৫। পয়োষ্ণী

৫। পয়োষ্ণী

ইরতেনসেনু এখন এই ভারত ভূখণ্ডের কন্যা। মিশর ছেড়ে আসার সময় সে জানত হয়তো আর কখনও তার ফিরে আসা হবে না। ভারতবর্ষের অভিমুখে দীর্ঘ যাত্রাপথে অগস্ত্যের মুখে এই দেশের এবং বিদর্ভের অনেক গল্প শুনেছে ইরতেনসেনু। সেই দিনগুলির মধ্যেই দ্রুত রপ্ত করেছে প্রাকৃত ভাষায় কথা বলা। ব্রাহ্মী হরফ পড়তে এবং তা ব্যবহার করে লিখতে যদিও তার সময় লেগেছে আরও কিছু মাস। তবে তা সে নিশ্চিন্তে করতে পেরেছে রাজ অন্তঃপুরে। রানি কঙ্কাবতী শিখিয়েছেন।

ভারতভূমি যে এভাবে তাকে সাদর আমন্ত্রণ জানাবে তা সে আশা করেনি। তবে এর পিছনে অগস্ত্যের বুদ্ধি আছে। ভিনদেশি তরুণীকে রাজ-ঋষি তার পত্নী রূপে গ্রহণ করছে এ ভারতীয়রা মেনে নিত কি না সে ব্যাপারে সন্দেহ ছিল অগস্ত্যের মনে। তাই সে গহীন অরণ্যে তপস্যা এবং ব্রহ্মার বরের আশ্চর্য কাহিনির সৃষ্টি করে। এতে তার আকস্মিক নিরুদ্দেশকে একটা কারণ দেওয়া গেল এবং ইরতেনসেনুকেও তার পক্ষে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করাটা সহজ হল। ধর্মপ্রাণ রাজা বসুমান অগস্ত্যের অলৌকিক ক্ষমতায় মুগ্ধ তো ছিলেনই। তাই বন্য হরিনী লুপ্ত হয়ে লোপামুদ্রার জন্মের আখ্যানকে বিশ্বাস করতে তিনি বিন্দুমাত্র কালক্ষেপ করেননি। রাজা এবং রানি দুজনেই তাকে আপন করে নিয়েছিলেন।

ইরতেনসেনু রানির কাছে শিখেছে কেমন ভাবে ভারতীয় মেয়েরা কাঁচুলি এবং শাড়ি পরে, কেমন ভাবে তারা স্নানের আগে চন্দনের প্রলেপে নিজেদের অঙ্গ চর্চিত করে। চন্দন বস্তুটি ইরতেনসেনুর কাছে একেবারেই নতুন। কোন এক গাছের কাণ্ড থেকে যে এমন সুরভিত দ্রব্য তৈরি হতে পারে তা তার জানা ছিল না। ভারতীয়দের খাদ্যরীতিও তাকে অবাক করে। ছাগ এবং শূকরের মাংসের সঙ্গে সে পূর্ব পরিচিত ছিলই, কিন্তু মিশরে তারা প্রধানত মাংসকে কাঠকয়লার আগুনে পুড়িয়ে খায়। অপূর্ব সেই নরম মাংসের স্বাদ। ভারতীয়রা সেই মাংসই নানা প্রকার মশলা সহযোগে মাটির তৈরি হাঁড়িতে রান্না করে, তার স্বাদও অতুলনীয়।

এই দেশের মানুষ মিষ্টান্নও প্রচুর পরিমাণে খায়, প্রতিটি খাবারের শেষ ভাগে কোনও না কোনও প্রকারের মিষ্টান্ন থাকবেই। ইরতেনসেনু খাদ্যরসিক। সে প্রায় দিনই নতুন নতুন খাবার আবিষ্কার করে উৎফুল্ল হয়, আবার একই সঙ্গে নিজের দেশের ভুট্টার রুটি এবং নীলনদের পাড়ে জন্মানো নলিশাক ভাজার কথা মনে পড়ে তার। সুগন্ধি দ্রব্য এবং সুস্বাদু খাদ্য, এই দুই হল ইরতেনসেনুর দুই দুর্বলতা। একদিন দারুণ সুস্বাদু ময়ূরের মাংস খেতে খেতে সে মিশরের ভাষাতেই বলে উঠেছিল, ‘হো হুন্দিহাসে!’

