1 of 2

৫০. নিয়তি ঠাকুরাণী

নিয়তি ঠাকুরাণী বড়ই কৌতুকপরায়ণা। প্রকৃতির রাজ্যে যে-সব নিয়ম প্রতিষ্ঠিত আছে, মাঝে মধ্যে তার কিছু কিছু ভণ্ডুল করে দিতেই তাঁর বেশী আমোদ। প্রকৃতির পাখিরা মুক্ত আকাশে স্বাধীনভাবে উড়ে যায়, আবার নিয়তির পাকচক্ৰে তাদের মধ্যেই দু দশটি পিঞ্জরে আবদ্ধ হয়। নিয়তির কৌতু; আজ যে রাজা কাল সে ফকির, আবার ঘুটে-কুড়ানীর পুত্রও অর্ধেক রাজত্ব সমেত রাজকন্যা পায়। পথের ঝাঁক-মুটে কঠোর পরিশ্রম করেও পরিবারের জন্য দু বেলার গ্রাসাচ্ছাদন সংগ্ৰহ করতে পারে না, অথচ ধনীর দুলাল, যে সারাদিন নিজের হাতে কুটোটিও নাড়ে না, সে নানাবিধ অত্যুত্তম খাদ্য সামগ্ৰীীর সামনে বসে নাক ছাঁটা দিয়ে বলে, এটা খাবো না, ওটা খাবো না! নিয়তি অতি নিষ্ঠুর, এতই নিষ্ঠুর যে মানুষ কোনোদিন তার মূর্তি পর্যন্ত কল্পনা করেনি!

সিংহ পরিবারের প্রতি নিয়তির নেকনজর যেন একটু বেশী। এ বাড়ির গঙ্গানারায়ণকে নিয়ে তিনি কম খেলা খেলেন নি, আবার আর একবার খেললেন।

নীলকর সাহেবরা গঙ্গানারায়ণের নামে যে বিভিন্ন মামলা দায়ের করেছিল, আদালতের বিচারে গঙ্গানারায়ণ তার সব কটিতেই বে-কসুর খালাস পেয়ে গেল। বিচারকদের মধ্যেও তো দু-একজনের সত্যি সত্যিই আইনের প্রতি আনুগত্য থাকে। এমনকি শ্বেতাঙ্গদের মধ্যেও তেমন ব্যতিক্রম আছে। জাস্টিস পীকফোর্ড গঙ্গানারায়ণকে সসম্মানে মুক্তি দিয়ে মন্তব্য করলেন যে নিঃস্বার্থভাবে এই ব্যক্তি নীলচাষের ব্যাপারে কয়েকটি অযৌক্তিক ব্যবস্থার প্রতিকার বাসনায় সাধারণ নিরীহ চাষীদের সাহায্য করতে গিয়েছিলেন, তার ফলে ইনি নিজেই অত্যাচারিত হয়েছেন। এই প্রকার ব্যক্তিদের শাস্তি দিলে দেশের আইনশৃঙ্খলার প্রতি প্রজাদের বিশ্বাস নষ্ট হয়ে যাবার আশঙ্কা আছে।

এদিকে ইণ্ডিগো কমিশন চলছে। গঙ্গানারায়ণের মামলায় এরকম রায়ে অনেক সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা, সেই জন্যই দেশীয় ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত সংবাদপত্রগুলিতে ফলাও করে এই বৃত্তান্ত ছাপা হলো। অতি ঘনিষ্ঠমহল ছাড়া গঙ্গানারায়ণকে বিশেষ কেউ চিনতো না, সে বিখ্যাত হয়ে পড়লো রাতারাতি। তার কীর্তিকাহিনী নানাভাবে অতিরঞ্জিত হয়ে এবার ছড়িয়ে পড়লো শহরের লোকের মুখে মুখে। অনেকে গঙ্গানারায়ণকে একবার চাক্ষুষ দেখার জন্যও সিংহসদনের দ্বারের সামনে এসে ভিড় করে।

গঙ্গানারায়ণ অবশ্য এই ব্যাপারে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলো খুবই। সে লোকের সামনে থেকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায়, নিজের কক্ষে লুকিয়ে থাকে। এমনকি সে চিন্তা করতে লাগলো যে কলকাতা ছেড়ে কিছুদিনের জন্য অন্য কোথাও ঘুরে আসবে কি না। ঠিক এই সময় নিয়তি দেবী অলক্ষ্যে গঙ্গানারায়ণের দিকে চেয়ে হাসলেন।

