিজেদের পরিচয় কিংবা ছবি দেখাতে রাজি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। ডাক্তার এটা নিজেই স্বীকার করেছে। তার দাবি, প্রচুর সেলিব্রেটির কসমেটিক্স সার্জারি করেছে সে, তাদের অনুরোধেই নাম প্রকাশ করা হয়নি। তবে কিছু কিছু সেলিব্রেটি উদারতা দেখিয়ে তাদের নাম আর ছবি দিয়েছে, সেইসাথে ডাক্তারের প্রশংসা করতেও ভোলেনি। তাদেরকে বিজ্ঞাপন হিসেবে ব্যবহার করেছে ডিপি মল্লিক।
এসব কিছু নিয়ে ছফার মধ্যে কোনো আগ্রহ নেই, থাকার কথাও নয়, কিন্তু একটা ছবি দেখে তার চোখ আটকে গেছে একটু আগে। এখন সেই
ছবিটার দিকেই ভুরু কুঁচকে চেয়ে আছে সে।
ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদ!
ডিপি মল্লিকসহ আরো অনেক ডাক্তারের সাথে দাঁড়িয় আছেন ভদ্রলোক। ছবিটা ২০১৩ সালের অক্টোবরের। আর সেটা বাংলাদেশেই।
ছবির নীচের ক্যাপশন বলছে : ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে ঢাকার নামকরা অরিয়েন্ট হাসপাতালের আমন্ত্রণে ডাক্তার ডিপি মল্লিক গিয়েছিলো সেখানকার প্লাস্টিক অ্যান্ড কসমেটিক্স সার্জারি ডিপার্টমেন্টের একটি সেমিনারে আমন্ত্রিত হয়ে।
ছফা টের পেলো উত্তেজনায় তার রক্ত টগবগ করছে। সে আরো কিছু ছবি দেখলো। মোট তিনটি ছবি পাওয়া গেলো যেগুলো ডিপি মল্লিকের অরিয়েন্ট হাসপাতাল সফরের সময়ে তোলা। তবে কেবলমাত্র একটি ছবিতেই ডাক্তার আসকারের সাথে, আর সেটা ডিপি মল্লিক নিজেই তুলেছে-সেফি। এই ছবির নীচে ক্যাপশনটা দেখলো ছফা : প্রখ্যাত সার্জন এবং অরিয়েন্ট হাসপাতালের কর্ণধার ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদের সঙ্গে।
কয়েক মুহূর্ত চুপ মেরে রইলো সে। ঐ সময়ে মুশকান জুবেরি অরিয়েন্ট হাসপাতালে কাজ করতো না, ততোদিনে সুন্দরপুরে চলে গেছে।
“হোগা!” বেশ জোরে বলে উঠলো সুশোভন, সেই সাথে অট্টহাসিতে ফেঁটে পড়লো।
ছফা যারপরনাই অবাক, কিছুই বুঝতে না পেরে চেয়ে রইলো তার দিকে। “কী হয়েছে? কী বলছো এসব?”
কোনোমতে হাসির দমক থামিয়ে সুশোভন বলতে লাগলো, “তোমার এই ডিপি মল্লিকের কথা শুনে আরেক মল্লিকের কথা মনে পড়ে গেছে আমার।”
মল্লিকের সাথে ‘হোগা’র কী সম্পর্ক থাকতে পারে সেটা ছফার মাথায় ঢুকছে না।
“স্কুলে আমাদের এক টিচার ছিলেন, আমরা সবাই তাকে মল্লিকস্যার বলে ডাকতাম…” একটা সেঁকুর তুললো নগরপাল। “মল্লিকস্যার একবার আমাদেরকে খুব মজার একটি গল্প বলেছিলেন,” কথাটা বলেই আবারো হেসে ফেললো সে।
“কী বলেছিলেন?”
হাসি থামিয়ে ছফার দিকে স্থিরচোখে তাকালো সুশোভন। তারপর গ্লাসের তলানিতে যতোটুকু হুইস্কি ছিলো শেষ করে ফেললো এক ঢোঁকে। “ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন…ভালোই পড়াতেন।”
মুচকি হাসলো ছফা। তার মাথায় ঘুরছে ডা. আসকার, মুশকান আর ডিপি মল্লিক, এদিকে আরেক মল্লিকের গল্প বলে যাচ্ছে তার হোস্ট। না শুনেও উপায় নেই।
“প্রায়ই ক্লাসে পড়ার ফাঁকে মজার মজার গল্প করতেন, আমরাও বেশ এনজয় করতাম। ভগবানই জানে, বানিয়ে বানিয়ে বলতেন নাকি আসলেই সব সত্যি ঘটনা ছিলো,” হুইস্কির বোতলটা হাতে তুলে নিলো সে।
“আর খেয়ো না, দাদা…অনেক তো খেলে,” বারণ করলো ছফা। “কী বলেছিলেন উনি, সেটা বলো?”
কয়েক মুহূর্ত ভেবে বোতলটা রেখে দিলো সুশোভন। “ভদ্রলোক আবার পূর্ববাংলার লোক ছিলেন, আদিবাড়ি ছিলো তোমাদের বরিশালে, ওখান থেকেই স্কুল পাস দিয়ে কলকাতায় চলে আসেন কলেজে পড়ার জন্য। যাই হোক, হকসাহেবের বাড়ি ছিলো ওঁর গ্রামেই।”
“শেরেবাংলা ফজলুল হক?”
“হ্যা…ওঁ-ই…ফজলুল হক। ঘটনাটা সম্ভবত চল্লিশের দশকে, ভারতবর্ষ তখনও বৃটিশরাজের অধীনে। হকসাহেব তো করতেন মুসলিমলীগ…তার এক বাল্য বন্ধু ছিলো বেশ নামকরা রাজনীতিক, সম্ভবত কমিউনিস্ট পার্টি করতো সে। তো, হকসাহেব সবাইকে অবাক করে দিয়ে কংগ্রেসের সাথে জোট বাঁধলে ওঁর সেই বাল্যবন্ধু ভীষণ ক্ষেপে যায়। ওদের গ্রামের বাড়ি ছিলো আবার খুব কাছাকাছি…খাল-বিল দিয়ে যেতে হতো নৌকোয় করে।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা।
“হকসাহেব গ্রামের বাড়িতে গেলে সেই বাল্যবন্ধুর বাড়িতে একবার হলেও দেখা করে যেতেন। তো, কংগ্রেসের সাথে জোট বাঁধার পর গ্রামে গেলে এক বিকেলে তিনি নৌকো নিয়ে বন্ধুর বাড়িতে গেলেন। নৌকোটা যখন ঘাঁটে ভিড়ছে তখন সেই বন্ধু ঘাঁটের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ছিলো, হকসাহেবকে দেখে রাগেক্ষোভে বলে উঠলো, ‘কিরে ফৈজ্যা, তর লাইগ্যা তো মাইনুষের কাছে আর মুখ দেহাইতে পারতেসিনা।’” সুশোভন বেশ চেষ্টা করলো বরিশালের আঞ্চলিক ভাষাটা বলার জন্য, তার প্রচেষ্টা মোটামুটি সফলও বলা যায়। “হকসাহেব ছিলেন খুবই আউটম্পোকেন পার্সন, বুঝলে…সেইরকম রসবোধও ছিলো। কথাটা আর মাটিতে পড়তে দিলেন না। নৌকো থেকে নামতে নামতেই জবাব দিলেন, ‘মুখ দেহাইতে পারলে হোগা দেখাগিয়া!’” কথাটা বলার পর ছফা আর কী হাসবে, সুশোভন হাসতে হাসতে সোফার উপর গড়িয়ে পড়লো।
ছফাও হাসি ধরে রাখতে পারলো না।
“ওঁর সেন্স অব হিউমারটা দেখেছে? মুখ না দেখাতে পারলে হোগা দেখা! হা-হা-হা!” হাসতে হাসতে পেট ফেঁটে যাবার উপক্রম হলো তার। “চিন্তা করো, কী জবাবটাই না দিয়েছিলেন! আই ক্যান ইমাজিন…সেই বন্ধুর চেহারাটা কেমন হয়েছিলো এ কথা শুনে! একেবারে লাজওয়াব!”
গল্পটা সত্যি হোক আর মিথ্যে, হাসি পাবার মতোই। কিন্তু ছফার মাথায় ঘুরছে অন্য চিন্তা। সুশোভনের হাসিটা যেনো ব্যাকগ্রাউন্ড সাউন্ড হয়ে গেলো নিমেষে। আবারো সে মনোযোগ দিলো ফোনের পর্দার দিকে। বেশ ধৈর্য নিয়ে ডা. ডিপি মল্লিকের পেইজের বাকি ছবিগুলো স্লাইড করে করে দেখতে শুরু করলো। এভাবে এভাবে দেখতে দেখতে হঠাৎ একটা ছবি দেখে নড়ে চড়ে উঠলো সে-সার্জন দয়াল প্রসাদ মল্লিকের অসংখ্য সেল্ফির একটি-ছবিতে ভদ্রলোক একাই আছেন, তবে তার ব্যাকগ্রাউন্ডে যেটা দেখা যাচ্ছে সেটা নুরে ছফা মোটেও আশা করেনি।
রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি।
.
অধ্যায় ৫৮
ডাক্তার দয়াল প্রসাদ মল্লিক রবীন্দ্রনাথে গেছিলো!
নুরে ছফা প্রবল উত্তেজনা নিয়ে বসে আছে, ওদিকে সুশোভন মিত্র আরেকটি নতুন উপাখ্যান শুরু করেছে কলেজ জীবনের এক বান্ধবীকে নিয়ে কিন্তু সেটা তার কানে ঢুকলেও মনোযোগ পাচ্ছে না একদমই। নগরপালের কথাগুলো দূর থেকে ভেসে আসা শব্দের মতো লাগছে যেনো!
ডিপি মল্লিকের পেইজটার সবগুলো ছবিই দেখে ফেলেছে ছফা, ঐ দুটো ছবি ছাড়া উল্লেখযোগ্য আর কিছু পায়নি। কিন্তু দুটো ছবিই যথেষ্ট একটি সংযোগ স্থাপনের জন্য নিখোঁজ প্লাস্টিক সার্জন ডিপি মল্লিকের সাথে ডাক্তার আসকারের সম্পর্ক ছিলো, আর সুন্দরপুরের মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের স্বাদও নিয়েছে ভদ্রলোক। রবীন্দ্রনাথকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে যে সেল্ফিটা তুলেছে সার্জন, তার ক্যাপশনে লেখা আছে : অদ্ভুত নামের এক রেস্টুরেন্ট! অসাধারণ সব খাবার!
তাহলে কি মুশকানকেও ডিপি মল্লিক চিনতো?
অবশ্যই চিনতো, নুরে ছফা মনে মনে বললো। ডাক্তার আসকারের আমন্ত্রণে গেছিলো ভদ্রলোক, সম্ভবত সুন্দরপুরেও তার সঙ্গি ছিলেন অরিয়েন্ট হাসপাতালের মালিক। ওখানে যাবার একটাই উদ্দেশ্যই থাকতে পারে-রবীন্দ্রনাথের অসাধারণ খাবারের আস্বাদন। তার মানে মুশকান জুবেরি তাকে আগে থেকেই চিনতো। যদি তা-ই হয়ে থাকে, তাহলে কলকাতায় আসার পর তাকে শিকার বানানোর একটাই কারণ থাকতে পারে-সার্জন ডিপি মল্লিককে দিয়ে নিজের চেহারা পাল্টে ফেলার পর ব্যাপারটা চিরতরের জন্য গোপন রাখতে তাকে হত্যা করা। তবে এরকম মার্জিত আর তরতাজা একজনকে নিশ্চয় অপচয় করেনি মহিলা শিকার হিসেবে ভদ্রলোক যথেষ্ট উপযুক্ত।
“বুঝলে, ও আবার প্রটেকশন ছাড়া ওসব করতে রাজি ছিলো না।”
সুশোভন মিত্রের এমন কথায় সম্বিত ফিরে পেয়ে তাকালো ছফা। “কীসে রাজি ছিলো না?”
“আরে প্রটেকশানের কথা বলছি…” এক কথা দু-বার বলতে গিয়ে সামান্য বিরক্ত হলো মাতাল।
“ও।”
“কিন্তু আমি তখন ওরকম সময়ে কী করে ও জিনিস জোগাড় করি, বলো?”
হ্যাঁ-না কিছুই বললো না। ছফার মাথায় অনেক কিছুই ঘুরপাক খাচ্ছে এখন।
“আমি বললাম, তুমি কিছু চিন্তা কোরো না, বাইরেই-”
“আহ, দাদা!” কথার মাঝখানে থামিয়ে দিলো তাকে। “কী শুরু করলে?” এ মুহূর্তে পর্নোগ্রাফির বয়ান শোনার মেজাজে নেই সে।
“আরে শালা! লজ্জা পাচ্ছো নাকি!” ভুরু কুঁচকে তাকালো সুশোভন।
মাখা দোলালো ছফা।
একটা ঢেঁকুর তুললো মাতাল। “যাই হোক, ও তো রাজিই হয় না, তখন আমার কি ইচ্ছে করলো জানো?” প্রশ্নের জবাবের অপেক্ষা না করেই বললো, “রেইপ করে বসি!”
ভুরু কপালে তুললো ছফা। “তুমি কি সেটা করেছে নাকি?”
“আরে ধুর, হাত নেড়ে উড়িয়ে দিলো কথাটা। “আমি কি অতোটা ইয়ে নাকি। রিল্যাক্টান্ট কারোর সাথে আমি কখনও কিছু করিনি,” একটু থেমে আবার বললো, “তুমি কখনও করেছো?”
ছফার ভুরু কপালে উঠে গেলো। আমাকে আবার এরমধ্যে টানছো কেন?”
“তুমি দেখি এসব কথা শুনতেও লজ্জা পাও, বলতেও লজ্জা পাও…বোকাচোদা!” বলেই মদের বোতলটা হাতে তুলে নিলো আবার।
“আর খেয়ো না, দাদা,” ছফা তাকে বাধা দিলো দ্বিতীয়বারের মতো। “অনেক খেয়েছো, এবার থামো। শোবার ঘরে চলে যাও, রাত অনেক হয়েছে। কাল তোমার অফিস আছে না?”
যেনো বিষম খেলো কলকাতা পুলিশের সহকারী নগরপাল। “কাল তো হলিডে…অফিস থাকবে কেন?”
“ওহ্! যাই হোক, তোমার রেস্ট নেয়া উচিত।”
“গেস্ট রেখে রেস্ট নেবো আমি?!” খুবই অবাক হলো সুশোভন। “তুমি আমাকে কী ভাবো, অ্যাঁ?”
“আমিও একটু পর শুয়ে পড়বো। তুমি শোবার ঘরে চলে যাও, আমি ঘরের বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়বো।”
সুশোভন তার লালচে আর ঢুলু ঢুলু চোখে তাকিয়ে রইলো ছফার দিকে। “আমি এখন ঘুমাবো? হাহ! নাইট ইজ স্টিল ইয়াং…ম্যান। আর বোতলটা তো অর্ধেকও খালি হয়নি!”
ছফা কিছু বলতে যাবে তার আগেই সুশোভন মিত্র সোফার উপরে শুয়ে পড়লো।
“ধুর…তুমি একটা মাজুল! মদ খাও না, ইয়েও করো না, কিছু করো না। শুধু ঐ ডেঞ্জারাস লেডিকে নিয়ে পড়ে আছে। তুমি যে বড় বোরিং একটা মানুষ সে-কথা কি কেউ কোনো দিন বলেছে তোমায়?” সোফায় শুয়ে শুয়েই জিজ্ঞেস করলো সহকারী নগরপাল।
মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা। “অনেকেই বলেছে।” যদিও সামনাসামনি কেউ তাকে এ কথা বলেনি, তবে তার ধারণা, মানুষ হিসেবে সে যথেষ্ট বোরিং।
“যারা বলেছে তাদেরকে আমি স্যালুট দেই,” বলেই সোফা থেকে ওঠার চেষ্টা করলো সুশোভন, আধশোয়া অবস্থায় স্যালুট ঠুকেই ধপাস করে শুয়ে পড়লো, তারপর আর কোনো রা নেই।
ছফা ভালো করে দেখলো তাকে। বেঘোরে চলে গেছে। বাঁচা গেলো! মনে মনে বললো সে।
.
অধ্যায় ৫৯
সুশোভনের এক হাত আর এক পা সোফার প্রান্ত থেকে ঝুলছে। বেঘোরে পড়ে আছে সে। তার ভারি নিশ্বাসের শব্দ ছাড়া ঘরে আর কোনো শব্দ নেই। এ মুহূর্তে। পুরো ঘরটা অন্ধকারে ঢাকা।
নুরে ছফা নিজের ঘরে এসে চুপচাপ বসে আছে বিছানার পাশের চেয়ারে। তার হাতে মোবাইলফোন। চার্জ শেষ হয়ে যাওয়াতে রিচার্জ করতে দিয়েছে, তবে ফোনটা এখনও তার হাতে। রাত প্রায় একটা বাজে। কলকাতা শহরও ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
ছফা টের পেলো তার দুচোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। দীর্ঘক্ষণ ফোনের ছোট্ট ডিসপ্লেটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এ অবস্থা। আজকে সে যা জানতে পেরেছে তারপর মনে হয় না রাতে ঘুমাতে পারবে।
ছফা এখন আর ডিপি মল্লিকের পেইজ ব্রাউজ করছে না। ওটা এ পর্যন্ত কতোবার দেখেছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। পুরো পেইজের হিস্ট্রি যতোটুকু সম্ভব ঘেঁটে দেখেছে, কোথাও নতুন কিছু পায়নি। যতোটুকু পেয়েছে তাতেই সে বিস্মিত।
ডাক্তার আসকারের সাথে কলকাতার নিখোঁজ প্লাস্টিক সার্জন ডিপি মল্লিকের সখ্যতা আছে। আর সেই নিখোঁজ সার্জন বাংলাদেশ সফর করার সময় সুন্দরপুরেও গিয়েছিলো-রবীন্দ্রনাথে! ছফা ধরেই নিলো, মুশকান জুবেরির সাথে ভদ্রলোকের পরিচয় কিংবা সখ্যতা ছিলো। ছফা একদম নিশ্চিত, ডিপি মল্লিককে হত্যা করার পর তার নিজস্ব ফেসবুক অ্যাকাউন্টটা ডিলিট করে দিয়েছে মুশকান।
পেইজটা কেন ডিলিট করতে পারলো না, সে প্রশ্নের জবাব একটু আগে দিয়ে দিয়েছে সুশোভন : পেইজটা ডিপি মল্লিক একা চালাতো না। আরো দু-জন অ্যাডমিন আছে, এ কারণে মুশকানের পক্ষে ওটা ডিলিট করা সম্ভব হয়নি।
আবার এমনও হতে পারে, মুশকানের হয়তো পেইজের কথা খেয়ালই ছিলো না। ভুল তো সবারই হয়, আর ভুলের চেয়েও বেশি হয় সমস্যা। হাসিবের বেলায়ও মুশকান হয়তো সমস্যায় পড়ে গেছিলো। কারণ যা-ই হোক, তার অ্যাকাউন্টটা হাতিয়ে নিতে পারেনি সে।
কয়েক মুহূর্ত ফোনটা নামিয়ে রেখে চোখ বন্ধ করে রাখলো সে। একমনে অনেকক্ষণ ভেবে গেলো। কিছু বিষয়ে ছফা এখন অনেকটাই নিশ্চিত : মুশকান জুবেরি সুন্দরপুর থেকে পালিয়ে ঢাকায় চলে যায়, সেখান থেকে কলকাতায়। আর পুরো কাজে তাকে সাহায্য করেছেন ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদ। কলকাতায় আসার পর এখানেও শিকারের সন্ধান করেছে মহিলা। এটা না করে সে থাকতে পারেনি। নেশায় আসক্ত মানুষ নেশাদ্রব্য খুঁজে বেড়ায় হন্যে হয়ে, মুশকানও কয়েক মাস পরই শিকারে নেমে পড়ে। আর তার প্রথম শিকার সম্ভবত প্লাস্টিক সার্জন ডিপি মল্লিকই। লোকটাকে দিয়ে নিজের চেহারা পাল্টে নিয়েছে মহিলা, তারপর ব্যাপারটা চিরকালের জন্য গোপন রাখতে হত্যা করেছে তাকে। এখানেই থেমে থাকেনি, এরপরও শিকার করেছে, আর ছফার কাছে এরকম আরেকজনের খোঁজও আছে।
দ্বিতীয়জন!
হঠাৎ করেই তার মনে পড়ে গেলো, দ্বিতীয় শিকার নিয়ে সে এখনও কোনো খোঁজাখুঁজি করেনি। সঙ্গে সঙ্গে চোখ মেলে ফোনটা নিয়ে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
মুশকানের সম্ভাব্য দ্বিতীয় শিকারের নাম সুকুমার রঞ্জন। আইডিয়াল অ্যানালিটিকস সলিউশন নামের একটি প্রতিষ্ঠানের এক্সিকিউটিভ। বয়স ২৮। অবিবাহিত। মুশকানের শিকারের জন্য একদম উপযুক্ত।
সুকুমার নিখোঁজ হয়েছে বছরখানেক আগে। তার নিখোঁজের সময়কাল হিসেব করে দেখলো ছফা-ডিপি মল্লিকের নিখোঁজ হবার প্রায় এক বছর পর। দুটো মানুষ নিখোঁজ হবার সময়ের মধ্যে যে ব্যবধান আছে সেটা একটু বেশি বলেই মনে হচ্ছে। তবে সে নিশ্চিত করে জানেও না, মুশকান জুবেরি আসলে কততদিন পর পর শিকার খোঁজে, কিংবা কতোদিন পর তার ঐ বিশেষ প্রত্যঙ্গটির দরকার পড়ে! তাছাড়া, এই সময়ের মধ্যে যদি শিকার করেও থাকে ছফার পক্ষে সবগুলো জানা সম্ভবও নয়।
যাই হোক, সুকুমার রঞ্জন সম্পর্কে আর কোনো তথ্য নেই সুশোভনের দেয়া তালিকায়।
ছফা অবশ্য একটা বিষয় বুঝতে পারছে, সুকুমার নামটা এমনই কমন যে, ফেসবুকে সার্চ করতে গেলে হাজারটা রেজাল্ট চলে আসবে। তারচেয়ে বরং আইডিয়াল অ্যানালিটিকস সলিউশন নামের প্রতিষ্ঠান সার্চ করাটা বেশি বুদ্ধিমানের হবে।
কলকাতার বাড়ন্ত রাতে নুরে ছফা ব্যস্ত হয়ে পড়লো মোবাইলফোন নিয়ে। মুশকান জুবেরিকে ধরার যে মিশনে নেমেছে তাতে বিরতি দেবার কোনো ইচ্ছে নেই তার।
ফেসবুকে সার্চ দিতেই আইডিয়াল অ্যানালিটিকস সলিউশন, সংক্ষেপে আইএএস-এর পেইজটা পেয়ে গেলো। প্রতিষ্ঠানটি একেবারেই নতুন একটি ক্ষেত্র নিয়ে কাজ করে : ডেটা অ্যানালিসিস।
বর্তমান দুনিয়ায় যেকোনো ব্যবসার ক্ষেত্রে যে ক্রমশই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে এই ডেটা অ্যানালিটিক্স সেটা পেইজের শুরুতে ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে। ব্যবসার অগ্রগতি, দুর্বলতা, উন্নতির সুযোগ বুঝতে তথ্য বিশ্লেষণ করা জরুরী। সারা বিশ্বজুড়ে ডেটা অ্যানালিটিক্যাল টুলের চাহিদা বাড়ছে দিনকে দিন। বিভিন্ন ধরণের কোম্পানির নির্দিষ্ট চাহিদা অনুযায়ি তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন প্রডাক্ট, আর তাকে ঘিরেই শুরু হচ্ছে নানান স্টার্টআপ।
এসব পড়ে হাপিয়ে উঠলো নুরে ছফা। আইটিবিষয়ক টপিকে তার কোনো আগ্রহ নেই। আগ্রহ নেই প্রতিষ্ঠানটি কবে থেকে কাজ শুরু করেছে কলকাতায়।
ছফা এর কর্মীবাহিনীর দিকে নজর দিলো। প্রচুর ছবি আছে প্রতিষ্ঠানের এক্সিকিউটিভ আর হর্তাকর্তাদের। অসংখ্য গ্রুপ ছবিতে দেখা যাচ্ছে হাস্যোজ্জ্বল সব তরুণ তুর্কিদের-যারা কিনা নেতৃত্ব দিচ্ছে নতুন ধরণের এই ব্যবসাটি। ছবিগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে গেলো সে।