অতি উত্তম!

এই বলেই সে নিজেকে সামলে নিয়েছিল। কী ভাগ্য যে তখন তার আশেপাশে তেমন কেউ ছিল না। যে পরিচারিকাটি খাবার পরিবেশন করছিল সেই শুধু অবাক চোখে তাকিয়েছিল তার দিকে। ঈশ্বরসৃষ্ট কন্যাটি প্রথমবার কোন ভাষা শিখছেন, তাই তার মুখে নড়বড়ে প্রাকৃত ভাষা মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু অন্য দেশের একটি ভাষা কীভাবে সেই জিহ্বা থেকে উদ্‌গত হল তার ব্যাখ্যা করাটা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য হতো বই কী বর্তমানে ভারতবর্ষের সঙ্গে মিশরের বাণিজ্যিক আদান-প্রদান ভালোই চলে। তাই রাজ অন্তঃপুরের কোন কর্মচারী বা দাসীর এই ভাষাকে চিনতে পারলে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তাই ইরতেনসেনু এই ব্যাপারে সদা সতর্ক থাকে।

সেইসঙ্গে তার মনে এক দোলাচলও আনাগোনা করে। এইভাবে কি সে দুটি মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে না? রাজা বসুমান এবং রানি কঙ্কাবতী তার সম্পূর্ণ অজ্ঞাতপরিচয় হয়েও তাকে নিঃস্বার্থ ভালোবাসায় ভরিয়ে দিয়েছেন। আবার অন্যদিক থেকে ভাবতে গেলে ইরতেনসেনুও তাদের সন্তানের অভাবকে দূর করেছেন, রাজা তার আসল পরিচয় না জেনে যে অমলিন আনন্দ পাচ্ছেন তারই বা তুলনা কীভাবে হয়। এই ভেবে ইরতেনসেনু সামান্য আশ্বস্ত হয়।

নিজের উপাস্যদেবী হাথোরকে উদ্দেশ্য করে সে বলে, ‘হে দেবী, আমায় ক্ষমা করবেন। জানবেন, এই মিথ্যার আড়ালে এই মানুষ দুটিকে প্রতারিত করার কোনও ইচ্ছা আমার নেই। অগস্ত্যকে আমি ভালোবেসেছি, তাকে স্বামী রূপে গ্রহণ করেছি। তার সঙ্গেই আমার বাকি জীবন অতিবাহিত করতে চাই, তাই এই দেশের সঙ্গে মিশে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল আমার।’

তখনই যেন নিজের মনেরই অন্য আরেকটি অংশ বলে ওঠে, যেন দেবী হাথোরই বলেন, ‘আর এই দেশবাসীর কথা কি ভেবেছ তুমি? যারা বিনা দ্বন্দ্বে তোমাকে নিজের করে নিয়েছে, যে দেশের মাটি তোমাকে ধারণ করছে, বায়ু তোমাকে প্রাণময় করছে, খাদ্য তোমার উদরপূর্তি করছে, সেই দেশের এই ঋণ কীভাবে চোকাবে তুমি?

ইরতেনসেনু নিজের অন্তরের এই প্রশ্নের উত্তরে বলে, ‘এই পর্বত প্রমাণ ঋণ মেটানোর ক্ষমতা তো আমার নেই, কিন্তু এই দেশকে আমার জ্ঞাত যা কিছু তাই দেব আমি। নীলনদের মাটিতে বাস করে, সেই বায়ু সেবন করে, থীবসের গ্রন্থাগারে এবং আমার নিজের গবেষণাগারে বহু দিবারাত্রি কাটিয়ে যে জ্ঞান আমি আহরণ করেছি তাই দিয়ে এই দেশের সেবা করব আমি।’

সেই সুযোগও অচিরেই উপস্থিত হয়েছিল, যখন কোনও এক সন্ধায় বিশ্রাম করার সময়ে অগস্ত্য ইরতেনসেনুকে জানায় যে সে রাজা বসুমানকে কথা দিয়েছে পয়োষ্ণী নদীর গতিপথ বদলানোর চেষ্টা সে করবে। এমন এক ভাবনায় সেদিন ইরতেনসেনু অবাকই হয়েছিল। নদীর গতিপথ যে বদলে দেওয়া সম্ভব তা সে কখনও ভাবেনি। পূর্বে এমন কখনও ঘটেছে বলেও তার জানা নেই। সে বলেছিল, ‘বিজ্ঞানের পক্ষে অসম্ভব হয়তো কিছুই নয়, কিন্তু এমন দুরূহ কাজ করার বিদ্যা কি তোমার আয়ত্ত অগস্ত্য?’

