৫০
কোথাও পাওয়া গেল না তাকে। শুধু মাথুরের গড় নয় ; ও দিকে দক্ষিণেশ্বর, কামারহাটি, সোদপুর, বেলঘরিয়া—অন্য দিকে টবিন রোড, সিঁথি মোড়, চিড়িয়া মোড়, শ্যামবাজার—কিছুই বাকি রাখলেন না প্রণবেশ আর আনিসুজ্জামান। এমনকী সত্য, যে মোটামুটিভাবে কৌশিককে মনে করতে পারছিল, সেও আপন ইচ্ছায় বরানগরের নানা জায়গা, কাশীপুর, দক্ষিণ সিঁথির গলি-ঘুঁজি ঘুরে ঘুরে দেখাতে লাগল চিন্তিত অধ্যাপককে। কিন্তু পাওয়া গেল না। তপন কয়েকটি জায়গায় যাবার সম্ভাবনার কথা বলেছিল, সেই তাদের কলেজে পড়ার সময়কার কিছু লুকনো আড্ডার জায়গা, সে-সব জায়গাও বাদ পড়েনি। কিন্তু নেই।
আবারও পুলিশের সাহায্য নেবার কথা তাঁদের মনে পড়ল এবং আবারও সেই মনে হওয়াকে তাঁরা প্রত্যাখ্যান করলেন এই ভেবে যে, কৌশিক এতদিন কোথায় ছিল তার স্পষ্ট ধারণা না থাকায় পুলিশের হস্তক্ষেপ তার পক্ষে অশুভ হয়ে উঠতে পারে। সব কিছু ভেবে বরং হাল ছেড়ে দিলেন তাঁরা। আনিসুজ্জামানের মধ্যে এ আশঙ্কা সর্বক্ষণ ছিল যে সে দরজা খুলে চলে যেতেও পারে কারণ এ তো ঠিক যে সে সংলগ্ন আচরণ করছিল না। তাঁরা, অতএব খুবই দুঃখের সঙ্গে যে-যার কাজের দিকে মুখ ফেরালেন এই ভেবে যে, কৌশিক হয়তো-বা নিজেকে একবার মনে করিয়ে দেবার জন্যই যে সে মরেনি, এখানে এসেছিল। চলেও গেছে। বহু বিষণ্ণতার মধ্যেও তাঁরা নিজের নিজের কাজের পরিকল্পনায় মন দিলেন, মন দিতে সক্ষম হলেন, কেন-না, দু’জনেরই প্রিয়জন হারানোর অভিজ্ঞতা আছে এবং হারাবার পর শ্বাস নিরুদ্ধ করে দেওয়া গভীর জলের তলা থেকে একটুখানি বাতাসের জন্য মরিয়া হয়ে ভেসে ওঠার প্রক্রিয়াও তাঁরা অর্জন করতে পেরেছেন। যে হারিয়ে যেতে চায় তাকে খোঁজার মধ্যে অর্থহীনতা থাকে। আগলে রাখা তাকেই সম্ভব যে আগল স্বীকার করে নেয়। যে মানতে শেখেনি তার ওপর জোর করা যায়, কিন্তু মানিয়ে তোলা যায় না।
কিন্তু নীলোফা ক্রমশ ডুবে যাচ্ছে এখন। ডুবে যাওয়া ছাড়া অন্য কিছু করা তার পক্ষে সম্ভব কি না তাও সে ভাবতে শেখেনি। সে, যেহেতু পীরবাবার দাক্ষিণ্য বুকে সাপটে নিয়েছে এবং সে-কথা মরে গেলেও মুখ ফুটে উচ্চারণ করতে পারবে না, এমনই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে—অতএব তার গভীর আনন্দের পর গভীরতর দুঃখ বোরখার আড়ালে ঢাকা পড়ে আছে যা দেখার জন্য আর কেউ এই গৃহে রয়ে গেল না। এমনকী বলেও গেল না, সে, তার এই ঈশ্বরপ্রতিম দৃষ্টি নিয়ে চলে যাচ্ছে কোথায়, কেন যাচ্ছে, বা আবার ফিরে আসবে কি না। সে অতএব এই দুঃখ ও করুণ একাকিত্ব একা একা আগলাচ্ছে, সামলাচ্ছে, বহন করছে এবং যেহেতু কথা সে খুব বেশি বলে না, বলছে না, সুতরাং সেই নীরবতাও কারও মধ্যে কোনও অস্বাভাবিকতার অনুভব জাগাচ্ছে না।
প্রথমে কৌশিকের এই নীরব পরিত্যাগ, যা কি-না গৌতম বুদ্ধের ত্যাগের মতোই নিষ্ঠুর, অনিবার্য ও প্রশংসনীয়—নীলোফা বিশ্বাস করেনি। সে-দিন থেকে প্রায় সাতদিন, দশদিন সে প্রতীক্ষা করেছে। এমনকী গভীর প্রতীক্ষায় তার হৃদযন্ত্র অতি দ্রুত ক্রিয়াশীল থেকেছে সর্বক্ষণ। ডোরবেল বাজলেই সে ছুটে গেছে এই ভেবে যে যদি কৌশিক ফিরে আসে এবং সে আশাহত হয়েছে। তবু এই ভেবে সে প্রাণ বেঁধেছে যে কৌশিক ফিরবে, ফিরবেই, কেন-না সে-ই একমাত্র যে নীলোফার সমূহ কষ্ট অনুভব করেছে এবং শুষে নিয়েছে দুঃখ-যন্ত্রণা সমেত চোখবাহিত জলবিন্দু। আর চিত্ত অসংযত হয়েছে, উত্তাল হয়েছে এবং বেপরোয়া কান্নায় ভেসে যেতে যেতে তার মনে হয়েছে এরই নাম বুঝি প্রেম এবং এই ভেবে দহন জেগেছে যে এর নাম হয়তো প্রেম নয়। আত্মকরুণা ছাড়া এ কিছু নয়। কারণ সেইদিন, সেই মিলন ও বিরহ রচনার, কে জানে, হয়তো বিচ্ছেদ রচনারও দিনে আনিসুজ্জামানকে দেখামাত্র তার নাভি থেকে ছিছিক্কার সমেত একটি শিখা জ্বলতে জ্বলতে হৃদয়ে এসেছিল এবং সে ভেবেছিল—হায় খোদা! এ কী করলাম! আমি এ কী করলাম! সে, জামাল কৌশিকের রেখে যাওয়া পোশাক গুছিয়েছে বারবার, তার দাড়ি কাটবার সরঞ্জাম ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখেছে, তার ব্রাশে আঙুল রেখে অনুভব করতে চেয়েছে কোনও সকালবেলার ঘ্রাণ। এবং, এই প্রত্যেকটি ক্রিয়ার কালে আনিসুজ্জামানের সঙ্গে যেন বিচ্ছেদ হয়েছে তার, এমনই বেদনা সে বোধ করেছে।
ফলে ক’দিন সে এতটুকু সেতার বাজায়নি। আর আনিসুজ্জামান তা লক্ষ করেছেন এবং এক সন্ধ্যায় খুবই তাপিত কণ্ঠে বলেছেন—‘একটু বাজা নীলু। বাজা। তোর বাজনা শুনলে ভেতরটা ঠাণ্ডা হয়ে যায়।’
সে তেমন বাজিয়ে নয়, তেমন শিল্পী নয়, তবু শিল্পী মাত্রেরই সেই প্রতীক্ষা থাকে যে অন্য কোনও হৃদয়কে জাগিয়ে তুলবে এবং দেবে শান্তি বা প্রজ্জ্বলন। অতএব সে সেতার নামিয়েছিল এবং হয়তো-বা নিজেকেই ঠাণ্ডা করার জন্য আঙুল চালিয়েছিল। কিন্তু তার চোখে জল এসেছিল এই ভেবে যে এমনই যত্নে কেউ তার শরীরে আঙুল রেখেছিল, তখন বুঝি সে নিজেই সেতার একজন, আর সেতার ও সেতারি দু’জনেই স্বর্গের সুখ বা বেহেস্তের আনন্দের চেয়েও উপচানো, অতিরিক্ত সুখে সুরের মতো পাক খেয়ে খেয়ে মিলিয়ে যাচ্ছিল হাওয়ায়—এমনটি আর সম্ভব হবে না।
অতএব নীলোফা, কখন কার জন্য তাপিত হল, দুঃখিত হল, তা তার নিজের কাছেও স্পষ্ট থাকল না। কিন্তু বাইরে থেকে বোরখা ঢাকা দেওয়া নীলোফা যেমন ছিল তেমনই রয়ে গেল মোটামুটি এবং আনিসুজ্জামান তাঁর পরবর্তী প্রবন্ধের দিকে যাবার জন্য কেন্দ্রীয় পাঠাগারে যাওয়া-আসা শুরু করলেন। সেই সঙ্গে তাঁর কলেজের ছুটি ফুরিয়ে এল।
প্রথম দিন, কলেজ খোলার পর, অধ্যাপক অজিতভূষণ বললেন—হ্যাঁ, বইখানা পড়লাম। বেশ খেটে করেছ। তবে দুর্গার প্রতি গভীর অনুভব ও শ্রদ্ধা তোমার লেখায় নেই। অবশ্য না থাকাটাই স্বাভাবিক।
আনিসুজ্জামান চমকিত হলেন। লজ্জিত বোধ করলেন। হিন্দুদের কাছে বিশেষত বাঙালির কাছে, দেবী দুর্গার মাহাত্ম্য কতখানি তিনি অনবহিত নন। এ লেখা তৈরি করার সময় গবেষকের দৃষ্টি ছিল কিন্তু কোথাও অশ্রদ্ধা ছিল না। তিনি খুবই বিনয়ের সঙ্গে প্রশ্ন করলেন—শ্রদ্ধার অভাব কোথায় আছে বলে আপনার মনে হয়েছে যদি বলেন তবে আমি নিশ্চয়ই শুধরে নেব।
অজিতভূষণ এড়িয়ে যান কিন্তু জুলজির অধ্যাপক মৃগেন সেন বলেন—আপনি তো দু’হেতে দুগ্গার কথাও লিখেছেন। সে কোথায় পেলেন শুনি? দুগ্গার যে পৌরাণিক বর্ণনা তাতেই তো দশ হাতের কথা আছে। ওই যে, মহালয়ায় বলে না অমুকে অমুক অস্ত্র দিলেন!
অজিতভূষণের ঐতিহাসিক জ্ঞান টনটন করে। তিনি বলেন—না না মৃগেন, দ্বিভুজা দুর্গার পূজা হত এককালে। এখনও কোনও কোনও পারিবারিক পূজায় এ রীতি প্রচলিত আছে।
বাংলার অধ্যাপক শক্তি আচার্য গম্ভীর মতামত দেন। বলেন—তবে দুগ্গার দশ হাতই থাক আর দু’হাত—হিন্দু দেবদেবীর প্রতি একজন হিন্দুর যে শ্রদ্ধা থাকবে একজন মুসলমানের তা থাকতেই পারে না। মুসলমানরা মূর্তিপূজা মানে না।
বয়সে তরুণ ফিজিক্সের অধ্যাপক সঞ্জয় বসু বছরখানেক হল কলেজে যোগ দিয়েছেন। হয়তো আর বেশিদিন থাকবেন না। চলে যাবেন আমেরিকায়। বললেন—শক্তিদা, বইটা আপনি পড়েছেন?
শক্তি আচার্য মাথা নাড়েন—না। পড়িনি ভাই। তবে অজিতবাবু তো পড়েছেন। তাই বলছি।
সঞ্জয় তাঁকে প্রায় থামিয়ে দিয়ে বলেন—আপনি পড়েননি, এই তো? কিন্তু আমি পড়েছি। খুবই নিরপেক্ষ ও বিশ্লেষণধর্মী লেখা। লেখা পড়ে একটুও মনে হয় না শ্রদ্ধার অভাব আছে বা কোনও মুসলমানের লেখা বলে অন্য দৃষ্টিভঙ্গি পাওয়া যাচ্ছে। উনি যদি কোনও হিন্দুর ছদ্মনামে লিখতেন তবে আপনারা ধরতে পারতেন? তা ছাড়া আমরা সবাই জানি, আনিসুজ্জাদার একেবারেই ধর্মের গোঁড়ামি নেই।
শক্তি আচার্য চড়া গলায় বলেন—শোন হে, ধর্ম মানা না-মানায় কিছু এসে যায় না। এ এমন জিনিস যে আমরা জন্মাবধি সঙ্গে করে বেড়াই। কম দেখলাম এ পর্যন্ত! যতবার হিন্দু-মুসলমানে দাঙ্গা হয়েছে ততবার ক্ষিপ্ত উন্মত্ত মানুষগুলো পরস্পর কাটাকাটি করেছে এই বলে যে, এ হিন্দু কাট্—ও মুসলমান কাট্। তুমি কি বলতে চাও এরা গভীরভাবে ধর্ম পালন করত? মোটেই না। কাটাকাটি করার আগে হয়তো মনেও ছিল না সে নিজে হিন্দু না মুসলমান।
সঞ্জয় বসু স্বাভাবিক কিন্তু দৃঢ় গলায় বলেন—এই তো আপনি পরস্পরবিরোধী কথা বলছেন, যারা দাঙ্গায় অংশ নেয় তারা স্বাভাবিক অবস্থায় মনেই রাখে না তারা হিন্দু না মুসলমান। দাঙ্গা লাগলে হঠাৎ এই বোধ মাথা-চাড়া দেয়। এটা ধর্মের প্রতি আনুগত্য নয়। এটা গণহিস্টিরিয়া। একধরনের সার্বিক পাগলামি বা মানসিক মড়কও বলতে পারেন। তার সঙ্গে একটা গবেষণামূলক কাজের তুলনা করাটা অন্যায়। আমি বলব নীচতাই একরকম, কারণ গবেষণাধর্মী কাজ সামগ্রিক সচেতনতা ছাড়া সম্ভব হয় না।
শক্তি আচার্য টেবিলে ঘুঁষি মারেন। রাগে বা তরুণ অধ্যাপকের স্পর্ধায় তার বাক্য সরে না। বলেন—তো-তো-তোমার সা-সা সাহস তো কম নয়! আমাকে তুমি অ-অ-অপমান করছ!
অজিতভূষণ উত্তেজনা প্রশমনের চেষ্টা করেন। আর মুখ প্রায় টেবিলের প্রান্ত পর্যন্ত নিচু করে বসে থাকেন আনিসুজ্জামান। তিনি একটি কাজ করেছেন। কাজ হিসেবেই করেছেন। সারা জীবনে যে-কাজ তিনি করবেন বলে ভেবেছেন—এ তার অংশমাত্র। কিন্তু এ কী প্রতিক্রিয়া! তাঁর পাঞ্জাবি ঘামে ভিজে গায়ের সঙ্গে লেপ্টে যায়। তিনি দু’হাতে চুল খামচে ধরেন। তাঁর ধারণা হয় যে এঁদের কারও হয়তো মনে নেই আলোচ্য মানুষটি এখানেই বসে আছেন। মনে মনে নিজেকে ঘাঁটতে থাকেন তিনি। মনের অন্ধি-সন্ধি হাতড়ে বেড়ান। বুঝতে চেষ্টা করেন, কাজগুলি করার সময় তাঁর মধ্যে কোনও ধর্মসচেতনতা ছিল কি না! না। ছিল না। এমনই উত্তর অন্তরে রচিত হয়। দেব-দেবী বা প্রাচীন ধর্ম সম্পর্কে গবেষণামূলক রচনাগুলি মানুষের ইতিহাসই প্রকাশ করে— এই তাঁর বিশ্বাস। এবং একজন মানুষ হিসেবেই এ কাজ তিনি করেছেন। কিন্তু এতখানি আত্মবিশ্বাস ও সচেতনতা সত্ত্বেও সহকর্মীদের আচরণ তাঁকে যন্ত্রণা দিতে থাকে। সঙ্গে মিশে থাকে অপমান। তখন, ঘরে ঢোকেন সহ-অধ্যক্ষ, ইংরাজির অধ্যাপক দীপঙ্কর মুখোপাধ্যায়। গোলমাল থেমে যায়। দীপঙ্কর গভীর গলায় ডাকেন—আনিসুজ্জামান— ভাই—
আনিসুজ্জামান উঠে দাঁড়ান। দেখতে পান প্রবীণ অধ্যাপক অপূর্ব স্নেহময় দু’টি চোখ মেলে দু’হাত বাড়িয়ে বলছেন—উঠে এসো, ভাই, কী কাজ করেছ! একেবারে সম্পূর্ণ। একেবারে সমগ্র।
আনিসুজ্জামান এগিয়ে আসেন। অধ্যাপক দীপঙ্কর তাঁকে বুকে টেনে নেন। প্রবীণ অধ্যাপকের দীর্ঘ, মেদবহুল, ধবধবে ধুতি ও শার্ট পরা শরীরের ভাপে তাঁর এতক্ষণের খারাপ লাগাগুলি পুড়ে যায়। তিনি দীপঙ্করের পা স্পর্শ করেন। দীপঙ্কর বলেন—তুমি যদি আমার ছাত্র হতে ভাই, ভারী গর্ব হত। এই যে এখন আমি মাঝে মাঝে আর্থ্রাইটিসে মেঝেতে পা রাখতে পারি না, তার বদলে তখন আমি গর্বে পা মাটিতে ফেলতুমই না। কাজ করো। কাজ করে যাও। আমার শুভেচ্ছা রইল। অনেকে অনেক কথা বলবে। কান দিয়ো না। যে কাজের সংকল্প নিয়েছ, তা শেষ করো।
আনিসুজ্জামানের চোখে জল এসে যায়।
বাড়ি ফেরার পথে আবার বিষণ্ণ বোধ করেন আনিসুজ্জামান। কিন্তু অনুপ্রাণিতও বোধ করেন। ভাবতে অবাক লাগে যে কী করে এক ঝটকায় চেনা মুখগুলি অচেনা হয়ে যায়! শক্তি আচার্য, মৃগেন সেন বা অজিতভূষণ—কেউই আগে এ ভাবে কথা বলেননি। আনিসুজ্জামান প্রত্যেককেই ভাবতেন ধর্মনিরপেক্ষ বা ধর্ম সম্পর্কে উদাসীন। আবার সঞ্জয়—সেও সম্পূর্ণ নতুন মাত্রায় নিজস্ব ব্যক্তিত্ব উন্মোচন করেছে আজ। সঞ্জয় কখনও আনিসুজ্জামানের অন্তরঙ্গ হননি। বইটিও তিনি নিজেই চেয়ে নিয়েছিলেন। আজ তাঁরই ছিল সবচেয়ে কাছের বন্ধুর ভূমিকা। আনিসুজ্জামান জানেন, উপলব্ধিও করেছেন এতকাল যে জীবন এইরকমই—ভালয়-মন্দয়। ঔদার্যে-অনৌদার্যে। তবু সম্পূর্ণ কষ্ট তাড়াতে পারেন না মন থেকে। কৌশিককে পেয়েও হারিয়ে ফেলার এবং তার জন্য কিছুই করতে না পারার গভীর বেদনা আজকের কষ্টে মিলে গিয়ে হতাশার জন্ম দেয়। এই ভার আনিসুজ্জামানের পক্ষে দুর্বিষহ বোধ হয়। বাড়ি ফিরে এসে নীলোফার কাছে উগরে দেন সব।
নীলোফা সব শুনে বলে—আপনি ভুলে যাচ্ছেন কেন ভাইজান, আপনার মতো মানুষ যেমন আছেন তেমনই আমার আব্বাজানের মতো মানুষেরও অভাব নেই। বলতে গেলে সংখ্যায় তাঁরাই বেশি।
আনিসুজ্জামানের চমক লাগে। তিনি কৃতজ্ঞতার চোখে নীলোফার দিকে তাকান। তাঁর বুক টন টন করে কারণ এই কথা এই উচ্চারণ যে-মুখে—সেখানে মায়াময় মাতৃত্ব জাগে। সে-মুখ দেখতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু উপায় নেই। কোনও উপায় নেই। নীলোফা যা বলেছে তিনি নিজেও সে-কথা কতদিন ভেবেছেন! তবে আজ কেন মনে পড়ল না! আর নীলোফা তা কত অনায়াসে বলে দিল! যেমন বন্ধু বলে বন্ধুকে। যেমন মা বলে ছেলেকে। যেমন স্বামী বলে স্ত্রীকে বা স্ত্রীও স্বামীকে। সম্পর্ক যাই থাক, মানুষ মানুষের আশ্রয় হয়ে উঠছে তখন। বাসে, ট্রামে, ট্রেনে বোঝাই তাপিত, ক্লিষ্ট, যন্ত্রণায় বিদীর্ণ মানুষ গৃহে ফিরে আসছে শান্তির আশায়। ভাবছে, সমস্ত অপমান, দাহ ও যন্ত্রণা উপশম করে দেবে কেউ। তেমনই আনিসুজ্জামান, তেমনই নীলোফা। বেদনার্ত আনিসুজ্জামানের জন্য পরিপূর্ণ আশ্রয় হয় নীলোফা। তার নিজের কষ্ট কই? নেই! তার নিজের যন্ত্রণা কই? নেই! সে সমস্ত লুকিয়ে রাখছে আর সে চায় আনিসুজ্জামানের জন্য শান্তি এনে দিতে।
আনিসুজ্জামানের সব ভার নেমে আসতে থাকে। তিনি শিশুর সারল্যে হাসেন। নীলোফারও বুকের তলায় মোচড় লাগে। শ্বেতীচিত্রিত ওই অসুন্দর মুখের হাসিও অপার্থিব লাগে তার। সে প্রশ্ন করে—খিদে পায়নি বুঝি ভাইজান? খাবেন না?
আনিসুজ্জামান পরম নির্ভরতায় বলেন—হ্যাঁ, খাব। কী বানিয়েছিস রে নীলোফা?
—ময়দা মেখে রেখেছি। পরোটা আর ভাজি করে দিই?
—দে। একটু বেশি করে বানাবি নীলু? মান্তুদাকে ডাকি?
নীলোফা মাথা নেড়ে রান্নাঘরে যায়। আনিসুজ্জামান তৃণাঙ্কুরের খোঁজে যান।
তৃণাঙ্কুর আজ কলেজ যাননি। ইদানীং তাঁকে বেশ সুস্থ লাগে। যদিও কলেজ যাবার দিনসংখ্যা তিনি বাড়াননি। কিন্তু নিজে নিজে হাঁটা-চলার প্রবণতা বেড়েছে। নির্ভরশীলতা ছাপিয়ে আজকাল মাঝে-মধ্যে বাজারে যেতেও দেখা যায় তাঁকে। কথায় কথায় উজ্জ্বল হাসি ও কৌতুকের ঢল এসেছে তাঁর স্বভাবে। আনিসুজ্জামান টের পান, বিষণ্ণতা উধাও করা এই হাওয়াটির নাম সম্ভবত রাধিকা। আর রাধিকাকে নিয়ে নীলিমা ও তৃণাঙ্কুরের মধ্যবর্তী দ্বন্দ্ব ও অশান্তির আঁচ আনিসুজ্জামানের কাছে গোপন নেই। নীলিমাকে বোঝেন আনিসুজ্জামান। যতই উদার হোন, ঝি-কে ঝি বলে না দেখে শুধু মানুষ বলে দেখার মতো ঔদার্যে তিনি পৌঁছতে পারেননি। এতে তাঁকে দোষ দেওয়া যায় না। এক জীবনে নীলিমা যত সংস্কার পেরিয়ে এসেছেন—সে অনেক। সব মানুষই কিছু-না-কিছু সংস্কার দ্বারা প্রভাবিত হয়। কিন্তু তৃণাঙ্কুর ও রাধিকার সম্পর্ক নিয়ে আনিসুজ্জামানের কোনও আপত্তি বা অভিযোগও নেই। শ্রেণীগত দিক থেকে ঝি বা বস্তিবাসী হলেও মেয়েটি ভদ্র ও পরিচ্ছন্ন। তার চেয়েও বড় কথা হল কেউ কারও দ্বারা মানসিক শূন্যতা অতিক্রম করে গেলে অন্য কারও আপত্তি করার কোনও অধিকার নেই। এ বিষয়ে আনিসুজ্জামান খুবই নিরপেক্ষতা গ্রহণ করেছেন।
আনিসুজ্জামান ঢুকতেই তৃণাঙ্কুর হাতের মোটা বইটি নামিয়ে রাখলেন। বললেন—কী? বইয়ের প্রতিক্রিয়া কেমন?
আনিসুজ্জামান অবাক গলায় বললেন—প্রতিক্রিয়া! আপনি কী করে জানলেন!
তাঁদের মধ্যে বই সম্পর্কে কথাবার্তাগুলি চলতে থাকে। তৃণাঙ্কুর চুপ করে থাকেন কিছুক্ষণ। এ রকম কিছু হবে অনুমান করেছিলেন তিনি। কারণ ধর্মনিরপেক্ষতার পাতলা আবরণ সরিয়ে ফেললে যে-মুখ সহজে বেরিয়ে আসে তার সন্ধান পেয়েছেন তিনি ইতিপূর্বে। তাঁর কলেজের অধ্যাপক রজতকান্তি যখন একটি মুসলমান ছাত্রীকে বিয়ে করেন তখন গোটা কলেজের চেয়ার-টেবিল পর্যন্ত নড়ে গিয়েছিল। দীর্ঘদিন রজতকান্তি প্রাণ সংশয়ে ছিলেন কারণ তাঁর স্ত্রীর ভাইয়েরা তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। সেইসঙ্গে রজতকান্তি অন্যান্য অধ্যাপকদের দ্বারা পরিত্যক্ত ছিলেন অনেকদিন। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। কিন্তু আজও রজতকান্তি সম্পর্কে কোনও প্রসঙ্গ উঠলে তাঁর মুসলমান স্ত্রীর কথাও অনিবার্য এসে পড়ে।
তৃণাঙ্কুরের সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে নীলোফার পরোটাসংবাদ পেশ করেছিলেন আনিসুজ্জামান। রাধিকা ঘুরে ঘুরে এ কাজ ও কাজ করছিল। তার বাড়ি যাবার সময় পেরিয়ে গেছে। এখন আর সময় মানে না সে। যতক্ষণ পারে থাকে। নীলিমা গজ গজ করেন—বাচ্চাটার প্রতি একটু টান পর্যন্ত নেই। অন্যদের দেখো, বাড়ি যাবার জন্য কীরকম ছটফট করে! আর এ? কে বলবে দুধের বাচ্চা ফেলে এসেছে!
আনিসুজ্জামানের কথা শুনে রাধিকা বলল—আমি ডিম-পাঁউরুটি করুম ভাবসিলাম।
নীলিমা রামকৃষ্ণ কথামৃত হাতে নিয়ে বসেছিলেন। বই থেকে চোখ না তুলেই বললেন— তোমাকে আর ভাবতে হবে না। বাড়ি যাবার তো তাড়া নেই। তার চেয়ে যাও, নীলোফাকে একটু সাহায্য করো।
রাধিকা মাথা নিচু করে চলে যায়। তৃণাঙ্কুর ও আনিসুজ্জামান পা বাড়ান। নীলিমা বলেন— আমাকে বাদ দিয়ো না।
আনিসুজ্জামান হাসেন। বলেন—কখনও না।
আনিসুজ্জামানের ঘরে এসে তৃণাঙ্কুর ডিভানে পা ছড়িয়ে আরাম করে বসেন। নীলোফাকে ডেকে বলেন—নীলু। শোনা পরোটা পরে বানাবি। আগে বল। পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম গল্প কী?
নীলোফা হেসে বাজে। বলে—জানি না মান্তুদা। আপনি বলুন।
তৃণাঙ্কুর বলেন—ভাল করে শোন। মন দিয়ে। বলব আর ফুরিয়ে যাবে কিন্তু। আর কোনও প্রশ্ন করা চলবে না। শুরু করছি—
দুইটি শিকারী। একটি বাঘ।
একটি শিকারী। একটি বাঘ।
একটি বাঘ।
আনিসুজ্জামান গলা ছেড়ে হেসে ওঠেন। নীলোফা অনুধাবন করতে একটু বেশি সময় নেয়। তারপর সেও হাসে। আর হাসতে হাসতে আনিসুজ্জামানকে দেখে। এ ভাবে হাসিতে ফেটে পড়তে সে ভাইজানকে এই প্রথম দেখল!
রাধিকা পরোটা বেলছে। নীলোফা ভাজছে। রান্নাঘরে জায়গা নেই। রাধিকা বেলন-চাকি, তেলের বাটি, ময়দার তাল ও থালা নিয়ে ছড়িয়ে বসেছে বসার ঘরের মেঝেয়। মাঝে মাঝে ময়দাটি ঠেসে নিচ্ছে খানিক। কাজ করতে করতে অন্যমনস্ক নিরুপায়তায় সে শুনছে তৃণাঙ্কুর ও আনিসুজ্জামানের কথোপকথন। তৃণাঙ্কুর বলছেন—তোমার জন্য খবর আছে।
—কী খবর?
—তোমার গবেষণার কাজে আগ্রহী একজন শিগগির আসছে ঢাকা থেকে। আমি তাকে চিনি না। তবে শুনেছি খুবই উজ্জ্বল ও মেধাবী। তার প্রাথমিক উদ্দেশ্য অবশ্য কলকাতা দেখা এবং তোমার সঙ্গে পরিচিত হওয়া। তোমার সঙ্গে কথা বলে সে তার পরবর্তী পরিকল্পনা ঠিক করবে।
আনিসুজ্জামান উৎসাহিত হন। আগ্রহের সঙ্গে বলেন—কবে আসছেন? কী নাম?
—সম্ভবত সাতাশে আসবে। তোমার এখানেই থাকবে প্রথম কয়েকদিন। তারপর শান্তিনিকেতন চলে যাবে। ছেলেটির বৃত্তান্ত অদ্ভুত, জানো।
—কীরকম?
—ওর বাবা নিরক্ষর। কিন্তু সম্পন্ন চাষী। ওদের পরিবারে ও-ই প্রথম অক্ষর চিনতে শিখেছে।
—বাঃ! চমৎকার! নাম কী ছেলেটির?
—শমসের। শমসের চৌধুরী। বা পুরো নাম বোধহয় শমসের রহমান চৌধুরী।
রাধিকার দম বন্ধ হয়ে আসছে। পরোটায় চাপ দিচ্ছে সে। খুব চাপ দিচ্ছে। চাকিতে-বেলনে মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে ময়দার তাল। সে ভাবছে—ঢাকা থেকে আসবে! শমসের! শমসের চৌধুরী, শমসের রহমান চৌধুরী, নিরক্ষর সম্পন্ন চাষীর ছেলে! এ কোন শমসের? সে নয় তো? হে ভগবান! পৃথিবীতে কত শমসের আছে? কত? রাধিকার মাথা টলমল করে। সারা শরীর অবিরল ঘামে ভিজে যায়। দাঁতে দাঁত চেপে প্রকাশ অবরুদ্ধ রাখে সে।
৫১
এই মাথুরের গড়। এই ভূখণ্ডের উত্তরে রেললাইন ও তার ধারে ফটিক বিল। ফটিক বিলের ধারে যে জনবসতি, দরিদ্রের বাসভূমি বলে তা বস্তি নাম পায়। লোকে বলে ফটিক বিল বস্তি। এই ভূখণ্ডের পশ্চিমে গঙ্গা ও দক্ষিণেশ্বর। উত্তর-দক্ষিণে সদাব্যস্ত বি টি রোড এবং বি টি রোড থেকে একটি শাখার মতো রাস্তা বেরিয়ে এসেছে পি ডব্লু ডি রোড, যা দক্ষিণেশ্বরের অভিমুখে গেছে। অর্থাৎ ফটিক বিলের অবস্থান বলা যায় উত্তর-পশ্চিমের কোণে এবং মাথুরের গড়ের সূর্য সেখানে প্রথম আলো কখনওই ফেলেন না। প্রথমে তিনি লাফিয়ে নামেন অরুণ সেনের ছাদে এবং ছাদের আলসেয় জোড় আসন করে বসে দরিদ্র জনগণকে আলো বিতরণ করেন। এ নিয়ে কখনও কোনও প্রশ্ন ওঠেনি কারণ এমনটাই হয়ে আসছে চিরকাল। আর, যা চিরকাল ধরে হয়ে আসে তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা খুবই অস্বাভাবিক ঠেকে। এতটাই অস্বাভাবিক যে যুগে যুগে যে-ইতিহাস রচিত হয়েছে তাতে দেখা গেছে যে এই মহাজগৎ সম্পর্কিত প্রত্যেক মূল প্রশ্ন ও যথাযথ উত্তরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে হত্যা ও রক্তের কাহিনী। কোনও কালেই তার ব্যতিক্রম হয়নি। এমনকী এ কালেও মানুষের অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল কেউ কেউ এবং অবাধ হত্যালীলা সম্পাদিত হয়েছিল। এখন, সে-প্রসঙ্গ চাপা আছে বটে, তবে কখন কার মুখ দিয়ে উচ্চারিত হবে আবার আর নতুন নতুন অস্ত্রের নীচে বুক-পেট ফুটো হয়ে গড়াতে গড়াতে বয়ে যাবে মানুষের লাল গরম রক্ত তা কেউ বলতে পারে না।
যেমন এই মাথুরের গড়। এখানে কোনও বর্ষায় কখনও জল জমেনি। কিন্তু কোন বর্ষায় হঠাৎ এই মাথুরের গড়ও ভাসতে শুরু করবে তা কে বলতে পারে! গঙ্গায় বান এলে সে বানের জল পি ডব্লু ডি রোড ধরে তেঁতুলতলা পর্যন্ত আছড়ে পড়ে আর হামলে ঝাঁপায় ফটিক বিলে। বিলের জলের অশুদ্ধি সংশোধন হয়। কিন্তু ওই বিল পর্যন্তই। মাথুরের গড়ের অভিজাত পাড়ার টিকি ছুঁতে পারেনি গঙ্গাজল।
অন্য দিক থেকে দেখতে গেলে কলকাতা মহানগরী ও তার উপকণ্ঠগুলির মানচিত্র স্মরণ করতে হয়। নোয়াই, বিদ্যাধরী ও বাগজোলা খাল কুলটি নদী পর্যন্ত সবই পরস্পর সংযুক্ত। নোয়াই খালের বহমানতা এই এলাকা থেকে খুব দূরে নয়। বাগজোলা উপচালেও এ জায়গার রক্ষে নেই। বিদ্যাধরী নদী ছিল এক সময়। স্কুলের ভূগোল বইতে এখনও সে নদী হয়ে বেঁচে আছে বটে তবে বাস্তবে তার অস্তিত্ব নদীমাতৃসুলভ নেই। সে এখন মজে যাওয়া, হেজে যাওয়া, জঞ্জাল ও কচুরিপানা ভর্তি খাল, যার জলধারণ ক্ষমতা শূন্যে ঠেকেছে। নোয়াই খালের অবস্থাও তাই। প্রায় বারো বছর আগে একবার নোয়াই খাল সংস্কারের প্রস্তাবনা হয়েছিল কিন্তু তাতে খালের মজন ঠেকানো যায়নি। ফলত প্রতি বছর বর্ষায় যা হয় তাতে এ ভাবে সংবাদপত্রগুলি জানায় যে—
টালা থেকে বিরাটি পর্যন্ত উত্তর কলকাতা ও শহরতলির জলনিকাশী ব্যবস্থা গুরুতর সঙ্কটে। আষাঢ়ের ঘন বর্ষায়, এমনকী ভারী বর্ষণের আগে, স্বল্প বৃষ্টিপাতেও জল জমে যাচ্ছে সিঁথি-কাশীপুর-বরানগর-নিমতা-কামারহাটি-বিরাটি প্রভৃতি অঞ্চলে।
এরকমই হয়। প্রতি বছর। প্রতি বর্ষায়। বৃষ্টির জল জমে। খালের জল, নদীর জল উপচে এসে বিল ভরিয়ে দেয়। বিলের জল উপুর-চুপুর হয়ে আছড়ে পড়ে ঘর-উঠোনে। প্রথমে তাই ফটিক বিল বস্তির ঘরদুয়ারে পায়ের পাতা ডোবে। তারপর, দিন গেলে, জল পায়ের গোছ ছাড়ায়। চৌকাঠ গলে ঘরে ঢুকে পড়ে। বস্তিবাড়ির মাটির মেঝে গলে কাদা। ক’দিন বড় কষ্টে যায়। কিন্তু তাতে বস্তির কোনও কাজ আটকায় না। বাচ্চার জন্ম পর্যন্ত হয়। কাজের মানুষেরা হাঁটু অবধি কাপড় তুলে জল ভেঙে কাজে বেরোয়। ক’দিনেই পায়ে হাজা ধরে। পা কুটকুট করে। গিন্নিদের কাছ থেকে তখন তারা একটু একটু হাজার মলম চেয়ে নেয়। খানিকটা মাখে। খানিকটা কাগজে লাগিয়ে বা পান-দোক্তার কৌটোয় পুরে ঘরে নিয়ে যায় বরের পায়ে লাগিয়ে দেবে বলে। এমনই হয়ে আসছে চিরকাল আর চিরকালের মতো একেবারে শুকনো ডাঙা হয়ে জেগে থাকছে মাথুরের গড়। কোনওকালে, কোনওদিন এখানে জল দাঁড়ায়নি। কে জানে, যদি সত্যিই কোনওকালে এ জমি রানি রাসমণির জামাই মথুরবাবুর হয়ে থাকে তবে তা হয়তো এ জন্যই যে, এ ডাঙায় জল জমে না। ভরা বর্ষায়ও মাথা তুলে জেগে থাকে দিনের পর দিন— পলাতক ছেলের জন্য মায়ের জেগে থাকার মতো। যদিও সে-ইতিহাস কোথাও লেখা নেই, শুধু নামটুকু আছে।
বসন্তের শেষ থেকে গ্রীষ্মের শুরু এবং এই বর্ষার মধ্যবর্তী ভরন্ত সময় যখন কলকাতা মহানগরী ও উপনগরীগুলি সব কাজ বজায় রাখতে চায় এবং জলমগ্ন ভূমিখণ্ডে জলকাদা মাড়িয়ে, টপকে কাজ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়, সেই সময়, অর্থাৎ প্রায় তিন মাসকাল ঋতু বন্ধ আছে নীলোফার। প্রথম মাসে সে ভেবেছিল এই বন্ধ হওয়া স্বাভাবিক ছন্দপতন কারণ মাঝে মাঝে কোনও কোনও মাসে তার এরকম হয়েছে। দ্বিতীয় ঋতু পেরুনোর সময় সে শঙ্কিত ছিল এই ভেবে যে রিপন স্ট্রিটের বাড়িতে কোনও বউদির দ্বিতীয় ঋতুকাল পেরিয়ে গেলেই বড়আম্মা আল্লার কাছে দোয়া প্রার্থনা করতেন। তাঁর মুখ উজ্জ্বল দেখাত ভরা শৃঙ্খলাবদ্ধ সংসারের সম্ভাবনায়। কিন্তু নীলোফার আনন্দ নেই। ঔজ্জ্বল্য নেই। তার দগ্ধ বিচিত্র চোখের তলায় কালি পড়ারও উপায় নেই। কালি পড়ার জন্যও প্রয়োজন হয় কিছু মসৃণ ত্বক। নীলোফার তা নেই। কিন্তু চোখ দু’টি ত্রাসে স্নান। আর তা বোরখায় ঢাকা আছে। নীলোফা অতি অসহায়তায় চুপ করে থাকে সারাক্ষণ। এতটুকু মাথা ঘোরা, এতটুকু বমিভাব সে প্রকাশ করছে না। কার কাছেই-বা করবে! আর কেমন করে করবে! একবার নীলিমাকে বলবে বলে ভেবেছিল। কিন্তু গুটিয়ে গেছে। নীলিমার সামনে এ কথা উচ্চারণ করা সম্ভব নয়। তার আম্মির কথা মনে পড়ে। বড়আম্মা চলে যাবার পর পর তিনিও চলে গেছেন। নীলোফার চোখে জল উপচায়। হায়! তার কথা শোনাবার মতো একজনও নেই! একজনও! কাকে বলে সে! কাকে জানায়! কষ্ট যন্ত্রণা গোপন রাখা যায়। ঢেকে রাখা যায়। কিন্তু মাতৃত্ব? সমস্ত পৃথিবীকে জানান দিয়ে মাতৃত্ব আসে।
মনিরুলের শিক্ষা তার মনে পড়ছে। বহুবার শোনা। শুনতে শুনতে মুখস্থ। কিন্তু এ সব ভাবনা, স্মরণ কবে তাকে ছেড়ে গেছে! মনিরুল বলতেন, শেখাতেন— গর্হিত আচরণ থেকে নিজেকে নিবৃত্ত রেখো। নৈতিক গুণের মধ্যে দিয়েই মানুষের কল্যাণ আসে। তোমাদের হাত, তোমাদের জিহ্বা, তোমাদের চক্ষু বা কোনও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেন অন্যের সম্পদ সম্মান বা প্রাণের কোনও ক্ষতিসাধন না করে। কোনও অনিষ্ট বা মানহানি না করে। যদি, জীবনযাপনে পবিত্রতা না থাকে, তবে কুক্রিয়ার কুফলে পৃথিবীতে লাঞ্ছনা ও অভিশাপ নেমে আসে। পরলোকে শাস্তি হয়। আত্মীয়স্বজনদের লজ্জা ও ক্ষতির মুখে পড়তে হয়।
নীলোফার হৃদয়ে হায়-হায় উৎক্ষিপ্ত হয়। সে কি তবে দুশ্চরিত্র? সে কি অসংযত? নাপাক কুক্রিয়ায় লিপ্ত? কিছুতেই নিজেকে খারাপ লাগার মতো দার্শনিকতা আসে না তার। সে জামাল কৌশিকের ব্যবহৃত বস্তুগুলি স্মৃতি আঁকড়াবার মতো করে নাড়ে। ছোঁয়। দেখে। মাঝে মাঝে সে জানলা দিয়ে তাকিয়ে থাকে এমনই প্রত্যাশায় যে, কৌশিক সমস্ত সুন্দর নিয়ে ফিরে আসবে ঠিক! কিন্তু আসে না কৌশিক। আসেনি। যেন তার আসতে নেই! যেন তার হারিয়ে যেতে হয়! যেন এই দগ্ধ স্বদেশের টানে সে দূরে চলে গেল স্বদেশকে মুক্তি দেবে বলে! কিন্তু একসময় ভাবনাগুলি নিস্তেজ হয় আসে। সে, অসহায়ভাবে ভয় পায় কিন্তু পাপবোধ দ্বারা যন্ত্রণাদীর্ণ হতে পারে না। তার মধ্যে এই বিশ্বাস গভীর প্রোথিত থাকে যে পীরবাবার দোয়ায় সে যা-কিছু প্রাপ্ত হয়েছে। কিন্তু তার যেন কুন্তীর দশা। পরিণতি না বুঝে বর প্রার্থনা করেছে সে। তার জানা নেই কর্ণকে ভাসাবার আগে কুন্তী এই বৎসরকাল বিশাল মাতৃত্ব কীভাবে গোপন করেছিল! তাই ভয়ে তার ঘুম আসে না। অসহায়ের মতো রাত জাগে। নির্ঘুম রাতে নীতি ও অনুশাসন, সাংসারিক অকল্যাণের সম্ভাবনা ও মনিরুলের চওড়া মুখ তাকে গিলে খেতে আসে। কাকে বলে সে? কাকে বলে এইসব? এই বিদীর্ণ হওয়া, এই গুঁড়ো গুঁড়ো হতে থাকা অস্তিত্ব নিয়েও তার মনে হয় পীরবাবা যদি ওই আশ্চর্য স্বর ও দৃষ্টি দিলেন, ওই আশ্চর্য শরীর ও হৃদয় দিলেন, দান করলেন ওই পরম আনন্দ— তবে তিনিই কি রক্ষা করবেন না আপন দানের মহিমা? স্থিতি ও বিশ্বাস আঁকড়াতে চায় সে। কিন্তু এই কঠিন দুনিয়ায় এই দু’টিই ক্ষণিকমাত্র। যে-কোনও সময় টলে যায়। ভেঙে যায়। এবং নীলোফাও দিশেহারা বোধ করে। পরকালের শাস্তি বা পাপবোধের চেয়ে ভয়ঙ্কর হয়ে দেখা দেয় সামাজিকতার প্রশ্ন। অন্ধকারে একা ডাকে সে। কৌশিককে ডাকে।
—কৌশিক তুমি চলে গেলে কেন?
—চলে গেছি? না তো।
—দেখো। আমি দন্ধে বেঁচেছিলাম। এখন যে আমার আর কোনও উপায় নেই।
—এই তো আমি আছি। এই তো। তোমার মধ্যে। তোমাকে ছেড়ে কোথায় যাব আমি!
—তুমি হারিয়ে যেও না। কৌশিক। হারিয়ে যেও না।
—তুমি, নীলোফা, যা চেয়েছিলে, পাওনি?
—হ্যাঁ। পেয়েছি।
—তবে?
—এটুকুই! ব্যস! এটুকুই?
—তোমার কীসে ভয়!
—সমাজকে। পরিবারকে। আর— আর—
—আর আনিসুজ্জামানকে।
—হ্যাঁ…না…মানে…তুমি কী করে জানলে?
—ওই যে আমি তোমার ভিতরে আছি। তোমার মধ্যেকার সব গলিতে ঘুরে বেড়াচ্ছি আর জেনে নিচ্ছি সব।
—কী জেনেছ?
—আমাকে কতটুকু চিনতে তুমি নীলোফা?
—চিনতাম। ভাইজানের ছাত্র ছিলে তুমি।
—ছাত্র নয়।
—বন্ধু ছিলে।
—ছিলাম। আমি হারিয়ে যাওয়াতে তোমার দুঃখ হয়েছিল?
—হয়েছিল।
—কেন?
—ভাইজানের দুঃখ হত বলে।
—আমি ফিরে আসাতে তুমি খুশি হয়েছিলে?
—হ্যাঁ। হয়েছিলাম।
—কেন? কেন হয়েছিলে?
—কারণ— কারণ— তোমাকে পেয়ে ভাইজান খুব খুশি হয়েছিলেন।
—আমি যখন তোমার মুখ দেখেছিলাম তখন তুমি কার মুখ না দেখার কথা ভেবে কষ্ট পেয়েছিলে? কার বমনের স্মৃতি তোমাকে নিয়ে গেছিল পীরবাবার কাছে আর তোমাকে আকুল কাঁদিয়েছিল আমার কোলে ফেলে?
—ভাইজানের। ভাইজানের।
—আমি যখন গ্রহণ করেছিলাম তোমাকে আর আমার ভারতবর্ষ প্রত্যক্ষ করেছিলাম তখন তুমি আনন্দ পেয়েছিলে তো? পেয়েছিলে কি-না বলো?
—হ্যাঁ। পেয়েছিলাম।
—সে কি এ জন্যই নয় যে তুমি প্রমাণ করতে পেরেছ তোমাকে গ্রহণ করা যায়?
—হ্যাঁ, মানে, না। মানে হ্যাঁ। তাই তো।
—তা হলে আর দ্বিধা নয়। বলল। তাঁকেই বলো। তিনিই শুনবেন। তোমার কেউ নেই ভেবো না। তিনি আছেন। আনিসুজ্জামান।
—কিন্তু— কিন্তু— সে-দিন আমি তো ভালবেসে ফেলেছিলাম তোমাকেই।
—মৌহূর্তিক ভালবাসা। নীলোফার। ভেবে দেখো। শুধু তোমার প্রার্থনা পূর্ণ হচ্ছিল বলে তুমি ভালবেসেছিলে। আমি না হয়ে দেব দানব যাই হোক না —তোমার ইচ্ছে পূর্ণ করলে তাকেই তুমি ভালবাসতে, যেমন মানুষ হৃদয় হিসেবে ভালবেসে থাকে তার হৃদযন্ত্রকেই।
নীলোফার হাত-পা কাঁপে। কিন্তু সে সিদ্ধান্ত নেয়— বলবে। আনিসুজ্জামানকে বলবে। মনে মনে বয়ান প্রস্তুত করে সে। তারপর? ঘৃণা পাবে সে? নতুন করে ঘৃণা? যদি পায়? সে মরে যাবে। মরে যেতে ইচ্ছে করে না নীলোফার। সে বাঁচতে চায় অনেক-অনেক দিন। বাঁচতে চায়। তবু মরে যেতে হবে, যদি ঘৃণা পায়! যাবতীয় ঘৃণা ও অবহেলা, এতকাল গাছের গোড়ায়, প্রত্যেক কশিদা শিল্পে সে ছড়িয়ে দিয়েছে নিরুত্তাপ। এ বার সে কী করে। সে জানে না। জীবন ও মৃত্যু সমান অনিবার্য হয়ে যায় তার অস্তিত্ব নিরূপণে।
এই সবকিছুই ঘটতে থাকে ঘোর বর্ষায় যখন আকাশে মেঘ ঘন হয়ে সূর্য আটকাতে তৎপর।
একদিন ‘হিন্দুধর্ম জাগরণী সভা’ হিন্দুত্ববাদ ও অন্যান্য ধর্ম সংক্রান্ত আলোচনা সভায় আনিসুজ্জামানকে আমন্ত্রণ জানাল এ মর্মে যে, তিনি যে-সাম্প্রতিক গ্রন্থটি লিখেছেন এবং তার ভূমিকায় তাঁর সারা জীবনের গবেষণার বিষয় উল্লেখ করেছেন সে-সম্পর্কে সভায় দু’চার কথা বললে তারা কৃতজ্ঞ থাকবে।
আনিসুজ্জামান সে-সভায় যোগ দিলেন। ‘হিন্দুধর্ম জাগরণী সভা’র সভাপতি একজন রাজনৈতিক সংগঠক। পশ্চিমবঙ্গে তাঁর সংগঠন ছোট কিন্তু নিষ্ক্রিয় নয়। তাঁর প্রশস্ত বসার ঘরে ফরাস বিছিয়ে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশজন বিদগ্ধ ও প্রাজ্ঞজনের সভাকে চেহারা ও চরিত্রে অনেকটা ঊনবিংশ শতকীয় দেখাল। এবং সভা শুরু হওয়ার কিছু পরেই তিনি বুঝলেন, ধর্মসমন্বয় নয়, মতাদর্শ নয়, আলোচনা বা প্রকৃত অর্থে এই সভা এক আক্রমণ যা তিনি দুর্গাবিষয়ক গ্রন্থ রচনার জন্য লাভ করতে চলেছেন। একজন, তাঁর কপালে তিলক, পাতলা শার্টের নীচে সোনার চেনের সঙ্গে পৈতে বাহিত দেখা যায়, আনিসুজ্জামানের বইখানি হাতে নিয়ে পরিশীলিত উচ্চারণ ও ভঙ্গিতে তাঁর পরিচয় সম্পন্ন করলেন। আনিসুজ্জামান ছাড়া এখানে সকলেই পরস্পরের পরিচিত এবং হিন্দুত্ববাদ নতুন করে জাগিয়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কারও মতবিরোধ নেই। নিম্নশ্রেণী, তফসিলি জাতি বা অন্য ধর্মাবলম্বী সম্পর্কে এঁরা বিদ্বিষ্ট ও উন্নাসিক। আনিসুজ্জামান অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। যদিও কেউ তাঁর সঙ্গে অশিষ্ট ব্যবহার করেননি। তবু তিনি নিজেকে বারবার এই বলে দায়ী করলেন যে তাঁর এখানে আসা বোকামি হয়েছে, এ কথা আগে বোঝা প্রয়োজন ছিল।
পৈতে ও সোনার চেনবাহক আনিসুজ্জামানের কাছে সভার বিশিষ্ট কয়েকজনের পরিচয় দিলেন এবং মুক্তকণ্ঠে ঘোষণা করলেন যে দুর্গাবিষয়ক গ্রন্থখানি খুবই প্রয়োজনীয় ও তথ্যবহুল। সভাপতির কাছে কয়েকটি জায়গা পড়ে শোনাবার আবেদন জানালেন তিনি। আবেদন মঞ্জুর হল। তিনি শুরু করলেন—
দুর্গাপূজায় যে-নবপত্রিকা ব্যবহৃত হয় তা দুর্গার প্রতীক। প্রতীক এ কারণে যে নবপত্রিকা দেখলে কোনও নারীজ্ঞান জন্মায় না। কিন্তু দুর্গার প্রতিভা নারীজ্ঞানের দ্যোতক। আর দুর্গার এই নারীদেহ, মাতৃদেহ। কুমোর ধীরে ধীরে যে-নারীমূর্তি ফুটিয়ে তুলে দশ হাত যোজনা করে দেন— সেই নিটোল নারীমূর্তিতে শক্তিশালিনী প্রবল মাতৃকারূপ বর্তমান। খোলা চুলে, দশ হাতের অস্ত্রসম্ভারে একটু আলুথালু লাগে এই মাকে। যেন দুপুরবেলায় দশ হাতে দশ সন্তানকে অন্নব্যঞ্জন পরিবেশন করতে করতে মা সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। তিনি এক শিশুকে ভাত বেড়ে দেন, এক শিশুকে মেখে দেন। এক শিশুকে ভোলান, আরেক শিশুকে স্তন্য দেন। এ জন্যই তিনি দশভুজা। দুর্গাপ্রতিমা আসলে আমাদের গাৰ্হস্থ্যের কর্ত্রী। আমাদের মায়ের রূপক। এই রূপকে ভাব ও রসের সম্মিলন হয়েছে। লোকগান খুঁজলে দেখা যাবে, আমাদের ঘরে ঘরে যত মেয়ে আছে, উমা, পুঁটি, খেন্তি, বুঁচি— প্রত্যেকেই তাদের পিতার বুকে দুর্গা হয়ে থাকে যখন তারা শ্বশুরবাড়ি যায় বা শ্বশুরবাড়ি থেকে দু’দিনের তরে প্রত্যাগমন করে। আবার অন্য দিক থেকে ভাবতে গেলে দুর্গামূর্তির মধ্যে অতিমানবিক শক্তির সন্ধান পাওয়া যায়…
গুঞ্জন উঠল। বাড়তে বাড়তে শোরগোল হল। শোরগোল প্রায় উন্মত্ততা ছোঁয়! আনিসুজ্জামানের হাত-পা কাঁপছে। তাঁকে কি এবার প্রশ্ন করা হবে? তাকে কি জবাবদিহি করতে হবে? তিনি ঋজু থাকার চেষ্টা করছেন। শক্ত হওয়ার চেষ্টা করছেন। একজন বলছেন— দুর্গা স্তন্যদান করছে এ কথা লেখার অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে? অন্যজন বলেন— আপনি মুসলমান। হিন্দুদের দেব-দেবী নিয়ে এরকম তুলনা করার অধিকার আপনাকে কে দিল?
আনিসুজ্জামান শান্ত গলায় বলছেন— দুর্গার সঙ্গে আমি মায়ের সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছি।
—মা মানে আপনার মা কি?
—হ্যাঁ। নিশ্চয়ই। আমারও মা। যে-কোনও বাঙালি মা।
—কিন্তু আপনারা পৌত্তলিকতা মানেন না। কোন সাহসে নিজের মায়ের সঙ্গে দুর্গার তুলনা করেন আপনি?
—আমি তো বলেছি, দুর্গার মূর্তি মাতৃত্বের প্রতীক।
—আমি যদি বলি, আপনি ঘরের মাকে বাইরে টেনে আনছেন আর কুৎসিত উপমা দিচ্ছেন হিন্দুত্বকে অপমান করার জন্যই?
—আমি তা হলে বলব, আপনি ভুল ভাবছেন। মা ও শিশুর চিত্র পৃথিবীতে সবচেয়ে পবিত্র ও সুন্দর বলে মানা হয়। যে-কোনও ধর্মেই তা সত্য। কারণ মাতৃত্ব সৃষ্টির ধারক। মাতৃত্ব মানবিক।
—এত বিষয় থাকতে আপনি হঠাৎ হিন্দুদের দেবী নিয়ে মাতামাতি করতে গেলেন কেন? আর বিষয় পাননি আপনি? আপনি অনধিকার চর্চা করেছেন!
আনিসুজ্জামান ক্লান্ত ও পর্যদস্ত বোধ করেন। তাঁর বোঝানোর চেষ্টা ব্যর্থ হয় যে তিনি বাঙালির সংস্কৃতিকে দেখেছেন এখানে। এই অংশটি সাংস্কৃতিক বিশ্লেষণ। তিনি একজন নিরপেক্ষ লেখক হিসেবেই দুর্গার মাতৃমূর্তি দেখছেন, মুসলমান হিসেবে নয়। কিন্তু তাঁর সব কথা সভাকক্ষের গোলমাল ও ধুলোর তলায় গড়িয়ে গেল। প্রস্তাব এল যে এই গ্রন্থের লেখক ও প্রকাশকের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হোক।
আনিসুজ্জামানের মধ্যে প্রতিবাদ তোলপাড় করে। কিন্তু তাঁর ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতিজ্ঞা। প্রাজ্ঞ, শিক্ষিত ও চেতনাসম্পন্ন মানুষদের এই আচরণের বিরুদ্ধে সরব হওয়ার সংকল্পেও নিজেকে হীন লাগে তাঁর। তিনি দু’হাত জোড় করে উঠে দাঁড়ান। বলেন— এই বই লিখে আমি ন্যায় করেছি না অন্যায় করেছি আমি জানি না। আপনারা যদি আমার বিরুদ্ধে কিছু করতে চান। সে-সিদ্ধান্ত আপনাদের। আমার সে-সব শোনার জন্য এখানে থাকা নিরর্থক। আপনাদের সবার অনুমতি নিয়ে আমি এখন যাবার জন্য তৈরি হতে চাই।
—পালাচ্ছেন? বই লিখেছেন! জবাব দিন!
—আমি যা বলতে চাই, বলেছি। আর হয়তো সত্যিই পালাচ্ছি কারণ আমি অতি দুর্বল, সাধারণ একজন লোক। আপনাদের সঙ্গে কথা বলার কোনও যোগ্যতাই আমার নেই। আমি যা সঠিক ভেবেছি, করেছি। আমার আর কিছু বলার নেই।
আনিসুজ্জামান পথে বেরিয়ে পড়েন। কটূক্তিগুলি তাড়া করে তাঁকে। নির্মমতা তাড়া করে। তিনি মুখ নিচু করে বাসে উঠে পড়েন। তাঁর মধ্যে একই সঙ্গে কাজ করে ভয় ও বিতৃষ্ণা। এবং সভায় যাবার জন্য নিজের প্রতি জমে ওঠে ক্ষমাহীন বিরক্তি। বাসের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকেন তিনি। কিন্তু কিছুই তাঁর চোখে ধরা দেয় না। মনের মধ্যে বিভিন্ন স্তর ভেদ করে উঠে আসে জটিল প্রশ্ন। মৌলিক প্রশ্নও। ধর্মকে আশ্রয় করা এবং গোঁড়ামি অবলম্বন করা— এই-ই কি তবে জীবনের মূল মন্ত্র হওয়ার কথা ছিল? পরধর্মবিদ্বেষই কি তাঁকে সমস্ত আঘাত ও অপমান থেকে রক্ষা করতে পারত? তাঁর কি উচিত ছিল জন্মসূত্রে পাওয়া ধর্ম নিয়ে মাতামাতি করা ও অন্য ধর্ম সম্পর্কে উন্নাসিক হয়ে ওঠা? তাঁর মনিরুলের কথা মনে হয়। মনিরুল বলতেন —তুমি ক্রমশ যেন হিন্দু হওয়ার চেষ্টায় আছ।
আনিসুজ্জামান মনে মনে বলতেন— ‘আমি মানুষ। এই আমার ধর্ম। এই আমার পরিচয়।’ তিনি কি ভুল করেছেন! ভুল ভেবেছেন এতকাল! পরধর্মবিদ্বেষ? কাজটি অতি সহজ কিন্তু অতি নীচ। আনিসুজ্জামান তাঁর সমস্ত শিক্ষা ও উপলব্ধি দ্বারা উত্তর রচনা করেন— না। পরধর্মবিদ্বেষ নয়। সহিষ্ণুতা-সহিষ্ণুতা। সহিষ্ণুতার পথ সবসময়ই দুর্গম, কিন্তু এই-ই মানুষের যথার্থ লক্ষ্যের পথ। তিনি স্থির করেন, যেমন ছিলেন, যেমন আছেন, তেমনই থাকবেন চিরকাল। এই অভিজ্ঞতাগুলি অতি তিক্ত ও নির্মম। কিন্তু এই-ই জীবনের সত্যিকারের চেহারা। মানুষের অন্ধত্ব ও ঔদার্য দুই-ই যদি না দেখতে পান তবে তাঁর কাজ পূর্ণ হবে না।
এ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পেরে একটু সহজ লাগে তাঁর। তবু ক্লান্তি আসে। অনিবার্য ক্লান্তিকে তিনি কেমন করে আটকাবেন? অতএব ভারী শিকল পায়ে নিয়ে ক্লান্ত বিপন্ন মানবজন্মকে টেনে টেনে সিঁড়ি দিয়ে উপরে নিয়ে চলেন তিনি আর দেখতে পান মনিরুল এসেছেন। তাঁর খেয়াল হয়, নীচে মনিরুলের গাড়ি রয়েছে। সমস্ত ক্লান্তি ঢেলে দেবার পরিবর্তে বরং টান টান হয়ে ওঠেন আনিসুজ্জামান কারণ মনিরুলের মুখ এমন এক ঝড়ো আভাস ঘোষণা করে যা কখনও আনিসুজ্জামানের অভিপ্রেত হতে পারে না।
মনিরুল চেয়ারে বসে আছেন। নীলোফা মাথা নিচু করে ডিভানে বসে আছে। এত বছরে এই প্রথম মনিরুল এই ফ্ল্যাটে পা রাখলেন। গম্ভীর মনিরুল নিজের সম্পর্কে আরও যত্নবান হয়েছেন, আরও সতর্ক। তাঁর বেশবাসের চেকনাই বেড়েছে। অঙ্গের স্থূলত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। কিছুক্ষণ এ কথা সে-কথার পর এই বৃষ্টিবাদলায় এত দূর আসার প্রকৃত উদ্দেশ্য পরিবেশন করলেন তিনি। বললেন— তুমি ধর্মান্তরী হবে শুনলাম?
—ধর্মান্তরী? আপনি কী বলছেন আমি বুঝতে পারছি না।
—হবে না বলছ?
—না। হব না। হওয়ার কথা আমার মাথাতেও আসেনি।
মনিরুল বাঁকা হাসেন। তাঁর গোঁফবিহীন ঠোঁট ও গালভর্তি লালাভ দাড়ির প্রেক্ষাপটে সেই হাসি কুটিল ও তেতো লাগে। তিনি বলেন—হবে নাই-বা কেন?
আনিসুজ্জামান বলেন—হব না কারণ কোনও ধর্মের অন্তর্ভুক্ত থাকা আমার কাছে জরুরি মনে হয় না। যা আমি কোনও দিন গ্ৰহণই করিনি তাকে ত্যাগই-বা করব কী করে!
—আজ তুমি কোথায় গিয়েছিলে?
—একটা আলোচনা সভা ছিল।
—শুনলাম হিন্দু ধর্ম জাগরণী সভায় যোগ দিয়েছ তুমি। সেখানে নিয়মিত যাতায়াত করছ?
আনিসুজ্জামান নীলোফোর দিকে তাকালেন। এসব গল্প কে করেছে মনিরুলকে! নীলোফা নিশ্চয়ই নয়। তিনি বলেন— আপনি শুনেছেন ঠিকই। তবে তা অর্ধসত্য। হিন্দু ধর্ম জাগরণী সভা আমাকে আজ আমন্ত্রণ করেছিল। আমার বইটি নিয়ে আলোচনা… …
মনিরুল আনিসুজ্জামানকে থামিয়ে দেন। তাঁকে উত্তেজিত দেখায়। বলেন— বই? না? বই? যে-বই তুমি লিখেছ, এই দুনিয়ায় তার বাইরে কি আর বিষয় ছিল না মেঠা? তুমি কোনওদিন ধর্মাচরণ করোনি। নমাজ পড় না। বারবার বলা সত্ত্বেও সাদি করোনি। রোজা রাখা কাকে বলে তুমি জানোই না। তুমি কি বলতে পারবে আমাদের ক্যালেন্ডারে এটা কী মাস? এই মেয়েটাকে পর্যন্ত তুমি ধর্ম ভুলিয়েছ।
আনিসুজ্জামান চমকে ওঠেন। সারাদিনের সমস্ত তিক্ততার ওপর ভাসমান অসহিষ্ণুতা আঁকড়ে বলেন— নীলোফা? নীলোফাকে তো আমি কিছু বলিনি! বারণও করিনি! ওর যা মনে হয় ও তাই করে।
—ওর যা মনে হয়? তুমি জানোই না যে ঘরে জেনানা থাকলে তাকে সহবৎ ‘শিক্ষা’ দিতে হয়, এটাই পুরুষের কাজ। শিক্ষা না দিলে জেনানা বিগড়ে যাবেই। তোমাকে বলতে হবে কেন? তুমি ধর্ম-টর্ম মানো না। নীলুও মানে না। তুমি হিন্দুদের সঙ্গে মেশো। ও-ও মেশে। তোমার কথা আর কী বলব! নীলুর কথা তো ছেড়েই দিলাম। ও তো একটা জ্যান্ত কয়লা। ও কী করল না-করল তাতে কিছু যায় আসে না। কিন্তু তোমার জন্য সমাজে আমাকে জবাবদিহি করতে হয়।
নীলফা আস্তে আস্তে রান্নাঘরে চলে যায়। আনিসুজ্জামান টের পান মনিরুলের কোনও কথা নীলোফাকে বিঁধেছে! মনিরুল বলে চলেন— তুমি বরাবরই হিন্দু ঘেঁষা। এমনকী বসবাসের জন্যও তুমি হিন্দু পাড়া বেছে নিলে।
আনিসুজ্জামান হাসেন। বলেন— আপনি বোধহয় জানেন না। এ পাড়ায় অনেক শিখ পরিবারও আছেন। একটি বৌদ্ধ ও তিনটি জৈন পরিবার আছেন।
—কিন্তু মুসলমান তুমি ছাড়া আর আছে কি? তুমি যাই বলো না কেন আর যতই তর্ক করো কেন, আমরা পরিষ্কার বুঝতে পারছি তুমি পৌত্তলিকতার দিকে ঝুঁকেছ। তোমার বইয়ের পাতায় পাতায় পুতুলপূজার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও আনুগত্য প্রকাশ পেয়েছে।
আনিসুজ্জামান দু’হাতে মুঠো মুঠো চুল খামচে ধরছেন। কী আশ্চর্য! কী আশ্চর্য! হিন্দুরা তাঁর বইয়ের পাতায় পাতায় অশ্রদ্ধা পেয়েছেন আর মনিরুল পেয়েছেন শ্রদ্ধা। দুইয়ে মিলে, গাণিতিক প্রক্রিয়ায়, নিশ্চিত হওয়া যায় যে তিনি নিরপেক্ষ আছেন!
মনিরুল বলে চলেছেন— আমি তোমাকে জানাতে এসেছি যে, ইয়াসিনের সাদি স্থির হয়েছে। এই অনুষ্ঠানে আমরা তোমাকে আমন্ত্রণ জানাতে পারলাম না কারণ তুমি উপস্থিত থাকলে আমাদের অনেক ভাই-বন্ধু অনুষ্ঠানে আসবেন না বলে জানিয়েছেন।
আনিসুজ্জামান মনিরুলের দিকে দেখেন। নীলোফার কাছে জল চেয়ে পান করেন পুরো এক গ্লাস। ভাবেন, এই ভাল হল। এই ভাল।
মনিরুল বলেন— তুমি যাবে না শুনে নীলোফাও যেতে পারবে না জানিয়েছে।
নীলোফা চা আর বিস্কিট সাজিয়ে নিয়ে আসে। আনিসুজ্জামান বলেন— নীলু যা ভাল বোঝে করবে।
মনিরুল উঠে দাঁড়ান। চা পান করতে অস্বীকার করেন। তাঁর অনিচ্ছে কবুল করেন তিনি। কিন্তু নীলোফা ও আনিসুজ্জামানের বুঝতে বাকি থাকে না যে মনিরুল এখানে কিছুই খাবেন না। তাঁরাও জোর করেন না। আনিসুজ্জামান মনিরুলের সঙ্গে নীচে গিয়ে তাঁর গাড়ি ছাড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। তারপর ফিরে এসে নিজের চায়ের কাপ হাতে নেন। বিস্কিট চিবোন অতি অন্যমনস্কতায়। নীলোফাও চায়ের কাপ হাতে চুপ করে বসে থাকে আনিসুজ্জামানের কাছে। বাদবাকি বাঁধা-ধরা কাজ নীরবেই সম্পন্ন করেন দু’জন। আনিসুজ্জামান নিজের ঘরের বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়েন বিছানায়। বলেন— বাজাবি নীলু?
নীলোফাও বসার ঘরের মৃদু আলোটি জ্বেলে আনিসুজ্জামানের ঘরে মেঝেয় সেতার নিয়ে বসে৷ সামান্য বাজায়। কিন্তু আজ আর আঙুলে সুর উঠছে না। আনিসুজ্জামান বলেন— কি? আজ বাজাতে ভাল লাগছে না?
নীলোফা অন্যমনস্ক আঙুল রাখছে সেতারে। বলছে— ভাইজান?
—কি?
—আমার কিছু কথা ছিল।
আনিসুজ্জামান নীলোফার স্বরের বিপন্নতা খেয়াল করেন না। আজ সারা দিন তাঁর ওপর দিয়ে ঝড় গেছে। সে-ঝড়ের রেশ লেগে আছে মাথায়, মস্তিষ্কে। তিনি বলেন— আমারও কথা আছে রে নীলু। অনেক কথা। আজ সভায় কী হল জানিস?
এই প্রথম নীলোফা, আনিসুজ্জামানকে ছাড়িয়ে, নিজেকে প্রক্ষেপণ করল। বলল— ভাইজান, আজ আমার কথা বলি?
কী করুণ, কী আকুল কণ্ঠস্বর! আনিসুজ্জামান বিছানায় সোজা হয়ে বসেন। কী হয়েছে! কী বলতে চায় নীলু! মনিরুল কিছু বলেছেন। তাঁর প্রথমেই মনে হয়, মনিরুল কি নীলোফাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চান?
নীলোফা সেতারে হাত বুলোয়, যেন-বা পৌঁছে গেছে স্মৃতিতর্পণে, বলে, ভাষা ও সংযম হারাতে হারাতে বলে— কৌশিক, ভাইজান, কৌশিক… …
আনিসুজ্জামান প্রাথমিকভাবে স্বস্তিবোধ করেন। প্রসঙ্গ তবে মনিরুল নন্। বলেন— হ্যাঁ। কী হয়েছে? কৌশিক এসেছিল নাকি নীলোফা? ওকে কোথাও দেখতে পেয়েছিস?
—না।
—তবে?
—আমি আর কৌশিক সারা দুপুর একা থাকতাম…
—হ্যাঁ। নীলু। তাতে কী?
—ভাইজান, কৌশিক আমাকে… আমাকে…
যে-কথা উচ্চারণ করতেও যন্ত্রণা, সে-কথা শোনার জন্য প্রস্তুত হন আনিসুজ্জামান। তিনি অনুমান করেন কিন্তু নিজের কাছেও তা অস্বীকার করতে থাকেন। নীলোফা বলে—আমি মা হচ্ছি, ভাইজান।
—হে আল্লা!
মাত্র দু’টি শব্দ উৎক্ষিপ্ত হয় আনিসুজ্জামানের মুখ দিয়ে। তাঁর বোধ, বিশ্বাস, ক্রিয়া-কর্তব্য গুলিয়ে যায়। অতীত বর্তমান গুলিয়ে যায়। শুধু ভয়ঙ্কর ভবিষ্যৎ রাক্ষুসে মুখ দিয়ে গ্রাস করতে চায় অস্তিত্ব! দু’হাতে মুখ ঢাকেন তিনি। কিন্তু ক্রোধী হন না। ক্রোধ প্রকাশ করা বা জন্মানোর শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলেন। মনে মনে নিজের প্রতি দোষারোপ করেন। কেন এরকম সম্ভাবনার কথা তাঁর আগে মনে হয়নি? কেন নীলোফার নিরাপত্তার চিন্তা না করে একটি পাগলের ভার তার ওপর ছেড়ে দিয়েছিলেন? কৌশিক! কৌশিক এরকম করল! কিন্তু আনিসুজ্জামান নিজেকে বোঝান, কৌশিক সুস্থ ছিল না। আত্মস্থ ছিল না। হঠাৎ তাঁর ভয় করতে থাকে। তাঁর আশঙ্কা হতে থাকে যে নীলোফা তবে অত্যাচারিত হয়েছিল! অসম্ভব কষ্ট হতে থাকে এ বার। তিনি কোনওক্রমে বলেন—নীলু, ও কি জোর করে… তোর ওপর জোর করে…
—না, ভাইজান, না!
আনিসুজ্জামানের কথা শেষ হওয়ার আগেই ঝাঁপ দেয় নীলোফা। বলে—ওরকম বলবেন না। সে ওরকম নয়।
আনিসুজ্জামানের বিস্ময় জাগে। কৌতূহলও হয়। একই সঙ্গে অসহায় অবাঞ্ছিত তিক্ততা জাগে মনে। গলা শুকিয়ে যায়। বলেন—তুই হতে দিলি তবে!
নীলোফা জবাব দেয় না। আনিসুজ্জামান আবার শুয়ে পড়েন। ভাবেন, কৌশিক পারল? কেমন করে পারল? পাগল বলেই? পাগল—তবু তাঁর অস্বাভাবিক কষ্ট হয়। এ কষ্ট কীসের তিনি বুঝতে পারেন না। এ কষ্ট কি ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের—যার পরিণতি তিনি জানেন না? নাকি এ কৌশিক ও নীলোফার স্বেচ্ছাকৃত জড়িয়ে পড়ার দরুন যন্ত্রণা! তিনি অসহায়ের মতো প্রশ্ন করেন—কেন নীলু? কেন হতে দিলি?
এখন নীলোফার গলায় কান্না নেই, ভয় নেই, উদ্বেগ নেই। স্বপ্ন দেখার মতো সে বলে যায়— আপনার কি মনে আছে ভাইজান, পীরবাবার কাছে প্রার্থনা করেছিলাম?… ভাইজান, কৌশিক হঠাৎ আমার মুখ দেখতে পেল। আমার পোড়া, বীভৎস, কুৎসিত মুখ। কিন্তু সে তার মুখ ফিরিয়ে নিল না। আমি মুখ ঢাকলাম। তবু সে বারবার ফিরে দেখতে চাইল। আমি বোরখা খুলতে চাইলাম না। সে নিজে খুলে দিল। এমন চোখে সে আমার দিকে চাইল যেন আমি কত সুন্দর! আমি ভুলে গেলাম আমি কী! সে এমন করে আমাকে ছুঁল, ভাইজান, আমি সুন্দর হয়ে উঠলাম। ভুলে গেলাম যে আমাকে দেখলে লোকে শিউরে ওঠে। আব্বা আমাকে দেখলে ঘেন্না পায়। আম্মা মৃত্যুকামনা করে। আমি ভুলে গেলাম যে আপনি আমাকে দেখে পালিয়ে যান, বমি করেন। আমি খুব-খুব-খুব সুন্দর পরি হয়ে উড়ে বেড়াতে লাগলাম। আর সে, আমাকে ধরে বলতে লাগল—আমি তোমাকে দেখলাম। এই আমার ভারতবর্ষ। দগ্ধ। ঝলসানো। রিক্ত। আমি তোমাকে নিলাম। এই আমার দেশ। তোমার এ পোড়া শরীরের নীচে সব আছে। সব প্রাণ। সব প্রেম। সব অনুভূতি। ও আমার দেশ। আমি তোমার। আমি এসেছি। আমি আসছি।…
নীলোফা থামল। জল পড়ছে দু’চোখ বেয়ে। কৌশিক নেই যে শুষে নেবে। অতএব তা পড়তে থাকল অবাধে। আনিসুজ্জামান বলতে চাইলেন—ওকে কেন বিশ্বাস করলি? ও তো সুস্থ নয়! ও তো পাগল!—কিন্তু বলতে পারলেন না। তাঁর প্রাণ পুড়তে লাগল। কোন যন্ত্রণায় নীলোফা পাগলকে বিশ্বাস করে বসে আছে আর সে-পাগল তাকে ছেড়ে গেছে অবহেলায়। তবু মনে মনে মিথ্যে স্বর্গ আঁকড়ে আছে নীলোফা যে একজন তাকে সুন্দর করেছিল। তাঁর দিশেহারা লাগে। এই মেয়ে নিয়ে কী করবেন তিনি! তখন নীলোফা কথা বলে। কান্নাচাপা আত্মস্থ গলায়—আপনি ভাবছেন ভাইজান, কৌশিক পাগল, তাই এরকম করেছে, না? কিন্তু তখন ওর চোখ দু’টো পুরো সুস্থ ছিল।
আনিসুজ্জামান চমকে ওঠেন। নীলোফা তাঁর চিন্তা পাঠ করেছে। হঠাৎ নিজেকে অক্ষম ও অসহায় লাগে তাঁর। ভয় করে। খুব ভয় করে। আতঙ্কিত মানুষের মতো কাঁপতে থাকেন তিনি। অসম্ভব যন্ত্রণা ও অসহায়তার কান্না ছিটকে ওঠে গলায়। তিনি এমনকী সে-কান্না লুকোবারও চেষ্টা করেন না। নীলোফা স্পষ্ট তার শব্দ পায়। তিনি কান্নায় ভিজতে ভিজতে বিলাপ-কণ্ঠে বলেন—আমি কী করব নীলু! আমাকে তো কেউ বুঝবে না। চাচা-চাচী কতখানি বিশ্বাস করে তোকে আমার সঙ্গে আসতে দিয়েছিলেন। তাঁদের সে-বিশ্বাস কোথায় রইল? পৃথিবীসুদ্ধু লোক ভাববে আমি সুযোগ নিয়েছি। আমি তোর সুযোগ নিয়েছি নীলোফা।
নীলোফা বোরখার ঢাকনায় নিজের চোখ মোছে। দুর্বহ অসহায় লাগে তার। যন্ত্রণাও হয়। কিন্তু নিজেকে কিছুতেই অপরাধী লাগে না। তার মনে পড়ে আব্বু ও আম্মির সংলাপ। মনে পড়ে, মনিরুল বলছেন—…কী কুৎসিত! হে আল্লা! আমার মেয়ে কিন্তু আমারই তাকাতে ঘেন্না করে।…
সঞ্জিদা বলছেন—… আল্লা ওকে কেন বাঁচিয়ে রাখলেন!…
নীলোফা এতদিনে একবারও জীবন ছাপিয়ে মৃত্যুর কথা ভাবেনি। মৃত্যু তার কাছে অপ্রিয় ও অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল। কিন্তু এই প্রথম তার মনে হল, সে তো মরে যেতেই পারে। সে মরে গেলে কারও কোনও ক্ষতি হবে না। সে একবার সেতারে হাত রাখে। পরক্ষণেই তার মনে হয় মৃত্যু খুব কঠিন। খুবই অনভিপ্রেত। এই ঘর ফেলে, এই সেতার, এই বাগান, বাড়ির পেছন দিকের আমগাছ ও সুপার মার্কেট ফেলে, এই রান্নাঘর, এই নির্ভরশীল সর্বজন পরিত্যক্ত মানুষটাকে ফেলে সে কেমন করে মরে যাবে! সে মৃত্যুমুখী হতে পারে না। জীবনের প্রতি আশ্চর্য মমতায় মনে মনে পীরবাবার কাছে সমাধান প্রার্থনা করে। কিন্তু দিশেহারা উদ্ভ্রান্ত মানসিক অবস্থার তবু উপশম হয় না। সে নিজের ঘরে যায়। যত্নে সেতার তুলে রাখে। পাশাপাশি দু’টি ঘরে স্তব্ধ ঘুমহীন রাত কাটে দু’জনের। মেঘ ছিঁড়ে বৃষ্টি নামে। ঝেঁপে বিদ্যুৎ জড়িয়ে ভূমি ছোঁয়। গুরু গুরু শব্দ ওঠে আর তার কাঁপন লাগে আনিসুজ্জামান ও নীলোফার সাজানো পাঁজরগুলিতে। আনিসুজ্জামানের মনে হয়— তিনি একজন পুরুষ, এ কথা ভেবে বিচলিত হয়েছেন যে লোকে তাঁকে কী বলবে! হায়! তিনি কী স্বার্থপর! নীলোফার অবস্থা একবারও ভেবে দেখছেন না তিনি যে সে কতখানি অসহায়! কারও কাছে বলার জায়গা নেই! কোথাও যাবার জায়গা নেই! যে তাকে স্বপ্নে ঠেলে দিল তার আর ফিরে আসার নিশ্চয়তা নেই! অসুন্দর, অনভিপ্রেত সে। কুমারী মাতৃত্বে অসহায়। ভয়ের হিমস্রোত আনিসুজ্জামানের মেরুদণ্ড বেয়ে গলে গলে নামতে থাকে। যদি মরে যাবার কথা ভাবে নীলোফা? যদি অসহায়তা ও লজ্জায় আত্মহত্যা করে? পর পর ঘটে যাওয়া মৃত্যুগুলির কথা মনে হয় আনিসুজ্জামানের। তিনি উঠে পড়েন। তাঁর মনে হয় নীলোফাকে সাহস দেওয়া দরকার। বোঝানো দরকার তিনি আছেন। নীলোফার পাশে আছেন। কিছু একটা হবে। কী হবে জানেন না। কিন্তু নীলোফাকে মৃত্যুর ইচ্ছা বা হননের ইচ্ছা থেকে দূরে রাখবার জন্য তিনি ছুটে যান তার দরজার কাছে। শব্দ করেন দরজায়। উত্তেজিত হয়ে ডাকেন—নীলোফা! নীলু! নীলু!
নীলোফা উঠে আসে। বোরখায় মুখ ঢেকে, যথাবিধি জাগরণে, বলে—কী হয়েছে ভাইজান?
আনিসুজ্জামান শিশুকে বোঝনোর মতো বলেন—নীলু, ঘাবড়াস না। ভেঙে পড়িস না। যা হয়েছে তা ভুল না ঠিক, পাপ না পুণ্য আমি জানি না। কিন্তু মানুষকে সবসময় জীবনের দিকে তাকাতে হয়। মনে থাকবে তো নীলোফা?
নীলোফা ঘাড় নাড়ে। এবং চোখে জল আসে তার।
এই প্রথম আনিসুজ্জামান তার চিন্তা পাঠ করেছেন। সে আস্তে বলে—ঘুমোতে যান, ভাইজান, কাল শরীর খারাপ করবে।
বাইরে আকাশে বজ্রবিদ্যুৎ উদ্ভ্রান্ত দাপিয়ে বেড়ায় এবং তুমুল অগ্ন্যুৎপাতের মতো বর্ষা নামে ডাঙায়।
৫২
ভোর হল। সূর্য উঠল না। সকাল হল। কিন্তু অন্ধকার এমন ঘনিয়ে এল যেন অকালেই সূর্য অস্ত গেছে। আনিসুজ্জামান ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ঘন কালো মেঘের দিকে চেয়েছিলেন। নীলোফা চা করছিল। দরজায় বেল বাজল। নীলোফা বলল— দরজা কি খুলবেন আপনি, ভাইজান? আমার হাত বন্ধ।
আনিসুজ্জামান সাড়া দিলেন। দরজা খুললেন। তাঁর মুখোমুখি এক অচেনা যুবক। উচ্চতায় মাঝারি। ভাল স্বাস্থ্য, শ্যামল-শ্যামল রং। তার শার্ট-প্যান্ট ভিজে গেছে। পাশে একটি স্যুটকেস। হাসিমুখে সে বলছে— আমি শমসের রহমান চৌধুরী, আমি এসেছি—
আনিসুজ্জামান তাকে কথা শেষ করতে দেন না। তার দু’ হাত ধরে বলেন— এসো, এসো। আমি আনিসুজ্জামান।
তাঁরা পরস্পরকে অভিবাদন করেন। আনিসুজ্জামান আপ্যায়নে মন দেন। খুশির সঙ্গে আতিথ্য করেন। এই সকালে এই বৃষ্টিতে শমসের কেমন করে সঠিক ঠিকানায় এসে পড়ল তার খোঁজ নেন তিনি, যদিও আনিসুজ্জামান ও শমসেরের মধ্যবর্তী যোগাযোগ তৃণাঙ্কুর এ পারে এবং অধ্যাপক সমীরুদ্দিন চৌধুরী ও পারে, ফলে শমসের তৃণাঙ্কুরের নাম জানে এবং তিনি পাশেই থাকেন শুনে উৎসাহিত হয়। সে জানাতে থাকে, আনিসুজ্জামানের গবেষণার বিষয়ে সে আগ্রহী, সে সাহায্যও করতে চায়, তবে তার এ বারে কলকাতায় আসার মূল উদ্দেশ্য কলকাতা দেখা এবং যাকে কি-না এই বর্ষাতেই সে দেখতে চায়।
আনিসুজ্জামান প্রথম দর্শনেই শমসেরকে গ্রহণ করলেন। তার শ্যামল-শ্যামল শরীর, সুস্বাস্থ্য, তার সরল দু’টি চোখ এবং গালভর্তি দাড়ি— এই সব কিছু সমেত সে অতি চঞ্চল এবং হাসি ছড়িয়ে দেয়। সে কথা বলতে ভালবাসে বোঝা যায়, কারণ এখানে আসা ইস্তক সে থামেনি এবং নতুন পরিচয়কে হাওয়ায় উড়িয়ে ক্রমাগতই কথা বলতে থাকছে। আনিসুজ্জামানের অস্থিরতা এবং এই চার দেওয়ালের মধ্যবর্তী গুমোট জটিল অবস্থান সে এক ঝটকায় পাল্টে দিয়েছে। আনিসুজ্জামান তাকে, পোশাক বদলাবার সুবিধে করে দেবার জন্য নিজের ঘরে নিয়ে গেছেন। সেখান থেকেই, পোশাক বদলাতে বদলাতে সে বলছে— হ। আমি আমাগো দ্যাশখানৈ তুইল্যা আনলাম। কী কন?
আনিসুজ্জামান সাড়া দেন— কেন বলো তো?
—এমুন জল, এমুন বৃষ্টি! সালতি একখান লাগব না-কি ক্যাডা জানে!
আনিসুজ্জামান হাসছেন। বোরখার তলায় নীলোফাও হাসছে। একখানি লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি পরে বেরিয়ে এল শমসের। ভেজা পোশাক কোথায় রাখবে জানতে চাইল। নীলোফা তার হাত থেকে পোশাক নিতে থাকল। সে বুঝি-বা দেবে কি-না ইতস্ততঃ করছিল। আনিসুজ্জামান নীলোফার পরিচয় দিয়ে বললেন— দিয়ে দাও। এ বাড়িতে নীলু যা চাইবে, না করলেই বিপদ!…আনিসুজ্জামানের কথায় শমসের হাসতে পারছে না। সে সালাম জানিয়েছে এবং চুপ করে গেছে। আনিসুজ্জামানের গৃহে এই বোরখাপ্রথা তাকে আহত করেছে। যতটুকু সে জেনেছিল আনিসুজ্জামানের গবেষণা সম্পর্কে, তাতে, একজন আধুনিকমনস্ক সংস্কারমুক্ত মানুষের কাছে সে আসছে এমনই ধারণা করেছিল। নীলোফার বোরখা তার উৎসাহ কালো করেছে। সে মনে মনে স্থির করছে, এ বিষয়ে আনিসুজ্জামানের সঙ্গে কথা বলা দরকার।
চা খাওয়া হলে শমসেরকে তৃণাঙ্কুরের কাছে নিয়ে গেলেন আনিসুজ্জামান। অন্যান্য দিন তৃণাঙ্কুর একটু দেরি করে ওঠেন। বিশেষ করে এই বাদল দিনে কিংবা যখন জাঁকিয়ে শীত পড়ে, তৃণাঙ্কুরের বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করে না। কিন্তু আজ তিনি তাড়াতাড়ি উঠেছেন কারণ আজ নীলিমার ইচ্ছায় তাঁকে চলতে হবে। রাধিকা কাজে আসছে না। তাদের ঘরে জল ঢুকে আছে। নীলিমা আবার নিজের হাতে সংসারের কাজ করছেন। কিছু অসহিষ্ণু হয়ে আছেন তিনি। কাজ-কর্ম রান্না-বান্না আর ভাল লাগে না। রাধিকার বিপদ তিনি বুঝছেন না এমন নয়। তবু অধৈর্য হয়ে উঠেছেন।
তৃণাঙ্কুর শমসেরের সঙ্গে কথা বলছেন। অধ্যাপক সমীরুদ্দিন চৌধুরী বিষয়ে কথা চলছে। আনিসুজ্জামান শুনছিলেন। নীলোফা এল। বলল— পাড়ার একজন এসেছেন ভাইজান। আপনাকে দরকার।
—কে?
—ওই যে, ডাক্তার জেঠুর ছেলে।
—কমলেন্দু?
আনিসুজ্জামান বেরিয়ে এলেন। কমলেন্দুই বটে। ভেতরে যায়নি। দরজার কাছে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আনিসুজ্জামান বললেন— কবে এলে কমলেন্দু?
কমলেন্দু বলল— কাল এসেছি। অমরেশ কাকা টেলিগ্রাম করেছিলেন। বাবার অবস্থা ভাল না।
—তাই নাকি! সত্যি তো! অনেকদিন খোঁজ নিইনি ডাক্তারদার। কী হয়েছে?
—দিন ছ’য়েক আগে দুপুরে পুজো করতে করতেই অজ্ঞান হয়ে যান। কালীতারা মাসি দেখতে পায়। চোখে-মুখে জল-টল দেবার পর একটু সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। পুজোও শেষ করেছেন। কালীতারা মাসি ডাক্তার ডাকার কথা বলেছিল। কান দেননি। মাসি নিজেই অমরেশ কাকাকে খবর দেয়। রাত্রে যখন কাকা এলেন তখন বাবা আর বিছানা থেকে উঠতে পারছেন না।
—হাসপাতালে নিলে না? বা কোনও নার্সিংহোমে?
—বাবা যাবেন না। জানেন তো বাবাকে। কথা বলতে পারছেন না। জিভ জড়িয়ে গেছে, তা নিয়েও বলেছেন— এখানে মরতে দে। বাড়িতে মরতে দে। রাত থেকে কথা বন্ধ হয়ে গেল। তার আগে শুধু আপনার নাম করলেন অনেকবার। সুবীরদা ছিলেন। বললেন, পরে ডেকো, সকাল পর্যন্ত সময় পাবে।
—সুবীরদা মানে, ডাক্তার? সুবীরব্রত?
—হ্যাঁ। আপনি কি যাবেন একবার?
—নিশ্চয়ই। একটু দাঁড়াও।
কমলেন্দুর ভাবলেশহীন মুখ। সে অপেক্ষা করতে লাগল। আনিসুজ্জামান নীলিমা ও তৃণাঙ্কুরকে মল্লিনাথের খবর দিয়ে বেরিয়ে এলেন। পোশাক বদলাবার কথা মনে রইল না। নীলোফা একটা ছাতা এগিয়ে দিল।
মল্লিনাথের ঘরে এলেন আনিসুজ্জামান। ঘরের সন্তর্পণ স্তব্ধতায় অমলেন্দুর মৃত্যুর দিনটি তাঁর মনে পড়ল। মল্লিনাথের মাথার কাছে চেয়ারে বসে আছেন মাধবী। তাঁর মুখও কমলেন্দুর মতো। কোনও ভাবান্তর নেই। পায়ের কাছে লিলি। লিলির ছেলে-মেয়েকে দেখা যাচ্ছে না। সত্যেন জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। মেঝেতে কালীতারা। মল্লিনাথ শুয়ে আছেন। গর্তে ঢুকে যাওয়া চোখ। গালে পাকিয়ে যাওয়া দাড়ি। বুকের খাঁচা জোরে জোরে ওঠা-পড়া করছে। ওঠা-পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কাঁপছেও যেন। চোখ দু’টি নিস্পৃহ। বহু দুরে সীমাবদ্ধ। হঠাৎ দেখলে মনে হয় তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছেন। আনিসুজ্জামান বুঝলেন— সময় আসন্ন। তাঁর মনে পড়ল—
The years to come seemed waste of breath,
A Waste of breath the years behind
In balance with this life, this death.
কমলেন্দু মল্লিনাথের কাছে গিয়ে ডাকল— বাবা। উনি এসেছেন।
মল্লিনাথের চোখের তারাগুলি কাঁপল। আনিসুজ্জামান শয্যা স্পর্শ না করে একটু ঝুঁকে বললেন— ডাক্তারদা, আমি এসেছি। আমি, আনিসুজ্জামান।
মল্লিনাথের স্থবির চোখ দু’টিতে জল ভরে এল। অন্তিম যাত্রার কালে যখন এই মহাপৃথিবী ডাকে, যেও না, দ্যাখো, আমরা এসেছি, আমাদের প্রিয়জন তুমি, থাকো, থেকে যাও, তখন একটু ফিরে আসার ইচ্ছা, একটু-বা লোভ এবং চূড়ান্ত অক্ষমতা জল হয়ে জমতে থাকে চোখে এবং গড়িয়ে যায়। মল্লিনাথ পক্ষীশাবকের মতো হাঁ করেন। শুকনো সাদা জিভ ভেতরে পাক খায়। আনিসুজ্জামান কী করবেন বুঝতে না পেরে এ দিক-ও দিক তাকান। মাধবী এক বাটি জল, বুঝি-বা তা গঙ্গাজলই, এনে বলেন, খুব স্বাভাবিক গলায়— ওঁকে জল দাও। উনি জল চাইছেন।
আনিসুজ্জামান অবাক হলেন। বলতে থাকলেন— আমি? আমি দেব? উনি তো আমাকে… আমার হাত থেকে… মানে শেষের দিকে উনি…
তাঁর কথা শেষ হয় না। মল্লিনাথ তাঁর জল প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এ কথা তিনি আজ পর্যন্ত কারওকে বলেননি। মাধবী বলেন— আমরা দিতে চেষ্টা করেছি। উনি মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন। এখন হাঁ করছেন। তুমিই দাও। উনি তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন।
আনিসুজ্জামান ভেতরে-ভেতরে কেঁপে উঠলেন। অমলেন্দুর মৃত্যুর দিন এই মহিলা সম্পূর্ণ অপ্রকৃতিস্থ ছিলেন। তাঁর পক্ষে হয়তো-বা তা আশীর্বাদই হয়েছিল। কিন্তু আজ তাঁর স্বাভাবিকতা যেন আরও এক অপ্রকৃতিস্থতারই অভিব্যক্তি। মানুষের সুস্থতাও যে কখনও এমন অসহ্য হতে পারে, আনিসুজ্জামান ইতিপূর্বে টের পাননি। তিনি বাটি হাতে নিলেন। একটি ছোট চামচ এগিয়ে দিলেন লিলি। আনিসুজ্জামান চামচে জল নিয়ে মল্লিনাথের মুখের কাছে ধরলেন। তাঁর হাত কাঁপছিল। বললেন— ডাক্তারদা, জল খাবেন কি?
মল্লিনাথ হাঁ করলেন। লিলি বললেন— ‘তিনবার দিন।’ একটু একটু করে তিনবার জল দিলেন আনিসুজ্জামান। মল্লিনাথ মুখ বন্ধ করলেন। চোখ বন্ধ করলেন। মাথাটা ঈষৎ কাত হল। মল্লিনাথ চলে গেলেন।
সমস্ত কান্নার শব্দ থেকে পালাবার জন্য বেরিয়ে এলেন আনিসুজ্জামান। তাঁর মন ভারাক্রান্ত হল। একটা মানুষ শুধু মিথ্যে দুঃস্বপ্নের তাড়া খেয়ে দগ্ধ হতে হতে চলে গেলেন। একটা মানুষ, যিনি নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে, সমস্ত অশুভ সম্ভাবনার সঙ্গে লড়তে চেয়েছিলেন সংস্কার আঁকড়ে। তিনি ভুল করেছিলেন। এই ভুলের উপলব্ধি হয়েছিল তাঁর। তাই, মৃত্যুর আগে তিনি ক্ষমা চেয়ে গেছেন। আশ্চর্য সেই ক্ষমা চাওয়ার অভিব্যক্তি! আশ্চর্য সেই পাপ প্রক্ষালন। মাত্র তিন চামচ জল দিয়ে তা সম্পন্ন হয়। মাত্র তিন চামচ জলে আনিসুজ্জামানের সমস্ত অপমানবোধ ধুয়ে যায়!
নীচেরতলার সিঁড়ির মুখে একলা দাঁড়িয়ে ছিল কমলেন্দু। আবার বেরুবে। তার মুখ নিস্পৃহ। করুণ। আনিসুজ্জামান ছাতা খুলছিলেন। কমলেন্দু অসহায় গলায় বলল— কাকে কাকে খবর দিই বলুন তো! অমরেশকাকা ও দিকটায় গেছেন।
আনিসুজ্জামান বলেন— আমি লাইব্রেরির দিকে কয়েকজনকে বলছি। সবাই খবর পেয়ে যাবেন। তুমি আর এখন বেরিয়ো না।
কমলেন্দু চুপ থেকে শুধু মাথা নাড়ে। একটি বিষয় মনে পড়ে যায় আনিসুজ্জামানের। প্রশ্ন করা উচিত হবে কি হবে না ভেবেও শেষ পর্যন্ত প্রশ্নটি রাখেন তিনি— তোমাদের পুজোর কী করবে? কমলেন্দু?
কমলেন্দু ম্লান হাসে। জবাব দেয়— মা’র ইচ্ছে পুজোটা রাখি। নিয়মিত প্রতি অমাবস্যায় করা তো সম্ভব হবে না। আর বাড়ির রীতি অনুযায়ী বড় ছেলে ছাড়া তা করার অধিকারও কারও নেই। ওই বছরে একবার আসব, পুজো দেব। এই।
আনিসুজ্জামানের মনে হয়, সত্যিই সংস্কারের মৃত্যু নেই। সংস্কার অমর।
৫৩
একটানা চারদিন বৃষ্টি হচ্ছে। সমস্ত খাল-বিল জলে ভর্তি। ফটিকবিলের জল রাস্তার এ পার থেকে ও পারে পড়ছে। যার জানা নেই তার পক্ষে চট করে ঠাহর করা মুশকিল যে ওখানে আলাদা কোনও বিল আছে। গোটা এলাকাই এখন খাল-বিল-জলাভূমি। বাদল আকাশ ক্রমশ-ক্রমশ-ক্রমশ নেমে আসছে নীচে যেন ছুঁয়ে দেবে অরুণ সেনের বাড়ির ছাদ। মাগো! এ কত বছরের জমা বর্ষা! কত দিনের অবরুদ্ধ জল!
পি ডব্লু ডি রোড বন্ধ। ট্রাক বাস চলছে না। ট্রেনও বন্ধ। কোথাও কোথাও রেললাইনের ওপরে জল উঠে গেছে। ফটিক বিল বস্তির বেশ কয়েকটি বাড়ির দেওয়াল ধসে গেছে। সেইসব বাড়ির লোকেরা প্লাস্টিকের ছাউনি বেঁধে রেললাইনের ওপরে উঠে গেছে। যে-যার নিজেকে সামলাচ্ছে। কারও কোনও দিকে তাকাবার সময় নেই। সামান্য সাংসারিক বস্তু সামান্য তল্পি-তল্পা বাঁচাতে জান-জীবন বেরিয়ে যাচ্ছে, আর সেই জীবন বাঁচাবার জন্য মাথার ওপর ছাদ বলতে প্লাস্টিকের ছাউনি। মাথুরের গড়ের গৃহিণীদের খুবই কষ্ট এই সময় কারণ কেউই আপন সংসার ও তার ভেসে যাওয়ার সম্ভাবনা ফেলে কাজে যাচ্ছে না।
প্রথম দু’দিনেই যখন হাঁটুর ওপর পর্যন্ত জল উঠল তখনও কারও ভয় করেনি। প্রতিবারের মতোই এই বাৎসরিক বিপর্যয় তাদের এই ভরসায় রেখেছিল যে বৃষ্টি কমলেই জল নামতে শুরু করবে আর তারা আবার স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবে। কিন্তু তৃতীয় দিন বৃষ্টি তো কমলই না। বরং খাল-বিল এক হল। মাটির মেঝে গলে গেল। ছাদ ফুটো হল। দেওয়াল ধসে পড়ল।
কলকাতার নানা জায়গা বন্যাবিধ্বস্ত হওয়ায় বিপর্যয় ঢুকে পড়েছে। কে বাঁচাবে, ত্রাণ করবে কে? আগে তো বন্যাকে বন্যা বলে সরকারি ঘোষণা জারি হোক— তারপর ত্রাণ। এই মাথুরের গড়ের একটুখানি ফটিক বিল বস্তি, কতখানি জল জমলে, কতখানি ক্ষতি হলে বন্যার্ত এলাকায় পড়া যায় জানে না, তবে বন্যাকবলিত মানুষের মতোই অকৃত্রিম ত্রাস ও খাঁটি জীবনধারণের তাগিদে সামান্য পোঁটলা বেঁধে, খোকাখুকু কোলে করে, ভাঙা ধসে পড়া ঘরের মানুষেরা ছুটে যাচ্ছে উঁচু কোনও ডাঙাভূমির সন্ধানে। আপাতত পার্শ্ববর্তী রেললাইন নাকটুকু জাগিয়ে রেখেছে। সেই এক ভূমির আশ্রয়। মাথুরের গড়ে হাঁটু-ডোবা জল। সেইখানে বাবুদের বাড়ি। আর তাতে আশ্রয় দেবে তেমন বাবু তারা নয়। এবং এই জলে মাথুরের গড়ও বিপন্ন বোধ করছে কারণ হাঁটু-ডোবা জলও জমে ওঠার কাহিনী এ অঞ্চলে কখনও শোনা যায়নি।
রাধিকা কাজে যাচ্ছে না। এই জল, এই বৃষ্টিতে যখন বিদ্যুৎ আকাশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছড়িয়ে যাচ্ছে, আর জল জমছে, ঘরে এক দানা আনাজ নেই, চাল ভিজে পচা গন্ধ বেরুচ্ছে তখন তার দুধের ছেলেকে সে কার ভরসায় রেখে বেরুবে? তার বালক পুত্র পলাশকে সে কার ভরসায় কাছছাড়া করবে! ফটিকবিলের সীমানা আর আলাদা করা যায় না। তাদের রূপসী নদী যেমন হত বর্ষায়, বিশাল, ভয়ঙ্করী, চরাচরগ্রাসী— এই বর্ষায় সামান্য ফটিকবিলকেও তেমনই লাগছে রাধিকার। যদি ঔৎসুক্যে কাছে যায় পলাশ! আর সীমানা বুঝতে না পেরে ডুবে যায়! ভয়ে বুক কাঁপে তার।
খিলপাটনি গাঁয়ে বর্ষা এলে আশ্রয় যাবে এমন ভয় ছিল না। এখন সে-ভয় মনের মধ্যে পাক খাচ্ছে। সংসার গেল বুঝি। দুই ছেলে নিয়ে এ বার সত্যি নিরাশ্রয় হল বুঝি রাধিকা। তার ঘরের চাল ফুটো হয়ে বৃষ্টি ঢুকছে অবিশ্রাম। ঝর ঝর টপ টপ। পলাশ ভয় পেয়ে মায়ের কোলের কাছটিতে এসে বসেছে। তাদের উঁচু বিছানা অবধি জল চলে এসেছে। তোশক ভিজে সপসপ করছে। যেন মড়া স্বামীর বদলে দুই জ্যান্ত সন্তান নিয়ে এ বার ভাসানে যাবে আধমরা বেহুলা।
জল থেকে কীট, কেন্নো, কেঁচো, বিছে উঠে পড়ছে বিছানায়। পলাশ একটি কাঠি নিয়ে বসে আছে। পোকা দেখলেই খুঁচিয়ে ফেলে দিচ্ছে। তার ভয়, একটি সাপ না উঠে পড়ে। ঘোলা জলে মাঝে মাঝে এমনকী দেখা যাচ্ছে শিঙমাছ সাটিমাছ। সেইসবে মন নেই পলাশের। ভেজা তোশকে বসে বসে তাদের গায়ের চামড়া জ্বালা করছে। ঘুম নেই। খিদে মেটেনি। ত্রাস আর অজানিত ভয়। ঘেন্না আর অস্বস্তি। আর সীমাহীন কষ্ট। কষ্টে চোখ-মুখ কালো। ক্লিষ্ট। জোছন সারাক্ষণ কেঁদে-কঁকিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে এখন। পলাশ মায়ের দিকে চেয়ে আছে। বারেবারে বলছে— বৃষ্টি কখন থামবে, মা? জল নামবে কখন?
সে জানে মা এক বর্ষাদেশের মেয়ে। মা মেঘ চেনে। বৃষ্টি চেনে। মায়ের সেই দেশে বাদলদিনে সালতি নিয়ে ভেসে পড়তে হয়। সেখানে জলে ভেসে এ বাড়ি-ও বাড়ি যাও। এ উঠোন থেকে চলে যাও অন্য উঠোনের জলে। কিন্তু এখানকার জলজমা ঠিক ওখানকার মতো নয়। সে ছিল নদী। পলি আনত। মাটি ভাঙত। ঘোলা যদি হতও সে বিশুদ্ধ মাটি মেখে। এখানে সব নোংরা। সব ময়লা। মল, মূত্র, রক্ত, কফ। আবর্জনা ধোয়া। পলাশের গা গুলোয়। রাধিকারও গা গুলোয়। শরীরে ভয়, ঘেন্না, খিদে অহরহ জড়াজড়ি পাক খায়।
এখানে এই প্রথম বর্ষা রাধিকার। অন্যদের কাছে শুনে সেও প্রথম ভেবেছিল জল নেমে যাবে। কিন্তু যখন সব ঘরের চাল ফুটো হল আর একে একে এ বাড়ি-ও বাড়ির দেওয়ালগুলো ধসে পড়ল, জল বাড়তে বাড়তে সর্বস্ব খায়, তখন সে ভাবছে— কার বাড়ি যাবে! কার বাড়ি যাওয়া যায়! জোছনের জ্বর আসবে হয়তো। তার নাক দিয়ে জল পড়ছে। পলাশের বুঝি পেটের অসুখ করবে কারণ সে ঘেন্নায় জড়সড়। কী করে রাধিকা? কার্তিক ত্রাতা হয়ে আসবে তা স্বপ্নেও ভাবে না সে। শেফালির মা কি আশ্রয় দেবে? সেখানেও জল। শুনেছে সে। তা হলে? তৃণাঙ্কুর! তৃণাঙ্কুরের কাছে যাবে? নীলিমা কি তাড়িয়ে দেবেন? বলবেন— ‘এত ঝক্কি কী করে পোহাব বাপু!’ না। বলবেন না। মানুষটা তো খারাপ নন। আর, তা ছাড়াও, এমন বোধ রাধিকাতে আজও অন্তর্গত যে সমস্ত বিপন্নতা নিয়ে অনাহূত কোথাও আশ্রয় চাইতে নেই। এবং যতখানি অপারগ ও দিকদিশাহীন অবস্থা এলে আশ্রয় আত্মসম্মানের চেয়েও বড় হয়ে ওঠে ততখানি রাধিকারও অস্তিত্বে পৌঁছে গেল কি-না সে-বিষয়ে সে নিশ্চিত নয়। তবু, সে জোছন শিশুটির দিকে দেখে, বালক পলাশের দিকে দেখে এবং ভাবিত হয়। সে যদি একবার যেতে পারত! একলা, সন্তানদের কারও হেফাজত করে, যদি বলতে পারত অবস্থা আর নীলিমা তাকে আদেশ করতেন—ছেলেদের ফেলে না রেখে এখানে নিয়ে এসো—যদি তা হয়, তবু এই বিপদে নিশ্চয়ই রাধিকাকে ফিরিয়ে দেবেন না তিনি। কিন্তু এখন যাবেই-বা কী করে! এই বুকজলে, কোমরজলে পলাশকে নিয়ে, জোছনকে নিয়ে কী করে পথ ভাঙে সে! ভাবছে, একটু জল নামুক, তারপর যাবে। তার ভাবনা হচ্ছে। নীলিমা ও তৃণাঙ্কুরের জন্যও ভাবনা হচ্ছে। একজন বৃদ্ধা। একজন আধাপঙ্গু। আহা। তাঁদের না-জানি কত কষ্টই হচ্ছে! তার মনে পড়ছে শমসের চৌধুরী বলে একজন আসবে ঢাকা থেকে। একবার শমসের মিলিয়ে যাচ্ছে। ভেসে আসছেন তৃণাঙ্কুর। তাঁর সব কথা, সব আর্তি, সব করুণ প্রার্থনা ও খুশি, সমস্ত অসহায়তা তাঁর! রাধিকা আকুল হয়। তার পলাশের মতো যেমন, জোছনের মতো যেমন তেমনিই তৃণাঙ্কুরের জন্যও। আবার শমসের আসে। চলে যায়। তৃণাঙ্কুর আসেন। থাকেন অনেকক্ষণ। চলে যান। আবার শমসের আসে। ঢাকা থেকেই আসবে কি সে? নাকি খিলপাটনি গাঁ থেকে গাঁয়ের গন্ধ নিয়ে? এই বর্ষায় সে কেমন করে আসবে! রাধিকার মনে পড়ে— এমনই জলমগ্ন গাঁয়ে, এমনই ঘোর বর্ষায় সে সেইদিনও ভেবেছিল কেমন করে সে আসবে? কিন্তু সে এসেছিল। তাকে আটকানো যায় না বুঝি। দাবিয়ে রাখা যায় না। সে সব বর্ষার দিনে পৌঁছয়। কত কাল, কত যুগ পেরিয়ে যেতে থাকে, তবু সে পৌঁছয়। সে বারবার বর্ষা বুকে করে, সালতি নিয়ে ভেসে ভেসে পৌঁছে যায় গ্রামে, আর পৌঁছে যায় ভাঙা মন্দিরের দাওয়ায়, আর বজ্রবিদ্যুৎ সাক্ষী করে তুমুল জলধারার মতো জাপটে নেয় রাধিকাকে। অপূর্ব ভালবাসায় কাছে টানে। বলে— ভালবাসি। ভালবাসি। ভালবাসি। অসামান্য প্রেমে সে দু’ঠোঁট নামিয়ে দেয় ঘাড়ের কুচো কুচো চুলে, কপালে, চোখে, গালে। সেই ঠোঁট ত্বক ভেদ করে শিরা, উপশিরা বেয়ে চলে গেছে কোন অন্তঃস্তলে! রাধিকা ভাবে। ভাবতে ভাবতে ভেজা তোশকের থেকে, ভেজা পোশাকের থেকে, পচা চাল ও পচা জলের গন্ধ ও দুই অসহায় সন্তানের থেকে পৃথক হয়ে পৌঁছে যায় জলমগ্ন গাঁয়ে, ঝুপসি বটগাছের নীচে ভাঙা মন্দিরতলায়। জলমগ্ন বস্তির মধ্যেই সে আবিষ্কার করে তার গ্রাম! আর নিরাপত্তাবিহীন অনিশ্চয়তার মধ্যেও সে স্মরণ করে পদাবলীর আখর—
আমার মনের কথা শুনো গো সজনি।
শ্যাম বঁধু পড়ে মনে দিবস-রজনী॥
কিবা গুণে কিবা রূপে মোর মন বান্ধে।
মুখেতে না সরে বাণী দুটি আঁখি কান্দে॥
চিতের অনল কত চিতে নিবারিব।
না যায় কঠিন প্রাণ কারে কি কহিব॥
তখন বাইরে চিৎকার ওঠে— জল বাড়ে। জল বাড়ে। কে আছ ঘরে…এ…এ। চলে এসো। এসো…ও…ও।
পলাশ রাধিকাকে ঠেলা দেয়— মা, অ মা, কী কয়! বাইর যাইতে কয়! অ মা!
রাধিকা চমকায়— অ্যাঁ! কী! কী!
বুকজল ঠেলে রাধিকার ঘরে আসে মাস্টার, হর ও অন্যান্য যুবক পুরুষ। তারা সাবধান করে। চেঁচায়— চলে আসুন। বেরিয়ে আসুন। বান আসছে। জল যা বেড়েছে— এখুনি গোটা বস্তি চলে যাবে জলের তলায়।
হর পলাশকে কাঁধে নেয়। মাস্টার জোছনকে তুলে ধরে। রাধিকা জলে নেমে আসে। জোছন ঘুম ভেঙে কাঁদছে। আরও কত কান্নার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে তার কান্না। শোনার অবকাশ নেই। ভোলানোর সময় নেই। সকলেই প্রতি মুহূর্তে টের পায় জল বাড়ছে। দলে দলে লোক হাঁটছে। একটুখানি ডাঙার সন্ধানে হাঁটছে। জেগে থাকা রেল লাইনে ছুটছে। প্লাস্টিক ছাউনির নীচে গাদাগাদি বসে থরথর কাঁপছে। চেঁচাচ্ছে। কাঁদছে। ভয়ের কান্না। সব হারানোর কান্না। সব গেল। সব গেল। ওই কি তাদের বস্তি? ওই কি তাদের সংসার? ভাঙা হোক, শূন্য হোক, তবু ওই তো তাদের গেরস্থালি!
অন্ধ বাপের মাথা কোলে করে বসে আছে। বুকে আগলেছে একটি মাত্র ডায়রি। মাস্টারের সংগৃহীত সমস্ত ইতিহাসের একটি মাত্র কণা। বাকি সব ইতিহাস ডুবে গেছে। যেমন যায়, চিরকাল। প্রায় সবটাই ডুবে গিয়ে ভেসে গিয়ে জেগে থাকে একটুখানি স্মৃতি। ইতিহাস নাম। কান্না নয়। হাসি নয়। কিছু কথা। কিছু কীর্তি।
বস্তি নেই। বিল নেই। জল জল জল। বস্তিতে-বিলে একাকার যেমন অন্ধকারে নারী-পুরুষ।
এতগুলি মানুষ! কোথায় যায়! কী করে! মাস্টার ও অন্যান্য পুরুষেরা ভাবছে। চিরকাল ডাঙা হয়ে জেগে থাকা মাথুরের গড়ে হাঁটুজল। তারা মাথুরের গড়ে আশ্রয় চেয়ে যাচ্ছে। বুকজলে এগোয় সাধ্য কী? তবু এগোতেই হয়। এ পার থেকে শ্যামাকান্ত দায়িত্বশীলতার সঙ্গে রওনা হয়েছিলেন তখন। তলিয়ে যাওয়া ফটিকবিলের মানুষজনের জন্য যাচ্ছিলেন। বুকজল ঠেলে এগুনো। মাঝামাঝি জায়গায় দেখা হল দু’ দলের। বর্ষা ভারী হচ্ছে। আরও ভারী হচ্ছে। শব্দে কথা শোনা যায় না। শ্যামাকান্ত নেতৃত্ব দিচ্ছেন। চিৎকার করছেন— ভাই সব, এখন আর পার্টি নয়, নীতিবিরোধ নয়, এই চরম বিপদের দিনে আসুন আমরা মতবিরোধ ভুলে বস্তির বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়াই।…
মানুষের পাশে মানুষই দাঁড়ায়। স্বাভাবিক অবস্থায় নয়। মনুষ্যত্ব প্রমাণের জন্য মানুষের জীবনে সব সময়ই কোনও বিপর্যয় প্রয়োজন হয়েছে।
ছাতা নিয়ে লাভ নেই, তবু ছাতা মাথায় যুবদল কাজে নেমে পড়েছে। শক্ত কাজ। মিছিলে হাঁটা নয়। গুছানো বক্তৃতা দিয়ে ফিরে এসে আরামের মাছের ঝোল ভাত ও আলুপোস্ত খাওয়া নয়। এ এক সত্যিকারের বিপর্যয়ের মোকাবিলা। বন্যা। এ কি বন্যা? কে জানে বন্যা ঘোষণা করা হবে কি না। সাধারণ লোক বন্যাকবলিত হলেও, বন্যার গ্রাসে দুর্গতিপ্রাপ্ত হলেও, আশ্রয়হীন খাদ্যহীন হলেও সরকার যতক্ষণ না ঘোষণা করছে—হ্যাঁ, এই জলোচ্ছ্বাস, এই বিপর্যয়, এই বিদঘুটে আকাশ, এই বিশ্বাসঘাতক বৃষ্টি— এদের ষড়যন্ত্রে যে-অব্যবস্থা তার নাম বন্যা বটে। বিশ্বাস করুন ভাইসব— এই বন্যার জন্য আমরা মোটে প্রস্তুত ছিলাম না— ততক্ষণ বন্যা নয় বন্যা। খরা নয় খরা। বিপর্যয় নয় বিপর্যয়।
কিন্তু বন্যা ঘোষিত হোক বা না-হোক, কাজ না করলে চলবে না। সেইসঙ্গে সরকারের বিরোধিতা না হয় তা দেখতে হবে। সরকার বন্যা ঘোষণা না করলে বলতে হবে জল উঠেছে। সতীন সেনে জল উঠেছে। নিয়োগীপাড়ায় জল উঠেছে। উদ্বাস্তু কলোনিতে জল উঠেছে। ফটিকবিল বস্তি জলের তলায়…
শ্যামাকান্ত মাথুরের গড় আদর্শ বিদ্যালয়ের বাড়িতে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছেন। একতলায় জল ঢুকেছে। থাকার ব্যবস্থা দোতলায়। আনিসুজ্জামান শমসেরকে নিয়ে বেরিয়ে এসেছেন। ছেলের দলে যোগ দিয়েছেন। শ্যামাকান্ত দল ভাগ করছেন। ছাতা মাথায়, মাথা ঠাণ্ডা করে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সকলে তাঁর নেতৃত্ব গ্রহণ করছে। তিনি স্থির করছেন— রেললাইনের ওপর থেকে মানুষগুলিকে স্কুল পর্যন্ত নিয়ে আসার দায়িত্ব নেবে কারা। এই দীর্ঘ জলমগ্ন পথ কিছু কম নয়। কারা বাড়ি বাড়ি ঘুরে চাল-ডাল সংগ্রহ করবে। কারণ এখনও কোনও ব্যয়ভাণ্ডার নেই। কারা থাকবে বিলি-বণ্টন ও ব্যবস্থাপনায়। শামাকান্ত আনিসুজ্জামানকে বলছেন— খাবার বিলি করার সময় আপনি থাকুন।
জল আরও বাড়ছে। সকলে আকাশ দেখছে। মেঘ সরে যাবার কোনও চিহ্ন নেই। শমসের ও আনিসুজ্জামান দেখছেন— প্রত্যেক দল একনিষ্ঠ কর্তব্য পালন করছে। এই বিপর্যয় কর্তব্যপালনের সময়ও বটে যেমন মনুষ্যত্ব দেখাবার সময়। আনিসুজ্জামান শমসেরকে নিয়ে নিজের দায়িত্ব পালন করার জন্য অপেক্ষা করছেন। শমসের এক বর্ষার দেশ থেকে এসে এ দেশের বন্যা ও বিপর্যয় দেখছে। সে ভাবছে, মাত্র তিরিশ বছর আগে দু’দেশে একই বর্ষা হত। এখন বর্ষাও ভাগ হয়ে গেছে।
ভেজা কাপড়ে, ভেজা শরীরে, শীর্ণ, সাপটানো, সব খোয়ানো মানুষের মিছিল আসছে। কেউ ছেলে কোলে নিয়ে, কেউ বৃদ্ধ পিতাকে কাঁধে নিয়ে, কেউ সামান্য সম্বল মাথায় করে আসছে। মাস্টার অন্ধকে পিঠে নিয়েছে। অন্ধ বলছে— আমায় নামিয়ে দাও।
—না।
—আমি ঠিক চলে যাব।
—না। পড়ে যাবি। জলে ডুবে যাবি রে অন্ধ।
—ডুবে গেলে কী? আমি তো কারও কাজে লাগব না মাস্টারকাকা।
—লাগবি। অন্ধ। আমাদের ইতিহাস পড়তে হবে না?
—তোমার মাত্র একটাই ডায়রি বাঁচানো গেল। আর সব চলে গেল।
—যাক।
—তোমার সব ইতিহাস, সব বই, সব লেখা চলে গেল।
—যাক। আমরা তো রইলাম। মানুষ থাকলেই ইতিহাস তৈরি হবে অন্ধ।
—আমি জলের গন্ধ পেয়েছিলাম মাস্টারকাকা।
—চুপ অন্ধ চুপ। এ কথা আর কারওকে বলিস না।
অন্ধর কান্না পাচ্ছে। সে জলের গন্ধ পেয়েছিল। ভাসানের গন্ধ পেয়েছিল। কিন্তু এই ভাসান কী ভয়ঙ্কর! মাস্টার অসুস্থ ছিল। তবু অন্ধকে বইছে। অন্ধ কত অসহায়। তার ভাল লাগে না। ভাল লাগছে না। অবধারিত অর্থহীন লাগছে নিজেকে। আদ্যোপান্ত অপ্রয়োজনীয়। মাস্টার যতই ইতিহাস পড়তে প্রলুব্ধ করুক, অন্ধ, তার পিঠে চেপে নিজেকে বোঝা ভাবা থেকে বিরত থাকতে পারছে না। সে ফের বলতে থাকছে—আমার বেঁচে থেকে আর কী হবে মাস্টারকাকা?
—কেন রে?
—এই যে, তুমি, তোমার অসুস্থ শরীর, আমাকে পিঠে করে টানছ…
—তাতে কী?
—তুমি তো বলো মানুষের উচিত তার নিজের ভার বইতে পারার শক্তি অর্জন করা, নইলে আর মানুষ কীসে? আমি আর নিজেকে বইতে পারছি কই!
—শুধু কি নিজের দেহ বয়ে চলার কথাই আমি বলেছি রে অন্ধ? মানুষকে আসলে বইতে হয় তার বোধ, উপলব্ধি, অনুভূতি। অন্ধ, শরীরের চেয়ে মানুষ অনেক বেশি দায়বদ্ধ তার বিশ্লেষণী শক্তির কাছে।
—বিশ্লেষণী শক্তি? মাস্টারকাকা? সেও তো তা হলে শক্তিই হল। তুমি যে বলো মানুষের শক্তিই তার সার্থকতা—আমার সার্থকতা কই?
—শোন, অন্ধ, শোন। পৃথিবীতে সবার ভূমিকা এক হয় না। এই যে আমি তোকে নিয়ে যাচ্ছি অন্ধ, আমার নিজের জন্মের বেশ একটা অর্থ আছে এতে। যেন আমার জন্ম, আমার বেঁচে থাকা শুধু আমার জন্যই নয়। তোর জন্যও। মানুষ হিসেবে এই পৃথিবীতে আমার নিজের কাছে নিজের প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছিল। তোকে পিঠে নিয়ে মনে হল, না, এটুকু সার্থকতা তো আজও ফুরোয়নি। অন্ধ, এই যে জলে ডুবে গেল আমাদের বস্তি, এই যে আমার এত আগলে রাখা ইতিহাস ভেসে গেল, এই যে আমরা এখন রিলিফের খিচুড়ি খেতে যাচ্ছি আর ইশকুলে থাকব কত দিন কে জানে, এর পরও, আমার আবার নতুন করে বাঁচতে ইচ্ছে করছে। জল নেমে গেলে আবার আমরা নতুন করে ঘর বেঁধে ফেলব দেখিস।
—সেই ঘরটা কেমন হবে মাস্টারকাকা? আর জলে ধসে পড়বে না?
—জানি না অন্ধ। হয়তো পড়বে। হয়তো আগামী বছর আবারও আমরা সব ডুবিয়ে বুকজল ভেঙে আশ্রয়ের জন্য হাঁটব কিন্তু আমরা ধ্বংস হব না।
—তখনও আমার কোনও কাজ থাকবে না, বলো, তখনও আমি তোমার পিঠে চেপে জল পার হব।
—অন্ধ, মানুষ যেমন নিজের শক্তি সম্পর্কে অবহিত হবে তেমনি পরস্পরের জীবনকে সার্থক করে তোলাও তার কাজ। অন্যকে সার্থক করেও নিজের জীবনের অর্থ পাওয়া যায়।
—তবু… কারও পিঠে চেপে জল পার হওয়া… এ তো সবসময়ই বিশ্রী, না, মাস্টারকাকা? নিজেকে একটা বোঝার মতো লাগে না?
—দরকার হলে আমরা এ ওর বোঝা একটু নেব না, অন্ধ? মানুষের সার্থকতা একমুখী নয় রে। একমাত্রিকও নয়। মানুষ একটা মানুষের শরীর নিয়েই জন্মায়। তার মধ্যে কিছু ক্ষমতা। উপলব্ধি। আচরণ। এর পর তাকে প্রতিনিয়ত ভাবতে হয়, ওই ক্ষমতা সে কীভাবে ব্যবহার করবে, ওই উপলব্ধি সে কী করে অভিব্যক্ত করবে, ওই আচরণ সে নিয়ন্ত্রণ করবে কেমন করে। ভাবতে হয়, ভাবতেই হয়, কারণ, এরই মধ্যে দিয়ে তার প্রকৃত মনুষ্যত্বের লক্ষণগুলি ফুটে উঠবে।
মাস্টার আকাশের দিকে দেখে। ভ্রূ কুঞ্চিত বাদল। কালো রাগী মেঘ। হালকা আলো আছে। সূর্য নেই। অবিশ্রাম বৃষ্টিপতন। কখনও ভারী, কখনও হালকা। মাস্টারের মনে হয় এই ভিজতে থাকা কোন অনাদি অতীত থেকে, এই জল ভেঙে চলা যেন চলবে চলছে আবহমানকাল। তখন, একটি জলস্থ গর্তে মাস্টারের পা পড়ে। সে একটু টাল খায়। অন্ধ জোরে আঁকড়ে ধরে মাস্টারকে। মাস্টার ঝাঁকি দিয়ে তাকে ঠিকঠাক পিঠে বসিয়ে নেয়। তারপর বলে—গলাটা ভাল করে জড়িয়ে ধর অন্ধ। হাত আলগা করিস না।
অন্ধ তবু ভাবছে নিরন্তর। যেন তার সংশয় ঘোচে না। অন্ধত্ব ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার মতোই সংশয় নিরসন নির্মম অসম্ভব। এ শুধু চাইতে পারা যায়। এবং চাইতে থাকলেও তার একা লাগে। নিঃসঙ্গ লাগে। আর মাস্টার? সেই বা কী? ইতিহাস হতে চাওয়া মানুষ। সে কি নিঃসঙ্গ নয়? ইতিহাস কি নিঃসঙ্গ নয়? একজন নিঃসঙ্গ একজন অসহায়কে কাঁধে তুলে জল ভেঙে চলেছে। তারা পরস্পর বন্ধুত্ব প্রর্থনায় রয়েছে। কে যে কখন কার বন্ধু হয়ে যায়, কে কার বন্ধুত্ব প্রার্থনা করে, কে বলতে পারে? যেমন শমসের ও আনিসুজ্জামান— দুই দেশের দুই যুবা, বয়সে অসমান, প্রথম দিনযাপনে পরস্পরের প্রতি বন্ধুত্ব অনুভব করছেন। মেঘলা আকাশ ও বারিপাতের নীচে, বিপর্যয়ে ও দায়িত্বশীলতায় তাঁরা পরস্পর দর্শনবিনিময় করে নিচ্ছেন। শমসের প্রশ্ন করছে— অ্যাকখান কথা জিগাই?
—হ্যাঁ। নিশ্চয়ই।
শমসের বলছে। শান্ত ও দৃঢ়ভাবে। তার নিজস্ব ভাষা ও উচ্চারণে— আপনেরে দেইখা অবাক লাগে।… হ্যাঁ। সত্যি। অবাক লাগে আপনাকে দেখে কারণ আপনি ধর্মের অনুশাসন মানেন না, নিয়ম মানেন না, অথচ আপনার বাড়িতে এখনও মেয়েদের বোরখা পরতে হয়।
আনিসুজ্জামান হাসেন। সে হাসি করুণ লাগে। ঠিক প্রশ্নই করেছে শমসের। সঙ্গত প্রশ্নই করেছে। তিনি বলেন— মেয়ে মানে তো একা নীলোফাই।
—হ।
আনিসুজ্জামান চুপ করে থাকেন কিছুক্ষণ। তার বুকের মধ্যে ভয়ের সিরসিরানি বাড়ে। কারণ, নীলাফা প্রসঙ্গে এসে তাঁর আবার মনে পড়ে গেছে কোন বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। এই বর্ষা থেমে যাবে। বন্যার জল নেমে যাবে। কিন্তু আনিসুজ্জামানের বিপর্যয় বৃদ্ধি পাবে ক্রমশ। তাঁকে কোনও উপায় খুঁজতে হবে। কী উপায় তিনি জানেন না। এই বন্যার্ত মানুষগুলির চেয়েও নিজেকে বেশি বিপন্ন ও অসহায় লাগে আনিসুজ্জামানের। শমসের, আনিসুজ্জামানের নীরবতায় সতর্ক হয়। প্রশ্ন করে—কিছু মনে করলেন কি? বললাম বলে? আনিসুজ্জাদা?
আনিসুজ্জামান শমসেরের পিঠে হাত রাখেন। ধীরে ধীরে নীলোফার পুড়ে যাবার বৃত্তান্ত বলতে থাকেন তিনি। শমসের স্তব্ধ হয়ে শোনে। আনিসুজ্জামানকে বিষণ্ণ ও গম্ভীর দেখায় এখন। এই বিষণ্ণতা কাটাতে দুর্গাবিষয়ক বইটির প্রসঙ্গ আনে শমসের। বলতে চায়, বইখানি প্রশংসনীয় কর্ম বটে। আনিসুজ্জামান বলেন— এ নিয়ে বহু প্রশ্ন উঠেছে।
—কী প্রশ্ন?
—মুসলমান হয়েও আমি পৌত্তলিকতা বিষয়ে কথা বলেছি। কারও কারও মতে এটা ইসলামবিরোধী কাজ। আবার কোনও কোনও হিন্দুর মত হল, দুর্গাবিষয়ে আমার বই লেখা অনধিকার চর্চা। আমি হিন্দুধর্মকে অপমান করার জন্য এটি লিখেছি।
শমসের মুখ নিচু করছে। আনিসুজ্জামানের বিষণ্ণতা তাকেও স্পর্শ করছে। সে বলছে— শুধু বিরোধ। শুধু ভাঙন৷ হিন্দু আর মুসলমান। মুসলমান আর হিন্দু। এ কি কোনওদিন মিটবে না? মিটতে পারে না? একই মানুষের শরীর! চামড়ার নীচে একই লাল রক্ত! একই প্রাণ! আনিসুজ্জাদা, আমি আমাদের সব নিয়ম মানি। অন্তত বাড়িতে যখন থাকি তখন আব্বার সামনে আমার নিয়ম না মেনে উপায় নেই। মানতে আমার খারাপও লাগে না। কিন্তু এই স্বধর্মবোধ আমাকে কখনও হিন্দুবিরোধী করেনি। কেন করেনি আমি জানি না। কতদিন আগে এক হিন্দু মেয়েকে আমি ভালবেসেছিলাম। সেই আমার প্রথম ও শেষ ভালবাসা।
সে বলে যায়। আত্মগতভাবে বলে যায়। বড় দুঃখী ছিল সেই মেয়ে। আর তাকে দেখেই তার হৃদয়ে প্রেমের উন্মেষ হয়েছিল। একদিন, এরকমই বৃষ্টির বিকেলে তাকে বুকে সাপটে নিয়েছিল সে। ভাঙা মন্দিরের অন্ধকার বারান্দায় প্রেমিকাকে বুকে নিয়ে অপার শান্তির সন্ধান পেয়েছিল। তখন শুধু শান্তিটুকু ছিল, সুখ ছিল, স্বপ্ন আর আকুল উদাস ভালবাসা। তার মধ্যে এতটুকু হিন্দুত্ব বা মুসলমান ছিল না। মানুষের সঙ্গে মানুষের এরকমই তো হওয়ার কথা, আনিসুজ্জাদা, কেন হয় না?
আনিসুজ্জামান শমসেরের হাত ধরেন। বলেন— আসলে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কটা এরকমই, শমসের। আমরা তা কেবল ভুলে থাকি। কিন্তু সেই মেয়েটির কথা বলো। সে কোথায় এখন?
—হারিয়ে গেছে সে, আনিসুজ্জাদা। আমি ঢাকায় পড়তে চলে গেলাম। রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লাম। নিয়মিত গ্রামে যাওয়া হত না। শুনলাম তার বিয়ে হয়ে গেছে। একটা আধবুড়ো লোকের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে তাকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
—ও।
—হেইল্লিগাই আমি কইলকাত্তায় আইসি।
—তাই?
—হ্যাঁ। আনিসুজ্জাদা। একবার দেখতে চাই ওকে। একবার জানতে চাই ও কেমন আছে। ভাল আছে কি না। ও যদি ভাল না থাকে, তবে ও যে অবস্থাতেই থাক, ও যদি পচে-গলে যায়, ওকে যদি কুষ্ঠরোগে ধরে, ও যদি পুড়ে-দগ্ধে আঙরা হয়ে যায়, তবু তবু তবু আমি ওকে নেব। ও আমার।
আনিসুজ্জামান আমূল কেঁপে ওঠেন। তাঁর কণ্ঠ থেকে শব্দ বেরোয়। ছিটকে ছিটকে ওঠে। হিক্কা তোলার মতো। খাবি খাওয়ার মতো। চোখের জল শুকিয়ে যাওয়া দম ফুরিয়ে যাওয়া কান্নার মতো। শমসেরের কথা শুনতে শুনতে এই বর্ষায়, এই বন্যা ও বিপর্যয়ে, খিঁচুড়ি বিলোবার আগে একটি তত্ত্ব তাঁর কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়—তিনি অন্ধ। নিজের সম্পর্কে এই অন্ধত্বের কোনও সীমা নেই তাঁর। শমসের, সেই কৈশোরের স্মৃতি আগলে রেখে যা উপলব্ধি করতে পেরেছে তিনি প্রাত্যহিকতার মধ্যে থেকেও তা বুঝতে পারেননি। আজ তাঁর এই বোধ জাগছে যে যা-কিছু থেকে তিনি পালাতে চেয়েছেন সারাক্ষণ তাই আসলে তাঁর পরম কাম্য। তিনিও কি ঠিক ওভাবেই চাননি কোনও প্রেম? কোনও দাম্পত্য? আত্মপ্রশ্ন দেখা দেয় তাঁর মধ্যে। আত্মদর্শন। আনিসুজ্জামান— কার ওপর সবচেয়ে বেশি নির্ভর করো তুমি?
—নীলোফার ওপর।
—সমস্ত ক্লান্তি ঢেলে দিয়েছ কাকে?
—ওকেই।
—কে, মাত্র দু’দিনের জন্যও রিপন স্ট্রিটের বাড়িতে গেলে অসহায় হয়ে গিয়েছ তুমি?
—ও। ওর জন্য।
—কষ্ট পেলে কার কাছে উদ্গিরণ করেছ সব আর খিদে-তৃষ্ণার কথা জানিয়েছ?
—ওকেই তো। ওকেই।
—তোমার তাপিত হৃদয়কে সুরে সুরে শান্ত করেছে কে?
—ও। ওই।
—তোমার ঘৃণায় চূড়ান্ত কষ্ট পেয়ে কে ছুটে গিয়েছিল পীরবাবার মাজারে আর প্রার্থনা করেছিল মাত্র একজনের জন্য যে ওকে দেখে…
—ও। ও-ই। আমারই জন্য ও ছুটে গিয়েছিল। আমিই ওকে চরমতম অপমান করেছিলাম। আমিই ওকে প্ররোচিত করেছি। আমার ওপর নির্ভর করেছিল ও। বিশ্বাস করেছিল। বিনিময়ে ওকে আমি কষ্টই দিয়েছি শুধু।
—আজ এই ভয়ঙ্কর পরিণতির মুখোমুখি সে কার জন্য?
—আমার, আমার জন্য।
—ভেবে দ্যাখো, কার জন্য উতলা হয়েছ তুমি? কে ভয়ে ও লজ্জায় মারা যেতে পারে বলে রাত্রে ঘুমোতে পারোনি?
—ও। ও। ওর জন্য।
—পৃথিবীতে কেউই কি আছে তোমার, যাকে ছাড়া বাঁচবে না তুমি? চলবে না তোমার?
—ও। ও না থাকলে। ওই রূপহারা মেয়ে। ওই পুড়ে যাওয়া বীভৎস মেয়ে। তবু ওই তো সবচেয়ে সুন্দর। সবচেয়ে প্রিয়জন আমার। ও আমাকেই… ও আমাকেই…
—কি? কি? কি? বলো!
আনিসুজ্জামান অকস্মাৎ শমসেরকে বলেন— তুমি কি স্কুলে গিয়ে কাজটা শুরু করে দেবে ভাই?
—আপনি?
—একটা জরুরি কাজ মনে পড়ে গেল। একবার ফিরে যেতে চাই।
—কোথায় আনিসুজ্জাদা?
—বাড়িতে। শমসের।
অনুপম আসছিল। ডাকছিল আনিসুজ্জামানকে। আনিসুজ্জামান অনুপমের সঙ্গে শমসেরকে পাঠিয়ে দিলেন স্কুলে। নিজে হাঁটুজল ভেঙে চললেন। বলবেন নীলোফাকে। কী বলবেন! কীভাবে বলবেন! বলবেন কি, ভালবাসি তোকে, ভালবাসতাম, কিন্তু বুঝিনি, বুঝতে পারিনি, কিন্তু, মনে মনে মূল্য দিয়ে গেছি, নীলোফা—। নীলোফা কী বলবে তখন? বলবে কি—‘মূল্য তুমি কীভাবে দিয়েছিলে? কীভাবে বানাও আমাকে তোমার জন্য লভ্য ও নিশ্চিত করুণা? আমাকে নিরস্ত করো কী করে, কবে কতদিন রেখেছ অন্তরে, আমি কি তোমার কাছে নিতান্ত পথিক? বসবাস দু’দিনের? দু’দিনের দেখাশুনো ফুরিয়ে যাবে কি? কখন ফুরোবে কখন নির্ধারিত হবে আমি আর প্রয়োজন নই। এর চেয়ে বড় কুম্ভ, আরও আরও বড় উদ্দেশ্য ছানিয়ে তুমি পেয়ে যাবে অবিকৃত… … আমি তো বিকৃত… ভুলে যাওনি তো!’ বলবে কি সে? এত কঠিন করে? এত স্পষ্ট? জানেন না তিনি। কিন্তু এইটুকু নিশ্চিত যে বলবেন। বলতেই হবে তাঁকে। তাঁর আর একটুও সংশয় নেই। উদ্বেগও নেই। ভেজা ভেজা ছাপ ফেলে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে থাকেন তিনি। সন্ধে নেমেছে। আলো নেই। অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে সব। আনিসুজ্জামান দরজায় শব্দ করলেন। নীলোফা দরজা খুলে দিল। এখনও আলো জ্বালেনি সে। ল্যাম্পের চিমনি পরিষ্কার করছিল বুঝি। টেবিলে ছড়ানো সব। আনিসুজ্জামান দরজাটি বন্ধ করে দিলেন। তাঁর শরীর কাঁপতে থাকছে। চোখ দু’টি লালাভ ও চঞ্চল। তিনি ডুবে যাওয়া, সমর্পিত, একলা মানুষের গলায় ডাকেন—নীলোফা, নীলু, শোন।
নীলোফা এই স্বর শুনে শঙ্কিত হয়। কিছু কি ঘটল? এমনিতেই তো তারা এক দুঃসময়ে আছে! সে প্রশ্ন করে— কী হয়েছে ভাইজান? কী হল? আপনি স্কুলে গেলেন না?
আনিসুজ্জামান বলেন— গিয়েছিলাম, নীলোফা। যাব আবার।
নীলোফা তাকিয়ে আছে। ভাইজানকে অন্যরকম লাগে তার। আনিসুজ্জামান বলেন— তোর কোনও কষ্ট হচ্ছে না তো নীলোফা?
—না ভাইজান।
আনিসুজ্জামান ভাষা হারিয়ে ফেলেন। দু’টি ঘেমে যাওয়া কাঁপতে থাকা হাতে তুলে দেন নীলোফার মুখের ঢাকনাটি। এবং ঊষর মুখ— এই প্রথম—স্পর্শ করেন তিনি। বলেন— ভয় পাস না। নীলোফা। আমি আছি রে। আমার যে তুই ছাড়া কেউ নেই আর। আমি তোকে… আমি তোকে… নীলু, তুই চলে যাবি না তো?
নীলোফা কেঁপে যায়। বলে— কোথায় যাব, ভাইজান?
—যদি কেউ তোকে নিতে আসে? যদি ফিরে আসে কেউ? যদি বলে—চলো—তুই চলে যাবি নীলু?
—আজ আপনার কী হয়েছে ভাইজান?
—আগে বল নীলু, চলে যাবি না তো তুই?
—না। যাব না, ভাইজান।
—কারও কাছে না?
—না।
—সত্যি? সত্যি নীলোফা? তোকে ছাড়া আমার চলবে না রে নীলু। নীলোফা। তোর মধ্যে যে আসছে সে আমার। কেমন? নীলোফা— আমি তোকে… আমি তোকে…।
দরজায় শব্দ হয়। আনিসুজ্জামানের কথা শেষ হয় না। নীলোফা স্তব্ধ পাথর হয়ে আছে। অসম্ভব আলোড়নের পূর্বেকার নিশ্চলতা। আনিসুজ্জামান দরজা খোলেন। তৃণাঙ্কুর। বলছেন— তুমি যাওনি তো এখনও! ভাগ্যিস!
—কেন মান্তুদা?
—হ্যাঁ। আমাকে একটু স্কুলে নিয়ে যাবে ভাই? ফটিকবিল বস্তির সবাই তো ওখানেই আছে?
নীলোফা তৃণাঙ্কুরের দিকে তাকায়। সে অনুমান করে কী হতে চলেছে। তৃণাঙ্কুর বলেন— রাধিকাকে নিয়ে আসব বাড়িতে। ওকে তো দেখার কেউ নেই। হলই-বা কাজের মেয়ে। আমার তো দায়িত্ব আছে একটা। বলো? দু’টো ছোট ছোট বাচ্চা নিয়ে… বেচারা…
—আছেই তো।
জোরের সঙ্গে জবাব দেয় নীলোফা। আপনি চলে যান ভাইজানের সঙ্গে মান্তুদা।
তৃণাঙ্কুরকে ধরে ধরে অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকেন আনিসুজ্জামান। বলেন— তুমি আর কষ্ট করে যাবে কেন? আমিই তো নিয়ে আসতে পারতাম।
তৃণাঙ্কুর বলেন— না। আমি না গেলে যদি না আসে সে?
দু’জনে ধীরে ধীরে এগোন। হাঁটুজল ভেঙে তৃণাঙ্কুরের এগোতে কষ্ট হয়। তবু তিনি আনিসুজ্জামানের হাত আঁকড়ে এগোন। আনিসুজ্জামান নির্দিষ্ট লক্ষ্য অভিমুখে প্রত্যয়ে পা ফেলেন। তাঁর একটুও অশান্তি নেই। সব কথা বলা হল না নীলোফাকে। তাতে কী? বলবেন। তাঁর আর তাড়া নেই। এবং, যেতে যেতে নিজেকে নতুন করে দেখতে পান তিনি। এই প্রথম তাঁর ধর্মের বিধান তাঁকে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে অনুপ্রাণীত করেছে। এই প্রথম, তাঁদের পরিবারের প্রচলিত বিধিটি তিনি ভাঙছেন। জীবন তাঁকে দিয়ে সম্পন্ন করে নিচ্ছে বহু ভাঙনের কাজ। বহু নির্মাণের কাজও। তাঁর সিদ্ধান্ত কে কীভাবে নেবেন? মনিরুল? ভাইয়েরা? তৃণাঙ্কুর? নীলিমা? যে যে-ভাবেই নিক—আনিসুজ্জামান অপূর্ব প্রশান্তি নিয়ে হেঁটে যান। ধীরে ধীরে। তৃণাঙ্কুরকে ধরে। তাঁর তাড়া নেই। কোনও তাড়া নেই।
৫৪
খিচুড়ি বিলোচ্ছিল শমসের। সে আর অনুপম কাঁধে কাঁধ দিয়ে কাজ করে যাচ্ছিল। দু’খানি লণ্ঠন জ্বালা। তবু পূর্ণ আলো নেই। আধো আলো আধো অন্ধকারে একের পর এক মিছিল করে আসা থালায় খিচুড়ি তুলে দেওয়া কাজ। একটি ঘোমটা দেওয়া মুখের হাত থেকে খিচুড়ি সমেত থালা পড়ে গেল নীচে। মিছিলের পিছনের লোকেরা তাকে ধিক্কার দিতে থাকছে। খাবার সস্তা পেয়েছ? একটু সাবধান হতে পারছ না? শমসের থামিয়ে দিল তাদের। ধমকাল। থালা তুলে খিচুড়ি দিল ফের। আর ওই থালাভর্তি খিচুড়ি নিয়ে একলা অন্ধকারে এসে দাঁড়াল রাধিকা। জল জল জল। আলো নেই এতটুকু। হাতের থালার খিচুড়ি দোতলার বারান্দা থেকে জলে ফেলে দিল সে। ছপ ছপ শব্দ হল জলে। মনে পড়ল তার— মা ভেসে যায়। সালতি ভেসে যায়। মেঘ-আঁচল ওড়ে। দুই চোখে জল আসে তার। এই বর্ষায় এই জলে ভেসে গেল সব। কী ভাসে? কী? তখন জোছনকে কোলে করে পলাশ মায়ের পাশে আসে। বলে— মা। তেনি আইছেন।
—কে?
—আমাগো লইতে আইছেন মা। যাবা না?
—কে?
—তুমি যাগো বাড়ি রান্দো!
ধীরে ধীরে থালা নামিয়ে রাখছে রাধিকা। তিনি এসেছেন তবে! বেশ! জোছনকে কোলে তুলে পলাশের হাত ধরে সে বলছে— ‘চল্।’ ভাবছে—আহা! পঙ্গু মানুষটা এত দূর এসেছেন কষ্ট করে! এই জলে! এই বৃষ্টিতে!
সিঁড়ি দিয়ে নামার আগে আর একবার খাবার দেবার ঘরে উঁকি দিল রাধিকা। শমসের একমনে কাজ করছে। লণ্ঠনের আলোয় ঘাম-চকচকে শরীরে কী আশ্চর্য দেখাচ্ছে তাকে! সুধা ছানিয়া কেবা ও সুধা ঢেলেছে গো, যেমতি শ্যামের চিকন দেহা… শমসের— কী সুন্দর! এ পাড়ায় অতিথি হয়ে এসে সবার সঙ্গে কেমন কাজ করছে দেখো! কী শক্ত কাঁধ ওর! কী মসৃণ কাঁধ! রাধিকা সেই কিশোরবেলার মতো ডাকতে চায়— শমসেরদা— কিন্তু পারে না। কোলে জোছন ছটফটিয়ে কেঁদে ওঠে। তার গা গরম। রাধিকা তাকে শান্ত করতে করতে ভাবে—কাকে ডাকতে যাচ্ছিল সে। কেনই-বা ডাকছিল! এত বছর পরও শমসের কি মনে রেখেছে সেইসব? রাখলে চিনতে কি পারত না সে? বুঝতে কি পারত না? সে তো বলত—‘আমি তর গন্ধ পাই। যেইখানেই থাক। তরে আমি ঠিক পামু।’
আজ রাধিকা এত কাছাকাছি ছিল, কই গন্ধ তো পেল না শমসের! চিনতে তো পারল না রাধিকাকে! ঘোমটা ছিল তার। তবু— তবু—! রাধিকার সংশয় বাড়ে। এই ক’ বছরে নিশ্চয়ই বদলে গেছে শমসের। কিংবা কে জানে, শমসের হয়তো তেমনই আছে, বদলে গেছে রাধিকার গন্ধ। ভাসতে ভাসতে ক্ষইতে ক্ষইতে সে বুঝি আর তেমন রাধিকা নেই।
পলাশ তাড়া দেয়। এই অন্ধকার স্কুলবাড়ি, এই গাদাগাদি ভিড় আর যন্ত্রণার চিৎকার হা-হুতাশ তার আর ভাল লাগছে না। এমনকী অন্ধও কোনও কথা বলছে না। এক কোণে তার বাবাকে নিয়ে চুপ করে বসে আছে। বাবার গায়ে মৃত্যুর ঘ্রাণ পেয়েছে সে। পলাশ তাই তাড়া দিচ্ছে মাকে। মায়ের ভেজা ময়লা আঁচলটি ধরে বলছে— মা। যাবা না? চলো!
তারা নেমে আসছে সিঁড়ি বেয়ে। তৃণাঙ্কুর সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে ছাতা। বলছেন— চলো। সঙ্গে কিছু আছে? কোনও জিনিস? তবে নিয়ে নাও।
কিছু নেই। কী নেবে! আজ রাধিকা পরিপূর্ণ রিক্ত! সে আজ সমস্ত ভাসিয়ে দিল। সবটুকু। তার দেওয়া অন্নের সঙ্গে সমস্ত স্বপ্ন আর স্মৃতি! এবং রিক্ত বলে, সে নেমে আসছে সন্তান সমেত। চলে যাবে—যেখানে তৃণাঙ্কুর।
আনিসুজ্জামান বলছেন— আমি তোমার সঙ্গে যাব মান্তুদা?
তৃণাঙ্কুর বলছেন— না ভাই। আর তোমাকে যেতে হবে না। রাধিকা আছে। আমার আর অসুবিধে নেই।
কী নিশ্চিন্ত তৃণাঙ্কুর! রাধিকা আছে। কী মমতায় জল ঠেলে পঙ্গু শরীর নিয়ে চলে এসেছেন তিনি। রাধিকার বুকের তলায় মোচড় লাগে। সে ভাবে, শমসের পাশের বাড়িতেই থাকবে। সে কি বলবে— ‘রাধু, তরে বিয়া করুম?’ না। বলবে না আর। যদি বলে তাতেই বা কী? সত্যি তো আর তা সম্ভব নয়। কেন নয়? যদি চলে যায় সে? কার্তিককে ফাঁকি দিয়ে? কার্তিককে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব। কিন্তু পলাশ? জোছন? যদি শমসের আকাশের মতো বড় হয়ে যায়? যদি বলে— ‘যাউক অরা। থাউক আমাগো লগে।’ তারপর?
না। এখন আর হয় না। হবে না। সে যে নিরন্তর ধ্যান করেছে শমসেরকে আর চেয়েছে এতকাল জাগরণে, স্বপ্নে— তা কি চাওয়াই শুধু নয়? চেয়ে বেঁচে থাকা নয়? স্বর্গের কল্পনায় পৃথিবীর কষ্ট পেরুনো নয়? সেই টান আর টের পাচ্ছে না রাধিকা। যার তুমুল প্ররোচনায় সে পরমেশে শমসের দেখত! কোথায় হারিয়ে গেল সব? স্বপ্নে যা জেগে ছিল, স্মৃতিতে যা জেগে ছিল সত্যিই সেই সবই কি ভেসে গেল জলে? নাকি তারা অন্য কোনও মানুষে ডুবেছে?
কিংবা কোনও মানুষেই নয়। দেহ-মনে বিচ্ছেদ হয়ে গেছে রাধিকার। চিরবিচ্ছেদ। কোনও মানুষে পৌঁছেই বুঝি তার পূর্ণতা সম্ভব নয়। এক পুরুষে দেহ ধায়, এক পুরুষে মন।
শুন গো মরম সখী
ঐ শুন শুন মধুর মুরলী
ডাকয়ে কমল-আঁখি॥
ধৈরয না ধরে প্রাণ কেমন করে
ইহার উপায় বল॥
আর কিয়ে জীব গোপের রমণী
বৃন্দাবনে যাব চল॥
এই অনুমান করে গোপীগণ
শুনি যে বাঁশির গীত।
শুধু তনু দেখ এই তনু মোর
তথায় আছয়ে চিত॥
জোছনকে কোলে নিয়েছে রাধিকা। অন্য হাতে পলাশ। তৃণাঙ্কুর রাধিকার কাঁধে হাত রাখলেন। ছাতা ধরলেন মাথায়। রাধিকা বলল—ছাড়েন। মাইনষে কী কইব?
তৃণাঙ্কুর বললেন— কে লোক? রাধিকা? লোকের কথায় কী আসে যায়? আমার কাছে থাকতে চাও না তুমি? চাও তো?
রাধিকা ক্লান্ত বোধ করে। নরম হাসে একবার। অন্ধকারে চোখ মেলে দেয়। আস্তে মাথা হেলিয়ে গাল রাখে তৃণাঙ্কুরের কাঁধ জড়ানো হাতে। বলে— চাই। চাই।
অন্ধকারে জল ভেঙে এগিয়ে যাবার শব্দ হয়। সে-শব্দ বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে মিশে যেতে থাকে।