উপকাহিনী
ভূতনাথের কাহিনী শেষ হয়ে গেল। শেষ হয়ে গেল উনবিংশ আর বিংশ শতাব্দীর একটা পরিচ্ছেদের ভগ্নাংশ। শেষ হয়ে গেল অনেক ওঠা-নামা, অনেক ভাঙা-গড়ার ইতিহাস! কিন্তু তবু সব যেন তখনও শেষ হয়নি। তখনও বনমালী সরকার লেন দিয়ে আপিসের বাবুরা পান চিবোতে-চিবোতে ছোটে। গলিটুকু পেরিয়ে গেলেই একেবারে সোজা রাস্তা। বউবাজার দিয়ে হেঁটে এসে বনমালী সরকার লেন-এ ঢুকে পড়ে—একে-বেঁকে সোজা পশ্চিমে বড় রাস্তা পাবে। বাঁ দিকে বড়বাড়ি আর ডানদিকে বরাবর ছোটছোট দোকানের সার। ছোট টিনের চালার নিচে বাঞ্ছার তেলেভাজার দোকান পাবে। বাঞ্ছা এখন নেই। তার ছেলে অধর। অধরের ছেলে আর এখন দোকানে বসে। অরের তেলেভাজার নাম-ডাক আছে এ-অঞ্চলে। শীতকালে ভোর থেকে ভিড় জমে অক্ররের দোকানে। গরম তেলের ওপর বেগুনীগুলো ফেলতে সময় দেয় না খদ্দেররা। ছেকে ধরে চারদিক থেকে। বলেআমাকে আগে দে রে—চা ফুটছে বাড়িতে…। তারপর রুপদ দে’র দোকান ‘স্বদেশী-বাজার। বিলিতি জিনিষ দোকানের ত্রি-সীমানায় ঢুকতে পাবে না। গুরুপদ দে’র এমনি নিয়ম। মোটা খদ্দরের পাঞ্চাবী আর ধুতি পরে গুরুপদ দে নিজের হাতে মাল বেচে। বলে—আপনার পণ করুন ভাই আজ থেকে বিলিতি জিনিষ কিনবেন না—প্রতিজ্ঞা করুন বিলিতি জিনিষ ছোঁবেন না–এ না হলে স্বাধীনতা আসবে না দেশের।
তারপর ত্রিকালদর্শী রাজজ্যোতিষী শ্রীমৎ অনন্তহরি ভট্টাচার্যির “শ্রীশ্রীমহাকালী আশ্রম”। এমন যে কলিকালের ভেজালের যুগ, এ-যুগেও অমন একটি খাঁটি নবগ্রহ কবচ কী করে যে মাত্র ১৩/১০য়, দিতে পারেন, তাই-ই এক বিস্ময়। তারপর আছে এ-পাড়ার ছেলেদের ‘সবুজ-সঙ্ঘ’। তারপর ‘পবিত্র খদ্দর ভাণ্ডার’। খদ্দর তো বাজারে অনেক রকম আছে। কিন্তু যদি পবিত্র খদ্দর চান তো ওখানেই যেতে হবে আপনাকে। তারপর বেণী স্বর্ণকারের সোনা-রূপেপার দোকান। আর তারপর মোড়ের মাথায় ভূজাওয়ালাদের মাটির দোতলা বাড়ি। হোলির এক মাস আগে থেকে খঞ্জনী বাজিয়ে পাড়া মাত করে তোলে।
এ-সব তো গেল রাস্তার ডানদিকের কাহিনী।
কিন্তু বাঁ দিকের বড়বাড়িটা তখনও ছিল। ছোট-ছোট খুপরি করে তখন ভাড়াটে বসিয়েছিল পটলডাঙার বাবুরা। দু’খানা করে ঘর আর একখানি রান্নাঘর। ব্যবস্থা ভালোই। রোদ আসে কলতলায়। ভাড়াটেদের কলকোলাহলে পাড়াটা মুখর হয়ে থাকতে দিনরাত। বাইরের দিকেও একটু অদল-বদল করে কয়েকজন ভাড়াটেকে বসানো হয়েছিল। কখনও-কখনও সন্ধ্যেবেলা সেখানে গানের আসর বসতো। ছুটুকবাবুর সে জমকালো আসর নয়। পর্দার আড়ালে সিদ্ধির সরবতেরও ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু মিয়া-কি-মল্লারের মতো কড়া রাগরাগিনীর চর্চা হতো। গানের সঙ্গে বায়া-তবলায় বিলম্বিত লয়ে মধ্যমানের ঠেকা চলতো। সঙ্গে বড় জোর পান-সুপুরি জর্দা-দোক্তা-কিমাম পর্যন্ত। তার বেশি নয়।
এ তো গেল বনমালী সরকার লেন-এর কাহিনী। এই যার নামের রাস্তা নিয়ে গল্প বলছি।
কিন্তু বাইরে তখন অদল-বদল হয়ে গিয়েছে অনেক। দিল্লীর মসনদে বসবার দিন লর্ড হার্ডিঞ্জের ওপর বোমা ফেললে কে একজন। সবাই বললে—এ বাঙালী। বাঙালী ছাড়া আর কার কাজ হবে। কিন্তু মরলো না বড়লাট সাহেব। মরলো তার হাতীর মাহুত। দশ কোটি টাকা খরচ করে নতুন রাজধানী উঠলো দিল্লীতে। নতুন ইন্দ্রপ্রস্থ। কবরের দেশে এক নতুন ইন্দ্রপ্রস্থ গড়ে উঠলো। কিন্তু লর্ড সিংহ ইতিমধ্যে চাকরিতে ইস্তফা দিয়েছেন। বেহারের লোক, স্যার আলী ইমাম এলেন এগিয়ে। লর্ড সিংহ-এর খালি জুতোয় তিনি পা গলালেন। তার নিজের দেশ বেহার। বেহারকে এবার আলাদা করে নিতে হবে। বেহারের জন্যে আলাদা লাটসাহেব, আলাদা ইউনিভার্সিটি, আলাদা হাইকোর্ট চাই। কিন্তু তা হোক, তবু তো বাঙলা দেশ আবার জোড়া লাগলো। তাইতেই খুশি সবাই।
বিলেতের ‘টাইমস পত্রিকা লিখলে–
“Bengal differs more from most other Indian provinces than they differ from one another. Economic, temperamental and social causes account for this difference. Caste is less powerful; a common literary language unites over forty million Bengalis. Even the Muslim community, who form a narrow majority of the population are indisputably less divided both socially and politically from their Hindu countrymen than they are in other parts of India. The Bengali temperament, at once calculating and emotional, critical and eithusiastic, baffles other Indians almost as much as it puzzles Britsh administrators.”
কিন্তু বড় ভালো মানুষ এই নতুন লাট কারমাইকেল সাহেব। কিন্তু হলে কি হবে। আসতে-না-আসতে যুদ্ধ গেল বেধে আর চার মাসের মধ্যে ভারতবর্ষ থেকে চব্বিশ হাজার লোক যুদ্ধ করতে গেল এক ফ্রান্সেরই লড়াইতে।
বুড়োনা রোয়াকের ওপর ‘হিল্লাদী বিছিয়ে পড়ে আর গল্প করে।
বলে—এবারকার লড়াইতে আট টাকা করে চালের মণ হবে দেখো-এই বলে রাখছি।
বলে—এবার আর টিকতে হবে না দাদা, টাকায় পাঁচ সের দুধ-বলল কি হে, দিনে ডাকাতি!
সত্যি, জিনিষপত্তোরের দাম আগুন তখন। ছ’ টাকা আট টাকা করে চাল, টাকায় পাঁচ সের করে দুধ, দশ আনা সের পাঁঠার মাংস, তিন আনা সের ডাল, সরষের তেল তিন আনা, মানুষ খাবে কী? কী খেয়ে বাঁচবে!
গোয়াবাগানের মেস-এর বাসাতেও আলোচনা চলেছে। সে বোধ হয় ১৯১৪ সালের মাঝামাঝি।
এই মেসেতেই পরে ওভারসিয়ার ভূতনাথ চক্রবর্তীর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। যে-কাহিনী আমি—এই উপন্যাসের লেখকলিখেছি তার অনেক পরে আমার জন্ম। আমি ও-সব দেখিনি, জানিও না। আমার জানবার কথাও নয় ও-সব। ভূতনাথবাবু তখন বৃদ্ধ। চাকরি থেকে রিটায়ার করে গিয়েছেন। তেতলার ছোট একটা ঘরে একলা থাকেন। অতি ভোরে ওঠেন। কী শীত, কী গ্রীষ্ম ভোরবেলা পায়ে হেঁটে গঙ্গা স্নানে যান। তারপর ফিরে এসে নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে অনেকক্ষণ কী সব জপ-তপ করেন। দুপুরবেলা শিরদাঁড়া সোজা করে গীতা পড়েন, রামায়ণ পড়েন। বিকেলবেলা পাড়ার একটা হরিসভায় গিয়ে কথকতা শোনেন। আমি যতটুকু জানতাম—এই ছিল তখন তার প্রাত্যহিক কাজ।
কী কারণে জানি না আমাকে তিনি একটু সুনজরে দেখতেন। আমাকে বলেছিলেন—আমার গল্প কি কারো ভালো লাগবে?
বললাম—যদি অনুমতি করেন তো লিখতে পারি।
বললেন—ও গল্প তো ওখানেই শেষ নয়, আরো আছে— শেষটাও তা হলে জুড়ে দেবেন আপনার গল্পে।
শেষটা তার কাছেই শুনেছিলাম। কাহিনীর সঙ্গে শেষ ঘটনাটা খাপ খাবে কিনা বুঝতে পারিনি তাই সেটা জুড়ে দিলাম ‘উপকাহিনী’তে।
আর তখনকার বনমালী সরকার লেন? ভূতনাথবাবুর কাছে শোনবার পর বউবাজারে একদিন দেখতে গিয়েছিলাম। সে আর চেনা যায় না। কোথায় দেউড়ি, কোথায় বাগান, কোথায় খাজাঞ্চীখানা, নহবৎখানা, তোষাখানা, ভিস্তিখানা, নাচঘর, পূজোবাড়ি! বড়বাড়ির একখানা ইটেরও পর্যন্ত সাক্ষাৎ পাওয়া গেল না। রাস্তার দু’পাশে বিরাট-বিরাট প্রাসাদ উঠেছে। এক শ’ ফুট চওড়া রাস্তা। ইলেকটিক লাইটের সার-সার থাম। এলাহি কাণ্ড! কোনোটাতে মোটরের শো-রূম, কোনোটা ইনসিওরেন্সের আপিস। গিসগিস করছে লোক। ব্যস্ত চাল-চলন। মিনিটে লক্ষ-লক্ষ টাকার মাল কেনা-বেচা হচ্ছে। সন্ধ্যে হলে সে-রাস্তায় শা-শা করে মোটর চলে। কেউ কারো মুখ চেনে না, নাম জানে না। অথচ পাশাপাশি বাস করছে দিনরাত। লিফটে করে উঠছেনামছে লোক জন। দেখে মনে হলো বড়বাড়ির সেই ঢিমে তালের জীবন-যাত্রার পর যেন জীবনের আর্কেস্ট। হঠাৎ বড় জলদে চলেছে এখন। সময়ের গতি বেড়েছে। দিন যেন ছোট হয়ে এসেছে এখানে। বৈদূর্যমণির নাম বললে কেউ চিনতে পারে না আর। হিরণ্যমণির পরিচয় কেউ আর জানে না। কৌস্তুভমণির ছায়াও কেউ দেখেনি। এমনি অবস্থা। পটলডাঙার বাবুদের হাত থেকে দশহাত বদল হয়ে-হয়ে বনমালী সরকার লেন তখন এক অন্য জগতে রূপান্তরিত হয়েছে।
আর বার-শিমলের সে-বাড়িটাও আমি দেখে এসেছি একদিন। দুটো রাস্তার মোড়ের মাথায় মস্ত বড় বাড়ি করেছেন সুপবিত্রবাবু। সত্যি বড় সুন্দর বাড়িটা। ভেতরের মানুষগুলোও, নিশ্চয় ভারী সুন্দর। তখন সন্ধ্যে হয়েছে। দোতলায় অর্গান বাজিয়ে একটি মেয়ের গান শুনেছি–
তোমারি রাগিণী জীবন-কুঞ্জে
বাজে যেন সদা বাজে গো—
একদিন ভূতনাথবাবুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম—সে চিঠিতে আপনি সেদিন কী লিখে এসেছিলেন?
ভূতনাথবাবু বললেন—ওই একবার মাত্র মিথ্যাচার করেছি জীবনে। বার-বার ভেবেছি, কিন্তু এ-ছাড়া আমার আর কোনো গত্যন্তরও ছিল না। আমি লিখেছিলাম—আমি সমস্ত সূত্র হইতে অনুসন্ধান করিয়া জানিয়াছি অতুল চক্রবর্তীর মৃত্যু হইয়াছে। তাহাদের বংশের আর কেহ কোথাও নাই। তুমি সুপবিত্রকে বিবাহ করিতে আপত্তি করিও না…আরো এমনি সব কী-কী কথা লিখেছিলাম তাড়াতাড়িতে, আজ আর তা মনে নেই-আর তার পরে তো দেখাই করতে পারলাম না। দুর্ঘটনায় পড়ে কতদিন যে হাসপাতালে রইলাম।
জিজ্ঞেস করেছিলাম—পরে আর কখনও জবার সঙ্গে দেখা হয়নি আপনার?
ভূতনাথবাবু বললেন—হয়েছিল, শুনুন, সে-ঘটনা।
ভূতনাথবাবুর কাছে শোনা ঘটনা আমার নিজের ভাষায় বলি।
হাসপাতাল থেকে একদিন সন্ধ্যেবেলাই ছাড়া পেয়ে গেল ভূতনাথ হঠাৎ। তখন রাস্তায় বেরিয়ে কেমন যেন প্রথমটা আড়ষ্ট লাগলো চলতে। কোথায় যাবে সে। কোথায় গিয়ে উঠবে ভূতনাথ। সমস্ত পৃথিবীটা যেন ফাকা মনে হলো। বড়বাড়িতে কোথায় সে যাবে। কেউ নেই! শেষ পর্যন্ত ছিল বংশী আর চিন্তা। তারাও অবশেষে চলে গিয়েছে কলকাতার ত্রি-সীমানা ছেড়ে। একবার মনে হলো বড়বাড়িতে গিয়ে বৌঠানকে সে খুঁজে দেখবে। মনে হলো—বৌঠান যেন কোথাও বড়বাড়ির কোনো ঘরে লুকিয়ে আছে নিশ্চয়। ধরা দিচ্ছে না। নইলে সেদিন ঘোড়ার গাড়ির সে-দুর্ঘটনার পর কোথাও পাওয়া গেল না কেন তাকে—এ কেমন করে হয়! এ কেমন করে সম্ভব!