‘না, এমন বিদ্যার কথা আমি নিজেও কখনও শুনিনি। তবে আমার ধারণা কাজটা আমি পারব। এ ব্যাপারে ভাবনা শুরু করি তিনবছর আগে। সেই সময় কিছু নকশাও এঁকেছিলাম। কিন্তু তারপর ব্যস্ত হয়ে পড়ি আমার অন্য যন্ত্রটির কাজে যার মধ্যে কৃত্রিম ভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। সেই কাজ করতে করতে আরও জ্ঞান আহরণের জন্য এই দেশ ত্যাগ করে হাজির হয়েছিলাম তোমার দেশে।

স্মিত হেসে ইরতেনসেনু বলল, ‘ভাগ্যিস এসেছিলে, সেই কলসটি না থাকলে আমার তৈরি আলোকযন্ত্রটিও কাজ করত না!’

‘হ্যাঁ! ভাগ্যিস আমি পৌঁছেছিলাম সেই দেশে, তা না হলে আজ এমন রূপে মহালক্ষ্মী, গুণে সরস্বতী নারীটিকেও আমার পত্নী রূপে পেতাম না!

এমনটি বলেই অগস্ত্য হেসে ফেলল, তার এই রসিকতায় ইরতেনসেও খিলখিল করে হাসতে লাগল। আরও ঘন হয়ে এল অগস্ত্যের কাছে। রানি কঙ্কাবতীর কাছে পুরাণের বহু গল্প শোনার কারণে দেবী মহালক্ষ্মী ও সরস্বতীর নাম তার অজ্ঞাত নয়। খানিক পরে সে বলল, ‘তাহলে বিজ্ঞানী মহাশয়, নকশা যখন তৈরিই আছে তখন কাজ শুরু করতে আর দেরি করা কেন?

নকশা অগস্ত্য সত্যিই তৈরি করে রেখেছিল। দুটি বাঁধের নকশা। বাঁধ দুটি তৈরি হবে শাল কাঠের গুঁড়ি দিয়ে। তবে বাঁধের আগে নদীর তীরে অজস্র দৈত্যাকৃতির পাথর বহন করে নিয়ে আসা প্রয়োজন। পয়োষ্ণী নদীর দু’তীর পাথুরেই, কিন্তু সেই নুড়ি আকারে ছোট। অগস্ত্য চায় বড় আকারের অজস্র প্রস্তরখণ্ডদের ধীরে ধীরে নদীর ডানদিকে জমা করতে। এতে প্রবাহে বাধা পেয়ে নদীর গতিপথ সংকীর্ণ হবে, এর কারণে নদীতে স্রোত আরও বেড়ে যাবে, সেই স্রোতের উপরে তৈরি করা হবে প্রথম বাঁধটিকে।

কিন্তু অগস্ত্যের কাজ শুরুর পিছনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল এই পাথরগুলি। বিন্ধ্য পর্বত থেকে হাতির দল দিয়ে টানিয়ে সেই শত সহস্র প্রস্তরখণ্ডগুলিকে সমতলে নামাতে সময় লেগেছিল প্রায় ছয় মাস। গজের দল পাথরগুলিকে নদী থেকে প্রায় দুশো হাত দূরে এনে ফেলতে সক্ষম হয়েছিল, বাকি পথ ছিল তাদের কাছে অগম্য। সেই পথ যে ছোট-বড় ডিম্বাকৃতি নুড়িতে ভরা। সেই নুড়িগুলি বড়ই আলগা। মানুষ চলতে সক্ষম হলেও বিশালাকৃতি হাতি তার উপর দিয়ে কোনও ভাবেই স্বচ্ছন্দে চলতে পারবে না। তাই তাদের দিয়ে টানিয়ে পাথরগুলিকে নদীতে এনে ফেলা ছিল একপ্রকার অসম্ভব।

