কাশী শহরে হুলুস্কুলু পড়ে গেছে। সকাল থেকেই লোকের মুখে মুখে একটি কাহিনী নানানভাবে পল্লবিত হতে লাগলো। ত্ৰৈলঙ্গ স্বামী আর একটি কাণ্ড করেছেন। ভোরবেলা তিনি মণিকণিকার ঘাটে নেমে ভুস করে এক ড়ুব দিয়ে বেশ খানিক পরে উঠেছেন আর এক ঘাটে, তারপর কী খেয়াল হয়েছে, জল থেকে উঠে এসে সামনের এক কালী মন্দিরে ঢুকে মূর্তির গায়ে প্রস্রাব করে দিয়েছেন।
কেউ বলে মন্দিরে তখন আর কেউ ছিল না, কেউ বলে পুরোহিত ছিল, আবার কেউ বলে সেখানে ছিল এক বাঙালী সাধক। সে যাই হোক, পুরোহিত বা বাঙালী সাধকটি এই কাণ্ড দেখে আঁতকে উঠে বলেছিল, আরে রাম রাম! স্বামীজী, ইয়ে আপ কেয়া কবিতা!
কয়েক বৎসর ধরে ত্রৈলঙ্গ স্বামী সম্পূর্ণ মৌনী, কিছুমাত্র ভ্রূক্ষেপ না করে তিনি সেই কার্যটি সমাপ্ত করলেন অনেকক্ষণ ধরে। তারপর মন্দিরের মেঝেতে গড়ানো প্রস্রাবের ধারার ওপরেই আঙুল দিয়ে লিখলেন, গাঙ্গোদকং।
বারাণসীর জনসাধারণ এই ঘটনায় দুটি দলে বিভক্ত হয়ে তর্ক বিতর্কে মেতে উঠলো। তবে ত্রৈলঙ্গ স্বামীর পক্ষপাতীরাই দলে ভারী। তাদের মতে ত্রৈলঙ্গস্বামী স্বয়ং চলন্ত শিব, তিনি যা করবেন, সেটাই তাঁর পূজা। তিনি লোকাচারের অতীত, সর্বসমক্ষে উলঙ্গ থাকতেও তাঁর কোনো দ্বিধা নেই। তাঁর কাছে চন্দন আর বিষ্ঠা সমান, সুতরাং গঙ্গাজল ও স্বমূত্ৰতেই বা প্ৰভেদ থাকবে কেন? গঙ্গা তাঁর শরীরের মধ্যে প্রবাহিত।
অন্য দল এতটা মানতে রাজি নয়। যোগীরাজ বা অবতারদেরও তো লোকশিক্ষার জন্য কিছু করতে হয়। এ কেমনধারা লোকাচার বহির্ভূত উৎকট ব্যবহার!
দলে দলে লোক ছুটে চলেছে সেই কালী মন্দিরের দিকে।
গঙ্গানারায়ণ বসে ছিল দশাশ্বমেধ ঘাটের পৈঠায়, যথাসময়ে সেও সংবাদটি শুনলো। কালী মূর্তির গায়ে প্রস্রাব ছিটানোর কাহিনী শুনে সে কৌতুক বোধ করলো খুব। এখন আর সে চক্ষু মুদলে সেই স্বর্ণজিহ্ব স্বর্ণনয়না মূর্তিটি দেখতে পায় না। শপথ ভঙ্গের কোনো গ্লানি তার নেই। এখন দেব-দেবীর। মূর্তি তার কাছে নিছকই প্রস্তর-দারু মূর্তি!
অবশ্য শপথ ভেঙেই বা কী লাভ হলো। বিন্দুবাসিনীর কোনো সন্ধান সে পায়নি। বোধকরি পাওয়ার আর কোনো আশাও নেই। ছড়িদার মনসারামের পিছন পিছন সে অনেক ঘুরেছে। যে লালাজীর কাছে বিধুশেখর টাকা পাঠাতেন, তাকেও সে খুঁজে বার করেছে, এরা দুজনেই বলতে চায় যে, বিন্দুবাসিনী আর বেঁচে নেই। কিন্তু সে কথা গঙ্গানারায়ণ বিশ্বাস করতে পারেনি পুরোপুরি। বিন্দুবাসিনী কোন রোগে মরলো, কোথায় তাকে দাহ করা হলো, সে বিষয়ে ঐ দুজনেই অস্পষ্ট উত্তর দেয়। কেমন যেন এড়িয়ে যেতে চায়। উদাসীনভাবে বলে, আর সে সব কথা শুনে কী হবে, বাবুজী! যা হবার তা তো হয়েই গেছে। আপনি ঘরে ফিরে যান। কাশীতে এক একা এমন দেওয়ানা হয়ে ঘুরবেন কেন?