হাঁটতে-হাঁটতে চাঁদনীর হাসপাতাল থেকে ভূতনাথ গিয়ে দাঁড়ালো একবার বড়বাড়ির সামনে। মনে হলো সমস্ত বাড়িটা যেন একটা বিরাট সরীসৃপের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমোচ্ছ। সমস্ত শরীরে তার মৃত্যুর অবসন্নতা। অন্ধকারের বিবর্ণতা যেন সমস্ত আবহাওয়ায়।
কেউ কোথাও নেই। ভূতনাথ তালাবন্ধ গেটটা ডিঙিয়ে ভেতরে ঢুকলো। বেশ ঘাস গজিয়েছে উঠোনের ওপর। ভয় করে পা ফেলতে। কোথাও যেন শব্দ পেয়ে একটা ব্যাং আচমকা থপ করে লাফিয়ে ওঠে। সমস্ত ঘরগুলোয় তালা-চাবি দেওয়া। শুধু খিড়কির দিকে বাগানের মুখোমুখি চোরকুঠুরিতে যাবার সিঁড়িটা খোলা। আস্তে-আস্তে ওপরে গিয়ে উঠলো ভূতনাথ। চোরকুঠুরির সামনে বারান্দা। বারান্দার উত্তরদিকেই সেই দরজাটা তালাবন্ধ। ফাঁক দিয়ে দেখা যায় ভেতরে কেবল অন্ধকার। ওপাশে বউদের মহলে যাবার উপায় নেই। ভূতনাথ কান পেতে রইল অনেকক্ষণ! কিছু শব্দ যদি শোনা যায়। কিছু যদি আভাষ পাওয়া যায়। কিন্তু কিছু নেই। সব যেন মৃত্যুর মতো বধির। অন্ধকারের মতো বোবা। ভূতনাথ চুপি-চুপি শুধু একবার ডাকলে— বৌঠান—
তারপর অনেকক্ষণ চুপ করে কান পেতে রইল ভূতনাথ। কেউ সাড়া দিলে না তবু।
আবার একটু জোরে ডাকলে—বৌঠান, আমি ভূতনাথ।
একটা প্রতিধ্বনি শুধু ভেতরের ফাঁকা ঘরগুলোর দেয়ালে আছাড় খেয়ে ফিরে এল। একটা গমগম করে শব্দ হলো শুধু। ফাঁকা-ফঁপা নিরর্থক শব্দ।
ভূতনাথ আবার ডাকলে—বৌঠান–
আবার সেই রকম। তারপর সেই ভাবে, মেঝের ওপরেই একবার বসে পড়লো ভূতনাথ। মাথা যেন ঝিমঝিম করছে। এত দিন হাসপাতালে শুয়ে যেন জড়তা এসেছে সমস্ত শরীরে। মাথা কুটতে লাগলো দেয়ালে। কোথায় গেল বৌঠান! কে বলে দেবে। কোথায় গেলে পাওয়া যাবে বৌঠানকে।
তারপর এক সময়ে উঠলো ভূতনাথ। সমস্ত পৃথিবীর ওপর যেন তার রাগ হতে লাগলো। সমস্ত সংসারের ওপর বিরাগ। আজ কেউ নেই ভূতনাথের। মানুষের পৃথিবীতে আজ যেন ভূতনাথ একলা। একেবারে নিঃসহায় নিঃসম্বল। মনে হলো নিশ্চয়ই এ মেজবাবুর কাণ্ড। মেজবাবুর গুণ্ডারা নিশ্চয়ই কোথাও নিয়ে গিয়েছে বৌঠানকে। মেজবাবু চৌধুরী বাড়ির বউ-এর এ আইন-অমান্য সহ্য করবে না। তাই বুঝি ভূতনাথকেই নিঃশেষ করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু বৌঠানই যখন নেই তখন ভূতনাথ বেঁচে থেকেই বা কী করবে!
আবার সেই রাস্তা দিয়ে নেমে এল ভূতনাথ। সেই পরিত্যক্ত বড়বাড়ি। চারিদিক নিস্তব্ধ। দেউড়ি পেরিয়ে আবার সেই বনমালী সরকার লেন-এ এসে পড়লো। কোথায় যাবে কোনো ঠিক নেই। কোথায় গিয়ে আশ্রয় মিলবে। কার কাছে গিয়ে আব্দার করবে, আবেগ জানাবে। কা’কে সে বকবে। কাকে অনুরোধ করবে, অনুযোগ অভিযোগ করবে।
সমস্ত কলকাতা শহর তখন বিষণ্ণ। অন্তত ভূতনাথের মনে হলো যেন বৌঠানের বেদনায় সমস্ত শহর বিষণ্ণ হয়ে আছে সেদিন। কখন আস্তে-আস্তে গিয়ে ভূতনাথ বার-শিমলেয় পৌচেছে খেয়াল নেই। একবার ফিরে আসতে যাচ্ছিলো ভূতনাথ। কী হবে, সেখানে গিয়ে। সে তো চিঠি দিয়ে এসেছে। সে-চিঠিতে তো সে চুড়ান্ত কথা লিখে এসেছে সেদিন। এতদিনে জবা নিশ্চয়ই সুপবিত্রকে গ্রহণ করেছে। তবে কেন আর তার যাওয়া।
তবু যেন বাড়িটার সামনে গিয়ে দরজা না ঠেলে পারলো না।
দরজা খুলে দিয়ে ক্ষুদির মা’ও অবাক হয়ে গিয়েছে। বললেদাদাবাবু, আপনি?
ভূতনাথ বললে—দিদিমণি কোথায় ক্ষুদির মা?
সিঁড়ি দিয়ে উঠে ভূতনাথ সেদিন জবাকে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল বৈকি। জবা বাবার ছবির সামনে তেমনি নিশ্চল হয়ে বসেছিল। কোনো পরিবর্তন নেই জবার। ভূতনাথকে দেখে জবাও যেন কম অবাক হয়নি। বললে-ভূতনাথবাবু, আপনি?
ভূতনাথ বললে—সুপবিত্র কোথায়?
জব সে-প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললে–কিন্তু এতদিন কোথায় ছিলেন আপনি, ভূতনাথবাবু?
মুহূর্তের জন্যে বুঝি বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিল ভূতনাথ, বললেআমি তো তোমাকে চিঠি লিখে রেখে গিয়েছিলাম জবা, পাওনি সে চিঠি?
—পেয়েছিলাম, কিন্তু…
—আমি সমস্ত জায়গায় খোঁজ নিয়েছিলাম, সেই নদীয়া জেলায় পর্যন্ত গিয়েছিলাম নিজে, তিনি মারা গিয়েছেন, তার বংশের কেউ আর জীবিত নেই—তিনি মৃত—বিশ্বাস করে।
—কিন্তু…
-তোমার কোনো দ্বিধা শুনবো না জবা, ছোটবেলার যে-বিয়ে সে-তত বলতে গেলে বান্দানেরই সামিল, তোমার কথা মতোই ‘অপূর্বা হয়ে তুমি নির্বিঘ্নে সুপবিত্রকে বিয়ে করতে পারবে।
জবা একবার বললে—সত্যিই কি তার কোনো সন্ধানই গেলেন না?
ভূতনাথ বললে—তার প্রেতাত্মা হয় তো আছে কিন্তু তাঁকে নিয়ে তুমি করবে কী? আমি সেই কথা বলতে অনেক দিন আগেই আসতাম, কিন্তু আসতে পারিনি এতদিন শুধু…
জবা সমস্ত শুনলে চুপ, করে। বললে—আপনি যে এতদিন হাসপাতালে ছিলেন, আমাকে একটা খবরও দেননি, আমি কিন্তু
অনেক দিন খোঁজ করেছিলাম আপনার—জানেন?
ভূতনাথের কেমন যেন রোমাঞ্চ হলে সমস্ত শরীরে। বললেসত্যি খোঁজ করেছিলে?
—কেন, মানুষ মানুষের খোঁজ করে না?
-না, তা করবে না কেন, তবু তুমি আমার খোঁজ করেছিলে এটা জানতে ভালো লাগে।
জবা খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইল। মুখটা যেন তার হঠাৎ বড় লাল হয়ে উঠেছে। তারপর যেন বড় মরীয়া হয়ে বললেআমার অনুরোধ, আপনি এবার একটা বিয়ে করে ফেলুন, আপনি সুখী হবেন হয় তো।
ভূতনাথ ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে। ” হাসতে-হাসতে বললে—আমি দুঃখী এ-কথা তোমায় কে বললে জবা…আর তা ছাড়া আমার বিয়ে করা আর চলেও না, একবার করেছি।
-তার মানে? জবাও যেন চমকে উঠলো।
ভুতনাথ হঠাৎ যেন ব্যস্ত হয়ে উঠলো। বললে—সে কথা যাক জবা, সুপবিত্রকে তুমি গ্রহণ করবে কিনা বলো আগে তোমার বাবার অন্তিম অনুরোধ!
—কিন্তু সত্যিই আপনার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ভূতনাথ বললে—বলেছি তো হয়েছে।
—কোথায়? কবে?
ভূতনাথ বললে—এ-কথার জবাব আর একদিন দেবো জবা–এখনও সময় হয়নি, এখন বোধহয় আর সময়ও নেই, এতক্ষণে সুপবিত্ৰ নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েনি, তাকে আমি এখনি ডেকে আনছি, আমার সামনেই তোমাকে কথা দিতে হবে—আর আমিই থাকবো তার সাক্ষী।
জবা যেন কী বলে প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলো। ভূতনাথ থামিয়ে দিয়ে বললে—তুমি আর ‘না’ বলো না জবা, তোমার দায়িত্ব থেকে আমি শুধু মুক্তি চাই, তোমাকে এমন অবস্থায় ফেলে আমি চলে যেতে পারি না, তা ছাড়া তোমার বিয়ে না হলে এখানে আমার আসাও তত শোভন নয়।
তারপর সেই রাত্রে সুপবিত্রকে ডেকে এনে কেমন করে সমস্ত দায়িত্ব থেকে মুক্ত হয়েছিলেন ভূতনাথবাবু তা-ও বলেছিলেন।
জিজ্ঞেস করেছিলাম—আর কখনও যাননি ওখানে, জবাদের বাড়িতে?
ভূতনাথবাবু বলেছিলেন—গিয়েছিলাম, সে জবার বিয়ের দিনকিন্তু তারপর হয় তো আমাকে প্রয়োজনও হয়নি আর—আমার কোনো আহ্বানও আসেনি—যেদিন ডাক আসবে, সেদিন যাবে আবার।
—আর ছোটবৌঠান? তার আর দেখা পেয়েছিলেন? ভূতনাথবাবু বলেছিলেন—পেয়েছিলাম, কিন্তু না পেলেই যেন ভালো হতো।
–সেই গল্পটা বলুন।
ভূতনাথবাবু বললেন—যেদিন বনমালী সরকার লেন-এ বড়বাড়ি ভাঙবার অর্ডার দিয়ে চলে এলাম, সে তো আপনাকে বলেছি, এ তার পরের দিনের কথা। সে এক অদ্ভুত দেখা! এমন করে শেষ দেখা হবে ভাবিনি। ছোটবৌঠান বলেছিল—আমার মৃত্যুর পর তুই কাদিস ভূতনাথ, আমার জন্যে একটু চোখের জল ফেলিস—আমাকে আমার বিয়ের বেনারসীটা পরিয়ে সাজিয়ে-গুজিয়ে দিস, কিন্তু কিছুই করা হলো না।
ভূতনাথবাবু প্রশান্ত হাসি হাসতে লাগলেন।
এ উপকাহিনীতে সেই গল্পটাই বলি।
ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্ট হলো সেই ১৯১১ সালে। প্রথম থেকেই ভূতনাথের চাকরি হয়ে গেল এখানে। রূপচাঁদবাবুর চেষ্টায় প্রথম নেটিখেকেই ঢুকে পড়লো এ-আপিসে।
ইদ্রিস বললে—খোদা আপনার ভালো করবে ওভারসিয়ারবাবু।
যে-সরকারবাবু অমন হিংসে করতো, সে-ও কেমন যেন নরম হয়ে এল শেষকালে। বললে—ভাগ্যবানের বোঝা ভগবান বয়এ আপনাকে দেখেই বুঝতে পারলাম মশাই।
নতুন অপিসে কাজ আরম্ভ হয়েছে। রাস্তা চওড়া করা হয়। বাড়ি ভেঙে মাটি সমান করে। এ-সব পুরোনো কাজ ভূতনাথের। তবু যেদিন বৌবাজারের বনমালী সরকার লেন ভাঙবার ফরমাশ হলো সে একটা দিন বটে! ভূতনাথের মনে হেলো—নিজের পাঁজর কখানা যেন ভেঙে গুড়িয়ে দেবার আদেশ হয়েছে। সে-বাড়ি ছেড়ে চলে আসার পর কোনো দিন ও-রাস্তা আর মাড়ায়নি তো ভূতনাথ। ওদিক দিয়ে গেলেই কেমন যেন আকর্ষণ করতো কেউ! কিন্তু চাকরি তো তার! আদেশ মানতেই হবে। প্রথম যেদিন মাপজোপ করতে গিয়েছিল ভূতনাথ, সেই দিনই কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল বারে-বারে। মনে হয়েছিল—কোথা থেকে যেন এক অদৃশ্য শক্তি তাকে বার-বার আকর্ষণ করছে। সে-বড়রাড়ি আর চেনা যায় না। সে পূজোর দালানটার তবু কিছু-কিছু অংশ তখনও রয়েছে। ফালি-ফালি ভাগ হয়ে গিয়েছে সব। এক ঘর, থেকে আসছে চিংড়ি মাছের গন্ধ। আর এক ঘর থেকে আসছে। মাংসর। এক ঘরে হয় তো চেয়ার, টেবিল, পাখা—আর এক ঘরে মাদুর,চটের পর্দা, আর এনামেলের কাপ। কত বিচিত্র লোক বাসা বেঁধেছে বড়বাড়িতে। কোথায় গেল তোষাখানা, ভিস্তিখানা, রান্নাবাড়ি। কোনো কিছুরই চিহ্ন নেই আজ। সেইদিন তেতলায় ওঠেনি ভূতনাথ। ইচ্ছে থাকলেও ওঠবার প্রয়োজন হয়নি।
কিন্তু যেদিন সেই সমস্ত পাড়াটা খালি হয়ে যাবার পর চরিত্র মণ্ডলকে বাড়ি ভাঙবার কাজ বুঝিয়ে দিয়ে চলে আসছিল, সেদিন ভূতনাথ ভাঙা বাড়ির ওপরে উঠেছিল সিঁড়ি দিয়ে। কিন্তু না উঠলেই বোধ হয় ভালো হতো। সে পুরোনো পরিত্যক্ত ঘর গুলোর মধ্যে কী যাদু ছিল কে জানে। মনে হয়েছিল কে যেন তাকে তেতলার ভাঙা রেলিং থেকে একেবারে নিচে ঠেলে ফেলে দিতে চেয়েছিল। সন্ধ্যার অস্পষ্ট অন্ধকারে মনে হয়েছিল বৌঠান যেন তাকে হঠাৎ মদ আনবার জন্যে হীরের কানফুলটা খুলে দিলে!
আর তারপর সেই রাস্তার কুকুরটা! বড় ভয় পেয়ে গিয়েছিল ভূতনাথ। কিন্তু সেদিনও ভূতনাথ জানতো না এ কীসের যাই। এ কীসের আকর্ষণ! জানতে পারলে পরের দিন। সে এক অদ্ভুত কাণ্ড।
ছুটুকবাবুকেও তখন এক-একদিন দেখতে পাওয়া যেতো। কালো কোট গায়ে দিয়ে ট্রামে চড়ে যান। ভূতনাথের মনে হতো ও কোট যেন অনেক কালি লেগে কালো। সময়ের কালি কলঙ্কের কালি। ও কালি যেন ধুলেও যাবে না।
আর মেজবাবু? মেজবাবুই শুধু শেষদিন পর্যন্ত গাড়িঘোড়া চড়ে গেলেন। বিকেল বেলা ইডেন-গার্ডেন-এর কাছে দাঁড়ালে দেখা যেতো ইব্রাহিম আস্তে-আস্তে ঢিমে চালে গাড়ি চালিয়ে আসছে। গাড়ির ভেতর মেজবাবু দু’হাতে দুটো হাতল ধরে চুপ করে বসে আছেন। শূন্য দৃষ্টি চোখের। তবু গিলে করা মলমলের পাঞ্জাবী। হাতে একটা মস্ত হীরের আংটি। গাড়িটা এসে গঙ্গার ধারের দিকে ইডেন-গার্ডেন-এর গা-ঘেঁষে রোজ দাঁড়ায় একবার। মেজবাবু নামেন না। ঘোড়া দুটোকে তখন ঘাস খাওয়াতে নামে ইব্রাহিম। ঘোড়া দুটো কয়েক মুঠো ঘাস খায়, আর মাঝেমাঝে বিরক্ত হয়ে পা ঠোকে। হয়তো ঠিক পছন্দ হয় না শুকনো ঘাস। কিন্তু মেজবাবু সেই গাড়ির ভেতর বসে-বসেই খানিকক্ষণ হাওয়া খান। আর ইডেন-গার্ডেন-এর গোরা-ব্যাণ্ডের বাজনার সঙ্গে-সঙ্গে পায়ে মৃদু-মৃদু তাল দেন। এ-দৃশ্য সাইকেল-এ যেতেযেতে ভূতনাথ অনেকদিন দেখেছে।
সুপবিত্রও বোধহয় মোটর কিনেছে। কী চাকরি করে কে জানে। বড় চাকরি নিশ্চয়ই। কাট-প্যান্ট পরা অবস্থায় অনেকদিন সকালবেলা যেতে দেখেছে ভূতনাথ। গাড়ি চালায় ড্রাইভার। ভেতরে হেলান দিয়ে সুপবিত্র খবরের কাগজ পড়ে।
তবু এ-সব ঘটনা ভূতনাথের জীবনে কোনদিন কোনো রেখাপাত করেনি। রেখাপাত করবার মতন ঘটনাও নয়। কিন্তু শেষ ঘটনাটার জন্যে ভূতনাথ যেন সত্যিই প্রস্তুত ছিল না।
সেদিন রাত্রে বুঝি ফিরতে অনেক দেরি হয়েছিল। বড়বাড়ির ___ চিহ্নটুকু দেখে সাইকেল-এ চড়ে আসতে-আসতে যেন অনেক যুগ পার হয়ে এল ভূতনাথ। কাল ও-বাড়ির আর কোনো কিছু চিহ্ন থাকবে না। নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে বড়বাড়ি। আর বড়বাড়ির সঙ্গে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে বনমালী সরকার লেন। বাতিল হয়ে যাবে বনমালী সরকার ইতিহাস থেকে। তাতেও কিছু দুঃখ নেই। দুঃখ শুধু এই যে, বাতিল করা তদারক করতে হবে সেই ভূতনাথকেই। একদিন যে আশ্রয় দিয়েছিল, শান্তি দিয়েছিল, সান্ত্বনা দিয়েছিল, তাকেই নিশ্চিহ্ন করতে হবে ভূতনাথকে নিজের হাতে। সারা রাত অসহ্য এক অনুভূতিতে কাটলো।
ভোর বেলা কিন্তু যথারীতি ঘুম থেকে উঠেছে ভূতনাথ। মেসের তেতলা ঘরটার জানালা দিয়ে সূর্যোদয় দেখা যায়। গঙ্গাস্নান সেরে এসে সেদিকে চেয়ে যথারীতি প্রণামও করেছে। প্রাতঃকালীন জপ-তপ গায়ত্রী—কোনো কিছুই বাদ যায়নি সেদিনও। আপিসেও গিয়েছে যথাসময়ে। কোনো ব্যতিক্রম হয়নি কোথাও। কিন্তু আপিসের ঘড়িতে তখন বেলা দুটো….
বড় সাহেব ডাকলো। ঘরে যেতেই বড়সাহেব বললে—বনমালী সরকার লেন-এ যে বিল্ডিং ভাঙা হচ্ছে—সেখানে এখনি দৌড়ে যাও ‘—গিয়ে সেখানে কী হয়েছে দেখে এসে আমাকে রিপোর্ট দেবে।
ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে কিছু ম্যাক্সিডেন্ট হয়েছে নাকি?
