৫০. আইনি বাধ্যবাধকতা

৫০

অনিককে এখন যেকোনো মুহূর্তে ছেড়ে দিতে পারে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে আদতে শক্ত কোনো অভিযোগ নেই। তারপরও কিছু আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে ছাড়া পায় নি সে। তার সঙ্গে একদিন দেখা করেছিল তিথি। কিন্তু সেদিন ভিড়ের মধ্যে ঠিকঠাক কথা বলতে পারে নি। কেবল নেহাল আর হৃদির অবস্থা জানিয়েছিল সে। অনিক অবশ্য কিছু বলে নি। চুপচাপ শুনেছে। আজ বেশ কিছুদিন পর আবার দেখা করতে এল তিথি। আবছার আহমেদ তাদের একটু আলাদা কথা বলার ব্যবস্থা করে দিলেন। তিথি বলল, কেমন আছ?

ভালো।

রোগা হয়ে গেছ অনেক।

অনিক হাসল, বল স্লিম হয়ে গেছি।

চোখের কোণে কালি পড়ে গেছে।

ছেলেবেলায় মা কত কাজল দিয়ে দিতেন!

তুমি তো মেয়ে নও!

মার শখ ছিল বলে তখন তা-ই ছিলাম।

এখান থেকে ছাড়া পেয়ে কী করবে?

বাড়ি চলে যাব।

ঢাকায় আর ফিরবে না?

না।

কী করবে বাড়ি গিয়ে?

মা আর বাবার কবরের পাশে বসে থাকব।

তারপর?

তারপর বেঁচে থাকতে শুরু করব।

কবরের পাশ থেকে বেঁচে থাকতে শুরু করবে?

হুম।

কেন?

কারণ, কবরই মানুষকে বাঁচতে শেখায়।

কীভাবে?

মৃত্যু ছাড়া জীবন তো মিনিংলেসই, তাই না? কবর ওটা অনুভব করায়।

তিথি কথা বলল না। অনিক বলল, মানুষ যত দিন বাঁচে, তত দিন তো সে ওই মাটিটুকুকে বঞ্চিত করেই বাঁচে। আর বাঁচে মৃত্যুকে মেরে।

কথাটা কানে গেঁথে রইল তিথির। সে বলল, তোমার কষ্ট হয় না?

কিসের কষ্ট?

এই যে এত এত কিছু হয়ে গেল?

কী হলো?

এত মানুষ তোমায় ঠকাল? ইনজাস্টিস করল।

অনিক কথা বলে না।

আপুর ওপর খুব রাগ হয় তোমার, না? কিংবা অন্যদের ওপর? যারা তোমায় এমন ভেঙেচুরে এলোমেলো করে দিল?

অনিক ম্লান হাসল, আগে হতো।

এখন হয় না?

নাহ্।

কেন?

কারণ, আজকাল সারাক্ষণ মনে মনে একটা মন্ত্র জপি আমি।

কী মন্ত্র?

একটা কবিতা।

কবিতা কখনো মন্ত্র হয়?

কবিতাই মন্ত্র হয়।

শোনাবে?

অনিক খানিক চুপ করে রইল। তারপর আচমকা চোখ বন্ধ করে গাঢ় গলায় পড়তে লাগল–

একটা দুঃসংবাদ আছে–
যারা আমাকে ভেঙেচুরে টুকরো কাঁচের মতো ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিল, তাদের জন্য।
দুঃসংবাদটি তাদের জন্যও, যারা ভেবেছিলে–
আমি হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলে আর কখনো উঠে দাঁড়াতে পারব না।
মুখ থুবড়ে পড়ে থাকব গা-ঘিনঘিনে কাদায়।
আমাকে ছিঁড়ে কাগজের মতো কুচিকুচি করে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিলে–
আমি হারিয়ে যাব দিকশূন্যপুর।
যে আমাকে টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে দিতে চেয়েছিল অতলান্তিক বিষাদ সমুদ্রে,
ডুবিয়ে দিতে চেয়েছিল এক পৃথিবী বিবমিষায়।
যে আমাকে অযুত রাতের কান্না লিখে দিয়ে বুকের ভেতর–
খুঁড়ে দিতে চেয়েছিল শেওলা জমা স্যাঁতসেঁতে এক মজা পুকুর।
যে আমাকে দুঃখ দিয়ে, পুড়িয়ে শেষে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলে ছাইয়ের মতন,
তাদের জন্য দুঃসংবাদ।
আমি এখন পাখির মতন, আমায় ছিঁড়ে কুচিকুচি ভাসিয়ে দিলে–
এখন আমি ডানা মেলে আকাশজুড়ে উড়তে জানি।
কাটা যায় না, ভাঙা যায় না, আমি এখন জলের মতন–
ভেসে যেতে যেতেও হঠাৎ জলোচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে দিতে আমিও জানি।
আমিও জানি ছড়িয়ে থাকা টুকরো কাঁচের শরীর থেকে, দুফলা এক ছুরি হতে।

এই যে মানুষ দুঃখ দিতে দক্ষ ভীষণ, সে-ও জানুক আমি এখন হাসতে জানি,
শেওলা জমা পুকুরজুড়ে আমিও এখন রোদের মতো ভাসতে জানি,
প্রস্থানের গল্প লিখেও ইচ্ছে হলেই আবার ফিরে আসতে জানি।

আমি এখন পুড়ে যাওয়া ছাইয়ের ভেতর জেগে ওঠা ফিনিক্স পাখি–
আমি এখন মৃত্যু মেরে বাঁচতে জানি।

অনিক থামলেও তিথি কথা বলল না। তবে সে আবিষ্কার করল, অনিকের চোখের কোনায় যেন টুপ করে এক ফোঁটা জল এসে জমা হয়েছে। সে বলল, তুমি হৃদি আপুকে খুব ঘৃণা করো, তাই না?

অনিক জবাব দিল না। তিথি বলল, একটা সত্যি কথা বলবে?

কী?

এই যে হৃদি আপুর জীবনটা এমন হয়ে গেল, নেহাল ভাই এমন ভয়ানক জঘন্য এক মানুষ–এসব শুনে তুমি খুব খুশি হয়েছ, তাই না?

অনিক জবাব দিল না। তিথি বলল, সেটাই তো স্বাভাবিক। আমি হলেও তা-ই হতাম।

অনিক এবারও চুপ। তিথিও। যেন সে অনিকের বুকে জমে থাকা ক্ষত ও ক্রোধের অস্তিত্ব অনুভব করতে পারছে। দীর্ঘ সময় নিঃশব্দ দাঁড়িয়ে রইল সে। আচ্ছা, এই মানুষটা কি জানে এই জীবনে কী আশ্চর্য মায়াময় এক অনুভব সে তার জন্য বয়ে বেড়ায়? মাঝে মাঝে একাকী নিঃশব্দ রাত্রিতে চরাচর ভাসিয়ে নেওয়া হাহাকার বুক ওলট-পালট করে ফেলে! জীবন এমন কেন?

এখানে ভুল মানুষের জন্য ভুল সময়ে কেন ভালোবাসা জেগে ওঠে? হৃদয় ব্যাকুল হয়ে ওঠার এই জটিল সমীকরণের অর্থ তিথি জানে না।

তবে এত কিছুর পরও সে চায় অনিক হৃদি আপুর পাশে গিয়ে একটু দাঁড়াক। একমুহূর্তের জন্য হলেও তার সঙ্গে কথা বলুক। আলতো করে হাত রাখুক তার মাথায়। সে খুব চায়, এমন কিছু ঘটুক।

আচ্ছা, যদি সত্যি সত্যি কখনো এমন হয়, তাহলে হৃদি আপু তখন কী করবে?

ওই দৃশ্যটা খুব দেখতে ইচ্ছে করে তিথির। কিন্তু সে এ-ও জানে, এর চেয়ে অন্যায় কোনো ইচ্ছে আর হয় না। যে মানুষটা অমন অকপটে, অমন জঘন্য নিষ্ঠুরতায় তাকে ছুঁড়ে ফেলে রেখে গেছে, দিয়ে গেছে এক দুঃসহ যন্ত্রণার জীবন, তার কাছে এমন কিছু সে কী করে চাইবে? সেই সাধ্য তার নেই। হয়তো নেই কারোরই। তিথি তারপরও বলে, তুমি কি একটা কথা জানো?

অনিক তাকায়।

হৃদি আপু একদিন সুযোগ পেয়ে বার্লিন থেকে ফোন করে হাউমাউ করে কেঁদেছিল।

অনিক কথা বলে না। তিথি বলল, সে কী বলেছিল, জানো?

অনিক জানতে চায় না। হৃদিই বলে, বলেছিল, এই জীবনে অন্তত একবারের জন্য হলেও সে তোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়। একমুহূর্তের জন্য তোমার পায়ের কাছে। চুপচাপ বসে থাকতে চায় তার আগে মরতে চায় না সে।

অনিক বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে শেষে বলে, তিথি?

হুম।

আজ তাহলে যা?

তিথি জবাব দেয় না। অনিক বলে, পৃথিবীতে মানুষ সবচেয়ে বেশি কী ভালোবাসে, জানিস?

কী?

নিজেকে।

কিন্তু তুমি তখন হৃদি আপুকে তোমার নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসতে। তাই না?

অনিক জবাব দিল না। তিথি বলল, আর এখন?

অনিক এবারও কথা বলল না। তিথিই বলল, এখন তুমি নিজেকে ভালোবাসতে শিখে গেছ। সবচেয়ে বেশি। তাই তো?