কিন্তু গঙ্গানারায়ণের ফিরে যাওয়ার কথা একবারও মনে আসে না। কাশীর জীবন-যাত্রায় সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
কোনোই কাজ নেই, তাই গঙ্গানারায়ণ ভিড়ের স্রোতের সঙ্গে মিশে দেখতে গেল ত্রৈলঙ্গ স্বামীকে।
সেই কালী মন্দিরের চাতালে গঙ্গামুখী হয়ে স্থির ভাবে বসে আছেন সেই মানুষ-পাহাড়টি। শত শত লোক তাঁর কাছে গিয়ে গড় করছে, বহু লোক আকুল চিৎকার করে তাঁর কাছ থেকে আশীর্বাদ প্রার্থনা করছে, কিন্তু স্বামীজীর কোনো হুঁশ বোধই নেই। তিনি যেন কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। কিছুই শুনতে পাচ্ছেন না। সাধু সন্ন্যাসীদের প্রতি ভক্তি চটে গেছে গঙ্গানারায়ণের, কিন্তু ত্রৈলঙ্গ স্বামীর দিকে তাকিয়ে তার মনে হলো, এই মানুষটি কিছুটা অসাধারণ নিশ্চিত। এত লোকের ব্যাকুলতার মধ্যে এমন অনড় অটল হয়ে বসে থাকা যে-সে লোকের কর্ম নয়। কিন্তু এই যে ভক্তের দলবল, এরা কি মানুষ, না পোকামাকড়? এদের কি নিজস্ব চিন্তাশক্তি বলে কিছু নেই? ওরই মধ্যে অনেক লোক আবার সেই প্রস্রাব হাতে মেখে সেই হাত জিভে ছোঁয়াচ্ছে। ঘৃণায় গঙ্গানারায়ণের মুখ কুঞ্চিত হলো।
গতকাল সন্ধ্যাতেই কাশীতে একটি ভয়াবহ কাণ্ড ঘটে গেছে। শিশমহল নামে একটি বাড়িতে একদল দুৰ্বত্ত তলোয়ার বন্দুক নিয়ে হানা দিয়েছিল। সে বাড়ি ভর্তি অনেক লোক, এমনকি বাড়ির কর্তার একটি বন্দুকও ছিল, কিন্তু কেউ বাধা দিতে পারেনি, দুৰ্বত্তরা দুজনকে হত্যা করেছে, সব অর্থ-স্বৰ্ণালঙ্কার লুণ্ঠন করেছে এবং একজন সুন্দরী রমণীকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে। এতবড় একটা নৃশংস ঘটনা সম্পর্কেও কাশীর লোকদের তেমন মাথাব্যথা নেই। অথচ একজন সাধু কালীমূর্তির গায়ে অপকর্ম করেছে, তা নিয়েই সবাই উন্মত্ত।
সেদিন অপরাহ্ন গঙ্গানারায়ণ নৌকাযোগে গঙ্গা পার হয়ে ওপরের রামনগরে গেল বেড়াতে। কাশী ও রামনগরের মধ্যে খেয়া আছে, কিন্তু সে আগে এদিকে আসেনি। রামনগরের দিকে ঠিক শহর গড়ে ওঠেনি, কাশীর রাজার প্রাসাদ এবং তাঁর লোকলস্করের বাসস্থান, আর খানিক দূরে দূরে এক একটি ধনী ব্যক্তির অট্টালিকা। এদিকে তেমন লোক চলাচল করে না। গঙ্গাতীরের বিস্তীর্ণ ফাঁকা জমিতে সে এক এক পরিভ্রমণ করতে লাগলো।
গঙ্গানারায়ণের এখন প্রায়ই কলকাতার কথা মনে পড়ে। একমাত্ৰ জননী বিম্ববতীর জন্যই তার বক্ষে মোচড় লাগে। আর কারুর প্রতি তার টান নেই। নিজের স্ত্রীর কথা স্মরণে এলে তার একটুও মমতা জাগে না। তার স্ত্রীকে সে নিজের মনোমত গড়ে নেবার অনেক চেষ্টা করেছিল, পারেনি। লীলাবতী শুধু তার শয্যাসহচরী হতে পারে, তার জীবনসঙ্গিনী হবার ক্ষমতা তার নেই। অথচ গঙ্গানারায়ণের তো আর কেউ নেই, তার বুক ভরা নিঃসীম একাকিত্ব, সে একজন সঙ্গিনীকেই চেয়েছিল। লীলাবতী বিন্দুবাসিনীর স্থান নিতে পারলো না! এখন লীলাবতীর যা ঘটে ঘটুক, সেজন্য গঙ্গানারায়ণ দায়ী নয়।
আর মনে পড়ে কলেজ জীবনের বন্ধুদের কথা। কলেজ পরিত্যাগ করার পর থেকে আস্তে আস্তে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মধু, রাজনারায়ণ, ভূদেব, বন্ধু, গৌর—সবাই এক একদিকে ছড়িয়ে গেছে। গঙ্গানারায়ণের মনে হয়, ঐসব বন্ধুরা সকলেই স্বেচ্ছামত নিজের জীবন গড়ে নিয়েছে, শুধু গঙ্গানারায়ণই কিছু পারলো না। তার জীবনের কোনো স্থির লক্ষ্য ছিল না। বৃথাই সে ঘোরাঘুরি করলো এদিক-ওদিক। বিধুশেখরের স্বৈরাচার দমন করতে গিয়েও ব্যর্থ হলো সে। এখন সে কোন মুখে আর ফিরে যাবে দেশে? ব্যর্থ, পরাজিত ভাবে তার প্রত্যাগমনে সবাই উপহাস করবে না? ইব্রাহিমপুর পরগণা পরিদর্শন করতে গিয়ে অকস্মাৎ বজরা থেকে তাঁর উধাও হয়ে যাওয়ার কোন কারণ সে দশাবে? কারণটি তো সে নিজেই এখনো জানে না। বিন্দুবাসিনী নেই, তবু এই বারাণসীতেই সে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবে।
ফেরার জন্য গঙ্গানারায়ণ তীর ধরে ধরে খেয়াঘাটের দিকে আসছে, পথে অন্য একটি ঘাট পড়লো! তখন প্ৰায়ান্ধকার হয়ে এসেছে, আকাশে ফিকে জোৎস্নার আভা, বার্তাস বইছে মন্দ মন্দ। গঙ্গানারায়ণ দেখলো, নদী থেকে উঠে আসছে এক রমণী। সিক্ত বসন শরীরের সঙ্গে সাঁটা, পিঠের ওপর গুচ্ছ গুচ্ছ কেশভার, চক্ষু দুটি নিমীল।
তৎক্ষণাৎ গঙ্গানারায়ণের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল, তার হৃদয়ে সংশয়ের অবকাশ মাত্র হলো না। এক পলক দেখেই সে অস্ফুট কণ্ঠে বললো, বিন্দু!
ঘাটের কাছে দুজন স্ত্রীলোক একটি লাল বনাত মেলে ধরে আছে, যাতে সম্মুখ থেকে অন্য কেউ মানরতাকে দেখতে না পায়। কিন্তু গঙ্গানারায়ণ আসছিল নদীর ধার ঘেঁষে, তার চোখ চলে গিয়েছিল হঠাৎ সেদিকে।
দ্বিতীয়বার দৃষ্টিপাত করেই গঙ্গানারায়ণ আবার জোর করে ডেকে উঠলো, বিন্দু! তারপরই দৌড়োলো সেদিকে।
গঙ্গানারায়ণ ঘাটের কাছে গিয়ে পৌঁছোতেই সেই বনাত ধরে থাকা স্ত্রীলোক দুটি চিৎকার করে উঠলো দুর্বোধ্য ভাষায়। অমনি কোথা থেকে দুজন ভীমকায় প্রহরী এসে গঙ্গানারায়ণের হাত চেপে ধরে কর্কশ স্বরে বললো, বেওকুফ, বেহুদা কাঁহিকা—
গঙ্গানারায়ণ নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করলো। কিন্তু সেই যমদূত সদৃশ প্রহরীদের সঙ্গে শারীরিক শক্তিতে সে পারবে কেন? তারা তাকে টানতে টানতে নিয়ে গেল খানিক দূরে। গঙ্গানারায়ণ প্রবলভাবে ছটফটিয়ে বিন্দু বিন্দু বলে চিৎকার করলে তারা তার ঘাড়ে ও উদরে দুটি কোৎকা কষালো সজোরে, তাতে তার যেন দম বন্ধ হয়ে এলো।
গঙ্গানারায়ণ দেখলো, পথের ওপরে নামানো রয়েছে একটি তাঞ্জাম, সেখানে আরও সাত আটটি প্রহরী মাটিতে উবু হয়ে বসে আছে। গোলমাল শুনে তারা কয়েকজন কাছে এগিয়ে এলো, তাদের হাতে বর্শা।
অনেকদিন চুল কাটেনি, দাড়ি মুণ্ডিত করেনি, তাই গঙ্গানারায়ণকে তারা পথের বেওয়ারিশ উন্মাদ বলেই ধরে নিল। নইলে হয়তো সেখানেই তার ভবলীলা সাঙ্গ হতো। প্রহরীরা তাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ দিয়ে ও মারতে মারতে টেনে হিচড়ে খানিক দূর নিয়ে গিয়ে ফেলে দিল কাঁটা ঝোঁপ ভরা মাঠের মধ্যে।
গঙ্গানারায়ণ সংজ্ঞা হারায়নি। শারীরিক ব্যথা বেদনার চেয়েও অসম্ভব এক বিস্ময়বোধ তাকে বিমূঢ় করে দিল। তার চিনতে কিছুতেই ভুল হয়নি। কিন্তু বিন্দুর সঙ্গে এত সব প্রহরী কেন? বিন্দু কি তার ডাক শুনতে পায়নি? অথবা সত্যিই কি তার এতখানি দৃষ্টিবিভ্রম হলো? ঐ রমণী বিন্দু ছাড়া আর কে!
একটু পরেই হুম হাম শব্দে সে আবার সচকিত হলো। তাঞ্জামটি চলতে শুরু করেছে। গঙ্গানারায়ণও টলতে টলতে উঠে এলো পথের ওপর। তাঞ্জামের দুপাশে পদা ফেলা, ভিতরের আরোহিণীকে দেখা যায় না। দুজন মশালধারী ছুটছে তাঞ্জামের সঙ্গে সঙ্গে।
মরীয়া হয়ে ছুটে এসে গঙ্গানারায়ণ তাঞ্জামের পদ সরিয়ে ভিতরে মুখ ঢুকিয়ে অসম্ভব আর্তকণ্ঠে বললো, বিন্দু! আমি গঙ্গা, চিনতে পারিস না? তুই কোথায় চলেছিস?
কয়েক মুহূর্ত মাত্র, তার মধ্যেই একজন মশালিধারী ধাক্কা মেরে ফেলে দিল তাকে। এবং পরপর কয়েকজন প্রহরী মাড়িয়ে চলে গেল তার দেহ। ভলকে ভলকে রক্ত বেরুতে লাগলো তার মুখ দিয়ে। তাঞ্জামটি মিলিয়ে গেল পথের বাঁকে।
সেই অবস্থায় সেখানেই বেশ কিছুক্ষণ শুয়ে রইলো গঙ্গানারায়ণ। তার মস্তিষ্ক তখনো একেবারে স্বচ্ছ। প্রহরীরা নেহাৎ অবজ্ঞাবশেই তাকে হত্যা করেনি। কয়েকজন পদদলিত করে গেছে তাকে, মনে হয় যেন তার হাড়-পাঁজরাগুলি আর অটুট নেই। তখুনি উঠে দাঁড়াতে পারলো না গঙ্গানারায়ণ, তবু সেই অবস্থায় থেকেও তার মনে হলো, তার ভুল হয়নি। সে বিন্দুবাসিনীকেই দেখেছে। চক্ষু মুদে সে শুধু দেখতে লাগলো। তাঞ্জামের মধ্যে দেখা কয়েক মুহূর্তের সেই দশ্যটি।
রাজরাজেন্দ্রাণীর ভঙ্গিতে বসে ছিল বিন্দুবাসিনী। তার সবঙ্গে কত রকমের বহুমূল্য অলঙ্কার। তার রূপ যেন আরও বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়েছিল বিন্দুবাসিনী, মুখের একটি রেখা কাঁপেনি, চোখের পলক পড়েনি। সকালে ত্রৈলঙ্গ স্বামীর যেমন দৃষ্টি দেখেছিল গঙ্গানারায়ণ, বিন্দুবাসিনীর দৃষ্টিও যেন ঠিক সেই রকম। কোনো আর্ত রবেই ভ্রূক্ষেপ হয় না। ঠিক যেন প্রাচীন পাথরের মূর্তির জীবন্ত চক্ষু, কী কঠিন, কী অস্বাভাবিক!
প্রহরীদের প্রহারের জন্য নয়, বিন্দুবাসিনীর সেই দৃষ্টির জন্যই গঙ্গানারায়ণের ভয় করতে লাগলো। এ কোন বিন্দুকে দেখলে সে?
ছড়িদার মনসারাম পরিত্যক্ত ফুল বেলপাতা তৈজসপত্র ঝেঁটিয়ে পরিষ্কার করে সবেমাত্র বাড়ি ফেরার উপক্রম করছে, এমন সময় সেখানে ধুলি ধূসরিত, রক্তাক্ত, ছিন্ন-বসন গঙ্গানারায়ণ এসে উপস্থিত হলো তার সামনে। মনসারামের কাঁধ খামচে ধরে সে হিংস্র কণ্ঠে বললো, তুমি কেন আমায় মিথ্যে কথা বলেছিলে?
মনসারাম সচকিতে এদিকে ওদিকে তাকালো তারপর একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, বাবুজী, আমার ডেরায় চলুন।
গঙ্গানারায়ণ আবার চিৎকার করে বললো, না। আগে বলো, কেন মিথ্যে কথা বলে আমায় ধোঁকা দিয়েছিলে?
