৫০. দূর পৃথিবীর ডাক

দূর পৃথিবীর ডাক

৫০. বরফ বর্ম

শেষ বরফপাতটি ওঠানোর ব্যাপারটি হওয়া উচিৎ ছিল আনন্দময় ঘটনা। কিন্তু সেটা এখন বড়জোর একটা বিষণ্ণ সন্তুষ্টি। থ্যালসার তিরিশ হাজার মিটার ওপরে শেষ বরফপাতটি ওঠানোর সঙ্গে সঙ্গে বরফ বর্মটি শেষ হলো।

দু’বছর পর এই প্রথম কোয়ান্টাম ড্রাইভ আবার ব্যবহার হলো, যদিও খুব অল্প শক্তিতে। ম্যাগেলান তার স্থির কক্ষপথ ছেড়ে গতি নিয়ে পরীক্ষা করলো বরফ বর্মের দৃঢ়তা এবং ভারসাম্য–যা তাকে নিয়ে যাবে নক্ষত্র রাজ্যের মাঝে। কাজটি ভালোই হয়েছে, কোন সমস্যা হলো না। এটা ছিল ক্যাপ্টেন বে’র জন্য একটা বিরাট স্বস্তি। কারণ তিনি কোনভাবেই এই কৃত্রিম হিমবাহের একজন অন্যতম স্থপতি ইয়েন ফ্লেচারের কথা ভুলতে পারছিলেন না। যাকে অবশ্য এখন উত্তর দ্বীপে আটকে রাখা হয়েছে এবং মাঝে মাঝে জানতে ইচ্ছে হয় যে, এই সাফল্যের অনুষ্ঠান দেখতে ফ্লেচার এবং অন্যান্য স্যাব্রাদের কেমন লাগছে। অনুষ্ঠানে ছিল একটা ভিডিও রেট্রোস্পেকটিভ, যাতে প্রথম বরফ তৈরীর ঘটনা এবং প্রথম বরফপাত ওঠানোর দৃশ্য দেখানো হয়েছিল। তারপর তাতে মহাকাশ ব্যালের সঙ্গে সঙ্গে দেখানো হলো বরফপাতগুলো কেমন করে উঠে গিয়ে বরফর্ম তৈরী করে। এখানে প্রথমে সত্যিকারের বিরতি এবং পরে প্রতি সেকেন্ডে প্রতিটি বরফপাত ওঠার দৃশ্য আসছিল। থ্যালসার প্রধান সুরকার এমনভাবে কম্পোজিশন করেছিলেন, যাতে প্রথমে খুব মৃদু লয়ে বাজনা শুরু হয়ে পরে দ্রুততায় পৌঁছে সবশেষে আবার ফিরে আসে প্রথম কোমল স্বরে।

এরপর দৃশ্য চলে গেল গ্রহের ছায়ায় ঘুরতে থাকা ম্যাগেলানে। তাৎক্ষণিক সচিত্র ভিডিওতে যে বিশাল সান-স্ক্রীনটা বরফটাকে ঢেকে রাখে, সেটা সরে গেলে পুরো বর্মটাকে প্রথমবারের মতো দেখা যায়।

ঠান্ডা সাদা বরফ পাতটা নিচের ফ্লাড লাইটের আলোয় ঝলসে উঠল। খুব শিগগিরি এটা চলে যাবে এমন মহাজাগতিক রাতে যেখানে তাপমাত্রা পরম শূন্যের মাত্র কয়েক ডিগ্রি ওপরে। সেখানে এটা কেবল উষ্ণ হবে নক্ষত্রের আলো, মহাকাশযানের রেডিয়েশন আর হঠাৎ করে আছড়ে পড়া কোন বস্তুর সংঘর্ষে।

ক্যামেরা ঘুরে বেরাতে লাগল বরফ বর্মের উপর তার সঙ্গে ভেসে এল সুপরিচিত মমাজেস ক্যালডরের ধ্বনি।

থ্যালসার অধিবাসীরা তোমাদের উপহারের জন্য ধন্যবাদ। আশা করি এই বরক বর্মের পেছনে সত্তর আলোকবর্ষ দূরে তিনশ র পাড়ি দিয়ে আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছুবো। যদি সবকিছু ভালোভাবে চলে তাহলে সাগান-২তে আমরা পৌঁছাব অন্তত বিশ হাজার টন বরফ নিয়ে। এটাকে তখন ফেলা হবে গ্রহটার উপরে। এবং ঢোকার সময় সংঘর্ষে এটা গলে বন্ধ্যা সেই গ্রহে প্রথম বৃষ্টি ঘটাবে। জমে যাবার আগে সেটাই গ্রহের আদি সমুদ্র হবে। একদিন আমাদের উত্তরসূরীরা একটা সমুদ্র পাবে তোমাদের মতো যদিও তোমাদের মতো গভীর বা বিস্তৃত নয়। নতুন গ্রহে আমাদের দুই বিশ্বের জল মিলবে এক নতুন জীবনের স্পন্দনে। এবং আমরা তোমাদের মনে রাখব, ভালোবাসায় আর কৃতজ্ঞতায়।

৫১. পবিত্র

-কি সুন্দর! মিরিসা শ্রদ্ধা মিশ্রিত স্বরে বললো। এখন আমি বুঝতে পারলাম কেন পৃথিবীতে স্বর্ণ এতো মূল্যবান ছিল।

-সৰ্ণ ছিল খুব কম গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। ক্যালডর ভেলভেটের বার থেকে দ্যুতিময় জিনিসটা বের করতে উত্তর দিল। তুমি কি বলতে পার এটা কি?

-নিশ্চয়ই এটা আরও বেশী কিছু?

-তুমি ঠিকই বলেছ। এটা একটা মহান সৌধ, একশ মিটারের উঁচু-তার প্রতিকৃতি। আদতে একটার ভেতরে আরেকটা নিয়ে মোট সাতটা অংশ ছিল। এটা ছিল সবচেয়ে ভেতরে পবিত্রতার শেষ চিহ্ন। আমার কিছু বন্ধু পৃথিবীর শেষ রাতে আমায় দিয়েছিল। তারা আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছিল সব কিছুই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চার হাজার বছর ধরে এটা পাহারা দিয়েছি। এটাকে নিয়ে যাও তারাদের দেশে। আমাদের আশীর্বাদ রইল।”

যদিও আমি তাদের বিশ্বাসে বিশ্বাসী নই কিন্তু এমন অমূল্য এক উপহার আমি কিভাবে অস্বীকার করি? এখন এটা এখানেই থাকুক। মানুষ যখন প্রথম এখানে এসেছিল তা ছিল পৃথিবীর প্রথম উপহার- এটা হোক শেষ।

-এভাবে বলল না, মিরিসা বলল। তোমরা এতো উপহার দিয়েছ–আমরা শুনে শেষ করতে পারব না।

লাইব্রেরীর জানালা দিয়ে পরিচিত দৃশ্য দেখতে দেখতে ক্যালডর কিছুক্ষণ কিছু বলল না। থ্যালসায় তার খুব ভালো সময় কেটেছে। থ্যালসার ইতিহাস পড়ে যা জেনেহে তা সাগান-২-এ নতুন উপনিবেশ করার জন্য অমূল্য সম্পদ হবে।

পুরানো মাতৃযান-বিদায়, সে ভাবল। তুমি তোমার কাজ ভালোই করেছ কি আমাদের তো আরও যেতে হবে বহুদূর। আশা করি তোমার মতোই ম্যাগেলান আমাদের বিশ্বাসী বন্ধু হবে। যেমন তুমি ছিলে এদের প্রতি।

-আমি নিশ্চিত যে, আমার বন্ধুরা আমার সঙ্গে একমত হবে, যে আমি ঠিকই করেছি। মহাকাশযানের চাইতে এখানকার পৃথিবীর যাদুঘরে এটা অনেক বেশী নিরাপদে থাকবে। এমনও তো হতে পারে যে আমরা সাগান-ত পৌঁছুতেই পারলাম না।

-অবশ্যই তোমরা পারবে। কিন্তু তুমি আমাকে বললে না তো যে ওই সাতটা বাক্সের মধ্যে কি থাকতো।

-এটা হচ্ছে একজন মহামানবের স্মৃতি চিহ্ন। তিনি এমন এক বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন যা কোন রক্তে রঞ্জিত হয়নি। আমার মনে হয় সেও নলে অবাক হতো যে চল্লিশ হাজার বছর পর তার একটা দাঁত নক্ষত্রের পথে উড়ে গিয়েছে।

৫২. দূর পৃথিবীর ডাক

এখন যাত্রার সময়। সময় বিদায়ের। মৃত্যুর মতোই এই বিচ্ছেদ। থ্যালসা এবং ম্যাগেলানে যত অশ্রু ঝরে পড়ল, তার পেছনে একটা স্বস্তিও অবশ্য ছিল। যদিও ঠিক আগের মতো কখনোই ফেরা হয়না–তবুও জীবন আবার তার পুরোনো ছন্দ ফিরে পাবে। অভিযাত্রীরা ছিল যেন এমন এক অতিথি–যাদের থাকাটা একটু বেশী হয়ে গেছে গৃহস্বামীর বাড়িতে। এখন তাই যাবারই সময়।

এমনকি প্রেসিডেন্ট ফারাদীনও মেনে নিয়েছেন এবং তার আন্তঃগ্রহ অলিম্পিকের স্বপ্ন বাদ দিয়েছেন। তবুও তার যথেষ্ঠ তৃপ্তি আছে। ম্যানগ্রোভ বনের বরফ-কল উত্তর দ্বীপে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আগামী আসরের আগেই স্কেটিং রিং তৈরী হয়ে যাবে।

কোন প্রতিযোগী পাওয়া যাবে কিনা কে জানে–তবে অনেক তরুণ ন্যাসানই আগেকার খেলোয়াড়দের ভিডিও দেখতে শুরু করেছে।

ইতিমধ্যে সবাই একমত যে ম্যাগেলানের যাত্রা উপলক্ষে একটা অনুষ্ঠান বা উচিত। কিন্তু সমস্যা হল কি করা উচিত তা নিয়ে কেউ একমত হতে পারছে না। যদিও ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রচুর অনুষ্ঠান সবাইকে শারীরিক এবং মানসিকভাবে ক্লান্ত করে ফেলেছে–কিন্তু কোন সরকারী উন্মুক্ত অনুষ্ঠান হয়নি। তারানার পক্ষ হতে মেয়র ওয়াডের্ন অনুষ্ঠানটি প্রথম অবতরণের জায়গায় করবার দাবী জানালেন। প্রেসিডেন্ট ফারদীন ছোট হলেও প্রেসিডেন্টের প্রাসাদই এর জন্য উপযুক্ত বলে যুক্তি দেখালেন। কেউ কেউ মধ্যবর্তী হিসাবে ক্র্যাকানের বিখ্যাত উপত্যকাকে চিহ্নিত করলেন।

যতক্ষণ পর্যন্ত না থ্যালসার সম্প্রচার কর্তৃপক্ষ, গ্রহের সবচেয়ে শক্তিশালী আমলাতন্ত্র নিঃশব্দে পুরো ব্যাপারটা ঠিক করুন ততক্ষণ পর্যন্ত পুরো ব্যাপারটা ঝুলে রইল।

বিদায়ের সঙ্গীতকে হতে হবে অনাগত ভবিষ্যতের জন্য মনে রাখার মতো কিছু একটা। কোন ভিডিও থাকবে না এর আবেদন অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য। শুধু বাজনা এবং নেপথ্য কণ্ঠ। দুই হাজার বছরের ঐতিহ্যকে নিয়ে, ভবিষ্যতের জন্য অনুপ্রেরণা হবে মূল বিষয়। যান্ত্রিক উৎকর্ষতার শেষ পর্যায়ে গিয়ে কম্পোজাররা নতুন কি কম্পোজিশন বের করতে পারে তা আসলেই এক প্রশ্নের ব্যাপার। দুই হাজার বছর ধরে ইলেকট্রনিক যন্ত্রগুলো মানব কানে পৌঁছায় এমন বাজনার প্রতিটি কমান্ড দিয়ে গেছে। ঐ মাধ্যমে আর নতুন কিছু আছে বলে মনে হয়না।

অবশ্য নতুন সব ইলেকট্রনিক যন্ত্রে কম্পোজারদের অভ্যস্ত হতেই এক হাজার বছর লেগে গিয়েছিল। প্রযুক্তি আর কলার এই নতুন বন্ধনে বেটোফেন এবং বাখকে অতিক্রম না করলেও তাদের কাছে অনেকেই পৌঁছেছিলেন।

শ্রোতাদের কাছে এ ছিল নতুন জিনিস। পৃথিবীতে যা রেখে আসা হয়েছিল এ তার স্মৃতি। বিশাল ঘন্টার দূরাগত ধ্বনি পুরোনো মন্দিরের অদৃশ্য ধোঁয়ার মতো; শান্ত মাঝির সুর যা হারিয়ে গেছে চিরতরে; যুদ্ধে যাবার সৈনিকের গান- সময় যাদের সব দুঃখ কষ্ট চুরি করে নিয়ে গেছে; পৃথিবীর বড় শহরের দশ মিলিয়নের কণ্ঠস্বর; ঠান্ডা বরফের উপরে অরোরার অশরীরি নৃত্য; নক্ষত্র যাত্রার শক্তিশালী ইঞ্জিনের গর্জন। এই সব শব্দাবলী ভেসে এলো বিদায় সঙ্গীতে- সে সঙ্গীতে আছে দূর পৃথিবীর ডাক, আলোকবর্ষ পেরিয়ে যার আহ্বান…

শেষ অংশ হিসেবে প্রযোজক রেখেছিলেন শেষ শ্রেষ্ঠ সিম্ফনীকে। থ্যালসা যখন পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্ক হারায় সে বছরেরই সৃষ্টি। দর্শকদের কাছে এটা সম্পূর্ণ নতুন। এর সামুদ্রিক ভাবটা ছিল অনুষ্ঠানের জন্য সম্পূর্ণ যুৎসই। এবং এর প্রভাব দর্শকদের ওপর যা ছিল তাই হতে পারে বহু আগে মৃত সুরকারের সর্বোচ্চ ইচ্ছা।

আমি যখন ‘আটলান্টিস শোকগাঁথা রচনা করি, তেমন কোন বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল না। আমার কিছু অনুভূতি প্রবল ছিল, কোন সচেতনতা নয়। আমি চেয়েছিলাম সুরটা একটা বিষাদ, একটা রহস্য- একটা সব হারানোর ছায়া আনুক। মৎস্যে ঘেরা কোন শহরের ছবি আমি আঁকতে চাইনি। কিন্তু অদ্ভুত একটা ব্যাপার হচ্ছে এখন যখনই আমি শেষটা শুনি, মনে হয় আমি এর জন্যই তৈরী…

যখন কিছু বাজনা নামতে নামতে অর্গানের একদম শেষ শব্দহীন জায়গায় নেমে গেল তারপর গভীর থেকে শব্দটা উঠতে লাগল, চড়া হতে শুরু করল…তুমি তো জানই যে সেই প্রাচীন, বিশাল তিমিদের সঙ্গীতের উপর ভিত্তি করে এটা রচনা করেছিলাম, যাদের আমরা বহু আগেই শেষ করে ফেলেছি নিষ্ঠুরভাবে। আমি এটা ওলগা কভ্রাসিনের জন্য লিখেছিলাম এবং তারপর আর কেউ ইলেকট্রনিক্সের সাহায্য না নিয়ে এটা গাইতে পারেনি।

কণ্ঠ সঙ্গীত যখন শুরু হয়, আমার মনে হয় সত্যি সত্যি কিছু একটা আছে। আমি দাঁড়িয়ে আছি সেন্ট পিটার অথবা সেন্ট মার্কসের মতো বড় শহরের চতুরে। আমার চারপাশে আছে ভাঙ্গা, পুরনো গ্রীক মন্দিরের মতো বাড়ী, শুয়ে থাকা মূর্তি।

সমুদ্রের আগাছা আর গুল্মরা আমার চারপাশে দুলছে। আর সবকিছুই ঢাকা পড়ে আছে শ্যাওলায়।

চত্বরটা ফাঁকা থাকে প্রথমে, তারপর কিছু একটা নড়াচড়া করে। আমাকে জিজ্ঞেস করো না, কেন এটা সব সময়ই হঠাৎ আসে, কেন প্রতিবারেই মনে হয় আমি প্রথম দেখছি…

চত্বরের মাঝে একটা ঢিবি থেকে কয়েকটা দাগ বেরিয়ে গেছে। আমার মনে হয় যেন সেগুলি ধ্বসে পড়া দেয়াল, শ্যাওলায় ঢাকা। জিনিসটার কোন মাথা মুন্ডু খুঁজে পাওয়া যায় না– তারপর হঠাৎ দেখি টিবিটা নড়ছে।

এক মুহূর্ত পর আমি দেখি বিশাল দুটো চোখ আমার দিকে নিস্পলক চেয়ে আছে। এইই সব–আর কিছু নয়। এখানে গত ছয় হাজার বছরে কিছু হয়নি। যখন থেকে সমুদ্র এই ভূমি গ্রাস করেছে এবং হারকিউলিসের প্রাচীর ডুবে গেছে। লেনেটা আমার সবচেয়ে প্রিয়। কিন্তু এতো দুঃখ আর নৈরাশ্যে আমার শেষ করতে ইচ্ছে করে না। তাই চূড়ান্ত ‘পুনরুত্থান’।

আমি জানি প্লেটোর আটলান্টিস কখনোই ছিল না। আর তাই এর মৃত্যুও নেই।

এটা একটা আদর্শ–একটা নিখুঁত স্বপ্ন সব মানুষকে উদ্দীপ্ত করার এক উৎস। তাই ভবিষ্যতের পদক্ষেপের স্বপ্নে সিম্ফনি শেষ হয়।

আমি জানি পদযাত্রার জনপ্রিয় ব্যাখ্যাটা হচ্ছে মুদ্র হতে আটলান্টিসের নবযাত্রা। সেটা খুব বেশী গৎবাঁধা। আমার কাছে চূড়ান্ত যাত্রা হচ্ছে নক্ষত্রের পানে যাত্রা শুরু করার পর সমাপ্তি সঙ্গীত শেষ করতে আমার মাস খানেক সময় লেগেছে। এই পনেরোটা নোট আমার মাথা খারাপ করে দিয়েছিল। এখন শোকগাথা আমার কাছ থেকেই আলাদা হয়ে গেছে। এর নিজের একটা পথ হয়ে গেছে। এমনকি যখন পৃথিবী ধ্বংসও হয়ে যাবে তখনও টিসোলকোভস্কি গ্রহাণুতে বসানো পঞ্চাশ হাজার মেগাওয়াটের ডিপ স্পেস অ্যান্টেনা দিয়ে অ্যামিডা নক্ষত্রের দিকে সুর ভেসে যাবে।

একদিন, হাজার কোটি বছর পর এটা কেউ ধরবে, শুনবে এবং বুঝবে।

–কথার স্মৃতিঃ সের্গেই ডি পিটার (৩৪১১-৩৫০৯)

৫৩. সোনালী কিশোর

–আমরা এমন ভাব করি যেন ওটা নেই, মিরিসা অনুযোগ করল। কিন্তু আমি একবার ওটা দেখতে চাই।

লোরেন কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর উত্তর দিল- তুমি তো জান, ক্যাপ্টেন বে কোন অতিথি গ্রহণ করেন না।

মিরিসা জানে- কেন, তাও বোঝে। যদিও প্রথমে এটা বেশ কথা তুলেছিল। কিন্তু থ্যালসার সবাই এখন ব্যাপারটা বোঝে। ম্যাগেলানের অল্প সংখ্যক ক্রুদের মধ্যে অনেককেই ব্যস্ত থাকতে হবে ভ্রমণ সঙ্গী হিসেবে বা শূন্য-মধ্যাকর্ষণে যে পনের ভাগের মতো দর্শকদের বমি চলে আসে তাদের সেবায় লাগতে হবে। এমনকি প্রেসিডেন্ট ফারাদীনকেও কৌশলে নিবৃত্ত করা হয়েছে।

–আমি মোজেসকে বলব। সে ক্যাপ্টেনকে বলবে। তাহলে হবে। কিন্তু মহাকাশযান চলে যাওয়া পর্যন্ত এটা যেন গোপন থাকে।

লোরেন তার দিকে তাকাল-হাসল। মিরিসা সব সময়ই তাকে অবাক করে, এটাই অবশ্য তার প্রতি আকর্ষণের মূল একটা কারণ এবং কিছুটা বিষাদের সঙ্গেই সে বুঝল মিরিসারই এই দাবী করা সাজে। তার ভাইই একমাত্র ল্যাসান যে ওপরে যেতে পেরেছিল। ক্যাপ্টেন বে বিবেচক মানুষ-প্রয়োজন অনুসারে তিনি নিয়ম পাল্টান। এবং মহাকাশযান চলে যাওয়ার পর আজ থেকে ঠিক তিনদিন পর-আর কিছু আসে যায় না।

–যদি তোমার সমুদ্র পীড়া থাকে?

–আমার কখনো হয়নি।

–সেটা কিছু প্রমাণ করে না।

-–আমি কমান্ডার নিউটনকে দেখিয়েছি। আমাকে তিনি পঁচানব্বই ভাগ মানসম্পন্ন বলেছেন। তিনি আমাকে মাঝরাতে শাটলে যেতে বলেছেন–তখন কোন লোক থাকে না আশেপাশে।

-তুমি সব ব্যবস্থা করে ফেলেছ–তাই না? লোরেন প্রশংসার সুরে বলল। দু’নম্বর ল্যান্ডিংয়ে মাঝরাতের পনের মিনিট আগে আমি দেখা করব। সে থামল। তারপর কষ্টে যোগ করল, আমি আর নামব না। ব্র্যান্টকে আমার হয়ে বিদায় জানিও।

এটা এমন একটা জিনিস যেটার মুখোমুখি সে হতে পারে না। কুমার মারা যাবার পর সে আর লিওনার্দের বাড়ীতে পা রাখেনি। ব্র্যান্ট আবার ফিরে এসেছে। যেন সে তাদের জীবনে কখনোই প্রবেশ করেনি।

সেও তাদের এড়িয়ে চলেছে। এখনও সে মিরিসার দিকে তাকায় ভালোবাসার দৃষ্টিতে, কিন্তু কামনা ছাড়াই। একটা গভীর বেদনা যা সে খুব কমই পেয়েছে–তার মন আচ্ছন্ন করে রেখেছে। কতদিন সে ভেবেছে সে তার সন্তানকে দেখবে। কিন্তু ম্যাগেলানের নতুন সূচী তা অসম্ভব করে তুলেছে। যদিও সে তার সন্তানের হৃদস্পন্দন শুনেছে, কিন্তু সে কখনোই তাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরতে পারবে না।

শাটলটা দিনের অংশে গেলে, মিরিসা প্রথম ম্যাগেলানকে দেখে প্রায় একশ কিলোমিটার দূর থেকে। মনে হয় সূর্যালোকে জ্বলা কোন খেলনা। দশ কিলোমিটার দূর থেকেও একে খুব বড় মনে হয়না। মধ্যের ওই গোল কালো জিনিসগুলো জানালা এমনটাই সে মনে করতে চাইছিল। শেষমেষ ঢোকার পর সে মেনে নিল যে ওগুলোই অবতরণের জায়গা।

লোরেন উদ্বিগ্নভাবে সীটবেল্ট খুলতে থাকা মিরিসার দিকে তাকিয়ে ছিল। এটাই হচ্ছে সবচে ভয়ঙ্কর সময়। সীটবেল্ট খোলা হঠাৎ মুক্তি পাওয়া অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী যাত্রী হঠাৎই প্রথমবারের মতো বুঝতে পারে যে শূন্য-মাধ্যাকর্ষণ ততটা সুখপ্রদ জিনিস নয়। তবে বায়ুরোধী দরজা পেরিয়ে কয়েক ধাপ আসা মিরিসার মধ্যে কোন অস্বস্তি নেই।

ভাগ্য ভালো যে এক-মাধ্যাকর্ষণ স্থানে তোমার যেতে হবে না। দ্বিতীয়ত আবার ঠিক হওয়া ঝামেলা। মাটিতে না ফেরা পর্যন্ত মাধ্যাকর্ষণ নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না।

এদের থাকার, খাবার জায়গাটা দেখতে পেলে ভালো হতো, মিরিসা ভাবল। কিন্তু সেখানে প্রচুর মোলায়েম কথা বলতে হবে অনেকের সঙ্গে। এখন যে জিনিসটা সে চাচ্ছে না। ক্যাপ্টেন বে থ্যালসায় ভেবে তার ভালো লাগল–কোন সৌজন্য সাক্ষাতকারে যেতে হবে না।

তারা এয়ারলক ছেড়ে পুরো মহাকাশযানের সমান লম্বা এক করিডোরে পড়ল। এর একদিকে মই, আর অন্যদিকে হাত-পায়ের জন্য উপযোগী দু’সারিতে নমনীয় রশি–সেগুলো আপনা আপনি দুদিকে সরে যাচ্ছে।

–গতিবেগ বাড়ার সময় এটা খুব ভালো জায়গা নয়। লোরেন বলল। এটা তখন দু’কিলোমিটার লম্বা শ্যাফট হয়ে যায়। এসময় মই আর রশির গিটুগুলো লাগে।

তারা কয়েক’শ মিটার বিনা চেষ্টায় চলে গেল। তারপর ডানদিকের একটা করিডোরে ঢুকল। লোরেন বলল, রশিগুলো ছেড়ে দাও। তোমাকে একটা জিনিস দেখাব।

মিরিসা রশি ছেড়ে দিয়ে করিডোরের জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। মোটা জানালা দিয়ে সে ভেতরের উজ্জ্বল, ধাতব জিনিসগুলোর দিকে তাকাল। সে যদিও পুরোটা বুঝল না, তবুও তার মনে হল বিশাল সিলিন্ডারগুলো পুরো মহাকাশযানকে কেন্দ্র করে ঘুরছে।

-কোয়ান্টাম ড্রাইভ। লোরেন গর্বের সঙ্গে বলল।

সেখানকার অসংখ্য ধাতব আর কৃষ্টালের যন্ত্রপাতি ব্যাখ্যার কোন চেষ্টাই সে অবশ্য করল না। প্রকোষ্ঠের ভেতর কৌতূহলোদ্দীপকভাবে উড়তে থাকা জিনিসগুলো, জ্বলতে নিভতে থাকা আলোগুলো, মিশমিশে কৃষ্ণতার মধ্যেই ফুটে ওঠা কোন অদ্ভুত আকৃতি, সবই কেমন রহস্যময়। কিছুক্ষণ পর সে বলল, মানব মস্তিষ্কের সর্বোচ্চ আবিষ্কার। পৃথিবীর শেষ উপহার তার সন্তানদের প্রতি। একদিন এটাই আমাদেরকে নক্ষত্রের অধিপতি করবে।

কথাগুলোর মধ্যে এমন এক ঔদ্ধত্য ছিল যা মিরিসাকে মর্মাহত করল। এ যেন থ্যালসায় দ্রবীভূত হয়ে যাবার আগেকার লোরেন কথা বলছে। তাই অবশ্য হওয়া উচিত, মিরিসা ভাবল, তবে তারপরও তার কিছু অংশ সব সময়ের জন্যই পরিবর্তিত হয়েছে। সে শান্তভাবে জিজ্ঞেস করল, তাহলেও কি নক্ষত্রের কিছু যাবে আসবে? তবে আসলেই সে মুগ্ধ হয়েছে। এসব বিশাল, অর্থহীন আকৃতির যন্ত্রগুলো তিরিশ আলোকবর্ষ পেরিয়ে লোরেনকে এখানে নিয়ে এসেছে তার কাছে। তবে সে নিশ্চিত নয় যা সে পেয়েছে তার জন্য কি একে শুভেচ্ছা জানাবে না যা নিয়ে যাচ্ছে তার জন্য অভিশাপ দেবে।

লোরেন এবার তাকে আরও ভেতরে, ম্যাগেলানের অন্তরে নিয়ে গেল। এখনও তারা কোন মানুষের সাক্ষাৎ পায়নি। ম্যাগেলানের বিশালত্বের তুলনায় এটা কুর স্বল্পতাই প্রমাণ করে।

-আমরা প্রায় এসে গেছি। লোরেনের স্বর শ্রদ্ধায় নীচু। এই হচ্ছে অভিভাবক। অবাক হয়ে এগুতে গিয়ে মিরিসা প্রায় ভেসে গিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকা সোনালী মুখটার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ছিল একটু হলেই। হাত দিতেই সে ঠান্ডা ধাতব স্পর্শ অনুভব করল। এই প্রথম সে বুঝল এটা কোন ত্রিমাত্রিক ছবি নয়, আসল মূর্তি।

-এটা-ইনি-কে? মিরিসা ফিসফিসিয়ে বলে উঠল।

-এটা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে দামী শিল্পকর্মের একটি লোরেন মৃদু গর্বের সঙ্গে উত্তর দিল। এটা খুব বিখ্যাত। এ ছিল একজন রাজা, কিশোর অবস্থাতেই…

একটা সমান্তরাল চিন্তায় লোরেনের স্বর নেমে এল। মিরিসার চোখও ঝাপসা হয়ে এসেছে। চোখের পাতা ফেলে পানি সরিয়ে সে সামনের লেখাগুলো পড়ল।

তুতেন খাম
১৩৬১-১৩৫৩ খ্রীষ্টপূর্ব
(সম্রাটের উপত্যকা ‘মিশর’ ১৯২২)

হ্যাঁ বয়সটা প্রায় কুমারের সমানই। সহস্রাব্দ পরে, সোনালী মুখ রাজার গর্ব নিয়েই তাদের দিকে তাকিয়ে রইল। তার মুখে শক্তি এবং আস্থা থাকলেও নেই ঔদ্ধত্য।

-এখানে কেন? অনুমান একটা থাকলেও মিরিসা শুধালো।

-এটাকে একটা যথার্থ প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। প্রাচীন মিশরীয়রা ভাবত যে, ঠিকভাবে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করতে পারলে মৃতরা কোন এক ধরনের পারলৌকিক জীবন শুরু করতে পারে। অন্ধ বিশ্বাস সন্দেহ নেই কিন্তু একভাবে আমরা সেটাই সত্যি করেছি।

মিরিসা দুঃখের সঙ্গে ভাবল, আমি যেভাবে আশা করেছিলাম সেভাবে নয়। কিশোর রাজার চোখের দিকে তাকিয়ে, সোনার মুখোশের ওপর তাকিয়ে তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল এটা কেবল একটা শিল্প, জীবন্ত কোন মানুষ নয়। শতবর্ষ পেরিয়ে আসা শান্ত, সম্মোহক চোখ থেকে সে চোখ ফেরাতে পারছিল না। আরেকবার সে হাত বাড়িয়ে সোনালী চিবুক স্পর্শ করল। প্রথম অবতরণের আর্কাইভে পাওয়া একটা কবিতা তার হঠাৎ মনে পড়ল। সান্তনা পাবার জন্য একটা কম্পিউটার সার্চে সে এটা পেয়েছিল। একশ’র বেশী বাক্যই খাপ খায় না, কিন্তু দুটো বাক্য ছিল একদম যথার্থ। (লেখক অজানা-? ১০০০-২১০০)

মানুষের গৌরবে তারা দিয়েছিল নতুন মাত্রা,
গর্বিত কিশোর, মৃত্যুতে আজ চিরযুবা।

মিরিসার চিন্তা সুস্থির না হওয়া পর্যন্ত লোরেন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করল। এরপর মুখোশের পাশে প্রায় অদৃশ্য ছেদায় কার্ড ঢোকাল। গোলাকার দরজা খুলে গেল নিঃশব্দে। মহাকাশযানের ভেতর ফারের পোশাক ভর্তি কক্ষ হজম করা শক্ত। কিন্তু মিরিসা ব্যাপারটা বুঝতে পারল। ইতিমধ্যেই তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি নেমে গেছে। সে হি হি করে কাঁপতে শুরু করেছে।

শূন্য মাধ্যাকর্ষণের অসুবিধার জন্য লোরেন তাকে ফারের পোশাক পরতে সাহায্য করল। ছোট সে কক্ষের দেয়ালের মাঝে ছোট ঝাপসা কাঁচের দিকে তারা এগুলো। হঠাৎ করে ক্রিস্টালের একটি গুপ্তদরজা তাদের দিকে বেরিয়ে এল। ভেতর থেকে বেরিয়ে এল এমন এক ঠান্ডা যার সঙ্গে মিরিসার কোন অভিজ্ঞতা নেই। বরফশীতল সেই ঠান্ডায় ভেসে থাকা কিছু কুয়াশা তাকে ঘিরে ধরল। সে এমনভাবে লোরেনের দিকে তাকাল যাতে বোঝাই যায় সে ঢুকতে চাচ্ছে না।

লোরেন তার হাত অভয় দেয়ার জন্য ধরল, ঘাবড়িও না–পোশাকটা তোমাকে রক্ষা করবে। আর কয়েক মিনিট পর তুমি টেরই পাবে না যে তোমার মুখে ঠান্ডা লাগছে। ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য না শোনালেও সত্যি। গুপ্ত দরজাটা পেরিয়ে প্রথম কৌতূহলী শ্বাস নিয়েই সে টের পেল ব্যাপারটা যতটা অপ্রীতিকর মনে হয়েছিল আদতে তা নয়। বরং তার ভালো লাগছে। সে এতো দিনে বুঝল কেন পৃথিবীর লোকেরা মেরু অঞ্চল ঘুরতে যেত।

সেই বিশাল বরফ রাজ্যের মধ্যে সে নিজেকে এখনই সহজেই কল্পনা করতে পারছে। চারপাশে বরফের এক বিশাল মৌচাক ঝকমক করছে। হাজারখানেক ষড়ভূজ দেখা যাচ্ছে। ম্যাগেলানের বরফ বর্মের যেন ক্ষুদ্র সংস্করণ এটা শুধু পার্থক্য হল এগুলো মিটারখানেক চওড়া, আর একটার সঙ্গে আরেকটা নল আর তার দিয়ে যুক্ত। তাহলে এখানেই ঘুমিয়ে আছে পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ ঔপনিবেশিকরা। যাদের কাছে পৃথিবী এখনো গতকালের স্মৃতি। দুশ বছরের যাত্রায় ঘুমিয়ে, কি স্বপ্ন দেখছে তারা? মৃত্যু আর জীবনের মাঝের সময়ে কি আদৌ মস্তিষ্ক স্বপ্ন দেখে? লোরেন ভাষ্যমতে দেখে না। কিন্তু তাই কি নিশ্চিত? মিরিসা ভিডিওতে মৌমাছির রহস্যময় অন্তহীন ব্যস্ততা দেখেছে। বিশাল এই মৌচাকের মাঝে লোরেনের হাত ধরে যেতে যেতে তার নিজেকে এক মানব-মৌমাছি মনে হচ্ছে। শূন্য অভিকর্ষে সে এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছে। ঠান্ডাটাও সহনীয় হয়ে গেছে। তার নিজের শরীরের অনুভূতিই যেন হারিয়ে ফেলেছে। মাঝে মাঝে তাকে জোর করে মনে করতে হয় যে সে সত্যি জেগে আছে–ঘুমুচ্ছে না।

প্রতিটি প্রকোষ্ঠ কোন নাম নয় বরং নম্বর দিয়ে চিহ্নিত। লোরেন হ-৩৫৪-এ থামল। একটা বোম স্পর্শ করতেই একটা ষড়ভুজ আকৃতির কাঁচ আর ধাতু দিয়ে তৈরী টেলিস্কোপ আস্তে বেরিয়ে এল। চোখ দিতেই ভেতরে একজন নারী ঘুমিয়ে আছে দেখা যায়।

সে সুন্দরী নয় যদিও ঝাঁকড়া চুলের সৌন্দর্য না দেখেই এধরনের মন্তব্য ঠিক না।

তার গায়ের রং মিরিসা আগে কখনো দেখেনি। প্রগাঢ় কৃষ্ণবর্ণ যাতে নীলচে একটা ছাপ তা পৃথিবীতেও খুব কম ছিল। আরও কিছু শরীর সাদা ও হলুদ তার। চোখে পড়ল–এছবি, সে জানে, জীবনেও তার পিছু ছাড়বে না।

সে আবার তার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকাল। শত বছরের নিদ্রাও এর মুখে সংকল্প আর বুদ্ধিমত্তা মুছে দিতে পারেনি। আমরা কি পরস্পরের বন্ধু হতাম? মিরিসা ভাবল, মনে হয় না। আমরা বড় বেশী একরকম।

তাহলে তুমিই হলে কিতানি। তুমি নিয়ে যাচ্ছ লোরেনের প্রথম সন্তান নক্ষত্রের মাঝ দিয়ে। তবে সত্যিই কি সে প্রথম সন্তান হবে, যখন আমার সন্তানের শতাব্দী পর তার জন্ম হবে।

সে এখনও আবিষ্ট। শুধু ঠান্ডার কারণেই সেটা নয়। ক্রিস্টালের দরজা তাদের পিছনে বন্ধ হয়ে গেল। লোরেন তাকে অভিভাবকের পাশ দিয়ে ধরে নিয়ে গেল।

তার আঙ্গুলগুলো আরেকবার ছুঁয়ে গেল অমর সোনালী কিশোরের মুখ। উষ্ণতা মুহূর্তের জন্য তাকে চমকে দিল তারপরই তার মনে পড়ল তার শরীর এখনও স্বাভাবিক তাপমাত্রায় ফেরেনি।

কয়েক মিনিট লাগল এতো কিছু দেখতে–মিরিসা ভাবল, কিন্তু তার বুকের ভেতর যে বরফ জমে আছে তা গলতে আর কতদিন লাগবে?

৫৪. বিদায় সম্ভাষণ

ইভলিন, দীর্ঘতম নিদ্রায় যাবার আগে এটাই তোমার সাথে শেষ কথা। আমি এখনও থ্যালসার মাটিতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই শাটল এসে যাবে ম্যাগেলানের উদ্দেশ্যে যাত্রার জন্য। আজ থেকে তিনশ বছর পরে গ্রহ বরণের আগে আমার আর কিছুই করার নেই… আমার বিষণ্ণ বোধ হচ্ছে। আমার প্রিয়তম বন্ধুকে আমি এইমাত্র বিদায় জানালাম, মিরিসা লিওনার্দ। তুমি যদি ওর সঙ্গে পরিচিত হতে পারতে। থ্যালসায় আমার দেখা সবচেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ। আমরা কত কথা বলেছি যদিও আমার আশংকা তার অনেকটাই বিরক্তিকর পুনরাবৃত্তি যা নিয়ে তুমি প্রায়ই আমাকে খেপাতে…

সে প্রায়ই ঈশ্বর সংক্রান্ত প্রশ্ন করত। তবে তার সবচেয়ে কঠিন প্রশ্ন যেটা ছিল তার উত্তর আমি ঠিকমতো দিতে পারিনি।

তার ছোট ভাইটি মারা যাবার পর, একদিন সে শুধালো, দুঃখের প্রয়োজন কি? এর কি কোন শারীরিক কাজ আছে?

কি আশ্চর্য আমি কখনো এই দিকে নজরই দেইনি। যদি কোন বুদ্ধিমান সভ্যতা থাকে যাদের মৃতদের চিন্তা হয় কোন দুঃখ ছাড়াই, অথবা মৃতদের চিন্তাই তাদের মাথায় আসে না, তবে সেটা কেমন হবে। অবশ্যই মানবীয় না–তবে পৃথিবীর পিপড়া বা উইয়ের মতো তারাও বাঁচতে পারে।

বিষাদ কি ভালোবাসারই মতো দুর্ঘটনা অথবা অবশ্যম্ভাবী উপজাত? যার এক আবশ্যকীয় শারীরিক ক্রিয়া আছে। এ এক অদ্ভুত, কুহেলীময় চিন্তা। কিন্তু অনুভূতিই আমাদের মানুষ বানিয়েছে। কেইবা অনুভূতিগুলো বিসর্জন দিতে চাইবে, যদিও সে জানে যে প্রতিটি ভালোবাসাই আসলে সময় আর ভাগ্যের মতো দুই সহদরের হাতে জিম্মি মাত্র।

সে প্রায়ই আমাকে তোমার কথা জিজ্ঞেস করত ইভলিন। সে খুব বিভ্রান্ত হয়ে যেত, যখন সে ভাবত যে একজন পুরুষ কেবল সারাজীবন ধরে একজন নারীকে ভালোবাসতে পারে, আর তার মৃত্যুর পর অন্য কোন নারীর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের চিন্তা করে না। আমি একবার তাকে খেলাচ্ছলে বলেছিলাম হিংসার মতো ব্যভিচার। শব্দটা ল্যাসানন্দের কাছে অপরিচিত। সে জবাব দিয়েছিল যে ওদুটো হারিয়ে তারা আদতে জিতে গেছে।

শাটল চলে এসেছে। তারা আমায় ডাকছে। থ্যালসাকে আমাকে এখন চিরতরে বিদায় জানাতে হবে। আর তোমার স্মৃতিও ধূসর হয়ে আসছে। যদিও আমি সবাইকে উপদেশ দিয়ে বেড়াই, তবে আমি মনে হয় আমার দুঃখ বেশীই আঁকড়ে আছি, যা তোমার স্মৃতিকে ব্যাথাতুর করে তুলছে।

থ্যালসা আমাকে সুস্থির হতে সাহায্য করেছে। তোমাকে হারাবার বিলাপ না করে, তুমি একদিন আমার ছিলে এটাই এখন শান্তির।

এক অদ্ভুত সমাহিতভাব আমাকে ঘিরে ধরেছে। আমার মনে হয় এই প্রথম আমি আমার বৌদ্ধ বন্ধুদের চিন্তা তাদের নির্বাণ কিছুটা বুঝতে পেরেছি… আর আমি যদি সাগান-২-এ জেগে নাও উঠি অসুবিধে নেই। আমার কাজ এখানেই সমাপ্ত হয়েছে –আমি তৃপ্ত।

৫৫. যাত্র

মাঝরাতের ঠিক আগে নৌকাটা গুল্মের জঙ্গলের প্রান্তে গিয়ে পৌঁছুল। ব্র্যান্ট তিরিশ মিটার পানির গভীরে নোঙর করল। সকাল থেকে কাঁকড়া পল্লী হতে দক্ষিণ দ্বীপ পর্যন্ত সে গোয়েন্দা- গোলক ফেলতে ফেলতে এসেছে। ঠিকমতো কাজ করলে এ পথে কাঁকড়াদের আসা যাওয়া সব চোখে চোখে থাকবে। যদি উপহার ভেবে কোন কাঁকড়া এটাকে বাড়ী নিয়ে যায় তাহলে আরও ভালো। খোলা সাগরের চাইতে সেখান থেকে আরও ভালো তথ্য সেটা পাঠবে।

এখন আর কিছুই করার নেই। মৃদু দুলতে থাকা নৌকায় শুয়ে তারনার রেডিওতে ভেসে আসা মৃদু সঙ্গীত শোনা ছাড়া। আজকে সেটা অবশ্য কম। থেকে থেকে বসতির লোকেদের পক্ষ থেকে পাঠানো কোন শুভেচ্ছাবাণী অথবা কবিতা পড়ে শোনানো হচ্ছে। দুই দ্বীপের খুব কম লোকই আজ ঘুমাতে পারবে। মিরিসা মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবে সম্পূর্ণ অজানা একটা বিশ্বে অবশিষ্ট জীবনের জন্য নির্বাসিত হওয়া ইয়েন ফ্লেচার এবং তার সঙ্গীদের মনে কি চিন্তা খেলা করছে এই মুহূর্তে। উত্তরের এক ভিডিওতে সে তাদের শেষ দেখেছে। তাদের দেখতে মোটেও অসুখী মনে হয়নি। তারা এখানে ব্যবসার সুবিধা সম্বন্ধে আলোচনা করছিল।

ব্র্যান্ট এতো চুপচাপ যে, সে ভেবেছিল ব্র্যান্ট ঘুমিয়ে গিয়েছে। শুধু নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে শুয়ে থাকা অবস্থায় আগের মতো শক্ত মুঠোর চাপটা বুঝিয়ে দেয় সে সজাগ। ব্র্যান্ট অনেক বদলেছে–সম্ভবতঃ তার চাইতেও বেশী। আগের অস্থিরতা নেই, বেড়েছে তার বিবেচনা বোধ। সবচে ভালো ব্যাপারটা হল ব্র্যান্ট বাচ্চাটাকে মেনে নিয়েছে। তার কথায় সে কেঁদে দিয়েছিল, ‘ওর দুটো বাবা হবে।’

এখন রেডিও তারনা, চূড়ান্ত তবে অপ্রয়োজনীয় উৎক্ষেপনের সময় গণনা শুরু করেছে। ল্যাসানরা ঐতিহাসিক রেকর্ড ছাড়া এই কাউন্টডাউন কখনো শোনেনি। মিরিসা ভাবল, আমরা কি আদৌ কিছু দেখব? ম্যাগেলান গ্রহের অন্যপাশে মধ্য দুপুরের সাগরের বহু উপরে। আমাদের মাঝে পুরো গ্রহটা দাঁড়িয়ে… শূন্য… তারনা রেডিও ঘোষণা দিল এবং একটা গর্জনে ঢালা পড়ে গেল। ব্র্যান্ট ঝুঁকে পড়ল নৌকা সামলাতে। এবং আকাশ দীর্ণ হবার আগে রেডিও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।

পুরো দিগন্তে আগুনে ঝলসে উঠল। উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম সব দিকেই। এ এমন এক দৃশ্য যা ল্যাসানরা আগে কখনো দেখেনি, ভবিষ্যতেও দেখবে না।

এ এক চমৎকার শ্বাসরুদ্ধকর দৃশ্য। মিরিসা এখন বুঝতে পেরেছে কেন ম্যাগেলান গ্রহের উল্টোদিকে। যদিও এটা কোয়ান্টাম ড্রাইভ নয়, কেবল মাত্র এর সঙ্গে জ্বলতে থাকা প্রাথমিক ইঞ্জিনগুলোর শক্তি, যার পুরোটাই আয়োনোস্কিয়ার দিয়ে শশাষিত হবে। সুপারস্পেসের শকওয়েভ সম্বন্ধে একবার লোরেন বলেছিল যে, এমনকি এই ড্রাইভের স্রষ্টাও এর কারণটা ঠিক জানেন না।

কাঁকড়াগুলো এই মহাজাগতিক রশি দেখে কি করবে-মিরিসা ভাবল। গুল্মের নীচে ডুবন্ত শহরে কিছু আলো ফিল্টার হয়ে অবশ্যই পৌঁছুবে।

এটা কল্পনাও হতে পারে, তবে একটা বহুরঙা আলোর মুকুট তৈরী হচ্ছে আকাশ জুড়ে। সম্ভবত ম্যাগেলান গতি বাড়ানোর জন্য থ্যালসা ঘিরে একটা চক্কর দিচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ তার লাগল ব্যাপারটা সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে এবং একই সময়ে সেটা কমে গেল। আর হঠাৎই সেটা থেমে গেল। রেডিও তারনা রুদ্ধশ্বাসে বাতাসে ভেসে এল।

…সবকিছুই পরিকল্পনা মাফিক এগুচ্ছে… মহাকাশযান দিক পরিবর্তন করছে… অন্যান্য জিনিস খুব ভালো বোঝা যাচ্ছে না… গ্রহের পাশে বাকী উত্তরণ ঘটবে, তবে তিনদিন পর যখন এটা এই গ্ৰহজগত ছেড়ে যাবে তখন আমরা একে দেখতে পাব সরাসরি…

মিরিসার কানে আর কিছু ঢুকছিল না। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। আকাশে এখন আবার নক্ষত্র একটা দুটো করে ফুটে উঠছে- যে নক্ষত্রের দিকে তাকালেই এরপর থেকে তার লোরেনের কথা মনে পড়বে। যদিও এ মুহূর্তে তার। তেমন অনুভূতি নেই। যদিও বা চোখে থাকে জল– তা পরেই দেখা দেবে।

সে তার চারপাশে ব্র্যান্টের উষ্ণ হাত অনুভব করল আর মহাকাশের নিঃসঙ্গতার বিপরীতে তাদের এই নিবিড়তাকে সে স্বস্তিকর হিসেবেই গ্রহণ করল। এটাই তার জায়গা। আর কিছুর জন্য তার হৃদয় ব্যথিত হবে না। এবং এতোদিনে সে এটাও বুঝতে পারল যে, লোরেনকে সে পছন্দ করে তার শক্তির জন্য এবং ব্র্যান্টকে তার দুর্বলতার জন্য।

বিদায় লোরেন– সে ফিসফিসিয়ে বলল–তুমি আর তোমার সন্তান দূরের সে পৃথিবীতে সুখে থেকো। মানব সভ্যতার সেই নতুন সাম্রাজ্যে আমার কথা মনে কোরো, পৃথিবীর পথে তিনশ বছরের পরের কথা মনে কোরো তুমি।

ব্র্যান্ট তার চুলে আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ভাবল কোন সান্তনার কথা বলে। কিন্তু বুঝল যে নীরবতাই শ্রেয়। যদিও মিরিসা আবার তার হয়েছে, তবু কোন বিজয়ের অনুভূতি তার মধ্যে কাজ করছে না। তাদের পুরানো, দায়িত্বহীন রোমান্স আজ মৃত। ব্র্যান্ট জানে লোরেনের ছায়া সব সময়ই তাদের সাথে অশরীরি ছায়া হয়ে থাকবে এবং তারা ছাই হয়ে বাতাসে মিশে যাবার দিনও সে থাকবে চির তরুণ।

তিনদিন পর যখন ম্যাগেলান পূব আকাশে দেখা দিল, খালি চোখে এর দিকে তাকানো যেত না। যদিও রেডিয়েশনের প্রভাব থেকে রক্ষার জন্য এর কোয়ান্টাম ড্রাইভ অন্যদিকে সতর্কভাবে ঘুরিয়ে রাখা হয়েছিল। সপ্তাহের পর সপ্তাহে, মাসের পর মাসে এটা ধীরে ধীরে ম্লান হতে লাগল। যদিও কোথায় আছে জানা থাকলে দিনেও এটা দেখা যায় আর বছরের বেশী সময় ধরে এটা ছিল রাতের আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারা।

দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে যাবার আগে মিরিসা শেষ বারের মতো এটা একবার দেখেছিল। এর কোয়ান্টাম ড্রাইভ-যা রেডিয়েশনের ভয় ছাড়াই সরাসরি থ্যালসার দিকে তাক করা, দূরত্বের কারণে মৃদুভাবে জ্বলছে।

যখন পনের আলোকবর্ষ দূরে, তখনও মিরিসার নাতি-নাতনিরা তৃতীয় উজ্জ্বলতার নীল তারাটাকে, বৈদ্যুতিক কাঁকড়া- প্রতিরক্ষা দেয়ালের পর্যবেক্ষণ চূড়ার ওপরে ঠিকই দেখতে পেত।

৫৬. সমুদ্রের তলদেশ

তারা এখনও বুদ্ধিমান না, তবে তাদের কৌতূহল আছে আর অন্তহীন যাত্রার পথে এটাই প্রথম পদক্ষেপ। প্রাচীন পৃথিবীর সমুদ্রের বহু প্রাণীর মতোই তারা হয়ত অন্ত হীনভাবে থাকতে পারত।

শেষের শতাব্দীর আগে অবশ্য তারা তেমন কিছু করার তাগিদ অনুভব করেনি। কারণ বিশাল সেই গুল্মের জঙ্গল তাদের সব কিছুর যোগান দিত। বড় পাতাগুলো খাদ্য যোগাত, কান্ডগুলো দিত তাদের প্রাচীন প্রযুক্তির উপকরণ।

তাদের শুধু দুটো প্রাকৃতিক শত্রু ছিল। একটা হচ্ছে সব সময় খিদে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো কদাচিৎ দেখতে পাওয়া গভীর পানির মাছ। আর বিষাক্ত জেলী মাছ যা এক ধরনের ভেসে বেড়ানো পাল্প। মাঝে মাঝে তারা সমুদ্রের তলদেশে হামলে পড়ে পুরো জায়গাটা মরুভূমি বানিয়ে দেয়।

মাঝে মাঝে পানি আর হাওয়ার ঝাট ছাড়া কাঁকড়াগুলো হয়তো সারাজীবনই পানির তলে চমৎকার ভাবে অভিযোজিত হয়ে কাটিয়ে দিত। কিন্তু পিঁপড়ে বা উই পোকার মতো তারা বিবর্তনের কানা গলিতে ঢুকে পড়েনি। তারা পরিবর্তনের সাপেক্ষে সাড়া দিতে জানে।

এবং সামান্য হলেও, সাগরের বিশ্বে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। আকাশ থেকে চমৎকার সব জিনিস এসে পড়ছে। এগুলো কোত্থেকে আসছে? এবং নিশ্চয়ই আরও আছে। প্রস্তুত হয়ে কাকড়ারা একদিন খুঁজতে বেরুল।

অন্তহীন সময়ের থ্যালসার সাগরে তেমন কোন তাড়াহুড়ো করার কারণ ছিল না। তাদের স্কাউটরা বিচিত্র সব রিপোর্ট আনার বহু বছর পর তারা বাইরের জীবগুলোর ওপর আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়।

তারা অবশ্য এটাও বোঝেনি অন্য স্কাউটরা তাদের ওপরে রিপোর্ট পাঠাচ্ছে। এবং যখন তারা চূড়ান্ত আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিল, তখন সময়টা ছিল তাদের জন্য সত্যিকার অর্থেই খারাপ। তীরে ওঠার সময় তাদের সামলাবার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়েন ফ্লেচার সম্পূর্ণ অসাংবিধানিকভাবে কিন্তু পুরো যোগ্যতা নিয়েই দ্বিতীয়বার তার অফিসে অবস্থান করছিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *