বুড়ো বোকার মতো আর কোন বোকা হয় না। হুকুম চাঁদের মনে এ কথা বার বার উদিত হতে লাগল। এ কথা যেন মনে না আসে, তার চেষ্টা করলেন, ভুলে থাকতে চাইলেন ঐ কথা। কিন্তু বার বার তাঁর মনে ঐ একই কথা উদয় হলো, বুড়ো বোকার মতো আর কোন বোকা হয় না। পঞ্চাশ বছরের একজন বিবাহিত লোকের পক্ষে মহিলা সংগ্রহ করে রাত কাটানো খারাপ এবং খুবই খারাপ কাজ। মেয়ের সমান বয়সী একটা মেয়ের সাথে আবেগপ্রবণ হয়ে জড়িয়ে পড়া মোটেই ঠিক হয়নি তাঁর। মেয়েটি আবার মুসলমান দেহপসারিণী। এটা সত্যি হাস্যকর। সব কিছুর ওপর তাঁর কর্তৃত্ব লোপ পাচ্ছে। তিনি বৃদ্ধ ও বোকা হয়ে পড়েছেন।
যে পরিকল্পনা সকালের দিকে তাঁর মনে আনন্দ দিয়েছিল, এখন তা উবে গেছে। আনন্দের পরিবর্তে তাঁর মনে দেখা দিয়েছে উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তা। তিনি যে বুড়ো হয়েছেন, এ কথাও তাঁকে ভাবিয়ে তুলছে বার বার। বদমায়েশ বেটা আর সমাজকর্মীকে তিনি ছেড়ে দিয়েছেন তাদের সম্পর্কে বিশেষ কিছু না জেনেই। তাঁর মতো সম্ভবত ওদেরও কোন ক্ষমতা নেই। বামপন্থী কতিপয় সমাজকর্ম অবশ্য অতিসাহসী ও দুৰ্দমনীয় বলে পরিচিত। কিন্তু যে সমাজকৰ্মীকে তিনি ছেড়ে দিলেন, তিনি একজন বুদ্ধিজীবী। এ ধরনের লোককে অবজ্ঞাভরে বলা হয় আরাম কেদারায় বসা বুদ্ধিজীবী। তিনি কর্তব্য পালনে ব্যর্থতার জন্য অন্যকে সমালোচনা ছাড়া সম্ভবত নিজে কিছুই করবেন না। বদমায়েশটা অবশ্য এক কুখ্যাত ডানপিটে। ট্রেন ডাকাতি, গাড়ি থামিয়ে লুঠ, ডাকাতি, খুন-সব কাজেই সে দক্ষ। হয় প্রতিশোধ আর না হয় টাকা, এ দু’টোই তার উদ্দেশ্য। সে যদি মাল্লির সাথে বোঝাপড়া করতে চায়, তাহলে একটা সম্ভাবনা আছে। জুগ্গার উপস্থিতির কথা শুনে মাল্লি যদি পালিয়ে যায়, তাহলে জুগ্গা হয়ত আগ্রহ হারিয়ে ফেলে ঐ দলে যোগ দেবে, হত্যা-লুঠপাটে মেতে উঠবে। কোন মেয়ের জন্য এ ধরনের লোক জীবনকে বাজি ধরে না। নূরান মারা গেলে সে অন্য মেয়ের কাছে যাবে।
হুকুম চাঁদ নিজের ভূমিকায়ও সন্তুষ্ট ছিলেন না। নিজের কাজ অন্যের ওপর চাপিয়ে দেয়াই কি যথেষ্ট? আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখা ম্যাজিস্ট্রেটদের দায়িত্ব। কিন্তু তাঁরা শৃঙ্খলা নিশ্চিত করেন তাঁদের পিছনে যে ক্ষমতা থাকে তার বলে, ঐ ক্ষমতার বিরোধিতা করে নয়। কিন্তু ক্ষমতা কোথায়? দিল্লীতে যে সব লোক আছে, তারা কি করছে? সংসদে সুন্দর সুন্দর ভাষণ দিচ্ছে! লাউড স্পীকারে তাদের অহংবোধ জোরে প্রকাশ করছে। দর্শক গ্যালারিতে আকর্ষণীয় মহিলারা তাদের ভাষণের তারিফ করছে। একজন মহান ব্যক্তি তোমাদের লোক মিঃ নেহেরু। আমার মনে হয়, আজকের বিশ্বে তিনি একজন বিরাট ব্যক্তিত্ত্ব। দেখতে কি সুন্দর। এখন কি সেই বিস্ময়কর অভিজ্ঞতার কথা বলার সময় হয়নি। অনেকদিন আগে আমরা ভাগ্যক্রমে মিলিত হয়েছিলাম পুরোপুরি নয়, আংশিকভাবে। হ্যাঁ, মিঃ প্রধান মন্ত্রী, আপনি মিলিত হয়েছিলেন। যেমন মিলিত হয়েছিল আরও অনেকে।
হুকুম চাঁদের বন্ধু প্ৰেম সিং লাহোর গিয়েছিল তার স্ত্রীর গয়নাপত্ৰ ফিরিয়ে আনতে। সেখানে সে মিলিত হয়েছিল ফলেট হোটেলে। এই হোটেলে ইউরোপীয় সাহেবরা একে অন্যের বউ নিয়ে প্রমোদে মত্ত হয়। এই হোটেলের পাশেই পাঞ্জাব এ্যাসেম্বলি বিল্ডিং। এখানে পাকিস্তানের সাংসদরা গণতন্ত্রের কথা বলে, আইন প্রণয়ন করে। প্ৰেম সিং হোটেলে বসে বিয়ার পান করে সময় কাটোত আর হোটেলে অবস্থানরত ইউরোপীয়দের বিয়ার পান করার আমন্ত্রণ জানাত। ওদিকে তার নিজের বাড়িতে তার জন্য অপেক্ষা করত। ফেজ টুপি ও পাঠান পাগড়ি পরিহিত ডজনখানেক লোক। সে বেশি পরিমাণ বিয়ার পান করে তার ইংরেজ বন্ধু ও অর্কেস্ট্রার লোকদের বিয়ার পান করার আমন্ত্রণ জানাত। নিজ গৃহে যাদের সে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল তারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত। তার ইংরেজ বন্ধুরা মাত্রাতিরিক্ত বিয়ার ও হুইস্কি পান করে প্ৰেম সিংকে মহৎ ব্যক্তি হিসাবে আখ্যায়িত করেছে। নৈশ আহারের জন্য দেরি হচ্ছে দেখে তারা বলেছে, শুভ রাত্রি মিঃ… আপনার নামটা মনে করতে পারছি না। হ্যাঁ, মনে পড়েছে। মি. সিং। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। মি. সিং, আবার দেখা হবে। খাবার রুমে গিয়ে তারা বলেছে, লোকটি ভাল। বৃদ্ধ হলেও ক্ষমতা আছে। এখনও মদ পান করছে। এমন কি বাদ্য দলের লোেকরাও আগের চেয়ে অনেক বিয়ার পেয়েছে। আপনি আর কি শুনতে চান স্যার, গোয়ার ব্যান্ড মাস্টার মেনডোজা তার কাছে জানতে চেয়েছে। অনেক রাত হয়েছে, আমরা এখন বন্ধ করতে চাই। ইউরোপীয় কোন সঙ্গীত সম্পর্কে প্ৰেম সিং কিছু জানে না। বিপদে পড়ে সে। তার মনে হলো, একজন ইংরেজকে সে বলতে শুনেছে ব্যানা নাজ-এর মতো শব্দ। তাই সে বলল। মেনডোজা ডি-মেলো, ডি-সিলভা, ডি-সারাম ও গোমেজ বানানাজ-এর সুর তুলল। তাদের যন্ত্রে। প্ৰেম সিং লন অতিক্রম করে গেটের দিকে গেল। ব্যান্ড দল দেখল, প্রেম সিং চলে গেছে। তারা গড় সেভ দি কিং-এর সুর তুলল।
হুকুম চাঁদের পিয়নের মেয়ে সুন্দরী। নিয়তি তাকে নিয়ে গেল। গুজরানওয়ালা যাওয়ার রাস্তায় মিলনের জন্য। চারদিন আগে তার বিয়ে হয়েছে। দু’হাত ভর্তি লাল সোনালী চুড়ি। হাতের তালুতে মেহেদি রং। মনসা রামের সাথে রাত কাটাবার সুযোগও তার হয়নি। তাদের আত্মীয়স্বজন তাদের এক মিনিটের জন্যও একা থাকতে দেয়নি। ঘোমটার ফাঁক দিয়ে স্বামীর মুখখানাও সে ভাল করে দেখতে পায়নি। নতুন বউকে সাথে করে রাম ওজরানওয়ালা যাবে। ওখানে সে পিয়নের চাকরি করে। সেশন কোট এলাকায় তার নিজস্ব একটা কামরা আছে। ওখানে তার কোন আত্মীয়স্বজন নেই। বউকে সে ওখানে নিজের করেই পাবে। তাকে খুব উৎসাহী মনে হলো না। বাসে বসে সে অন্য যাত্রীদের সাথে খোশ-মেজাজে আলাপ করতে শুরু করল। তার আগে আলাপে অনেকে উদাসীনতা দেখাল। কেউ কেউ সত্যি সত্যি বিশ্বাস করল না যে, বিবাহিত মহিলাটি তার স্বামীর প্রতি অনুরক্ত। ঘোমটা মুখে মহিলাটি বসে আছে, তো আছেই। স্বামীর দিকে ফিরে একটা কথাও বলছে না! হাত থেকে সোনালী চুড়ি একটাও খুলবে না। এতে অকল্যাণ হয়, তার বান্ধবীরা তাকে বলেছিল। বাসর রাতে তোমার স্বামী যখন তোমার সাথে মিলিত হবে তখন তার দ্বারাই যেন ওগুলো ভেঙ্গে যায়।
প্রতি হাতেই প্রায় ডজনখানেক চুড়ি, কাবুজি থেকে কনূই পর্যন্ত বিস্তৃত। হাতের আঙ্গুল দিয়ে একবার সে নাড়াচাড়া করে দেখল। চুড়িগুলো শক্ত কিন্তু ভঙ্গুর। এগুলো ভাঙতে রামকে বেশ জোরে জড়াজড়ি করতে হবে এবং কিছুটা নিষ্ঠুরও হতে হবে। হঠাৎ করে মেয়েটির দিবাস্বপ্ন ভেঙ্গে গেল। চলন্ত বাস থেমে গেল। রাস্তার ওপর বড় পাথর। প্রায় হাজার খানেক লোক তাদের ঘিরে ধরল। প্রত্যেককে বাস থেকে নেমে যেতে বলা হলো। শিখদের কেটে ফেলা হলো। দাড়ি কামানো লোকদের কাপড় খুলে দেখা হলো। সুন্নত দেয়া লোকদের ছেড়ে দেয়া হলো, যাদের সুন্নত করা ছিল না তাদের সুন্নত করানো হলো। শুধু লিঙ্গের অগ্রভাগের চামড়া নয় পুরো লিঙ্গটাই কেটে ফেলা হলো। যে মনসা রামের দিকে তার স্ত্রী ভাল করে তাকাচ্ছিল না, সেই মনসা রামকে তার স্ত্রীর সামনে উলঙ্গ করা হলো। কয়েকজন লোক তার হাত-পা ধরে রাখল, আর একজন লোক তার লিঙ্গ কেটে কর্তিত অংশ তার স্ত্রীকে দিল। উন্মত্ত লোকগুলো রামের স্ত্রীর ইজ্জত লুঠ করল। হাতের চুড়ি তাকে নিজে খুলতে হলো না। রাস্তার ওপর পড়ে থাকা অবস্থায় সব চুড়ি ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। সম্ভবত ঐ চুড়িই তার জন্য সৌভাগ্য বয়ে এনেছিল।
সুন্দর সিং-এর কাহিনী অবশ্য অন্য ধরনের। হুকুম চাঁদ তাকে সেনাবাহিনীর জন্য সংগ্রহ করেছিলেন। সে ভাল কাজ করেছিল। বৰ্মা, ইরিত্রিয়া ও ইতালিতে সাহসের সাথে যুদ্ধ করার জন্য সে খুবই নাম করে এবং বহু মেডেল পায়। সিন্ধুতে সরকার তাকে জমি প্রদান করে। ট্রেনের মধ্যেই সে চরম অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে। তার সাথে তার স্ত্রী ও তিন ছেলেমেয়ে ছিল। ৪০ জন বসার এবং ১২জন ঘুমাবার কামরায় পাঁচ শর বেশি পুরুষ, মহিলা ও শিশু ওঠে। কামরায় ছোট একটা প্রক্ষালন কক্ষ। সিস্টার্নেও পানি নেই। কামরার মধ্যে তাপমাত্রা ১১৫ ডিগ্ৰী। বাইরে আরও বেশি। নিশ্চয়ই। আশপাশে কোন গাছপালা নেই। দেখা যায় শুধু সূৰ্য আর বালি. পানি নেই কোথাও। প্রতিটি স্টেশনেই রেলিংয়ের ধারে বর্শা হাতে লোক দাঁড়িয়ে। এরপর একটা স্টেশনে এসে ট্রেন থেমে গেল। চারদিন ঐভাবেই রইল। কাউকে বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয় না। সুন্দর সিং-এর ছেলেমেয়েরা খাদ্য ও পানির জন্য চিৎকার করল। অন্যরাও খাদ্য ও পানির আশায় আর্তচিৎকার করল। সুন্দর সিং নিজের প্রস্রাব ছেলে-মেয়েদের পান করাল। কিন্তু তারপর …। সে তার রিভলবার বের করে সন্তানদের গুলি করে হত্যা করল। সাঙ্গারা সিং-এর বয়স ছয়। তার মাথার লম্বা চুল দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হলো। চার বছরের শিশু দীপুর চোখ উল্টে গেল। চার মাসের শিশু আমারো তার মায়ের শুকনো বুকে কিছু দুধ পাওয়ার আশায় চিৎকার করছিল। চিৎকারে তার মুখে রক্তবিন্দু ফুটে উঠল। সুন্দর সিং তার স্ত্রীকেও রেহাই দিল একটা গুলি ছুড়ে। এরপর সে পাগলপ্রায় হয়ে গেল। সে তার নিজের মাথায় রিভলবার ধরল। কিন্তু গুলি ছুডুল না। নিজেকে হত্যা করার কোন অর্থ হয় না। ট্রেনটি আবার যাত্রা শুরু করল। স্ত্রী ও সন্তানদের মৃতদেহ জড়িয়ে সে পড়ে রইল। এভাবেই সে চলে এলো ভারতে। সে তার প্রতিজ্ঞা পালন করেনি। তার পরিবারের সদস্যরাই জীবন দিয়ে মুক্ত হয়েছে।
হুকুম চাঁদের মনে হলো তিনি সত্যি দুঃখী। রাত ঘনিয়ে এলো। নদীর দিক থেকে ব্যাঙের ডাক শোনা গেল। বারান্দার পাশে জেসমিন ফুল গাছের ঝোপে জোনাকিরা মিট মিট করে আলো জ্বালালো। হুকুম চাঁদের জন্য বেয়ারা হুইস্কি এনেছিল। কিন্তু তিনি তাকে ফিরিয়ে দিলেন। বেয়ারা তাঁর জন্য রাতের খাবার দিল। কিন্তু তিনি কিছুই খেলেন না। ঘরে রাখা হারিকেন তিনি সরিয়ে নিতে বললেন। অন্ধকারে বসে তিনি অনন্ত আকাশের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।
কেন তিনি মেয়েটিকে চন্দননগর ফেরত পাঠালেন? মুষ্টিবদ্ধ হাত দিয়ে কপালে আঘাত করে তিনি নিজেকেই প্রশ্ন করলেন, কেন? সে যদি রেষ্ট হাউসে তাঁর সাথে থাকত, তাহলে বাকি পৃথিবী ধ্বংস হচ্ছে কি না তা তিনি চিন্তাও করতেন না। কিন্তু সে এখানে নেই, সে আছে ট্রেনে। ট্রেনের শব্দ শুনতে পেলেন হুকুম চাঁদ।
হুকুম চাঁদ চেয়ারের এক পাশে সরে বসলেন দু’হাত দিয়ে মুখ ঢেকে নিঃশব্দে কাঁদলেন কিছুক্ষণ। তারপর মাথা উঁচু করে আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রার্থনা শুরু করলেন।