মনসারাম হাত জোড় করে কাতর গলায় বললো, বাবুজী, আমি সব বলবো। তবে এখানে বলা যাবে না, হাওয়া বহুৎ খারাপ, আপনি আমার ডেরায় চলুন আগে।
মনসারাম প্ৰায় টানতে টানতে গঙ্গানারায়ণকে নিয়ে চললো। কাছেই তার বাড়ি। বারাণসীর বড় বড় পাথরের বাড়ির একতলায় সাধারণত মানুষ থাকে না, সেইরকমই একতলার দুটি ঘরে মনসারামের সংসার। তার দুই পত্নী ও তিনটি সন্তান। নিছক ফুল-বাতাসা বিক্রয় করে ও পুণ্যার্থীদের চন্দনের ফোঁটা দিয়ে সে তার সংসারের অনটন ঘোচাতে পারেনি। মাঝে মাঝে দালালি করে কিছু উপরি জুটে যায়।
অতিশয় যত্নে সে গঙ্গানারায়ণের ক্ষতস্থান মুছে দিল। একটা নতুন কোড়া ধুতি এনে বললো, বাবুজী, আপনার পোষাক ছেড়ে এটা পরে নিন।
ঘরে জ্বলছে রেড়ির তেলের সেজবাতি। তার দুই পত্নী দ্বারের কাছে এসে কৌতূহলী হয়ে দেখছে আগস্তুককে। মনসারাম তাদের তাড়া দিয়ে বললো, এই যা, যা, উদ্ধার যা! বাবুজীর জন্য পানি লিয়ে আয়। আর এক বর্তন দহি। আর নিমক আন—
তারপর সে কোমলকণ্ঠে বললো, বাবুজী, একটু দহি খেয়ে নিন, শরীর ঠাণ্ডা হবে। আজ শুয়ে যান আমার এই গরীবখানায়।
গঙ্গানারায়ণের কোটরগত চক্ষু দুটি জ্বলছে। সে যেন মনসারামকে দগ্ধ করে ফেলতে চায়।
মনসারাম ধীর স্বরে বললো, বাবুজী, আমি গরিবলোক, সিংহ কিংবা শেরের সঙ্গে কি আমি বিবাদ করতে পারি! দেবী সিং-এর নামে এ তল্লাটে সবাই ডরে কাঁপে। তার যেমন ধনদৌলত, তেমন লাঠির জোর। তার সঙ্গে টক্কর দেওয়া, আমি তো দূরের কথা, আপনারও সাধ্য নয়। সেইজন্যই বলেছিলাম, আপনি মুলুকে ফিরে যান।
গঙ্গানারায়ণ বললো, তুমি কেন বলেছিলে যে মেয়েটি মরে গেছে? আমি আজ নিজে তাকে দেখলাম।
—ঠিকই তো বলেছিলাম, বাবুজী। হিন্দু ঘরের মেয়েকে যদি পরপুরুষে একবার নিয়ে যায়, তাহলে তাকে তো মরাই বলে। যমের হাত থেকে যেমন কারুকে ছিনিয়ে আনা যায় না, তেমনি হিন্দু রমণীকেও পরপুরুষের ঘর থেকে ফিরিয়ে আনা যায় না।
—উঃ, কী পাষণ্ড তোমরা! সে বেঁচে আছে জেনেও তার মৃত্যুর খবর রটিয়ে দিলে? তার বাড়িতেও সেই খবর পাঠিয়েছে, ঐ লালাজীও তোমার মতন চশমখোর।
—আরো সীয়া রাম, সীয়া রাম! লালাজী বড় ধরম প্ৰাণ মানুষ। কখনো অন্যায় করেন না। উনিই আপনাদের বাঁচাবার জন্য ঐ খবর ইচ্ছে করে রটিয়েছেন। নইলে, ভালো করে ভেবে দেখুন, আপনারা জাতে পতিত হয়ে যেতেন না? যে-বংশের মেয়েকে, তাও কিনা বিধবা, ভিন্ন জাতের লোক লুঠ করে নিয়ে যায়, সে বংশই পতিত হয়ে যায় না? বিদ্ধুবাবু ব্রামভান, তাঁর বংশে কলঙ্ক লেগে যেত না এই কথা জানাজানি হলে? আমি জানি, বাবুজী, বঙ্গালদেশে মগ-সংসর্গে কত ব্ৰামভন বংশ পতিত হয়ে গেছে।
—কী হয়েছিল আমায় খুলে বলো।
—নতুন তো কিছু না। এখানে এমন হামেশা হয়। খাপসুরত জেনানা দেখলেই তার পেছনে লোক লেগে যায়। প্ৰথমে লোভ দেখিয়ে ভোলাতে চায়। সোজা পথে কাম হলে তো ভালোই, নইলে জোর করে তুলে নিয়ে যায়। দিনের বেলা, সকলের সামনে দুশমনরা এসে তুলে নিয়ে যায় সুন্দর মেয়েদের। আপনাদের ঐ মেয়েটিকে যেদিন নিয়ে যায়, সেদিন আমি নিজে ঘাটে ছিলাম। সবাই হায় হায় করলো, ব্যস, আর কি, দশ পনেরো জন দুশমনকে কে আটকাবে?
—এ দেশে কি কোতোয়ালী নেই? পুলিশ নেই? আমি কালই পুলিশ নিয়ে গিয়ে ওকে উদ্ধার করে আনবো।
—বাবুজী, এখন রাবণের রাজত্ব, রামজীর দেখা নেই। আপনাদের কলকাতার মতন এখানে কথায় কথায় পুলিশ দৌড়য় না। পুলিশের সাধ্য কি, দেবী সিং-এর মহাল থেকে কোনো আওরৎকে বার করে আনে! আপনি কি ভাবছেন দেবী সিং নিজে ধরে নিয়ে গেছে! না, না, সে এমন নোংরা কাজে নিজে হাত লাগায় না। এখানে মেয়ে বিক্রির ব্যবসার ধুম চলছে। আপনারা বাঙালীরা বিধবাদের এই কাশীধামে পাঠিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকেন, ব্যস। তার মধ্যে কতজন যে রেণ্ডি পাড়ায় যায় আর কতজন বিক্রি হয়ে চালান হয়ে যায় তার খবর কে রাখে। সুরাট বন্দর দিয়ে আরব দেশেওকত লেড়কি চালান যায়।
-বিন্দুকে গুণ্ডারা বিক্রি করেছে?
—বিলকুল ঠিক ধরেছেন।
–তা বলে আমরা মেনে নেবো?
—তাছাড়া আর কী করবেন?
–আমি নিজের চোখে তাকে দেখেছি…দেবী সিং যদি তাকে আটকে রেখে থাকে, আমরা সেখান থেকে উদ্ধার করবোই। দেশ এখন অরাজক নয়, কোম্পানির আমলে আইন আছে, আইনের জোরে দেবী সিং-এর মতন গুণ্ডাদের শাস্তি দেওয়া যায়।
—বাবুজী, আজ রাতটায় ভালো করে নিদ যান, কাল মাথা ঠাণ্ডা হবে, তখন সব বুঝবেন। লেখনী পুস্তিকা ভার্যা পর হস্তং গতা গতাঃ–কলম কেতাব আর কামিনী একবার পরের হাতে গেলে আর ফিরে আসে না। সেইজন্যই তো বলছিলাম, মনে করে নিন, ও জেনানা পরলোকে চলে গেছে। ওকে ফিরিয়ে এনে আপনি কী করবেন?
—কী করবো মানে? কলকাতায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবো।
—আপনার মাথা গরম হয়ে গেছে, তাই বুঝছেন না। লুঠ করার পর কাটা জানোয়ার ঐ মাঈজীর ধরম নাশ করেছে কে জানে। তারপর পড়েছে দেবী সিং-এর খপ্পরে, শুনেছি, তার মহালে এমন বিশ ত্ৰিশটা জেনানা আছে। আপনি যদি ঐ মাঈজীকে বার করে আনতেও পারেন, তারপর কে তাকে স্থান দেবে? ওনার পিতাজী দেবেন? আপনি দেবেন? আপনি চাইলেও সমাজ দেবে না। কোনো উপায় নেই। ঐসব জেনানাদের শেষ পর্যন্ত স্থান হয় রেণ্ডি পাড়ায়। আপনি ওর কথা ভুলে যান। কেন শুধু শুধু এক ধরম ভ্ৰষ্টা, জাতি ভ্ৰষ্টা আওরতের জন্য নিজের বিপদ ডেকে আনবেন।
গঙ্গানারায়ণের মনে পড়লো ইব্রাহিমপুর পরগনায় মুসলমান চাষীটির বিবিকে নীলকর সাহেবরা ধরে নিয়ে গিয়েছিল, তার সম্পর্কেও তার খাজাঞ্চি সেন মশাই ঠিক এই কথাই বলেছিলেন। এরা একই কথা বলে। অন্য পুরুষ একবার ছুঁলে সেইসব মেয়েদের আর ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করাও অর্থহীন। তাদের আর কেউ ঘরে স্থান দেবে না।
গঙ্গানারায়ণের চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল পড়তে লাগলো। বিন্দু তাকে কোনোদিন তার শরীর স্পর্শ করার অধিকার দেয়নি। সূক্ষ্ম অনুভূতিপ্রবণ তার মন, ধর্মনীতি, শাস্ত্ৰনীতির ওপর অভিমান করে সে ভয়ঙ্কর কঠোর ব্ৰতচারিণী হয়েছিল, সেই বিন্দুকে কয়েকটা নরপশু মিলে–গঙ্গানারায়ণ আর ভাবতেও পারে না। বিন্দু কেন একটা কথাও বললো না তার সঙ্গে। কেন অমন হিমশীতল, নিষ্পন্দ চোখে চেয়েছিল?
মনসারাম বললো, লুঠ করা লেড়কিদের ফিরিয়ে এনে আরও বেশী ঝঞ্ঝাটে পড়তে হয় বলে আংরেজ পুলিশও আর এসব নিয়ে মাথা ঘামাতে চায় না। কোথায় রাখবে সেই লেড়কিদের? একবার বে-ইজ্জত হলে হিন্দু ঘরের জেনানার মরণই ভালো।
কথা বলতে বলতে সে দেখলো, গঙ্গানারায়ণ অজ্ঞান হয়ে ঢলে পড়ছে। মেঝেতে মাথা ঠুকে যাবার আগেই সে ধরে ফেললো, তারপর শুইয়ে দিল যত্ন করে। মনসারাম অনেক কিছু দেখেছে, জীবন কত কঠোর, কত বিচিত্র, সে জানে। কিন্তু এই ছোঁকরাবাবুটি বড় ঘরের ছেলে, মন নরম, হয়তো জীবনে এই প্ৰথম আঘাত পেল, তাই সহ্য করতে পারছে না।
এরপর কয়েকদিন গঙ্গানারায়ণ থেকে গেল মনসারামের বাড়িতে। মনসারামের দুই স্ত্রী পালা করে সেবা শুশ্রুষায় সুস্থ করে তুললো তাকে। মনসারামের স্ত্রী দুজন এক হিসেবে বড় অদ্ভুত। এরা পাশাপাশি দুটি ঘরে থাকে, এখন গঙ্গানারায়ণ একটা ঘর জুড়ে থাকায় ওরা দুজনেই একঘরেই এক সঙ্গে আশ্রয় নিয়েছে, কিন্তু ওদের কক্ষনো ঝগড়া বিবাদ করতে শোনা যায় না। পরস্পরের মধ্যে খুব ভাব, যেন দুই ভগিনী কিংবা দুই সখী।
একদিন ওদের সকলকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বিদায় নিল গঙ্গানারায়ণ। মনসারাম বারবার বলে দিল, গঙ্গানারায়ণ যেন কাশী ছেড়ে চলে যায়। এখানে থাকা তার পক্ষে বিপজ্জনক। দেবীসিং-এর অনুচররা চতুর্দিকে ঘোরাঘুরি করে, তারা যদি জানতে পারে যে, এই ছোঁকরাটি দেবী সিং-এর কেনা আওরতের দিকে নজর দিয়েছে, তাহলে তারা সেদিনই গঙ্গানারায়ণকে এ পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবে।
গঙ্গানারায়ণ মনসারামের কথায় মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। কিন্তু বারাণসী ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছে তার একটুও নেই। সে সাধুদের এক আখড়ায় গিয়ে আশ্রয় নিল, মিশে রইলো চ্যালাদের মধ্যে। খঞ্জনী বাজিয়ে যখন গান হয়, সেও গান ধরে, অন্যরা তার দিকে গঞ্জিকার কল্কে এগিয়ে দিলে সেও দু-এক টান মারে। আর প্রায়ই সন্ধের দিকে একটা ছোট নৌকো ভাড়া নিয়ে সে রামনগরে যাতায়াত করে।
তারপর এলো বৈশাখী পূর্ণিমার রাত। এ রাতে গঙ্গাতীরবতী বারাণসী আর তীর্থক্ষেত্র থাকে না, হয়ে ওঠে একটি প্রমোদ নগরী। এ শহরে মন্দির, সাধুদের আখড়া যত আছে, সে তুলনায় সঙ্গীত, নৃত্যের মজলিসও কিছু কম নেই। এই রাতে রেণ্ডিপাড়া খালি করে তারা সবাই চলে আসে গঙ্গার ধারে। লক্ষ্মেী, এলাহাবাদ থেকেও বাঈজীরা আসে এখানে।
কথায় বলে, যদি ভোর দেখতে চাও তো যাও বারাণসীতে, সন্ধ্যা দেখতে চাও তো যাও লক্ষেীতে, আর যদি রাতের সুস্নিগ্ধ বার্তাস উপভোগ করতে চাও তো চলে যাও মালবে। কিন্তু বৈশাখী। আর কোজাগরী পূর্ণিমার সন্ধ্যায় বারাণসী লক্ষীকেও টেক্কা দেয়। গঙ্গাবক্ষে ভাসে শত শত বজরা, দূর থেকে মনে হয় যেন শত রাজহংসী, আলোকমালায় সজিত। বজরার ছাদ থেকে ভেসে আসে সারেঙ্গি, তবলা বাদ্যের ধ্বনি আর নূপুরের নিক্কণ অথবা ঠুংরির সুমিষ্ট সুর। এই উপলক্ষে বড় বড় রাইস ব্যক্তিদের মধ্যে চলে প্ৰতিযোগিতা। বিশাল বিশাল পাত্ৰে গোলা হয় সিদ্ধি, সুরার বোতলও কম থাকে না, যার যেমন রুচি।
উৎসব শুরু হয় সন্ধ্যার সঙ্গে সঙ্গেই, উদ্দেশ্য থাকে একইভাবে নিশিভোর করে দেবার। কিন্তু বেশীর ভাগ বজরাতেই দেখা যায়, মধ্যরাত্রির পর নর্তকী নেচে চলেছে, বাঈজী গেয়ে চলেছে কিন্তু দর্শক বা শ্রোতারা নিঃশব্দ। বাবু তাঁর ইয়ারবক্সী নিয়ে সংজ্ঞাহীন। দাঁড়ি, মাঝি, প্রহরীরাও সিদ্ধির নেশায় বিভোর হয়ে পড়ে।
দেবী সিং-এর বজরা চারখানি একসঙ্গে বাঁধা। সন্ধে থেকেই দাপটে ফুর্তি শুরু করে দেবী সিং চালালো অনেকক্ষণ। পঞ্চাশোধ বয়েস দেবী সিং-এর, টকটকে ফস রং, গোলমরিচের রঙের মস্ত।বড় গোঁফ, মুখখানি ঠিক যেন বাঘের মতন। এখনো সে নর্তকীদের সঙ্গে নিজে উঠে নাচতে পারে, তবে নেশার ঝোঁকে যখন তার চোখ দুটি ঘোলাটে হয়ে আসে, তখন তার পরিহিত বস্ত্রও খসে পড়ে।
শেষ রাতের দিকে যখন সব নিঃসাড় হয়ে এলো, তখন একটি ছোট ডিঙ্গি এসে লাগলো দেবী সিং-এর একটি বজরার গায়ে। সেই ডিঙ্গি থেকে গঙ্গানারায়ণ সঠিক গবাক্ষটিতে উঁকি দিল।
ধবল জ্যোৎস্নায় কামরার ভিতরটি দেখতে অসুবিধে হয় না। শয্যায় পাশ ফিরে, পা দুটি গুটিয়ে ঘুমিয়ে আছে বিন্দুবাসিনী। জড়ির চুমকি বসানো রক্তবর্ণের রেশমী শাড়ি পরে আছে সে, গলায় একটি গোড়ের মালা, সুগন্ধে ঘরটি আমোদিত।
গঙ্গানারায়ণ ফিসফিস করে দু-বার ডাকলো, বিন্দু, বিন্দু!
বিন্দুবাসিনী চোখ মেলে তাকালো। সিদ্ধির নেশায় তার চোখ দুটি টকটকে লাল। সে চমকে উঠলো না। মাথাটি সামান্য তুলে, একটুখানি বাঁকিয়ে কৌতূহলী ভাবে চেয়ে রইলো। গঙ্গানারায়ণের মাথায় সন্ন্যাসীদের মতন বড় বড় চুল, মুখ ভর্তি দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল, তাকে সহজে চিনতে পারার কথা নয়।
বিন্দুবাসিনী শাড়ি-গয়নার শব্দ করে উঠে বসলো। তারপর হাত দুটি সামনের দিকে বাড়িয়ে খুব নরম গলায় বললো, কে, গঙ্গা? আয়—
যেন মাঝখানে বহু উত্তাল সময় বয়ে যায়নি, যেন নিয়তি তাদের নিয়ে চূড়ান্ত বিপর্যয়ের খেলা খেলেনি, যেন কিছুই হয়নি, ঠিক যেন আগের দিনই দেখা হয়েছিল, এমনভাবে ডাকলো বিন্দু। রামনগরের ঘাটে বিন্দুর ভাবলেশহীন মুখ দেখে গঙ্গানারায়ণ যতখানি অবাক হয়েছিল, আজ রাতে তার অতি-স্বাভাবিক ব্যবহার দেখেও গঙ্গানারায়ণ প্ৰথমে হতচকিত হয়ে গেল।
বিন্দু আবার বললো, আয়, গঙ্গা, ভেতরে আয়!
গঙ্গানারায়ণ এক লফে কামরার মধ্যে প্রবেশ করে ছুটে গিয়ে বিন্দুবাসিনীকে আলিঙ্গন করলো। তারপর যেন কত যুগ যুগান্ত কেটে গেল। কেউ আর একটিও কথা বললো না। শুধু বাইরে জলের ছলছল মধুর শব্দ। দুটি তপ্ত প্ৰাণ অনেকদিন পর এক সঙ্গে জুড়োচ্ছে। গঙ্গানারায়ণের পিঠে বিন্দুবাসিনীর দুই হাত, শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছে সে, যেন আর কিছুতেই ছাড়বে না।
গঙ্গানারায়ণই এক সময় ছড়িয়ে নিল নিজেকে। ব্যস্ত হয়ে বললো, আর একটুও দেরি নয়, আমি নৌকো এনিচি, তুই এক্ষুনি চল আমার সঙ্গে!
বিন্দু সারা মুখে চন্দ্ৰকিরণের মতন হাসি ফুটিয়ে বললো, কোতায়!
—চল, আমরা চলে যাবো, অনেক দূরে, বহু দূরে, যেখানে কেউ আমাদের চিনবে না—
বিন্দু আদুরে গলায় জিজ্ঞেস করলো, আগে বল, সেই জায়গা কোতায়?
গঙ্গানারায়ণ বললো, সে জায়গা আমরা খুঁজে নেবো, যেখানে আর কেউ নেই, কোনো বনের মধ্যে নদীর ধারে, একটা কুঁড়েঘর বেঁধে, শুধু তুই আর আমি।
বিন্দুবাসিনী হঠাৎ যেন খুব উৎসাহিত হয়ে বললো, সে রকম জায়গা আচে? চল, এক্ষুনি চলে যাই।
–চল, আমার হাত ধর।
—ওমা, আমার গয়নার বাক্স যে আনিনি।
–কী?
—গয়নার বাক্স আমার…একবার রামনগর ঘুরে যেতে হবে।
—গয়নার বাক্স দিয়ে কী হবে? ওসবের কিছু দরকার নেই।–
-সে কি, আমার অত গয়না, সেগুলো ফেলে যাওয়া যায় নাকি।
গঙ্গানারায়ণ আহতভাবে বললো, বিন্দু, তুই গয়নার কথা ভাবচিস? গয়না দিয়ে আমাদের কী হবে?
বিন্দুবাসিনী যে নেশার ঝোঁকে কথা বলছে, তা বুঝতে পারলো না গঙ্গানারায়ণ। বিন্দুবাসিনী তার ঢুলঢুলে চক্ষু দুটি গঙ্গানারায়ণের মুখের দিকে স্থাপন করে ফিক করে হেসে বললো, তুই সত্যি গঙ্গা? আমার সেই ছেলেবেলার খেলুড়ি? যাঃ, আমি স্বপ্ন দেখচি! আমার স্বপ্ন দেখতে ভাল্লাগে না! একদম ভাল্লাগে না!
গঙ্গানারায়ণ ব্যাকুল হয়ে বললো, বিন্দু আর একটুও দেরি করার সময় নেই। এক্ষুনি যদি কেউ জেগে ওঠে
বিন্দুবাসিনী সঙ্গে সঙ্গে বললো, ওমা, তাই তো! তুই এলি কী করে? দেবী সিং-এর লোকরা যে তোকে দেখলে একেবারে কেটে ফেলবে! তুই শিগগির চলে যা—
—তুই আমার সঙ্গে যাবি না?
—আমি? আমি কোতায় যাবো?
—বিন্দু দেরি করিসনি, এই পাপের জায়গায় আর এক মুহূর্ত থাকা নয়, আয় আমার সঙ্গে।
—কিন্তু আমার ছেলে?
–ছেলে!
দুজনে দুজনের দিকে নিবকিভাবে চেয়ে রইলো। কেউ যেন একটা মুগুড় দিয়ে প্রচণ্ড আঘাত করেছে গঙ্গানারায়ণের মাথায়। বিন্দু আগে বললো গয়নার বাক্সের কথা, তারপর…তারপর…।
বিন্দুবাসিনী এবার গঙ্গানারায়ণের বুকে মাথা রেখে হু হু করে কেন্দে ফেললো। বিমূঢ় হয়ে বসে রইলো গঙ্গানারায়ণ। এ কী শুনলো সে বিন্দুবাসিনীর মুখে?
আবার মুখ তুলে বিন্দুবাসিনী একটু সামলে নিল নিজেকে। আঁচলে চোখ মুছে সে শান্ত গলায় বললো, তুই জিজ্ঞেস করলি না, আমি কেন এতদিনে মরিনি?
গঙ্গানারায়ণ বললো, আগে এখেন থেকে চলে যাই, তারপর সব কথা শুনবো।
—তুই আমার ছেলেকে এনে দিতে পারবি?
—তুই কি বলচিস, আমি বুঝতে পাচ্চি না, বিন্দু!
—ইস, আমায় বড় বেশী খাইয়ে দিয়েচে, আমি তোকে ভালো করে দেকতে পাচ্চি না। ইস, এ কী চেহারা হয়েচে তোর, এত রোগা হয়ে গেচিস!
—বিন্দু, তুই আমার সঙ্গে যাবি না? আর দেরি করলে দুজনেই বিপদে পড়বো।
—শোন, মরা তো সহজ, আমি কি মরতে পারতুম না? ওরা আমাকে জোর করে ধরে নিয়ে গেল, মা মা বলে কত চ্যাঁচালুম, কেউ বাঁচাতে এল না…তার আগে কখনো পাপ করিনি, তবু দেবতারাও বাঁচালো না। আমায়, দেবী সিং-এর বাড়িতে হাত পা বেঁধে রেকেচিল, খাবার খেতে চাইনি, জোর করে মুখে দুধ ঢেলে দিয়েচে…আমার ওপর কত অত্যেচার করেচে, তবু ঠাকুরকে ডেকেচি, ঠাকুর আমায় মরণ দাও! আমার ডাক শুনে ঠাকুর কী দিল জানিস? আমার পেটে বাচ্চা এলো। পেটে বাচ্চা নিয়ে কি কেউ মরতে পারে বল, তুই বল?
আবার ফিক করে হেসে ফেলে বিন্দুবাসিনী বললো, তুই আমায় চিনলি কি করে, গঙ্গা? বিধবা ছিলুম, এখন দ্যাখ আমার কেমন ঝলমলে রঙীন শাড়ি, গায়ে গয়না, দাসীরা দুধের সর হলুদ বাটা দিয়ে আমার গা মেজে দেয়।
গঙ্গানারায়ণ নিরসভাবে জিজ্ঞেস করলো, তোর ছেলে হয়েচিল?
বিন্দুবাসিনী বললো, হী রে, ফুটফুটে ছেলে, ঠিক যেন রাজপুত্ত্বর!…ঠাকুরের কী খেলা ভেবে দ্যাখ, বিধবার পেটে ছেলে! চাইলুম মরণ, দিল ছেলে! তারপর আবার ছেলেকে কেড়ে নিয়ে গেল!
–কে?
–ওরা! তিন মাসের বাচ্চা, তাকে কেড়ে নিয়ে গেল, আমার কোল থেকে। কোতায় রেখেচে জানি না! ওদের কাচে ভিক্ষে চাই, ওগো, আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দাও! সেইজন্যই তো ওদের সব কথা শুনি, ওরা নাচতে বললে নাচি, হাঁ রে, আমি নাচতে শিখিচি, ওরা সিদ্ধি খেতে বললে সিদ্ধি খাই, যদি ছেলেকে ফিরিয়ে দেয়! আগে তো কখনো ভাবিনি যে আমি মা হবো; ওরে, মা হওয়া যে কী কষ্টের, কী সুখের!
গঙ্গানারায়ণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। জীবনে কোনো একটা ব্যাপারেও সার্থক হওয়া তার নিয়তিতে নেই। এত সাবধানতার সঙ্গে, এত পরিকল্পনা করে সে এসেছে বিন্দুবাসিনীর কাছে, তারপর যে এমন ঘটবে, তা সে দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি।
—তুই ফিরে যা গঙ্গা।
—তুই যাবি না?
—না রে, আমি কি যেতে পারি? আমি নষ্ট। আমার শরীর অপবিত্র। তুই যে বিন্দুবাসিনীকে চিনতিস, সে তো আমি নয়! আমি তো একটা কাশীর রেণ্ডি।
–ছিঃ, বিন্দু! তুই এখনো যদি আমার সঙ্গে যেতে চাস, আমরা দুজনে কোনো দূর দেশে চলে যেতে পারি।
—আমি বিচ্ছিরি, পোকায় খাওয়া, আমায় নিয়ে তুই কী করবি, গঙ্গা! উঃ, বড় মাথার যন্ত্রণা, একটু মাথা টিপে দিবি!
–আয়।
—না, না, আমি কী পাগলের মতন কথা বলচি। আমি কি তেমন ভাগ্য করে জন্মিচি? তুই চলে যা, ওরা এখুনি এসে পড়বে।
—আমি তোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে চাই, বিন্দু।
—ওরে, সে আর আমার ভাগ্যে নেই। তুই যা, আমার মাথার দিব্যি, তুই চলে যা, চলে যা, চলে যা।
বিন্দুবাসিনী এমন এক স্বরে চলে যাওয়ার কথা বলতে লাগলো যে গঙ্গানারায়ণ আর স্থির থাকতে পারলো না। সে চলে যাওয়াই ঠিক করলো। বিন্দু যাবে না, সে বুঝতে পেরেছে। ছেলেকে ছেড়ে কোন মা যায়? হোক না পাপের সন্তান তবু তো নিজের গর্ভের ফুল।
কোনো রকম বিদায় না নিয়ে গঙ্গানারায়ণ আবার গবাক্ষ দিয়ে বেরিয়ে এসে ডিঙ্গি নৌকোয় উঠলো। অন্য মাঝি আনেনি, সে নিজেই দাঁড় বাইবে। এত বড় একটা দুঃসাহসী কাজ সে জীবনে কখনো করেনি, তবু সব বৃথা গেল। দাঁড়টা তুলে নিয়ে সে দেখলো বিন্দু গবাক্ষ দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ব্যাকুল ভাবে চেয়ে আছে। পরিপূর্ণ আলোয় এবার গঙ্গানারায়ণ বুঝতে পারলো, বিন্দুর মুখখানি অস্বাভাবিক নেশাগ্ৰস্ত।
বিন্দু প্ৰায় কেঁদে উঠে বললো, তুই চলে যাচ্ছিস গঙ্গা? আমায় নিয়ে যাবি না?
গঙ্গানারায়ণ এক হাত বাড়িয়ে বললো, আয়।
বিন্দু সঙ্গে সঙ্গে নৌকোয় নেমে এলো!
গঙ্গানারায়ণ রুদ্ধশ্বাসে বললো, মাথা নীচু করে বসে পড়, কেউ যেন দেখতে না পায়।
বজরা থেকে খানিকটা দূরে নৌকোটা সরে আসার পর বিন্দুবাসিনী খানিকটা জল মাথায় চাপড়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। তার চুল খোলা, জ্যোৎস্নায় ঝলমল করছে শরীরের অলঙ্কার। দুদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে সে যেন আপন মনে বললো, আঃ, বড় সুন্দর, বড় সুন্দর এই পৃথিবী।
গঙ্গানারায়ণ বললো, বিন্দু, বসে পড়, কেউ দেখতে পাবে!
বিন্দুবাসিনী সে কথায় ভ্রূক্ষেপ না করে হঠাৎ নিজের গলা চেপে ধরে অসম্ভব তীক্ষ্ণ গলায় চিৎকার করে উঠলো, ওহ হো হো হো, আমায় দিলে না, আমায় কেউ দিলে না—
হঠাৎ আবার পরিষ্কার কণ্ঠে বললো, নীচে মা গঙ্গা, মাথার ওপরে আকাশে রয়েচেন দেবতারা, সবাইকে বলে গেলুম, যদি পরজন্ম থাকে, তবে পরজন্মে যেন তোকে আমি পাই। এ জন্মে আমার সব নষ্ট হয়ে গেল রে! সব নষ্ট হয়ে গেল! আমায় কেউ কিচু দিলে না…।
গঙ্গানারায়ণকে প্রস্তুত হবার কোনো সুযোগ না দিয়ে বিন্দুবাসিনী ঝাঁপিয়ে পড়লো জলে। ডিঙ্গি নৌকোটা প্রচণ্ডভাবে দুলে ওঠায় গঙ্গানারায়ণ একটুক্ষণের জন্য দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল। তারপর সেও ঝাঁপ দিল।
জ্যোৎস্নায় ধুয়ে যাচ্ছে সব দিক। গঙ্গানদীকে সেইজ্যোৎস্নায় মনে হয় যেন এক প্রশস্ত পথ। সেই পথ চলে গেছে কোন নিরুদ্দেশের দিকে।
একটু পরেই শুরু হলো ঝড়। সব বজরাগুলো একসঙ্গে দুলে উঠলো। তারপর ঝড় ও বৃষ্টি মাখামাখি হয়ে মুছে দিল বিশ্ব চরাচর।
।। প্ৰথম পর্ব সমাপ্ত।।
Please continue