অনিক হাসল। এবারও কথা বলল না সে।

৫১

মঈনদের বাড়ি থেকে একটা দুঃসংবাদ এসেছে। কিন্তু সেই দুঃসংবাদের খবর কেউ কাউকে বলতে চাইছে না। বরং সকলেই একে অন্যের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখছে। কানে কানে ফিসফাস করছে। মঈনের মামলা নিয়ে তার মা, খালা, মামারা দিনভর দৌড়ঝাঁপ করছেন। কিন্তু গ্রামের বাড়িতে কেউ নেই বলে তার বাবাকে প্রায়ই বাড়ি যেতে হচ্ছে। সেখানে তার স্কুল, ছাত্রছাত্রী, জমিজমা আছে। হাঁস-মুরগিসহ নানান। গবাদিপশু আছে। ফলে তিনি একনাগাড়ে বেশি দিন ঢাকায় থাকতে পারেন না। ছোটাছুটির মধ্যে আছেন।

তার এই ছোটাছুটির মধ্যেই ঘটনাটা প্রথম কানে এসেছে মঈনের মামার। তিনি সেই খবর বলেছেন তার ছোট বোনকে। তার ছোট বোন বলেছেন মঈনের মাকে। সেই থেকে তিনি কাঁদছেন। কারও সঙ্গে কোনো কথা বলছেন না। এদিকে মঈনের মামলার কোনো কিছুই হচ্ছে না। যেন একটা জায়গায় এসে থেমে আছে।

অবন্তী মাঝে মাঝে তার সঙ্গে দেখা করতে আসে। কিন্তু তাদের কথা হয় খুব অল্প। বেশির ভাগ সময়ই তারা কেবল পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকে। মঈনের মুখ শুকিয়ে। এতটুকু হয়ে গেছে। আগের সেই ডাকাবুকো মানুষটা আর নেই। এ যেন তার ছায়া। তবে সেই ছায়াজুড়ে আশ্চর্য এক মায়ার বসতি টের পায় অবন্তী।

ওই মায়াটুকু শিশিরের শীতল স্পর্শের মতো লেপ্টে থাকে বুকে। রাতভর ঘুমাতে পারে না সে। জেগে থাকে একা একা। আর মঈনের জন্য তার মন কেমন করে। বুকের ভেতর আশ্চর্য এক হাহাকার বয়ে যায়। কিন্তু তার জন্য কী করবে সে?

মঈন যদি সত্যি সত্যি ছাড়া পায়, তবে আর একমুহূর্তও দেরি করবে না সে। পেছনের সবকিছু ভুলে যাবে। অবন্তী জানে, কিছু ক্ষত কখনোই ভোলা যায় না। এর উপশমও নেই। ফলে জীবনভর তা বয়ে বেড়াতে হয়। হয়তো সে-ও বেড়াবে। কিন্তু তার কারণে যে অবর্ণনীয় দুর্ভোগটা পোহাতে হলো মঈনকে, যে শাস্তিটা ভোগ করল সে, তা তার প্রাপ্য নয়। ফলে মঈনের এই অভাবিত যন্ত্রণা আর দুঃস্বপ্নের জীবন থেকে মুক্তির জন্য হলেও নিজের ওই ক্ষতটা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা সে করবে।

.

জীবন কেমন মেঘলা দিনের মতো। ক্ষণে ক্ষণে বৃষ্টি, ঝোড়ো হাওয়া। সেই হাওয়ায় চারপাশ ভেঙেচুরে একাকার। সঁতসেঁতে শেওলা জমা মনের উঠোন। সেখানে জল জমে ভার হয়ে থাকে দুপুর, রাত্রি, সকাল-সন্ধ্যা। যেন কান্না ছাড়া কোথাও কিছু নেই। হাসি নেই, আনন্দ নেই, রোদ কিংবা মন ভালো করে দেওয়া বসন্তবাতাস নেই। সবকিছু হঠাৎ কেন এমন হয়ে গেল?

গত কয়েক মাসে রিয়ার জন্যও কম কাঁদে নি অবন্তী। দিনের পর দিন কেঁদেছে। অমন একটা জলজ্যান্ত, হাসিখুশি মানুষ কী করে এমন উধাও হয়ে গেল? কী হয়েছে তার? সে কি বেঁচে আছে? অবন্তী এখনো নিয়ম করে রিয়ার বন্ধ ফোনে ফোন করে। তারপর কানে চেপে ধরে রাখে। তার কেন যেন মনে হয়, রিয়া হঠাৎ কথা বলে উঠবে। ফোন ধরে বলবে, কী রে মিয়াও, কেমন ভয় দেখালাম?

তখন কী করবে সে? কেঁদেই ফেলবে। তারপর ইচ্ছেমতো বকাঝকা করবে। হাওয়া উড়ে ছুটে যাবে দেখা করতে। দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদবে। তা সে রাস্তা হোক, মাঠ কিংবা শপিং মল। তারা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদবে, হাসবে। তারপর আবার কাঁদবে। যা ইচ্ছে তা-ই করবে তারা। অবন্তীর হঠাৎ কান্না পেয়ে গেল। চোখের কোল গড়িয়ে নেমে আসতে থাকল জলের ধারা। আচ্ছা, রিয়া কি বেঁচে আছে?

এই প্রশ্নের উত্তর সে জানে না।

তবে তার পরদিন বিস্ময়কর এক ঘটনা ঘটল। আবছার আহমেদ ফোন করলেন অবন্তীকে। তারপর উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, আপনি এখুনি একটু আমার অফিসে আসুন।

এখুনি?

হুম।

বিকেলে আসি?

নাহ্। এখুনি মানে এখুনি।

অবন্তী কিছুই বুঝতে পারল না। সে বলল, আচ্ছা।

শুনুন। আসার সময় আপনার চিঠিগুলো সঙ্গে নিয়ে আসবেন।

অবন্তী কিছুই বুঝল না। তবে সে থানায় গেল। আবছার আহমেদ গম্ভীর মুখে বসে আছেন। কিন্তু তার চোখ চকচক করছে। যেন অভাবিত কোনো সম্ভাবনার আলো দেখতে পেয়েছেন তিনি। তার সামনে টেবিলে ছড়ানো-ছিটানো অনেক কাগজপত্র। অবন্তী বসতেই তিনি বললেন, একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে।

কী অদ্ভুত ঘটনা।

বলছি। তার আগে দেখুন তো এই হাতের লেখাটা আপনি চেনেন কি না?

বলে অবন্তীর দিকে একটা রাইটিং প্যাড এগিয়ে দিলেন আবছার আহমেদ। অবন্তী রাইটিং প্যাডটা হাতে নিয়ে দীর্ঘ সময় বসে রইল। বোঝার চেষ্টা করল ঘটনা। প্যাডে জেলপেনে কেউ এলোমেলো কাটাকুটি করেছে। অর্থহীন আলপনা, ছবি। তবে সেসবের মধ্য থেকেও কয়েকটি শব্দ স্পষ্ট হয়ে আছে। শব্দগুলো পরখ করে দেখল অবন্তী। তারপর বলল, আপনি বলছেন যে আমাকে চিঠি লিখত, এটা তারই হাতের লেখা?

আপনার কী মনে হয়?

বুঝতে পারছি না। একবার মনে হয় এক, আরেকবার মনে হয় কোথাও না কোথাও একটু পার্থক্য আছে।

ধরেন আপনি যখন আনমনে, কোনো কিছু না ভেবে কোথাও কিছু লেখেন, তখন সেটার সঙ্গে কি আপনার খুব যত্ন করে লেখা কোনো কিছুর একটু পার্থক্যও থাকবে না?

তা থাকবে। বলে আবার লেখাটা দেখল অবন্তী। তারপর বলল, তার মানে এই প্যাডে উনি আনমনে কাটাকুটি করে কিছু লিখছিলেন?

হুম।

কে উনি?

ওয়েট। তার আগে আপনার সন্দেহ পুরোপুরি দূর করি। নিন, এই দেখুন।

বলে অবন্তীর হাতে কখানা কাগজ এগিয়ে দিলেন আবছার আহমেদ। অবন্তী কাগজগুলো হাতে নিয়ে চমকে উঠল। হুবহু সেই এক হাতের লেখা। একই আকার, অক্ষরের আদল। একই কাগজ এবং সেই একই রকম চোখ নিয়ে কবিতা। সে ঝট করে। আবছার আহমেদের দিকে তাকাল, এগুলো কোথায় পেলেন?

আবছার আহমেদ সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিলেন না। চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে আয়েশি ভঙ্গিতে হাসলেন। তারপর হাসতে হাসতেই বললেন, প্রথম থেকেই কিছু একটা সন্দেহ। হচ্ছিল আমার। কিন্তু ভদ্রলোককে কিছুতেই বাগে পাচ্ছিলাম না আমি। যেন আগে থেকেই সব নিখুঁত প্ল্যান করে রাখা। কোন প্রশ্নে কোন উত্তর দেবেন, কীভাবে সবকিছুর সঙ্গে যুক্ত থেকেও আবার নিজেকে বিচ্ছিন্ন দেখাবেন!

আপনি আগে ঘটনা বলুন, প্লিজ। অবন্তী অধৈর্য হয়ে উঠল। কে এই লোক?

আবছার আহমেদ আবারও হাসলেন। পরিমিত হাসি। তারপর বললেন, প্রফেসর ড. মাহমুদ হাসান!

হোয়াট! বসা থেকে প্রায় উঠে দাঁড়াল অবন্তী। কী বলছেন আপনি? উনি কেন আমাকে বেনামে চিঠি পাঠাবেন?

কারণ, আপনাকে তার পছন্দ।

আমাকে! রিয়ার সঙ্গে প্রফেসরের সম্পর্কটা বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল অবন্তী। এই মুহূর্তে আর কোনো জটিলতা তৈরি করতে চায় না সে।

হুম। মানে উনি সম্ভবত আপনার চোখের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন।

কী বলছেন আপনি?