সাহেব বললে—তা ঠিক নয়, তবে কুলীর কাজ বন্ধ করে দিয়েছে বলছে আর কাজ করবে না, টুলস্ যন্ত্রপাতি ফেলে দিয়ে বসে আছে।
সেদিনও ঠিক সেই জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালো ভূতনাথ আবার। কিন্তু আজ দুপুরবেলা চেহারা যেন সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছে বড়বাড়ির।–বড়বাড়ি আর বল কেন। বড়বাড়ির একখানা ইট পর্যন্ত আর দাঁড়িয়ে নেই। মাটি সমান হয়ে গিয়েছে সমস্ত। দূর থেকে কিছুই দেখা যায় না। কাছে এলে বোঝা যায় চারদিকে বড়-বড় গর্ত। ইট সিমেন্ট ভেঙে মাটি বেরিয়ে গিয়েছে। ভিত্ পর্যন্ত উপড়ে ফেলেছে সব। সমস্ত বনমালী সরকার লেনটা যেন মরুভূমির মতো খাঁ-খাঁ করছে।
কিন্তু কাছে যেতেই বোঝা গেল বেশ ভিড় জমেছে ঘন। কা’কে কেন্দ্র করে যেন অনেক জটলা চলেছে।
ভূতনাথ হাজির হতেই চরিত্র মণ্ডল এগিয়ে এল। মুখ দেখে ভাব তার বদলে গিয়েছে। বললে—আমরা কাজ করবো না হুজুর।
—কেন, কী হলো তোমাদের?
চরিত্র মণ্ডলকে আর বলতে হলো না কী হয়েছে। ভূতনাথ দেখলে পাশেই বৈজু নির্জীব হয়ে পড়ে আছে। গাঁইতির ঘা লেগে একেবারে রক্তারক্তি কাণ্ড। বউবাজার থেকে ডাক্তার এসে ব্যাণ্ডেঞ্জ। বেঁধে দিয়েছে। ব্যাণ্ডেজের কাপড়টাও তখন রক্তে ভেসে গিয়েছে।
চরিত্র মণ্ডল আবার বললে—আমরা আর এখানে কাজ করা হুজুর।
—কেন, কাজ বন্ধ করবি কেন? তা কাজ না করিস অন্যাকুল ডাকবো কাল থেকে!
চরিত্র বললে–কোনো কুলী এখানে কাজ করবে না– কবরখানা আছে হুজুর—ওই দেখুন—সঙ্গে-সঙ্গে চরিত্র মণ্ডল হাত দিয়ে দেখিয়ে দিলে—ওই দেখুন হুজুর—ওই দেখুন।
অনেক লোক উৎসুক হয়ে সেদিকেই তখন দেখছিল। চরিত্র মণ্ডল ভূতনাথকে সঙ্গে করে নিয়ে গেল সেইদিকে। বড়বাড়ির তি খুড়েছে কুলীরা। গত করেছে জায়গায়-জায়গায়। একটা গর্তের ভেতর স্পষ্ট প্রত্যক্ষ দেখতে পেলে ভূতনাথ। কোনো সন্দে, নেই। মানুষের সম্পূর্ণ একটা কঙ্কাল। মাথার খুলি থেকে পায়ের আঙুল পর্যন্ত। উপুড় হয়ে পড়ে আছে। কত দিনের, কত কাল আগের কে জানে। কিন্তু এতটুকু বিকৃত হয়নি যেন তখনও। খানিকটা মাটির আড়ালে তখনও ঢাকা। তার পাশে যেন কী একটা চিকচিক করছে। সোনার মতন। যেন মিনে-করা সোনা।
ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে—ওটা কী?
এতক্ষণ কেউ দেখতে পায়নি। সবাই ঝুঁকে পড়লো এবার। কিন্তু ভূতনাথ চিনতে পেরেছে ঠিক।
কে যেন এবার বলে উঠলো-ওটা সোনার গয়না মনে হচ্ছে যেন-মেয়েছেলের গয়না-সোনার গোটছড়ার মতন ঠিক।
কিন্তু ভূতনাথ তখন অন্য কথা ভাবছে। তার মনে হলো–…পটপরিবর্তন যেন সম্পূর্ণ হলে এতদিনে।
তারপর সেই কঙ্কালটার দিকে চেয়ে ভূতনাথ অভিভূতের মতন দাঁড়িয়ে রইল অনেকক্ষণ। তার মনে হলো জীবনের যেন এক মহা অর্থ চোখের সামনে উদঘাটিত হয়ে গেল এক মুহূর্তে। মৃত্যু যেন আর শুধূ মৃত্যুই রইল না। মনে হলো জীবনেরই আর এক মহাপ্রকাশ যেন মৃত্যু। মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই যেন জীবনকে সম্পূর্ণ করে পেতে হয়। মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই যেন সার্থকতার চরম লক্ষ্যে। পৌঁছোতে হয়। মৃত্যু দিয়েই যেন জীবনের চরম উৎসর্গ সম্পূর্ণ হয়। কোনো সাংসারিক প্রয়োজনের তুচ্ছতা দিয়ে নয়, কোনো লৌকিক সম্বন্ধের ক্ষুদ্রতা দিয়েও নয়—জীবনের চরম সার্থকতা একটি মাত্র যোগে—সে অমৃতের যোগ। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও তাই ভূতনাথ যেন অমৃতের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেল এক আশ্চর্য উপায়ে।
তারপর ভূতনাথ সেখানে দাঁড়িয়ে সেদিন তার পরম প্রার্থনা জানালো-যে-দেবতা সকল মানুষের দুঃখ গ্রহণ করেছেন, যার বেদনার অন্ত নেই, যার ভালোবাসারও অন্ত নেই, তাঁর ভালোবাসার বেদনা যেন সমস্ত মানবসন্তান মিলে গ্রহণ করতে পারি। ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।