আধুনিক কালের শিক্ষিত ব্যক্তিদের মধ্যে যিনি শিরোমণি, সেই এজু-রাজ রামগোপাল ঘোষ স্বয়ং একদিন গঙ্গানারায়ণের সঙ্গে দেখা করে একটি প্ৰস্তাব দিলেন। না ভেবেচিন্তে হুট করে কোনো কথা বলেন না বলেই রামগোপাল ঘোষের মতামতের বিশেষ গুরুত্ব আছে। হরিশ মুখুজ্যে রামগোপাল ঘোষের বিশেষ অনুগত, এক সময় হরিশ রামগোপালের গৃহের সান্ধ্য আড্ডায় নিয়মিত যেতেন। কিন্তু সেখানে পরিমিত মদ্যপান হয় বলে ইদানীং হরিশ। আর বড় একটা যান না, কিন্তু রামগোপালের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ অক্ষুণ্ণ আছে।

রামগোপাল বললেন, হরিশের কাচ থেকে আপনার বৃত্তান্তু সব শুনিচি। ইউ আর এ মারভেল! অথচ আপনি এত মডেস্ট, এত সফট স্পোকেন, এই আপনিই বন্দুক ধরেচেন কতকগুলিন ব্লাড হাউণ্ড ঐ প্ল্যানটারগুলিনের বিরুদ্ধে-এ যে বিশ্বাসই করা যায় না।

গঙ্গানারায়ণ মস্তক অবনত করে বললো, হরিশ সব কিছুই বাড়িয়ে বলেন, বন্দুক ধরিচি বটে। কিন্তু ফায়ার করিচি মাত্র একবার।

রামগোপাল অল্পকালের মধ্যেই সরাসরি চলে এলেন মূল প্রসঙ্গে। তিনি বললেন, আমার নিজের পক্ষ থেকে এবং আরও অনেকের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি একটি নিবেদন আচে। আপনি বাগবাজারের কৃষ্ণনাথ রায়ের বিধবা কন্যা কুসুমকুমারীকে বিবাহ করার কথা বিবেচনা করে দেখুন।

গঙ্গানারায়ণের মাথায় যেন একেবারে আকাশ ভেঙে পড়লো।

গঙ্গানারায়ণের মতন, কুসুমকুমারীর নামটিও এখন একেবারে অপরিচিত নয়। কৃষ্ণনাথ রায়ের মতন একজন মান্যগণ্য ব্যক্তি যে তাঁর বিধবা কন্যার পুনর্বিবাহ দিতে চেয়েছেন এবং সেজন্য পাত্র খোঁজাখুঁজি চলছে, এ সংবাদ ক্ৰমে ক্ৰমে ছড়িয়ে পড়েছে শহরে। এখন ঐ বিবাহের ব্যাপারটি আর শুধু বাগবাজারে কৃষ্ণনাথ রায়ের পরিবারেই আবদ্ধ নেই। বিধবা বিবাহের সমর্থকরা এই উপলক্ষে আবার কোমর বেঁধে উঠে পড়ে লাগলেন, যেমন করেই হোক, এই কন্যার বিবাহ দিতেই হবে। অন্যদিকে গৌড়ার দলও নিশ্চেষ্ট হয়ে নেই, তারা ভেবেছিল, এর মধ্যেই বিধবা বিবাহের ঝোঁক স্তিমিত হয়ে গেছে, আর কিছুদিনের মধ্যেই লোকে এই অনাচার সম্পূর্ণ বর্জন করবে। তার মধ্যে আবার এ কি হাঙ্গামা! কৃষ্ণনাথ রায়ের মতন ধীর, স্থির ধর্মপ্ৰাণ ব্যক্তির কি হঠাৎ বুদ্ধিনাশ হলো! গোঁড়ার দল রাজা রাধাকান্ত দেবকে গিয়ে ধরলো, আপনি, যেমন করেই হোক এই বিয়ে আটকান!