আবছার আহমেদ হাসলেন, মানুষের মন বড় বিচিত্র। আমরা তো কেবল তার বাইরেটাই দেখতে পাই। ভেতরটা থাকে আড়ালে। ফলে সেখানে কার কী আছে, সেটা কেবল সে নিজেই জানে। তাই না?

তাই বলে উনি আমাকে চিঠি…! কথাটা কিছুতেই হজম করতে পারছে না। অবন্তী।

এর আগেও তিনি বিচিত্র সব কাজ করেছেন। তবে সেসব বেশির ভাগই ছাত্রছাত্রীরা উপভোগ করত বলে কেউ কিছু বলে নি। বিশেষ করে ছাত্রীরা। তারা তাদের সাথে ঘটা কোনো ঘটনা কখনোই বলত না। বরং খুশিই হতো। কারণ, মাহমুদ হাসান মানুষ হিসেবে আরাধ্য। অন্যকে আকর্ষণ করার প্রচণ্ড ক্ষমতা তার রয়েছে। ফলে তিনি কাউকে আলাদা করে গুরুত্ব দিলে তার নিজেকে স্পেশাল ভাবার যথাযথ কারণ আছে।

অবন্তীর এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। সে বলল, আপনি এগুলো কোথায় পেয়েছেন?

আমি তার অফিসে গিয়েছিলাম তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে। সম্ভবত তখন নোট নিতে গিয়ে ভুলে তার টেবিল থেকেই প্যাডটা নিয়ে এসেছিলাম। অফিসে ফিরে প্যাডের এই এলোমেলো লেখাগুলো দেখে তখনই কী যেন একটা খচখচ করছিল মাথায়। কিন্তু ধরতে পারছিলাম না। পরে একদিন তার বাসায় তল্লাশির সময় আমরা তার অজান্তেই কিছু কাগজপত্র, ফাইল নিয়ে এসেছিলাম। তার মধ্য থেকে অনেক ফাইলই গত মাসখানেক ধরে আমরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছি। কিন্তু কোথাও সন্দেহজনক কিছু পাওয়া যায় নি। আমরা খুঁজছিলাম জামশেদের সাথে তার সম্পৃক্ততা। কিন্তু পাই নি। আজ হঠাত্র একটি ফাইলের ভেতর এই চিঠিগুলো পাই আমি। উনি সম্ভবত একসঙ্গে অনেকগুলো চিঠি লিখে রাখতেন। তো এগুলো থেকে কিছু পোস্ট করা হয়েছিল, আর কিছু নানা কারণেই পাঠানো হয় নি।

কিন্তু একটা কথা। আমি কিন্তু রিয়ার কাছে ওনার হাতে লেখা লেকচার শিট দেখেছি। এমনকি দুয়েক দিন দুষ্টুমি করে ওদের ক্লাসেও বসেছি। সেখানেও বোর্ডে ওনাকে সরাসরি লিখতে দেখেছি আমি। সেই হাতের লেখা আর এই হাতের লেখা কিন্তু এক নয়।

আবছার আহমেদ হাসলেন। বললেন, আপনার কি মনে হয় যে উনি অতটাই বোকা?

কতটা?

যতটা বোকা হলে সবার সামনে যেভাবে লেখেন, ঠিক সেভাবেই আবার উনি কাউকে গোপনে চিঠি লিখবেন?

তাহলে?

অ্যাম্বিডেক্সটারিটি–এই টার্মটার কথা শুনেছেন? বললেন আবছার আহমেদ।

না। মাথা নাড়ল অবন্তী।

Ambidexterity হলো একই সঙ্গে দুই হাতে কাজ করার ক্ষমতা। পৃথিবীতে শতকরা মাত্র এক ভাগ মানুষের এই ক্ষমতা রয়েছে। যারা দুই হাতেই সমান কাজ করতে পারে। লিখতে পারে।

তার মানে উনি দুই হাতেই লিখতে পারতেন?

হুম। কারণ, উনি ক্লাসে লিখতেন ডান হাতে। অথচ সেই দিন প্যাডে উনি বা হাতে লিখছিলেন। যেহেতু কাজটা করার সময় উনি আনমাইন্ডফুল ছিলেন, সেহেতু খেয়াল করেন নি। আমার ধারণা, উনি আপনাকে চিঠিও লিখেছেন বাঁ হাতেই।

কিন্তু উনি যদি নিজেকে লুকিয়েই চিঠি লিখতে চাইতেন, তাহলে তো টাইপ করেই লিখতে পারতেন?

তাহলে সেটা কি খুব ইউনিক কিছু হতো? হাতে লেখা অটোগ্রাফ বা চিঠির যে আবেদন, তা কি কম্পিউটারে টাইপ করা চিঠির আছে?

না। তা নেই।

এটা একটা কারণ। আরেকটা কারণ যে উনি জানতেন উনি খুব বিরল মানুষদের একজন। মেধাবীও। ফলে বিষয়টা উনি নানাভাবে উপভোগ করতে চাইতেন। আপনি কি জানেন, দুই হাতে লিখতে পারা বিরল এই মানুষদের যে তালিকা পৃথিবীতে আছে, তাতে কার কার নাম আছে?

কার কার?

আলবার্ট আইনস্টাইন, বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন, নিকোলা তেসলা, লেওনার্দো দা ভিঞ্চি!

ওহ্ গড!

হুম। হতে পারে এ কারণেই ওভাবে চিঠি লেখার প্রতি একটা ফ্যাসিনেশন ওনার ছিল।

কিন্তু এখন আপনারা তাহলে কী করবেন? মানে এটার সঙ্গে কি অন্য কিছুর কোনো যোগসূত্র আছে মনে হচ্ছে?

আমি জানি না। তবে আজ একবার ওনার সঙ্গে দেখা করতে চাই আমি। দুপুরে ওনার বাসায় যাব।

.

দুপুরে মাহমুদ হাসানের বাসায় গিয়ে থমকে গেলেন আবছার আহমেদ। মাহমুদ হাসানের বাসার দরজায় বিশাল তালা মারা। ফোনও বন্ধ। বিষয়টাতে ভারি অবাক হলেন তিনি। তবে তার চমকে যাওয়া আরও বাকি ছিল। তিনি মাহমুদ হাসানের বিভাগে খোঁজ নিতে গিয়ে শোনেন, তিনি দেশে নেই। মাসখানেকের ছুটি নিয়ে প্যারিসে গেছেন। তবে সেখানে গিয়েই আরও দীর্ঘ ছুটির জন্য আবেদন করেছেন তিনি। অর্থাৎ খুব শিগগির আর দেশে ফেরার পরিকল্পনা তার নেই।

এই ঘটনায় থমকে গেলেন আবছার আহমেদ। তার হঠাই মনে হলো, তিনি বড়সড় কোনো ভুল করেছেন। কিন্তু এই ভুল শোধরানোর সুযোগ আর তার নেই। এ জন্যই মানুষ বলে, চোখের সবচেয়ে কাছে থাকা জিনিসটাই আমরা লক্ষ করি না। এড়িয়ে যাই। আমরা দেখতে চাই দূরের জিনিস। মাহমুদ হাসানের ক্ষেত্রেও কি তারা এমন কোনো ভুলই করেছেন?

বিষয়টা স্বাভাবিক মনে হলো না আবছার আহমেদের। তার সেই অস্বাভাবিকতার অনুভূতি আরও ঘনীভূত হলো যখন তিনি শুনলেন যে যাওয়ার আগে নিজের ফ্ল্যাটটাও বিক্রি করে দিয়ে গেছেন মাহমুদ হাসান!

.

নেহাল মুখ খুলল এক মাস তেরো দিনের মাথায়। আবছার আহমেদ বললেন, জামশেদের সঙ্গে আপনার পরিচয় ফ্যাঙ্কফুর্টে?

এই কথা আমি আপনাদের এই নিয়ে নব্বইবার বলেছি।

প্রয়োজন হলে আরও এক হাজার নব্বইবার বলবেন। ক্লিয়ার?

নেহাল জবাব দিল না। আবছার আহমেদ বললেন, একটা বিষয় খুব ইন্টারেস্টিং।

কী?

এই এত দিনেও আপনি কেন একটা নাম কিছুতেই আমাদের বলেন নি?

কী নাম?

আপনিই বলুন কী নাম?

আমি যা জানি, সবই আপনাদের বলেছি।

ফাঙ্কফুর্ট ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লায়েড সায়েন্সে আপনার আরও একজন বাংলাদেশির সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল।

আর কারও সঙ্গে আমার পরিচয় হয় নি।

আবছার আহমেদ বললেন, মূলত জামশেদই আপনাকে তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। অ্যাকচুয়ালি হি ওয়াজ দ্য মাস্টারমাইন্ড অব অল দিজ থিংস। আমি ফ্রাঙ্কফুর্টের ওই ইউনিভার্সিটিতেও খোঁজ নিয়েছি। আপনি তার সঙ্গে কিছুদিন রিসার্চ অ্যাসিসট্যান্ট হিসেবে কাজও করেছেন।

এই কথায় চুপ করে গেল নেহাল। আবছার আহমেদ বললেন, নামটা আপনিই বলুন এবং বলুন যে এত কিছুর পরও ওই নামটা কেন কোথাও নেই?

নেহাল সঙ্গে সঙ্গে কথা বলল না। বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, প্রফেসর মাহমুদ হাসানের একটা শর্ত ছিল।

কী?

পুরো কাজে তার সঙ্গে কখনো কোনো যোগাযোগ করা যাবে না। তার নাম ব্যবহার করা যাবে না। বিনিময়ে তিনি আমাদের তার পুরো প্ল্যান আর এ-সংক্রান্ত তার রিসার্চ ফাইন্ডিংস শেয়ার করবেন।

কেন?

উনি খুব অ্যাম্বিশিয়াস। কিন্তু নিজে ইনভলভড হতে চান নি।

টাকাপয়সাতেও না?

না। উনি জাস্ট নতুন কিছুর অ্যাডপটেশন নিয়েই এক্সাইটেড ছিলেন।

আপনি কি জানেন যে তিনি দেশে নেই?

এখন জানি।

কীভাবে? অবাক গলায় বলল নেহাল।

এমনই প্ল্যান ছিল।

কী?

আমরা কেউ একজন ধরা পড়লে অন্যদের নিরাপদে সরে যাওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। সেই পর্যন্ত মুখ বন্ধ রাখতে হবে।

৫২

হৃদি বসে আছে ছাদে। খানিক আগেই তাকে গোসল করিয়ে দিয়েছেন রোখসানা বেগম। বিকেলের তেরছা মোলায়েম একটা রোদের আলো এসে পড়েছে তার পায়ের। ওপর। সে সেই আলোর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। রোখসানা বেগম বললেন, এখন একটু ভালো লাগছে, মা?

হৃদি জবাব দিল না। রোখসানা বেগম বললেন, ঘুম পাচ্ছে?

হৃদি মাথা নাড়াল। তার ঘুম পাচ্ছে না।

এখন তাহলে কী করবি? এখানে বসে থাকবি?

হুম।

আমি চলে যাব?

না।

তোর এখনো ভয় করছে?

হুম।

আমার সঙ্গে ঘুমাতে তোর খারাপ লাগে?

না।

তোর মাথায় বিলি কেটে দেব?

হুঁ।

রোখসানা বেগম হৃদির চুলে বিলি কেটে দিতে লাগলেন। হৃদি হঠাৎ মাকে ডাকল, মা।

রোখসানা বেগমের মনে হলো, তার বুকের ভেতরটা হঠাৎ কেঁপে উঠেছে। তিনি বললেন, কী মা? কী হয়েছে?

হৃদি কথা বলল না। তার শরীর শক্ত হয়ে গেছে। তবে সে হাত বাড়িয়ে কিছু একটা দেখাল। রোখসানা বেগম তাকিয়েও কিছু বুঝতে পারলেন না। তিনি ঘুরে হৃদির সামনে এসে বসলেন। তারপর বললেন, কী হয়েছে? তুই এমন করছিস কেন?

হৃদি ততক্ষণে কাঁপতে শুরু করেছে। ভয়ে তার দুচোখ প্রায় কোটর থেকে বেরিয়ে। আসছে। মুখের এক পাশ দিয়ে লালার মতো বের হচ্ছে। রোখসানা বেগম আতঙ্কিত গলায় বললেন, কী হয়েছে, মা? মা রে, কী হয়েছে তোর?

হৃদি তার আঙুল তুলে কিছু একটা দেখাতেই লাগল। আর গোঁ গোঁ শব্দ করতে লাগল। রোখসানা বেগম যেন হঠাই মানুষটাকে দেখলেন। গেটের বাইরে কেউ একজন গাড়ি থেকে নেমেছে। তবে এখান থেকে তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। মানুষটাকে দেখে হঠাৎ ভয় পেয়ে গেছে হৃদি। রোখসানা বেগম বললেন, কী হলো? ভয়ের কী আছে?

ও এসেছে, মা। ও এসেছে।

কে?

নেহাল। আমাকে নিচে নিয়ে যাও, মা। আমাকে ঘরে নিয়ে যাও। তারপর দরজা জানালা সব বন্ধ করে দাও। আলো নিভিয়ে দাও। মা, মা, আমাকে নিয়ে যাও।

ও নেহাল না, মা। নেহাল আর কখনো এ বাড়িতে আসতে পারবে না। তোর কাছেও আসতে পারবে না আর কোনো দিন।

না মা, ও নেহালই। ওই যে নেহাল। ও আমাকে মারবে, মা। অনেক মারবে। তারপর গায়ে সুচ ফুটিয়ে দেবে…। তারপর আবার আমি ঘুমিয়ে পড়ব। মা…ও মা। বলে হঠাৎ কাঁদতে লাগল হৃদি। তবে তার সেই কান্নাজুড়েও তীব্র আতঙ্ক। ভয়, অসহায়ত্ব। ফলে চিৎকার করে কাঁদতে পারছে না সে। যেন কেউ তার মুখ চেপে ধরে আছে, এমন বিভীষিকাময় শব্দে কাঁদছে সে। রোখসানা বেগম হৃদির দিকে তাকিয়ে চমকে গেলেন, হৃদি নিজে দুহাতে তার মুখ চেপে ধরে আছে। সে চাইছে না তার কান্নার শব্দ কেউ শুনুক। কেউ জানুক। তার মানে, নেহাল তাকে কান্নার সময় শব্দও করতে দিত না! চাইত না তার কান্নার কথা অন্য কেউ জানুক! নিশ্চয়ই তখন আরও ভয়ানক কোনো শাস্তি তাকে দিত সে। কান্না পেলে তাই এভাবে নিজের মুখ চেপে ধরে যতটা সম্ভব নিঃশব্দেই কাঁদতে হতো তাকে!

তিনি হঠাৎ মেয়েকে দুহাতে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, এখানে কেউ তোকে মারবে না। এই যে মা তোকে বুকের ভেতর নিয়ে রেখেছে। আর কেউ কখনো তোকে কিছু করতে পারবে না।

হৃদি তারপরও থামল না। সে মায়ের বুকের ভেতর গুটিসুটি মেরে কাঁদতেই লাগল। তাকে ডাক্তার দেখানো শুরু হয়েছে। ডাক্তার জানালেন, উচ্চ মাত্রার সিডেটিভসহ নানা ধরনের সাইকেডেলিক ড্রাগ দিয়ে তাকে পুরোপুরি হ্যালুসিনেশনের জগতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তার মনোজগৎকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল নেহাল এবং সেখানে সে নানাভাবে নিজের নিয়ন্ত্রণও প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছিল। নেহাল ছাড়া বাইরের জগতের আর কাউকেই তার কাছে বাস্তব মনে হতো না। মনে হতো সবই বিভ্রম।

এই অবস্থা থেকে ফিরে আসাটা সহজ নয়। কারণ, যে মাত্রার সাইকেডেলিক ড্রাগস ও সিডেটিভ হৃদিকে দেওয়া হয়েছে, তা বিপজ্জনক। এর থেকে স্থায়ী মানসিক ক্ষতি হওয়াটাও বিচিত্র কিছু নয়।

রোখসানা বেগম তার সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন ডাক্তারের নির্দেশনা অনুসরণ। করতে। কখনো কখনো মুহূর্তের জন্য মনে হয়, এই বুঝি হৃদি খানিক স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। এই বুঝি তার চোখে লেগে থাকা বিভ্রমাত্মক দৃষ্টিটা কেটে যাচ্ছে। কিন্তু পরক্ষণেই আবার গভীর বিষাদে ডুবে যান তিনি। হৃদি তখন আগের চেয়েও বেশি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যায়, ছটফট করতে থাকে ওই ঘোরে ডুবে যাওয়ার জন্য। তার মধ্যে একটা দ্বৈত সত্তা কাজ করে। একটা সত্তা ওই জগক্টাকে ভয় পায়। ওখান থেকে। বেরিয়ে আসতে চায় বা যেতেই চায় না। আরেকটা সত্তা তাকে তার ওই অভ্যস্ত ঘোের বা নেশার জগৎ থেকে বের হতে দেয় না। বারবার আহ্বান করতে থাকে। হৃদিও যেন ওই আহ্বান এড়াতে পারে না। ফলে কখনো ভীষণ বেপরোয়া আর নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে সে। আবার কখনো হয়ে যায় শিশুর মতো অসহায়, ভীত, আতঙ্কিত।

যেমন এই মুহূর্তে বাইরের দেয়ালের ওপাশে কাউকে দেখেই সে নেহালের ভয়ে জড়সড় হয়ে গেল। কাঁদল। ছুটে যেতে চাইল নিচে। কিন্তু রোখসানা বেগম তাকে ছাড়লেন না। শক্ত করে ধরে রইলেন বুকের মধ্যে। তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে। এমনই এক সন্ধ্যায় হৃদি একা বসে ছিল এই ছাদে। আর নেহাল চুপি চুপি এসে তার পাশে দাঁড়িয়েছিল। কী অদ্ভুত মোহময় সেই সন্ধ্যা। কিন্তু কে জানত, সেই সন্ধ্যার ভেতর এমন অদেখা আততায়ী লুকিয়ে ছিল!

আজও তেমনই এক সন্ধ্যা। সেই সন্ধ্যায় হৃদি আর রোখসানা বেগমের পেছনে এসে দাঁড়াল কেউ। রোখসানা বেগম তাকালেন। তারপর ওই অন্ধকারের চেয়েও বেশি জমে গেলেন তিনি। তার সামনে দাঁড়ানো এই ছেলেটাকে চেনেন তিনি। বহু বহুদিন আগে এ বাড়িতেও এসেছিল। কিন্তু সেই মানুষটা আর এই মানুষটার ভেতর অনেক তফাত। এই মানুষটা শীর্ণ, ক্লান্ত, বিধ্বস্ত কিন্তু দ্বিধাহীন। তার দাঁড়িয়ে থাকার ওই ভঙ্গিটা ঋজু। সেখানে উঁকি দিচ্ছে নিজের প্রতি বিশ্বাস কিংবা ভালোবাসা। তিনি অনিকের সঙ্গে কথা বললেন না। সেই সাহসও তার নেই। তবে হৃদিকে রেখে ধীরপায়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলেন। তিনি। সিঁড়ির দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে তিথি। আমগাছাটার ঝাকড়া ডালপালার ফাঁকে কী সুন্দর আলপনা আঁকা আলো। সেখানে বসে আছে হৃদি। অনিক আরও দুই পা এগোল। তার পায়ের শব্দে সচকিত হয়ে উঠল হৃদি। ঝট করে মুখ তুলে তাকাল সে। তারপর ভয় পেয়ে কাঁদতে গিয়েও আচমকা থমকে গেল। কে এই মানুষটা?

আবছা আলোয় মানুষটাকে কেন চিনতে পারছে না সে? ফ্যালফ্যালে চোখে দীর্ঘ সময় তাকিয়ে রইল হৃদি। তার মন ও মগজজুড়ে অসংখ্য হিজিবিজি রেখা, স্মৃতি, ভাবনা পরস্পরের সঙ্গে গলাগলি ধরে ছুটে আসতে লাগল। তারপর হারিয়ে যেতে লাগল। আবার ফিরে আসতে লাগল। কিন্তু সেই অসংখ্য রেখার কোনো একটাকেও যেন ঠিকঠাক আলাদা করতে পারল না সে।

হৃদি হঠাৎ আবিষ্কার করল, তার খুব অস্থির লাগছে। কষ্ট হচ্ছে। যেন সে শ্বাস নিতে পারছে না। বুকের ভেতর তীব্র একটা যন্ত্রণা। একটা অবর্ণনীয়, অব্যাখ্যেয় শূন্যতার অনুভব। ওই অনুভব থেকে ফিরে আসার চেষ্টা করছে সে। কিন্তু পারছে না। তার তীব্র কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে, মাথাটা ফেটে গিয়ে চারপাশে ছড়িয়ে পড়বে। সে। হঠাৎ দুহাতে মুখ চেপে ধরে মাথা ঘুরিয়ে নিল। সে জানে, এই মানুষটাকে চেনে সে। খুব চেনে। কিন্তু কেন যেন কিছুতেই উঠে দাঁড়াতে পারছে না সে। কথা বলতে পারছে না। বরং একটা অমোঘ শক্তি জলের ঘূর্ণির মতো পাক খেয়ে খেয়ে তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে গভীর কোনো অন্ধকারের অতল গহ্বরে। এমন কেন হচ্ছে তার?

অনিক ডাকল, হৃদি?

হৃদি কথা বলল না। তবে সে আরও অন্ধকারে লীন হয়ে যেতে থাকল। অনিক এগিয়ে এল। এক পা। দুই পা। তারপর আরও খানিক কাছে। তারপর ডাকল সে, হৃদি, হৃদি?

হৃদি তার দুই হাঁটুর ভঁজে মুখ লুকিয়ে ফেলল। মাথা চেপে ধরল হাতে। যেন অজস্র ঝিঁঝি পোকা কোথা থেকে উড়ে এসে তার কান ঝালপালা করে দিতে লাগল। কর্কশ শব্দে ডেকে যেতে লাগল অসংখ্য কাক। অনিক সেই এলোমেলো শব্দের ভেতর থেকেই আবার ডাকল, হৃদি, আমি অনিক।

শব্দগুলো কি হঠাৎ থেমে গেল? নিঃশব্দ হয়ে গেল কোনো অসীম শূন্য চরাচর? সেখানে কি হঠাৎ জেগে উঠল জলের শব্দ? পাখির কলতান? ফুলের সৌরভ?

হৃদি তা জানে না। তবে সে ফিরে তাকাল। অনিক অবশ্য আর এগোল না। সে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলল। হৃদি তা শুনতে পেল না। সে কেবল তার মাথায় অনিকের হাতের আলতো স্পর্শ পেল। তারপর গালে। ওই স্পর্শটুকু কী ঠান্ডা, শীতল বরফের মতো। কিন্তু হৃদির মনে হচ্ছিল ওই অনুভবটুকু যেন শিরশির করে ছড়িয়ে পড়তে লাগল তার মন ও শরীরজুড়ে। শীতল করে দিতে থাকল তার সকল যন্ত্রণা। ওই হাতটাও খুব ধরতে ইচ্ছে হচ্ছিল তার। কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল। কিন্তু সেই শক্তিটুকু নেই তার। সেই নিয়ন্ত্রণও না। একটা আধো আলো-আধো অন্ধকারের জগতে বসবাস করে সে। সেখানে তুমুল ঘোর। বিভ্রম। অনেক চেষ্টা করেও সে সেই বিভ্রমের জগৎ থেকে বেরিয়ে আসতে পারল না। তবে অনিকের দিকে তাকিয়েই রইল সে। নিষ্পলক, শূন্য, নির্বাক। মানুষটা কি তাকে হাত ধরে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করবে?

অনিক অবশ্য তেমন কিছুই করল না। সে হঠাৎ ঘুরে হাঁটতে শুরু করল। তারপর নামতে শুরু করল সিঁড়ি বেয়ে। আর ঠিক তখুনি সিঁড়ির ওপর থেকে নেমে এল তিথি। সে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল ওখানেই। হেঁটে অনিকের কাছাকাছি চলে এল সে। তারপর প্রায় ফিসফিস করে বলল, অন্তত এই সময়টুকুর জন্য হলেও আমি তোমার কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব।

অনিক কথা বলল না। ফিরেও তাকাল না আর। সে নেমে যেতে থাকল বাকি সিঁড়ি বেয়ে। কে জানে, ছাদের ওই আবছা অন্ধকারে হৃদি তখন কী করছে!

৫৩

মঈন জামিনে ছাড়া পেয়েছে। তবে ছাড়া পেয়ে ভীষণ চুপচাপ হয়ে গেছে সে। অবন্তী বার কয়েক তার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েও তেমন সাড়া পেল না। রিয়ার উধাও রহস্যেরও এখনো কোনো সমাধান হয় নি। এই নিয়ে সকলেই ভীষণ উদ্বিগ্ন। সেদিন কথাটা বললেনও আবছার আহমেদ। কিন্তু অবন্তী বলার মতো কিছু খুঁজে পেল না। পুরো বিষয়টাই একটা দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয় তার কাছে। যেন যেকোনো সময় ওই দুঃস্বপ্ন ভেঙে জেগে উঠবে সে। আর দেখবে সবকিছু ঠিকঠাক। কিন্তু কিছুতেই কিছু ঠিক হয় না। বরং চারপাশ যেন আরও থমথমে, আরও বেশি দুঃখভার হয়ে রয়।

মঈনকেও কিছু বলা হয় না তার। সে কি তার ওই দুঃসহ জীবন, যন্ত্রণাকাতর ক্ষত, অবর্ণনীয় দুর্ভোগ আর কখনো ভুলতে পারবে? পারার কথা নয়। আর সে কারণেই নিজের ভেতর আরও সেঁধিয়ে যায় সে। অবন্তী বেশ কয়েকবার তার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে। মঈন যে তাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করেছে, তা নয়। বরং সে হয়ে ছিল অচেনা মানুষ। অবন্তী সেদিন বলল, আপনি এখন কেমন আছেন?

ভালো।

শরীর?

ভালো।

বাসার সবাই?

মঈন এই প্রশ্নের জবাব দেয় নি। অবন্তী ভেবেছিল সে যে মঈনকে এখন আবার আপনি করে বলছে, এটা মঈন খেয়াল করবে। তারপর এই নিয়ে কিছু বলবে সে। কিন্তু মঈন তেমন কিছুই করল না। সে যেন সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন। তবে একদিন মঈন নিজ থেকেই জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, রিয়ার খবর কি কিছু পাওয়া গেল?

উঁহু। বলে চুপ করে রইল অবন্তী। মঈনও। তারপর হঠাৎ সে বলল, কী যে হলো মেয়েটার! আমি না কিছুই বুঝতে পারছি না।

কী বুঝতে পারছেন না?

কিছুই না। সবকিছু কেমন অসহ্য লাগছে।

অবন্তী আর কথা বলল না। মঈনও না। তারা জানেও না আর কী নিয়ে কথা বলবে তারা।

অবন্তী অবশ্য আরও একবার চেষ্টা করল। সেদিন ফোন করে বলল, আপনি কি একদিন আমার সঙ্গে একটু দেখা করবেন?

কেন?

কারণ নেই।

তাহলে?

কারণ ছাড়া দেখা করা যায় না?

আমার না কিছু ভালো লাগছে না, অবন্তী।

নিজেকে একটু সময় তো দিতে হবে। কী ভয়ংকর একটা ঝড়ই না গেল আপনার ওপর দিয়ে।

ওটার জন্য না।

তাহলে।

এ কথা আমি কাউকে কখনো বলতে পারব না, অবন্তী। তোমাকেও না।

এই কথায় অবন্তী চুপ করে রইল। তারপর বলল, তাহলে সব মানুষের জীবনেই এমন কিছু কথা থাকে, যা কখনো কাউকে বলা যায় না?

হয়তো। বলে থামল মঈন। তারপর বলল, হয়তো না। থাকেই।

আমার কথাটাও যে তেমনই ছিল! যেটা আমি কোনো দিন আপনাকে বলতে চাই। নি। আসলে পারতাম না।

এখন পারবে?

জানি না। তবে আপনি যখন জেলখানায় ছিলেন, তখন মনে হচ্ছিল, আমি কথাটা আপনাকে বলব। যত খারাপই হোক, আমি বলব। আর তারপর, আপনি আমাকে যা করতে বলবেন, আমি তা-ই করব।

মঈন কথা বলল না। চুপ করে রইল দীর্ঘ সময়। তারপর হঠাৎ বলল, কেন যেন এখন আর তোমার ওই কথাটা আমার জানতে ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে, আমি যেমন। আমার খুব গোপন, কুৎসিত একটা কথা তোমাকে বলতে পারছি না, ঠিক তেমনই তোমার কথাটাও হয়তো অমন কিছুই!

কিন্তু আমার এখন কি মনে হয়, জানেন?

কী?

মনে হয়, যদি আমরা নিজেরা কোনো অন্যায় না করি, তাহলে অন্যের কুৎসিত কিছুর দায় আমরা কেন নেব?

এ কথা কেন বললে?

কারণ, আমি তো কোনো অন্যায় করি নি। তাহলে অন্যজনের অন্যায়কে কেন আমি বয়ে বেড়াব? তার জন্য কেন আমি আমার প্রিয় মানুষের থেকে দূরে সরে যাব?

কী হয়েছে, অবন্তী?

বলব। আপনার সঙ্গে এরপর দেখা হলেই বলব। অনেক অনেক কিছু বলব।

অবন্তী সেদিন আর কিছু বলল না। তবে তারা দেখা করল তার দুদিন বাদেই।

.

আশুলিয়ার এই রাস্তাটা সুন্দর। দিনটাও ঝলমলে। রাস্তার পাশে টলটলে জল। সেই জলে ফুরফুরে হাওয়া মৃদু ঢেউ তুলছে। অবন্তী বলল, আপনার মন খারাপ কেন?

মঈন কথা বলল না। একটা ঢিল ছুঁড়ে ফেলল জলে। অসংখ্য তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। অবন্তী বলল, মানুষের জীবনের বড় দুঃখ এবং আনন্দ ওই ঢিলটার মতো।

কীভাবে?

যখন বড় কোনো আনন্দের ঘটনা ঘটে, তখন তা অমন করে অসংখ্য ঢেউয়ের মতো ছড়িয়ে পড়ে। তখন সবকিছুই আনন্দময় মনে হয়। আবার খুব খারাপ কিছু ঘটলে সেটাও অমন ছড়িয়ে গিয়ে বাকি সব বিষাদময় করে তোলে।

মঈন অবন্তীর দিকে তাকাল। কথাটা পছন্দ হয়েছে তার। কিন্তু জীবনের কোনো দুর্বিপাকই তাকে এতটা ভেঙে দিতে পারে নি, যতটা ভেঙে দিয়েছে বলতে-না-পারা এই কুৎসিত ঘটনাটা। তার পুরো জীবন, বিশ্বাস, ভাবনা–সবকিছুই মুহূর্তে টালমাটাল করে দিয়েছে। ভেতরে ভেতরে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে সে। এই জীবনে নিজের ওই ভাঙা টুকরোগুলোকে এক করে কি আর কখনো উঠে দাঁড়াতে পারবে সে? দীর্ঘশ্বাস ফেলল মঈন।

অবন্তী হঠাৎ বলল, আপনার বলতে হবে না। আমি জানি আপনার কেন মন খারাপ?

মঈন ঝট করে তাকাল, তুমি জানো?

হুম।

কী করে?

মা জানিয়েছে।

তোমার মা?

হুম।

উনি কী করে জানলেন?

ময়না যে মেয়েটা, ওর মা-ই বলেছে।

তাহলে কি গ্রামের সবাই এখন জানে?

মনে হয় না। আমি অবশ্য জিজ্ঞেস করি নি আর। ওটুকু শুনেই নিজেকে বরং ভাগ্যবান মনে হয়েছে আমার।

মানে! ভ্রু কুঁচকে তাকাল মঈন। এই ঘটনায় তোমার নিজেকে ভাগ্যবান মনে হচ্ছে মানে কী?

অবন্তী কথা বলল না। মঈন বলল, আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না, অবন্তী।

অবন্তী এবারও কথা বলল না। দূরে একটা চিল উড়ে যাচ্ছে। তার ছায়া পড়েছে নদীর জলে। সেই ছায়া ঢেউয়ের স্পন্দনে কাঁপছে। তার ওপারে একটা নৌকা। একা একটা রেইনট্রিগাছ। আকাশে ঠিক নৌকার মতোই ভেসে যাচ্ছে মেঘ। সবকিছুই ছবির মতো সুন্দর। অথচ সেই সুন্দর ছবির ভেতরও কোথায় যেন একটা তীব্র বিষাদ। অবন্তী কিংবা মঈন তারা কেউ সেই বিষাদটুকু ধরতে চায় না। কিন্তু বিষাদ এমন ভয়ংকর যে তা আলগোছে, অগোচরে বুকের ভেতর বসত গাড়তে থাকে সন্তর্পণে। তারপর নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করে সদর্পে। মেঘলা আকাশের মতো থমথমে করে দেয় সব। এই অবন্তীকে যেমন।

মঈন বলল, কী হলো, বলো?

অবন্তী দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর সোজা হয়ে বসল। বলল, আপনার মনে আছে আমি এইচএসসির পর কোচিং করতে ঢাকায় এসেছিলাম?

হ্যাঁ। কেন মনে থাকবে না, তারপর এসেই তো শুনলে যে আমাকে পুলিশে ধরেছে।

হুম।

আব্বা আর তুমি এসেছিলে। লঞ্চে।

হুম।

বলে আবার চুপ করে রইল অবন্তী। হঠাই তার চোখের কোলে জল জমতে শুরু করেছে। থরথর করে কাঁপতে শুরু করেছে শরীর। মঈন যেন মুহূর্তেই কিছু একটা আঁচ করতে পারল। সে দুহাতে অবন্তীকে জড়িয়ে ধরতে গিয়েও হঠাৎ থমকে গেল। বলল, অবন্তী? অবন্তী?

উ? যেন বহু দূর কোনো দেশ থেকে উত্তর দিল সে।

আব্বা কি সেদিন লঞ্চে তোমার সঙ্গে…। কথাটা শেষ করতে পারল না মঈন। তার আগেই ঝড়ে উপড়ে পড়া বৃক্ষের মতো সমূলে উপড়ে পড়ল অবন্তী। হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল সে। মঈন চেষ্টা করেও আর তাকে স্পর্শ করতে পারল না। যেন নিজেকে হঠাৎ ঘৃণ্য, অচ্ছুৎ, জঘন্য গা-ঘিনঘিনে এক প্রাণী মনে হতে লাগল তার।

অবন্তী কাঁদছে। মঈন নিঃসাড়ে তাকিয়ে আছে আকাশে উড়ে চলা নিঃসঙ্গ একা চিলটার দিকে।

অবন্তী কান্নাজড়ানো গলায় বলল, এই কথা আমি আপনাকে কী করে বলতাম? আপনিই বলেন, এই কথা কি কাউকে বলা যায়? ওনাকে আমি বাবাই ভাবতাম। নিজের বাবা। অথচ সেই মানুষটা। বলে আবারও কাঁদতে লাগল সে। বলল, আমি এই কথা আপনাকে বলতে পারতাম না। আমি যা পারতাম, তা হলো আপনার কাছ থেকে চুপচাপ দূরে সরে আসতে। সেটাই করেছিলাম আমি।

মঈন কী বলবে, জানে না। তার জগৎসংসার সব লন্ডভন্ড হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, সে দাঁড়িয়ে আছে এক অসীম অতল শূন্যতায়। এই শূন্যতা থেকে এই জীবনে আর পরিত্রাণ নেই তার। বাবা সম্পর্কে জেলে থাকতেই ভয়াবহ জঘন্য এক খবর সে শুনেছে। কিন্তু কথাটা কিছুতেই বিশ্বাস হয় নি তার। কিন্তু আজ এখন অবন্তীর কাছে এ সে কী শুনছে!

অবন্তী নিজেকে খানিক সামলে নিল। তারপর বলল, তবে হ্যাঁ, আপনাদের বাড়ির কাজের মেয়েটার চেয়ে আমি ভাগ্যবানই ছিলাম। আমার বড় কোনো ক্ষতি উনি করতে। পারেন নি। তার আগেই ঘটনা বুঝে ফেলেছিলাম আমি। কিন্তু ধাক্কাটা প্রথমে সামলাতে পারি নি। দুঃস্বপ্নেও ভাবি নি উনি এমন কিছু করতে পারেন। ফলে একটু সময় লেগেছিল বুঝতে। কিন্তু বোঝামাত্রই কৌশলে কেবিন থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলাম আমি। তারপর সারা রাত আর ফিরি নি। লঞ্চের ডেকে অনেক মানুষের সঙ্গে রাতভর বসে থেকে ঢাকায় পৌঁছেছিলাম।

একটা অসহ্য নীরবতা জমাট অন্ধকারের মতো ওই দিনের আলোতেও যেন গাঢ় থেকে গাঢ় হতে লাগল। অবন্তী বা মঈন কেউ আর কোনো কথা বলল না। তবে তিরতির করে বয়ে যাওয়া জলের ঢেউ, ফুরফুরে হাওয়া, পাতার শব্দ, পাখির গান কী সব বলে যেতে লাগল। অবন্তী আর মঈন অবশ্য সেসব আর শুনল না। তারা কেবল নিজেদের বুকের ভেতর বয়ে যাওয়া অতল যন্ত্রণার অবিনাশী কান্নায় বুঁদ হয়ে রইল।

.

তারা ফিরল সন্ধ্যার আগে। ফিরতে ফিরতেই মঈন বলল, আমি এখন কী করব?

অবন্তী জবাব দিল না। এই প্রশ্নের উত্তর অবন্তীর কাছে নেই। মঈন বলল, আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে।

মৃত্যুই কি সবকিছুর সমাধান?

তাহলে?

বেঁচে থাকা। বলল অবন্তী। সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকা।

কিন্তু সেটা তো আর নেই আমার। আই লস্ট এভরিথিং। আমি গ্রামে কাউকে মুখ দেখাতে পারব?

ইউ ক্যান গেইন এভরিথিং।

কীভাবে?

আমরা সবাই একটা অদ্ভুত কাজ করি, জানেন? সবাই।

কী কাজ?

অন্য কেউ অপরাধ করলে আমরা যেমন হইচই করি, নিজেদের কেউ করলে কিন্তু তেমন করি না। বরং আড়াল করে রাখার চেষ্টা করি। নিজের বাবা, সন্তান, ভাই, বোন, বন্ধু বা রিলেটিভ করলে তখন আমরা সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করি তাকে রক্ষা করতে। আড়াল করতে। তাই না?

মঈন কথা বলল না। অবন্তী বলল, ওতে বরং অপরাধীকে উসকে দেওয়া হয়। অথচ আমরা সবাই যদি সবার আগে এই জায়গাটায় শক্ত হতাম, আমাদের নিজেদের ঘরের অপরাধীদের প্রতি, তাহলে দেখতেন পৃথিবীটা অন্য রকম হতে পারত। অন্য রকম সুন্দর।

কী করব আমি?

বাড়ি যাবেন। গিয়ে ময়নাকে থানায় নিয়ে গিয়ে আপনি নিজে আপনার বাবার নামে একটা ধর্ষণ মামলা করাবেন।

আমি?

হুম। আপনি। দেখবেন, হাউ ইউ লিভ উইথ ইয়োর ডিগনিটি। মাথা উঁচু করে বাঁচবেন তখন।

মঈন কথা বলল না। চুপ করে তাকিয়ে রইল রিকশার প্যাডেলের দিকে। চাকার দিকে। রাস্তার দিকে। দীর্ঘ সময়। তারপর বলল, আমি কি একটু তোমার হাত ধরতে পারব?

অবন্তী কথা বলল না। তবে সে সসংকোচে তার হাতটা মঈনের দিকে বাড়িয়ে দিল। মঈন বলল, আমার আরও একবার জেলে যেতে খুব ভয় হচ্ছে, অবন্তী।

আপনি আবার জেলে কেন যাবেন?

তুমি শব্দটা শুনবার জন্য।

মানে?

মানে আরেকবার তোমার কাছ থেকে তুমি শুনতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু আমি জেলে না গেলে তো আর…।

অবন্তী হঠাৎ হেসে ফেলল। মৃদু কিন্তু প্রাণবন্ত সেই হাসি। তার আচমকা মনে হলো, এমন আনন্দময় নির্ভেজাল হাসি সে বহুদিন হাসে নি।

৫৪

ফোনটা এল ঠিক দুপুর দুইটা কুড়ি মিনিটে। দুপুরের খাবার খেয়ে রুমেই বসে ছিলেন আবছার আহমেদ। একটু ঝিমুনির মতোও এসেছিল। এই সময়ে ফোন দেখে ভারি বিরক্ত হলেন তিনি। তারপরও ধরলেন। ফোনের ওপারের কণ্ঠটা শুনে হঠাৎ ঘুম কেটে গেল। কেউ একজন আতঙ্কিত গলায় বলছে, স্যার, স্যার?

জি, কে বলছেন?

লোকটা তার কথা শুনল কি না বোঝা গেল না। তবে সে হড়বড় করে বলতে লাগল, স্যার, এখুনি একটু আমার বাসায় আসতে হবে। এখুনি। ভয়াবহ ঘটনা, স্যার। এমন ঘটনা কেউ কোনো দিন দেখে নি, স্যার। স্যার। লোকটার গলা কাঁপছে। প্রবল। আতঙ্কে জড়িয়ে যাচ্ছে কথা।

আবছার আহমেদ বললেন, কী হয়েছে?

আমি মুখে বলতে পারব না, স্যার। আপনি আসেন, স্যার। এখুনি আসেন।

কোথায় আসব? কে আপনি?

আমার নাম মোহাম্মদ আশরাফুদ্দিন। প্রফেসর ড. মাহমুদ হাসানের বাসাটা আমি কিনেছি, স্যার।

.

আবছার আহমেদ ঘরে ঢুকে দেখেন চারপাশে সব এলোমেলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। কয়েকজন মিস্ত্রি ফ্যাকাশে মুখে বসে আছে। ঘরের প্রতিটি মানুষের চোখেমুখে তীব্র আতঙ্ক, অবিশ্বাস।

কী হয়েছে? জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

আশরাফুদ্দিন বললেন, এই তিন-চার মাস হলো এই বাসা আমি প্রফেসর সাহেবের কাছ থেকে কিনেছি। খুবই অল্প দাম। ঢাকা শহরে এই দামে এখন টিনের ঘরও পাওয়া যায় না।

হুম।

তো উনি যখন বাসাটা ছাড়েন, তখনই এইখানে-ওইখানে ভাঙাচোরা ছিল। মানে ইন্টেরিয়রের কাজ করতে শুরু করেও কী কারণে যেন বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ফলে ওই টয়লেট আর দুইটা রুমের দেয়ালটেয়াল ভাঙা ছিল। তো আমি ভাবলাম, এত কম দামে যেহেতু পাচ্ছি, পরে না হয় কিছু টাকা খরচ করে নিজের মতো সাজিয়ে নেব।

তারপর? একটু অধৈর্য হয়ে উঠেছেন আবছার আহমেদ।

গত কয়েক দিন ধরে মিস্ত্রি নিয়েছি কাজ করতে। আজ খেয়াল করলাম, বেডরুমের বাথরুমের ওপরে যে ফলস ছাদ আছে, ওই ছাদের প্রায় অর্ধেকটা সিমেন্ট করে প্লাস্টার করা। অতিরিক্ত জিনিসপত্র যে ওইখানে রাখব, সেই সুযোগ নাই। অত বড় বাথরুমের ওপরে এত ছোট ফলস সিলিং তো হয় না।

আবছার আহমেদ কৌতূহলী ভঙ্গিতে বেডরুমে ঢুকলেন। আশরাফুদ্দিন বললেন, তো ভাবলাম ফলস সিলিংয়ের বাকি অর্ধেক কেন আলাদা করে সিমেন্ট আর প্লাস্টার করা একটু দেখি। প্রয়োজনে ওটা ভেঙে জায়গাটা আরেকটু বড় করব। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, ওই সিমেন্ট-প্লাস্টার বেশি দিন হয় নাই করেছে। এবড়োখেবড়ো। আনফিনিশড। কেউ তাড়াহুড়া করে কোনো রকমে করেছে।

তারপর?

তারপর…। তারপর ভাঙতে যেতেই দেখি ওই সিমেন্টর ভিতর একটা লাশ। প্লাস্টার করা!

হোয়াট! কী বলছেন আপনি? আবছার আহমেদের বুকে যেন রক্ত ছলকে উঠল। লাশ?

জি স্যার।

বাথরুমের ফলস সিলিংয়ের ভেতরে আলাদা সিমেন্ট করে সেটার ভেতর লাশ রেখে প্লাস্টার করা?

জি স্যার।

আবছার আহমেদ আর কথা বললেন না। তিনি মই দিয়ে সিলিং অবধি উঠলেন। তারপর যে দৃশ্যটা দেখলেন, সেই দৃশ্য তিনি আর তার এই জীবনে কখনো ভুলতে পারবেন না। সেখানে হাতুড়ি দিয়ে সিমেন্টের আস্তরণ কিছুটা ভাঙা হয়েছে। সেই আস্তরণের ভেতর থেকে একটা মেয়ের মুখ বেরিয়ে আছে। মুখটা দেখে পুরো শরীর শিরশির করে উঠল আবছার আহমেদের। মেরুদণ্ড বেয়ে তিরতির করে নেমে গেল ভয়ের তীব্র শীতল স্রোত। মেয়েটার চোখ বন্ধ। তারপরও মনে হচ্ছে সে যেন তার দিকেই তাকিয়ে আছে। বীভৎস সেই দৃশ্য আর সহ্য করতে পারলেন না আবছার আহমেদ। তিনি কোনোমতে মই বেয়ে নেমে এলেন।

.

মাহমুদ হাসান কেন রিয়াকে খুন করলেন, সেই রহস্য থেকে গেল অজানাই। অজানা হয়ে রইল তার অনুভবের আখ্যানও। স্ত্রী সুমির জন্য তার মন খারাপের দিন যাপন কখনোই বিবর্ণ হয় নি। বরং ওই যন্ত্রণাটুকু বুকে নিয়েই তিনি রিয়াকে ভালোবেসেছিলেন। সেই ভালোবাসার স্পর্শটুকুও কখনোই অকিঞ্চিৎকর ছিল না। বরং রিয়া তাকে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছিল। যেন তার জীবনের সকল তেষ্টা, অপূর্ণতাকে লীন করে দিয়েছিল অপার আনন্দে। এ জীবনে যা কখনো পাওয়া হয় নি, তার সবটুকুই যেন অঢেল ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ করে দিয়েছিল সে। তারপরও কেন এমন করলেন তিনি?

এই প্রশ্নের উত্তর কারও কাছেই নেই। হয়তো নেই মাহমুদ হাসানের কাছেও। আবছার আহমেদের ধারণা, রিয়া তার কোনো গোপন গল্প জেনে গিয়েছিল। জেনে গিয়েছিল তার রহস্যাবৃত জীবনের অসংখ্য গলিখুঁজিও। সেই গল্প কিংবা গলিখুঁজিতে কী ছিল কে জানে!

