অধ্যায় ৫০
হোমিসাইডের মহাপরিচালক ফারুক আহমেদ চুপ মেরে আছে। মনোযোগ দিয়ে জেফরির কথা শুনে গেলেও কোনো মন্তব্য করেনি এখন পর্যন্ত।
“স্যার, আমাদের হাতে এখন অনেকগুলো প্রমাণ আছে। এমন কি খুনির ছবি পর্যন্ত! এই লোকটিই জায়েদ রেহমানকে খুন করেছে, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।”
ফারুক সাহেবের সামনে টেবিলের উপর পেশাদার সেই খুনির ছবি রাখা আছে।
“তাহলে মিসেস রেহমান আর আলম শফিক? তারা কি কোনোভাবেই এর সাথে জড়িত নয়?” বলল মহাপরিচালক।
“না।” বেশ দৃঢ়তার সাথে বলল জেফরি।
“ধরে নিলাম পেশাদার খুনিই কাজটা করেছে কিন্তু তাকে ভাড়া করেছে কে? মিসেস রেহমান আর তার প্রেমিক কি তাকে ভাড়া করতে পারে না?”
মাথা দোলাল বেগ। “স্যার, এই খুনি, টেবিলের উপর ছবিটায় টোকা মেরে বলল সে, “দীর্ঘদিন ধরে ভিটা নুভার সামনে বসে পর্যবেক্ষণ করেছে। মিসেস রেহমান আর আলম শফিক তাকে ভাড়া করলে তাকে এভাবে রেকি করতে হতো না, কারণ সব তথ্য সে তাদের কাছ থেকেই পেতো।”
মাথা নেড়ে সায় দিল ফারুক সাহেব। “তাহলে তাকে ভাড়া করেছে কে?”
খুবই সঙ্গত প্রশ্ন, মনে মনে ভাবলো জেফরি। “সেটা খুঁজে বের করতে হলে তদন্তটি আবার নতুন করে শুরু করতে হবে।” একটু থেমে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করল সে। “এই খুনিকে যদি ধরা যায় কিংবা আমাদের কাছে থাকা সন্দেহভাজনদের কারোর সাথে যদি এর কোনো রকম কানেকশান বের করা যায় তাহলে খুব সহজেই সেই প্রশ্নের জবাব জানা যাবে।”
চুপ মেরে রইল ফারুক সাহেব তবে তার চোখমুখ দেখে জেফরি ইতিবাচক কিছু আশা করছে। “এভাবে আনঅফিশিয়ালি তদন্ত চালিয়ে গেলে খুনিকে ধরা যাবে না। এ রকম একটা ছবি হাতে থাকার পরও যদি আমরা ব্যাপকভাবে ম্যানহান্ট শুরু করতে না পারি তাহলে কিছুই করতে পারবো না।”
“তাহলে তুমি চাচ্ছো এই খুনিকে খুঁজে বের করতে?” ধীরকণ্ঠে বলল ফারুক আহমেদ।
“জি স্যার। এই খুনিকে খুঁজে বের করতে পারলেই আমরা অনেক কিছু জানতে পারবো।”
“কিভাবে কাজটা করতে চাও?”
“স্যার, সমস্ত থানায় এর ছবি দিয়ে এর সম্পর্কে খোঁজ নেবার জন্যে একটি টিম গঠন করে ব্যাপক অভিযান চালাতে হবে। আমার ধারণা খুব সহজেই তাকে ধরা সম্ভব হবে।”
চুপ করে রইল ফারুক সাহেব। অনেকক্ষণ পর বলল, “ঠিক আছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়কে এটা জানাতে হবে। জায়েদ রেহমানের হত্যা মামলাটি তারা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মামলার মধ্যে অন্তর্ভূক্ত করেছে। এরইমধ্যে ফাইনাল ইনভেস্টিগেশন রিপোর্ট তৈরি হবার পথে। তাদেরকে না জানিয়ে তো এই কেসটা পুণঃতদন্ত করতে পারবো না।”
কথাটা শুনে জেফরি খুশি হলো। তার বসূকে তাহলে বোঝানো গেছে।
“ধন্যবাদ, স্যার।”
এমন সময় তার ফোনটা বিপ্ করে উঠলে জেফরি বুঝতে পারল রেবা আরেকটা মেসেজ পাঠিয়েছে।
ফারুক সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এল নিজের অফিসে। ওপেন করল মেসেজটা।
তোমার সাথে দেখা করতে চাই।
অসম্ভব! রেবার মাথা কি খারাপ হয়ে গেছে? মোবাইলটা পকেটে রেখে দিল সে। এ রকম একেকটা এসএমএস তাকে অস্থির করে তোলে ভেতরে ভেতরে। মাথা থেকে রেবার চিন্তাটা কিছুক্ষনের জন্য ঝেড়ে ফেলতে জায়েদ রেহমানের কেসটা নিয়ে ভাবতে শুরু করে দিল সে। নিজের ডেস্কে বসে সহকারী জামানকে ফোন করে তার রুমে চলে আসতে বলল। একা একা থাকলেই রেবার চিন্তা মাথায় এসে পড়ে, সামনে একজন থাকলে চিন্তাটা সহজে আসবে না।
দশ মিনিট পর জামান আর জেফরি ডুবে গেল জায়েদ সাহেবের কেসটা নিয়ে। জামানকে জেফরি জানাল ফারুক সাহেব তদন্ত পুণরায় করার ব্যাপারে রাজি হয়েছে। এখন পুর্ণোদ্যমে কাজ শুরু করতে হবে। খুনিকে ধরার অভিযান চলতে থাকবে পাশাপশি কে হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা সেটা খুঁজে বের করার জন্য তাদেরকে কাজ করে যেতে হবে।
“আমরা কি সন্দেহভাজন হিসেবে গ্যাট আর আবেদ আলীকে নিয়েই কাজ করবো?” জানতে চাইল জামান।
“গ্যাট, আবেদ, আলী আর অভিনেত্রী পমি। আমরা এখন এই তিনজনের উপর কাজ করবো। আমার ধারণা এদের মধ্যেই কেউ খুনের মূল হোতা। এ পর্যন্ত আমরা গ্যাট আর আবেদ আলীর ব্যাপারে কিছু জানতে পারলেও পমির ব্যাপারে কিছু জানি না।”
“আমি কি তার ব্যাপারে খোঁজখবর নেবো, স্যার?”
“না। আমি নিজে তার সাথে একবার দেখা করতে চাই।”
.
অধ্যায় ৫১
আধো-আলো-অন্ধকার একটি ঘর। মৃদু ভলিউমে চলছে টিভি। ঘরের একমাত্র লোকটি লাগেজ গোছগাছ করছে। নেবার মতো খুব বেশি কিছু নেই। প্রয়োজনীয় কাপড়চোপড় আর কিছু আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র। লোকটা এর আগে কখনই এতোটা ঝামেলায় পড়েনি। হুট করে তাকে জায়গা বদল করতে হচ্ছে। দরকার পড়লে দেশও ছাড়তে হতে পারে। এই প্রথম তার ছবি কোনো গোয়েন্দার হাতে চলে গেছে। ব্যাপারটা তার জন্যে ভয়ানক খারাপ খবর। জেফরি বেগ নামের গোয়েন্দা লোকটি কিভাবে তার ছবি জোগাড় করতে পারল এখনও সেটা ভেবে পাচ্ছে না।
এটা কি করে সম্ভব হলো?
এই জীবনে কখনই এতোটা অস্থির হয়নি সে। তার কাছে খবর আছে সেই গোয়েন্দা আরেকজনকে সাথে নিয়ে তার ছবি দেখিয়ে লোকজনকে জিজ্ঞেস করেছে তাকে কেউ চেনে কি না। আরো জানতে পেরেছে, জায়েদ রেহমানের হত্যাকাণ্ডের পুণঃতদন্ত হবে।
এই জেফরি বেগ লোকটা তার জন্যে চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে। মনে মনে তার প্রশংসা না করে পারল না। পুরো পরিকল্পনা নতুন করে সাজিয়ে নিতে হবে এখন। তবে সবার আগে এই জায়গাটা ছেড়ে চলে যেতে হবে।
*
অভিনেত্রী পমি প্রথমে কোনোভাবেই রাজি ছিল না দেখা করার জন্য। জেফরি তাকে অনেক বুঝিয়েসুঝিয়ে রাজি করিয়েছে। হোমিসাইডের সাথে সহযোগীতা না করলে জায়েদ রেহমানের খুনের ব্যাপারে তাকেও সন্দেহ করা হতে পারে এ রকম একটি প্রচ্ছন্ন আভাস দিলে এই তরুণী নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে।
এবারও সঙ্গে করে জামানকে নিয়ে আসেনি। গ্যাটের কথা যদি সত্যি হয় তাহলে তার সাথে জায়েদ রেহমান যা করেছে সেটা দু’জন পুরুষের সামনে বলতে অস্বস্তি বোধ করবে পমি। এখান থেকে পমিকে বিদায় দিয়ে সে চলে যাবে ভিটা নুভায়, জামানকে বলে দিয়য়েছে সে যেন ওখানে চলে যায়।
নিজের বাড়িতে দেখা না করে একটা রেস্তোরাঁয় বসেছে পমি। এই অভিজাত রেস্তোরাঁয় যে সে খুব নিয়মিত আসে সেটা বুঝতে পারল জেফরি বেগ। তার মতো একজন উঠতি অভিনেত্রী এ শহরের যেখানে খুশি সেখানে যেতে পারে না। ব্যাপারটা জেফরিও বোঝে। নিজের বাড়িতে জেফরিকে আসতে না বলার একটাই কারণ, তার মধ্যবয়সি ধনাঢ্য স্বামী। ভদ্রলোককে গত বছর বিয়ে করেছে সে। বয়সে তারচেয়ে বিশ বছরের বড়। জেফরির সাথে তার কথাবার্তা স্বামীর কাছে যেন প্রকাশ না পায় সেজন্যেই পমি এই জায়গাটা বেছে নিয়েছে।
“বলুন, আমার কাছ থেকে কী জানতে চান?” পমির কণ্ঠে অধৈর্য।
“জায়েদ রেহমানকে কতো দিন ধরে চেনেন?” বলল জেফরি।
“উমমম…তিন-চার বছর হবে।”
“আপনি তো উনার সাথে কাজ করেছেন, তাই না?”
“হ্যাঁ। এটা সবাই জানে, মি. বেগ। আপনি নিশ্চয় এসব কথা জানার জন্য আসেননি। আসল কথায় আসুন। আমাকে বাড়ি যেতে হবে।”
ঠিক আছে, মনে মনে বলল জেফরি। “আপনি জায়েদ রেহমারে একটি ছবিতে কাজ করেছিলেন কিন্তু সেটা শেষ করেননি, কেন?”
দেখতে দারুণ সুন্দরি পমি চেয়ে রইল ইনভেস্টিগেটরের দিকে। “কাজ করতে সমস্যা হচ্ছিল। ছবি সাইন করার সময় উনি আমার চরিত্রটা যেরকম বলেছিলেন পরে দেখি সেটা তেমন না, তাই কাজটা আর করিনি।”
জেফরির ঠোঁটে মুচকি হাসি। “উনার এতোগুলো টিভি নাটকে কাজ করেছেন অথচ এ রকম সামান্য একটি কারণে মাঝপথে এসে ছবিটা ছেড়ে দিলেন?”
“আমি মনে করেছি কাজটা করা ঠিক হবে না তাই ছেড়ে দিয়েছি, এতে সমস্যার কি আছে!?”
“তাহলে এরপর তার সাথে আপনি আর সম্পর্ক রাখলেন না কেন?”
“রাখিনি কারণ…কারণ, উনি আমার সাথে বাজে ব্যবহার করেছিলেন।”
মাথা নেড়ে সায় দিল জেফরি। “আচ্ছা। এবার আমাকে বলুন, মানুষ হিসেবে জায়েদ রেহমান কেমন ছিলেন?”
অবাক হলো পমি। “এটা জানা কি আপনার তদন্তের জন্যে খুবই দরকার?”
“হ্যাঁ।”
একটু ভেবে বলল পমি, “ইবলিশ! আস্ত একটা ইবলিশ তবে সাধুপুরুষের মুখোশ পরে থাকতো সব সময়। আসল জায়েদ রেহমানকে খুব কম মানুষই চেনে।”
“সেই অল্প মানুষের মধ্যে আপনিও আছেন,” চট করে বলল জেফরি।
পমি কিছু বলল না, একদৃষ্টিতে চেয়ে রইল শুধু।
“মিসেস জায়েদ, মানে গোলনূর আফরোজ তরফদারের সাথে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল?”
এই প্রশ্নটি শুনে আবারো অবাক হলো পমি। “খুবই ভালো। উনাকে আমি বড়বোনের মতো দেখতাম। আমাকে তুই করে সম্বোধন করতেন। তবে এখন আর যোগাযোগ নেই।”
কথাটা কিভাবে বলবে ভেবে পেল না সে। একটু ইতস্তত করে বলল, “জায়েদ রেহমান যে ধর্ষণ করেছিলেন সে ব্যাপারে জানতে চাইছি।”
একটু চমকে উঠল পমি। পরক্ষণেই মুখটা তিক্ততায় ভরে উঠল। “আপা তাহলে আপনাকে বলে দিয়েছে…”
“হ্যাঁ। না বলার তো কোনো কারণ নেই।”
“জানার আর কী আছে। এসব জঘন্য ঘটনার কথা বলতে ইচ্ছে করে না। একজন বিকৃত মানসিকতার লোক ছিল সে। আই হেইট হিম।”
জেফরি বুঝতে পারছে জায়েদ রেহমানকে এতোটা ঘৃণা করার সঙ্গত কারণ রয়েছে মেয়েটির। তার নিজেরও এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। কোনো মেয়েকে তার ধষর্ণের কথা জিজ্ঞেস করা মানে তাকে পুণরায় ধর্ষণ করার শামিল।
“আপনি জায়েদ রেহমানের বিরুদ্ধে মামলা করলেন না কেন?”
“আমি মামলা করবো??” চোখেমুখে সুতীব্র বিস্ময় পমির। “আমি কেন তার বিরুদ্ধে মামলা করতে যাবো!?”
“কারণ উনি আপনাকে ধর্ষণ করেছেন…”
“হোয়াট!?” সীমাহীন বিস্ময়ে ফেটে পড়ল অভিনেত্রী পমি। “আপনি এসব কী বলছেন!?”
*
জেফরি আসার অনেক আগেই জামান চলে এসেছে ভিটা নুভায় তবে সেখানে
ঢুকে এর আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে সে। ইচ্ছে করেই একটু আগেভাগে এসেছে খুনির ছবিটা নিয়ে লোকজনকে জিজ্ঞেস করবে বলে। ঢাকা শহরের এই অংশটা সহকারী ইনভেস্টিগেটর জামানের খুব চেনা। ছাত্র জীবনে এখানেই তারা পাঁচ বন্ধু একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতো। তার ধারণা লন্ড্রির দোকানদারের কথা যদি সত্যি হয় তাহলে এখানকার কেউ না কেউ খুনির ছবি দেখে তাকে শনাক্ত করতে পারবেই।
ভিটা নুভা থেকে একটু দূরে আরো কিছু বাড়ির দারোয়ান, মুদি দোকানিকে খুনির ছবিটা দেখিয়ে জানতে চাইল লোকটাকে তারা কখনও দেখেছে কি না। কেউ দেখেনি।
হাঁটতে হাঁটতে একটা ফাঁকা রাস্তা য়এসে পড়ল সে। হাতঘড়িতে সময় দেখে বুঝতে পারল ভিটা নুভায় ফিরে যেতে হবে। অনেক দূল এসে পড়েছে, হাঁটতে আর ভালো লাগছে না। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আছে একটা রিক্সার জন্য।
“স্যার?”
একটা ফ্যাসফ্যাসে কণ্ঠ শুনে ঘুরে তাকাতেই দেখতে পেল তার পেছনে এক ভিক্ষুক।
“এই গরীবৃরে দুইডা পয়সা দেন…স্যার।”
লোকটার এক পা নেই। বসে আছে জামানের পেছনে ফুটপাত ঘেষা একটি বড় গাছের নিচে পুরনো নষ্ট হয়ে যাওয়া ফোমের টুকরোর উপর। দেখে বোঝা যাচ্ছে এখানেই লোকটা প্রতিদিন বসে।
পকেট থেকে দু’টাকার একটি কয়েন বের করে ভিক্ষুকটার হাতে তুলে দিল সে। খুশিতে হলুদ রঙের দাঁত বের করে হাসল লোকটা।
জামান আবার রাস্তার দিকে তাকাল। না। কোনো রিক্সা দেখা যাচ্ছে না।
“স্যার কি রিস্কা খুঁজতাছেন?” পেছন থেকে ভিক্ষুক বলল।
“হুমম…”
“এই সময় এইহানে রিস্কা পাইবেন না…সামনে বায়ে গিয়া একটু আগে বাড়লে পাইবেন।”
আরেকটু হেঁটে সামনে যাবো? এমন সময় চট করেই তার মাথায় একটা ভাবনা চলে এল। এই ভিক্ষুকটি কি প্রতিদিন এখানেই বসে?
“তুমি কি রোজ রোজ এখানে বসেই ভিক্ষা করো?” জানতে চাইল জামান।
“হ, স্যার।”
“কতো দিন ধরে এখানে ভিক্ষা করছো?”
“দুই মাস তো অইবোই…”
একটু ভেবে পকেট থেকে খুনির একটি ছবি বের করে হাতে নিয়ে নিলো সে। “তাহলে তো তুমি এখানকার অনেককেই চেনো।”
ময়লা দাঁত বের করে হাসল আবার। “সবাইরে না, স্যার…যারা রেগুলার ভিক্ষা দেয় খালি তাগোরে চিনি।”
জামান মুচকি হাসল। লোকটার কাছে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল সে। “এই ছবিটা একটু দ্যাখো তো,” খুনির ছবিটা ভিক্ষুকের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল সে।
ভুরু কুঁচকে ছবির দিকে তাকাল ভিক্ষুক।
“আমার এক পুরনো বন্ধু…শুনেছি এখানেই থাকে কিন্তু তার ঠিকানাটা হারিয়ে ফেলেছি, তাই বাসাটা খুঁজে পাচ্ছি না।”
লোকটার ময়লা দাঁত দেখা গেল আবার। “হেরে তো আমি চিনি,..”
জামানের গায়ের পশম দাঁড়িয়ে গেল। “তাই না কি!”
“হ। দ্যাখা অইলেই আমারে পাঁচ টাকা দেয়।”
“কোথায় থাকে সে?”
রাস্তার পুব দিকে দেখিয়ে বলল ভিক্ষুক, “ঐ যে লাল বাড়িটা আছে …ঐ বাড়িতে।”
কিছুক্ষণ আগে এই বাড়িটা অতিক্রম করে এসেছে জামান। গেটে কোনো দারোয়ান দেখতে পায়নি তখন।
“আজকে তাকে দেখেছো?” জামান উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করল।
“আধা ঘণ্টা আগেই তো বাড়ির ভিতর ঢুকতে দ্যাখলাম…এহনও মনে হয় বাড়িতেই আছে।”
.
অধ্যায় ৫২
অভিনেত্রী পমির কাছ থেকে যা জানতে পেরেছে সেটা একেবারেই লোমহর্ষক একটি ব্যাপার। ভয়ঙ্কর এই তথ্যটা তার চোখের সামনে সমস্ত রহস্য উন্মোচন করে দিয়েছে।
রেস্তোরাঁ থেকে বের হয়ে পমিকে বিদায় দিয়ে ফুটপাত ধরে হাঁটছে আর ভাবছে ইনভেস্টিগেটর জেফরি বেগ। জায়েদ রেহমানের হত্যাকাণ্ডের গোলকধাঁধা থেকে বের হবার পথটা খুঁজে পেয়েছে সে। পুরো এপিসোডটা
এখন তার কাছে পরিস্কার।
এমন সময় তার মোবাইল ফোনটার রিং বেজে উঠল।
তার সহকারী জামান।
“হ্যাঁ, জামান…ফোন করে ভালো করেছে। একটা দারুণ খবর আছে?”
“স্যার! আমি এখন খুনির বাড়ির সামনে। সে বাড়ির ভেতরেই আছে! আপনি এক্ষুণি চলে আসুন!” এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলল জামান।
“কি!?” জেফরি টের পেল তার শরীরের সমস্ত পশম দাঁড়িয়ে গেছে।
“ধানমণ্ডিতে…ভিটা নুভার কাছেই…এক্ষুণি চলে আসুন, স্যার!”
*
ভিটা নুভা থেকে এক ব্লক দূরে ধানমণ্ডির এক নিরিবিলি রাস্তার পাশে লাল রঙের ডুপ্লেক্স বাড়িটি অবস্থিত। প্রথম দিকে এখানে যেসব বাড়িঘর তৈরি করা হয়েছিল এই বাড়িটা সেরকমই একটি বাড়ি। দশ কাঠার বাড়িটার সামনে বিশাল একটি লন, তারপরই পুরনো দোতলা ভবনটি অবস্থিত।
দশ-পনেরো বছর আগেও এই এলাকায় এ রকম বাড়ি ছিল শত শত। তবে ডেভেলপারদের আধিপত্যে এখন অবস্থা একেবারে পাল্টে গেছে। বিরল হয়ে উঠেছে সামনে বিশাল লনবিশিষ্ট এ রকম দোতলার বাড়িগুলো।
লালমাটিয়ার একটি রেস্তোরাঁয় বসেছিল পমির সাথে কথা বলার জন্য, সেখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে ধানমণ্ডির দিকেই যাচ্ছিল, ফলে এখানে আসতে বড়জোর দশ মিনিট লেগেছে তার। অবশ্য রিক্সা করে আসার সময় ফোনে পুরো ব্যাপারটা শুনে নিয়েছে জামানের কাছ থেকে।
তার সহকারী জামান লাল বাড়িটার মেইন গেটের সামনে প্রবল উত্তেজনা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জেফরিকে আসতে দেখেই তার কাছে ছুটে গেল।
“স্যার…এই বাড়িটাতেই আছে!” লাল রঙের বাড়িটা দেখিয়ে বলল জামান।
বাড়িটার দিকে তাকাল জেফরি। মেইনগেটটা বেশ পুরনো, মলিন, রঙ উঠে গেছে। “কোনো দারোয়ান নেই?”
“না, স্যার। আশেপাশে জিজ্ঞেস করে জানতে পেরেছি এই বাড়িতে অনেক দিন থেকে কেউ থাকে না। ডেভেলপারকে না কি দিয়ে দেয়া হয়েছে। কয়েক দিন পরই ভেঙে ফেলা হবে।”
একটু ভেবে জেফরি বলল, “চলো।”
জামান একটু অবাক হলো। “আমরা দুজনেই যাবো?”
“হ্যাঁ। চিন্তার কিছু নেই, আমার সাথে গান আছে।”
“আমার সাথেও আছে, স্যার,” বলল জামান।
“গুড। তাহলে সময় নষ্ট না করে চলো…ও যদি টের পেয়ে যায় অনেক ঝামেলা হয়ে যাবে। একবার ফসূকে গেলে ওকে আর ধরা সম্ভব হবে না।”
জামানও বুঝতে পারছে সেটা। আর কোনো কথা না বলে তারা লাল বাড়িটার দিকে এগিয়ে গেল নিঃশব্দে।
মেইনগেটটা ভেতর থেকে বন্ধ। কোনো কলিংবেল নেই। জেফরি ইশারা করলে জামান গেটটার উপর উঠে টপকে গিয়ে খুলে ফেলল সেটা। বাড়ির ভেতর ঢুকেই নিজেদের অস্ত্র হাতে তুলে নিলো দুজনে।
বিশাল লনটা ফাঁকা। আগাছা জন্মে আছে। উপর তলা থেকে ভেসে আসছে টিভি চলার মৃদু শব্দ। জেফরি পা টিপে টিপে লনটা পেরিয়ে দোতলা বাড়ির সদর দরজার কাছে চলে এল, তার পেছনে জামান।
জেফরি বেগ কাঠের দরজাটা আস্তে করে ধাক্কা দিতেই খুলে গেল সেটা। ভেতর থেকে আঁটকানো ছিল না। একটু অবাকই হলো সে। ভেতরে ঢুকে পড়ল তারা দু’জন। ভেতরে সব জানালা বন্ধ, দিনের বেলা হলেও আলো খুব কম। বিশাল ড্রইংরুমটা দেখে মনে হয় না কেউ ব্যবহার করে। পরিত্যাক্ত।
টিভির শব্দটা আসছে উপর তলা থেকে, জামানকে ব্যাকআপ দেবার ইশারা করে জেফরি বেগ ড্রইংরুমের শেষমাথায় থাকা সিঁড়িটা দিয়ে উপরে উঠে গেল নিঃশব্দে।
দোতলার ল্যান্ডিংয়ে উঠে টিভির শব্দটা কোত্থেকে আসছে বোঝার চেষ্টা করল বেগ। বাম দিকের দুটো ঘর, সেগুলোর দরজায় বড় একটা তালা দেখা যাচ্ছে। তবে ডান দিকের একটা ঘরের খোলা দরজা দিয়ে মৃদু আলো দেখতে পেল সে।
দরজা খোলা!
টিভির আওয়াজ সেই ঘর থেকেই আসছে। জেফরি বেগ টের পেল তার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে। দিলান মামুদ তাকে বলে দিয়েছে লোকটা ভয়ঙ্কর…খুবই বিপজ্জনক। জেফরিও জানে পেশাদার এক খুনিকে মোকাবেলা করতে যাচ্ছে তারা।
পিস্তলটার লক খুলে দু’হাতে ধরে আস্তে আস্তে পা টিপে এগোতে লাগল জেফরি। জামান সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে দাঁড়িয়ে থাকল ব্যাকআপ হিসেবে।
দরজার কাছে এসে দেয়ালের সাথে পিঠ দিয়ে দাঁড়াল সে। খুব দ্রুত করতে হবে কাজটা। ঘরের ভেতর থেকে টিভির শব্দটা এখন আরো স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। এক ঝটকায় ঢুকে পড়ল দরজা দিয়ে। হাতের পিস্তলটা সামনের দিকে তাক করা।
ফাঁকা।
ঘরে কেউ নেই। অসম্ভব!
শুধু একটা টিভি চলছে। অ্যানিমেল প্লানেট।
কয়েক মুহূর্তের জন্যে জেফরির কাছে মনে হলো সে একটা ফাঁদে পড়ে গেছে। কথাটা ভাবতেই তার গায়ের পশম দাঁড়িয়ে গেল।
“স্যার?”
জামানের কণ্ঠটা শোনা গেল সিঁড়ির ল্যান্ডিং থেকে। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে জামানের দিকে তাকিয়ে দু’পাশে মাথা নাড়তেই হঠাৎ করে একটা গন্ধ নাকে টের পেল জেফরি, ব্যাপারটা ধরতে দু’তিন সেকেন্ডের বেশি লাগল না। হাত তুলে জামানকে ল্যান্ডিংয়ে থাকার ইশারা করে করিডোরের শেষ মাথায় রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল সে।
রান্নাঘরটাও ফাঁকা। এখানে গন্ধটা আরো প্রকট। বন্ধ জানালার সামনে গ্যাসের চুলা, সেদিকে তাকাতেই জেফরির হৃদস্পন্দনটা থেমে গেল।
“জামান!” চিৎকার দিয়ে রান্নাঘর থেকে ল্যান্ডিংয়ের দিকে দৌড়ে গেল সে। “জলদি! নিচে নামো!”
জেফরির এমন আচরণে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেও বিপদের গন্ধ আঁচ করতে পেরে সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নামতে লাগল জামান।
জেফরি সিঁড়ির ল্যান্ডিং থেকে চার ধাপ নিচে পা রাখতেই ঘটনাটা ঘটলো।
*
লাগেজ গুছিয়ে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে গোসল সেরে নেয়। তারপর নিজের প্রিয় কালো রঙের প্যান্ট আর ব্লেজার পরে লাগেজটা হাতে নিয়ে ঘর থেকে বের হবার সময়ই সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ের জানালা দিয়ে দেখতে পায় বাড়ির মেইনগেটের সামনে দু’জন লোক দাঁড়িয়ে আছে।
জেফরি বেগ!
এতো দ্রুত তার বাড়ির সন্ধান পেয়ে যাবে ভাবতেই পারেনি। আবারো অবাক হয় সে। এ রকম পরিস্থিতিতেও তার মাথাটা দারুণভাবে কাজ করল। ঠাণ্ডা পানি দিয়ে গোসল করলে তার মধ্যে স্থিরতা চলে আসে। মাথা ঠাণ্ডা রেখে নিজের ঘরে ফিরে যায় দ্রুত। টিভিটা ছেড়ে দিয়ে ঘরের দরজা খোলা রেখেই পাশের রান্নাঘরে ঢুকে পড়ে। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট আর দেয়াশলাই বের করে প্রচণ্ড দ্রুততায় একটি ভয়ঙ্কর ডিভাইস তৈরি করে ফেলে অল্প সময়ের মধ্যেই।
একটা সিগারেট ধরিয়ে দু’একটা টান দিয়ে দেয়াশলাই থেকে সবগুলো কাঠি বের করে মেলে রাখে গ্যাসের চুলার পাশে, তারপর সিগারেটটা এমনভাবে দেয়াশলাইয়ের কাঠিগুলোর উপর রেখে দেয় যাতে কিছুক্ষণের মধ্যেই সেটা জ্বলতে জ্বলতে কাঠিগুলোর বারুদ স্পর্শ করে। এরপর গ্যাসের চুলাটা ছেড়ে দিয়ে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে ঢুকে পড়ে পাশের একটা বাথরুমে।
এই বাড়ির রান্নাঘর আর বাথরুমটা সিঁড়ির ল্যান্ডিং থেকে দেখা যায় না। পুরনো ডুপ্লেক্স বাড়ি। একটু বেশি রক্ষণশীল। সে জানে অন্য কারো পক্ষে এই বাড়িতে ঢুকে কমন বাথরুম আর রান্নাঘরটি খুঁজে বের করতে কিছুটা সময় লেগে যাবে। তার দরকার মাত্র চার-পাঁচ মিনিট।
রান্নাঘরের জানালার মাত্র তিন ফিট নিচেই গাড়ি রাখার একটি গ্যারাজ রয়েছে। এই বাড়ির চারপাশ ঘিরে থাকা বাউন্ডারি দেয়ালটা চলে গেছে সেই গ্যারাজটা ঘেষে। দেয়ালটার ওপাশে আছে সরু একটি গলি। তার হিসেবটা খুব সহজ। এ মুহূর্তে এরচেয়ে সহজে এ বাড়ি থেকে বের হওয়া প্রায় অসম্ভব।
বাথরুমের ভেতর অপেক্ষা করছে সে। আর মাত্র কয়েক মিনিট বাকি।
কিছুটা সময় অতিক্রান্ত হবার পরই সে শুনতে পেল কেউ একজন চিৎকার করে বলছে, “জামান! জলদি নিচে নামো!”
তারপরই সেটা ঘটলো।
কানে তালা লাগার মতো বিকট একটি বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল পুরো বাড়িটা। বাথরুমের নিরাপদ চারদেয়ালের মধ্যেও বিস্ফোরণের আঁচ টের পেল সে, সেইসাথে দুজন মানুষের আর্ত চিৎকার। সিঁড়ি থেকে এসেছে সেটা। একটু দম নিয়ে বাথরুম থেকে বের হতেই দেখতে পেল ধুয়ায় চারপাশ অন্ধকার হয়ে আছে। রান্নাঘরে উঁকি মারল, ঘরটা দেখে মনে হচ্ছে। বোমা বিস্ফোরিত হয়েছে সেখানে।
দেয়াশলাইয়ের কাঠির বারুদে সিগারেটের আগুন লাগতেই চার-পাঁচ মিনিট ধরে চুলা থেকে নির্গত গ্যাসে বিস্ফোরণ ঘটেছে। বোমার মতো শক্তিশালী সেই বিস্ফোরণে উড়ে গেছে ঘরের দরজা জানালা।
দম বন্ধ করে রান্নাঘরে ঢুকে ভাঙা জানালা দিয়ে লাফিয়ে নেমে পড়ল গ্যারাজের টিনের ছাদের উপর। শব্দটা খুব জোরে হলো বলে একটু চিন্তায় পড়ে গেল সে। দ্রুত সেখান থেকে লাফ দিয়ে নিচের গলিতে নেমে এমনভাবে হাঁটতে শুরু করল যেন কোনো কিছু হয়নি।
অনেক দূর যাবার পর মুচকি হেসে পেছনে ফিরে বাড়িটা এক নজর দেখেই আবার হাঁটতে লাগল সে।
*
একটু আগে বিস্ফোরণের শব্দে সিঁড়ি থেকে হুরমুর করে জেফরি আর জামান ছিটকে পড়ে যায় নিচের ল্যান্ডিংয়ে। পিস্তলটা আরেকটু হলে হাত থেকে ছিটকে পড়ে যেতো। তাদের কানে তালা লাগার জোগাড় হয়। ধাতস্থ হতে আধ-মিনিটের মতো লেগে যায়।
মেঝে থেকে উঠে বসল জেফরি। একেবারে অক্ষত আছে। বিস্ফোরণের শকওয়েভে বেসামাল হয়ে পড়েছে শুধু। তবে তার সহকারী জামান বোধহয় ডান পায়ে ব্যথা পেয়েছে। ডান পায়ের গোড়ালী ধরে কোঁকাচ্ছে সে।
ঠিক তখনই ধপাস করে কোনো কিছু পড়ার শব্দ শুনতে পেল জেফরি বেগ। কিছু একটা আঁচ করতে পেরে উঠে দাঁড়াল সে। জামানের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি এখানেই থাকো, আমি উপরে যাচ্ছি…”
এক হাতে পিস্তল নিয়ে দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে রান্নাঘরের দরজার সামনে আসতেই দেখতে পেল সেটার দরজা জানালা বিস্ফোরণে উড়ে গেছে। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন ঘরটায় ঢুকে ভাঙা জানালা দিয়ে নিচে তাকাতেই বুঝে ফেলল কি হয়েছে।
সে-ও ঠিক খুনির মতো লাফিয়ে নাএল গ্যারাজের টিনের ছাদে। সেখান থেকে দ্রুত লাফ দিয়ে গলিতে নামতেই দৌড়াতে শুরু করল। সে জানে, খুনি তার থেকে একটু এগিয়ে আছে।
গলিটা একশ’ গজের মতো এগিয়ে গিয়েই ডানদিকে বাঁক নিয়ে মিশে গেছে মেইনরোডের সাথে। জেফরি দৌড়ে চলে এল সেখানে। মেইনরোডে অসংখ্য যানবাহন আর মানুষজনের মধ্যে খুঁজে বেড়াল তার দুচোখ। পিস্তলটা কারোর নজরে পড়ার আগেই কোমরে গুঁজে রাখল। একবার ডানে আরেকবার বামে তাকাল সে। বুঝতে পারছে না কোন্ দিকে গেছে খুনি।
কয়েক মুহূর্ত পরই সেটা তার চোখে পড়ল।
ডানদিকের রাস্তার ফুটপাতে, তার থেকে বেশ দূরে, কালো ব্লেজার আর প্যান্ট পরা এক লোক। হাতে মাঝারি আকৃতির একটি লাগেজ। মানুষের ভিড়ে এতো দূর থেকে তাকে লক্ষ্য করতে পারতো না যদি না সে পেছন ফিরে তাকাতো।
জেফরি দ্রুত এগিয়ে গেল। তার হাঁটার গতি অনেকটা দৌড়ের মতোই। খুনিও বুঝে গেছে জেফরি তার পিছু নিয়েছে, তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো হাঁটার গতি একদম স্বাভাবিক রেখেছে সে। ধীরস্থির। কোনো তাড়াহুড়া নেই তার মধ্যে।
আশ্চর্য!
দূরত্ব কমিয়ে আনার জন্য জেফরি বেগ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। এখন তার থেকে মাত্র একশ’ গজ দূরে আছে। কোমর থেকে পিস্তলটা বের করে হাতে নেবে কি না বুঝতে পারল না। এতো মানুষের ভিড়ে এভাবে পিস্তল হাতে…না। সিদ্ধান্ত নিতে পারল না সে। সম্ভবত খুনিও সেটা বুঝে গেছে!
আচমকা ডানদিকের একটা গলিতে ঢুকে পড়ল সে। একেবারে চোখের পলকে। জেফরিও দৌড়ে ছুটে গেল। গলিতে ঢুকতেই দেখে সুনসান। জনমানুষের কোনো চিহ্ন নেই।
অসম্ভব।
ম্যাজিকের মতো উধাও হয়ে গেছে খুনি। এভাবে তার চোখের সামনে থেকে হাওয়া হয়ে যাবে একদমই বুঝতে পারেনি জেফরি। কী করবে বুঝে উঠতে পারল না। অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে রইল।
তার মোবাইল ফোনে ইনকামিং মেসেজের বিপ হলে পকেট থেকে সেটা বের করে দেখল। ইংরেজিতে লিখেছে, বাংলা করলে অর্থ দাঁড়ায় :
আমাকে অনুসরণ করবে না। ফিরে যাও।
জেফরি ভেবেছিল রেবার মেসেজ…কিন্তু খুনির কাছ থেকে এ রকম একটি মেসেজ পেয়ে তার বুকটা ধক করে উঠল। তার মোবাইল ফোনের নাম্বার পর্যন্ত আছে লোকটার কাছে! আশেপাশেই কোথাও ঘাপটি মের আছে ভয়ঙ্কর সেই খুনি!
চারদিকটা চকিত দেখে নিলো সে। গলির দু-পাশে সারি সারি বাড়ি আর অ্যাপার্টমেন্ট। জনমানুষের চিহ্ন নেই। সতর্ক হয়ে উঠল। একেবারে বিশুদ্ধ গোলকধাঁধা!
চট করে তার মাথায় একটা বুদ্ধি এল। ইনকামিং মেসেজটা যে নাম্বার থেকে এসেছে সেই নাম্বারে রিটার্ন কল করল সে।
যা ভেবেছিল তাই।
দূর থেকে একটা মোবাইল ফোনের রিং হবার শব্দ শুনতে পেল ইনভেস্টিগেটর জেফরি বেগ। তার গায়ের পশম দাঁড়িয়ে গেল। কোমর থেকে পিস্তলটা বের করে যেখান থেকে শব্দটা আসছে সেদিকে ছুটে গেল সতর্কভাবে।
একটু সামনে, ডানদিকের দুটো বাড়ির মাঝখানে, সরু আরেকটা গলি চলে গেছে, সেই গলি থেকে আসছে শব্দটা। গলিতে ঢুকতেই রিংটা থেমে গেল, কয়েক মুহূর্তের জন্য ভড়কে গেল জেফরি কিন্তু পরক্ষণেই বুঝতে পারল রিং হতে হতে স্বাভাবিকভাবেই সেটা থেমে গেছে। আবারো ডায়াল করল সেই নাম্বারে।
এবার তার খুব কাছ থেকে রিং হবার শব্দ শুনতে পেল সে। আস্তে আস্তে গলির আরো ভেতরে ঢুকে পড়ল জেফরি। গলির শেষ মাথায় ডানদিকের বাউন্ডারি দেয়ালের উপর একটা মোবাইল ফোন রাখা আছে, সেটা থেকে আওয়াজটা আসছে।
বুঝতে পারল, দেয়ালের উপর থেকে মোবাইল ফোনটা নিয়ে দৌড়ে গলিটা পেরিয়ে আরেকটা বড় রাস্তায় এসে পড়ল সে। প্রথমে ডানে, তারপর বায়ে তাকাল। খুনির কোনো চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না।
মোবাইল ফোনটা ব্যবহার করে তাকে ধোঁকা দেয়া হয়েছে। এতে করে বাড়তি কিছুটা সময় পেয়ে উধাও হয়ে গেছে খুনি।
এমন বোকামির জন্য মনে মনে নিজেকে ভৎর্সনা করল জেফরি বেগ।
.
অধ্যায় ৫৩
খুনিকে ধরতে ব্যর্থ হলেও জেফরি বেগ জানে লেখক জায়েদ রেহমানকে কে হত্যা করিয়েছে, তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কেন করিয়েছে সেটাও জেনে গেছে সে। পুরো ঘটনাটিই বেশ জটিল। একটা নিখুঁত পরিকল্পনা। দক্ষ এক খুনি। গোলকধাঁধাতুল্য এই হত্যারহস্য অবশেষে উন্মোচিত হয়েছে তার কাছে।
সহকারী জামান পায়ে একটু চোট পেলেও সেটা মারাত্মক কিছু না-তার ডান পায়ের গোড়ালী মচকে গেছে।
জামানকে এখন পর্যন্ত কিছুই বলেনি। হোমিসাইডে ফিরে এসে, বেশ কিছু তথ্যও জোগাড় করে ফেলেছে সে। ধানমণ্ডির ঐ লাল রঙের বাড়িটা যে রিয়েল এস্টেট প্রতিষ্ঠানের তার পরিচয় এবং মালিকের নামও জেনেছে জেফরি। সবগুলো তথ্য একটা বিষয়কেই দৃঢ় করে তুলেছে : জায়েদ রেহমানের আসল খুনি। তবে যে মোবাইলফোন দিয়ে খুনি তাকে ধোঁকা দিয়েছে সেটা আনরেজিস্টার্ড একটি সিমের। তার ধারণা খুনির কাছে একাধিক ফোন থাকে সব সময়।
সিদ্ধান্ত নিলো পুরো ব্যাপারটা হোমিসাইডের মহাপরিচালককে অবগত করতে হবে।
*
সব শুনে ফারুকসাহেব চুপ মেরে গেল। এই নীরবতা দীর্ঘস্থায়ী হলো কয়েক মিনিট। তার সামনে বসে আছে তার প্রিয়পাত্র জেফরি বেগ। অবশেষে মুখ খুলল হোমিসাইড প্রধান।
“অবিশ্বাস্য!” কথাটা বলেই আবার চুপ মেরে গেল। পুরো কেসটা তো একেবারে ওলটপালট হয়ে যাবে। কাউকেই বিশ্বাস করানো যাবে না।”
“কিন্তু আমাদের হাতে প্রমাণ আছে, স্যার। আমরা এটা প্রমাণ করতে পিরবো,” বলল জেফরি।
“প্রমাণ?” ফারুক আহমেদ অবাক হয়ে বলল। “কোথায় প্রমাণ? এগুলো কি আদালতে টিকবে? খুনি যদি ধরা পড়তো…পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তি দিতো তাহলে ব্যাপারটা ভেবে দেখা যেতো।”
“কিন্তু স্যার, অভিনেত্রী পমি যে কাহিনীটা আমাকে বলেছে, সেটাকে কী বলবেন?”
“একজন অভিনেত্রী কী বলল না বলল সেটা আদালতে গ্রহণযোগ্য হবে না…অবশ্য ঐ অভিনেত্রী যদি শেষ পর্যন্ত আদালতে গিয়ে এসব কথা বলে
জেফরিও জানে কথাটা সত্যি। পমি তার সাথেই দেখা করেছে গোপনে, যাতে করে তার স্বামী জানতে না পারে। সে আদালতে গিয়ে এসব কথা বলবে সেটা আশা করা হবে বোকামি।
“শোনো, জেফ…আমি বুঝতে পারছি তোমার অবস্থাটা। তোমার কথা যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে তুমি যাদেরকে দায়ি করছে তাদেরকে কোনো দিনই আদালতে দোষি প্রমাণ করা যাবে না।”
“কিন্তু আরেকটু তদন্ত করলে আমি নিশ্চিত সেটা প্রমাণ করা যাবে। আমার হাতে অনেকগুলো প্রমাণ আছে, সেগুলো নিয়ে কাজ করলে-”
“তোমার হাতে আসলে শক্ত কোনো প্রমাণই নেই, জেফ,” তার কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বলে উঠল মহাপরিচালক, “যেগুলো আছে সেগুলো এক ফুঙ্কারে হাওয়া হয়ে যাবে। ঐ দারোয়ান আর নাইটগার্ড? চায়ের দোকানি? ঘুষখোর এক পুলিশ ইন্সপেক্টর? আর ঐ পমি না ফমি নামের এক অভিনেত্রী?” মাথা দোলাল ফারুকসাহেব। “এদের কথায় কিংবা সাক্ষিতে কিছুই প্রমাণ করা যাবে না।”
“তাহলে আমি যা জানতে পেরেছি তার কি কোনোই মূল্য নেই?” হতাশ হয়ে বলল জেফরি।
“তুমি একটি কাহিনী জানতে পেরেছে। অবিশ্বাস্য একটি কাহিনী। জায়েদ রেহমানের হত্যার তদন্তে যেসব অসঙ্গতি তোমার কাছে ধরা পড়েছিল এই কাহিনীটা সে-সব দূর করতে সাহায্য করছে। তোমার কাছে এখন পুরো বিষয়টা পরিস্কার…কিন্তু এটা তুমি প্রমাণ করতে পারবে না।”
“খুনি যে বাড়িতে ছিল সেটার ব্যাপারে কি বলবেন?”
মাথা দোলাল হোমিসাইড প্রধান। “ডেভেলপাররা বলবে বাড়িটা পরিত্যক্ত ছিল…খুনি হয়তো সেই সুযোগই নিয়েছে।”
“স্যার, আপনি যদি আমাকে সুযোগ দেন তো আমি প্রমাণ করতে পারবো…”
“কি রকম সুযোগ?”
“সি ই এ সিদ্দিকীকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে দিন আমাকে।”
“অসম্ভব!” সঙ্গে সঙ্গে নাকচ করে দিল হোমিসাইড প্রধান। “শুধুমাত্র সন্দেহের উপর ভিত্তি করে এ রকম একজন ধনাঢ্য শিল্পপতি-ব্যবসায়িকে খুনের মামলায় জিজ্ঞাসাবাদ!? মাইগড! তুমি বুঝতে পারছো না?”
“তাহলে তো আমরা এ হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করতে পারবো না, স্যার।”
“তুমি ভুলে গেছো, এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে আছে। আমার ধারণা আগামী মাসের মধ্যেই ফাইনাল ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্ট দেয়া হবে।”
“স্যার, আমরা তো জানি ওরা এই খুনটা করেনি!” জেফরি বলল।
“ঠিক আছে, সেটা আদালত আর ওদের উকিলের উপরেই ছেড়ে দাও। এ ব্যাপারে আমরা এখন কিছু করতে পারবো না,” বলল ফারুক আহমেদ। “কিছু করার নেই।”
“আমি যদি ঐ খুনিকে ধরতে পারি কিংবা সিদ্দিকীসাহেবের বিরুদ্ধে শক্ত কোনো প্রমাণ পাই তাহলে কি তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দেবেন?”
“যদি কিছু পাও তখন দেখা যাবে।” একটু থেমে আবার বলল সে, “তবে ঐ খুনি শুধু ধরা পড়লেই হবে না, তাকে স্বীকারোক্তিও দিতে হবে। আমি জানি, এ রকম কিছু ঘটবে না।”
হতাশ হয়ে ফারুকসাহেবের দিকে চেয়ে রইল জেফরি।
“রিয়েলিটি…মাইবয়,” একটু থেমে আবার বলল, “বাড়ি যাও। বিশ্রাম নাও, জেফ।”
অন্যমনস্ক হয়ে উঠে চলে গেল সে। যাবার আগে হোমিসাইড প্রধানকে কিছুই বলল না।
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল ফারুক আহমেদের ভেতর থেকে।
.
অধ্যায় ৫৪
সন্ধ্যার একটু আগে, সি ই এ সিদ্দিকী নিজের অফিস থেকে বের হবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন মাত্র অমনি ইন্টারকমে তার প্রাইভেট সেক্রেটারি জানাল ইনভেস্টিগেটর জেফরি বেগ তার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে।
আশ্চর্য! এই লোকটা তার সাথে বার বার দেখা করতে চাইছে কেন?
অমূল্যবাবুও কাছে নেই। একটু চুপ করে থেকে সেক্রেটারিকে বলে দিলেন ইনভেস্টিগেটরকে তার অফিসে পাঠিয়ে দিতে, তারপর নিজের ডেস্কের নিচে একটা গোপন সুইচ টিপে দিলেন তিনি।
“আসুন,” দরজা খুলে অফিসে ঢুকতেই জেফরির উদ্দেশ্যে বললেন সি ই এ সিদ্দিকী। “বসুন, প্লিজ।”
একটা চেয়ারে বসল ইনভেস্টিগেটর। “ধন্যবাদ।”
“আবার কি মনে করে, মি. বেগ?” সিদ্দিকীসাহেব জানতে চাইলেন।
“আপনার সাথে দেখা করার কোনো পরিকল্পনা আমার ছিল না কিন্তু পরিস্থিতি বাধ্য করেছে।”
ভুরু তুলে চেয়ে রইলেন তিনি। “যা বলার তাড়াতাড়ি বলুন, আমি জাস্ট বের হচ্ছিলাম।”
মাথা নেড়ে সায় দিল জেফরি বেগ। পকেট থেকে খুনির ছবিটা বের করে ডেস্কের উপর রাখল। সি ই এ সিদ্দিকী ছবিটার দিকে তাকালেন কিন্তু তার অভিব্যক্তি দেখে বোঝার উপায় নেই লোকটাকে তিনি চিনতে পেরেছেন কি না। ভাবলেশহীন। নির্বিকার।
“চিনতে পেরেছেন?”
মাথা নাড়লেন তিনি। মুখে কিছু বললেন না।
“এই লোক লেখক জায়েদ রেহমানকে খুন করেছে,” সিদ্দিকীসাহেবের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে বলল জেফরি।
এখনও কোনো অভিব্যক্তি নেই। “তাই না কি,” নির্লপ্তভাবে বললেন। “কিন্তু আমার কাছে কেন এসেছেন সেটা বলুন।”
“বলছি,” একটু থেমে বলতে লাগল সে, “এই লোকটা পেশাদার খুনি। নিজের কাজে বেশ প্রতিভাবান। আমাদের কাছে প্রমাণ আছে এই লোকই লেখক জায়েদ রেহমানকে খুন করেছে…তবে কাজটা সে করেছে আরেকজনের হয়ে।”
“ইনভেস্টিগেটর…আপনার যা বলার সংক্ষেপে বলুন। কে কাকে খুন করেছে সেটা আমাকে শুনিয়ে লাভ নেই। আসল কথায় আসুন।” বেশ দৃঢ়ভাবে বললেন তিনি।
“মি. সিদ্দিকী, এই পেশাদার ভাড়াটে খুনিকে দিয়ে লেখক জায়েদ রেহমানকে আপনিই খুন করিয়েছেন!”
সিদ্দিকীসাহেব নিষ্পলক চোখে জেফরির দিকে চেয়ে রইলেন। “আমি!?”
মাথা নেড়ে সায় দিল জেফরি। “হ্যাঁ।”
“আমি তাকে খুন করতে যাবো কেন?”
“পমি আমাকে সব বলেছে।” কথাটা শুনে এই প্রথম সিদ্দিকীসাহেব একটু চমকে উঠলেন। “এখন আমি সব জানি।”
সি ই এ সিদ্দিকী চুপ মেরে রইলেন।
“আপনার ছেলে ইরাম অল্পবয়স থেকেই লেখক জায়েদ রেহমানের অন্ধভক্ত। তার সাথে লেখকের বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল। জায়েদ সাহেব তাকে একটা বইও উৎসর্গ করেছিলেন। লেখকের খুব ঘনিষ্ঠ ছিল ইরাম।” একটু থেমে সিদ্দিকীসাহেবের দিকে ভালো করে তাকাল জেফরি। কয়েক বছর আগে…লেখক জায়েদ রেহমান তার একটি ছবির শুটিং ইউনিট নিয়ে সেন্ট মার্টিনে যান, সঙ্গে ছিল ইরাম।”
“আমার কাছে বলেছিল বন্ধুদের সাথে সেন্ট মার্টিনে যাচ্ছে…” অন্যমনস্ক হয়ে বললেন সিদ্দিকীসাহেব।
“এক রাতে…ছবির নায়িকা পমি স্ক্রিপ্টের ব্যাপারে একটু আলোচনা করার জন্য জায়েদ রেহমানের রুমে ঢুকতেই ভয়ঙ্কর একটি দৃশ্য দেখতে পায়।”
সিদ্দিকীসাহেব দুচোখ বন্ধ করে ফেললেন।
লেখক জায়েদ রেহমান যে ইরামকে নেশাগ্রস্ত করে বলাকার করছিলেন সেটা আর মুখে বলল না জেফরি।
“পমি এটা মেনে নিতে পারেনি। ঐ রাতেই এ নিয়ে জায়েদ রেহমানের সাথে তার তুমুল বাকবিতণ্ডা হয়। পর দিন সকালেই ইউনিট ছেড়ে চলে আসে সে। সেই ছবিতে আর কাজ করেনি।”
চোখ খুললেন সিদ্দিকীসাহেব। তার দুচোখ লাল টকটকে।
“জায়েদ রেহমানের মতো জনপ্রিয় লেখকের বিরুদ্ধে এসব বলে কোনো লাভ হবে না বরং তার নিজেরই ক্ষতি হবে, এটা বুঝতে পেরে পমি সেদিনের ঘটনাটি আর কাউকে বলেনি। বিনিময়ে জায়েদ রেহমানও তার বিরুদ্ধে মাঝপথে ছবির কাজ ছেড়ে দেয়ার জন্য কোনো মামলা বা ক্ষতিপূরণের দাবি করেননি। বিশাল অঙ্কের টাকা লোকসান মেনে নেন তিনি।” একটু থামল জেফরি।
সিদ্দিকীসাহেবের দৃষ্টিতে শূন্যতা। যেন অন্য কোথাও হারিয়ে গেছেন।
“জায়েদ রেহমানের সাথে তার প্রথম স্ত্রীর ডিভোর্সের পর কথা প্রসঙ্গে পমি মহিলাকে জানায়, লেখক একজন ধর্ষণকারী। জঘন্য সেই ঘটনাটি পুরোপুরি খুলে বলেনি সে, ফলে গোলনূর আফরোজ তরফদার ধরে নেয় জায়েদসাহেব পমিকেই ধর্ষণ করেছেন। মহিলাকে দোষ দেয়া যায় না…ধর্ষণ বলতে আমরা সাধারণত পুরুষ কর্তৃক নারীকে ধর্ষণ করাই বুঝি।”
সিদ্দিকীসাহেব এবার জেফরির দিকে তাকালেন।
“আপনি অবশ্য এই ব্যাপারটার কিছুই জানতেন না। কিন্তু ঘটনাচক্রে পমি আপনাকে পুরো ঘটনাটি বলে দেয়।”
“হ্যাঁ…ঐ দিনের কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে,” সিদ্দিকীসাহেব বললেন।
“আপনার বন্ধু মির্জা আদিলকে বিয়ে করার পর পরই পমি নিয়মিত ঢাকা ক্লাবে আসতে শুরু করে,” বলতে লাগল জেফরি, “এক দিন লেখক জায়েদ রেহমানও অন্য একজন মেম্বারের গেস্ট হয়ে ক্লাবে এলেন। আপনার সাথে তার পরিচয় করিয়ে দেয়া হলো…আপনারা তিনজনে বসে একটু ড্রিঙ্ক করলেন। লেখক অবশ্য জানতেন না আপনিই ইরামের বাবা। এমন সময় পমি এসে হাজির হয় সেখানে…কিছুটা মাতাল ছিল সে।”
আলতো করে মাথা নাড়লেন সিদ্দিকীসাহেব তবে তার দৃষ্টি এখনও শূন্যে ।
“ক্লাবে জায়েদ রেহমানকে দেখেই পমি বিগড়ে যায়। জায়েদ রেহমানকে গালিগালাজ করতে শুরু করে সে। মাতাল ছিল বলে কোনো হুশ ছিল না তার। আপনি তাকে ধমক দিলে সে রেগেমেগে বলে দেয় ইরামের সাথে জায়েদসাহেব কি জঘন্য কাজটা করেছিল সেন্ট মার্টিনে।”
মাথা নিচু করে রাখলেন সি ই এ সিদ্দিকী।
“জীবনে এতোটা বিস্মিত হননি আপনি…এতোটা ক্ষুব্ধও হননি কখনও। জায়েদসাহেবের সাথে আপনার তুমুল ঝগড়া বেধে যায়। হাতাহাতির পর্যায়ে চলে গেলে অন্যেরা এসে আপনাদেরকে থামায়। সেদিনই আপনি সবার সামনে বলেছিলেন, জায়েদ রেহমানকে এর মাশুল দিতে হবে।”
মুখে তিক্ত হাসি দেখা গেল সিদ্দিকীসাহেবের। “হ্যাঁ, তা বলেছিলাম।”
“ক্লাব থেকে ফিরেই জায়েদসাহেব স্ট্রোক করে বসেন। কয়েক দিন পর তার ওপেনহার্ট সার্জারি করা হয়…এর কয়েক মাস পর আরেকটা স্ট্রোকে উনি প্যারালাইজ্ড হয়ে যান।” জেফরি বেগ একটু থেমে আবার বলতে লাগল, “তারপর যখন জানতে পারলেন লেখক জায়েদ রেহমান আত্মজীবনী লেখার কাজে হাত দিয়েছেন তখন আর দেরি করলেন না। আত্মজীবনীর কাজ শেষ হবার আগেই পেশাদার এক খুনিকে দিয়ে খুনটা করালেন…খুবই নিখুঁতভাবে। ফেঁসে গেল মিসেস রেহমান আর তার প্রেমিক।”
“সবই তো জানেন দেখছি…” বললেন সিদ্দিকীসাহেব।
জেফরি বেগ আরো বলতে লাগল, “অমূল্যবাবুর এক দূরসম্পর্কের আত্মীয় নির্মল প্রকাশনীতে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে কাজ করে। তার কাছ থেকেই জায়েদসাহেবের আত্মজীবনী লেখার কথাটা জানতে পারে অমূল্যবাবু…সে আপনাকে সব জানালে পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়।”
“কিন্তু আপনি কোনো কিছুই প্রমাণ করতে পারবেন না,” দৃঢ়তার সাথে বললেন ইরামের বাবা।
জেফরি এ ব্যাপারে কিছু বলল না। “অবয়ব প্রকাশনী থেকে জায়েদ রেহমানের যে আত্মজীবনীটা প্রকাশিত হয়েছে খুব সম্ভবত সেটা আপনার ঐ অমূল্যবাবুর লেখা…আমি খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি, ভদ্রলোক এক সময় লেখালেখি করতেন। বলা যায় ব্যর্থ লেখক।”
সিদ্দিকীসাহেবের ঠোঁটে মুচকি হাসি। “এখন তো আর সেটা বলার কোনো উপায় নেই। বইটা দারুণ বিক্রি হচ্ছে।”
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জেফরি বলল, “তবে আপনার ছেলে ইরাম কেন ঐদিন রাতে ভিটা ভার সামনে গিয়েছিল সেটা এখনও জানি না।”
“আপনার খুব জানতে ইচ্ছে করছে?” গম্ভীর কণ্ঠে বললেন সিদ্দিকীসাহেব।
অবাক হলো ইনভেস্টিগেটর জেফরি বেগ।
“ঠিক কি কারণে ইরাম ঐ দিন ওখানে গিয়েছিল জানি না। তবে প্রায়ই সে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। আমার ধারণা, সম্ভবত সে-ও লেখককে খুন করতে চায়!”
অবাক হলো জেফরি। “কী বলেন!”
মাথা নেড়ে সায় দিলেন তিনি। “আমার ছেলে এলএসডি’র মতো মারাত্মক এক ড্রাগে আসক্ত। ঐ ঘটনার পর থেকে সে কিছুটা অস্বাভাবিকও হয়ে পড়ে। আপনি অনেক কিছু জানলেও এটা জানেন না, লেখক জায়েদ রেহমানের এক বইতেই এলএসডি সম্পর্কে ভুল ধারণা পায় ইরাম। আমি অবশ্য কিছু দিন আগে জানতে পেরেছি কথাটা।”
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চেয়ে রইল জেফরি বেগ।
“এই ড্রাগ নিলে না কি মায়ের জরায়ুতে থাকার স্মৃতি মনে পড়ে যায়-লেখকের এমন কথায় বিশ্বাস করে ওটাতে আসক্ত হয়ে পড়েছিল সে। জন্মের পর পরই ওর মা মারা যায় সুতরাং মায়ের ব্যাপারে ওর সব সময়ই একটা ফ্যাসিনেশন কাজ করে। কোত্থেকে এসব ড্রাগ জোগাড় করে বুঝি না। খুব সম্ভবত ওর একটি সার্কেল আছে। অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু অ্যাডিকশন থেকে ফেরাতে পারিনি। ইদানিং ড্রাগ নেবার পরই জায়েদ রেহমানকে খুন করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। সব সময়ই চোখে চোখে রাখি কিন্তু আমার ছেলেটা সবাইকে ফাঁকি দিয়ে বার বার পালিয়ে যায়। কাকতালীয়ভাবে ঐদিনও একই কাজ করেছিল।” সিদ্দিকীসাহেব থামলেন।
“আপনি জায়েদ রেহমানের উপর প্রতিশোধ নেবার জন্যে তাকে খুন করেছেন…বানোয়াট একটি আত্মজীবনী তার নামে ছেড়ে দিয়ে তার মানসম্মান ধুলোয় মিটিয়ে দিয়েছেন।”
“হ্যাঁ,” বললেন সিদ্দিকীসাহেব। এছাড়া আমার কিছু করার ছিল না। আমি তো আদালতে গিয়ে বলতে পারবো না, আমার ছেলের সাথে কী করেছে ঐ বিকৃত মানসিকতার লোকটি। তাই আমি আমার মতো করেই প্রতিশোধ নিয়েছি। আমার ছেলেকে বলাকার করার প্রতিশোধ…আমার ছেলেকে নেশায় আসক্ত করানোর প্রতিশোধ!”
“একজন পক্ষাঘাতগ্রস্ত লোককে হত্যা করে প্রতিশোধ নিলেন!”
“হ্যাঁ, নিলাম…কারণ ঐ জঘন্য লোকটি ভণ্ড আর মিথ্যায় পরিপূর্ণ একটি আত্মজীবনী লিখছিল। নিজেকে একজন সাধুপুরুষ হিসেবে অমর করতে চেয়েছিল…চেয়েছিল নিজের সমস্ত নোংরা সত্যগুলোকে আড়াল করতে। আমি তা হতে দিইনি!” একটু থেমে আবার বলতে লাগলেন, “আপনার সাথে যদি কেউ অন্যায় করে আপনি তার প্রতিশোধ নেবেন…এটাই স্বাভাবিক।”
“তাহলে আইন-আদালত কি করবে?” প্রশ্ন রাখল জেফরি।
“তাদের যা করার তারা করবে, আমার যা করার আমি করেছি। আমি আদালতে যেতে পারবো না বলে তো তাকে ছেড়ে দিতে পারি না।” একটু থেমে আবার বলতে লাগলেন তিনি। “আপনি ব্যাপারটা যেভাবে দেখছেন আমি সেভাবে দেখছি না, এই হলো পার্থক্য।”
“আপনি কিভাবে দেখছেন!?” অবাক হয়ে জানতে চাইল জেফরি।
“অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়াটাকে আমি স্বাভাবিক ব্যাপার বলেই মনে করি। প্রতিশোধ এই মহাবিশ্বেরই অংশ। আপনি নিউটনের থার্ড ল সম্পর্কে নিশ্চয় জানেন-প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি বিপরীত এবং সমান। প্রতিক্রিয়া আছেদ্যাটস ইট! আপনি যা করবেন তার পাল্টা প্রতিক্রিয়া থাকতে হবে। প্রতিশোধ ছাড়া পৃথিবীটা একবার চিন্তা করে দেখুন, মি. বেগ…ওয়ান ফাইন মর্নিং আপনি ঘুম থেকে উঠে দেখতে পেলেন কোনো রকম প্রতিশোধ নেই। অন্যায় বেড়ে যাবে হু হু করে! কেউ অন্যায়-অত্যাচার করতে ভয় পাবে না। আমরা প্রতিশোধের ভয়ে অনেক অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকি। আই ফর আই! চোখের বদলে চোখ-এটাই জগতের নিয়ম। সেই প্রাচীনকাল থেকেই এটা চলে এসেছে।” উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন তিনি, নিজেকে একটু ধাতস্থ করে আবার বলতে লাগলেন, “মি. বেগ, আপনি নিশ্চয় জানেন, অন্যায়ের প্রতিশোধের জন্যে গ্রিকদের একজন দেবি পর্যন্ত রয়েছে…নেমেসিস! আমার ছেলের সাথে যে অন্যায় করা হয়েছে তার প্রতিশোধ আমি নিয়েছি।”
“কিন্তু আপনার এই প্রতিশোধের কারণে নির্দোষ দু-জন মানুষ ফেঁসে যাচ্ছে সেটা কি আপনি জানেন না?”
“জানি। এ-ও জানি, তাদেরকে নিয়ে আপনার খুব চিন্তা হচ্ছে।”
“আমি তো মনে করি যেকোনো বিবেকবান মানুষেরই তা-ই হওয়া উচিত।” কথাটা বেশ ঝাঁঝের সাথে বলল জেফরি বেগ।
“এ নিয়ে চিন্তা করার দরকার নেই। কিছু দিনের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে।”
অবাক হলো ইনভেস্টিগেটর। “ঠিক হয়ে যাবে! কিভাবে? আপনি নিজের দোষ স্বীকার করে নেবেন!?”
দু-পাশে মাথা দোলালেন সিদ্দিকীসাহেব। “ছেলেমানুষী কথাবার্তা বলবেন না। একটু অপেক্ষা করে দেখুন, সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“আপনি নিজেকে খুব ক্ষমতাবান ভাবেন, তাই না? ভাবেন টাকা দিয়ে সব করা সম্ভব?”
“টাকা দিয়ে অনেক কিছুই করা সম্ভব, মি. বেগ।”
“আচ্ছা! তাহলে আমাকে বলুন, এই দু-জন নির্দোষ মানুষ কিভাবে রক্ষা পাবে?”
“মনে করুন কয়েক দিন পর জেলে থাকা এক ডাকাত নিজে থেকে পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তি দিল, সে কৌশলে জায়েদ রেহমানের ফ্ল্যাটে ঢুকে ডাকাতি করতে গিয়ে তাকে খুন করে ফেলেছে!”
জেফরি চেয়ে রইল, কিছু বলল না।
“ভাবছেন অসম্ভব?” মাথা দোলালেন তিনি। “টাকা দিয়ে সব না হলেও এ কাজটা করা যাবে।”
বাঁকাহাসি হাসল জেফরি বেগ।
“আমার কতো টাকা আছে সেটা আমি নিজেও জানি না, মি. বেগ। সম্ভবত হাজার কোটি টাকা। এতো টাকা থাকার পরও তুচ্ছ এক লেখক আমার অল্পবয়সি ছেলের সাথে জঘন্য একটা কাজ করল আর আমি কি না বসে বসে আদর্শের বাণী আওড়াবো!” দু-পাশে দৃঢ়ভাবে মাথা নাড়লেন তিনি। “না। এভাবে পৃথিবীটা চলে না। তুমি আমার নিষ্পাপ ছেলেকে বলাকার করেছে আমি তোমার সারা জীবনের অর্জিত মানসম্মানকে বলাকার করে দিলাম!”
“আপনার কাজ আপনি করেছেন, এবার আমার কাজ আমাকে করতে দিন।” উঠে দাঁড়াল জেফরি বেগ। “আপনার প্রতি, আপনার ছেলের প্রতি আমার যথেষ্ট সমবেদনা রয়েছে, তারপরও হত্যাকাণ্ডকে কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। এর অবশ্যই বিচার হওয়া উচিত, আর আমি সেই চেষ্টাই করবো।”
“গুডলাক, মি. বেগ।” কথাটা নির্বিকারভাবে বললেন সি ই এ সিদ্দিকী।
“এরপর এখানে যখন আসবো আপনি বুঝতে পারবেন, টাকা আর ক্ষমতা দিয়ে সব কিছু করা যায় না।” কথাটা বলেই দরজার দিকে পা বাড়াল সে।
“আর আপনি এখান থেকে ফিরে গিয়ে বুঝতে পারবেন, ইটস অ্যা ওয়াইল্ড ওয়ার্ল্ড, মি. বেগ…অ্যান্ড ফানি টু!” সি ই এ সিদ্দিকী তার ডেস্কের নিচে সুইচটা আবারো টিপে দিলেন।
মুচকি হেসে জেফরি বেগ দরজা খুলে বের হতেই শুনতে পেল পেছন থেকে সিদ্দিকীসাহেব বলছেন, “এপ্রিল ফুল!”
কথাটার কোনো মানে বুঝল না ইনভেস্টিগেটর।
*
নিজের অফিসে এসে লেদার জ্যাকেটের ভেতরের পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে আনলো জেফরি বেগ।
সি ই এ সিদ্দিকীর সাথে তার সমস্ত কথাবার্তা রেকর্ড করেছে সে। এছাড়া তার আর কোনো উপায়ও ছিল না। এমন কোনো শক্তিশালী ক্ল তার হাতে নেই যা দিয়ে ক্ষমতাধর সিদ্দিকীসাহেবকে অভিযুক্ত করা যাবে। সিম অফ না করে রাখলে রেকর্ডিংয়ের মাঝপথে কেউ কল করে বসতে পারে সেজন্যে ভদ্রলোকের অফিসে ঢোকার আগেই সিম অফ মোডে রেখে রেকর্ডিং করেছিল।
দীর্ঘ সংলাপে জেফরি ইচ্ছে করেই পুরো হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি বিস্তারিত বলে গেছে। তার ফাঁদে পা দিয়ে ভদ্রলোকও এমন অনেক কথা বলে ফেলেছেন যা তার জন্যে কাল হয়ে দাঁড়াবে।
মি. সিদ্দিকী, আপনি অনেক টাকার মালিক হতে পারেন, হতে পারেন অনেক ক্ষমতাধর ব্যক্তি ন্তু অতোটা স্মার্ট হয়ে উঠতে পারেননি! মনে মনে বলল সে।
রেকর্ডিং অপশনে গিয়ে কিছুক্ষণ আগে রেকর্ড হওয়া অডিও ফাইলটি প্লে করে ফোনসেটটা কানের কাছে তুলে ধরল ইনভেস্টিগেটর।
ঘর্ঘর্… ঘর্ঘর্… ঘর্ঘর্…
অবাক হয়ে ফোনটা চোখের সামনে এনে দেখল ফাইলের ডিউরেশন মাত্র ৮ সেকেন্ড!
ঘর্ঘর্… ঘর্ঘর্… ঘর্ঘর্…
এটা কি করে সম্ভব!?
সিদ্দিকীসাহেবের শেষ কথাটার মানে বুঝতে পারল জেফরি বেগ।
জ্যামার! ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস বিকল করে দেবার জন্যে বিভিন্ন ধরণের জ্যামার রয়েছে। কিছু জ্যামার আছে শুধুমাত্র শব্দধারণকে বাধা দিয়ে থাকে। নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর পাশাপাশি বড় বড় অনেক ব্যবসায়িও এ ধরণের জিনিস ব্যবহার করে থাকে ব্ল্যাকমেইলের হাত থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করার জন্যে। সি ই এ সিদ্দিকীর অফিসরুমে যে এ রকম একটি ডিভাইস আছে সে-ব্যাপারে জেফরি বেগ একদম নিশ্চিত।
শুধুমাত্র সিদ্দিকীসাহেবের শেষ কথাটাই রেকর্ড হয়েছে।
এপ্রিল ফুল!?
.
অধ্যায় ৫৫
রেবার ইয়েলো ক্যাবটা এসে থামল দোতলা একটি বাড়ির সামনে। রাত দশটা। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পড়েছে। একটা শাল গায়ে জড়িয়ে আস্তে করে গাড়ি থেকে নেমে দোতলা বাড়িটার দিকে পা বাড়াল সে।
সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলার যে ফ্ল্যাটের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল সেই ফ্ল্যাটের একটি ডুপ্লিকেট চাবি আছে তার কাছে। অনেক দিন পর আজকে আবার এখানে এসেছে রেবা।
প্রায় এক ঘণ্টা ধরে জেফরির মোবাইলে ফোন করে গেলেও তাকে পায়নি। তার ফোন বন্ধ। অজানা আশঙ্কায় রেবার বুক কেঁপে উঠলেও নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিয়েছে, জেফ হয়তো জরুরি কোনো কাজে ব্যস্ত আছে। রেবা জানে, ইন্টেরোগেশনের সময় মোবাইলফোন বন্ধ রাখে সে।
অনেক বার ফোন করেও যখন পেল না তখন আর এখানে না এসে উপায় রইল না তার।
ভেতরে ঢুকে সুইচ টিপে বাতি জ্বালিয়ে দিল সে।
জেফরির এই দুই রুমের ফ্ল্যাটে অনেক দিন পর এল। এই কয়েক মাসেই জায়গাটা একটু অপরিচিত বলে মনে হচ্ছে তার কাছে। এলএল হয়ে আছে ফ্ল্যাটটা। জেফরি যে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এটা যেন তারই বহিপ্রকাশ। এমনিতে সে খুব গোছানো একজন মানুষ।
এমন সময় দরজার নবে চাবি ঘোরানোর শব্দ শুনে রেবা ছুটে গেল সেদিকে। জেফরি তাহলে এসে পড়েছে।
দরজাটা খুলতেই দেখতে পেল এক আগন্তুক দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। রেবার চেয়ে তার বিস্ময় কোনো অংশেই কম নয়।
*
ইনভেস্টিগেটর জেফরি বেগ খুবই নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে বেড়ে ওঠা একজন মানুষ। ফাদার জেফরি হোবার্টের কাছ থেকে মা-বাবার স্নেহ পেলেও কঠিন শাসনের মধ্যে থাকতে হয়েছে তাকে। সিগারেট কিংবা মদের প্রতি কখনই তার আকর্ষণ ছিল না, তবে বন্ধুবান্ধবদের পাল্লায় পড়ে বছরে দু-একবার পানাহার করে। ভার্জিনিয়ায় ট্রেনিং নেবার সময়ও খুব একটা ছুঁয়ে দেখেনি মদ নামক জিনিসটা। তবে আজকে তার মানসিক অবস্থা খুব খারাপ। এ রকম ব্যর্থ একটি দিন তার জীবনে আর কখনও আসেনি।
বেশ কয়েক দিন ধরে তার মনমেজাজ ভালো নেই। ভেতরে ভেতরে একটা অস্থিরতা চলছে। যে মেয়ের সাথে দীর্ঘ পাঁচ বছরের সম্পর্ক তার কাবিন হয়ে গেছে কয়েক দিন আগে। এরপর জায়েদ রেহমানের হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি তাকে একেবারে শেষ করে দিয়েছে। নিজেকে একজন ব্যর্থ মানুষ ছাড়া আর কিছু ভাতে পারছে না।
খুনিকে হাতের নাগালে পেয়েও ধরতে পারেনি। ধূর্ত খুনি তাকে বোকা বানিয়ে সটকে পড়েছে। এরপর তাকে আরেকবার বোকা বানিয়ে এপ্রিল ফুল উপহার দিয়েছেন সি ই এ সিদ্দিকী।
আর সব দিনের মতো হোমিসাইড থেকে সোজা নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে গেল না, একটা বারে গিয়ে আকণ্ঠ পান করল সে। অনেক রাত পর্যন্ত থাকার ইচ্ছে ছিল কিন্তু সেটা আর সম্ভব হয়নি। বারে বসে পান করতে করতেই তার মনে পড়ে যায় মোবাইল ফোনটা বন্ধ করে রেখেছে। সিদ্দিকীসাহেবের কথা রেকর্ড করার জন্যে সিম অফ করে রেখেছিল। সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা বের করে সিম অন করতেই তিন-চারটা এসএমএস এসে জড়ো হলো। সবগুলোই রেবার।
প্রথমটা সন্ধ্যার দিকে। শেষ মেসেজটা প্রায় এক ঘণ্টা আগের।
তোমাকে কল করে পাচিছ না। দেখা করতে চাই। জরুরি।
রেবা আমার সাথে দেখা করতে চাইছে! বিস্মিত হলো জেফরি বেগ।
আমি তোমার কাছে আসছি।
আমার কাছে!
তোমার ফ্ল্যাটে যাচিছ। জলদি আসো। প্লিজ।
কি!
সঙ্গে সঙ্গে রেবার মোবাইলে কল করল কিন্তু তার ফোন বন্ধ। উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল জেফরি বেগ। বার থেকে বের হয়ে একটা ট্যাক্সি ক্যাব নিয়ে রওনা হলো নিজের ফ্ল্যাটের উদ্দেশ্যে। তার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। রেবা কেন তার ফ্ল্যাটে আসতে চাইবে! তার ফোনই বা কেন বন্ধ! মদের নেশায় মাথাটা ঠিকমতো কাজ করছে না। অস্থির হয়ে উঠল সে। বার বার ক্যাবের ড্রাইভারকে জোরে চালানোর জন্যে তাগাদা দিল পেছনের সিট থেকে।
বাড়ির সামনে আসতেই দ্রুত ভাড়া মিটিয়ে নিজের ফ্ল্যাটের দিকে টলতে টলতে পা বাড়াল সে। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় একবার হোঁচটও খেলো। ফ্ল্যাটের দরজায় দরজায় নক করলেও কোনো সাড়া শব্দ পেল না। রেবা হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। অগত্যা পকেট থেকে চাবি বের করে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ল।
বেডরুমে বাতি জ্বলছে। সে-দিকে পা বাড়াল জেফরি। দরজার কাছে। আসতেই এমন একটা দৃশ্য দেখতে পেল যা কখনই চিন্তা করেনি।
মাই গড!
*
বেডরুমে বিছানার প্রান্তে বসে আছে রেবা। চোখেমুখে তীব্র আতঙ্ক। তার ঠিক পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে দেবদূতের মতো চেহারার সেই খুনি-জায়েদ রেহমানের হত্যাকারী।
কিন্তু জেফরি নড়তে পারল না। তার পা দুটো আড়ষ্ট হয়ে গেছে, কারণ খুনির হাতে যে পিস্তলটি রয়েছে সেটা রেবার মাথার পেছনে তা করা।
এই জীবনে নিজেকে এতোটা অসহায় আর কখনই লাগেনি। বেডরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইল বেশ কিছুটা সময়। তার মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোলো না।
“জেফ!” অস্ফুটস্বরে বলল রেবা। ভয়ে কাঁপছে সে।
তার পেছনে থাকা খুনির চেহারা একদম নির্বিকার। “পিস্তলটা বিছানার উপর রাখুন,” আস্তে করে বলল সে।
কটের ভেতরে হাত দিয়ে শোল্ডার হোলস্টার থেকে নাইন মিলিমিটারের পিস্তলটা বের করে বিছানার উপর রেখে দিল।
খুনি এবার অন্য হাত দিয়ে কয়েক পা পেছনে চলে যাবার ইশারা করল জেফরিকে।
“মি. জেফরি বেগ, বসুন,” বিছানার অন্যপ্রান্তের দিকে ইশারা করে বলল খুনি।
তার কথামতো জেফরি বসে পড়ল। রেবাকে আশ্বস্ত করে বলল সে, “ভয় পেয়ো না।”
“এই নোক কে…জেফ?” কাঁপা কাঁপা গলায় বলল রেবা।
“তোমাকে পরে সব বলবো। এখন কোনো কথা বোলো না।”
খুনি তাদের কথাবার্তায় কোনো বাধা না দিয়ে মুচকি হাসল কেবল। পিস্তলটা এখনও রেবার দিকেই তাক্ করে রেখেছে।
“আ-আমাদেরকে মেরে ফেলবে…?”
“না। রেবা,” বলল জেফরি।
“ব্যস্…এবার চুপ! আর কোনো কথা নয়,” রেবার উদ্দেশ্যে বলল খুনি।
“তুমি কি চাও?” প্রশ্ন করল জেফরি বেগ।
খুনির ঠোঁটে বাঁকাহাসি। “আমি কারো কাছ থেকে কিছু চাই না…দরকার পড়লে নিজেই নিয়ে নিই।”
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল জেফরির বুক থেকে। “তুমি আমাকে খুন করতে চাও তো…ঠিক আছে, ওকে ছেড়ে দাও।” জেফরির কথা শুনে রেবার চোখ দুটো বিস্ফারিত হবার জোগাড় হলো। “ওকে কিছু কোরো না।”
*
জেফরির সাথে কথা বলার পর পরই সিদ্দিকীসাহেব নিজের বাড়িতে ফিরে এসেছেন, আজ আর ক্লাবে যাননি।
ড্রইংরুমে বসে আছে অমূল্য বাবু। কিছুক্ষণ আগে এসেছে সে। সিদ্দিকী সাহেবের কাছ থেকে সব শুনে বাবু বলল, “এই ব্যাপারটা নিয়ে আপনাকে আর না ভাবলেও চলবে। ঐ ইনভেস্টিগেটর ভদ্রলোক কিছুই করতে পারবে না। সব ক্লিয়ার করে ফেলা হয়েছে। তবে আমার আশঙ্কা বাস্টার্ড হয়তো তাকে ছেড়ে দেবে না। কিছু আলামত রয়ে গেছে তার কাছে।”
“মানে?” সিদ্দিকীসাহেব অবাক হয়ে জানতে চাইলেন। “ঐ ইনভেস্টিগেটরকে বাস্টার্ড…মাই গড! আমি আর কোনো খুনখারাবি চাই না, বাবু। যথেষ্ট হয়েছে।”
“আমরা তো আর ওকে খুন করতে বলিনি, বাস্টার্ড তার প্রয়োজনে যা করার করবে, আমাদের কিছু করার নেই।”
দু-পাশে মাথা দোলালেন সিদ্দিকীসাহেব। “আমি চাই না ঐ জেফরি বেগ লোকটার কোনো ক্ষতি হোক। বাস্টার্ডকে যেভাবে পারেন থামান।”
অমূল্যবাবুর কপালে ভাঁজ পড়ে গেল, তবে মুখে কিছু বলল না।
“কী?” সিদ্দিকীসাহেব উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইলেন।
“ভাবছি দেরি হয়ে গেল কি না…”
“মাই গড…কী বলেন! ওকে এক্ষুণি বলে দিন। জলদি!”
*
খুনি সম্পর্কে আমাদের মনে যে ধরণের ছবি গেঁথে আছে এই বাস্টার্ড নামের খুনির সাথে তার কোনো মিলই নেই। নিষ্পাপ চেহারার এক যুবক। দেখলে মনে হবে বয়স বাড়লেও চেহারাটা রয়ে গেছে ফুটফুটে শিশুর মতোই। আর এটাই ইনভেস্টিগেটর জেফরি বেগের ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই মুহূর্তে জেফরির অবস্থা খুবই নাজুক। মদের প্রভাবে মাথাটাও ঠিকমতো কাজ করছে না। সে একা থাকলে যেটুকু সুবিধা পেতো এখন রেবার উপস্থিতিতে একেবারে বেকায়দায় পড়ে গেছে। পুরোপুরি অসহায় হয়ে পড়েছে সে।
এমন সময় ফোনের রিং বেজে উঠলে তারা দুজনেই চমক উঠল।
না। জেফরির নয়, খুনির ফোনটা বাজছে।
বাস্টার্ড অবাক হয়ে জেফরির পিস্তলটা বিছানা থেকে তুলে নিয়ে নিজের কোমরে গুঁজে পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করল। কলটা রিসিভ করলেও কিছু বলল না সে। কানে চেপে রেখে কিছুক্ষণ শুনে গেল ওপাশের কথা।
“আপনাদের সাথে আমার ডিল শেষ হয়ে গেছে…” জেফরির দিকে তাকাল খুনি। “আমার সামনেই আছে…আমি খুন করার জন্য টাকা নেই জীবন বাঁচানোর জন্য না।”
জেফরি বুঝতে পারছে ফোনটা সম্ভবত সিদ্দিকীসাহেব করেছেন।
“…বুঝতে পারছেন না…আমার নিজের প্রটেকশনের জন্য করতে হচ্ছে এটা…তাই!…হ্যাঁ…ঠিক আছে!”
জেফরি টের পেল তার হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে। মদের প্রভাবে যেটুকু ঝিমুনি ভাব চলে এসেছিল সেটাও উধাও হয়ে গেছে এখন। কিছু একটা করতেই হবে। এক্ষুণি!
ফোনে কথা বলতে গিয়ে খুনির হাতে থাকা পিস্তলটি রেবার মাথার পেছন থেকে একটু সরে গেল। সেটা এখন ছাদের দিকে তাক করা। স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া। ব্যাপারটা খুনির অগোচরেই হয়েছে। এক্ষুণি! মনে মনে নিজেকে আবারো তাড়া দিল জেফরি বেগ।
ঠিক তখনই ঘটলো ব্যাপারটা।
আচমকা চারপাশ ঘন অন্ধকারে ডুবে গেল।
*
অমূল্যবাবু ফোনটা কানে ধরে রেখেছে, কিছু বলছে না। তার চোখমুখ দেখে সিদ্দিকীসাহেব চিন্তিত হয়ে পড়লেন।
“কি হয়েছে!?”
কানে ফোন ধরে রেখেই বাবু বলল, “গুলির শব্দ!”
“কি?”
“ধস্তাধস্তির শব্দও পাচ্ছি।”
সিদ্দিকীসাহেব অস্থির হয়ে ঘরে পায়চারী করতে লাগলেন।
অমূল্যবাবু ফোনটা এখনও কানে ধরে শুনে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর চোখমুখ কুঁচকে ফেলল সে।
“কি হয়েছে?” পায়চারী থামিয়ে জানতে চাইলেন সি ই এ সিদ্দিকী।
“আরেকটা গুলি!”
*
জেফরি খুনির দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার হাত থেকে পিস্তলটা নিতে উদ্যত হবার আগেই এটা ঘটলো। মুহূর্তেই বুঝে গেল সে, তবে ফোনে কথা বলতে থাকার কারণে বুঝতে দেরি করে ফেলল খুনি।
লোডশেডিং!
ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া খুনি কিছু বুঝে ওঠার আগেই জেফরি বেগ তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার লক্ষ্য ছিল একটাই-খুনির পিস্তল ধরে থাকা হাতটি।
মোবাইল ফোনটা চালু থাকার কারণে অন্ধকারেও খুনির মুখের দিকটা ডিসপ্লের আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল, ফলে জেফরির নিশানা ব্যর্থ হয়নি।
আর্তচিৎকার দিয়ে ওঠে রেবা। তাকে উদ্দেশ্যে করে জেফরি কেবল একটা কথাই বলতে পেরেছিল—”রেবা! ঘর থেকে বেরিয়ে যাও!”
খুনির পিস্তল ধরা হাতটির কব্জি বামহাতে শক্ত করে ধরে ডানহাতে সজোরে ঘুষি চালায় মাথার বামদিকে। তারা দুজনেই বিছানা থেকে হুরমুর করে মেঝেতে পড়ে গেলে পিস্তল থেকে একটা গুলি বের হয়ে যায় সঙ্গে সঙ্গে।
জেফরি বুঝতে পারে রেবা এখনও বিছানার উপরে, প্রাণপণে চিৎকার দিচ্ছে।
“রেবা! ঘর থেকে বেরিয়ে যাও! বেরিয়ে যাও!”
জেফরির ফ্ল্যাটে অনেকবার এসেছে রেবা, সবকিছুই তার চেনা। ফলে গাঢ় অন্ধকারেও সেখান থেকে বের হতে কোনো অসুবিধা হয়নি। সিঁড়ি দিয়ে যখন নিচে নামছে ঠিক তখনই দ্বিতীয় গুলির শব্দটা শুনতে পায়। থমকে যায় সে। বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে তার। বুঝতে পারে না কী করবে। দুচোখ ঠেলে পানি বের হতে শুরু করে। দৌড়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে মেইন রোডে এসে পড়ে। জীবনে এ রকম পরিস্থিতিতে পড়েনি। প্রচণ্ড নার্ভাস হয়ে ছিল কিন্তু গুলির শব্দটা তাকে বিপর্যস্ত করে ফেলে।
এমনিতেই জায়গাটা নিরিবিলি, লোডশেডিং চলছে বলে একেবারে ভুতুরে লাগছে, তার উপর পরপর দুটো গুলির শব্দে আশেপাশের লোকজন ভয় পেয়ে বন্ধ করে দিতে শুরু করেছে নিজেদের ঘরের দরজা। অনেকে হয়তো ভাবছে ডাকাত পড়েছে।
রাস্তাটা পার হয়ে জেফরির ফ্ল্যাটের দিকে তাকাল সে। বাইরে থেকে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ছে না।
*
ওদিকে অন্ধকারে দু-জন মানুষ নিজেদের সমস্ত শক্তি দিয়ে লড়ে যাচ্ছে একে অন্যকে ঘায়েল করার জন্য।
এখনও পর্যন্ত খুনির হাত থেকে পিস্তলটা ছাড়াতে পারেনি জেফরি বেগ । এক হাতে খুনির পিস্তল ধরা হাতের কব্জি শক্ত করে ধরে অন্য হাতে ঘুষি মেরেছিল প্রচণ্ড জোরে তারপরও হাত থেকে পিস্তলটা ছাড়াতে পারেনি। পর পর দুটো গুলি বের হয়ে গেছে অস্ত্র থেকে। দুটোই আঘাত হেনেছে ছাদে।
তারা দুজন এখন মেঝেতে ধস্তাধস্তি করছে। জেফরি প্রথমে খুনির উপরে থাকলেও দুটো গুলির শব্দে একটু চমকে যেতেই সেই সুবিধাটুকু নিয়ে নিলো খুনি। খপ করে জেফরির গলা চেপে ধরল, এতোটাই জোরে যে জেফরির মনে হলো তার গলাটা বুঝি ছিঁড়েই ফেলবে।
দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। যেভাবেই হোক হাতটা ছাড়াতে হবে নইলে কিছুক্ষণের মধ্যেই নিঃশেষ হয়ে যাবে তার সমস্ত শক্তি। কিন্তু খুনির যে হাতে পিস্তলটা আছে সেটা কোনোভাবেই ছাড়া যাবে না, ছাড়লেই গুলি করে বসবে। আবার যে হাতটা দিয়ে তার গলা ধরে রেখেছে সেটাও একহাতে ছাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না।
জেফরি দ্রুত ভাবতে লাগল। এফবিআই’তে যে কমব্যাট ট্রেনিং নিয়েছিল তার সবগুলো কৌশলই ভেবে দেখল সে।
হাঁটু দিয়ে খুনির তলপেটে একটা আঘাত করলেও কোনো কাজ হলো না, উল্টো খুনি তার গলাটা আরো জোরে চেপে ধরল।
জেফরি বেগ টের পেল তার সমস্ত শক্তি দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে আসছে তার হাত-পা।
ঠিক তখনই একটা ব্যাপার মনে পড়ে গেল তার।
আমার পিস্তলটা!
ডানহাতে খুনির কোমরে গুঁজে থাকা পিস্তলটা এক ঝটকায় হাতে নিয়েই গুলি চালিয়ে বসল জেফরি বেগ ।
একটু আগে সেটা বিছানা থেকে তুলে নিজের কোমরে খুঁজে রেখেছিল খুনি।
একটা চাপা আর্তনাদ। জান্তব গোঙানী!
টের পেল গুলির আঘাতে খুনি তার কাছ থেকে কিছুটা দূরে ছিটকে পড়েছে, সেই সাথে তার গলাটাও মুক্ত হয়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে একটু সরে গিয়ে বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে নিলো।
খুনির গোঙানী থেমে গেছে এখন। অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। জেফরি বেগ আন্দাজ করার চেষ্টা করল ঘরের ঠিক কোথায়, কোন্ পজিশনে আছে। অন্ধকারে ধস্তাধস্তি করতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলেছে সে।
বামহাতে বিছানার প্রান্ত ধরে উঠে বসল। এখনও হাফাচ্ছে। খুট করে একটা শব্দ হতেই সেদিকে লক্ষ্য করে আরেকটা গুলি চালাল সে।
বিস্ফোরণের আগুনে ক্ষণিকের জন্যে ঘরের সেই অংশটুকু দেখতে পেল খুবই অল্প সময়ের জন্যে, কিন্তু স্পষ্ট দেখতে পেয়েছে মেঝের সেই জায়গাটি খালি। ওখানে কেউ নেই!
মাই গড! ওখানেই তো খুনি ছিল! গেল কোথায়?
গায়ের সমস্ত পশম দাঁড়িয়ে গেল তার। আর সময় নষ্ট না করে অন্ধকারেই ছুটে গেল দরজার দিকে। একটু আগে রেবা বের হয়ে গেছে, ফলে দরজাটা খোলাই আছে।
কতো দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এল ধারণাও করতে পারল না জেফরি। নিজের ফ্ল্যাট ছেড়ে প্রাণপণে দৌড়ে চলে এল মেইন রোডে। খুনিকে কোনো সুযোগ দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। সে জানে তার কাছেও একটি পিস্তল আছে।
“রেবা! রেবা!” চিৎকার করে ডাকতে লাগল সে। অন্ধকার রাস্তায় কাউকে দেখা যাচ্ছে না, তবে সে জানে রেবা অনেক আগেই তার ঘর থেকে বের হয়ে গেছে। “রেবা!”
রাস্তার ডানদিকের ফুটপাতে একটি অবয়ব দেখতে পেল সে।
“রেবা!”
হঠাৎ চারপাশ আলোকিত হয়ে উঠল। লোডশেডিংয়ের সমাপ্তি।
তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে রেবা, ভয়ে কাঁপছে। তার দুচোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। জেফরিকে দেখামাত্রই দৌড়ে ছুটে এল, ঝাঁপিয়ে পড়ল তার বুকে। কিছুই বলতে পারল না, শুধু জড়িয়ে ধরে কেঁদে চলল কিছুক্ষণ।
এই জীবনে এতোটা প্রশন্তি পায়নি জেফরি বেগ। তার কাছে মনে হলো এক মুহূর্তে সে হারানো সব কিছু ফিরে পেয়েছে।
*
একটি খুনের ব্যবচ্ছেদ
ভিটা নুভার দারোয়ান মহব্বত সেন্ট্রি বক্সে বসে আছে। ঘড়ির দিকে তাকাল সে। ৬টা বাজতে ১০ মিনিট বাকি। তার ডিউটি শেষ হবে ঠিক ছ টায়। গেট দিয়ে এক লোককে ঢুকতে দেখে সেন্ট্রি বক্স থেকে বেরিয়ে এল।
“কই যাইবেন?”
লোকটার হাতে খাকি ব্যাগ। একটা কার্ড বের করে দেখাল সে। “টাওয়ারে যাবো।”
মহব্বত আইডিকার্ডটা দেখে কোনো কিছু না বলে ফেরত দিয়ে দিলে লোকটা পার্কিং এরিয়ার লিফটের দিকে পা বাড়াল।
ভিটা নুভার নাইটগার্ড আসলাম ডিউটিতে এল দশ মিনিট পর। রাত থেকে ভোর পর্যন্ত ডিউটি করবে সে। ছুটি পেয়ে নিজের ঘরে ফিরে গেল মহব্বত।
*
রাত দুটো বাজে।
পূর্ণিমার আলোয় চারপাশটা অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছে। ভিটা নুভার ছয়তলার ছাদের সেলফোনের টাওয়ারের উপর থেকে কালো ফুলহাতা হাইনেক গেঞ্জি, কালো প্যান্ট আর মাথায় ক্যাপ পরা এক লোক নেমে এল নিঃশব্দে। তার হাতে একটি খাকি ব্যাগ।
ছাদের দক্ষিণ দিকে এসে নিচের দিকে তাকাল সে, রাস্তাটা একেবারে ফাঁকা। ব্যাগ থেকে বারো-তেরো ফুটের একটি দড়ি বের করে ছাদের রেলিংয়ের সাথে বেধে নিলো লোকটি। তার ঠিক নিচেই একটা বেলকনি। অন্যসব ফ্ল্যাটের মতো শেড কিংবা গ্রিল দিয়ে সুরক্ষিত করা নেই। মুচকি হাসল সে। এই ভবনের স্থপতিকে মনে মনে ধন্যবাদ দিল। নিরাপত্তাকে ছাপিয়ে গেছে সৌন্দর্য!
দড়ি বেয়ে আস্তে করে নেমে গেল সেই বেলকনিতে।
বেলকনির সাইডিং ডোরটা একটু ফাঁক করাই আছে। সিনথেটিক গ্লাভ পরা হাত দিয়ে সেটা আরেকটু সরিয়ে ঢুকে পড়ল ঘরের ভেতর।
অন্ধকার ঘরে মেডিকেল বেডে একজন শুয়ে আছে। বেলকনির স্লাইডিং ডোর দিয়ে আসা জ্যোত্মার মৃদু আলো ঢুকে পড়েছে ঘরে, চারপাশটা দেখে নিয়ে পা টিপে টিপে বেডের কাছে গিয়ে থামল সে।
এই ঘরে এর আগেও এসেছিল, কয়েক দিন আগে, অন্য এক পরিচয়ে।
বেডের পাশে কফি টেবিলের উপর রাখা ল্যাপটপটির দিকে তাকাল। চালু অবস্থায়ই আছে। টাচপ্যাডে আঙুল ছোঁয়াতেই পর্দায় ভেসে উঠল ইয়াহু মেইলের হোমপেজ। আরেকবার মুচকি হাসল সে। তার কাজটা সহজ হয়ে গেল। তার মানে, তাকে আর জোর করে অসুস্থ লোকটার কাছ থেকে মেইল অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ড আদায় করার ঝামেলা পোহাতে হবে না।
বেডে শুয়ে থাকা লোকটির দিকে তাকাল। তার দুচোখ ভোলা।
“কে?” ফ্যাসফেসে কণ্ঠে অসুস্থ লোকটি বলল।
কালো পোশাকের লোকটি একটুও চমকালো না। তার নার্ভ বেশ শক্ত। অপেক্ষা করল সে। তার হাতে অনেক সময় আছে, তাড়াহুড়ার কোনো দরকার নেই। অসুস্থ লোকটি আর কিছু বলল না। আরেকটু সময় নিলো সে, তারপর বেডের কাছে গিয়ে একহাতে অসুস্থ লোকটার মুখ চেপে ধরে তার বুকের বামপাশে সজোরে ঘুষি চালাল।
পর পর তিনটি।
শেষে কনুই দিয়ে প্রচণ্ড জোরে ঘৃণার সাথে আরেকটা আঘাত করল। এ রকম অথর্ব লোককে খুন করার মতো কাপুরুষ নয় সে। তাকে যখন এই খুনের লোভনীয় প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছিল কিন্তু সব শুনে অবশেষে রাজি হয়ে যায়। তার নিয়োগকর্তা অবশ্য এসবের কিছুই জানে না। যারা শিশুদের উপর যৌননিপীড়ন চালায় তাদেরকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করে সে। অনেক আগে, শৈশবে তার সাথেও এ রকমটি করার চেষ্টা করেছিল আরেকজন বিকৃত লোক। তার পরিণাম এই লোকটার চেয়েও খারাপ হয়েছিল।
অসুস্থ লোকটার মুখ থেকে হাত সরিয়ে দেখল, সে নিশ্চিত, কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃত্যু হবে। কিন্তু তাকে বিস্মিত করে দিয়ে আচমকা চোখ খুলে যন্ত্রণাকাতর কণ্ঠে বলে উঠল লোকটি : “…আমাকে ক্ষমা করে দিও!”
একটু চমকে উঠল খুনি! আরেকটা আঘাত করার জন্যে উদ্যত হতেই দেখতে পেল লোকটি নিস্তেজ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে।
পকেট থেকে একটা পেনড্রাইভ বের করে ল্যাপটপের কাছে গেল সে। পুরো কাজটা করতে মাত্র দশ মিনিট সময় লাগল।
বেলকনিতে এসে নিচের রাস্তার দিকে তাকাতেই তার চোখ আটকে গেল একটা দৃশ্য দেখে, নিচু হয়ে বসে পড়ল সঙ্গে সঙ্গে।
রাস্তার ফুটপাত থেকে এক ছেলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বেলকনিটা দেখছে!
একটু ভড়কে গেল খুনি। কিছুক্ষণ বসে থেকে বেলকনির রেলিং দিয়ে উঁকি মেরে দেখল ছেলেটা এখনও বেলকনির দিকেই তাকিয়ে আছে।
নিচু হয়ে বসে আরেকটু অপেক্ষা করল সে। কিছুক্ষণ পর রাস্তা থেকে হৈহল্লার শব্দ শুনে আবারো উঁকি মেরে দেখতেই গায়ে কাটা দিয়ে উঠল।
পুলিশ!
ছেলেটা প্রাণপনে দৌড়াচ্ছে, তার পেছনে একটি পুলিশ জিপ ।
জিপটি দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেলে খুনি আর দেরি করল না, দড়ি বেয়ে বেলকনি থেকে আবার উঠে পড়ল ছাদে।
দড়িটা খুলে ব্যাগে ভরে নিয়ে টাওয়ারের উপর গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল সে। এরপর ভিটা নভার নিচে পলিশের আগমন আর টের পায়নি। ফজরের আজানের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল খুনি।
আজান হতেই টাওয়ার থেকে নেমে এল। খাকি ব্যাগ থেকে একটা পাজামা আর পাঞ্জাবি বের করে পোশাক পাল্টে বাকি পোশাক আর দড়ির গোছাটা ব্যাগে ভরে নিলো সে। ছাদের উত্তর দিকে গিয়ে আস্তে করে নিচে ফেলে দিল ব্যাগটা। এই ভবনের উত্তর অংশে একটা লেক চলে গেছে। ব্যাগটা গিয়ে পড়ল লেকের পাশে থাকা সারি সারি গাছের নিচে।
তারপর ছাদ থেকে সিঁড়ি দিয়ে সোজা চারতলায় এসে অপেক্ষা করল হানিফসাহেবের জন্যে। দীর্ঘ দিন পর্যবেক্ষণ করে সে জানে, এই ভদ্রলোক এখনই ফজরের নামাজ পড়তে বের হবে। তিনতলার একটি ফ্ল্যাটে দরজা খোলার শব্দ হতেই সে সজাগ হয়ে উঠল। বুঝতে পারল হানিফসাহেব বের হচ্ছে। ভদ্রলোক লিফটে ঢোকার পর পরই দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে গেল
হানিফসাহেব যখন লিফট থেকে বের হয়ে পার্কিং এরিয়া দিয়ে মেইনগেটের দিকে এগোতে লাগল খুনি তার পিছু নিলো। সদ্য ঘুম থেকে ওঠা হানিফসাহেব অবশ্য টের পেল না তার পেছনে আরেকজন আছে। টের পেলেও কোনো সমস্যা হতো না। ভদ্রলোক মনে করতো অন্য কোনো ফ্ল্যাটের গেস্ট হয়তো।
নাইটগার্ড ছেলেটি হানিফসাহেবকে দেখেই সালাম দিয়ে মেইনগেটটা খুলে দিল। খুনি নাইটগার্ডের দিকে তাকাল না, যেন হানিফ সাহেবের সাথে সাথে সে-ও নামাজ পড়তে যাচ্ছে এ রকম একটি ভান করে বের হয়ে গেল ভিটা নুভা থেকে।
অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বের হয়ে লেকের যে জায়গায় ব্যাগটা ফেলে দিয়েছিল সেটা তুলে নিতেই শুনতে পেল পুলিশের গাড়ি এসে মেইনগেটের সামনে থেমেছে। আর দেরি না করে লেকের ওয়াকওয়ে ধরে চলে গেল খুনি।
*
উপসংহার
বাস্টার্ড নামের খুনির ব্যাপারটা বেশ রহস্যজনক। এটা নিশ্চিত, গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরও জেফরির আগেই ঘর থেকে বের হয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে সে, কারণ এরপর পুলিশ এসে ঘরে কাউকে খুঁজে পায়নি। সবচেয়ে বড় কথা কোনো রক্তপাতের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। পুলিশের ধারণা খুনিকে গুলি করতে ব্যর্থ হয়েছে জেফরি, কিন্তু সেটা অসম্ভব। খুনির তলপেটে পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করেছে সে।
তবে জেফরি এ ঘটনায় একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছে : খুনি সম্ভবত বুলেটপ্রুফ ভেস্ট পরে ছিল। গুলির আঘাতে একটু আহত হয়, তারপর গড়িয়ে বিছানার নিচে চলে যাবার সময় দ্বিতীয় গুলিটা করে জেফরি। আর ঘর থেকে সে বেরিয়ে যাবার ঠিক আগেই খুনি সেখান থেকে সটকে পড়ে।
জেফরিকে গুলি করার মোক্ষম সুযোগ পেয়েও তাকে গুলি করল না কেন?
সম্ভবত ফোনে সিদ্দিকীসাহেবের শেষ নির্দেশ মেনে খুনি এ কাজ করেনি।
পুরো ঘটনায় জেফরির একটাই প্রাপ্তিরেবা!
তার কাছে ফিরে এসেছে মেয়েটি। বাবা-মা’র মুখের দিকে তাকিয়ে সব মেনে নিয়ে প্রবাসী এক পাত্রকে বিয়ে করার জন্যে রাজি হয়েছিল সে। কাবিন করে ছেলে চলে যাবে কানাডায় তারপর কয়েক মাস পর ফিরে এসে বিয়ের অনুষ্ঠান করে রেবাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। কিন্তু কাবিনের দিন যতোই ঘনিয়ে আসতে লাগে রেবার মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ততোই বাড়তে থাকে। শেষ পর্যন্ত কাবিনের আগের দিন রাতে নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারেনি।
একটা ভয় জেঁকে বসে তার মধ্যে-জেফরিকে হারানোর ভয়। এক অচেনা মানুষের সাথে সারাজীবন কাটানোর ভয়। সাহস করে মুখোমুখি হয় বাবার। স্পষ্ট বলে দেয় তার পক্ষে এ বিয়ে করা সম্ভব নয়। পরিবারের কেউই তাকে বোঝাতে পারেনি। নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকে সে। ভেঙে দেয়া হয় বিয়ে।
এ ঘটনার পর থেকে নিজের পরিবারে অপাংক্তেয় হয়ে পড়ে সে। গুমোট পরিবেশে একটা সপ্তাহ কাটিয়ে দেয়। নিজের বাবা-মা, ভাই-বোন সবাই তার সঙ্গে শীতল আচরণ করতে শুরু করে। দম বন্ধ হয়ে আসে তার। সিদ্ধান্ত নেয়। জেফরির কাছে ফিরে যাবে। বাড়ি থেকে বের হয়ে সোজা চলে আসে তার ফ্ল্যাটে।
জেফরি বেগ এখন জায়েদ রেহমান হত্যাকাণ্ডের পুরো ঘটনাটা জানতে পেরেছে কিন্তু তার করার কিছুই নেই। এই ঘটনাটি সে কোনোভাবেই আইনের চোখে প্রমাণ করতে পারবে না। তবে তার মনে ক্ষীণ আশা সিদ্দিকীসাহেব হয়তো মিসেস রেহমান আর আলম শফিককে নির্দোষ প্রমাণ করার ব্যবস্থা নেবেন।
কিন্তু সাংবাদিক পাভেল আহমেদের খুন এবং সেই ইন্টারভিউটি একেবারেই আড়ালে চলে গেছে। কেউ জানে না লেখক জায়েদ রেহমানের হত্যাকাণ্ডের সাথে পাভেল আহমেদের হত্যার যোগসূত্র রয়েছে। অন্য অনেকের মতো এ ব্যাপারে জেফরির কোনো ধরাণাই নেই।
লেখক জায়েদ রেহমানের যে ইন্টারভিউটি নিয়েছিল পাভেল সেটাতে ছোট্ট একটি ঘটনা ছিল : সদ্য স্ট্রোকে আক্রান্ত লেখক মানসিকভাবে একটু ভারসাম্যহীন ছিল বলে ইন্টারভিউয়ের এক পর্যায়ে অসংলগ্নভাবে বলে ফেলেন, তিনি আশঙ্কা করছেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ি এবং শিল্পপতি সি ই এ সিদ্দিকী তার ক্ষতি করতে পারেন।
সাংবাদিক পাভেল আহমেদ অনেক কষ্টে এই ইন্টারভিউটা নিতে পেরেছিল। মিসেস রেহমান একজন মিডিয়া সেলিব্রিটি হওয়ায় পাভেলের সাথে তার পরিচয় ছিল, ঐ ভদ্রমহিলাই তাকে ইন্টারভিউ নেবার সুযোগ করে দেয়। তবে বিশাল অঙ্কের বিজ্ঞাপন হারানো এবং মানহানি মামলার ভয়ে সি ই এ সিদ্দিকীর মতো বিজনেস টাইকুনের বিরুদ্ধে বলা এ রকম অসংলগ্ন কথা প্রচারের ঝুঁকি নিতে চায়নি কেউ।
বিগত এক সপ্তাহ ধরে রেবা জেফরির সাথেই আছে। খুব শীঘ্রই বিয়ে করার জন্য তাগাদা দিচ্ছে সে তবে জেফরি তাকে বলেছে এভাবে এক ছাদের নিচে থাকতে তার ভালোই লাগছে। রেবা অবশ্য স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে তাকে, যতো এত সম্ভব মিসেস বেগ করার ব্যবস্থা নিতে হবে। রেবার বাবা অবশ্য জেফরির সাথে যোগাযোগ করে তার সাথে দেখা করার জন্য বলেছিল, তবে এখন পর্যন্ত জেফরির সে-রকম কোনো ইচ্ছে নেই।
*
দু-দিন ধরে শৈত্যপ্রবাহ চলছে। গতকাল জগিং করা হয়নি, রেবার সাথে সারাটা সকাল বিছানায় গল্পগুজব করে কাটিয়ে দিয়েছে। তবে আজকে আর সেটা করেনি, প্রবল শৈত্যের মধ্যেও চলে এসেছে। রেবা অবশ্য বলেছিল এই ঠাণ্ডার মধ্যে জগিং না করলেও চলবে কিন্তু জেফরি তার কথা শোনেনি। এক দিন জগিং না করলেই তার শরীর ম্যাজ ম্যাজ করে।
প্রায় বিশ মিনিটের মতো জগিং করার পর একটু ঘেমে উঠল সে। ধানমণ্ডি লেকের পাশ দিয়ে ছোট্ট একটা ওয়াকওয়ে ধরে আস্তে আস্তে দৌড়াচ্ছে। সামনের তিন-চার গজ দুরের দৃশ্য পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পড়েছে বলে জগারের সংখ্যা নেমে এসেছে শূন্যের কোঠায়।
হঠাৎ টের পেল তার পেছনে আরেকজন জগার আছে। জগিংরত অবস্থায়ই ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখল সে, কিন্তু প্রচণ্ড কুয়াশার কারণে লোকটার চেহারা দেখতে পেল না। তার থেকে দশ-পনেরো গজ দূরে হবে, মাথায় হুড দেয়া একটি ট্রাকসুট পরে আছে, শুধু এটুকুই বুঝতে পারল।
কিছু দূর যাওয়ার পর টের পেল পেছনের লোকটি তার খুব কাছে এসে পড়েছে। অজানা এক আশঙ্কায় তার শরীরের সমস্ত পশম দাঁড়িয়ে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে না দেখে দৌড়ানোর গতি আরেকটু বাড়িয়ে দিল সে। পেছন থেকে নিশ্বাসের যে শব্দ শুনতে পাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে লোকটাও গতি বাড়িয়ে তার খুব কাছে চলে এসেছে।
ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে যাবে তার আগেই পেছন থেকে লোকটা তার গতি বাড়িয়ে জেফরিকে অতিক্রম করে চলে গেল সামনের ঘন কুয়াশার দিকে। হাফ ছেড়ে বাঁচলো সে। খামোখাই আশঙ্কা করেছিল।
মুচকি হেসে নতুন উদ্যমে দৌড়াতে শুরু করল জেফরি। প্রায় পঞ্চাশ গজ এগোবার পরই ওয়াকওয়েতে একটা এনভেলপ পড়ে থাকতে দেখে থেমে গেল সে। বুঝতে পারল এনভেলপটি এইমাত্র এখানে ফেলে দিয়ে গেছে কেউ।
বাস্টার্ড!?
চারপাশে তাকিয়ে দেখল কেউ নেই। জেফরির হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। এনভেলপটি তুলে নিয়ে আবারো চারদিকে তাকাল। উপরে সুন্দর করে লেখা : জেফরি বেগ।
এনভেলপ খুলে দেখতে পেল ভেতরে ছোট্ট একটি চিরকুট আর দলা পাকানো একটি ধাতব বস্তু। স্লগ! ব্যবহৃত বুলেট। চিরকুটটা খুলে পড়ল সে :
তোমার বুলেট তোমাকে ফিরিয়ে দিলাম! অযাচিত উপহার আমি গ্ৰহণ করি না।
আমাকে নিয়ে ভয় পাবার কিছু নেই। তুমি তোমার মতো জীবন যাপন করো, আমি আমার মতো। তোমার সাথে দেখা করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। তুমিও সে-রকম কোনো ইচ্ছে পোষণ কোরো না। তোমার বিয়ের অগ্রীম শুভেচছা রইল।
বুলেটটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল জেফরি বেগ, তারপর ছুঁড়ে মারল লেকের ঘোলা পানিতে।
জায়েদ রেহমানের হত্যাকাণ্ডের পুরো ঘটনাটি সে কোনো দিনই প্রমাণ করতে পারবে না। কাউকে বললেও বিশ্বাস করবে না বিশিষ্ট ব্যবসায়ি শিল্পপতি সি ই এ সিদ্দিকী তার ছেলের প্রতি জঘন্য এক অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে জনপ্রিয় এক লেখককে খুন করিয়েছেন।
অবশ্য সে যদি লেখক হোতো এই ঘটনাটি নিয়ে একটা বই লিখতে পারতো।
এই প্রথম জেফরি বেগ লেখকদের ঈর্ষা করল।