কৃষ্ণনাথ রায়ের সঙ্গে শহরের অন্য অনেক ধনী ব্যক্তির ব্যবসা-বাণিজ্য সূত্রে সম্পর্ক আছে। তারাও এই বিবাহ বন্ধ করার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে লাগলো নানাপ্রকারে। কৃষ্ণনাথ নিজ সিদ্ধান্তে অবশ্য এখনো অনড় আছেন, তবে তাঁর একটাই শর্ত। কুসুমকুমারীর প্রথম বিবাহের সময় তিনি ভুল করেছিলেন, এবার ভালো করে দেখে শুনে পছন্দ মতন পাত্র না পেলে যার-তার হাতে তিনি তাঁর এই আদরিণী কন্যাকে তুলে দেবেন না।

পাছে বিরুদ্ধ পক্ষীয়রা কোনো ষড়যন্ত্র করে কিংবা অকস্মাৎ আবার কৃষ্ণনাথ রায়ের মত পরিবর্তিত হয়, তাই বিধবা-বিবাহ-সমর্থকরা যত শীঘ্র সম্ভব এই বিবাহ সঙ্ঘটিত করতে চায়। এ সব ব্যাপারে কালাহরণ মানেই অশুভ। এ পর্যন্ত কোনো পাত্রকেই কৃষ্ণনাথ রায় মনোনীত করেন নি। কুসুমকুমারীকে যারা চক্ষেও দেখেনি, কৃষ্ণনাথ রায়ের পরিবারের সঙ্গে যাদের কোনো প্রকার সম্পর্ক নেই এমন শত শত ব্যক্তি কুসুমকুমারীর জন্য পাত্র অন্বেষণে তৎপর। এদের মধ্যে রামগোপাল ঘোষের মতন ব্যক্তিও আছেন। বিদ্যাসাগর অবশ্য এ ব্যাপারে কোনো নিজস্ব উদ্যোগ নেননি, তবে কুসুমকুমারীর বিবাহের দিনক্ষণ ধাৰ্য হলে তিনি স্বয়ং যে বিবাহ বাসরে উপস্থিত থাকবেন সে কথা জানিয়ে দিয়েছেন।

বলা যায় সত্যিই প্রায় শতাধিক ব্যক্তির মুখপাত্র হয়েই এসেছেন রামগোপাল। বিভিন্ন সম্মিলনীতে আলোচনায় এই জনমতই গড়ে উঠেছে যে গঙ্গানারায়ণ সিংহই কুসুমকুমারীর যোগ্যতম পাত্র। এমন উদার ও মহৎ মানুষ এখন সারা দেশেই দুর্লভ, তদুপরি সে ধনী ও অভিজাত বংশের সন্তান, সুশ্ৰী, স্বাস্থ্যবান, সুগঠিত শরীরের অধিকারী এবং বিপত্নীক। কৃষ্ণনাথ রায় কোনো কারণেই গঙ্গানারায়ণকে অপছন্দ করতে পারবেন না।

গঙ্গানারায়ণকে সম্পূর্ণ নীরব দেখে রামগোপাল ঘোষ আবার বললেন, আমি কন্যাপক্ষের লোক নই, সুতরাং আমার কাচ থেকে এ প্ৰস্তাব শুনে ইউ মে বাঁ জাস্টিফায়েবলী সারপ্রাইজড-কিন্তু আসলে আমরা পত্রিপক্ষেরই, আপনার কাচ থেকে সম্মতি পেলে মেয়ে পক্ষের কাচে গিয়ে কতা পাড়বো।

গঙ্গানারায়ণ এবার ধীর কণ্ঠে বললেন, আপনি কষ্ট করে আমাদের বাড়িতে এয়েচেন, আমরা কৃতাৰ্থ হয়িচি, আমার ছোট ভাই এখন গৃহে নেই, সে আপনাকে দেখলে খুবই আহ্বাদিত হতো, তবে-দুঃখের বিষয় এইটুকুই যে, আপনাদের নির্বাচন ভুল হয়েচে, আমার আর বিবাহ করার ইচ্ছে নেই। আমি আর সংসারী হতে চাই না।

রামগোপাল হেসে বললেন, আপনি বন-জঙ্গল ছেড়ে সংসারে ফিরে এশ্চেন। সংসারে থাকলে তো সকলকেই সংসারী হতে হয়।

—অনেক সংসারেই আবার দু-একজন আলগোচ ধরনের মানুষ থাকে, যারা সাতে-পাঁচে যেতে চায় না। মিঃ ঘোষ, আমি বাকি জীবনটা খোলামেলা থাকতে চাই!

–আপনি চাইলেই বা আমরা দেবো কেন? দেশের স্বার্থে, সমাজের স্বার্থে আমরা চাই আপনি এই দায়িত্ব গ্ৰহণ করুন।

—দেশের জন্য আপনি আর যা হোক কর্তে বলুন, কিন্তু বিবাহ কর্তে বলবেন না।

–দেশের জন্য মানুষ প্ৰাণ পর্যন্ত দেয়, আর আপনি বিবাহের মতন একটা সামান্য কাজ কত্তে পারবেন না? এই দেকুন না, সিপয় মিউটিনির সময় দিল্লির বারুদখোনা দখল রাখবার জন্য কজন ইংরেজ কেমন স্বেচ্ছায় প্ৰাণ দিলে-।

—মিঃ ঘোষ, আমার গায়ে গেরুয়া হাওয়া লেগে গ্যাচে, আমার আর দারা-পুত্র-পরিবারে মন বসবে না।

—হাওয়া পালটাতে আর কতক্ষণ! দেকুন না, দেশের হাওয়াই এখন উল্টো দিকে বইচে। আরও কিছুক্ষণ এরকম কথার পিঠে কথা চলল, কিন্তু গঙ্গানারায়ণ বিবাহে সম্মতি দিল না। শেষ পর্যন্ত তাকে আরও একটু বিবেচনা করতে বলে রামগোপাল ঘোষ বিদায় নিলেন। কিন্তু ব্যাপারটা সেখানেই ক্ষান্ত হলো না। এরপর গঙ্গানারায়ণের ওপর আক্ৰমণ আসতে লাগলো নানা দিক দিয়ে। হরিশ মুখুজ্যের কাছেও এ সংবাদ পৌঁছেচে, তিনিও এতে খুব উৎসাহী। গঙ্গানারায়ণের বন্ধুরা গৌরদাস, রাজনারায়ণ, ভূদেব এমনকি মধুসূদন পর্যন্ত দেখা হলেই তাকে ঐ কথা বলেন। সকলেই একমত যে একটা বড় কাজ-এর জন্য গঙ্গানারায়ণের এই বিবাহ করা উচিত।

রাজনারায়ণ তাঁর স্বভাবসিদ্ধ রসিকতার ভঙ্গিতে বললেন, ওরে গঙ্গা, সেকেলে স্বয়ম্বর সভায় কতা শুনিচিস তো, তোর হলো গে একেলে স্বয়ম্বর সভা। আমরা সবাই মিলে ভোটে তোকে বর নির্বাচন করিচি, এখন তো তোর পেচপাও হলে চলবে না!

গঙ্গানারায়ণ বললো, আমি কি নমিনেশান পেপার সাবমিট করিচিলুম যে তোরা আমায় ইলেক্ট কল্লি–

রাজনারায়ণ বললেন, ক্রমওয়েলকে যখন রাজা করা হলো, তখন তিনি কি নমিনেশান পেপার সাবমিট করেচিলেন? সবার ক্ষেত্রে লাগে না!

–অর্থাৎ আমার দশাও ক্রমওয়েলের মতই হবে।

—তা ভাই বিয়ে করা মানেই তো একরূপ ফাঁসী কাঠে চড়া নয়? তুই একবার বিয়ে করেই এত ভয় পেয়ে গেলি? এই দ্যাক না, গৌর, মধু, আমি আমরা সবাই তো দুবার করে মাথা মুড়িয়িচি, আর দেরি করিস নি, তুই এবার দুর্গা বলে ঝুলে পড়!

—আমাকে এমন অনুরোধ করে আর বিব্রত করিস নি তোরা!

—তুই কি বিধবা বিবাহ কত্তে ভয় পাচ্ছিস? দ্যাক বিদ্যাসাগরের আন্দোলনের অনেক আগেই আমার দ্বিতীয় বিয়ে হয়ে গেচে, নইলে আমি নিশ্চয়ই কোনো বিধবার পাণিগ্রহণ করে অন্তত একজন দুঃখিনী বালিকার দুঃখ দূর কর্তৃম। কিন্তু আমি নিজে উদযুগী হয়ে আমার দুই ভায়ের বিয়ে দিইচি দুই বিধবার সঙ্গে। তখন লোকে ভয় দেখিয়েছেল আমায়। আমি মেদিনীপুরে বাংলা বাড়িতে থাকি, বলে কিনা রাতের বেলা আমার বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেবে। আমি বলেচিালুম, দিক দেখি একবার। বোড়ালের লোকেরা বললো, আমি গ্রামে গেলে আমায় ইট মারবে। আমি একটা মোটা লাঠি হাতে নিয়ে গ্রামে যৌতুম। তোর যদি কোনো বিপদ হয়। আমরা সকলে মিলে তোর পাশে থাকবো।

গঙ্গানারায়ণ মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, না, না, আমি সে কতা বলচি না, সে কতা বলচি না-!

গঙ্গানারায়ণ তর্কবাগীশ নয়। সকলের কাছেই সে যুক্তিতে হেরে যায়, কিন্তু তার মন মানে না। অবস্থা এমন হয়েছে যে তার এখন আর কোথাও যাবার উপায় নেই, সব জায়গাতেই ঐ এক কথা। এরা সকলে মিলে গঙ্গানারায়ণের মনের কষ্ট অনেক বধিত করে দিল।

এতদিন পর আবার বারবার মনে পড়তে লাগলো বিন্দুবাসিনীর কথা। কুসুমকুমারীকে চক্ষে দেখেনি গঙ্গানারায়ণ, কিন্তু তার যে বয়সের কথা সে শুনেছে, সেই বয়সেই বিন্দুবাসিনীকে গোপনে চিরতরে প্রেরণ করা হয় কাশীতে। কৈশোরের ক্রীড়াসঙ্গিনী বিন্দুবাসিনীর মুখ, ঠিক যেন গর্জন তেল মাখা প্রতিমার মুখের মতন, আর সেই সময়কার সুমধুর দিনগুলি গঙ্গানারায়ণের স্মৃতিপটে কতকগুলি স্থির চিত্রের মতন দোলে। তারপর বারানসীর বিন্দুবাসিনীকে মনে পড়া মাত্র তার বুকের মধ্যে যাতনা শুরু হয়। যেন সবকটি তন্ত্রী থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্তপাত হচ্ছে। শেষের সেই অমোঘ কালরাত্ৰিতে বজরা থেকে নেমে নৌকোর ওপর দাঁড়িয়ে বিন্দু আঃ আঃ শব্দ করেছিল, সে রকম বুক ফাটা আর্তনাদ মানুষের কণ্ঠ থেকেও বেরোয়। তার আগে বিন্দুবাসিনী নেশাচ্ছন্ন গলায় অন্তত দুবার বলেছিল, আমার কিচুই পাওয়া হলো না রে, গঙ্গা! এমন বঞ্চিত কাতরোক্তি কি গঙ্গানারায়ণ কোনোদিন ভুলতে পারবে? সে প্ৰাণপণে ভুলে থাকার চেষ্টা করেছিল। কেন সকলে মিলে তার সেই দুঃসহ স্মৃতিকে আবার উস্কে দিতে চায়!

বিন্দুবাসিনীর সঙ্গে শেষ সাক্ষাতের কথা গঙ্গানারায়ণ কারুকে বলেনি, এই গোপনীয়তার বিপুল ভার সে সারা জীবন একলা বহন করবে। কোথায় গেল বিন্দুবাসিনী? সে নিশ্চয় সাঁতার জানতো না। নগর কলকাতার বনেদী পরিবারের পুরাঙ্গনা, তাও বালবিধবা, তার সন্তরণ শিক্ষার সুযোগ কোথায়? তা ছাড়া বাঁচতে সে চায়নি, ইচ্ছে করে লাফ দিয়েছিল নৌকো থেকে, জলের গভীরে তলিয়ে গেছে, হাঙরে-কুমীরে ঠুকরে খেয়েছে তার দেহ!

একরাত্রে বিন্দুবাসিনীকে স্বপ্নে দেখলে গঙ্গানারায়ণ। বারানসীর বিন্দুবাসিনী নয়, সেই প্ৰাণোচ্ছলা কিশোরী যার সঙ্গে একসাথে গঙ্গানারায়ণ পণ্ডিতমশাইয়ের কাছে সংস্কৃত পাঠ নিত। স্বপ্নের বিন্দুবাসিনী অভিমানে ভুরু বাঁকিয়ে বললো, তুই না বলিচিলি আমায় মেঘদূত কাব্যখানা পড়াবি? মিথুক! তোর কোনো কতার ঠিক নেই।

স্বপ্ন ভেঙে জেগে উঠে গঙ্গানারায়ণ অনেকদিন পর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলো। অন্ধকার কক্ষ, রাত্রি নিশুতি, তার এই কান্নার কথা আর কেউ জানবে না।

মুলুকচাঁদের আখড়ায় হরিশ মুখুজ্যে একদিন নবীনকুমারকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার দাদা এ বিয়ের ব্যাপারে কিছু ঠিক কল্লেন? আমার কাচেও কদিন যাবৎ আসচেন না!

নবীনকুমার মুলুকচাঁদের আখড়ায় আবার নিয়মিত যাওয়া আসা শুরু করেছে। প্রতিদিনই অত্যধিক সুরা পান করে শেষে একসময় চেতনা হারায়। এখন সে ঠিক যেন হরিশ মুখুজ্যেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করছে, সারাদিন মহাভারত অনুবাদ এবং অন্যান্য কাজে প্রভূত পরিশ্রম করে, তারপর সন্ধ্যা থেকেই এখানে এসে শুরু করে মদ্যপান। তবে আগের তুলনায় সে অনেক গভীর, অন্য সকলকে চুপ করিয়ে রেখে নিজে এক কথা বলার অভ্যাস একেবারেই পরিত্যাগ করেছে, মাতলামির হুল্লোড়েও সে যোগ দেয় না এবং বারনারীদের সম্পর্কে কোনো আগ্রহ নেই। নর্তকীরা এলে সে পাশের কক্ষে শুতে চলে যায়।

মুলুকচাঁদের ব্যবসার অনেক শ্ৰীবৃদ্ধি হয়েছে ইতিমধ্যে। রাজস্থান থেকে সে তার ভাই ও আত্মীয় স্বজনদের এনে নানান ব্যবসায়ে জুড়ে দিয়েছে, বড়বাজার অঞ্চলে অনেকগুলি বাড়ির মালিক সে নিজে। জানবাজারের এই আখড়ায় সে আর প্রতি সন্ধেবেলা আসতে পারে না, তবে ব্যবস্থাদি সবই ঠিক থাকে। মনে হয়। এই আখড়াটি সে টিকিয়ে রেখেছে শুধু হরিশ মুখুজ্যের জন্যেই। রাইমোহন এখানে আর আসে না, এটা নবীনকুমারের পক্ষে একটা স্বস্তির বিষয়।

হরিশের প্রশ্নের উত্তরে নবীনকুমার সংক্ষেপে বললো, কী জানি!

হরিশ সচকিত হয়ে বললেন, অ্যাজ এ মেটার অফ ফ্যাকট্‌ আই ওয়াজ গোয়িং টু আস্ক ইউ। তোমার এ ব্যাপারে কোনো উৎসাহ নেই কেন বলো তো, বেরাদার? কদিন ধরেই লক্ষ করচি, তুমি এ সম্পর্কে একটাও কতা কও না! সবাই যখন এত মাতামাতি কচে!

নবীনকুমার বললো, আমি আর কি বলবো?

—তুমি তোমার দাদাটিকে বোঝাওনি? গঙ্গানারায়ণ আমাদের গর্ব! উই হ্যাভ মেনি প্ল্যানস টুগেদার। গঙ্গাতে আমাতে দেকো না সামনের বছর থেকে একটার পর একটা মুভমেণ্ট লনচ কবো-আগামী দশ বছরের মধ্যে আমি এই ইংরেজ ব্যাটাদের টিটু করে ছাড়বো।

—এইসব মুভমেণ্ট কত্তে গেলে কি নতুন বিয়েতে জড়িয়ে পড়লে চলে? তাতে বাধার সৃষ্টিই তো হবার কতা!

—না, না, এই বিয়েটা করা বিশেষ দরকার। এই উদাসীন জাতিকে বারবার ঘা মারতে হবে! এক একটা মহৎ এক্‌জাম্পল সেট কত্তে হবে। গঙ্গানারায়ণ সিংহের মতন মানুষ যদি বিধবা বিবাহ করেন তা হলে আরও কত লোক এ রকম কাজ কত্তে ভরসা পাবে।

–আমার মনে হয়, এ বিয়ে হবে না।

–কেন?

—আমার মা বেঁচে রয়েচেন, তিনি হরিদ্ধারে থাকুন আর যেখানেই থাকুন। এ খবর ঠিকই তাঁর কানে পৌঁচবে, তিনি ড়ুকরে ড়ুকরে কাঁদবেন। দাদা নিশ্চয়ই মায়ের মনে এরকম দুঃখ দিতে চান না।

হাতের গেলাসটা নামিয়ে রেখে হরিশ মুখুজ্যে মহা উত্তেজিতভাবে বললেন, তুমি-তুমি এই কতা বললে, নবীন? তুমি প্রতিটি বিধবা-বিবাহের জন্য এক হাজার টাকা দান ঘোষণা করেচিলে, সেই তোমার মুখে এমন কতা! তুমি না বিদ্যাসাগরের চ্যালা! এখন নিজের পরিবারে এই বিয়ে ঢুকচে বলেই অন্য সুর গাইচে। জানি, জানি, তোমরা সব একটু এদিক ওদিক হলেই বাপ-মায়ের সুপুত্তুর হয়ে যাও! মুখেন মারিতং জগৎ, তারপর দায় পড়লেই ভালো মানুষের মতন মুখটি করে বলবে, কী কর্বো ভাই, মা অনেক করে বল্লেন, তাই এই বিয়েটা করে ফেলুম! হেঃ! আমি যে কাগজ চালাবার জন্য সর্বস্বান্ত হচ্চি, সাহেবদের সঙ্গে মোকদ্দমায় জড়িয়ে পড়চি, সে কি আমার মায়ের মত নিয়ে? তোমার দাদা যদি এ বিয়ে করতে ভয় পান, তা হলে তাঁর সঙ্গে আমার আর কোনো সম্পর্কই রইবে না! আমি একাই আমার ক্রুসেড চালিয়ে যাবো!

এমন ভর্ৎসনার উত্তরে নবীনকুমার একটাও কথা বললো না। সে গালিচার ওপর বসে ছিল, হাতের গেলাসটি শেষ করে আস্তে আস্তে শুয়ে পড়ে চোখ বুজলো।

হরিশ বললেন, তোমাদের জননী হাজার হাজার মেইল দূরে রয়েচেন, তবু তোমরা মায়ের দোহাই পেড়ে সাঁটকাচো!

নবীনকুমার নীরবে দুটি হাতের পাঞ্জা স্থাপন করলো দুই চক্ষুর ওপর।

–কী, কোনো উত্তর দিচ্চো না যে?

–আমাকে এখন বিরক্ত করো না!

—জানি, যখন তোমরা কোনো যুক্তি দেকাতে পারো না তখন ঘুমিয়ে পড়ে। খাঁটি ভারতীয় একেই বলে, হেঃ!

নবীনকুমার এবার উপুড় হয়ে গেল। হরিশ মুখুজ্যের অনেক প্ররোচনাতেও সে আর একটি শব্দও উচ্চারণ করলো না।

এর দশ দিনের মধ্যেই বিবাহের দিন ও লগ্ন ঠিক হয়ে গেল। গঙ্গানারায়ণ হচ্ছে সেই ধরনের মানুষ, যে লোকের অনুরোধের উত্তরে বারবার না বলার চেয়ে ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক কোনো ক্রমে মেনে নিয়ে স্বস্তি বোধ করে। সৌজন্য ও ভদ্রতার খাতিরে এবং বন্ধুদের উপরোধে সে বোধ হয় বিষও খেতে পারে। অবশ্য এক্ষেত্রে কুসুমকুমারীর সঙ্গে বিয়ের উপমা দেওয়া কোনো ক্রমেই ঠিক হলো না। সেই এক রাত্রে বিন্দুবাসিনীকে স্বপ্নে দেখার পর থেকেই গঙ্গানারায়ণের মন একটু একটু পরিবর্তিত হচ্ছিল। তার মনে হলো, বিন্দুবাসিনীর বয়সী এক বিধবাকে প্রত্যাখ্যান করার ফলে সে ঐ মেয়েটিকে বিন্দুবাসিনীর মতনই দুভাগ্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই মেয়েটিকে স্ত্রীর সম্মান দিয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠিতা করলে বিন্দুবাসিনীর আত্মা নিশ্চয়ই সন্তুষ্ট হবে। সেই ইঙ্গিত দেবার জন্যই স্বপ্নে আবির্ভূত হয়েছিল বিন্দুবাসিনী। সুতরাং গঙ্গানারায়ণ বিবাহে এই ভেবেই সম্মতি দিল যে, সে যেন অন্য মূর্তিতে বিন্দুবাসিনীকেই গ্ৰহণ করছে।

আশ্চর্যের ব্যাপার, এই বিবাহ উপলক্ষে বিধুশেখর কোনোরূপ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির চেষ্টাই করলেন না। সিংহ পরিবারে এত বড় একটা কাণ্ড হতে চলেছে, অথচ তাতে বিধুশেখরের যেন পক্ষে বিপক্ষে কোনো উদ্দীপনাই নেই। যথা সময়ে গঙ্গানারায়ণ বিধুশেখরের অনুমতি নিতে গিয়েছিল, তিনি শুকনো গলায় বলেছিলেন, তুমি বিবাহ কত্তে চাইচো-এতে আর আমার বলবার কী আচে! যা ভালো বুঝবে, কর্বে। এটুকু বলেই পাশ ফিরে শুয়েছিলেন তিনি। গঙ্গানারায়ণ তখন সুহাসিনীকে জিজ্ঞেস করেছিল, সুসি, সব তো শুনিচিস, আমি যদি এই বে করি, তোরা খুশী হবি? উদগত অশ্রু কোনো ক্রমে রোধ সুহাসিনী উত্তর দিয়েছিল গঙ্গাদাদা, দেশদ্ধে সব দুঃখিনী মেয়ের তোমায় দুহাত তুলে আশীর্বাদ কর্বেন।

বাগবাজারে কৃষ্ণনাথ রায়ের প্রাসাদে এই বিবাহের দিন সমারোহ হলো বিস্তর। আসরে উপস্থিত রইলেন গণ্যমান্য বহু ব্যক্তি। নবীনকুমারের অবশ্য যাওয়া হলো না।

বর-বেশী গঙ্গানারায়ণকে কুসুমসজ্জিত জুড়ি গাড়িতে চাপিয়ে এবং অন্যান্য গাড়ি ও পাল্কীতে বরযাত্রীদের চাপিয়েই নবীনকুমার চঞ্চল হয়ে উঠলো। বিকেলেই এক নিদারুণ দুঃসংবাদ এসেছে, অতিকষ্টে সে সংবাদ গোপন করে রাখা হয়েছে গঙ্গানারায়ণের কাছ থেকে। গত রাত্রি থেকে হরিশ মুখুজ্যে অনবরত রক্ত-বমি করছেন। তাঁর মাথার কোনো শিরা ছিঁড়ে গেছে বোধ হয়, বাঁচার সম্ভাবনা খুবই কম।

দুই জন সাহেব চিকিৎসক এবং ডাক্তার দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে নবীনকুমার খানিক পরেই উপস্থিত হলো হরিশের বাড়িতে। সেখানেও একটি ছোটখাটো ভিড় জমে গেছে। গঙ্গানারায়ণের বিবাহের নিমন্ত্রণ সেরে রামগোপাল ঘোষ প্রমুখ কয়েকজন ছুটে এসেছেন এত দূরে হরিশকে দেখবার জন্য। তাঁরা বললেন, নবীনকুমারকে এখন একবার বাগবাজারে যেতে, সকলেই তাকে খোঁজাখুঁজি করছে। গঙ্গানারায়ণকে হরিশ ও নবীনকুমারের অনুপস্থিতির কারণ সম্পর্কে নানা রূপ ভুজুং-ভাজুং দেওয়া হয়েছে, এখন নবীনকুমারের একবার যাওয়া অবশ্য প্রয়োজন। কিন্তু মুমূর্ষ। বন্ধুর শয্যাপার্শ্ব ছেড়ে নবীনকুমার কিছুতেই উঠে যেতে রাজি নয়।

রাত্রি ভোর হবার পর বহু কাৰ্য অসমাপ্ত রেখে, বহু মানুষকে কাঁদিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ফেললেন হরিশ। আগের দিন থেকেই তাঁর বাকরোধ হয়েছিল, মৃত্যুর আগে ঘনিষ্ঠজনদের একটি কথাও বলে যেতে পারলেন না।

হরিশের গৃহের সামনে যে ছোটখাটো একটা জটলা জমেছিল, সেখানে মাঝে মাঝে এসে উঁকি দিয়ে যাচ্ছিল রাইমোহন। ভেতরে যায়নি। যাবার মতন অবস্থাও নয়। তার পোশাক শতাচ্ছিন্ন, বার্ধক্যে শরীর ন্যুজ হয়ে গেছে, চক্ষু দুটি স্তিমিত, ঠিক পথের পাগলের মতন চেহারা, চেনাই যায় ন আগেকার মানুটিকে। শেষ সংবাদ শোনার পর সে বেসুরা জড়িত কণ্ঠে তৎক্ষণাৎ রচিত একটা গান শুরু করে দিল :

নীল বাঁদরে সোনার বাংলা
করলে রে ভাই ছারখার
অসময়ে হরিশ মোলো
লঙের হলো কারাগার
প্ৰজার প্রাণ বাঁচানো ভার…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *