অধ্যায় ৫০
বাইকে করে বারিধারা থেকে বনানী কবরস্তানে আসতে খুব একটা সময় লাগলো না।
কবরস্তানের বিশাল মেইনগেটের কাছে আসতেই চারু দেখতে পেলো একটা পাজেরো জিপ বেরিয়ে যাচ্ছে। আইন অমান্য করে কালচে রঙের কাঁচ ব্যবহার করা হয়েছে গাড়িটাতে, তাই ভেতরে কে আছে দেখতে পেলো না। অবশ্য দেখলেও কোনো লাভ হতো না, কারণ মিসাতের মাকে কখনও সামনাসামনি তো দূরের কথা টিভি কিংবা পত্রিকায়ও দেখেনি।
দামি গাড়ি আর আইন অমান্য করে কালো কাঁচ ব্যবহার করা হয়েছে বলে চারুর মনে হয়েছিলো, এটা মিসকাতের মায়ের গাড়ি হতে পারে। এ দেশের আইন প্রণয়নকারীরাই যে সবচেয়ে বেশি আইন ভঙ্গ করে সেটা কে
জানে!
কবরস্তানের বাইরে পার্কিং এরিয়ার কাছে আসতেই সতর্ক হয়ে উঠলো সে।
কিছু প্রাইভেটকারের পাশাপাশি একটা সিএনজিও আছে ওখানে!
অন্য গাড়িগুলোর কারণে সিএনজিটার লাইসেন্স নাম্বার দেখা যাচ্ছে না। চারু তার বাইকটা নিয়ে ছুটে গেলো পার্কিং এরিয়ার দিকে। বাইকের ইঞ্জিন বন্ধ করে হেলমেটটা না খুলেই এগিয়ে গেলো সিএনজির কাছে। দুরু দুরু বুকে সিএনজিটার পেছনে আসতেই চমকে উঠলো সে।
ঢাকা চ-১৩৫৮৯৭!
এই নাম্বারের সিএনজিই বাইকার বাবুকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে গেছিলো! ট্যাপার দেয়া নাম্বারও এটাই!
চারুর গায়ের পশম দাঁড়িয়ে গেলো সঙ্গে সঙ্গে। সিএনজির পেছন থেকেই বুঝতে পারলো, ভেতরে কেউ একজন বসে আছে।
সাহস সঞ্চয় করে বামদিকের গেটটা দিয়ে ভেতরে উঁকি দিলো সে। অচেতন এক লোক শরীর এলিয়ে দিয়ে পড়ে আছে প্যাসেঞ্জার সিটে!
লোকটাকে ধরে ঝাঁকুনি দিলো। নিঃশাস নিচ্ছে। বেঁচে আছে তাহলে। তবে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়া মানুষের মতোই বেহুঁশ সে।
চারু দ্রুত তাকালো রাস্তার দিকে। ঠিক যেখান দিয়ে একটু আগে পাজেরোটা যেতে দেখেছে। চোখ কুঁচকে দেখতে পেলো, গাড়িটা প্রায় অপসৃত এখন।
সময় নষ্ট না করে বাইকের দিকে ছুটে গেলো। উদভ্রান্তের মতো কিক দিয়ে ইঞ্জিন স্টার্ট করেই ছুটে গেলো পাজেরোটাকে ধরতে। যদিও জানে ওটার নাগাল পাওয়া সহজ হবে না। এরইমধ্যে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেছে গাড়িটা।
দ্রুত গতিতে বাইক নিয়ে ছুটে যাবার সময় একটা ভয় জেঁকে বসলো তার ভেতরে। বাইকের গতি আরো বাড়িয়ে দিলো সে। পাজেরোটার নাগাল তাকে পেতেই হবে। কোনো কিছু হবার আগেই।
প্রায় বিপজ্জনক গতিতে বাইক ছুটিয়ে গেলো চারু। পর পর বেশ কয়েকটি গাড়ি ওভার-টেক করার সময় দুয়েকজন ড্রাইভারের গালিও তার কানে গেলো। একবারের জন্য ফিরেও তাকালো না। তার দৃষ্টি সাপের মতো এঁকে বেঁকে চলে যাওয়া রাস্তার দিকে। পাজেরোটা দৃষ্টির সীমার ভেতরে এখনও আসেনি।
এমন সময় টের পেলো পকেটে থাকা মোবাইলফোনটা ভাইব্রেট করছে। কিন্তু চারুর পক্ষে এখন সেই কল ধরা সম্ভব নয়। সব কিছু অগ্রাহ্য করে ছুটে চলেছে সে। পাজেরোটা ধরতে পারলে কি করবে তা অবশ্য জানে না।
মোইবালফোনটা ভাইব্রেট করেই যাচ্ছে।
ঠিক এমন সময় দেখতে পেলো কয়েকশ’ গজ সামনে, রাস্তার উপর কিছু গাড়ি থেমে আছে। ঢং ঢং করে বাজছে ঘন্টা।
আরেকটু কাছে যেতেই দেখতে পেলো বনানী রেলক্রসিংয়ের উপরে লাল-সাদা দাগ কাটা ব্যারিকেডটা নেমে আসছে।
পাজেরোটার পেছনে হন্যে হয়ে ছোটার সময় পথে এমন একটা জিনিস বাধা হয়ে দাঁড়াবে সেটা ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি।
হতাশ হয়ে বাইকের গতি কমিয়ে দিলো সে। রেলক্রসিংয়ের কাছে আসতেই মানুষজনের চিল্লাফাল্লা শুনে মাথা উঁচু করে দেখার চেষ্টা করলো সামনের দিকে। যে দৃশ্যটা দেখতে পেলৌসেটার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না সে।
কালো কাঁচের পাজেরোটা রেলক্রসিংয়ের উপর থেমে আছে!
কয়েক মুহূর্ত লাগলো ব্যাপারটা বুঝতে। ব্যারিকেড নামার আগেই গাড়িটা তুলে দেয়া হয়েছে রেললাইনের উপরে। অতি পরিচিত একটা শব্দ শুনে বামদিকে তাকিয়ে দেখতে পেলো একটি আন্তঃনগর ট্রেন ছুটে আসছে হুইসেল বাজাতে বাজাতে।
রেলক্রসিংয়ের সামনে জড়ো হওয়া গাড়িগুলোর ড্রাইভাররা জানালার কাঁচ নামিয়ে পাজেরোর উদ্দেশ্যে চিৎকার করে সরে যেতে বলছে।
চারু তার বাইকের ইঞ্জিন বন্ধ করে দ্রুত সেটা স্ট্যান্ডের উপর দাঁড় করিয়ে যেই না ছুটে যাবে, তখনই বুঝে গেলো বড্ড দেরি হয়ে গেছে।
প্রচণ্ড গতিতে ছুটে আসা ট্রেনের আঘাতে পাজোরোটা খেলনার গাড়ির মতো দুমরে মুচরে ছিটকে গেলো চোখের সামনে।
চারু শুধু একটা কথাই ভাবতে পারলো-চাঁন মিয়া এইমাত্র প্রতিশোধ চরিতার্থ করার জন্য সুইসাইড করেছে!
.
অধ্যায় ৫১
বনানী রেলক্রসিং আপাতত বন্ধ।
মারাত্মক একটি দূর্ঘটনা ঘটে গেছে এখানে। রেলক্রসিংয়ের উপরে বিলাশবহুল একটি পাজেরো ট্রেনের আঘাতে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেছে। ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেয়া হয়েছে দুমড়েমুচড়ে যাওয়া গাড়ির ভেতর থেকে লাশ বের করার জন্য। পুলিশ ঘিরে রেখেছে জায়গাটি। চারপাশ থেকে উৎসুক মানুষের ভিড় বাড়ছে ক্রমশ।
চারু আহসান সেই ভিড় থেকে একটু দূরে নিজের বাইকটার পাশে দাঁড়িয়ে আছে, তার সাথে আছে ডিবি অফিসার মুর্তজা। এমপির গাড়িটার পিছু নেবার সময়ই মুর্তজা বনানী কবরস্তানের কাছে চলে এসেছিলো একটা সিএনজি নিয়ে, চারুকে বাইক নিয়ে ছুটে যেতে দেখেছে সে। কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরে তার পিছু নেয়। বার কয়েক মোবাইলফোনে তাকে কলও করেছিলো, কিন্তু চারু সাড়া দেয়নি।
বনানীর রেলক্রসিংয়ের কাছে চারুর বাইকটা থামতে দেখে দূর থেকে, তারপরই অন্য সবার মতো ট্রেনের আঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ হতে দেখে একটি পাজেরো গাড়ি।
চারু বুঝতে পারছে, চাঁন মিয়া সুকৌশলে এমপির ড্রাইভারকে অজ্ঞান করে ড্রাইভার সেজে এ কাজ করেছে। সম্ভবত, মিসকাতের মা যখন ছেলের কবর জিয়ারত করছিলেন তখনই এটা করেছে সে।
“গাড়ির ড্রাইভার অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে কবরস্তানের বাইরে…চাঁন মিয়ার সিএনজিটার ভেতরে,” আস্তে করে বলল চারু। এভ
“কী ভয়ঙ্কর লোক!” মুর্তজা বলল বিস্ময়ে।
“কবরস্তান থেকে বের হবার সময় আমি এমপির গাড়িটা দেখেছিলাম কিন্তু তখন বুঝতে পারিনি।”
। “ঐ সিএনজিটা যে চাঁন মিয়ার সেটা কিভাবে বুঝলেন?” জানতে চাইলো ডিবি অফিসার।
“নাম্বার দেখে।”
একটু ভেবে মুর্তজা আবার বলল, “গাড়ির যা অবস্থা লাশদুটো বের করতে খবর হয়ে যাবে।”
অফিসারের দিকে তাকালেও চারু কিছু বলল না। গাড়িটার দোমড়ানো মোচড়ানো অবয়ব একটু দূরেই পড়ে আছে। ওটাকে দলা পাকানো স্টিলের দঙ্গল ছাড়া আর কিছু মনে হচ্ছে না।
পুলিশের এক কনস্টেবল হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো তাদের কাছে। “ছার…ভিতরে তো একজরে দেখতাছি…এক মহিলা…কুনো ডেরাইবার নাই।”
কপাল কুঁচকে ফেলল মুর্তজা। “বলো কি!”
“একজন?! শুধু একজন মহিলা?” অবিশ্বাসে বলে উঠলো চারু।
“হ…আমি ফাঁকফোকর দিয়া ভালা কইরা দেখছি, ভিতরে একটাই লাশ।”
কনস্টেবলের কথা শুনে চারু আর মুর্তজা একে অন্যের দিকে চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। তারপরই যেন টনক নড়লো ওদের।
“কবরস্তানের পার্কিং এরিয়ায় সিএনজিটা আছে!” বাইকের উপরে উঠে বসলো চারু।
মুর্তজাও দ্রুত তার বাইকের পেছনে উঠে বসলো। “জলদি চলেন?” তাড়া দিলো সে।
বাইকটা ঘুরিয়ে তারা ছুটলো বনানী কবরস্তানের দিকে।
চারু বুঝতে পারছে না চাঁন মিয়া কিভাবে চোখের সামনে এমন ভেলকি দেখালো! গাড়িটা রেললাইনের উপরে তুলে দিয়ে কোন ফাঁকে হাওয়া হয়ে গেছে? সে ভেবেছিলো সুরুজের বিক্ষুব্ধ বাবা আত্মঘাতি হয়েছে। নিজের জীবন বিপন্ন করে এমপিকে হত্যা করেছে।
“ঐ লোকটা গাড়ি থেকে কেমনে নামলো?” বাইকের পেছন থেকে একটু চেঁচিয়ে বলল ডিবি অফিসার।
“বুঝতে পারছি না। আমি যখন এখানে আমি তখন গাড়িটা রেললাইনের উপরে দেখেছি,” চারু বলল। “আর কিছু দেখিনি।”
“আমিও দূর থিকা সেটাই দেখছি।”
“আমরা আসার আগেই হয়তো গাড়ি থেকে নেমে সটকে পড়েছে।”
“তাইলে কি এমপিরেও সে অজ্ঞান কইরা ফাইলাছিলো?”
চারুর তেমনটাই মনে হচ্ছে। নইলে চাঁন মিয়া নেমে যাবার পর তিনি বের হয়ে যেতেন। “মনে হয়…”
মুর্তজা কিছু না বলে শুধু মাথা দোলাল। কয়েক মুহূর্ত তারা কিছুই বলল না।
বনানী কবরস্তানের কাছে আসতেই বাইকের গতি কমিয়ে দিলো চারু। কবরস্তানের বাইরে পার্কিং এরিয়ায় দুয়েকটা প্রাইভেটকার থাকলেও সেখানে কোনো সিএনজি নেই।
“সিএনজিটা কই?” মুর্তজা বলে উঠলো।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা দোলাল চারু।
“এমপির ড্রাইভার?”
অচেতন লোকটাকে নিশ্চয় নিরাপদ কোথাও ফেলে দেবে চাঁন মিয়া। তার জীবনহানি হবার সম্ভাবনা কম। চারু অন্তত সে আশঙ্কা করছে না।
“চাঁন মিয়ার সিএনজির নাম্বারটা আমি জানি…পুলিশ চাইলে দ্রুত ওটা ধরতে পারবে।”
“আমি এখনই পুলিশরে জানায়া দিতাছি,” জবাবে বলল মুর্তজা। “আপনে আমারে নম্বরটা দেন।”
.
অধ্যায় ৫২
ডক্টর আজফার হুসেন গম্ভির হয়ে বসে আছেন।
একটু আগে চারুর কাছ থেকে ডক্টর আর মায়া জানতে পেরেছে মিসকাতের মায়ের করুণ পরিণতির কথা। সবটা শুনে এখন অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছেন আজফার হুসেন। মায়াও চুপ মেরে আছে। একটা কথাও বলছে না।
টোটা এসে তাদের জন্য চা-কফি দিয়ে যাবার সময়ও ঘরের গুমোট পরিবেশটা আঁচ করতে পেরেছে।
চারু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চায়ের কাপটা তুলে নিলো। যেন এই পরিবেশ থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্য চা পানই একমাত্র অবলম্বন।
মায়া অবশ্য সেরকম কিছু করলো না। উদাস হয়ে জানালা দিয়ে বাইরের লনের দিকে চেয়ে রইলো।
“এমপির ড্রাইভারের কোনো খোঁজ পাওয়া গেছে?” ডক্টর জানতে চাইলেন অবশেষে।
“এয়ারপোর্ট রোডে রাস্তার পাশে অজ্ঞান অবস্থায় পুলিশ উদ্ধার করেছে তাকে।”
“যাক, একজন নির্দোষ মানুষকে অন্তত খুন করেনি ঐ লোক।”
“কিন্তু সিএনজিটার কোনো হদিস বের করা যায়নি এখনও।”
মাথা নেড়ে সায় দিলেন ডক্টর হুসেন। “এই চাঁন মিয়া লোকটা যে রকম ধূর্ত আর ক্যাপাল, মনে হচ্ছে না কাজটা সহজ হবে।”
চারু কিছু বলল না। যদিও ডক্টরের কথার সাথে দ্বিমত প্রকাশ করার কোনো কারণ নেই। ডিবির মুর্তজা অবশ্য উঠেপড়ে লেগেছে। সে বলেছে, সিএনজিটা ধরতে পারলেই চারুকে ফোন করে জানাবে।
“তবে একটা কথা না বললেই নয়,” বললেন ডক্টর। “এ পর্যন্ত তোমরা যা করেছে সেটা কিন্তু প্রশংসার যোগ্য।”
মায়া আর চারু তার দিকে তাকিয়ে রইলো।
“ডিবি-পুলিশ অনেকদিন ধরে ইনভেস্টিগেট করেও কিছুই করতে পারেনি। সেদিক থেকে দেখলে ইউ হ্যাভ ডান অ্যা গ্রেট জব।”
“ক্রেডিটটা মি. চারুকেই দিন,” মায়া বলল। “এখানে আমার তেমন কোনো ভূমিকা নেই, যা করার উনিই করেছেন।”
চারু কিছু না বলে নির্বিকার থাকার চেষ্টা করলো।
“না না, আমি সেটা মনে করি না। এক টিমে থাকলে কমবেশি সবাই কনট্রিবিউট করে। চারু হয়তো বেশি করেছে, কিন্তু তুমি কিছু করোনি সেটা ঠিক না।” যুক্তিবাদির দিকে তাকালেন ডক্টর। “কি বলো তুমি?”
“তা তো অবশ্যই,” আস্তে করে বলল সে।
“যাই হোক, তারপরও আমি মনে করি না এখানে আমি কিছু করেছি।”
চারু কিছু বলতে যাবে অমনি তার ফোনটা বেজে উঠলো। পকেট থেকে ফোনটা বের করে ডিসপ্লে দেখে সঙ্গে সঙ্গে কলটা রিসিভ করলো সে। ডিবির মুর্তজা ফোন করেছে। সম্ভবত সিএনজিটা উদ্ধার করা গেছে। হয়তো চাঁন মিয়াকেও ধরতে পেরেছে পুলিশ।
“কি খবর বলেন?”
“এই চাঁন মিয়া তো গভীর জলের মাছ…” ফোনের ওপাশ থেকে বলল ডিবি অফিসার।
“কেন, কি হয়েছে?” উৎসুক হয়ে উঠলো চারু। “এখনও ধরতে পারেননি, তাই না?”
“দুইদিন আগে কুড়িল থানায় সিএনজি চুরির জিডি করছে ঐ লোক। বোঝেন এইবার!”
নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো চারু। এতটা সে-ও আশা করেনি। চাঁন মিয়া যে আসলেই ধুরন্ধর সেটা বুঝতে তার অন্তত বাকি নেই।
“কি প্ল্যান করছে ভাবেন একবার,” মুর্তজা বলে যাচ্ছে, “এখন তো ধরা পড়ার পর কইবো, তার সিএনজিটা চুরি কইরা অন্য কেউ আকামটা করছে।”
একটু ভেবে চারু বলল, “হুম, তা হয়তো বলবে। তবে আপনারা চেষ্টা করেন লোকটাকে আগে অ্যারেস্ট করতে।”
“তা তো করুমই। কিন্তু যে লোকের পাল্লায় পড়ছি…মনে হইতাছে না কাজটা এত সহজে করন যাইবো।”
একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো চারুর ভেতর থেকে।
“আপনে চিন্তা কইরেন না, কি হইলো না হইলো সব আপনেরে আমি জানামু।”
“থ্যাঙ্কস,” বলে কলটা কেটে দেবার পর ডক্টর আর মায়ার দিকে তাকালো সে। “দু-দিন আগে চাঁন মিয়া তার সিএনজি চুরির জিডি করেছে থানায়।”
“ওহ!” আর্তনাদের মতো করে উঠলেন আজফার হুসেন।
গভীর করে নিঃশ্বাস নিলো মায়া।
“আমার মনে হয়, তোমাদের অ্যাসাইনমেন্টটা এখানেই শেষ করে দেয়া দরকার,” ডক্টর বললেন।
তার কথা শুনে চারু সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো, “কেন?”
“এর জবাব তো খুব সহজ। মিসকাতের খুনটা কে করেছে সেটা তোমরা বের করে ফেলেছে।”
“কিন্তু খুনি তো এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে…ওকে না ধরে।”
চারুর কথার মাঝখানে হাত তুলে থামিয়ে দিলেন আজফার হুসেন। “খুনিকে ধরার অ্যাসাইনমেন্ট কিন্তু আমি দেইনি। এটা ভুলে যাচ্ছো কেন?”
হতোদ্যম হয়ে পড়লো চারু আহসান। ডক্টর ঠিকই বলেছেন। তাদের কাজ ছিলো রহস্যটার সমাধান করা-অপরাধিকে পাকড়াও করা নয়।
“বাকি কাজটা পুলিশের…এ ব্যাপারে তোমাদের কিছু করার নেই। কিছু করতে যাওয়াটাও ঠিক হবে না।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো মায়া।
“কিন্তু উনি যে আরেকজন সহযোগির কথা বলেছিলেন, সেটার কি হবে?” মায়াকে দেখিয়ে বলল।
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ডক্টর। “সেটা চাঁন মিয়া ধরা পড়ার পরই জানা যাবে। অপেক্ষা করে দেখো পুলিশ কি করে।”
“পুলিশ যদি ঐ লোকটাকে ধরতে না পারে?”
কাঁধ তুললেন আজফার হুসেন। “তাহলে আর কী, অসংখ্য অমীমাংসিত ঘটনার সাথে আরেকটি ঘটনা যোগ হবে।”
চারুর চোখেমুখে অবিশ্বাস। “এটা কী বললেন! এরকম তো কথা ছিলো না।”
মাথা দোলালেন ডক্টর। “এরকমই কথা ছিলো, মাই ডিয়ার চারু, মায়ার দিকে তাকালেন তিনি। মেয়েটা এখনও উদাস হয়ে চেয়ে আছে। “আমি তোমাদেরকে যে রহস্যটার সমাধান করতে দিয়েছিলাম সেটার সমাধান তোমরা সফলভাবেই করতে পেরেছে।”
কথাটা মানতে না পেরে বলে উঠলো যুক্তিবাদি, “চাঁন মিয়ার সহযোগি অশরীরি নাকি জীবিত কেউ…সুরুজ এখনও বেঁচে আছে কিনা…এসবের কিন্তু সমাধান হয়নি?”
মাথা নেড়ে সায় দিলেন ডক্টর। “সব রহস্যের সবটা সমাধান হয় না। কিছু না কিছু রহস্য থেকেই যায়। এটা তোমাকে মেনে নিতে হবে। আর যদি না মানতে চাও আমার কিছু করার নেই। আমি যে অ্যাসাইনমেন্টটা তোমাদেরকে দিয়েছিলাম সেটা শেষ। ইটস ওভার।”
“আপনি বললেই হলো!” রেগেমেগে বলে উঠলো চারু আহসান। “আমি এর শেষ দেখে ছাড়বো।”
ছল ছল চোখে তার দিকে তাকালো মায়া।
আক্ষেপে মাথা দোলালেন ডক্টর। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “সেটা তোমার ব্যাপার।”
“আপনাকে একটা কথা বলি,” জানালার পাশ থেকে বলে উঠলো মেয়েটা।
ডক্টর আর চারু দু-জনেই তাকালো মেয়েটার দিকে।
“এটা নিয়ে আর কিছু করবেন না, প্লিজ। আপনার ক্ষতি হয়ে যাবে।”
কয়েক মুহূর্ত স্থিরচোখে চেয়ে রইলো চারু। কিছু বলতে গিয়েও বলল না। চুপচাপ উঠে কাউকে কিছু না বলে বের হয়ে গেলো ডক্টরের বাড়ি থেকে।
.
অধ্যায় ৫৩
ঐদিন ডক্টরের বাড়ি থেকে বের হবার পর তিন-চারদিন অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও এক ধরণের রাগ-ক্ষোভ আর কষ্ট থেকে মায়ার সাথে যোগাযোগ করেনি চারু। মেয়েটা একটাবার তাকে ফেসবুকে নক করলেও সাড়া দেয়নি। তবে ইনবক্সে মেসেজ দিয়ে সে জানিয়েছে কয়েক দিনের জন্য রাঙামাটি থেকে ঘুরে আসার কথা ভাবছে। অবশ্য কবে যাবে, কতোদিন থাকবে সে-সম্পর্কে কিছু বলেনি।
এ কয়দিন চারু ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যে সময় কাটিয়েছে। র্যাশনালিস্ট সোসাইটির কিছু জরুরি মিটিং আর নতুন একটি চ্যালেঞ্জ নিয়ে সময়টা কেটে গেছে তার। চ্যালেঞ্জটা মোটেও কঠিন কিছু ছিলো না, এক বসাতেই উড়িয়ে দিতে পেরেছে।
এক উজবুক এসে দাবি করে দেশের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে ফাইল্যা বাবা নামের কামেল এক লোকের মাজার আছে, সেই মাজারে খাস দিলে মানত করে দুই কেজি চিনি নিয়ে রাখলে যার মনোবাঞ্ছা কবুল হবে না তার চিনি কিছুক্ষণের মধ্যে লবন হয়ে যায়। আর যারটা চিনি থেকে যাবে বুঝতে হবে তার মনোবাঞ্ছা পূরণ হবে।
চ্যালেঞ্জটা শুনেই মনে মনে হেসে ফেলেছিলো চারু। লোকটাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করে জানতে পারে, মাজারের যাবার আগে একটি বাজার আছে, সেই নির্দিষ্ট বাজারের নির্দিষ্ট কিছু দোকান থেকে একদামে চিনি কিনতে হবে। অন্য কোথাও থেকে কিনলে হবে না। চিনি কেনার সময় দামাদামি করলে মানত নষ্ট হয়ে যাবে।
মুচকি হেসে চারু বলেছিলো, এইসব ফালতু চ্যালেঞ্জের জন্য কষ্ট করে অতো দূরে যাবার কোনো মানে হয় না। কেরামতির নামে বাটপারিটা সে ঢাকায় বসেই ধরে ফেলতে পেরেছে। এ কথা শুনে লোকটা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলো। চারু তাকে বলে, যদি লবন নিয়ে গেলে চিনি হতো তাহলে সে বুঝতো মাজারের কিছু কেরামতি আছে। কিন্তু চিনির লবন হয়ে যাওয়াটা স্পষ্ট করে দিচ্ছে ওখানে বেশ ভালো রকমের ‘বাণিজ্য’ করছে একদল লোক। মাজারের খাদেম আর বাজারের ব্যবসায়িরা দারুণ একটি কৌশল খাঁটিয়েছে। ম্যাজিশিয়ানদের মতো হাত সাফাইয়ের খেল ব্যবহার করে চিনির বদলে লবন দিয়ে দিচ্ছে। চিনি আর লবনের দামের হেরফেরই বলে দেয় এই কেরামতির আসল রহস্য কোথায় লুকিয়ে আছে।
এরকম ফালতু চ্যালেঞ্জ তার দলের জুনিয়র সদস্যরাই মোকাবেলা করতে প্রস্তুত এখন। তার অনুপস্থিতিতে জুনিয়ররা কিছু চ্যালেঞ্জ সফলভাবে মোকাবেলাও করেছে।
যাই হোক, র্যাশনালিস্ট সোসাইটির কাউকে সে চাকরির ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু জানায়নি বলে সোসাইটির সদস্যরা একটু অবাকই হয়েছে। তার এমন রহস্যজনক আচরণের কারণ কি ভেবে পায়নি কেউ।
.
দেখতে দেখতে রুমমেট আশফাঁকের ব্যাচেলর পার্টির দিনটি চলে এলো। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে পার্টিতে যোগ দেবার জন্য গুলশানের একটি রেস্টুরেন্টোর উদ্দেশে বাইক নিয়ে রওনা হলো চারু। জায়গাটা ডক্টরের বাড়ির কাছেই।
গুলশান দুই নম্বর গোল চক্করটার কাছে আসতেই সে দেখতে পেলো ডক্টরের গাড়িটা। এই গাড়িটা সে ভালোমতোই চেনে। দুয়েকবার ব্যবহার করেছে তদন্তের কাজে। গাড়িতে অবশ্য ডক্টরকে দেখতে পেলো না, প্যাসেঞ্জার সিটে গুরুগম্ভির হয়ে বসে আছে টোটা।
চারুর একটু কৌতূহল হলো, কেন হলো সে জানে না। কোনো কিছু না ভেবেই সেই গাড়িটা অনুসরণ করতে শুরু করলো। হাতে সময় আছে, পার্টিতে পনেরো-বিশ মিনিট লেট করে গেলে এমন কিছু হবে না।
কিছুক্ষণ অনুসরণ করার পরই অপার বিস্ময় নিয়ে চারু আবিষ্কার করলো ডক্টরের গাড়িটা কুড়িল বস্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
প্রচণ্ড কৌতূহল আর সন্দেহ মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। গাড়িটাকে অনুসরণ করে যেতে লাগলো সে। তাকে দেখতেই হবে এটা। ডক্টর আজফার হুসেনের খাস লোকটি কুড়িল বস্তিতে কেন যাবে?
হাজারটা ভাবনা চারুর মাথায় এসে ভর করলো। সবগুলোই সন্দেহ আর অবিশাস থেকে।
ডক্টরের গাড়িটা থামলো কুড়িল বস্তির সামনেই। কিছুক্ষণ পর টোটা নামের বামনটি রাজসিক ভঙ্গিতে নেমে পড়লো। আশেপাশের লোকজন তাকে উৎসুক হয়ে দেখতে লাগলেও টোটা সেসব আমলে না নিয়ে সোজা হেঁটে গেলো বস্তির দিকে।
অনেকক্ষণ বাইকের উপর বসে রইলো চারু। তার মাথায় কিছুই ঢুকছে। সে কেবল বুঝতে পারলো, এই ডক্টরের সাথে আর না। লোকটা যেমন ধূর্ত তেমনি বিপজ্জনক। বার বার তাকে বোকা বানাচ্ছে। কিন্তু কেন?
এমন সময় তার ফোনটা বেজে উঠলো। আশফাঁক ফোন দিয়েছে। কলটা রিসিভ করে চারু সংক্ষেপে জানিয়ে দিলো, সে আসছে। খুব কাছেই আছে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাইকটা ঘুরিয়ে আবারো গুলশানের দিকে চলে গেলো সে। সিদ্ধান্ত নিলো আজকের পার্টির পর এ নিয়ে ভাববে। এখন এসব ভেবে ভেবে আনন্দ মাটি করার কোনো মানেই হয় না।
বন্ধুর পার্টিতে গিয়ে একটু গম্ভির হয়ে রইলো সে। এক ধরণের অস্বস্তিও পেয়ে বসলো, কারণ আশফাঁকের তিনজন কলিগ ছাড়া আর কাউকে বলা হয়নি। ওদের সাথে চারুর তেমন একটা পরিচয় নেই। অপরিচিত মানুষজনের সাথে বসে পানাহার করতে খুব একটা স্বস্তি বোধ করে না সে।
ব্যাচেলর জীবনের শেষ আড্ডায় আশফাঁক বেশ উদারভাবেই বন্ধুদেরকে উদরপূর্তি করালো। মুখরোচক খাবারের পর স্কচ, ভদকা আর বিয়ারের পর্বটা জমলো বেশ। শুরুতে যে অস্বস্তি ভাব ছিলো সেটা কেটে গেলো। বিশেষ করে সবার পেটে স্কটল্যান্ডের পানি পড়তেই জমে উঠলো পার্টি। চারুর ধারণা ছিলো তাদের এই আড্ডাটা সর্বোচ্চ রাত নটা পর্যন্ত গড়াতে পারে। কিন্তু পানপর্ব শুরু হবার পর সেটা রাত এগারোটায় গিয়েও শেষ হতে চাইলো না।
তবে রাত এগারোটার পর অবশ্য আশফাঁকের দু-জন বিবাহিত কলিগের টনক নড়ে উঠলো। ঘরে তাদের বউ বিদ্রি রজনি কাটাছে, আর বেশি দেরি করা ঠিক হবে না। পথঘাটের অবস্থাও ভালো নয়। এরইমধ্যে যথেষ্ট রাত হয়ে গেছে। আজকের এই মিলনমেলা এখানেই শেষ করা দরকার।
আশফাকের বিয়ের অনুষ্ঠানে আবার দেখা হবে, এমন প্রত্যাশা নিয়ে একে একে সবাই যার যার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলো।
কয়েকদিন আগেই চারুর রুমমেট ফ্ল্যাট ছেড়ে দিয়েছে বলে তাকে একাই রওনা দিতে হলো। আশফাঁক অবশ্য তাকে বলেছিলো, এমন অবস্থায় বাইক চালিয়ে যেতে পারবে কিনা। সে হেসে জানিয়েছে, কোনো সমস্যা নেই। যে পরিমাণ খেয়েছে তাতে করে বাইক চালিয়ে যেতে কোনো সমস্যা হবে না।
কিন্তু এখন গুলশানের প্রায় ফাঁকা রাস্তা দিয়ে বাইক চালাতে গিয়ে টের পাচ্ছে ড্রিঙ্কের মাত্রা একটু বেশিই হয়ে গেছে। দৃশ্যগুলো গুলিয়ে যাচ্ছে। মাথাটা পুরোপুরি ফাঁকা অনুভূত হচ্ছে এখন। মদের প্রভাব শুরু হয়ে গেছে, বাইকের ভারসাম্য রাখতে বেগ পাচ্ছে সে। নিজেকে ধাতস্থ করার জন্য বাইকটা থামিয়ে রাস্তার পাশে ফুটপাতে বসে একটু জিরিয়ে নেবে কিনা ভেবে দেখলো। যদিও কাজটা করা বুদ্ধিমানের হবে না। এরকম রাতে নির্জন পথে ছিনতাইকারি আর চোর-ডাকাতের কবলে পড়তে পারে। তার বাইকটা ছিনতাই হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আরো আছে টহল পুলিশের ভয়। তাকে ফুটপাতে বসে থাকতে দেখলে ওদের সন্দেহ হবে। আর সন্দেহ হলেই জিজ্ঞাসাবাদ করবে। বুঝে যাবে প্রচুর মদ খেয়ে খানিকটা বেসামাল হয়ে পড়েছে সে। তখন হয়তো তাকে থানায় নিয়ে যাবার চেষ্টা করবে, নইলে পাঁচশ’-হাজার টাকা হাতে গুঁজে দিয়ে রেহাই পেতে হবে।
তিন পেগ হুইস্কির পর দুটো বিয়ার খাওয়া একদম ঠিক হয়নি। বিশেষ করে বিয়ারগুলোর অ্যালকোহল যখন পনেরো ভলিউমের ছিলো। নিজেকে ভৎর্সনা করলো চারু। একবার ভাবলো, মুখে আঙুল দিয়ে বমি করে দেবে কিনা। বমি করে দিলে নেশা একটু কমে যেতো। কিন্তু এসবের কোনোটাই সে করলো না, শুধু বাইকের গতি একটু কমিয়ে দিলো।
রাস্তার বামপাশ ঘেষে ধীরগতিতে বাইক চালাতে অবশ্য বেগ পেলো না। এভাবে চালিয়ে কোনোমতে বাড়িতে পৌঁছাতে পারলেই হলো। হেলমেটের ফেস-শিল্ডটা তুলে দিলো, বাতাসের ঝাঁপটা মুখে এসে লাগতেই একটু ভালো লাগলো। বুক ভরে নিঃশাস নিলো সে।
সে ঠিক এমন সময় তাকে অতিক্রম করে চলে গেলো একটা সিএনজি।
কোনো প্রাইভেটকার কিংবা গাড়ি হলে তার মনোযোগ আকর্ষণ হতো, কিন্তু সিএনজি বলেই চারুর নজর চলে গেলো গাড়িটার দিকে। তাকে ওভারটেক করে সামনের দিকে ছুটে যাচ্ছে ওটা।
সহজাতভাবেই তার চোখ চলে গেলে সিএনজিটার লাইসেন্স প্লেট নাম্বারের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে পিটপিট করে তাকালো সে। ভালো করে দেখার চেষ্টা করলো। বাইকের গতি আরেকটু বাড়িয়ে দিলো ধাবমান সিএনজিটার আরো কাছে এগিয়ে যাবার জন্য।
কয়দিন আগেও ঢাকার প্রধান প্রধান রাস্তায় বিভ্রান্তিকর হলদেটে আলোর সোডিয়াম বাতি ছিলো, এখন সে জায়গা দখল করেছে তীব্র সাদা আলোর এলইডি লাইট। সোডিয়াম বাতি থাকলে হয়তো চারুর চোখে নাম্বারটা ধরা পড়তো না। কিন্তু পরিস্কার এলইডি বাতির কারণে স্পষ্ট দেখতে পেলো সেটা।
ঢাকা চ-১৩৫৮৯৭!
চারু রোমকূপ দাঁড়িয়ে গেলো সঙ্গে সঙ্গে। সিএনজিটার পেছন থেকে দেখতে পেলো একজন যাত্রিও আছে। কৌতূহল চেপে বসলো তার মধ্যে। হিতাহিতজ্ঞানশূণ্য হয়ে বাইকের গতি বাড়িয়ে দিলো সে।
অল্পক্ষণের মধ্যে সিএনজিটার বামপাশে চলে আসতে পারলো। দুচোখ কুঁচকে ভালো করে দেখার চেষ্টা করলো গাড়ির ভেতরে কে বসে আছে। এই লোকটাই কি তবে চাঁন মিয়ার সমস্ত অপকর্মের সহযোগি?
কিন্তু প্যাসেঞ্জার সিটের দরজার গ্রিলের ভেতর দিয়ে যে দৃশ্যটা চারু দেখতে পেলো সেটার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না।
অল্পবয়সি এক ছেলে বসে আছে চুপচাপ। চারুর উপস্থিতি টের পেয়ে একটু ঝুঁকে মাথাটা কাত করে স্থিরদৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে। চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে যেন। ঠোঁটে অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠলো ছেলেটার। তারপর চারুকে অপ্রস্তুত করে দিয়ে ডানহাতটা তুলে ধীরে ধীরে নাড়তে লাগলো। যেন তাকে টাটা দিচ্ছে।
ভয়ের একটি শীতল স্রোত বয়ে গেলো চারুর শিরদাঁড়া বেয়ে। সুরুজ!
ছেলেটার চেহারা হুবহু চাঁন মিয়ার মতোই, শুধু বয়সটা কম। সে শুনেছে সুরুজ নাকি দেখতে হুবহু তার বাবার মতো ছিলো!
অসম্ভব!
কিন্তু চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছে। একটুও ভুল হবার নয়।
আচমকা প্রবল ঝাঁকুনি খেয়ে চারুর সমস্ত দুনিয়া টলে গেলো। কয়েক মুহূর্তের জন্য তার মনে হলো সে বুঝি শূন্যে ভাসছে।
তারপর আরেকটা তীব্র ঝাঁকুনিতে তার সমস্ত শরীর দুমড়ে মুচরে গেলো। টের পেলো মাথা থেকে কিছু একটা ছিটকে গেছে।
এলইডি লাইটের উজ্জ্বল আলোগুলো নিভে গেলো এক ফুৎকারে।
.
উপসংহার
বাবা হাত বাড়িয়ে দিলে, সেই হাতটা ধরলো চারু।
কিন্তু বাবার হাত এত নরম ছিলো কি? মনে করতে পারলো না। অনেকদিন আগের কথা। বাবার ছবিটাই যেখানে ঝাপসা হয়ে গেছে সেখানে তার হাত নরম কি শক্ত ছিলো সেটা মনে থাকার কথা নয়।
হাত ধরে বাবার সাথে হেঁটে যাচ্ছে চারু।
“বাবা, আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
ছেলের কথায় তার বাবা ফিরে তাকালো। মুখ তুলে বাবার হাসিটা দেখলো সে। বাবা কিছুই বলল না।
“বাবা, আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
প্রশ্নটা আবারো করলো। এবারও কোনো জবাব পেলো না। অস্থির হয়ে উঠলো চারু। একটু রাগও হলো। বাবা কথা বলছে না কেন? তার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন না কেন?
অভিমানে বাবার হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করলো সে, কিন্তু শক্ত করে ধরে রেখেছে।
“চারু! চারু!”
কণ্ঠটা তাকে রীতিমতো ঝাঁকি দিয়ে জাগিয়ে দিলো।
চোখ খুলে দেখতে পেলো মায়াবি একটা মুখ চেয়ে আছে তার দিকে। কিন্তু সেটা তার বাবার মুখ নয়।
কয়েক মুহূর্ত লেগে গেলো মুখটা চিনতে।
মায়া!
তার একটা হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে মেয়েটা। তার একচোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। পরক্ষণেই বুঝতে পারলো ওটা কি। একটা টিয়ার ড্রপ ট্যাটু!
ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইলো চারু। তারপরই হাসপাতালের সুপরিচিত গন্ধটা নাকে এসে লাগলো। ঘরের চারপাশে তাকাতেই দেখতে পেলো মায়ার বিপরীতে, তার বেডের আরেক দিকে বসে আছেন ডক্টর আজফার হুসেন। তার প্রিয় ছরিটার উপরে দু-হাত রেখে তার উপরে রেখেছেন থুতনিটা। চারুর সাথে চোখাচোখি হতেই স্মিত হাসি দিলেন তিনি।
“উত্তেজিত হবার কিছু নেই, ভরাট কণ্ঠে বললেন ডক্টর। “বিপদ কেটে গেছে। ইউ আর অলরাইট।”
চারু উঠে বসতে যাবে অমনি মায়া বলে উঠলো, “প্লিজ, ওঠার দরকার নেই।”
“আ-আমার কি হয়েছে?” অস্ফুটস্বরে বলতে পারলো সে।
“আপনার কিছুই মনে নেই?” মায়া অবাক হলো। এখনও তার হাতটা ধরে রেখেছে।
চারু মনে করার চেষ্টা করলো। সঙ্গে সঙ্গে টের পেলো মাথায় চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে। চোখ কুঁচকে ফেলল সে। তার মাথার পুরোটাই ব্যান্ডেজে ঢাকা।
“মাথার আঘাতটা তেমন গুরুতর কিছু না,” ডক্টর বললেন। “হেলমেট পরা ছিলো বলে বেঁচে গেছে। তবে কপাল আর মাথায় সাত-আটটা স্টিচ দিতে হয়েছে। ডাক্তার বলেছে, মাথা নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলবে।”
“তবে আপনি পায়ে বেশ ভালো ব্যথা পেয়েছেন,” মায়া বলল।
সঙ্গে সঙ্গে চারুর বুকটা ছ্যাৎ করে উঠলো। আমার পা কি আছে? কেটে ফেলেনি তো?
“সামান্য আঘাত…একটু ফ্র্যাকচার…আর কিছু না,” ডক্টর আজফার যেন তার মনে কথা বুঝতে পেরেছেন। একটু হেসে আশ্বস্ত করলেন তাকে। “একটু বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।”
তারপরও চারু তার পায়ের দিকে তাকালো। চাদরে ঢেকে থাকার কারণে ঠিক বুঝতে পারলো না পা-দুটো অক্ষত আছে কিনা। পা দুটো নড়াচড়া করার চেষ্টা করলো।
“বললাম তো, সব ঠিক আছে,” ডক্টর আবারো তাকে আশ্বস্ত করলেন। “বাম পা-টা ভেঙে গেছে। ডান পায়ের পাতায় ফ্র্যাকচার হয়েছে সামান্য।”
মায়া আস্তে করে তার হাতটা ছেড়ে দিলো। “ডাক্তার বলেছে আপনি ড্রাঙ্ক ছিলেন।”
মেয়েটার দিকে স্থিরচোখে চেয়ে রইলো চারু।
“এরকম অবস্থায় কেউ বাইক চালায়,” অনুযোগের সুরে বলল সে।
চারুর মনে পড়ে গেলো আশফাঁকের ব্যাচেলর পার্টির কথা। খানাপিনা আর মদ্যপান…চাঁন মিয়ার সিএনজিটার পিছু ধাওয়া করা…সুরুজের সাথে চোখাচোখি…তারপর প্রচণ্ড জোরে একটা ঝাঁকি…শূন্যে ভেসে থাকার অনুভূতি…
আর কিছু মনে করতে পারলো না। মনে নেই-ও।
“খুব বড় কিছু হতে পারতো কিন্তু…” ডক্টর বললেন। “ভাগ্য ভালো রাস্তার পাশে যে ফুটপাতের উপর তুমি পড়েছিলে সেটার পাশে আবার এক চিলতে মাটি ছিলো। গুলশানের বেশিরভাগ ফুটপাতই এমন। বাইকটার ভারসাম্য রাখতে না পেরে ফুটপাতের উপর তুলে দিয়েছিলে, গতি বেশি ছিলো বলে ছিটকে পড়ে গেছে সামনের দিকে।”
“আমি ড্রাঙ্ক ছিলাম ঠিক আছে,” চারু বলল। “কিন্তু অ্যাকসিডেন্টটা সে-কারণে করিনি।”
“ডক্টর সামনের দিকে ঝুঁকে এলেন।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। “এখন আমার সব কিছু মনে পড়েছে…”
“দ্যাটস অ্যা গুড নিউজ।”
“কি ঘটেছে সেটা আপনারা কেউ বিশ্বাসই করতে চাইবেন না।”
ডক্টর আর মায়া সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো তার দিকে।
“অবিশ্বাস্য ঘটনা!” গভীর করে নিঃশাস নিয়ে একে একে সবটা খুলে বলল চারু। রুমমেটের ব্যাচেলর পার্টি থেকেই শুরু করে অ্যাকসিডেন্ট হওয়া পর্যন্ত।
চারুর মুখ থেকে সবটা শোনার পর ডক্টরের ভুরু কপালে উঠে গেলেও মায়া পুরোপুরি নির্বিকার রইলো।
“হুম, ডক্টর আজফার হুসেন গম্ভির মুখে বললেন। “অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে এক ধরণের ডিল্যুশনের শিকার হয়েছিলে,সবটাই তোমার মনের কল্পনা।”
“কি?” চারু বিশ্বাসই করতে পারলো না ডক্টর এমন কথা বলতে পারেন। “আ-আমি স্পষ্ট দেখেছি! ওটা সুরুজ ছিলো! ওর বাবা ওকে সিএনজিতে করে নিয়ে যাচ্ছে। ছেলেটা বেঁচে আছে!”
মাথা দোলালেন ডক্টর আজফার। “তুমি তো স্বাভাবিক অবস্থায় ছিলে না, এরকম ডিলুশন হওয়াটাই স্বাভাবিক। তোমার মাথার মধ্যে মিসকাতের খুনটা ঘুরপাক খাচ্ছে বহুদিন ধরে, চাঁন মিয়া, সুরুজ…এদের নিয়ে অবসেসড হয়ে পড়েছিলে, সেজন্যেই ওরকম কিছু চোখে দেখেছো তুমি। সম্ভবত এই ডিলুশনের ফলেই তোমার অ্যাকসিডেন্টটা হয়েছে।”
অসহায়ের মতো মায়ার দিকে তাকালো চারু। মেয়েটা চোখ নামিয়ে ফেলল।
“মানুষের মস্তিষ্ক খুবই অদ্ভুত আচরণ করে,” ডক্টর আজফার বলতে থাকলেন, “বিজ্ঞান এখন পর্যন্ত মানব-মস্তিষ্কের খুব কম অংশই এক্সপ্লের করতে পেরেছে। মস্তিষ্কের এই বিচিত্র আচরণ সম্পর্কে কিন্তু বহুকাল আগেই গৌতম বুদ্ধ অবগত ছিলেন।”
চারু ফ্যাল ফ্যাল চোখে চেয়ে রইলো ডক্টরের দিকে।
“বুদ্ধ জানতেন মানুষ যা তীব্রভাবে দেখতে চায় সেটা সে সত্যি সত্যি দেখতে পায়। মানে, বাস্তবিক নয়…তার মস্তিষ্ক এটা তাকে দেখায়।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা দোলাল চারু। এসব গল্প শুনতে ইচ্ছে করছে না তার।
“একটা রটনা ছিলো, বুদ্ধ ইন্দ্রজালের মাধ্যমে নাকি অনেকগুলো বুদ্ধে পরিণত হতে পারতেন। যদিও তিনি এটাকে দৃষ্টিবিভ্রম হিসেবেই ব্যাখ্যা করতেন শিষ্যদের কাছে কিন্তু তার ঘনিষ্ঠজনরা মনে করতো এটা তার ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতা। বুদ্ধ অবশ্য সব সময়ই বলতেন, মানুষ যা দেখতে চায় সেটাই সে দেখতে পায়।”
“আপনি বলতে চাইছেন আমি সুরুজকে দেখতে চেয়েছিলাম? কক্ষনও না!”
মাথা দোলালেন ডক্টর। “সচেতনভাবে হয়তো চাওনি, কিন্তু তোমার অবচেতন মন কি চেয়েছিলো সেটা তো জানো না।”
“আমি বোঝাতে পারবো না,” হতাশ হয়ে বলল চারু। “যা দেখেছি তা ডিলুশন হতে পারে না!”
“কেন পারে না?”
ডক্টরের দিকে চেয়ে রইলো চারু আহসান।
“তুমি যুক্তিবাদি বলে তোমার ডিল্যুশন হবে না?”
চারুর হতাশা আরো বেড়ে গেলো।
“একজন যুক্তিবাদি যদি মাতাল হতে পারে তাহলে তার ডিল্যুশনও হতে পারে।”
“আহ..” মায়া বলে উঠলো। “বাদ দিত তো, ডক্টর। এখন এসব নিয়ে কথা বলার সময় নয়।”
“না, আমার কোনো সমস্যা নেই,” চারু জানালো। “আপনি বিশ্বাস করুন, ডক্টর…আমি যা দেখেছি সেটা বাস্তব।”
ভুরু কপালে তুললেন আজফার হুসেন। “বিশ্বাস!”
সঙ্গে সঙ্গে চারুর চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। সে বুঝতে পেরেছে নিজের ফাঁদেই পড়ে গেছে।
“এটা অন্তত তুমি বলতে পারো না।”
চারু চুপ মেরে গেলো।
“আপনারা এসব আলাপ বাদ দেবেন নাকি আমি এখান থেকে চলে যাবো?” একটু রেগেই বলল মায়া।
হাত তুলে আত্মসমর্পনের ভঙ্গি করলেন অজিফার হুসেন। “ঠিক আছে, এসব কথা বাদ। যেটা বলছিলাম, এ নিয়ে আর কথা বলার কিছু নেই। অ্যাসাইনমেন্টটা শেষ হয়ে গেছে। কথাটা তোমার মনে রাখা উচিত। নইলে আরো কোনো বিপদে পড়ে যাবে হয়তো।”
“না, শেষ হয়নি,” দৃঢ়ভাবে বলল চারু। “আমি এর শেষ দেখে ছাড়বো।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ডক্টর।
“সুরুজ বেঁচে আছে। চাঁন মিয়া তার ছেলের ফেইক মৃত্যু সাজিয়েছে। এটা প্রমাণ করবোই করবো।”
“সুরুজ যে বেঁচে আছে তার কোনো প্রমাণ নেই,” ডক্টর নিজের রাগ দমন করে বললেন। “তাকে তুমি ছাড়া কেউ দেখেওনি। বরং ছেলেটা যে মরে গেছে তার পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ আছে।”
“কি প্রমাণ আছে? একটা কবর? যেখানে ওর কোনো কঙ্কাল নেই? একটা লাশ দেখেছে সবাই…যার কোনো মাথাই ছিলো না।”
ডক্টর কিছু বলতে যাবেন এমন সময় মাথা দুলিয়ে মায়া তাকে বারণ করে দিলো। চারুর চোখে এটা এড়ালো না অবশ্য।
“কি প্রমাণ আছে বলুন? আপনারা কি কিছু লুকোচ্ছেন আমার কাছ থেকে?”
গভীর করে নিঃশাস নিলেন আজফার হুসেন। মায়ার দিকে তাকালেন তিনি। “কথাটা ওর জানা উচিত।”
মায়া কিছু বলল না, আস্তে করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল শুধু।
“আশ্চর্য…কি হয়েছে? কি প্রমাণ আছে বলুন?” চারু উত্তেজিত হয়ে উঠলো।
“তোমার ধারনা সুরুজের লাশটা কেউ ভালো করে দেখেনি, তাই না?”
“হুম। কেউ দেখেনি। সবাই ওর বাবার কথাটাকেই সত্যি বলে ধরে নিয়েছে। চাঁন মিয়া আর তার ছেলে সবার চোখে ধুলো দিয়ে একটা ভুয়া মৃত্যুকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে।”
“শান্ত হোন,” চারু এক নাগারে কথা বলে যাচ্ছে দেখে মায়া বলল।
“কিন্তু সত্যিটা হলো সুরুজের লাশ অনেকেই দেখেছে।” আস্তে করে বললেন ডক্টর হুসেন।
“কারা দেখেছে?” ভুরু কুচকে জানতে চাইলো চারু।
“ওর লাশ গোসল করিয়েছিলো যারা তারা,” ডক্টর বললেন।
কথাটা শুনে চারু স্তম্ভিত হয়ে গেলো। এটা তার মাথায়ই আসেনি। মুসলমান মারা গেলে তার জানাযা পড়ার আগে গোসল দেয়া হয়-এটা কে না জানে। কিন্তু ধর্মের সাথে দূরত্ব বাড়াতে বাড়াতে চারুর অবস্থা এমনই হয়েছে যে, এই সামান্য কথাটাও তার মাথায় আসেনি।
“এই ব্যাপারটা কেন যে তুমি ধরতে পারোনি আমি জানি না,” ডক্টর গম্ভির হয়ে বললেন। ঐদিন তুমি রাগ করে চলে চলে যাবার পর মায়া আমাকে বলল এটা।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলল চারু, মেয়েটার দিকে তাকালো সে। তার সেই চোখ অন্তভেদি।
“আমি তখন টোটাকে দিয়ে ব্যাপারটা খতিয়ে দেখলাম।”
কথাটা শোনামাত্রই চারুর মনে পড়ে গেলো, ঐদিন সে টোটাকে কুড়িল বস্তিতে যেতে দেখেছে। এখন ডক্টর অকপটে সে কথা বলাতে তার সমস্ত সন্দেহ আবারো মারাত্মক ধাক্কা খেলো।
“যে লোক সুরুজের গোসল করিয়েছিলো সে ঐ বস্তিতেই থাকে। কুড়িল বস্তির মোয়াজ্জিন…হাফেজ মিয়া তার নাম। ঐ লোক জোর দিয়ে বলেছে, সুরুজের লাশের এক পা ছিলো না।”
চারু বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো।
“সুরুজের লাশ গোসল দেবার সময় কমপক্ষে আরো, চার-পাঁচজন দেখেছে। তারাও একই কথা বলেছে। তাদের সবার বক্তব্য মোবাইলফোনে ভিডিও করে রেখেছে টোটা। আমি কিন্তু ওকে এটা করতে বলিনি। কিন্তু ছেলেটা খুবই বুদ্ধিমান,” একটু থেমে ডক্টর বললেন, “তুমি চাইলে সেই ভিডিওটা দেখতে পারো।”
হাত তুলে বারণ করে দিলো চারু। এটা দেখার কোনো ইচ্ছে তার নেই।
তারপর দীর্ঘক্ষণ কেউ কোনো কথা বলল না।
“তাহলে আমি যাকে দেখেছি…!” অবশেষে নিরবতা ভাঙলো চারু।
কাঁধ তুললেন ডক্টর। “হতে পারে ডিল্যুশন,..হতে পারে সুরুজ নামের ছেলেটা আদতেই বেঁচে আছে। আবার এমনও হতে পারে, ছেলেটা মরে গেলেও তার অশরীরি আত্মা সব সময় তার বাবার সঙ্গে থাকে। তুমি হয়তো সেটাই দেখেছো। কে জানে কোনটা সত্যি!”
চোখ বন্ধ করে ফেলল যুক্তিবাদি।
“তুমি এখন রেস্ট নাও। দ্রুত সেরে উঠতে চাইলে ওটার খুব দরকার আছে,” উঠে দাঁড়ালেন ডক্টর। “আর পরের অ্যাসাইনমেন্টের জন্য প্রস্তুতি নাও। যদি তুমি আগ্রহি থাকো তো।”
ছরি হাতে উঠে দাঁড়ালেন ডক্টর আজফার। অভিজাত ভঙ্গিতে কেবিন থেকে বের হয়ে গেলেন তিনি।
ডক্টর চলে যাবার পর মায়াও উঠে দাঁড়ালো। “আমিও যাই…কাল সকালে একবার আসবো।”
“আপনিও মনে করেন আমি দৃষ্টি বিভ্রমের শিকার হয়েছি…তাই না?” আস্তে করে বলল চারু।
স্থিরচোখে তাকালো মায়া। “না। আমি আপনার কথা বিশ্বাস করি। শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস করতেই হয়…এছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় থাকে না।”
কথাটা বলে মায়া যখন কেবিন থেকে বের হয়ে যাবে অমনি চারুর মনে পড়ে গেলো একটা কথা।
“আচ্ছা, আমাকে হাসপাতালে কে নিয়ে এসেছে?”
দরজার সামনে থেকে ঘুরে দাঁড়ালো মেয়েটি। স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বলল, “এক সিএনজিওয়ালা।”
তারপরই ঘর থেকে বের হয়ে গেলো সে।
মেয়েটা চলে যাবার পরও দীর্ঘক্ষণ দরজার দিকে ফাঁকা দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে থাকলো চারু আহসান। তার কাছে মনে হচ্ছে সমস্ত জগত দুলছে। সমস্ত হিসেবে-নিকেশ আর বিশ্বাস-অবিশ্বাস নিত্য এক দোলাচলে দুলছে।
ঠিক পেন্ডুলামের মতো!