হাতিগুলিকে সঠিক পথে চালনা করার জন্য এবং পিছন থেকে ঠেলা দেওয়ার জন্য শ্রমিকদেরও আসতে হতো। একটি হাতিরও অসাবধানতায় পা পিছলে গেলে মারাত্মক প্রাণহানির আশঙ্কা ছিল। মহাভাগ অগস্ত্যের এই মহান কর্মকাণ্ডে যোগ দিয়ে সহস্ৰ কর্মঠ যুবক নিজের শ্রম দান করছে স্বেচ্ছায়। তাদের অন্তরে হয়তো দেবানুগ্রহের সুপ্ত বাসনা রয়েছেই, তাই হয়তো তাদের প্রবৃত্ত করেছে এই কর্মে।

কিন্তু তাদের একজনেরও ক্ষতি অগস্ত্য মেনে নিতে পারবে না। বিজ্ঞানের জন্ম হয়েছে মানুষকে আরও উন্নত জীবন দেওয়ার জন্য, যদি তার অন্যথা হয় তবে তার অর্থ সেই বিজ্ঞান হয় যথেষ্ট কার্যকরী নয় অথবা তার অপব্যবহার হচ্ছে। নিশ্চয়ই এমন কোন উপায় আছে যার দ্বারা এই পাথরগুলিকে অপেক্ষাকৃত সহজে তাদের গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া যায়। সেই উপায় অগস্তের অজ্ঞাত।

তবে এই সমস্যা সমাধানের জন্য কিন্তু ইরতেনসেনুকে দু’দণ্ডও ভাবতে হয়নি। সে বলেছিল, ‘তোমার জ্ঞান কখনও কখনও আমার মনেও ঈর্ষা জাগায়। তোমার এক একটি আবিষ্কার এই দেশে তোমাকে প্রায় ঈশ্বরের সমান সম্মান এনে দিয়েছে। সেই আবিষ্কারগুলির জটিলতা সাধারণ মানুষের কাছে দুর্বোধ্য। কিন্তু এখন যে সমস্যায় তুমি পড়েছ আজ থেকে দু’হাজার বছর আগে সেই সমস্যার সমাধান করেছিল আমাদের দেশের মানুষ।’

এই কথোপকথনের কয়েকদিন পরে পয়োষ্ণী নদীর বুকে ভাসতে দেখা গেল দশটি বেশ বড় আকারের নৌকাকে। নৌকার খোল বোঝাই করে তারা নদীগর্ভের কাদামাটি নিয়ে এল। নদীর ডানদিকের পাড়ে কাঠ এবং বাঁশের তৈরি বেশ চওড়া পাটাতন তৈরি করা হল, সেই পাটাতনটি মাটি থেকে প্রায় পঞ্চাশ হাত উঁচুতে। পাটাতনের উপরিভাগ কয়েক হাত সমতল হওয়ার পর তা মাটির দিকে কৌণিক ভাবে নেমে এল এবং জমিয়ে রাখা বিশালাকৃতি পাথরগুলির কাছে এসে মাটি স্পর্শ করল। সেই দীর্ঘ ঢালু পাটাতনের উপরে চাপানো হল কাদামাটির প্রলেপ।

সেই মাটি শুকিয়ে গেলে এক মসৃণ তলের সৃষ্টি হল। এরপর তার উপর দিয়ে ভারী পাথরগুলিকে টেনে আনতে লাগল শ্রমিকের দল। তাদের পায়ে থাকা চর্ম-পাদুকার নীচে লাগানো হল ছোট ছোট পাথর কুচি। এর ফলে তাদের পক্ষে সেই মসৃণ ঢালু পথ আরোহণ করা অনেক সহজ হল। শ্রমিকের দল প্রতিদিন ঢালু পথ বেয়ে পাথর টেনে এনে পাটাতনের শেষ প্রান্ত থেকে নীচে বয়ে চলা নদীতে ফেলতে লাগল, সশব্দে নদীর বুকে আছড়ে পড়তে থাকল তারা। সেই আওয়াজ কখনও কখনও আশেপাশের ছোট ছোট পাহাড়গুলির গায়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ত চারপাশের গ্রামগুলিতে। গ্রামবাসীরা নিজেদের মধ্যে বলত, ওই শোনো, অগস্ত্য মুনির মহাকর্মযজ্ঞ চলছে।

এইভাবে নদীর এক অংশকে পাথর দিয়ে ভরিয়ে দিতে সময় লাগল একটি বছর। তারপর চলল নদীর উপরে বাঁধ তৈরির কাজ। সেই সঙ্গে কিছু শ্রমিক নদীর বামদিকের পাড় থেকে প্রায় দু’ক্রোশ দূরে একটি গভীর এবং চওড়া নালা খনন করে চলল, সেই স্থান বর্তমান নদীর পাড়ের মতো নুড়ি বিকীর্ণ নয়। পাথর ফেলে নদীর গতিপথ সঙ্কীর্ণ করে দেওয়ার জন্য যে তীব্র স্রোতের সৃষ্টি হল তার বিপরীতে শক্তপোক্ত বাঁধ দুটি তৈরি করতে সময় লাগল আরও দুটি বছর।

পনের দিন আগে সেই বাঁধ তৈরির কাজ সমাপ্ত হয়েছে। রাজ জ্যোতিষী শুক্লদেবের সঙ্গে পরামর্শ করে মকর সংক্রান্তির এই পুণ্য তিথিটিকে স্থির করা হয়েছে এক আশ্চর্য ঘটনার সাক্ষী হওয়ার জন্য।

বড় পবিত্র আজকের দিনটি। আজকের দিনে সূর্য উত্তরায়ণে যান, ছয় মাস রাত্রিবাসের পর দেবতাদের দিবাযাপন শুরু হয়। আবার আজকের দিনেই বিষ্ণুর বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ থেকে নির্গত গঙ্গা ভগীরথের পিছন পিছন কপিল মুনির আশ্রমে পৌঁছন। কপিল মুনির আশ্রম থেকে সাগরে মিশে যান তিনি। সে সময় গঙ্গা ভগীরথের পূর্বপুরুষ মহারাজ সগরের পুত্রদের মুক্তি প্রদান করেন। আজ কোন পুণ্য কাজ করলে তা অক্ষয় হয়, তাই আজকের দিনটিকেই বেছে নিয়েছিলেন রাজজ্যোতিষী শুক্লদেব। এখন সেই মুহূর্ত আগতপ্রায়।

মহর্ষি অগস্ত্য কি পারবেন পয়োষ্ণীর গতিপথ বদলে দিতে?

নদীর বাঁ-দিকের তটের কাছে অগস্ত্যকে দেখা যাচ্ছে ব্যস্তসমস্ত হয়ে পায়চারি করতে। শেষ বারের মতো সব কিছুর তদারকি করে নিচ্ছে সে। ইরতেনসেনু আছে নদীর অপর প্রান্তে। একটি অশ্বের পিঠে উঠে সে ছুটে চলেছে নদীর তীর বরাবর, সেই প্রান্তের কাজ দেখে নিচ্ছে। একসময় ইরতেনসেনু থামল, তারপর ঘোড়াটিকে ঘুরিয়ে আবার পিছনের দিকে এল যেখানে বাঁধ দুটি নির্মিত হয়েছে। কোনও এক অলৌকিক জাদুবলে বাঁধ দুটি তৈরি করেছেন অগস্ত্য। দুটি বাঁধ পরস্পরের সঙ্গে কৌণিকভাবে অবস্থিত।

ইরতেনসেনু আর একবার দেখে নিল নদীর উপরে থাকা বাঁধটিকে, সেটি এখন নদীর উপরিভাগ থেকে কিছু হাত উপরে ঝুলছে। এই কাজটি সম্ভব হয়েছে এক আশ্চর্য যন্ত্রের জন্য। যন্ত্রটি অগস্ত্য এবং ইরতেনসের যুগ্ম মেধার ফল। কুড়িটি ভারী এবং মোটা দড়ি বাঁধের উপরের প্রান্তে বাঁধা। সেই দড়িগুলি এসে মিশেছে দশটি দড়িতে, সেই দশটি দড়ি এসে মিশেছে পাঁচটি দড়ির সঙ্গে। এই পাঁচটি দড়ি উপরের দিকে উঠে গেছে, তারপর মাটি থেকে প্রায় শতহস্ত উপরে একটি কাঠের তৈরি মিনারের উপরে থাকা গোলাকৃতি একটি যন্ত্রের গা বেয়ে উঠে এসে আবার নীচের দিকে নেমে এসেছে তারা। দড়িগুলির এই প্রান্তগুলিকে টেনে মাটির গভীরে গেঁথে রাখা বলিষ্ট লৌহকীলকের গায়ে বেঁধে রাখা হয়েছে।

অন্য বাঁধটি রয়েছে নদীর বাঁ-পাশের তীরের উপরে। একটি গভীর খাদ নির্মাণ করে তার উপরে প্রোথিত করা হয়েছে এই বাঁধটিকে। শ্রমিকরা যে চওড়া নালাটি খনন করছিল তা শেষ হয়েছে এই বাঁধটির ঠিক পিছনে এসে। অগস্ত্য দাঁড়িয়ে রয়েছে এই প্রান্তে। ইরতেনসেনু তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পদাতিক সৈন্যটিকে চোখের ইশারা করল। সৈন্যটি তার হাতে ধরা শিঙায় ফুঁ দিল এবারে। রণক্ষেত্রে শত্রুর উপরে আক্রমণের আগে এই শিঙা বাজানোর রীতি, তবে আজ তাকে ব্যবহার করা হচ্ছে ধ্বংসের জন্য নয়, বরং এক নতুন সৃষ্টিকে ঘোষণা করার জন্য।

আশেপাশের ছোট পাহাড়ের গায়ে যে সহস্র মানুষ আজ এসে জড়ো হয়েছে তাদের প্রত্যেকের কানে গিয়ে পৌঁছল এই শিঙার আওয়াজ। এতক্ষণ অপেক্ষা করার পরে যারা সামান্য অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল তারাও এবার স্নায়ু টানটান করে তাকিয়ে রইল বাঁধের দিকে।

শিঙার আওয়াজ কানে পৌঁছতেই অগস্ত্য পিছনে ফিরে তার সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা শ্রমিকটিকে বলল, ‘প্রস্তুত থাকো।’

নদীর অন্য প্রান্তে এবার ইরতেনসেনুর নির্দেশে লৌহকীলক থেকে দড়িগুলিকে খুলে ধীরে ধীরে নদীর উপরে বাঁধটিকে নামাতে লাগল শ্রমিকেরা। প্রবল গুরুগুরু শব্দ করে বাঁধটি নদীর বুকে প্রোথিত হল। গতিপথ আচমকাই রূদ্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে নদী যেন ভীষণই ক্রুদ্ধ। ইরতেনসেনু দেখল নদীর স্রোত তীব্রবেগে আছড়ে পড়ল বাঁধের গায়ে। সেই স্রোত প্রবল আক্রোশে ভেঙে চুর্ণ বিচূর্ণ করে ফেলতে চাইল বাঁধটিকে।

সামান্য যেন নড়ে উঠছে বাঁধটি, কিন্তু মহাশালের গুঁড়ি দিয়ে এমনই অদ্ভূত কারিগরী দক্ষতায় বানানো বাঁধটি যে নদীর বারংবার মুষ্টাঘাতেও তার গায়ে সামান্যতম চিড়ও ধরছে না। নদীর ধর্ম এই যে সে সদাপ্রবাহমান থাকতে চায়, বাধা পেয়েই সে খুঁজে নিতে লাগল অন্য একটি পথ। নিমেষে নদীর জল কুল ছাপিয়ে প্রবল বেগে আছড়ে পড়ল পাশে কোনাকুনি ভাবে দাঁড় করিয়ে রাখা অন্য বাঁধটির উপরে। যেন এক বন্দি দৈত্য ভয়ঙ্কর আষ্ফালনে আঘাত করছে কারাগারের দেওয়ালে। তার আওয়াজে মাটি কেঁপে উঠল। অগস্ত্য এইবার বলল, ‘এখনই সময়! শুরু করো!’

প্রথম বাঁধটির মতো দ্বিতীয় বাঁধটির উপরের অংশেও একই রকম ভাবে দড়ি বাঁধা। সেই দড়িগুলিও নদীর বাঁ-পাশের একটি মিনারের উপরে রাখা যন্ত্রের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। দড়িগুলির অন্য প্রান্ত বাঁধা আছে পাঁচটি গজের গায়ে। ইন্দ্রের বাহন ঐরাবতের মতো তাদের আকার। তাদের পিঠের উপরে বসে থাকা মাহুতের ইশারায় তারা এবারে নদীর বামপাড় থেকে উল্লম্ব কোণে হাঁটতে লাগল। প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে থাকা বাঁধটি এবার যেন সদ্য ঘুম ভাঙা দানবের মতো নড়ে উঠল, তারপর ধীরে ধীরে উপরের দিকে উঠতে থাকল।

অগস্ত্য ইতিমধ্যে মিনারের চূড়ায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। এখান থেকে ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করা যাবে। সামান্য ফাঁক পেতেই পয়োষ্ণী নদী তীব্রবেগে সামনের দিকে বইতে শুরু করল। নদীর স্রোত বাঁধ আর ভূমির ফাঁক দিয়ে এসে পড়ল আগে থেকে তৈরি করে রাখা সেই গভীর এবং প্রশস্ত নালাতে। প্রবল জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে গুমগুম শব্দ করে নতুন খাতে বইতে লাগল পয়োষ্ণী।

তখনই এমন এক ঘটনা ঘটল যার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না। নালাটিকে বেশ চওড়া করেই কাটা হয়েছিল। তবু নদীর স্রোত সেই নালা ছাপিয়ে বইতে শুরু করল। অগস্ত্য যে মিনারের উপরে দাঁড়িয়ে ছিল তা নতুন প্রস্তুত নালাটি থেকে মাত্র কয়েক হাত দূরে। সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই এক বিশাল ঢেউ এসে আছড়ে পড়ল মিনারের উপরে। সঙ্গে সঙ্গে দুর্বল শনের কাঠির মতো টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ল মিনারটি! মিনারের চূড়া অগস্ত্যকে নিয়েই প্রকাণ্ড শব্দ করে এসে পড়ল স্রোতস্বিনী নদীর উপরে। অপর

প্রান্তে দাঁড়িয়ে হতবাক হয়ে ঘটনাটি দেখছিল ইরতেনসেনু। সে ভয়ে বিহ্বল হয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘অগস্ত্য!’

ইরতেনসেনুর গলার আওয়াজ নদীর প্রবল গর্জনে মিলিয়ে গেল। সে কি তবে তার গতিপথ রুদ্ধ করার প্রতিশোধ নিতে চায় পয়োঞ্চী? দূরে দাঁড়িয়ে থাকা জনগন বিস্মিত চোখে হাহাকার করে উঠল। আকাশের দিকে তাকিয়ে কাতর আকুতি জানাতে লাগল তারা, ‘হে ঈশ্বর! মহর্ষি অগস্ত্যকে রক্ষা করুন!

এই আকস্মিক কাণ্ডের বিহ্বলতার মধ্যে একটি ঘটনা সবার চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল। মিনারের চূড়াটি নদীতে পড়ে যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই এক যুবক ঝাঁপ দিয়েছিল নদীর জলে। প্রবল স্রোতের মধ্যেও যেন অতি অবলীলায় সাঁতরে চলল যুবকটি। কয়েক পলের মধ্যেই দেখা গেল তাকে, সাঁতার কেটে নদীর পাড়ের দিকে এগিয়ে আসছে সে। নদীর তীরে এসে যখন সে উঠে দাঁড়াল তখন তার কোলে অচৈতন্য অবস্থায় অগস্ত্য। চিৎকার করে সে বলল, ‘রাজবৈদ্যকে খবর দাও! শীঘ্র!’

বলেই সে অগস্ত্যকে মাটিতে শুইয়ে দু’হাতের তালু দিয়ে তার বুকে ক্রমাগত চাপ দিতে লাগল। কয়েকবার চাপ দিয়েই সে নিজের মুখ অগস্ত্যের মুখে লাগিয়ে শ্বাস দিতে লাগল, তারপর আবার বুকে চাপ দিতে লাগল, তারপর আবার শ্বাস…এইভাবে কয়েক বার করার পর হঠাৎই অগস্ত্যর নাক মুখ দিয়ে অনেকটা জল বেরিয়ে এল। পরক্ষণে ধড়ফড় করে উঠে বসল সে। সামনে বসে থাকা যুবকটিকে দেখে সে বলল, ‘উপল।’

ততক্ষণে তাদের চারপাশে ভিড় জমে গেছে। এবার উপলের দিকে নজর গেল জনতার। উপলের বয়স অগস্ত্যের মতো। তবে তার চেহারা অগস্ত্যের প্রায় দ্বিগুণ। সে উচ্চতায় সাড়ে তিন হাত লম্বা, তার কাঁধ এতটাই চওড়া যে অনায়াসে দু’জন পূর্ণ বয়স্ক পুরুষ বসতে পারবে দু’কাঁধে। কাঁধ থেকে নীচের দিকে নেমে এসেছে সুসংহত পেশিবহুল শরীর। তার ঊর্ধ্বাঙ্গ পাতলা জামায় আবৃত ছিল, জলে ভিজে সেই জামা গায়ের সঙ্গে যেন মিশে গেছে। গায়ের রং অগস্ত্যরই মতো, সোনালি ধানের বর্ণ। অগস্ত্য অবাক চোখে উপলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি কবে এলে?’

‘ফিরেছি দু’দিন আগে, বন্দরে নেমেই শুনলাম ঋষিরাজ অগস্ত্য নাকি অদ্ভুত এক কাণ্ড ঘটাতে চলেছেন পয়োষ্ণী নদীর তীরে। কী সেই কাণ্ড তা আর বুঝতে বাকি ছিল না। দু’জনে কত প্রহর কাটিয়েছি এই আলোচনায়। তাই এক দ্রুতগামী অশ্ব নিয়ে চলে এলাম চাক্ষুস দেখার জন্য। এসে দেখি তুমি ব্যস্ত, তাই তোমাকে আর বিরক্ত না করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ভেবেছিলাম কার্য সমাধা হতেই তোমাকে জড়িয়ে ধরব, তা যে এই ভাবে হবার সে কী আর তখন বুঝতে পেরেছিলাম!

এবার দুই বন্ধু হো-হো করে হেসে উঠল। উপল আবার বলল, ‘তোমার স্বপ্ন সত্যি হয়েছে অগস্ত্য, চেয়ে দেখ!’

সত্যিই পরপর এতগুলি ঘটনার মধ্যে যেন ক্ষনিকের জন্য অগস্ত্য ভুলতে বসেছিল তার এখানে এই অবস্থায় থাকার কারণটিকেই। প্রবল জলোচ্ছ্বাসে মিনারটি ভেঙে গেল, তারপরই জ্ঞান হারায় সে। তারপর কী হল? পয়োষ্ণী কি সব কিছুকে তছনছ করে দিল? কিন্তু সেই ভয়ঙ্কর আওয়াজ তো আর শোনা যাচ্ছে না। অগস্ত্যের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষেরা এখন তারই নামে জয়ধ্বনি করছে, তাদের মধ্যেও তো কোন প্রকার বিরূপতা চোখে পড়ছে না।

ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেল অগস্ত্য। যা দেখল তাতে তার চিত্ত এক অনির্বচনীয় আনন্দে ভরে উঠল। তার সামনেই কুলুকুলু ধ্বনিতে নতুন খাতে প্রবাহিত হচ্ছে পয়োষ্ণী! অগস্ত্য পেরেছে নদীকে মানুষের কাছে আনতে! বিদর্ভবাসীদের জলকষ্ট এবার চিরতরের জন্য মিটে যাবে! নদীগাত্রে একটি নৌকাকে দেখতে পেল অগস্ত্য। দ্রুত দাঁড় বেয়ে সেই নৌকা তার দিকেই এগিয়ে আসছে।

নৌকার উপরে দাঁড়িয়ে রয়েছে ইরতেনসেনু। এতদূর থেকে তার মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না বটে, কিন্তু সে নিশ্চয়ই চিন্তিত। অগস্ত্যকে পড়ে যেতে দেখেই সে এই পাড়ে আসতে শুরু করেছে। সে কি এখন অগস্ত্যকে দেখতে পেয়েছে? অগস্ত্য দু’হাত মাথার উপরে আন্দোলিত করে ইরতেনসেনুর দৃষ্টি আকর্ষণ করল। সঙ্গে সঙ্গে ইরতেনসেও তার ডানহাত নাড়াল। অগস্ত্য মুখের দু’পাশে দুই তালু নিয়ে এসে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে চিৎকার করে বলল, ‘আমরা পেরেছি ইরতে….!’

নাহ, ক্ষনিকের জন্য নিজের পারিপার্শ্বকে ভুলে যাচ্ছিল সে। হাজার জোড়া চোখ এখন তাকে দেখছে। নিজেকে মুহূর্তে সামলে নিয়ে আবার চিৎকার করে অগস্ত্য বলল, ‘আমরা পেরেছি লোপামুদ্রা! আমরা পেরেছি!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *