৫০. বিভাস রাগিণী

৫০. বিভাস রাগিণী

দখিনের হাওয়া কৃষ্ণর কানের কাছে এসে বলে গেল, ‘ওগো চিরসখা, এখন প্রেম নেই, বিরহও-বা কোথায়!’

কৃষ্ণ তো চিরকালই ছিলেন রাধাগত প্রাণ। তাকে তিনি কখনো অনাদর করতে পারেনই না। অমন যে বাগদেবী তাঁকেও তিনি রাধার প্রেমে অস্বীকার করেছিলেন। সে তো খুব সহজ কর্ম ছিল না। এই অরণ্যে বয়ে যাওয়া সুবাতাস সে কথা কি কখনো জানতে পারবে? জ্ঞানের দেবী তখন উন্মাদিনী। স্বয়ং ব্যাসদেবও তাঁকে রোধ করতে পারছেন না। ‘ইয়েব কৃষ্ণং কামেন কামুকী কামরূপিণী। এদিকে সারারাত কামক্রীড়া করার পর পরিশ্রান্ত শ্রীরাধিকা কৃষ্ণের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। অদূরে দ্বারে অপেক্ষা করছেন সরস্বতী। তিনি এতকিছু স্বচক্ষে দেখার পরও কৃষ্ণকে চাইছেন। বিদায় দিতে হবে রাধাকে। কৃষ্ণ বাঁশিতে সুর তুললেন বিভাস রাগিণীর। নবসংগমে যেন তিনি ভীত। আর তাঁর রমণক্ষমতা নেই। রাধার ঘুম ভেঙে গেল। চতুর কৃষ্ণ পালাতে চাইছেন। বিভাস রাগিণীর সুর বিস্তারে বাইরে অরুণোদয় হয়েছে। কৃষ্ণকে আর। রাখা যাবে না। রাধা বিলাপ শুরু করলে প্রীত হলেন কামুকী সরস্বতী। কৃষ্ণ আসলে সাময়িক বিরতি নিলেন রাধার কাছ থেকে। পরে জ্ঞানের দেবীকে ব্যাসদেবের উপস্থিতিতে বহু আলোচনার পর সম্মত করালেন, তিনি যেন বিষ্ণুকে পতিরূপে গ্রহণ করেন। ‘পতিং তমীশ্বরং কৃত্বা মোদস্ব সুচিরং সুখম্।

ঋতু ছিল শীত। তবে তখনই বসন্তের আহ্বান প্রকৃতির বহিরঙ্গে প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। মাঘ মাস। শুক্লা পঞ্চমী তিথি। কৃষ্ণ প্রঘোষণ রাখলেন, ‘মাঘস্য শুক্ল পঞ্চম্যাং/বিদ্যারম্ভেষু সুন্দরী।‘ এইভাবে দেবী সরস্বতাঁকে রাধার কারণে প্রত্যাখ্যান করে কৃষ্ণ মহাভারতের কালে সূচনা। করলেন বাগদেবীর আরাধনার। সেই পুজোর পৌরহিত্য করেছিলেন। ব্যাসদেব।

ভুলে যাওয়া সেই বিভাস রাগিণী হাওয়ার চটুলতার কারণে কিঞ্চিৎ উত্তর দেওয়ার অভিলাষে কৃষ্ণ বাঁশরিতে ধরতে চাইলেন। কিন্তু সেই রস প্রকাশের চেষ্টা ব্যর্থ হল। তিনি পারছেন না। বসন্তের অপরাহ্নে ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টি নামল। মনে হচ্ছে এ যেন কোনো আষাঢ়ন্ত বেলা। তরুশীর্ষে বসে থাকা পাখির দল স্বল্পকালীন বৃষ্টি শেষ হলে তাদের ডানা ঝাঁপটে যে জল গড়িয়ে দিল নীচে কৃষ্ণের বাঁশিতে তার কয়েক ফোঁটা এসে পড়ল। তপ্ত রোদে পোড়া ভূমি বৃষ্টির সিঞ্চনে জেগে উঠেছে ক্ষণকাল আগে। কৃষ্ণ, তিনি তো কালের অধীশ্বর, তাঁর আকুতিতে ঝংকৃত আবেগে কি জাগবে না বাঁশরি! একটু পরেই সন্ধ্যার বাতাসে ফুলের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। পূর্ণিমার চাঁদ উঠল গোল হয়ে। কৃষ্ণ নীচু স্বরে ডাকলেন, ‘সময়, তুমি কার?’ সময় উত্তর দিল, ‘কেশব আমি তোমার। কৃষ্ণ বাঁশরিতে স্পন্দন ছড়িয়ে দিলেন। এইতো তিনি পারছেন। গাছের পাতা কাঁপিয়ে, ফুলের গন্ধ যেন ছড়িয়ে পড়ল চটুল উদ্যানে। আবার নামল অঝোর বৃষ্টি। টুপটাপ তারা ঝরে পড়তে থাকল দীর্ঘ দীর্ঘ বৃক্ষগুলির শীর্ষে। এক অস্পর্শিত রূপ আর অবর্ণনীয় আলোর মালায় পূর্ণ হয়ে উঠল অরণ্য। কৃষ্ণের বাঁশরিতে প্রত্যাগমন করে সুর। তিনি ফিরে পেয়েছেন বিভাস রাগিণী। সময় আবার তাঁর আজ্ঞাবহ। বাতাস স্তব্ধ হয়ে প্রত্যক্ষ করতে চাইছে রাধাকৃষ্ণের যুগলমিলনের অপার আনন্দের মহিমা। দেবী বাগেশ্বরীও এসেছেন। আর তাঁর অসূয়া নেই। রুপোলি রেখার মতো তাঁর অশ্রু নতুন বৃত্তান্ত হয়ে ভালোবাসার ভূমিতে গড়িয়ে পড়ল। সুরের কম্পনে কম্পনে পূব আকাশে রক্তিম রেখা। অকাল সূর্যোদয়। যতই দূরে থাকুক শ্রীরাধিকা, কৃষ্ণের সেই ভালোবাসার স্পন্দন এক অপার্থিব বিভা নিয়ে তাকেও স্পর্শ করে গেল।

.

৫১. শ্রীরাধিকার বঙ্গদেশ ও কৃষ্ণকথা

আকাশময় কৃষ্ণমেঘ। বৈশাখের দাবদাহ ছিল দিনের তপ্ততায়। বৃক্ষশাখার ফাঁকে ফাঁকে একটু আগেও রোদ্দুরের প্রকাশ ছিল। কিন্তু অপরাহ্ন বেলায় হাওয়ার গতি প্রকৃতি গেল বদলে। মেঘের বর্ণের হল পরিবর্তন। হাওয়ায় বৃষ্টিগন্ধ লাগতে না-লাগতেই সে হয়ে উঠল দামাল দস্যি। তছনছ করার কারণেই উপস্থিত হল রাধার বাতায়নে। মরকতকুঞ্জেও লহমায় প্রলয় এনে দিল। একেই বলে বঙ্গদেশের কালবৈশাখী। বঙ্গদেশের মেয়ে শ্রীরাধিকা। নদীমাতৃক, সুজলা-সুফলা সেই দেশ। কোথাও অনুর্বরতা নেই। ফসলশূন্য প্রান্তর নেই। আর্যাবর্তের ভূমি অনুর্বর, পাথুরে। কালবৈশাখীর আগমন এখানে কখনো হয় না। গাছপালাগুলি কাঁপিয়ে অবশেষে বৃষ্টি নামত। কত সুখদায়ক সেই বৃষ্টি। কেশবের মতোই তার আগমন ছিল। রাধাকে আকর্ষিত করে, অবশেষে ছোটো ছোটো সুখ এবং ছোটো ছোটো দুঃখের মালা রচনা করে সে চলে যেত আনন্দটুকু নিংড়ে নিয়ে রাধার জন্য বেদনার মুহূর্তগুলি ফেলে রেখে। কৃষ্ণ ছিলেন শাকান্নভোজী। রাধা তাঁকে বঙ্গদেশের মৎস্য রন্ধন করে খাইয়েছেন। বঙ্গদেশের অন্নের সুমিষ্ট স্বাদের রসগ্রাহী করে তুলেছেন। রাধার কারণে কৃষ্ণ কিঞ্চিৎ পানাসক্তও হয়েছিলেন।

রাধা কৃষ্ণের সেই জলদর্পণে ক্লিষ্ট মুখের প্রতিবিম্ব দর্শনের পর তাঁর সন্নিকট অভিমুখে যাত্রার বদলে দীর্ঘ বৎসর পর বঙ্গদেশে এসে উপনীত হয়েছে। এখানে তিনি নেই তাই বঙ্গদেশও নির্বান্ধব পুরী। তবুও তাঁর বাঁশরির সুর রয়েছে। সেই সুর বিষণ্ণতার বাতাসের স্তর ভেদ করে রাধাকে ছুঁয়েছে। তাই আরও দূরে চলে যাওয়া। তিনি যেন কখনো প্রৌঢ়া রাধাকে দেখতে না পান। বাঁশির সুর জীবনের সব হতাশা তুচ্ছ করে অপ্রত্যক্ষ কিন্তু সদা দৃশ্যমান তাঁকে সম্মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে। চোখের জলকে একসময় শ্রাবণের জলধারা ভেবেই বিভ্রম হল। অরণ্যের সেই ক্লিষ্ট মুখ সরে গিয়ে মনে হচ্ছে তিনি যেন গভীর প্রশান্তিতে শুয়ে রয়েছেন। এত প্রশান্তি তিনি আবার অর্জন করেছেন। কিন্তু রাধা তো শান্ত হতে পারছে না। বঙ্গদেশে নিজের জন্মভিটের বসতবাড়িতে রাধা এসে উঠেছে। দ্বিতল কক্ষের বাতায়নে দাঁড়িয়ে সে শুধু ভাবছে সামনের এই রাঙাপথেও যেন তাঁর পায়ের চিহ্ন। তিনি যেন তাঁর নিত্য আসা-যাওয়ার মধ্য দিয়ে রাধাকে কাঁদিয়ে গেছেন। বার বার শুধু মনে হয়, যে আমারে কাঁদায় সে কি এমনি রবে। ঘর যে ছাড়ায়, হাত যে বাড়ায়, সে-ই তো ফিরিয়ে নেবে।

এ কোন চোখের জলের গভীরে রাধার আবাসস্থল। এ যে আবার নতুন করে পথ চলা শুরু হল। তাঁর বাঁশির সুর হৃদয়ে ধারণ করে রাধার দিন অতিবাহিত হয়। বর্তমান জীবন যেন লুপ্ত হয় কালো কানাইয়ের বাঁশির সুরে। বঙ্গভূমিতে দাঁড়িয়ে প্রভাত-সন্ধ্যা, আবার বেঁচে ওঠা, নতুন করে কেশবের প্রেম নিবেদনের সঙ্গে যুক্ত হওয়া– সবই তো বাঁশির। সুরে। চোখের আলোয় তিনি যখন নেই, রাধার যাবতীয় আনন্দধারা সেই অদর্শিত পুরুষের জন্যই যেন উৎসর্গীকৃত হয়ে রয়েছে।

–কেশব, তুমি তো আজ বস্ত্রত্যাগ করছ না। অথচ আমি তো সম্পূর্ণ অনাবৃতা। এ তো তোমার অসম খেলা।

কেশব হঠাৎ বললেন, ‘রাধিকে, বঙ্গদেশটা কি অন্য দেশ? আর্যাবর্তের সঙ্গে এর কোনো মিল নেই!’

বাইরের চাঁদের আলো তখন রাধার নগ্ন দেহে এসে পড়তেই হীরকদ্যুতির মতো জ্বলছে।

লুপ্ত বস্ত্র অন্বেষণ করতে করতে রাধা বলল, ‘কেন প্রভু এত অনাত্মীয়তা?’

কৃষ্ণ স্মিত হেসে বললেন, ‘প্রকৃতি এখানে তোমার মতোই। আর্যাবর্ত যদি আহির ভৈরবীর হয় তবে এখানে মল্লার। পুরুষ নারীর কাছে বঙ্গভূমিতে সদা বশীভূত থাকবে।

–তাই কি তুমি সঙ্গম থেকে বিরত থাকবে?

–না, রমণ হবে। তবে সায়াহ্নের পর।

সবস্ত্র কৃষ্ণ রাধাকে নিরাভরণ রেখেই বাঁশিতে তুললেন মল্লার। নেশা ধরানো সেই বাঁশির সুরের মাদকতায় অসীম আকাশ, বিস্তীর্ণ প্রান্তর এবং বিশ্বসংসারের যত ধ্রুবপদ এতদিন বিচ্ছিন্ন ছিল, রমণে রমণে কত-না দাক্ষিণ্যে তারা সঙ্গমযুক্ত হয়ে আলোকধারায় প্রবাহিত হতে শুরু করল। চন্দ্রিমা প্রত্যাবর্তন করলেন রোহিণীর কাছে। ফলে পেলেন ক্ষয়রোগ। আর বিশ্বসংসারের সমস্ত ধ্রুবপদে প্রেমের যে ফুরণ উপভোগ করেছিল, তারই প্রতিদানে ভারতবর্ষের প্রান্তরে ঘটেছিল মহাযুদ্ধ কুরুক্ষেত্র। নারীরা হারিয়েছিলেন রমণক্ষম পুরুষদের আর রাধা তাঁর কৃষ্ণকে। হারিয়ে গিয়ে প্রত্যাবর্তন করবেন না বলেই তিনি বস্ত্রত্যাগ করেননি। শুধু সুরের মায়াজালে রাধাকে গভীর সুষুপ্তিতে রেখে তিনি ফিরে গেছিলেন প্রভাসতীর্থে পান্ডবদের কাছে। পত্নী সত্যভামার সঙ্গে লীন হয়েছিলেন সামাজিক শৃঙ্খলার নিয়ম মেনে। আর অনাবৃতা রাধাকে প্রত্যূষের সূর্য প্রকাশিত করতেই মিথ্যে রমণের দায়ে অভিযুক্ত করেছিল বঙ্গদেশ। সেই দেশের প্রকৃতি তা-ই। বিতাড়িত হয়েছিল রাধা। তবুও রাধার প্রত্যাবর্তন হল না কোনো প্রতিহিংসার মার্গে। কত-না ছলা কৃষ্ণ জানেন। প্রতারক প্রেমিক, তবুও রাধার অন্তরে বিশ্বাসহন্তার জন্য ক্ষমা আর প্রেম ব্যতীত অন্য কিছু নেই।

এখন রাধা সত্যিই বুঝতে পারছে তার বয়স হয়েছে। বৃন্দাবন আর বঙ্গদেশ কোথায় যেন একাকার হয়ে যাচ্ছে। নিশীথরাতে বঙ্গদেশে বাদলধারা নামল। অচেনা সে বাদলধারাকে বড় ভয় করল রাধার। কেশবের জন্যই তো এই আঁখি জেগে থাকা। কিন্তু ভোর রজনিতে যদি ক্লান্তি আসে? তিনি যদি বৃষ্টির পর কোনো হিমের রাতে রাধার দরজা থেকে ফিরে যান। নিখিল ভাবধারা তাঁকে যদি রাধা কখনো শূন্যহাতে ফিরিয়ে দেয়। সে তো তবে মৃত্যুর অধিক যন্ত্রণা হবে। আকাশপার। দিয়ে তিনি যদি কখনো চিরকালের জন্য নির্গত হন ধূসর জীবনের এই গোধূলিতে রজনির শেষ তারার মতো, রাধার যে আর কোনো গন্তব্য থাকবে না। রাধার মতো সহায়হীনার সঙ্গে তাঁর এ কোন খেলা! হাসির বাঁধ ভেঙে, দুঃখের উজান ঠেলে পরম শেষের অন্বেষণে শ্রীরাধিকার বড় ভয় করে। কুঞ্জবনে সে হবে কোনো নিঠুর খেলা। বসন্তের সুর পাঠিয়ে সে কি তবে বার্তা দিল! চিরতরে লুক্কায়িত হওয়ার! পৃথিবীর কোনো ঘটনাই দীর্ঘতম হতে পারে না। পলিমাটির আস্তরণ ফেলে দেয় সময়। রাধাকেও সবসময় কৃষ্ণপ্রেমের জাবর কেটে গেলে চলবে না। কৃষ্ণ বিদায় নিলে ভাবাই যাবে– সে কালা আমার কেই-বা ছিল! বয়ঃসন্ধি পেরোনো বয়সে জীবনের প্রথম পুরুষটি ছিল আয়ান ঘোষ। আয়ান প্রেমকে রচনা করতে জানত না। শরীরের ওপর লোভ ছিল খুব কিন্তু ভোগ করার ক্ষমতা ছিল না। কর্মঠ পুরুষ, ঘর্মগন্ধ তীব্র ছিল। বক্ষ ছিল লোমশ। অপ্রশস্ত নয়। মধ্যদেশ তখনও স্ফীতিলাভ করেনি। মুখমন্ডলে কোমলতা ছিল। অদ্ভুত বৈপরীত্য ছিল যৌনাঙ্গটির। সবসময় কোমল এবং ক্ষুদ্র। রাধা সেদিনের ভরা যৌবন নিয়েও তাকে জাগ্রত করতে পারেনি। সুপ্তই থেকে গেছে। যোনিদ্বারে প্রবেশ করার মতো সামান্য কাঠিন্যও তাতে আসত না। ফলে আয়ানের আদর রাধার কাছে পীড়নই মনে হত। নৈতিক, দৈহিক কোনোরকম সবলতা না থাকায় রাইকিশোরী রাধার দিনরাত্রি অসহনীয় হয়ে উঠেছিল এই মানুষটির সঙ্গ।

প্রথম যেদিন কালার বাঁশি রাধার মরমে প্রবেশ করল সে ছিল রাগ মধুন্তিকা। রাধা তখন মৃত্যুচিন্তায় বিভোর হয়ে থাকত। সেই মৃত্যু ধূসরিত পথে যুবতী রাধাকে জাগাল বসন্তের সেই রাগ। সে কী অজানা শিহরণ!

বংশীবাদকের প্রথম সংলাপ ছিল, ‘মরার কথা ভাব বুঝি?’ মাথা নেড়ে রাধা মিথ্যে কথা বলেছিল, ‘কই না তো!’

–আয়ানমামার সঙ্গে বিবাদ করে এসেছ নাকি?

সংবিত ফিরল রাধার। বাঁশির ডাকে নিশিরাতে ঘর ছেড়েছে রাধা। চলে এসেছে যমুনার তীরে, তমালের তলদেশে।

হাহাকার ভরা বাতাস বয়ে গেল। হৃদয়ের অভ্যন্তর থেকে উত্থিত হচ্ছে কান্না। ভীষণ ভয় করছে। বাঁশির ডাকে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়। রাধা সব ভুলে বলে ফেলল, ‘আমার স্বামী আয়ান খুব নারায়ণের ভক্ত। ভোররাতে ভগবানের পদযুগল ধৌত করতে হবে। সময়জ্ঞানের অভাবে আমি রাত্রির দ্বিপ্রহরে যমুনার জল আনতে চলে এসেছি।’

–আমার মধুন্তিকার ডাকে তবে নয়?

–তুমি ভগবান মান না?

কৃষ্ণ বললেন, ‘আমিই তো তোমার আরাধ্য দেবতা। নারায়ণ এবং আমাতে অন্তর কোথায়?’

–আমাকে ফিরে যেতে দাও।

–আর তুমি ফিরবে কোথায়? সে-পথ তো বন্ধ।

–তবে কি আমি এরকমই তোমার বাঁশির ডাকে অন্ধকার আঘাটায় ঘুরে বেড়াব? আমি কি উন্মাদিনী হয়ে যাব একদিন?

কৃষ্ণ বললেন, ‘তুমি আমার দেবী। এসো তোমার রাঙা চরণ দুটি জল দিয়ে ধৌত করে দিই।‘

রাধা চমকে গিয়ে পিছিয়ে গেল।

–ছি ছি! তুমি সত্যিই ঈশ্বর মান না।

আবছায়া অন্ধকারে কৃষ্ণ হাসলেন। রাধা দেখল তাঁর মোহনরূপ। আরাধ্য দেবতা না-হলেও এ-রূপ তার যেন জন্মজন্মান্তরের চেনা। ইহকাল, পরকালের সীমারেখা ওতে যেন লুপ্ত হয়ে গেছে।

কৃষ্ণ সত্যিই রাধার পা-দুটি যমুনার জলে ধৌত করে দিলেন। আর তাতেই যুবতী রাধার অতৃপ্ত ক্ষুধা সর্বশরীরে জেগে উঠল।

কান্ডজ্ঞানহীন কৃষ্ণ রাধার মনোগত ইচ্ছে বুঝতে পেরেই কাল ব্যয় না করে চুম্বন করলেন আর তাতেই ভেঙে গেল রাধার বিষাদ, দীর্ঘদিনের অন্ধকার। ভালোবাসার আলোর অভীপ্সায় সেই যাত্রা। দেবোত্তম যাত্রাপথ তো বটেই। সময়ের কানে কানে রাধা বলল, ‘আমাদের প্রেম হারিয়ে যাবে না তো?’ উত্তর এল না, শুধু সময়ের শ্বাস-প্রশ্বাসে পবিত্রতা, যাবতীয় শুদ্ধতা ছড়িয়ে পড়ল।

ক্ষণকালের বিরতির পর কৃষ্ণ বললেন, এই যে দেখছ দিন-রাত্রি, জীবজগৎ অন্ধকার থেকে আলোয় চলেছে আবার কখনো বিপরীতমুখী গতি– সবটা আমিই করাই। চন্দ্রালোক, অমানিশা আমার বাঁশির। সপ্তসুরের এক একটা প্রকাশ।

সেই তো প্রথম দেখা তবুও তার চেয়ে বয়সে অনুজ যুবকটির গলায় যে-প্রত্যয় ছিল রাধার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছিল।

–বৃষ্টি, দাবদাহ, এসবও কি তোমার বাঁশির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া?

–প্রমাণ চাও?

–না।

–তবে বিশ্বাস করেছ?

–কিন্তু তুমি তো ঈশ্বর নও।

–কেন?

–তোমার তো ভয়ংকর কামরিপু রয়েছে।

–ঈশ্বর তো নিয়ত পৃথিবীর সঙ্গে রমণ করছেন, তাই তো কক্ষপথে এত শৃঙ্খলা।

–পৃথিবী তবে নারী?

–হ্যাঁ নারী। তোমারই মতন একজন নারী।

–ঈশ্বরের কাছেও নারী শুধু রমণের কারণেই ভোগ্য!

–আমি একটু আগে তোমাকে চুম্বন করলাম, তার অর্থ কি আমি তোমাকে একা ভোগ করেছি! এই যমুনাতটে রাত্রিগভীরে তোমার আসাটা আসলে তো অন্ধকার থেকে আলোর অভিমুখে যাত্রা। এই উপভোগের কারণে তুমি আমার কাছে ধরা দিলে। পৃথিবীও দীর্ঘদিন তাপিত ছিল, বক্ষে ছিল তোমারই মতো ভয়ংকর অস্থিরতা। তারপর যেদিন প্রথম রমণ হল, সৃষ্টি হল জীবজগতের।

–প্রেম তবে কী?

–জীবজগতের একমাত্র চেতনা। সেই চেতনা পুরুষ-নারী উভয়েরই প্রয়োজন। আয়ানের সঙ্গে তুমি যখন সম্ভোগ লিপ্ত হতে সেই প্রেম অনুপস্থিত থাকত। ফলে তোমাদের রমণ সম্ভব হত না।

–আমার এ নতুন পরিচয় যে গর্হিত!

–গর্হিত নয়, গোপন। অভিসারই তো তোমায় মুক্তি দেবে, রাধা। পৃথিবীরও তো একই অভিসার হয়, তখন চন্দ্রালোক থাকে না। নিশায় আবৃত থাকে পৃথিবী।

–তুমি যে বললে ঈশ্বরের সঙ্গে পৃথিবীর প্রতি মুহূর্তে রমণ হচ্ছে!

–রমণ তো সবসময় দেহগত নয়। মনের রমণ, আরও প্রসারিত, আরও দীর্ঘস্থায়ী।

.

রাধা সেদিন উপলব্ধি করতে পারেনি কারণ সেদিন ছিল প্রেমের উষাকাল মাত্র। তারপর তো কত দীর্ঘ অভিসার। এখনও তো সেই অভিসারের ক্ষয় হল না। তাঁর মৃত্যুতেও কি অপেক্ষার শেষ হবে রাধার! নাকি আরও দীর্ঘতর, প্রসারিত হবে জীবনের অন্তিম উপলখণ্ডগুলি। আর্যাবর্ত থেকে বহু দূরে এই বঙ্গদেশে এসেও পৃথিবীর অভিসার-যন্ত্রণা টের পেল রাধা।

.

৫২. কীকট অর্থাৎ বঙ্গদেশ, অর্কজ্যোতি ও নাস্তিক্যবাদ

বিশাখজ্যোতি যা-ই মনে করুক-না রূপজ্যোতিকে অর্কজ্যোতি পুত্রবৎ স্নেহ করেন বা পুত্রের অধিক কিছু। রূপজ্যোতি বঙ্গদেশে তাঁকে চাইছেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে যজ্ঞ, দেব-দেবী, আত্মা, পরালোক, স্বর্গ-নরক, জন্মান্তর ইত্যাদিতে বিশ্বাস প্রবল। কৃষ্ণও ঘরে ঘরে ভগবৎ জ্ঞানে পূজিত হচ্ছেন। অবশ্য পাশাপাশি তরুণদের মধ্যে যুক্তিচর্চার প্রাবল্য আনতে পেরেছে বলে রূপজ্যোতি বিশ্বাস করে। প্রকাশ্যে কৃষ্ণের বিরুদ্ধে সংশয় ঘোষিত না-হলেও অবিশ্বাস বিস্তারলাভ করেছে। সমাজপতিদের সযত্ননির্মিত সংহতি আংশিক হলেও এতে বিপন্ন হয়েছে। আধ্যাত্মিক স্তরে একটা প্রতিস্পর্ধা এবং তার ফল স্বরূপ জাগতিক স্তরে অসহযোগ যে জনসাধারণের সামগ্রিক আনুগয়ের অভাবকে ডেকে আনতে পারে– বঙ্গদেশের শাসনকর্তারা এরকম একটা প্রমাদ অনুভব করেছেন। রূপজ্যোতির কয়েক দিনের কারাবাসও হয়ে গেছে। যদিও এতে তার সাহস বর্ধিত হয়েছে। তবে নব্য অনুগামীদের নাস্তিকতা সম্পর্কে লক্ষণীয় তর্কের উত্তরণের কারণে রূপজ্যোতি গুরুদেবের আগমন প্রার্থনা করেছে।

বঙ্গদেশে গুরুদেব গেলেন। তখন বর্ষাকাল, আকাশে সজল মেঘের আনাগোনা। কর্দমাক্ত পথ, কারণ বারিবর্ষণ ও রোদ্দুর বিচিত্র লুকোচুরি খেলায় অংশ নিলেও গাঙ্গেয়তটের ভূমিতে কর্দমের প্রাবল্য থাকায় সেই পথে স্বল্প বৃষ্টিতে পিচ্ছিলতা তৈরি হয়। বঙ্গদেশ সর্পসংকুলও বটে। তবে শস্যশ্যামল প্রান্তর দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। আরও চোখ জুড়িয়ে গেল। উপবিষ্ট যুবকবৃন্দদের দেখে। অর্কজ্যোতি উপবেশন করতেই এরা কেউ দন্ডায়মান হল না অর্থাৎ অর্কজ্যোতি সম্পর্কে এদের সম্ভ্রম এখনও অপুষ্ট। তিনি সংশয়ীদের এই আচরণ মনে মনে সম্মান করলেন। সমাজের আপ্ত নীতির বিরুদ্ধে এরা লড়াই করতে সমর্থ।

তিনি কিছু বলার আগেই এক যুবক তাঁর দিকে তাকিয়ে বল, ‘আপনি কি নাস্তিক?

অর্কজ্যোতি মৃদু হেসে বললেন, ‘স্বর্গ নেই, মোক্ষ নেই এবং পরলোকে। কোনো আস্থা নেই।’

–তবে তো আপনি নাস্তিক।

–প্রাণীরা এই পৃথিবী থেকে ঊর্ধ্বে কোথায় যায় তা জান?

–না।

–কেমন করে তারাই আবার পুনর্জন্মের মাধ্যমে প্রত্যাবর্তন করে– জান?

এবার সমবেত উত্তর এল, না।

–দেবযান, পিতৃযান পথ দুটি কোথায় বিচ্ছিন্ন হয়েছে জান?

–না।

–চন্দ্রালোক কেন ভোরে ওঠে না, জান?

–না।

–কেন পুরুষ বলে অভিহিত হয় বিশেষ করে পঞ্চম আহুতিটি দেওয়ার পর–জান?

–না।

–অতএব তোমাদের শিক্ষা অসম্পূর্ণ।

আবার সমবেত স্বরে প্রশ্ন এল, ‘আপনি এসব জানেন?’

–আমিও জানি না। কিন্তু একইসঙ্গে শাস্ত্রের উত্তরগুলি মান্য করি না। ওর মধ্যে কোনো প্রত্যক্ষ সত্য নেই। তবে তোমাদের এই সম্পর্কে উদবেগকে সম্মান করি। উদবেগই রূপ পায় প্রশ্নে। প্রশ্নাতুর বেঁচে থাকাই নাস্তিকের নিয়তি। সেখানেই রয়েছে স্বাধীনতার স্পৰ্থ। তোমরা যুবক, তোমাদের আমি এই স্বাধীনতার স্পর্ধায় দীক্ষিত করতে চাই। অর্কজ্যোতি আবার বললেন, ‘আত্মা বলে তোমরা কার উপাসনা কর?’।

বৈশ্বানর বলে এক যুবক এগিয়ে এসে বলল, ‘দ্যুলোক, আদিত্য, বায়ু, আকাশ, জল ও পৃথিবী।’

–অর্থাৎ আত্মা খন্ডিত কিছু নয়। সর্বলোক সর্বভূতে বিরাজমান। তোমরা কি জান এই বিরাজ করার ক্ষমতা কার মধ্যে রয়েছে?

সংশয়ী যুবক বলল, ‘কৃষ্ণের মধ্যে!’

–এই ক্ষমতা রয়েছে আমাদের চেতনার মধ্যে। কৃষ্ণের চেতনা এবং তোমার চেতনায় অন্তর কোথায়?

–কৃষ্ণ তবে ভগবৎ জ্ঞানে পূজিত হন কেন?

–সমাজপতিদের স্বার্থে, শাস্ত্রকারদের স্বার্থে। তিনি একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের একক মাত্র এবং সেই প্রতিষ্ঠান হচ্ছে আস্তিক্যবাদ।

যুবকদের মধ্যে সামান্য প্রবীণ একজন বলল, আপনারা চার্বাকপন্থীরা বেদ, ঈশ্বর এবং পরলোককে অস্বীকার করেন।

–আমরা সত্য-মিথ্যা বিষয়ে বেদের সার্বভৌম অনুজ্ঞা, কৃষ্ণের লোকাতীত অনুশাসনকে অস্বীকার করেন।

–তবে আপনাদের কাছে গ্রাহ্য বস্তুটা কী?

–ব্যক্তিস্বাধীনতা।

–উপলব্ধি বা মননজাত তত্ত্বকে আপনারা তবে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন।

–কোথাও প্রত্যয়, কোথাও সংশয়, কোথাও নাস্তিক্য মানুষের জীবনপ্রবাহ কখনো একমুখী নয়। শাস্ত্র অত্যন্ত অসহিষ্ণু, আমার গুরুদেব বলেন। চার্বাকের প্রতি দ্বেষ থেকে তাঁকে অভিহিত করা। হয়েছে ‘রাক্ষস’ হিসেবে। তিনি দুর্যোধনের সুহৃদ বলে তথাকথিত ব্রাহ্মণেরা তাঁর গৃহ অগ্নির দ্বারা ভস্মীভূত করে পরে তাঁকেও হত্যা করে। লোকায়তিক চার্বাক যেসব সংশয়ের কথা বলেছিলেন সবই ছিল কৃষ্ণ এবং বেদবিরোধী, তাই তিনি সহজেই বধ্য ছিলেন। কিন্তু আমার প্রিয় যুবকবৃন্দ, সময়ের পরিবর্তন হয়েছে। কৃষ্ণকাল সমাপ্তির। পথে। তিনি নিজেও সংশয়ে দীর্ণ, অরণ্যে শায়িত হয়ে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছেন। তিনি যদি মৌন প্রেরণা হতে পারতেন তবে তাঁর যদুবংশে এত অনাচার প্রবেশ করেছিল কোন রন্ধ্রপথে! তিনি যা বলেছেন তা তিনি পালন করেননি। তাঁর জীবন যুবকদের প্রত্যক্ষ প্রেরণা হতে পারে না। তাঁর মৃত্যুও হবে অতি সাধারণ। সেই মৃত্যুর পর কিছুই নেই, ‘নাস্তি’। তিনি দেবযানে আরোহণ করে সৌরলোকে গমন করবেন– বেদব্যাস এবং যুধিষ্ঠির ব্যতীত আর কেউই প্রত্যক্ষ করবেন না, এটা মিথ্যাচার ভিন্ন অন্য কিছু নয়। মৌলিক সংশয় ও নাস্তিক্য সজীবতার লক্ষণ। ব্রাহ্মণের সেই সজীবতা নেই। ক্ষত্রিয়ের রয়েছে। তোমরা ক্ষত্রিয়, তোমাদের চাই ভূমা। প্রচলিত মত ও পথ আমাদের যেন তৃপ্ত করে। আমাদের জিজ্ঞাসা হোক যন্ত্রণাদীর্ন। আমাদের পথও হোক যন্ত্রণাদীর্ণ ও প্রশ্নাতুর। আর জয় হোক সেই কালের, যে-কাল কৃষ্ণ ও শাস্ত্রকারদের বিরুদ্ধে প্রতিস্পর্ধা দেখিয়ে নিয়ত সজীবতার পথে সঞ্চরণশীল। জয় হোক বঙ্গদেশেরও।

সকলেই উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানালেন অর্কজ্যোতিকে। তিনিও জানলেন এই বিশ্বাস এসেছে প্রশ্ন ও সন্দেহের জাগরণের মধ্য দিয়ে।

অর্কজ্যোতি দেখলেন যুবকদের মধ্যে লুক্কায়িত এক বৃদ্ধও রয়েছেন। তিনি ক্রমশ অর্কজ্যোতির দিকে এগিয়ে আসছেন। বৃদ্ধের চেহারা অপকৃষ্ট অর্থাৎ এক কথায় খারাপ। আর্যাবর্তের মানুষেরা এদের ঘৃণা করে কারণ তারা মনে করে কীকটের অর্থাৎ বঙ্গদেশের লোকেরা যজ্ঞ করে না। ওরা অধিকাংশ আচরণহীন। ওরা গাভীকে ভগবতী জ্ঞানে পুজো করে না। এই আর্যেতর মানুষেরা ঘৃণ্য। ওদের সম্পত্তিতে যাবতীয় অধিকার আর্যদের রয়েছে। এই কীকট দেশের নারীরাও বহুবল্লভা এবং স্বৈরিণী। অর্কজ্যোতি স্বয়ং চার্বাকের অনুগামী হওয়া সত্ত্বেও মানদণ্ডে তিনি ব্রাহ্মণ। ফলে আর্যদের স্বাভাবিক ভ্রূকুঞ্চন আর্যেতর মানুষদের দিকে দৃষ্টিপাতে– এই ঘোরতর প্রত্যক্ষ ব্যাপারে তিনি ব্যতিক্রম হলেও সম্পূর্ণ মুক্ত নন। তবে তিনি অভিনয় জানেন এবং জেনেন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে নাস্তিকদের চেয়েও তাঁর প্রয়োজন অজ্ঞেয়বাদীদের, যাদের মধ্যে সংশয় ও বিশ্বাস যুগপৎ ক্রিয়াশীল। কীকট অর্থাৎ বঙ্গদেশে এই শ্রেণির মানুষের সংখ্যাধিক্য রয়েছে। এ ছাড়াও বঙ্গদেশের জনগোষ্ঠীর মূল অংশে রয়েছে। প্রাগার্য, ম্লেচ্ছ, চন্ডাল, শূদ্র, দাস এবং নারীরা। এরা শিল্পোর নিয়ে থাকে, আর্য উপাসনা পদ্ধতিতে বিশ্বাসী নয়।

অর্কজ্যোতি বৃদ্ধকে বললেন, ‘ভদ্রে, আপনি কিছু বলবেন?’

‘সংশয়ের মধ্যেও আমাদের কিছু বিষয়ে প্রত্যয়ও রয়েছে।’ প্রশ্নকর্তার স্বরের দৃঢ়তায় একটু চমকিত হলেন অর্কজ্যোতি।

–প্রত্যয় কী বিষয়ে? বস্তুবাদে?

–প্রকৃতির সুনিয়ন্ত্রণ আচরণে। দিন-রাত্রি ও ঋতুর নিয়মিত আবর্তনে।

–প্রকৃতি তো প্রত্যক্ষ ব্যাপার।

–তবে বন্যা, ভূমিকম্প, খরা–আমাদের স্বার্থের প্রতিকূল বিষয়েও আমাদের কোনো সংশয় নেই।

–এর হেতু কী জানেন?

–প্রকৃতি নিয়ম মেনে চলে। বরুণদেব ঋতের অধিদেবতা। এ ছাড়াও ঋত এক স্বয়ংক্রিয় শক্তি।

–এটুকু মান্য করলেও আমাদের জীবনের অবগঠনের অনেকটাই আমাদের বোধের এবং নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

–জানা জগতের অংশবিশেষ সংশয়ের, বাকিটা তা নয় এবং সেটা বিশ্বাসের। ফলে আমাদের অবস্থান দ্বান্দ্বিক। সর্বমঙ্গলময় ঈশ্বর, বিধৃতাগোষ্টী বা বিশ্ববিধানের অনেকটাই আমাদের উপলব্ধির বাইরে, তাই বলে সেটাকে অসত্য বলে অস্বীকার করি কী করে!

–চার্বাকও অজ্ঞেয়বাদীদের শ্রদ্ধা করতেন। আমিও আপনার বিশ্বাস অবিশ্বাসের দ্বন্দ্বকে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু দেবতাদের উদ্দেশ্যে যজ্ঞ, স্তোত্র, হব্য এগুলি কি নিষ্ফল নয়?

–আমাদের কীকট দেশে যজ্ঞের চর্চা বিরল। তবুও আমরা কৃষ্ণের অবতারত্বে বিশ্বাস করি, তাঁর দিব্য পথনির্দেশকে প্রকৃত বলেই স্বীকার করি।

–কেন?

–তিনি দীর্ঘ ধর্মযুদ্ধের পর ভারতবর্ষকে প্রকৃত প্রজানুরঞ্জক শাসকের হাতে তুলে দিয়েছেন।

–যুদ্ধের নিবৃত্তির পর দুর্যোধনও প্রজাপ্রিয় হওয়ার চেষ্টা করতেন।

–হয়তো-বা। কিন্তু প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বলে জয়ী পান্ডবেরা, কারণ কৃষ্ণ তাঁদের সহায় ছিলেন।

–কখনো কখনো বর্ষাকালে দেখা দেয় খরা অথবা অতিবৃষ্টি। হঠাৎ ঘটে ভূমিকম্প, পশুপালে মড়ক লাগে; তৃণভূমি শুকিয়ে ওঠে। কেন? মানুষের অধর্মের কারণে দেবতার রোষেই তবে অমঙ্গল, পাপ, অনৃত আসে। এ সবই কৃষ্ণ বলেন। তবে যদুবংশের এই পরিণতি কেন? তিনি তো স্বয়ং যদুপতি।

বৃদ্ধ এবার নতজানু হয়ে বললেন, ‘কেন প্রভু?’

–অনেকসময় নিসর্গবস্তুকেও আমরা আতঙ্কিত হয়ে দেবায়িত করি। চন্দ্র, সূর্য, বায়ু-সবই আমাদের দেবতা। আসলে প্রকৃতিতেও দেখা দেয় বিশৃঙ্খলা। জীবন ও সমাজে এ কোনো অশুভ শক্তির প্রবেশ নয়। ধর্মকে আমরা প্রতিঘাতরূপে দেখতে অভ্যস্ত। সেই কারণেই কৃষ্ণের আবির্ভাব। সাধারণ বুদ্ধির উপরে তিনি ধর্মকে প্রতিঘাতরূপে স্থাপন করে আর্যাবর্তে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি ঈশ্বরকে নির্মাণ করেছেন নিজেরই প্রতিরূপ হিসেবে। আমার গুরুদেব চার্বাক বলেন সৃষ্টি মৌলিক, ভৌতিক উপাদান থেকেই উদ্ভূত হয়েছে। এটাই তাঁর ভূতার্থবাদী সৃষ্টিতত্ত্ব। ভস্মীভূত দেহের পুনরায় আগমন হয় না। সে মিশে যায় ধূলিকণার মধ্যেই।

–তবে কি পাপ-পুণ্য মিথ্যে?

–সময়ের সাপেক্ষেই পাপ-পুণ্য। সমাজ মূল্য নির্ধারণ করে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রকের ইচ্ছে অনুসারে। সেটাই ধর্ম, সেটাই পুণ্য। বাকিটা অধর্ম যা কিনা রাষ্ট্রের স্বার্থবিরোধী, বর্তমানে কৃষ্ণবিরোধী।

–এই রাষ্ট্রদ্রোহিতায় কত রক্তক্ষয় হবে?

–বঙ্গদেশে নাস্তিকতার জয় বিনা রক্তপাতেই ঘটবে। এই আর্যের ভূমিকে চার্বাকের আদর্শের পীঠস্থান বলে প্রণাম করি।

বৃদ্ধ প্রণাম করে নির্গত হলে রূপজ্যোতি কাছে এল। সে নিবেদন করল, ‘গুরুদেব, দীর্ঘ পথশ্রমের পর আপনি বঙ্গদেশে এসেছেন। এখন নিশ্চয়ই খুব ক্লান্ত। খাদ্যের ব্যবস্থা করেছি, আপনার শয়নের কারণে কক্ষের প্রস্তুতিও শেষ।

স্মিত হাসলেন অর্কজ্যোতি। সস্নেহে কাছে টেনে নিলেন রূপজ্যোতিকে। তারপর মৃদুস্বরে বললেন, ‘কোনো আমিষ খাদ্য আজ আমি গ্রহণ করব না। খুব সামান্য শাকান্নের ব্যবস্থা থাকলেই চলবে। আর নিদ্রার জন্য কক্ষের কোনো প্রয়োজন নেই। হস্তিনাপুর থেকে এই কীকট দেশে আসতে মাসাধিক সময় অতিবাহিত হয়েছে। দিবাভাগ সূর্যদেব ছিলেন নিষ্করুণ, রাত্রিও নানা কারণে কন্টকযুক্ত ছিল; ফলে সুখনিদ্রার অভ্যাসও বিগত হয়েছে। তৃণভূমিতে শয়নে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। যদুপতি কৃষ্ণও তো অরণ্যের তৃণভূমিতে শয়ন করছেন। আমিই-বা তবে এর অন্যথা করি কেন!’

কৌতুকমিশ্রিত স্বরে রূপজ্যোতি বলল, ‘আপনিও তবে সর্ব অর্থে কৃষ্ণভক্ত!’

বিষণ্ণ হলেন অর্কজ্যোতি।

–রূপজ্যোতি, এটুকু অস্বীকার করলে চলবে না তিনিই আমাদের কালের অধিশ্বর। তাঁর চেয়ে শ্রেষ্ঠ পুরুষ আমাদের সময়ে হয়তো আর আসবে না। আমরা তাঁর কর্ম ও আদর্শের বিরোধী কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে শ্রদ্ধা করি।

রূপজ্যোতি গুরুদেবের মনোভাব বুঝতে পেরে ক্ষমাপ্রার্থনা করল।

–এটিও একটি রণকৌশল। শত্রুর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া। আর এখন নিদ্রার সময় নয়। ব্রাহ্মণের দায়িত্বটুকু আমি পালন করব। এই কীকটদেশ এমনিতেই নাস্তিক্যবাদের প্রশস্তভূমি। তবে বর্তমান সময়ে এই বঙ্গভূমির শাসনকর্তা যুধিষ্ঠিরের আস্থাভাজন। তিনি কৃষ্ণ-অনুরাগীও বটে। অজ্ঞেয়বাদীদের তিনি অগ্রাহ্য করলেও নাস্তিক্যবাদের প্রচার এবং প্রসার ওঁকে শঙ্কিত করে তুলবে। ফলে যে-জনগণ মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে উঠেছে তাদের রক্ষার সমস্ত দায়িত্ব এখন আমাদের। এই বিষয়ে পুত্র রূপজ্যোতি…

বাক্য সমাপ্ত করার পূর্বেই রূপজ্যোতি দুটো হাত মুখের কাছে এনে এক গগনভেদী শব্দ হাওয়ায় ছড়িয়ে দিল। উন্মুক্ত প্রান্তরে সেই শব্দের প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে পড়তেই হস্তীর দল বিচিত্র অঙ্গভঙ্গিতে শুড় আন্দোলিত করে উপস্থিত হল। এই হস্তীবাহিনীতে যাঁরা আরূঢ় ছিলে তাঁরা বর্শা এবং তরবারি সহযোগে রণকৌশলের প্রদর্শন উপস্থাপিত করলেন। এরপর এল শ্বেত-অশ্ববাহিনী। এঁরা প্রত্যেকেই দক্ষ তিরন্দাজ। ধনুকের টঙ্কারে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে উঠল। সবশেষে এল পদাতিক বাহিনী, তাদের মধ্যে মল্লযোদ্ধারাও রয়েছে।

যুবকদের অস্ত্র প্রদর্শনে প্রীত হলেন অর্কজ্যোতি।

.

৫৩. ভ্রমি এক বিস্ময়ে

ব্রহ্মা বললেন, ‘ভগবন্‌, ক্ষমা করবেন। আপনি নিম্নে দৃষ্টি নিবদ্ধ করছেন বার বার। এতে স্বর্ণরথের সারথির ভয়ের উদ্রেক হচ্ছে।’

কৃষ্ণ বললেন, ‘কীসের ভয়?’

–যদি আপনি ওর কারণেই নিম্নে পতিত হন।

ক্ষতি কী, আবার মর্ত্যলোকে প্রত্যাবর্তন করব। পুনর্জন্ম আমার তো আগেও বার বার হয়েছে। মায়া, তৃষ্ণা, প্রেম এখনো সবই তো আমার মধ্যে রয়েছে।

–এই ব্রহ্মান্ডের মায়া তো আপনারই আংশিক প্রকাশ মাত্র, এতে তো আপনার বশীভূত হওয়ার কথা নয়।

–ব্রহ্মা, আমি মানব-ই থাকতে চাই।

–কেন প্রভু? মর্ত্যলোকে কেউ সুখে নেই। কাল হরণ করছে যাবতীয় প্রভা। বেদবিৎ, কৃষ্ণভক্ত ব্রাহ্মণকে কেউ শ্রদ্ধা করে না। গৃহে গৃহে যজ্ঞ হয় না আর। নাস্তিক্যবাদী, অজ্ঞেয়বাদীরা কৃষ্ণভক্ত বেদবিন্দুদের দেখলে উপহাস করে।

–কালের প্রতিশোধ, তবুও আমি প্রত্যাবর্তন করব।

–ভগবান এটা তো সম্ভব নয়। দেবরাজ ইন্দ্র আপনাকে অভিনন্দিত করার জন্য অপেক্ষা করছেন। সৌরলোক সংবর্ধিত হবে আপনার। পদরেণুতে। চন্দ্রদেশে আপনি স্বল্পকালের জন্য অবস্থান করবেন। এই সম্পূর্ণ সূচি দেবতাদের মধ্যে বিতরণ করে দেওয়া হয়েছে। কত বছর আপনি লক্ষ্মীদেবীর মতো সম্পদশালিনী ও সুন্দরী ভার‍্যা থেকে পৃথক হয়ে রয়েছেন। জগতের পালক আপনি, মহাদেবের সংগীতের উৎসমুখ। স্বর্গের নন্দনকাননে অপ্সরাগণ আপনাকে নৃত্য-গীতে তৃপ্ত করার জন্য উন্মুখ হয়ে রয়েছেন। তাঁদের প্রতি আপনার অপার স্নেহদৃষ্টি মর্ত্যে সামান্য অবস্থানে পরিবর্তিত হওয়া কি সম্ভব?

–আমি মানব ভ্রমি একা বিস্ময়ে। দেবাদিদেব ব্রহ্মা, অন্তত এক বার প্রত্যাবর্তন করতে দিন।

–কেন?

–আমি এক বার শুধু রাধাকে দেখব। আর আমার মোহনবাঁশিটা ফেলে এসেছি, সেটাও নিয়ে আসব।

–ভগবন, পৃথিবীর প্রেমে তো বিরহের যন্ত্রণা, সংগীতও অসমাপ্ত। স্বর্গের রম্ভা, উর্বশী তাদের প্রেমে বিচ্ছেদ নেই, সেখানে চিরবসন্ত বিরাজ করছে। আমার ক্ষমা করবেন, এ সব আপনি বিস্মৃত হয়েছেন।

–মানুষের দুঃখ, অবসাদ আমি আরও এক বার উপভোগ করতে চাই।

–এ সব তো উপভোগের সামগ্রী নয়, ওরা যাতে দেবতাদের স্মরণ করে, ভুলে না যায়, তাই তো স্বর্গের বৈশেষিকদের দিয়ে ধূলিকণার মধ্যে ওসব বিবাদ, অবসাদ মিশিয়ে দিয়ে মর্ত্যে প্রেরণ করেছিলেন।

–এত অমৃত সেই দুঃখের মধ্যে, বিরহে এত রঙিন সেখানকার দখিন হাওয়া। আমার রাধার হৃদয় ছিল কুসুমসম কোমল, সেই হৃদয় আমি এত অনাদরের মধ্যে রেখে এলাম!

–প্রভু, রাধা কীকট দেশের রমণী, আপনাকে মনে রাখতে তার বয়েই গেছে। খামোখা আপনি ওর কথা ভেবে কষ্ট পাচ্ছেন।

–রাধা তবে নতুন প্রেমবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে!

–তাই তো হবে।

–আমার বিশ্বাস হয় না।

-ভগবন্‌, নশ্বর মানুষের প্রেম অস্থায়ী, সম্পর্কও পরিবর্তনশীল। এই মায়ার খেলা আপনারই রচিত।

–হ্যায়, স্বর্গ বড্ড একঘেয়ে। উর্বশীরা বড্ড শীতল। তাদের আকাঙ্ক্ষা করতে আমার মোহনবাঁশির সুরের কোনো প্রয়োজন নেই।

–দেবাদিদেব শংকর সুগায়ক এবং নৃত্যবিদ। আপনি এখন নারায়ণের ভাবে একাত্ম রয়েছেন। মহাদেবের গানে বিভোর হয়ে আপনি। মহাভাবসমুদ্রে নিমজ্জিত হলেন, সেই মহাভাব শংকর তাঁর জটায় ধারণ করলেন। তারপর আপনার সংবিত ফিরল।

-উফ, মহাদেবের জটায় বড় উকুনের উৎপাত ছিল। তাই তো আমি অমৃতবাহী নদী গঙ্গাকে মুক্তি দিলাম মর্তে।

–প্রভু, ক্ষমা করবেন। আপনি দেবভাষা একদম বিস্মৃত হয়েছেন। ‘উকুন’ জাতীয় ইতর শব্দ স্বর্গে উচ্চারণ করা যায় না। মর্ত্যের আর্যের গোষ্ঠীর অর্বাচীন ভাষা সৃষ্টিকর্তার শ্রীমুখে শোভা পায় না।

–মহতী ব্ৰহ্মা, আমিও নাস্তিক্যবাদকে স্বীকার করি। জনপদের ভাষা আমার কাছে আন্তরিক মনে হয়।

–প্রভু, মহাপ্রলয় হয়ে যাবে! সৃষ্টি রসাতলে যাবে!

–হে চতুর্মুখ ব্রহ্মা, এ দেশের সংগীত কখনো শ্রবণ করেছেন?

–কোন রাগ-রাগিণী প্রভু?

–মধুর তোমার শেষ নাহি পাই প্রহর হল শেষ।

–ছি প্রভু! এ কি কোনো সংগীত হতে পারে, এ তো ক্লীবভাবে শৃঙ্গাররসের পরিবেশন মনে হচ্ছে।

–কীকটদেশের গান।

–নাস্তিক্যবাদের সেই দেশটা এতটা অধঃপতনে গেছে! কী কুৎসিত অর্বাচীন ভাষা। পুরুষেরাও শুনেছি সেখানে অলস। কর্মহীন। শুধু কাব্যগীতাদি নিয়েই থাকে।

–হ্যায় ব্রহ্মা, তোমার অজ্ঞতা দেখে আমি খুব পীড়িত বোধ করছি। বঙ্গদেশের রমণীরা এহেন শৃঙ্গাররসই সমীরণের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়। তখন সমীরণ হয়ে ওঠে ‘বসন্তবায়’।

প্রভু, স্বর্গের অপূর্ব রাগ-রাগিণী আপনি কি বিস্মৃত হয়েছেন? বৃষ্টিপাত, প্রদাহ, চিরবসন্তের কৌমার্য– সবই তো অপ্সরাদের সংগীতের অনুরণন।

–ও দেশের পুরুষেরা প্রেম নিবেদনের সময় দয়িতাকে কী বলে জান?

–সেও কী সংগীতের ভাষায়?

–কীকটদেশের আকাশে-বাতাসে কাব্য ও সংগীত। আমি কী বলতাম রাধাকে যখন ওর মানভঞ্জন করতে হত– শুনবে কি?

–প্রভু, আমরা স্বর্গদ্বারে এসে উপনীত হয়েছি। এখন আর রাধা কেন! বরং সত্যভামা, জাম্ববতীদের কথা বলতে পারেন।

–ও সব রমণীরা মূর্খ। কাব্য-সংগীতের সাধই নেই। অনাবৃত সঙ্গম ব্যতীত ওরা কিছু বোঝে না।

–কিন্তু ভগবন, মর্তে ওরাই আপনার বৈধ মহিষী ছিল।

–আমি রাধার মানভঞ্জন করতাম এই বলে…

–প্রভু, আমাকে কি শুনতেই হবে?

–তোমার শ্রবণ-অঙ্গ অমৃতবাহী হয়ে উঠবে।

–থাক প্রভু, আর আমি শুনতে চাইছি না। আপনার ভয়ানক মতিভ্রম হয়েছে।

–চলভাষ যন্ত্রে রাধাকে কত লাভ মেসেজ প্রেরণ করেছি।

–হ্যায় প্রভু! এ তো যবন দেশের ভাষা। এসব তো কয়েক হাজার বছর পর ভারতবর্ষে ঘটবে, বঙ্গদেশে ঘটবে। আর ওসব কারিগরিও তো নাস্তিক্যবাদের ফসল। সবই তো মর্ত্যে ভবিষ্যৎ কালের ব্যাপার।

–কিছু ক্রান্তদর্শিতা না দেখালে মর্তের মানুষ আমায় ভক্তি করবে কেন? আর নশ্বর মানুষের মস্তিষ্কের ক্ষমতাও তো স্বল্প, বিশ্বসৃষ্টির কতটুকুই-বা জানবে ওরা। সবটাই তো ওদের কাছে অধরা মাধুরী। কিছু রেখে এলাম। স্মৃতিবাহী চেতনায় মরচে পড়ে গেলে দিব্যি সব ভুলে যাবে।

–ভগবন্‌, মেঘের দল পশ্চাদবর্তী হয়েছে, ওই দেখুন আলোকিত স্বর্গের প্রভা। কত হীন ফেলে আসা মর্তদেশ। ক্ষুধার হাহাকার, লোভ, রিরংসা, মাৎসর্য; আর এখানে নিরন্তর প্রবাহিত অমৃতধারা।

এসব কী ভাবছিলেন পুরুষোত্তম রাধারমণ! তিনি কি কালের যাত্রার ধ্বনি শুনতে পেলেন? উষাকালের নরম রোদ্দুর। অহনা আলোয় স্নাত হচ্ছেন তিনি। বৃক্ষশাখাগুলিতে পাখিদের কূজন অসম্ভব তৃপ্তি দিল তাঁকে। জরার তির তাঁর পায় বিদ্ধ হবে। তিনি প্রত্যাবর্তন করবেন, তাঁর মর্ত্যলীলা সমাপ্তির সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে রয়েছে। উদগত এক কান্নার বেগ উঠে আসছে। হৃদয় থেকে। মোহনবাঁশি তখনই রক্তিম ঠোঁটের অন্তরে স্থাপন করলেন। অসীম বিষাদ ছড়িয়ে পড়ছে অরণ্যে। সূর্য গেলেন অসময় অস্তাচলে। পাখির দল বিভ্রান্ত হয়ে শূন্যে চক্কর দিতে থাকল। একসময় বৃষ্টি নামল অঝোরে। ক্ষণে ক্ষণে দেয়া গর্জনে অরণ্যের হিংস্র পশুর দলও উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠল। কৃষ্ণ স্তব্ধ হলেন। এত মায়া তাঁর এই পৃথিবীর প্রতি। কত সহজ ছিল অন্যের মৃত্যু রচনা করা; আর কতটাই কঠিন মৃত্যুদিনের নিত্য সংশয়কে মন থেকে মোচন করা। নিরাশী প্রত্যক্ষকে এই প্রথম রাধারমণের খুব সাধারণ মানব-মানবীর মতোই নির্মম মনে হল।

.

৫৪. শ্রীরাধিকা ও রাধারমণ

–রাধা কি তোমার চৌকিদার যে সব কিছু আগলে রাখবে?

কৃষ্ণ হাসলেন, এত দূর থেকেও সেই হাসির নৈঃশব্দ্যে বুক কেঁপে উঠল রাধার। নতুন করে প্রকম্পিত হচ্ছে হৃদয়।

–বস্তু হলে তোমাকে আগলে রাখতে বলতাম না, সত্যভামারা সেইসব করবে। কিন্তু এতো আমার স্মৃতির উপলখণ্ড।

–কেশব, তুমি তো বলেছিলে কখনো প্রত্যাবর্তন কর না প্রাচীন স্মৃতি-সমূহে। মুহূর্তের অন্তিম মুহূর্তের মধ্যেই নিহিত থাক।

–আমি তো এখন তেমন করে ঋতু পরিবর্তনের দিকে তাকাই না। অভ্যন্তরে অনন্ত সময়ের প্রবাহকে প্রত্যক্ষ করি। সেই স্মৃতির উপলখন্ডগুলিতেই বৃষ্টিপাত হয়, বসন্তের পাতা ঝরে।

–কালাধীশ পুরুষ। এই সামান্য রমণী কীভাবে তোমায় স্মৃতির রক্ষক হবে। বরং তোমার পত্নীদের সেই দায়িত্ব দিতে পারো।

খুব করুণ দেখাল তাঁকে।

–সত্যভামাকে আমি কতদিন বলতাম আমায় একটু বেষ্টন করবে তুমি বাহুদ্বয় দিয়ে! বললে হয়তো সামান্য হাতের স্পর্শ পেতাম। কত রাত চুম্বন ভিক্ষে করেছি সে আমায় দেয়নি। প্রভাসতীর্থে আমি শুধু প্রেমহীন সঙ্গম করেছি। হয়তো আমি তাদের উজাড় করে দিতে চেয়েছি তারা বার বার আমায় প্রত্যাখ্যান করেছে।

তখন পশ্চিম আকাশে সূর্য ঢলে পড়েছে। বনান্তের পুব প্রান্ত থেকে চাঁদ উঠছে। বনভূমিতে চাঁদের আলোর শুভ্র প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ল। পলকের মধ্যেই রাধার মনে হচ্ছে যেন যাবতীয় ব্যবধান ছিন্ন হোক, হঠাৎ দূর পাহাড় থেকে বর্ষায় জলে ভরন্ত পোয়াতি মেঘ বিস্মৃত প্রেমের বার্তা নিয়ে এসেছে। যাবতীয় কুণ্ঠা কেটে যাচ্ছে, আবার সেই কথা শোনার টান, হৃদয়ের মধ্যে যেন বারোয়াঁ সুরে সানাই বাজছে। গহনতর প্রেমের সমস্ত সংকেত কৃষ্ণের কথায়। তিনি ভেঙে পড়েছেন দয়িতার কাছে। রাধা উত্তর করল, ‘ওগো রাধারমণ, আমি আছি। চুম্বনে চুম্বনে ভরিয়ে দেব তোমার নীলকান্ত শরীর। আমার দেহটা তোমার কাছে না থাকলেও প্রাণ আছে, প্রেমও আছে। আমি তোমার স্মৃতির চৌকিদার হলুম অনন্তের পথে।

.

৫৫. অন্তিম অধ্যায়

ব্রহ্মা অরণ্যে প্রবেশ করে দেখলেন কৃষ্ণ শায়িত রয়েছেন। এই মর্তে তাঁর তো যোগনিদ্রায় অভিভূত হয়ে থাকার কথা নয়! তবে এতটা নিশ্চেষ্ট তিনি কীভাবে রয়েছেন যখন মৃত্যু তাঁর দ্বারপ্রান্তে এসে উপস্থিত? সভ্যতার মৃত্যু ঘটবে এই যদুপতি নিধনের সঙ্গে সঙ্গে। লোকক্ষয়কারী মহাভারতীয় যুদ্ধেও যা হয়নি তা ঘটতে পারে কৃষ্ণের মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই। অরণ্যে তখন বসন্ত কাল। বায়ু শীত কালের বিজিগীষু মনোভাব হারিয়ে এখন অনেকটা মধুর। এমন মধুবৎ কালে বা ঋতুতে অশ্বত্থামা জরা ব্যাধকে ভ্রান্ত দণ্ডনীতি শুনিয়ে রাধারমণের হত্যার জন্য প্রস্তুত করে তুলেছে। ব্রহ্মা কোমল স্বরে বললেন, ‘ভগবন্‌, সৃষ্টি যে লুপ্ত হবে এবার।‘

কৃষ্ণ বললেন, ‘অঙ্গিরা প্রভৃতি ঋষিবর্গ আমার প্রচেষ্টার সাক্ষী রয়েছেন এই সত্য বলে জেনে যে, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের নিবৃত্তির জন্য আমি কোনো আয়ুধই অব্যবহৃত রাখিনি।

–তবে জরা ব্যাধকে কীভাবে উদ্বুদ্ধ করছেন অশ্বত্থামা?

–আপনি স্বয়ং দণ্ডনীতি পরিবেশন করার পর আত্মস্থ করেছিলেন শিব। তাঁর পরে ইন্দ্র এবং কালচক্র অনুযায়ী শুক্রাচার্য ও বৃহস্পতি। এবং তাঁদের কাছ থেকে লাভ করেছিলেন অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য। ফলে অশ্বত্থামা দণ্ডনীতি সম্পর্কে অবগত হয়েই ‘জরা’কে নিয়োগ করছেন এই। হত্যালীলায়। বিজিগীষু দুর্বল রাজার ভূমির রক্ষণাবেক্ষণ করে। ব্রহ্মা, আমার নিষ্ক্রমণ ঘটলেও আপনি তো রইলেন।

–তবুও এই অকিঞ্চিৎকর মৃত্যু রাধারমণের অনুপযুক্ত নয় কি?

–প্রভু, এই মৃত্যু আপনিই রচনা করেছেন, আমি তার ব্যতিক্রম হব কীভাবে? প্রত্যূষে এক বসন্ত কালে স্নান ও আহ্নিক সমাপন করে অগ্নিকে প্রদক্ষিণ করে কিছু প্রহরণ রথস্থ করে সাত্যকিকে বলেছিলাম অশ্বচালনা করতে। হস্তিনাপুরের সেই সন্ধিসভায় নারদ, জামদগ্ন্য, শ্বেতকেতু, অঙ্গিরা প্রভৃতি ঋষিবর্গ উপস্থিত থেকে দেখেছিলেন লোকক্ষয় নিবারণের কারণে আমার প্রয়াসে কোনো কপটতা ছিল না।

–তবে এই দণ্ডনীতি আপনি গ্রহণ করছেন কেন? জরাকে নিধন করাও তো আপনার কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। আপনি বিদায় নিলে আমার পৃথিবী যে চণ্ডহীনা শর্বরীর মতো হয়ে যাবে। জ্ঞানশূন্য হবে রাজন্যবর্গ, অন্তত যাঁরা কিনা প্রজার পালন আন্তরিকভাবে কামনা করেন।

–মহারাজ যুধিষ্ঠিরকে বলেছি আমার হত্যার পর অযথা শোক না করতে।

–আপনিই অস্তি বৃদ্ধির ধৃতি– তিনি শোক না করে পারবেন কেন!

–‘কাল পচতি ভূতানি সর্বাণ্যে মহামতে।’ মহামতি ব্রহ্মা, আমিও তো কালের অধীন।

–হে নারায়ণ, তবে কি আবার সেই পৃথুর পূর্ব অবস্থা ফিরে আসবে! আবার ভূমি কর্ষণযোগ্যতা হারাবে। ব্রাহ্মণের অবলুপ্তি ঘটবে। মরীচি প্রভৃতি ঋষিদের আবার আমায় পুনরায় সৃষ্টি করতে হবে?

–ভগবন্‌ ব্রহ্মা, আপনি অযথা শঙ্কিত হবেন না। চিরকাল ধর্ম বলে যা চিহ্নিত হয়ে এসেছে তার বিনাশ সম্ভব নয়। এখনও সে সময় অনাগত যখন রাজন ব্রাহ্মণ্যবর্গকে রক্ষা করবে না। দণ্ডনীতির ধর্মও পৃথিবীতে স্বাভাবিক। মানুষ সেই স্বাভাবিক ধর্ম পালন করবে। শুধু যুগের রূপান্তর ঘটতে পারে।

ব্রহ্মার প্রস্থানের পর অগ্নি ও বরুণ এলেন।

অগ্নি বললেন, ‘কৃষ্ণ, আমি বহু বৎসর এই অরণিতে বাস করেছি, কিন্তু যখন কুরুক্ষেত্রের ভয়ংকর লোকক্ষয় শুরু হল, আমি জন্মস্থান অরণিকে ত্যাগ করে ইন্দ্রকে বরণ করলাম এবং বার বার নশ্বর মনুষ্যদেহকে ভস্মীভূত করলাম। এখন বরুণদেব অত্যন্ত ভীত হয়েছেন, তিনি আমার কাছেই ঋত বা সত্যের দ্বারা অনৃতকে পৃথক করার প্রার্থনা করছেন। মৃত্যুর পূর্বে আপনি কি আমার জন্য কোনো নির্দেশ রেখে যাবেন?’

–হে অগ্নি, কেউ যদি হঠকারিতা করে আপনার সমীপে আসে তখন সংলগ্ন অঙ্গটি দহনের হাত থেকে রক্ষা পায় না, তবে অন্য কোনো অঙ্গের হানি ঘটে না। আপনি এভাবেই ঋত বা সত্যের দ্বারা অনৃতকে পৃথক করতে পারেন। ফলে বরুণদেবের সেই শিক্ষাগ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে। আসলে তো ভয়ংকর রাজাগ্নি। সেই অগ্নিকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা আপনারও নেই। সামান্য কারণে সেই ক্রোধাগ্নি প্রজাকে পুত্র-পরিবার যাবতীয় ঐশ্বর্য-সহ ধ্বংস করতে পারে। আপনারা নিশ্চয় আমার কথার অর্থ অনুধাবন করতে পারলেন।

এবার এলেন রাজচক্রবর্তী যুধিষ্ঠির।

কৃষ্ণ এবার দন্ডায়মান হয়ে যুধিষ্ঠিরকে আলিঙ্গন করলেন। যুধিষ্ঠির একাকী এসেছেন, তিনি অর্জুন ও দ্রৌপদীকে কৃষ্ণের বর্তমান অবস্থার কথা জানাননি। প্রণাম করে যুধিষ্ঠির জিজ্ঞেস করলেন, তাঁর করণীয় কর্ম কী। এ ছাড়াও রাজ্যচালনায় প্রচুর পাপকর্ম করতে হয়। মানুষের মধ্যে বিদ্যমান ভ্রষ্টাচার, মিথ্যাচারকেও তিনি ভয় পান। কৃষ্ণ স্মিত হেসে বললেন, ‘কিন্তু মহারাজ, এসবের কারণে প্রজারা আপনাকে কর দেন। তাদের প্রতি আপনি যে দায়বদ্ধ। বলবত্তর ব্যক্তি যদি দুর্বলতরকে গ্রাস করে তাকে রক্ষা করা আপনার কর্তব্য। অরাজক রাজ্যে পাপীদের পাপকর্ম করার মধ্যেও শৃঙ্খলা থাকে না। রাজার অভাবে অদাসও দাস হয়ে যায়।

–প্রান্তিক রাজ্যগুলিতে দ্রোহ দেখা দিয়েছে। বঙ্গদেশে নাস্তিক্যবাদের প্রসারে ভগবৎ অর্থনীতি বিপন্ন।

–মহারাজ, স্মরণ করুণ উচ্ছল ধ্বংসস্তূপ থেকে যখন পৃথু জন্মালেন, তাঁর হাতে ছিল শরসেন এবং গায়ে অঙ্গরক্ষার ধর্ম। ফলে আপনি বরাবরের মতোই নিঃশঙ্কচিত্তে ধর্ম-আচরণ করুন। অর্কজ্যোতির নাস্তিক্যবাদ যদি যাবতীয় কারণের হেতু জানতে পারে, তবেই তার অস্তিত্ব রক্ষা পাবে। সেটা যে সম্ভব নয়– আপনার অধিক কে জানবে! অর্কজ্যোতি ধর্ম মান্য করেন না, ফলে তিনি আংশিকভাবে হলেও বাস্তবজ্ঞানবর্জিত। তিনি সম্পূর্ণভাবে বাস্তববর্জিত মানুষ। চতুর্বিদ্যার অধিকারী পিতামহ ভীষ্ম আপনাকে বিস্তৃতভাবে আম্বীক্ষিকী, ত্রয়ী, বার্তা ও দণ্ডনীতির পাঠ দিয়েছেন।

–স্যংখ্য, যোগ, লোকায়ত দর্শনের প্রবক্তা হে কৃষ্ণ, আমি আপনার অবর্তমানে প্রজাদের রক্ষা করতে পারব তো?

–শুধুমাত্র মহারাজ এই চতুর্বিদ্যার মধ্যে দণ্ডনীতি প্রয়োগের বিষয়ে আপনার কিঞ্চিৎ দুর্বলতা রয়েছে। অবশ্যই তা পরিত্যাগ করুন। দণ্ড হচ্ছে। লব্ধ বস্তু রক্ষণের উপায়। পৃথিবীর লাভ এবং পালনের উপায়।

–কেশব, আপনি কি অর্কজ্যোতির শাস্তির কোনো বার্তা আমায় প্রেরণ করছেন?

–রাষ্ট্রের পক্ষে অর্কজ্যোতি ক্ষতিকারক, যেমন ছিলেন চার্বাক। ঔচিত্যপূর্ণ ছিল না তাঁর দর্শন। ফলে শূন্যতার মধ্যেই সেই আম্বীক্ষিকী ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল কিন্তু আবার তা রাষ্ট্রদ্রোহিতার রূপ নিচ্ছে। এই কার্য সম্পাদনের কারণে আপনি আরেক জনকে পাবেন।

–কে তিনি?

–বিশাখজ্যোতি।

–কৌরব সেনাধ্যক্ষ!

–বিজিগীষু রাজা চিরকাল যে-ধর্ম পালন করে এসেছে আপনাকেও তাই করতে হবে। প্রথমে ওকে বন্দি করে স্বপক্ষে আনতে হবে।

–কিন্তু তিনি তো অর্কজ্যোতির প্রিয় কিংকর।

–মহারাজ, দণ্ডনীতির অন্যতম অঙ্গ হল ভেদনীতি। ধৃতরাষ্ট্র একসময় কণাদকে আনয়ন করেছিলেন, সেই ভেদনীতি আপনাকে প্রয়োগ করতে হবে।

–কেশব, আবার নতুন করে পাপকর্মের সূচনা!

কৃষ্ণ হাসলেন, শত্রুকে দমিত করে তাঁর ভগবৎ নীতির অস্তিত্বরক্ষার জন্যই তিনি লোকক্ষয়ও নির্বাচন করেছিলেন। মানুষ নশ্বর কিন্তু তার দর্শন অবিনশ্বর। আন্থীক্ষিকী হল হেতুবিদ্যা, যার মধ্যে সম্যক দৃষ্টি রয়েছে। তিনি নিজের অবরণীয় মৃত্যুকেও স্বীকার করছেন প্রজ্ঞা ও রাজন্যর রক্ষার কারণে।

–অর্থ এবং অনর্থ দুটোই রাজধর্ম। পুণ্য, পাপ বলতে রাজার কিছু থাকতে নেই। যারা চরিত্রহীন তাদের আমরা ত্যাগ করব, না-হলে বলবত্তর ব্যক্তি দুর্বলকে গ্রাস করবে।

–যারা দণ্ডদান করার সময় খুব কঠিন অথচ নিজে চরিত্রহীন– এমন রাজকর্মচারীদের প্রতি আমাদের আচরণ কেমন হওয়া উচিত?

‘রাজান অসৃজৎ প্রভুঃ।’ রাজা বিধাতার অংশ, সূর্যের মতো তাঁর তেজ, পাপী ব্রাহ্মণকেও শাস্তি দেওয়ার অধিকার রাজার রয়েছে। নিয়শিক্ষা, ইন্দ্রিয় জয়ের শিক্ষা যেহেতু রাজার রয়েছে তিনি চরিত্রহীন, পদস্থ রাজকর্মচারীকে শাস্তি বিধানের ক্ষেত্রে নিপীড়িত প্রজাদের বিষয়ে অনুগ্রহশীল হবেন।

–কেশব, প্রজাদের মধ্যে ব্যাপক ব্যভিচার পরিলক্ষিত হচ্ছে। সমকামিতায় আচ্ছন্ন নগর। প্রেমশূন্য গৃহস্থরা। বারাঙ্গনা পল্লিতেও সমকামের চর্চা অধিক।

–আমার সম্মুখেই দ্বারকায় সমকামী প্রেমের আধিক্য দেখা দিয়েছিল। নানা অশুভ লক্ষণ আমিও প্রত্যক্ষ করেছি, গোরু প্রসব করেছে গাধা, ঘোড়ার গর্ভ থেকে জন্ম নিচ্ছে হাতি। অন্তরে মহিলা, বহিরঙ্গে পুরুষ এমন বৃহন্নলায় ছেয়ে যাচ্ছিল নগর। যদুবংশের যুবকেরা, যুবতীরা কেউ আমার নিষেধাজ্ঞায় কর্ণপাত করেনি, আমি ওদের রক্ষার্থে ব্যাসদেবের কাছেও গিয়েছিলাম। তিনি বললেন, ওরা ব্ৰহ্মশাপে বিনষ্ট হবে। কালের হাতে পরাভূত হয়েছিলাম আমি। সমকামীদের মস্তক মুণ্ডন করে, হস্ত-পদ কর্তন করে গাধার পিঠে আরোহণ করার দণ্ডনীতি রয়েছে কিন্তু স্নেহের আধিক্যবশত আমি বিচ্যুত হয়েছিলাম।

–নাস্তিক্যবাদীরা যৌন-স্বাধীনতার কথাও বলে। সমকামকে, কেশব, আপনিও সমপ্রেম বলেই সম্বোধন করেছেন।

–এই বিকর্ষিত যৌনসম্পর্ক আমার কাছে কখনো আদরণীয় ছিল; কিন্তু কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে বীরদের প্রয়াণের পর পুরুষত্বহীনতার ব্যাধি সমগ্র আর্যাবর্তকে গ্রাস করবে। ফলে স্বভাবে নারীত্ব বহিরঙ্গে পুরুষ এরা মূলত কাপুরুষ, কোনো বিবাহও এদের পক্ষে বিধিসম্মত নয়, ক্লীবত্ব সভ্যতাকে গ্রাস করবে। তবু, মহারাজ, এই বিকৃত যৌনতাও প্রেম, আমার প্রিয় সখা অর্জুনও উর্বশীর অভিশাপে বৃহন্নলার বেশ ধরেছিল।

–কৃষ্ণা দ্রৌপদী আপনার দর্শনপ্রার্থিনী, আমি কি তাঁকে প্রেরণ করব?

–আমি কাউকে ফেরাতে পারব না শুধুমাত্র আমার ষোলোশো গোপিনী ব্যতীত।

–কেন কেশব?

–ওরা আমার এই ভগ্নদশা সহ্য করতে পারবে না। ধর্মরাজ, ভেদনীতির দ্বারা আপনি বিশাখজ্যোতির আস্থা অর্জন করুন। কীটদেশের সংবাদ শুভ নয়, এই বিদ্রোহের অগ্নি যেন সর্বাত্মক রূপ না নেয়।

–আমি চেষ্টা করব, কেশব। আপনি আমার অন্তিম প্রণাম গ্রহণ করুন।

কৃষ্ণা দ্রৌপদীর সুগন্ধ অরণ্যের হাওয়ায় ছড়িয়ে গেল। চাঁদের আলোও ম্লান, বসুন্ধরাকে কুহকের মতোই মনে হয়। সামান্য বাতাস বইতে পল্লবে পল্লবে মর্মরধ্বনি শ্রুত হল। কত স্মৃতি পাঞ্চালীকে আবর্তন করে, মহাভারতের যুদ্ধের এই অভিমানী নারীই তো সূত্রধারিণী। সন্ধির প্রস্তাবে কোনো পক্ষের আন্তরিকতা ছিল না। পাঞ্চালী কখনো সম্মত হয়নি কৃষ্ণ এই দৌত্যকর্ম করুন। তবুও লোকক্ষয়কারী যুদ্ধ তো খুব অনায়াস প্রারম্ভের বিষয় নয়, শত্রুকে আক্রমণও তখনই সম্ভব যখন শান্তির যাবতীয় দ্বার রুদ্ধ হয়ে যায়। রাধারমণ কৃষ্ণ হস্তিনাপুরের রাজনীতিতে যেন দ্বারপণ্ডিতের ভূমিকা পালন করছেন। শান্তির সত্যিকারের অগ্রদূত কোন পক্ষ, তার দায়ও একান্তভাবে কৃষ্ণের। তিনি পরীক্ষা করছেন উত্তীর্ণ ক্রমের।

দ্রৌপদী দেখলেন উত্তর দিকে মাথা রেখে সখা শুয়ে রয়েছেন। উদ্গত অশ্রু সংবরণ করা দুর্মর পাঞ্চালীর পক্ষে এ সব অনুধাবন করে কৃষ্ণ স্মিত মুখে বললেন, ‘নৈব ত্বং মধুসূদন। সত্যিই কৃষ্ণা এখনও তুমি ভাব আমি তোমার কেউ নই।’

–এটা কি ইচ্ছামৃত্যুর প্রস্তুতি?

–মহামতি ভীষ্ম ছাড়া এই অধিকার কারুর নেই।

–কেশব, এই জীবজগৎ তোমার প্রেমের আখড়া, প্রাণীজগতের একান্ত গতিও তুমি, যদি ইচ্ছামৃত্যু না হয় তবে এই আত্মহননের প্ররোচনায়। এতটাই মগ্ন কেন?

–হে সখি, এবার কাল আমায় গ্রাস করেছে। দূতসভায় ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরেরও মতিভ্রম হয়েছিল, তিনি তোমায় বাজি রেখেছিলেন। আমার যদুবংশ আত্মহননের খেলায় মত্ত হয়ে ধ্বংস হয়েছে, বলরাম চলে গেছেন, আর আমার থাকাটা সমীচীন নয়।

–কেশব, আমি তোমার একান্ত সখি। তুমি বলতে, আমি তোমার অর্ধেক আকাশ। তবে সেই সখির কাছে কিছু যেন গোপন করছ। কোথায় তোমার ব্যথা, কেশব?

ঘন, কালো, কুঞ্চিত একরাশ চুলের গন্ধ বনরাজির সৌরভকে ছাপিয়েও কৃষ্ণের নাকে এল। তিনি সখ্য নিয়েই সস্নেহে বললেন, ‘পাঞ্চালী, তুমি বলেছিলে সন্ধির জন্য তোমার হৃদয় ব্যাপক উদগ্রীব হলে তুমি আমার কুঞ্চিত চুলের কথা মনে রেখো।‘

–হ্যাঁ, বলেছিলাম।

–যাজ্ঞসেনী, আমি কথাও রেখেছিলাম।

–যুদ্ধ ব্যতীত আর কোনো কিছুই সম্ভব ছিল না।

–কৃষ্ণ পারতেন না– এই কালে এমন কার্য সংঘটিত হতে পারত না।

–কেশব, তুমিই আমায় যাবতীয় শক্তি। তুমি চলে গেলে এই বসুন্ধরা থেকে সখ্য হারিয়ে যাবে আর বিলাসকক্ষের জীবন আমায় বিষবৎ মনে হবে।

কৃষ্ণ পাঞ্চালীর দিকে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। সখি কে স্পষ্টভাবে বলা গেল না কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের মূল হোতা পাঞ্চালী। আন্তরিকভাবে কৃষ্ণা চেয়েছিলেন যুদ্ধ। বরং তিনি বললেন, তবে তোমার পঞ্চস্বামীকে এক লহমায় ত্যাগ করে চলে এসো এই অরণ্যে। দ্রৌপদী প্রকম্পিত হলেন। এবার তিনি কৃষ্ণকে ভালো করে নিরীক্ষণ করলেন। এক অদ্ভুত রূপ যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে, তা প্রত্যক্ষ করে। কৃষ্ণা দ্রৌপদী অবলোকন করলেন বসুন্ধরার শ্যামল প্রতিবিম্ব কৃষ্ণ তাঁর। অঙ্গে ধারণ করেছেন। যুগান্তরের এক লীলাক্ষেত্র যেন কেশবের শরীরে মূর্ত হয়েছে, চোখের সামনে ভেসে উঠছে লক্ষ লক্ষ বছরের সৃষ্টি এবং রূপের প্রবহমাণতা।

অশ্রুপাত রোধ করা কঠিন হয়ে দাঁড়াল পাঞ্চালীর।

–তোমার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সভ্যতাও কি বিলীন হবে, কেশব?

–এই অরণ্যের অদূরে নদীতীরে এক প্রভাযুক্ত ঋষি অনেকক্ষণ আমার জন্য অপেক্ষা করছেন, আমায় যে তাঁর কাছে যেতে হবে, পাঞ্চালী।

–কে তিনি?

–যুগের অন্তরে যিনি দণ্ডায়মান থাকেন, সভ্যতার প্রবহমাণতার রক্ষাকর্তা তিনিই।

–কী হবে আমাদের?

–বিবিধ কর্ম ও উপাসনার মধ্যে নিজেদের নিয়োজিত রাখো, পাঞ্চালী। সময় সতত সঞ্চরমাণ এবং পরিবর্তনশীল, তার জন্য শোক করতে নেই।

–আমাকে তবে বিদায় দিচ্ছ, কেশব? বাতাসের শনশন ধ্বনি শ্রুত হচ্ছে। কৃষ্ণ বললেন, ‘রাজকীয় সুখ ভোগের সমাপ্তিতে তুমিও একদিন কালের আহ্বান শুনতে পাবে, আজ তোমার কিছুই বোধগম্য হবে না।’

দ্রৌপদী চলে গেলে কৃষ্ণ বাঁশিতে সুর তুললেন। সেই সুরের মায়ায় গভীর নিশীথেও পশু-পাখিরা ঘুম ভুলে গিয়ে আকাশের বুকে পক্ষ বিস্তার করে উড়তে থাকে। চাঁদ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তাঁর মুখের দিকে। তিনিও অনুভব করলেন যে-প্রেমের রচনা তিনি বসুন্ধরায় রেখে গেলেন, তার ক্ষয় নেই। রাধার কাছে সেই বাঁশির ডাক নিশিডাকের মতোই মনে হল। দ্বিধাগ্রস্ত রাধার জড়তা কাটল না। কৃষ্ণও তাই চেয়েছিলেন। তিনি চাননি এই মৃত্যুমুহূর্তে দয়িতা রাধা কোনোভাবে তাঁর কাছে প্রত্যাবর্তন করুন। সেই বাঁশির সুরে সুরে আকাশের মোহময় রাজ্য জেগে উঠল। অশ্বত্থামাও জরাকে নিয়ে বাঁশির সুর অনুগমন করতে করতে কৃষ্ণের সমীপে এসে উপস্থিত হলেন। তিনি বাঁশি বাজাচ্ছিলেন বৃক্ষশাখায় নিজেকে শায়িত রেখে। অস্বাভাবিক মদিরা পান করেছিল জরা। সে। প্রত্যক্ষ করছিল পৃথিবীর বুকের লক্ষাধিক প্রাণ সেই বৃক্ষশাখায় জড়িয়ে রয়েছে। নানা আকারের প্রাণ, শত শত উদ্ভিদ, বহু কোটি দূরে থাকা তারা, নক্ষত্রদের জীবাশ্ম যেন লীন হয়ে রয়েছে।

বিভ্রান্ত জরা অশ্বত্থামার নিরন্তর প্ররোচনায় এবং স্ব-অভিকর্ষজ বলের টান সামলাতে না পেরে ধনুকে তির যোজনা করল। পৃথিবী যেমন তার আদিকালে বিভিন্ন গ্রহাণু ও ধূমকেতুর সঙ্গে সংঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল কিন্তু একইসঙ্গে ধরিত্রীর বুকে প্রোথিত হয়েছিল জীবনের প্রথম বীজ, সেরকমই কিছু ঘটল। কৃষ্ণ বিদায় নেওয়ার অন্তিমক্ষণে রাধা এক গর্ভর্যন্ত্রণা অনুভব করল, রাধারমণ তাঁর শেষ রমণে পৃথিবীতে প্রেমের অঙ্কুর, জীবনের অঙ্কুর প্রোথিত করেই নশ্বরতার অভ্যন্তরে মেঘের গহ্বনে লীন হয়ে গেলেন। প্রেমশূন্য কালে আবার প্রেম প্রত্যাবর্তন করল, ভূমি ফিরে পেল কৰ্ষণযোগ্যতা, দ্বেষ-প্রতিহিংসাকে পশ্চাতে রেখে আবার জয় হল অন্তরের অনুভূতির।

কৃষ্ণের মৃত্যুর মুহূর্তে জরার রমণী পাপের ভয়ে ক্রন্দন করে উঠেছিল। সে অশ্বত্থামাকে বলল, ‘কুটিল ব্রাহ্মণ, আমার পুরুষকে দিয়ে তুমি এমন হীনকর্ম কেন করালে? আমরা, নিষাদেরা কৃষ্ণনিধনে কলঙ্কিত হলাম। আমাদের পুরুষদের রমণক্ষমতা লুপ্ত হবে, নিষাদদের ভবিষ্যৎ বলতে কিছু থাকবে না।’

অশ্বত্থামা বললেন, ‘হীন রমণী, তুমি কি দেখছ না বসুন্ধরা আবার শ্যামলিমা ফিরে পাচ্ছে। অনুর্বর ভূমিতে প্রত্যাবর্তন করছে উর্বরতা। এসবের জন্য একটি শ্রেষ্ঠমৃত্যু কাম্য ছিল। বর্ণাশ্রম ধর্ম অনুযায়ী তোমরা ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের সেবক। সেই সেবাধর্ম চরিতার্থ হল।’

জরা বিহ্বলতা কাটিয়ে সংবিত ফিরে পেল। ক্রোধে, ঘৃণায় উন্মত্ত জরা এবার শানিত কুঠার হাতে কুচক্রী অশ্বত্থামার দিকে ধাবিত হল। নিদারুণ যন্ত্রণায় থাকা অশ্বত্থামা প্রতিহিংসা চরিতার্থ হওয়ার আনন্দে অট্টহাস্যে ফেটে পড়ল। তিনি জরাকে বললেন, ‘ওরে পামর, আমার নিধন সম্ভব নয়! আমি অজর, অমর!’

প্রতারিত জরা মৃত কৃষ্ণের শবের ওপর পড়ে রোদন করতে থাকল। তার রোদনে ধরিত্রীর বুকে বৃষ্টি নামল। ব্যাসদেব কৃষ্ণের শরণাপন্ন হয়ে বললেন, ‘নিষাদ জাতি ধ্বংস হয়ে গেলে মানবের প্রভূত অপকার হবে। হে ভাবগ্রাহী জনার্দন, তুমি জরাকে ক্ষমা করো।’

তিনি তখন জরাকে বললেন উচ্চারণ করতে—’শ্রীবিগ্রহস্তং পুরুষোত্তম ত্বং সদা কেশব/ত্বং হৃষ্টস্তমেব পূজ্য প্রতিষ্ঠায়েৎ নিজনোক্ত বৃত্তি/তবানুকূ লং যদি সত্যকাম্ মৃদু কৃপয়া কুরু কর্মনিষ্ঠম/সন্ধিৎসয়া সেবয়া যাজনে সর্বাংস্ত এবানুরঞ্জয়নি/রোগ শোক গ্রহদোষ বুদ্ধিবিপর্যয়াশ্চমে/দারিদ্র্যাদি সর্ব দৈন্যাৎ মুঞ্চমে ত্বয়ি নিষ্ঠয়া/শান্তিং স্বস্তিং শুভ দেহি, দেহি মে কর্ম সুকৌশল…।’

জরা অসংস্কৃত উচ্চারণে ব্যাসদেবকে অনুসরণ করল। তখন অবশেষে ব্যাসদেব বললেন, ‘এই পাপের কারণে তুমি বৃত্তিচ্যুত হলে, এখন থেকে তুমি সদাচারী জীবনযাপন করবে। নিরামিষ আহার গ্রহণ করবে। প্রাণীহত্যা করবে না। মহামতি কৃষ্ণের বাজন হবে তোমার জীবনের ব্রত। তুমি তাঁকে পূর্বভারতে প্রতিষ্ঠা করবে।’

জরার রমণী তখন বলল, ‘মহাত্মন্‌, তবে আমার কী হবে?’

ব্যাসদেব দেখলেন নিষাদদের একটি বৃহৎ দল এদিকে আসছে। তিনি বললেন, ‘জরা এখন ভিন্ন মানুষ, সে পুরুষোত্তমের ঘাতক। তার এই ঘৃণ্য পাপ থেকে উদ্ধার হতে গেলে নিত্য উপাসনা ও সাধনার প্রয়োজন। সেখানে তোমার সংসর্গ ব্রাত্য হওয়াই বিধেয়। আর সময়ের ভিন্ন ঊর্ধ্বতনে তুমিও সঙ্গী নির্বাচন করে নেবে অথবা সংযম রক্ষা করতে পারলে প্রোষিতভর্তৃকার মতন দীর্ঘ অপেক্ষার ক্লেশ সহ্য করতে হবে। এতদ্ব্যতীত জরার প্রত্যাবর্তনের আশা খুব ক্ষীণ। সে এখন মহামতি ভগবন্‌ কৃষ্ণের উপাসক ও অধ্বর্যু।

সমবেত নিষাদদল তখন বলে উঠল, ‘মহর্ষি, কৃষ্ণ ছিলেন জগতের পিতা, তাঁকে হত্যার শাস্তি একমাত্র প্রাণদণ্ড। সেই স্থলে আপনি জরাকে অধ্বর্য হিসেবে অভিষিক্ত করছেন। ভগবান কৃষ্ণের নিস্পন্দ দেহে প্রাণের সঞ্চার করে তাঁর মুখ থেকে আমরা এই কার্যের বিধান শুনতে চাই। অন্যথা জরাকে বধ করে আমরা প্রজাতির সমূহ ধ্বংসের হাত থেকে। রক্ষা পেতে চাই।’

ব্যাসদেব তখন নিজের পরিচয় দিলেন। সকলের উদ্দেশ্যে শান্তির স্বস্তিবচন উল্লেখ করে তিনি বললেন, ‘কৃষ্ণের পুনর্জীবন প্রকৃতিবিরুদ্ধ কর্ম হবে। অমর অশ্বত্থামা ইতিমধ্যে সভ্যতার ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেছে। জগতে মৃত্যুও স্বাভাবিক সত্য, হয়তো গান্ধারীর অভিশাপে কৃষ্ণের এই নিধন সম্ভব হয়েছে। জরা উপলক্ষ্য মাত্র। ফলে জরাকে। প্রকৃতির নিয়ম মান্য করেই ক্ষমা করা উচিত, এ ছাড়াও ভবিষ্যতে যে-কর্ম ওকে সম্পাদনা করতে হবে তা খুব কঠিন। সমগ্র ভারতবর্ষ উন্মত্ত, কৃষ্ণের মৃত্যুতে বৃষ্ণি বংশীয়রা আহত হয়েছেন সর্বাধিক যদিও তাঁদের মধ্যে শাম্ব, সাত্যকির মতন বীরেরা অনুপস্থিত এবং যদুবংশও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে; তবুও বৃষ্ণি বংশীয়দের মধ্যে কেউ কেউ চারণকবি। হিসেবে জীবিত রয়েছেন। তাঁরা জনগণের মধ্যে হত্যার স্পৃহা সঞ্চারিত। করতে পারেন এবং হিংসার সেই উন্মত্ততা সমগ্র নিষাদ সম্প্রদায়কে অবলুপ্ত করতে পারে। ফলে সেই রোগের দাবানল আর্যাবর্ত তথা ভারতবর্ষকে গ্রাস করার পূর্বে জরার মোক্ষপথ মানুষকে সংযত করবে।’

নিষাদগোষ্ঠী ব্যাসদেবের বাক্যে সম্মতি জানাল। তারা জরাকে বিদায় জানাল। হত্যার অব্যবহিত পর থেকেই জরার অবয়বের সেই ভয়ংকর রূপ অনেকাংশে রাহুগ্রস্ত হয়েছিল। অভ্যন্তরের বিলাপ এবার আত্মজনের সম্মুখে প্রকটিত হল। পাপের প্রকাশ হিসেবে দেহে অকালবার্ধক্য নেমে এল। যুবক জরার এই রূপান্তরে তাকে চেনাও খুব কঠিন কর্ম। নিষাদেরা রূপান্তরিত প্রবীণ জরাকে বিদায় জানালে ব্যাসদেব প্রভাসতীর্থে ফিরে গেলেন। সেখানে তিনি কৃষ্ণের পত্নীদের জগৎসংসার সম্পর্কিত আপ্তবাক্য শুনিয়ে শান্ত করলেন।

কৃষ্ণের হত্যার সংক্ষোভ ব্যাপক আকার নিল বঙ্গদেশে। নাস্তিক্যবাদে প্রায় যখন আবৃত হচ্ছিল সেই দেশ, কৃষ্ণের মৃত্যু জনগণকে আবার ভাগবতদর্শনের প্রতি ভাবোচ্ছ্বাস বিহ্বল করে তুলল। অচিরেই কারারুদ্ধ হলেন অর্কজ্যোতি। চার্বাকের মতনই পরিণতি তাঁর সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ। বিশাখজ্যোতি পুত্র রূপজ্যোতি ও নবীন যুবক অনুগামীদের গরিষ্ঠ অংশকে মুক্ত করতে সমর্থ হলেন। রাজচক্রবর্তী যুধিষ্ঠির তাঁকে সেনাধ্যক্ষের পদে অভিষিক্ত করেছেন। গুরুদেব অর্কজ্যোতিকে এই দ্বিতীয় বার কারাবাস থেকে মুক্ত করা প্রায় দুঃসাধ্য। বধ্যভূমি থেকে তাঁর নিষ্ক্রমণের কারণে নিঃশর্ত ক্ষমাভিক্ষা একমাত্র উপায়। তিনি এই বিষয়ে যেহেতু সম্মত হবেন না দীর্ঘ কারাবাস নিধন ওঁর একমাত্র ভবিতব্য। প্রবীণের জন্য গোপনে অশ্রুপাত ব্যতীত বিশাখজ্যোতি আর কী-বা করতে পারেন!

প্রভাসতীর্থ থেকে প্রত্যাবর্তনকালে ব্যাসদেব বঙ্গদেশে এলেন। নাস্তিক্যদর্শন যে সাময়িক উন্মাদনা, তা তিনি জানতেন। অজ্ঞেয়বাদীদের প্রশ্নের মীমাংসার জন্য যে যৌক্তিক বিচার পদ্ধতি তা এই যুগের অগ্রবর্তী চিন্তন। সাহিত্যে, কাব্যে, ইতিহাসে চিন্তনের প্রতিফলন যুগদর্শী ও ক্রান্তদর্শিতার সমাহার হতে পারে কিন্তু রাজনীতি ক্ষমতা, অধিকার ও শাসন সংক্রান্ত নিয়ামক শক্তি হওয়ায় যুগের অগ্রবর্তী চিন্তাধারার প্রতিফলনকে সহ্য করে না এবং রাষ্ট্রশক্তি একেই রাষ্ট্রদ্রোহিতা বলে গণ্য করে। কারারুদ্ধ অর্কজ্যোতিকে ব্যাসদেব দেখতে গেলেন না। এই ঘটনাটির গুরুত্বও তিনি ইতিহাসের বিবৃতিকার হিসেবে রাখতে চান না। বঙ্গদেশে তিনি এসেছেন অন্য কারণে, মহাভারতে যে-নায়িকাকে তিনি অন্তর্ভুক্ত করেননি অনুশাসনবাদ সমাজনীতিকে মান্য করে, সেই বঙ্গদেশীয় রমণী, কৃষ্ণের অভিসারিকা রাধা– তাঁর আহ্বানের স্পন্দনে সাড়া দিয়ে তাঁর এই আগমন। রাধারও প্রতীক্ষা ছিল মহাভারতের কথাকারের সন্দর্শনে। মহাত্মন ব্যাসদেব শ্রীরাধিকাকে সাক্ষাৎ করলেন লোকচক্ষুর অন্তরালে গাঙ্গেয় সমভূমির প্রান্তরে। অদূরে বেগবতী গঙ্গা প্রবহমান। মাতৃসমা নদী গঙ্গাকে ভগীরথ মর্তে আনয়ন করেছিলেন বলেই বঙ্গদেশে তাঁর নাম ‘ভাগীরথী।’

সবিতা তখন পশ্চিম আকাশে অস্ত যাচ্ছে, অস্তরাগের আভা কৃষ্ণ দয়িতা শ্রীরাধিকার মুখে পড়তেই লুক্কায়িত সৌন্দর্যে আরও বেশি রক্তাভা যুক্ত হল। ব্যাসদেবকে পূর্বে কখনো দর্শন করেননি রাধা। পথশ্রমে তাঁকে আরও ভীষণদর্শন দেখাচ্ছে। রাধা মহাত্মাকে প্রণাম করতেই অন্তরের দ্বিধা কেটে গেল। এই নারীর কারণে নতুন কোনো মহাকাব্য রচনা করা যায় কি? যুদ্ধ নয়, প্রেমের পতাকা উড্ডীন থাকবে সেই কাব্যে। ক্রান্তদর্শিতার আলোয় ভালো করে নিরীক্ষণ করে ব্যাসদেব দেখলেন যুগনায়ক যুবতীশতবৃতং মদনমোহন রাধারমণ কৃষ্ণ বারংবার আবিষ্কৃত হবেন শ্রীরাধিকার প্রেমে। ভগবৎদর্শন, ভেদনীতি, ভীষ্মের প্রাজ্ঞতা– যাবতীয় ঢক্কানিনাদকে পশ্চাতে ফেলে রাধারমণের এই রাসলীলা আগামী যুগকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করবে। সমতলভূমি হলেও প্রান্তরটি কর্দমাক্ত। বঙ্গদেশে পাখির ডাক কেমন জানি মন আবিষ্ট করা ভাব নিয়ে আসে। আর্যাবর্তের তুলনায় প্রকৃতি অনেক কোমল। রঙের আগুন, রূপের বাহুল্য এই দেশে দুর্লভ নয়। কৃষ্ণ প্রায়ই অবকাশের অন্তরে তাঁকে রাধার কথা বলতেন, বঙ্গদেশের কথা বলতেন। তিনি বলতেন এই দেশে এলে আত্মার শুদ্ধি হয়। মাথার উপরের আকাশে সংঘবদ্ধ মেঘ দূরে দূরে ভেসে যাচ্ছে। অনাহূতের মতোই সন্ধ্যা নামছে। তেমন অবলোকন করা হল না কৃষ্ণের একান্ত প্রেমিকা রাধাকে। রাধা প্রথম মুখ খুলল–

‘মহাত্মন, এই দেশে খেয়ালখুশি মতো বৃষ্টি আসে।‘

একটা ঘোরের মধ্যে ছিলেন ব্যাসদেব। যুদ্ধবিগ্রহ আর রাজনীতির বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনিও কি খুব অসঙ্গতভাবেই কৃষ্ণের এমন প্রেমিকার কথা মহাকাব্যে বিধৃত করতে পারেননি। ব্যাসদেব খুব কোমল স্বরে বললেন, মাতা, তোমায় দেখতে এসেছি।’

–আমি তো রানি কিংবা কোনো রাজনন্দিনী নই, সামান্য নারী মাত্র; আমাকে দেখতে এসেছেন মহাত্মন্ ব্যাসদেব, বিস্ময়ের অবধি নেই আমার।

–রাধা, তোমার গর্ভপাত সম্পূর্ণ হয়েছে। পৃথার মতো কোনো অনভিপ্রেত সৃষ্টি তুমি কোরকে ধারণ করনি তো?

রাধা বললে, ‘মহর্ষি! সত্যি আপনি নারীচরিত্র সম্পর্কে বেশ অজ্ঞ।’

–পাঞ্চালী আমার সৃষ্টি। যজ্ঞাগ্নি থেকে জাত এই নারীর পরিচয় তুমি জেনেছ নিশ্চয়। তিনি কৃষ্ণের একান্ত সখিও ছিলেন।

–কৃষ্ণের রমণে শুধু রাধা কেন বৃন্দাবনের যাবতীয় গোপিনীদের গর্ভে প্রাণের আবির্ভাব ঘটেছিল।

–সেই প্রাণের স্ফুরণ তুমি কি চাও, রাধা?

–হে মহাকবি, সেই প্রাণের স্ফুরণ আমি প্রেমশীর্ষে নিবেদন করে লীন হতে চাই।

স্তব্ধ হয়ে রইলেন ব্যাসদেব। মুখের ভাষা যেন আর নিঃসৃত হচ্ছে না। কোনোক্রমে অজ্ঞানতাকে স্বীকার করে তিনি বললেন, ‘প্রেমশীর্যে লীন হয়ে যাওয়া আমার বোধগম্য হল না।’

–আমি প্রাণের প্রকাশে কৃষ্ণের পুনর্জন্ম প্রার্থনা করি।

–তোমার গর্ভে নারায়ণকে ধারণ করতে চাও! এমন প্রকাশ তুমি আর কখনো করবে না।

–স্ত্রীর গর্ভে প্রত্যাবর্তন করে পুরুষ সন্তানের অবয়বে। কোনো প্রলাপ নয়, আমি কৃষ্ণপ্রেমের গর্ভধারিণী হয়েই তাকে শাশ্বত করতে চাই।

–রাধা, জগৎকে তুমি পঙ্কিলতার কুম্ভীপাকে নিয়ে যেতে চেয়ে আহত করছ সামাজিক বিন্যাসকে।

প্রভু, আমি তো তাঁর জায়া নই, ফলে আমি মাতা-পুত্রের সম্পর্কের কথা বলছি না। আমি তাঁকে অর্থাৎ প্রেমকে ধারণ করতে চাই, সেটা কি সম্ভব?

ব্যাসদেব বললেন, ‘আমি তোমায় এতক্ষণে চিনতে পেরেছি। তুমি প্রেমের প্রবহমাণতা চাও, যার অবস্থান হবে প্রেমশীর্ষে। তবে তাই হোক, তথাস্তু।’

সেই থেকে অনাগত কালেও বেঁচে রইল রাধাকৃষ্ণের প্রণয়লীলা। ব্যাসদেব অনুশাসনের কারণে লিপিবদ্ধ করেননি এই পরকীয়া প্রেমকথা, যদিও তিনি জানতেন এই বঙ্গভূমি একদম স্বতন্ত্র। প্রেমের নব্য প্রবাহ ধারণ করা একমাত্র বঙ্গদেশের পক্ষেই সম্ভব।

অপালা ও গোপিনীরা বালক গোপালকে স্নান করিয়ে সজ্জিত করে তুলে সেই প্রেমের প্রবাহের অন্য রূপমাধুর্যে মেতে রইলেন। মর্ত্যে তখন যাবতীয় প্রাণের প্রকাশ ঘটতে থাকল। রাধারমণ কৃষ্ণ অন্য কোনো শ্লাঘা ব্যতীত যুগ থেকে যুগান্তরে রাধার প্রেমিক হয়ে রইলেন আর রাধাও তাঁর রমণকে গর্ভে ধারণ করে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন। তবুও মৃত্যু হয়নি সেই প্রেমকথার, নয়নে নয়নে অবগাহনে সময়ের সীমা পেরিয়ে প্রেমের আকাক্ষার নিবৃত্তি ঘটেনি রাধার, যদিও দয়িতার এই পাগলপারা অবস্থার নিঃসংশয় মৃত্যুও চাননি রাধারমণ, বার বার প্রত্যাবর্তন করেছেন নর নারীর সার্থক সম্ভোগলীলায়। পিরিতির আগুনে দীপ্তমান হয়েছেন রাধারমণ কালের সীমা অতিক্রম করেই।

–মহর্ষী ব্যাস, কৃষ্ণ ভগবান হলেও তিনি তো পরপরুষই ছিলেন।

–রাই, জগতে একমাত্র তিনিই পুরুষ, অবশিষ্ট সব কিছুই প্রকৃতি।

–বৃন্দাবনের বাঁশি ছেড়ে তিনি ধরলেন ভারতবর্ষের রাজনীতির অসি।

–বাঁশির সুর চিরতরে হারিয়ে গেল। মথুরায় হাটে যেতে যেতে আমার মতো কত গোপিনী মন-ভোলানো সেই বাঁশির সুরে ভেসে গেছে।

–নন্দিত হবে কাব্যে সংগীতে সেই অপার্থিব প্রণয়কথা।

–মহাত্মন; ভবিষ্যতের গর্ভে আমার সন্তানও যাবতীয় কিছু নিমজ্জিত করলেন। প্রেম যেন রক্ত-মাংসের কোনো প্রাকৃতিক রমণের সঙ্গে যুক্ত নয়, সবটাই অলীক কল্পনা মাত্র। কৃষ্ণও যেমন কখনো কখনো বলেছেন, তিনি ও মহাশূন্য সমার্থক।

ব্যাসদেব মৌন রইলেন। কথার চাতুর্যে রাধাকে বশ করা কঠিন। উত্তীর্ণ রূপের অধিকারিণী রাধার সঙ্গে কৃষ্ণা দ্রৌপদীর আশ্চর্য সাদৃশ্য। কেশব বাইরের যুদ্ধটা জিতেছেন কিন্তু অন্তরের যুদ্ধে তিনি বোধ হয় শূন্যতার ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন।

কোনো অপার্থিব, দূরাগত সম্পদে রাধাকে প্রলোভিত করা যাবে না। মহাভারতের পক্ষে এই আখ্যান অনুপযুক্ত, ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ভাষ্যের দূরবর্তী প্রান্তে গিয়ে রাধারমণের পরকীয়া প্রেমের কাব্যময় প্রকাশ মহাকাব্যের শৌর্যের পক্ষে অপ্রাসঙ্গিক। রাধাকে স্বীকার করা অর্থাৎ মহাভারতে অন্তর্ভুক্তি– প্রাঞ্জতার কাছে চঞ্চলতার সমর্পণ ব্যতীত অন্য কিছু বলে পাঠকের কাছে প্রতিভাত হবে না। কিন্তু রাধার গর্ভে স্থিত জ্বণটির চর্চা ও চর‍্যা প্রয়োজন। মাতা সত্যবতীর আহ্বানে তাঁকে যেতে হয়েছিল। এবার তিনি এসেছেন স্বযাচিত অভিপ্রায় নিয়ে। কৃষ্ণ অনুভব করে গেছেন পৃথিবী প্রেমশূন্য। ফসলের আহ্বান নেই প্রান্তরে। প্রান্তরে কারণ ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগের ফলে ধরিত্রী অনাবৃষ্টির কবলে রয়েছে। নক্ষত্রমণ্ডিত আকাশে কোথাও দয়া নেই আর্যাবর্তের মানুষগুলি জন্য। নর-নারীর প্রেমে রমণসখ্যতা নেই। পুরুষের রমণবাসনা নির্বাসিত এবং নারীও যান্ত্রিক রমণের মুহূর্তে নিস্পন্দ। সে যেন মৃতবৎ নিষ্পেষণ সহ্য করে মাত্র। মৃত্যুর হারের তুলনায় জন্মের হার অত্যধিক হ্রাসপ্রাপ্ত হয়েছে। সেই ক্ষণে, সেই কালবেলায় একমাত্র রাধার গর্ভে আনিত ড্রণে রয়েছে। লক্ষ কোটি জীবনের প্রকাশ। পৌর্ণসখীর ক্ষিপ্রতায় অন্ধকার গর্ভগৃহের তমসা থেকে আলোয় আনতে হবে প্রেমের তনয়কে। শ্রীরাধিকার কাছ থেকে অধিকার করে নিতে হবে নিঃশর্ত প্রেমের আত্মদান। মরীচিৎকার কুহক সৃষ্টি করলেন ব্যাসদেব। আত্মদানে পুনরায় অভিষিক্ত করলেন রাধাকে। প্রেম দেহহীন অস্তিত্ব নিয়ে প্রবেশ করছে তার অন্তরে। হৃদয়ের গুহায় আলোর প্রকাশ ঘটছে।

ব্যাসদেব খুব কোমল স্বরে রাধাকে বললেন, ‘তুমি কি আবার বৃন্দাবনে ফিরে যেতে চাও? সেই বংশীধ্বনি আমি পুনরায় সৃষ্টি করতে পারি তোমার কারণে।’ রাধা ভ্রুণের ক্রন্দন টের পাচ্ছে, যুগান্তরের লীলাখেলা সামান্য কুয়াশার অভ্যন্তরে অনুভব করতে করতে ক্ষয়ে যাচ্ছে রাই। ক্ষোভ, অভিমান, অহংকার– সব যেন বায়ুতে লীন হয়ে যাচ্ছে। মেঘের গর্ভে একটু একটু করে সঞ্চিত হচ্ছে রাধার অশ্রুজল। নৈঋত কোণে কৃষ্ণমেঘের আভাস দেখা দিল। হাওয়ায় এল সজল ভাব। পৃথিবীর আলোর মুখ দেখল রাধার ভ্রুণ। নবজাত শিশু কোনো ক্রন্দন করল না। ব্যাসদেব তাকে শতধা বিভক্ত করলেন। ইন্দ্রিয় শুদ্ধ ও স্থির করে দেখতে পেলেন অসীম আত্মাকে। প্রাণের প্রকাশ অঙ্কুরিত হল সেই রমণীদের গর্ভে যাঁরা গণচিতায় দন্ডায়মান থেকে শোকে বিলাপ করেছিলেন। রাধারমণ শাপমুক্ত হলেন। নতুন নারীরা বরণ করে নিল তাদের পুরুষদের। সার্থক রমণ হল, বৃষ্টির প্রকাশে ভূমি পেল উর্বরতা। বর্ণলোচনী ক্ষমতার অধিকারী গণেশ মহাকবির দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসছিলেন, ব্যাসদেবও প্রীত হলেন। উপভোগ্য অবিরাম বর্ষণ উপভোগ করল ভারতবর্ষ।

অপালাও অপরূপ স্নানে নিজেকে পবিত্র করে তুলেছে। বিশাখ জ্যোতি, রুপজ্যোতি গৃহে প্রত্যাবর্তন করেছে। শ্রীকৃষ্ণকে অপালা দেবতার মতোই নিয়মিত জল ও ফলপত্রাদি-সহ পুজো করে থাকে। শ্রীরাধিকার প্রতি আর কোনো অসূয়া অনুভব করে না। কৃষ্ণ নিহত হয়েছেন সামান্য জরা ব্যাধের বাণে নিন্দুকের এই সংবাদ সে বিশ্বাস করে না। এখনও সংগোপনে কত সংলাপ তাঁর সঙ্গে প্রতিক্ষণেই রচিত হয়। বিশাখজ্যোতির মধ্যে অপালা রক্ত-মাংসের কেশবকেই দেখে। ঈশ্বরও তো স্বামী, আর অপালা নাথের একজন সামান্য অনুগামিনী। বৃন্দাবনের বৈরাগী ঠাকুর বলেছেন অপালার এই ভাব শ্রীকৃষ্ণের অনুগৃহীত মধুর ভাব। বৃন্দাবনের গোপিনীদেরও একই ভাব। ফলে অপালা যেহেতু বিবাহিতা, এই মধুর ভাব সঞ্চারিত হবে স্বামী বিশাখজ্যোতির মাধ্যমে।

ব্যাসদেবকে কখনো কেউ অশ্রুমোচন করতে দেখেননি। লিপিকর গণেশ আজ তাই প্রত্যক্ষ করলেন। মহাভারতের অমৃতকথার অন্তরালে রাই শ্রীরাধিকার রাধারমণ ও এই বসুন্ধরার প্রতি আত্মত্যাগ ও প্রেমের অনির্বচনীয় প্রকাশ-উপভোগ্য বারিধারা শুষ্কপ্রায় নদ-নদীকে উজ্জীবিত করার প্রয়াসে উদ্বুদ্ধ করল। ব্যাসদেব শ্রীরাধিকাকে বললেন, ‘মা, সত্যতার অগ্রগমনে নব যুগের কবির হাতে তোমার প্রেম অক্ষয় ও চিরকালীন হয়ে থাকবে। সেই কবিকে ভারতবর্ষের ইতিহাসের ধারক ভূমিপ্রান্তের জনগণ স্বাগত জানাবে, আমার অকিঞ্চিৎকর বর্ণন তোমার ধারণ করতে অক্ষম রয়ে গেল। যদি সম্ভব হয় ইতিহাসের এই সামান্য বিবৃতিকারকে কাব্যপ্রকাশের ভাষা ও হৃদয়ে প্রেমের স্ফুরণের দৈন্যতার দরুন ক্ষমা কোরো।’

রাধা বলল, মহাত্মন, আমার যাবতীয় চিন্তা ও শঙ্কা অন্তর্হিত হল। ভূমা, কেশব এবং স্বয়ং ব্যাসদেবকে ক্ষমা করতে পেরে আমার মনে। প্রশান্তির প্রত্যাবর্তন ঘটেছে।’

মহাভারতের ন্যায় সুবিশাল আখ্যান লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে যে-গণেশ বৎসরের পর বৎসর মৌন ছিলেন, তিনি বলে উঠলেন–

‘জয়তু রাই শ্রীরাধিকা।’

শাপমুক্ত রাধারমণও সেই থেকে পুনরায় প্রেমের দেবতায় অধিষ্ঠিত হলেন। তাঁর বংশীধ্বনির আহ্বানে নারীর রমণেচ্ছা চিরায়ু হল আর পুরুষও তার নারীকে পুনরায় সম্ভোগে পূর্ণ করতে সক্ষম হল।

ব্যাসদেব শ্রীরাধিকার অন্তিম প্রণাম গ্রহণ করে পরিশেষে বললেন, ‘রাই রাধিকা, আমিও তোমাকে প্রণাম জানালাম। যদি তোমার আমার কাছে চাওয়ার মতো কিছু থাকে তবে নিঃশঙ্কচিত্তে নিবেদন করতে পারো। আমি তোমায় ক্ষমার অগ্নিতে নিজেকে শুদ্ধ করে নিয়েছি।’

হঠাৎ এই চরম মুহূর্তে লিপিকর গণেশ বলে উঠলেন, ‘মহর্ষি, আপনি বলেছিলেন যা আমি উপলব্ধির অন্তর্দেশে সমাগত হয়ে অনুভব করছি, রাইসুন্দরী বসুন্ধরার কৃত পাপের স্খলনের জন্য যা দিয়ে গেলেন সেই মহৎ কথা আমি যদি লিপিবদ্ধ না করি তবে লিপিকরের কার্যে অপূরণীয় ভ্রান্তি থেকে যাবে।

ব্যাসদেব বললেন, ‘সিদ্ধিদাতা গণেশ, আপনি জনগণের অধিনায়ক, সত্যিকারের প্রতিনিধি। তাই ব্রহ্মা লিপির কার্যের স্থূল পরিশ্রমটুকুর জন্য আপনার সমীপে আসতে বলেছিলেন। আমি বলেছিলাম, না বুঝে কিছু লিখবেন না; কিন্তু বর্ণনের পক্ষ অংশের অন্তর্ভুক্তির স্বাধীনতা লেখকের বা কবির। ফলে আপনার নিজস্ব অভিপ্রায় বলে কিছু থাকতে পারে না। আপনি আমার কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ, ফলে সেই প্রতিজ্ঞা থেকে কখনো চ্যুত হতে পারেন না।’

গণেশ আবার মৌনতায় প্রত্যাবর্তন করলে রাধা বলল, ‘মহর্ষি, আমার একটাই জিঞ্জাসা, ব্যাবহারের পর নারী কি বর্জ্য উপাচার ভিন্ন অন্য কিছু নয়?’

ব্যাসদেব বললেন, ‘রাই, স্বয়ং বাসুদেব তোমার আত্মদানে শাপমুক্ত হয়েছেন। ফলে কোনো পুরুষই আজ থেকে রাত নারীর মধ্যে রাধাভাবের সৃষ্টি না করতে পারলে রমণে সক্ষম হবে না।’

–তবে কি ভবিষ্যতের পৃথিবীতে নারীর ধর্ষণ হবে না?

–কয়েক যুগ ধরে হয়তো হবে না। মহাভারতের প্রতিনায়কদের মধ্যে কর্ণ সম্মানিত হবেন। চারণেরা ইতিমধ্যে বিভিন্ন গীত রচনা করে তাঁকে সম্ভাষিত করেছেন। কৃষ্ণপুত্র শাম্বও শাপমুক্ত হয়েছিলেন কেশবের। জীবদ্দশায়, তিনি এখন শাম্বাদিত্য হিসেবে পূজিত হচ্ছেন। মৈত্রেয় বনে অবস্থান কালে মহর্ষি নারদও জেনেছেন এই আত্মত্যাগের কাহিনি। তিনি উদগ্রীব শ্রীরাধিকার সকাশে আসতে। কৃষ্ণের কোনো পত্নী বা বৃন্দাবনের গোপিনীরা এই বিরল সম্মানের অধিকারী হবে না। যা হবে রাই সুন্দরী রাধা। কৃষ্ণ সমর্পিত শ্রীরাধিকার চরণে, রাইয়ের প্রসন্নতা ভিন্ন বৈকুণ্ঠেও তাঁর মুক্তি নেই। আর কী চাও তুমি রাধা?

রাধা মহাকালের বহু অন্তরে এতদিনে তৃপ্ত হলেও হেমন্তের অরণ্যে নিশাচর পাখি আসন্ন অরণ্যোদয়ের শুভ আকাঙ্খায় ডেকে উঠল। শিশিরে সিক্ত বসুন্ধরা পুরুষোত্তমের রমণের পূর্বে রাধাভাব নিয়ে জাগ্রত রইল। সভ্যতা, প্রকৃতি এক অনির্বচনীয় সুখানুভূতির সম্মুখে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণযুগের শ্রীরাধিকাকে অন্তিম প্রণাম জানাল। ব্যাসদেবও লিপিকর গণেশ-সহ সেই প্রণামে অংশ নিলেন। শুধু রাধার কারণে রাধারমণ কিছু হারালেন। না। যে-জীবন তিনি কুরুক্ষেত্রে কৃত পাপের কারণে, যদুবংশ নিধনে হারিয়েছিলেন, প্রাপ্ত হলেন। ব্যাসদেব নয় বহু যুগ যুগের অন্তরে ভক্তকবি জয়দেব বললেন, ‘দেহি পদপল্লব মুদারম্।’

শ্রীরাধিকা দেবী নন, মাতা নন, এক অনন্ত জীবনপ্রবাহ আর সৃষ্টির উৎসমুখে রইল পাপ-পুণ্যরহিত এক রমণ; তার ভোক্তা আর কেউ নন স্বয়ং পুরুষোত্তম, যুবতিশতবৃতং রাধারমণ।