তবে ওই ছাদের গায়ে অস্পষ্ট করে লিখে রাখা কয়েকটি লাইন দেখে চমকে গিয়েছিলেন তিনি। এ যেন রিয়ার ওই বিভৎস বিভীষিকাময় কবরের গায়ে লেখ অদ্ভুত এক এপিটাফ।

আমাকে চেয়ে পাবে ধুলো, থেমে যাওয়া মৃত নদীগুলো
আমাকে চেয়ে পাবে ভুল, জলে ডোবা ক্লান্তির চক্ষু দুকূল।
আমাকে চেয়ে পাবে ব্যথা–
অঝোর শ্রাবণ জলে লেখা, বিরহ বসন, দুঃখগাথা।

৫৫

টিনের চালে শিশিরের শব্দটা কান্নার মতো। টুপ করে ঝরে পড়ে। তারপর গাল বেয়ে নেমে আসার মতো নেমে আসতে থাকে টিনের নিথর শীতল শরীর বেয়ে। রাত হলে অনিক খুব মন দিয়ে ওই শিশিরের শব্দ শোনে। শোনে পাতাঝরার শব্দও। চারপাশটা তখন এত শূন্য, এত অর্থহীন মনে হতে থাকে। এমনকি এই সব দুঃখ, অপ্রাপ্তি, ভালোবাসা, ঘৃণা কিংবা আর সব ব্যক্তিগত অনুভূতিও। মনে হয়, এইটুকু নশ্বর জীবনে দুঃখ ও দহন, বিষাদ ও বিবমিষা কেন অবিনশ্বর হয়ে থাকবে? আর ভালোবাসা পড়ে রইবে আড়ালে, আবডালে, অভিমানে স্পর্শহীন?

হয়তো এ কারণেই এই সব অর্থহীন ভাবনার অনুভব পেরিয়ে হৃদির জন্য তার মন কেমন করে। তিথির ওই শেষ কথাটুকু কানে বাজে তার, এই জীবনে অন্তত একবারের জন্য হলেও হৃদি তার সঙ্গে দেখা করতে চায়। একমুহূর্তের জন্য তার পায়ের কাছে বসে থাকতে চায় তার আগে মরতে চায় না সে।

কিন্তু কেন?

এই প্রশ্নের উত্তর অনিকের কাছে নেই। যে হৃদির সঙ্গে তার সেই সন্ধ্যার অন্ধকারে, ছাদে একমুহূর্তের দেখা হয়েছিল, সে কি আসলেই হৃদি ছিল? নাকি হৃদির ছায়া? কিন্তু হৃদি তো তার ছায়া হয়ে দেখা করতে চায় নি। তাহলে? অনিক কি আর কখনো ওই ঘুমঘোর ভাঙা সত্যিকারের হৃদির মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়াবে? শুনতে চাইবে কেন সে একবারের জন্য হলেও দেখা করতে চেয়েছিল?

আচ্ছা, হৃদিকে কি সে ঘৃণা করে? অনিকের ধারণা, এর উত্তর সে জানে না। কিংবা বিষয়টা খুব গোলমেলে। হৃদি তার সঙ্গে যা করেছে, তাতে তাকে ঘৃণা করা অবশ্যম্ভাবীই। কিন্তু সে তাহলে পারে না কেন?

হৃদি কি তবে তার কাছে বদলে যাওয়ার আগের স্মৃতিতেই আটকে আছে? সেই হৃদি, যে তার অসুস্থ মায়ের কাছে দিনমান বসে থাকত আদরে-আহ্লাদে, যার চোখেমুখে লেগে থাকত আশ্চর্য মায়ার বিভা। আর চোখের তারায় ভেসে উঠত স্বচ্ছ জলের আয়না। সেই আয়নায় মুখ দেখা যেত, মন দেখা যেত, দেখা যেত মানুষও।

অনিক কেন এখনো সেই মানুষটাকেই বুকের ভেতর এমন যত্ন করে সঞ্চয় করে রেখেছে? তার জন্য কেন তার কষ্ট হয়? কেন সে চেষ্টা করেও এই বদলে যাওয়া হৃদিকে চোখের সামনে এনে দাঁড় করাতে পারে না? ঘৃণায়, অবজ্ঞায় অপাক্তেয় করে রাখতে পারে না!

কেন এখনো এই রাতদুপুরের একাকী নিঃসঙ্গতায় ভোরের কুয়াশা ভেঙে জানালার ফাঁক গলে মেঝেতে গড়িয়ে পড়া অমল আলোর মতো ভেসে ওঠে হৃদি? সেই যে ধলেশ্বরীর মাঠ, মাঠের পাশে নদী, নদীর বুকে শব্দ ছলছল। আকাশজোড়া মেঘ, মেঘের বুকে বৃষ্টি নামের নদী, ডাকছে অবিরল?

কেন ডাকে? কেন সে ধূসর হয়ে যায় না ঘৃণায়, ক্রোধে? কেন সে জেগে থাকে অবিরাম, অনিবার অসুখের মতো? এ কেমন অসুখ, যার যন্ত্রণায় বুকের ভেতর জ্বলে ওঠে উনুন। সেই উনুনের আঁচে দগ্ধ হতে থাকে সব অভিমান, ঘৃণা, ক্রোধ। তারপর মায়াময় ছায়া হয়ে ডেকে যায় অমোঘ আহ্বানের মতো। অনিকের সাধ্য কি তা এড়ায়?

অনিক এক মাঝরাতে ঘর থেকে বেরোয়। উদ্দেশ্যহীন। যেন এই জীবনে কোথাও আর যাওয়ার নেই তার। কিন্তু তারপরও সে পৌঁছে যায় এক অমোঘ গন্তব্যে।

মাথার ওপর ছাতার মতো ছড়িয়ে থাকা আমগাছওয়ালা বাড়িটার সামনে গিয়ে সে যখন দাঁড়ায়, তখন কেবল ভোরের আলো ফুটেছে। কিন্তু বাড়ির দরজা পেরোতেই সে অবাক তাকায়। উঠানে মানুষের ভিড়। তার ওপাশে মিহি সুরের কান্না। তার ওপাশে আগরবাতির ঘ্রাণ। তার ওপারে বাতাসে ভেসে যেতে থাকে কারও হৃদয়। সেই হৃদয় অনিক আর ছুঁতে পারে না। কিংবা ছুঁয়ে দিলেও ধরে রাখতে পারে না। স্টেইনলেস স্টিলের খাঁটিয়াতে হৃদি তাই নিথর হয়ে পড়ে থাকে সফেদ কাফনে।

শুভ্র শামিয়ানার নিচে অনিক গিয়ে দাঁড়ায়। তার পায়ের তলায় অদ্ভুত এক অনুভূতি হয়। সেই অনুভূতির নাম সে জানে না। কোথা হতে অজস্র কান্না এসে তাকে ঘিরে ধরে। কিন্তু কাঁদে না সে। আলগোছে বসে দুহাতে শক্ত করে ওই খাঁটিয়াটা ধরে রাখে। তারপর বসেই থাকে। অনন্তকাল। যেন থমকে থাকে সময়। কান্না ও ক্লান্তি। জরা ও যন্ত্রণা।

কেউ তার পেছনে এসে দাঁড়ায়। অনিক ফিরে তাকায়। তিথি। সে কিছু বলে না। তিথিও না। কেবল ওই আগরবাতির ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়তে থাকে চারপাশে। মিশে যেতে থাকে হাস্নাহেনা, বকুল ফুলের সঙ্গে। কোথা থেকে এসে এক হয়ে যায় গোলাপ ও গোলাপজলও। তার সঙ্গে খানিক হৃদয়।

তিথি হঠাৎ ফিসফিস করে বলে, ও প্রায় সেরে গিয়েছিল। ভালো হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ওর আর সব অসুখের চেয়েও বড় হয়ে উঠেছিল অন্য এক অসুখ। সেই অসুখ সারানোর সাধ্য তো কারও ছিল না!

কী অসুখ?

সব অসুখ তো আর চোখে দেখা যায় না! কিছু অসুখ কেবল অনুভব করা যায়। কিন্তু আমাদের সাধ্য কী আমরা তা বুঝি?

অনিক তাকায় না। সে বসে থাকে নিশ্চল পাথুরে মূর্তির মতো। তিথি বলে, ওই অসুখটাই ওকে আর ছাড়ল না।

অনিক আবার তাকায়। তিথি বলে, ওই অসুখ কেউ সারাতেও পারত না। নিজের বোধের আগুনে যে পুড়ে যায়, তাকে কে রক্ষা করবে?

অনিক কাঁদল। এক ফোঁটা জল টুপ করে পড়ল ওই সাদা শুভ্র কাফনের ওপর। তিথি বলল, ওই অসুখটাই ছিলে তুমি। হয়তো ওর প্রিয়তম অসুখও।

.

সময় ও জীবন কোন অগোচরে বয়ে যায় মানুষ তা জানে না। মানুষ কেবল জানে জীবনজুড়ে যে গভীর ক্ষত সে বয়ে বেড়ায়, সেই ক্ষতের যন্ত্রণা ক্রমশই মুছে দিতে থাকে সময়। মুছে দিতে থাকে বেদনায় বিদীর্ণ হৃদয়ের ক্ষত। কিন্তু ক্ষত মুছে গেলেও থেকে যায় দাগ। সেই দাগে লেখা থাকে কত কত স্মৃতি-বিস্মৃতির গল্প। সেই গল্প মানুষ ভুলবে কী করে?

আর তাই তো এই জনমের কোনো একাকী দুপুর, বিষণ্ণ সন্ধ্যা কিংবা মন খারাপের রাত্তির বয়ে আনে উত্তরে হিম হাওয়া। সেই হাওয়ায় অনিক জেগে থাকে একা। আর তার বুকের বাঁ পাশে আলগোছে জেগে থাকে তৃষিত হৃদয়।

সেই হৃদয় সব ভুলে অকূলে আকুল হয়ে যেন হাওয়াদের গানে গানে কানে কানে বলে যায়–

সে এসে বসুক পাশে, যেভাবে অসুখ আসে
তারপর হয়ে যাক যন্ত্রণা অনায়াসে
তবুও আসুক সে।
জানুক–প্রিয়তম অসুখ সে!

সেই আহ্বান হৃদি কি শুনতে পায়?

2 Comments
Collapse Comments

শেষটা কি একটু সুন্দর করা যেতো না? হৃদিকে অনিক এর করে রাখা যেতো না?

অনিক আর হ্রদি কী আবার আগের মতো হতে পারত না?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *